ধার

ধার

অফিসে ঢোকার মুখে আজ মাসতিনেক হল ভিখারিটাকে দেখতে পায় অঙ্কিতা৷ বয়স পঞ্চাশের আশপাশে৷ মিশমিশে কালো গায়ের রং৷ পরনে একটা ছেঁড়া নীল লুঙ্গি আর ফুলহাতা চেক শার্ট৷ চুল দাড়ির মা-বাপ নেই৷ একটা ছোট বস্তার ছাউনি টাঙিয়ে অফিসের ঠিক বাইরেটাতেই বসে থাকে৷ ওদের সেক্টর ফাইভ-এর চকচকে কর্পোরেট অফিসের পাশে বস্তার বিশ্রী ছাউনি ভীষণ বেমানান৷ তবে বাসু স্যারের দয়ার শরীর বলেই ওখানে ঠাঁই হয়েছে লোকটার৷

প্রথমদিন বসতে দেখে সিকিউরিটি গার্ড এসে তুলে দিতেই যাচ্ছিল৷ বাসু স্যার তখনই বেরোচ্ছিল কাচের দরজা ঠেলে৷ হাঁ হাঁ করে এগিয়ে এসে বলল, ‘একি সুজয়! তুমি ওর উপর চিৎকার করছ কেন?’

রুলটা ভিখারিটার পিঠে বসাতে যাচ্ছিল সুজয়, সেটা আবার কোমরের খোপে গুঁজতে গুঁজতে বলেছিল, ‘জায়গাটা একদম স্পয়েল করছে স্যার৷ মানে আমাদের বিদেশি ক্লায়েন্ট আছে…’

‘তো? দেশের যা অবস্থা তাই তো তারা দেখবে, নাকি?’

বাসু হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল লোকটার সামনে৷ তারপর আঙুলের ঠেলায় চশমাটা নাকের উপর তুলতে তুলতে বলেছিল, ‘কোত্থেকে আসছ?’

লোকটা মার আটকাতে হাতের বাটিটা মুখের সামনে তুলেছিল, সেটা নামিয়ে নিতে নিতে বলল, ‘হেঁহেঁ… তা সার সেই মেদিনীপুর থিকে…’

‘কী করতে মেদিনীপুরে?’

‘চাষের জমি ছিল সার৷ চাষ করতাম, জমি মালিকে কিনে নিলে৷ কলকেতা এসচিলাম কাজের খোঁজে৷ কারখানায় কাজ করতাম, কলে হাত কেটি গেল৷ এহন ভিক্ষে করছি…’ ইশারায় নিজের কবজি থেকে কাটা ডানহাতটা দেখিয়েছিল লোকটা৷

একটু হেসে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন বাসু৷ তারপর সুজয়ের দিকে চেয়ে বলেছিলেন, ‘তবে? চাষা মানুষ বলে কথা৷ সকালে যে ভাতটি খেয়ে অফিসে আসছ তা এরই হাতে ফলানো৷ তাকে ঠেঙিয়ে তুলে দিলে একেবারে পাতে মরবে ভাই, ও থাক…’

তারপর থেকে আর ওখান থেকে নড়েনি হাতকাটা লোকটা৷ অঙ্কিতার শিফটিং ডিউটি৷ কখনও সকালে অফিসে ঢোকে, কখনও বিকেলে, আবার কখনও গভীর রাতে৷ সারাক্ষণই দেখে লোকটা ওখানেই পড়ে আছে৷ হয় বাটি হাতে বসে আছে ছাউনির বাইরেটায়, না হয় বস্তার ঘেরাটোপের ভেতরে ঢুকে ঘড়ঘড় করে কী একটা আওয়াজ করছে৷

আওয়াজটা কিসের সেটা অবশ্য জানে অঙ্কিতা৷ লোকটার ভিক্ষা চাওয়ার একটা ধরন আছে৷ হাতের দোমড়ানো বাটিটাকে ক্রমাগত মাটির উপর ঘষতে থাকে৷ তাতেই সড়সড় আওয়াজটা হয়৷ ওভাবেই নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ তারপর হাত বাড়িয়ে দেয় সামনের দিকে, ‘ধার দিবেন সার?’

 হ্যাঁ, সিরিয়াল কিলারদের যেমন মোডাস অপারেন্ডি থাকে, ভিখারিদেরও সেরকম ভিক্ষা চাওয়ার একটা ধরন থাকে৷ এই লোকটা ভিক্ষা চায় না, ধার চায়৷

আজও সেভাবেই বাটি এগিয়ে ধরেছে লোকটা৷ অন্য দিন অঙ্কিতা এড়িয়ে চলে যায়৷ আজ কী মনে হতে দশটা টাকা বের করে এগিয়ে দেয় ওর দিকে, ‘বেশ, দিলাম ধার৷ কবে শোধ করবে?’

‘যেদিন আপনের দরকার হবে৷’ কথাটা বলে নোংরা দাঁতগুলো বের করে লোকটা হাসে৷

‘বাবা! তুমি ভিখারি না হয়ে ব্যাঙ্ক খুলতে পারতে তো…’

লোকটা জিভ কাটে, ‘খপরে বলছেল ব্যাঙ্কই নাকি ভিখারি হই গেছে ম্যাডাম?’

লোকটার কথাবার্তা কেমন যেন বাঁকাচোরা গোছের৷ মোটেই ভালো লাগে না অঙ্কিতার৷ খানিক রাগও হয়৷ আপাদমস্তক একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলে, ‘তোমার আর একটা হাত আছে, তাও ভিক্ষা করো কেন? কাজ করে খেতে পারো না?’

‘খেতুম তো, খেতে দিলে কই?’

‘মানে? তোমাকে চাষ করতে বাধাটা দিচ্ছে কে?’

‘হেঁহেঁ, একহাতি ভিক্ষা করি চলি যাচ্ছে যখন খেটেখুটে কে চাষ করে?’ বিশ্রী হাসিটা আবার ফুটে ওঠে লোকটার মুখে৷

‘সেয়ানা মাল শালা…’ অঙ্কিতা বাঁকা স্বরে বলে৷

এরপর চাষবাসের হিসেবের যে ফিরিস্তি দিলে সেসব অঙ্কিতার মাথায় ঢুকল না৷ ঢোকার কথাও নয়৷ অঙ্কিতাদের আদিবাড়ি বর্ধমানে৷ চাষের জমিজমা কিছু ছিল সেখানে৷ ওর ছোড়দাদু সেসব দেখাশোনা করতেন৷ মাঝে মাঝে কলকাতায় ওদের বাড়ি এলে গ্রামের গল্প শোনাতেন তিনি৷ তবে সেসব ছোটবেলার কথা৷ ভদ্রলোক বহুকাল হল গত হয়েছেন৷

তারপর থেকে চাষজমির সঙ্গে ওর সম্পর্ক বলতে ওই গ্রামের মাঝখান দিয়ে যাওয়া ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকা৷ বরঞ্চ ওর ছোট থেকেই ব্যবসায় আগ্রহ৷ বাবার বাগবাজারে একটা শাড়ির দোকান ছিল৷ এক গুজরাটি বেনের উৎপাতে বছরদশেক আগে সে দোকানে তালাচাবি ঝোলে৷ সে সময় থেকেই সংসারে টানাটানি ওদের৷ বাবা ভয়ানক ভেঙে পড়েছিল৷ তারপর থেকেই অঙ্কিতার জেদ, যেভাবেই হোক পয়সা রোজগার করবে ও৷

কলেজ শেষ করে সেই কারণেই এমবিএ নিয়ে ভর্তি হয়েছিল টেকনোতে৷ কিন্তু সেটা শেষ হওয়ার আগেই অঙ্কিতার জীবনে ঝড় নেমে আসে৷

তিনবছর আগে একরকম ঝোঁকের মাথাতেই একটা বিয়ে করে বসে অঙ্কিতা৷ তার আগে একটা বছর চারেকের সম্পর্ক ছিল৷ সেটা হুট করে বিশ্রীভাবেই কেটে যায়৷

কী করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছে না, জীবনে টালমাটাল অবস্থা৷ ঠিক এমন সময় এসে ওর হাত ধরে সৌম্য৷ মাসখানেক মেলামেশা করে ভালোই লাগে ছেলেটাকে৷ বড় পরিবার, বিশাল ব্যবসা, বিশেষ দাবিদাওয়াও নেই৷ ধুমধাম করে বিয়েটা করে ফেলে অঙ্কিতা৷ এবং তারপরেই ভুল বুঝতে পারে৷

একটা সহানুভূতিশীল মানুষের মুখোশের পেছনে এত বড় হিংস্র শয়তান লুকিয়ে থাকতে পারে জানা ছিল না অঙ্কিতার৷ দিনের পর দিন ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের আর সেক্সুয়াল টর্চারের শিকার হতে থাকে সে৷ কোনও মতে তিনটে মাস সেভাবে কাটে৷ তারপর একরকম জোর করেই শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাড়ি চলে আসে৷ বাবা-মা খুব একটা জোর করেননি৷ ডিভোর্স পিটিশন করেছিল৷ সেটা পেতে সমস্যা হয়নি৷

তারপর থেকে ওর ধ্যানজ্ঞান এই অফিস৷

লোকটার কথায় মাথা না ঘামিয়ে অফিসের ভিতরে নিজের কিউবিকলে ঢুকে আসে অঙ্কিতা৷

কাজ শুরুর আগে ফোনটা লকারে রেখে আসতে হয়৷ এ অফিসের ওই দস্তুর৷ অবশ্য তাতে অঙ্কিতার তেমন অসুবিধা হয় না৷ বরং কাজে খানিকটা বেশি মন বসে৷

ঘণ্টাতিনেক পর একটা ব্রেক নেয়৷ ওদের মোট আধঘণ্টার ব্রেক৷ সেটা তিনভাগে ভেঙে নেওয়া যায়৷ লকার থেকে ফোনটা বের করে বাইরে এসে দেখে এর মধ্যে তিনটে মিসড কল ঢুকেছে ওর নম্বরে৷ সব ক-টাই বাড়ির থেকে৷ বাবা-মা দু-জনের বয়সই ষাটের কাছাকাছি৷ একটার বেশি মিসড কল এলে দুশ্চিন্তাই হয়৷

রিং ব্যাক করতে ওপাশ থেকে বাবার গলা শোনা যায়, ‘হ্যাঁ মানু, বল…’

‘ফোন করেছিলে যে…’

‘ও তোর মা করেছিল৷ আমি কতবার বললাম থাক, মেয়েটা এলেই একেবারে বলবে… ওর তো আবার তর সয় না…’

‘আরে হয়েছেটা কী?’

অঙ্কিতা বোঝে কথাটা বলতে বাবা একটু ইতস্তত করছে৷ এদিকে ওর পনেরো মিনিট শেষ হয়ে আসছে, ও তাড়া দেয়, ‘আরে বলবে তো…’

‘ইয়ে তোর সেই কুমারেশের কথা মনে আছে?’

‘তোমার সেই বসের ভাই৷ থাকবে না কেন? বাঞ্চত লোক…’

‘আঃ, কতবার বলেছি তোকে মুখ খারাপ করবি না৷ ও তোর ফেসবুকটা ভিজিট করছিল মনে হয়৷ তো বলল…’

‘ব্লাডি পারভার্ট…’ ফুঁসে ওঠে অঙ্কিতা, ‘হি ইজ ফাকিং ফরটিটু বাবা…’

‘তোরও তো নয় নয় করে ছাব্বিশ হতে চলল৷ তাছাড়া লাইফে এত বড় একটা ব্লান্ডার ঘটে গেছে…’

‘তো আর একটা না ঘটা অবধি শান্তি হচ্ছে না তোমাদের, তাই না?’

ফোনটা মুখের উপর কেটে দিয়েই বারান্দার রেলিংয়ের দিকে সরে আসে অঙ্কিতা৷ পকেট থেকে বের করে একটা সিগারেট ধরায়৷ মাথার ভিতরটা গরম হয়ে গেছে আচমকাই৷ কুমারেশ সরকারের মুখটা মনে পড়লেই গা’টা রিরি করে জ্বলে উঠছে৷ কচি মেয়ে বিয়ে করার পুরকি জেগেছে বাঞ্চতটার৷

বাইরে দুপুরের সেক্টর ফাইভ রোদে পুড়ছে৷ মানুষের বাড়িঘর বিশেষ নেই৷ সবই ঝাঁ চকচকে অফিস৷ এখানে কেউ আশ্রয়ের সন্ধান করে না, জিরিয়ে নিতে চায় না৷ কেবল দুটো পয়সার ধান্দায় ঘোরে৷ অফিসের এই জায়গাটায় এসে দাঁড়ালে অকারণেই ছোড়দাদুর কথা মনে পড়ে অঙ্কিতার৷

ছোড়দাদু শহরে এলে সারাদিন কলকাতার রাস্তাঘাট চষে বেড়াতেন৷ ততদিনে তাঁর ষাটের আশপাশে বয়স হয়েছে৷ মা বকাবকি করতেন, ‘এই বয়সে রোদের মধ্যে কী এত টোটো করে ঘোরেন বলুন তো?’

ভদ্রলোক গামছা দিয়ে পিঠের ঘাম মুছতে মুছতে বলতেন, ‘এত বুদ্ধি করে বানানো শহরটা একটু ঘুরে দেখব না?’

মা অবাক হতেন, ‘কোথায় বুদ্ধি করে বানানো দেখলেন বলুন তো? অফিস, বাড়ি, বাজার, মন্দির, কবরস্থান সব ঘোঁট পাকিয়ে রয়েছে৷ রবিদার ছেলে প্যারিস থেকে ফিরেছে৷ সে বলল…’

‘আরে রাখো তোমার প্যারিস-ফ্যারিস৷ সবকিছুর একটা ব্যালেন্স রাখতে হয়, বুঝলে? দেখ, অফিস কাছারিতে লোকে যায় পয়সার ধান্দায়, এক জায়গায় যত বেশি অফিস তত বেশি ধান্দা৷ তাই মাঝে মধ্যে দুটো বাড়ি ঘর গুঁজে দিতে হয়৷ আবার ধর কসাইখানার পাশেই একটা মন্দির৷ মদের দোকানের পাশেই একটা ওষুধের দোকান… না হে, আমার কিন্তু মনে হয় কলকাতা বেশ বুদ্ধিশুদ্ধি করে ব্যালেন্স রেখেই বানানো…’

ছোড়দাদু এরকম উদ্ভট কথা মাঝে মধ্যেই বলতেন৷ সেসব মায়ের তেমন পছন্দ হত না৷ অঙ্কিতা বাবা-মায়ের ঘরে কান পেতে মাঝে মাঝে শুনত আড়ালে মা বাবাকে বলছেন, ‘ওই পার্টি পলিটিক্স করেই তোমার কাকার মাথাটা গেছে৷ যাই বলি কেমন ট্যারাব্যাঁকা উত্তর দেয়…’

‘পার্টি পলিটিক্স না৷ ঠিক বয়সে মেয়ে দেখে একটা বিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যেত…’

মা চটুল হেসে বলত, ‘এখনও তো শক্তসমর্থ আছেন, মেয়ে দেখ…’

বাবা একটা হাত বাড়িয়ে মাকে খপ করে ধরে নিয়ে বলত, ‘ধুর, এই একটা মেয়ে ছাড়া আর মেয়ে দেখলাম কই জীবনে…’

এরপর এক ছুটে বারান্দায় চলে আসত অঙ্কিতা৷ বারান্দায় টবে রাখা গাছপালার মাঝেই মেঝেতে শুয়ে থাকতেন দাদু৷ ওকে পাশে বসিয়ে গল্প বলতেন৷ সে নানারকমের গল্প৷ দাদু নাকি একবার ভয়ঙ্কর এক যুদ্ধে গেছিল৷ দেশের রাজা আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা ইচ্ছা করে খাবার দাবার লুকিয়ে ফেলছিল৷ ফলে খাবারের দাম বেড়ে যাচ্ছিল চোঁচোঁ করে৷ গরিব মানুষ খেতে পাচ্ছিল না৷ শেষে সব গরিব মানুষ মিলে রাজার বিরুদ্ধে ভীষণ যুদ্ধ করল৷ রাজা যাকে পারল জেলে ভরল৷ পেয়াদা দিয়ে মারল, পিটিয়ে পিটিয়ে মেরেও ফেলল; কিন্তু লাভ হল না৷ শুনে ভারি বিরক্ত লাগত অঙ্কিতার, সে মুখ ভার করে বলত, ‘ধুর, তোমার গল্পের শেষগুলো সব একইরকম হয়৷ শুধু গরিব লোক আর চাষারা জিতে যায়৷ রাজা জিততে পারে না কখনও?’

দাদু হেসে বলত, ‘জিতবে কী করে? রাজা তো মন্ত্র জানে না…’

‘মন্ত্র জানলেই জিতে যাওয়া যায়? আমাকেও শিখিয়ে দাও…’ আবদার করত অঙ্কিতা৷

দাদু তখন উঠে বসে দু-হাতে তালি দিয়ে দিয়ে ভাঙা সুরে গাইত, ‘হেই সামালো ধান হো/ কাস্তেটা দাও শান হো/ জান কবুল আর মান কবুল/ আর দেব না আর দেব না/ রক্তে বোনা ধান, মোদের প্রাণ হো…’

‘জান কবুল আর মান কবুল—ব্যস এটা বলেই চাষারা জিতে যেত!’

অঙ্কিতার তখন বিশ্বাস হত না৷ এখনও হয় না৷ বছর খানেক আগে এক রাতে ওর হাতদুটো পাখার ব্লেডে বেঁধে রেখেছিল সৌম্য৷ গেঞ্জি, প্যান্ট আর অন্তর্বাস ছিঁড়ে পড়েছিল ঘরের এক কোণে৷ কোমরের চামড়ার বেল্ট দিয়ে ওকে মেরে মেরে রক্তাক্ত করছিল৷ পা দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছিল, ঘামে রক্তে ভিজে যাচ্ছিল বিছানার চাদর৷ মুখে কীসব যেন বলছিল সৌম্য, ‘তোর মতো স্লাটকে বিয়ে করতে নেই, ছিবড়ে করে ফেলে দিতে হয়…’

অঙ্কিতা প্রথমদিকে চিৎকার করত৷ পরে রুটিন হয়ে যাওয়ায় অত ছটফট করত না৷ মাঝে মাঝে যন্ত্রণামাখা শব্দগুলোর সঙ্গে ওই মন্ত্রটা কি দু-একবার বেরিয়ে আসেনি? উঁহু, ওতে আর লাভ হয় না… ও মন্ত্রটা কালের যাত্রায় ভোঁতা হয়ে গেছে৷

সিগারেটে দুটো টান দেয় অঙ্কিতা৷ পিঠে একটা হাতের ছোঁয়া পেয়ে ঘুরে তাকায়৷ রুমেলাদি এসে দাঁড়িয়েছে ওর পেছনে৷ এই অফিসে যে ক-জনের সঙ্গে ওর মোটামুটি একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে তার মধ্যে রুমেলাদি একজন৷ মধ্যে সেই স্কুল জীবনের মতো নিখাদ বন্ধুত্ব খুঁজে পায়৷

অঙ্কিতার হাতের সিগারেটটা প্রায় নিভে এসেছে৷ সেটা রুমেলার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘নেবে?’

কাউন্টার নিতে নিতে ওর পাশটায় এসে দাঁড়ায় রুমেলা, বলে, ‘কিছু নিয়ে আপসেট আছিস নাকি? এসে থেকে অন্যমনস্ক দেখছি…’

মুখের সামনে থেকে চুল সরায় অঙ্কিতা৷ তারপর উল্টোদিকে ফিরে বলে, ‘ওই যা চলে, আগের মাসে একটু বেশি কেনাকাটা হয়ে গেছিল৷ এ মাসে হাতটান যাচ্ছে…’

‘সেকি! এর মধ্যেই? লাস্ট উইক তো স্যালারি ক্রেডিট হল…’

‘ধুর, সেসব ইএমআইতেই চলে যায় শালা৷ বিয়ের সময় একগাদা টাকা লোন নিয়েছিলাম৷ সামনের মাসে আবার বাবার একটা অপারেশন আছে, তাতে লাখ দেড়েক খসবে…’

‘তুই বাবা বড্ড ধুমধাম করে বিয়ে করেছিলি৷ অত খরচ না করলেই পারতিস৷’

সিগারেটে লম্বা একটা রিং ছাড়ে অঙ্কিতা, ‘আমার অত শখ ছিল না৷ বাবা বলল রিসেপশন ওরা এত ঘটা করে করছে, আমরা মুরগির ঝোল ভাত খাইয়ে বিয়ে সারলে আর প্রেস্টিজ থাকবে না৷’

‘বাঙালি মধ্যবিত্তের প্রেস্টিজ হেব্বি ঝাঁটের জিনিস মাইরি৷ খরচ করছি দেখানোর সুযোগ পেলেই আর পায় কে শালাদের৷ নেহাত সেক্স করার সময় লোক দেখানো যায় না, তাই সবকিছুর দাম বেড়ে গেলেও কনডোমের বাড়েনি৷ কুড়ি টাকাকে কুড়ি টাকাই রয়ে গেছে…’

অঙ্কিতা হাসে, নিচে ছাই ফেলে বলে, ‘তোমারও তো ইএমআই চলছে, সেটা কিসের?’

‘আমি চাকরিতে ঢুকেছিলাম কেন জানিস?’

‘কেন?’

‘একটা ক্যামেরা কিনতে…’

‘ক্যামেরা?’

‘হ্যাঁ, নিকন জেড-ডি-এক্স আঠেরো৷ বডি আর লেন্স মিলে লাখের কাছাকাছি দাম৷ হিসেব করে দেখেছিলাম মোটামুটি বছরখানেক চাকরি করতে পারলে পয়সাটা উঠে আসবে৷ তারপর চাকরি ছেড়ে ফটোগ্রাফি করে রোজগার করব৷ ক্যামেরাটা কিনেওছিলাম৷ দু-একটা বিয়েবাড়িতে কাজও করেছি…’

‘তারপর চাকরিটা ছেড়ে দিলে না কেন?’

সিগারেটের ফিল্টারের কাছে আগুন চলে এসেছিল৷ সেটা ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দেয় রুমেলা৷ তারপর নিজের প্যাকেট থেকে আর একটা ধরাতে ধরাতে বলে, ‘নেশায় পেয়ে গেল বাঞ্চত৷ হুট করে মনে হল ক্যামেরা ছাড়া আমার আরও অনেকগুলো শখ আছে… হতে চেয়েছিলাম আর্টিস্ট, হয়ে গেলাম বালের লোভী কর্পোরেট৷ শালা আমাদের এই চাকরি জীবনটা না, একটা টক্সিক রিলেশনশিপের মতো৷ অত্যাচার করবে, যন্ত্রণা দেবে, কিন্তু ছেড়ে যেতে দেবে না…’

বড় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রুমেলার মুখ দিয়ে৷ অঙ্কিতার দিকে চেয়ে ও দেখে সেও উদাস চোখে তাকিয়ে আছে দূরের দিকে৷ কয়েকদিন ধরেই মেয়েটাকে একটু উদ্বিগ্ন দেখছে রুমেলা৷ বাড়িতে শান্তি নেই, টাকাপয়সার টান, অফিসে চাপ, মানসিক যন্ত্রণার কথা না হয় বাদই রাখল৷ মায়া লাগে রুমেলার, কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘কিন্তু তুই আগের মাসে এতগুলো এপ্রেইজাল পেলি, এতদিনে বেশ কয়েকটা ইংক্রিমেন্ট হওয়ার কথা, তাতেও লাভ হয়নি?’

‘বালের ইংক্রিমেন্ট৷ আমার ওসব হয় না…’

‘কেন?’

‘ওর জন্য উপরতলায় তেল দিতে হয়৷ আমি এসব তেল-ফেল দিতে পারি না…’

‘তা যা বলেছিস, তোর কথাবার্তা কেমন যেন কাটাকাটা গোছের৷ কর্পোরেটে একটু নরমসরম কথা বলতে না পারলে চলে না৷ এখানে বাল সবাই সবাইকে ডমিনেট করতে চায়৷ যতক্ষণ না ওর উপরে যাচ্ছিস ওর নিচে ভালো করে থাকাটা শিখতে হবে…’

‘সারাজীবন তো তাই করে এলাম৷ নিচে থাকা শিখলাম ভালো করে…’

নিচে তাকিয়ে ভিখারিটাকে দেখতে পায় অঙ্কিতা৷ পাশেরই একটা ভাতের হোটেল থেকে রোজ দুপুরের দিকে ফেলে দেওয়া ভাতের খানিকটা ওকে দিয়ে যায়৷ সেটাই হলদে টাইপের কী দিয়ে যেন মেখে খাচ্ছে৷ একটু হেসে রুমেলা বলে, ‘এর থেকে শালা ভিখারি হলেই ভালো হত৷ ইএমআই-এর টেনশন নেই, সংসারের জোয়াল টানা নেই, বসের খিস্তি নেই, আরামের জীবন…’

‘তার উপরে বাবা আজকাল থেকে থেকে আবার বিয়ের জন্য সম্বন্ধ নিয়ে আসছে…’

‘বেশ, তো তুই চাস না বিয়ে করতে?’

মাথা নামিয়ে নেয় অঙ্কিতা, ‘না, ভয় লাগে৷’

‘আরে সব ছেলে তো সৌম্যের মতো নাও হতে পারে৷’

রুমেলার দিকে তাকিয়ে হাসে অঙ্কিতা, ‘এই টক্সিক রিলেশনগুলোর সমস্যা কী জানো তো? দীর্ঘদিন এর মধ্যে থাকলে এই সম্পর্কগুলো তোমায় বুঝিয়ে দেবে যে তোমার মতো একটা মেয়ে এই সমস্ত কিছু ডিজার্ভ করে৷ ওই মার, সেক্সচুয়াল টর্চার, ডমিনেসন… ইউ ফাকিং ডিজার্ভ অল দ্যাট… সব ছেলে সৌম্যের মতো নয়, কিন্তু সব সম্পর্কের একটা দিকে তো আমি থাকব, বলো?’

‘এর মধ্যে আর কাউকে ভালো লাগেনি?’

কাঁধ ঝাঁকায় অঙ্কিতা, ‘ফেসবুকে একটা ছেলের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ক-দিন৷ ছবি আঁকত ছেলেটা৷ কথাবার্তা খারাপ না…’

‘তারপর?’

‘তারপর বলল ন্যাংটা ছবি পাঠাতে৷ নুড স্টাডি করবে৷ চুদির ভাইটা সামনে থাকলে ওই নুড স্টাডি ওর গাঁড়ে গুঁজে দিতাম… শালা গোটা সমাজটা ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাও এদের মেয়েদের শরীর লাগে…’

ফিরতে হবে৷ পনেরো মিনিট প্রায় শেষ হতে চলেছে৷ রুমেলা ভিতরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলে, ‘শেষ কবে মদ খেয়েছিস বল তো?’

‘হবে, মাসখানেক আগে৷’

‘গ্রেট, পরশু আমার বাড়ি চলে আয়৷ ভালো বিয়ার আছে…’

রুমেলার কথাগুলো খুব একটা ভালো করে কানে যায় না অঙ্কিতার৷ ও রেলিংয়ের উপর ঝুঁকে চেয়ে থাকে বস্তার ছাউনির পাশে শুয়ে থাকা ভিখারিটার দিকে৷ খাওয়া শেষ করে বাসন ধুয়ে পাশ ফিরে রাস্তার উপরেই নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়েছে৷

কী যেন অদ্ভুত একটা ব্যাপার আছে লোকটার মধ্যে৷ মুখে কিছু না বলেও যেন ওদের ঝাঁ-চকচকে অফিস, কেতাদুরস্ত জামাকাপড়ের দিকে চেয়ে ব্যঙ্গ করে লোকটা৷ কোনও খারাপ উদ্দেশ্য আছে কি?

রেলিং থেকে সরে আসে অঙ্কিতা৷

(২)

‘দেখ আমরা আর পাঁচটা বাবা-মার মতো কোনওদিনও কনজার্ভেটিভ ছিলাম না৷ যেদিন প্রেম করতে চাইছিস করেছিস৷ যেদিন বিয়ে করতে চেয়েছিস, তাও করেছিস৷ আমরা কোনওদিনই তোকে বাধা দিই না…’ টিভিতে খবরের চ্যানেলে অ্যাড দিয়েছে৷ তাই অন্য চ্যানেল ঘোরালেন বাবা৷ এখানেও অ্যাড৷ বিড়বিড় করে বললেন, ‘এরা শালা যুক্তি করে অ্যাড দেয়৷ সব হারামজাদা…’

‘আর আজ জাস্ট কিচ্ছু করতে চাইছি না৷ তাতেই বা বাধা দিচ্ছ কেন?’ চোখ থেকে চশমাটা খুলে ঠক করে টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখে অঙ্কিতা৷ অফিসে গাধার মতো খাটনি গেছে আজ৷ তার উপরে বাড়ি ফিরতেই মা আর বাবা মিলে ঝিঁঝিঁ পোকার মতো আসর বসিয়েছে৷

মা এগিয়ে আসে ওর কাছে৷ পিঠে একটা হাত রেখে বলেন, ‘আমরা শুধু চাই না সারাজীবন তুই এভাবে একা একা কাটা…’

‘আরে বিয়ে ভাঙাটা আজকালকার দিনে কোনও বড় ব্যাপার নয়৷ কত লোকের ডিভোর্সের পর আবার বিয়ে হচ্ছে৷ তোমার মেয়ের এসব জেদ৷’

‘হ্যাঁ বেশ করছি জেদ করছি৷ আমার লাইফ আমি জেদ করব না তো কি পাশের পাড়ার পাঁচুদা করবে? নাকি তোমাদের ওই বাঞ্চত কুমারেশ করবে?’

‘আঃ তুই কুমারেশের উপরে কেন এত রাগ করছিস বল তো? ও জাস্ট আগ্রহ দেখিয়েছে…’

‘আগ্রহ? ফেসবুকের পোস্টগুলো দেখেছ শুয়োরটার৷ ব্লাডি মিসোজিনিস্ট৷ অনলি রিজন হি ওয়ান্টস টু ম্যারি মি ইজ ওকে এই বয়সে আর কেউ জাস্ট দেয় না…’

এতক্ষণে বিজ্ঞাপন শেষ হয়েছে৷ রাজনীতির কচকচি চলছে চ্যানেলে চ্যানেলে৷ বাবা ভলিউম বাড়িয়ে সেদিকে মন দেন৷ সেই সুযোগে বাকি কীর্তনের দায়িত্ব মা কাঁধে তুলে নেন, ‘আসলে তোকে নিয়ে টেনশন হয় বাবার৷ পরের মাসে এতগুলো খরচ…’

‘তার জন্য বাবার টেনশনের কী হয়েছে? আমি বলেছি তো…’

মা একটু ইতস্তত করে, ঢোঁক গিলে বলে, ‘তুই আর ক-টা টাকাই বা রোজগার করিস… তোর একার পক্ষে…’

‘মানেটা কী?’ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে অঙ্কিতা, ‘বললাম টাকাটা জোগাড় করে ফেলব, তাও এই কম রোজগারের খোঁটাটা না দিলেই চলছিল না তোমার?’

‘তোকে কিছু বলা মানেই তোর মনে হয় খোঁটা দেওয়া হচ্ছে৷’ টিভির ভলিউম কমিয়ে বাবা মুখ তোলেন, ‘এই বাজারে একটু বুদ্ধি করে না চললে…’

‘মানে? বলতেটা কী চাইছ?’

‘কুমারেশের টাকাপয়সার অভাব নেই৷ সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের কী র‌্যাঙ্কে চাকরি করে খোঁজ নিয়ে দেখ…’

‘আমি বুদ্ধি করে বিয়ে করতে পারব না৷ বুলশিট…’ টেবিলের উপরে একটা ঘুসি মেরে পাশের ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছিল অঙ্কিতা৷ পেছন থেকে মায়ের মিহি গলা শুনতে পায়, ‘ভালোবেসে বিয়ে করেও তো দেখলি… সেই তো…’

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে অঙ্কিতা৷ পেছন ফেরে না৷ পাথরের মূর্তির মতো সেভাবেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে৷ ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ কানে আসে, টিভিতে সন্ধের চিৎকার, পাশের বাড়ির পাম্প চলার শব্দ৷

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় অঙ্কিতা৷ আলোটা নিভিয়ে বিছানার উপরে চুপ করে শুয়ে থাকে৷ কয়েক সেকেন্ড পর চোখের কোলে বেয়ে নেমে আসা জলের রেখাটা মুছে নেয়৷

ছোড়দাদুর কথা হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায়৷ ওর ছোটবেলার কথা ভাবলেই দাদুর কথা মনে পড়ে৷ অঙ্কিতার মনে হয় এখনও যেন পাশের বারান্দায় বসে বছর ষাটের ঋজু মানুষটা সুর করে গাইছেন—মোরা তুলব না ধান পরের গোলায়৷ মরব না আর ক্ষুধার জ্বালায় মরব না৷

দাদুর সারা গায়ে ধানের গন্ধ লেগে থাকত৷ সোনালি সোনালি ধুলোর মতো মনে হত রোদে পোড়া বুকের লোমগুলোকে৷ কাঁধের গামছাটা ভারি নরম ছিল৷ সে গামছা দিয়ে কতবার ওর মুখ মুছে দিত দাদু৷

আবার হাতের উলটোদিক দিয়ে চোখের জল মোছে অঙ্কিতা৷ বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে মন্ত্রটা, ‘জান কবুল আর মান কবুল৷’

নাহ, লাভ হয় না৷ এসব চাষাদের মন্ত্র৷ খাদ্য আন্দোলনের মন্ত্র৷ বড্ড পুরনো হয়ে গেছে৷ এমনকী অফিসের বাইরে ওই হাতকাটা চাষিটাও আর এসব গান গায় না৷

টুংটুং শব্দ করে একটা মেসেজ ঢোকে অঙ্কিতার ফোনে, বাসু স্যার মেসেজ করেছেন, ‘তোমার ইংক্রিমেন্টের জন্য তদ্বির করছি খুকি৷ মনে হয় হয়ে যাবে৷’

অঙ্কিতার ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে৷ উল্টো মেসেজ পাঠিয়ে দেয়, ‘একটু দেখুন স্যার, হাঁড়ি চলছে না৷’

ফোনটা পাশে সরিয়ে রেখে একটা বালিশ মাথার নিচে টেনে নেয় অঙ্কিতা৷ তারপর পাশ ফিরে জানলার দিকে চেয়ে শোয়৷ ভারি অসহায় লাগে ওর নিজেকে৷ এই কর্পোরেট নাকি একটা কয়লা খনির সিঁড়ির মতো৷ এখানে কায়দা করে উপরে উঠতে হয় নাহলে কয়লার বিষাক্ত গ্যাসে দম বন্ধ হয়ে আসে৷

চোখ বুজতে অঙ্কিতার মনে হয় সত্যি বিষাক্ত গ্যাসে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ অনেক বছর ধরে একটু একটু করে ওর নিঃশ্বাস ভোরে উঠছে কালো ধোঁয়ায়৷ ছটফট করতে থাকে অঙ্কিতা, আর মৃদু কানে আসে সেই মাটিতে বাটি ঘষার ঘড়ঘড় শব্দটা৷

(৩)

রাত সাড়ে বারোটা বাজে৷ স্ট্রেট লাইটের আলোয় ওদের দু-জনের ছায়াটাই রাস্তার উপরে প্রলম্বিত হয়েছে৷ দু-জনের হাতেই বিয়ারের বোতল৷ এর আগে আরও তিনটে ঠিক ওই সাইজের বোতলই শেষ করেছে অঙ্কিতা৷ তারপর গরম লাগতে রুমেলার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসেছে ফাঁকা রাস্তায়৷

রাস্তায় গাড়িঘোড়া এখন প্রায় চলছে না বললেই চলে৷ রুমেলার ফ্ল্যাটটা সল্টলেকের একেবারে মধ্যিখানে৷ এ পাড়ার বেশিরভাগ বাড়িই অবস্থাপন্ন বড়লোকেদের৷ একটি মাত্র ফ্ল্যাট৷ এখানেই ভাড়া থাকে রুমেলা৷ সপ্তাহান্তে একবার করে বর আর বাচ্চার কাছে যায়৷ সোমবার সকাল সকাল আবার অফিসমুখো৷

অঙ্কিতা বুঝতে পারে ক-বোতল বিয়ার শেষ করে নেশাটা গাঢ় হয়েছে ওর৷ পা’টা স্বাভাবিক ছন্দে চলছে না৷ নেহাত সল্টলেকের রাস্তা একেবারে ঢোঢা ফাঁকা৷ নইলে যেকোনও সময় গাড়ির তলায় যেতে পারত৷

‘তোর আর টেনশনের কী আছে এখন? স্যার তো বলেছে ইংক্রিমেন্টের ব্যবস্থা করে দেবে… আর বলেছে যখন…’

গরম লাগছিল বলে উপরের জামাটা খুলে ফেলে বাড়িতে পরার ট্যাঙ্ক টপ গলিয়ে নিয়েছিল অঙ্কিতা৷ রাতের হাওয়া শরীরে লেগে শিরশিরে একটা অনুভূতি হচ্ছে৷ সেটা মাখতে মাখতেই বলল, ‘ধুর, লাভ হবে না ওতে… শুতে হবে…’

‘আর ইউ নাটস? বাসুস্যারের নামে একটা খারাপ কথা শুনিনি কোনওদিন৷ বিবিবাচ্চাওয়ালা আদমি…’

‘জানি, কিন্তু ওর উপরে আর একটা বাঞ্চত বসে আছে৷ কী যেন নাম শালার, এস টি জোশী না কী…’

‘সে কী বলেছিল তোকে?’

‘অফিসে ডেকে শুতে বলেছিল, আর কী বলবে…’ রাস্তার উপরেই একদলা থুতু ফেলে অঙ্কিতা, ‘ও শালা চেয়ারে থাকতে আমার কিছু হতে দেবে না, না এপ্রেইজাল, না ইংক্রিমেন্ট, না ঝাঁটের বাল…’

‘তুই এক কাজ কর, টিম চেঞ্জ করে নে৷’

‘নিয়ে? অন্য এইচআর বলবে কলিগের সঙ্গে কোল্ড ওয়ারে যেতে চাই না৷ তুমি নিজের মতো বুঝে নাও…’

কথা বলতে বলতে রাস্তার ধারে একটা রেলিংয়ে ঘেরা ছোট জলাশয়ের ধারে এসে পড়ে ওরা৷ নরম ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে এখানে৷ শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে৷

কাঠের রেলিং ধরে কোনওরকমে বসে পড়ে অঙ্কিতা, বসতে বসতে বলে, ‘নিজের মতো বুঝে নাও… এরা কেউ শালা কাউকে নিয়ে ভাবে না৷’

বোতলে ঠোঁট ডুবিয়ে বড় চুমুক দেয় রুমেলা, তারপর সামনে জলের দিকে চেয়ে বলে, ‘আমরা ছোটবেলায় সেই একটা ভালুকের গল্প পড়েছিলাম মনে আছে? যেখানে ভালুকটা শুয়ে থাকা বন্ধুর কানে কানে বলেছিল দরকারের সময় যে পালিয়ে যায় তাকে বন্ধু বলে না… এ শালারা সে গল্পটা পাল্টে দিয়েছে…’

অঙ্কিতা হাঁটুর উপর থুতনি রেখে বসে বলে, ‘ছোটবেলার সব গল্প আর শিক্ষাই পাল্টে দিয়েছে এরা৷ আমার দাদু বলত, জানিস?’

‘কী বলত?’

‘পয়সা আর লোভ মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়৷ ছবি আঁকার স্বাধীনতা, গান গাওয়ার স্বাধীনতা, সারাদিন বয়ফ্রেন্ডের কোলে মাথা দিয়ে ঘুমানোর স্বাধীনতা, কিংবা ধর এইরকম খোলা আকাশের নিচে রাতবিরেতে বসে থাকার স্বাধীনতা৷ ওদের মতে সবকিছুরই একটা কারণ থাকতে হবে, সব কাজের শেষে একটা পয়সা কামানোর হিসেব থাকতে হবে৷ অনর্থক কিছুই করব না, অনর্থক অন্যের সাহায্যই তো আরই নয়…’

ওর দিকে মুখ ফেরায় রুমেলা, ‘স্বাধীনতাহীন মানুষ স্বার্থপর হয়৷ আর যত বেশি স্বার্থপর হয় তত এদের এই বিরাট সিস্টেমটার সঙ্গে খাপে খাপ মিলে যায়৷ তোর-আমার মতো৷’

বোতলটা শেষ করে একটু দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় অঙ্কিতা, ‘আমিও কবে শালা এরকম হয়ে গেলাম, না রে? দাদু দেখলে খুব কষ্ট পেত৷ আসলে বিয়েটা ওইভাবে ভেঙে যেতে মাথাটা খারাপ হয়ে গেল৷ বাবারও তেমন রোজগার নেই, এদিকে শরীরের পেছনেও অতগুলো করে টাকা প্রতি মাসে… তাও…’

অঙ্কিতার মুখের সামনে চুলের গোছা এসে পড়েছে৷ সেগুলো সরিয়ে আবার ঠোঁট ভেজায় ও, ‘তাও আমার বাপ-মায়ের কাছে বোঝা হয়ে গেলাম৷ ওদের একটা পয়সাওয়ালা মেল অ্যাডভাইজার চাই৷ মেয়েমানুষ আর যাই হোক ফিনান্সিয়াল সিকিউরিটি হতে পারে না৷ কাল শালা হেব্বি কথা শুনিয়ে দিয়েছি মুখের উপর…’

‘তুই বাবা-মাকে খুব ভালোবাসিস, নারে?’ রুমেলার কথাগুলো যেন ম্যাজিকের মতো কাজ করে৷ অঙ্কিতা কাঁদে না৷ সৌম্যর হাতে মার খাওয়ার পর থেকেই ফ্যাচফ্যাচে কান্নাকাটি টাইপের নরম অনুভূতিগুলো ফুরিয়ে গেছে ওর৷ তাও আজ এই পুকুরের ধারে বসে রাতের ঠান্ডা হাওয়া যেন ওর চোখে ধুলো ছিটিয়ে দিয়ে যায়৷ চাঁদের আলোয় চিকচিক করে ওঠে ওর মুখ, ‘খুব…’

রুমেলা ধীরে ধীরে ওর মাথাটা বুকে টেনে নেয়৷ নিরাপত্তার উষ্ণতা গ্রাস করে ওকে৷ ও একটা হাতে রুমেলার কোমর জড়িয়ে ধরে৷ শরীরটা ফুঁপিয়ে ওঠে দু-বার৷

‘আয়াম সো ফাকিং টায়ার্ড অফ অল দিস, ভালো লাগছে না আমার আর…’ ফোঁপাতে ফোঁপাতেই ওর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে৷

‘লোকটার নাম কী বললি যেন?’ রুমেলা নিচু স্বরেই প্রশ্ন করে৷

‘কোন লোক?’

‘ওই বাঞ্চতটার…’

‘এস টি জোশী…’ নামটা বলে মুখ তুলে হাসে অঙ্কিতা, ‘রাগের মাথায় মালটাকে নিয়ে একটা ছড়া বানিয়েছিলাম, জানিস৷ এস টি জোশী, তোর মুখে পোঁদ ঘষি, তোর ভুঁড়ি বাড়ছে ঘুষে, মর নিজের ধন চুষে…’

‘খুব সুন্দর৷ আয় এবার৷’ কথাটা বলেই ওর হাত ধরে টান দেয় রুমেলা৷ ওকে যেন এক দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে মেয়েটা৷

‘যাঃ শালা! আবার কোথায় যাব?’ অঙ্কিতা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে৷

‘আয়, তারপর দেখছি কোথায় যাওয়া যায়৷’

রুমেলার মনে হয় নেশা চড়ে গেছে৷ অঙ্কিতাও খুব একটা আপত্তি করে না৷ মেয়েটার উপর ওর নিজে থেকেই একটা ভরসা আসে৷ কর্পোরেট জগতে এরকম একটা মানুষ সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না৷

খানিকটা হাঁটার পর একটা তিনতলা জমকালো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল দু-জনে৷ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়ি৷ রাত গভীর হয়েছে বলে বাড়ির বেশিরভাগ আলোই নিভে গেছে৷ তাও বোঝা যায় বাড়ির মালিক নেহাত কম খরচ করেননি৷

‘এ কোথায় আনলি শালা?’ অঙ্কিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে৷

‘তোর জোশীবাবুর বাড়ি৷’

চোখ বড় বড় করে বাড়ির বাইরে নাম ফলকটা লক্ষ করে অঙ্কিতা৷ সত্যি ওই নামটাই লেখা আছে বাইরে৷ থতমত খেয়ে বলে, ‘এ শালা এখানে থাকে নাকি? কিন্তু আমি কী করব?’

নিচু হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা একটা লাল ইট তুলে নেয় রুমেলা৷ তারপর সেটা অঙ্কিতার দিকে এগিয়ে দেয়, ‘নে, এটা দিয়ে লিখে দে৷’

‘কী লিখব?’

‘তোর ওই ছড়াটা…’

অঙ্কিতার চোখেমুখে বিরক্তি ফুটে উঠল, ‘ধুর, এসব ছেলেমানুষি৷’

‘উঁহু, ছেলেমানুষি না, স্বাধীনতা৷ একটা পারভার্ট লোকের দরজায় যদি খিস্তি লিখতে না পারিস তাহলে আর কিসের স্বাধীনতা?’

অঙ্কিতা আবার প্রতিবাদ জানাতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই হেসে ফেলে৷ সত্যি, কাল সকালে মদের নেশা নেমে গেলে আর এসব ছেলেমানুষি করা হবে না৷

দু-পাশে তাকিয়ে একবার ভালো করে দেখে নেয় ও৷ নাঃ সিসি টিভি জাতীয় কিছু দেখা যাচ্ছে না কোথাও৷ কেউ জানতেও পারবে না৷ রুমেলা একটু পিছিয়ে দাঁড়ায়৷

উৎসাহে লাল ইট দিয়ে গোটা ছড়াটা পাঁচিলের উপরে ফলাও করে লিখে দেয় অঙ্কিতা৷ লিখতে লিখতে তার মুখ আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে৷ যেন অনেক দিন পরে মনের উপর জমা হওয়া মেঘটা সরে যায়৷

লেখা হয়ে যেতে একটু পিছিয়ে এসে ছড়াটা বেশ কয়েকবার পড়ে অঙ্কিতা৷ রুমেলাও ওর কাঁধে হাত রাখে, বিড়বিড় করে বলে, ‘কাল সকালে বাড়ির পাঁচিল দেখে মুখের কী হাল হবে ভাব বাঞ্চতটার…’

অনেকদিন পর মনটা ভারি খুশি খুশি লাগে অঙ্কিতার৷ ইটের রং লাগা হাতে রুমেলার হাত জড়িয়ে ধরে সে৷

(৪)

আজও অঙ্কিতা অফিসে ঢোকার মুখে সেই ভিখারিটা পথ আটকেছিল, ‘ধার দিবেন?’

ঝোঁকের মাথায় পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ফেলেছে অঙ্কিতা৷ দিয়েই হাত কামড়েছে৷ আগে ভালো খবরটা আসুক তারপর নাহয় হাত লম্বা করবে৷ কাল রাতে বাসুদা বলেছে আজকের মধ্যে ওর কনফারমেশনের মেইল ঢুকবে৷ তাতেই টাকাপয়সা বাড়বে কি না বোঝা যাবে৷ আগে থেকে এত নেচে পরে কিছুই না হলে?

অফিসে বেশ কয়েকবার বাসুদার রুমে ডাক পড়েছে৷ ওকে দেখেই হেসে বাসুদা বলেছে, ‘না, না এখনও কোন মেইল আসেনি৷ তখন কিন্তু ছাড়া মিষ্টি ছাড়া অ্যালাউ করব না…’

সারাদিন দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে কাজ করল অঙ্কিতা৷ কিন্তু ঘড়ির কাঁটা যত এগোল ততই খারাপ হয়ে যেতে লাগল মনটা৷ তবে কি আজ আসবে না? কালও যদি না আসে? তার পরের দিন?

ব্রেকের সময়ে বারান্দায় গিয়ে ভিখারিটাকে আবার লক্ষ করে৷ ব্যাটা দুপুরের ঘুম দিয়েছে শান্তিতে৷ লোকটাকে দেখে আজকাল হিংসা হয়৷ ভালো খবর, খারাপ খবর কিছুই আসার নেই ওর৷ ওরই নিশ্চিন্তের জীবন৷

ঘড়িতে রাত দশটা বাজতে মাথাটা গরম হয়ে গেল অঙ্কিতার৷ বাসুদা ঘণ্টাখানেক আগেই শুকনো মুখে বেরিয়ে গেছে অফিস থেকে৷

জিনিসপত্র গুছিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে তার নম্বরটা ডায়াল করল ফোনে, দু-বার রিং হতেই ওপাশ থেকে তেমনই বিষণ্ণ গলা শোনা গেল, ‘না অঙ্কিতা, নট ইয়েট…’

‘আই নো, আমি জাস্ট জানতে চাই আদৌ ওটা আসবে না আপনি মিথ্যে আশা দেখিয়ে…’

ওপাশের লোকটার গলা আগের মতোই শান্ত শোনায়, সহানুভূতির স্বর মেশে তাতে, ‘তোমাকে আশা দেখিয়ে আমার কী লাভ বলো?’

‘আমি জানি না, দেখুন স্যার টাকাপয়সার আমার ভীষণ দরকার৷ অ্যান্ড আই নিড ইট রাইট নাও৷ আপনি যেভাবেই হোক…’

কথাটা বলতে গিয়েও থেমে যায় অঙ্কিতা৷ বেপরোয়া হয়ে বাজে একটা দাবি করে ফেলেছে সে৷ ওপাশের গলাটা আবার শোনা যায়, ‘তুমি বেরচ্ছ এখন?’

‘আরও ঘণ্টাখানেক পরে বেরব৷ ব্রেকে বাইরে এসেছি৷’

‘ওকে, আজ ঠান্ডা মাথায় বাড়ি যাও৷ কাল যেভাবেই হোক কিছু একটা জানাচ্ছি আমি তোমাকে…’

ফোনটা মুখের উপরেই কেটে দেয় অঙ্কিতা৷ আবার টেবিলের দিকে ফিরতে গিয়ে দেখে রুমেলা দাঁড়িয়ে আছে ওর পেছনে৷ চোখের দৃষ্টিতে একটা বিরক্তির ভাব, ওর দিকে একপা এগিয়ে এল সে, ‘অকারণেই লোকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিস তুই…’

‘অল দ্যাট আই ক্যান এফোর্ড রাইট নাও…’

কথাটা বলে এগিয়ে আসছিল অঙ্কিতা৷ ওকে হাত ধরে থামিয়ে দেয় রুমেলা, ‘তুই জানিস কেন তোর মাইনে বাড়ে না? তোর কাজের জন্য না, সমস্যা হল তোর এই অ্যাটিটিউড…’

‘অ্যাটিটিউড? আই সি? কাকে গালাগাল করেছি আমি?

‘গালাগাল করাটা বড় কথা নয়৷ তোকে কতবার বলেছি কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড-এর নিয়ম হচ্ছে যার নিচে আছিস তার নিচে থাকাটা ভালো করে শিখতে হবে৷ সবসময় অতটা অবাধ্য হলে চলে না৷ আর পাঁচটা মানুষের থেকে এগিয়ে যেতে গেলে নিজের স্কিল ছাড়া নিজেকেও ব্যবহার করা শিখতে হবে…’ রুমেলার গলায় আজ কাঠিন্য এসে মিশেছে৷ এই মানুষটাকে চেনে না অঙ্কিতা৷

‘ওসব ঢলানি আমাকে দিয়ে হবে না ভাই৷ আমার বাপ-মা আমাকে ওই শিক্ষা দেয়নি…’

‘সেই বাপ-মাই তোকে খোঁটা দিতে তো ছাড়ে না…’

কাঁধ ঝাঁকায় অঙ্কিতা, ‘আই ডোন্ট কেয়ার৷ আমি আনফেয়ার গেম খেলি না…’

ওর দিকে একপা এগিয়ে এসে ওকে রেলিংয়েই চেপে ধরে রুমেলা, ‘এই দুনিয়ার কোন লড়াইটা ফেয়ার গেম অঙ্কিতা? কোটিপতির ছেলে, যারা কোনওদিন কোনওভাবে ডিপ্রাইভড নয় তারা কাস্ট সার্টিফিকেট ব্যবহার করে না? সেটা ফেয়ার গেম? যার বাপের পয়সা আছে, কিংবা মামা-কাকা আছে তাদের সাদা খাতায় চাকরি হয়ে যায় না? সেটা ফেয়ার গেম? কোনও মেয়ে নিজের রূপ ব্যবহার করে ভিক্টিম-প্লে করে না? দুনিয়ার কোনও ছেলে তার অবাধ্য বউকে শুধু গায়ের জোর আছে বলে, আর বউ ফিনান্সিয়ালি ইন্ডিপেন্ডেন্ট নয় বলে মেরে লাল করে দেয় না? সেটা ফেয়ার গেম? এই পৃথিবীতে সব থেকে বড় বোকামি কি জানিস অঙ্কিতা? একটা চোট্টামিতে ভরা গেমে একা সৎ প্লেয়ার হয়ে বোকাচোদামি করা…’

অঙ্কিতার মুখ নেমে আসে৷ উসকোখুসো চুলগুলোকে দু-হাতে সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়৷ মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘জানি, এতগুলো বছর ধরে সেটাই দেখে আসছি৷ কিন্তু কোথাও একটা আটকে যাই আমি…’

‘কোথায়?’

ভেবেচিন্তে একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় খুব ক্ষীণ একটা গড়গড় আওয়াজ ভেসে আসে৷ নিচে সেই ভিখারি লোকটা আবার মাটিতে বাটি ঘষছে৷ এত রাতে অফিসের সামনের রাস্তাটা শুনশান হয়ে গেছে৷ সেখানে কার থেকে ভিক্ষা চাইছে আবার?

অঙ্কিতার মাথাটা ধরে গেছে৷ ও আর দাঁড়ায় না৷ এক ছুটে বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসে৷

ঘণ্টাখানেক পরে যখন ও অফিস থেকে বের হয় তখন রাত ঘন হয়ে গেছে৷ বাইরে পার্কিংয়ের কাছে ওর স্কুটিটা দাঁড়িয়েছিল৷ মাথায় হেলমেট গলিয়ে সেটা স্টার্ট করতে যায়, কিন্তু স্টার্ট হয় না৷

বারবার চাবি ঘুরিয়েও স্টার্ট হচ্ছে না স্কুটিটা৷ অঙ্কিতার মাথাটা গরমই ছিল, এতক্ষণে আগুন জ্বলতে শুরু করে তাতে৷

‘ফাক…’ শব্দটা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে স্কুটির গায়ের সজোরে একটা লাথি মারে অঙ্কিতা৷ সিমেন্টের মেঝের উপরেই সশব্দে উল্টে পড়ে যায় সেটা৷ রাগের মাথায় আবার লাথি মারতে যাচ্ছিল, পেছন থেকে একটা গাড়ির আওয়াজ পেয়েই থমকে যায়৷

গাড়িটা এতক্ষণ যে দাঁড়িয়েছিল সেটা খেয়াল করেনি ও৷ মুখ তুলে দেখে বাসু স্যার দরজা খুলে নেমে আসছে গাড়ি থেকে৷ এতক্ষণ তার মানে অফিসের আশপাশেই ছিলেন ভদ্রলোক? ওর রাগটা একটু প্রশমিত হয়৷ স্যারের সামনে এতটা মেজাজ হারানো ঠিক হয়নি৷

‘মানুষের উপর রাগ, যন্ত্রের উপর দেখালে চলে?’ হাসতে হাসতেই ওর দিকে এগিয়ে আসেন বাসু, ‘রাগ, দুঃখ, অভিমান আর একটা মানুষই নিতে পারে৷ যন্ত্র নয়…’

অঙ্কিতা একটা করুণ হাসি হাসে, ‘আমার অভিমান দেখানোর কেউ নেই তো, তাই আর কী…’

‘চারপাশে তাকালেই দেখতে পাবে…’

স্কুটিতে আর একবার চাবি ঘোরানোর চেষ্টা করল অঙ্কিতা, বাসু ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওটা আজ থাক না হয়, তোমার অভিমানের প্রেশার নিতে পারবে না৷ তার বদলে একটা মানুষ তোমার সামনে আছে যখন…’

রাস্তার আওয়াজগুলো হুট করেই নিভে আসে৷ একটু দূরে ভিখারির ছাউনিটা দেখা যাচ্ছে৷ এখন কোনও আওয়াজ আসছে না সেখান থেকে৷ ঘুমিয়ে পড়েছে লোকটা৷

অঙ্কিতা একটু থতমত খেয়ে বলে, ‘মানে?’

বাসু স্যারের মুখে একটা নরম হাসি ফোটে, ‘দেখ, আমি জোর করার মতো মানুষ নই… জোর করে তোমার হাতটা অবধি ধরব না৷ ইটস জাস্ট…’ মাথা চুলকে গাড়ির উপরে একটা চাপড় মারে বাসু, ‘তুমি একটা ডিভোর্সী মেয়ে৷ অলরেডি ফাস্ট্রেটেড… আমার নিজের জীবনে হাজারটা ফ্রাস্ট্রেশন৷ আমাদের দু-জনের কারওরই তো কোনও ক্ষতি হবে না৷ আই মিন ইউ হ্যাভ নাথিং টু লুজ, তাই না…’

অঙ্কিতার গলকণ্ঠটা একবার ওঠানামা করে, সে বিড়বিড় করে বলে, ‘আপনার বউ বাচ্চা আছে স্যার…’

‘গড়িয়াহাটের কাছে একটা রেজিস্টার্ড ফ্ল্যাটও আছে৷ আই গেস তোমার ওটা ভালো লাগবে৷ যে হাসপাতালে তোমার বাবার অপারেশন হওয়ার কথা সেখানে কিছু চেনাজানাও আছে৷ বলো তো তাদের নম্বরটা…’

‘গো ফাক ইয়োর মাদার…’ দু-হাতে একটা ধাক্কা মেরে মানুষটাকে সরিয়ে দেয় অঙ্কিতা৷ সোনালি চশমার আড়ালে লোভে চকচক করছে দুটো চোখ৷ কেমন স্যাঁতস্যাঁতে সরীসৃপের স্পর্শ লোকটার সমস্ত শরীরে৷

হেঁটেই আবার অফিসে ঢুকে আসছিল অঙ্কিতা, পেছন থেকে বরফের মতো ঠান্ডা গলার আওয়াজ ভেসে এল, ‘ইউ সি বউ-বাচ্চা ছাড়া আরও একটা দরকারি অ্যাসেট আছে আমার কাছে৷ আই থিঙ্ক ইউ উইল লাভ টু সি ইট…’

নিজের মোবাইলে একটা ভিডিও খুলে ওর দিকে ফিরিয়ে চালিয়ে দেয় বাসু৷ প্রথমে আওয়াজ শুনতে পায় অঙ্কিতা৷ তারপর দৃশ্য ভেসে ওঠে৷ ভিডিওতে নিজেকেই দেখতে পায় ও৷ মাঝরাতে মদের বোতল হাতে একটা তিনতলা বাড়ির বাইরের পাঁচিলে নোংরা ছড়া লিখছে ও৷

‘এটা রুমেলা…’ মুহূর্তে অঙ্কগুলো স্পষ্ট হয় মাথার ভিতরে, ‘ব্লাডি বিচ…’ নিজের হাতেই নিজের কপাল চাপড়ায় অঙ্কিতা৷

 ‘সি, আমি বা অন্য কেউ তোমাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছি এর কোনও প্রুফ নেই৷ অ্যান্ড গেস ওয়াট, কুপ্রস্তাব দেওয়াটা আইনি অপরাধ না৷ ইনটারনেটে দু-দিন বাওয়াল করতে পারবে ম্যাক্সিমাম৷ বাট ইউ নো ওয়াট আই ক্যান ডু উইথ দিস ফুটেজ? তোমার এই চাকরি, সেই চাকরি সব খেয়ে নিতে পারি… আই ক্যান টার্ন ইউ ইন্টু আ ফাকিং বেগার উইথ দিস…’

অঙ্কিতার কানের পাশটা গরম হয়ে ওঠে৷ ভিডিওটা একটু আগে বন্ধ হয়ে গেছে৷ ব্ল্যাঙ্ক স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে ও, তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ায়৷

‘সি আমার তোমার সাথে শত্রুতা নেই৷ আমি জাস্ট তোমাকে এই শিক্ষাটুকু দিতে চাই৷ এখানে কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়৷ দ্যাটস দ্য মান্ত্রা৷ ইউ আর গেটিং মাই পয়েন্ট?’

লোকটার মুখের ঝাঁজ হুট করেই কমে আসে৷ স্নেহশীল পিতার মতো ওর মাথায় একটা হাত রাখেন বাসু, ‘বাট নো হারি মাই লেডি৷ কোনও তাড়াহুড়ো নেই৷ আপাতত চলো, তোমাকে বাড়ি অবধি ছেড়ে দিই…’

ওর হাত ধরে নিজের গাড়ির দিকে টান দেয় বাসু৷ অঙ্কিতা হালকা বাধা দেয়, ‘না টাইম লাগবে না, আমি এখনই ভেবে বলছি…’

বাসু একটু অবাকই হয়, ‘এখনই? রিয়ালি?’

পাথরের মতো বলে অঙ্কিতা, ‘হ্যাঁ, জাস্ট একটু একা থাকতে দিন আমাকে…’

‘বেশ, টেক ইয়োর টাইম৷ আমি গাড়িতেই ওয়েট করছি…’

ধীরে ধীরে হেঁটে রাস্তার একটা ধারে এসে বসে পড়ে অঙ্কিতা৷ রাতটা কি এক ধাক্কায় আরও অনেকটা ঘন হয়ে এসেছে? সমস্ত চরাচর ডুবে গেছে নৈঃশব্দ্যে৷ পাশেই এতবড় অফিসের ভিতরে যে এতগুলো মানুষ আছে তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই৷ অঙ্কিতার ঠিক পাশেই সেই ভিখারির বস্তার ছাউনিটা৷ তারও কোনও আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না৷

এত নৈঃশব্দ্যের মধ্যে ওর হঠাৎ মনে পড়ে যায় সৌম্যর কথা৷ দিনের পর দিন ওর গলা টিপে ধরে, কিংবা চুলের মুঠি ধরে অকথ্য যৌন অত্যাচার করত ওর হাসব্যান্ড৷ এ লোকটা ততটা খারাপ নয়৷ এ ওর কাছে একটা অপশন দিয়েছে, একটা লাইফলাইন৷ ওর তো হারানোর কিছু নেই৷

হাত দিয়ে কপালের ঘাম মোছে অঙ্কিতা৷ চুলগুলো মাথার পেছনে বেঁধে নেয়৷ কোমরে ভর দিয়ে উঠতে যাচ্ছিল৷ এমন সময় বস্তার ছাউনির ভেতর থেকে সেই বাটি ঘষার শব্দটা আবার ভেসে আসে৷ লোকটা ঘুমায়নি?

ঘড়ঘড়… ঘড়ঘড়… একটানা নিরবচ্ছিন্ন আওয়াজ…

কিন্তু এখন সে ভিক্ষা চাইছেটা কার কাছে?

হুট করে একটা পুরনো কথা মনে পড়ে যায় অঙ্কিতার৷ এই বাটি ঘষার আওয়াজটা ও আগেও শুনেছে৷ আজ থেকে অনেক বছর আগে৷ অবিকল এই একই আওয়াজ৷ এই প্রথম অঙ্কিতা বুঝতে পারে—আওয়াজটা বাটি ঘষার নয়…

কয়েক সেকেন্ড পরেই বস্তার ছাউনি থেকে একটা হাত বেরিয়ে আসে৷ অঙ্কিতার হাতে কিছু একটা গুঁজে দিয়ে আবার ছাউনির ভিতরেই মিলিয়ে যায় হাতটা৷

বাসুর গাড়িটা তখনও পার্কিংয়েই দাঁড়িয়ে ছিল৷ তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কাচের দরজায় টোকা দেয় অঙ্কিতা৷ দরজা খুলে একগাল হাসে বাসু, ‘সো ইউ হ্যাভ ডিসাইডেড?’

চাঁদের আলো খেলা করছে অঙ্কিতার মুখে, সেক্টর ফাইভের এই ইট-পাথরের জঞ্জালের ভিতরেও এত চাঁদের আলো আসে এতদিন খেয়াল করেনি বাসু৷ অঙ্কিতা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে বাসুর মুখের দিকে৷ একটু আগে ওর চোখ থেকে চশমাটা খসে পড়ে গেছে৷ ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না লোকটার মুখটা৷ সৌম্য বসে আছে কি? নাকি কুমারেশ? নাকি নুড স্টাডি করতে চাওয়া সেই আর্টিস্ট লোকটা? রুমেলা?

চোখে একবার হাত ঘষে ও৷ বাসু মুচকি হেসে বলে, ‘তো ভেবে কী ঠিক করলে?’

মেয়েটার শান্ত ধীর গলা শোনা যায়, ‘ভেবে দেখলাম জানেন… এই দুনিয়ার সব রাজা, জমিদার, অত্যাচারী শাসক, ফ্রাস্ট্রেটেড মিসোজিনিস্টদের আসলে একইরকম দেখতে হয়… আর তাদের একটাই ওষুধ…’

অঙ্কিতার অন্য হাতে ধরা কাস্তের কালো ফলাটার উপরে রাস্তার হলদে আলো ঝিকমিকিয়ে ওঠে৷ সেটার দিকে চেয়ে বাসু হো হো করে হেসে ওঠে, ‘খুন করবে তুমি আমাকে? ওই চাষার অস্ত্র দিয়ে? ও তিন মাস হল বসে আছে এখানে৷ এতদিনে ও কাস্তে ভোঁতা হয়ে গেছে…’

অঙ্কিতার মুখে একটা অদ্ভুত হাসি খেলে যায়৷ তার একটা হাত বিদ্যুৎশিখার মতো উঠে এসে বাসুর চুলের মুটি খামচে ধরে৷ এই প্রথম, গনগনে আগুনের মতো গলায় বলে, ‘আপনি জানেন না, কিন্তু আমার দাদু ছিল, আমি জানি৷ চাষি চাষ ছেড়ে দিক আর যাই করুক না কেন, কাস্তেতে শান দিতে ভোলে না…’

বাসুর মুখ থমথমে হয়ে যায়৷ কোনওরকমে বাধা দিতে যাচ্ছিল সে কিন্তু তার আগেই ধারালো কাস্তের ফলা নেমে আসে তার গলার উপর৷ একবার, দু-বার, বারবার৷ ফিনকি দিয়ে ওঠা রক্তের স্রোতে ভিজে যায় দামি গাড়ির মখমলি সিট৷ কিছুটা রক্ত গড়িয়ে আসে বাইরের রাস্তায়৷ প্রত্যেকটা কাস্তের কোপে অঙ্কিতার গলা দিয়ে এক অদ্ভুত উন্মাদনার শব্দ বেরিয়ে আসে৷ ও জানে না কার উপর নেমে আসছে কোপগুলো…

খানিকক্ষণ পর বাসুর আলগা দেহটা খসে পড়ে যায় গাড়ির বাইরে৷

ভিখারিটা এতক্ষণ ছাউনির ঠিক বাইরেটায় বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিল সমস্ত ঘটনাটা৷ অঙ্কিতা কাস্তেটা ধরেই পিছিয়ে এসে বসে পড়ে তার পাশে৷ জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে ওর৷ সমস্ত গায়ে রক্তের ছিটে৷ বুক জুড়ে নেমে আসছে শান্তির ঢেউ৷ যেন অনেকদিনের লুকিয়ে রাখা একটা সমুদ্রস্রোত বালির বাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে দিচ্ছে এক ইট-কাঠ-পাথরের শহর৷ বহু বছর পরে এই প্রথম ওর শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে…

কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে চেয়ে থাকে ভিখারিটা৷ তারপর দ্রুত উঠে পড়ে৷ একহাতেই তড়িঘড়ি বস্তাগুলো খুলতে খুলতে বলে, ‘আমার আর এখানে থাকা হবেনি ম্যাডাম৷ পুলিশ আসবে, আপনাকে ধরবে৷ কিন্তু খুনের অস্তর খুঁজে পাবেনি… হেঁহেঁ…’

এতক্ষণে হুঁশ ফেরে অঙ্কিতার৷ অবাক হয়ে তাকায় লোকটার দিকে, নরম প্রশমিত গলায় বলে, ‘কিন্তু কে আপনি?’

লোকটা আবার আগের মতোই হেঁহেঁ করে হাসে, ‘সেইটে কি বড় কতা হইল ম্যাডাম?’

অঙ্কিতা হতবাক হয়ে দেখে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বস্তার চাদর খুলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ফেলেছে লোকটা৷ সমস্তটা গুটিয়ে এক জায়গায় এনে একটা মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধতে বাঁধতে বলল, ‘বড় কথা হইল এই গোটা শহরটা একটা মস্ত বড় জন্তর৷ এই জন্তরে আপনাকে ঢুকতিই হবে, কোনও ছাড়ন নেই…’ ঘাড় বাঁকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলে লোকটা, ‘কিন্তু জন্তর যদি বিগড়ে যায়, যদি জন্তর মানুষ মারে, তাহলে সে যত বড়ই হোক, সেইটাকেই ফলানো ধানের মতো উপড়ি ফেলতি হবে৷ যে যাই বলুক ম্যাডাম, দুনিয়ায় এমন কোন জন্তর নেই যার দাম জ্যান্ত মানুষের থিকে বেশি৷ আর…’

 অঙ্কিতা কিছু জিজ্ঞেস করে না৷ উঠে দাঁড়িয়ে লোকটাকে স্পর্শ করে একবার৷ সে এতক্ষণে তার মালপত্র কাঁধে ফেলে হাঁটতে শুরু করেছে৷ বাকি কথাটা ক্রমশ দূরে মিলিয়ে আসতে থাকে, ‘আর মনে রাখবেন ম্যাডাম৷ সব মানুষই হল চাষার বংশধর৷ আর চাষারা কাস্তেয় শান দিতি ভোলে না… আপনি ভুলবেননি তো ম্যাডাম?’

‘না, ভুলব না…’ স্থবির পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই দু-পাশে মাথা নাড়ে অঙ্কিতা৷ লোকটার মিলিয়ে আসা শরীরের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ওর রক্তের ছোপ লাগা ঠোঁটের কোনায় একটা পুরনো মন্ত্র ফুটে ওঠে, ‘জান কবুল আর মান কবুল…’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *