ধীরে রজনি!
পাশের বাড়িতে শানাই বাজিতেছে। কি মধুর শানাই বাজিতেছে। আজ ও-বাড়ির একটি মেয়ের বিবাহ।
মেয়েটিকে আমি দেখিয়াছি। নবোদ্ভিন্ন যৌবন, কিন্তু যৌবনরাজের মন্ত্রে দীক্ষিত হয় নাই। চোখের দৃষ্টিতে বিস্ময় আর আনন্দ।
মেয়েটির নাম শুনিয়াছি,—রজনী।
আজ তাহার বিবাহ।
ধীরে, রজনি,—ধীরে!
এখনও তুমি অন্ধ, তাই তোমার চোখে এত বিস্ময়, এত আনন্দ। যখন সোনার কাঠি স্পর্শে তোমার অন্ধতা ঘুচিয়া যাইবে, তখনও যেন তোমার দৃষ্টির বিস্ময় আর আনন্দ ঘুচিয়া না যায়। ধীরে রজনি—
তোমার হাতে প্রদীপ জ্বলিতেছে, আর জ্বলিতেছে তোমার অকলঙ্ক দেহবর্তিকায় কুমারী-মনের নিষ্কম্প শিখা। এই স্নিগ্ধ নির্মল দীপালোকে তোমার বাসরগৃহ আলোকিত হোক্।
আজ যে পথে তোমার অলক্ত-রাঙা চরণ অৰ্পণ করিলে, অভিসারিকার মতো তুমি চিরদিন সে পথে চলিও—সংগোপনে, কম্প্রবক্ষে, স্বপ্নবিজড়িত নেত্রে।
ওগো বধূ, রাখো তোমার লাজ
রাখো লাজ;
অতি যত্নে সীমন্তটি চিরে
সিঁদুর বিন্দু আঁকো নাই কি শিরে,
হয়নি সন্ধ্যা সাজ?
দয়িত যে তোমার প্রতীক্ষা করিতেছে—অধীর উদ্বেল হৃদয়ে নবীনা অভিসারিকার পথ চাহিয়া আছে। তবু—ধীরে রজনি—। মন্দং নিধেহি চরণেী। লঘু মন্থর পদে অভিসার-গৃহে প্রবেশ কর। অয়ি প্রথম-প্রণয়ভীতে, ব্ৰীড়ায় সমস্ত দেহ আবৃত করিয়া তুমি প্রিয়-সমাগম কর। তোমার সুমধুর আনন্দ-বিস্ময়-মাখা অন্ধতা ঘুচিয়া যাক্—
When beauty and beauty meet,
All naked fair to fair—
Th earth is crying—sweet—
And scattering—bright the air
Eddying, dizzying, closing round
With soft and druken laughter
Veiling all that may befall.
After—after—
নন্দনবন-মধুপূর্ণ পাত্র তুমি পান কর। অয়ি কুমারি, তুমি নারী হও—তবু—ধীরে, রজনি—ধীরে—
শানাইয়ের সুরের সঙ্গে মিশিয়া মনটা বোধ হয় কাব্যলোকে উত্তীর্ণ হইয়াছিল, হঠাৎ ঝন্ঝন্ শব্দে বাস্তবলোকে নামিয়া আসিলাম। পাশের ঘরে দাদা ও বৌদিদির কথাবার্তা কানে আসিল।
দাদা খিঁচাইয়া বলিলেন, ‘জামাতে যে একটাও বোতাম নেই, এটা কি চোখে দেখতে পাও না?’
বৌদিদি জবাব দিলেন, ‘পারব না আমি। থাকে না কেন বোতাম? তোমার যদি দশটা দাসী-বাঁদী থাকে তাদের দিয়ে সেলাই করিয়ে নাওগে।’
দাদা বলিলেন, ‘তা তো বটেই, নবাব-বংশের মেয়ে তুমি, বোতাম সেলাই করতে পারবে কেন!’
বৌদিদি ঝাঁঝিয়া উঠিলেন, ‘খবরদার বলছি, বাপ তুললে ভাল হবে না। তুমি কোন নবাব-বংশের ছেলে শুনি? ভাত-কাপড়ের কেউ নয়, কিল মারবার গোঁসাই।…ওরে লক্ষ্মীছাড়া, তুই থাম্বি, না কেবল বাপের মতো চেঁচাবি?’—বলিয়া দুই বছরের ছেলেটাকে দুম্দুম্ করিয়া পিটিতে লাগিলেন। ছেলেটা ব্যা ব্যা করিয়া তারস্বরে চিৎকার জুড়িয়া দিল।
এই সময় পাশের বাড়ির দরজায় ঘন ঘন শঙ্খ ও হুলুধ্বনি শুনা গেল। বর আসিয়াছে। বিবাহের আর দেরি নাই। এখনই দুইটি মানব-মানবী অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া পড়িবে! আমি লাফাইয়া গিয়া জানালা হইতে মুখ বাড়াইয়া চিৎকার করিয়া উঠিলাম, ‘ধীরে, রজনি—ধীরে!’
কিন্তু শঙ্খ ও হুলুধ্বনিতে আমার গলা চাপা পড়িয়া গেল।
১৩৪৪