ধুলো

ধুলো

গজাদার দোকানের শিঙাড়া এতই সুস্বাদু যে খাওয়ার সময় আরামে আর আনন্দে আধখানা চোখ বুঁজে যায়। আধবোঁজা চোখে গরম শিঙাড়া হাতে নিয়ে ‘উফ, আ:’, ‘উফ, আ:’ করতে করতে খেতে হয়। আমরা বাজি ধরে বলতে পারি, আমাদের এই ছোট মফসসল শহরের গজাদার শিঙাড়া কলকাতার বাঘা বাঘা দোকানের পিৎজা, স্যান্ডুইচ, রোল, মোমোকে অনায়াসে বোল্ড আউট করে দেবে। আজ পর্যন্ত এই শিঙাড়া কেউ একটা খেয়ে থামতে পারেনি। ছোটমামা খায় সাড়ে তিনটে। শেষ আধখানা ভেঙে আমাদের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

সেদিন আধবোজা চোখে তিন নম্বর শিঙাড়ায় কামড় বসিয়ে ছোটমামা বলল, ‘আচ্ছা বল তো, ধুলো কখন সোনার চেয়ে দামি?’

আমরা অবাক। ছোটমামা এসব কী বলছে! ধুলো সোনার থেকে দামি! তা কখনও হয় নাকি? অর্চি বলল, ‘ছোটমামা, এটা কি কোনও ধাঁধা?’

ছোটমামা দু-পাশে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘একেবারেই নয়। একেবারে সোজাসাপটা প্রশ্ন।’

তরান আমাদের মধ্যে একটু বোকা। আমতা আমতা করে বলল, ‘ধুলো কেন দামি হবে? ধুলো তো সব জায়গায় পাওয়া যায়। যে জিনিস সব জায়গায় পাওয়া যায় সে জিনিস কখনও দামি হয়? চাইলে আমি এখনই একমুঠো নিয়ে আসতে পারি। কোনও দাম লাগবে না। আনব?’

ছোটমামা পটাং করে চোখ খুলে ফেলল। তরানের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘বোকার মতো কথা বলিস না। বলতে পারবি না সেটা বল। কী হয় আর কী হয় না তাই নিয়ে তোকে কে জ্ঞান দিতে বলেছে? যেখানে জ্ঞান ফলানোর কথা সেখানে তো অষ্টরম্ভা। পরীক্ষার সময় কোয়েশ্চেন পেপার হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকিস। ভূগোলে কি আর এমনি সতেরো পেয়েছিস? এরকম কম বুদ্ধি বলেই পেয়েছিস।’

তরান বেচারি থতমত খেয়ে বলল, ‘সতেরো না উনিশ। আমাদের ক্লাসে দুজন এগারো আর একজন তিন পেয়েছে। স্যার বলেছেন, সেই তুলনায় আমার নম্বর ভালোই হয়েছে।’

ছোটমামা নাক দিয়ে ‘ফুস’ করে আওয়াজ করে বলল, ‘অতি খারাপ হয়েছে। কম নম্বর পেয়ে ফেল করায় একটা প্রেস্টিজ আছে। অন্তত ফেলুদের মধ্যে ফার্স্ট হতে পারতিস। তাও পারলি না। যাক, আর কেউ বলতে পারবে? যে পারবে সে প্রাইজ হিসেবে হাফ শিঙাড়া পাবে। আমার ফোর্থ শিঙাড়ার হাফ।’

আমরা মুখ চাওয়াচায়ি করলাম। প্রাইজ হিসেবে আধখানা শিঙাড়া মন্দ নয়। কৌস্তুভ এক গাল হেসে বলল, ‘ছোটমামা নিশ্চয় ম্যাজিকের কথা বলছ? তাই না? আমি ঠিক ধরেছি।’

ছোটমামা বলল, ‘তোমার মুণ্ডু ধরেছ।’

আমি ঢোঁক গিলে বললাম, ‘তাহলে কি সোনার খনির ভিতর থেকে ধুলো আনতে হবে?’

ছোটমামা হতাশ গলায় বলল, ‘তোদের বুদ্ধির দৌড় বুঝতে পেরেছি। ওরে বোকার দল, সোনার খনিতেই যদি নামতে হয় তাহলে ধুলো নিয়ে ফিরব কেন? পকেটে করে এক খানিকটা সোনা নিয়ে ফিরব। নে, এই শিঙাড়াটা তোরা পুরোটাই ভাগ করে খা। তোদের বুদ্ধি দেখে আমার খাওয়ার ইচ্ছে নষ্ট হয়ে গেল।’

আমরা চারজন অপরাধীর মতো মুখ করে অতি উৎসাহে শিঙাড়া ভাগ করতে লাগলাম।

কৌস্তভের এই ছোটমামা এখন আমাদের সকলের ছোটমামা। আমাদের সে ধমকধামক দেয় বটে কিন্তু ভালোবাসে খুব। আমরাও বাসি। বন্ধুর মতো। আড্ডা, ফুটবল, ক্রিকেট, পিকনিক, নাটক সবেতে ছোটমামাকে চাই। ছোটমামা বলে দিয়েছে, তার সঙ্গে মোটে ‘আপনি, আজ্ঞে’ করা যাবে না। এতে নাকি ‘দূরের মানুষ’ বলে মনে হয়। আমরাও খুশি। আমরা ‘তুমি’ই বলি। আর সত্যি কথা বলতে কী, ছোটমামার বয়স মোটে ‘আপনি আজ্ঞে’ করবার মতো হয়নি। এই তো বছর কয়েক আগে আমার বড়দার সঙ্গে কলেজ পাশ করেছে। বড়দা চাকরিতে ঢুকে পড়েছে, ছোটমামা নানা ধরনের ব্যবসাপাতির চেষ্টা করছে। তবে কোনও ব্যবসাই জমছে না। কৌস্তুভের মা-বাবা তাকে অনেকবার চাকরি করবার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। ছোটমামা বলে, ‘ও আমার পোষাবে না। দশটা-পাঁচটা অফিস আমার কাছে অসহ্য। নিজে কিছু করতে হবে। মাথা খাটিয়ে করব। তাতে অনেক আনন্দ পাওয়া যায়। উত্তেজনাও আছে। আমার চেষ্টা চলবে।’

সেই চেষ্টাতেই চলছে। ছোটমামার উৎসাহও আছে। তবে এব্যাপারে আমাদের কোনও আগ্রহ নেই। আমরা ছোটমামাকে পেলেই হল। ছোটমামা আড্ডায় গল্প বলবে, শিঙাড়া খাবে। ফুটবল ম্যাচে কোচ হবে। ক্রিকেটে আম্পায়ার। পিকনিকে জোরজবরদস্তি করে মাংস রান্নার দায়িত্ব নেবে। নাটকের সময় ডিরেক্টর হবে। মজার কথা হল, বেশিরভাগ সময়েই দায়িত্ব নিয়ে ছোটমামা কিছু না কিছু গোলমাল করে ফেলে। ছোটখাটো গোলমাল। ফুটবল ম্যাচে জোর করে এমন কাউকে টিমে ঢোকাবে যে একটা সেমসাইড করবেই। নইলে পেনাল্টি মিস করে বসবে। ক্রিকেটে আম্পায়ার হয়ে একটা ভুল আউট, খান পাঁচ ভুল নো বল ঘোষণা বাঁধা। পিকনিকে কোনওবার মাংসে ঝাল বেশি দিয়ে ফেলবে, কোনওবার সেদ্ধ কম হবে। খাওয়ার সময় বলবে, ‘এই যা:, আরও খানিকক্ষণ হাঁড়িতে চাপিয়ে রাখলে ঠিক হত।’ নাটকের বেলায় গোলমাল বেশি। হয়তো জমজমাট কোনও সিনের মাঝখানেই উত্তেজনায় হুইশল বাজিয়ে ফেলল। ব্যস, যে পরদা ফেলে সেও দড়ি ধরে মারবে টান। খোদ ডিরেক্টরের আদেশ বলে কথা। গড়গড়িয়ে পরদা পড়ে গেল। হইহই কাণ্ড। দর্শকরা চেঁচাচ্ছে, আমরা চেঁচাচ্ছি, ছোটমামাও চেঁচাচ্ছে। ফের পর্দা সরিয়ে নাটক শুরু করো। এসব ঘটনা যখন ঘটে আমরা বেশ রেগে যাই। ছোটমামাকে দু-কথা শোনাতে ছাড়ি না।

ছোটমামা হেসে বলে, ‘ইচ্ছে করে করেছি। কতদিন এসব মজা মনে থাকবে দেখিস। বুড়ো হয়ে গেলেও পিকনিকের কথা মনে পড়বে। তখনও দেখবি মুখে ঝাল স্বাদ পাবি।’

কথা শেষ করে ছোটমামা ‘হো-হো’ আওয়াজে হেসে ওঠে। এই মানুষকে পছন্দ না করে উপায় আছে? রাগ করি আর যাই করি, একটানা সাতদিন দেখা না হলে আমাদের মন ছটফট করে। কী হল? অসুখ-বিসুখ করেনি তো? ছোটমামা যেমন অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প জানে তেমন উদ্ভট উদ্ভট কাণ্ড করতে পারে। বেশিরভাগ কাণ্ডই তার নতুন নতুন ব্যবসা নিয়ে।

শিঙাড়া খাওয়া শেষ হলে ছোটমামা ঘোষণা করল, তার নতুন ব্যবসার সাবজেক্ট ধুলো। ধুলো নিয়ে ব্যবসা।

আমরা চারজনে একসঙ্গে মিলে বলে উঠলাম, ‘অ্যাঁ! ধুলো দিয়ে ব্যবসা!’

ছোটমামা টেবিলে চাপড় মেরে বলল, ‘ইয়েস, ডাস্ট। ধুলো দিয়েই বাজিমাত করতে হবে।’

কৌস্তভ ভয়ে ভয়ে বলল, ‘ধুলো নিয়ে ব্যবসা কি সম্ভব ছোটমামা? ধুলো কে কিনবে?’

ছোটমামা উত্তেজিত ভাবে বলল, ‘সবাই কিনবে। লাফা-লাফি করে কিনবে। ছোটাছুটি করে কিনবে। কাড়াকাড়ি করে কিনবে। মাথা খাটিয়ে করলেই সম্ভব। অবশ্য মাথা খাটানোর সঙ্গে গায়ে গতরে খাটনিও লাগবে। কী রে পারবি তো?’

তারন বলল, ‘কীরকম খাটনি?’

ছোটমামা বলল, ‘ছোটাছুটি আছে। তার আগে প্ল্যান ছকে নিতে হবে ঠিকমতো। এই কাজে প্ল্যানটাই আসল। ভেবেচিন্তে লম্বা লিস্ট বানাতে হবে। তারপর কাজ শুরু।’

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘ছোটমামা, তোমার আগের ব্যবসাগুলোর মতো এটাও ভরাডুবি হবে না তো?’

ছোটমামা বলল, ‘আমি যা ভেবেছি তাতে ভরাডুবি হবার কোনও চান্স নেই। আগেও কেউ কেউ ধুলো নিয়ে ব্যবসার চেষ্টা করছে। করে ফেল মেরেছে। সেসব নিয়ে হাসিঠাট্টার গল্পও আছে। পত্রপত্রিকায় বেরিয়েছে সেসব। আমার কানেও এসেছে দু-একটা। তবে আমারটা ওই ফেলু পার্টিদের মতো হবে না। এ একেবারে আলাদা প্ল্যান। হাসিঠাট্টার ব্যাপার নয়। সিরিয়াস ব্যাপার। ক’টা দিন ঠিক মতো চালাতে পারলে লাভের ওপর লাভ। আমার ধুলো সোনার থেকেও দামি। ধুলো থেকেই টাকা আসবে।’

অর্চি চোখ গোল করে বলল, ‘একেবারে টাকা! ধুলো টাকা হয়ে যাবে! মন্ত্রটন্ত্রের ব্যাপার আছে নাকি ছোটমামা?’

ছোটমামা বিরক্ত মুখে বললেন, ‘উফ! এই ছেলের মাথায় একেবারেই বুদ্ধি নেই দেখছি। নো গ্রে ম্যাটর, ওনলি ধুলো। ওরে বোকা, বললাম না ম্যাজিক, মন্ত্র এসব কোনও ব্যাপার নয়। ধুলো ধুলোই থাকবে। এই বিজনেসে কোনও ইনভেস্টমেন্ট নেই। ওনলি লাভ। আমাদের সঙ্গে যদি থাকিস, তোরাও সেই লাভের ভাগ পাবি। পুজোর ছুটির সারাক্ষণ মাঠেঘাটে ঝাঁপাঝাপি না করে যদি দুটো পয়সা উপার্জন করতে চাস? রাজি থাকলে বল।’

আমরা নড়েচড়ে বসলাম। ছোটমামার কথা আমাদের মনে ধরল। সত্যি তো ছুটির ক’টা দিন শুধু বল খেলে, ক্যারাম পিটিয়ে, ভিডিয়ো গেমস নাড়াচাড়া করে কী হবে? তার থেকে নিজেরা কিছু রোজগার করতে পারলে খুব ভালো হয়। হজমি গুলি, শিঙাড়া, এগরোল, আইসক্রিম, ঘুড়ি, বল, সাইবার কাফেতে গিয়ে ভিডিয়ো গেম, ফুটবল ম্যাচের এন্ট্রি ফিস-এর জন্য কতবার বাড়িতে হাত পাতা যায়? বাবা চোখ কটমট করে। মা দশ টাকা চাইলে, দু-টাকা দেয়। বলে, ‘এইটুকু ছেলে অত টাকা হাতে নিয়ে কী করবি?’ ছোড়দা বলে, ‘আগে পিঠ টিপে দে। পিঠটা বড্ড কনকন করছে।’ তার থেকে নিজেরা যদি রোজগার করতে পারি তাহলে কোনও ঝামেলাই নেই। আমরা ঘাড় কাত করলাম। ছোটমামা বলল, ‘ভেরি গুড। আগে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আয়। কেউ যেন শুনতে না পায়। প্ল্যান ফাঁস হয়ে গেলেই সব শেষ। সবাই এই ব্যবসায় নেবে পড়বে।’

কৌস্তব দরজা আটকে দিয়ে এল। ছোটমামা কাগজ পেন হাতে নিয়ে নীচু গলায় বলল, ‘আমি একটা নামের লিস্ট বানিয়ে দিচ্ছি। তোরা কালই ভাগাভাগি করে বেরিয়ে পড়বি। কাছেরগুলো তোরা সামলাবি, দূরের আর স্পেশাল কেস আমি দেখব।’

আমি বললাম, ‘এরা কারা?’

ছোটমামা চাপা গলায় ধমক দিয়ে বলল, ‘আ:। আস্তে বল। এরা সব বিশিষ্ট মানুষ। কেউ মাস্টার, কেউ গায়ক, কেউ আর্টিস্ট, কেউ খেলোয়াড়, কেউ অভিনেতা, কেউ ডাক্তার, কেউ কবি। তার সঙ্গে আছে অমুক বাবা, তমুক বাবা। এদের কাছে তোরা যাবি। আর আমি যাব নেতা, মন্ত্রী, পুলিশ, চোর, ডাকাত—এদের কাছে।’

কৌস্তভ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘চোর-ডাকাতের কাছে যাবে কেন ছোটমামা?’

ছোটমামা বলল, ‘দরকার আছে বলেই যাব। এদের দাম বেশি। যা বলছি শোন। সবার কাছে একটা করে কৌটো নিয়ে যাবি। আমরা কৌটো ভর্তি ধুলো নিয়ে যাব।’

ছোটমামা এবার বিজয়ীর হাসি হেসে সবটা খোলসা করল।

‘ওটাই আমার ব্যবসা। ওই ধুলো সকলের পায়ে ঠেকিয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবি। ব্যস, এক নিমেষে সামান্য পথের ধুলো হয়ে যাবে নামি দামি মানুষের পায়ের ধুলো। চট করে তো এসব পায়ের ধুলো পাওয়া যায় না। ধুলো হয়ে যাবে সোনার চেয়ে দামি। অনেকেই চায় জরুরি আর শুভকাজে যাবার আগে দামি মানুষের পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকাতে। যেমন ধর, পরীক্ষায় আগে মাস্টারের পায়ের ধুলো, স্টেজে গান গাইতে ওঠবার সময় গায়কের পায়ের ধুলো, খেলতে নামবার আগে বড় প্লেয়ারের পায়ের ধুলো, নাটক করবার আগে অভিনেতার পায়ের ধুলো…কাজের সঙ্গে মিলিয়ে লোক পাওয়া না গেলেও সমস্যা নেই। অন্য কোনও ‘বড়’ লোকের ধুলোতেও মানুষ খুশি হয়। ক’দিন আগে বাজারে একটা ঘটনা দেখলাম। আমাদের পাড়ার তবলাবাদক কুন্তলদাকে দুটো ছেলে দেখি ঝপাঝপ প্রণাম করছে। কুন্তলদা বাজারের থলি সামলে হাই হাই করে উঠল। বলল, ‘করো কী, করো কী! আমাকে প্রণাম করো কেন?’ ছেলেদুটো গদগদ গলায় বলল, ‘আজ আমাদের ইতিহাস পরীক্ষা, তাই আপনার পায়ের ধুলো নিলাম। কুন্তলদা তো অবাক। বলল, ‘আমি ইতিহাসের কী জানি! আমি তো বাজাই তবলা, ইতিহাস পরীক্ষার আগে আমার পায়ের ধুলো কোন কাজে লাগবে? তবলার কম্পিটিশন হলে একটা কথা ছিল।’ ছেলেরা বলল, ‘বড় মানুষের ধুলো সবসময় উপকারে লাগে। সে ইতিহাসই বলুন আর তবলাই বলুন।’ ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস? তখনই আমার মাথায় প্ল্যান খেলে গেল। নতুন ব্যবসার প্ল্যান।’ ছোটমামা চোখ চকচক করে উঠল।

আমাদের চোখ কপালে। মুখ হাঁ। তরান বিড়বিড় করে বলল, ‘ওরে বাবা!’

ছোটমামা বলল, ‘ওরে বাবা নয়, হ্যাঁ রে বাবা। এবার আমি পায়ের ধুলোর বিজনেস শুরু করছি। বিভিন্ন প্রকারের পায়ের ধুলো আমার কাছে থাকবে। যার যখন যেমন দরকার দাম দিয়ে কিনতে পারবে। ধুলো অনুযায়ী দাম। তোরা ঘুরে ঘুরে ধুলো কালেক্ট করে আনবি। আমার বাড়ির একতলার ঘরে অফিস করব। অফিস কাম দোকান। ধুলোর দোকান। আলমারিতে কৌটো আর প্ল্যাস্টিকের পাউচে সারি সারি ধুলো সাজানো থাকবে। গায়কের ধুলো, খেলোয়াড়ের ধুলো, মাস্টারমশাইদের ধুলো, অভিনেতার ধুলো…নেতা মন্ত্রী, চোর, ডাকাত, পুলিশের পায়েরও ধুলোও রাখব ঠিক করেছি।’

আমি বললাম, ‘নেতা, মন্ত্রী, চোর ডাকাতের পায়ের ধুলো দিয়ে কী হবে?’

ছোটমামা বলল, ‘বলিস কী রে! ওদের পায়ের ধুলোর তো বিরাট দাম। দেখিস না নেতা-মন্ত্রীকে সামনে পেলে সবাই কেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে? পেন্নামের পর পেন্নাম। ওনাদের পায়ের ধুলো নাকি সব ব্যাপারে কাজে দেয়। সে তুই ভোটে দাঁড়ানোই বল, ফুটবল ম্যাচে কাউকে ল্যাং মারাই বল, গাছে ওঠবার কম্পিটিশনে চুপিচুপি সামনের ছেলেটার পা ধরে টেনে নামানোই বল, যার ওপর রাগ তার পায়ের কাছে কলার খোসা ফেলে দেওয়াই বল। সেই কারণেই তো ওনাদের পায়ের ধুলোর এত ডিমান্ড। নেবার জন্য হুড়োহুড়ি। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই পাওয়া যায় না। নেতা-মন্ত্রীর দেখা মেলা, তাদের পায়ের কাছে পৌঁছোনো খুব ঝামেলার ব্যাপার। এবার আমার কাছে পাওয়া যাবে।’

কৌস্তভ অস্ফুটে বলল, ‘আর চোর-ডাকাত? পুলিশ? ওদের পায়ের ধুলো কে নেবে?’

উত্তরে ছোটমামা যা বলল তাতে আমাদের হাঁ হয়ে যাওয়া মুখ আরও হাঁ হয়ে গেল। চোর-ডাকাতরাও নাকি কাজে বেরোনোর আগে বড় বড় চোর-ডাকাতের ফটোতে প্রণাম করে বের হয়! চুরি-ডাকাতি যেন সফল হয়। এবার হাতে গরম পায়ের ধুলো পেয়ে যাবে। মাথায় ঠেকিয়ে বেরিয়ে পড়বে। সঙ্গে যদি পুলিশের আশীর্বাদ পাওয়া যায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। যে পুলিশ চোর-ডাকাতকে পায়ের ধুলো দিয়ে আশীর্বাদ করবে সে কি আর চট করে তাদের ধরতে পারবে? একটা চক্ষু-লজ্জার ব্যাপার থাকবে না?

অর্চি বলল, ‘সবাই আমাদের পায়ের ধুলো দেবে তো ছোটমামা?’

ছোটমামা বলল, ‘আলবাত দেবে। তোরা তো ধুলো নিয়েই যাচ্ছিস। শুধু একবার পায়ে ছুঁইয়ে নিয়ে আসবি। পায়ের ধুলো এমন জিনিস যে দেবার জন্য সবাই ছটফট করে। ও নিয়ে তোরা চিন্তা করিস না। কালই নামের লিস্ট আর কৌটো নিয়ে বেরিয়ে পড়। এবার আমার এই ব্যবসা দুদিনের মধ্যে ফুলেফেঁপে ওঠে দেখবি। অফিসে লাইন পড়ে যাবে। দোকানে ভিড় সামলাতে পারব না।’

হায়রে! কিছুই হল না। ছোটমামার ধুলোর ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠবার আগেই চুপসে গেল। কেন? সে বড় দু:খের গল্প। দু:খের? নাকি মজার?

তিনদিনের মধ্যে আমরা অনেকটাই তৈরি হয়ে গেলাম। ছোটমামার অফিস কাম ধুলোর দোকান সাজানো হয়ে গেল। টেবিল, চেয়ার, কম্পিউটার আর গোটা তিনকে কাচের আলমারি। আলমারির তাকে সাজিয়ে রাখা হবে কৌটো আর ছোট ছোট প্যাকেট। ছোটমামা দোকানের নাম দিল, ‘চরণ ধূলি’। সাইনবোর্ডে দুটো পায়ের ছবি। একটা বুট পরা, একটা খালি। লিফলেট ছাপানো হল। তাতে লেখা—

‘আর চিন্তা নেই। পায়ের ধুলো এখন আপনাদের হাতের কাছে। যে ধুলো সোনার থেকে দামি। পাবেন নাম মাত্র দামে। পরীক্ষা থেকে চুরি ডাকাতি, গান থেকে ফুটবল ম্যাচে ল্যাং, অভিনয় থেকে পা ধরে টান—যে-কোনও শুভকাজে যাবার আগে বড় মানুষের পায়ের ধুলো আশীর্বাদ হিসেবে সঙ্গে রাখুন। কাজ সফল। মনের ইচ্ছে পূর্ণ হবে…।’

লিফলেটের নীচে নানা প্রকার পায়ের ধুলোর নাম আর দামের লিস্ট। আমরা সেই লিফলেট বিলি করলাম। কয়েকটা এদিক-ওদিক দেয়ালে আঠা দিয়ে সেঁটেও দিলাম। এক রবিবার ‘চরণ ধূলি’র উদ্বোধন। বিকেল চারটের সময় সবাইকে আসতে বলা হল। দোকানের দরজায় গাঁদা ফুলের মালা ঝোলাল ছোটমামা। গজাদার কাছে গেল শিঙাড়ার অর্ডার। অতিথিদের দেওয়া হবে। দুপুরে শেষ মিটিং ডাকল ছোটমামা। সব ঠিকঠাক আছে তো?

না ঠিক নেই। কেলেঙ্কারি হয়েছে।

তরানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, লিস্ট দেখে ধুলোর কৌটো আর প্যাকেটে গায়ে লেভেল সাঁটতে হবে। যেমন ‘অভিনেতার ধুলো’, ‘খেলোয়াড়ের ধুলো’, ‘মাস্টারমশাইয়ের ধুলো’, ‘ডাকাতের ধুলো’, ‘নেতার ধুলো।’ গত তিনদিন ধরে তরান এই কাজ করেছে। কৌটো, প্যাকেট আলমারির তাকে সাজিয়েও ফেলা হয়েছে। শেষ মুহূর্তের মিটিং-এ তরান জানাল, সে নাকি একটা গোলমাল করে ফেলেছে।

ছোটমামা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী গোলমাল?’

তরান মাথা চুলকে বলল, ‘লিস্টটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাই লেভেল বসিয়েছি খুশি মতো।’

ছোটমামা চিৎকার করে উঠল, ‘মানে!’

তরান ঢোঁক গিলে বলল, ‘সবই তো ধুলো। কে আর আলাদা করতে পারবে? তাই হাতের কাছে যেটা পেয়েছি সেটাতেই খুশি মতো লেভেল লাগিয়ে দিলাম।’

ছোটমামা মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘সর্বনাশ!’

সর্বনাশ তো বটেই। পুলিশের পায়ের ধুলোর কৌটোয় ডাকাতের পায়ের ধুলো অথবা গায়কের কৌটোতে কুস্তিগিরের ধুলো অথবা নেতার কৌটোতে যদি অভিনেতার ধুলো থাকে তাহলে সর্বনাশ হবে না? পুলিশের পায়ের ধুলো ভেবে কেউ যদি চোর-ডাকাতের ধুলো কিনে নিয়ে যায়? নেতার ভেবে খেলোয়াড়ের কৌটো নিয়ে বাড়ি ফেরে?

ছোটমামা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ব্যবসা বন্ধ। দোকান উদ্বোধন হবে না।’

কৌস্তব মিনমিন করে বলল, ‘তরান ভুল বলেনি। ধুলো কেউ চিনতে পারবে না।’

ছোটমামা ধমক দিয়ে বলল, ‘না পারুক। আমার একটা গুড উইল আছে না? মানুষ ঠকাতে পারব না। তা ছাড়া…তা ছাড়া…ধর থানার বড়বাবু যদি ডাকাত ধরতে যাবার আগে ডাকাতের পায়ের ধুলো কপালে ঠেকিয়ে আশীর্বাদ চায়? কী ঘটবে ভাবতে পারছিস? সেই ডাকাত কোনওদিন ধরা পড়বে? না, না, আমি এতে নেই। এখনই গেট বন্ধ করে দে। বাইরে নোটিশ লাগা—অনিবার্য কারণে চরণ ধূলি খুলছে না। আজই সব কৌটো, প্যাকেট মাঠে ফেলে দিয়ে আসবি।’

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আর গজাদার অতগুলো শিঙাড়া? তার কী হবে?’

ছোটমামা কোনও উত্তর না দিয়ে উদ্বোধন না হওয়া ‘চরণ ধূলি’ ছেড়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *