চার
শীতার্ত বাতাস পরিবেশকে নিষ্প্রাণ করে দিয়েছে। এখানে ওখানে মাটিতে সাদা ছোপ চিহ্ন নিয়ে পড়ে আছে তুষার। সূর্য উঠতে এখনও অনেক দেরি। মিলার্ড আর লিয়োনেল ক্যাম্পফায়ারের দু’ধারে বসে আছে কফির মগ হাতে। চোখের ইশারায় কেবিন দেখাল মিলার্ড।
‘আর কয়দিন? এরপর তো বাইরে দেড়হাত বরফ জমবে।’
অন্যমনস্ক লিয়োনেল বিড় বিড় করে কী যেন বলল কিছু বোঝা গেল না। আগুনের দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। অনেকক্ষণ পর নড়েচড়ে বসল, আগুনে কাঠ ফেলল কয়েক টুকরো। এক সময় বলল, ‘আমি এখনও বুঝতে পারছি না ওই আউট-লদের সঙ্গে তুমি কীভাবে পারবে। যতই হাত চালু হোক, সিক্সগান হাতে একা বারো-চোদ্দজনের মুখোমুখি দাঁড়ানো তোমার জীবনের শেষ ভুল হবে।’
‘সবার বিরুদ্ধে লড়ার কোনও ইচ্ছে নেই আমার। দল হচ্ছে সাপের মত। মাথা কেটে ফেলে দাও, শরীরটা লাফালেও কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। যদি ম্যাকেনলিকে ধরতে পারি, বাকিরা পালাবার জন্য পাগল হয়ে যাবে।’ বন্ধুর উদ্দেশে কথা ক’টা বললেও অন্য চিন্তা করছে মিলার্ড। ভাবছে, সে একাই ছিল, আরও নিঃসঙ্গ হয়েছে। প্রতিটি পেরিয়ে যাওয়া পল ওকে আরও একা করে দিয়েছে। যে মেয়েটিকে বহু বছর আগে ভালবাসত তাকে সে পায়নি। কার বাহুডোরে সুখে ছিল, উষ্ণতায় ছিল সে? জানে না ও। জানতেও চায় না। শুধু চায় সে সুখী হোক, কোনও কষ্ট যেন তাকে ছুঁতে না পারে। তাছাড়া মেয়েটাকে তো ও বলার সুযোগই পায়নি যে ভালবাসে। আজও চোখের সামনে ওকে দেখলে হৃৎস্পন্দন বেড়ে ওঠে, ঘিরে ধরে ব্যর্থ প্রেমের নাগপাশ। তবু কী যেন একটা দ্বিধা ওকে কাছে যেতে বাধা দেয়…!
‘আমার কথা না শুনলে বলব তুমি একটা আস্ত বোকা। ম্যাকেনলিকে ডাকাতি করতে দাও, ওই শালার শহরের মানুষ বুঝুক সঞ্চয় কেড়ে নিয়ে গেলে কেমন লাগে।’ আবার মগে কফি ভরে দিয়ে বলল লিয়োনেল।
‘ব্যাপারটা ব্যক্তিগত, বাস্তবে ফিরে খেই না হারিয়ে বলল মিলার্ড। ‘ম্যাকেনলিকে আমি বহু বছর ধরে খুঁজছি। তাছাড়া শহরের লোকদের তো কোনও দোষ নেই, ওরা শুধু মেয়র উইলিয়ামের চাতুরিতে পড়ে আমাকে বিদায় জানিয়েছে।’
‘বিদায়?’ তামাকের কষ লাগা এক মুখ কালচে থুতু আগুনে ফেলল লিয়োনেল। ‘ওরা জানে না বন্ধুকে কীভাবে বিদায় দিতে হয়। ওরা বোঝে শুধু মার্শাল বা মেয়রের কথা মেনে কীভাবে চলতে হয়। ওদের জন্য এত বছর যা করেছ তার মূল্য দিয়েছে ওরা? ক’জন তোমাকে শ্রদ্ধা করে? মেয়রের কথামত একটা সোনার ঘড়ি উপহার দিয়েই তো সবার দায়িত্ব মিটে গেছে, তাই না?’
‘বাদ দাও,’ চুলে হাত বুলাল মিলার্ড। ‘অতীত তো আর ফিরবে না, ও ব্যাপারে চিন্তাও করি না। যা গেছে গেছে, এখন আমি শুধু ম্যাকেনলির কথা ভাবতে চাই।’
ভোর হয়ে এসেছে। পাহাড়ী ভোর। এখনও উঁকি দেয়নি সূর্য, কিন্তু ধূসর আলো ছড়িয়ে দিয়েছে চারধারে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পাখি ডাকতে শুরু করবে, আকাশ হয়ে উঠবে লাল।
মগের বাকি কফি আগুনে ফেলে উঠে দাঁড়াল জো মিলার্ড। স্যাডল পরীক্ষা শেষে ঘোড়ায় চাপল। পেছন থেকে লিয়োনেল বলল, ‘এক মিনিট, জো, আমি বাফেলো গানটা নিয়ে আসি।’
‘দরকার নেই,’ শান্তস্বরে সিদ্ধান্ত জানাল মিলার্ড। ‘আমি একা যাচ্ছি,
তোমাকে সঙ্গে নেব না।’
‘কেন?’
‘কারণ ম্যাকেনলির পিছু ধাওয়া করা তোমার কাজ নয়।’
‘তোমারও না, জো বয়। চাকরিচ্যুত করেছে ভুলে গেছ নাকি?’
বুড়োকে রাগতে দেখে মজা পেয়ে হাসল মিলার্ড। ঘোড়ার পেটে স্পার ছুঁইয়ে বলল, ‘পরে দেখা হবে।’
‘ভাল! মরে গেলে তখন আর দুঃখের গল্প ফাঁদতে এসো না,’ ডান হাত মুঠো করে অপসৃয়মান মিলার্ডের উদ্দেশে ঝাঁকাল লিয়োনেল। বামহাতে কফি মগ মাটিতে আছড়ে ফেলে এক লাথিতে ওটা পাঠিয়ে দিল জঙ্গলের মধ্যে।
দৌড়ে কেবিনে গিয়ে ঢুক্ল বুড়ো। বেরিয়ে এল বাফেলো গান হাতে। অস্ত্রটা কেবিনের গায়ে ঠেকা দিয়ে আবার ভেতরে ঢুকে স্যাডল গিয়ার নিয়ে এল। অনেকদিন পর আবার ঘোড়া ব্যবহার করবে সে।
.
লিয়োনেলের বলে দেয়া পথে এগিয়ে আউটলদের ক্যাম্প খুঁজে বের করতে কোনও অসুবিধা হলো না মিলার্ডের। দ্রুত বয়ে চলা ঝরনার তীরে ক্যাম্প করা হয়েছে। একটা নিচু রিজের ওপর শুয়ে সামনের পুরো দৃশ্য পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে। শ’খানেক গজ দূরে একটা ঝোপের গায়ে আউট-লদের ‘ঘোড়া বাঁধা আছে।
ফিল্ডগ্লাস তুলে চোখে লাগাল মিলার্ড। ওরা পনেরোজন। তিন চারজন ঘুমাচ্ছে, বাকিরা ক্যাম্পফায়ার ঘিরে বসে আছে। পোকার খেলা চলছে ওখানে। মিলার্ডের ফিল্ডগ্লাস ম্যাকেনলির ওপরে স্থির হলো। লম্বা-চওড়া লোক। আপাদমস্তক কালো পোশাকে আবৃত। স্যাডলকে বালিশ বানিয়ে ঘুমিয়ে আছে। হ্যাট দিয়ে মুখ ঢেকে থাকায় চেহারা দেখা যাচ্ছে না, তবে তার পরিচয় নিয়ে মিলার্ডের মনে কোনও দ্বিধা নেই। বিগ জিম ম্যাকেনলিকে খুঁজে পেয়েছে ও।
পিছিয়ে রিজ থেকে নামল সে, দৌড়ে ঘোড়ার কাছে চলে এল। নাকে হাত বুলিয়ে জন্তুটাকে বলল, ‘কিছু হয়ে গেলে মনে রাখিস, বন্ধু, ভুলে যাস না।
ঘোড়াটাও যেন বুঝল, নাকের আলতো গুঁতোয় মিলার্ডকে নিঃশব্দে আদর জানাল।
রিজ ঘুরে ঝরনার তীরে জন্মানো ঝোপগুলোর পেছনে চলে এল মিলার্ড। আউট-লদের চোখে না পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছে গেল ওদের ঘোড়াগুলোর কাছে। মৃদুস্বরে অভয় দেয়ার ফাঁকে ওগুলোর বাঁধন খুলে ফেলল দ্রুত হাতে। কাজ শেষে সিক্সগান হাতে নামল হিমশীতল ঝরনার জলে, এগিয়ে চলল ক্যাম্পের দিকে। দু’পাশের উঁচু দু’পাড় ওকে খানিকটা হলেও কাভার দিচ্ছে।
কথা শোনার মত দূরত্বে পৌঁছে ঝুঁকি নিয়ে তাকাল মিলার্ড। ঝোপের ফাঁক দিয়ে দেখল ওর ঠিক সামনাসামনি কিছুটা দূরে বসে আছে পোকার খেলোয়াড়রা। সবক’জন কমবয়সী। পোড় খাওয়া চেহারার গান ফাইটার। ওদের পেছনে শুয়ে আছে কালো পোশাকধারী, ঘুমাচ্ছে এখনও।
পোকার প্লেয়ারদের একজন বলল, ‘আর ভাল লাগছে না, হবে কখন?’
‘এত চিন্তার কী আছে, ডারবি,’ বলল আরেকজন। ‘লোকোর ওপর ভরসা রাখো। প্রোগ্রেসে আমাদের কেউ ঠেকাতে পারবে না।’
।কিছুক্ষণের জন্য পোকার খেলায় ডুবে গেল সবাই। কথাবার্তা বন্ধ। কিন্তু চারপাশ নীরব নয়, দূরাগত মেঘ গর্জনের মত নাক ডাকাচ্ছে বিগ জিম ম্যাকেনলি।
‘অসহ্য,’ ঘোঁত করে উঠল ডারবি। ‘একদিন আমি ওই বুড়ো গাধাটার মুখের মধ্যে বুটজুতো পুরে দেব। বুঝতেই পারছি না এটাকে কেন আমরা সঙ্গে বয়ে বেড়াচ্ছি।’
‘ও আশপাশের পুরো এলাকা ভালমত চেনে,’ ভারিক্কি চেহারায় একজন বলল, ‘আমি শুনেছি বুড়ো নাকি একসময় নিজের দল নিয়ে ঘুরে বেড়াত এদিকেই।’
হাসির রোল উঠল আউট-লদের মাঝে। কিছুক্ষণ পর সামলে নিয়ে ডারবি বলল, ‘ভাবতে পারো ওই বুড়ো গাধা কোনও দলের নেতা ছিল? আমার মনে হয় বাচ্চাদের হাত থেকে ললিপপ কেড়ে নিয়ে পুরো টেরিটোরিতে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল ওরা!’
ঝরনার পাড়ে উবু হয়ে শুয়ে আছে জো মিলার্ড। হাঁ হয়ে গেছে ওর মুখ, মনে সন্দেহ খেলা করছে। না বোধহয়, ওরা জিম ম্যাকেনলির ব্যাপারে কথা বলছে না, ভাবছে সে। পেরিয়ে যাওয়া দীর্ঘ বছরগুলো কি আউট-লর সম্মান কমিয়ে দিয়েছে, এমন হতে পারে? তাই যদি হয় তা হলে কি প্রোগ্রেসের লোকজনের কাছে ওর গ্রহণযোগ্যতাও এই সমান? হয়তো গোঁয়ার বলে এতদিন বুঝতে পারেনি ও নিজে। হয়তো সত্যি যুক্তিসঙ্গত কারণেই ওকে সরিয়ে তরুণ ডেপুটিকে মার্শাল করেছে মেয়র! সামনে দুঃসময় আসছে, মনের দ্বিধাদ্বন্দ্বের জবাব পেয়ে যাবে ও, ভাবল মিলার্ড।
আউট-লদের ঘোড়াগুলোর কাছে ঝোপের পাশে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে বিশালাকারের গ্র্যানিট বোল্ডার। বরফ আর ঝড়ের ক্রমাগত আক্রমণে উঁচু রিজ থেকে খসে ওখানে পড়েছে ওগুলো। দু’বার পাথর লক্ষ্য করে আগুন ঝরাল মিলার্ডের কোল্ট। জোরাল গর্জন আর আউট-লদের বিস্মিত চিৎকারের মধ্যেও ও শুনতে পেল পাথরে বুলেট আঘাত করার শব্দ। ভয়ঙ্কর আওয়াজে ভয় পেয়ে হ্রেষাধ্বনি করল ঘোড়াগুলো, উন্মত্ত হয়ে ক্যাম্পের দিকে ছুটে এল সবদিক থেকে। জান বাঁচাতে পালাতে শুরু করল আউট-লরা, মুখ খিস্তি করছে প্রাণ খুলে। জো মিলার্ডের বাবা শুনলে কবরে উঠে বসত।
শুধু ক্যাম্প ছেড়ে যায়নি বিগ জিম ম্যাকেনলি। ঘুম থেকে আচমকা উঠে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। মাথা ঝাঁকিয়ে ম্যাকেনলি উঠে বসতেই ক্রীক থেকে দৌড়ে ঝোপের মাঝ দিয়ে বেরিয়ে এল মিলার্ড। শরীরের নিচের অংশ থেকে পানি ঝরছে তার, সিক্সগানের নল ঠেসে ধরল ম্যাকেনলির পিঠে
‘ঠিক আছে, ম্যাকেনলি! হাত তুলে উঠে দাঁড়াও দেখি। দাঁড়াও! দাঁড়াও!’
কাঁধের পেশি শক্ত হয়ে গেল ম্যাকেনলির, এক মুহূর্ত পর মাথার ওপর দু’হাত তুলল সে। আউট-ল উঠে দাঁড়িয়েছে এমন সময় পেছনে পায়ের ক্ষীণ শব্দ পেল মিলার্ড। ঘুরে তাকাতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। মাথায় রাইফেলের বাঁটের আঘাতে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
‘ডারবি! আমি ভেবেছিলাম বাকিদের মত তুমিও ভেগেছ,’ জ্ঞান ফেরার পর অনেকদূর থেকে কথাগুলো শুনতে পেল বলে মনে হলো মিলার্ডের। গুঙিয়ে উঠে চোখ খুলে দেখল ওর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে লোক দু’জন। কমবয়সী লোকটাই ডারবি, বুঝতে অসুবিধা হলো না। ওর সিক্সগান তুলে নিয়েছে লোকটা, হৃৎপিণ্ডে লক্ষ্যস্থির করে অলস ভঙ্গিতে ধরে রেখেছে।
অন্যজনের দিকে তাকাল মিলার্ড। প্রথমদর্শনে অপরিচিত মনে হলো। কয়েক সেকেণ্ড এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর বয়স্ক লোকটার চেহারার সঙ্গে ওয়ান্টেড পোস্টারের ম্যাকেনলির মিল খুঁজে পেল। অনেকগুলো বসন্ত ওর চেহারা পাল্টে দিয়েছে, আগের মত আর সুদর্শন নেই ম্যাকেনলি।
‘ম্যাকেনলি,’ ফিসফিস করে বলল মিলার্ড, ‘বিগ জিম ম্যাকেনলি।’
বিস্ফারিত চোখে ওকে কয়েক মুহূর্ত দেখল ম্যাকেনলি, তারপর বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘মিলার্ড!’
‘তুমি একে চেনো?’ জানতে চাইল ডারবি।
‘হ্যাঁ, ভাল মত চিনি। মার্শাল জো মিলার্ড। ‘মার্শাল? এই বুড়ো হাবড়া?’
মিলার্ড আর ম্যাকেনলি দু’জনেই একদৃষ্টিতে তরুণ পাঙ্কের দিকে তাকাল। মাথার ফোলা জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে উঠে দাঁড়াল মিলার্ড সাবধানী ভঙ্গিতে। ওর অভিজ্ঞ চোখে ডারবির ভয় মেশানো অস্বস্তি চাপা থাকেনি। জানে, চমকে গেলে বিনা দ্বিধায় গুলি করবে ছোকরা।
ঘোড়া ধরে আউট-লরা ক্যাম্পে ফিরতে শুরু করেছে। আবার ঝোপের গায়ে বাঁধা হচ্ছে জন্তুগুলোকে। ওদের সামনে এসে ঘোড়া থেকে নামল রোগা- লম্বা একটা লোক। চেহারায় হিংস্রতা, বাজ পাখির ঠোঁটের মত বাঁকানো নাক। সরু ঠোঁট দুটো এত চেপে বসেছে যে আছে বলে মনেই হয় না। উরুতে নিচু করে দুটো সিক্সগান বেঁধেছে। ক্রস ড্রয়ের সুবিধে হবে সেজন্য বাঁট সামনের দিকে।
‘তুমিই গুলি করেছ?’ মিলার্ডের সামনে এসে জানতে চাইল সে।
জবাব না দিয়ে বিতৃষ্ণা মাখা চেহারায় তাকিয়ে থাকল মিলার্ড। এক ঝটকায় ডানদিকের সিক্সগান বের করে হ্যামার ওঠাল তরুণ আউট-ল, মিলার্ডের কপালে তাক করল। হিসহিস করে বলল, ‘আমি একটা প্রশ্ন করেছি, বুড়ো শকুন।’
‘হ্যাঁ, ও-ই গুলি করেছে, লোকো, তড়িঘড়ি করে বলল ম্যাকেনলি। ‘আমার খোঁজে এখানে এসেছে।’
হাসি হাসি চেহারায় ম্যাকেনলিকে দেখল লোকো। ‘আচ্ছা, তোমার জন্য এসেছে?’ মিলার্ডের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘কেন এসেছ, আরেক বুড়ো শকুনের রক্তের লোভে?’
মাঝখান থেকে ডারবি কথা বলে উঠল। ‘ম্যাকেনলি বলছে লোকটা ‘মার্শাল।’
কয়েক মুহূর্ত মিলার্ডকে চোখ সরু করে দেখল লোকো। তারপর অবিশ্বাসের হাসি হাসল। ‘দেখে তো মনে হয় না এ লোক মার্শাল। বেশি বুড়ো।’
‘এই লোক জো মিলার্ড,’ জোর দিয়ে বলে গুরুত্ব বোঝাতে চাইল ম্যাকেনলি।
‘জো মিলার্ড তো কী হয়েছে, সে কী এমন?’ নামটা পরিচিত নয় লোকোর। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল ম্যাকেনলি। চোয়াল ঝুলে পড়েছে, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না মার্শালকে লোকো চেনে না। লোকোর গলা আরও চড়ল, ‘আমি জানতে চাইছি জো মিলাৰ্ড তো কী হয়েছে!’
‘আশ্চর্য!’ বিড়বিড় করে বলে অবিশ্বাস ভরে মাথা ঝাঁকাল ম্যাকেনলি, ‘মিসিসিপির এপাড়ে ওর চেয়ে নামী মার্শাল আর নেই।’
মিলার্ডকে দেখল লোকো। টিটকারির হাসিতে বেঁকে গেছে ঠোঁট। ‘বাহ্, তো খুব নামকরা মার্শাল, না? তোমাকে দেখে বুটের মধ্যে গোড়ালি কাঁপছে আমার। কোন্ শহরের মার্শাল তুমি, মিস্টার নামী মার্শাল?’
মিলার্ড জবাব দেয়ার আগেই দ্রুত কথা বলে উঠল ম্যাকেনলি, ‘মিলার্ড ফর্কস রিভারের পারগেটরি শহরের মার্শাল।’ মিলার্ড ভুল তথ্য শুধরে দেয়ার জন্য হাঁ করেও চুপ হয়ে গেল, কথা বলল না। ম্যাকেনলি জানতে চাইল, ‘তুমি এখনও পারগেটরির মার্শাল আছ; তাই না?’
বুড়ো আউট-লয়ের চোখের দৃষ্টিতে সতর্ক হওয়ার আবেদন ফুটে উঠেছে। ঢোক গিলে মাথা ঝাঁকাল মিলার্ড। ‘হ্যাঁ, আমি এখনও পারগেটরির মার্শাল, ম্যাকেনলি।’
‘পারগেটরি?’ হাসিতে ঠোঁটের দু’কোণ বেঁকে গেল লোকোর। ‘টেরিটোরির বাইরে চলে এসেছ, পারগেটরি এখান থেকে এক দেড়শো মাইল দূরে।’ চোখ সরু হয়ে গেল তার। মিলার্ডের জ্যাকেট হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে হাতড়ে দেখল। ‘তোমার ব্যাজ কই?’
‘এ বোধহয় আণ্ডারওয়্যারের সামনের দিকে ব্যাজ পরে,’ বলল আউট- লদের একজন। হাসির রোল উঠল সবার মাঝে। চেহারা গম্ভীর থাকল শুধু মিলার্ড আর ম্যাকেনলির।
‘পথে কোথাও খসে পড়েছে,’ রাগ দমিয়ে সংযত স্বরে বলল মিলার্ড।
‘আহা-হা,’ জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করল লোকো। ‘আমাদের নামী মার্শাল তার দামী ব্যাজ হারিয়ে ফেলেছে।’ সবার ওপর চোখ বুলিয়ে সে নির্দেশ দিল, ‘স্যাডল চাপাও সবাই। প্ল্যান বদলেছি আমি, কালকের বদলে আজই আমরা প্রোগ্রেসে ঢুকব।’
খুশির হুল্লোড় তুলে ঘোড়ার দিকে দৌড় দিল আউট-লরা। মাথা ঝাঁকিয়ে মিলার্ডকে দেখাল ম্যাকেনলি। ‘এর কী হবে?’
শ্রাগ করল লোকো, ঘোড়ার মুখ ফেরানোর আগে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘গুলি করে মেরে ফেলো।’
‘বিনা কারণে কাউকে খুন করতে পারব না আমি,’ প্রতিবাদ জানাল ম্যাকেনলি।
‘তা হলে এখানে বসে ওকে পাহারা দাও। তোমাকে সঙ্গে না নিলে কাজে আমাদের সুবিধা হবে, উটকো ঝামেলার সম্ভাবনা কম।’
‘এক মিনিট, লোকো, তুমি আর আমি চুক্তি করেছিলাম যে…’
লোকোর সরু চেহারা কঠিন দেখাল। ‘তোমাকে কেউ আটকে রাখেনি, ম্যাকেনলি। সঙ্গে আসতে চাইলে তোমার নামী মার্শালের মাথায় একটা গুলি ঢুকিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বসো। আর কাজটা করার সাহস যদি না থাকে, এখানে বসে থাকো ওর সঙ্গে। তুমি সঙ্গে আছ কি নেই তাতে কিছুই যায় আসে না আমার।’
ম্যাকেনলির জবাবের তোয়াক্কা না করে ঘোড়া ছুটিয়ে রিজের ওপরে গিয়ে উঠল লোকো। পেছন পেছন ছুটল তার দলবল। রাগে টকটকে লাল চেহারায় মিলার্ডের দিকে তাকাল ম্যাকেনলি, গম্ভীর স্বরে বলল, ‘আমার উচিত তোমার গোবর ভরা মাথাটা উড়িয়ে দেয়া।’
দুঃখিত চেহারায় মাথা নাড়ল মিলার্ড, বলল, ‘নিজের চোখে না দেখলে কোনদিন বিশ্বাস করতাম না।’
‘বাজে কথা রাখো,’ ধমকে উঠল ম্যাকেনলি, ‘আমিই এখনও ওই দলের নেতা, লোকো শুধু আমার হয়ে চালাচ্ছে।’
‘হ্যাঁ, তাই তো দেখলাম এতক্ষণ।’
‘যাও, ওই গাছের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসো গিয়ে। তোমার বকবক করা কুৎসিত মুখটা বন্ধ রাখবে,’ অসন্তোষ মেশানো গলায় বলল ম্যাকেনলি। মিলার্ড পাইন গাছে ঠেস দিয়ে বসার পর আনমনে বলল, ‘কী করি?’
‘কী আর করবে, করার কিছু নেই,’ দুঃখিত চেহারায় মাথা চুলকাল মিলার্ড, নড়েচড়ে বসল। ‘জীবনে কোনদিন ভাবতে পারিনি বিগ জিম ম্যাকেনলির চামড়া আমার চোখের সামনে ছাড়াবে কোনও পাঙ্ক, আর তা দেখার সুযোগ হবে আমার।’
‘চামড়া ছাড়িয়েছে মানে?’ চোখ সরু হয়ে গেল ম্যাকেনলির। ‘ভেবে দেখো বোকা কে বনেছে। দিনের আলোয় খুব তো বীরের মত ঢুকেছিলে ক্যাম্পে। এখন? দু’পা এগোও, খুলি ফেটে যাবে।’
‘হুঁহ্! আমার ওপর থেকে দু’মিনিটের জন্য সিক্সগান সরাও, দেখি কে কার খুলি ফাটায়।’
‘উঁহু, এতদিন পরেও তোমার বুদ্ধি হয়নি,’ হাসল ম্যাকেনলি দাঁতের ফাঁকে। হ্যামার উঠিয়ে বলল, ‘আবার যদি নড়েছ, তোমার লাজুক মেয়েলি চেহারা এক গুলিতে চুরমার করে দেব।’
‘চোখের সামনে একটা বুড়ো ছ্যাচড়াকে দেখে লজ্জা পাচ্ছি আমি,’ গম্ভীর গলায় বলল মিলার্ড। রাগে ওর চেহারা কালো হয়ে গেছে। ‘দু’মিনিট আগে কথা দিয়ে যে লোক রাখে না তাকে দেখে সবাই লজ্জা পায়, সেজন্য মেয়ে হতে হয় না।’
এবার রাগে লাল হয়ে ওঠার পালা ম্যাকেনলির। দাঁত খিঁচিয়ে সে বলল, ‘আমি তোমাকে কথা দিইনি।’
‘কথা দিতে তুমি শেখোনি, তোমাকে কেউ শেখায়নি।’ পাল্টা চেঁচাল মিলার্ড।
‘একশোবার আমি কথা দিয়েছি,’ আরও জোরে চেঁচাল ম্যাকেনলি।
‘তুমি কথা দিয়েছিলে কোনও চালাকি করবে না। তারপর যেই আমি একটু পেছন ফিরেছি অমনি আমার মাথা ফাটিয়ে পালিয়েছ তুমি। একেবারে মুক্ত বিহঙ্গ!’
‘তো আর কী করতাম? তোমার সঙ্গে গিয়ে বিশ বছরের জন্য জেলে পচে মরা উচিত ছিল?’
‘আমি ভেবেছিলাম কথা দিলে রাখার মত কোমরের জোর আছে তোমার।’
‘আমি কথা বলেছি, কথা দিইনি।’
‘দুটোর মধ্যে কী ঘোড়ার তফাৎটা আছে?’
‘আমি কথা সবার সঙ্গেই বলি, প্যাচে পড়ে বাঁচার আশা দেখলেই বলি। কিন্তু দুনিয়ার কেউ বলতে পারবে না বিগ জিম ম্যাকেনলি কথা দিয়ে কথা রাখেনি। কথা দিলে শত্রু হোক, বন্ধু হোক, মেনে চলতেই হবে।’
পুরো এক মিনিট চুপ করে থাকল মিলার্ড আউট-লর আবেগ উপলব্ধি করে। তারপর নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে হঠাৎ পারগেটরির মার্শাল বানানোর ব্যাপারটা কী?’
‘আগেও মনে হয়েছিল, এখন বুঝলাম হ্যাট রাখার কাজ ছাড়া আর কোনও কাজে তুমি মাথা ব্যবহার করো না। সহজ ব্যাপারটাও বুঝতে পারোনি? কালকে প্রোগ্রেস থেকে ছেলেরা এক লক্ষ ডলার সরাবে। সবাই উত্তেজিত হয়ে আছে। আমি যদি লোকোকে বলতাম তুমি প্রোগ্রেসের মার্শাল, সঙ্গে সঙ্গে খুন হয়ে যেতে।’
চিন্তিত চেহারায় ম্যাকেনলিকে দেখল মিলার্ড। ‘কখনও মনে হয়নি আমি মরলে অখুশি হবে তুমি।’
চোখ সরিয়ে নিল ম্যাকেনলি। ‘অনর্থক খুন আমি পছন্দ করি না।’ মিলার্ডকে উঠে দাঁড়াতে দেখে পেশি শক্ত হয়ে গেল ওর, সিক্সগান তাক করে জানতে চাইল, ‘অনুমতি ছাড়া কোথায় যাচ্ছ?’
‘পানি খাব।’
মিলার্ডকে বসতে ইশারা করে ঘোড়ার স্যাডল থেকে ক্যান্টিন খুলে নিয়ে এল ম্যাকেনলি। ছিপি খুলে লম্বা চুমুক দিয়ে মিলার্ডের দিকে বাড়িয়ে ধরল। বলল, ‘এত বছর ধরে আমার পেছনে লেগে আছ কেন? আমার মনে হয় না কোনও লম্যানের স্মৃতিতে এত বছর জুড়ে বসে থাকার ক্ষমতা আছে আর কোনও আউট-লর।’
‘কে বলেছে আমি তোমাকে খুঁজতে এসেছি?’ এক ঢোক পানি গিলে বলল মিলার্ড। ‘আমি এখানে জ্যাক র্যাবিট শিকারে এসেছিলাম। রিজের ওপরে ওঠার পর ভাগ্যচক্রে ক্যাম্প দেখে ফেলেছি। বুঝলাম অস্বাভাবিক কোনও উদ্দেশ্যে এখানে হাজির হয়েছ তোমরা, তাই দেখতে এলাম।’
ম্যাকেনলির চেহারায় পরিবর্তন দেখে মিলার্ড বুঝল ওর মিথ্যে বিশ্বাস করেছে আউট-ল। জয়ের আনন্দ মিলিয়ে গিয়ে হঠাৎ লজ্জা লাগল মিলার্ডের। জেনে বুঝে কারও আত্মসম্মানে আঘাত দেয়া ঠিক নয়। বলল, ‘আসলে আমি শুনেছিলাম কয়েক বছর আগে মারা গেছ তুমি। স্বস্তির শ্বাস ফেলে তোমাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি। তোমার খোঁজে এখানে আসিনি, কারণ আমি জানতাম তুমি শয়তানের সঙ্গে আকাশে বসে বৈঠক করছ।’