ধারাপাত

ধারাপাত

বিশাখার সকালের হাঁটাটা আজ মাটি হল। রাত থাকতেই শুরু হয়েছিল ঝড়বৃষ্টি। বিশাল আকারের কিছু নয়, তা বলে ছাতা মাথায় তো আর মর্নিংওয়র্ক করা যায় না! কনে বিদায়ের কান্নার মতো বৃষ্টি চলে গিয়ে এখন দিব্যি রোদ উঠেছে। গলি, গাছপালা ঘরবাড়ি ধুয়ে গিয়ে যেন হাসছে পাড়াটা। বিশাখা গুম মেরে আছে। ডাক্তার বলেছে, ব্লাডসুগার আটকাতে হলে হাঁটা মাস্ট। টেস্ট করিয়ে অল্প সুগার ধরা পড়েছে বিশাখার। বংশে কারও ডায়াবেটিস ছিল কিনা, মনে করে ডাক্তারকে বলতে পারেনি। বাবার ছিল না, মায়ের নেই। এটুকু জানাতে পেরেছে। ডাক্তারের মত, টেনশন থেকেও হতে পারে।

প্রাইমারি স্টেজ এখনই ওষুধ দিচ্ছি না। এক-দেড়ঘণ্টা সকালে হাঁটুন আর খাওয়া দাওয়া মেনে চলতে হবে। একমাস পর ফের ব্লাড টেস্ট করিয়ে, আমার কাছে আসবেন। এরপর ডাক্তারবাবু ডায়াবেটিস কী মারাত্মক অসুখ, সবিস্তারে জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বংশে যদি কারও না থাকে তো ভাল, রুটিন মেনে চললে আপনিই কন্ট্রোল হয়ে যাবে। তা আপনার টেনশনটা কীসের?

মেয়ের বিয়ে নিয়ে। বলেছিল বিশাখা। উত্তরে ডাক্তারবাবু এমনভাবে ও বলে উঠেছিলেন, এটা যেন খুবই সাধারণ ঘটনা। নাম, বয়স জেনে নিয়ে প্রেসক্রিপশনে লিখলেন, তার সঙ্গে যোগ করলেন খানিক আগে চেক করা ব্লাডপ্রেশার আর শরীরের ওজন। খাওয়াদাওয়া সব মুখে বলে দিয়েছিলেন। ডাক্তারখানা থেকে বেরিয়ে আসার পর গোপার বাবা যথারীতি একটা হাড়জ্বালানি কথা বলেছিল, তোমাদের বংশে যেমন সুগারের পেশেন্ট নেই, মর্নিংওয়র্কেরও নাম শোনেনি কেউ, ওতে কাজ হবে?

এ ধরনের টিপ্পনী যখন কাটে পরিতোষ, মুখে একফোঁটা হাসি থাকে না, গলায় বিদ্রূপের সুরও নয়, মাথা নিচু করে অত্যন্ত নিরীহভাবে বলে কথাগুলো। তাতে মাথা আরও বেশি গরম হয়ে যায় বিশাখার। ইচ্ছে করে দু’ঘা লাগিয়ে দিতে, পারে না। যতই হোক লোকটা বয়সে তার চেয়ে অনেকটাই বড়। স্বামী স্ত্রীর ডিফারেন্স আঠেরো বছরের। গায়ে হাত তুলতে কেমন যেন বাধোবাধো লাগে। বিবাহিত জীবনের আঠাশ বছরেও দূরত্বটা এতটুকু কমল না। বিশাখা যতটা পারে মুখেই ঝাল মেটায়। এই যে পরিতোষ বলছে বিশাখার বাড়ির লোক ‘মর্নিংওয়র্ক’ কাকে বলে জানে না। এর মানে হচ্ছে বিশাখারা হদ্দগাঁইয়া। কথাটা মোটেই সত্যি নয়। হতে পারে বিশাখাদের বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের শশান্দায়। একেবারেই গণ্ডগ্রাম। বিশাখারা কিন্তু মোটেই গ্রামের মানুষের মতন হাবা-গবার জীবন কাটায়নি। বাবা চাকরি করতেন কলকাতায় সাজ-পোশাক সব কলকাতার বাজার থেকেই

আসত। এ ছাড়াও রকমারি খাবার। ঘর সাজানো হত শহরের কায়দায়। সেইদিক থেকে দেখতে গেলে পরিতোষ বড় হয়েছে গ্রামের খুব গরিব পরিবেশে। বাইশ বছর বয়সে চলে আসে কলকাতায়, চাকরির খোঁজে। সেখানেও দেশের বাড়ির আত্মীয়র আশ্রয়ে থেকেছে বছরের পর বছর। সামান্য রোজগারের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছে। বত্রিশ বছরে পেয়েছে সরকারি চাকরি। ইলেকট্রিক সাপ্লাই অফিসের কেরানি। মাইনে তখনকার দিনে খুবই কম। কষ্টেসৃষ্টে দেড়কাঠা জমি কিনে বাড়ি করল এখানে, ভদ্রেশ্বরের উকিলপাড়ায়। বিশাখাকে বিয়ে তারও দু’বছর পর। ততদিনে পরিতোষের মজ্জায় ঢুকে গেছে সাদামাটা জীবনযাপন। কোনও বাহুল্য নেই আজও। চাকরি থেকে রিটায়ার করেছে তিনবছর হল। খরচের ব্যাপারে এখন আরও সাবধানি। ‘মর্নিংওয়র্ক’ জিনিসটা যেন ওর কাছে শৌখিন কিছু। ডাক্তারের পরামর্শ শুনে বিশাখা পরিতোষকে বলেছিল, চলো, কাল থেকে তুমিও আমার সঙ্গে হাঁটতে বেরোবে। তোমারও বয়স হয়েছে, এ সময় হাঁটাচলা করা দরকার।

উত্তরে পরিতোষ বলেছিল, ওসব বড়লোকি আমার ধাতে সইবে না। তুমি একাই যাও। রাস্তায় অনেক মেয়ে-বউ পেয়ে যাবে। আজকাল অনেকেই হাঁটে শুনেছি। তবে গায়ে

সোনাদানা কিছু রেখো না। ভোরের দিকে যখন-তখন ছিনতাই হতে পারে। বিশাখা বলে, সে না হয় হল। কিন্তু হাঁটার মধ্যে তুমি বড়লোকিটা কী দেখলে? হাঁটতে গেলে তো আর টাকা খরচ হচ্ছে না!

প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে পরিতোষ বলেছিল, হাঁটাহাঁটি সারাদিনে আমি যথেষ্ট করি। দেশের

বাড়ি গেলে খাটাখাটুনি কিছু কম হয় না। শরীরে রোগ-বালাই নেই। আর কী চাই! কথাটা মিথ্যে নয়। তাই আর তর্কে যায়নি বিশাখা। লোকটার শেষ কবে জ্বর, পেটখারাপ হয়েছে মনে পড়ে না। ভদ্রেশ্বরে বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব আছে, থাকে দূরে দূরে। রিটায়ারের পর তাদের কাছে নিয়মিত আড্ডা মারতে যায়। রিকশার নামগন্ধ করে না। তা বাদে রোজ সকালে এক-দেড় ঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে বাজার করা তো আছেই। দু’মাসে একবার দেশের বাড়ি যায়। চাষের দরকার মতো দশ-পনেরো দিন থেকে আসে। তখন তো সারাদিন রোদেজলে কাটে। গায়ের রং এক পোচ কালো করে ফিরে আসে বাড়ি। অফিস যখন ছিল এতদিন ধরে থাকতে পারত না, ছুটি নষ্ট হবে। বিশাখাও চাইত না বেশিদিন মাধবপুরে গিয়ে থাকুক। ওখানে গেলেই পরিতোষ এ বাড়ির কথা প্রায় ভুলেই যায়। বাড়ি, জমিজমা, পুকুর নিয়ে সেখানে তার ছোটখাটো একটা রাজ্য। তার ওপর গ্রামের প্রতিটি লোক তাকে মুরুব্বি বলে গণ্য করে। মাধবপুরে গেলে কেমন একটা ঘোরে পড়ে যায় পরিতোষ। অথচ ওই লোকটাই এই পাড়ায় মুখচোরা বলে পরিচিত। খুব চেনা লোক ছাড়া কথা বলে না। অল্প-পরিচিতের সঙ্গে হাসি দিয়ে ভদ্রতা সারে। বিয়ের পর থেকেই পরিতোষ যখন দেশের বাড়ি যেত, ভীষণ চিন্তায় থাকত বিশাখা। ফিরতে এক-দু’দিন দেরি হলেই মনে হত, পরিতোষ বুঝি রয়ে গেল মাধবপুরে। দেশের বাড়ির দিকে তার টান সবচেয়ে বেশি। পাশের গ্রাম শ্যামচকে একটা সর্বনাশ অপেক্ষা করে আছে পরিতোষের জন্য। এখন আর এসব নিয়ে টেনশন করে না বিশাখা। প্রতীক্ষা যত দীর্ঘ হয়, পথ ততই আবছা হয়ে আসে। পরিতোষ আর শ্যামচকে যায় বলে মনে হয় না। নিজের গ্রাম নিয়েই মেতে আছে। তাই থাকুক। রিটায়ারের পর কিছু তো

একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। ভদ্রেশ্বর এলাকায় নিজেকে গুটিয়ে রাখে।

এতকাল এখানে কাটিয়েও জায়গাটাকে নিজের মনে করে না। তবে বেশ কয়েক মাস হল দেশের বাড়ি যাওয়ার নাম করছে না পরিতোষ। সেটা সম্ভবত মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তার কারণেই। মেয়ে মায়ের গায়ের রং নিয়ে জন্মেছিল। লোকে বলে আরও কালো। বিশাখার অবশ্য তা মনে হয় না। কর্তা-গিন্নি জানতই এই মেয়ের বিয়ে দিতে তাদের বেগ পেতে হবে। ভাল মতোই পাচ্ছে। গোপা বিয়ে পাশ করার পর থেকেই দেখাশোনা চলছে। পরিতোষের একটাই শর্ত, নগদ হিসেবে টাকাপয়সা কিছু দেব না। মেয়েকে সোনা যা দেওয়ার দেব। শয্যা, নমস্কারি কোনও কিছুতেই আপত্তি নেই। বরপক্ষকে বউভাতের খরচা দিতে পারব না। এটুকু সামর্থ্য তাদের থাকতেই হবে। আমার মেয়ের গায়ের রংটুকুই শুধু কালো। চেহারা বেঢপ নয়। মুখের কাট খুবই মিষ্টি। আমরা মরে গেলে মেয়ে সমস্ত সম্পত্তি পাবে, একটাই সন্তান। পাত্রী এমএ করছে। আর কী চাই! এর পরও যদি টাকা দিয়ে মেয়ে পার করতে হয়, ধরে নিতে হবে কপালে অশেষ দুঃখ আছে বেচারির! পাত্রপক্ষের খিদে কোনওদিনই মেটানো যাবে না। গোপাকে মনে করবে ব্যাঙ্কের পাসবই। ওরকম লোভী বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেয়ে কুমারী রেখে দেওয়া ভাল।

যুক্তি সব ঠিক আছে। এদিকে কুমারী মেয়ের বয়স যে দ্বিগুণ হারে বাড়ে, কর্তা-গিন্নি দু’জনেই জানে। যত দিন যাচ্ছে মুখ শুকোচ্ছে বিশাখা, পরিতোষের। মেয়ের কোনও দুশ্চিন্তা নেই। দিব্যি খাচ্ছে দাচ্ছে, ঘুরছে। এমএ করছে করেস্পন্ডেসে, কলেজ যাওয়া নেই। কম্পিউটার শিখছে আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় কানে ফোন। সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসবে না। লেখাপড়ায় ভাল ছিল না তেমন। গড়িয়ে গড়িয়ে পাস করে গেছে। এমএ-র পর বড় কোনও প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরির চেষ্টা করবে। ছোটখাটো চাকরিতে তার রুচি নেই। আসলে জানে জীবনে খাওয়া-পরার অভাব হবে না। মাথার ওপর ছাদও আছে। বিয়েটা তো শুধু একটা সামাজিকতা। শ্বশুরবাড়ি নিয়েও মেয়েটা বোধহয় চিন্তায় আছে। যা সব শোনা যায় আজকাল। নিজের বাড়িটাকেই ও সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করে। কিন্তু মেয়ের ভাবনা মতো বাবা-মা’র চললে তো হবে না। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন যত দিন যাবে বাঁকা বাঁকা কথা শোনাবে। অল্পবিস্তর ইতিমধ্যে শোনানো শুরু হয়ে গেছে। তাদের ঘুরেফিরে একটাই কথা, তোমাদের এত কিছু থাকতে একমাত্র মেয়েকে পার করতে পারছ না! গন্ডগোলটা কোথায়? কালো মেয়ের জন্য কি তোমরা রাজপুত্রের খোঁজ করছ? চিড়বিড় করে গা। কথাগুলো তবু সহ্য করতে হয়। এগারো ক্লাসে পড়ার সময় গোপার সঙ্গে একটা ছেলের প্রেম হয়েছিল। পরিতোষ না থাকাকালীন সুদীপ্ত বাড়িতে এসেছিল দু’বার। মিষ্টি আনার নাম করে অনেকটা সময় বাইরে কাটিয়ে ঘরে ফিরেছিল বিশাখা। মেয়ের চুলে, জামায়, চোখে আলুথালু ভাব লক্ষ করেছিল। বছর ঘুরল না, সুদীপ্তর নাম নেওয়া বন্ধ করে দিল গোপা। বাড়িতে ফোন আসত না ছেলেটার, তখন মোবাইলের এত চল হয়নি। গোপাও ফোন করত না সুদীপ্তকে। উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে না পেরে বিশাখা মেয়ের কাছে জানতে চেয়েছিল, তোদের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছে? কেউ কারও খোঁজ নিচ্ছিস না…

হ্যাঁ, ওর সঙ্গে আমার কাটঅফ হয়ে গেছে। বলেছিল গোপা।

গভীর আক্ষেপের সুরে বিশাখা বলেছিল, সে কী! কেন?

উত্তরে মেয়ে বলে, এতে হা-হুতাশ করার কী আছে! প্ৰেম বুঝি কাটে না মানুষের? বিশাখা আর কথা বাড়ায়নি। প্রেম যেমন মানুষের কাটে, তেমনই আবার হয়ও। গোপার হল না। চেষ্টাই করেনি হয়তো। ফের যদি আঘাত পেতে হয়। তার চেয়ে যেমন আছে, সেটাই ভাল। বিশাখা খেয়াল করে দেখেছে, মেয়ে যে ফোন কানে সারাক্ষণ কথা বলে যাচ্ছে, সবই মেয়েবন্ধু। ফোন এখন ফ্যাশন। ফালতু পয়সা নষ্ট। ওপারের বন্ধুদের এক এক করে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ফোন করার লোক কমে যাচ্ছে মেয়ের। ফোন হাতে নিয়ে আজকাল গোপা কেমন যেন অস্থিরভাব করে। হয়তো সেদিন একটা বন্ধুকে দু’বার ফোন করা হয়ে গেছে, আবার করবে কি না ভাবে।

সুদীপ্তর ব্যাপারটা পরিতোষ জানে না। রাস্তাঘাটে দেখে ফেলে পরিতোষকে হয়তো কেউ জানাতে পারে। বিশাখা বলেনি। ভেবেছিল, সম্পর্কটা আর একটু গড়ালে কর্তাকে জানাবে। কী কী বলবে, সে সবও ভাবা ছিল। এমনভাবে বলতে হবে, পরিতোষ যাতে নাকচ না করে দেয়। পুরনোকালের মানুষ তো, বলার সুযোগই পাওয়া গেল না। পরিতোষও হয়তো ঘটনা জেনে, চেপে গেছে বিশাখার কাছে। সময় থাকতে মেয়ে আর একটা প্রেমের চেষ্টা করল না, তার খেসারত দিচ্ছে এখন। একের পর এক পাত্রপক্ষ এসে ক্যানসেল করে যাচ্ছে। মেয়ের কোনও বিকার নেই। ফের নতুন পাত্রপক্ষের সামনে সেজেগুজে বসছে। একদিন শুধু আক্ষেপ করে বলেছিল, তোমার রংটা না পেয়ে যদি বাবারটা পেতাম, দেখতে তোমার মতো হলে এতদিনে হয়তো বিয়েটা হয়ে যেত।

কথাটা নির্মম হলেও সত্যি। মায়ের সবটাই খারাপ। মেয়ে পেয়েছে বাপের মুখ-চোখ। মেয়ে তো আর জানে না এই কুরূপাকে কেন তার বাবা মেনে নিয়েছে। জানানো যাবে না। বাবা-মা দু’জনেই ছোট হবে তার কাছে। অগত্যা মেয়ের পরিতাপ শুনে যেতে হয়েছে, কোনও সান্ত্বনা দিতে পারেনি বিশাখা।

সম্বন্ধ হাতছাড়া হচ্ছে ওই গায়ের রঙেতে গিয়েই। বারোটা পার্টি অপছন্দ করেছে। দশটা পার্টি নগদ টাকার কথাই তোলেনি। যে দুটো তুলেছিল, কর্তা মুখের ওপর না বলেছে। তেরো নম্বরকে নিয়ে বড় গোলমালে পড়ে গেছে বিশাখা। সিদ্ধান্তের দায়িত্ব তার ঘাড়ে এসে পড়েছে। পাত্রপক্ষ পছন্দ করেছে গোপাকে। দেখতে এসেই ফাইনাল করেনি। বাড়ি ফিরে ফোন করে জানিয়েছিল। বলেছিল, মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। রং নিয়ে একটু চিন্তা ছিল। ছেলেকে বললাম, মেয়ে কালো। মুখচোখ, গড়ন একেবারে লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো। ছেলে এক কথায় রাজি। বলেছে, মনে মনে আমি ঠিকই করেছিলাম কালো মেয়ে বিয়ে করব। কেননা আমার মা কালো। আমিও তেমন ফরসা নই।

সব ঠিকঠাক চলছিল। পল্লব একদিন খুড়তুতো ভাই আর এক বন্ধুকে নিয়ে এসে দেখে গেল গোপাকে। গোপারও নিশ্চয়ই পল্লবকে পছন্দ হয়েছে। কোনও আপত্তি জানায়নি। একটু বুঝি উৎসাহ ধরা পড়ছে ওর কথাবার্তায়। বলেছে, ছেলে যা রোগা, ধুতি পাঞ্জাবিতে অখাদ্য লাগবে। ওকে প্যান্ট-শার্ট পরে বিয়েতে বসতে বোলো। এই নিন্দে যে আসলে আহ্লাদের ছদ্মরূপ, এটা যে কেউ বুঝবে। পরিতোষ একদিন পাত্রর অফিস দেখে এল।

প্রাইভেট হলেও বেশ বড় কোম্পানি। পল্লবের কাজের এবং ব্যবহারের সুনাম করেছে ওর বড়কর্তা, অফিসের বন্ধুরা। মানিকতলায় পল্লবদের শরিক বাড়ি। পাড়ায় খোঁজ করে ওর সম্বন্ধে কোনও ধরনের বদনাম শোনা গেল না। গোপার বাবা ছেলেপক্ষের সঙ্গে বসে বিয়ের তারিখ ঠিক করে এল। ক’দিন পর পল্লবের বাবা ফোন করেছিলেন। খুবই বিনয়ের সঙ্গে গোপার বাবার কাছে বলেছেন, আপনারা ঠিক কত ভরি সোনা মেয়েকে দিচ্ছেন, জানতে পারলে একটু ভাল হয়।

গোপার বাবা তো অবাক! দেখাশোনার শুরুতে এই মানুষটাই বলেছিল, আমাদের কোনও ডিমান্ড নেই। আপনারা ইচ্ছেমতো মেয়েকে সাজিয়ে দেবেন। নমস্কারির শাড়ি ক’টা লাগবে এখনও পর্যন্ত ওদের মুখ থেকে বার করা যায়নি। হঠাৎ সোনার হিসেব চাইছে কেন? কৌতূহল মুলতুবি রেখে পরিতোষ সরাসরি জানিয়ে দিল, আমরা ভরি দশেকের মতো দিচ্ছি।

পল্লবের বাবা বললেন, ওটা ভরি পাঁচেক বাড়ালে আমাদের একটু সুবিধে হয়।

গোপার বাবা চুপ করে ছিল, কোনও উত্তর করেনি। ভদ্রলোক নিজেই কারণটা বলতে শুরু করেছিলেন, আসলে কী জানেন, ক’দিন আগেই আমার মেজভাইয়ের ছেলের বিয়ে হল। কনে এক গা গয়না নিয়ে ঢুকল এই বাড়িতে। এরপরই তো আমার ছেলের বিয়ে, আত্মীয়, প্রতিবেশী আমার বউমার সঙ্গে কমপেয়ার করবেই। সেইজন্যেই বলছিলাম…

কথার মাঝে গোপার বাবা বলে উঠেছিল, ঠিক আছে, আমি দেখছি। দু’দিন পরে আপনাকে জানাচ্ছি।

অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে ফোনের রিসিভার নামিয়েছিল পরিতোষ। বিশাখা, গোপা, দু’জনেই ব্যগ্র হয়ে অপেক্ষা করছিল ফোনের ওপারের কথা শোনার জন্যে। পরিতোষ প্রথমে বলল, এটাও ক্যানসেল। তারপর বলল, পল্লবের বাবার ডিমান্ড। সব শেষে পরিতোষ জানাল নিজের মতামত। বলেছিল, এ তো সেই নগদ দেওয়ারই সমান। পাঁচ ভরি মানে এক লাখের ওপর ধাক্কা। এরা অনেক বেশি ধুরন্ধর। ডাইরেক্ট টাকা না চেয়ে, সোনার মাধ্যমে আদায় করছে। চাওয়ার সময়টাও বুদ্ধি করে বেছেছে, বিয়ের ডেট পাকা হয়ে যাওয়ার পর। ভেবেছে, আত্মীয়স্বজনদের সুখবরটা জানিয়ে দিয়েছি। এখন পিছিয়ে আসা প্রেস্টিজের ব্যাপার…

আরও অনেক কথাই গজগজ করে যাচ্ছিল পরিতোষ। গোপা উঠে গিয়েছিল চুপচাপ। পরিতোষ থামতে বিশাখা বলে, গয়না তো মেয়েরই থাকবে। ওই দিয়ে লোক খাওয়ানোর খরচা তুলতে পারবে না। দেখো না একটু চেষ্টা করে। এত ভাল পাত্র হাতছাড়া করা কি ঠিক হবে?

পরিতোষ বলল, গয়না মেয়ের থাকবে না। ও-বাড়ি গেলেই ও সব ওদের সম্পত্তি। গা থেকে খুলে নিয়ে বেচে দেবে। মেয়ের যদি সত্যিই কিছু থাকে, তা হল এ বাড়িটা আর দেশের বাড়ি, জমিজমা। একটা মেয়ের সঙ্গে এত কিছু পেয়েও ওদের সাধ মিটছে না। কালই আমি জানিয়ে দেব, আমার পক্ষে এক্সট্রা পাঁচ ভরি দেওয়া সম্ভব নয়।

ভীষণই হতাশ হয়ে পড়েছিল বিশাখা। আবার সেই পাত্রপক্ষ দেখতে আসা, প্লেটে মিষ্টি সাজিয়ে দেওয়া, হেসে হেসে কথা বলা, বিরক্তির একশেষ। ভাগ্যিস বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়াটা কারওকেই বলেনি বিশাখা, লজ্জায় মাথা কাটা যেত তখন।

পরের দিনই, ছবিটা আশ্চর্যভাবে বদলে গেল! অফিস থেকে ফোন করেছিল পল্লব। গোপার বাবা তুলেছিল ফোন। পল্লব বলে, বাবার গয়না চাওয়া নিয়ে আপনারা কিছু মনে করবেন না। আসলে মেজকাকার সঙ্গে বাবার অনেকদিনের রেষারেষি। সেইজন্যেই ডিমান্ডটা করে বসেছে। আপনাদের ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না; আমি অফিস থেকে লোন নিয়ে পাঁচ ভরির গয়না পাঠিয়ে দেব, গোপা যেন ওটা পরে বিয়েতে বসে। আর এই ব্যাপারটা আপনারা কারওকেই জানাবেন না। আমার আর আপনাদের মধ্যে থাকবে।

প্রস্তাবটা শোনামাত্র বাতিল করে দিয়েছিল পরিতোষ। বলেছিল, আমি আমার মেয়েকে কোনও ধরনের রেষারেষির মধ্যে ফেলতে চাই না। আমার সাধ্যের সঙ্গে মানানসই বাড়িতে ওর বিয়ে দেব।

পল্লব তখন বলে, ব্যাপারটাকে আপনি এত সিরিয়াসলি নেবেন না। আমি জানি বাবা কাকার এই রেষারেষির কোনও মানেই হয় না। বাবাকে এখন একথা বোঝাতে গেলেও, বুঝবে না। দুই ভাইয়ের মাঝখানে অনেক মান-অপমান, অভিমানের ঘটনা আছে। সেগুলো যেমন আমি বাবাকে ভোলাতে পারব না, তার দায় নেওয়াটাও আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। বাবার এখন বয়স হয়েছে, আমি আর চাইছি না তর্কাতর্কিতে যেতে। মানুষটাকে তো আর পালটানো যাবে না। বউমার গায়ে বেশি গয়না দেখে যদি শান্তি পায়, পাক।

একটু হলেও পরিতোষের মাথাটা ঠান্ডা হয়েছিল। বলেছিল, কিন্তু তোমারও তো চাপ পড়ে যাবে। বেশিদিন চাকরিতে ঢোকোনি। বিয়ের খরচ আছে, তার ওপর এটা আবার যোগ হল।

পল্লব বলেছিল, কিচ্ছু চাপ পড়বে না। বিয়ের কোনও খরচই আমাকে দিতে হচ্ছে না। বাবা করছে সব। চাকরিতে আর ক’বছর আগে ঢুকলে গয়নার জন্যে আমাকে লোনও নিতে হত না। আপনারা এদিকের ভাবনাটা আমার ওপর ছেড়ে দিন।

তখনই কোনও কথা দেয়নি পরিতোষ। পল্লবকে বলেছিল, আমি গোপার মায়ের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি।

কাল থেকে এখন অবধি কিছুই ঠিক করে উঠতে পারেনি বিশাখা। সারাক্ষণ ওই নিয়ে ভেবে যাচ্ছে। ভাল ঘুমও হয়নি রাতে। কাল ফোন রেখে পল্লবের সব কথাই মেয়ে বউকে বলেছিল পরিতোষ। বিশাখা উৎসাহিত হয়ে বলেছিল, তা হলে ঝামেলা মিটেই গেল। তুমি রাজি হয়ে যাও।

পরিতোষ মাথা নেড়ে বলে, না, তা হয় না। পাত্রের থেকে গয়না নেওয়া যাবে না। নিজেদের ছোট করা হবে। গোপারও সম্মান থাকবে না স্বামীর কাছে। বিয়ে যদি ও বাড়িতে দিতেই হয়, গয়নাটা আমাদেরই দিতে হবে।

তা হলে তাই দাও। বড় নিশ্চিন্ত হয়ে কথাটা বলেছিল বিশাখা। কল্পনাও করতে পারেনি উত্তরে কী মারাত্মক প্রস্তাব তাকে ফিরিয়ে দেবে পরিতোষ। না বুঝেই অবশ্য দিয়েছে। পরিতোষ বলেছিল, তোমার গয়না থেকেই দিয়ো তবে। আমার এক্সট্রা আর কোনও টাকা নেই। বিয়ের জন্য যা টাকা জমিয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি খরচ হবে। জিনিসপত্রের যা দাম বেড়েছে হঠাৎ। পড়ে থাকবে পেনশনের টাকা আর পোস্ট অফিসের ইএমআই। ওতে

তো হাত দেওয়া যাবে না, সংসার চালাব কী করে! বিয়ের পর জামাই খাতিরে খরচা হবে নিয়মিত… কথাগুলো শুনতে শুনতে চোয়াল ভারী হয়ে গিয়েছিল বিশাখার। পরিতোষের বিরুদ্ধে বলারও কিছু নেই। অন্যায্য কিছু বলছে না। বিশাখার গয়না যথেষ্টর চেয়ে বেশি। এই ঘটনার আগে অবধি মেয়ের বিয়ের জন্য একগ্রামও চায়নি পরিতোষ। গয়নার সিংহভাগ পরিতোষের টাকায় বানানো। বাপের বাড়ি থেকে সামান্যই সোনা এনেছিল কনেবেশী বিশাখা। পরেও বাবা-মা আর দিতে পারেনি। স্বামীর দেওয়া জিনিস মেয়ের বিয়েতে লাগবে। এতে ‘না’ বলবে কোন মুখে বিশাখা? দেশের বাড়ির চাষ থেকে যে সামান্য টাকা আয় হত, পরিতোষ তুলে দিত বউয়ের হাতে। বলত, কিছু গড়িয়ে নিয়ো। কখনও বা বাড়ি রিপেয়ারিং-এর কাজে লাগাত।

চাষের আয়টাকে বাড়তি বলেই গণ্য করত পরিতোষ। মাধবপুরে গিয়ে থাকলে চাষ থেকে অবশ্যই রোজগার হত বেশি। জমি প্রায় দশ বিঘে মতো। লোক দিয়ে চাষ করালে, আয় তেমন হয় না। ওরা যা দেয়, বিশ্বাস করে নিয়ে নেয় পরিতোষ। চাষ ওর কাছে শখ। তেমনই বিশাখার শখ গয়নার। সেটা যে আসলে একটা নেশার মতো পরিতোষ জানে না। এই নেশার একটা উপযুক্ত কারণও আছে। বিশাখা ভাল করেই জানে এই পৃথিবীতে তার একচ্ছত্র অধিকার বলতে ওই গয়নাগুলোয়। বাকি সবকিছুতে কারও না কারও ভাগ আছে। শরীরটা অবশ্য নিজের। যা একেবারেই পছন্দ হয় না বিশাখার। জোর করে হওয়ানোর কোনও মানেও হয় না। গয়না তার কাছে অহংকার। ওই অলংকারগুলোই তার কুরূপকে আড়াল করে রাখে। কোনও নেমন্তন্নবাড়ি গেলে লোকে তার চেহারাকে তাচ্ছিল্য করার আগেই গয়নায় দিশেহারা হয়ে যায়। মেয়েরাই বেশি। মেয়েদের সাজগোজ মেয়েরাই লক্ষ করে প্রথমে। সমীহ আদায়কারী ওই গয়নাগুলো থেকে কিছুটা কারওকে দিয়ে দেওয়া মানে নিজের গা থেকে খানিকটা মাংস দান করা। বিশাখার এই অসহায়তা বাপ-বেটি অনুভব করবে না, তারা ধরে বসে রয়েছে, এত যখন আছে, নিজের মেয়ের বিয়েতে কিছুটা দিতে আপত্তি থাকবে না বিশাখার। বরং খুশি হবে এই ভেবে, তার অবদানেই বিয়ের গাঁটটা অবশেষে পার করা গেল।

খুশি বা আনন্দ কোনওটাই হচ্ছে না বিশাখার। কাল থেকে সে গয়না বাঁচানোর উপায় ভেবে যাচ্ছে। একটা সমাধান মাথায় এসেছিল। পরিতোষকে বলবে, দেশের কিছুটা জমি বেচে দাও। পরক্ষণেই ভাবনা বাতিল করেছে। পরিতোষকে একবার জোর করে দু’বিঘে জমি বিক্রি করিয়েছিল বিশাখা। ওই টাকায় এ বাড়ির সিমেন্টের মেঝে তুলিয়ে পাথর বসিয়েছে। তখন যা চোখমুখের অবস্থা হয়েছিল পরিতোষের, ভয় হচ্ছিল ভালমন্দ কিছু হয়ে না যায়। পাথরের মেঝেতে পা বোলাতে বোলাতে পরিতোষ বলেছিল, মনে হচ্ছে কবরের চাতালে দাঁড়িয়ে আছি। পাথরে তো আর ধান জন্মায় না! নিজের জমিতে যখন ধানগাছ মাথা নাড়ে, সত্যিই মনে হয় বেঁচে আছি। সে যে কী সুখ!

তখনই বিশাখা ঠিক করে নিয়েছিল, জীবনে আর পরিতোষকে জমি বিক্রি করতে বলবে না। এখনও পায়ের নীচে স্বামীর মনখারাপ লেগে থাকে তার। বড্ড অস্বস্তি হয়। মেয়ের বিয়ের মুখে জমি বিক্রির কথা তোলাই যাবে না। শেষ মুহূর্তে যদি কোনও অঘটন ঘটে যায়, মা-মেয়ে দু’জনেই ভেসে যাবে।

উলটোদিক থেকে পরিতোষ যদি জিজ্ঞেস করে, গয়না দিতে তোমার অসুবিধেটা কোথায়? জোরালো কোনও যুক্তি দিতে পারবে না বিশাখা। মানুষের মনের ভিতরের কথা সবসময়ই যুক্তিকে ভয় পায়। তাই তো লুকিয়ে থাকে গভীরে। জানে, যুক্তি তাদের মুহূর্তে নিঃশেষ করে দেবে।

আজকের মর্নিংওয়র্কটা খুবই দরকার ছিল বিশাখার। ভোরের দিকে হাঁটাচলা করলে মাথাটা অনেক ফ্রেশ হয়ে যায়। যে-কোনও সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হয় বেশ। ঝড়-বৃষ্টিটা এসে পণ্ড করল বাইরে বেরোনো। এখন রোদ উঠলেও, রাস্তায় বেরিয়ে বিশাখা সঙ্গীসাথিদের পাবে না। তারা আজ কেউ বেরোয়নি। তাদের তো বিশাখার মতো কোনও দুশ্চিন্তা নেই। একা একা হাঁটতেও কেমন যেন লাগে। তা ছাড়া বেলাও হয়ে যাচ্ছে। ভোরের দিকে যেহেতু ঝড়বাদলা হয়েছে, ওয়েদার বেশ ঠান্ডা। বাপ, মেয়ে যে যার বিছানায় মৌজ করে ঘুমোচ্ছে। বিশাখা গ্রিলের গেটের চাবি হাতে নিয়ে বসে আছে বারান্দার মোড়ায়। ভোরবেলায় বাপ বেটিকে না ডেকে, গেটে তালা দিয়ে বেরোয় বিশাখা। ডুপ্লিকেট চাবি ঘরে রাখা থাকে। মোড়া থেকে ওঠে বিশাখা। চা বানাতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে পারুক না পারুক, ঘড়ির কাঁটা তো কারও জন্য বসে থাকবে না।

রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসউনুনে চায়ের জল চাপিয়েছে বিশাখা। জল প্রায় ফুটে এল, চাপাতা দিতে যাবে, থেমে গেল হাত। ভিতর ঘরে ফোন বাজছে। একমুঠো হাওয়া কমে যায় বুকের। এত সকালে ফোন আসে একমাত্র পরিতোষের গ্রাম থেকে। খুব প্রয়োজন ছাড়া তারা ফোন করে না। যদিও মারাত্মক কোনও বিপদের খবর বিয়ের পর থেকে আসতে দেখেনি বিশাখা। তবু কীরকম যেন আতঙ্ক লাগে। বিশাখা ভাল করেই জানে, পরিতোষ যতটা না এই সংসারের, তার চেয়ে অনেক বেশি দেশের বাড়ির লোকেদের। প্রয়োজন যথার্থ হলে বিশাখাদের ফেলে চিরকালের জন্য দেশের বাড়ি চলে যেতে পরিতোষের বাধবে না। ফুটন্ত জলে চা-পাতা দিয়ে সসপ্যান ঢাকা দেয় বিশাখা। গ্যাসউনুন নিভিয়ে বেড়াল-পায়ে শোওয়ার ঘরে আসে। ফোনের আওয়াজ খানিক আগেই থেমেছিল, এখন রিসিভার কানে নিয়ে কথা বলছে পরিতোষ। একহাতে কোমরের লুঙ্গি সামলে রেখেছে। ঘুমচোখেই নেমে এসেছে বিছানা থেকে। ফোনটা যে দেশের বাড়ির, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয় বিশাখা। একমাত্র ওদিককার ফোন এলেই এত নিচু গলায় কথা বলে পরিতোষ। পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও কিচ্ছু শোনা যাবে না। পরিতোষের মুখের দিকে তাকিয়ে ফোনের গুরুত্ব আন্দাজ করার চেষ্টা করে বিশাখা। পাঁচভরির সমাধান এখনও হয়নি, এ সময় পরিতোষ যদি দেশের বাড়ি ছোটে, বিশাখা একা পড়ে যাবে। পল্লব এবং ওদের বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা চালাতে হবে বিশাখাকেই। সে এক কঠিন দায়িত্ব! বিশাখা অত স্মার্ট নয়।

খবর ভাল নয় বলেই মনে হচ্ছে, থমথম করছে পরিতোষের মুখ। নামিয়ে রাখল রিসিভার। বিশাখা পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে, দেশের ফোন?

পরিতোষ মাথা ওপর নীচ করে। বিশাখা জানতে চায়, কোনও খারাপ খবর? পরিতোষ শুধু বলে, এখন-তখন অবস্থা। শ্যামচক।

বিশাখা দ্রুত কয়েকটা কথা ভাবতে থাকে। মশারির এক খুঁট খোলা বিছানায় গিয়ে

বসেছে পরিতোষ। চেহারায় বিধ্বস্তভাব। ভোরের ঝড়বাদলা কি এই দুঃসংবাদেরই সংকেত নিয়ে এসেছিল? বিশাখার কতটা ক্ষয়ক্ষতি হবে বোঝা যাচ্ছে না। লাভ কি কিছু হবে?

বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল পরিতোষ। বলল, আমাকে এখনই যেতে হবে। বিশাখা বলে, আমিও যাব তোমার সঙ্গে।

পরিতোষ কপাল কুঁচকে বউয়ের দিকে তাকায়। বলে, কেন? হঠাৎ তুমি…

সে তো আমারও কেউ হয়। বলে তড়িঘড়ি পরিতোষের সামনে থেকে সরে যায় বিশাখা।

এ ঘরের আলো বাতাস, আসবাব দু’জনের কথোপকথনের অর্থ উদ্ধার করতে পারবে না। এমনকী ভদ্রেশ্বরের কাকপক্ষীর কাছেও এদের কথা সাংকেতিক বলে মনে হবে। ফোনের সূত্রটা স্বামী-স্ত্রী অতিসতর্কতার সঙ্গে গোপন করে রেখেছে এই এলাকায়।

কোলাঘাট ব্রিজ পার হচ্ছে ট্রেন। নদীতে জল একেবারেই কম। বড় বড় চর জেগে উঠেছে। ব্রিজটা এত লম্বা, ট্রেনে করে যেতে যেতে কখন যেন শহরের সুতোটা হাত থেকে ফসকে যায় বিশাখার। সে এসে পড়ে নিজেদের গ্রামদেশে। হাওয়ার গন্ধই বদলে যায়। এবার অবশ্য বাপের বাড়ি যাবে না। বাপের বাড়ি বলতে তেমন কিছু নেইও, শুধু মা আছে, সত্তরের ওপর বয়স। বাবা মারা গেছে বিশাখার বিয়ের এক বছর আগে। দাদার চাকরি পটনায়, ওখানেই সংসার পেতেছে। মায়ের শরীর-স্বাস্থ্য ভাল, নিজেই চাষ দেখাশোনা করে। জমি খুবই অল্প, লাভ যা হয়, মায়ের একার তাতে চলে যায়। মা এতটাই সক্ষম, জমির সবজি, পুকুরের মাছ নিয়ে বছরে চার-পাঁচবার পৌঁছে যায় ভদ্রেশ্বরের বাড়িতে। তুলনায় বিশাখা খুব কম যায় বাপের বাড়ি। শ্বশুর বাড়িও এড়িয়ে চলে। এই অঞ্চলে এলে নিজেকে বড় খাটো লাগে। চেনাজানা মানুষগুলো যখন তার দিকে তাকায়, কেন জানি মনে হয় ওদের দৃষ্টির ভিতর কোথাও একটু অনুকম্পা মিশে আছে। বড়দের চাহনিতে করুণা একেবারে স্পষ্ট দেখা যায়। এই সমস্যা ভদ্রেশ্বরে নেই। কোনও পুজো অথবা বিশেষ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়বাড়ির উৎসব-অনুষ্ঠান ছাড়া এদিকে আসতে চায় না বিশাখা। গোপা বড় হওয়ার পর থেকে গ্রামদেশের নাম শুনলে মুখ বেঁকায়। একা রেঁধেবেড়ে খাবে, তবু বাবা-মায়ের সঙ্গে আসবে না। আজ যে কারণে যাওয়া হচ্ছে দেশের দিকে, মা-বেটির দু’জনেরই আসার কথা নয়। এটা সম্পূর্ণ পরিতোষের ব্যাপার। বিশাখা হঠাৎ সঙ্গ নিতে চাওয়ায় পরিতোষ রীতিমতো অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। প্রায় হতভম্ব অবস্থা। সেই ভাবটা এখনও ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বাড়িতে কয়েকবার বলার চেষ্টা করেছিল, ওরা এমনিতেই তাদের মেয়েকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে দেখে আরও অস্বস্তিতে পড়ে যাবে। এইসময় তোমার সঙ্গে ভাল করে কথাও বলে উঠতে পারবে না। আপ্যায়নে ত্রুটি থেকে যাবে। তখন আবার তোমার রাগ হবে ওদের ওপর।

বিশাখা বলেছে, মোটেই হবে না। আমি কি কচি খুকি, বুদ্ধিশুদ্ধি পাকেনি? বাড়িতে একজন মরতে চলেছে আর আমি আশা করব খাতির যত্ন!

কিন্তু তুমি যাওয়াতে ওদের লাভটা কী হবে? হতাশ নিরুপায় গলায় জানতে চেয়েছিল পরিতোষ।

উত্তরে বিশাখা বলে, বিয়ের পর থেকে মানুষটা ছিল আমার গায়ের জ্বালা। অনেক খারাপ খারাপ কথা ভেবেছি তার সম্বন্ধে। শেষ সময়ে পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়ে নেব। যতই হোক, সে তো আমার গুরুজন।

এ কথাগুলোর কোনওটাই বিশাখার মনের নয়, মাথার। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে পরিতোষের সঙ্গ নিয়েছে। পরিতোষও বিশাখাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় না। এত উদার স্বভাব যে বিশাখার নয়, তা সে ভাল করেই জানে। বেশি কথা চালাচালিতে যায়নি মেয়ের কারণে। গোপা যদি আঁচ করে ফেলে ব্যাপারটা, সেই ঝড় সামলানো এখন মুশকিল হবে।

মেয়েকে জানানো হয়েছে দাদুর শরীর খুব খারাপ, দেখতে যাচ্ছে পরিতোষ বিশাখা। দাদু মানে, ঠাকুরদা। পরিতোষের বড়জ্যাঠা। ছোটবেলায় পরিতোষ পিতৃহারা হয়। মানুষ হয়েছে বড়জ্যাঠার সংসারে। মানুষটা পরিতোষকে যেমন লালনপালন করেছিলেন, বিনিময়ে গলায় ঝুলিয়ে দেন খরচের রসিদ। অদৃশ্য সেই তাবিজ আজ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। পরিতোষ বাইশ বছর অবধি জ্যাঠার আশ্রয়ে ছিল, জ্যাঠা খরচ উসুল করলেন পরিতোষের যখন আঠাশ। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে গলায় রসিদ ঝুলিয়ে ঘুরছে পরিতোষ। মূল্যটা বড্ড বেশি চোকাতে হল না?

মেচেদায় থেমেছিল ট্রেন। ফের চলতে শুরু করেছে। এরপরই ঘুরে যাবে দিঘার লাইনে। চা-ওয়ালা এসেছে, কাছে, পরিতোষ জানতে চায়, খাবে চা?

বিশাখা ঘাড় এলিয়ে সায় দেয়। সম্মতির ভঙ্গি দেখেই মাটির ভাঁড়ে চা ঢালতে থাকে চাওয়ালা অর্ডারের অপেক্ষা না করে। দাম নিয়ে চলে গেল। দু’জনে ভাঁড়ে চুমুক দিতে থাকে। ট্রেনে ওঠার পর থেকে এই প্রথম চা খেল বিশাখা। এর আগে বেশ কয়েকবার সেধেছে পরিতোষ। একবার মুড়িওয়ালা দাঁড় করিয়েছিল, বিশাখা না করে দিয়েছে। পরিতোষ একটু বেশিই যত্ন নিচ্ছে বউয়ের। বিশাখার জন্যই ট্রেনপথে এল। একা হলে বাসে আসত। বাসে বিশাখার কষ্ট হয়। পরিতোষ বেশ নার্ভাস হয়ে আছে। প্রথমপক্ষের জন্য ঠিকমতো মন খারাপ করতে পারছে না। সে এখন অন্তিমশয্যায়। এই প্রথমবার পরিতোষের দুই স্ত্রী মুখোমুখি হবে। অন্তত পরিতোষ তাই জানে। ঘাবড়ানোর কারণ এটাই। ও বাড়ির পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, বেচারা আন্দাজ করতে পারছে না।

পরিতোষের প্রথম বউ বাপের বাড়িতে থাকে, শ্যামচকে। নামমাত্র বউ। বিয়েটা পরিতোষের বড়জ্যাঠা দেন। এই সময় ওঁর আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ঘুরে দাঁড়ানোর একটাই উপায়, শ্যামচকের ব্রজধর মাইতির বড় মেয়ের সঙ্গে পরিতোষের বিয়ে দেওয়া। মেয়েটার মাথায় ছিট আছে। বিনিময়ে ব্রজধর অনেক দেওয়া-থোওয়া করবে। সামর্থ্যও আছে তার। পরিতোষ তখন কলকাতায়। কম মাইনের চাকরিতে প্রচুর পরিশ্রম করছে। জ্যাঠামশাই ডেকে পাঠালেন পরিতোষকে। নিজের দুরবস্থার কথা জানালেন। পরিতোষ অবশ্য জানতই, খারাপ লাগত জ্যাঠার পাশে দাঁড়াতে পারছে না বলে। পরিতোষের মা তখন জ্যাঠার সংসারে আছে। জ্যাঠা বিয়ের কথা পাড়লেন। মেয়ের মাথায় ছিটের কথাটা গোপন করেননি। বড্ড কমিয়ে বলেছিলেন। সঙ্গে পরামর্শ দেন, শহরের

ডাক্তার দেখালে ওইটুকু রোগ সারতে সময় লাগবে না। মেয়েটা একটু নিজের খেয়ালে চলতে ভালবাসে। বিয়ের পর স্বভাব বদলে যেতে পারে। অনেকেরই যায়।

নিজের আগ্রহে বিয়েটা করেনি পরিতোষ, জ্যাঠার সংসারে সুরাহা হবে বলে রাজি হয়েছিল। মেয়ে দেখতেও যায়নি। সোজা বরবেশে পৌঁছেছিল বিয়ের আসরে। শুভদৃষ্টি, মালাবদল অবধি মেয়েটির মধ্যে কোনও পাগলামির লক্ষণ খুঁজে পায়নি। টের পেয়েছিল ঘটের ওপর হাতে হাত রাখার পর। পুরোহিত গামছা দিয়ে দু’জনের হাত মুড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিতোষ অনুভব করে মেয়েটা কী পরিমাণ অস্থির! সদ্য খাঁচায় পোরা পাখির মতো ছটফট করছিল ওর তালু। দশাসই চেহারার এক মহিলা ধরে রেখেছিল শীলার হাত। উনি সম্পর্কে শীলার মাসি।

বিয়েটা কোনওমতে পার হওয়ার পরই খেল দেখাতে শুরু করেছিল মেয়ে। ‘গা চুলকোচ্ছে’ বলে শাড়ি-গয়না সব খুলে ফেলার জোগাড়। মেয়ের বাড়ির লোক সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল নববধূকে। মেয়ের বাবা কপাল চাপড়াচ্ছিলেন পরিতোষের সামনে। পরিতাপের সুরে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন এই বলে, ওর মাথা এতটা খারাপ নয়। ইচ্ছে করে এরকম করছে। স্রেফ বদমাইশি। আমার মুখে চুনকালি লেপার চেষ্টা। মেয়ে পণ ধরেছিল, বিয়ে করবে না…

আরও অনেক কিছুই বলে যাচ্ছিলেন উনি। পরিতোষ ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিল কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে তার। তাও এতটুকু মাথা গরম করেনি। কটূ কথা শোনায়নি কারওকে। ধরে নিয়েছিল এটাই আমার ভবিতব্য। সান্ত্বনা বলতে এইটুকু, বড়জ্যাঠার ঋণটা শোধ হল।

পরের দিন গা ভরতি গয়না, আলুথালু শাড়ি পরা বউকে নিয়ে মাধবপুরের যৌথ পরিবারের বাড়িতে ঢুকেছিল পরিতোষ। তখনও নিজের বাড়িটা করেনি। একতলা ছোট বাড়িটা বিশাখাকে বিয়ে করার পর করেছে। এখন যখন চাষের কাজ দেখাশোনা করতে যায়, নিজের বাড়িতে থাকে, রান্না করে খায়। বিশাখা মাধবপুরে গেলে ওই বাড়িতেই থাকে।

শীলা শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়ে বিশেষ কোনও গন্ডগোল করেনি। একটু এলোমেলো কথা বলছিল আর বয়সে বড় কারওকে সামনে দেখলেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছিল, এর ফলে কিছু কাজের লোকও ফাউ প্রণাম পেয়ে যায়। গোল বাধল ফুলশয্যার রাতে। পরিতোষ যেই খিল দিয়েছে দরজার, হইচই লাগিয়ে দিয়েছিল শীলা। চিৎকার করে বলছিল, তোমার নিশ্চয়ই কোনও বদ মতলব আছে। তুমি নোংরামি করবে আমার সঙ্গে। খুলে দাও দরজা।

পণ্ড হল ফুলশয্যার রাত। বউ গিয়ে শুল মহিলামহলে। সারারাত ধরে গুনগুন সুরে কেঁদে গেল পরিতোষের মা। জ্যাঠামশাই বারদুয়ারে পায়চারি করে গেলেন। ভোরবেলা নতুন বউ উধাও! খোঁজ খোঁজ রব উঠে গেল। কিছু লোক দৌড়োল বউয়ের বাপের বাড়ি। অনেক পরে শীলাকে পাওয়া গেল বেরাদের বাঁশবাগানে। ওই জায়গাটা খোঁজার কথা লোকে ভাবেইনি। বেরাদের এক বউ ধানসেদ্ধর জন্য শুকনো বাঁশপাতা আনতে গিয়ে দেখতে পায়, নতুন বউ গালে হাত দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে। প্রথমটায় ভীষণ ভয় পেয়ে

গিয়েছিল বেরাদের বউ, তারপর লোকজন ডেকে আনে। শ্বশুরবাড়ির লোক শীলার কাছে জানতে চাইল, কেন গিয়েছিলে বাঁশবাগানে?

সকলে ভেবেছিল বউ হয়তো পায়খানা যাওয়ার কথা বলবে। তখন তাকে বলা হবে বাড়িতে তো পায়খানাঘর আছে। শীলা সেসব কিছু না বলে বলেছিল, চুল আঁচড়াতে গিয়েছিলাম। বাঁশবাগানে চুল আঁচড়াতে আমার খুব ভাল লাগে।

সবাই থ! শীলার কাছে কোনও চিরুনি পাওয়া যায়নি। আরও চারদিন গ্রামে ছিল পরিতোষ। মাঝে মধ্যে শীলাকে খুবই স্বাভাবিক লাগত, ঘরের কাজে বড়দের সাহায্য করছে, পোষা জীবজন্তুগুলোকে আদর করছে, গল্প করছে পরিতোষের সঙ্গে। জানতে চাইছে, কলকাতায় তুমি কী কাজ করো? কবে নিয়ে যাবে আমাকে? অল্পবিস্তর রাগঅনুরাগের কথা হত। তবে স্বামীকে গায়ে হাত দিতে দিত না। দরজা খোলা রেখে রাতে শুতে হত।

এইসব কথা পরিতোষের থেকেই জেনেছে বিশাখা। গায়ে হাত না দেওয়ার ব্যাপারটা বিশ্বাস করেনি। বিশাখা যাতে কষ্ট না পায়, সেইজন্যই বলছে, প্রথম বউয়ের সঙ্গে ওসব কিছু হয়নি। পুরুষের শরীরের খিদে কী জিনিস, জানে বিশাখা। শীলার গোলমাল ছিল মাথায়, শরীরে নয়। বিশাখার মতো খারাপ দেখতে মেয়েকে নিয়ে কর্তা যা হাপুস-হুপুস করত, শীলাকে ছেড়ে দেবে, এ কথা ভাবাই যায় না। বিয়ের পর বিশাখা লুকিয়ে শীলাকে দু’বার দেখে এসেছে, পরিতোষ জানে না। শীলাকে অবশ্য বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় দেখেছে বিশাখা, হাঁটুর নীচ অবধি শাড়ি, চুল খোলা, বিড়বিড় করতে করতে, হাত ঝাড়তে ঝাড়তে হেঁটে যাচ্ছে শ্যামচকের মাটির রাস্তা দিয়ে। দু’বারই ছিল বিকেল। মনে হচ্ছিল এক টুকরো ভোরের রোদ হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটা বিয়ের সময় কেমন দেখতে ছিল, ওতেই আন্দাজ পেয়ে যায় বিশাখা।

সে যাই হোক, পরিতোষ কিন্তু শীলার ব্যাপারে কর্তব্যে কোনও ত্রুটি রাখেনি। বউকে মাধবপুরে না রেখে কলকাতায় নিয়ে এসেছিল। তখন থাকত কসবায় চালাঘরের ভাড়াবাড়িতে। মনের ডাক্তার দেখাল শীলাকে। ডাক্তার বলল, সারার আশা নেই। রোগটা জন্মগত। যত দিন যাবে, বাড়বে। ওষুধ দিয়ে সামলে রাখা যেতে পারে।

শীলা ওষুধ খেতে চাইত না। পরিতোষ ভুলিয়ে-ভালিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করত। জোর করতে হত কখনও। গেটে তালা দিয়ে অফিস চলে যেত। শীলা রান্নাবান্না গুছিয়ে করতে পারত না। দু’জনের রুটি করতে গিয়ে দশজনের করে ফেলত। কিছু বলতে গেলে বলত, বাড়িতে আমরা দু’জনেই আছি নাকি? আরও কত লোক আছে! তারা না খেয়ে থাকবে?

ও কাদের দেখতে পেত জানে না পরিতোষ। পরিস্থিতি ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছিল। বাড়িওয়ালা, প্রতিবেশী শীলার কীর্তি দেখে হাসাহাসি করত। ওরাই পরিতোষকে বলেছিল, শীলা যখন বাড়িতে একা থাকে, বারান্দায় বসে কর গুনে কী যেন হিসেব করে বারবার!

পরিতোষও আড়াল থেকে লক্ষ করে ব্যাপারটা। শীলাকে যখন জিজ্ঞেস করে, তুমি কী হিসেব করো এত?

শীলা অস্বীকার করে। বলে, কই, কিছু হিসেব করি না তো! কীসের হিসেব করব! কী আছে আমার?

এইভাবেই চলছিল। শীলা যেদিন তালা মারা গেট ডিঙিয়ে বেরিয়ে গেল কলকাতায়, পরিতোষ বুঝে যায় বউকে এখানে রাখা বোকামি হয়ে যাবে। কলকাতার মতো নিষ্ঠুর শহরে যখন-তখন ক্ষতি হয়ে যেতে পারে শীলার। বাড়ি চিনে শীলা কিন্তু নিজেই ফিরে এসেছিল। পরিতোষ কোনও ঝুঁকি নেয়নি, পরের দিন শীলাকে মাধবপুরে দিয়ে আসে। ওষুধপত্র কখন কী খাওয়াতে হবে বুঝিয়ে দেয় নিজের মাকে। ওষুধ খাওয়ানো যায়নি শীলাকে। রোগের প্রকোপ দিনের পর দিন বেড়েছে। বড়জ্যাঠা একদিন সমস্ত গয়না, দান করা জমির কাগজ সমেত শীলাকে দিতে যান শ্যামচকে। শীলার বাবাকে বলেন, আপনার পাগল মেয়ে রইল। এ বিয়ে আমরা ভেঙে দিতে চাই।

ব্রজধর মাইতি পায়ে পড়ে যান বড়জ্যাঠার। বলেন, মেয়ে এ বাড়িতেই থাকুক। বিয়েটা আপনারা ভাঙবেন না। গ্রামে সম্মান চলে যাবে আমার। মেয়ের মাথায় সিঁদুর দেখে আমি শান্তিতে মরতে চাই।

বড়জ্যাঠা নরম মনের মানুষ। কড়া কথা আর কিছু বলতে পারেননি। মনে করে মেয়ের গয়নাগুলো ফেরত দিয়ে এসেছিলেন। বলেছিলেন, গয়না বউমার নিজের জিনিস। এগুলো থাক।

বাড়ি ফিরে বড়জ্যাঠা সমস্ত ঘটনা ফোনে পরিতোষকে জানিয়েছিলেন। পরিতোষ বলেছিল, আপনি জমির কাগজও ফেরত দিয়ে আসতে পারতেন।

বড়জ্যাঠা বলেছিলেন, কেন দেব? ওরা বিয়ে ভাঙবে না, তোমার স্ত্রীর পরিচয় নিয়ে ঘুরবে ওদের মেয়ে, বিনিময়ে কিছু দিতে হবে না!

পরিতোষ আর কথা বাড়ায়নি। বিয়ে, দেশের বাড়ির সমস্ত কিছুই ভোলার চেষ্টা করছিল। বড়জ্যাঠার জন্য যা করণীয় সে করেছে। বাকিটা উনিই বুঝে নেবেন।

কলকাতায় বসেই দেশের লোক মারফত পরিতোষ খবর পেত, শীলার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। সারাদিন বাড়ির বাইরেই থাকে। কখনও বেলতলায়, পুকুর ধারে, জঙ্গলে। কথা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। সারাক্ষণ বিড়বিড় করছে আর কর গুনছে। শীলাকে ফেরত দিতে গিয়ে এই কর গোনার ব্যাপারটা বড়জ্যাঠা বলেছিলেন, ব্রজধর মাইতিকে। জিজ্ঞেস করেছিলেন, ও সারাক্ষণ কেন ওরকম করে?

শীলার বাবা বলেন, মেয়েটার পড়াশোনার খুব মাথা ছিল। ও যখন ক্লাস থ্রি-ফোর, আমার চাষের হিসেবপত্তর ওকে দিয়ে কষাতাম। আমি তো টিপছাপ। মেয়েটার মাথাটা গোলমাল হয়ে গেল, হিসেবের অভ্যেসটা রয়ে গেছে।

এলোমেলো হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে বেখেয়ালে কখনও সখনও হিসেব মিলিয়ে ফেলত শীলা। পৌঁছে যেত শ্বশুরবাড়ির কাছে। দূর থেকে বাড়িটা দেখে ফিরে যেত। আর একটা হিসেবে ছিল পাকা, খিদে পেলে অন্য কোনও বাড়ি বা খাবার দোকানে দাঁড়াত না। ফিরে আসত নিজের বাড়ি। ওকে জোর করে চান করানো হত।

শীলার ওই পরিণতি চাক্ষুষ করতে চায়নি পরিতোষ। মা মারা যেতে আসতেই হয়েছিল দেশে। ঘাটকাজের পর রাস্তায় শীলা একদিন মুখোমুখি হয়ে যায়। পরিতোষকে চিনতে পারেনি শীলা, সেটা পরিতোষের ন্যাড়ামাথার জন্য, নাকি চেনার ক্ষমতাটাই চলে গেছে,

বুঝতে পারেনি পরিতোষ। শীলার হাতে একটা কঞ্চি ছিল, সঙ্গী একটা কুকুর। কঞ্চিটা সম্ভবত আত্মরক্ষার জন্য, গ্রামের বাচ্চাগুলো হয়তো জ্বালায়।

শীলার ওই চেহারা দেখে পরিতোষ ঠিক করে নেয়, জীবনে আর দেশের বাড়ি আসবে না।

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার কী হবে বলো তো?

পরিতোষের গলা পেয়ে সংবিৎ ফেরে বিশাখার। অতিদূরমনস্ক হয়ে থাকার ফলে কথাটা বুঝে উঠতে পারে না। অবোধ দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। পরিতোষ বলে, সোজা এখন শ্যামচকে গেলে ভাত জুটবে বলে মনে হয় না। ওদের বাড়ির এখন যা অবস্থা। তার চেয়ে বাড়ি গিয়ে দুটি ফুটিয়ে নিয়ে চান-খাওয়া করে ও বাড়ি গেলে হয় না?

প্রস্তাবের ভিতরটা পড়ার চেষ্টা করে বিশাখা। প্রথমপক্ষ মৃত্যুশয্যায় থাকা সত্ত্বেও পরিতোষ যে বিচলিত নয়, সেটাই কি দ্বিতীয়পক্ষের কাছে প্রমাণ করতে চাইছে? সম্ভবত তাই। কিন্তু ওকে এত উদাসীনতার ভান করতে দেওয়া চলবে না। পরিতোষ নির্বিকার হলে, বিশাখার এই ঘটনায় দৌড়ে আসাটা বাড়াবাড়ি দেখাবে। উদ্দেশ্যটা ধরা পড়ে যেতে পারে। সেই কারণে বিশাখা বলে, খাওয়াটা কি বড় হল? মানুষটা এখন মৃত্যুর দোরগোড়ায়। তাড়াতাড়ি পৌঁছোতে না পারলে, শেষ দেখাটা হয়তো হবে না। ট্রেনে আসতে গিয়ে এমনিতেই দেরি হয়েছে আমাদের।

পরিতোষ আর কিছু বলে না। জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ট্রেনের বাইরে এখন শুধুই ধানখেত আর চালাবাড়ি। দিঘার লাইন বেশিদিন চালু হয়নি, এখনও দু’পাশ অনেক সবুজ আছে। সিঙ্গল লাইন। কখনও মনে হচ্ছে যেন গৃহস্থের উঠোন দিয়ে চলে গেল। ভিটের গাছগুলো গায়ে হাত বোলাল ট্রেনের। পরিতোষ যতই নির্বিকারভাব দেখাক, দেশের বাড়ির প্রতি ওর টান প্রবল। যত দিন গেছে, সেটা বেড়েছে। ওই টানের মধ্যে জড়িয়ে আছে শীলাও। আধময়লা, পাগল শীলার প্রতি ওর কোনও আকর্ষণ নেই। না থাকারই কথা। আছে শীলাকে বিয়ের সূত্রে পাওয়া জমিগুলোর ওপর। পরিতোষ বলে, নিজের জমির ধানের দোলা দেখার মতো সুখ আর হয় না। ও আসলে জমিতে শস্যের বেশে শীলাকেই দেখে। মেয়ের বিয়ের গয়নার জন্য সে জমি পরিতোষ বিক্রি করতে পারবে না। এই দুর্বলতা ও ভালবাসা তো শীলারই প্রাপ্য। বিশাখা নিশ্চিত, শীলাকে পরিত্যাগ করার জন্য পরিতোষ অপরাধবোধে ভোগে। শীলার জমির ফসল থেকে ও নিয়মিত রোজগার করে চলেছে। ভদ্রেশ্বরের বাড়ি তৈরিতে কাজে লাগিয়েছে ধান বিক্রির টাকা। বিশাখাকে দিয়েছে। সেই টাকা একটু একটু করে জমিয়ে গয়না গড়িয়েছে বিশাখা। সেই টাকাতে দানধ্যানও করেছে পরিতোষ। আসল মানুষটা বঞ্চিত থেকে গেছে। সেই মানুষটা আজ যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে, পরিতোষের মধ্যে হা-হুতাশ থাকা উচিত। মনের ভিতরটা নিশ্চয়ই ছটফট করছে ওর। বিশাখার সামনে সেটা চেপে রাখার চেষ্টা করছে। ধরা পড়ে গেলেই বিশাখাকে বলা সমস্ত মিষ্টি মিষ্টি কথা যে মিথ্যে হয়ে যাবে।

পরিতোষ যখন শীলাকে দেশের বাড়ি ছেড়ে যায়, বিশাখার ক্লাস ফোর। সেই যুগে গ্রামের দিকে বউ পরিত্যাগের ঘটনা হামেশাই ঘটত। পাগল বউ পোষার কোনও প্রশ্নই ছিল

না। দিন যেতে যেতে লোকে ভুলেই গেল শীলার কখনও বিয়ে হয়েছিল। গ্রামের মানুষের তখন অনেক কাজ। জীবন নির্বাহ করতে ওষ্ঠাগত প্রাণ। শহরের মানুষের মতো কেচ্ছা করার সময় কোথায়? প্রত্যেক গ্রামে যেমন একজন স্থায়ী পাগলি থাকে, শীলা সেরকমই একজন হয়ে গেল শ্যামচকের।

পরিতোষদের থেকে বিশাখার কাছে সম্বন্ধ এসেছিল আট বছর পর। বিশাখা তখন হায়ার সেকেন্ডারি দেবে। দাদা কলকাতার কলেজে পড়াশোনা করছে। বাবা মারা গেছে এক বছর হল। এক সন্ধেবেলা বিশাখা বিছানায় বসে দুলে দুলে পড়ছে, জানলার বাইরে চোখ যেতে দেখেছিল একটা টর্চের আলো এগিয়ে আসছে। স্পেশাল টর্চ, বাবা কিনে দিয়েছিল কাকাকে। কলকাতার দিকে ওই টর্চ তখন নতুন বেরিয়েছে। হ্যান্ডেলওলা, হারিকেনের মতো ঝুলিয়ে নেওয়া যায়।

কাকার বাড়ি পাশেই। বাবারা দু’ভাই। বাবা মারা যাওয়ার পর, কাকা কদাচিৎ আসত বিশাখাদের বাড়ি। পাছে কোনও দায়িত্ব পড়ে যায়। কাকাকে আসতে দেখে তাই খুব অবাক হয়েছিল বিশাখা।

বাড়ির গা দিয়ে কাকা সোজা গিয়ে উঠেছিল পাকশালায়। মা তখন বাবার কিনে দেওয়া পাম্পস্টোভে ভাত ফোটাচ্ছে। বিশাখা বাইরে দাঁড়িয়ে আড়ি পাতে। কাকা বলল, বিশাখার জন্য একটা সম্বন্ধ পেয়েছি বউদি। পাত্র কলকাতায় থাকে, সরকারি চাকরি করে। বিশাখা কলকাতাতেই থাকবে। পাত্র দেখতে শুনতে বেশ ভাল, একটাই শুধু গন্ডগোল, আট বছর আগে নামমাত্র বিয়ে হয়েছিল। বউ পাগলি। পাত্রর বাড়ি থেকে কোনও ডিমান্ড নেই। এখন তুমি কী বলো?

মা বলেছিল, আমি কী বলব? মেয়ে তোমাদের বাড়ির, তুমি ওর গুরুজন, যা ভাল বুঝবে করবে।

বিশাখা বুঝে গিয়েছিল এ বিয়ে হবেই। এর চেয়ে ভাল পাত্র তার কপালে জোটার কথা নয়। একেবারে সোনার পাত্র বলা যায়। খাদ বলতে পাগলি বউ। তবু ভাল সতিন নিয়ে ঘর করতে হবে না। সব বুঝেও একটা নিরুপায় রাগ হচ্ছিল বিশাখার। রাগটা আরও বাড়ল, পরিতোষ যখন দেখতে এল, বয়সটা চেপে গিয়েছিল কাকা। অনেকটাই বড় পরিতোষ, মুখেচোখে ভালমানুষিভাব, খানিকটা বুঝি দুঃখী দুঃখীও লাগছিল ওকে। বিশাখার মনে হয়েছিল সবটাই অভিনয়, লোকটা অনেকদিন আগে জন্মে, ওত পেতে ছিল কবে বিশাখার মতো কচি বউ পাবে। রাগটা জুড়োনোর জন্য বিশাখা বিয়ের ক’দিন আগে বিশুদাকে নিজের পুরো শরীরটাই তুলে দেয়। বিবাহিত বিশুদা অনেকদিন ধরেই ছোঁক ছোঁক করছিল। থালা চেটে নামিয়ে দিল বিশাখাকে। নিশ্চিন্তে বিয়েতে বসেছিল বিশাখা। পাগলি বউয়ের শোধ তুলে নিয়েছে বিশুদাকে দিয়ে। খুবই অনাড়ম্বরভাবে বিয়েটা হল। দু’বাড়িতেই হাতে গোনা লোকজন খেল। বিশাখাদের সামর্থ্য ছিল না, পরিতোষরা বিয়ের ঢাক পেটাতে চায়নি। দোজবরকে বিয়ে করতে হচ্ছে বলে কেউ উপহাস করেনি বিশাখাকে। ওর চেহারায় যেন দোজবরের বউ হওয়ার ছাপ ছিল। গ্রামের দিকে তখন পুরুষদের দু’-তিনটে বিয়ে কোনও ব্যাপারই নয়।

বাবার বন্ধু বিমলকাকার ছিল মিষ্টির দোকান। ফ্রি-তে মিষ্টি দিয়েছিল বিশাখার বিয়েতে। বিমলকাকার চারটে বিয়ে। প্রথমপক্ষ অল্পবয়সে মারা যায়। বাকি তিন বউ একসঙ্গে শান্তিতে সংসার করত। বিমলকাকা বিয়েতে আশীর্বাদ করার সময় বিশাখার মাথায় হাত রেখে বলেছিল, বয়স্ক বর তো, বেশি আদর পাবি, দেখবি। সুখে থাকবি।

বিয়ের পর মাধবপুরে বিশাখাকে একা রাখেনি পরিতোষ, ভদ্রেশ্বরের বাড়িতে এনে তুলেছিল। এটা আর একটা ধাপ্পা, বিশাখা জানত পাত্র খোদ কলকাতায় থাকে। তাকে তেমনই বলা হয়েছিল। তবে ভদ্রেশ্বর জায়গাটা খারাপ লাগেনি বিশাখার। ভদ্রেশ্বরের বাড়িতেই হায়ার সেকেন্ডারি পাশের খবরটা পেয়েছিল বিশাখা। কাকা ফোন করে পরিতোষের অফিসে জানিয়েছিল। বিয়ের তোড়জোড়ের মধ্যেই পরীক্ষাটা দিয়েছিল বিশাখা। কত ভাবনা ছিল, পাশ করলে বন্ধুরা মিলে বেলদা কলেজে ভরতি হবে। পরিতোষ অবশ্য জানতে চেয়েছিল, পড়াশোনা আর করতে চায় কি না?

বিশাখা ‘না’ করে দিয়েছিল। বিয়ের পর পড়াশোনা করে আর কী হবে! কপালে যেমন পাত্র জোটার ছিল, সে তো জুটেই গেছে। তা ছাড়া এখানে তার চেনা কেউ নেই। সবই নতুন বন্ধু হবে। মাথায় সিঁদুর নিয়ে তাদের সঙ্গে ক্লাস করতে ভাল লাগবে না।

ইতিমধ্যে শীলার সম্বন্ধে সব কথাই বলেছে পরিতোষ। যার মধ্যে একটা কথা খুব সাংঘাতিক, পাগল বউ নাকি বেভুল অবস্থাতে অনেক সময় ঠিক পথে চলে আসে। মাধবপুরে চলে এসে দূর থেকে দেখে শ্বশুরবাড়ি। এদিকে পরিতোষ মাঝে মাঝেই চাষের কাজে দেশের বাড়ি যায়। ভীষণ দুশ্চিন্তায় সেই সময়টা কাটাত বিশাখা। টেনশনটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, বাপের বাড়ি গিয়ে বিশাখা কাকার ছেলেকে সঙ্গে করে শ্যামচকে যায়, তখনই দেখেছিল, বিকেলের রাস্তায় ভোরের হেঁটে যাওয়া। পরেরবার একা গিয়েছিল, কাছ থেকে দেখবে বলে শীলার মাথায় এখনও সিঁদুর আছে কি না। পরিতোষ দেশের বাড়ি থেকে ফিরত বড় পরিতৃপ্ত মুখ নিয়ে। শীলার কাছাকাছি যেতে পারেনি বিশাখা। কেউ একজন পিছু নিয়েছে বুঝে, পালিয়ে গিয়েছিল পাগলি।

গোপা পৃথিবীতে এল। বিশাখা ভেবেছিল দেশের বাড়ির প্রতি টান একটু কমবে পরিতোষের। কমেনি, বরং বেড়েছিল। বিশাখা বুঝেছিল পরিতোষকে কোনওদিনই তার পুরোপুরি পাওয়া হবে না। শীলা ভাগ বসিয়ে যাবেই। ফিরে এসেছিল গায়ের জ্বালা। সেই সময় ভদ্রেশ্বরের বাড়িতে সোমনাথ প্রায়ই আসত। পরিতোষের দেশতুতো ভাইপো। তার সঙ্গে শোয়াশুয়ির সম্পর্কে জড়িয়ে যায় বিশাখা। উদ্যোগ ছিল বিশাখারই। পরিতোষ দেশের বাড়ি গেলেই সোমনাথকে ডেকে নিত। তবু জুড়োত না জ্বালা। সাবান দিয়ে মুখ ধুলে কিছুক্ষণ ফরসা ভাব থাকে। তারপর তো সেই ফিরে আসে নিজের রং।

গোপা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোমনাথের সঙ্গে সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসে বিশাখা। মায়ের ওপর মেয়ের কোনও খারাপ ধারণা হোক, চায়নি। তার দুর্ভাগ্যের জন্য মেয়ের মনটা বিষিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। পরিতোষ ধীরে ধীরে নিজস্ব একটা বাড়ি তৈরি করে নিল মাধবপুরে। মূলবাড়ির একটু তফাতে। জ্যাঠতুতো ভাইবোনের মধ্যে বনিবনা নেই, এ বাড়িতে অশান্তি লেগেই আছে। পরিতোষ নিজের মতো থাকত, ফুটিয়ে খেত আর

পয়সা ঢালত চাষে। প্রথমদিকে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিশাখা বেশ কয়েকবার ও বাড়িতে থেকে এসেছে। আত্মীয়, প্রতিবেশীরা তাকে খাতির করেছে খুবই। ভুলেও শীলার নাম মুখে আনেনি। বিশাখা কিন্তু কান পেতে থাকত, এরা একবার বলুক, পাগলি নতুন বাড়িতে ঢুকে পড়ে। অথবা পরিতোষ এখানে এলেই ঘনঘন শ্যমচকে যায়। সেসব কিছুই বলত না তারা। কেবলই পরিতোষের গুণগান।

দেখো, ছেলেটা কত ভাল! নিজের গ্রামকে ভোলেনি। গ্রাম থেকে কলকাতায় একবার যারা যায়, আর কখনওই ফেরে না। বিক্রি করে দেয় এখানকার জমি। চাষ থেকে কীই বা আয় হয়! পরিতোষ তবু চাষ দিয়ে যাচ্ছে জমিতে… এ সব শুনলে মনে হত পরিতোষ বুঝি টাকা খাইয়ে রেখেছে গ্রামের লোকেদের। আবার একই সঙ্গে মনে হত, পরিতোষের মনের ভিতরে শীলার প্রতি টান থাকতেই পারে। তার ছায়া কখনওই বিশাখার সংসারে পড়বে না। কিন্তু পড়েছিল। একবার ছোট্ট গোপাকে নিয়ে মাধবপুর থেকে ভদ্রেশ্বরে ফিরেছে বিশাখা। গোপা বলেছিল, হ্যাঁগো মা, আমার নাকি আর একটা মা আছে? পুতুলপিসি বলছিল।

ধড়াস করে উঠেছিল বিশাখার বুক। মেয়েকে বলে, ওসব বাজে কথা। তোকে খেপানোর জন্য বলেছে।

এরপর থেকে ভীষণ সাবধান হয়ে গিয়েছিল বিশাখা। খুব প্রয়োজন ছাড়া মাধবপুরে যেত না। গোপার মনেও ঢুকিয়ে দিয়েছিল মাধবপুরের প্রতি বিদ্বেষ। বলত, একেবারে গেঁয়ো জায়গা। ওখান থেকে ঘুরে এলে গায়ে ছাপ পড়ে যায়। শহরের লোকরা ধরতে পারে এরা গ্রামের লোক। দেখিস না, এখানকার লোকেরা তোর বাবার সঙ্গে মিশতে চায় না।

লজ্জা অপমান থেকে বাঁচতে এই রাস্তা নিয়েছিল বিশাখা। আজ সমস্ত অপমানের দাম উসুল করতে হবে।

কাঁথি পেরিয়ে গেল ট্রেন। আর একটা স্টেশন পরেই সুজালপুর। এখানে নেমে ভ্যানরিকশা করে যেতে হবে শ্যামচক। পথে মাধবপুর পড়বে। জানলার বাইরে তাকিয়ে বিস্তৃত ধানখেত দেখে বিশাখা। এখন বোরো ধানের সময়। বিশাখার দৃষ্টিপথে যত দূর পর্যন্ত চাষের জমি দেখা যাচ্ছে, এর সব ফলন বেচে যা লাভ হবে, তা দিয়েও পাঁচভরি সোনা হবে না। তবু এখানকার মানুষ পরম মমতায় চাষ করে যাচ্ছে। এই দরদই চাষিবাড়ির ছেলে পরিতোষের থেকে পেয়ে এসেছে শীলা। মেয়েটা কোনও কাজেই লাগল না, তবু মমতা থেকে বঞ্চিত হয়নি।

ভ্যানরিকশায় চেপে মাধবপুরে চলে এসেছে বিশাখারা। ওই দূরে দেখা যাচ্ছে পরিতোষের তৈরি করা একতলা পাকাবাড়ি। পিছনে সোনাঝুরি বন। পরিতোষ বলে, এখনও ভেবে দেখো, নামবে কি না? যথেষ্ট বেলা হয়েছে। ভালই খিদে পাচ্ছে আমার।

না-না, আগে ও বাড়ি চলো। বলে ওঠে বিশাখা। রোদের ভালই তেজ। বড় করে ঘোমটা টেনেছে বিশাখা। কিছুটা নিজেকে আড়াল করার জন্য, বাকিটা রোদ।

দ্বিতীয়পক্ষ যাচ্ছে প্রথমপক্ষের কাছে, এটা দেখে গ্রামের লোক মজা পাক, চাইছে না। তবে গ্রামের লোক খবরটা জানে না বলেই মনে হচ্ছে। উলটোদিক থেকে আসা তিনচারজনের সঙ্গে কথা হল পরিতোষের, তারা কেউ সাইকেলে, কেউ-বা হেঁটে। তারা জানতে

চাইল, কী গো পরিতোষদা, কোথায় চললে? এলে কবে?

সবাইকেই পরিতোষ বলল, দুপুরের ট্রেনে এলাম। এই এদিকে একটু কাজ আছে। পাগলির অসুস্থতার খবর কেই-বা রাখতে যাবে! কী দায় আছে। শীলার মাথায় স্ট্রোক হয়েছে। এমনটাই খবর এসেছে ফোনে। অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে বউটা।

শ্যামচকে এসে পড়েছে রিকশা। এলাকাটা চেনাচেনা ঠেকে বিশাখার। বহু বছর আগে এসেছিল। ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছটা এখনও আছে। পরিতোষ হাত তুলে দেখায়, ওই যে, বাড়িটা।

বিরাট এলাকা জুড়ে একতলা বাড়ি। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সদর হাট খোলা। বাড়ির সামনে কোনও লোকজন দেখা যাচ্ছে না। তা হলে কি সব শেষ? শীলাকে নিয়ে চলে গেছে শেষ যাত্রায়? বিশাখা মনে মনে বলে, তা যেন না হয় ভগবান। আরও একটু বাঁচিয়ে রাখো। অপমানের মূল্য চোকানোর শেষ সুযোগটা দাও।

দোরগোড়ায় পৌঁছোল রিকশা। পাঁচিলের গায়ে ছোট্ট রোয়াক। একটা বেড়াল জোড়া থাবায় মুখ রেখে চিন্তিত মুখে বসে আছে। বিশাখাদের দিকে অলস দৃষ্টিতে তাকাল। ভাড়া মিটিয়ে রিকশাওলাকে ছেড়ে দেয় পরিতোষ। সদর পেরিয়ে দু’জনে উঠোনে নামে। একজন বয়স্ক মানুষ বারান্দা থেকে নেমে এগিয়ে আসছেন, আন্দাজ করা যায় ইনিই শীলার বাবা। চেহারা এককালে দশাসই ছিল, এখন বুড়িয়ে গেছেন। ভদ্রলোক বিশাখাকে দেখে ভীষণ রকম চমকেছেন, মুখে কিছু প্রকাশ করলেন না। বললেন, এসো। তোমাদের দেখার জন্যই হয়তো বেঁচে আছে।

বিশাখা ভগবানকে ধন্যবাদ দেয়। কথা রেখেছেন। সহানুভূতি দেখিয়ে কার্যোদ্ধার করা যাবে। শীলা চলে গেলে উদারতা দেখানো যেত না। এরা পাত্তাই দিত না বিশাখাকে। ঘরে এসে একটু থমকাল বিশাখা। বিছানায় শুয়ে থাকা কাঁচাপাকা চুলের শীলাকে পাগল বলে মনে হচ্ছে না। চোখমুখ একেবারে স্বাভাবিক। পরিতোষ মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। শীলার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, লোক চিনতে পারছে?

সবাইকে পারছে না। তুমি ডেকে দেখো, সাড়া দেয় কি না। বললেন শীলার বাবা। ডাকতে হল না। শীলা নিজেই চোখ তুলে পরিতোষকে কী যেন বলতে চাইছে। কথা স্পষ্ট হচ্ছে না। ঘরে এখন অনেক লোক। এক মহিলা শীলার মুখের কাছে কান নিয়ে গেলেন। শীলার কথা বুঝে নিয়ে পরিতোষকে বললেন, তোমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলছে, কলকাতায়। চকিতে বেসামালভাব দেখা গেল পরিতোষের মুখে। মুহূর্তে দুর্বলতাটাকেই কাজে লাগিয়ে দিল। শীলার বাবাকে বলল, চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়া যায় কি?

কাঁথির ডাক্তার বলেছে কোনও লাভ নেই। কলকাতায় যেতে যেতে আবার অ্যাটাক হতে পারে। যদিও বা বেঁচে যায়, চিকিৎসার বিরাট খরচ। তাও যে হেঁটে চলে বেড়াতে পারবে তার কোনও গ্যারান্টি নেই। একটু থেমে শীলার বাবা বললেন, আর ওকে বাঁচিয়ে রেখেই বা কী লাভ? অনেক জ্বালিয়েছে।

শেষের দিকে ভদ্রলোকের গলাটা একটু ধরে এল। পরিতোষ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বিশাখা শীলার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। চিনতে পারছে না শীলা, চেনার কথা নয়।

অবলা পশুর মতো তাকিয়ে আছে। বিশাখা শীলার কাঁচাপাকা চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। ওর সিঁথিতে সযত্নে পরানো সিঁদুর। নিজে পরেনি, কেউ পরিয়ে দিয়েছে।

ঘরে গোঙানির শব্দ উঠল। বিশাখা মুখ তুলে দেখে, শীলার বাবা কান্না সামলাচ্ছেন। পায়ে পায়ে শীলার বাবার কাছে যায় বিশাখা। ওঁর কনুই ধরে পিঠে হাত রাখে। মুখে হাত চাপা দিয়ে কেঁদে ওঠেন উনি। বাড়ির অন্যরা তাঁকে ঘিরে ধরে। বিশাখা বেরিয়ে আসে বাইরে।

পরিতোষ মাথা নিচু করে বসে রয়েছে বারান্দায়। থামের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় বিশাখা। বাতাসে মৃত্যুর গন্ধ ভাসছে। খানিক বাদেই একদম স্বাভাবিক চেহারায় বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন শীলার বাবা। বিশাখাকে বললেন, তোমরা তো খাওয়াদাওয়া করবে। যাও, স্নানটান সেরে নাও।

জ্যাঠার ওখানে ভাত চাপিয়েছে। আমরা ফিরে গিয়ে খাব। বিশাখার হয়ে উত্তরটা দিল পরিতোষ। নির্জলা মিথ্যে। এ বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাইছে। শীলার বাবা কাকে যেন রিকশা ডেকে আনতে বললেন। ঠিক আছে, তোমরা গিয়ে বিশ্রাম করো। তেমন কিছু হলে আমি খবর পাঠাব।

কথা শেষ হতেই বাড়ির এক মহিলা জল-মিষ্টি নিয়ে আসেন। বিশাখা ইতস্তত করছিল। পরিতোষ প্লেট থেকে মিষ্টি তুলে মুখে পোরে। নিরাসক্তভাবটা বজায় রেখেছে দিব্যি। ভিতরটা নিশ্চয়ই পুড়ছে।

সন্ধে উতরে গেছে। মাধবপুরের বাড়িতে বসে টিভি দেখছে বিশাখা, সঙ্গে পাড়ার মেয়েরা জুটেছে অনেক। এদের কারও বাড়িতেই টিভি নেই। বিশাখার সঙ্গে গল্প করতে এসেছে এরা। জানতে চাইছে, কেন হঠাৎ এলে? শীলার খবর এ গ্রামে পৌঁছায়নি। বিশাখা বলেছে, এমনিই এলাম, অনেকদিন আসিনি।

টিভিটা এ বাড়িতে মেয়ে-বউয়ের জন্য কিনেছিল পরিতোষ। নিজে এখানে থাকলে দেখে না। তাস পেটায় ক্লাবে। আজ অনেকদিন পর টিভিটা কাজে লাগছে। যদিও সিরিয়ালটায় মন নেই বিশাখার। ভদ্রেশ্বরে একটা এপিসোডও মিস করে না। বিশাখার মন পড়ে আছে শীলাদের বাড়িতে, কখন নিভে যাবে প্রাণটা। নিভবে খুব তাড়াতাড়ি, খুব স্পষ্ট করে মৃত্যুর গন্ধ পেয়েছে বিশাখা। বাড়ি এসে ভাত খেতে খেতে বিকেল হয়ে গেল। তারপর দু’জনে গিয়েছিল বড়জ্যাঠাকে দেখতে, দেখার কিছু নেই। কানে শুনতে পান না, চোখেও দেখেন না। উবু হয়ে বসে থাকেন বারান্দায়। স্পর্শ দিয়ে চেনেন আপনার লোককে।

ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরিতোষ বলল, তুমি ঘরে যাও। আমি জমিজমাগুলো দেখে আসি।

সেই যে গেছে, এখনও ফেরার নাম নেই! মোবাইল রেখে গেছে। মেয়েকে ফোন করেছে বিশাখা। বলেছে, দাদু এখন একটু সুস্থ। কাল বলতে পারব, কবে ফিরছি। গোপা বলল, পল্লব ফোন করেছিল। তোমাদের খুঁজছিল।

বিশাখা বলেছে, ঠিক আছে। আমরা বাড়ি ফিরে কথা বলব।

মেয়ের ফোনের পর একঘণ্টা কেটে গেছে। পরিতোষ কোথায় গিয়ে বসে আছে, কে জানে! শ্যামচকে চলে গেল না তো?

ভাবনা শেষ হতেই ঘরে ঢুকল পরিতোষ। বিশাখা সকলের কান বাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, কোনও খবর হল?

কথাটা বুঝতে একটু সময় নেয় পরিতোষ। বলে, না। খবর তো এখানে এসে দিয়ে যাওয়ার কথা।

বিশাখা বিছানা থেকে নামে। রাতের খাবার রাঁধতে হবে। এখানে রান্না করার অনেক হ্যাপা। গ্যাস নেই। স্টোভে রাঁধতে হয়।

অভ্যেসমতো ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গেল বিশাখার। কাল রাত অবধি কোনও খবর আসেনি। পরিতোষ ও বাড়ি নিয়ে কোনও চিন্তাই করছে না। মেয়ের বিয়ের খরচ কীভাবে সামলাবে ভাবছে। কাল বলল, বাড়ির পিছনের গাছগুলো বিক্রি করে দেব ঠিক করলাম। গোপার বিয়েতে টাকাটা লাগবে। কেনার লোক ঠিক করে ফেলেছি। তিরিশ হাজার মতো পাব।

এক্সট্রা গয়না নিয়ে মোটেই ভাবছে না পরিতোষ, ধরেই নিয়েছে বিশাখা দেবে। কত লোক নেমন্তন্ন করবে, সেই নিয়ে আলোচনা করল। বিশাখার শুনতে ভাল লাগছিল না, গয়নার ব্যাপারটাতেই সে আটকে রয়েছে। দরজা খুলে বারান্দায় আসে বিশাখা। এ বাড়ির ডিজাইনটা ভদ্রেশ্বরের বাড়ির মতোই। বারান্দাটা শুধু গ্রিল ঘেরা নয়। ভোরের দিকে এখানে বেশ শীত শীত করছে, মার্চের মাঝামাঝি। বাইরে আলো এখনও ভাল করে ফোটেনি। বিশাখার হঠাৎ চোখ যায় জামগাছতলায়, কে যেন সাইকেল নিয়ে এ বাড়ির দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রথমটায় একটু ভয় ভয় করে। সেটা কাটিয়ে বিশাখা হাঁক দেয়, কে, কে ওখানে? কী

চাই?

সাইকেল গড়িয়ে এগিয়ে আসে একটা ছেলে। কুড়ি-বাইশ বয়স হবে। বারান্দার সিঁড়ির কাছে এসে বলে, একটা খবর আছে। শ্যামচকের মাইতিবাড়ি থেকে পাঠাল।

বিশাখা বুঝতেই পারে, কী খবর। বলে, তুমি ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন? আপনাদের ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করছিলাম। বিশাখা জানতে চায়,কখন হল?

রাত দুটো নাগাদ।

দাঁড়াও, ওকে ডাকি। বলে, ঘরে ঢোকে বিশাখা। অকাতরে ঘুমোচ্ছে পরিতোষ। বিশাখা আস্তে করে ডাকে, ওগো, শুনছ! বেশ কয়েকবার ডাকার পর ঘুম ভাঙে পরিতোষের। উঠে বসে বিছানায়। জানতে চায়, কী হয়েছে?

খবরটা মুখ ফুটে বলে উঠতে পারে না বিশাখা। পরিতোষ নিজেই বুঝে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে আসে। বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলে, আমার জামা, টাকাপয়সা দাও।

শ্মশান থেকে পরিতোষ ফিরল দুপুরে। চান করেই এসেছিল। ফের একবার চান করে খেতে

বসেছে। বিশাখা শীলার মরদেহ দেখতে যায়নি। একা ছিল বাড়িতে। ভোর থেকে সকাল হতে দেখল। দূরে স্পষ্ট হল শীলার নামে পাওয়া জমি। আসল মানুষটা রাতের অন্ধকারে নিঃসাড়ে চলে গেছে। রান্না করে রেখেছিল বিশাখা, যদি এসে খায় পরিতোষ। বুঝতে পারছিল না, ও বাড়ি থেকে কখন ছাড়া পাবে।

এখন ভারী তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছে পরিতোষ। কে বলবে, রাতে বউ মারা গেছে লোকটার! মাছ রাঁধোনি? কারওকে বললেই তো পুকুরে ছিপ মেরে দিত।

পরিতোষের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকায় বিশাখা। বলে, তুমি মাছ কী খাবে গো! তোমার না অশৌচ!

না-না, আমি ওসব মানব না। বলে পরিতোষ

বিশাখা বলে, মানবে না কেন! তোমাকে তো শ্রাদ্ধের কাজ করতে হবে।

কিচ্ছু করতে হবে না। ওরা সব ম্যানেজ করে নেবে। আজ বিকেলের ট্রেনে আমরা ফিরে যাব। ওদের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি।

পরিতোষের কথা শুনে থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে বিশাখা। তারপর বলে, আমি একবার ওদের বাড়ি যাব।

কেন?

দরকার আছে।

কথাটা এমন গম্ভীরভাবে বলল বিশাখা, পরিতোষ ওর দিকে একবার তাকিয়ে, চুপ করে রইল।

ব্যাগ ট্যাগ নিয়েই শ্যামচকের উদ্দেশে রওনা হল বিশাখারা। ও বাড়ি হয়ে সোজা স্টেশনে চলে যাবে।

ফের শীলাদের বাড়ির সামনে পৌঁছোল বিশাখা। উঠোনে বেশ ক’টা বাচ্চা হুটোপাটি করছে। সদর দিয়ে পরিতোষদের ঢুকতে দেখে শশব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন শীলার বাবা। বিশাখা প্রথমেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। আগেরবার করা হয়নি, বাড়িতে তখন সিরিয়াস কন্ডিশন। শীলার বাবাকে কালকের তুলনায় একটু ঝরঝরে লাগছে। ভালমন্দ যাই হোক, একটা নিষ্পত্তি তো হল। ভদ্রলোক বললেন, শেষ সময়ে তুমি আসাতে বড় খুশি হয়েছি মা। তোমার ভালবাসা পেয়ে মেয়ে যখন ওপরে গেছে, নিশ্চয়ই শান্তিতে থাকবে। বিশাখা একবার আশপাশটা দেখে নেয়, কেউ নেই। পরিতোষ দূরে দাঁড়িয়ে একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। বিশাখা মুখ তুলে শীলার বাবাকে বলে, আপনার থেকে একটা ব্যাপার আমার জানার আছে।

বলো না, কী জানতে চাও? বলার পর ভদ্রলোক বললেন, এসো না, ঘরে এসে বলো।

শীলার বাবাকে অনুসরণ করে একটা ছোট ঘরে আসে বিশাখা। ঘরটা সম্ভবত ওঁর নিজস্ব। একটা ইজিচেয়ার আছে। বিশাখা ভদ্রলোকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিনীত কণ্ঠে বলে, আসলে ব্যাপারটা হল কী, আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। তিনমাস বাদেই বিয়ে। দিদি

চলে গেল। আমরা কি অশৌচের মধ্যে পড়ে গেলাম? বিয়ের তারিখ কি একবছর পিছোতে হবে?

না-না। পিছোবে কেন! ওর নিজের কেউ তো মারা যায়নি। ফলে ওর কোনও অশৌচ নেই।

ভদ্রলোকের বলা শেষ হতেই বিশাখা আসল চালটা চালে। বলে ওঠে, অবশ্য বিয়ে আদৌ দিতে পারব কি না, জানি না। ছেলের বাড়ি থেকে হঠাৎ পাঁচভরি সোনা ডিমান্ড করে বসেছে। আপনাদের জামাই টাকাটা কোথা থেকে জোগাড় করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। যদি বিয়েটা দিতে পারি, আপনারা আশীর্বাদ করতে আসবেন কিন্তু। বলার পর চলে

যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিল বিশাখা। শীলার বাবা বললেন, একটু দাঁড়াও।

বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছে বিশাখা। ফিরে এলেন ভদ্রলোক। হাতে লালশালুতে মোড়া কিছু জিনিস। এটারই অপেক্ষা করছিল বিশাখা। পুঁটলিটা বিশাখার হাতে তুলে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, শীলার গয়নাগুলো তোমার প্রাপ্য। কাল তোমাকে দেখেই, এগুলো গুছিয়ে রেখেছিলাম।

বিশাখার বুক জুড়ে শান্তি নেমে আসে। যেন ডুবসাঁতার দিচ্ছে পুকুরের গভীরে, যেমন ছোটবেলায় দিত। শরীরময় লেগে যেত শ্যাওলার গোপন স্নেহ।

আনন্দের চোটে সোনার ওজনটা আন্দাজ করা গেল না। ফেরার ট্রেনে সারাক্ষণ উসখুস করেছে বিশাখা। পরিতোষকে বলেছে, পুঁটলিটা বার করে একবার হাতে তুলে দেখবে, কতটা দিল? পাঁচভরির অনেক বেশিই হবে মনে হয়। খুলব না পুঁটলিটা? ধরে দেখব? পরিতোষ ধমকে বলেছে, কোনও দরকার নেই। বাড়ি গিয়ে দেখো।

পরিতোষরা কাল রাতে ফিরেছে দেশ থেকে। আজ সকালে উঠে খবরের কাগজ দেখছে পরিতোষ। বিশাখা এখনও চা দেয়নি। গোপা এল ঘরে। বলল, বাবা, একবার রান্নাঘরে চলো। কেন?

একটা মজার জিনিস দেখাব। এসো না। মেয়েকে অনুসরণ করে পরিতোষ। কী মজার জিনিস দেখাবে, ওই জানে! রান্নাঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বিশাখার দিকে আঙুল তোলে গোপা। চমকে ওঠে পরিতোষ। বিশাখার কাণ্ড দেখে মেয়ে মজা পেলেও, পরিতোষ পেল না। বিশাখা দু’হাতের কর গুনছে, আর বিড়বিড় করে হিসেব করছে। অনেকটা শীলার মতো।

পরিতোষ এগিয়ে বলে, কীসের এত হিসেব করছ বিশাখা?

হাত ঝেড়ে বিশাখা বলে, কই, কিছু না তো!

পরিতোষ কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে স্ত্রীর দিকে। মনে মনে বলে, হিসেব খুব খারাপ জিনিস বিশাখা। হিসেব পৃথিবীতে সৃষ্টিই হয়েছে না মেলার জন্য।

সানন্দা নববর্ষ, ২০১১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *