দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

ধিন তাকের ব্যাটা

ধিন তাকের ব্যাটা

মাঝে-মাঝে মনে হতে পারে কেন? আমরা বেঁচে আছি। কী কারণে! পৃথিবীকে কী দিয়েছি? পৃথিবীই বা আমাকে কী দিতে পেরেছে! কেউ তো কিছু দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। এই দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটা সেই প্রথম ট্যাঁ করার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে। মায়ের কোলে শুয়ে আছে শিশু। প্রতিবেশী মহিলা ঝুঁকে পড়ে দেখলেন। দেখে ‘ও মা কি সুন্দর দেখতে হয়েছে, যেন রাজপুত্তুর গো!’ ছেলে অমনি কোলে-কোলে ঘুরতে লাগল। এ চুমু খায়, ও চুমু খায়। খোকা খলখল হাসে। হাত-পা ছোঁড়ে। তাকে কোলে নেওয়ার জন্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়! শিশু তার মোহন রূপে আদায় করে নেয় ভালোবাসা। এইবার শিশুটি যদি কুৎসিত হয়, প্রতিবেশিনীরা এসে উঁকি মেরে বলে, ‘ম্যা গো, কী পেঁচার মতো দেখতে হয়েছে গো।’ শিশুটি পড়ে থাকে একপাশে। কেঁদে বাড়ি মাথায় করলেও ছুটে এসে কেউ বুকে তুলে নেয় না। এক তার মা! যতই হোক মা তো! ফেলতে পারে না। সামলাতে বাধ্য হয়। শরীর ছেঁড়া ধন। মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে চড়চাপড়ও চালিয়ে দেয়। কেউ প্রতিবাদ করে না। বরং বলে, যেমন রূপ, তেমন তার গুণ। গলা দ্যাখো যেন ফাটা বাঁশ। শিশুটি আদায় করে নেওয়ার মতো কিছু পুঁজি আনতে পারেনি। বেচারার বরাতে চড়চাপড় আর গালাগাল ছাড়া কী জুটবে! আরও একটা ব্যাপার আছে, সেই অদৃশ্য প্রভুর বিচারে কেউ কেউ আবার সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়। যতদিন না সে সাবালক হচ্ছে, ততদিন তার বরাতে জোটে রাজভোগ।

এই সাবালক হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তার সঙ্গেই পৃথিবীর অন্য ব্যবহার। তখন নিজেকে ভাঙাতে হয়। শক্তি, গুণ, মেধা, বুদ্ধি। তখন নিজেকে সচল হতে হয়। ডিগ্রি, ডিপ্লমা কুড়োতে হয়। চাকরি অথবা জীবিকার ধান্দা করতে হয়। শুধু পণ্ডিত হলে কদর নেই। রোজগার চাই। যার যত কামাই, তার তত খাতির। বড় ছেলের বিরাট কামাই, তার পাতে মাছের মুড়ো। বাড়ির দক্ষিণ-খোলা সেরা ঘরটি তার দখলে। শহরের সেরা মেয়েদের অভিবাবকরা হামলে পড়েছেন। কে কার মেয়েকে ওই মহামানবের পদতলে অঞ্জলি দেবেন। নিলামের মতো ছেলের বাজারদর বাড়ছে। ক্রমশই বাড়ছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে সেই এলেমদার শুধু এক সুন্দরী লটকে আনবে না, সঙ্গে আনবে হরেকরকম্বা। ফ্রিজ, কালার টিভি, ওয়াশিং মেশিন, স্টিরিও মিউজিক সিস্টেম। একজনের মেয়ে একটু শ্যামলা। তিনি সেই রঙের খামতি সামাল দিতে চাইলেন একটা মোটরগাড়ি দিয়ে। এক মেয়ের বাবা শহরের এক পাশে পাঁচকাঠা জমির ওপর দোতলা একটা বাড়ি দিতে চেয়েছেন। কম্পিটিশান লেগে গেছে। লোভে ছেলের বাবা আর মায়ের চোখ জ্বলজ্বল করতে শুরু করেছে। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন, ছেলে আমাদের সোনায় চাঁদ।

ওদিকে ছোট ছেলে। রোগা-পাতলা। চোখে পুরু লেনসের চশমা। বাংলার এম. এ.। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। পড়ে পড়ে বেচারার চোখ গেছে। হজমশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে। তার সর্ববিষয়ে অসীম জ্ঞান। ভালোমানুষ, তেমন চালক-চতুর, মুখ-ফোঁড় নয়, তাই চাকরি জোটাতে পারেনি। পড়ে আছে এখনও বাবার হোটেলে অচল টাকার মতো। তাই তার কোনও খাতির নেই। না ঘরে, না বাইরে। তার ভালো নাম ভুলে লোকে বলে ঢ্যাঁড়স। ভেন্ডিকুমার। এ যুগে মানুষের বিচার টাকা দিয়ে। ক্ষমতা আর তার প্রতিপত্তি দিয়ে। সেইটাই তার নেই। সংসারে তার খবর কেউ রাখে না। সে কখন আসে, কখন যায়, কী খায়, কেউ জানে না। তার খাবার একপাশে ঢাকা পড়ে থাকে। খাবার সময় তার সামনে কেউ বসে থাকে না। চেয়ে-চেয়ে সে এক কাপ চা-ও পায় না। এত অবহেলা, তবু সে হাসে। তবু সে সবার আগে এগিয়ে যায় মানুষের উপকারে। সে যখন ছাত্র ছিল, তখন একটি মেয়ে তার সঙ্গে প্রেম করেছিল। পরে সে তার ভুল বুঝে সরে গেছে। সরে গিয়ে এক মোটা মাইনের ইঞ্জিনিয়ারের গলায় দোল খাচ্ছে। প্রেম মানে তো আর নরম নরম কথা নয়। রকম-রকম শাড়ি কে দেবে? কে দেবে ভোগ, স্ট্যাটাস, সম্মান, বেহিসেবী খরচের রেস্ত। ঢ্যাঁড়সকুমার হলে কবিতা শোনাত। নীল আকাশে চাঁদের শোভা দেখাত, রবীন্দ্রসংগীত শোনাত। মেয়েকে সবাই বাহবা দিলে। বুদ্ধিমতী একেই বলে। দুবাইয়ের ইঞ্জিনিয়ার সোনা দিয়ে বউকে মুড়ে দিয়েছে। শ্বশুড়বাড়িতে বিদেশি মালের বন্যা বইছে। মেয়ের শরীরে পান-ভোজনের কল্যাণে কাশ্মীরি আপেলের রং ধরেছে।

শুধু চাকরি করলেই কদর বাড়ে না। বছরের পর বছর পড়ে আছে একই পদে। ঘষটাচ্ছে। আর সেই অপদার্থটাকে টপকে অন্য সবাই চলে যাচ্ছে ওপর দিকে। সে-ও এই জগতের বিচারে ‘ঢ্যাঁড়স’। সে কেবল অবাক হয়। জান লড়িয়ে কাজ করছে। ফাঁকি মারা নেই, কথায় কথায় ছুটি-ছাঁটা নেই, বিদোবুদ্ধি রয়েছে, সাধু-সৎ, তাহলে কেন এমন হচ্ছে! সেই এক সত্য, কেউ যেচে দেয় না। আদায় করে নিতে হয়। শুধু কাজ দেখালে তোমার ঘোড়ার ডিম হবে। মনোরঞ্জন করো। তেলের ফর্মূলাটা জেনে নাও কায়দা করে, তারপর মালিশ করো বড়কর্তার শ্রীঅঙ্গে। কর্তাভজা না হলে চাকরি-জীবনে তোমার সিদ্ধিলাভ অসম্ভব। ওই জন্যে বলে—গুরু কৃপাহি কেবলম। সাধন চাই।

বউ বলবে, ‘তোমার মতো গর্দভ আমি দুটো দেখিনি। ভগবান তোমার বাঁ-হাতটা কী জন্যে দিয়েছিলেন? শুধুই শোভা, না শরীরের ভারসাম্য, ব্যালেন্স। ব্যবহার-বিধিটা শেখো।’ সেটা কী? আরে, এই জগতের আসল কামাই তো বাঁ-হাতের রে ভাই! তাইতেই লোক বাড়ি করে, গাড়ি করে, গড়গড়া নিয়ে ফরাসে গড়াগড়ি যায়।

তারপর কী হয়! আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, যে যেখানে আছে সব তেড়ে আসে, দেহি দেহি রবে। মেয়ের বিয়ে দেবো, কিছু চাই। ছেলের পরীক্ষার ফিজ দিতে হবে। অমুকের ছেলের বিয়ে, পাঁচশো টাকা দামের শাড়ি দিতে না পারলে প্রেস্টিজ থাকে না। যখন অবস্থা তেমন ছিল না, পরিবারে কারোর অসুখ করলে সাধারণ ডাক্তার আসতেন, এক ডজন ক্যাপসুলেই রোগী চাঙ্গা। সেই বাঁ-হাতের কামাইয়ে দুটো পয়সা হল, অমনি শুরু হল স্পেশালিস্ট, নার্সিংহোম, স্ক্যানিং, বায়ু-পরিবর্তন। উৎপাতের ধন চিৎপাতে।

তারপর, শেষের সেদিন অতি ভয়ঙ্কর। সেই ছড়ায় আছে, ‘ধিন তাকের ব্যাটা তিন তাক। আমি নিতে থাকি তুই দিতে থাক।’ লেনেওয়ালা পার্টিদের আর টিকির দর্শন পাওয়া গেল না জীবনের শেষ ভাগে। তারা সব উড়ে গেছে অন্য মক্কেলের আস্তানায়। কর্তা ময়লা বিছানায় বসে হাঁপানির কাশি ধরেছেন। ছেলেরা বলছে—আর সহ্য হয় না, দিনরাত এই কাশি। বুড়ো ব্যাটা নড়েও না, মরেও না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *