ধাইমা – অনুবাদক: ক্ষিতীশ রায়

ধাইমা

ঝিয়ের হাত থেকে চিঠিটা ছিনিয়ে নিয়ে সিনোরা মানফ্রনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বাঁচা গেল।’ রোম থেকে কবে চিঠি এসে পৌঁছবে তারই দিন গুনছিলেন। এন্নিয়ো মোরিকে উনি বলে দিয়েছিলেন এরসিলিয়ার ছেলেপুলে হলেই যেন সব খবর দিয়ে চিঠি লেখে। এ সেই চিঠি।

তাড়াতাড়ি পাঁশনেটা পরে তিনি চিঠি পড়তে শুরু করলেন। জামাই টেলিগ্রাম করে আগেই জানিয়েছিল যে মেয়ে খুব কষ্ট পেয়েছে, যদিও ভয়ের কোনও কারণ ছিল না। এখন চিঠি পড়েই বোঝা গেল সত্যিই বিপদের সম্ভাবনা ঘটেছিল; এমনকী শেষ পর্যন্ত ধাত্রীবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ একজন ডাক্তারও ডাকতে হয়েছিল। মোরি আরও লিখেছে যে পাছে শ্বশুর-শাশুড়ির ভাবনা বাড়ে তাই আগে সব কথা সে জানায়নি। এখন অবশ্য অন্য কথা, কারণ ভালয়-মন্দয় ব্যাপারটা তো চুকেই গেছে। অনুযোগ করেছে যে এরসিলিয়া ওর কথা না মেনে চলাতেই এমন হল। মোরি বারণ করা সত্ত্বেও একেবারে শেষদিন পর্যন্ত আঁট-সাঁট জামা আর হিল-তোলা জুতো পরতে সে ছাড়েনি।

‘কী কথাই লিখেছে, হিল-তোলা জুতো পরতে ছাড়েনি, নিরেট মুখ্যু কোথাকার।’ যত চিঠি পড়েন সিনোরার তত বিরক্তি বাড়ে। কটমট করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখেন। হাতের কাছে কাউকে পেলে যেন মনের ঝাল মিটিয়ে নেন।

‘বোকাটা কী লিখেছে দেখো। খোকার ধাইমা রোমের লোক হলে চলবে না। কেন রে বাপু রোমের লোক কী দোষ করল? মাইনে বেশি চাইবে, এই তো। লোকটা হাড়কিপটে। ভাল মাইনে দিয়ে ভাল ধাই রাখবার বেলায় যত টানাটানি, এদিকে আবার সোশ্যালিস্ট! পণের টাকাটি তো হাত পেতে দিব্যি গুনে নিয়েছিল। ছি ছি ছি, এরসিলিয়ার কপালে এতও ছিল! সিসিলি থেকে একটা গেঁয়ো ভূত যাবে ওর ছেলেকে বুকের দুধ দিয়ে মানুষ করতে। তাকে নিয়ে ও বেচারি রোমের রাস্তায় বেরুবে কোন লজ্জায়? চাষাড়ে মেয়েকে য়ুনিফর্ম পরিয়ে দিলেই তো আর নার্স হয় না। যা নোংরা, দশবিশ করে আছড়ে কাচলেও গায়ের ময়লা যায় না। মুখ্যু কোথাকার! আহাম্মক!’

‘ওগো টেবিল লাগানো হয়নি কেন? আজ খেতে-টেতে দেবে না নাকি?’

সিনোর মানফ্রনি এসে ঢুকলেন। এ নালিশটা তাঁর প্রাত্যহিক। এইমাত্র দাসী ও রাঁধুনিকে বকে এসেছেন।

‘সব কিছুতে এত মেজাজ দেখাও কেন বলো তো? জানোই তো তোমার এ বাড়িতে কাজের কখনও কামাই নেই।’

‘বটে, বেশ আছ যা হোক। বলি আমার কাজটা ভেবে দেখেছ।’

‘খাবার যতক্ষণ না আসছে ততক্ষণ তোমার ওই সাধের জামাই-বাবাজির চিঠিটা পড়ে সময় কাটাতে পারো।’

‘এরসিলিয়ার কথা লিখেছে বুঝি?’

‘পড়েই দেখো না।’

সিনোর মানফ্রনি ক্ষণে রুষ্ট, ক্ষণে তুষ্ট। দিব্যি খাবারের কথা ভুলে গিয়ে চিঠি পড়তে শুরু করলেন। পড়া শেষ হল। ভাঁজ করে চিঠিটা খামে পুরতে পুরতে বললেন, ‘বেশ হয়েছে। যেমনটি চাই ঠিক তেমনি একটি ধাই পাওয়া যাবে।’ সিনোর মানফ্রনির প্রায়ই এরকম ‘অনুপ্রেরণা’ আসে। এ যেন হঠাৎ আলোর ঝলকানি— ওঁর নিজের চোখই ধাঁধিয়ে যায়। ব্যাবসা করে উনি যে প্রচুর জমিয়েছেন ওঁর ধারণা সমস্তই এই প্রেরণালব্ধ। একটু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে সিনোরা বললেন, ‘সে লোকটি কে শুনি?’

‘তিত্তা মারুল্লোর বউ।’

‘তিত্তার বউ? ওই দাগী চোরটার?’

‘চুপ করো।’

‘ওই লোক খ্যাপাবার সর্দারটার বউ?’

‘বাজে বোকো না বলছি।’

‘জেলখানার কয়েদির বউ শেষকালে…’

‘আমায় একটু বুঝিয়ে বলতে দাও তো। মেয়েমানুষের বুদ্ধি আর কত হবে? ভগবান তোমাদের মাথায় মস্তিষ্কের বদলে গোবর পুরে দিয়েছেন। আজকালের সামাজিক ব্যবস্থায়…’

অবাক হয়ে সিনোরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এর মধ্যে আবার সামাজিক অবস্থার কথা এল কী করে?’

‘আসে বই কী, দস্তুরমতো আসে। এই ধরো না, আমরা যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যাকে বলে বুকের রক্ত জল করে দুটো পয়সা জমিয়েছি, আমাদের সামনে এখন কী রয়েছে জানো? একটা অনিশ্চিত সংকটময় ভবিষ্যৎ। মাথায় ঢুকছে কথাটা?’

‘কী যে বলছ তার মাথামুন্ডু নেই।’

‘তা তো বলবেই। সাধে বলি তোমাদের মাথায় গোবর পোরা।’

রাগে গজগজ করতে করতে সিনোর অসহিষ্ণুভাবে একটা চেয়ার টেনে স্ত্রীর চেয়ারের কাছে গিয়ে বসলেন। চাকরেরা পাছে আড়ি পেতে কথা শুনে ফেলে সেই ভয়ে কর্তা গলা নামিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘মারুল্লোকে রুটির কারখানা থেকে তাড়িয়েছিলাম কেন জানো? ওর মাথায় জনজাগরণের ভূত ঢুকেছিল বলে।’

‘ওতে আর তোমার সাধের জামাই মোরিতে কী তফাত বলো তো? তবু মেয়ে দিতে বাধল না তোমার ওই সোশ্যালিস্ট উকিলটার হাতে?’

সিনোর অধীর হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ফের? আমায় দুটো কথা বলতে দেবে কি না? মোরির হাতে মেয়ে দিয়েছি কেন— এই তো? প্রথমত মোরি চমৎকার ছেলে তাই— দ্বিতীয়ত মোরি সোশ্যালিস্ট তাই। বিয়েটা আমার প্ল্যানের সঙ্গে এত সুন্দর খাপ খেয়েছিল বলেই মত দিয়েছিলাম। যেসব মজুরেরা আমার কারখানাগুলোয় কাজ করে তারা আমায় এত খাতির করে কেন জানো? ঘটে বুদ্ধি নেই তো জানবে কেমন করে। যাক গে সেসব কথা— এন্নিয়োর সঙ্গে এ ব্যাপারটির কোনও যোগ নেই। আমি বলছিলাম তিত্তা মারুল্লোর কথা। রুটির কারখানা থেকে দিলুম তো তাকে ছাড়িয়ে। হতভাগা বেকার হয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াল। তারপর যেই না বাড়াবাড়ি শুরু করল— অমনি কয়েদ, তারপর কালাপানি। এখন আমি যে কথা বলতে চাই সে হল এই: আমি বড়লোক সত্যি— কিন্তু আমারও তো হৃদয় বলে একটা পদার্থ আছে। তাই আমি ঠিক করেছি যে মারুল্লোর বউটিকে আনিয়ে নেব একটা থার্ডক্লাস টিকিট কেটে পাঠিয়ে দেব রোমে— সেখানে গিয়ে মেয়েটা আমার নাতির দাসীবৃত্তি করুক।’

সিনোর মানফ্রনি আরও অনেক যুক্তি দিতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ থেমে গেলেন। সিনোরের গালের উপর ছিল অদ্ভুত একটা আঁচিল। স্বামীর অকাট্য যুক্তির কাছে যখনই হার মানবার সম্ভাবনা হয়, তখনই সিনোরা ওই কিম্ভূতকিমাকার আঁচিলটার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। এই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টির নীচে বিবেকবান সিনোরের কথা গুলিয়ে যায়, তিনি বাজে বকতে শুরু করেন। উনি যথাসময়ের অনেক আগেই আলোচনা কমিয়ে ঘণ্টা বাজিয়ে ঝিকে ডাকলেন, ‘লিসিকে বল এখুনি এসে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।’

লিসি একাধারে কোচোয়ান ও চাকর। গায়ে কোট নেই, শার্ট-এর হাতা গুটোনো। লিসি এসে দরজার কাছে দাঁড়াল। কর্তার কাছে তলব পড়লে লিসি দাঁত বের করে হাসে— ওটা তার স্বভাব। ওর বুদ্ধির উপর প্রথম থেকেই সিনোরের কেমন একটা আস্থা জন্মে গেছে।

‘তিত্তা মারুল্লোর বউ কোথায় থাকে জানিস?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ স্যর, বুঝেছি’—লিসি বললে। একটা বোকাটে হাসিতে ওর মুখচোখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

ঠিক সেই মুহূর্তে লিসির বুদ্ধির তারিফ করার মতো অবস্থা সিনোরের ছিল না। ‘কী বুঝলি, হতভাগা?’ তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন।

লিসি এমন একটা সলজ্জ ভঙ্গি করল যেন কর্তা তার পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন। বলল, ‘ওকে গিয়ে বলব হুজুর।’

‘বলগে এখুনি এখানে আসতে, ওর সঙ্গে কথা আছে।’

কিছুক্ষণ পরেই সিনোর তাঁর চাকরের অদ্ভুত তৎপরতার প্রমাণ পেলেন। তিনি ও সিনোরা তখনও খাওয়া শেষ করেননি, এমনি সময় খাওয়ার ঘরে একটি মেয়ে এসে ঢুকল। কোলে তার দু’মাসের শিশু। এ আর কেউ নয়— তিত্তা মারুল্লোর বউ আন্নিচ্চিয়া।

সিনোরের পায়ের কাছে পড়ে মেয়েটি বলতে লাগল, ‘কর্তাবাবুর দয়ার শরীর। আপনার হাতদু’টি দিন, একবার চুম্বন করি।’ রাঁধুনি আর ঝি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে সব দেখছে। তাদেরই সামনে দাঁড়িয়ে লিসি, মুখে তার আকর্ণবিস্তৃত আহ্লাদের হাসি।

সিনোর মানফ্রনির মুখে দ্বন্দ্বের রেখা ফুটে উঠল। এই হঠাৎ আবির্ভাবে তিনি যেমন অবাক হয়েছেন, বিরক্তও হয়েছেন তেমনি। ভ্রু কুঁচকে তিনি হাত সরিয়ে নিলেন, দরজার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘বেরোও বলছি এখান থেকে। লিসি, তুমি যেয়ো না। এদিকে এসো। একে কী বলেছ বলো দেখি?’

আন্নিচ্চিয়া তখনও হাঁটু ভেঙে বসেই আছে। ‘লিসি বলছিল তিত্তা ফিরে আসছে, আপনি তাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনছেন।’

কথা শুনে সিনোর লাফিয়ে উঠলেন। ‘দাঁড়াও, দেখাচ্ছি রাসকেলটাকে।’

লিসি ততক্ষণে পিটটান দিয়েছে।

করুণভাবে সিনোরার দিকে তাকিয়ে আন্নিচ্চিয়া আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল, বললে, ‘তা হলে কথাটা সত্যি নয়?’

অনেক কষ্টে তাকে বোঝানো গেল যে, সিনোর মানফ্রনির এ বিষয়ে কোনও হাত নেই। ইচ্ছে থাকলেও তিনি তিত্তাকে ছাড়িয়ে আনতে পারেন না। সিনোর ওকে বুঝিয়ে বললেন, ‘দেখো, আমার রুটির কারখানা থেকে তিত্তাকে আমি ছাড়িয়ে দিয়েছি বটে, কিন্তু তুমি তো নিজেই দেখেছ ওর কত অপরাধ আমি মুখ বুজে সয়ে গেছি। সয়েছি কেন? তোমার দিকে তাকিয়ে। ছেলেবেলায় তুমি আমার বাড়িতেই মানুষ হয়েছ। এরসিলিয়ার তুমি খেলার সঙ্গী ছিলে। এ সব কথা কি আমি ভুলতে পারি?’

সিনোর কথা বলছেন, এদিকে সিনোরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আন্নিচ্চিয়াকে পরখ করে দেখছেন। ভাবছেন: হ্যাঁ, ধাইর পোশাকে ওকে মানাবে ভাল, লাল রুমালে সোনালি চুল বাঁধা গায়ে নার্সের উর্দি চড়ানো— বেশ ভালই দেখাবে। উনি যেন কল্পনার চোখে ওর শহুরে সভ্য চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন।

সব কথা শুনে আন্নিচ্চিয়া যেন আকাশ থেকে পড়ল। নিজের শিশুটিকে ওদের চোখের সামনে ধরে বলল, ‘আমার খোকা— তার কী হবে? তাকে কে দেখবে?’

শিশুটিকে বুকে চেপে বেচারি আবার কাঁদতে শুরু করলে। ‘বাছা আমার, লুৎসি রে, তোর বাবা আর ফিরে আসচে না।’ জলভরা চোখে সিনোরার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘ওর বাবা ওকে দেখেইনি, আমাদের খোকন সোনাকে দেখেইনি।’

‘এরসিলিয়া তোকে যে মাইনে দেবে তাই থেকে কিছু খরচ করলে তোর ছেলেকে দেখবার লোক ঢের মিলবে।’

‘সিনোরা এরসিলিয়ার কাছে আমি তো খুশি হয়েই যেতাম, কিন্তু— যে অনেক দূর— সেই রোম!’

সিনোর মানফ্রনি বলে উঠলেন, ‘দূর আবার কী রে! এ হল রেল স্টিমারের যুগ। গাড়িতে চেপে বসলেই হল, দেখতে দেখতে রোমে পৌঁছে যাবি।’

আন্নিচ্চিয়া বললে, ‘আজ্ঞে সে তো ঠিকই। আমি পাড়াগেঁয়ে মুখ্যু মেয়েমানুষ। কী জানি, কোথায় পথ হারিয়ে ফেলব। গাঁ ছেড়ে কোনও দিন এক পা বেরুইনি। আর তা ছাড়া কত্তা তো জানেন আমি আর আমার শাশুড়ি এক বাড়িতে থাকি। বেচারা বুড়ো মানুষ, তাকে একা ফেলে যাই কী করে? তিত্তা বারেবারে বলে গেছে আমি যেন ওর মা-র দেখাশুনো করি। কী কষ্টে যে থাকি কী বলব? এদিকে আমার এই খোকা, ওদিকে সত্তর বছরের ওই থুত্থুড়ে বুড়ি। কিছুদিন ধরেই ভাবছি, কারু হাতে ছেলেটার ভার দিয়ে কোথাও একটা কাজে লাগি। অভাবের সংসার; এটা ওটা বিক্রি করে কোনওমতে চালাচ্ছি। এভাবে চললে কিছুদিন পর আর কুটোটিও থাকবে না। বিয়ের সময় তিত্তা কত সাধ করে ঘর সাজিয়েছিল। এমন কিছু দামি জিনিস নয় কিন্তু শখের জিনিস তো। ফিরে এসে ও যখন দেখবে বাড়িঘর একদম ফাঁকা, আমি তখন ওকে কী বলব? কিন্তু বুড়ি কি আমাকে কাজ করতে দেবে? ওর যা দেমাক, চাকরির কথা কানেই তুলবে না। তবে সিনোরা এরসিলিয়ার কাজে যদি লাগি… আচ্ছা, এক কাজ করা যাক, শাশুড়িকে একবার বলে দেখি।’

‘কিন্তু জবাবটা জরুরি চাই। কালকের মধ্যেই রওয়ানা হতে হবে।’

আন্নিচ্চিয়া বড় ফাঁপরে পড়ল। ‘কালকেই? আচ্ছা যেতে পারব কি পারব না কালকেই জানাব।’ এই বলে চলে গেল।

কাছেই একটা গলিতে ওরা থাকে। ইতিমধ্যে লিসির কল্যাণে মিথ্যে গুজব পাড়াময় রাষ্ট্র হয়ে গেছে যে তিত্তা ছাড়া পেয়েছে। তিত্তার বুড়িমা তাদের ছোট্ট একতলা বাড়িটার এক কোনায় শীতে জড়সড় হয়ে আগুন পোয়াচ্ছে। পাড়ার মেয়েরা তার চারদিকে ভিড় করে এসে দাঁড়াল। সবাই একবাক্যে সিনোর মানফ্রনির গুণ গাইতে শুরু করে দিল। ‘কী তাঁর দয়ার শরীর।’ বুড়ির মাথাটা বুকের উপর ঝুঁকে পড়েছে। মাঝে মাঝে এক-আধবার হুঁ-হাঁ শব্দ করছে সেটা খুশিতে না বিরক্তিতে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। চোখে কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টি।

ইতিমধ্যে আন্নিচ্চিয়া এসে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছে। ওর কাছে সব কথা শোনার পর সিনোরের গুণগান এক মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেল। বুড়ি এবার মুখ তুলে পড়শিদের দিকে তাকাল। চোখে তার কী তীব্র ঘৃণার দৃষ্টি। মানফ্রনি কী প্রস্তাব করেছে শুনে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। বউকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী জবাব দিলি?’

আন্নিচ্চিয়া কাতর দৃষ্টিতে পড়শিদের দিকে তাকাল। ভাবখানা এই— তোমরা ভাই, বুড়িকে বুঝিয়ে বলো, এ কাজটা ছাড়া আমার পক্ষে উচিত হবে না।

শাশুড়ির কথার উত্তরে বলল, ‘আমি বলেছি তোমাকে জিজ্ঞেস করে জানাব।’

বুড়ি রেগে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওসব হবে না, কিছুতে হবে না বলে দিচ্ছি।’

আর-একবার অনুনয়ের দৃষ্টিতে পড়শিদের দিকে তাকিয়ে আন্নিচ্চিয়া বলল, ‘আমি তো চাইনে যেতে, কিন্তু’…

এবার দু’-একজন এসে বুড়িকে বোঝাতে লাগল— বউ যদি এ সুযোগ ছাড়ে তবে বড় বোকামি হবে। কাজটা নিলে তিনটি প্রাণীরই একটা হিল্লে হয়।

ওদের মধ্যে একজন এসেছিল কোলে ছেলে নিয়ে। ছেলেকে মাই দিতে দিতে সে বলে উঠল, ‘তুই কিছু ভাবিসনি, তোর ছেলেকে আমি দেখব। এই দেখ…’ বলে ছেলেটার মুখ থেকে বোঁটাটা খুলে মাই উঁচু করে ধরে টিপল। ফিনকি দিয়ে দুধের ফোয়ারা মুখে-চোখে এসে পড়তে লাগল। কাণ্ড দেখে সবাই হেসে গড়াগড়ি।

কিন্তু বুড়ি সহজে টলবার পাত্র নয়। পড়শিদের কারুর কথায় কান দিল না। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বউকে বলল, ‘যাস তো আমার মাথা খাস। আমার কথা না শুনিস তো ভাল হবে না বলে রাখছি। আমার শাপে তোর সর্বনাশ হবে।’

এন্নিয়ো মোরি এসেছে স্টেশনে— নেপলস-এর ট্রেন আসতে দেরি নেই। মোরি লোকটা বেঁটে, কাঁধ দুটো উঁচু— রোগা শরীর। দেখলেই মনে হয় যকৃতের দোষ আছে। শীর্ণ মুখ দাড়িগোঁফে আচ্ছন্ন। অপেক্ষা করতে করতে ওর বিরক্তি ধরে গেছে। ক্রমাগত পাঁশনেটা নাকের উপর সোজা করে বসাবার চেষ্টা করছে। ক্ষণে ক্ষণে পকেট হাতড়াচ্ছে, সবটা মিলিয়ে কেমন একটা অস্থির ভাব। কোট আর ওভার-কোটের পকেটগুলো খবরকাগজে ঠাসা।

একজন রেল কর্মচারীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল: ‘আচ্ছা মশাই, নেপলস-এর ট্রেনটা কখন আসবে বলতে পারেন?’

‘গাড়ি চল্লিশ মিনিট লেট।’

‘বলেন কী, মশাই। হবেই তো, সাধে বলে ইতালিয়ান গাড়ি। যাচ্ছেতাই ব্যাপার।’

এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে শেষ পর্যন্ত সে যেমন-তেমন একটা জায়গায় বসে পড়ল। একটা বেঞ্চিও খালি নেই।

‘শেষকালে কিনা একটা ধাইয়ের খবরদারি করতে হবে। তিনি কখন এসে পৌঁছবেন তার অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে। যাচ্ছেতাই ব্যাপার।’ এরসিলিয়া আজ প্রায় বছর দুই হল রোমে আছে, ওদের বিয়ের পর থেকেই। না চেনে রাস্তাঘাট, না চেনে কিছু। বাড়ির সামান্য জিনিসটুকু কিনতে যাবার সাহস নেই। দু’পা বাইরে বেরুতে গেলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে— ও যেন সিসিলির দেহাত থেকে সবে কাল শহরে এসেছে। ঘরে বসে বসে ওর একমাত্র কাজ মোরিকে গালাগাল দেওয়া। সকাল থেকে শুরু হয়, ঘুমুতে যাবার আগে পর্যন্ত। একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যান সুরে গাল দিচ্ছে তো দিচ্ছেই। ওর গালাগালগুলোর মধ্যে কোনও অর্থ নেই, যুক্তি নেই। এইটাই মোরির কাছে সব চাইতে ক্লান্তিকর। ওর বিরক্তির আর একটা কারণ হল এরসিলিয়ার ঈর্ষা, এ তার প্রেমের ঈর্ষা নয়, নিছক বদমেজাজ।

মোরি বসে বসে ভাবছে, ‘ও মনে করে ওকে ভালবাসি না। কী জন্য বাসব? ইচ্ছে করে ঘেন্না কুড়নো ওর যেন স্বভাব— তাতেই ও আনন্দ পায়। একটা মিষ্টি কথা নয়, একটু আদর না… সারাক্ষণ সন্দেহ! ঝগড়াটে, বিষমুখো! কী দেখেই যে ওকে বিয়ে করেছিলাম, এখন তাই ভাবি। যাচ্ছেতাই ব্যাপার!’

নাকের ডগায় চশমাটা বসিয়ে পকেট থেকে একটা খবরের কাগজ টেনে পড়তে সে শুরু করলে।

এন্নিয়োর সব তাতেই বিরক্তি। বউয়ের সঙ্গে বনে না— কাগজ পড়েও স্বস্তি নেই। এক-একটা খবর পড়ছে আর ক্রমাগত আউড়ে চলেছে, ‘যাচ্ছেতাই ব্যাপার।’ তবু পড়তে ছাড়ে না। রোম, মিলান, নেপলস, তুরিন, ফ্লোরেন্স— এইসব শহরের নামকরা খবরকাগজগুলো সারাক্ষণ ওর পকেটে পকেটে। প্রত্যেকটি কাগজ আগাগোড়া না পড়া পর্যন্ত ওর খাবার হজম হয় না। ও বলে, ‘কাগজ পড়া আমার লিভারের ওষুধ।’ ডাক্তার বলে ঠিক তার উলটো কথা। বসে বসে পড়াশুনো করেই নাকি ওর যকৃতের দোষ হয়েছে। মোরি ভাবে পড়াশুনা ছেড়ে ও যদি দাম্পত্য জীবনের মাধুর্যের মধ্যে ডুবে থাকত তা হলে সেটা ওর লিভারের পক্ষে বড় বেশি ভাল হত না। এরসিলিয়ার সঙ্গে সময় কাটানোর চাইতে খবর কাগজ পড়া অনেক ভাল।

‘হতচ্ছাড়া ট্রেনটা নেপলস থেকে আসবে না কি?’ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তড়াক করে উঠে পড়ল: সর্বনাশ, এক ঘণ্টা উতরে গেছে! ও তাড়াতাড়ি যাত্রীদের বেরুবার গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কোথায় মেয়েটা? বেশ কিছুক্ষণ আগে নিশ্চয় পৌঁছে গেছে —কোথায় গেল? বাড়ির ঠিকানাও তো জানে না।

খুব ভাগ্য বলতে হবে চট করে খুঁজে পাওয়া গেল। লাগেজ ঘরে উঁকি দিতেই দেখে আন্নিচ্চিয়া তার বাক্সটির উপর বসে হাপুসনয়নে কাঁদছে। লাগেজবাবুরা ওকে প্রবোধ দিয়ে বলছেন থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে খবর দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

‘আন্নিচ্চিয়া।’

মোরির গলা শুনে আন্নিচ্চিয়ার ধড়ে যেন প্রাণ এল। আনন্দে অধীর হয়ে কাঁপতে লাগল— প্রায় মোরির ঘাড়ের উপর পড়ে আর কী! ‘আর একটু হলেই একেবারে হারিয়ে যেতাম। ভাগ্যিস জামাইবাবু এসেছিলেন!’

‘শ্বশুরমশাই আমার বাড়ির ঠিকানাটাও তোমাকে বলে দেননি? এক টুকরো কাগজে লিখে দিলেই পারতেন।’

কান্নার ধাক্কাটা সামলে, চোখের জল মুছতে মুছতে আন্নিচ্চিয়া বলল, ‘আমি তো পড়তে জানি না তাই বোধহয় দেননি।’

‘যাচ্ছেতাই ব্যাপার। ঠিকানা হাতে থাকলে যে-কোনও গাড়িওলা তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারত। আমায় কষ্ট করে এতদূর আসতে হত না। কপালে ভোগান্তি ছিল, তা নইলে আর আসি। প্ল্যাটফর্মেই বসে ছিলুম নেপলস-এর গাড়ি কখন এল টেরও পাইনি।’

ঘোড়ার গাড়িতে বসতে বসতে সাবধান করে দিল, ‘খবরদার তোমার এই কান্নাকাটির খবরটা এরসিলিয়া যেন টের না পায়, জানতে পেলে সামান্য ব্যাপার নিয়ে কুরুক্ষেত্র বাধাবে।’

এন্নিয়ো আর একটা খবরের কাগজ বার করে পড়তে শুরু করে দিল। আন্নিচ্চিয়া বেচারি শরীরটাকে যথাসম্ভব সংকুচিত করে কোণ ঘেঁষে বসেছে। মনিবের সঙ্গে একলা এক গাড়িতে পাশাপাশি বসে যাওয়া ওর কাছে অভাবনীয় ব্যাপার। বেচারি লজ্জায় ভয়ে জড়সড়। অবিশ্যি এ ভাবটা শিগগিরই কেটে গেল। নিতান্ত পাড়াগেঁয়ে মেয়ে, দৈনন্দিন জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে কোনও কালে বেরোয়নি। রেলে স্টিমারে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে নানা বিচিত্র ব্যাপার দেখে বেচারি একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়েছে। ওর ভাবনা চিন্তা সব গুলিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত রোমে পৌঁছে ও যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। এখনও থেকে থেকে মনে পড়ছে— সমুদ্রে কী ঢেউ আর রেলগাড়ি কী ছুটটাই না দিল! প্রাণ নিয়ে যে বেঁচে এসেছে চোদ্দো পুরুষের ভাগ্যি। এই এক নতুন রাজ্যে এসেছে। ইচ্ছে হল এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, কিন্তু এত ক্লান্ত, ভাল করে তাকাতেও পারছে না। রোম হল তীর্থস্থান, কত লোক পুণ্যি করতে আসে। জায়গাটা ভাল করে দেখতে হবে। তা অনেকদিন তো থাকব। ঢের সময় পাওয়া যাবে। এখন আর ভাবনা নেই, সঙ্গে চেনা লোক রয়েছেন আর এক্ষুনি তো সিনোরিনার সঙ্গে দেখা হবে। ওর চোখের উপর গাঁয়ের ছবি ভেসে ওঠে— ওর খোকাকে, ওর বুড়ি শাশুড়িকে মনে পড়ে। জোর করে ভাবনাগুলো সরিয়ে দিতে চায়।

প্রথম স্বস্তির মুহূর্তটা ও দুর্ভাবনা দিয়ে ভারাক্রান্ত করতে চায় না।

মোরি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে, ‘জাহাজ যখন নেপলস-এর বন্দরে পৌঁছল, কেউ তোমাকে নিতে এসেছিল?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, একজন বাবু এসেছিলেন। চমৎকার ভদ্রলোক। আপনাকে তাঁর নমস্কার জানাতে আজ্ঞা করেছেন।’

‘আজ্ঞা করেছেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘অনুরোধ করেছেন বলো।’

‘আজ্ঞে আমি সামান্য লোক— আমাকে কি অনুরোধ করতে পারেন?’

এন্নিয়ো অধীর হয়ে খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে লাগল। ওষুধ, পাতা ভরতি ছাইপাঁশ ওষুধের বিজ্ঞাপন।

‘আজ্ঞে আমায় কিছু বলছিলেন?’

‘নাঃ, ও কিছু নয়।’

আন্নিচ্চিয়া একটু অবাক হয়ে গেল। ‘প্যালার্মোতেও এক ভদ্রলোক এসেছিলেন স্টেশনে আমাকে স্টিমার অবধি পৌঁছে দিতে। চমৎকার মানুষ!’

‘তিনিও আমাকে নমস্কার জানাতে আজ্ঞা করেছিলেন নাকি?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।

মোরি খবরের কাগজটা নামিয়ে পাঁশনেটা নাকের উপর বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার স্বামী? তার খবর কী?’

আন্নিচ্চিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললে, ‘এখনও ছাড়া পায়নি। সেই কালাপানিতেই আছে। আপনি তো রোমে থাকেন— আপনি যদি রাজাকে…’

মোরি বাধা দিয়ে বললে, ‘ওসব রাজা-বাদশার কথা আমার কাছে বোলো না।’

আন্নিচ্চিয়া অনুনয়ের সুরে বললে, ‘আপনি রাজাকে দু’কথা বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

মোরি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল, খবরের কাগজটা মুচড়ে জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল, ‘যাচ্ছেতাই ব্যাপার! তুমি ভেবেছ তোমার সাধের স্বামীটিকেই শুধু দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়েছে! কাকে যে কখন পাঠায় তার ঠিক নেই। একদিন আমাকেই হয়তো পাঠাবে।’

আন্নিচ্চিয়া অবাক হয়ে গেল, কথাটা তার বিশ্বাস হল না। ‘সেখানে ভদ্দরলোকদেরও পাঠায় নাকি?’

ওর অজ্ঞতা মোরির অসহ্য মনে হয়। চেঁচিয়ে ওঠে, ‘তুমি চুপ করো তো!’ মনে মনে ভাবে সিসিলিতে দাস মনোভাব এমন মজ্জাগত যে ওখানকার ছোটলোকদের মধ্যে আত্মসম্মান জাগানো অসাধ্য ব্যাপার। ওর মনটা দমে যায়।

গাড়ি ভিয়া সিসটিনায় মোরির বাড়ির দরজায় এসে থামল।

প্রকাণ্ড খাট, উপরে লাল রঙের চাঁদোয়া খাটানো। লেস লাগানো বালিশের উপর গা এলিয়ে— এরসিলিয়া শুয়ে আছে। ওর রং যেন কালি হয়ে গেছে— প্রসবের পর ক্লান্ত শীর্ণ চেহারা।

আন্নিচ্চিয়া ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল।

‘সিনোরিনা, সিনোরিনা, এই তো আমি এসে গেছি। এত শিগগির তোমার কাছে চলে আসতে পারব স্বপ্নেও ভাবিনি। এখন কেমন আছ? খুব কষ্ট হয়েছে না? কী রোগাই হয়ে গেছ! চেনা যায় না। কী করবে বলো, সবই ভগবানের ইচ্ছা। মেয়েদের কপালে দুঃখ লিখেছেন, রেহাই পাবে কী করে?’

‘ছাইপাঁশ বকিসনে। সব শেয়ালের এক রা। মেয়ে হয়ে জন্মেছি কাজেই দুঃখ পেতে হবে। অদৃষ্টের দোহাই দিতে দিতে কী দশা হয়েছে দেখতে পাস না? পুরুষগুলো ভাবে তাঁরা হলেন প্রভু আর আমরা তাঁদের বাঁদি। আছি তাঁদের হুকুম তামিল করতে। পান থেকে চুন খসবার জো নেই। সারাক্ষণ ভাবতে হবে কীসে তাঁরা খুশি হন, কীসে তাঁদের আরাম হবে। তাঁরা যে হলেন কত্তা। ঝাঁটা মারো!’

বলাবাহুল্য এন্নিয়োকে লক্ষ্য করেই এসব বাক্যবাণ। সে রেগেমেগে তার খবরের কাগজটি মুড়ে ঘর ছেড়ে পালাল।

আন্নিচ্চিয়া বেচারি অপ্রস্তুত হয়ে বললে, ‘আহা পুরুষদেরও তো দুঃখ কষ্ট আছে।’

‘আহা কী আমার দুঃখ রে— খাও দাও আর ফুর্তি করো। ওদের একটু উচিত শিক্ষা দেওয়া দরকার। যত সব একচোখো’—

‘তা যা বলেছ। ওদের তো আর পেটে ধরতে হয় না।’

‘শুধু কি তাই? সারাজীবন হাড় জ্বালিয়ে মারে। সমস্ত জাতটার ওপর ঘেন্না ধরে গেছে আমার।’

পাশের ঘরে এন্নিয়ো মোরির গলা শোনা গেল, ‘মরুকগে, জাহান্নমে যাক।’

পরমুহূর্তেই শোনা গেল আর একজন কে বলছে, ‘আজ্ঞে এই যে আমি, কী করতে হবে বলুন।’

এরসিলিয়া হো হো করে হেসে উঠল। আন্নিচ্চিয়াকে বললে, ‘আমার এক ঝি আছে। ও কানে খাটো, ভাল শুনতে পায় না। কারু গলার আওয়াজ পেলে ও মনে করে বুঝি ওকে ডাকছে।’ এরসিলিয়া হাঁক দিয়ে ডাকলে, ‘মারগেরিটা।’

কালা বুড়ি ঝিটা মুখ কালো করে দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল। মুখে অপ্রতিভ ভাব, কারণ পাশের ঘর থেকে মোরি চোখ লাল করে ওকে প্রায় তেড়ে এসেছিল।

এরসিলিয়া বললে, ‘মারগেরিটা, এই আমাদের নতুন দাসী, এক্ষুনি এসে পৌঁছল। ওকে ঘর দেখিয়ে দাও তো।’ আন্নিচ্চিয়াকে বললে, ‘যা, চানটান করে আয়। ধোঁয়া কালি মেখে তো ভূত সেজে আছিস।’

আন্নিচ্চিয়া মাথা বাড়িয়ে আরশিতে মুখ দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘বাপরে কী চেহারা হয়েছে!’

রেলের ধোঁয়ায় অমনিতেই ওর মুখ কালচে হয়ে গিয়েছিল, তার উপরে সেই যে স্টেশনে বসে কেঁদেছিল তখন চোখের জল আর কালিতে মিশে মুখে দিব্যি এক পোঁচ রং হয়ে গিয়েছে। কিন্তু চান করতে যাবে কী! তখনও যে সিনোরিনাকে পথের কাহিনি কিচ্ছু বলা হয়নি। ওর আর তর সয় না, তক্ষুনি বলতে হবে। রেলে স্টিমারে কোথায় কী ঘটেছিল হাত পা নেড়ে চেঁচিয়ে আদ্যোপান্ত সব বলতে লাগল। কালা ঝিটা হাঁ করে ওর কাণ্ড দেখছে। ‘বলব কী ভাই, রাস্তায় বুকে দুধ জমে গিয়ে মাই দুটো টনটন করতে লাগল। ফেটে পড়ে আর কী! যন্ত্রণায় আমি কেঁদেই ফেলেছিলাম। গাড়ির সব লোক জিজ্ঞেস করতে লাগল, ব্যাপার কী, কী হয়েছে? আমি কি ছাই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারি? শেষটায় ওরা সব বুঝতে পারলে। তার পরে হল কী জানো? একটা বদ ছোকরা ফস করে বলে উঠল, তা ভাবনা কী, আমি চকচক করে খেয়ে নেবখন। ছোঁড়াটা যেন মজা পেয়ে বসল, হাত বাড়িয়ে দিল আমার বুকের দিকে। আমি তো ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, বললুম, তা হলে আমি গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ব। ভাগ্যিস আমার পাশে এক বুড়ো বসে ছিল। পরের স্টেশনে গাড়ি থামলে পর বুড়ো আমাকে আর এক কামরায় নিয়ে গেল। সেখানে একটি মেয়ে তিন মাসের এক বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছে— রোগা টিঙটিঙে চেহারা। সেই বাচ্চাটাকেই বসে বসে মাই দিলুম; ব্যথাটা আস্তে আস্তে কমে গেল।’

এরসিলিয়া এখন পুরোপুরি শহুরে হয়ে গেছে। আন্নিচ্চিয়ার গেঁয়ো কথাবার্তা ভাবভঙ্গি ওর ভাল লাগছিল না। বললে, ‘হয়েছে হয়েছে। এখন যা ছুটে, চান সেরে আয়। পরে বাবা-মা-র খবর শুনবখন। যা, হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলি কেন?’

‘কিন্তু আমাদের সোনামণি, খোকন? ওকে একটিবার দেখে নিই, তার পরেই যাচ্ছি।’

দোলনাটা দেখিয়ে দিয়ে এরসিলিয়া বললে, ‘খোকন ওখানে আছে। কিন্তু তোর ওই নোংরা হাতে মশারিটা ছুঁসনে যেন। মারগেরিটা, এদিকে এসো তো, খোকনকে দেখিয়ে দাও।’

চারদিকে রংবেরঙের ফিতে লেসের ছড়াছড়ি। মাঝখানে বাচ্চাটা শুয়ে আছে, মুখটা লালচে, বিদঘুটে চেহারা। কী বিচ্ছিরি দেখতে! গাড়িতে যে বাচ্চাটাকে মাই দিয়েছিল তাকেও হার মানিয়েছে। মুখে বললে, ‘বাঃ, কী মিষ্টি দেখতে। কেমন লক্ষ্মীটির মতো ঘুমুচ্ছে। তুমি দেখে নিয়ো ছেলেকে কেমন জোয়ান করে দি। আমার খোকাও ঠিক অমনি ছিল— ঠিক ওইটুকু দেখতে— এখন যদি ওকে দেখো’ — আন্নিচ্চিয়া হঠাৎ থেমে গেল। খোকার কথা বলতে গিয়ে ওর চোখ জলে ভরে উঠল, গলা ধরে এল। ‘যাচ্ছি এবার, এই এলাম বলে।’ ঝিয়ের সঙ্গে পাশের ঘরে চলে গেল।

ওর ইচ্ছে ছিল তক্ষুনি এসে বাচ্চাকে মাই দেয়; বাড়ির কর্তারও তাই মত। কিন্তু এরসিলিয়ার তো সব কিছু নিয়েই স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া বাধানো চাই। তাই সে বললে, ‘উঁহু, সে হবে না। আগে ওর বুকের দুধ ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে।’

আন্নিচ্চিয়া হেসে বললে, ‘কেন, ডাক্তারের কী দরকার? দেখছ না আমার শরীর? কোনওদিন অসুখ বিসুখ করেনি।’

বাস্তবিক দেখবার মতো ওর স্বাস্থ্য। মুখে গোলাপি আভা। স্বাস্থ্যের প্রতিমূর্তি।

এরসিলিয়া কটমট করে ওর দিকে তাকাল। ও ভেবেছে আন্নিচ্চিয়া ইচ্ছে করে স্বাস্থ্যের কথাটা পেড়েছে শুধু নিজেকে তার স্বামীর চোখে জাহির করবার জন্যে। বললে, ‘ডাক্তার চাই, এক্ষুনি— ডাক্তার নিয়ে এসো।’

মোরি আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে ডাক্তারের জন্য বেরিয়ে গেল।

ডাক্তার আসতে আসতে সেই সন্ধে। এদিকে আন্নিচ্চিয়ার মাই ফুলে উঠে আবার সেই আগের মতো ব্যথা। ওদিকে বাচ্চাটা খিদেয় চেঁচাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই খাবে না, মায়ের বুকে দুধ নেই কিনা।

এন্নিয়োর ইচ্ছে ছিল ডাক্তারের পরীক্ষার সময় কাছে থাকে কিন্তু স্ত্রী তাকে দূর করে দিলে, বললে, ‘হাঁ করে কী দেখছ? দেখবার কিচ্ছু নেই। যাও, মারগেরিটাকে বলো এক গ্লাস জল আর একটা চামচে নিয়ে আসতে।’

‘চুলের রং কটা দেখছি— হুঁ কটা চুল।’ ডাক্তারের ওই এক স্বভাব। একটা কথাই তিন-চারবার আওড়াতে থাকে। বড্ড ভুলোমন। কোনও বিষয়ে মনঃসংযোগ করা তার পক্ষে কষ্টকর ব্যাপার। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে। আন্নিচ্চিয়া লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।

‘ফরসা রং, কটা চুল, কেমন কিনা? কী বলেন সিনোরা, কটা চুল তো? দিব্যি বাড়ন্ত বলিষ্ঠ গড়ন, সুন্দরী… যুবতী। স্বাস্থ্যটা বেশ ভাল… বলিষ্ঠ— বাড়ন্ত, কেমন কিনা। কিন্তু শ্যামলা হলেই যেন ভাল হত। কালো গাইয়ের দুধ ভাল। দেখি, একবার ভাল করে দেখা যাক।’ আন্নিচ্চিয়ার থুতনিটা উপর দিকে তুলে ধরে গলার গ্রন্থিগুলো টিপে টিপে দেখতে লাগল। তারপর অন্যমনস্ক ভাবে তার বুকের বোতামগুলো খুলতে লাগল। আন্নিচ্চিয়া তো হতভম্ব, লজ্জায় ওর সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে। ও হাত দিয়ে মাই দুটো ঢাকতে যাবে ডাক্তার বলে উঠল, ‘সরিয়ে ফেলো—হাত সরিয়ে ফেলো।’

ব্যাপার দেখে এরসিলিয়া খিলখিল করে হেসে উঠল।

‘হেসে উঠলেন যে, সিনোরা, হাসছেন কেন?’

‘পাড়াগেঁয়ে ভূতটাকে দেখুন। লজ্জায় ভয়ে জড়সড়।’

‘লজ্জা? লজ্জা কী? আমি যে ডাক্তার।’

‘লজ্জা— অচেনা পুরুষের কাছে। আর জানেন তো আমাদের সিসিলির মেয়েরা এখানকার শহুরে মেয়েদের মতো অত সভ্য নয়।’

‘ওঃ বুঝেছি, বুঝে নিয়েছি। লজ্জা শরম একটু বেশি, কেমন কিনা। কিন্তু ডাক্তারের কাছে লজ্জা কী? মাইটা একটু টিপে দু’-এক ফোঁটা দুধ ফেলো তো এই চামচেটার মধ্যে। তোমার খোকার বয়স কত?’

আন্নিচ্চিয়া অতি কষ্টে চোখ তুলে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকাল।

‘এই দু’মাস হল কোলে এসেছে।’

‘কোলে এসেছে? তার মানে? জন্ম দিয়েছ বলো। ছেলে আবার আপনা থেকে কোলে আসে নাকি? জন্ম দিতে হয়। প্রসব করতে হয়, তাতে দোষটা কী?’

দুধ পরীক্ষা করে ডাক্তার চলে যাবার পর আন্নিচ্চিয়া ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। যেন অত্যধিক পরিশ্রমে ওর সমস্ত শরীরে অবসাদ এসেছে। ছি, ছি, ছি, ছি, লজ্জায় মরি! কী বিশ্রী ব্যাপার!

পরমুহূর্তে কান্না শুনে এরসিলিয়ার খোকাটিকে কোলে তুলে ও মাই দিতে লাগল। ‘আয়, কোলে আয় জাদুধন, পেট ভরে দুদু খা।’

বিছানায় শুয়ে শুয়ে এরসিলিয়া আবার কটমট করে তাকাল। সোনালি চুল, মাঝখানে সিঁথি, দু’কানের দু’পাশে গোল করে খোঁপা বাঁধা। ওই সোনালি চুলের বেষ্টনীর মধ্যে ওর নিটোল মুখ আরও যেন সুন্দর দেখাচ্ছে। জামার ফাঁক দিয়ে ঈষৎ দেখা যাচ্ছে ওর সুগঠিত স্তন— ধবধবে সাদা। এরসিলিয়া বিরক্তির সুরে বলে, ‘রাত-কাপড়টা পরিয়ে নিলে না? কী বুদ্ধি! খেতে খেতে যে ঘুমিয়ে যাবে।’

‘আহা খিদে পেয়েছে, আগে খেয়েনিক। কেমন সুন্দর চুকচুক করে খাচ্ছে।’

খোকাকে ঘুম পাড়িয়ে ও পাশের ঘরে নিয়ে গেল। ও ঘরে ওদের দু’জনের শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। চমৎকার বিছানা, সুন্দর আসবাবপত্র। সব দেখে ওর বিস্ময়ের অন্ত নেই। তা হবে না! রোম তো। এখানকার ব্যাপারই আলাদা। সুন্দর ধবধবে পরিষ্কার বিছানা ওর জন্যও পাতা রয়েছে। আন্নিচ্চিয়া থমকে দাঁড়ায়। দু’বছর আগেকার সেই বাসর শয্যার কথা মনে পড়ে। সেই প্রথম ওর অন্য কারু সঙ্গে এক বিছানায় শোওয়া। দূর সিসিলির সেই ছোট্ট বাড়িটির ছবি চোখের উপর ভেসে ওঠে। তিত্তাকে তখনও বাউন্ডুলেপনায় ধরেনি। কত সাধ করে নতুন সংসার পেতেছিল। আজ সেই ঘরটির কী ছন্নছাড়া চেহারা। আসবাব বলতে দু’টি মাত্র চেয়ার। শাশুড়ি ও নিজেকে নিয়ে এক বিছানায় গাদাগাদি করে শোওয়া।… বুড়ি তো সমস্ত খাটটা এখন একলাই দখল করবে। লুৎসি হয়তো পড়শিদের কাছেই থাকবে। আহা বেচারি, অল্প বয়সে মা-ছাড়া ঘরছাড়া! সেই পড়শি মেয়েটি কি লুৎসির দিকে তেমন নজর দেবে। হয়তো এক পাশে ফেলে রাখবে— নিজের বাচ্চাকে খাইয়ে দাইয়ে সামান্য যা বাকি থাকবে ততটুকুই দেবে। একা মা-র কোল দখল করে ছিল, এখন পরের ছেলের এঁটো খেয়ে সে বাঁচবে। আন্নিচ্চিয়ার বুক ঠেলে উঠতে থাকে। পাছে আবার কেউ টের পায় তাই জোর করে চোখের জল মুছে ফেলে। নিজের মনকে বোঝাতে চায়। লুৎসির ঠাকুমা তো কাছেই থাকবে। নাতির অনাদর হলে সে কি ছেড়ে কথা কইবে— পষ্টাপষ্টি পড়শির মুখের উপর দু’কথা শুনিয়ে দেবে। তা যাই বলো তিত্তারই তো মা, ভেতরে ভেতরে মনটা ওর ভাল। কিছুদিন পর নিশ্চয় বউয়ের উপর ওর রাগ পড়ে যাবে— বুঝবে আন্নিচ্চিয়া যা করেছে, সাত-পাঁচ ভেবেই করেছে, ও তো আর সাধ করে শাশুড়ির কথা অগ্রাহ্য করেনি। বাড়ি বসে থাকলে না খেয়ে মরতে হত।

ও যে শাশুড়ি আর ছেলের মুখ তাকিয়েই রোমে এসেছে— নিজে সুখে থাকবে বলে নয়— এ কথাটা নিজের কাছে প্রমাণ করতে পারলে ও যেন বেঁচে যায়। যদি সম্ভব হত তা হলে আরামের শয্যা ছেড়ে মেঝের উপর শুতে পারলেই ও যেন বেশি খুশি হত। আর সত্যিই এত ঐশ্বর্য তো ওর জন্যে নয়— সমস্তই ওই খোকাটির জন্যে। ও যদি বাড়ির সামান্য কুকুরটার মতো মেঝের ওপর শুতে পায় তা হলেই যথেষ্ট। লুৎসি বেচারি আর তিত্তার বুড়ি মা ছেঁড়া কাঁথায় রাত কাটাবে আর ও করবে বাবুগিরি, তাও কি কখনও হয়।

দু’দিন পরে দরজি যখন ওর জন্য নার্স-এর পোশাক নিয়ে এল তখন ওর আরও মন খারাপ হয়ে গেল। এত সুন্দর ইউনিফর্ম ও পরবে কোন লজ্জায়— রঙিন সিল্কের রিবন, জামার উপর সুন্দর ছুঁচের কাজ, রুপোর চিরুনি— এ যেন নাচের সাজ! এ পরে ওকে রাস্তায় বেরুতে হবে?

এরসিলিয়া ইতিমধ্যে বিছানা ছেড়ে উঠেছে। আন্নিচিয়ার রকমসকম দেখে ও রেগে আগুন।

‘আহা ন্যাকামো দেখো! ঠিক যা ভেবেছিলাম। রোমের দাসীরা যেমন কাপড়-চোপড় পরে তোকেও তাই পরতে হবে। ভাল-লাগা মন্দ-লাগার কথা শুনতে চাইনে— যেখানকার যা নিয়ম তাই মেনে চলতে হয়।’

আন্নিচ্চিয়া কর্ত্রীকে খুশি করার জন্য তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমি কি তাই বলেছি দিদি। তোমার আজ্ঞা ঠেলতে পারি! আমি শুধু বলছিলুম আমার জন্যে এত বাজে খরচ করার কী দরকার ছিল। তা ছাড়া তুমি তো জানোই দেশে আমরা’—

‘মনে রাখিস এ তোর সিসিলি নয়— এ হল রোম। তা ছাড়া পোশাকটা তো তোকে বেশ মানিয়েছে।’

তা সত্যি। টকটকে সিল্কের জামা পরে ওর চুলের সোনালি আভা, ওর ভাসা ভাসা চোখের নীল মাধুরী— আরও যেন খুলেছে। এরসিলিয়া ভাবে ওকে নিয়ে যদি রাস্তায় বেরোয় তা হলে কর্ত্রীর চাইতে দাসীর দিকেই রাস্তার লোকে নজর দেবে বেশি। তা দিক— দাসী বই তো নয়! ঈর্ষার চাইতে ওর অহংকারটা প্রবল হয়ে ওঠে— সুন্দরী দাসী তো সবার জোটে না।

এরসিলিয়া একদিন বেরুল ঘোড়ার গাড়ি চড়ে— সঙ্গে দাসী, তার কোলে খোকা। বেচারি আন্নিচ্চিয়া নতুন পোশাক পরে এই প্রথম বাইরে বেরুল। লজ্জায় ও লাল হয়ে গেছে, চোখ তুলে চাইতেই পারছে না। কোলের খোকাটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কাঠ হয়ে বসে আছে। এরসিলিয়া দেখলে যে রাস্তায় সবাই চোখ ফিরিয়ে নার্সের দিকে চাইছে।

‘মুখ নিচু করে আছিস কেন, কেউ তোকে ধরে মেরেছে না কি? ন্যাকা কোথাকার!’

আন্নিচ্চিয়া চেষ্টা করে চোখ তুলে তাকাতে। ক্রমে নতুন শহর দেখবার ইচ্ছা ওকে পেয়ে বসে, লজ্জা কেটে যায়। এরসিলিয়া যেদিকে আঙুল দেখায় সেদিকেই ও ছেলেমানুষের মতো গোল গোল চোখ করে দেখে। ‘কী চমৎকার, এমন সুন্দর শহর কখনও দেখিনি।’ বাড়ি ফিরে আসবার অনেকক্ষণ পরেও ওর সেই আচ্ছন্ন ভাবটা কাটল না। পা দুটো কাঁপছে, মাথা ঝিমঝিম করছে, কানে যেন তালা লেগেছে। একটা ছোটখাটো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ও যেন কোনওরকমে প্রাণ হাতে করে বেরিয়ে এসেছে। এ যেন অন্য এক জগৎ— ওদের সেই সিসিলির পাড়া-গাঁ থেকে একেবারে আলাদা। সুদূর এক মায়াপুরীতে ও যেন পথ ভুলে এসে পড়েছে।

— ‘মা গো মা— কী চমৎকার— কী সুন্দর!’

ঠিক সেই মুহূর্তে মোরি তার স্ত্রীর হাতে একটি চিঠি দিল— সিসিলি থেকে এসেছে। সিনোরা মানফ্রনি লিখেছেন। আন্নিচ্চিয়ার প্রথম মাসের মাইনে বাবদ এরসিলিয়া যে আগাম টাকা পাঠিয়েছিল মারুল্লোর বুড়ি মা তা ফেরত দিয়েছে। ও বলেছে, দ্বারে দ্বারে ভিক্ষে করে খাই, না খেয়ে মারা পড়ি, সেও ভাল, তবু ও-পাপের টাকা চোখেও দেখতে চাইনে। ইতিমধ্যে যে পড়শির হাতে আন্নিচ্চিয়া ছেলে দিয়ে গেছে সে এসে নালিশ করে গেছে হতচ্ছাড়ি বুড়ি তাকে একটি পয়সাও দেয়নি এমনকী লুৎসির জামাকাপড় কেনবার জন্যেও না। সিনোরা আরও লিখেছেন যে, এরসিলিয়ার পাঠানো টাকা থেকে অর্ধেক টাকা উনি পড়শির হাতে দিয়েছেন। আর বলে দিয়েছেন সে যেন বুড়িকে রোজ কিছু খেতে দেয়— নইলে সে তো না খেয়েই মারা পড়বে। পড়শি যেন এমন ভাব করে যে সে নিজের থেকেই দয়া করে বুড়িকে দু’টি খেতে দিচ্ছে। বুড়ির যা দেমাক! এরসিলিয়া যেন এবার থেকে অর্ধেক টাকাই পাঠায়— বুড়িটা তো টাকা নেবে না। শেষে লিখেছেন যে এরসিলিয়ার স্বামীর কথা মতো চলতে গিয়েই এই গোলমালটা হল। চিঠিখানা ভাঁজ করতে করতে এরসিলিয়া বলল, ‘তোমার কি কখনও বুদ্ধি হবে না? কেন তুমি মাকে লিখতে গেলে?’

‘আমি কি ওই খ্যাপা বুড়িটার ছেলের বউকে পাঠাতে মাথার দিব্যি দিয়ে লিখেছিলাম? তোমার মা দেখি আমার ঘাড়েই দোষ চাপাচ্ছেন।’

‘চাপাবেন না তো কী— একশোবার চাপাবেন। সিসিলি থেকে ধাই পাঠাবার কথা তুমি লেখোনি? আজ তোমার জন্যে এই কাণ্ডটা ঘটল। তোমার তো ভারী বয়েই গেল। হাঁ করে দাসীর রূপ গিলছ। আমার চোখকে ফাঁকি দেবে?’

মোরি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী বকছ তুমি? আমার ছেলের দাসীকে নিয়ে…’

‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ ওই দাসীই।— করো না,চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করো।’

‘আলবত চেঁচাব। কে চুপ করে সইবে তোমার ওই বাজে কথা? ছেলের দাসী নিয়ে হিংসে… তোমার মাথা খারাপ হতে আর বাকি নেই।’

‘আর তোমার মাথাটি খুব ঠান্ডা বুঝি? মাথা নেই তার মাথা গরম!’

‘এখন কী করা যায় সেইটে বলো। টাকাটা যে ফেরত দিলে’—

‘ওর শাশুড়ি যে টাকাটা নিতে চাইছে না সে কথা ওকে বুঝিয়ে বলবে না?’

‘খেপেচ? ওকে আমি সে কথা বলতে যাই আর কী। তা হলে ও একেবারে ঘাবড়ে যাবে।’

রাগে বিরক্তিতে অধীর হয়ে মোরি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

শেষ পর্যন্ত তা হলে এতদূর গড়াল! মোরি তার খোকার ধারে-কাছেও যেতে পারবে না— আদর করা তো দূরের কথা। এমন অদ্ভুত সন্দেহ কে কবে দেখেছে! খোকাকে আদর করলে এরসিলিয়া ভাববে যে দাসীকে সোহাগ করছে! একদিন তো স্পষ্ট বলেই ফেলল।

‘খোকা যখন আমার কোলে থাকে তখন তো ছায়াও মাড়াও না। আর দাসীর কোলে থাকলে আদিখ্যেতার অন্ত নেই কী আদরের ঘটা!’ এ ধরনের কথায় এন্নিয়ো দুঃখও পায় যেমন তার রাগও হয় তেমনি।

‘খোকা তো তোমার কাছে কখনও থাকে না।’

সে কথা সত্যি। খোকা তার মা-র কোলে দু’দণ্ড থাকতে চায় না, কাঁদতে থাকে আর কেবল তার ছোট্ট দু’টি হাত বাড়িয়ে আন্নিচ্চিয়ার কাছে যেতে চায়। বোধ হয় এরসিলিয়া ওকে ঠিকমতো সামলে ধরতেই পারে না। ছেলে কোলে করার অভ্যেস নেই বলে যে এমনটা হয় এ কথা মনে করা ভুল। আসলে ওর সারাক্ষণ ভয় পাছে খোকাটা ওর দামি ড্রেসিংগাউন নষ্ট করে দেয়।

বাড়ির বাইরে এরসিলিয়া বড় একটা বেরোয় না, লোকজন কালেভদ্রে ওর সঙ্গে দেখা করতে আসে। তা হলে কী হবে। পোশাক-পরিচ্ছদের জন্যও দু’হাতে খরচ করে আর তাও ওর কিছুই পছন্দ নয়। কিছুতে সন্তুষ্ট হওয়া ওর ধাত নয়, সব তাতে ওর অরুচি, এমনকী নিজেকেই যেন ওর ভাল লাগে না। ওর ধারণা ও অসুখী। তা হয়তো সত্যি। কিন্তু সেজন্য অন্য লোককে দোষী করলে চলবে কেন। এর জন্য দায়ী ওর নীরস কটুস্বভাব— ওর ঝগড়াটে প্রবৃত্তি। এদিকে ওর কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস যে মনের মতো মানুষ যদি ও পেত— এমন কেউ যে ওকে ভালবাসত, ওকে বুঝত— তা হলে ওর বুকের ভিতরটা এমন খাঁ খাঁ করত না। খোকার প্রতিও এরসিলিয়ার মনে বিতৃষ্ণা এসেছে— মাকে ছেড়ে ও দাসীকে চায় বলে। কাজ নেই, কর্ম নেই, একঘেয়ে দিন কাটে— হেন দিন নেই যেদিন ও কান্নাকাটি করে না। মোরি মাঝে মাঝে লক্ষ করে ওর চোখ লাল। দেখেও দেখে না। পারতপক্ষে স্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তাও বলে না। কিছু বলে কয়ে যে এরসিলিয়ার মন পাবে, এমন আশা সে ছেড়েই দিয়েছে। জীবনটাকে উপভোগ করার ক্ষমতাটাই এরসিলিয়া হারিয়ে বসেছে— সে জানে না মানুষ নিজে যদি সুখী না হয় তা হলে কেউ তাকে সুখী করতে পারে না। আর এরসিলিয়ার চাইতে মোরি নিজেই বা কোন সুখে আছে। ওর সঙ্গে এক বাড়িতে থাকাটাই তো যন্ত্রণা বিশেষ। কী বিশ্রী জীবন— সারাটা দিন ওর আপিস-ঘরে বন্দি। ভাগ্যিস মাঝে মাঝে ওর সোশ্যালিস্ট বন্ধুরা আসে, তাদের সঙ্গে গল্পগুজবে আলোচনায় তবু মনটা একটু হালকা হয়।

সিনোর ফেলিচিসসিমো রামিচেল্লি মোরির কর্মচারী। আধবয়সি লোক, উকিলের মুহুরি। বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার সময় মোরি রামিচেল্লিকে বসবার ঘরে পাঠিয়ে দেয়। সমবেত ভদ্রলোকদের কায়দা দুরস্ত সেলাম করে মুহুরি বেরিয়ে আসে, বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দেয়। দরজার বাইরে তার অন্য মূর্তি, নাচের ভঙ্গিতে পা ফেলতে ফেলতে, হাত কচলাতে কচলাতে, কলপ-করা গোঁপে তা দিতে দিতে বাইরের ঘরে এসে একটা বেঞ্চ-এর উপর বসে। সিসিলির সুন্দরী দাসীটির প্রতি ওর ভারী লোভ! ইতিমধ্যে ভাব করার চেষ্টা হয়ে গেছে: ‘আমার নামটা কী বলো তো? আমার নাম ফেলিচিসসিমো (ভাগ্যবন্ত)।’

আন্নিচ্চিয়া ঠাট্টাটা ঠিক যেন বুঝতে পারে না। মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

সিনোর রামিচেল্লি আপন মনেই আক্ষেপ করে।

‘কী নামই রেখেছিল বাপ-মা— ফেলিচিসসিমো। পোড়াকপাল আমার!’ বাপ-মা যখন এমন গালভরা নামটা দিয়েছিলেন তখন তাঁদের আশা ছিল ছেলে এককালে ভাগ্যবন্ত হবে। কী চমৎকার কপাল— খুদকুঁড়ো কুড়িয়ে বেড়ানোকে কি সৌভাগ্য বলে! দিনমজুরি মোটে আট লিরা পায়। কোনওরকমে সংসার চালাবার পক্ষে এ পয়সাটা নিতান্ত যৎসামান্য নয়। ওর কিন্তু এতে কুলোয় না। কারণটা খুবই সাধারণ— স্ত্রীলোকের প্রতি ফেলিচিসসিমোর একটা সহজাত দুর্বলতা আছে। এটা ওর খেয়াল নয়— অভ্যেস; কিছুতেই ঘুচল না। স্ত্রীলোক দেখলে ও আর ঠিক থাকতে পারে না।

এই আন্নিচ্চিয়ার কথাটাই ধরো না— রসে টইটম্বুর! দেখলেই জিভে জল আসে। মেয়েটা শুধু যে খাপসুরত তা নয়— আদব কায়দাও জানে। বাইরে ভড়ংটা কিন্তু ঠিক রেখেছে। হ্যাঁ ভড়ং নয় তো কী। ধাই মাত্রেই যে নষ্ট মেয়েমানুষ সে কথা কে না জানে, পাঁচ ভাতারের ব্যাপার— তুলে নিলেই হল।

মুহুরি বাবুর মিউনো চাউনি আর লাম্পট্যের বিকৃত ভঙ্গি আন্নিচ্চিয়ার চোখে যে পড়েনি তা নয়। হাসিও পায় রাগও হয়। অদ্ভুত লোকটা— বয়স ঢাকতে পারে না অথচ কলপ লাগিয়ে চুলটা এখনও দুরস্ত রাখবার চেষ্টা। বোধহয় মাথা খারাপ— আর তা যদি নাও হয় তো খারাপ হতে খুব বেশি দেরি নেই।

একদিন আন্নিচ্চিয়া মোরির ছেলেটিকে ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা করাচ্ছে। খোকার নাম হয়েছে লিওনিদা। ও নামটা আন্নিচ্চিয়ার মুখে কিছুতে আসে না— এই ছ’মাসেও রপ্ত হয়নি। ও তাই নামটা সহজ করে খোকাকে ডাকে, নোনিদা।

রামিচেল্লি খুনসুটি করে বলে: ‘ও দাসী, কী তোমার বুদ্ধি! নোনিদা নয় গো, লি-ও-নি-দা।’

‘ও নাম আমার মুখে আসে না।’

‘আচ্ছা বলো তো দেখি ফেলিচিসসিমো। ও নামটা কার জানো? আমার।’

আন্নিচ্চিয়া খোকাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে: ‘ওরকম নাম আবার হয় না কি?’

মুহুরি বাবু উদাসভাবে আপন মনে বলে, ‘না হলেই ভাল ছিল।’

বেঞ্চিতে বসে বসে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর হতাশ ভাবে মাথা নাড়ে। পাশের ঘরে তখন জোর আলোচনা চলছে। টুকরো টুকরো কথা কানে আসে: শোষক সম্প্রদায়ের অবিচার… সর্বহারাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য… আন্দোলন… সভা সমিতি… প্রোগ্রাম… ইত্যাদি। এ সব কথা সে শুনেও শোনে না, ও শিকারি বিড়ালের মতো বাড়ির ভিতরের দরজাটার দিকে লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ ভেসে আসে করুণ সুরে গাওয়া ছেলেভুলানো ছড়ার দু’-চারটে ছত্র। আন্নিচ্চিয়া এরসিলিয়ার খোকাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। ছেলেটি ইতিমধ্যে বুকের দুধ পেয়ে দিব্যি মোটাসোটা হয়েছে। ওকে দেখে দেখে আন্নিচ্চিয়ার লুৎসির কথা মনে পড়ে, গান গাইতে গাইতে ওর গলা ধরে আসে। লুৎসি যদি এই ছ’টা মাস মা-র বুকের দুধ পেত তা হলে কী মোটাসোটাই না হত। কে জানে বাছা আমার কেমন আছে। মাঝে মাঝে ও স্বপ্নে লুৎসিকে দেখে— রোগা ডিগডিগে, হাড় জিরজির করছে, গলাটা সরু লিকলিকে, প্রকাণ্ড মাথাটা টলমল করে একবার এ-কাঁধে একবার ও-কাঁধে লুটিয়ে পড়ছে। আন্নিচ্চিয়া আঁতকে ওঠে, ভয়ে ওর হাত পা পাথরের মতো জমে যায়। হা ভগবান, আমার বাছার এমন দশা কে করলে। স্বপ্নে তাড়াতাড়ি ছেলেকে দুধ দিতে যায় আর লুৎসি ওর দিকে কটকট করে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কী তীব্র বিদ্বেষের দৃষ্টি, ঠিক ওর বুড়ি শাশুড়ির মতো। বিশ্রী স্বপ্ন— আন্নিচ্চিয়া ভয়ে শিউরে ওঠে। সারারাত ঘুম হয় না। শুয়ে শুয়ে ছটফট করতে থাকে— লুৎসির ওই তিরস্কারের চাউনিটা ওর বুকে যেন কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে।

এরসিলিয়ার কাছে ওর দুর্ভাবনার কথা জানাতে আন্নিচ্চিয়া ভয় পায়। ঘন ঘন দেশের খবর, লুৎসির খবর জানতে চাইলে বিরক্ত হয়, রাগ করে। বোধহয় ভাবে যে নিজের ছেলের প্রতি এত যার টান, সে কি পরের ছেলের তেমন করে যত্ন নেবে। এ যে তার মিথ্যে সন্দেহ আন্নিচ্চিয়া বুকে হাত দিয়ে তা বলতে পারে। অমন কথা ওর অতি বড় শত্রুও বলতে পারবে না— নোনিদার দিকে তাকালেই বোঝা যায় ধাইয়ের যত্নে কিছু ত্রুটি কোথাও হয়নি— কেমন সুন্দর মোটাসোটা চেহারা হয়েছে।

দেশে ও যে সিনোরিনাকে চিনত আজকালকার এরসিলিয়া তা থেকে একেবারে আলাদা জীব। আন্নিচ্চিয়া যে এককালে ওর খেলার সঙ্গী ছিল সে কথা একেবারে যেন ভুলেই গেছে— এমন ব্যবহার করে যেন ও দাসীর চাইতেও অধম। কর্ত্রীকে খুশি করতে ও তো চেষ্টার ত্রুটি করে না। মারগেরিটা নামে সেই কালা ঝিটা বিদেয় হবার পর থেকে ও বাড়ির সব কাজ খুশি হয়েই করে। খোকাকে মানুষ করার কাজ ছাড়াও এতগুলো উপরি কাজ অথচ একটি দিনের জন্যেও অনুযোগ করেনি। ও জানে এরসিলিয়ার খুঁতখুঁতে স্বভাব— একটুতেই বিরক্ত হয়। তাই ওর সারাক্ষণ চেষ্টা সিনোরিনার মেজাজ যেন না বিগড়োয়। ওর মুখে সারাক্ষণ ওই এক কথা— ‘এই যে সিনোরিনা, এই যে আমি। সব ঠিক হয়ে যাবে… কিছু ভেবো না।’ এত কাজ করে অথচ এরসিলিয়ার দিক থেকে এক ফোঁটা দরদ নেই। একটা দিনের ঘটনা বলি। সিসিলির ডাক এসেছে। পিয়নের হাত থেকে চিঠিগুলো নিয়ে আন্নিচ্চিয়া ছুটে গেল কর্ত্রীর কাছে: ‘সিনোরিনা! সিনোরিনা!’

‘বলি হয়েছে কী, এত চেঁচামেচি কেন? যেন যুদ্ধ জয় করে এসেছে।’

এরসিলিয়ার বকুনি শুনে ওর বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চিঠি পড়া শেষ করে এরসিলিয়া যখন চিঠিগুলো খামের ভিতর পুরছে তখন ভয়ে ভয়ে আন্নিচ্চিয়া জিজ্ঞেস করে: ‘লুৎসির কিছু খবর নেই চিঠিতে?’

‘হ্যাঁ, লিখেছে তোর ছেলে ভাল আছে।’

‘আর বুড়ি? আমার শাশুড়ি?’

‘সেও ভাল আছে।’

এই সামান্য দু’টি কথায় ওকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। সঙ্গে আর কোনও খবর নেই তো? আহা ও যদি নিজের হাতে চিঠি লিখতে পারত! নিজের অজ্ঞতাকে ধিক্কার দেয়। বাড়ি ছেড়ে এলে পর ওর মন খারাপ হবে সে কথা আন্নিচ্চিয়া বুঝেছিল। কিন্তু এ তো কেবল মন খারাপ নয়— এ যেন দগ্ধে দগ্ধে মরা!

ও নিজের মনকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করে। কিছু দিনের মধ্যেই তো নোনিদার সাত মাস বয়স হবে। মোরি ঠিক করেছে ন’মাসে বুকের দুধ ছাড়াতে হবে। সুতরাং আর ক’টা দিন মাত্র ধৈর্য ধরে থাকা। আর দু’টি মাস নরক যন্ত্রণা! অদৃষ্টের ফের— ঠেকিয়ে রাখবে কী করে। যা ঠেকানো যাবে না তাকে মেনে নেওয়া ভাল।

যেদিন নোনিদার সাতমাস পূর্ণ হয়েছে সেদিনই আবার ওর প্রথম দুধে-দাঁত দেখা দিয়েছে। বাড়িতে যেন উৎসবের ধুম। আসন্ন মুক্তির সম্ভাবনায় আন্নিচ্চিয়ার মনও খুশিতে উঠেছে ভরে। অন্তরালে সেদিনই যে ওর সর্বনাশের আয়োজন হচ্ছিল এমন আশঙ্কা ওর ভুলেও মনে হয়নি। বাইরের দরজায় ঘণ্টা বাজল। আন্নিচ্চিয়া ভাবল পিয়ন এসেছে বুঝি এক ছুটে দরজা খুলতে গেল। আজ হয়তো-বা সিসিলির ডাক এসেছে। দরজা খুলে দেবার পর কী যে ঘটল ওর কিছু মনে নেই। মাথায় একটা প্রচণ্ড আঘাত লেগে ও বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল মেঝের উপর। জ্ঞান ফিরে এলে পর দেখে মারুল্লো দাঁড়িয়ে, বুটসুদ্ধু পা তুলেছে ওর মুখের উপর লাথি মারতে। রাগে সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে, মুখ থেকে সমস্ত রক্ত যেন মুছে গেছে।

‘হারামজাদি! কোথায় তোর মনিব!’

আন্নিচ্চিয়ার কান্না শুনে সিনোর মোরি, এরসিলিয়া আর রামিচেল্লি দৌড়ে বাইরের ঘরে এল। মোরির কোটের কলারটা ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলল, ‘আমার ছেলে মরে গেছে জানো সে কথা?’

আন্নিচ্চিয়ার দিকে ফিরে দাঁড়াতে সে পাগলের মতো চেঁচিয়ে উঠল।

‘লুৎসি মরে গেছে, আর ফিরবে না। নবাবপুত্র কী করবেন এখন— ক্ষতিপূরণ করবি না ছেলের বদলে ছেলে দিবি?’

ভয়ে এরসিলিয়ার মুখ চুন— বলল, ‘লোকটা পাগল হল না কি?’

মোরি ছোট্ট মানুষটি— আচমকা তিত্তার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে দরজার দিকে ধাক্কা দিল। বাইরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘বেরিয়ে যাও বলছি। বেরোও আমার বাড়ি থেকে!’

‘মুখ সামলে কথা বলো। আমি কারও পরোয়া করি না। যা ছিল সব গেছে —জীবনে মায়া আমার নেই। মা পথের ভিখিরি হয়েছে, ছেলে গেছে মরে। আমার কী? আমি শিগগির যাচ্ছি না। আগে তোর গায়ে থুতু দি তারপর এই হারামজাদিকে চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাব।… ওঠ বলছি হতচ্ছাড়ি!’

হট্টগোল যখন পুরোদমে চলছে তখন একটা ফাঁকে রামিচেল্লি গিয়েছিল বেরিয়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল, সঙ্গে দুটো পুলিশ। উত্তেজনায় তখনও মোরি কাঁপছে— পুলিশকে বলল, ‘নিয়ে যাও ওকে, ঘাড় ধরে নিয়ে যাও। বদমাশটা বাড়ি বয়ে আমায় অপমান করতে এসেছিল… শাসাতে এসেছিল।’

পুলিশ দুটো শক্ত করে মারুল্লোকে ধরল। ও চেঁচাচ্ছে, ‘আমার বউকে চাই— ওকে আমি ছাড়ব না।’

চেঁচাচ্ছে আর ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। পুলিশরা শেষ পর্যন্ত ওকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে চলে গেল। মোরি ওদের পিছনে পিছনে থানায় গিয়ে তিত্তার নামে নালিশ রুজু করে এল।

পরদিন সিনোর মানফ্রনির চিঠি এল— যথাসময়ের বহু পরে। চিঠিতে লুৎসির মৃত্যু ও মারুল্লোর বুড়িমা-র অসুখের খবর আছে, তিত্তার উল্লেখ নেই।

মোরি প্রথমে ভেবেছিল লোকটা বোধহয় দ্বীপান্তর থেকে পালিয়ে এসেছে। পরে শুনল ওর রুগ্ন মা হাসপাতাল থেকে দরখাস্ত করায় পুলিশের কর্তৃপক্ষ ওর শাস্তির বাকি সময়টা মকুব করে দিয়েছেন। রোমের পুলিশ তিত্তাকে সিসিলি চালান করে দিল। সাবধান করে দিল— তিন বছর নজরবন্দি থাকবে, বাড়াবাড়ি করলে আবার সেই কালাপানির পারে পাঠানো হবে।

তিত্তার হাতে নিগ্রহ, তার উপর লুৎসির মৃত্যু সংবাদ, এই দুই ঘটনার সংযোগে আন্নিচ্চিয়ার অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। তিনদিন ভীষণ জ্বর, ঘোর বিকার, মনে হল পাগল হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে যেন ঘোর কেটে গেল, একটু একটু করে ও প্রকৃতিস্থ হয়ে এল। ঝড়ের পরেকার প্রশান্তি অথচ থমথমে ভাবটা এখনও কাটেনি। ওর চোখ চেয়ে থাকে কিন্তু দেখে না। কেউ কিছু বললে মাথা নাড়ে কিন্তু কথাটা বুঝেছে বলে মনে হয় না। এর চেয়ে যেন আগের সেই অবস্থাটাই ভাল ছিল।

অসুখ হবার সঙ্গে সঙ্গে ওর বুকের দুধ শুকিয়ে গেল। দায়ে পড়েই ছেলেটাকে দুধ ছাড়াতে হল। বাড়িতে হুলস্থুল ব্যাপার। একটি দিনের জন্যে ছেলেটির দেখাশুনো করেনি, এখন এরসিলিয়ার কাছে সে থাকবে কেন। দুটো রাত তো ঘুমোতেই দিলে না— সারাক্ষণ কাঁদল ধাইমার জন্যে। এক মুহূর্তের স্বস্তি নেই— এর উপর আবার গৃহস্থালির কাজ, নতুন ঝিকে খাটানো। আন্নিচ্চিয়াকেও একটু আধটু তো দেখতে হয়! এরসিলিয়ার মেজাজ একেবারে বিগড়ে গেছে। হরদম মোরিকে বকছে। সে বেচারি খবর কাগজ হাতে এদিকে ওদিকে ঘুরঘুর করছে, বুঝতে পারছে না কী করবে।

‘কিছু করতে হবে না কি?’

‘ন্যাকামি রাখো! চোখের মাথা খেয়েছ নাকি? দেখতে পাচ্ছ না একা কত কাজ সামলাচ্ছি। সংসারের কাজ, খোকার খেজমত, এর উপর যদি ওই বজ্জাত মেয়েটার হেফাজত করতে হয় তো আমার সইবে না বলে দিচ্ছি। বাড়ি থেকে দু’পা বেরিয়ে গিয়ে একটা কোনও অনাথ আশ্রমে বা হাসপাতালে ওকে ভর্তি করে দাও গে। বুঝেছ, হাঁ করে তোমায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।’

এন্নিয়ো ওর কথা শুনে অবাক, বলল, ‘ওকে পাঠাবে অনাথ আশ্রমে?’

‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ! দরদ যে উপচে পড়ছে, সোহাগ ধরে না। যত মায়ামমতা ওই দাসীটার জন্যে, আর আমি বুঝি বানে ভেসে এসেছি। রাতের পর রাত চোখে ঘুম নেই, চুলটা আঁচড়াবার পর্যন্ত সময় পাই না— সে তো তোমার চোখে পড়ে না! খেটে খেটে হাড় কালি! আমি বাড়ির সবাইকার বাঁদি —না! সেরে উঠুক মাগি— তখন দেখে নেব। দূর করে দেব— ও পাপ বিদেয় না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।’

শাসাল বটে, কিন্তু কাজে খাটাতে পারল না। আন্নিচ্চিয়ার শরীরটা যখন সারবার মুখে তখন একদিন কথায় কথায় জানিয়ে দিল ওর সাতমাসের মাইনে বাবদ অনেকগুলো পয়সা জমেছে।

নোনিদাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আন্নিচ্চিয়া বলল, ‘টাকা পয়সা নিয়ে আমি কী করব দিদি। খোকাই আমার সর্বস্ব ধন।’ নোনিদা আবার ওর কোলে ফিরে এসেছে। দুধ পায় না কিন্তু ঠিক সেই আগের মতো ভালবাসে। ওর অসুখ সারবার পর প্রথম যেদিন ঝি নোনিদাকে ওর বিছানায় নিয়ে আসে সেদিন খোকার দিকে ওর তাকাতেই ইচ্ছে হচ্ছিল না। আন্নিচ্চিয়া যে-খোকাকে চায় সে আর কখনও ওর কোলে ফিরবে না। কিন্তু নোনিদা যখন ছোট ছোট হাত দুটো বাড়িয়ে অধীরভাবে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ল তখন আর ও ঠিক থাকতে পারল না। খোকাকে দু’হাত দিয়ে বুকে তুলে নিল যেন নোনিদাই ওর লুৎসি। এতদিনকার নিরুদ্ধ শোকের বাঁধ অবিরল অশ্রুর বন্যায় ঝরে ঝরে পড়তে লাগল।

‘খোকা আমার জাদু আমার। কী চাস বাবা আমার কাছে। একফোঁটা দুদু নেই ধন। তোর ধাইমা মরে গেছে…’

লুৎসি কী ভাবে মারা গেল সে খবরটা পেলে ও যেন একটু নিশ্চিন্ত হত। মরল— কিন্তু খেতে না পেয়ে না অযত্নে— কিছু না জানতে পারলে ও মনকে বোঝায় কী করে! কিছু জানতে পাবে না ও? এ যেন একটা কুকুরের বাচ্চা মরেছে। আহা বাছারে, মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো অনাথ ছেলের মতো পরের ঘরে অযত্নে মারা গেল! হা ভগবান!

আন্নিচ্চিয়ার কষ্ট কেউ বোঝে না। এরসিলিয়া তো নয়ই। উলটে বরঞ্চ বিরক্তই হয়— সাতমাস যেতে না যেতে বুকের দুধ শুকিয়ে গেল বলে। তা তো চটবেই— মায়ের প্রাণ। মা-র কাছে তার নিজের ছেলে ছাড়া জগতে আর কেউ নেই। ওর শিশুটি মারা গেছে তাতে এরসিলিয়ার কী! বিরক্ত হতে পারে কিন্তু দুঃখ কেন হবে। আন্নিচ্চিয়া মাঝে মাঝে ভাবে, সিনোরা নাই-বা দুঃখ পেল। কিন্তু এতটুকু তো ওর বোঝা উচিত যে নোনিদার উপর আমারও খানিকটা দাবি থাকতে পারে। পেটে সে ধরেছে বটে কিন্তু বুকের দুধ দিয়ে মানুষ তো আমিই করেছি। আমার তো এখন কেউ নেই ওই নোনিদা ছাড়া।

খোকাকে দেখাশুনোর ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে না বলে এরসিলিয়া খুশিই হয়েছে। কিন্তু মনে মনে ও স্থির করেছে লিওনিদাকে দাসীর অত ন্যাওটো হতে দিলে চলবে না— মাগি এমন করে যেন ছেলেটা ওর নিজের। ওকে বাড়ি থেকে তাড়াবার জন্য ও দৃঢ়সংকল্প। কেনই বা ওকে রাখবে? না জানে বাড়ির কাজ, না পারবে খোকার আয়া হতে। তা ছাড়া এরসিলিয়া চায় ওর ছেলে যেন সভ্য মার্জিত ইতালিয়ান ভাষা শেখে। সেদিক থেকে আন্নিচ্চিয়া অচল! সিসিলির গেঁয়ো ভাষা ছাড়া কোনও ভাষা জানে না। নাঃ, ওকে থাকতে দেওয়া হবে না! ওকে রাখা মানে মোরিকে সুন্দর মুখ দেখবার সুযোগ দেওয়া। মোরিকেই বলতে হবে ওকে যেন তাড়ায়।

মোরি বলে, ‘আমি ওকে তাড়াতে যাব কেন?’

‘কারণ তুমি যে হলে বাড়ির কত্তা। তা ছাড়া দরদ দেখিয়ে তুমি যে ওর মাথা খেয়েছ। বুঝতে পারো না?’

‘আমি? আমি আবার দরদ দেখাতে গেলুম কবে?’

‘তুমি কি বলতে চাও এটা আমার মন-গড়া কথা? দেখতে পাও না ওর হাবভাব এমন যেন বাড়িটা ওর নিজের। একই ছেলের দু’-দুটো মা আর একই বাড়িতে দু’-দুটো কর্ত্রী— এ তোমার ভাল লাগতে পারে, আমার কিন্তু বরদাস্ত হবে না।’

এন্নিয়ো জানে কথা কাটাকাটি করতে গেলে ব্যাপার খারাপই হবে, তবু নিজের হয়ে ওকালতি করতে ছাড়ে না। ‘এ সব তুমি কী যা-তা বলছ বলো দেখি? জোর করে সমস্ত জিনিসটা তুমি বিচ্ছিরি করে তুলছ। এসব অমূলক সন্দেহ করে লাভ আছে কিছু? তুমি দেখতে পাও না, আমি সারাক্ষণ কাজ আর পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। অন্য মেয়ের দিকে আমি কোনওদিন নজর দিয়েছি? বাড়িতে যাতে শান্তি থাকে, তুমি যাতে সুখী হও সেজন্য নিজের ছেলেকে পর্যন্ত আদর করা ছেড়ে দিয়েছি। আন্নিচ্চিয়া বেচারির কোনও দোষ নেই— মিছিমিছি তুমি ওকে অবিশ্বাস করছ। একবার ওর কথাটাও ভেবে দেখো। সিসিলি ফিরে যাবে ও কোন সাহসে?… ছেলে মরে গেছে, জানোয়ার স্বামীটা ওকে কি আর আস্ত রাখবে? এইখানে ধাইমা হয়ে এল বলেই তো নিজের ছেলেটি হারাল। যে ছেলেকে মানুষ করবার জন্য ও আপন ছেলেকে বিসর্জন দিল তার প্রতি যদি ওর মায়া বসে যায়, তার কাছ-ছাড়া হতে যদি না চায়, সেটা তুমি দোষের বলবে? বুঝে দেখো।’

স্ত্রীর কাছে ও যে যুক্তিগুলো আওড়াচ্ছে সেগুলো ওর নিজের লেখা থেকেই চুরি করা। সেগুলি সোশ্যালিস্ট ক্লাবে কিছুদিন পরে ওর বক্তৃতা দেবার কথা! বক্তৃতার জন্য সে তৈরি হচ্ছে। ও স্থির করেছে দূর সিসিলিতে এই যে একটি মা-ছাড়া শিশুর মৃত্যু হল এই ঘটনাটা বেশ ফলাও করে বক্তৃতার মধ্যে জুড়ে দেবে।

এরসিলিয়া যুক্তি তর্কের ধার ধারে না। বরঞ্চ উলটো বিপত্তি ঘটল। গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তক্ষুনি আন্নিচ্চিয়াকে কাজ থেকে জবাব দিতে। সিনোর মোরি বিরক্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল— বক্তৃতার লেখা অংশগুলো ছুড়ে ফেলে দিলে।

মিনিট কয়েক পরে আন্নিচ্চিয়ার চাপা কান্নার শব্দ শোনা গেল। কাতরস্বরে ওর কর্ত্রীকে অনুনয় করে বলেছে, ‘আমায় ছাড়িয়ে দিয়ো না, মাইনে চাইনে, কেবল দু’মুঠো খেতে দিয়ো— তোমাদের এঁটোকাঁটা যা পড়ে থাকে। আমি এক কোনায় পড়ে থাকব। দোহাই তোমার, আমাকে ছাড়িয়ে দিয়ো না। আমি ফিরে যেতে পারব না, কক্ষনও পারব না। নোনিদার দোহাই, আমাকে দয়া করে রাখো। তাড়িয়ে দিলে আমার সর্বনাশ হবে। আমার কোথাও যাবার পথ নেই।’ অনেকক্ষণ ধরে কান্না আর অনুনয়ের পালা চলল। তারপর সব চুপচাপ। মোরি ভাবলে এরসিলিয়ার মন হয়তো ভিজেছে। মেয়েটাকে শেষ পর্যন্ত হয়তো তাড়াল না।

কিছুক্ষণ পর সিনোর রামিচেল্লি মোরির ঘরে ঢুকল। ওর প্রতিদিনকার ভারিক্কি চাল খসে পড়েছে! লাল মুখখানায় কুতকুতে দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে।

‘খুব বাগিয়েছি বলতে হবে।’ মনিবের সামনেই আনন্দে হাত কচলায় আর কী। ‘সিসিলির ওই খাপসুরত ধাইটা— ওই যাকে গিন্নি একটু আগে বের করে দিয়েছেন— আজ রাত্রেই সে আমার বাড়িতে আসচে! জোর বরাত বলতে হবে— শিকার আপনা হতে ধরা দিয়েছে। ধাইগুলো যে নষ্ট মেয়েমানুষ তা কে না জানে? পাঁচ ভাতার নিয়ে কারবার… যে কেউ তুলে নিলেই হল। এটি কিন্তু ভারী সেয়ানা— এমন ভড়ং করে যেন ভাজা মাছটি তুলে খেতে জানে না। ওর ভাবখানা আমি যেন ওকে দিয়ে দাসীর কাজ করাব। দাসী বটে… কিন্তু সেবাদাসী।’

‘সিনোর রামিচেল্লি!’

‘আজ্ঞে।’

বক্তৃতার লিখিত অংশগুলো মুহুরির হাতে দিয়ে মোরি বলল, ‘এগুলো চট করে কপি করে ফেলুন তো।’

রামিচেল্লি লিখে চলল: সমাজতন্ত্রের বনিয়াদ পাকা করতে গেলে অর্থাৎ মানব সমাজে সাম্যের প্রতিষ্ঠা করতে হলে দু’টি কথা মনে রাখা কর্তব্য। প্রথমত, সকল মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, জীবন সংগ্রামের সূচনায় সকলকে সমান সুযোগ দিতে হবে। সমাজ-ব্যবস্থায় এই সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে প্রত্যেকেই স্বকীয় ব্যক্তিত্ব বিকাশের স্বাধীন ক্ষেত্র পাবে। দুঃখের বিষয় আধুনিক সমাজে এখনও এরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়নি। তার বিষময় ফল আমরা সকলেই প্রত্যক্ষ করছি। যে শিশু শক্তি ও স্বাস্থ্য নিয়ে গরিবের ঘরে জন্মাল, পরিণামে তাকে রুগ্ন শীর্ণ ধনীর সন্তানের কাছে হার মানতে হয়।…

‘সিনোর রামিচেল্লি!’

‘আজ্ঞে! স্যার!’

‘আপনার আজ কী হয়েছে বলুন তো? মাথা খারাপ হল নাকি? অমন করে হাসছেন কেন?’

—ক্ষিতীশ রায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *