ধুলোবালির জীবন – ২

বিধানের চোখমুখ সেদিন বলে দিয়েছিল, সে দেখেছে। তার চোখে গভীর বিস্ময়। বাথরুমে ঢুকে জামা–‌কাপড় খুলে গায়ে জল ঢালতে-ঢালতে মন স্থির করেছিল শ্রীজিতা। বিধান যদি কিছু দেখে থাকে, ভালই হয়েছে। স্ত্রীকে সে চিনুক। অফিস থেকে বড় অঙ্কের বেতন নিয়ে ঘরে আসছে, সেই টাকায় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া সংসার চনমনে হচ্ছে, শুধু এইটুকু জানলেই হবে? তা ছাড়া গত কয়েকটা বছর তো তারা নামেই স্বামী–স্ত্রী। না শরীর, না মন, কিছুরই যোগাযোগ নেই। তোয়ার জন্মের আগেও তাই ছিল। এই চাকরি পাওয়ার পর বিধান গাঁইগুঁই করেছিল।

“কতক্ষণের ডিউটি?”

শ্রীজিতা গম্ভীর হয়ে বলেছিল, “চব্বিশ ঘণ্টার বেশিও‌ হতে পারে।”

বিধান চিন্তিত গলায়, “এতটা সময় ‌কাজ করতে হবে!‌”

শ্রীজিতা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “দুনিয়ার সব অফিস তোমার অফিসের মতো হবে, এমনটা ভাবছ কেন? পান‌–বিড়ি খেয়ে আর হাসি-ঠাট্টা করে মাইনে নিয়ে বাড়ি ফিরবে?”

“তা বলিনি। কিন্তু এতটা সময় বাড়ির বাইরে দিতে পারবে?”

“না, পারব না। কলেজ ইউনিভার্সিটির মার্কশিটগুলো ছিঁড়ে ফেলে বাড়িতে মেয়ের আয়ার কাজ করতে পারব। বরের দু’ পয়সার চাকরির জন্য সকালে উঠে টিফিন বানাতে পারব। রাতে বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে পারব।”

বিধান গলা নামিয়ে বলেছিল, “মেয়েটা তো ছোট। স্কুলের কাজটাই তো ভাল ছিল, দুপুরের আগে ফিরে আসতে।”

শ্রীজিতা বলেছিল, “মেয়ে আমার একার নয়। আর মেয়ে যখন ছোট, তুমি চাকরি ছেড়ে বাড়িতে বসে তাকে দেখলেই পারো। কী এমন মাইনে পাও? বিয়ের পর এতগুলো বছর কেটে গেল, প্রোমোশনও তো জোটেনি একটা।” এরপর চোয়াল কঠিন করে বলেছিল, “বিধান, ভাল করে শুনে রাখো, স্কুলের নরককুণ্ডে আমি আর ফিরছি না। ফিরব না অভাবের জীবনে। আমার যা লেখাপড়া, বুদ্ধি তাতে বড় কোনও কাজ করাটাই আমাকে মানায়। এতদিন চান্স পাইনি। এখন পেলাম। এই ধরনের একটা কাজের জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম। শুধু রোজগার নয়, কাজটার মধ্যে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে। কল্পনাশক্তি ব্যবহারের সুযোগ আছে। ঠিকমতো করতে পারলে অনেকদূর যেতে পারব। ‌আমাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।”

ঠেকাতে পারেনি কেউ। শ্রীজিতা কাজের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল খুব দ্রুত। শাহির পাশে বসে কাজ শিখেছে।

দূরত্ব ছিলই। নির্ঝর মল্লিকের ঘটনাটার পর বিধানের সঙ্গে শ্রীজিতার দূরত্ব আরও অনেকটা বেড়ে যায়। ঘটনা যদিও আহামরি কিছু নয়। আজকের সময়ের জন্য তো নয়ই। পরে শ্রীজিতা এর চেয়ে অনেক বড় ঘটনায় মেতেছে। তবু সেদিনের পরিস্থিতি, পরিবেশের জন্য সেটা গুরুতর ছিল। বিধানের মতো স্বামীর পক্ষে বড় ধাক্কা। ঘটনাটা ঘটেছিল আড়াই বছর আগে।

শ্রীজিতা আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে। কারণ, আজ একটা বিশেষ দিন। তোয়ার জন্মদিন। তোয়া আট বছরে পা দিল। শ্রীজিতা গত শনিবার অফিস থেকে নিউ মার্কেট গিয়েছিল। তোয়ার ক্লাসের বন্ধুদের জন্য রিটার্ন গিফট কিনে এনেছে। রং-পেনসিল, চকোলেট, পুতুল। ছোট-ছোট কাগজের থলিতে সেগুলো ভরা হয়েছে। মিনু আর তোয়া ভরেছে।

খাট থেকে নেমে শ্রীজিতা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিল। তোয়ার জন্য সে যে গিফটের ব্যবস্থা করছে, তাতে ফাইনাল টাচ দিতে হবে। কাল রাতে তোয়া ঘুমিয়ে পড়লে সে আর মিনু দু’জনে মিলে অনেকটা করে রেখেছে। বিছানার চাদর, জানলার পরদা, টেবল ক্লথ, বড় টেবল ল্যাম্প, সবই কেনা ছিল। আর ছিল দেওয়ালে, দরজায় লাগানোর জন্য বড়-বড় স্টিকার। স্টিকারে ফেয়ারি টেলসের ছবি। রাতে ঘণ্টাদেড়েকের মধ্যে সেসব সাজানোর কাজ শেষ করা গিয়েছে। তোয়া কিছুই জানে না। আজ তাকে সারপ্রাইজ় দেওয়া হবে। আলমারি থেকে কতগুলো সফট্‌ টয়েজ় বের করল শ্রীজিতা। অনলাইনে একটা বইয়ের তাকের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। দু’–একদিনের মধ্যে চলে আসবে।

ফ্ল্যাটের দক্ষিণে যে ছোট ঘরটা আছে, সেটা পরিষ্কারের কাজ ক’দিন ধরেই চলছিল। তোয়া কাল স্কুলে গেলে নতুন খাট, ফ্যান্সি স্টাডি টেবিল, ছোট চেয়ার চলে এসেছে। সেসব ঢুকিয়ে দিয়েছিল শ্রীজিতা। তারপর ঘরে তালা। তোয়া বাড়ি ফিরে এক–দু’বার জানতে চায়, “মিনুদি, ছোট ঘরে তালা কেন?”

মিনু বলেছিল, “পরিষ্কার করা হয়েছে না? কেউ যদি ঢুকে আবার নোংরা করে দেয়! তাই…”

ছোট তোয়া তার স্বভাবসিদ্ধ পাকাভঙ্গিতে বলেছিল, “ঠিকই হয়েছে। কোন দুষ্টু এসে সব এলোমেলো করে দেবে, তার ঠিক আছে?”

শ্রীজিতা বেডরুমে ফিরে এসে মেয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলে, “হ্যাপি বার্থ ডে ডার্লিং।”

দু’বার ‘উঁ-উঁ’ করে ঘুম থেকে উঠে পড়ে তোয়া। শ্রীজিতা জড়িয়ে ধরে চুমু খায়, “কী ব্যাপার! আজ এক ডাকেই উঠে পড়‌লে যে বড়?”

তোয়া গালে টোল ফেলে হেসে বলল, “বাঃ, আজ আমার জন্মদিন না? জন্মদিনে যদি দেরি করে উঠি, সারাবছর দেরি হয়ে যাবে যে।”

শ্রীজিতা হেসে বলল, “ঠিক বলেছে আমার পাকা বুড়ি।”

তোয়া বলল, “মা, আমার বয়স আট হল, তার মানে আমি সত্যি বড় হয়ে গেলাম, ‌তাই তো?”

শ্রীজিতা মেয়ের চুল ঘেঁটে দিয়ে বলল, “অবশ্যই বড় হয়ে গেলে। আর সেই কারণেই তোমাকে আমি এবার বড়দের মতো একটা উপহার দেব।”

তোয়া চোখ বড়-বড় করে বলল, “তাই!‌ কী গিফট মা?”

“আগে তুমি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর দেখতে পাবে।”

ছোট ঘরের দরজায় একটা লাল রঙের রিবন বাঁধা। তোয়া কাঁচি দিয়ে সেই ফিতে কাটল। শ্রীজিতা, মিনু হাততালি দিয়ে ওঠে। শ্রীজিতা গেয়ে ওঠে, ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ.‌.‌.‌’

শ্রীজিতার গানের গলা ভাল। স্কুলে পড়ার সময়ে গান শিখেছে। গানের স্কুল থেকে বিভিন্ন কম্পিটিশনে নিয়ে যেত। প্রাইজ় নিয়েও ফিরেছে। ক্লাস ইলেভনে পড়ার সময় ‘‌মণি’‌ বলে গানের স্কুলের এক মাস্টার ফস করে একদিন শ্রীজিতাকে একটা চিঠি লিখে বসল। সেটা ছিল জীবনে পাওয়া প্রথম প্রেমপত্র। একেবারে নিরামিষ প্রেমের কথা। রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন ক’টা। শেষে লেখা ছিল,‌ ‘যদি চাও উত্তর দিয়ো। না হলে ভুলে যেয়ো।’‌ মণিস্যারের চিঠির কোনও জবাব শ্রীজিতা দেয়নি। দিতে চায়ওনি। তবে সেই চিঠি প্রাণে ধরে ফেলতেও পারেনি। সেই বয়স প্রেমপত্র ফেলে দেওয়ার বয়স নয়। বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে রেখেছিল শ্রীজিতা। ভুলেও গিয়েছিল। খুব তাড়াতাড়িই সেই চিঠি মায়ের হাতে যায়। সেখান থেকে বাবা। পরদিন জানা যায়, মণিমাস্টার রাতে গানের স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়ি যাওয়ার পথে পাড়ার একদল মস্তানের হাতে বেধড়ক মার খেয়েছে। তার বাঁ হাতটা এমনভাবে ভেঙেছে, খুব সহজে হারমোনিয়াম বাজাতে পারবে বলে মনে হয় না।

অনিমেষ বসু মেয়ের গান শেখা বন্ধ করে দেন। ব্যস, সেই শ্রীজিতার গানের ইতি। আজ মেয়ের জন্মদিনে দরদ দিয়ে দু’‌ লাইন গাইল।

হাতের ঠেলায় দরজা খুলে থমকে দাঁড়াল তোয়া। বিস্ফারিত চোখে ঘরের চারপাশে তাকাল। এ সে কী দেখছে!‌ তারপর লাফিয়ে উঠল, “ওয়ান্ডারফুল!‌ ইটস গ্রেট!‌”

শ্রীজিতা নিচু হয়ে মেয়ের কাঁধ ধরল। গাঢ় স্বরে বলল, “তোয়া এটাই তোমাকে আমার বার্থ ডে গিফট। এটা তোমার ঘর। একদম নিজের। কেউ এই ঘরের ভাগ নিতে পারবে না। আজ থেকে তুমি এঘরে থাকবে।”

তোয়া মায়ের গলা জড়িয়ে ঝুলে পড়ল।

“মা, আই লভ ইউ, আই লভ ইউ.‌.‌.‌”

শ্রীজিতা বলল, “তুমি মিনুদিদিকেও ধন্যবাদ বলো। কাল রাত জেগে তোমার জন্য সে ঘর সাজিয়ে দিয়েছে।”

তোয়া মিনুর দিকে ফিরে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল‌, “তোমার সঙ্গে আড়ি মিনুদি। কেন তুমি আগে বলোনি?”

মিনু তোয়ার গাল টিপে বলল, “তা হলে তো মজাই নষ্ট হয়ে যেত। এবার চলো, চটপট রেডি হয়ে নাও। আজ কিছুতেই বাস পাওয়া যাবে না। স্কুলের বন্ধুদের জন্মদিনের গিফট দিতেও পারবে না।”

তোয়া এবার ছুটল। শ্রীজিতা সকালের আলোয় মেয়ের ঘরের দিকে ভাল করে তাকাল। সুন্দর লাগছে। প্রথমে ভেবেছিল ইন্টিরিয়র দিয়ে কাজ করাবে, তারপর ভেবেছিল, নিজে করেই দেখা যাক না কেমন হয়। আর একটা ঝামেলা ছিল। তোয়াকে সারপ্রাইজ় দেওয়া হত না। ফার্নিচার ওকে লুকিয়ে আনা গিয়েছে, ইন্টিরিয়রকে তো লুকিয়ে আনা যেত না। আগে থেকে দেখলে মজা নষ্ট। বিস্মিত হওয়ার মধ্যে যে আনন্দ আছে, তা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। তাই সবটা লুকিয়ে করতে হয়েছে। শ্রীজিতার মনটা একটু ভারী হয়ে গেল। মেয়েকে আঁকড়ে থাকার দিন শেষ। সে নিজের মতো বড় হবে। হয়তো একটু আগেই হয়ে গেল। হোক, তোয়া আর পাঁচজন মেয়ের মতো নয়। তাকে একাই বড় হতে হবে। ক’টা বছর পর তাকে বাইরে পাঠিয়ে দেবে। বোর্ডিং-এ থেকে পড়বে।

স্কুলে বেরোনোর আগে তোয়া মাকে জিজ্ঞেস করল, “মা, রাতে আমি আমার ঘরে একা শোব তো?”

শ্রীজিতা বলল, “নিশ্চয় শোবে। ভয় করবে না তো?”

তোয়া জোরে মাথা নাড়িয়ে বলল, “একেবারেই করবে না।”

“ভেরি গুড।”

তোয়া বলল, “মা, বাবাকে এই ঘরটা আমি দেখাতে পারি?”

শ্রীজিতা একটু থমকে থেকে বলল, “অবশ্যই পারো। তোমার বাবা এলে তাকে দেখাবে। মনে হয়, আজই সে আসবে। সানডে বিকেলে তোমার জন্মদিনের পার্টি ওই ঘরেই হবে।”

তোয়া বলল, “আজই তো বার্থ ডে, পার্টি কেন আজ হল না?”

শ্রীজিতা মেয়ের পিঠে হাত রেখে বলল, “আজ হবে কী করে সোনা? আজ তো কারও ছুটি নেই‌। এবার বেরিয়ে পড়ো। লেট হয়ে যাবে।”

তোয়া বেরিয়ে গেলে অন্য দিনের মতো বিছানায় এসে শুল শ্রীজিতা। কিন্তু আর ঘুম এল না। আজ একটা আনন্দের দিন, তারপরেও মন খারাপ লাগছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *