ধানশ্রী
বন্দরের ঘাট থেকে এক্সপ্রেস স্টিমার ছেড়ে চলে গেল। সুধাকর মাঝি অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইল সেদিকে। জাহাজ তো নয় একটা প্রকান্ড দৈত্য যেন! কীর্তনখোলার জল তোলপাড় করে, চারদিক ফেনায় ফেনাময় করে দিয়ে বাঁকের মুখে আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে গেল। শুধু বহুক্ষণ ঢেউয়ের দোলায় দুলতে লাগল সুধাকরের কেরায়া নৌকা।
কোথায় যায়, কত দূরদূরান্ত থেকে আসে। এত বড়ো রাক্ষসী নদীটাকে গ্রাহ্যও করে না। রোদ-বৃষ্টি-তুফান কোনোটাতে ভ্রূক্ষেপ মাত্র নেই। উত্তরের আকাশে মেঘ জমে, নদীর বুকে কাজলবরণ ছায়া ছড়িয়ে পড়ে, ঢেউ উলাস দেয়। হুশিয়ার মাঝিরা সঙ্গে সঙ্গে কূলের দিকে পাড়ি জমায়। কিন্তু ওই জাহাজটা নির্বিকার। ও জানে পাগলা নদীর মাতাল ঢেউ মিথ্যে আক্রোশেই বার বার ওর গায়ে এসে ভেঙে পড়বে, এতটুকুও ক্ষতি করতে পারবে না।
জাহাজটা আর দেখা যাচ্ছে না, শুধু কানে আসছে দুটো প্রকান্ড চাকার হুস হুস করে জল ভাঙবার আওয়াজ। শোনা যাচ্ছে বাঁশির গম্ভীর সুর। সুধাকর অন্যমনস্ক হয়ে রইল। ওই জাহাজটার দিকে তাকালে ভারি ছোটো মনে হয় নিজের জীবনকে, মনে হয় ভারি সংকীর্ণ। কখনো কখনো ইচ্ছে করে জাহাজের খালাসি হয়ে চলে যায় সে—যেখানে হোক, যত দূরেই হোক।
সুধাকরের দীর্ঘশ্বাস পড়ল একটা।
এইবার চারদিকে তাকিয়ে দেখল সে। অধিকাংশ কেরায়া নৌকাই তেমনি সারবেঁধে দাঁড়িয়ে, সওয়ারি জোটেনি। পুজোর মরশুম শেষ হয়ে গেছে, এখন আর ঘরমুখো যাত্রীর ভিড় নেই, সব ফিরে চলেছে কলকাতার দিকে। স্টিমার থেকে মাত্র সামান্য ক-টি লোক নেমেছিল, অধিকাংশই বন্দরের মানুষ। দূরের কেরায়া নেই বললেই চলে।
অতএব এখন আর হাতে কোনো কাজ নেই, চুপচাপ ঘাটেই অপেক্ষা করা। এর মধ্যে যাত্রী জোটে তো ভালোই, নইলে সন্ধ্যার মেল পর্যন্ত দেখে তবে ঘরে ফেরা।
গোটা কয়েক ইলিশ মাছের নৌকা আসছিল ঘাটের দিকে। সুধাকর ডাকল, আছে?
আছে।
দরদাম কীরকম?
বারো আনা, চৌদ্দ আনা, এক টাকা।
বলে কী! একটা ইলিশ মাছ বারো আনা। মগের মুল্লুক ছাড়া একে আর কী বলা যায়।
কীসের মাছ তোমার? সোনার না রুপার? সুধাকর রসিকতা করতে চেষ্টা করল।
তুমি আদার ব্যাপারী, সে-খোঁজে তোমার কী দরকার? চটাং করে উত্তর এল ইলিশ মাছের নৌকা থেকে।
মুখের মতো জবাব পেয়ে চুপ করে গেল সুধাকর। তারপর বিড়বিড় করে বকতে লাগল, ইস, বারো আনায় ইলিশ মাছ বেচবেন! সেদিন আর নেই, কলকাতার বাবুরা সব ফিরে গেছে এখন। ওই ইলিশ মাছ নৌকাতেই পচবে, এ আমি বলে দিচ্ছি।
তা নাহয় পচুক, কিন্তু তাতে সুধাকরের কোনো সান্ত্বনা নেই। আপাতত রান্না চাপাতে হবে এবং কিছু মাছ দরকার। কিন্তু নৌকার দর শুনেই আর গঞ্জের দিকে এগোতে সাহস হচ্ছে না। এক টাকা, পাঁচ সিকের কমে মাছ ছোঁয়াই যাবে না হয়তো। তার চেয়ে…
গলুইয়ের পাটাতন সরাল সুধাকর। ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে একটা আওয়াজ উঠল সেখান থেকে। নড়ে উঠল বেজির মতো একটা মেটে রঙের প্রাণী—উদবেড়াল একটা।
আয় জুয়ান (জোয়ান), আয়। উদবেড়ালের গলার লম্বা দড়িটা ধরে টান দিলে সুধাকর। উদ-টা উঠে এল পাটাতনের ওপর। পোষা বেড়ালের মতোই সুধাকরের চারদিকে সে ঘুরতে লাগল, মাথা ঘষতে লাগল তার হাঁটুতে। সুধাকর একটা সংকেত করলে, যা—
উদ আর অপেক্ষা করলে না। ওস্তাদ সাঁতারুর মতো ঝুপ করে ঘোলাটে নীল জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কয়েকটা চ্যালা মাছ ঝাঁক বেঁধে নৌকার আশপাশে ঘুরছিল, একরাশ খইয়ের মতো চারদিকে সভয়ে ছিটকে পড়ল তারা। হাতের দড়িটা শক্ত করে ধরে জলের দিকে তাকিয়ে রইল সুধাকর। উদের মেটে রঙের শরীরটা কখনো জলের তলায় নিঃশেষে মিলিয়ে যাচ্ছে, কখনো-বা নিশ্বাস নেওয়ার জন্যে এক-এক বার ভেসে উঠছে ওপরে। সুধাকর অপেক্ষা করতে লাগল।
ওদিকের একটা নৌকা থেকে মকবুল মাঝি ছিপ ফেলেছিল। বিরক্ত হয়ে ছিপ তুলে নিয়ে বললে, আবার উদ নামিয়েছ জলে? একটা মাছও ধরা যাবে না আর! সুধাকর জবাব দিল না, তার দৃষ্টি তখনও জলের দিকে। জলের তলায় উদ ঘুরে বেড়াচ্ছে; কখনো টান পড়ছে হাতের দড়িতে, কখনো ঢিলে হয়ে যাচ্ছে তার আকর্ষণ। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা হুটোপুটি টের পাওয়া গেল। সুধাকর রইল উৎকর্ণ হয়ে।
একটু পরেই উদ ভেসে উঠল জলের ওপর। তার ধারালো দাঁতে আন্দাজ একপো একটা রুপালি মাছ ছটফট করছে প্রাণপণে। হাত বাড়িয়ে জানোয়ারটির ভিজে মসৃণ শরীর সুধাকর তুলে নিলে নৌকার ওপরে।
শেষপর্যন্ত বোয়াল মাছ ধরলি জুয়ান।
জুয়ান এক বার মনিবের মুখের দিকে তাকাল। তারপর আবার জলে ঝাঁপ দেওয়ার উদ্যোগ করল।
থাক থাক, ওতেই হবে। গলার দড়িতে একটা ঝাঁকুনি দিলে সুধাকর।
পাটাতনের ওপর বসে উদ এবার নিজের শরীর পরিষ্কার করতে লেগে গেল। মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাতে লাগল সুধাকরের দিকে। সে-দৃষ্টিতে একটা গভীর আত্মপ্রসাদ।
বিকেলে একটা ইলিশ ধরতে হবে বুঝলি? বেশ বড়ো ইলিশ মাছ। তুই আর আমি ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাব রাত্রে। বুঝলি তো?
উত্তরে জুয়ান মনিবের হাঁটুতে ভিজে মাথাটা ঘষে দিলে।
কী মাছ আনল তোমার জুয়ান? মকবুল মাঝির জিজ্ঞাসা শোনা গেল।
বোয়াল। ভাগ নেবে নাকি?
থাক, আমি এক গন্ডা ট্যাংরা ধরেছি।
উদকে খানিকটা কাঁচা মাছ কেটে দিয়ে তোলা-উনুন ধরিয়ে নিলে সুধাকর। বেলা বাড়ছে, জোয়ার আসছে নদীতে। ঘোলাজল ফুলে ফুলে ওদিকের ইটের ভাঁটা পর্যন্ত পৌঁছেছে। কেরায়া নৌকা দুলছে, স্টিমার ঘাটের পন্টুন দুলছে। গাংশালিক উড়ছে দল বেঁধে। মন্থর শান্ত গতিতে একটা ডেসপ্যাঁচ চলেছে মাঝনদী দিয়ে, এ ঘাটে ওটা ভিড়বে না। স্টিমারঘাটের সামনে একটা মিঠাইয়ের দোকানের কাছে কুকুরে ঝগড়া করছে তারস্বরে।
শুধু সুধাকরের নয়, সব নৌকাতেই প্রায় রান্না চড়েছে এখন। জলের গন্ধ, কাদার গন্ধ, কাছ দিয়ে ভেসে-যাওয়া একঝাঁক নিরাশ্রয় কচুরিপানার গন্ধ। তার সঙ্গে রসুন, মশলা আর ফুটন্ত ভাতের গন্ধ মিশে গেছে। রোদটা সম্পূর্ণ উত্তপ্ত হয়ে ওঠবারও সুযোগ পাচ্ছে না, নদীর ভিজে হাওয়ায় জুড়িয়ে যাচ্ছে বার বার।
সুধাকর খেতে বসেছে, এমনসময় ডাঙা দিয়ে ঘুরে ওর নৌকায় মকবুল এসে উঠল।
কী, খাওয়া হয়নি এখনও?
না, রান্না চাপাতে দেরি হল একটু। রসুনের ঝোলমাখা ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে তুলতে সুধাকর বললে, একটু বসো ভাই। তামাক খাও।
মকবুল তামাকের সরঞ্জাম বের করে টিকে ধরাতে বসে গেল।
এই হয়ে এল আমার। বড়ো বড়ো গ্রাস মাখতে লাগল সুধাকর।
আস্তে আস্তে খাও-না, ব্যস্ত হওয়ার কী আছে? টিকেতে ফু দিতে দিতে মকবুল বললে, বিকেলের আগে তো কোনো সওয়ারি পাওয়ার আশা নেই। খাও নিশ্চিন্ত হয়ে।
হয়ে গেছে আমার। প্রায় চক্ষের পলকে পেতলের থালাখানা পরিষ্কার হয়ে গেল সুধাকরের। দুটি-চারটি ভাতের অবশেষ সে নদীর মধ্যে ছড়িয়ে দিলে। ভালো করে সেগুলো জলে পড়বার আগেই ঝাঁকে ঝাঁকে চ্যালা মাছ তা যেন লুফে নিতে লাগল।
থালা মেজে, হাঁড়ি-কড়াই গলুইয়ের ভেতরে সাজিয়ে রাখতে আরও সময় গেল খানিকটা। ততক্ষণে হুঁকোয় একটা শালপাতার নল গুঁজে তামাক টানতে শুরু করেছে মকবুল। মুখের ওপর দুশ্চিন্তার ছায়া।
কী হল? মেজাজ খারাপ নাকি?
নলটা খুলে নিয়ে সুধাকরের দিকে হুঁকো এগিয়ে দিলে মকবুল, নাও।
কড়া দা-কাটা তামাকে টান দিয়ে চোখ দুটো প্রায় তৃপ্তিতে বুজে এল সুধাকরের। বেশ আমেজ লাগিয়ে দিয়েছে মকবুল–কলকেতে গনগন করছে টিকের আগুন।
আয়েশ-জড়ানো গলায় সুধাকর আবার বললে, কী হয়েছে? অমন কেন মুখের চেহারা?
মকবুল জাকুটিভরা চোখে তাকিয়ে ছিল জলের দিকে। কপালটা কোঁচকানো, অন্যমনস্কভাবে হাতের শালপাতার নলটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ছে।
আর ভালো লাগছে না, এবার চলে যাব শহরে।
শহরে?
সেই কথাই ভাবছি। মুখ ফিরিয়ে মকবুল একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, স্টিমারঘাটে কুলিগিরি করব, রিকশা টানব তা নইলে।
কেন, আর বুঝি নৌকা বাইতে মন চায় না?
কী হবে? এও তো কুলির কাজ। যেখানেই যাই আমার অবস্থা সমান। বরং শহরে দুটো পয়সা বেশি আসবে। রিকশা টানতে পারলে আরও বেশি হবে রোজগার।
সুধাকর আস্তে আস্তে বললে, কিন্তু চাচার কথাটা এক বার ভেবে দ্যাখো তোমার।
চাচার কথা! কেমন চমকে উঠল মকবুল। তার চাচা জয়নালও একদিন গ্রাম-দেশ ছেড়ে শহরে গিয়েছিল। দিন কয়েক ঘোরাঘুরি করেই পেয়ে গেল রিকশা টানার কাজ। তারপরে মনে হত জয়নালের মতো সুখী বুঝি বিশ্বসংসারে কেউ নেই। সারাদিনে রোজগার বেশ ভালোই হয়, মালিকের জমার পয়সা মিটিয়ে দিয়েও বেশ উদবৃত্ত থাকে হাতে। তাই থেকে প্রায়ই বাড়িতে পাঁচ-দশটা টাকা পাঠায় জয়নাল, ফর্সা লুঙ্গি পরে, সন্ধ্যা বেলায় এক-আধটু ফুরতি করতেও যায় দু-চার দিন। বছর খানেক এইভাবেই চলল।
কিন্তু হোটেলের কলে-ছাঁটা ভাত, জলের মতো ডাল, দু-এক টুকরো মাছ আর কালেভদ্রে এক-আধ খন্ড মাংস—এতে পেট হয়তো ভরতে পারে, কিন্তু শরীরের তাগিদ মেটে না। যে শক্তি আসে সীমানাহীন নদীর অপর্যাপ্ত জোলো-হাওয়ার উচ্ছাস থেকে; যে-প্রাণ আসে চন্দ্র সূর্য-তারার অবারিত আলোর ঝরনায়; মুঠো মুঠো রাঙা মোটা চালের ভাত, টাটকা নদীর মাছ আর শাকসবজি শরীরে যে-সঞ্জীবনী জাগিয়ে রাখে; রেঙ্গুন চালের ভাতে আর মাপা তরকারিতে তা কোথায় পাবে জয়নাল? প্রথমে বেরিবেরি ধরল, হাত-পা ফুলে দিন কয়েক কষ্ট হল খুব। তারপর থেকেই কেমন যেন নিষ্প্রাণ মনে হতে লাগল শহরের আলো। রিকশা নিয়ে ছোটবার সময় কেমন ঝাঁঝাঁ করতে লাগল কানে, হঠাৎ এক-এক সময় ধড়ফড় করতে লাগল বুকের ভেতরে। শহরে তখন সাইকেল-রিকশা আসতে শুরু হয়েছে, জয়নাল ভাবল ওর একটা জমা নিতে পারলে ঢের বেশি রোজগার করা যাবে। কিন্তু সাইকেল-রিকশার ওপরে বাবুদের ঝোঁক বেশি, কাজেই জমা নিতে গেলে আগাম চায় মালিক। অতএব টাকা জমাবার জন্যে প্রাণপণ পরিশ্রম শুরু করল জয়নাল। তারপর একদিন যখন সদর রোড থেকে সওয়ারি নিয়ে চলেছে কাশীপুরের দিকে, তখন নথুল্লা বাজার পুলের উপরে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সে। সেই যে পড়ল—আর উঠতে পারল না, মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগল খোয়া-ওঠা পথের ওপর। হাসপাতালে নিয়ে আসার পরে দু-ঘণ্টার বেশি বাঁচেনি জয়নাল।
এক বার এক পলকের জন্যে সেই স্মৃতিটা চমকে গেল মকবুলের মনের ওপর। শহর! সেখানে টাকা পাওয়া যায়, সাইকেল-রিকশা টানা চলে, কুলিগিরি করা যায়, একটা পান বিড়ির দোকান দিয়ে বসলেও নেহাত মন্দ হয় না। বায়োস্কোপ দেখা যায়, নানারকম ঘূর্তি করাও চলে, কিন্তু…
কিন্তু!
মকবুল জাকুটি করে জোয়ারের ফুলে-ওঠা জলের তরঙ্গোচ্ছাস দেখতে লাগল। কতকগুলো কুমিরের ছানার মতো একঝাঁক খরশুলা মাছের পোনা জলের উপর বড়ো বড়ো চোখ তুলে ভেসে বেড়াচ্ছে। উড়ন্ত মাছরাঙার লোলুপ দৃষ্টি আছে ওদের ওপর, কিন্তু সহজে ধরা দেবার পাত্র নয় ওরা। ছোঁ মেরে ওদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই টুপ করে ডুবে যাবে জলের মধ্যে। মকবুল একটা কাঠের টুকরো তুলে নিয়ে ছুড়ে দিলে ওদের দিকে। ছলাৎ করে লঘু শব্দ হল একটু,মাছগুলো চক্ষের পলকে মিলিয়ে গেছে। মকবুল বললে, তা হোক। শহরই আমার ভালো।
যেরকম খেপে গেছ, এরপরে খুনখারাপি করবে মনে হচ্ছে। সুধাকর হাসল।
খুন করতে আর পারছি কই। তাহলে তো বেঁচে যাই। ইচ্ছে করে কাল্লাটা নামিয়ে দিয়ে ধড়টাকে পুঁতে দিই কচুরিপানার ভেতরেশেয়াল-কুকুরে টেনে খাক।
এত রাগ তাহলে ইদ্রিশ সাহেবের ওপরেই?
ইদ্রিশ সাহেব! মুখটা বিকৃত করলে মকবুল, বাঁদির ব্যাটা, চুরি-ছ্যাঁচড়ামি করে দুটো পয়সা জমিয়েই সাহেব হয়ে বসেছে। এখন আমাকে বলে বান্দা! বলে, আমি ওর জুতোর চাকর!
বান্দা তো বটেই—সুধাকর ভাবল। মকবুলের নৌকা তার নিজের নয়, ইদ্রিশ মিয়াই তার মালিক। প্রতিটি পাইপয়সার হিসেব দিতে হয় তাকে। আর আশ্চর্য খরশান দৃষ্টি ইদ্রিশ মিয়ার! তিন টাকার সওয়ারি বয়ে দুটো টাকা বলে পার পাওয়ার জো নেই। কী করে টের পায় সে-ই জানে। মকবুল বলে, লোকটার ইবলিশের চোখ আছে।
মকবুল বলে চলল, আমারও দিন ছিল। আমার বাপ-দাদা যদি দাঙ্গাবাজি আর মামলা করে ফতুর না হত, তাহলে কে পরোয়া করত ওই ইদ্রিশ মিয়াকে? এই আমাকেই তবে পোলাও খাওয়ার নেমন্তন্ন করত, ফরাশে বসিয়ে বলত, আসুন মিয়াভাই আসুন—এই নিন ফরসি। কী করব, সবই নসিব।
নসিব বই কী? কী আর নসিব ছাড়া? নইলে গোলাম আলি সর্দারের মেয়ে রোকেয়াকে দেখে এমন করে মন মজবে কেন মকবুলের? যে-মকবুলের মাথা গোঁজবার গোলপাতার ছাউনিটুকু পর্যন্ত একটা দমকা হাওয়ার ভর সয় না—তার কেন হবে বিয়ে করে ঘর বাঁধবার শখ? আর গোলাম আলি সর্দারই-বা কেন এমন হতে যাবে, যার চোখের চামড়া বলে কোনো জিনিস নেই! তারও তো সম্বলের মধ্যে বিঘে তিনেক জমি, তাও চাষ করতে হয় ইদ্রিশ মিয়ার কাছ থেকে বলদ ধার করে। যদিও নামেই সর্দার, তবু তার ঘর থেকেও তো দিনের সূর্য আর রাতের চাঁদ দেখা যায়। তবু সেই গোলাম আলিই-বা জেনেশুনে কেন পাঁচকুড়ি টাকার দেনমোহর চেয়ে বসবে মকবুলের কাছে?
ঘর নেই, জমি নেই, খোরাকি ছাড়া তিন টাকা মাইনে। লুঙ্গি কিনতে হলে এক মাস বিড়ি না খেয়ে থাকতে হয়। সেই মকবুল কিনা রোকেয়াকে দেখে দিশেহারা হয়ে গেল। তারপর ইদ্রিশ মিয়ার কাছে গিয়ে দরবার করে বললে, মিয়া সাহেব, যদি পাঁচকুড়ি টাকা কর্জ দেন…
পাঁচকুড়ি টাকা! ইদ্রিশ মিয়া হা-হা করে হেসে উঠেছিল, শোধ করবি কী করে? বিবি বাঁধা দিয়ে না কি?
আশ্চর্য ধৈর্য মকবুলের! এরপরেও তাই সে ঝাঁপ দিয়ে পড়েনি ইদ্রিশ মিয়ার ঘাড়ের উপর, চড়চড় করে টেনে ছিঁড়ে দেয়নি তার মেহেদি-রাঙানো দাড়িগুলো। শুধু রক্তচোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে চলে এসছে সামনে থেকে।
সুধাকর জানে, সবই জানে। বুঝতে পারে দিনের পর দিন কী অসহ্য হিংস্রতায় মকবুলের বুকের ভেতরটা জ্বলে যেতে থাকে। কিন্তু সহানুভূতি বোধ করা ছাড়া আর কীই-বা উপায় আছে তার। তার নিজের ঘরের মেঝেতে যে মেটেহাঁড়িটা পোঁতা রয়েছে, বড়োজোর চার গন্ডা টাকা মিলতে পারে তার ভেতর। কিন্তু পাঁচকুড়ি তার থেকে অনেক দূরে।
মকবুল বললে, তার চাইতে শহরে যাওয়াই ভালো। স্টিমারঘাটে মুটের কাজ করলেও পাঁচকুড়ি টাকা জমে যাবে এক বছরে।
তা হয়তো যাবে। কিন্তু ততদিন রোকেয়া বিবি তোমার জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকবে না।
থাকবে না? মকবুলের দৃষ্টি হিংস্র হয়ে উঠল, না থাকে বয়ে গেল। আরও অনেক রোকেয়া জুটে যাবে দুনিয়ায়!
এইটে কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে ভাই। এত দুঃখেও হাসি এল সুধাকরের, মেয়ে হয়তো গন্ডা গন্ডা জুটবে, কিন্তু রোকেয়া বিবি দুটি জুটবে না।
মকবুল ছাড়া এত বেশি করে আর কে জানে সেকথা? এমন করে আর কে সেটা অনুভব করে রক্তে রক্তে, নাড়িতে নাড়িতে?
কিছুক্ষণ চুপচাপ। জোয়ারের জল কল্লোল তুলছে। ইটের পাঁজার ওপরে একটা সবুজ লতা দুলছিল, আস্তে আস্তে ঢুকতে লাগল ফাটলের ভেতরে। লাউডগা সাপ একটা।
ও মাঝি, কেরায়া যাবে?
আচমকা ডাক উঠল, যেন মাটি খুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়াল একটা লোক। গায়ে ছিটের শার্টের ওপরে একখানা গামছা, এক হাতে পুঁটলি আর এক হাতে জুতো এক জোড়া।
মকবুল উঠে পড়ল, ওই নাও তোমার সওয়ারি এসে গেছে।
যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎ লাফিয়ে নেমে পড়ল নৌকা থেকে। তারপর ডাঙা ধরে হাঁটতে শুরু করে দিলে।
সুধাকর ভ্রকুটি করল। যদিও সওয়ারির জন্যেই সকাল থেকে সে অপেক্ষা করে আছে, তবু মনে হল যেন এ সময়ে না এলেই ভালো করত লোকটা। কেমন বিশ্রীভাবে রসভঙ্গ করে দিলে।
লোকটা আবার অধৈর্যভাবে বললে, যাবে নাকি কেরায়া?
কেন যাব না? যাওয়ার জন্যেই তো বসে আছি। কোথাকার কেরায়া?
মুরাদপুর।
দেড় টাকা দেবেন। দেড় টাকা?
এই তিন মাইল রাস্তা দেড় টাকা?
তবে অন্য নৌকা দেখুন।
কিন্তু লোকটা বোকার মতো এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াতে রাজি নয়। দশ জায়গায় দর করে বেড়ানোর চাইতে এক জায়গায় দামদস্তুর করাই ভালো। রফা হল এক টাকায়।
সওয়ারি তুলে নিয়ে সুধাকর যখন নৌকা ভাসাল, তখন তার চোখে পড়ল মকবুল জলে ছিপ ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছে।
জোয়ারের জলে মাছ উঠবে না, তা ছাড়া মাছের দরকারও নেই ওর। তবু!
২.
কিন্তু মকবুলের জন্যে মিথ্যে দুঃখ করে কী হবে সুধাকরের? তার নিজের কথাই কি সে ভাববার সুযোগ পেয়েছে এ পর্যন্ত?
ওপরে আকাশ, নীচে গাং, মাঝখানে ডিঙি। সুধাকরের জীবনে এ ছাড়া কোথায় কী আছে আর? ঘর আছে, সে ঘরে থাকে তার বুড়ি পিসি। সে-ই চারদিক আগলে রাখে, যক্ষের মতো পাহারা দেয় কয়েকটা সুপুরি গাছ। রাত্রে কান পেতে থাকে পুকুরের দিকে। মাছেরই দেশ, তবু লোকের স্বভাব যাবে কোথায়? চুরি করতে না পারলে পেটের ভাত যাদের হজম হয় না–রাতবিরেতে তারা আসে। ঝপাং করে জাল ফেলে পুকুরে—মোচা চিংড়ি, পোনা মাছ, কাঁকড়া যা পায় তাই নিয়েই পালায়। পুকুর-ভরতি কলের কাঁটা ফেলেও নিস্তার নেই তাদের হাত থেকে। তাই বুড়ি সারারাতই কানখাড়া করে থাকে, জলে একটা গোসাপ পড়লেও হুড়মুড় করে ছুটে যায় ঠ্যাঙা নিয়ে। আর সারারাত পড়ে কফফলের মন্ত্র :
কফফল, কফফল, কফফল—
চোরের রাত্তির নিষ্ফল!
সাপা, চোরা, বাঘা না-বাড়াইয়ে পাও—
যদ্দূরে যায় কফফলের রাও!
কিন্তু কফফলকে পাহারা দেওয়ার দরকার হয় না। বুড়ি একাই যথেষ্ট।
এক-একদিন চটে যায় সুধাকরের ওপর। প্রাণখুলে গাল দিতে শুরু করে।
বিয়ে করবে না, সংসার করবে না, রাতদিন নৌকা আর নৌকা। আমারই-বা এমন কোন দায়টা ঠেকেছে সংসার আগলে থাকার? আমারও শ্বশুরবাড়ি আছে, ঘরদোর আছে। একদিন চলে যাব সেখানেই।
শুনে সুধাকরের হাসি পায়।
যাও-না, সেখানেই যাও।
যাবই তো। ভয় করি নাকি তোকে?
আমাকে ভয় করবে কেন খামোখা? কিন্তু আমি বলছিলাম কে আছে তোমার শ্বশুরবাড়িতে? সব তো কবে মরে হেজে শেষ হয়ে গেছে। গিয়ে দ্যাখো, ভিটের ওপর এখন শেয়াল চরে বেড়াচ্ছে, ডিম পাড়ছে গোখরো সাপে।
তা হোক, তা হোক। তবু এই অলক্ষীর সংসারের চাইতে সেই জঙ্গলই আমার ঢের ভালো।
সুধাকর জানে বুড়ি কোনোদিন যাবে না, সে-প্রশ্ন ওঠেও না। তবু মধ্যে মধ্যে তারও কি মনে হয় না এ তার অলক্ষীর সংসার? বউ আসবে, ধানের পালা সাজাবে, চিড়ে কুটবে চেঁকিতে, শাঁখ বাজাবে সন্ধে বেলায়, বাড়ি ফিরলে মুখ ধোয়ার জলের ঘটি আর গামছা এগিয়ে দেবে, আর যখন রাত হবে…
যখন রাত হবে, তখন এই ভাঙা ঘরকেই মনে হবে যেন সায়েস্তাবাদের নবাববাড়ি। খড়ের ওপরে ছেঁড়া কাঁথার বিছানায় নেবে আসবে স্বর্গ। একটা রাত শেষ হয়ে যাবে এক পলকে সুপুরি বনের মাথার ওপর থেকে এক ডুবে চাঁদটা নদীর ওপারে গিয়ে ভেসে উঠবে।
কিন্তু সে আর হয় না। সুর কেটে গেছে।
মকবুলের মতো নয়, তার কারণ অন্য।
চব্বিশ বছরের সুধাকর ছ-বছর পেছনে ফিরে তাকাল। মুরাদপুরের সওয়ারি নামিয়ে ভাটার টানে নৌকাটা ভাসিয়ে দিয়ে আচ্ছন্ন চোখ মেলে তাকাল সুধাকর।
ছ-বছর আগেকার সুধাকর। আঠারো বছর বয়েস তখন। বুকের মধ্যে টগবগ করে ওঠে, সবসময়ে নিজেকে আশ্চর্য শক্তিমান মনে হয়। মনে হয়—ইচ্ছে করলে এখন সে লড়তে পারে ডোরাদার বাঘের সঙ্গে, তুফানের মুখে সাঁতার দিতে পারে কালাবদরের জলে, মানুষখেকো কুমিরের মুখ দু-হাতে ধরে ছিঁড়ে আলাদা করে দিতে পারে। সেই আঠারো বছর বয়েস, যখন মেয়েদের দিকে তাকালে মন একটা নতুন অর্থে গুঞ্জন করে ওঠে, তাদের চলার ছন্দে রক্তের ভেতর কী যেন ঝিনঝিন করে বাজতে থাকে।
সেই সময় বাইচ খেলা হচ্ছিল রায়মহলে।
বিজয়া দশমী–-প্রতিমা বিসর্জনের দিন। গাঁয়ের বাইচের নৌকায় সুধাকরও এসেছিল। নামকরা বাইচের দল তাদের। এর আগে অনেক বার তারা বাইচ জিতেছে, পাঁচ পাঁচ টাকা করে বকশিশ পেয়েছে প্রত্যেক দাঁড়ি, পেয়েছে একখানা করে কাপড়। বড়ো রায়কর্তা বলেছেন টাকা তো দেবেনই, তা ছাড়া একটা করে রুপোর মেডেলও দেওয়া হবে সকলকে।
তাই জোর পাল্লা হবে এবার।
হলও।
সে কী উত্তেজনা! দু-পাড় থেকে ঢাক বাজছে, নদীতে নৌকায় নৌকায় উঠছে ঢাকের আওয়াজ। ধূপধুনোর সঙ্গে যেন ঘন কুয়াশা জমেছে নদীর ওপরে। হুস হুস করে সাপের মতন আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে উড়নতুবড়ি। দাঁড়ের তালে তালে হালের মাঝি দমাদম পা ঠুকছে গলুইয়ের উপর।
দুখানা নৌকা পাশাপাশি চলেছে সমানে সমানে। বাকিগুলো হাল ছেড়ে দিয়েছে, পিছিয়ে পড়েছে তারা। সুধাকরদের নৌকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে রায়মহল বাজারের নৌকা।
হঠাৎ রায়মহলের নৌকা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে অনেকখানি সরে এল এদিকে। ধাক্কা লাগল সুধাকরদের নৌকার গলুইয়ে, সঙ্গে সঙ্গে ওদের নৌকা প্রায় তিন হাত পিছিয়ে সরে গেল।
এটা বেআইনি, মারাত্মক অপরাধ। এ অপরাধে বাইচের নৌকায় খুনোখুনি হয়ে যায়, এর আগে হয়ে গেছে অনেক বার।
মার শালাদের…
বিশাল বাবরি দুলিয়ে পা ঠুকল হালের মাঝি। গোঁয়ার ধরন, গায়ে অসুরের মতো শক্তি, তার ওপর মদ খেয়ে এসেছে লোকটা। বলেই ফস করে গলুইয়ের তলা থেকে একখানা রামদা বের করে ঘোরাতে লাগল মাথার ওপর, পৈশাচিক গলায় চিৎকার করে উঠল, মার শালাদের…
নদীর দু-ধার থেকে লোকে হইহই করে উঠল, কিন্তু অবস্থা তখন আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। মার মার শব্দে দু-নৌকাতেই দাঁড়িয়ে উঠল আটচল্লিশ জন লোক। বেরুল রামদা, বেরোল সড়কি, বেরোল টেটা। তারপর সুধাকর একটা বল্লম ছুড়ে দিলে রায়মহলের নৌকায়। কারও গায়ে লাগল না, একটা লোকের কানের পাশ দিয়ে সোজা গিয়ে পড়ল নদীর জলে। সঙ্গে সঙ্গে একটা টেটা এসে সুধাকরের হাঁটুতে বিঁধল শতমুখী ফলায়। অসহ্য যন্ত্রণায় টলে উঠল সুধাকর। ঝপ করে পড়ে গেল নদীতে।
সেই অবস্থাতেই টেটাটাকে পা থেকে খুলে নৌকায় ওঠবার চেষ্টা করল সুধাকর, কিন্তু তাকে পেছনে ফেলে নৌকা অনেকখানি এগিয়ে গেছে তখন। আর তার ওপরে লক্ষও ছিল ও-নৌকার, মাথা তুলতে ঝপাং করে একটা বল্লম একেবারে সামনে এসে পড়ল।
নদীর ওপর তখন অন্ধকার নামছে, কালো হয়ে গেছে জল, আবছা আবছা দেখাচ্ছে সমস্ত। কয়েকটা ভেসে-যাওয়া কচুরিপানার সঙ্গে আত্মগোপন করে সাঁতরে চলল সুধাকর পাড়ে উঠতে পারলে হয়। কিন্তু শরীরে আর বইছে না। ডান পা-টা ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে, শতমুখী ক্ষতে নোনতা জল লেগে একটা দুর্বিষহ যন্ত্রণার চমক বইছে। সুধাকর বুঝতে পারছিল, আর বেশিক্ষণ এভাবে চলবে না। তার আঠারো বছরের লোহায়-গড়া শরীরেও এই মুহূর্তে ভাঙন ধরেছে, বড়ো বেশি দপ দপ করছে হৃৎপিন্ড। হয়তো…
হয়তো? মুহূর্তের মধ্যে সুধাকর অনুভব করতে পারল সে নিঃশেষিত হয়ে আসছে, মৃত্যু এসে ছায়ার মতো নামছে তার মাথার ওপরে। আর এক মিনিট কিংবা দু মিনিট কিংবা হয়তো আরও কম-তার মধ্যেই সে তলিয়ে যাবে জলের মধ্যে। যে-জলটা একসময় পাখির পাখার মতো তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত, সেই জলই এখন এক মন ওজনের একটা গুরুভার বোঝার মতো তাকে আকর্ষণ করছে নীচের দিকে।
শুধু তাই নয়, এ অঞ্চলের জলের সঙ্গে পরিচিত সুধাকর স্পষ্ট একটা অভ্যস্ত শব্দ শুনল পেছনে। ছলাৎ করে একটা আওয়াজ—আরও একটা তারপরে। মুখ ফিরিয়ে চকিতের জন্যে সুধাকর দেখতে পেল একটা প্রকান্ড রাঘববোয়ালের মতো বিরাট উজ্জ্বল মাছ ক্রমাগত জলের ওপর লাফিয়ে উঠছে।
কামট! রক্তের গন্ধ পেয়েছে।
একটা আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল সুধাকরের গলা দিয়ে। কিন্তু কেউ শুনতে পেল না— শোনবার উপায়ও নেই। বাইরের নৌকায় তখনও মারামারি চলছে, দু-ধার থেকে সমান কোলাহল উঠছে আকাশ ফাটিয়ে। তার মধ্যে নদীর কালোজলে কোথায় মৃত্যুর মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে সুধাকর-কে তার খবর রাখে?
ছলাৎ করে শব্দটা আরও কাছে। কামটটা এবার অনেক কাছে এসে পড়েছে। পালাবার উপায় নেই। রক্তের গন্ধ অনিবার্যভাবে আকর্ষণ করে আনছে তাকে।
সুধাকর চোখ বুজল। সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। উড়নতুবড়ির ফুলঝুরিগুলো শেষ বারের জন্যে চোখের সামনে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ল।
সেই তখন—
একটা কী তাকে আঁকড়ে ধরল, কিন্তু সে কামটের দাঁত নয়, মানুষের হাত। তারপর সুধাকর যখন চোখ মেলল তখন সে রায়মহলের ছোটোকর্তার বজরায়।
নেশায় ঝুঁদ হয়ে আছেন ছোটোকর্তা। বেপরোয়া মেজাজের লোক। নেশায় সাক্ষাৎ বৃহস্পতি, চরিত্রে গুণের ঘাট নেই। পাড়ার ঝি-বউ সন্ত্রস্ত থাকে তাঁর ভয়ে। বিয়ে একটা করেছিলেন, কিন্তু স্ত্রী ছ-মাসের বেশি টিকতে পারেননি। শোনা যায় আফিং খেয়েছিলেন। ডাক্তার কবিরাজে তাঁকে বাঁচাল, কিন্তু ছোটোকর্তার সংসারে তিনি আর রইলেন না। কিছুদিন পরে বাপেরবাড়ির লোক এসে ছোটোগিন্নিকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল। আর ফিরে আসেননি তারপরে।
কিন্তু ছোটোকর্তা নিরঙ্কুশ সেই থেকে।
রেসের মরশুমে কলকাতা যান, মাস কয়েক থাকেন। তারপরে আবার গ্রাম। দিনদুপুরেই পড়ে থাকেন মদে চুর হয়ে, নিজের রক্ষিতা নিয়ে বেড়াতে বেরোন খোলা নৌকায়।
আজও বিজয়ার দিনে বেরিয়েছিলেন রং চড়িয়েই।
তাঁরই বজরার মাঝিরা তুলে এনেছে সুধাকরকে।
চোখ মেলতেই সুধাকর দেখল গোলগাল ফর্সা একটি মুখ। পানের রসে রাঙানো টুকটুকে ঠোঁট। পরনে নীলাম্বরি শাড়ি-হাতে সোনার চুড়ির ঝলক।
একটু ভালো আছ এখন?
কথা তো নয়—যেন গানের সুর।
বজরার ভেতরে গ্যাসের আলো জ্বলছে। সেই আলোয় যেন মায়াপুরীর মতো মনে হল সমস্ত। পায়ের পাতায় টেটার অসহ্য যন্ত্রণা ভুলে গেল সুধাকর। তাকিয়ে রইল মুগ্ধদৃষ্টিতে।
একটা গম্ভীর গমগমে গলা এল এবার।
লোকটাকে এখন নামিয়ে দাও ডাঙায়। বাড়ি চলে যাক।
সেই ফর্সা সুন্দর মুখোনা ভরে উঠল করুণায়। দুটি কালো চোখ চকচক করে উঠল। না। দাঙ্গার পরে পুলিশে সব খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওকে পেলে এখুনি নিয়ে যাবে থানায়।
তাহলে কী করা যায়! আবার সেই গম্ভীর জড়ানো গলাটা শুনতে পাওয়া গেল, কী করতে চাও একে নিয়ে?
সুধাকর তাকিয়ে দেখল। প্রকান্ড মুখ, কালিপড়া কোটরের ভেতরে রাঙা টকটকে চোখ। ছোটোবাবু।
সুন্দর মানুষটি বললে, আজ আমাদের ওখানেই নিয়ে চলো।
কী বলছ তুমি? একটা দাঙ্গার আসামিকে নিয়ে—
সে আমি বুঝব। তোমায় ভাবতে হবে না।
সেই মিষ্টি মুখের কথা। কিন্তু কথা নয়—আদেশ। ছোটোকর্তা বললেন, বেশ, তাই হবে।
তারপর…
তারপরের অভিজ্ঞতা কী করে ভুলবে সুধাকর? সে যেন স্বপ্নের ঘোরে পরির দেশের আশ্চর্য কাহিনি। বাইচের নৌকা থেকে রূপকথার রংমহলে।
সুধাকর আবার কখন যে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল কে জানে। যখন ঘোর ভাঙল তখন পিঠের নীচে দুধের মতো নরম বিছানা। সামনে ছোটো টেবিলে একটা কাচের গ্লাস-ভরতি গরম দুধ। আর— আর সেই স্বপ্নময়ী মেয়েটি। একটা চেয়ারে তারই মুখোমুখি বসে আছে।
আবার সেই গানের সুর শোনা গেল।
নাও, এই দুধ খাও।
সুধাকর চোখ কচলাল। ব্যাপারটা এখনও বাস্তব বলে মনে হচ্ছে না তার।
উঠে বসো, খেয়ে নাও দুধটা।
আদেশ। সুধাকরকে উঠে বসতে হল। পরনে ভিজে কাপড়টা নেই, একখানা মসৃণ ধুতি কে যেন জড়িয়ে দিয়েছে। পায়ে যেখানে টেটার ঘা লেগেছিল, সেখানে একটা পুরু ব্যাণ্ডেজ। যন্ত্রণা আছে, তবু আঠারো বছরের শরীরটা আবার শক্তি আর লঘুতায় ভরে উঠেছে।
দেখুন, এবার আমি যাই।
এখনি যাবে কোথায়? আজ রাতে বিশ্রাম করো এখানে। তোমার কোনো ভয় নেই, এবাড়িতে পুলিশ আসবে না।
দেখুন, আপনারা আমাকে…
মেয়েটি ভঙ্গি করলে। বিহ্বলতার নেশা লাগল সুধাকরের।
মেয়েটি বললে, আমাকে অত আপনি আপনি করছ কেন? আমি এবাড়ির গিন্নি নই।
তাহলে আপনি…
আমি কে পরে বলছি। তোমার নাম কী?
আমার নাম সুধাকর।
সুধাকর! বেশ নাম। মেয়েটি মনে মনে যেন আউড়ে নিলে একবার। কী জাত?
বলতে গিয়ে একটা ঢোঁক গিলল সুধাকর। এই ঘর, দুধের ফেনার মতো নরম বিছানা, সামনে বিচিত্র চেহারার ওই ঝাড়লণ্ঠনের আলো, আর এই আশ্চর্য মোহময় মেয়েটি। এখানে নিজের পরিচয় আরও একটু বুক ফুলিয়ে বলতে পারলে হত। ভালো হত আরও গর্বের সঙ্গে বলতে পারলে। কিন্তু কুঁকড়ে গিয়ে সুধাকর বললে, আমরা জাতে জেলে।
আমি কপালির মেয়ে। রাধা আমার নাম।
কপালির মেয়ে! চকিতে বিস্ময় চলকে পড়ল সুধাকরের চোখ থেকে। তাহলে–? তারপরেই লোকশ্রুতিতে শোনা ছোটোবাবুর কাহিনি মনে পড়ে গেল সুধাকরের। ছোটোকর্তা অত্যন্ত দুশ্চরিত্র লোক, নিজের স্ত্রীকে তাড়িয়ে দিয়েছে বাড়ি থেকে, রক্ষিতা নিয়ে থাকে।
সুধাকর শিউরে উঠল এক বার। রক্ষিতা! জেলের ছেলে সুধাকরেরও সর্বাঙ্গে একটা ঘৃণার ঢেউ বয়ে চলে গেল। এক বার মনে হল…
কিন্তু পরক্ষণেই রাধার দিকে চোখ তুলে চেয়ে দেখল সে। কাকে ঘৃণা করবে সে, কাকে ভাববে রক্ষিতা? বয়েসে তারই সমান হবে মেয়েটি, রূপ আর যৌবন ফেটে পড়ছে পাকা ডালিমের মতো। কপালির ঘরে এমন মেয়ে কোথা থেকে জন্মায়! কী করেই-বা জন্মায়।
রাধা বললে, কাজেই বুঝতে পারছ আমার কাছে তোমার লজ্জার কিছু নেই। আমাকে আপনি-আজ্ঞেও করতে হবে না। এখন এই দুধটা খেয়ে নাও।
এবার আর দুধের গ্লাস তুলে নিতে আপত্তি রইল না কোথাও।
আপন ডাইন, আপন ডাইন!
একটা তীব্র চিৎকার। সুধাকরের ঘোর ভেঙে গেলে। ক্ষিপ্র হাতে নৌকাকে সামলে নিলে সে। খালের বাঁক ঘুরে আর একখানা নৌকা যে আসছিল, তার সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে গেছে। ছইয়ের বাতাগুলো কট কট করে উঠল, ও-নৌকা থেকে একটা লগি ঝপাস করে পড়ে গেল জলের ভেতরে।
এই মাঝির পো, চোখ থাকে কোন দিকে? নৌকা বাইতে শেখনি এখনও? বিপরীতমুখী নৌকা থেকে ধমক এল।
লজ্জিত সুধাকর জবাব দিল না।
বেলা তিন প্রহর। আরও দুটো বাঁক সামনে। রোদের রং হলদে হয়ে আসছে। সুধাকরের মন ফিরে এসেছে বাস্তবের সীমায়। চোখে পড়ল পাশে একটা মস্ত কচুরিদামের ভেতরে কুচো চিংড়ি লাফাচ্ছে।
সুধাকর ঝুপ করে লগিটা পুঁতে ফেলল। তারপর কচুরির ঝাঁকটাকে টেনে তুলল নৌকার ওপর। অনুমান নির্ভুল। প্রায় আধপো কুচো চিংড়ি আর গোটা কয়েক ডারকিনা মাছ ছটাং ছটাং করে লাফাতে লাগল চারদিকে।
নে জুয়ান, খা। তোর খিদে পেয়েছে নিশ্চই।
জুয়ানকে নিমন্ত্রণ করবার দরকার ছিল না। যেমন করে ছোটো ছেলেপুলে এক-একটা করে মুড়ি কুড়িয়ে খায়, তেমনিভাবেই সে মাছগুলোর সদগতিতে লেগে গেল।
আবার নৌকা ছাড়ল সুধাকর। মকবুল, রোকেয়া! গোলামের বাদশাজাদি পাওয়ার স্বপ্ন! কিন্তু সে নিজেও তো কিছুতেই তো ভোলা যাচ্ছে না রাধাকে। বারে বারে মনে পড়ছে, একটা দুঃসহ যন্ত্রণায় মনে পড়ে যাচ্ছে। সুধাকর ঠোঁট কামড়ে ধরল।
সেই রাত। সে তো শেষ রাত নয়। আঠারো বছরের সুধাকরকে রাধা বলেছিল, আবার
কিন্তু এখানে?
কোনো ভাবনা নেই। সন্ধ্যার পরে বাবুর আর সাড় থাকে না।
তা থাকে না। কিন্তু সেজন্যে ছোটো রায়কর্তার কোনো লজ্জা-সংকোচের প্রশ্ন নেই। তিনি নিজেই গর্বভরে অনেক বার বলেছেন, সন্ধের পরে কোনো ভদ্রলোক কী করে যে চোখ মেলে তাকায় আমি তো সেকথা ভেবেই পাইনে।
নিঃসন্দেহ! খাঁটি ভদ্রলোক হতে গেলে সন্ধের পরে কিছুতেই চোখ খুলে রাখা উচিত নয়। কিন্তু সুধাকর তো ভদ্রলোক নয়। তাই সন্ধ্যার অন্ধকার তার রক্তে একটা কীসের যেন ঘুম ভাঙায়, প্রত্যেকটা মুহূর্ত যেন তার বুকের মধ্যে মৃদঙ্গের আওয়াজের মতো ঘা দিতে থাকে। রাত্রির আড়ালে আড়ালে যারা শিকার খুঁজে বেড়ায়, তাদের মতোই কতগুলো খরধার নখদন্তের অস্তিত্ব নিজের মধ্যে অনুভব করতে থাকে সুধাকর। আঠারো বছরের বলিষ্ঠ হাতের মুঠো দুটো যেন থাবা হয়ে যায়, বনবেড়ালের চোখের মতো জ্বলতে থাকে দৃষ্টি।
সুধাকর ভদ্রলোক নয়, তাই রাত্রিই তার সময়।
প্রথম দিন রাধাই দাঁড়িয়ে ছিল দোরগোড়ায়, খিড়কির ধারে।
আপনি?
আবার আপনি? রাধা ধমক দিয়ে উঠেছিল, আমি কপালির মেয়ে। নাম ধরেই ডেকো আমাকে।
একবার তাকিয়ে দেখল সুধাকর। কানে সোনার দুল দুটো ঝকঝক করছে। কপালের উলকিটা যেন রাজটিকা। তবু রাজকন্যা নয়—রাধা।
রাত্রির নেশা তখন একটু একটু করে কাঁপছে রক্তে। আকাশে নক্ষত্ররা বিহ্বল। গাছের ডালে ডালে অতন্দ্র বনবেড়াল ঘুরছে শিকারের সন্ধানে। সেই বনবেড়ালের লুব্ধ পিঙ্গল চোখের মতোই জ্বলে উঠল সুধাকরের চোখ।
সেই মুহূর্তের প্রভাবে সুধাকর বলেছিল, বেশ তাই হবে। কিন্তু তুমি আমায় ডেকেছ কেন?
সেকথা তো এখানে বলা যাবে না। চলো ভেতরে।
ভেতরে? এক বারের জন্যে কুঁকড়ে গিয়েছিল সুধাকর। কিছুই বিশ্বাস নেই, কে জানে কোথায় অপেক্ষা করে আছে একটা বিপজ্জনক ফাঁদ! ছোটো রায়কর্তা যদি টের পান?
রাধা বলেছিল, কোনো ভয় নেই। আমি বলছি, তুমি এসো আমার সঙ্গে।
সত্যিই ভয় ছিল না। নেশায় বেঘোর হয়ে একটা জগদ্দল পাথরের মতো পড়ে আছেন রায়কর্তা। পড়ে আছেন উবুড় হয়ে মস্ত ফরাশের ওপর। রাধার পায়ের শব্দ শুনে জড়ানো গলায় কী যে বললেন সেটা বোঝা গেল না।
কী করে সেই রাতকে ভুলবে সুধাকর? কেমন করে ভুলবে সেই আশ্চর্য রূপকথা?
কত সহজে নিজের কথা বলেছিল রাধা! কত অবলীলাক্রমে কপালির মেয়ে নিজেকে মেলে ধরেছিল জেলের ছেলের কাছে!
সে-মুখ সুধাকর পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে এখনও। পদ্মফুলের ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলেছে জলের বিন্দু।
আমি আসতে চাইনি, কক্ষনো আসতে চাইনি এখানে। একমুঠো টাকা নিয়ে আমার কাকা আমাকে তুলে দিয়ে গিয়েছিল জমিদারের বজরায়।
তারপর–
তারপর চার বছরের ইতিহাস। অন্ধকার আর অন্ধকার। টাকা-গয়না সব পেয়েছে রাধা, কিন্তু আর-কিছুই তো পায়নি। রায়কর্তার ঘরে আরও অনেক পুতুলের মতো তাকেও সাজিয়েই রাখা হয়েছে শুধু। আরও বহু মেয়ে এসেছে এর মধ্যে, একটার পর একটা শূন্য মাটির ভাঁড়ের মতো তাদের দূরে ছুড়ে দিয়েছে ছোটোকর্তা।
রাধা তার পাটরানি। তবু…
সেই বৃষ্টি-বোয়া পদ্মের মতো মুখোনা রাধা তুলে ধরেছিল সুধাকরের দিকে।
নিয়ে যাও আমাকে এখান থেকে, নিয়ে যাও। অনেক দূরে কোথাও নিয়ে ছেড়ে দাও। নতুন করে ঘর বাঁধতে না-পারি, ভিক্ষে করে খাব।
শিউরে উঠে পালিয়ে এসেছিল সুধাকর।
সেই শেষ নয়, তারপরে আরও আরও অনেক সন্ধ্যা। অনেক প্যাঁচার ডাক, ঝিমঝিম রাতের অনেক বুক দুড়দুড় প্রহর। সবশেষে রাধা সুধাকরের দু-হাত জড়িয়ে ধরেছিল।
নিয়ে যাও এখান থেকে, নিয়ে যাও আমাকে। অনেক সোনার গয়না আছে আমার, অনেক টাকা আছে। কোনো কষ্ট হবে না।
কিন্তু সেই মুহূর্তে সুধাকর বুঝেছিল, বড়ো বেশি এগিয়ে গেছে সে! পা দিয়েছে সাপের গর্তে।
রাধা বলেছিল, চলো শহরে যাই। তুমি বিড়ির দোকান করবে, আমি পান সেজে দেব। কোনো অভাব আমাদের থাকবে না। না না, এ শহরে নয়, কলকাতায়। আমি দেখেছি কলকাতা। কত বড়ো, কত লোক! সেখানে কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না।
ঠিক সেই সময় হঠাৎ শোনা গিয়েছিল চটির আওয়াজ। ছোটোকর্তা। আজ নেশাটা তাঁর মাঝপথে কেন চটে গিয়েছিল কে জানে!
পাঁচিল টপকে পালিয়েছিল সুধাকর।
সেই থেকে রাধাও মুছে গেল চিরদিনের মতো। আর রাধার কোনো খবর পায়নি সে। ছোটোকর্তার যে-মাঝিটা চুপি চুপি রাধার খবর নিয়ে আসত তার কাছে, সেও কোনো হদিশ। দিতে পারেনি আর।
কী হল রাধার?
কেউ ফিসফিস করে বলেছিল, ছোটোকর্তা তার গলা টিপে মেরেছে। কেউ বলে, কলকাতায় নিয়ে গিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে কোথাও। কেউ-বা আন্দাজ করে—রাধা নিজেই পালিয়ে গেছে ছোটোকর্তার খপ্পর থেকে, কোনো মনের মানুষকে নিয়ে ভেসে পড়েছে যেদিকে চোখ যায়।
মনের মানুষ?
বুকের ভেতরে জ্বালা করে সুধাকরের। আঠারো থেকে চব্বিশ—এই ছ-বছরের পরেও সে-জ্বালা এখনও অনির্বাণ। আজও সে বিশ্বাস করে, রাধা যদি কারও খোঁজে বেরিয়ে পড়ে থাকে, তবে সে সুধাকর ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু এখনও সে তাকে খুঁজে পায়নি। এক একটা বাঁকের মুখে পড়ে যেমন আনাড়ি মাঝির নৌকা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে অথচ বেরিয়ে আসবার পথ পায় না, সে-দশা রাধারও। যদি বেঁচে থাকে, তবে আজও সে সুধাকরের জন্যেই বেঁচে আছে।
কয়েক বারই ভেবেছিল একদিন রাতে ধারালো একটা দা নিয়ে সে ঢেকে রায়কর্তার বাড়ি। নেশায় অচেতন ওই প্রকান্ড লাশটার বুকের ওপর চেপে বসে তারপর প্রশ্ন করে, বলে দাও কোথায় আছে রাধা! নইলে এই দা দিয়ে গলা দুখানা করে ফেলব তোমায়!
কিন্তু সে-আশাও সুধাকরের মেটেনি। আজ প্রায় চার বছর আগে কলকাতায় ছটফটিয়ে মরে গেছে ছোটোকর্তা। যকৃতে জল হয়েছিল তার।
সেজন্যে একবিন্দু দুঃখ নেই। শুধু এই ক্ষোভটাই সে কিছুতে ভুলতে পারছে না যে, মরে গিয়ে ছোটোকর্তা চিরদিনের মতোই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে রাধাকে—আর তাকে ফিরে পাওয়ার পথ নেই কোথাও।
তবু সুধাকর অপেক্ষা করবে।
ছ-বছর কেটে গেছে। আরও কতদিন যাবে জানা নেই। কিন্তু রাধাকে না পাওয়া পর্যন্ত তো সুধাকরের বুকের উপবাসী জন্তুটা তৃপ্তি মানবে না কিছুতেই। আর কাউকে তো সে ঠাঁই দিতে পারবে না মনের মধ্যে। আর কাউকে নিয়ে তো তার ঘর বাঁধবার উপায় নেই। তাতে যদি তার ঘর চিরদিন শূন্য থাকে তবে তাই থাক।
একটা বাঁক ঘুরে সুধাকরের নৌকা এবারে গাঙে এসে পড়ল। লাল আলো পড়েছে জলে, কেমন অদ্ভুত লাগছে দেখতে। জোয়ারের ঘোলাজলে দিনান্তের শেষ রং দেখে মনে হচ্ছে যেন মোষবলি হয়ে গেছে একটা, রক্তে আর কাদায় চারদিক একাকার।
সামনে গঞ্জ। নৌকার সারি এখনও তেমনি করে প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে। দুটি-চারটি সরেছে। বটে, কিন্তু জমেছে আরও বেশি। পুজোর পরে কেরায়া নৌকার মাঝিদের বড়ো দুঃসময় এখন।
তার মধ্যে মকবুলের নৌকা দাঁড়িয়ে আছে ঠিক। ওর ভাড়াটে জোটেনি। জীবনের সব কিছুই ওর ফাঁকা, নৌকাও ফাঁকা পড়বে তাতে আর আশ্চর্য কী।
৩.
এলে? নৌকা লাগাতেই মকবুলের প্রশ্ন।
এলাম। পালটা উত্তর সুধাকরের।
মকবুলের পাশেই খালি জায়গা ছিল একটা। সুধাকর নৌকা ভেড়াল সেখানে।
এবেলাও ফাঁকা গেল তাহলে? প্রশ্নটা করার ইচ্ছে ছিল না, তবু সুধাকর সেটা থামাতে পারল না।
জিজ্ঞাসা করেই সে লজ্জা পেল।
আমার কী? ভাড়াটে জুটল না ইদ্রিশ মিয়ার, আমি কী করব? আমি চিনির বলদ, বোঝ টেনে চলেছি, টেনেই চলব। এক-আধটা দিন ছুটি পাই তো হাত-পা ছড়িয়ে বেঁচে যাই।
কিন্তু মাইনে কেটে নেবে যে!
নিক গে যাক। আমার তো এমনি উপোস অমনিও উপোস। একমুঠো আমানি ভাত না। জোটে মুড়ি চিবিয়েই পড়ে থাকব।
সুধাকর কিছুক্ষণ মকবুলের দিকে তাকিয়ে রইল। মকবুলের মুখ থেকে দুপুরের সেই ছায়াটা এখনও সরে যায়নি। রোকেয়া বিবি। এখনও ঘুণের মতো কুরে কুরে খাচ্ছে বুকের ভেতরে।
সুধাকর ছইয়ে বসল হেলান দিয়ে। একটা পোষা বেড়ালের মতো কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে উদটা। সস্নেহে সুধাকর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বেড়ালের ডাকের মতোই একটা গুরগুরে আওয়াজ বেরুতে লাগল তার গলা দিয়ে।
একটু দূরে দুখানা বড়ো ভাউলি নৌকা তখন এসে লেগেছে। সুধাকরের চোখ সেদিকে পড়তেই মকবুল জবাব জুগিয়ে দিলে।
গানের দল এসেছে আজ। ঢপ-কীর্তনের দল। বারোয়ারিতলায় গান হবে।
আজই? সুধাকর চকিত হয়ে উঠল।
তাই তো শুনেছি।
এক বার গেলে হত শুনতে! কখন লাগবে?
সন্ধের পরেই। তা যেতে চাও যাও-না।
তুমি যাবে?
আমি? মকবুল এক বার উদাস আর উদার দৃষ্টিতে সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকাল, কিন্তু আমি গিয়ে কী করব? আমি মুসলমান, আমাকে তো আর ভেতরে ঢুকতে দেবে না।
আর ভেতরে ঢুকলে আমাকেই বুঝি ফরাশে বসিয়ে তামাক খেতে দেবে? সুধাকর হাসল, সব গরিবেরই এক অবস্থা ভাই, হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো কথা নেই। বেশ তো, দুজনেই নয় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব। গান শোনা নিয়ে কথা!
তবে চলো নিরাসক্ত উত্তরটা প্রায় নদীর বাতাসেই ছেড়ে দিলে মকবুল। রাত্রে আর রান্নার পাট করবার উৎসাহ নেই। সুধাকরের নয়—মকবুলেরও না। তাড়াতাড়ি চারটি চিড়ে চিবিয়ে নিলে দুজনে। সকালের একমুঠো ভাত আছে, আর আছে দুটো কুচো চিংড়ি। ওদের ওতেই কুলিয়ে যাবে।
তারপর রওনা হল গান শুনতে।
বন্দরের অবস্থা জমজমাট ছিল এককালে, এখন ভাঙনদশা। অর্ধেক নদীতে নিয়েছে, সে আমলের বনেদি বাড়িগুলো এখন নিশ্চিহ্ন। তা ছাড়া পাশাপাশি বড়ো হয়ে উঠেছে ঝালকাঠির বন্দর, এখানকার ঐশ্বর্য গিয়ে সংহত হয়েছে সেখানে। এর অর্ধেক এখন শূন্যপুরী। ধান চালের যে-কারবার এখানকার সব জায়গাতেই চলে, তারই কিছু কিছু অবশিষ্ট আছে এখন। আট-দশ ঘর বড়ো বড়ো সাহা আছে আর আছে দুটো ধানের কল। সেগুলো সরে গেলেই সব অন্ধকার।
বারোয়ারিতলা সেই অতীত আমলের। রাধাকৃষ্ণের মস্ত মন্দির আছে, আছে নাটমন্দির। তারাও ভাঙতে শুরু হয়েছে, কেউ বিশেষ হাত লাগায় না আর। যতদিন আছে ততদিনই চলবে, তারপর যেদিন ঝুপঝুপিয়ে ভেঙে পড়বে সেদিন একেবারেই মিটে যাবে সমস্ত।
তবু রামধন সাহার এক-আধটু নজর আছে এদিকে। তারই চেষ্টায় কিছু কিছু জমে আছে বারোয়ারিতলা। এই গানের ব্যবস্থাও তারই উদ্যোগে।
দুজনে যখন পৌঁছাল তখন গান শুরু হবহব করছে। এর মধ্যেই বিস্তর লোক জড়ো হয়ে গেছে। মকবুলের চিন্তার কারণ ছিল না, ভেতরে ঢোকবার পথ এমনিতেই বন্ধ। আরও দশজন মাল্লা-মাঝি-গরিবের সঙ্গে সিংহদরজার বাইরেই দাঁড়াল তারা।
দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল উঁচু নাটমন্দিরের ওপর দুজন বৈরাগী অল্প অল্প খোলে চাঁটি দিচ্ছে, জন দুই ঝম ঝম করছে করতাল নিয়ে। রামধন সাহা গলায় সিল্কের চাদর জড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন, হাতজোড় করে কী যেন বললেনও সবাইকে। কিন্তু চারদিকে প্রচন্ড গোলমালে তার একটি বর্ণও শোনা বা বোঝা গেল না।
কিন্তু তারপরেই যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল সব। জনতার কোলাহলের ওপর দিয়ে তিরের মতো তীক্ষ্ণ সুরেলা গলায় ভেসে এল :
ছোড়ল আভরণ মুরলী-বিলাস,
পদতলে লুটই সো পীতবাস!
সখিরে, যাক দরশ বিনু ঝুরই নয়ান–
অব নাহি হেরসি তাকে বয়ান—
ঢপের প্রধান নায়িকা এসে দাঁড়িয়েছে আসরে। সাদা শাড়ির জরিপাড়টা চকচক করছে, মোটা একছড়া গোড়ের মালা দুলছে তার গলায়। এত দূর থেকে তাকে ভালো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু যতদূর অনুমান করা যাচ্ছে মেয়েটি সুন্দরী—রীতিমতো সুন্দরী।
মকবুল বললে, বেড়ে গাইছে না?
সুধাকর সংক্ষেপে বললে, হুঁ!
সুন্দরী তেজহ দারুণ মান–
পদতলে লুটই রসিক কান—
সভা স্তব্ধ। এতগুলো মানুষ নিঃশব্দ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মাথা দুলছে শুধু, কখনো-বা টান পড়ছে হাতের বিড়ি-সিগারেটে।
গাইতে গাইতে মেয়েটি মুখ ফেরাল। আর সঙ্গে সঙ্গেই যেন সাপের ছোবল খেল সুধাকর।
আর্তনাদের মতো চাপা একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল গলা দিয়ে।
কী হয়েছে? প্রশ্ন করল মকবুল। চারপাশের মানুষগুলো ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ফেলল সুধাকরের ওপর।
কিন্তু ততক্ষণে শরীরের সমস্ত রক্ত এসে জমেছে সুধাকরের মাথায়। বুকের ভেতরে পড়েছে হাতুড়ির ঘা। বিশ্বাস করা যায় না, তবুও মিথ্যে নয়! ওই মেয়েটি…
আর কেউ হতেই পারে না। রাধা!
পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুধাকর। গানের একটি বর্ণও আর কানে আসছে। মাথার মধ্যে একরাশ কুয়াশা পাক খাচ্ছে। বুকের ভেতরে যেন এক্সপ্রেস স্টিমারটা চলছে, আর রক্তের ঢেউ আছড়ে পড়ছে মাথার খুলিতে।
সামনের পাঁচ-সাতশো মানুষরে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আর মাঝির ছেলে সুধাকরের সাধ্য কী এখন হাত বাড়ায় রাধার দিকে! আকাশের চাঁদের চাইতেও অনেক দূরে—ধরাছোঁয়ার সীমার বাইরে সরে গেছে রাধা।
মকবুল আবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। ফিসফিস করে বললে, খাসা চেহারা, খাসা গান!
সুধাকর বললে, হুঁ।
কিন্তু কতক্ষণ এভাবে থাকা যায় আর? একটা বনবেড়াল যেন হৃৎপিন্ডটাকে আঁচড়ে চলেছে সমানে। কপালের ওপরে খরখর বিঁধছে একরাশ তীক্ষ্ণধার কাঁটা। খানিক পরেই সুধাকর বললে, তুমি গান শোনো, আমি নৌকায় ফিরে যাই।
সে কী কথা! এই তো সবে জমে উঠেছে! মকবুলের বিস্ময়ের অন্ত রইল না।
আমার শরীর বড়ো খারাপ লাগছে, আর থাকতে পারছি না।
কিন্তু বড়ো ভালো গান হচ্ছে যে।
তা হোক।
মকবুল আর আপত্তি করল না। তার সারা মন পড়ে রয়েছে গানের দিকে। সমস্ত মানুষ যখন দু-কান ভরে রাধার গান শুনছে, তখন আসর থেকে একা বেরিয়ে এল। সুধাকর। বন্দরের অন্ধকার পথটাকে আরও কালো মনে হচ্ছে এখন। পায়ের নীচে মাটিটা কালাবদরের ঢেউয়ের মতো দুলছে। ছ-বছরের ক্ষুধার্ত জানোয়ারটা এখন আর এক মুহূর্ত প্রতীক্ষা করতেও রাজি নয়!
রাধা! এতদিন পরে যখন পেয়েছে, তখন আর ছাড়বে না। সেদিন আঠারো বছরের মন নিঃসংশয় হতে পারেনি, ছোটোবাবুর প্রেতমূর্তিটা সবসময় চোখের সামনে যেন ভেসে বেড়াত। কিন্তু এই ছ-বছরে অনেক গাং পাড়ি দিয়েছে সুধাকর, অনেক কালবৈশাখীর মুখে পাল তুলেছে মাতাল নদীতে। গত শীতকালে বল্লম দিয়ে চিতাবাঘও মেরেছে একটা। চব্বিশ বছরের সুধাকর এত সহজেই হাল ছাড়বে না।
মকবুল ঘাটে ফিরল রাত এগারোটার পরে। মুখে গুনগুন গান। অদ্ভুত পরিতৃপ্ত সমস্ত মন। এমনকী রোকেয়াবিবির ক্ষোভটাও ভুলে গেছে আপাতত।
কী দোস্ত, ঘুমিয়েছ?
ঘুমোবার সাধ্য কী সুধাকরের। অসহ্য যন্ত্রণা চমকে বেড়াচ্ছে সর্বশরীরে। ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে বেরিয়ে ডাকাতি-খুনোখুনি যাহোক একটা কিছু করে আসে!
কী মাঝির পো, ঘুমে বেঘোর নাকি?
আবার জিজ্ঞাসা এল মকবুলের। কিন্তু সুধাকর জবাব দিলে না, পড়ে রইল মুখ গুঁজে। কথা বলবার মতো কোনো উদ্যম তার অবশিষ্ট নেই। আর কীই-বা বলবার আছে? হয়তো মকবুলকে ব্যথার ব্যথী করা চলে, একটা উপদেশ চাওয়াও যাবে তার কাছে। কিন্তু সব কথা খুলে বলার মতো মানসিক প্রশান্তি এখন নেই সুধাকরের। তার চেয়ে চুপ করে থাকাই ভালো।
মকবুল আর ডাকল না। সুধাকর কান পেতে শুনতে লাগল তার সুরের গুঞ্জন। রাধার গানই নিশ্চয়! তারপরে লণ্ঠন জ্বালল, তামাক সাজল, অনেকক্ষণ ধরে তামাক খেল। কলকেটা নদীর জলে উবুড় করে ফেলার ছ্যাঁক ছ্যাঁক আওয়াজ পর্যন্ত কানে এল সুধাকরের।
মকবুল এবার গলা ছাড়ল :
মুখ তুলে চাও সজনি–
তোমারি নাম বাঁশিতে মোর
বাজে লো দিন-রজনি।
রাধার গান! একটা অদ্ভুত হিংস্রতায় সুধাকরের চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করল। থামো থামো। ও আমার রাধার গান, ওর ওপরে তোমাদের কারও কোনো দাবি নেই। কিন্তু সেকথা কিছুতেই বলা গেল না, দাঁতে দাঁত চেপে সুধাকর পড়ে রইল।
রাত বাড়তে লাগল, কৃষ্ণপক্ষের রাত। বন্দর নিঝুম হয়ে গেল। স্টিমারঘাটের কাছে যে কেরোসিনের আলোটা জ্বলে সেটা নিবুনিবু হয়ে এল। পন্টুন থেকে কখন একটা লণ্ঠন হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল ঘাটবাবু, কাল সকালের আগে আর সে আসবে না। নদীর অনেকটা দূর দিয়ে আবার একটা ডেসপ্যাঁচ চলে গেল। ঢেউ এসে নৌকাগুলোকে দোলাতে লাগল দোলনার মতো, পাড়ের ওপর উঠল আছড়ে-পড়া জলের ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ।
আবার সব নিথর। স্টিমারঘাটের আলোটা নিভে গেছে এখন। শুধু জলের কলশব্দ। থমথমে রাত নেমে এসেছে চারদিকে। নদীটাকে কেমন আদি-অন্তহীন মনে হচ্ছে এখন। কেমন অদ্ভুত গুমোট রাত, কেমন ছাইরঙের অন্ধকার। হঠাৎ মনে হয় এরপরেই উঠবে একটা প্রচন্ড কাইতান-কার্তিকের ঝড়।
এইরকম এক-একটা রাত মাঝিদের বুকে ভয় ধরায়। এমনি এক-একটা থমথমে অন্ধকারে নদীর চাপা শব্দটা যেন একটা গোপন অর্থে ভরে ওঠে। হঠাৎ সন্দেহ হয় জলের মধ্যে কারা যেন ফিসফিস করে কথা কইছে। একটু কান পেতে শুনলেই সে-কথাগুলো স্পষ্ট বুঝতে পারা যাবে।
কারা কথা কইছে? কারা তারা? সুধাকর জানে, মকবুল জানে, এ অঞ্চলের সমস্ত মাঝিরাই জানে। নদী মা! জল দেয়, অন্ন দেয়। জ্যোৎস্নার রঙে, ভোরের আলোয় রূপসি হয়ে মন ভোলায়। কিন্তু… কিন্তু এইসব রাত্রে? তার অতল তলায় যারা আছে তাদের ঘুম ভাঙে। কত মানুষ ডুবে মরেছে এই নদীর জলে, দা-এর আর বল্লমের ঘায়ে কত লোককে খুন করে ডাকাতেরা এই সর্বনাশা জলেই ভাসিয়ে দিয়েছে, গলায় কলসি বেঁধে আত্মহত্যা করেছে কতজন, কতজনকে কুমিরে টেনে নিয়ে গেছে! এমনই এক-একটা নিশি-পাওয়া রাত্রেই তাদের ঘুম ভাঙে। তখন কুমিরের ভয়ে ডাঙার দিকে পালিয়ে আসে কামট, পাঙাশ আর ইলিশ মাছের দল আতঙ্কে নদীর তলায় কাদা কামড়ে পড়ে থাকে, একটা শুশুক পর্যন্ত ডিগবাজি খায় না। আর তখন…
তাদের যারা দেখে তারা শিবনেত্র হয়ে যায়। টকটকে লাল চোখে কোনো দৃষ্টি থাকে না, মুখ দিয়ে শুধু বেরিয়ে আসে বোবা গোঙানি। তারপর তিন দিনের দিন জ্বরবিকারে মরে যায়, নয়তো দু-ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় ওলাওঠায়। মরা মাঝির নৌকা স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে চলে যায় যেদিকে খুশি।
সুধাকরের বুকটা গুরগুর করে উঠল।
ভয় নয়, তার রক্তের তলা থেকেও অমনি একটা প্রেত উঠে আসতে চাইছে। কী অন্ধকার! কী বীভৎস অন্ধকার! পাতলা একটা মেঘের আস্তর ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে, যেন চিতার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে রাতটা।
এই রাত! এই রাত সবসময়ে আসে না। কিন্তু যেদিন আসে…
সুধাকর চোরের মতো উঠে পড়ল। জলের শব্দ, দূরে ব্যাঙের ডাক। দু-একটা বোয়াল মাছ ছলাৎ ছলাৎ করছে ইতস্তত। সুধাকর নৌকা থেকে নেমে গেল নিঃশব্দে।
বন্দরের অন্ধকার পথ দিয়ে নিঃসাড়ে চলল সুধাকর। একটা গোসাপ পালিয়ে গেল সামনে দিয়ে। দু-তিনটে শেয়াল জ্বলজ্বলে সবুজ চোখে তার দিকে তাকিয়ে পাশের ঝোপগুলোতে গা-ঢাকা দিলে। আচমকা হাওয়া দিল একটা, এদিক-ওদিকের সুপুরিবন থেকে দুটো-চারটে পাকা সুপুরি টুপ টুপ করে ঝরে পড়ল।
হঠাৎ নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সুধাকর। একটু দূরেই একটা লণ্ঠন আসছে।
ঘুমের মানুষ, জাগো হ…
চৌকিদার। দেখতে পেলে এমনি ছাড়বে না, আধঘণ্টা ধরে কৈফিয়ত দিতে হবে, নইলে হয়তো টেনেই নিয়ে যাবে থানায়। কয়েকটা বন্য গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেল সুধাকর।
ঘুমের মানুষ, জাগো হো…
ডাকতে ডাকতে সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল চৌকিদার। হাতের লাঠিটা ঠুকতে ঠুকতে অদৃশ্য হয়ে গেল বাঁক ঘুরে।
আরও খানিক নিঃসাড় হয়ে রইল সুধাকর। তারপরে আবার চোরের মতো এগোতে লাগল বন্দরের পথ ধরে। পায়ের কাছে ঝপাৎ করে কী পড়ল, দুরদুর করে উঠল বুক। নাঃ, ভয়ের কিছু নেই। কটায়-খাওয়া একটা শুকনো নারকেল খসে পড়েছে গাছ থেকে।
কিন্তু এইতো বারোয়ারিতলা। এখানেই আস্তানা নিয়েছে ঢপের দল।
সদরের বড়ো দরজাটা বন্ধ। ভেতরেও কোনো সাড়াশব্দ নেই। উঁচু উঁচু দেয়ালগুলো যেন ভূতুড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এক বারের জন্যে অনিশ্চিত হয়ে রইল সুধাকর। কিন্তু আর উপায় নেই। এত দূর যখন এসেছে, কোনো মতেই ফিরে যাওয়া চলে না। এই ভূতে-পাওয়া সর্বনেশে রাত্রে তাকেও যেন ভূতে পেয়েছে। যা হওয়ার হোক, একটা-কিছু সে করে যাবেই। যেমন করে তোক রাধার কাছে তাকে পৌঁছাতেই হবে।
কিন্তু! এই ছ-বছর পরে রাধা যদি তাকে চিনতে না পারে? যদি ছ-টা বছর নদীর জলের মতোই একেবারে মুছে গিয়ে থাকে তার মন থেকে? রাধার জীবনে হয়তো সুধাকরের মতো কত মানুষ এসেছে, আরও কত আদরে-সোহাগে ভরে দিয়েছে তাকে। সেখানে জেলের ছেলে সুধাকরকে সে মনে রাখতে পারে না। রাখবেই-বা কোন দুঃখে?
তা ছাড়া ওই মেয়েটিই যে রাধা তাই-বা কে বলতে পারে জোর করে? দূর থেকে যতটুকু দেখেছে তাতে তো ভুলও হতে পারে তার। একরকম চেহারার মানুষ কি দুজন থাকতে নেই সংসারে?
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের বুকের স্পন্দন শুনতে লাগল। কিন্তু আর অপেক্ষা করা যায় না। সন্দেহের শেষ কোথাও নেই। তাকে যতই বাড়িয়ে চলো, ততই সে ফেঁপে উঠতে থাকবে, থামতে সে জানে না।
তার চেয়ে যা হওয়ার তাই হোক। রাধাই হোক আর যেই হোক, এসেছে যখন আর ফেরা চলে না।
উঁচু পাঁচিলের চুন-সুরকি ঝরে গেছে, ইট বেরিয়ে পড়েছে এখানে-ওখানে। তাদের ওপর পা দিয়ে সতর্ক একটা জন্তুর মতো উঠতে লাগল সুধাকর। তারপর তিন মিনিটের মধ্যেই একেবারে প্রাচীরের মাথায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বড়ো বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল সে, রাত্রির প্রেতের মতো চোখটা তীক্ষ্ণ করে দেখতে চাইল সবটা।
নাটমন্দিরেই পড়ে আছে সব। একরাশ মড়ার মতো নিস্তব্ধ। সারাদিনের ক্লান্তির পরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
দেয়ালের মাথাটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরে যথাসম্ভব নিজের শরীরটাকে নীচে ঝুলিয়ে দিলে সে। তবু আরও দু-হাত তলায় মাটিটা। হাতটা ছেড়ে দিতেই সে নীচে পড়ল, ধুপ করে আওয়াজ উঠল একটা।
কয়েক মুহূর্ত নিথর হয়ে রইল সুধাকর, দাঁড়িয়ে রইল দেয়ালে পিঠ দিয়ে। কারোর কি ঘুম ভেঙে গেছে, টের পেয়ে গেছে কেউ? অসহ্য উৎকণ্ঠায় হাতুড়ি পড়তে লাগল বুকের মধ্যে। কান পেতে সে নিজের হৃৎস্পন্দন শুনতে লাগল।
না, কেউ নড়ে উঠল না। তেমনি নিঃসাড় নিস্পন্দ সব। একদল মড়ামানুষের মতো কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে। প্রাচীর ঘেঁষে ঘেঁষে ছায়ামূর্তির মতো সরতে লাগল সুধাকর। এর মধ্যে কোথায় সে খুঁজে পাবে রাধাকে?
সতর্ক পায়ে ঘুমন্ত মানুষগুলোর চতুর্দিক প্রদক্ষিণ করল সুধাকর। নানা অঙ্গভঙ্গিতে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে সব। মাথার কাছে ছোটো-বড়ো পুটলি, হারমোনিয়াম, খোল, অন্ধকারে চকচকিয়ে ওঠা পেতলের করতাল। কিন্তু মেয়েরা কোথাও নেই।
আরে তাই তো, মেয়েরা কী করেই-বা থাকবে খোলা নাটমন্দিরে? নিশ্চয় আর কোথাও আছে তারা। কিন্তু কোথায় তা হতে পারে?
ভয়ের আড়াল ভেঙে সুধাকর ক্রমে দুঃসাহসী হয়ে উঠছিল। অন্ধকারে একটা রাত্রির প্রাণীর মতো সে নাটমন্দিরের চারদিক প্রদক্ষিণ করতে লাগল। তারপর ভোগের ঘরের কাছে আসতেই উৎকর্ণ হয়ে উঠল সে।
এককালে বারোয়ারিতলা যখন জমজমাট ছিল, তখন এই ঘরে বড়ো বড়ো হাঁড়ায় ভোগ রান্না হত। সে দশ বছর আগের কথা। এখন আর ও-ঘর কোনো কাজেই লাগে না। কবাটহীন দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকাতেই সুধাকরের নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল।
প্রায় দরজার পাশেই শুয়ে আছে রাধানিঃসন্দেহেই রাধা। ওদিকের জানালা দিয়ে হেলে-পড়া চাঁদের আলো তার মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। ছ-বছর আগেকার সেই মুখ, কপালে সেই উলকির চিহ্ন। আরও ভারী হয়েছে, আরও ফর্সা হয়েছে যেন। কয়েক মুহূর্ত নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের রক্তে করতাল শুনতে লাগল সুধাকর। তারপর লঘুভাবে স্পর্শ করে ডাকল, রাধা!
সঙ্গে সঙ্গে কান্ড হল একটা।
বিদ্যুদ্বেগে রাধা উঠে বসল। ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলে সুধাকরের গালে। চোখে যেন সর্ষের একরাশ ফুল দেখতে পেল সুধাকর।
তুমি আবার এসেছ বাবাজি? তোমার লজ্জা করে না? তোমাকে আমি হাজার বার বলিনি যে তেমন মেয়ে আমাকে তুমি পাওনি? সাপের গর্জনের মতো চাপা তীক্ষ্ণআওয়াজ উঠল রাধার গলায়।
বিহ্বলতা মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যেই। তারপরেই সুধাকর বললে, বাবাজি নয় রাধা, আমি!
কে? কে তুমি? তারস্বরে রাধা চিৎকার করে উঠতে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সুধাকরের হাত পড়ল তার মুখে। আত্মরক্ষার জৈবিক তাগিদে নিষ্ঠুরভাবে রাধার মুখ চেপে ধরে ফিসফিসে গলায় সুধাকর বললে, রাধা আমি—আমি! আমাকে চিনতে পারছ না? আমি জেলের ছেলে সুধাকর।
এতক্ষণ দু-হাতে রাধা সুধাকরের হাত সরাতে চাইছিল, গোঁ-গোঁ করে একটা চাপা আওয়াজ উঠছিল তার গলা থেকে, ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল তার চোখ। কিন্তু সুধাকরের নামটা কানে আসতেই তার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল থরথরিয়ে। ঝুলে পড়ল হাত দুটো–উদ্ভান্ত চঞ্চল চোখের তারা দুটো এক জায়গায় এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
সুধাকর মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলে।
আমাকে এর মধ্যেই কি ভুলে গেলে তুমি?
রাধা আরও কিছুক্ষণ কথা কইতে পারল না। অদ্ভুত বিহ্বলচোখে সমানে তাকিয়ে রইল।
এই ছ-বছর ধরে আমি দিন গুনেছি শুধু তোমারই জন্যে। তুমি কি আমায় চিনতে পারছ না?
রাধা হঠাৎ যেন আত্মস্থ হয়ে উঠল। জড়িয়ে ধরল সুধাকরের দু-হাত।
কী করে এলে তুমি এখানে?
যেমন করে আসতে হয় প্রাচীর টপকে।
এখনি পালাও, পালিয়ে যাও এখান থেকে।
তোমাকে না-নিয়ে আমি আর যাব না।
সর্বনাশ, কী করে নেবে আমাকে?
যেমন করে নিজে এসেছি— প্রাচীর টপকে।
মাঝি, তুমি কি পাগল? এখনও ধরা পড়নি সে তোমার বিস্তর পুণ্যের ফল। কিন্তু বেশি দেরি করলে কী-যে হবে কিছুই বলা যায় না। এরা টের পেলে সঙ্গে সঙ্গেই তোমাকে পৌঁছে দেবে থানায়, দারোগা হাজতে ভরে দেবে চোর বলে। তুমি পালাও।
রাধা!
আমাকে তুমি পাবে না মাঝি। আমি ছাড়লে দল ভেঙে যাবে। সর্দার বৈরাগী বাঘের বাচ্চার মতো পাহারা দেয় আমাকে। আমি ইচ্ছেয় চলে যেতে চাইলেও ছাড়ান নেই তার হাত থেকে। আগে ডাকাতি করত, এখন বুড়ো হয়ে গেছে, খুঁতো হয়ে গেছে ডান হাত, তাই বৈরাগী সেজে ঢপের দল খুলে বসেছে। কিন্তু ইচ্ছে হলেই খুন করতে পারে এখনও।
আমিও খুন করতে পারি! সুধাকরের চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগল।
তোমার হাত ধরছি মাঝি, আমার কথা রাখো। আজ তুমি পালাও। কাল সন্ধ্যায় যখন গান শেষ হয়ে যাবে, তখন মন্দিরের পেছনে বড়ো গাব গাছটার তলায় এসে দাঁড়িয়ে। আমার যা বলবার আছে সেই তখন বলব।
বেশ, তাই হবে। সুধাকর উঠে দাঁড়াল। দু-চোখে ক্ষুধার্ত আগুন ছড়িয়ে বললে, সেই কথাই রইল। কিন্তু ছ-বছর তোমার জন্যে দিন গুনেছি আমি, আর আমার সইবে না। কাল যদি একটা হেস্তনেস্ত না হয়—তাহলে দুজনের একজন খুন হয়ে যাবে।
সুধাকর নাটমন্দিরের অধকারের মধ্যে সরে গেল। যেন মিলিয়ে গেল চোখের পলক পড়তে-না-পড়তে। রাধা বিস্ফারিত চোখ মেলে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ।
একটু পরেই বাইরে শব্দ উঠল–ধুপ ঝপাস!
এতক্ষণে ঘুম ভেঙে জড়ানো গলায় চেঁচিয়ে উঠল সর্দার বৈরাগী, কে? কে ওখানে? রাধার বুকের ভেতরটা যেন আতঙ্কে পাথর হয়ে গেল।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আর একজন কেউ জবাব দিলে, কী আর হবে! একটা খটাস কিংবা একটা ভাম হয়তো?
৪.
সকালে যখন সুধাকরের ঘুম ভাঙল, সূর্য তখন অনেকখানি উঠে বসেছে আকাশে। রোদে ধার লেগেছে, একটু পরেই এসে পড়বে এক্সপ্রেস স্টিমার। চকিতভাবে উঠে পড়ল সুধাকর। নৌকার খোলের ভেতর থেকে উদবেড়ালের ডাক আর মৃদু মৃদু আঁচড়ানোর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। খিদে পেয়েছে ওর।
সুধাকর উদকে টেনে তুলল নৌকার ওপর। তারপর জল দেখিয়ে বললে, যা। সঙ্গে সঙ্গেই ছপাৎ করে শব্দ। উদ জলে পড়ল।
সুধাকর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল জলের ভেতর কীভাবে ওর ধূসর শরীরটা খেলে বেড়াচ্ছে।
এক মিনিট, দু-মিনিট, তিন মিনিট। তারপরেই উদ সাঁতরে এল নৌকার দিকে। বেশ বড়ো চেহারার একটা সরপুঁটি মাছ তার মুখে।
সুধাকরের পায়ের কাছে মাছটা এনে সে রাখল।
সদয় হাসিতে সুধাকর ইঙ্গিত করলে, খা।
বেশি বলবার দরকার ছিল না। সঙ্গে সঙ্গেই উদ তার সদব্যবহারে লেগে গেল। সু
ধাকর তাকিয়ে দেখল চারপাশে। অনেক নতুন নৌকার আমদানি হয়েছে—চেনা, অচেনা। অনেক নৌকা সওয়ারি নিয়ে চলে গেছে। মকবুলও।
কখন গেল কী জানি! যাওয়ার আগে হয়তো দু-চার বার ডেকেও ছিল তাকে। কিন্তু সুধাকর একেবারে জগদ্দল পাথরের মতো পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে, একটা শব্দও তার কানে যায়নি।
নিজের মাথাটায় একটা ঝাঁকুনি দিলে সুধাকর। কালকের রাতটা কীভাবে কেটেছে তার? যা-কিছু হয়েছে সে কি স্বপ্ন? সব কি ঘটে গেছে ঘুমের ঘোরে? সেই ছ-বছর পরে দেখা রাধাকে, অসহ্য উত্তেজনায় মাঝরাতে সেই নাটমন্দিরে গিয়ে হাজির হওয়া, সেই আশ্চর্য আবিষ্কার, সর্দার বৈরাগীর কথা, রাধা—আরও সুন্দর হয়েছে, ফর্সা হয়েছে আরও…
কিন্তু কী করেই-বা বলা যাবে স্বপ্ন? ওই তো পর পর দুখানা ভাউলি নৌকা দাঁড়িয়ে। ঢপের নৌকা! ওই তো কে যেন একটা স্টিমারঘাটের কাঠের রেলিঙে বসে চড়াসুরে গান ধরেছে :
ওলো, মন-মজানো বিনোদিনী রাই লো,–
তোমার প্রেম-সায়রে ডুব দিয়েছি
তল তবু না পাই লো!
সুধাকরের মাথার ভেতরে চড়াৎ করে উঠল। আজ সন্ধ্যার পরে গান শেষ হলে মন্দিরের পেছনে নিথর কালো গাব গাছটার ছায়ায়। তারপর তারপর একটা খুন হয়ে যাবে, হয় সর্দার বৈরাগী, নইলে সে নিজেই। দুজনে একসঙ্গে পেতে পারে না রাধাকে।
মাঝি, কেরায়া যাবে?
দুজন ভদ্রলোক যাত্রী। বগলে সতরঞ্চি-জড়ানো বিছানা, হাতে চামড়ার সুটকেস।
কোথায় যাবেন? কত দূরে?
গৈলা।
গৈলা! সে তো অনেক দূর!
অনেক দূর বই কী! ভদ্রলোক যাত্রীরা প্রাকুটি করলেন, হেঁটে যেতে পারলে আর তোমার নৌকা ভাড়া করতে আসব কেন? যাবে কি না বল?
না, অত দূর যেতে পারব না।
ওরে বাপ রে, তোমরা দেখছি দস্তুরমতো বাবু হয়ে গেছ আজকাল। ঘাট হয়েছে বাপু, তোমাকে বিরক্ত করেছি। বসে বসে ঝিমুচ্ছিলে-ঝিমোও।
ঠাট্টা করে গেল বাবুরা! তা যাক। আজ কিছুতেই ঘাট ছেড়ে নড়বে না সুধাকর, কুড়ি টাকার কেরায়া পেলেও না। কাছাকাছির যাত্রী হলে তবু ভেবে দেখা যেত, সন্ধের আগেই যাতে সে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু আজ উৎসাহ নেই। আজ সারাদিন সে অপেক্ষা করবে, অপেক্ষা করবে দাঁতে দাঁত চেপে। অসহ্য প্রতীক্ষাটাকে মন্থন করবে নিজের রক্তের ভেতরে।
দূরে গম্ভীর বাঁশির আওয়াজ। স্টিমারঘাটে চাঞ্চল্যের স্পন্দন। এক্সপ্রেস স্টিমার আসছে। পুরো একটা দিন—চব্বিশ ঘণ্টা। কিন্তু এই একটা দিনের মধ্যেই যেন যুগযুগান্ত কাল-কালান্ত পার হয়ে গেছে সুধাকর। ছ-বছর ধরে বুকের মধ্যে সব ঝিমিয়ে এসেছিল, এখন খড়ের আগুনের মতো দপ দপ করে জ্বলছে।
স্টিমার এগিয়ে এল ঘাটের দিকে। সাড়া পড়েছে নৌকার মাঝিদের মধ্যে, ঘাটের কুলিদের ভেতরে। মাঝনদী থেকে বড়ো বড়ো ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে নৌকার গায়ে, কাদাভরা তীরের ওপর। ইটের পাঁজাটার ওপরে গোটা দুই মাছরাঙা বসেছিল, কর্কশ আওয়াজ করে আকাশে ডানা মেলল তারা।
স্টিমার ঘাটে এসে লাগল। আজকে লোক নামল আরও কম, মাত্র দু-চারটি যাত্রী। ঘাটের কাছাকাছি যে দু-চারটে নৌকা ছিল, যা হয় তারাই ভাড়া পেল।
যাক, নিশ্চিন্ত। সন্ধ্যা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত প্রতীক্ষা।
কিন্তু ও কে! হঠাৎ খরশান হয়ে উঠল সুধাকরের দৃষ্টি।
দু-তিন জন বৈরাগী এসে ঘাটের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছে—স্টিমার দেখতে এসেছে। তাদের মাঝের লোকটাকে দেখবামাত্র একটা অশুভ অনুমান বিদ্যুতের মতো চমকে গেল পা থেকে মাথা পর্যন্ত।
সর্দার বৈরাগী। নিঃসন্দেহ।
এতদূর থেকেও দেখা যাচ্ছে কালো কদাকার লোকটাকে। মাথার চুল ধূসর, মুখে বসন্তের গোটা কয়েক চিহ্নও আঁকা আছে বলে বোধ হল। বয়েস হয়েছে, একটু কুঁজোও হয়েছে। পিঠটা, তবু শরীরটা এখনও অসামান্য শক্তিমান। মুখে একরাশ বিশৃঙ্খল সাদা দাড়ি— হাওয়ায় উড়ছে সেগুলো। চেহারা দেখলেই মনে হয় রাধার কথা মিথ্যে নয়, লোকটা এককালে ডাকাতি করত।
তার প্রতিদ্বন্দ্বী–বাঘ। শিকারের মতো আগলে বসে আছে। সহজে কেড়ে নেওয়া যাবে। এ ছোটো রায়কর্তা নয়, এর চোখ নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে না। অনেকখানি শক্তির পরীক্ষা দিয়েই এর কাছ থেকে কেড়ে নিতে হবে রাধাকে।
সুধাকর জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।
ভুল হয়ে গেছে, মস্তবড়ো ভুল। সেদিন সে হাত বাড়িয়ে দিলেই রাধাকে কেড়ে নিতে পারত, ছিনিয়ে নিয়ে চলে যেতে পারত যেদিকে যতদূরে খুশি। সেদিনকার সেই সুযোগ সে হেলায় হারিয়েছে। আঠারো বছরের শরীরে উন্মাদনা ছিল, কিন্তু মনে সাহস ছিল না। তখনও অনেক ঝোড়ো নদী তার পাড়ি দেওয়া হয়নি, তখনও বল্লমে ফুড়ে চিতাবাঘ মারবার সাহস ছিল না তার। সেদিন সুযোগ হারিয়েছে, তাই আজ তারজন্যে ঢের বেশি দাম দিতে হবে।
চিতাবাঘ নয়, লড়তে হবে জাতবাঘের সঙ্গে।
তা হোক।
লোকগুলো বন্দরের দিকে ফিরে চলেছে। সুধাকরের ইচ্ছে হল এখনই গিয়ে দাঁড়ায় লোকটার সামনে, এই মুহূর্তেই যাহোক একটা-কিছুর চরম নিষ্পত্তি করে ফেলে।
কিন্তু কিন্তু এখনও সময় হয়নি। আজ রাত পর্যন্ত অপেক্ষাই করতে হবে তাকে।
দিন এগিয়ে চলল, বেড়ে চলল বেলা। আবার নদী উজ্জ্বল হয়ে উঠল রোদের খরধারে, খরশুলা মাছের ঝাঁক নৌকার আশেপাশে খেলে বেড়াতে লাগল। সুধাকরের মনে পড়ল রান্না চাপানো দরকার। কাল রাতে সে কিছুই খায়নি।
চাল আছে, আলু আছে, পেঁয়াজ আছে দু-চারটে। উদ নামালে এক-আধটা মাছও মিলতে পারে হয়তো। কিন্তু খাওয়ার জন্যে বিশেষ উৎসাহ হচ্ছে না। যা আছে চলে যাবে ওতেই।
ক্লান্তভাবে ভোলা উনুনটায় আগুন দিতে বসল সুধাকর।
আচ্ছা, ধরো যদি রাধাকে পাওয়া যায়–
বুকের নাড়িগুলো তারের বাজনার মতো ঝনঝন করে উঠল। যদি রাধাকে পাওয়া যায় কোথায় নিয়ে যাবে তাকে? ওই ঘরে—ওই গ্রামে? যেখানে পিসির কাছে তাকে জিম্ম করে রেখে আবার পরের সওয়ারি-বওয়া? নিজের ঘর ছেড়ে রাতের পর রাত এই খাল-বিল-নদী নালায় ভূতের মতো ঘুরে-বেড়ানো? তার নৌকায় উঠবে অল্পবয়সি স্বামী-স্ত্রী, সারারাত তারা
গুঞ্জন করবে জলের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে সুর মিলিয়ে, আর তখন…
তখন দাঁতে দাঁত চেপে হয়তো-বা নৌকার লগি ঠেলে চলবে সুধাকর। ওরা যখন দুজনে ঘন হয়ে জড়িয়ে থাকবে, তখন তার মাথার ওপরে ঝরঝরিয়ে ঝরবে বৃষ্টির জল।
তা হয় না, কিছুতেই না।
আজ যদি কয়েক কাঠা ধানিজমি থাকত, থাকত একটুখানি খেতখামার, রাধাকে নিয়ে কী নিশ্চিন্ত আনন্দে তাহলে সংসার বাঁধত সে। সামনে ধানের খেত, ঘরে রাধার সোনামুখ, জানলা দিয়ে সোনার মতো চাঁদের আলো…
ধান! খেত! মাটি!
নদীর মতো দুলে ওঠে না, রাক্ষসী ক্ষুধায় থাকে না মুখ বাড়িয়ে। একটু অসতর্ক হও— সঙ্গে সঙ্গে আর কথা নেই! অমনি ডাইনির মতো হাজারটা হাত বাড়িয়ে একেবারে টেনে নেবে পেটের মধ্যে। মেঘের লক্ষণ দেখে যদি বুঝতে না পার, তাহলে অথৈ গাঙের ক্রোধ থেকে আর তোমার আত্মরক্ষা করবার কোনো আশাই নেই। আর তা ছাড়া…
তা ছাড়া যদি সেইরকম একটা রাত আসে? যে-রাতে জলের অতল থেকে উঠে আসে সেইসব অপঘাতের দল? যারা ডাকাতের হাতে প্রাণ দিয়েছে, যাদের নীচে টেনে নিয়েছে মানুষখেকো কুমির, গলায় কলশি বেঁধে আত্মহত্যা করেছে যারা, যদি কখনো তাদের হাতে তোমাকে পড়তে হয়? তারপরে কী হবে সেকথা ভেবে লাভ নেই।
তার চেয়ে ভালো মাটি। ঢের ভালো। সে স্থির, সে ভর সয়। জীবনকে আঁকড়ে রাখে দু হাতে। তার উপরে ফুল ফোটে, পাখি গান গায়, ফসল ফলে। তার উপরেই মানুষ ঘর বাঁধে। মাটি—একটুখানিও সে যদি পেত, তাহলে রাধাকে নিয়ে সোনার সংসার গড়ে তুলত সেখানে।
সুধাকর চমকে উঠল। ধক করে জ্বলে উঠেছে উনুনটা। একটু হলেই তার হাতে লাগত আগুনের ঝলক।
দিনটা কী অদ্ভুত বিলম্বিত! যেন নদীর স্রোতটা হঠাৎ থমকে গেছে, যেন সূর্যটা আর চলতে পারছে না। কোনোমতে একমুঠো ভাত গিলে, উদকে খাইয়ে, সুধাকর লম্বা হয়ে পড়ে রইল।
মাটি। ধানের খেত। নদীর স্রোতের মতো অস্থির অনিশ্চিত জীবন নয়।
যদি একটুখানি জমি থাকত তার, তবে কি এইভাবে ঘুরে বেড়াত সে? সুধাকর জানে— চব্বিশ বছর চিরদিন থাকবে না। তারপরে আসবে চল্লিশ, পঞ্চাশ। সেদিন আর এমন শক্তি থাকবে না শরীরে, সেদিন মাতলা নদী পার হওয়ার কল্পনাও করতে পারবে না সে। রাত্রির পাথুরে অন্ধকারে সে পথ দেখতে পাবে না। সেদিন?
এই মাটি নেই বলেই তো এমন করে নতুন বউকে ফেলে গাঙে গাঙে ঘুরে বেড়ায় মাঝিরা। মাটি নেই বলেই তো জীবনের মূল নেই কোথাও—স্রোতের কচুরিপানার মতো তাদের ভেসে বেড়াতে হয়। তাই মকবুল রাতদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর অভিশাপ দেয় ইদ্রিশ মিয়াকে, তাই রোকেয়া তার কাছে আশমানের চাঁদের চাইতেও সুদুর।
রাধা! রাধাকে নিয়ে থাকবার মতো একটু মাটি যদি সে পেত! পেত এক ফালি নিশ্চল মাটি!
ঘটাং ঘট—
একটা নৌকা এসে ধাক্কা দিলে সুধাকরের নৌকার গায়ে। ভয়ংকরভাবে দুলে উঠল সবটা।
বিরক্ত হয়ে উঠে বসল সুধাকর, গায়ের ওপর এমন করে এসে নাও ভিড়োয় কে? একটুও আক্কেল-পছন্দ নেই নাকি?
যার নৌকা, সে তখন হিংস্রভাবে লগি পুঁতছে নৌকার। বললে, মকবুল!
সওয়ারি নামিয়ে ফিরলে?
না। তিক্ত জ্বালাভরা গলায় মকবুল বললে, নিজের কবর দেখে এলাম।
কবর? কী বকছ দোস্ত? পাগল হলে নাকি?
হিংস্রভাবেই নৌকার লগিটা মকবুল ছইয়ের ওপরে ছুড়ে দিলে।
কী হয়েছে খুলে বলো দেখি।
বলছি। মকবুল ঝুপ করে প্রায় একহাঁটু জলের মধ্যে নেমে পড়ল, অনেকখানি ভিজে গেল লুঙ্গিটা। তারপর ক্ষিপ্ত স্বরে বললে, শালার নৌকার তলা ফুটো করে ডুবিয়ে দেব মাঝগাঙে।
উঠে এসো, উঠে এসো এখানে। নিজের কথা ভুলে গিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠল সুধাকর, সব খুলে বলো। নতুন কিছু করেছে নাকি ইদ্রিশ মিয়া?
মকবুল উঠে এল সুধাকরের নৌকায়। কান থেকে একটা বিড়ি নামাল ধরাবার জন্যে, তারপরেই সেটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে নদীর জলে ছড়িয়ে দিতে লাগল। দুটো লাল টকটকে চোখ সুধাকরের মুখে ফেলে দিয়ে বললে, শালা গোলাম সর্দার এতদিন তামাশা করছিল আমাকে নিয়ে!
সে কী! মকবুল পৈশাচিক মুখে বলে যেতে লাগল, তলায় তলায় ঠিক ছিল সবই। হয়তো বান্দার খরচায় একটু মজা দেখবার জন্যেই ওকে লেলিয়ে দিয়েছিল শয়তান ইদ্রিশ মিয়া!
কী হয়েছে? অমন রেখে রেখে বলছ কেন? সুধাকর অধৈর্য হয়ে উঠল, খোলসা করো সব।
খোলসা কী করব আর? খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম ইদ্রিশ মিয়ার সঙ্গে রোকেয়ার বিয়ে হয়ে গেছে।
সুধাকর অস্ফুট আর্তনাদ করল একটা।
বিশ্বাস হচ্ছে না, না? মকবুল অদ্ভুত ধরনের হাসতে চেষ্টা করল, এই-ই দুনিয়া। তিনটে বিবি আছে ইদ্রিশ মিয়ার—চারটে বাঁদি। কিন্তু তবু আর একটা বিবি না-হলে শরিয়তি কানুনটা পাকা হয় না। তাই তিনশো নগদ টাকা দিয়েছে গোলাম আলি সর্দারকে—টিনের ঘর করে দেবে এরপরে। থুঃ–মকবুল জলের মধ্যে থুতু ফেলল।
অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সুধাকর। তারপর কিন্তু রোকেয়া বেগম? তার আশনাই?
মেয়েমানুষের আশনাই! ও শুধু কথার কথা! হাজার হাজার টাকা ইদ্রিশ মিয়ার, হাজার বিঘে ধানের জমি, গন্ডা গন্ডা গোরু-ছাগল-মুরগি পাঁচ-সাতটা খামার। রোকেয়া হবে লালবিবি–ইদ্রিশ মিয়ার চোখের সুর্মা হয়ে থাকবে। কোন দুঃখে ও আসবে ভাঙা গোলপাতার ঘরে? কেন খেতে যাবে খুদের জাউ আর পেঁয়াজের তরকারি!
কিন্তু দোস্ত, সুধাকর যেন বার কয়েক খাবি খেল, আমি ভেবেছিলাম রোকেয়া বিবি তোমাকে…
খুব পেয়ার করে, না? আবার সেই অদ্ভুত বিকৃত হাসিটা ভেসে উঠল মকবুলের মুখে, মেয়েমানুষ শুধু জোরকেই পেয়ার করে, হয় টাকার জোর নইলে গায়ের জোর। টাকার জোরে ইদ্রিশ মিয়া ওকে নিয়ে গেল, কিন্তু তার আগে আমি যদি ওকে গায়ের জোরে কেড়ে আনতাম, তাহলে এমন করে বুক চাপড়াতে হত না আমাকে।
মেয়েমানুষ শুধু জোরটাকেই পেয়ার করে। কথাটা যেন তিরের মতো এসে আঘাত করল সুধাকরকে। তাই বটে! সেই ভুল করেই সে এক বার হারিয়েছিল রাধাকে, আর আজ…
মকবুল কর্কশ গলায় বলে চলল, ইদ্রিশ মিয়ার বাড়িতে খুব খানাপিনা হচ্ছে। আমাকে বললে, বড়ো বড়ো মুরগি রান্না হচ্ছে, পোলাও হচ্ছে, মিঠাই এসেছে— খেয়ে যা। আমি ভাবছিলাম কোথাও যদি খানিক বিষ পাই তাহলে মিশিয়ে দিই ওই পোলাওয়ের সঙ্গে। ওই ইদ্রিশ মিয়া, ওই লালবিবি, ওই হারামি গোলাম আলি সর্দার একসঙ্গেই মিটে যায় সমস্ত!
যদি বিষ পাই! কিন্তু একথা কেন বলছে না মকবুল যে ইদ্রিশ মিয়াকে সে খুন করবে?
চলে যাব, শহরেই চলে যাব। আমার পক্ষে শহরও যা—নদীও তাই। মজুরের খেটে খাওয়াই সার—সে নদীতেই হোক আর শহরেই হোক।
হাঁটুতে থুতনি রেখে মকবুল বসে রইল। সুধাকরের মনে হল, অদ্ভুত রকমের ভাঙাচোরা যেন তার চেহারাটা। যেন প্রকান্ড একটা তাল গাছের মাথা থেকে আছড়ে পড়ে সম্পূর্ণ তালগোল পাকিয়ে গেছে সে।
সুধাকর আস্তে আস্তে বললে, তোমার সঙ্গে একটা পরামর্শ আছে মকবুল।
পরামর্শ! কীসের? মকবুল যেন কেমন চমকে উঠল।
মেয়েমানুষ সম্বন্ধেই।
মেয়েমানুষ? মকবুল গর্জে উঠল, না, ওর মধ্যে আমি আর নেই। কোনো কথা শুনতে চাই না আর।
কিন্তু শুনতে তোমাকে হবেই। সুধাকর মকবুলের কাঁধে হাত রাখল, তোমার রোকেয়া তোমায় ঠকিয়েছে, কিন্তু আমার রাধা আমায় ঠকাতে পারবে না। তোমাকে আমার দরকার।
মেয়েমানুষ! থুঃ। জলে আবার থুতু ফেলে মকবুল বললে, বলে যাও।
৫.
বারোয়ারিতলায় ঢপকীর্তন আজ শেষ হয়ে গেল।
গানটা আরও ভালো জমেছিল আজ। রাধাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন মাটির নয়,
আকাশ থেকে নেমে এসেছে। তার গলায় গন্ধর্বলোকের সুর।
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর,
প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর!
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কাঁদে–
পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বাঁধে—
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কাঁদে। তেমনি নাটমন্দিরের বাইরে দরজার সামনে অসংখ্য চাষাভুসোর ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে গান শুনেছে সুধাকর। হিয়ার পরশের জন্যে হিয়া কাঁদে না —কথাটা ভুল। বুকের প্রত্যেকটা হাড়-পাঁজরা পুড়ে খাক হয়ে যেতে থাকে।
চারদিকে বার বার হাততালি পড়েছে আজ। সাহাবাবুদের বাড়ির ছেলেরা শহরের কায়দায় বলেছে, এনকোর—এনকোর। আর তারই তালে দুলে উঠেছে রাধার শরীর—যেন জোয়ারের ঢেউ দুলেছে উছল গাঙে। রামধন সাহা নিজে দাঁড়িয়ে উঠে বলেছেন, একটা সোনার মেডেল দেবেন রাধাকে। রাধা তাঁকে হাতজোড় করে নমস্কার করেছে। কিন্তু সুধাকর এসব দেখেছে নিছক ছায়াবাজির মতো, যেন স্বপ্ন দেখেছে। শুধু অপেক্ষা করেছে কখন শেষ হবে গান, কখন সেই অন্ধকার গাব গাছের নীচে…
আসর শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কালো ছায়ার তলায় নিশ্চল প্রতীক্ষা সুধাকরের। সময় বয়ে চলেছে। কই, রাধা তো আসছে না এখনও!
তবে কি আসবে না? তবে কি মিথ্যেই স্তোক দিয়েছে কাল? সুধাকরের চোখের সামনে একটা রক্তাক্ত ঘূর্ণি ঘুরছে যেন। যদি না আসে, তাহলে
শুকনো পাতার ওপর খরখর শব্দ একটা। সুধাকরের হৃৎপিন্ড যেন ফেটে বেরিয়ে যেতে চাইল। রাধাই বটে। অন্ধকারের মধ্যে একটা শ্বেতপদ্মের মতো দাঁড়িয়ে আছে সে, চিকচিক করছে গলার সোনার হার। সুধাকর এগিয়ে এল। দুঃসহ উত্তেজনায় বললে, রাধা! দু-পা পিছিয়ে গেল রাধা। বললে, না।
আমার সঙ্গে চলো রাধা। নদীতে নয়—খালের ঘাটে নৌকা রেখে এসেছি। দুটো সুপুরিবন পার হলেই খাল। আঁধারে আঁধারে চলে যাব, কেউ দেখতে পাবে না।
আমি যাব না। পাথরের মতো শক্ত শোনাল রাধার স্বর।
সুধাকরের গায়ে যেন সাপের ছোবল লাগল।
রাধা?
আমি যাব না। কেন যাব? রাধার গলার স্বরে বিদ্রোহ ভেঙে পড়ল, কোন দুঃখে মরতে যাব তোমার সঙ্গে? ছ-বছর আগে তোমায় ভালো লেগেছিল, একটা মাতাল শয়তানের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে আসতে চেয়েছিলাম তোমার সঙ্গে। কিন্তু আজ তো আমার কোনো কষ্ট নেই। কত নাম হয়েছে আমার, গয়না হয়েছে, টাকা হয়েছে। সর্দার বৈরাগী আমার হাতের মুঠোয়। কেন যাব আমি?
সুধাকরের গলার স্বর যেন বন্ধ হয়ে আসতে চাইল।
রাধা, ছোটো রায়কর্তাও তোমাকে অনেক সোনাদানা দিয়েছিল।
দিয়েছিল বই কী। কিন্তু সেদিন আমার বয়স ছিল অল্প, তাই তার কদর বুঝতে পারিনি। কিন্তু আজ আমার চোখ খুলেছে। আমি জানি টাকাতেই সুখ। সে-টাকা আমি দু-হাতে রোজগার করতে পারব। মাঝি, তুমি ফিরে যাও।
রাধা!
তুমি ফিরেই যাও মাঝি, সেই ভালো হবে সবচেয়ে। সর্দার বৈরাগী টের পেয়ে যাবে এখনই। সে এলে আর তোমার রক্ষা থাকবে না। এককালে ডাকাতি করত সে, দরকার হলে এখনও খুন করতে পারে।
তাহলে সেই চেষ্টাই সে করুক। সুধাকর আর নিজের ধৈর্য রাখতে পারল না। দৃঢ় কঠিন বাহুতে হঠাৎ সে দু-হাতে রাধাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল।
কাল রাতের মতোই একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার তুলতে চাইল রাধা। কাল রাতের মতোই সুধাকর তার মুখ চেপে ধরল। তীব্র গোঙানি, প্রাণপণ ছটফটানি কিছুক্ষণ। কাঁধের গামছাটা সজোরে সুধাকর রাধার মুখের ভেতরে চালিয়ে দিলে। একটু পরেই নিঃসাড় হয়ে এলিয়ে পড়ল রাধা।
ঝোপের মধ্য থেকে এগিয়ে এল মকবুল।
দিব্যি হয়েছে খাসা। এই হল পাকা হাতের কাজ। পালাও এবার।
অন্ধকার সুপুরি বাগানের মধ্য দিয়ে পথ। মাঝরাতের চাঁদ উঠতে আরও দেরি আছে খানিকটা। রাধাকে কাঁধের ওপর তুলে নিয়ে কুঁজো হয়ে এগোতে লাগল সুধাকর। কিন্তু পিঠে অত বড়ো ভারটাকেও যথেষ্ট ভারী বলে মনে হচ্ছে না তার। শুধু রক্তের চাপে বুকের ভেতরটা যেন ফেটে যাওয়ার উপক্রম করছে। আর পেছনে পেছনে পাহারা দিতে দিতে আসছে মকবুল। ঠিকই বুঝেছিল সে। মেয়েদের পেতে গেলে জোর চাই। সে টাকার জোর হোক আর গায়ের জোরই হোক!
খালের ধারে যেখানে শ্মশান, আশেপাশে জনমানুষের চিহ্ন নেই যেখানে, সেইখানেই ভাঙা ঘাটলার আড়ালে সুধাকরের নৌকাটা লুকানো ছিল। রাধাকে নৌকায় নামিয়ে ছইয়ের ভেতরে তাকে ঠেলে দিলে সুধাকর। মড়ার মতো পড়ে রইল রাধা। তারপরে দুখানা দাঁড় ধরল দুজনে। তিরের মতো খালের কালো জল কেটে নৌকা এগিয়ে চলল। একটি কথা নেই কারোর মুখে।
প্রায় দশ মিনিট পরে নৌকা বড়ো গাঙে গিয়ে পড়ল। স্টিমারঘাট অনেকখানি বাঁ-দিকে পড়ে আছে, মিটমিট করছে ঘাটের কেরোসিনের আলোটা, জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে নৌকাগুলো। সেইদিকে তাকিয়ে একটা কথা মনে পড়ে গেল সুধাকরের।
দোস্ত, তোমার নৌকা যে পড়ে রইল!
নৌকা আমার নয়, ইদ্রিশ মিয়ার।
কিন্তু…
কেন মিছিমিছি নিয়ে আসতে যাব ওই বাঁদির বাচ্চার নৌকা? ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে যাব কোন দুঃখে? আমি তো শহরে চলেছি, খেটেই খাব সেখানে। ওর নৌকা থাক পড়ে। গরজ থাকে তো নিজেই নিয়ে যাবে খোঁজ করে।
আর কোনো কথা বলল না কেউ। দুখানা দাঁড়ের টানে নৌকা তরতর করে এগিয়ে চলল কালো অন্ধকারের স্রোত বেয়ে। তারপর আরও খানিকটা পরে যখন মাঝরাতের চাঁদ উঠল আকাশে, দুজনের মুখে পড়ল তার আলো, তখন আবার কথা কইল মকবুল।
মুখের গামছাটা খুলে দাও মেয়েটার। নইলে শেষে হয়তো দম আটকেই মরে যাবে।
রাত ভোর হয়ে গেছে। রাধা চোখ মেলল। স্তিমিত শান্ত আলোয় ঝিমন্ত চোখে বইঠা বাইছে সুধাকর। রাধা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে। মাথাটা তার পরিষ্কার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।
রাধা ডাকল, মাঝি?
সুধাকর চমকে উঠল। রাধা উঠে বসেছে। বসেছে গলুইয়ে হেলান দিয়ে।
আবার ডাকল, মাঝি?
সুধাকর বিবর্ণ হয়ে গেল। হঠাৎ যেন নিজের অপরাধটা একটা কালো ছায়ার মতো তার সামনে এসে দাঁড়াল। রাধাকে জোর করে ধরে এনেছে সে, কিন্তু রাধার মন যদি ধরা না দেয় তার কাছে? চোখ তুলে তাকানোর সাহসও সে খুঁজে পেল না, নতদৃষ্টিতে পান্ডুর জলের দিকে চেয়ে রইল।
রাধা বললে, অত শক্ত করে কি মুখ বাঁধে? একটু হলেই মরে যেতাম যে!
আমায় মাপ করো রাধা। একটা আবেগ ঠেলে এল সুধাকরের গলায়, ঝোঁকের মাথায় তোমাকে ধরে এনেছি, কিন্তু এখন দেখছি তাতে লাভ নেই। আমি তোমায় ফিরিয়েই দিয়ে আসব।
রাধা হাসল। করুণ, ক্লান্ত হাসি। ফিরেই যদি যাব, তাহলে কাল কেন দেখা করতে আসব তোমার সঙ্গে?
হঠাৎ নৌকাটা দুলে উঠল, যেন একদিকে হেলে গেল এক বার। রাধা বললে, কী করছ? ডুবিয়ে দেবে নাকি নৌকা? জোর করে ধরে এনে শেষে ডুবিয়ে মারবে নদীতে?
বিহ্বল বিস্ময়ে সুধাকর বললে, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
রাধা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর চোখ তুলল আকাশের দিকে। পুবের দিগন্ত রাঙা হয়ে আসছে, সাদা মেঘের মাথায় সিঁদুর পড়ছে একটু একটু করে। তারই একটুখানি আভা এসে যেন রাধার সিঁথিতেও পড়ল, অন্তত সেইরকমই মনে হল সুধাকরের।
রাধা গম্ভীর গলায় বললে, কী যে হয়েছে সে কি আমিই বুঝতে পারছি? আমি খাঁচার পাখির মতো। খাঁচা আমার সয়ে গেছে—দাঁড়ে বসে নিশ্চিন্তে দিন কাটাতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু কেউ যদি খাঁচার বাইরে এনে আমায় ছেড়ে দেয়, তাহলেই কি ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি আমি?
আর একটু স্পষ্ট করে বললা রাধা! আকুল গলায় জানতে চাইল সুধাকর।
কী স্পষ্ট করে বলব এর চেয়ে? সিঁদুরে আলোটা এবার শুধু রাধার সিঁথিতেই নয়, তার সারা কপালেও ছড়িয়ে পড়ল। ছোটো রায়কর্তার ঘর থেকে পালাতে পারতাম অনেক দিন আগেই, তবু এত দেরি হল কেন পালাতে? খাঁচার নেশা আমার সহজে কাটতে চায় না। ভেবেছিলাম বোষ্টমি হয়ে বৃন্দাবনে চলে যাব, তোমাকেও ভুলে যাব। পারলাম কই? পদ্মার ওপারে শ্রীপাট খেতুরের মেলায় গিয়ে পড়লাম সর্দার বৈরাগীর হাতে, ভিড়লাম ঢপের দলে। সর্দার বৈরাগী আমাকে সেবাদাসী করে নিতে চাইল—লোভ সামলাতে পারলাম না। আবার চলে এলাম খাঁচায়। তারপর কাল রাতে তুমি এলে। মন এক বার দুলে উঠল, তারপরেই মনে হল–আর নয়, এই বেশ আছি। কিন্তু থাকতে তো পারলাম না। চলে এলাম তোমার সঙ্গে দেখা করতে। আর তুমিও কী করবে সেও আমি জানতাম। তোমার চোখ দেখেই আগের রাতে সে আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
তবে কেন মিথ্যে করে আমায় বাধা দিলে?
মিথ্যে করে বাধা দিইনি মাঝি, সেও সত্যি। জোর করে না আনলে আমায় তুমি পেতে, সর্দার বৈরাগীই তার জোরে আমায় ধরে রাখত।
ভোরের আলো এবার সোনা হয়ে রাধার চোখ-মুখ আলো করে তুলল। সুধাকর এবার সোজা হয়ে বসল। আঠারো বছরের চঞ্চলতা ফিরে এসেছে শরীরে—এসেছে চব্বিশ বছরের অভিজ্ঞতা। হাতের পেশিতে সমস্ত শক্তি এনে জোর করে বইঠায় টান দিলে সুধাকর। বললে, এবার আমার জোরেই তোমায় ধরে রাখব রাধা।
রাধা হাসল। সূর্যের প্রথম আলোয় মন-ভোলানো অপরূপ হাসি।
পারবে?
পারব।
কোথায় নিয়ে চলেছ আমাকে? শহরে?
না, শহরে নয়। এবার সুধাকরও হাসল, সেখানে অনেক ছোটো রায়কর্তা আছে, অনেক সর্দার বৈরাগী আছে। তাদের সকলের সঙ্গে জোরে আমি পেরে উঠব না। আমি তোমায় দক্ষিণে নিয়ে যাব।
দক্ষিণে?
হ্যাঁ। নতুন চরে নতুন মাটি উঠেছে সেখানে। বিনা পয়সায় পত্তনি পাওয়া যায় শুনেছি। নোনা কাটিয়ে ফসল ফলাব আগে, তারপরে দেব খাজনা। আর সেইখানে ঘর বাঁধব তোমার নিয়ে।
রাধা স্মিতমুখে তাকিয়ে রইল। আর ঠিক সেই সময় কাঠের পাঠাতনের তলা থেকে একলাফে সুধাকরের কোলের কাছে লাফিয়ে উঠল জুয়ান। রাধা চমকে উঠে চাপা আর্তনাদ করল একটা। সুধাকর হা-হা করে হেসে উঠল।
ভয় নেই, আমার উদ, জুয়ান ওর নাম। দুজন বন্ধু আমার, একজন জুয়ান আর একজন মকবুল।
জুয়ান তখন সুধাকরের হাঁটুতে মাথা ঘষছে। এক হাতে সস্নেহে তার মাথায় হাত বুলোতে লাগল সুধাকর। কৌতুকভরা চোখে রাধা দেখতে লাগল। তারপর শুধাল, মকবুল কে?
সে না থাকলে কী করে আনতাম তোমাকে? সে-ই তো ভরসা দিয়েছিল। তাকিয়ে দ্যাখো, পেছনের গলুইয়ে সে ঘুমুচ্ছে।
রাধা ফিরে তাকাল, কই পেছনের গলুইয়ে তো কেউ নেই!
নেই! সুধাকর চকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল, নেই! তাই তো, তবে কোথায় গেল মকবুল? পান্ডুর বিবর্ণমুখে বললে, তবে কি জলে পড়ে গেল? অনেকক্ষণ আগে নৌকাটা এক বার দুলে উঠেছিল বটে-ঝুপ করে একটা আওয়াজও হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম শুশুকের
সঙ্গে ধাক্কা লাগল বোধ হয়। তবে কি মকবুল ঘুমোতে ঘুমোতে…
কিন্তু মকবুল তো ঘুমোতে ঘুমোতে জলে পড়ে যায়নি। একটা চরের পাশ দিয়ে যখন নৌকা চলেছে, তখন নিজেই সে টুপ করে নেমে পড়েছিল তা থেকে। কারণ রোকেয়াকে সে পায়নি, কিন্তু দেখেছে রাধাকে কী করে পেয়েছে সুধাকর। আরও দেখেছে রাধার রূপ, নিজের বুকের মধ্যে শুনেছে উচ্ছ্বসিত কলধ্বনি। যদি নিজের মনের পশুটা তার বাগ না মানে? যদি ওইভাবেই সেও সুধাকরের কাছ থেকে রাধাকে কেড়ে নেওয়ার কথা ভাবে? যদি শয়তান তার মাথার ভেতরেই সব কিছু ওলটপালট করে দেয়? তার চেয়ে… প্রথম সূর্যের আলোয় একটা নির্জন চরের একবুক বেনাঘাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে মকবুল ভাবতে লাগল–তার চেয়ে আর এক বার ফিরে যাবে গ্রামে। আর এক বার নতুনভাবে চেষ্টা করে দেখবে রোকেয়াকে সত্যিই ফিরে পাওয়া যায় কি না।