ধানাই-পানাই
এই নিবন্ধের নামকরণে এ রকম একটি ব্রাত্য শব্দের ব্যবহারে কারও যদি আপত্তি থাকে, তিনি স্বচ্ছন্দে এর নামকরণ করতে পারেন ‘শব্দরূপ’।
‘ধানাই-পানাই’কে ব্রাত্য শব্দ বলাও হয়তো ঠিক হচ্ছে না। সাহিত্য অকাদেমি প্রকাশিত পণ্ডিত হারচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশাল অভিধানে শব্দটির স্থান হয়নি। অবশ্য হাতের কাছে রাজশেখর বসুর চলন্তিকায় শব্দটি রয়েছে, অর্থ দেয়া আছে, ‘অসম্বদ্ধ বাগজাল বিস্তার’।
সপ্তাহান্তে কয়েক ইঞ্চি গদ্য রচনা করতে গিয়ে এমন অনেক শব্দের মুখোমুখি হই, পরিচিত প্রবাদবাক্যের মধ্যে এমন অন্যরকম আভাস পাই—যা আমাকে ভাবায়।
বলতে পারেন, লেখেন তো ওই হাবিজাবি গদ্য, কখনও কদাচিৎ অগভীর পদ্য, শব্দ নিয়ে আপনার এত ভাবনা কীসের।
সত্যি কথা স্বীকার করতে গেলে শব্দ নিয়ে, শব্দের ব্যবহার করা নিয়ে আমি যে খুব একটা বিচলিত তা নিশ্চয়ই নয় কিন্তু কখনও কখনও কোনও কোনও শব্দের অর্থ, ব্যবহার কিংবা উদ্ভব নিয়ে মনে প্রশ্ন যে জাগে না তা তো নয়। তত নির্বিকার নই।
যেমন এই ধানাই-পানাই শব্দটি।
শব্দটি কেমন গোলমেলে। প্রথম শুনলে মনে হবে অর্থহীন শব্দ। শব্দটি নিশ্চয়ই সংস্কৃতজ নয়, সংস্কৃত থেকে আসা শব্দগুলির, তৎসম, তদ্ভব, অর্ধতদ্ভব সেগুলির ওপরে একটু ভাল করে চোখ বোলালেই তাদের সংস্কৃত চেহারা আন্দাজ করা যায়।
আবার আরবি-ফারসি-তুর্কি-মুসলমানি শব্দও নয়, সেগুলোর চেহারা আলাদা। এদিকে বিদেশি শব্দ, ইউরোপীয় ভাষা থেকে আগত ইংরেজি, ফরাসি, পর্তুগিজ শব্দের মেজাজ অন্যতর।
অবশ্য হতে পারে বাংলা দেশি শব্দ, প্রাচীন অনার্য শব্দ। কিন্তু ধানাই-পানাই শুনলে খুব পুরনো শব্দ মনে হয় না। মনে হয় প্রায় আধুনিক, খুব কাছাকাছি সময়ের শব্দ এটা, যেমন তুলোধোনা, যেমন বাহিরফট্টাই।
এতদিনে হঠাৎ মনে হল ধানাই এবং পানাই এই দুটি আলাদা কথা একত্র হয়ে ধানাই-পানাই হয়েছে। ধানাই ও পানাই, ধানাই-পানাই দ্বন্দ্ব সমাস।
এর পরে কী করে মাথার মধ্যে খেলে গেল যে ওই ধানাই এবং পানাই আসলে হল ধা নাই এবং পা নাই। অর্থাৎ এমন ব্যাপার যার মধ্যে ধা এবং পা—এই দুটি নেই।
চকিতে মনে পড়ে গেল, ‘সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি। ধা এবং পা বাদ দিয়ে যদি কেউ শুধুই সারেগামানি করে যায় সে হবে খুবই একঘেয়ে ও অসম্বদ্ধ সুর রচনা, হয়তো বা নিরর্থক।
ধানাই-পানাই ঠিক তাই। অনেকক্ষণ ধরে আমি যদি উলটোপালটা একই কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলে যাই, আপনারা বলবেন, ‘তুমি ধানাই-পানাই করছো।’
সুরসিক হিমানীশ গোস্বামীকে ফোন করেছিলাম ধানাই-পানাই নিয়ে আমার ব্যাখ্যা জানাতে। শ্রীযুক্ত গোস্বামী বাংলা শব্দের ব্যাপারে একজন বিশেষ ওয়াকিবহাল ব্যক্তি। তিনি বললেন, ‘আপনার ধানাই-পানাইয়ের ব্যাখ্যা আপাতদৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য। তবু শব্দটির অন্য কোনও উৎস আছে কি না সেটাই দেখতে হবে।’
এরপর হিমানীশ আমাকে একটা প্রশ্ন করলেন যেটা তাঁর পক্ষেই করা সম্ভব, “‘দরদিয়া মরমিয়া” গানটি তো শুনেছেন। এর মানে কী বলতে পারেন?’
আমি ‘জানি না’ বলতে হিমানীশ বললেন, ‘মোগলাই হোটেলে এক ব্যক্তি অনেক কিছু খেয়ে তারপর হেঁচকি তুলতে লাগলেন। তাঁর কাছে বেয়ারা বিল নিয়ে যেতে তিনি বললেন, “দেখছ, আমি মরতে বসেছি। এখন বিল নিয়ে এসেছ?” বেয়ারা এই কথা হোটেলের ম্যানেজারকে গিয়ে বলায় তিনি ছুটে এসে সেই খদ্দেরকে বললেন, “মর মিঞা দর দিয়া,” অর্থাৎ, ‘দাম দিয়ে মারা যাও।’ এরপর ফোনের মধ্যেই গম্ভীর হয়ে হিমানীশ বললেন, ‘গানের পঙক্তিটি এর থেকেই এসেছে।’ হাসিঠাট্টার ব্যাপার নয়। এবার একটা ভাল শব্দ নিয়ে বলি।
মা শব্দের মানে হল লক্ষ্মী। মা লক্ষ্মী কথাটি দ্বিত্ব দোষে দুষ্ট। মাধব হলেন লক্ষ্মীর স্বামী, বিষ্ণু। ধব শব্দটি দেখুন, এর থেকেই সধবা এবং বিধবা। লোকে যখন রসিকতা করে কোনও অবিবাহিতা মহিলাকে বলে অধবা, সেটাও খুব একটা ভুল নয়।