ধাতু
আমরা সর্ব্বদা যে সকল বস্তু ব্যবহার করি তাহার অধিকাংশই ধাতুময়। থালা, ঘটী, বাটী, গাড়ু, ঘড়া, পিলসুজ, ছুরী, কাঁচী, ছুচ ইত্যাদি অনেক প্রকার বস্তু ও নানাবিধ অলঙ্কর, এই সমুদায় ধাতু নির্ম্মিত।
অন্য অন্য বস্তু অপেক্ষা ধাতুর ভার অধিক। ধাতু অতিশয় কঠিন; ঘা মরিলে সহসা ভাঙ্গে না; কিন্তু আগুনে গলান যায়। ধাতুকে পিটিয়া অতি পাতলা পাত ও সরু তার প্রস্তুত করা যাইতে পারে। ধাতু এমত ভারসহ যে সরু তারে অতি ভারি বস্তু ঝুলাইলেও ছিঁড়িয়া পড়ে না।
ধাতু আকরে পাওয়া যায়। আকরে বিশুদ্ধ ও বিমিশ্র দুই প্রকার ধাতু পাওয়া যায়। ধাতু যখন স্বভাবতঃ নির্দ্দোষ হয় তাহাকে বিশুদ্ধ বলা যায়; আর যখন অন্য অন্য বস্তুর সহিত মিলিত থাকে তখন উহাকে বিমিশ্র কহে। স্বর্ণ, রৌপ্য, পারদ, সীস, তাম্র, লৌহ, টিন এই কয়েক টী প্রধান ধাতু।
স্বর্ণ।
গলাইলে স্বর্ণের ভার কমিয়া যায় না ও বর্ণের ব্যত্যয় হয় না; এজন্য স্বর্ণকে উৎকৃষ্ট ধাতু কহে। স্বর্ণ জল অপেক্ষা উনিশ গুণ ভারি। এক সরিষা প্রমাণ স্বর্ণকে পিটিয়া দীঘে ও প্রস্থে নয় অঙ্গুল পাত প্রস্তুত করা যাইতে পারে; এবং ঐ প্রমাণ স্বর্ণে ২৩৫ হাত তার প্রস্তুত হইতে পারে। স্বর্ণ এমত ভারসহ যে এক যবোদর মাত্র স্থূল তারে ৫ মন ৩৪ সের ভার ঝুলাইলেও ছিঁড়িয়া পড়ে না।
স্বর্ণ স্বভাবতঃ অতিশয় উজ্জ্বল ও সুশ্রী, ইহা মলিন হয় না; এ জন্য লোকে উহাতে অলঙ্কার গড়ায়। স্বর্ণেতে যে টাকা প্রস্তুত হয তাহাকে মোহর কহে। স্বর্ণের মুল্য সর্ব্ব ধাতু অপেক্ষা অধিক। বিশুদ্ধ স্বর্ণের বর্ণ কাঁচা হরিদ্রার মত। পৃথিবীর প্রায় সকল প্রদেশেই স্বর্ণের আকর আছে; কিন্তু উষ্ণপ্রধান দেশেই অধিক।
রৌপ্য।
রৌপ্য জল অপেক্ষা প্রায় এগার গুণ ভারি। রৌপ্য শুক্ল ও উজ্জ্বল। স্বর্ণে যেমন পাতলা পাত ও সরু তার হয় ইহাতেও প্রায় সেই রূপ হইতে পারে। রৌপ্য এমত ভারসহ সে এক যবোদয় স্থূল তারে ৪ মন ১১ সের ভার ঝুলাইলেও ছিঁড়িয়া পড়ে না।
পৃথিবীর প্রায় সকল প্রদেশেই রূপার আকর আছে। কিন্তু আমেরিক দেশে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক।
রূপাতে টাকা, আধুলি, সিকি, দুআনি নির্ম্মাণ করে। রূপাতে নানা প্রকার অলঙ্কার এবং ঘটী. বাটী প্রভৃতিও নির্ম্মাণ করিয়া থাকে।
পারদ।
পারদ রৌপ্যের ন্যায় শুক্ল ও উজ্জ্বল। এই ধাতু জল অপেক্ষা প্রায় চৌদ্দ গুণ ভারি। ইহা আর আর ধাতুর মত কঠিন নহে; জলের ন্যায় তরল। যাবতীয় দ্রব দ্রব্য অপেক্ষা অধিক ভারি। সর্ব্বদা তরল অবস্থায় থাকে; কিন্তু মেরু সন্নিহিত দেশে লইয়া গেলে জমিয়া যায়। তখন অন্য অন্য ধাতুর ন্যায় উহাতে সরু তার ও পাতলা পাত প্রস্তুত হইতে পারে এবং ঘা মারিলে সহসা ভাঙ্গিয়া যায় না।
পারা স্বভাবতঃ সমস্ত দ্রব দ্রব্য অপেক্ষা; অধিক শীতল। কিন্তু আগুনের উত্তাপ দিলে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক উষ্ণ হয়। অতি সহজেই পারকে অসংখ্য খণ্ডে বিভক্ত করা যাইতে পারে। ঐসকল খণ্ড গোলাকার হয়।
পারা জমাইয়া কাচের পাশ্চাৎ ভাগে বসাইয়া দিলে ঐ কাচে প্রতিবিম্ব পড়ে। ঐ রূপ কাচকে দর্পণ ও আরসী কহে। লোকে দর্পণে মুখ দেখে।
ভারতবর্ষ, চীন, তিব্বৎ, সিংহল, জাপান, স্পেন, অষ্ট্রিয়া, বাবেরিয়া, পেরু, মেক্সিকো এই সকল দেশে পারার আকর আছে।
সীস।
সীস সকল ধাতু অপেক্ষা নরম। জল অপেক্ষা এগার গুণ ভারি। সীসের ভার রৌপ্য অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অধিক। অন্য ধাতু অপেক্ষা ইহা অল্প উত্তাপে গলে। অত্যন্ত অধিক উত্তাপ দিলে উড়িয়া যায়। জলে অথবা অনাবৃত স্থলে ফেলিয়া রাখিলে সীসের অধিক ভাব পরিবর্ত্ত হয় না; কেবল উপরের উজ্জ্বলতা মাত্র নষ্ট হইয়া যায়।
ইংলণ্ড, স্কটলণ্ড, আয়র্লণ্ড, জর্ম্মনি, ফ্রান্স ও আমেরিকা এই সকল দেশে অপর্য্যাপ্ত সীস জন্মে। হিমালয় পর্ব্বতে ও তিব্বৎ দেশেও সীসের আকর আছে।
সীস কাগজের উপর টানলে ধূষর বর্ণ রেখা পড়ে। সীসেতে পেনসিল প্রস্তুত হয়। অধিকাংশ সীসেতে গোলা গুলি নির্ম্মাণ করে। কিছু শক্ত ও উত্তম রূপে গোলাকার কারবার নিমিত্ত ইহাতে হরিতাল মিশাল দেয়। রসাঞ্জন বিশ্রিত করলে সীসেতে ছাপিবার অক্ষর নির্ম্মিত হয়। টিন ও তামা মিশ্রিত করিলে উত্তম কাঁসা প্রস্তুত হয়।
তাম্র।
এই ধাতু জল অপেক্ষা আট গুণ ভারি। ইহা লাল বর্ণ, উজ্জ্বল ও দেখিতে অতি সুন্দর। ইহাকে পিটিয়া যেমন পাত করা যায়, তার তেমন হয় না। সকল ধাতু অপেক্ষা ইহা অতি গম্ভীর শব্দজনক। লৌহ অপেক্ষা অনেক সহজে গলান যায়। এক যবোদর স্থুল তারে ৩ মন ১৫ সের ভার ঝুলাইলেও ছিঁড়িয়া যায় না।
তাম্রে পয়সা প্রস্তুত হয়। তামার পাত করিয়া জাহাজের তলা মুড়িয়া দেয়; তাহাতে জাহাজ শীঘ্র যায় ও শঙ্খ শম্বুক প্রভৃতি তল ভেদ করিতে পারে না। অনেকে তামাতে পাকস্থালী ও জলপাত্র প্রস্তুত করে।
তিন ভাগ দস্তা ও এক ভাগ তামা মিশ্রিত করিলে পিত্তল হয়। পিতল দেখিতে অতি সুন্দর; অত্যন্ত প্রয়োজনে লাগে। তামায় যত শীঘ্র মরিচ ধরে পিতলে তত শীঘ্র নয়। পিতলে থালা, ঘটী, বাটী, কলসী ইত্যাদি নান বস্তু প্রস্তুত করে। সুইডন, সাক্সনি, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, পেরু, মেক্সিকো, চীন, জাপান, নেপাল, আগ্রা, আজমীর প্রভৃতি দেশে তাম্রের আকর আছে|
লৌহ
লৌহ সকল ধাতু অপেক্ষা অধিক কার্য্যোপযোগী। এই ধাতুতে লাঙ্গলের ফাল, কোদাল,ক্যাস্তয়া প্রভৃতি কৃষি কার্য্যের যন্ত্র সকল নিৰ্মাণ করে। ছুরী, কাঁচী, কুড়াল, খন্তা, কাটারি, চবিকুলুপ, শিকল, পেরেক, ছূচ, হাতা বেড়ী, কড়া, হাতুড়ি ইত্যাদি যে সকল বস্তু সর্ব্বদা প্রয়োজনে লাগে সে সমুদয় লৌহে নির্ম্মিত। ইহা ভিন্ন নানা বিধ অস্ত্র শস্ত্রও লৌহে নির্ম্মাণ করিয়া থাকে।
লৌহ জল অপেক্ষা সাত আট গুণ ভারি। ইহা টিন ভিন্ন আর সকল ধাতু অপেক্ষা হালকী। লোহাতে মানুষের চুলের সমান সরু তার হইতে পারে। ইহা সকল ধাতু অপেক্ষা অধিক ভারসহ; এক যবে্দর স্থূল তারে ৬ মন ১৭ সের ভারি বস্ত ঝুলাইলেও ছিঁড়িয়া যাইবেক না। লৌহ সকল ধাতু অপেক্ষা অধিক পাওয়া যায় এবং সকল দেশেই ইহার আকর আছে। কিন্তু ইংলণ্ড, ফ্রান্স, সুইডেন, রুশিয়া এই কয়েক দেশে অধিক।
টিন।
টিন জল অপেক্ষা সাত গুণ ভারি। পূর্ব্বোক্ত সকল ধাতু অপেক্ষা লঘু, রূপা অপেক্ষা নরম, সীস অপেক্ষা কঠিন।
ইংলণ্ড, জর্ম্মনি, চিলি, মেক্সিকো এবং বঙ্কদ্বীপ এই কয়েক স্থানে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক টিন জন্মে।
এই ধাতুতে বাক্স, পেটরা, কৌটা প্রভৃতি অনেক দ্রব্য প্রস্তুত হয়।