১০
বিধান বসে আছে হাসপাতালে।
এমার্জেন্সি গেটের ঠিক উলটোদিকে একটা বড় বটগাছ রয়েছে। নীচটা খানিক বাঁধানো। অনেকটা গোল বসার জায়গার মতো। তবে একপাশের ইট খুবলে উঠে এসেছে। সেখানে সাবধানে বসেছে বিধান। মাথায় ব্যান্ডেজ। ব্যান্ডেজটা বেশ বড়ই। এই ধরনের ব্যান্ডেজ মাথায় থাকলে সকলে তাকায়। এখানে কেউ তাকাচ্ছে না। হাসপাতালে ব্যান্ডেজ স্বাভাবিক ব্যাপার।
খানিক আগে ছুটি হয়েছে বিধানের। বাড়ি থেকে কেউ আসেনি এবং আসবেও না শুনে ওয়ার্ডের হেড নার্স ভুরু কোঁচকালেও, হকচকিয়ে যাননি। হাসপাতালে নানা ধরনের পেশেন্ট-পার্টি নিয়ে তাঁরা অভ্যস্ত। ছুটির পর কাউকে নিয়ে যেতে পঞ্চাশ জন আসে, কেউ দু’–একজনের সঙ্গে চুপচাপ বেরিয়ে যায়। এই নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও কারণ নেই। তারপরেও বিধানের বেলায় মহিলা একটু যেন চিন্তিত হলেন। তা কি একেবারে একা বলে? হতে পারে। লোহার টেবিলে বসে রিলিজ় অর্ডার, প্রেসক্রিপশন, বাড়তি ওষুধ গোছাতে-গোছাতে হালকাভাবে বললেন, “ওই মেয়েটি আসবেন না?”
বিধান অবাক হল, “কোন মেয়েটি!”
নার্সটি বয়স্ক। গম্ভীর ধরনের। গম্ভীর মানুষ কোনও বিষয়ে চট করে বাড়তি প্রশ্ন করেন না। ইনি করলেন। মুখ তুলে বললেন, “ওই যে, যিনি আপনাকে এখানে ভরতি করিয়েছেন। সেদিন বিকেলেও তো এসেছিলেন শুনলাম।”
বিধান শুকনো হেসে বলল, “আর কতবার আসবেন? রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে হাসপাতালে এনেছেন, এই যথেষ্ট।”
নার্স বললেন, “ও, উনি আপনার কেউ হন না!”
“কেউ হন না বলি কী করে? প্রাণে বাঁচিয়েছেন। তবে আগে চিনতাম না।”
এবার নার্স খানিকটা যেন নিজের মনে বললেন, “কলকাতা শহরে তা হলে এখনও রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষকে বাঁচানোর মতো লোক পাওয়া যায়।”
বিধান অস্ফুটে বলল, “অবশ্যই।”
নার্স প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে বললেন, “ওষুধগুলো কিনে নিয়ে ঠিক করে খাবেন। ডাক্তারবাবু রেস্ট লিখে দিয়েছেন। আর এই নিন আপনার পার্স। খুলে দেখে নিন সব ঠিক আছে কি না।”
বিধান ব্যাগ খুলল না। দেখার মতো কিছু নেই। বলল, “টাকাপয়সা কিছু দিতে হবে?”
নার্স বললেন, “সরকারি জায়গায় স্টিচ করতে টাকা লাগে না। যেটুকু অল্প লেগেছে, আপনার ওই অপরিচিত মেয়েটি প্রথমদিনই ক্যাশে জমা করে গিয়েছেন। এই যে রসিদ। একটাই প্রবলেম ছিল, আপনার কোনও পরিচয়পত্র পাওয়া যায়নি। আইডেন্টিটি ছাড়া ভরতি...”
বিধান বলল, “তা হলে চিকিৎসা করলেন কেন?”
গম্ভীর মহিলা এবার এমনভাবে তাকালেন, যেন এরকম বোকার মতো প্রশ্ন কেউ করতে পারে এটাই ওঁর ধারণা ছিল না। বললেন, “কী করব? পেশেন্টকে বাইরে ফেলে দেব? যাক, আপনি থাকেন কোথায়? যাবেন কীভাবে?”
বিধানের অবাক লাগছে। নার্স মহিলা কত যত্ন করে কথা বলেছেন। “আমি থাকি বজবজে। চিন্তা করবেন না, ঠিক একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাব।”
এমার্জেন্সির সামনে এসেছে বিধান। ট্যাক্সি এখনও পায়নি। ট্যাক্সি আসছে ঠিকই, কিন্তু বিধান কাছ পর্যন্ত যাওয়ার আগেই অন্য কেউ লাফালাফি করে ধরে নিচ্ছে। একটা ট্যাক্সির কাছে পৌঁছলেও কিশোরীগঞ্জ শুনে ড্রাইভার যেতে চাইল না। হাঁফিয়ে পড়ে এখন এসে বসেছে বিধান। ছোট একটা ছেলে ঘুরে ঘুরে চা বেচছে। এক হাতে ফ্লাস্ক, অন্য হাতে কাগজের কাপ। এক কাপ চা নিয়ে বেশ আরাম করে খেল বিধান। আদা দেওয়ায় গলায় ঝাঁঝের মজা পেল। মানিব্যাগ থেকে খুচরো পয়সা বের করে দাম মেটাতে-মেটাতে ভাবল, ছেলেটাকে একটা ট্যাক্সি ধরে দিতে বললে কেমন হয়? এরা হাসপাতালে থাকে, ঘাঁতঘোঁত নিশ্চয়ই জানে। ভাবতে-ভাবতেই সেই ছেলে সামনে থেকে সরে গেল এবং চা বিক্রি করতে দ্রুত মিশে গেল ভিড়ে। বিধান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সব সিদ্ধান্তেই কি তার দেরি হয়ে যায়? দেরি না ভুল?
ঘুম ঘুম পাচ্ছে। খানিকটা ঘুমোতে পারলে বেশ হত। হাসপাতালে একবার ছুটি হয়ে গেলে, আবার কি ওয়ার্ডে ফিরে যাওয়া যায়?
বিধান পিছিয়ে গাছের গায়ে হেলান দিল। পা দুটো গুটিয়ে তুলে নিল বাঁধানো জায়গাটার উপর। গায়ের একপাশে তেরচা করে রোদ পড়ছে। খারাপ লাগছে না। রোদ খুব চড়া নয়। চোখ বুজতে-বুজতে বিধানের মনে হল, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে কী হবে? সাইবার কাফের ডিউটিতে আজ কিছুতেই যেতে পারবে না। কাজটা ভাল লাগছে না। কমবয়সি ছেলেরা এসে নোংরা ছবি দেখে। মেয়েরাও আসে। স্কুলের মেয়েরা। মালিককে জানিয়েছিল। মালিক বিরক্ত হয়েছে।
“তোমার কী? কে কম্পিউটারে ন্যাংটো দেখছে, কে হরিনাম জপছে, তোমার তো উঁকি মারবার দরকার নেই! তোমার কাজ, সময় মেপে পয়সা বুঝে নেওয়া। মেশিনে বসার আগে পরিচয়পত্রটি একবার টুক করে দেখে নেবে।”
বিধান বলেছিল, “অনেকে সেটাও ঠিকমতো দেখাতে পারে না। এর তারটা কপি করে আনে।”
মালিক গলা নামিয়ে বলেছিল, “আরে বাপু, ছোট ছেলেমেয়েদের একটু কনসেশন দিতে হয়। স্টুডেন্ট বলে কথা। এত কড়াকড়ি হলে ব্যাবসা চলবে কী করে? দুপুরের দুটো ঘণ্টা তো আমি এই জন্যই ছেড়ে রেখেছি। নিজেও যাই না। তোমাকে বসিয়ে দিয়েছি।”
বিধান মাথা নিচু করে বলেছিল, “আর একটা সমস্যা আছে।”
“কী?”
“অনেক সময় ছেলেমেয়েরা এখান থেকে জোড়ায়-জোড়ায় বেরিয়ে যায়।”
মালিক চোখ বড় করে বলেছিল, “এটা আবার কী সমস্যা বিধান! কে কার সঙ্গে বেরোয় তোমার আমার কী? এই সব দিকে মোটেও তাকাবে না। তুমি ওখানে গার্জেনগিরি করতে যাও না। দুনিয়ায় বড়-বড় ভদ্রলোকদের গপ্পো আমার জানা আছে। তারা যখন পরের বউ নিয়ে দরজায় খিল দেয়? যত দোষ সাইবার কাফের? যাও মাথা থেকে এসব ফেলে চুপচাপ কাজ করো।”
এরপর কথা বাড়ানোর মানে হয় না। বিধান চুপ করে গিয়েছিল। এবার বলে দিতে হবে, এই কাজ আর করবে না। কোচিং নিয়ে আছে তাই ভাল। টাকাপয়সা কম, অনিয়মিত। তা হোক। অনেকগুলো ভাল ছেলেমেয়ে পড়তে আসে। লেখাপড়া শেখার কী ইচ্ছে তাদের! পড়া একবার বুঝতে না পারলে বারবার বুঝতে চায়। পরীক্ষায় বেশি-বেশি নম্বর পেয়ে যখন বলতে আসে মন ভরে যায়।
কিশোরীগঞ্জ পর্যন্ত পৌঁছতে আজ বেলা হয়ে যাবে। কোচিং সন্ধের পর। কলকাতায় পড়ে থাকলে বিধানের কী হত কে জানে? হাতে যে সামান্য টাকাপয়সা ছিল, ফুরিয়ে আসছিল দ্রুত। তারপর? সুইসাইড করত? অন্য কেউ হলে হয়তো একবার চেষ্টা করত। বিধানের সেই সাহস নেই। জীবন সম্পর্কে যারা বেশি নিস্পৃহ, তারা বোধহয় মৃত্যুকে ভয় পায়। অর্থহীন, উদাসীন জীবনে গুটিসুটি মেরে বেঁচে থাকতে ভালবাসে। শুধু টাকাপয়সার জন্য নয়, কলকাতায় আর থাকতে পারছিল না বিধান। ভিতরে-ভিতরে ভয়ংকর অস্থির লাগছিল। ডিভোর্স প্রক্রিয়ার মাঝখানেই অফিসের তহবিল তছরুপের ঘটনাটা এসে পড়ল। দুটোর কোনওটাতেই আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারেনি বিধান। সেভাবে যে করতে চেয়েছিল, এমনও নয়। আর কী-ই বা করার ছিল তার?
ডিভোর্সের প্রসঙ্গটা শ্রীজিতা এনেছিল শান্তভাবে। তারপর উত্তেজনা বাড়ে।
একদিন রাতে বাড়ি ফিরল না শ্রীজিতা। সন্ধেবেলাই ফোন করে জানিয়েছিল, রাত হবে। রাত ন’টা নাগাদ ছোট্ট তোয়ার শরীরে সম্ভবত কোনও সমস্যা হল। সে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করল। বিধান শ্রীজিতাকে ফোন করেছিল।
“কী হয়েছে?” শ্রীজিতা বিরক্ত ছিল।
“তোয়া কাঁদছে।”
চাপা গলায় বলে উঠেছিল শ্রীজিতা, “কী করব আমি? অফিসের কাজ ফেলে দিয়ে মেয়ের কান্না থামাতে বাড়ি চলে যাব? কোলে নিয়ে ঘুরে-ঘুরে, গান গেয়ে তার কান্না থামাব?”
বিধান আমতা-আমতা করে বলেছিল, “তা নয়।”
“তা হলে কী? মেয়ের কান্না থামানোর দায়িত্ব শুধু আমার নয়। তোমারও।”
“আমি কি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব?”
“ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে, না ওঝার কাছে নিয়ে যাবে, ইউ হ্যাভ টু ডিসাইড। আমাকে বিরক্ত করবে না।”
বিধানকে তারপরেও বিরক্ত করতে হয়েছিল। একবার নয়, আরও দু’বার ফোন করেছিল শ্রীজিতাকে। একবার ডাক্তারের নাম, ফোন নম্বর জানতে। আর একবার কখন বাড়ি ফিরবে জানতে।
“মেয়ের ডাক্তারের নাম, ফোন নম্বর না জানাটা বাবা হিসেবে কতটা লজ্জার বুঝতে পারছ? মনে হয় না, সেই লজ্জাবোধ তোমার আছে। যা-ই হোক, ড্রেসিং টেবিলের বাঁ দিকের নীচের তাকে একটা ডায়েরি আছে। ওটা খুললে প্রথম পাতায় বড়-বড় করে লেখা…”
দ্বিতীয়বারের ফোনটা ধরেনি শ্রীজিতা। রাত এগারোটায় নিজেই ফোন করে, “তোয়ার কান্না থেমেছে?”
“ডাক্তার লাগেনি। নিজেই কান্না থামিয়েছে। খেলেওছে খানিকক্ষণ। আমি টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম। এখন ঘুমিয়ে পড়েছে।”
“গুড। এবার তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো। কখন ফিরব জানি না। রাতে ফিরতে নাও পারি।”
“সে কী! রাতে বাইরে থাকবে?”
শ্রীজিতা গলা একেবারে নামিয়ে বলেছিল, “তোমার সমস্যা কী? এমনভাবে বলছ যেন, রাতে পাশে বউ না থাকলে ঘুমোতে পারো না।”
বিধান কিছু একটা কথা বলতে গেলে, শ্রীজিতা হিসহিসিয়ে বলেছিল, “বিধান, আমি আগেও বলেছি, আজও বলছি। নিজেকে অনেক নষ্ট করেছি, আর নয়। নাও কেরিয়ার ইজ় মাই ফার্স্ট প্রায়োরিটি। আমাকে আর বিরক্ত কোরো না।”
সেদিন সত্যিই শ্রীজিতার অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রেজ়েন্টেশন তৈরি হচ্ছিল। টিভি কোম্পানির কাজ। চারজনের একটা টিম রাতে অফিসে থেকে গিয়েছিল।
বাড়ি ফিরতে ভোর হয়ে গিয়েছিল শ্রীজিতার। স্নান সেরে চা নিয়ে বসার পর বিধান বলেছিল, “তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল শ্রী।”
“ভাল, আমারও আছে।”
বিধান বলেছিল, “তুমি খানিকক্ষণ রেস্ট নেওয়ার পর না হয় বলি? তুমি বরং খানিকটা ঘুমিয়ে নাও।”
শ্রীজিতা ঠোঁটের কোণে হেসে বলেছিল, “তোমার কথায় ঘুম না হওয়ার সময় বোধহয় আমি পিছনে ফেলে রেখে এসেছি বিধান। দেরি না করে বলো, কী বলতে চাও।”
বিধান বসেছিল উলটো দিকের বেতের চেয়ারে। ডান হাত দিয়ে হাতের আঙুলের নখ খুঁটতে খুঁটতে বলেছিল, “আগে তোমাকে বলেছিলাম শ্রী। আমার জন্য সবটা একটু কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমি ঠিক নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছি না। সেদিন রাতে তুমি এক ভদ্রলোকের গাড়িতে বাড়ি ফিরলে... বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম... আমি তোমাদের দেখতে পাই... শ্রী, তোমার কাছে এসব কোনও ব্যাপার নয়, আমার কাছেও নয়। তুমি অ্যাডাল্ট এবং বুদ্ধিমতী। তোমার আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলার স্পর্ধা আমার নেই। ভাল-মন্দ বিচার করার ক্ষমতাও আমার নেই। তবে মনে হয়, আমি না থাকলে তোমার জীবনে সুবিধে হত। আমি কোনও দোষারোপ করছি না। কিন্তু নিজেকে অপরাধী মনে হয়। বিয়ের পরপরও তাই মনে হয়েছে।”
এতটা বলে চুপ করেছিল বিধান। শ্রীজিতা শান্তভাবে কাপে শেষ চুমুক দিয়েছিল। তারপর কাপ নামিয়ে বলেছিল, “থামলে কেন, বলো। বেশ গুছিয়েই তো বলছ। অবাক লাগছে শুনে, এত গুছিয়ে কথা বলতে তুমি পারো!”
“না, আর তেমন কিছু বলার নেই। এরকম ছোট-ছোট ঘটনায় নিজেকে বিচার করে দেখছি... শ্রী, কালকের রাতের ঘটনাটাই ধরো। কাজ করতে গিয়ে তোমার সারারাত লেগেছে। লাগতেই পারে, একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাজ করো তুমি, আমার মতো কেরানি তো নও। অথচ আমি তোমাকে বিরক্ত করেছি বারবার।”
বিধান চুপ করলে শ্রীজিতা সহজভাবে বলেছিল, “কী করতে বলছ?”
“তুমি ভাল বলতে পারবে।”
শ্রীজিতা হাই তুলে বলেছিল, “দেখো বিধান সমস্যাটা শুধু বাচ্চা নয়। তুমি সেটা বুঝতে পারছ। কোন পুরুষমানুষ আমাকে চুমু খেল, আমার বুকে হাত দিল, এতেও তুমি বদারড নও। এদিকে আমার রাতে কাজ করা নিয়েও তোমার কোনও বক্তব্য নেই । দিনে হলেও নেই। একটা সময়ে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থেকেছি। পাশে বসে সময়ও কাটাওনি দু’ দণ্ড।” কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ করল শ্রীজিতা। দম নিল। ফের বলতে শুরু করল, “বিয়ের আগেই আমি বলেছিলাম, এটা কোনও এক্সকিউজ় হতে পারে না। তোমাকে আমার প্রয়োজনে বিয়ে করেছিলাম মানে আর কোনও পুরুষমানুষ আমার কপালে জুটত না, এটা ভাবার কোনও কারণ নিশ্চয়ই নেই। তাই না? তারপরেও তোমাকে পছন্দ করি, কারণ তোমাকে আমি ভালমানুষ বলে চিনেছিলাম। এখনও তাই জানি। কিন্তু তখন যেটা বুঝতে পারিনি সেটা হল, এই ভালমানুষ আমার জন্য নয়। আমার মনে হয়, কারও জন্যই নয়। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে, যারা শুধু নিজের খোলসে ঢুকে থাকতে ভালবাসে। যেটুকু না করলে নিজে বেঁচে থাকা কঠিন, তার বেশি করে না। এদের কেউ স্বার্থপর বলে, কেউ অলস, জীবনের প্রতি ভাবলেশহীন বলে। বিধান আমি তোমার সঙ্গে থেকে বুঝেছি, তুমি আসলে কিছুই নও। নাথিং। খারাপ মানুষ হওয়ার যোগ্যতাও তোমার নেই।”
“তুমি ঠিকই বলেছ শ্রী।”
শ্রীজিতা এবার খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, “চুপ করো। আসলে তোমার সাহসের অভাব। বউকে ভালবাসার জন্যও সাহস লাগে। সে সাহস যেমন তোমার নেই, অফিসে তোমাকে নিয়ে যখন সবাই তামাশা করে, তার প্রতিবাদ করার সাহসও নেই। মন দিয়ে শুনে রাখো, আমি আমার মতো চলতে শুরু করেছি। সে চলা আমি কিছুতেই আর থামাব না। সেই পথে কোন পুরুষ আমার শরীর স্পর্শ করল, আমি কোন পুরুষের বিছানায় গেলাম, তাই নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন নেই। যে তার স্ত্রীর যোগ্যতা নিয়ে উদাসীন, তার শরীরের শুদ্ধতা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনও অধিকার তার নেই। তোমার এই ভিখিরির সংসার আমার জন্য নয়। ভেবেছিলাম বিয়ের পর বদলাবে। ভুল ভেবেছিলাম। আমি আমার কেরিয়ার তৈরি করব। আমার মেয়েকে বড় করব। সেখানে তোমার কোনও ভূমিকা থাকবে না। বাধা দিতে এলে সংঘাত হবে,” একটু থেমে শ্রীজিতা বলেছিল, “তা ছাড়া...তা ছাড়া আমাদের জীবনে তোমার পরিচয়টা খুব একটা সুখদায়ক হবে না। তোমাকে আরও বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াতে হবে।”
বিধান বিড়বিড় করে বলেছিল, “তাও ভাল, তোয়া এখনও ছোট আছে।”
“মেয়েকে নিয়ে তোমার আদিখ্যেতা আমি গায়ে মাখি না। আমি কনসিভ করেছিলাম জোর করে। মাঝরাতে বারান্দা থেকে তোমাকে ধরে আনতে হত। পেটে বাচ্চা আসার পর অ্যাবর্ট করাতে বলেছিলে। মেয়ের উপর তোমার দরদ কতটা, আমার চেয়ে বেশি কে জানে?’ শ্রীজিতা খালি কাপ হাতে উঠে পড়ে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, “এবার বলো তুমি কী চাও?”
বিধান অস্ফুটে বলেছিল, “তুমি যা চাইবে।”
“তোমার আমার একসঙ্গে থাকার খেলাটা এইবার শেষ করলে মনে হয় ভাল হবে। এর বেশি গড়াতে দিলে দু’জনের জন্যই খারাপ হবে। মেয়ের জন্য হবে বেশি খারাপ। সে এখন ছোট আছে, কিছু বোঝে না, এটাই ঠিক সময়।”
শ্রীজিতাই উকিলের সঙ্গে কথা বলেছিল। রোগা চেহারার উকিল। পুরনো আমলের নাম। প্রেমনাথ তরফদার। ঘনঘন সিগারেট ধরাচ্ছেন। ক’টা টান দিয়েই গুঁজে দিচ্ছেন অ্যাশট্রে-তে। সব শুনে প্রেমনাথ বলেন, “মামলা লড়বেন? তা হলে থানায় গিয়ে একটা ফোর নাইনটি এইট করে দিন। মামলা ইজ়ি হবে।”
শ্রীজিতা বলেছিল, “লড়াইয়ের দরকার হবে না। মিউচুয়াল।”
প্রেমনাথ বলেন, “খোরপোশের কী হবে? আপনার স্বামী তো চাকরি করেন। পিটিশন করতে হবে।”
“খোরপোশ নেব না। আমিও চাকরি করি।”
“তাতে কী হয়েছে, মেয়ে তো আছে। বাবা তার ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। কড়া আইন আছে।”
“আমার কড়া-নরম, কোনও আইনই লাগবে না উকিলবাবু। একটা কানাকড়িও আমাদের চাই না। ওর দেওয়ার ক্ষমতাও নেই। আপনি এমনি কাগজপত্র তৈরি করুন।”
যতই বোঝাপড়ার মধ্যে হোক, কোর্টের সব কাজে সময় লাগে। এক্ষেত্রেও লাগছিল। শ্রীজিতা বিধানকে বলেছিল, “যখন আমরা একটা সিদ্ধাম্তে আসতেই পেরেছি, একসঙ্গে থাকার অভিনয় করে আর লাভ কী? আমরা বরং আলাদা ঘর নিই। শেষ পর্যন্ত নিতে তো হবেই। তা ছাড়া মেয়েটাও অভ্যস্ত হয়ে যাক।”
বিধান বলেছিল, “তোমরা এই বাড়ি ছেড়ে যাবে কেন? আমিই বরং কোথাও চলে যাচ্ছি। এত ঘর আমার লাগবে কীসে? দেখি পুরনো পাড়ায়...”
শ্রীজিতা অবশ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, সে এবার ফ্ল্যাট কিনবে। বড় ফ্ল্যাট। যতই কষ্ট হোক, নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই নিজে তৈরি করবে। এই ঘুপচি ঘরে সে আর থাকবে না। তাকে মানায়ও না। তা ছাড়া মেয়ে বড় হবে, তাকে একা থাকতে হবে। সিকিয়রড জায়গা চাই। রাস্তার উপরের ঘরে থাকা যাবে না। অফিসে জয়েন করে প্রথম মাস থেকেই কিছু-কিছু করে সরিয়ে রেখেছিল শ্রীজিতা। তাতে ফ্ল্যাট কেনা যায় না, কিন্তু ভরসা জাগে। অফিসে কথা বলল। এইচ আর ডিপার্টমেন্ট বলল, ফ্ল্যাট কেনাটা কোনও সমস্যাই হবে না। ব্যাঙ্ক লোন দেওয়ার জন্য বসে আছে। অফিসই ব্যবস্থা করে দেবে। এর আগেও অনেককে দেওয়া হয়েছে। শ্রীজিতা ফ্ল্যাট খুঁজতে শুরু করে। সকালে বিকেলে অফিস যাতায়াতের পথে ফ্ল্যাট দেখে বেড়াত আর একবার করে উকিলকে ফোন করত, “কাগজপত্র রেডি হয়েছে?”
প্রেমনাথ বলতেন, “হয়ে যাবে ম্যাডাম।”
“আর ক’দিন?”
“একটা বড় কেস নিয়ে ফেঁসে আছি। সামনের সপ্তাহে হয়ে যাবে।”
‘সামনের সপ্তাহ’ আসার আগে বিধানের অফিসে গোলমাল শুরু হল। ছোট গোলমাল নয়, খুব বড় গোলমাল।
অফিসে অডিট করতে গিয়ে জানা গেল, পারচেজ় সেকশনে দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর ধরে দুর্নীতি চলছে। সময়টা প্রায় বছর পাঁচ। আর একটু বেশিও হতে পারে। ছোট একটা হিসেবের গরমিল ধরতে গিয়ে বড় গরমিল সামনে এল। ‘কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ’ বেরিয়ে আসা যাকে বলে। খাতায় যা দেখানো হয়েছে, মাল এসেছে তার চেয়ে কম। পারচেজ় আর স্টকের হিসেব মিলছে না। এদিকে বিল করে টাকা ছাড়া হয়েছে নিয়মিত। পারচেজ় বিল বিভিন্ন পর্যায়ে ঘোরাফেরা করে তবে পেমেন্টের শিলমোহর পায়। এই বিভিন্ন পর্যায়ের একটির দায়িত্বে বিধান। খুব সহজেই তার উপর দায় এসে পড়ল। বিলিং সেকশন, অ্যাকাউন্টস, পারচেজ়, স্টক মেনটেনেন্স–এর মোট পাঁচজনকে শোকজ় করা হল দ্রুত। শোকজ়ের চিঠি পাওয়ার পর একজন ইউনিয়ন, একজন বসকে ধরে তাদের মামলা ‘ডিসমিস’ করে নিল। ভালরকম ফেঁসে গেল তিনজন। পারচেজ়ের অচিন্ত্য, স্টকের শান্তি বিশ্বাস আর বিলিং-এর বিধান। তিনজনকেই সাসপেন্ড করা হল। অচিন্ত্যর বয়স কম। সে খুব তড়পাল। কোর্টে যাবে বলে হমকি দিল। শান্তি বিশ্বাস তো হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। সে কিছু জানে না। চুপ করে রইল বিধান। নানাজনে নানাকথা বলতে লাগল।
কয়েকজনের পরামর্শমতো বিধান ইউনিয়নের নেতা সুফল হালদারের সঙ্গে দেখা করল। মানুষটার কথা স্পষ্ট।
“আপনার নাম জড়িয়েছে শুনে চমকে গিয়েছিলাম। যতদূর শুনেছিলাম, আপনি মানুষটা ভাল। গোবেচারা ধরনের। অবশ্য অন্যের মুখে শুনে মানুষকে বিচার করা কঠিন। ভাল–মন্দ দুটোই ভুল হয়।”
বিধান নিচু গলায় বলেছিল, “আমি কিছু জানতাম না। আমি কিছু করিনি।”
সুফল হালদার বলেছিল, “শোকজ়ের জবাব কে লিখেছে?”
“আমি নিজে।”
সুফল হালদার মাথা নাড়তে-নাড়তে বলেছিল, “ওইটাই তো আপনাদের গোলমাল। আমাদের একবার দেখানো উচিত ছিল। যে ক’জন বেরিয়ে গেল, সব আমাদের দিয়ে চিঠি করিয়েছে। অচিন্ত্যটা বেশি পাকা। উলটোদিকের ইউনিয়ন করলে কী হয়, হারামজাদা এবার হাড়ে-হাড়ে বুঝতে পারছে।”
বিধান অস্ফুটে বলেছিল, “আমি এসব জানতাম না।”
সুফল হালদার উত্তেজিতভাবে বলেছিলেন, “জানবেন কী করে? ভালমানুষরা ইউনিয়ন টিউনিয়নের ধারে কাছে আসে না। ইউনিয়নের কোনও অ্যাক্টিভিটিতে আপনাকে পাইনি কখনও। এখন বিপদে পড়ে মনে পড়েছে।”
“কী হবে তা হলে?”
সুফল হালদার চিন্তিতভাবে বলেছিল, “এখন তো কিছু হবে না, ইনভেস্টিগেশনের সময় যদি কিছু করা যায়! চিন্তা কী জানেন বিধানবাবু… একবার যদি দোষী প্রমাণ হয়ে যান তো গেলেন। অফিস তো থানায় এফআইআর করবে। অ্যারেস্ট-ট্যারেস্ট করে একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে।”
বিধান কাঁপা গলায় বলেছিল, “কী করব?”
সুফল হালদার একটু চিন্তা করে বলেছিল, “কী আর করবেন। আপাতত বাড়িতে বসে থাকুন। আমাদের কাছে একটা অ্যাপ্লিকেশন জমা করুন। তাতে লিখুন...লিখুন, ‘এই চুরি-চামারির বিন্দুবিসর্গ আমি জানি না। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি কর্মচারী ইউনিয়নের কাছে আবেদন করছি, আপনারা অনুগ্রহ করে আমার বিষয়টা...’ না-না, আমার বিষয় নয়, লিখবেন ‘আমার বিরুদ্ধে আনা মিথ্যে অভিযোগের তদন্ত করে দেখবেন।’ ব্যস, এইটুকু লিখে নীচে নিজের মোবাইল নম্বর, ঠিকানা লিখে কেটে পড়ুন। এখন আমার মিটিং আছে।”
বিধান অবাক হয়ে বলল, “আমাকে কে ফাঁসাবে?”
সুফল হালদার অতি বিরক্তির সঙ্গে বলেছিল, “সে আমরা বুঝব। আগে চান্স পাই।”
বিধান উঠলে সুফল হালদার বলেছিল, “ইউনিয়নের ধারেকাছে আপনি ভেড়েন না, তা-ও কেসটা কেন নিলাম জানেন?”
বিধান চুপ করে রইল। সত্যি তো সে জানে না। সুফল হালদার বলেছিল, “নিলাম কারণ, শুনেছি, আপনি মানুষটা ভাল। পলিটিক্স করতে গিয়ে ভাল মানুষের জন্য বিশেষ কিছু করা হয় না। দেখি কিছু করতে পারি কি না। তবে টাইম লাগবে।”
পরদিন থেকে বিধানের অফিসে যাওয়া বারণ। তারপরেও সে একই সময় বেরিয়ে পড়ত। রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরত। পার্কে গিয়ে বসে থাকত। কখনও লম্বা হাঁটা দিত। অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেত। সে অফিসের ঘটনা শ্রীজিতাকে জানাতে চায়নি। আর তো মাত্র ক’টাদিন, তারপরই তো ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। প্রাক্তন স্বামীর কেলেঙ্কারি জেনে লাভ কী? কিন্তু তিনদিনের বেশি ঘটনা গোপন রাখতে পারল না।
একদিন অফিস থেকে থমথমে মুখে বাড়ি ফিরল শ্রীজিতা। বিধানকে বলল, “তোমার অফিসে গোলমাল হয়েছে?”
বিধান চমকে উঠে বলেছিল, “তুমি কী করে জানলে?”
“কী করে জানলাম তুমি জেনে কী করবে? ঘটনা সত্যি কি না বলো।”
বিধান একটু চুপ করে থেকে বলল, “হ্যাঁ সত্যি।”
“কোনটা সত্যি? তুমি চুরি করেছ?”
বিধান চুপ করে ছিল। শ্রীজিতা বলল, “আমার এক কলিগের পরিচিত তোমার ওখানে মালপত্র সাপ্লাই করে। সে ওকে বলেছে। অফিসে খবরটা ছড়িয়েছে। ছি-ছি!”
বিধান বলেছিল, “তুমি তো আমাকে চেনো।”
“না, চিনি না। তবে এটুকু জানি চুরি করার মতো সাহস তোমার নেই। তারপরেও তুমি জড়িয়েছ। তবে সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, আমার প্রেস্টিজ। চুরির দায়ে সাসপেন্ড হওয়া লোকের বউ হয়ে বড় জায়গায় চাকরি করা লজ্জার ব্যাপার। আমার ক্লিন কেরিয়ারে একটা স্ক্র্যাচ পড়ল তো বটেই। আমাকে লুকিয়ে তুমি আবার একটা স্বার্থপরতার কাজ করলে।”
বিধান চুপ করে ছিল। শ্রীজিতা রাতে খেতে বসে বলেছিল, “এই ঘটনার কোনও দায় আমি নেব না। অফিসে আমি বলে দিয়েছি, আমি তোমার ব্যাপারে কিছু জানি না। উই আর অলরেডি সেপারেটেড। যাই হোক, কামিং সানডেতে আমি তোয়াকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি।”
“কোথায়?”
“তুমি জেনে কী করবে? আমার এক বন্ধুর বাড়ি ক’দিন থাকব। আশা করি, এই সপ্তাহে কোর্টের কাজ হয়ে যাবে।”
বিধান নিচু গলায় বলেছিল, “আমি কিছুই জানতাম না শ্রী। এতদিন ঘটনা ঘটে যাচ্ছে... তিন হাত ঘুরে আমার কাছে বিল আসত। আমার যোগ বিয়োগে কোনও ভুল পাওয়া যাবে না, হলফ করে বলতে পারি।”
শ্রীজিতা খাওয়ায় মন দিয়ে বলেছিল, “যোগ বিয়োগ মিললেই সব অঙ্ক ঠিক হয় না। তোমার আমার সম্পর্কেও তো কিছু যোগ বিয়োগ মিলেছে, কী হয়েছে তাতে? এতদিন ধরে তোমার নাকের ডগা দিয়ে চুরি হয়ে গেল, অথচ তুমি বুঝতে পারলে না! লোকে বিশ্বাস করবে?”
“তুমি তো করবে শ্রী।”
শ্রীজিতা ঠোঁটের কোনায় বিদ্রূপের হেসে বলেছিল, “ধরার জন্য খড়কুটো খুঁজছ? সরি। টাইম ইজ় ওভার। বিধানবাবু সংসারে নিস্পৃহ থাকা যায়। কিন্তু বাইরের টাকা–পয়সার হিসেব? সেখানে গ্রস নেগলিজেন্স চুরির মতো অপরাধ। যাই হোক, মনে হয় ইনভেস্টিগেশন ঠিকমতো হলে তুমি নির্দোষ প্রমাণ হবে। আমি চাই না আমার মেয়ে তার বাবার ‘চোর’ অপবাদ সম্পর্কে কিছু জানুক।”
শ্রীজিতা মেয়েকে নিয়ে চলে যাওয়ার দশ দিনের মধ্যে ডিভোর্সের কাগজে সইসাবুদ হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যেই ছোটাছুটি করে ব্যাঙ্ক লোন বের করে নতুন ফ্ল্যাট কিনে নিল শ্রীজিতা। রেডি ফ্ল্যাট। উঠে যেতে অসুবিধে হল না। এদিকে বিধানের চুরির তদন্ত অতি ঢিমেতালে শুরু হল। সবাই বলল, পাঁচ বছর ধরে চলা চুরির তদন্ত কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে তো চলবেই। বিধান মাঝে মাঝে অফিসে যেত। সুফল হালদারের সঙ্গে দেখা করত।
“দাঁড়ান, আগে ইনভেস্টিগেশন এগোক। এখন তো সবে হিসেবপত্র পরীক্ষা চলছে। এরপর এক-এক করে আসামিদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ হবে। সময় লাগবে। আমি আপনাকে সময়মতো ডেকে নেব। আপনি আছেন কোথায়?”
“আপাতত বজবজের কাছে।”
সুফল হালদার চোখের চশমা নাকের ওপর নামিয়ে নিচু গলায় বলতেন, “চলছে কী করে? শুনলাম স্ত্রী...”
বিধান বোকার মতো হেসে বলত, “আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। কোচিং-এ পড়িয়ে চালাচ্ছি। একটাই তো পেট এখন।”
সুফল হালদার মুখ দিয়ে ‘চুকচুক’ আওয়াজ করতেন। প্রতিবারই প্রায় একই কথা, একইভাবে মুখে ‘চুকচুক’ আওয়াজ…
কেউ একজন কাঁধ ধরে অল্প-অল্প নাড়া দিচ্ছে আর ডাকছে।
“এই যে উঠুন। উঠুন এবার।”
বিধান ধড়ফড় করে উঠে বসল। চোখ খুলেই সামনে ঝুমুরকে দেখতে পেল। আশ্চর্য! ঘুম ভাঙলেই কি এই মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়!
“এ কী! আপনি এখানে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছেন!”
বিধান লজ্জা পেয়ে বলল, “না ঘুমোইনি, চোখ বুজে ছিলাম। ক্লান্ত লাগছিল। আপনি আবার এসেছেন?”
ঝুমুর কড়া গলায় বলল, “ভাগ্যিস এসেছি। নইলে হয়তো সারাদিন এখানেই ঘুমিয়ে থাকতেন। ইস পড়ে-টড়ে গেলে কী হত? আবার মাথায় লাগত।”
বিধান শুকনো হেসে বলল, “কী আর হত, আবার হাসপাতালে ভরতি হয়ে যেতাম।”
গোলাপি শাড়িতে ঝুমুরকে বেশ ঝলমলে লাগছে আজ। চোখে হালকা কাজল আছে, তবে আগের দিনের মতো ঠোঁটে লিপস্টিক নেই।
“বাড়ি না গিয়ে গাছতলায় ঘুমোচ্ছেন কেন?”
বিধান লজ্জা পেয়ে বলল, “এবার যাব। ট্যাক্সি পাচ্ছিলাম না। আপনি এখানে কী করছেন?”
ঝুমুর ঢোঁক গিলে বলল, “কেন আমার হাসপাতালে আসা বারণ হয়ে গিয়েছে নাকি!”
বিধান বলল, “না-না, ভাবলাম আমাকে দেখতে...”
কথাটা বলেই বিধান বুঝতে পারল, বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। ঝুমুর ফিক করে হেসে বলল, “কেন আপনি ছাড়া হাসপাতালে আর কেউ ভরতি হয় না?” তারপর গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি একজন পরিচিতকে দেখতে এসেছি। তার আজ...আজ একটু পরে অপারেশন হবে।”
মিথ্যে কথা। ঝুমুর কালও ‘কাজ’ পেয়েছিল। বেশি রাতে বাড়ি ফিরেছে। রাতে ঘুম হয়নি। যদিও সন্তোষদার পার্টি একেবারেই জ্বালাতনের ছিল না। মদ খেতে খেতে গান গেয়ে শুনিয়েছে। অনেকে একসঙ্গে মদ খাওয়ার জন্য জোর করে। তখন একটু-আধটু নিয়ে কায়দা করে লুকিয়ে ফেলে দিতে হয়। নয়তো বলতে হয়, ‘কখনও এসব খাইনি। লেখাপড়া নিয়ে থাকি তো।’ এতে ‘স্পেশাল পার্টি’ খুশি হয়। তারা তো এরকম ‘মেয়ে’ চেয়েছিল। বেশি পয়সা কি এমনি খরচ করছে? কালকের লোক নিজেকে নিয়েই মশগুল ছিল। তা-ও বেশিক্ষণ নয়। একটু পরে ঝুমুরকে বিছানায় ডেকে নিল। সেখানেও ঝামেলা করতে পারেনি। বোঝাই যাচ্ছিল, মদ, মেয়ে কোনওটাতেই অভ্যস্ত নয়। অনেকটা সময় ধরে টানার মুরোদ নেই।
রাতে ঘুম এসেছে দেরিতে। আজ আবার মায়ের শরীর খারাপ লাগায় ভোরে উঠতে হয়েছে। সব সামলে ঝুমুর ভেবেছিল একটু ঘুমিয়ে নেবে। কিন্তু শুয়ে শুয়ে মনে পড়ে, লোকটা আছে কেমন? হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল কি? নাকি এখনও রয়ে গিয়েছে?
কিছুক্ষণের মধ্যে নিজের উপর বিরক্ত লাগছিল ঝুমুরের। অচেনা মানু্য নিয়ে একেবারে ফালতু চিন্তা করছে। ফালতু চিন্তা দূর করার জন্য পাশ ফিরে শুয়েছিল। এমনকী চাদর টেনে মাথাও চাপা দিয়েছিল। তাতে লাভ হয়নি। হাসপাতালে শোওয়া মানুষটা ঘুরে ফিরে আসছিল বারবার। লোকটার চেনা পরিচিত কেউ নেই! হতে পারে? তা হলে গোলাপ গাছ নিয়ে যাচ্ছিল কার কাছে? করে কী লোকটা?
ছটফট করে একসময় উঠে পড়েছিল ঝুমুর। মায়ের বিছানার পাশে গিয়ে খানিকক্ষণ বসেছিল। ভাইকে বলেছিল, “জয়েন্ট এন্ট্রান্সের জন্য আলাদা একটা কোচিং-এর খোঁজ কর।”
“পয়সা দেবে কে?”
“কেন? যে-শত্রু তোর লেখাপড়ার খরচ দেয়, সে–ই দেবে।”
পার্থ সন্দেহে চোখ সরু করে বলেছিল, “অনেকটা টাকা কিন্তু।”
“খুব খরচ হলে তো পারব না। আমার পক্ষে যতটা সামর্থ্য, ততটা দেখ।”
পার্থ উৎসাহ নিয়ে বলেছিল, “তা হলে শুধু দুটো সাবজেক্টের জন্য ভরতি হয়ে যাই। খুব কিছু খরচ হবে না। ওরা মক টেস্ট নিয়ে রেডি করিয়ে দেবে।”
ঝুমুর ব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলেছিল, “যা আজই কথা বলে আয়।”
এরপরেই ক্লিয়ারিং অফিস থেকে ফোন আসে। কিছু পেমেন্ট এসেছে। অফিসে এলে বকেয়া বেতনের খানিকটা পাওয়া যাবে। লোকটার এই একটা বড় গুণ। টাকা না থাকলে যেমন দিতে পারে না, তেমন টাকা এলে কমর্চারীদের কাছে লুকোয় না। তবে এসব ক্ষেত্রে দেরি করা ঠিক নয়। পাওনাদারের সংখ্যা তো কম নয়। ঝুমুর চট করে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। শিয়ালদা স্টেশনে নেমে মনে হল, হাসপাতাল তো অফিস যাওয়ার পথেই পড়বে। একবার ঘুরে গেলে কেমন হয়? লোকটা ছুটি পেল কি না জানা যাবে।
ওয়ার্ডে ঢুকে বেডে অন্য পেশেন্ট দেখে ঝুমুর বুঝতে পেরেছিল, ওই লোক চলে গিয়েছে। ওয়ার্ড থেকে হাসপাতালের গেটের দিকে এগোনোর সময় মনটা কেমন যেন করল ঝুমুরের। ইস্, ঠিকানাটা রেখে দিলে ভাল হত। পারলে একবার ঢুঁ মারা যেত। বজবজ তো ছোট জায়গা নয়। ঠিক এরকম একটা সময় এমার্জেন্সির বিল্ডিং-এর উলটোদিকের গাছতলায় ঘুমন্ত বিধানকে দেখতে পায় ঝুমুর। প্রথমে চিনতে পারেনি। চিনতে পারার পর গভীর বিস্ময় নিয়ে এগিয়ে যায়। ট্যাক্সি ধরে আনে ঝুমুর।
বলে, “এই যে ড্রাইভারভাই, সাবধানে যাবেন।”
বিধান বলল, “চিন্তা করবেন না। আপনি আপনার পরিচিতর কাছে যান।”
ট্যাক্সি স্টার্ট দেওয়ার পরই ঝুমুর জানলা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বলল, “একটু দাঁড়ান দেখি,” তারপর গাড়ির দরজা খুলে উঠতে-উঠতে বলল, “সরে বসুন।”
বিধান অবাক হয়ে বলল, “আপনি কোথায় যাবেন?”
ঝুমুর সিটে হেলান দিয়ে খুব সহজভাবে বলল, “আমাকে সামনে এক জায়গায় নামিয়ে দেবেন। ড্রাইভারভাই আপনি গাড়ি ছেড়ে দিন।”
চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে বিধান বাইরের দিকে তাকাল। কী অদ্ভুত! একটা দিন এভাবেই গাড়িতে শ্রীজিতা উঠে বসেছিল। সেদিনও সে ছিল অসুস্থ। জীবন কি তবে এমনই রহস্যময়? একই ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে, শুধু মানুষগুলো বদলে-বদলে যায়!
ঝুমুরের ‘সামনে এক জায়গা’ আর এলও না। সে ট্যাক্সিতে বসে কিশোরীগঞ্জ পর্যন্ত চলে গেল। কেন গেল সে নিজেও জানে না।