ধাপ্পা
‘চালস ওয়েকম্যানের ‘হিস্ট্রি অফ ম্যাজিক’ আপনার ক’ ভল্যুম ছিল?’
সমরেশ ব্রহ্ম ইন্টারন্যাশনাল ম্যাজিক সার্কলের চিঠির উত্তরে সইটা করে মুখে তুলে চাইল মহিমের দিকে। তাঁর বন্ধু অধ্যাপক রণেন সেনগুপ্তর ছেলে মহিম। সবে লাইব্রেরিয়ানশিপ পাশ করেছে। সে নিজেই আগ্রহ করে তার সমরেশকাকার আড়াই হাজার অগোছালো বইগুলোকে বিষয় অনুযায়ী ভাগ করে গুছিয়ে শেল্ফে রেখে তাদের একটা তালিকা করে দেবার ভার নিয়েছে।
‘কেন, দু ভল্যুম!’ বলল সমরেশ।
‘মাত্র একটাই পাচ্ছি। সেকেণ্ডটা?’
‘সে কি! ভালো করে দেখেছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘আশ্চর্য! সেটটা কানা হয়ে গেল? ও বই যে আর পয়সা দিলেও পাওয়া যায় না।’
সমরেশ ব্রহ্মের বইয়ের নেশা সেই কলেজ থেকেই। পঁচিশ বছর আগের কথা। ইতিহাসের ছাত্র ছিল সে, তবে তার বাইরেও অনেক বিষয়ের বইয়ের প্রতি তার আকর্ষণ। যেমন ভ্রমণ কাহিনী, শিকার কাহিনী, প্রত্নতত্ত্ব, অ্যানাটমি। আর ম্যাজিক। ম্যাজিক ছিল প্রথমে সমরেশের হবি। তারপর ক্রমে সেটা নেশায় দাঁড়ায়। বাপ ছিলেন কলকাতার নামকরা ব্যারিস্টর আদিনাথ ব্রহ্ম। ছেলেও বিলেত গিয়ে ব্যারিস্টরি পাশ করে আসে, এমন একটা ইচ্ছে বাপের ছিল, এবং সে ইচ্ছে অনুযায়ী সমরেশ গিয়েওছিল বিলেত। কিন্তু কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে তিন মাস পড়ার পর জাদুকর মার্কা সিলভারস্টোনের সঙ্গে আলাপ হয়ে পড়াশুনা শিকেয় উঠল। সমরেশ তার বাপকে জানাল সে ব্যারিস্টরি পড়বে না; তার শখ চেপেছে ম্যাজিসিয়ান হবার। অনুরোধটা যাতে আরো জোরদার হয় সেই উদ্দেশ্যে নিজের চিঠির সঙ্গে সিলভারস্টোনেরও একটা চিঠি সে পুরে দিল খামের মধ্যে। সিলভারস্টোন লিখেছে আদিনাথ ব্রহ্মকে—‘তোমার ছেলের বন্ধু হিসেবেই তোমাকে লিখছি—সমরেশ ইজ ওয়ান্ডারফুলি ক্লেভার উইথ হিজ হ্যাণ্ডস। ঐন্দ্রজালিক হিসেবে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে বলে আমি মনে করি।’
এক্ষেত্রে যে-কোনো সাধারণ বাপই হয় মর্মাহত হতেন, না হয় মারমুখো হতেন। কিন্তু আদিনাথ ছিলেন সাধারণের বাইরে। তিনি ছেলেকে লিখলেন, ‘তোর স্বাধীনতায় আমি হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তোর মধ্যে যদি কোনো বিশেষ ক্ষমতা থেকে থাকে, তাহলে সেটার স্ফুরণ হোক সেটাই আমার কাম্য। লণ্ডনে যদি ম্যাজিক শেখার সুযোগ থাকে তাহলে তার জন্য কী খরচ পড়বে সেটা আমাকে জানাতে দ্বিধা করিস না। আমি টাকা পাঠিয়ে দেব।’
সমরেশ কিন্তু আর লন্ডনে থাকেনি। সে দুমাসের মধ্যে দেশে ফিরে আসে এবং বাড়িতেই ম্যাজিক অভ্যাস শুরু করে। তখন তার বয়স বাইশ। পঁচিশ বছর বয়সে সে প্রথম মঞ্চে ম্যাজিক দেখায়। সেটা অবিশ্যি একক প্রদর্শনী; শুধু হাত সাফাইয়ের খেলা। তা সত্ত্বেও এই তরণ জাদুকরের আশ্চর্য দক্ষতার প্রচুর তারিফ করে দৈনিক কাগজের সমালোচকেরা।
বত্রিশ বছর বয়সে সাতজন সহকর্মী ও স্টেজ ইল্যুশনের যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করেন ব্রামা দ্য গ্রেট। শো-এর শেষে দর্শকের তুমুল করধ্বনিতে হলের প্রথম সারিতে বসা আদিনাথ ব্রহ্মের বুক গর্বে দশ হাত হয়।
উনিশশো চুয়াত্তরে আদিনাথের মৃত্যু হয়। বাপের একমাত্র সন্তান হিসেবে সমরেশ তাঁর সম্পত্তির মালিকানা পায়। কিন্তু ততদিনে তার নিজের রোজগারও কিছু কম নয়। ভারতের বিভিন্ন শহর থেকে ডাক ত আসেই, সেই সঙ্গে বিদেশ থেকেও আহ্বান আসা শুরু হয়েছে। আইটেমগুলোর উৎকর্ষ ছাড়াও, সমরেশের শো-এর দুটো বিশেষত্ব দেশ-বিদেশের দর্শককে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। জাদুকরের বুক্নিটা তার ম্যাজিকের একটা অঙ্গ বলেই এতদিন লোকে মেনে নিয়েছে। সমরেশই প্রথম দেখাল যে কথা না বলেও জাদু হয়। আড়াই ঘণ্টা শো-এর মধ্যে একটিবারের জন্যও মুখ খোলে না সে। তার বদলে কানে শোনার জন্য যেটা থাকে সেটা হল সমরেশের দ্বিতীয় বিশেষত্ব। সেতার সরোদ বাঁশী ও তবলার একটি চমৎকার অর্কেস্ট্রার খাঁটি রাগসংগীত সমরেশ ব্যবহার করে তার জাদুর সঙ্গে। সব দেশেরই দর্শকের কাছে এটা একেবারে নতুন জিনিস। বিশেষ বিশেষ জাদুর সঙ্গে বিশেষ বিশেষ রাগ যেভাবে খাপ খেয়ে যায় সেটা দর্শকের চিত্ত জয় না করে পারে না।
আজ একচল্লিশ বছর বয়সে সমরেশের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তার ম্যাজিকের উন্নতির সঙ্গে তাল রেখে তার জনপ্রিয়তাও বেড়ে চলেছে উত্তরোত্তর। কলকাতায় তার ম্যাজিকের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সাত দিনের সব টিকিট বিক্রী হয়ে যায়। শো-এর শেষে আনন্দে ও বিস্ময়ে বিভোর অবস্থায় ছেলে বুড়ো মেয়ে পুরুষের দল বেরিয়ে আসে হল থেকে। সমরেশও জানে যে একসঙ্গে হাজার দু’ হাজার লোককে সুকৌশলে ধাপ্পা দেওয়ার আর্ট আজ তার হাতের মুঠোয়। আমেরিকানরা তার তুলনা করে থার্সটন ও হুডিনির সঙ্গে, বৃটিশরা করে ম্যাসকেলাইন ও ডেভিড ডেভান্টের সঙ্গে, ফরাসীরা রোবেয়র-উদ্যাঁ আর হংকং-এর চীনেরা চিং-লিং ফূ-এর সঙ্গে।
তবে সমরেশের আকাঙক্ষার শেষ এখানেই নয়; তার দৃষ্টি এখনো সামনের দিকে। আরো নতুন-নতুন জাদুর উদ্ভব করবে সে, দর্শকদের আরো চমক দেবে, মুগ্ধ করবে, বিস্মিত করবে।
আর তাই তার বই কেনা আর বই পড়াও শেষ হয়নি। ম্যাজিকের বই ত বটেই, সেই সঙ্গে আছে উইচ্ক্রাট, ভূডুইজ্ম ইত্যাদি আদিম ম্যাজিক, আর হিপ্নটিজ্ম, ক্লেয়ারভয়েন্স, ভেন্ট্রিলোকুইজ্ম ইত্যাদি সংক্রান্ত বই। শুধু এই সব বইয়েতেই তার তিনখানা বড় বুককেস ভরে গেছে। বাইরে থেকে অর্ডার আছে আরো খান-পনেরো সদ্য প্রকাশিত বইয়ের। অনেকটা সময় বাইরে থাকতে হয় বলে বইগুলো অগোছালো ভাবে ছড়িয়ে ছিল, তাই বন্ধুপুত্রের প্রস্তাবে সমরেশ আপত্তি করেনি। মহিমের কাজ শেষ হতে লাগবে আরো দিন চারেক।
এককালে বন্ধুবান্ধবদের বই ধার দিয়েছে সমরেশ, যদিও খুশিমনে দেয়নি কখনো। কেউ কিছু চাইলে না বলাটা ছিল সমরেশের ধাতের বাইরে। এটা যে চরিত্রের একটা দুর্বলতা সেটা সে নিজেও বুঝত, কিন্তু বুঝেও কারুর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি কখনো। ধার দেওয়া বইয়ের হিসেব রাখার জন্য একটি খাতা করেছিল সমরেশ; যে বই নিচ্ছে সে নিজেই তার নাম, বইয়ের নাম এবং ধার নেবার তারিখ সে খাতায় লিখে রাখত। বই ফেরত এলে সমরেশ এই নাম-তারিখের উপর দিয়ে কলম চালিয়ে পাশে একটা সই করে রাখত।
কাজে সফলতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চরিত্র আরো দৃঢ় হয়, আত্মপ্রত্যয় বাড়ে। সেই কারণেই বোধ হয় বছর দশেক হল সমরেশ বই ধার দেওয়া একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে—‘মাপ করো ভাই, ওই একটি অনুরোধ রাখতে পারব না’—এই কথাটা বলা হঠাৎ তার পক্ষে সহজ হয়ে গিয়েছিল। আজকাল ব্যাপারটা সকলেই জানে, তাই আর অনুরোধটা কেউ করেও না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই একটা বই বেপাত্তা হয় কি করে?
ওই খাতাটা একবার দেখলে হত না কি? কিন্তু ম্যাজিকের বই নেবার মতো লোক—?
ঠিক ত! তেমন লোকও ছিল। সমরেশের মনে পড়েছে। মহিম পাশেই দাঁড়িয়ে; সমরেশ তার দিকে ফিরল।
‘শোন মহিম, আমার ইতিহাসের বইয়ের শেল্ফের ডানদিকে একটা ছোট রাইটিং টেব্ল আছে, দেখেছ ত? তার দেরাজে দেখবে একটা নীল রঙের নোটবুক আছে। এককালে বই ধার দিয়েছি লোককে; যে নিত সে ওই নোটবুকে লিখে রাখত। একবার ওটাতে দেখ ত হিস্ট্রি অফ ম্যাজিক কেউ ধার নিয়েছিল কিনা?’
মহিম এক মিনিটের মধ্যেই খাতাটা নিয়ে এল, তার মুখে হাসি।
‘পাওয়া গেছে’, বলল মহিম, ‘লাস্ট এন্ট্রি। নামটা কাটা হয়নি।’
‘সুশীল তালুকদার কি?’
‘হ্যাঁ।’
‘ঠিক ধরেছি। দেখি খাতাটা।’
যাক, অন্তত হদিস পাওয়া গেছে। চার্লস ওয়েকম্যানের হিস্ট্রি অফ ম্যাজিক ভল্যুম ওয়ান ধার নিয়েছিল সুশীল তালুকদার ১০-১০-৭২ তারিখে। অর্থাৎ আজ থেকে দশ বছর আগে। ফেরত দেয়নি। হস্তাক্ষর সুশীলের তাতে কোন সন্দেহ নেই।
কিন্তু সশীল ত এসেছিল দিন পাঁচেক আগে। বিকেলের দিকে। তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে জানিয়ে স্লিপ পাঠিয়েছিল মহিমের হাতেই। অসুস্থতার অজুহাতে সমরেশ দেখা করেনি। সাক্ষাতের কারণ ত জানাই আছে। হয় শো-এর টিকিটের জন্য হাতে-পায়ে ধরা, না হয় কোনো ফাংশনে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি। এককালে প্যাণ্ডেলে ম্যাজিক দেখিয়েছে বৈকি সমরেশ। কিন্তু এখন যে সমরেশ আর সে-সমরেশ নেই সে কথাটা অনেকেই ভুলে যায়। আর টিকিটের জন্য আবদার জিনিসটা ত বাঙালীদের মজ্জাগত। ফুটবলের টিকিট, ক্রিকেটের টিকিট, থিয়েটারের টিকিট, গানবাজনার টিকিট, ম্যাজিকের টিকিট—এর আর শেষ নেই। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কিনতে হবে ভাবলেই গায়ে জ্বর আসে। যদি আসল লোকের কাছে চাইলে পাওয়া যায় তাহলে মিথ্যে হ্যাঙ্গাম কেন? যতসব কুঁড়ের দল। অথচ না-দিলে বলবে ব্রামা দ্য গ্রেটের ভারী দেমাক হয়েছে; নইলে পুরোন আলাপীদের এই ভাবে নিরাশ করে?
‘এ ভদ্রলোক ত এসেছিলেন সে দিন’, বলল মহিম।
‘হ্যাঁ। নির্ঘাত কোনো ফেভার চাইতে। সঙ্গে করে বইটা নিয়ে এলেই হত, কিন্তু তা করবে না। তখনকার দিনে আড়াইশো টাকা দাম ছিল সেটটার। বহুদিন আউট অফ প্রিন্ট। আজকের দিনে নতুন করে ছাপলে দাম হবে হাজার টাকা।’
সমরেশ কথা থামিয়ে ভুরু কুঞ্চিত করল। তারপর বলল, ‘কিরকম দেখলে ভদ্রলোককে? আমার সঙ্গে কলেজে পড়ত। বহুকাল দেখা নেই।’
‘রোগা, আধপাকা চুল, ঘন ভুরু, চোখদুটো তীক্ষ্ণ। আমি বললাম আপনি এ সময় দেখা করেন না, তাও জোর করে আমাকে দিয়ে স্লিপ পাঠালেন। বললেন ওনার নাম শুনলে নাকি আপনি দেখা করতে পারেন।’
‘হুঁ…’
সুশীল তালুকদারকে ম্যাজিকের বইটা ধার দেবার স্মৃতি সমরেশের মন থেকে একেবারে মুছে গেছে। কী মুর্খই ছিল সে নিজে দশ বছর আগে। নইলে এমন বই কেউ ধার দেয়? তখনও পর্যন্ত সুশীলের ম্যাজিক সম্বন্ধে বেশ আগ্রহ ছিল সেটা সমরেশের মনে আছে। হাত সাফাইটা বেশ ভালোই পারত। তবে ধৈর্য বা অধ্যবসায় কোনোটাই ছিল না।
তাছাড়া অবিশ্যি সমরেশের মতো ধনী বাপও ছিল না। তাই ম্যাজিকটাকে পেশা হিসেবে নেবার প্রশ্ন সুশীলের ক্ষেত্রে ওঠেনি। সেই লোকের কাছে আজ দশ বছর থেকে পড়ে আছে সমরেশের সংগ্রহের সবচেয়ে মূল্যবান দুটি বইয়ের একটি।
ভরসা এই যে, জানা যখন গেছে তখন ফেরত পাবার একটা উপায় হবে নিশ্চয়ই।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা কলামন্দিরে শো ছিল। রাত দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরে এসে সমরেশের আবার মনে পড়ল বইয়ের কথাটা। বছর বারো আগে প্রথম কিনে বইদুটো সুশীলকে দেখিয়েছিল সেটাও মনে পড়ল। সুশীলের মন্তব্যটাও মনে পড়ল—‘জাদুবিদ্যার ইতিহাসে একদিন তোমারও নাম লেখা হবে সমরেশ!’ সুশীলের অবস্থা তেমন সচ্ছল নয় সেটা সমরেশ জানে। সে বিয়ে করেছিল বেশ অল্প বয়সে। দুটি মেয়েও হয়েছিল। একটির অন্নপ্রাশনে সমরেশ নেমন্তন্ন খেয়েছিল। ইতিমধ্যে আরো সন্তান হয়ে থাকতে পারে। এমন মানুষের টাকার টানাটানি আশ্চর্য ঘটনা নয়। সে যদি বইটা বিক্রী করে দিয়ে থাকে? মহামূল্য সেটটা পঙ্গু হয়ে যেতে পারে মনে করে সমরেশের বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।
পন্থা একটাই। সে নিজে বইটা ফেরত নিয়ে আসেনি, তখন তাকে চিঠি লিখে সেটার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে।
সমরেশ লিখল, ‘প্রিয় সুশীল, সেদিন তুমি এলে, অথচ অসুস্থতার জন্য তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারলাম না। আশা করি কিছু মনে করনি। আমার একটা বই—ওয়েকম্যানের হিস্ট্রি অফ ম্যাজিক প্রথম খণ্ড—১০-১০-৭২ তারিখে আমার কাছ থেকে তুমি পড়তে নিয়েছিলে—একথা আমার নোটবুকে তোমার নিজের হস্তাক্ষর বলছে। ওটা আমার সংগ্রহের একটা সেরা বই, এবং অধুনা দুষ্প্রাপ্য। পত্রপাঠ যদি সেটা ফেরত দিতে পার ত আশ্বস্ত হই। সকালের দিকে এলে চা-যোগে কিঞ্চিৎ আড্ডাও হতে পারে। শুভেচ্ছা নিও। সমরেশ।’
চিঠিটা লিখে বার দুয়েক পড়ে দেখল সমরেশ। ফেরত দেবার ব্যাপারটা বেশ জোর দিয়েই বলা হয়েছে, তবে রূঢ় ভাবে নয়। এটাই দরকার।
খামের উপর ঠিকানা লিখে টিকিট লাগিয়ে সমরেশ ড্রাইভার রঘুনাথের হাতে চিঠিটা দিয়ে দিল তৎক্ষণাৎ ডাকে ফেলে আসার জন্য।
কলকাতার ডাকবিভাগ যে সবসময়ে খুব তৎপরতার সঙ্গে কাজ করে তা নয়। তবে তাদের গাফিলতির জন্য চার দিন সময় দিয়েও যখন সুশীল তালুকদার দেখা দিল না, তখন সমরেশ রীতিমতো বিরক্ত বোধ করল। এখন করা কী? নিজে গিয়ে সরাসরি বইটা ডিমাণ্ড করাটা কি একটু বিসদৃশ মনে হবে? তা হলেও, যদি ধরে নেওয়া যায় যে চিঠি সুশীলের হাতে পৌঁছায়নি, ডাকে খোয়া গেছে, তাহলে এ ছাড়া গতি কী? বুক শেল্ফ-এর দিকে চোখ পড়লেই দ্বিতীয় খণ্ডের পাশে প্রথম খণ্ডের অভাবে সমরেশের মনটা হু হু করে ওঠে। বইয়ের নেশা এমনই জিনিস। ওটা উদ্ধার না করা অবধি শান্তি নেই।
সাতের তিন মাধব লেনে থাকে সুশীল তালুকদার। রবিবার সকালে গেলে তাকে বাড়িতে পাবার সম্ভাবনাটা বেশি, তাই সেটাই করল সমরেশ। ন’টার সময় সুশীলের কলিং বেলে তার হাত পড়ল। মাধব লেনে এসময় লোক চলাচল যথেষ্ট। সমরেশ কোনো জনপ্রিয় ফিল্ম স্টার হলে আর রক্ষা ছিল না, কিন্তু এমনি দেখে তাকে ব্রামা দ্য গ্রেট বলে চেনার কোনো উপায় নেই। স্টেজে সে গোঁফ ও ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ব্যবহার করে এবং নিজের আসল চেহারা কাগজে ছাপতে দেওয়ায় তার নিষেধ আছে।
‘কাকে চাই?’
দরজা খুলেছে একটি চাকর।
‘সুশীলবাবু আছেন কি?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। কী নাম বলব?’
‘বলো যে সমরেশবাবু দেখা করতে এসেছেন।’
চাকর তাঁকে বসতে বলে ভিতরে চলে গেল বাবুকে ডাকতে।
দরজার পিছনে বৈঠকখানায় ছড়ানো রয়েছে গোটা চারেক সাধারণ সোফা ও চেয়ার, মাঝখানে একটা গোল কাশ্মীরী কাঠের টেবিল, এক পাশে একটা ছোট বইয়ের আলমারির মাথায় একটা ওয়াড় পরানো রেডিও, দেয়ালে গোটা তিনেক ছবি ও দু’রকম ক্যালেণ্ডার।
সমরেশকে বসার সঙ্গে সঙ্গেই আবার উঠতে হল। চোখ কপালে তুলে পর্দা ফাঁক করে হাসিমুখে ঘরে ঢুকেছে তার কলেজের সহপাঠী সুশীল তালুকদার।
‘কী সর্বনাশ! এ কী সৌভাগ্য আমার! কোনদিকে সূর্য উঠল ভাই?’
‘আমার চিঠিটা পাওনি বোধ হয়?
‘পেয়েছি বৈকি!’
‘তাহলে—?’
সমরেশ হতভম্ব। সুশীল বসেছে তার মুখোমুখি সোফায়।
‘ব্যাপার কী জান? বইয়ের প্রতি তোমার যে কী দুর্বার আকর্ষণ সে ত জানি! আর সেদিন ত গিয়ে দেখলুম আরো কত বেড়েছে তোমার সংগ্রহ। তাই ভাবলুম, যদি জবাব না দিই তাহলে তোমার সশরীরে এসে পড়াটা খুব আশ্চর্য নয়। তা অনুমান ঠিকই করেছি, কী বল?’
সশরীরে এসে পড়ে সমরেশের যে খুব ভালো লাগছিল তা নয়। দুজনের জগৎটা যে একেবারে আলাদা হয়ে গেছে সেটা সে বেশ বুঝতে পারছিল। পৃথিবীর চল্লিশটা বড় শহরের কত লক্ষ লোককে সে তার জাদুবলে বশ করেছে, আরো কত লক্ষকে করবে। আর সুশীল? কত সংকীর্ণ তার জগৎটা! ভাবলে অনুকম্পাই হয়। বইটা পেলেই সমরেশ উঠবে। এর সঙ্গে বসে গালগল্প করার সময় তার নেই।
‘তুমি চালটা ঠিকই চেলেছ’, বলল সমরেশ। ‘এমনিতে হয়ত সত্যিই আসা হত না। শো চলছে ত শহরে, তাই বেজায় ব্যস্ত। এবার বইটা যদি ফেরত দাও ত উঠে পড়ি।’
‘বই?’
‘আছে ত? নাকি—’
সুশীল তালুকদার হো হো করে হেসে উঠল।
‘তোমার কোনো বই আমার কাছে নেই ভাই।’
‘সে কি!’—যা আশঙ্কা করেছিল তাই। সে বই পাচার হয়ে গেছে।
‘বই আছে তোমার বাড়িতেই’, বলল সুশীল তালুকদার।
‘মানে? খাতায় যে তোমার হাতে লেখা দেখলাম—’
‘তা থাকবে না কেন? খাতাটা কোথায় থাকত সেটা ত আমার জানা। ওই ছোকরাটির কথা শুনেই যখন বুঝলুম তোমার সঙ্গে দেখা হবে না, তখন মাথায় একটা মতলব এল। দেখিই না একটু রগড় করে! ওকে স্লিপ দিয়ে হটিয়ে দিলুম। তারপর দেরাজ খুলে দেখলুম নোটবুক সেখানেই আছে। ম্যাজিকের বইটা শেলফে দেখতে পাচ্ছিলুম, লিখে দিলুম খাতায় সেটার নাম, আমার নাম আর দশ বছর আগের একটা তারিখ। তারপর দু’ভল্যুম বইয়ের এক ভল্যুম বার করে নিয়ে লুকিয়ে রেখে দিলুম তোমারই ঘরে।’
‘কোথায়?’
‘তোমার যে বাক্স প্যাটার্নের পুরোন গ্রামোফোনটা আছে, সেটার ঢাকনা খুললেই পাবে।’
‘কিন্তু—কিন্তু…’ কিঞ্চিৎ আশ্বস্তভাবের সঙ্গে একটা হতভম্বভাব সমরেশের মনটাকে দু’ভাগে চিরে ফেলেছে। এরকম পাগলামির কারণটা কী?
‘কারণটা আর কিছুই না, ভাই’, বলল সুশীল তালুকদার, ‘সেদিন সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম আমার দুই মেয়ের অটোগ্রাফের খাতা। ব্রামা দ্য গ্রেট আমার কলেজের সহপাঠী ছিল সেটা তাদের বলেছি। তার উপরে তোমার ম্যাজিক দেখে তারা অভিভূত। আবদার করল তোমার সই নিয়ে আসতে হবে। তুমি ত দেখা করলে না। তারা শুনে প্রচণ্ড খাপ্পা, তোমার উপর থেকে ভক্তি চলে যায় আর কি! এটা হবে আমি জানি, যদিও হওয়াটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। বললুম বেচারা অসুখের জন্য আসতে পারেনি, এবার দেখিস্ একেবারে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হবে। আর হলও ত তাই!—ওরে রুনু ঝুনু! তোরা আয়রে!—দেখে যা তোদের বাপের কথা ঠিক হল কিনা!’
পরক্ষণেই পর্দা ফাঁক করে বারো থেকে ষোল বছর বয়সের দুটি ছিপ্ছিপে মেয়ে মুখে সলজ্জ হাসি ও চোখে উজ্জ্বল দৃষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকে সমরেশকে প্রণাম করে তার সামনে খাতা কলম ধরল।
সই দিতে দিতে সমরেশ ব্রহ্ম ভাবল তাকে ধাপ্পা দিতে পারে এমন লোকও এই কলকাতা শহরেই আছে এটা তার জানা ছিল না।