ধুম লেগেছে হৃৎকমলে

ধুম লেগেছে হৃৎকমলে (রচনা ১৯৮৪-৮৬। প্রকাশ ১৯৮৭)

ক্যান্সার হাসপাতাল

রোজ আসতে আসতে সবারই সঙ্গে জানাশোনা হয়ে যায় একদিন
সবারই দিকে তাকিয়ে বলা যায় : এই-যে, কেমন!
 গ্রহণের সূর্যের দিকে চোখ তুলে তাকানো যায় বেশ সহজে।

গ্রহণের সূর্যের দিকে তাকানো যায় সহজে
কোনো অপরাধের কথা কোনো ক্ষতির কথা মনে থাকে না আর
আমারও ইচ্ছে করে এমনসব কথা বলি যার কোনো মানে নেই

আমারও ইচ্ছে করে এমনসব বলি যার কোনো মানে নেই
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যা একটাই মাত্র স্তূপের মতন ঊর্ধ্বতায়
 মুহূর্তের বল্মীকে ভরে থাকে যার অগোচর ধ্যান

মুহূর্তের বল্মীকে ভরে থাকে যার ধ্যান
তার ভিতর থেকে তাকিয়ে দেখা যায় জায়মান অশথের পাতাগুলি, শুধু
আমাদের মাঝখানে জেগে থাকে পুরোনো এক হালকা পর্দা

আমাদের মাঝখানে একটাই সেই পর্দা এখনও স্থির
সীমান্তের কাছে থেকে জলতরঙ্গের শব্দ শুনে শুনে
চৌকাঠ পেরিয়ে গহ্বরের দিকে পা বাড়াই, ফিরে আসি

চৌকাঠ পেরিয়ে গহ্বরের দিকে ফিরে আসি, আর
পথচলতি চিৎকারের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে মনে পড়ে
দেখে এসেছি ক্যান্সার হাসপাতালে সকলেই আজ বেশ হাসিখুশি।

*

স্বপ্ন

আ, পৃথিবী! এখনও আমার ঘুম ভাঙেনি।

স্বপ্নের মধ্যে তুমুল পাহাড়
পরতে পরতে তার পাপড়ি খুলে দিচ্ছে

খুলে দিচ্ছে সবুজ পাপড়ি, ভিতরের থেকে ভিতরে,
খুলছে, খুলে দিচ্ছে, আর তার মাঝখান থেকে জেগে উঠছে ধানজমি

যখন লক্ষ্মী আসবে
লক্ষ্মী যখন আসবে

তখন কৃপাণ আর পাইপগান হাতে খানায়খন্দে ওরা কারা- আ, পৃথিবী
এখনও আমার ঘুম ভাঙেনি।

*

পোশাক

অনেকদিন হলো
পরব না পরব না করেও পোশাক পরা হলো অনেকরকম।

ছেড়ে ফেলতে কোনো কষ্ট নেই তো?
 তাহলেই হলো।

নাচগান চলছেই চারপাশে
মাঝে মাঝে হিজড়েরাও কোমর বাঁকিয়ে চলে যায়–

কতরকম কাঁকড়াবিছে, তোরণ,
আর অন্ধিসন্ধি

কথা হলো, তুমি ঠিক কেমনভাবে
 তোমার মতো হবে।

*

হৃৎকমল

চিতা যখন জ্বলছে
তোমরা চাও আমি তখন আলোর কথা বলি
বলব আলোর কথা।

বলব যে, ভাই, আরো কিছুক্ষণ
এ ওর মুখের উলকি দেখে
 কাটিয়ে দেব সময়। বলব আলোর কথা।

চণ্ডালকেই মুক্তি ভেবে খুঁচিয়ে দেব আগুন
 ফুলকি দেখে দেখে বলব আলোর কথা
ভাবব ওই তো জয়ধ্বজা, শ্মশান, বড়ো ধুম লেগেছে হৃৎকমলে

চিতা যখন জ্বলছে, আমার হৃৎকমলে
ধুম লেগেছে, ঘুম লেগেছে চরাচরে, পাপড়ি জ্বলে
এই তো আমার

এই তো আমার জন্মভূমির আলোর কথা।

*

শেকল বাঁধার গান

ছিটকিনি খুলে অক্ষরগুলি বেরিয়ে পড়েছে পথে আজ সারারাত বেলেল্লা নাচ হবে
কানায় কানায় উপচে পড়ছে আপ্লুত আহ্লাদ
জানলা দিয়ে দেখি
শেকল গড়িয়ে আসছে পায়ে পায়ে বেঁধে নিচ্ছে তালবেতাল টান
 শপাং শব্দে ঢেউ উঠছে ঢেউ উঠছে ছত্রিশ ব্যঞ্জনে
 অঙ্কশায়ী স্বরধ্বনিগুলি
বলছে এ কী মুক্তি এ কী স্বাধীন সংগৎ এ কী সুখ তন্দ্রাহারা
জানলা দিয়ে দেখি কে নাচায় কে নাচে কার ঝনৎকার নাচে

শপাং শব্দে ঢেউ উঠছে খোলা পথে দিগবিদিকে উছলে উঠছে গা
 এ কী মুক্তি এ কী সুখ
কার হাতে চাবুক সেটা দেখা যায় না শুধু
 নরম চামড়ার শব্দ চামড়ায় চামড়ায় শব্দ শীৎকারে আতুর
ছত্রিশ ব্যঞ্জন আর অঙ্কশায়ী স্বরধ্বনিগুলি
পায়ের শেকলে আনছে ঝনৎকার স্বাধীন থৈ থৈ তা তা থৈ
চারদিকে সোর ওঠে আরে ভাই কেয়াবাৎ কামাল কর দিয়া
 ছিটকিনিও নেচে ওঠে উড়ে যায় খিল আর সারারাত জানলা দিয়ে দেখি

কার হাতে চাবুক সেটা দেখা যায় না শোনা যায় কেয়াবাৎ শুধু
তারাগুলি মুদ্রা হয়ে ঝরে পড়বে বলে যেন লেগে থাকে আকাশের গায়ে
কানায় কানায় উপচে পড়া
শেকলের ঝনৎকার খোলা পথে বেজে ওঠে পায়ে পায়ে থৈ তা তা থৈ
সবুজ কপিশ লালে স্বরে ও ব্যঞ্জনে
নিজেরই আহ্লাদ ভেবে নেচে ওঠে ছিটকিনি বা খিল

কার হাতে চাবুক সেটা দেখা যায় না শোনা যায় জানলা দিয়ে দেখি
শপাং শব্দে ঢেউ উঠছে স্বাধীন সংগৎ এ কী মুক্তি এ কী সুখ তন্দ্রাহারা

ছিটকিনি খুলে অক্ষরগুলি বেরিয়ে পড়েছে পথে আজ সারারাত বেলেল্লা নাচ হবে

*

মেয়েদের পাড়ায় পাড়ায়

‘তারপর আট মাসের মেয়েটিকে ভাসিয়ে দিয়ে যুবতী বধূটিও…’

মনে হয়       অনেকদিনই
সে কিছু       বলছিল না
ভেবেছে       অভাব তো নেই
দড়িরও না    কলসিরও না!  
যদি জল      সামনে থাকে
অতলে        বাঁধবে তাকে
সাত না–    হাজার পাকে
জলে কি      মন ছিল না?
 ভেবে সে     অনেকদিনই
কিছু আর     বলছিল না।

‘আমি কি       মানুষ নিয়ে
কেবলই        পুতুল খেলি?’
বলে সে        ‘আয়রে পুতুল
 জলে আজ    তোকেই ফেলি!
আহা রে        নতুন চোখে
একদিন        কোন্ আলো-কে
দেখে তুই      কিসের ঝোঁকে
 জড়াবি        বিয়ের চেলি
তার চেয়ে      আয় মামণি
আগে আজ    তোকেই ফেলি!’

তারপর        বিসর্জনের
জোড়া ঢাক       পাড়ায় পাড়ায়
এ-রকম          ঘটেই থাকে
 ভেবে লোক      কষ্ট তাড়ায়
 কিছুদিন          স্থির থাকে জল
 ছবিও            দেয় অবিকল
কবে ফের        মত্ত মাদল
সে-জলের        গ্রাসকে নাড়ায়
ভেবে সব        খুঁজছে পুতুল
মেয়েদের         পাড়ায় পাড়ায়!

*

খবর সাতাশে জুলাই

পরিচারিকার নিগ্রহ- ও. সি.-র স্ত্রী ধৃত
মালদহে দুটি খুন
গর্বাচভকে রেগন দিলেন চিঠি
 পারমাণবিক সাহায্য নিয়ে ফ্রান্স-পাক কথা হবে
আফ্রিকাজোড়া বিভীষিকাময় খরাকবলিত শিশুদের
 মুখ ভেবে আজ ইনভোরস্টেডিয়ামে
 সুপারস্টার
স্টার
 সুপারস্টার
 ধুম তাতা তাতা থৈ
 কিশোরীর নাকি হাতটান ছিল হাতটান
 গায়ে তাই ঢেলে দিয়েছে গরম জল
 অবশ্য তাকে দেখতেও যায় দুবেলা হাসপাতালে
ধুম তাতা তাতা থৈ তাতা তাতা থৈ
৬৬০ জন গেরিলা শান্তিশিবিরে
 দেখামাত্রই গুলি কারফিউ পশ্চিম দিল্লিতে
ভারত হারাল দক্ষিণ কোরিয়াকে
ফিগার কীভাবে রেখেছেন তার রহস্য বলা হবে এ-কাগজে
আরো বলা হবে মিলনের রূপরেখা
জেলাকংগ্রেসে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরমে
বোন তারা দুটি বোন তারা শুধু খেতে চায় রুটি চায়
এমন তো কিছু মারাও হয়নি ফোস্কা পড়েছে গায়ে
 পুড়ে গেছে শুধু কোমরের নীচ থেকে
ও. সি.-র মা ও স্ত্রী
আপাতত আছে জামিনে, তাছাড়া
আড়াইশো গ্রাম হেরোইন হাতে ধরা পড়ে শুধু একজন, আর
খরাকবলিত রহস্য নিয়ে নাচ হবে আজ ধুম তাতা তাতা ইনডোরস্টেডিয়ামে।

*

অন্ধবিলাপ

ধৃতরাষ্ট্র বললেন :

ধর্মক্ষেত্রে রণক্ষেত্রে সমবেত লোকজনেরা
সবাই মিলে কী করল তা বলো আমায় হে সঞ্জয়

অন্ধ আমি দেখতে পাই না, আমিই তবু রাজ্যশিরে
কাজেই কোথায় কী ঘটছে তা সবই আমায় জানতে হবে

সবই আমায় বুঝতে হবে কার হাতে কোন অস্ত্র মজুত
 কিংবা কে কোন্ লড়াইধাঁচে আড়াল থেকে ঘাপটি মারে

অন্ধ আমি, দেখতে পাই না, আমিই তবু রাজ্যশিরে
এবং লোকে বলে এদেশ যে তিমিরে সেই তিমিরে

কারা এসব রটিয়ে বেড়ায় বলো আমায় হে সঞ্জয়
অন্ধ আমি, কিন্তু তবু এসব আমায় জানতে হবে

তেমন তেমন তম্বি করলে বাঁচবে না একজনার পিঠও
জানিয়ে দিয়ো খুবই শক্ত বল্গাতে এই রাষ্ট্র ধৃত

অসম্ভবের কুলায় আমার পালক দিয়ে বুলিয়ে যাবে
সেই আশাতে ঘর বাঁধিনি, দুর্যোধনরা তৈরি আছে

এবং যত বৈরী আছে তাদের মগজ চিবিয়ে খাবে
খাচ্ছে কি না সেই কথাটা জানাও আমায় হে সঞ্জয়

সামান্য এক ছটাক জমি ছাড়বে কেন আমার ছেলে
আমার সঙ্গে ভূমিসেনা আমার সঙ্গে ভূস্বামীরা

আমার সঙ্গে দ্রোণ বা কৃপ আমার সঙ্গে ভীষ্মবিদুর
সেদিক থেকে দেখতে গেলে ধর্মরাজ্য এমন কী দূর

দুষ্টে বলে, মনে মনে তারা আমার কেউ না কি নয়
সেটাও যদি সত্যি হয় তো একাই একশো আমার ছেলে

তারাই জানে শমনদমন, ধ্বংস দিনে ধ্বংস রাতে
ছড়িয়ে যাবে ঘটল যা সব আরওয়ালে কানসারাতে

যে যা করে তাকে তো তার নিশ্চিত ফল ভুগতে হবে
কোথায় যাবে পালিয়ে, দেখো সামনে আমার সৈন্যব্যূহ

তিনদিকে তিন দেয়াল ঘেরা সাতান্ন রাউন্ড গান্ধীমাঠে
 ভিজল মাটি ভিজল মাটি ভিজুক মাটি রক্তপাতে।

অধর্ম? কে ধর্ম মানে? আমার ধর্ম শত্রুনাশন
নিরস্ত্রকে মারব না তা সবসময় কি মানতে পারি?

মারব না কি নির্ভুমিকে? নিরন্নকে? নিরস্ত্রকে?
অবশ্য কেউ মেরেছিল সেটাই বা কে প্রমাণ করে!

এখন আমার মনে পড়ে বেদব্যাস যা বলেছিলেন
 সৈন্যে শস্ত্র ছুঁড়ছে তা নয়- কোষ থেকে তা আপনি ছোটে

মাঝেমাঝেই ছুটবে এমন- ব্যাস তো জানেন আমার দশা
এই যে আমার একশো ছেলে- কেউ বশে নয় এরা আমার

এইরকমই অন্ধ আমি, আমিই তবু রাজ্যশিরে
–কিন্তু কারা শপথ নিল নিজেরই হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে?

ধানজমিতে খাসজমিতে সমবেত লোকজনেরা
ধেয়ে আসছে সামন্তদের– কেন এ দুঃস্বপ্ন দেখি?

পুব থেকে পশ্চিমের থেকে উত্তরে বা দক্ষিণে কে
অক্ষৌহিণী ঘিরবে বলে ফন্দি করে আসছে ঝেঁপে?

লোহার বর্মে সাজিয়ে রাখি কেউ যেন না জাপটে ধরে
স্বপ্নে তবু এগিয়ে আসে নারাচ ভল্ল খড়্গ তোমর–

এখন আমার মনে পড়ে বেদব্যাস যা বলেছিলেন
নিদেনকালে সমস্তদিক নাশকচিহ্নে ছড়িয়ে যাবে

সন্ধ্যাকাশে দুই পাশে দুই শাদালালের প্রান্ত নিয়ে
কৃষ্ণগ্রীব মেঘ ঘুরবে বিদ্যুদ্দামমণ্ডিত

বাজশকুনে হাড়গিলেতে ভরবে উঁচু গাছের চুড়ো
তাকিয়ে থাকবে লোহার ঠোঁটে খুবলে খাবে মাংস কখন

মেঘ ঝরাবে ধুলো, মেঘেই মাংসকণা ছড়িয়ে যাবে
হাতির পিঠে লাফিয়ে যাবে বেলেহাঁস আর হাজার ফড়িং

কাজেই বলো, হে সঞ্জয়, কোন্ দিকে কার পাল্লা ভারী?
জিতব? না কি নিদেনকালের জাঁতায় পিষে মরব এবার?

সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধেক কি ছাড়তে হবে?
 টুকরো টুকরো করব কি দেশ পিছিয়ে গিয়ে সগৌরবে?

যে যাই বলুক এটাই ধ্রুব- আমার দিকেই ভিড়ছে যুব
তবুও শুধু ব্যাস যা বলেন সেটাই কি সব ফলবে তবে?

ফলুক, তবু শেষ দেখে যাই, ন্যাংটার নেই বাটপাড়ে ভয়
ইঙ্গিতে-বা বলছে লোকে আমার না কি মরণদশা

বাজশকুনে হাড়গিলেতে তাকিয়ে আছে লোহার ঠোঁটে–
 ধানজমিতে খাসজমিতে জমছে লোকে কোন্ শপথে

কিসের ধ্বনি জাগায় দূরে দিকে এবং দিগন্তরে
দেবদত্ত পাঞ্চজন্য মণিপুষ্পক পৌণ্ড্র সুঘোষ

শেষের সে-রোষ ভয়ংকরী সেই কথাটা বুঝতে পারি
 কিন্তু তবু অন্ধ আমি, ব্যাসকে তো তা বলেইছিলাম

বলেছিলাম এটাই গতি, ভবিতব্য এটাই আমার
আমার পাপেই উশকে উঠবে হয়তো-বা সব খেত বা খামার

আমার পাপেই উশকে উঠুক মহেশ্বরের প্রলয়পিনাক
 সর্বনাশের সীমায় সবাই যায় যদি তো শেষ হয়ে যাক

কোন্ খেতে বা কোন্ খামারে সমবেত লোকজনেরা
জমছে এসে শস্ত্রপাণি বলো আমায় হে সঞ্জয়

সমবেত লোকজনেরা কোথায় কখন কী করছে তা  
শোনাও আমায়, অন্ধ আমি, শোনাও আমায় হে সঞ্জয়

শোনাও আমায় শোনাও আমায় শেষের সেদিন হে সঞ্জয়!

*

শিশুরাও জেনে গেছে

কী হতভাগ্য সেই দিন যখন শিশুরাও জেনে গেছে গাছ কখনো কথা বলতে পারে
না আর সাতভাই চম্পাকে ডাকতেও পারে না কোনো পারুলবোনের
রূপকথা

কী হতভাগ্য সেই দিন যখন বুকের ভিতর দিকে ছুটে যায় বাঁধভাঙা জল কিন্তু
চোখ তাকে ফিরেও ডাকে না শুধু অযুত আতশবাজি শোভা হতে হতে
শূন্যের গহ্বরে ভেঙে অন্ধ হয়ে দেখে

পাথরের মুখচ্ছবি নেই কিন্তু মুখের পাথরছবি আছে

কী হতভাগ্য সেই দিন যখন গর্জনতল ভুলে শুকনো দাঁড়িয়ে থাকে নিঃস্বপ্ন
প্রতিমা কোনো গাছ আর একটাও কথা বলতে পারে না এই হিমানীর
ঘরে

কী হতভাগ্য সেই দিন যখন চম্পাকে বুক ভরে ডাকতেও পারে কোনো পারুল
আর শিশুরাও জেনে গেছে সেইসব কথা।

*

যন্ত্রের এপার থেকে

যন্ত্রের এপার থেকে কথা বলতে বলতে শব্দগুলি জলস্তম্ভ তোমাকে তারা ছুঁতে
পারে না আর তুমিও দেখতে পাও না মুখচ্ছবি কোথায় কীভাবে ভাঙে
কেননা কেবলই স্তম্ভ, জল নেই স্নানজল নেই
অথবা বালির ঝড় উলটোমুখে ছুটে যাওয়া পথে পথে পেতে রাখা জালগুলি কিছু
ওড়ে কিছুবা জড়িয়ে যায় পায়ের ভিতরে তার অন্ধকারে মজ্জার ভিতরে
আমি বলি এই শব্দ ছিল শুধু নৌকো হয়ে তোমাকে সে তুলে আনবে আমার ঘুমের
কাছে বিশ্ববিকাশের কাছে যে-কোনো ঘুমের মধ্যে নতুন জন্মের ভ্রূণ আছে
ভেবে ডাক দিই শোনো
যন্ত্রের এপার থেকে সেইসব শব্দ আজ ঘূর্ণমান সুদর্শনে ছিঁড়ে দেয় অর্থদল নতুন
জন্মের কথা গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ে এধারে ওধারে আর তোমাকে ছোঁয়
না তারা, তাই

প্রতিটি মুহূর্ত দিয়ে অবিচুয়ারির স্তূপ গেঁথে
যন্ত্রের এপারে আমি বসে থাকি বসে থেকে ভাবি যদি একদিন কোনো এক
রাত্রিবেলা অতর্কিত অন্ধকারে তোমার বুকের সব রুদ্ধ পাপড়ি খুলে
 খুলে শহর সমুদ্রে নামে

শহর সমুদ্রে নামে স্নান নিতে, ঘুমের ভিতরে।

*

ভালোবাসা অর্ধেক স্থপতি

যখন এক জীবনের কাজের আমূল ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে ভাবি এইবার
তাহলে কোনদিকে যাব
যখন এক পা থেকে আরেক পায়ের দূরত্ব মনে হয় অলীক যোজন ছায়ায় ঝাপসা
হয়ে-থাকা স্থিরতা
যখন মূর্তির কোনো-এক নিরর্থ খণ্ড হাতে তুলে নিয়ে মনে পড়ে কোন্ মূখের স্বর্গে
ছিল আমার বসবাস
কেননা ভেবেছিলাম আমিই তো জাগিয়ে তুলতে পারি তোমার হৃৎপিণ্ড, তোমার
সত্তা

যখন সেই স্তূপের ভিতর থেকে কেঁপে ওঠে শুধু হাজার হাজার নিষ্প্রাণ আঙুলের
উৎক্ষেপ .
যখন তার অনুচ্চার অভিযোগ গড়িয়ে পড়তে থাকে আমার সমস্ত ব্যর্থতার গায়ের
ওপর আগুনের ঝর্না
যখন কোষগুলির মধ্যে চিৎকার শোনা যায় বলো তাহলে বলল এইবার কোন্ পথ
আর বাকি রইল অবাধ আস্তরণের সামনে
 ঠিক তখনই স্বপ্নের চেয়েও মিথ্যে এই ভ্রষ্ট সচলতার দিকে তাকিয়ে আজ খুঁজে
বেড়াই অন্য আরো অর্ধেক, কেননা

ভালোবাসা অর্ধেক স্থপতি!

*

তাই এত শুকনো হয়ে আছো

অনেকদিন মেঘের সঙ্গে কথা বলোনি তাই এত শুকনো হয়ে আছো এসো তোমার
মুখ মুছিয়ে দিই
 সকলেই শিল্প খোঁজে রূপ খোঁজে আমাদের শিল্পরূপে কাজ নেই আমরা এখানে
বসে দু-একটি মুহূর্তের শস্যফলনের কথা বলি
 এখন কেমন আছো বহুদিন ছুঁয়ে তো দেখিনি শুধু জেনে গেছি ফাটলে ফাটলে
নীল ভগ্নাবশেষ জমে আছে  
দেখো এই বীজগুলি ভিখারির অধম ভিখারি তারা জল চায় বৃষ্টি চায় ওতপোত
অন্ধকারও চায়
তুমিও চেয়েছ ট্রামে ফিরে আসবার আগে এবার তাহলে কোনো দীর্ঘতম শেষকথা
হোক
 অবশ্য, কাকেই-বা বলে শেষ কথা। শুধু
দৃষ্টি পেলে সমস্ত শরীর গলে ঝরে যায় মাটির উপরে, আর ভিখারিরও কাতরতা
ফেটে যায় শস্যের দানায় এসো মেঘ ছুঁয়ে বসি আজ বহুদিন পর এই
 হলুদডোবানো সন্ধ্যাবেলা।

*

টলমল পাহাড়

তোমার মৃত চোখের পাতা ভেঙে উঠে আসছে বাষ্পগহ্বর আর তাকে ঢেকে দিতে
চাইছে কোনো অদৃশ্য হাত যখন চারপাশে ফাটলে ফাটলে ভরে গিয়েছে
টলমল পাহাড়
 দৃষ্টিহারা কোটরের প্রগাঢ় কোলে ঝর্ঝর গড়িয়ে নামছে অবিরাম কত নুড়িপাথর
আর আমরা হলুদ হতে থাকা শ্বেতকরোটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি স্থির–
 যেন কুয়াশার ভিতর থেকে উঠে আসছে চাঁদ
 অথচ শনাক্ত করা যায় না আজও এত অভিসম্পাতের ভিতরে ভিতরে বিষাক্ত
লতাবীজের ঘন পরম্পরা কে তোমার মুখে তুলে দিয়েছিল সেদিন, ঝিমধরা
 শীতরাত্রির অবসরে।

আমি জীবনেরই কথা বলি যখন এই নীল অধোনীল নিশ্বাসের প্রতিচ্ছায়ায় ছড়িয়ে
থাকা পাতাগুলি কেঁপে উঠতে থাকে বাসুকীর শিরে আর মর্মের মর্মরে
হা হা করে ওঠে তরাইয়ের জঙ্গল
আমি জীবনেরই কথা বলি যখন জান্তব পদচ্ছাপ দেখতে দেখতে ঢুকে যাই দিগম্বর
অন্ধকারের ভিতরে ভিতরে কোনো আরক্তিম আত্মঘাতের ঝুঁকেথাকা
কিনারায়
আমি জীবনেরই কথা বলি যখন তোমার মৃত চোখের পাতার ওপর থেকে অদৃশ্য
হাত সরিয়ে নিয়ে কোটরে কোটরে রেখে যাই আমার অধিকারহীন আপ্লুত
চুম্বন–

তোমার মৃত চোখের পাতা ভেঙে উঠে আসছে বাষ্পগহ্বর আর তাকে ঢেকে দিতে
চাইছে কোনো অদৃশ্য অশ্রুত হাত এই টলমল পাহাড়।

*

সৈকত

আজ আর কোনো সময় নেই এই সমস্ত কথাই লিখে রাখতে হবে এই সমস্ত কথাই যে নিঃশব্দ সৈকতে রাত তিনটের বালির ঝড় চাঁদের দিকে উড়তে উড়তে হাহাকারের রুপোলি পরতে পরতে খুলে যেতে দেয় সব অবৈধতা আর সব হাড়পাজরের শাদাধুলো অবাধে ঘুরতে থাকে নক্ষত্রে নক্ষত্রে শুধু একবার একবারই ছুঁতে চায় ব’লে।

আর নীচে দুইপাশে কেয়াগাছ রেখে ভিতরের সরু পথ যেমন গিয়েছে চলে অজানা অটুট কোনো মসৃণ গ্রামের মুখে এখনও যে তা ঠিক তেমনই অক্ষত আছে সেকথা বলাও শক্ত তবু এই সজল গহ্বর এই সর্বস্ব মাতন নিয়ে এ রাতের সমুদ্রবিস্তার তার স্তনন শোনায় যতদূর,

সে-পর্যন্ত জেগো না ঘুমন্ত জন ঘুমাও ঘুমাও ওই গ্রামের উপরে উড়ে পড়ুক নিঃশব্দ সব বালি আর তোমাকেও অতর্কিতে তুলে নিক নিঃসময় কোলে নিক অন্ধকারে কিংবা আলো-আঁধারের জলসীমানায় নিক পদ্মের কোমল ভেদে মৃত্যু এসে দাঁড়াক জন্মের ঠোঁট ছুঁয়ে

আজ আর সময় নেই সমস্ত কথাই আজ লিখে রাখতে হবে এই সমস্ত কথাই
এই সমস্ত কথাই