ধার্মিক
মহেশ গাঙ্গুলি লোকটা বড় ধার্মিক। কিন্তু একেবারে চার পো কলি, ধাৰ্মিক লোকের আর ভদ্রস্থ নাই; যত অত্যাচার তাহাদেরই উপর।
গঙ্গার ঘাটে বসিয়া মহেশ গাঙ্গুলি সেই কথাই ভাবিতেছিল। কাল মাখন চৌধুরী গরুটা খোঁয়াড়ে দিয়াছে।
বেশ, তোর কথাই মেনে নিলাম, অবলা জীব, এই নিয়ে পাঁচ-পাঁচ বারই গেছে বেড়া ভেঙে; কিন্তু তোর বাগান কি উজোর করে ফেলত? বড় বাড় বেড়েছিস মাখনা। কিন্তু অবোধ জীব হলেও গরু সাক্ষাৎ ভগবতী তা জানিস, এত অহঙ্কার সইবে না। এই মা- গঙ্গার সামনে বসে প্রাতবাক্যে বলছি, যাবি—যাবি—যাবি। অন্যের অনিষ্ট কখনও মনে ও আনি নি, আমার কথা ফলবেই, দেখে নিস।
হাতের তেলোয় খানিকটা তেল ঢালিয়া লইয়া সজোরে নস্য করিয়া লইল। তাহার পর তেলটা দুই হাতে মাখিতে মাখিতে গঙ্গার পানে একবার চাহিয়া লইয়া বলিল, নাঃ, ফলেই বা আর কই মা, কলিতে তোমার মাহাত্ম্য আর রইল কই? নইলে জীবন কুণ্ডু, বেটা কেওট, ছেলের অসুখের দোহাই দিয়ে সুদ দিলে না, বাড়ির মধ্যে বামুনকে অমন কটুকাটব্য করলে, উলটে ছেলেটা চাঙ্গা হয়ে উঠল! আর মাহাত্ম্যর গুমর ক’রো না, যেদিন থেকে সাধ করে পায়ে ইংরেজের বেড়ি পরেছ, সেই দিন থেকেই তোমার মাহাত্ম্য গেছে। তা হক-কথা বলব বইকি মা।
প্রায় শূন্য ঘাট। সকালবেলা মেয়ে-বুড়োদের স্নান, তাহার পর ডেলি প্যাসেঞ্জারদের পালা, এখন ক্বচিৎ এক-আধজন মাঝে মাঝে আসিতেছে, দুই-একটা কথা, তাহার পর স্নান করিয়া চলিয়া যাইতেছে। গাঙ্গুলি গঙ্গাস্নানের সাত-হাতী কাপড়টি পরিয়া তেল মাখিতেছে আর কলিতে অধর্মের দৌড় সম্বন্ধে মনে মনে চিন্তাকুল হইয়া উঠিতেছে।
মাধব গয়লার মেয়েটা জল লইতে নামিল, আবার জল ভরিয়া ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙিয়া চলিয়া গেল।
চিন্তাস্রোতে একটু বাধা পড়িল, মেয়েটা উপরের আগাছার আড়ালে একেবারে অদৃশ্য হইয়া গেলে গাঙ্গুলির সম্বিৎ হইল, দৃষ্টি ফিরাইয়া একেবারে গঙ্গার পানে চাহিয়া বলিল, তাই দেখছিলাম না, আমার সেই পুজোর ঘটিটার কাঁসাটাও ঠিক মেদোর মেয়েটার ওই কলসীর কাঁসার মত ছিল কিনা, মনে পড়ে গেল, তাই ঠায় দেখছিলাম। গেল তো? নেয়ে উঠে অশথ-গোড়ায় বুড়ো শিবের মাথায় একছিটে করে জল দিচ্ছিলাম, সেটুকুও বন্ধ হল তো? আর গেল কিনা তোমার চোখের সামনে এই গঙ্গার ঘাটেই। ধর্ম-কর্মের জিনিস, করকরে একটি টাকা—বুকের রক্ত, তাই দিয়ে কেনা, নিক, কিন্তু ও ঘটি আর সরতে হবে না। তোমাতে যদি ভক্তি থাকে মা, কায়মনোবাক্যেও যদি কারও অনিষ্ট-চিন্তা না করে থাকি—
এমন সময় হুড়মুড় করিয়া একদল পশ্চিমা ঘাটের উপর আসিয়া দাঁড়াইল। দুই- তিনজন গঙ্গাবক্ষে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া কহিল, হউ আবতা।
মেয়ে পুরুষ কাচ্চাবাচ্চায় বেশ সুপুষ্ট দলটি। সঙ্গে পোঁটলা-পুঁটলি হাঁড়িকুড়ি লোটাকম্বলে অনেকগুলি লটবহর। বেশ বোঝা যায়, মুলুক হইতে আসিতেছে, এখানে স্টেশনে নামিয়াছে, গঙ্গা পার হইয়া ও-পারে কর্মস্থানে যাইবে।
এরা ভুল করিয়াছে, এটা ফেরি-ঘাট নয়, ফেরি-ঘাটটা আর একটু সরিয়া ডানপাশে। ঠিক সামনাসামনি ও-পারের ঘাট হইতে দুইটা ফেরির নৌকা ছাড়িয়াছে। সেই দুইটাকে লক্ষ্য করিয়াই ‘হউ আবতা’ অর্থাৎ ওই আসছে। কিন্তু ও দুইটা এ ঘাটে লাগিবে না। মহেশ গাঙ্গুলি ধার্মিক হইয়াও পরোপকারব্রতী হইয়াও কথাটা কেন জানাইয়া দিল না বলা শক্ত। একটি কচি ছেলে জল খাওয়ার জন্য, “দিদি, দিদি’ করিয়া কান্না ধরিয়াছে। তাহার দিদি একটা ঘটি লইয়া চঞ্চল গতিতে ঘাটের রানা ভাঙিয়া নামিয়া গেল, খানিকটা জলে নামিয়া ঘাটের দিকে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইল, তাহার পর মাথার কাপড়টা খুলিয়া মুখে, কপালে, সামনের চুলে আঁজলা আঁজলা জল ছিটাইতে ছিটাইতে ওরই মধ্যে হাসির সঙ্গে চিৎকার করিয়া ভাইকে সান্ত্বনা দিতে লাগিল চুপ কর, এই এলাম ব’লে, চুপ কর্ বউয়া।
অথচ জল পাইয়া আর নড়িবার নাম নাই। সতেরো-আঠারো বছরের ধাড়ি, আচ্ছা বেয়াক্কেলে তো! ঠায় দেখিয়া দেখিয়া মহেশ গাঙ্গুলির রাগে আর বাকস্ফূৰ্তি হইতেছিল না।
মহেশ গাঙ্গুলি যে রাগিয়াছে, এটা আমার আন্দাজ, ধার্মিক লোক বলিয়া আন্দাজ করিতেছি তবে বাস্ফূর্তি যে হইতেছে না, এটা আন্দাজ নয়। সত্যই বাস্ফূৰ্তি হইতেছে না! এবং চোখ ফিরাইতে পারিতেছে না। যাহার উপর রাগা যায়, তাহার মুখের উপর হইতে কি চোখ ফেরানো যায়? যে কাহারও উপর রাগিয়া দেখুন না।
মেয়েটার সঙ্গে এদিকে তাহার মায়ের তুমুল বচসা লাগিয়া গিয়াছে। ছেলেটা কাঁদিয়া সারা, ওদিকে মুখ ধোওয়া আর শেষ হয় না; বেহায়া, লজ্জা-শরমের মাথা খাইয়া বসিয়া আছে!
মেয়েটা বলিতেছে, খেয়েছি মাথা লজ্জা-শরমের, তোর কি? ইস্! উহারই মধ্যে আবার হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিতেছে। বেশ বোঝা যায়, অন্তত নিজের তরফ হইতে ঝগড়া করিবার উদ্দেশ্যটা ততটা প্রবল নয়, যতটা বুড়িকে চটাইয়া তুলিবার।
বুড়ি বলিল, তবে র’স্ এই আসছি তোর মুণ্ডুপাত করতে, গঙ্গাজীর মধ্যে থেকে তোকে আর উঠতে দোব না, র’স্ তুই।
সে দুইটা ধাপ নামিতে একটি বর্ষীয়সী স্ত্রীলোক বলিল, রুনিয়ার মা, যাচ্ছিস তো আমার ঘটিটা নিয়ে যা। তেষ্টা পেয়েছে।
ঘটি লইয়া কলহের পর্দা চড়াইতে চড়াইতে রুনিয়ার মা প্রায় জলের কাছে পৌঁছিয়াছে, রুনিয়া আঁজলা ভরিয়া জল উঠাইয়াছে, মা আর একটু অগ্রসর হইলেই বরুণা স্ত্র ছাড়িবে। চার পো কলির প্রভাব দেখিয়া ধর্মপ্রাণ মহেশ গাঙ্গুলির চোখের আর পলক পড়িতেছে না, এমন সময় উপরে সবাই সমস্বরে হৈ-হৈ করিয়া উঠিল।
মহেশ গাঙ্গুলি গোলমালের মধ্যে ভাষাটা ঠিক বুঝিল না বটে, কিন্তু দলের কয়েকজনের ভীত দৃষ্টি এবং ব্যস্ত তর্জনীনির্দেশ অনুসরণ করিয়া ব্যাপারটা বুঝিতে পারিল। ওপার হইতে যে নৌকা দুইটা ছাড়িয়াছিল, মাঝগঙ্গার একটু এদিকে আসিয়া গতি পরিবর্তন করিয়াছে, তাহার মানে—এ ঘাট ফেরি-ঘাট নয়। সবাই যে যাহার বোঁচকা-কুঁচকি কচিকাঁচা কাঁখে পিঠে মাথায় করিয়াছে। রুনিয়া ও তাহার মাকে ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি পড়িয়া গিয়াছে, এদের ত্রস্ত তাগিদ ভাল রকম বুঝিতে না পারিলেও মহেশ গাঙ্গুলির একটু আর সন্দেহ রহিল না যে, ভাষাটা খুব শুদ্ধ নয়।
বুড়ি তাড়াতাড়ি ফিরিল। রুনিয়া একবার গ্রীবা বাঁকাইয়া নৌকা-দুইটার দিকে দেখিল, তাহার পর পড়ি-কি-মরি করিয়া কাপড় ভিজাইয়া কাদা-ছিটাইয়া মাঝপথে মাকে সামনের দিকে ঠেলা দিয়া উঠিয়া গিয়া ভাইটাকে কোলে তুলিয়া লইল এবং হস্ত ও ঊর্ধ্বাংশ সঞ্চালন করিয়া বুড়িকে উচ্চৈঃস্বরে তাগাদা দিতে লাগিল।
বুড়ি আসিলে সবাই ফেরি-ঘাটের দিকে হনহন করিয়া অগ্রসর হইল। নৌকো দুইটা তখন ঘাটে প্রায় ভিড়িয়া গিয়াছে।
***
রুনিয়া যেখানটায় দাঁড়াইয়া জলক্রীড়া করিতেছিল, মহেশ গাঙ্গুলি চিত্রার্পিতের মত খানিকক্ষণ সেইখানটায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার পর উহারা যে পথ ধরিয়া চলিয়া গিয়াছে, একবার সেই দিকে ফিরিয়া দেখিল, একবার মনে হইল, একটা হাঁক দেয়, রুনিয়ার নাম ধরিয়া, আর কাহারও তো নাম জানে না। কি ভাবিয়া ডাকিল না। তেলের শিশি, কাচা-কাপড় আর নামাবলীটা তুলিয়া লইয়া ধীরে ধীরে নামিয়া গিয়া রুনিয়া যেখানটায় দাঁড়াইয়া জলক্রীড়া করিতেছিল, তাহার ঠিক সামনে ঘাটের শেষ রানাটির উপর গিয়া বসিল। তাহার পর চিন্তা।
মহেশ গাঙ্গুলি ধার্মিক, তাহার দ্বিধাদ্বন্দ্বের আলোড়ন জাগিয়াছে। এ আলোড়নের বিক্ষোভ সে কখনও বুঝিবে না, যে নিজে ধার্মিক নয়—মহেশ গাঙ্গুলির মতই ধার্মিক নয়। একবার মনে হইল, নিজেই ছুটিয়া যায় রুনিয়ার কাছে, এখনও উহাদের চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা যাইতেছে। আবার মনে হইল, চাই কি রুনিয়া নিজেই নিশ্চয় আসিয়া পড়িতে পারে। সে কি এতই অন্ধ? এত বড় একটা ভুল কি সে করিতে পারে? হঠাৎ সন্ত্রস্তার মধ্যে এই বিভ্রমটা ঘটিয়াছে। এ ভাবটা কাটিয়া গেলেই রুনিয়ার মনে পড়িবে নিশ্চয় মনে পড়িবে।
ঘাটের ওদিকে উহাদের কলরবের আওয়াজ মিলাইয়া গেল। নিদারুণ উদ্বেগে মহেশ গাঙ্গুলির বুকে নিশ্বাস জমিয়া উঠিতেছিল; একটি দীর্ঘনিশ্বাসের আকারে সেটি নামিয়া আসিল। তখন মনে হইল, ফেরির নৌকা না ছাড়া পর্যন্ত রুনিয়ার ফিরিয়া আসিবার সম্ভাবনা আছে।
মহেশ গাঙ্গুলি দাঁড়াইয়া ফেরিঘাটের দিকে চাহিল। জায়গাটা ছাড়িল না, বক্ষের স্পন্দন বাড়িয়া গিয়াছে। ভয়ে আশায় সেই জায়গাটিতে যেন সম্মোহিত হইয়া গিয়াছে মহেশ গাঙ্গুলি। একবার গঙ্গার দিকে চাহিয়া, তাহার পর বদ্ধাঞ্জলি হইয়া অস্ফুটস্বরে বলিল, এই খেয়ার নৌকা ছাড়া পর্যন্ত দেখব, তারপরই বুঝব, তোমার কি ইচ্ছে মা। বুঝছই তো, এই ধন্দে প’ড়েই আমি নিজে গেলাম না, চিরকালই তোমার ওপরই মতিগতি, তুমি যা করেছ তাই হয়েছে, আমি নিজে হতে এগিয়ে তোমার ওপর কারসাজি করবার কে মা? তোমার যদি সেই রকমই অভিরুচি হয়, রুনিয়ার মনে পড়বে, সে ফিরে আসবে; না হয় বুঝব, সেও তোমারই ইচ্ছে।
নৌকা বোঝাই হইতেছিল। ওই একটি দলকে লইয়াই ছাড়িয়া দিল। মহেশ গাঙ্গুলি আড়চোখে দুরস্থিত নৌকাটির উপর দৃষ্টি রাখিয়া কাঠ হইয়া বসিয়া রহিল। এখনও ধুকপুকানি, মনের ধর্মই এই, এখনও যদি মনে পড়িয়া যায়, চকিতে চোখে পড়িয়া যদি মনে পড়িয়া যায় ঘাটের কথা তো রুনিয়া ফিরিবেই। তুচ্ছ দুইটা ফেরির পয়সার মায়ায়, কি আত্মীয়-স্বজনের ভয়ে—আর আত্মীয়-স্বজন তো জানিবেই কথাটা একদিন—এ কি! নৌকা দূরে চলিয়া গেল; উহাদের হাস্যকলরব ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া মিলাইয়া আসিতে লাগিল।
মহেশ গাঙ্গুলি রানা হইতে নামিয়া, রুনিয়া যেখানে জলক্রীড়া করিতেছিল, তাহার হাত-চারেক এদিকে পাঁকের উপর হইতে একটি ঘটি তুলিয়া লইল। অর্ধেক পিতল অর্ধেক তামার চমৎকার একটি বেনারসী লোটা।
মহেশ গাঙ্গুলি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে গঙ্গার পানে চাহিয়া বলিল, তাই তো বলি মা, তুমি এখনও ধরাতলে বইছ, আর কলির প্রভাবই কি এতটা প্রবল হয়ে উঠতে পারে? পুজোর ঘটিটা গিয়ে অবধি মনটা যে কি হয়েছিল, অন্তর্যামী মা সুরধুনী আর কেউ না জানুক, তুমি তো তা জান। কায়মনোবাক্যেও কখনও পাপ করি নি, মনের দুঃখ শুধু তোমাকেই জানিয়েছি, না শুনে কি পারিস বেটি? তাই একেবারে হাতে তুলে দিলি, বললি, নে। ঘটিটিও চমৎকার, একেবারে বাবার ধামের জিনিস—তামায় পেতলে একেবারে পুজোর যুগ্যিটি। আহা মেড়ো মাগীর হাতে কত অনাচারই হয়েছে, গঙ্গামৃত্তিকে দিয়ে মেজে নিই।
মহেশ গাঙ্গুলি খুব ভক্তিভরে গোটাকতক বেশি ডুব দিয়াই স্নান করিল। তাহার পর বুড়াশিবের মাথায় ঢালিবার জন্য ঘটিটি পরম নিষ্ঠার সহিত গঙ্গোদকে পূর্ণ করিয়া উদাত্ত কণ্ঠে মন্ত্র পড়িতে পড়িতে উঠিয়া গেল।