ধস

ধস

চোখের পাতা পড়ার বিরতিতে আলো ফুটছে বাইরে। পিছিয়ে যাচ্ছে মাঠঘাট, চালাঘর, গাছপালার সিল্যুয়েট। ট্রেনের ভিতরে কিন্তু রাতের তলানিটুকু নেই। সকলেই বেশ জাগ্রত। আলোপাখা চলছে। ভিড় যথেষ্ট। সিট না পেয়ে কয়েকজন দাঁড়িয়েও আছে। এরই মধ্যে অহরহ চলছে হকারের হাঁকডাক।

রাত সাড়ে তিনটেয় শিয়ালদা থেকে ছেড়েছে প্যাসেঞ্জার ট্রেনটা। ট্যাক্সি করে এসে ট্রেন ধরেছে অতীশ। পাড়ার ড্রাইভারটিকে আগের দিনই বলে রেখেছিল।

কসবার নিজের ফ্ল্যাট থেকে স্টেশন আসতে যা ভাড়া লাগল, তার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ টাকায় পাওয়া গেল দুশো কিলোমিটারের ওপর প্যাসেঞ্জার ট্রেনের জার্নির টিকিট। কাউন্টারের লোকটি ভাড়া বলাতে, প্রথমে বিশ্বাস হয়নি অতীশের। বলেছিল, এত কম! স্মিত হেসে লোকটি বলে, এই লাইনে এরকমই। সবচেয়ে কম ভাড়াটা হচ্ছে দু’টাকা।

পৃথিবীর কোথাও নেই।

প্ল্যাটফর্মে একটু আগেভাগে পৌঁছেছিল অতীশ, জানলার ধারে সিট পেয়েছে। ট্রেন গতি নিতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হাওয়া। সেই হাওয়ায় এখন ভোর ভোর গন্ধ।

শেষ কবে দূরপাল্লার প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠেছে মনে পড়ে না অতীশের। ছোটবেলায় বছরে দু’-তিনবার মধুপুরে জেঠুর বাড়ি যাওয়া হত। বাবা কোনওদিন মেল ট্রেনে নিয়ে যাননি। বলতেন অপচয়। মেল ট্রেনের টিকিট কাটার সংগতি বাবার ছিল। কলেজ লাইফে বন্ধুরা মিলে বহু জায়গায় প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চেপে বেড়াতে গেছে। তার পিছনে আর্থিক কারণ যেমন ছিল, অনেক মানুষের সঙ্গে জার্নির মজাটাও ছিল বাড়তি পাওনা। ছাত্র রাজনীতি করার সময় থেকে বহু লোকজনকে নিয়ে প্যাসেঞ্জার ট্রেনেই নানান সম্মেলনে গেছে অতীশ। তারপর কবে থেকে যেন জীবনটা এক্সপ্রেস ট্রেনের গতি নিয়ে নিল। ইদানীং বউ-ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে গেলেও, এসি ছাড়া যায় না। কোম্পানি তো অফিস টুরে এসি-র ফেয়ার প্রোভাইড করেই। প্রয়োজনে ফ্লাইটেও পাঠায়। একটা নামী ওষুধ কোম্পানির এরিয়া সেলস ম্যানেজার সে। অতীশের চেহারায় এমন একটা বৈভব বিচ্ছুরিত পালিশ পড়ে গেছে যে, এই ট্রেনের আশপাশের সহযাত্রীরা নিজেদের মধ্যে প্রচুর বকবক করলেও, তাকে সঙ্গী হিসেবে নেয়নি। ওদের কথায় ঢোকার মতো উপযুক্ত প্রসঙ্গও খুঁজে পাচ্ছে না অতীশ। ওরা ডালিম-বেদানার পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করছে। বেলডাঙার লঙ্কার যতই নামডাক থাক, কপিও কিন্তু কিছু খারাপ হয় না। শ্রাবণ শেষ হয়নি, এখনই বড় বড় সাইজ হয়ে গেছে। এবার মুর্শিদাবাদে আমের ফলন নাকি দারুণ হয়েছিল, তবে সেইসব নামীদামি আম তো

আমরা পাই না, প্লেনে করে বিদেশে চলে যায়। আমগুলোর নামও বলছিল ওরা… কোন যোগ্যতায় এসব প্রসঙ্গে নাক গলাবে অতীশ? কিছুই তো জানে না। শুধু বাজার থেকে কিনে খায়। সহযাত্রীদের কথায় কান পেতে রেখে অতীশ তাই ট্রেনের বাইরে ভোর আসা দেখছে।

দাদা, কাইন্ডলি আপনার জলটা একটু দেবেন।

‘কাইন্ডলি’ শুনেই অতীশ বুঝেছে, কথাটা তাকে উদ্দেশ করে বলা। ঘাড় ফেরাতে দেখে, তার পাশের জনের পরের যুবকটি হাতটা একটু বাড়িয়ে আছে। তিরিশের কাছাকাছি বয়স।

ওহ্, শিয়োর। বলে অতীশ পিঠের কাছে রাখা মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা এগিয়ে দেয়।

ছেলেটি দু’ঢোক খেয়ে ফেরত দেয় বোতল। বলে, থ্যাঙ্ক ইউ।

অতীশ সৌজন্যের হাসি হাসে। ছেলেটি বলে, সিট পাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে কোথায় যে জলের বোতলটা ফেললাম…! এখন অবধি কোনও জলওলা উঠল না। আলাপ জমানোর ইচ্ছায় অতীশ জানতে চায়, যাবে কত দূর? ছেলেটি বলে, বহরমপুর। আপনি?

সত্যিকারের গন্তব্য বলতে গিয়েও ঢোক গিলে নেয় অতীশ। বলে, একেবারে শেষ। লালগোলা।

হিসেব করে কথাটা বলেছে অতীশ। ছেলেটি নেমে যাবে বহরমপুর, অতীশের আসল গন্তব্য তার পরে। কিন্তু লাভ কিছু হল না। ছেলেটি বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, লালগোলা যাবেন তো এই ট্রেনে এলেন কেন! ঘণ্টা দুয়েক পরেই এক্সপ্রেস ট্রেন ছিল, হাজারদুয়ারি। ফাঁকাও থাকে। আরামে যেতে পারতেন। একটু হয়তো দেরি হত।

অতীশের চেহারার জৌলুস দেখেই কথাটা বলেছে ছেলেটি, কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না অতীশ। ছেলেটি নিজের থেকেই কারণ খুঁজে পেল। বলল, আপনার অবশ্য কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। সিট ভালই পেয়েছেন।

স্বস্তি পেল অতীশ। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ফের জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল। আকাশ ফরসা হয়েছে অনেকটাই। গ্রামের সবুজাভা এখন দিগন্ত প্রসারিত।

সঠিক গন্তব্য ছেলেটিকে বলতেই পারত অতীশ, তাতে ছেলেটির বিস্ময় বাড়ত বই কমত না। অতীশের যেমন প্যাসেঞ্জার ট্রেনে যাত্রা করার কথা নয়, ভগবানগোলাতেও কোনও কাজ থাকা বেশ আশ্চর্যের। ছেলেটি যদি জিজ্ঞেস করত, কী কারণে যাচ্ছেন?

উত্তর দিতে বেগ পেতে হত অতীশকে। ভগবানগোলা সম্বন্ধে তার কোনও ধারণা নেই। রিলেটিভের বাড়ি যাচ্ছি বললে ছেলেটি হয়তো ঠিকানা জানতে চাইত। গ্রামের মানুষ অনেক দূর অঞ্চলের হদিশ জানে। যে-ঠিকানায় যাচ্ছে অতীশ, সেটা আদৌ আছে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান সে। লোকটি জায়গার নাম বলার সময় অতীশের মতোই হোঁচট খেয়েছিল। অতীশের যেহেতু তথ্য গোপন করার শহুরে নৈপুণ্য আছে, তাই গিলতে পেরেছে আসল নাম। লোকটা পারেনি। প্রথমে বলেছিল, ভগবানগোলায় নেমে টাঙা বা রিকশায় চড়ে

বলবেন আখেরিগঞ্জ যাব। সঙ্গে সঙ্গে শুধরে নিয়ে বলেছিল, না না, আখেরিগঞ্জ নয়। ভুল হয়ে গেল, বলবেন, খড়িবনি। সেখানে এসে যে-কাউকে আমার নাম বললে দেখিয়ে দেবে বাড়ি।

লোকটার নাম ব্রজলাল মিশ্র। ফোনে এই নামটাই বলেছে। তাকে এখনও চোখে দেখেনি অতীশ। লোকটা যে-কারণে অতীশকে ডাকছে, আজকের দিনে তা বেশ অভাবনীয়। বিষয়টা পুরোপুরি না মেটা পর্যন্ত আত্মীয়, বন্ধু কাউকে কিছু বলা যাবে না। ট্রেনের সহযাত্রী যুবকটিকে তো নয়ই। কেননা এই মিশনে অতীশের ঠকে যাওয়া বা একটু স্পেসিফিক্যালি বলতে গেলে বোকা বনে যাওয়ার চান্স আছে প্রচুর। খানিকটা রিস্ক ফ্যাক্টরও থাকছে এই অভিযানে। কিন্তু বিষয়টা এমনই কৌতুহলোদ্দীপক, আকর্ষণ এড়ানো যাচ্ছে না।

লোকটা, মানে ব্রজলাল মিশ্র গতকালও ফোন করেছিল। রাত তখন সাড়ে আটটা। অফিস থেকে ফিরে অতীশ জুতো খুলছে। কাল ফিল্ডওয়ার্কে যেতে হয়নি, জোনাল অফিস থেকে ফিরেছিল বাড়িতে। মোবাইল সেটে আসা কলটা ধরতে একটু দেরি হয় অতীশের, ‘হ্যালো’ বলতেই ওপ্রান্তে ভেসে ওঠে গত ক’দিনের রহস্যেঘেরা বিনয়ী কণ্ঠস্বর। খানিকটা নাছোড় ভাবও আছে ওই স্বরে। লোকটা বলল, ফোন ধরতে দেরি হল যে, ঘুমায়ে পড়ছিলেন নাকি?

হেসে ফেলেছিল অতীশ। বলেছিল, এখনই কী শোব! এই তো অফিস থেকে ফিরলাম। আমাদের শুতে শুতে রাত বারোটা।

তা জানি। আপনাদের শহরের অভ্যাস। আমি তো ফোন সেরে নিয়া শুতে চলে যাব। গ্রামের দিকে কীই বা আর কাজ! তবে আজ আপনার একটু তাড়িতাড়ি শুতে যাওয়া উচিত। কাল শেষরাতে ট্রেন।

ব্রজলালের কথা শেষ হতে অতীশ বলেছিল, হ্যাঁ, আজ আগেই শুয়ে পড়ব। আপনি কি এটা খেয়াল করানোর জন্য ফোনটা করলেন?

না। আসলে আমার স্ত্রী কইল কী, আপনি মাছ না মাংস কোনটা পছন্দ করেন, একবার জেনে নিতে। মাংস হলে কীসের, মুরগি না খাসি?

এই হল সেই ‘নাছোড় ভাব’। বিরক্তি চলে এসেছিল অতীশের গলায়। বলেছিল, আপনাকে তো বলেছি, যাব, জিনিসটা নেব আর চলে আসব। কোনও খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত করবেন না।

ও প্রান্তে একইরকম নিরুত্তাপ বিনয়ী কণ্ঠে ব্রজলাল বলেছিল, তা কী করে হয়! অতটা পথের ধকল নিয়া আপনি দুপুর নাগাদ এসে পৌঁছাবেন, আমার স্ত্রী আপনাকে না খাইয়ে ছাড়বেই না।

ব্যাপারটা এড়ানোর জন্য অতীশ একটা যুক্তি খাড়া করেছিল। বলেছিল, দেখুন, দিনের বেলা বেশির ভাগ দিনই আমি ভাত খাই না। ফিল্ডে ঘুরে কাজ করতে হয়। দোকান থেকে স্ন্যাকসট্যাকস কিনে চালিয়ে দিই।

আপনি তো কাল রাস্তায় থাকছেন না। আসছেন আমার বাসায়। নারায়ণসেবার সুযোগটা অন্তত দিন।

কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না অতীশ। গত সাতদিন হল লোকটা তাকে এমন একটা কারণে বিরক্ত করে খাচ্ছে, কিছু বলাও যাচ্ছে না। অতীশের দিক থেকে কোনও সাড়া না পেয়ে ব্রজলাল ফের বলেছিল, ঠিক আছে, আমি আমার মতো ব্যবস্থা করে রাখব। এবার আপনার অভিরুচি। রাখছি। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন। নয়তো ট্রেন মিস করবেন।

ফোনটা কাটার পর অতীশ থম মেরে দাঁড়িয়ে ছিল। কেয়া ছিল কাছেই। ফোনের এক প্রান্তে কথা শুনেই বুঝেছে, কার ফোন, বক্তব্য কী। বলে উঠেছিল, যতই রিকোয়েস্ট করুক, খাওয়াদাওয়া একদম নয়। যে-রিকশায় যাবে, দাঁড় করিয়ে রাখবে। জিনিসপত্তর বুঝে নিয়ে ফিরবে ওই রিকশাতেই।

রানা টিভিতে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দেখছিল। ঘাড় ফিরিয়ে বলেছিল, চা অফার করলেও খাবে না। নট ইভন ওয়াটার।

কেয়া বলেছিল, তুই যা না বাবার সঙ্গে!

রানা বলল, আমি তো বলেই ছিলাম যাব। ইফ বাবা নট এগ্রিড, হোয়াট ক্যান আই ডু?

রানা ক্লাস টেন। এমন কিছু বড় হয়ে যায়নি যে ওকে সঙ্গে নিলে খুব কিছু সুবিধে হবে। তা ছাড়া অতীশের ঠিক কী ধরনের ক্ষতি করতে পারে লোকটা, এখনও পর্যন্ত ভেবে বার করা যায়নি।

অফিসের ড্রেস ছেড়ে চায়ের কাপ হাতে সেটাই আবার করে ভাবতে বসেছিল অতীশ। ঘটনা হয়েছে কী, দিন দশেক আগে অতীশের এক্সিকিউটিভ ব্যাগটা খোওয়া গিয়েছিল। ওই ব্যাগটা নিয়েই অতীশ ফিল্ডওয়ার্ক করে। যাচ্ছিল ভলভো বাসে শিলিগুড়িতে। বাঙ্কে নিজের ট্র্যাভেল ব্যাগের পাশেই ছিল কাজের ব্যাগটা। চৌত্রিশ নম্বর হাইওয়ের কৃষ্ণনগরের কাছে এসে বাসটা চা খাওয়ার জন্য হল্ট দিল। অন্যান্য প্যাসেঞ্জারদের মতো অতীশও নেমেছিল চা-সিগারেট খেতে। বাসে উঠে সংগত কারণেই চোখ গিয়েছিল বাঙ্কে, ব্যাগ দুটো ঠিকঠাক আছে কিনা? ভীষণ অবাক হয়ে অতীশ দেখে, কাজের ব্যাগটা নেই। ব্যাপারটা প্রথমে বিশ্বাসই হতে চাইছিল না। তার এতদিনের সেলসের চাকরিতে এই ঘটনা প্রথম। তাড়াতাড়ি চোখ চালিয়েছিল বাঙ্কে রাখা বাকি লাগেজের ওপর, কেউ হয়তো ভুল করে মিস প্লেসড করে ফেলেছে। তৎপর হাতে লাগেজগুলো সরিয়েও কোথাও পাওয়া গেল না। বাস তখন সবে স্টার্ট দিয়েছে, অতীশ ‘আমার ব্যাগ কোথায় গেল’ বলে হইচই শুরু করে দিয়েছিল। থেমে গিয়েছিল বাস। কনডাক্টর এল, প্যাসেঞ্জাররা ঘিরে ধরল অতীশকে। নানান প্রশ্ন ধেয়ে এল, কোথায় ছিল ব্যাগ, দেখতে কীরকম, দামি কিছু ছিল কি… খানিকক্ষণ খোঁজাখুঁজি হল। দেখা হল সমস্ত সিটের তলা। যাত্রীদের মধ্যেই একজন পরামর্শ দিল, দাদা, ও ব্যাগ আর আপনি পাবেন না। যে নেওয়ার অনেক আগেই নিয়ে চলে গেছে। আপনি এখনই নেমে গিয়ে নিয়ারেস্ট থানায় এফআইআর করুন। দেরি করলে থানা ইন্টারেস্ট দেখাবে না।

ব্যাগে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিল। কোপ্যাসেঞ্জারদের সবটা বলেনি অতীশ। ব্যাগ না থাকাটা চাকরি না থাকার মতো মনে হচ্ছিল। সময় নষ্ট না করে অতীশ নেমে এসেছিল বাস থেকে।

কৃষ্ণনগর থানায় গিয়ে এফআইআর করেছিল অতীশ। ব্যাগে যা যা ছিল, লিখল সব। লিস্ট দেখে অফিসার বললেন, আপনি এখনই কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে এটিএম কার্ড আর ক্রেডিট কার্ড ব্লক করতে বলুন। আশা করি এত তাড়াতাড়ি অ্যাকাউন্ট অপারেট করতে পারেনি চোর।

ভাগ্যিস মোবাইল সেটে দুটো কার্ডেরই কাস্টমার কেয়ারের নম্বর সেভ করা ছিল। ব্যাঙ্ককে জানিয়ে কার্ডগুলো ব্লক করিয়েছিল অতীশ। তারপরই মনে হতে থাকে, ব্যাগ হারিয়ে বিশাল কিছু ক্ষতি হয়নি। ব্যাগের নিজস্ব একটা দাম আছে, আর ছিল ল্যাপটপ। দুটোই কোম্পানির দেওয়া। স্টকিস্টের নামে তিনটে অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক ছিল। অন্য কেউ ভাঙাতে পারবে না। তবু ব্যাঙ্ককে স্টপ পেমেন্টের নোটিশ করতে হবে। সাবধানতার মার নেই। ভোটার কার্ডও ছিল ব্যাগে। ই-টিকিট কিংবা হোটেল বুকিং-এর জন্য অনেক সময় দরকার পড়ে। আই কার্ডের কাজ এবার থেকে প্যান কার্ড দিয়ে চালিয়ে নেবে। ভোট এখনও অনেক দেরি, অ্যাপ্লাই করে রাখবে কার্ডের জন্য। ওষুধের কিছু লিটারেচার ছিল, যেমন থাকে৷ ক্ষতি বলতে নগদ চার হাজার টাকা। শিলিগুড়ি সার্কিটে কাজ করতে যাচ্ছিল অতীশ, টাকাটা থাকা-খাওয়া বাবদ নেওয়া।

পুলিশ অফিসার খুব একটা আশ্বস্ত করতে পারেননি। বলেছিলেন, দেখি, কত দূর কী করা যায়। বাসে-ট্রেনে চুরি হওয়া জিনিস উদ্ধার করা ভারী মুশকিল। আপনারা যদি একটু কেয়ারফুল না হন…

পার্সে কিছু টাকাপয়সা ছিল। থানা থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরে কলকাতার জোনাল অফিসে ফিরে এসেছিল অতীশ। কলিগদের সাহচর্যে এসে চুরির ধাক্কাটা অনেকটাই লঘু হয়ে গেল। তারা বলল, তুমি অন ডিউটি ছিলে, কম্পেনসেট করা উচিত কোম্পানির। জেনারেল ম্যানেজারকে জানাও।

বসকে সেদিনই রিপোর্ট করে অতীশ। জিএম পরামর্শ দিলেন, যা যা চুরি গেছে সব লিখে সঙ্গে থানা এবং এফআইআর নম্বর উল্লেখ করে হেড অফিসে একটা দরখাস্ত করতে। তারপর উনি দেখবেন। আশা করা যায় পজিটিভ কিছু হবে। এরকম কেসে কোম্পানি এর আগে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।

নিশ্চিন্ত মনে পরের দিন থেকেই অফিসের কাজে নেমে পড়েছিল অতীশ। বাড়িতে একটা ব্যাগ ছিলই। এমআর থাকাকালীন ব্যবহার করত। অফিস থেকে চেয়ে নিল টেপ মারা ওল্ড মডেলের ল্যাপটপ। ফিল্ডওয়ার্ক করতে কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না।

তিনদিন বাদে কাজ সেরে বাড়ি ফিরেছে। রাত তখন আটটা। মোবাইলে ফোন এল অচেনা নম্বর থেকে। অতীশ সাড়া দিতে, ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল বয়স্ক মানুষের কণ্ঠস্বর, কথায় একটু গেঁয়ো টান, পূর্ববঙ্গের ধরন। বলল, আপনি কি অতীশ সেনগুপ্ত বলছেন?

অতীশ একটু অবাক হয়েছিল, হঠাৎ একটা গ্রামের লোক তাকে কেন খুঁজছে! হ্যাঁ, বলছি।

বলেছিল,

ও প্রান্ত বলেছিল, ক’দিন আগে কি আপনার কোনও কিছু হারিয়েছে?

হ্যাঁ, চুরি গেছে। অফিসের ব্যাগ। কেন বলুন তো? অবাক এবং সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চেয়েছিল অতীশ।

লোকটি বলল, চুরি গিয়েছিল কি না, জানি না। তবে ব্যাগটি আমি পাইছি। যদি একবারটি আইসা নিয়া যান…

হারিয়ে ফেলা প্রিয়জনকে অপ্রত্যাশিত ভাবে ফিরে পাওয়ার মতো আনন্দ হয়েছিল অতীশের। যতই জড় পদার্থ হোক, ব্যাগটার সঙ্গে নিত্যদিনের একটা সম্পর্ক তো তৈরি হয়েছিল। অতীশ বলেছিল, আপনি থাকেন কোথায়?

ভগবানগোলা স্টেশনে নাইমা খানিকটা আসতে হবে।

স্টেশনটার নাম চেনা চেনা লাগলেও, ঠিকঠাক প্লেস করতে পারছিল না অতীশ। জানতে চেয়েছিল, ভগবানগোলাটা যেন কোন লাইনের?

লোকটি বলেছিল, লালগোলার দুইটা স্টেশন আগে। এক্সপ্রেস ট্রেন দাঁড়ায় না।

মোটামুটি বুঝে গিয়েছিল অতীশ। একই সঙ্গে অবাক হয়েছিল এই ভেবে, জিনিসটা হারাল কৃষ্ণনগরের হাইওয়েতে, পাওয়া যাচ্ছে ভগবানগোলা। জিজ্ঞেস করেছিল, ব্যাগটা আপনি পেলেন কীভাবে?

উত্তরে লোকটা যা বলেছিল, মোটেই বিশ্বাসযোগ্য লাগেনি অতীশের। খটকাটা এখনও রয়ে গেছে। ব্রজলাল বলেছিল সে নাকি নিজের কাজে প্রায়ই রানাঘাট, কৃষ্ণনগর আসে। ক’দিন আগে রাতের প্যাসেঞ্জার ধরে প্ল্যাটফর্মে নেমেছে, দেখে, একটা পাগল দামি ব্যাগ নিয়ে ওলটপালট করছে। খুলতে অবশ্য পারেনি। ব্রজলাল পাগলের থেকে ব্যাগটা কেড়ে নেয়। বাড়ি গিয়ে ব্যাগ খুলে কার্ড পায় অতীশের। ওখান থেকেই নম্বর পেয়ে ফোন করেছে।…

কথাবার্তার মাঝে লোকটার নাম জেনে নিয়েছিল অতীশ, গোটা ঘটনা শোনার পর একটা বাঁকা প্রশ্ন করে, ব্যাগটা আপনি থানায় জমা দিলেন না কেন?

ব্রজলাল বলেছিল, পুলিশ বড় হুজ্জতের ব্যাপার। জেরা করে জেরবার করে দেবে। যখন তখন ডেকে পাঠাবে। আমি সামান্য খেটেখাওয়া মানুষ, কাজ কামাই কইরা থানায় ছুটতে হইলে, সংসার চলবে কী করে কন?

প্রস্তাবে রাজি হওয়া ঠিক হবে কিনা, ভাবছিল অতীশ। খানিক নীরবতার পর ব্রজলালই বলে, দেখুন, ব্যাগটা আমি পেয়েছি, ভিতরে যা ছিল কিছুই খোওয়া যায় নাই। আপনি এসে নিয়া যাবেন। খামকা পুলিশকে জড়িয়ে কী লাভ! পুলিশের কাজ চোর-ডাকাত ধরা। এখানে তো সেরকম কিছু হয় নাই।

সামান্য জেরার ঢঙে অতীশ বলেছিল, ব্যাগ থেকে কিছুই খোওয়া যায়নি, আপনি কী করে বুঝলেন?

ব্রজলাল বলেছিল, যেহেতু ব্যাগ থেকে আমি কিছু নেইনি। পাগলটাও খুলতে পারে নাই ব্যাগ।

উত্তরটা যে এত সহজ হবে, আশা করেনি অতীশ। কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে বলেছিল, ঠিক আছে, দু’-চার দিনের মধ্যে সময় করে আপনার কাছে যাচ্ছি। ঠিকানাটা বলুন।

তখনই ব্রজলাল জায়গার নাম প্রথমে আখেরিগঞ্জ বলে নিজেকে শুধরে নিয়ে বলেছিল খড়িবনি। ব্যাগ খোওয়া যাওয়ার ঘটনাটা বাড়ি, অফিস ছাড়া বাইরের কাউকে বলেনি অতীশ। বলা মানেই তো নিজের ক্যালাসনেসকে বিজ্ঞাপিত করা। ব্যাগ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনাটাও ঠিক করল বাড়ির লোক ছাড়া কাউকে বলবে না। কেননা, সেখানে যদি আবার ঠকে যায়, চেনা পরিচিতজনের কাছে ঠাট্টার পাত্র হয়ে যাবে।

কেয়া অবশ্য বারবার বলেছে, সঙ্গে একজন অন্তত কাউকে নাও। রানা তৈরি ছিল যেতে৷ অতীশ রাজি হয়নি। বলেছে, দিনের বেলা যাব আসব এত ভয়ের কী আছে! লোকটা ভাল করেই জানে, যে-ফোন থেকে ও কল করছে, নম্বর আমি সেভ করে রাখব। ওখানে যাচ্ছি, দু’-একজনকে নিশ্চয়ই বলেও রাখব। যদি কোনও ধরনের প্রবলেম হয়, পুলিশ দিয়ে লোকটাকে ট্রেস করা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। ইচ্ছে করলে এখনই আমি পুলিশ দিয়ে লোকটাকে তোলাতে পারি। সেটা বুঝেও লোকটা আমাকে ডাকছে, কোথাও একটা সততার জোর আছে নিশ্চয়ই।

পুরোপুরি কনভিন্স হল না কেয়া। খুঁতখুঁত করতে লাগল। রানার মনও সায় দেয়নি। অজানা আশঙ্কায় ভুগতে লাগল ওরা। ব্রজলাল ওদিকে একদিন অন্তর ফোন করে যাচ্ছে, কবে আসছেন?

প্রথম দু’দিন যাচ্ছি, যাব, জানাচ্ছি দিন, বলে কাটাল অতীশ। ব্যাগ হারিয়ে বিশাল কোনও ক্ষতি তো হয়নি। কাজও চলে যাচ্ছে। অফিসে কানাঘুষো শুনেছে তাকে কম্পেনসেট করা হবে। সাব-কনশাস মাইন্ডে অতীশও বোধহয় খুঁজে যাচ্ছিল, খড়িবনি গেলে তার কী কী ক্ষতি হতে পারে। তাই খুব একটা তাগিদ পাচ্ছিল না যাওয়ার।

তৃতীয়বার যখন লোকটা ফোন করল, অতীশ বলেছিল, আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন! জিনিস তো হারিয়েছে আমার। ফেরত পাওয়ার আগ্রহ আমারই বেশি হওয়া উচিত।

ব্রজলাল বলেছিল, আসলে কী জানেন, আমার বাড়ি খুব একটা পাকাপোক্ত নয়। আপনাকে একবার কথা দিয়েছি ব্যাগটা ফেরত দেব, ফের যদি চুরি হইয়া যায়। আমি কাজে বেরিয়ে গেলে বাসায় থাকে শুধু মেয়েরা…

সেদিনও অতীশ বলেছিল, অফিসের একটু চাপ চলছে। আপনাকে আজ-কালের মধ্যে জানাচ্ছি কবে যাব।

পরের দিন বাড়ি ঢুকতেই আবার ফোন। এবার আর অতীশের সঙ্গে কথা বলতে চাইল না। বলেছিল, বউদিরে দ্যান। ,

বউদিটি কোন জন, বুঝতে একটু সময় লেগেছিল অতীশের, ফোন সেট কেয়ার দিকে বাড়িয়ে বলেছিল, তোমার সঙ্গে কথা বলবে।

কেয়া অপ্রস্তুত। অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল, আমার সঙ্গে আবার কী কথা!

ঠোঁট উলটে ছিল অতীশ। ফোন সেট কানে নেওয়ার খানিক বাদেই কেয়ার মুখে কেমন যেন গদগদ ভাব ফুটে উঠল। কেয়া বলতে লাগল, না, এবার হবে না। পরে যাবখন। ওপারের কথা শুনে নিয়ে বলল, আমার একটিই ছেলে, ক্লাস টেন-এ উঠল। আপনার?… এরকম আরও কিছু সাংসারিক কথা বলার পর কেয়া ফোন সেট এগিয়ে দিয়েছিল অতীশের দিকে।

অতীশ ‘হ্যাঁ, বলুন’ দিয়ে শুরু করতেই ব্রজলাল বলে ওঠে, বউদিকে কইলাম আপনার সাথে আসতে। কথা দিয়েছেন পরেরবার আসবেন।

কথা কেটে অতীশ বলেছিল, আচ্ছা ব্রজবাবু, আপনিই তো ব্যাগটা নিয়ে চলে আসতে পারেন আমাদের বাড়ি!

প্রায় আঁতকে ওঠা গলায় ব্রজলাল বলেছিল, ওরে বাবা, কলকাতা আমি ভীষণ ভয় পাই! রাস্তা গুলায়ে ফেলি। আমার দৌড় কৃষ্ণনগর, রানাঘাট পর্যন্ত। তা ছাড়া আপনি ধরুন আমার আসার কথা আত্মীয়বন্ধুদের কইয়া রাখলেন। আমার অপেক্ষায় তাঁরাও রইলেন আপনার বাড়ি। আমি গিয়া পড়তেই, তাঁরা যদি এটা-ওটা প্রশ্ন শুরু করে দেন, আমি গুছিয়ে উত্তর দিতে পারব না। সে এক গোলমেলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। আমি ওসবের মধ্যে যেতে চাইছি না। কেনই বা যাব কন? আপনার জিনিস ফিরত দেওয়ার বদলে আমি তো কিছু প্রত্যাশা করছি না।

লোকটা বোকা না চালাক, বুঝতে এতদিনের পোড় খাওয়া সেলসম্যান অতীশ বেশ ফাঁপরে পড়েছিল। কথা আর বাড়ায়নি। ওই ফোনেই সিডিউল ঠিক করে নিয়েছিল। সামনের রবিবার যাবে। ব্রজলাল বলে দিয়েছিল, ট্রেনের টাইম। দিনের দিন ফিরতে হলে শেষরাতের লালগোলা প্যাসেঞ্জারটাই ধরা ভাল।

ফোন ছাড়ার পর ব্রজলালকে সার্টিফিকেট দিয়েছিল কেয়া। বলেছিল, কথা বলে মনে হল লোকটা খারাপ নয়।

একদিন যেতে না যেতেই এই কেয়াই আবার অনিশ্চয়তায় ভুগতে শুরু করেছে। গতকালের ফোনটার পর যেমন বলেছিল, ও বাড়িতে ভাতটাত খাবে না। রানা তো আরও সাবধানী। ওদের সঙ্গে কোনও আলোচনায় না গিয়ে অতীশ যখন চা খেতে খেতে ভাবছিল— ওখানে গেলে তার কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে, মাথায় এসেছিল একটা সম্ভাবনার কথা, আচ্ছা, লোকটা এভাবে ডেকে কিডনি ফিডনি কেটে নেবে না তো? সবচেয়ে দামি জিনিস বলতে ওটাই থাকবে কাছে। রানা সঙ্গে গেলে লোকটার বাড়তি লাভ। পরক্ষণেই নিজেকে মনে মনে ধমকেছিল অতীশ, এত বাড়াবাড়ি চিন্তার কোনও মানে হয়! কিডনি নেওয়ার হলে, এমনিই কখনও সুযোগ বুঝে অজ্ঞান করে নিয়ে নিতে পারত। তার জন্য ব্যাগ চুরি করতে যাবে কেন?

দাদা, একটু চা খান।

সংবিৎ ফেরে অতীশের। যে-ছেলেটি তার থেকে জল খেয়েছিল সে-ই প্লাস্টিক কাপে চা নিয়ে এগিয়ে ধরেছে। চা-ওয়ালা দাঁড়িয়ে রয়েছে প্যাসেজে। ওর থেকে নিশ্চয়ই নেওয়া হয়েছে চা-টা।

তবু সামান্য ইতস্তত করে অতীশ। দিনকাল যা হয়েছে নখের মধ্যে ঘুমের ওষুধ রেখে, আঙুল ডুবিয়ে দিচ্ছে চায়ে। প্যাসেঞ্জারকে ঘুম পাড়িয়ে লুঠ হচ্ছে সব।

ছেলেটি ফের বলে, আরে নিন না। আপনি তো উঠে থেকে কিছুই খাননি।

সত্যিই কিছু খাওয়া হয়নি। শরীরটাও চা চা করছে। সঙ্গে বিস্কিট দিয়েছে কেয়া। বাকি প্যাসেঞ্জাররা তখন থেকে কিছু না-কিছু খেয়েই যাচ্ছে। কামরায় এখন অনেক আলো।

সহযাত্রীদের মুখগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুখে অভাব, পরিশ্রমের ছাপ থাকলেও, আছে অদ্ভুত সারল্য। মনে হচ্ছে না এরা কোনও লুঠেরার দল। চায়ের কাপটা ছেলেটার থেকে নেয় অতীশ।

চা-বিস্কিট পেটে যেতে খিদে চাগিয়ে উঠল। ঝালমুড়িওয়ালার থেকে মুড়ি কিনল অতীশ। খেতে খেতে লক্ষ করল উলটোদিকে বসা বছর পনেরোর ছেলেটি শসাওলাকে ডেকে একটা শসা দিতে বলল, খোসা না ছাড়িয়ে।

অতীশ বলল, না ছাড়িয়ে খাচ্ছ কেন?

ছেলেটি বলে, ওতেই তো ভিটামিন।

অতীশ বলল, ধুয়ে খাও অন্তত। আজকাল তো সব ফসলেই কীটনাশক স্প্রে করা হয়। কথা শুনল ছেলেটি। জানলার কাছে গিয়ে নিজের বোতলের জল দিয়ে ধুল শসাটা। অতীশের মুখোমুখি বসে থাকা ষাট পার করা লোকটা বলল, এখন কিন্তু পানপাতায় স্প্রে করা বন্ধ হয়ে গেছে। কড়াভাবে বারণ করেছে সরকার। পান তো সরাসরি মুখে পুরে দেওয়া হয়। তারপর ধরুন বেগুন, পোকা লাগা মানেই কিন্তু ভাল। বিষ দেওয়া হয়নি… এরকম নানান কথাবার্তা চলতে লাগল। অতীশ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করে, এদের সঙ্গে কথা চালাতে মোটেই তার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। দলে বেশ ভারী মনে হচ্ছে নিজেকে।

দশটার আগেই ভগবানগোলায় পৌঁছে গেল অতীশ। রিকশা নিয়েছে। বলেছে, খড়িবনি যাব। বেশিক্ষণের কাজ নেই, ফিরে আসব তোমার গাড়িতেই।

এ কথায় কোনও ভাববিকার দেখা গেল না মাঝবয়সি রিকশাওয়ালার। ভাড়া কত দিতে হবে, বলল না তাও। বোঝাই যাচ্ছে প্যাসেঞ্জার খুব একটা হয় না। যা পাবে, সেটাই রোজগার।

দ্রুত ফুরিয়ে গেল গঞ্জ এলাকা। রাস্তা পিচঢালা হলেও, একেবারেই ভাঙাচোরা। এখন দু’পাশে দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত। চড়চড়ে রোদ উঠেছে। তবে গরম খুব একটা লাগছে না। একটা চোরা মিঠে হাওয়া বইছে। রিকশাওয়ালার সঙ্গে আলাপ জমাতে চেয়ে অতীশ বলে, ধান এবার বেশ ভালই হয়েছে বলো।

রিকশাওয়ালা বলে, কই আর ভাল হইল। বৃষ্টিই নাই। জল খরিদ করে কি আর চাষ হয়? পুজোর আর দেড় মাসও বাকি নাই। গাছগুলান ক্যামনে কালা পারা হইয়া আছে।

অতীশ বুঝল কথা এদিকে গড়াতে দিলে তার জ্ঞানভাণ্ডারের বাইরে চলে যাবে। চলে গেল অন্য প্রশ্নে। সেটা জানাটাও জরুরি। জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, এখানে আখেরিগঞ্জটা কোথায়?

প্যাডেল মারতে কষ্ট হচ্ছে রিকশাওয়ালার, হাঁপ ধরা গলায় বলে, এটাই আখেরিগঞ্জের রাস্তা। তবে সে গাঁ এখন আর নাই। লদীর ভাঙনে সবটাই তলিয়ে গেছে।

বুকটা কেমন একটু ছমছম করে উঠল অতীশের, গোটা গ্রামটাই নেই! অথচ ব্রজলাল প্রথমে বলেছিল আখেরিগঞ্জে থাকে। ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। বিশদ জানার জন্য অতীশ জিজ্ঞেস করে, এখানে কী নদী? রাস্তাটা কি সোজা নদীতে গিয়ে পড়বে?

রাস্তা বাঁধে গিয়া শেষ হবে। লতুন বাঁধ। লদি হচ্ছে গিয়া পদ্মা।

আখেরিগঞ্জের লোকগুলোর কী হল?

যারা পলাইতে পারল, গেল। বাকি সব লদির বুকে।

হাওয়াটা এখন আর ততটা মিঠে লাগছে না। হাওয়ার ভিতরে কেমন একটা খাঁ খাঁ ভাব। এবার প্রশ্ন করে রিকশাওয়ালা, আপনে খড়িবনিতে কার বাসায় যাইবেন? ব্রজলাল মিশ্র। চেনো?

রিকশাওয়ালা যেন একটু তৎপর হল উত্তর দিতে, খুব চিনি। ব্রজদা তো আগে আখেরিগঞ্জেই ছিল। বিরাট মুদিখানা। জমি, বাড়ি! লদি গ্রাম খেয়ে নিতে ব্রজদা খড়িবনিতে বাড়ি করেছে। তা আপনের সাথে উনার কী কাম?

আছে একটা। বলে চুপ করে রইল অতীশ। রিকশাওয়ালা নিজের মনেই বলতে লাগল, ব্রজদা লোক ভাল। এলাকায় খুব সুনাম, নয়তো মল্লিকসাহেব উনাকে এককথায় মুনশির কাজে বহাল করে!

‘মুনশি’ পদটা সেই জমিদার আমলের। এখন কাজের ধরনটা ঠিক কী, বোঝার জন্য অতীশ জিজ্ঞেস করে, মল্লিকসাহেব এখানকার কে?

পাটের বিরাট আড়তদার। ব্রজদা উনার খাতাপত্তর দেখে। আদায় উশুলে এ-শহর ও-শহরে যায়। খুবই বিশ্বাসী লোক। ব্রজদার ছেলেটা হইছে বিপরীত। কীরকম? জানতে চায় অতীশ।

নেশাভাং করে। মেলামেশা করে চোরাকারবারিদের সাথে। কাছেই বর্ডার। ছেলেকে শোধরানোর তরে বিয়া দিল ব্রজদা। শোধরায় নাই। ব্রজদা ছেলেকে বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। ছেলের বউ অবিশ্যি আছে। বাবা না থাকলে ছেলে বাড়িতে ঠিকই আসে…

কথা চলতে চলতে অতীশরা পার হল দুটো পাড়া। রাস্তা সেখানে একেবারে ভেঙে গেছে, গৃহস্থের উঠোন দিয়ে চলে গেল রিকশা। বেশির ভাগ বাড়িতেই বাঁশ খাটিয়ে পাট শুকোতে দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টি কম হওয়াতে এবার নাকি পাটচাষও ভাল হয়নি। অবশেষে গাছপালা ঘেরা একটা বসতিতে ঢোকার মুখে রিকশাওয়ালা বলল, এই হল গিয়া খড়িবনি।— আর একটু এগিয়ে বলল, ওই তো, বটগাছের নীচে বইসা আছে ব্রজদা।

বটগাছের বেদিতে বসে থাকা লোকটা রিকশা দেখে তড়িঘড়ি এগিয়ে এল। পরনে উঁচু করে পরা ধুতি, শার্ট। বয়স ষাটের নীচেই। গায়ের রং রোদে পোড়া, হাইট শর্ট। অতীশ নেমে এসেছে রিকশা থেকে। ব্রজলাল একটু তাকিয়ে রইল, বোধহয় মিলিয়ে নিল ভোটার কার্ডের ছবির সঙ্গে অতীশের চেহারা। তারপরই অতি বিনয়ে বলে উঠল, খুব কষ্ট হইল তো আসতে?

না না, কষ্টের কী আছে! বলল অতীশ।

প্রায় বরযাত্রী আপ্যায়নের মতো এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে ব্রজলাল বলল, আসেন আসেন। এই তো কাছেই বাড়ি।

দুপুর ফুরোতে চলল। ব্রজলাল, অতীশ এখন পদ্মার ধারে বোল্ডার ফেলা বাঁধের ওপর

দাঁড়িয়ে আছে। ব্রজলাল মিশ্রর বাড়িতে চা, জল, দুপুরের আহার সবই সেরেছে অতীশ। খুবই যত্ন করে খাইয়েছে ব্রজলাল মিশ্রর স্ত্রী। শাশুড়ির হাতে হাতে জিনিস এগিয়ে দিয়েছে ঘোমটা টানা পুত্রবধূ। খাওয়াদাওয়ার আগেই ব্রজলাল মিশ্র স্টিলের আলমারি থেকে ব্যাগ বার করে হ্যান্ডওভার করেছে অতীশকে। বলেছে, ভিতরের জিনিস ভাল করে দেখে নিতে।

দেখেছে অতীশ। কিচ্ছু খোয়া যায়নি। নগদ চার হাজার টাকাটাও রয়েছে। ফোনে খবরটা কেয়াকে জানিয়েছে অতীশ। কিছু টাকা অফার করেছিল ব্রজলাল মিশ্রকে। সে নেয়নি। বলেছে, সবসুদ্ধু আপনাকে ফিরত দিতে পাইরা আমার যে কী তৃপ্তি হচ্ছে, বলে বোঝাতে পারব না। ওর থেকে কিছু যদি আমি নেই, খুঁত থেকে যাবে।

অগত্যা অন্য প্রসঙ্গে গিয়েছিল অতীশ। বলেছিল, রিকশাওয়ালার মুখে শুনলাম, আপনার আগের বাসস্থান নাকি ভাঙনে তলিয়ে গেছে।

ব্রজলাল বলল, হ্যাঁ, যাবেন নাকি একবার পদ্মা দ্যাখতে? মিনিট পাঁচ-সাতের পথ।

‘না’ করেনি অতীশ। পদ্মানদী আগে কখনও দেখেনি। দেখে একেবারে হাঁ হয়ে গেছে, এত চওড়া! এটা কি শুধু এখানেই?

ব্রজলাল আঙুল তুলে বলছে, ওই যে ওপারে দ্যাখছেন গাছপালা, বাড়িঘর, ওটা বাংলাদেশ।— আঙুল ফিরে এল এপারের জলের ওপর। বলল, ওইখানে ছিল আমাদের গ্রাম, আখেরিগঞ্জ। খুব বর্ধিষ্ণু গ্রাম।

অতীশ শুধু তাকিয়ে থাকে, সেই গ্রামের তো কোনও চিহ্ন নেই। প্রবল বেগে বয়ে যাচ্ছে জলরাশি। ব্রজলাল হয়তো মনের চোখে দেখতে পাচ্ছে গ্রামটা।

ব্যাগ ফেরত পাওয়া, আতিথেয়তা সব কিছু প্রত্যাশার বাইরে হলেও, একটা ব্যাপারে খটকা রয়ে গেছে অতীশের মনে। জিজ্ঞেস করেই ফেলে, আপনি তো বলেছিলেন আপনার বাড়ি পাকাপোক্ত নয়। এসে দেখলাম রীতিমতো ইটের গাঁথনি। ছাদ অবশ্য টালির। ব্যাগটা রেখেছিলেন স্টিলের আলমারিতে। আপনার বাড়িটাও কোনও ফাঁকা জায়গায় নয়। একটা পাড়ার মধ্যে। চুরির ভয় পাচ্ছিলেন কেন?

ম্লান হাসি ফুটে উঠল ব্রজলালের মুখে। বলল, প্রকৃত কারণটা ফোনে ঠিক বুঝানো যেত না। এখন কই তা হলে, আমি তো পায়ের তলায় মাটি হারানো মানুষ, বুঝি, কারও জরুরি কিছু হারিয়ে যাওয়া কতটা ক্ষতির। আপনার ব্যাগে দরকারি অনেক কাগজপত্তর ছিল, ব্যাঙ্কের কার্ড, টাকা, ভোটার কার্ড… ধরুন, দুম করে আমি আমি মইরা গেলাম। আমার পরিবার যদি আপনাকে ব্যাগটা না দেয়। বড় সমস্যায় পড়ে যাবেন।

অতীশ বোঝে, নদী ব্রজলালের পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিলেও, মনের জমিতে ধস নামাতে পারেনি। প্রসঙ্গ হালকা করতে চেয়ে অতীশ বলে, আপনি হঠাৎ মরে যেতে যাবেন কেন!

পদ্মার দিকে চেয়ে ব্রজলাল অন্যমনস্ক গলায় বলতে লাগল, কিছুই নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না, জানেন। দোকান বন্ধ কইরা দুপুরে খেতে এসেছি বাসায়, গ্রামে হঠাৎ রব উঠল, ফাটল ধরেছে। ঘর থেকে লাফিয়ে বাইরে আইসা দেখি, মাইলের পর মাইল সাপের মতো

শুয়ে আছে ফাটল— একটু থামল ব্রজলাল। বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, মাত্র পনেরোকুড়ি মিনিট সময় পাইছিলাম। যতটুকু সম্ভব পারছি, নিয়া আসছি এপারে। চোখের সামনে আমার ছ’বিঘে চাষের জমি, বসতবাড়ি, দোকানঘর পদ্মার জলে ভাইসা গেল। গেল আরও অনেকের জমি বাড়ি। বাচ্চারা যেমন খেলনাবাটি নিয়ে খেলে, নদীরও যেন এটা একটা খেলা।

অতীশদের পায়ের একটু দূরে পদ্মার জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। কীরকম যেন ক্রূর শোনায় আওয়াজটা, হাসতে হাসতে বুঝি আগাম সর্বনাশের কথা বলছে নদী। বোল্ডারের পাথরের দিকে আঙুল তুলে অতীশ বলে, এসব বাঁধ-টাঁধ দিয়েও ভাঙন রোখা যাচ্ছে না?

কী করে যাবে! সরকার থেকে যে টাকার বরাত পাচ্ছে ঠিকাদাররা বেশিটাই পকেটে পুরছে। কাজের বেলায় ফাঁকি। লোহার তার দিয়া ভাল করে বাঁধন দেয় না পাথরগুলাকে। জল ঠিক ঢুকে যাচ্ছে মাটির ভিতরে। বর্ষা কাটলে নদীর জল যখন নামতে থাকবে, বাঁধসুদ্ধু তলিয়ে যাবে।

আপনারা একজোট হয়ে ঠিকাদারদের এগেনস্টে কিছু বলেন না কেন?

কী বলব! তারা সব এই এলাকারই কেষ্টুবিষ্টু লোক। ওপর মহলে বিস্তর চেনাজানা। এখান থেকে যা কামাচ্ছে, বাড়িগাড়ি করছে কলকাতায়। আমরা শুধু ধমকাই গ্রামের পোলাপানেরে। ওরা যখন দাপাদাপি কইরা খেলাধুলা করে। মাটি তো আলগা।

নদীর ওপর কালো মেঘ উঠে এসেছে। যেন এইমাত্র একটা মোষ চান করে উঠল। স্রোতে ভাসছে দলছুট কচুরিপানা, কাঠকুটো। ঝাঁকবাঁধা পাখি উড়ে যাচ্ছে ওদেশে। আপাত এই মনোরম দৃশ্য দেখলে মনে হবে, ব্রজলালের কথাগুলো সব বানানো। এইজন্যই বোধহয় প্রকৃতিকে বলা হয় ছলনাময়ী।

ব্রজলাল বলল, চলুন এবার। দেরি হয়ে যাবে। পৌনে পাঁচটার ট্রেনটা মিস করবেন।

ব্যাগ কোলে নিয়ে জুলুর রিকশাতেই ফিরছে অতীশ। লোকটির নামটা ইতিমধ্যে জেনেছে। জুলুও দুপুরের খাওয়া সেরেছে ব্রজলাল মিশ্রর বাড়ি। নদীর ধারের সংশয়াকুল আবহ থেকে অতীশ এখন অনেকটাই দূরে। পায়ের তলার মাটিও শক্ত। এই কারণেই হয়তো অতীশ অতিবাস্তব একটা ধাঁধা এই মুহূর্তে সমাধান করে ফেলল, ব্রজলালের ব্যাগ ফেরত দেওয়ার ব্যগ্রতার পিছনে আছে অন্য কারণ। ওর ছেলেই সম্ভবত ব্যাগটা চুরি করে বাড়ি নিয়ে এসেছিল। ছেলেটা যে খারাপ হয়ে গেছে, রিকশাওয়ালা জুলু আগেই বলেছে। ঘটনাচক্রে ব্রজলাল ছেলের হাতে ব্যাগটা দেখে নেয় এবং কেড়ে নিয়ে সরিয়ে রাখে। ব্রজলালের একটাই ভয় ছিল, ছেলে যদি বাবা না থাকাকালীন এসে মা-বউকে ধমকে ব্যাগটা আবার নিয়ে নেয়।

পাগল ব্যাগ নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল, এটা সম্পূর্ণ বানানো। ব্রজলাল জানে না ব্যাগটা কোথা থেকে চুরি হয়েছে। প্ল্যাটফর্ম তার চেনা জায়গা, নিয়মিত যাতায়াত করে। চুরিচামারি ওখানেও হয়। তাই ওই প্রেক্ষাপটটা বেছেছিল। কিন্তু পাগল চরিত্রটাকে বাছল কেন?

বেশ খানিকক্ষণ ভাবার পর অতীশ একটা দিশা খুঁজে পায়, পাগল হচ্ছে এখানে প্রকৃতির

প্রতীক। প্রকৃতি যেমন খেয়ালখুশি মতো ছেলেখেলা করে মানুষের জমিবাড়ি নিয়ে, তেমনই পাগলও না বুঝে নাড়াচাড়া করছিল অতীশের কাজের ব্যাগ। যদিও অতীশ জানে, জ্ঞানত ব্রজলাল প্রকৃতির প্রতীক হিসেবে পাগলকে বাছেনি। এত সূক্ষ্ম বোধ তার নেই। অবচেতন থেকেই উঠে এসেছে প্রকৃতির বদলে পাগল।

রাত প্রায় সাড়ে দশটায় লিফটে করে নিজের চারতলার ফ্ল্যাটে উঠে এল অতীশ। ডোরবেল বাজানোর পর দরজা খুলল কেয়া। যথেষ্ট ক্লান্ত, অবসন্ন থাকা সত্ত্বেও অতীশ মুখে মোটামুটি একটা বিজয়ীর হাসি ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু কেয়ার মধ্যে তার কোনও প্রভাব পড়ল না। কেয়া হাসছে আলাদা করে। অনেক উজ্জ্বল সেই হাসি! অতীশ হাতে ধরা ব্যাগটা সামান্য তুলে দেখায়। পাত্তা দেয় না কেয়া

ব্যাপারটা কী হল? কেয়া চলে যাচ্ছে ভিতরে। অতীশ জুতো ছেড়ে সোফায় এসে বসে। ফ্রিজ থেকে জল বার করে সেন্টার টেবিলে রাখল কেয়া। গলা তুলে ডেকে উঠল, রানা ওগুলো নিয়ে আয়।

কোনগুলোর কথা বলছে, কিছুই বুঝতে পারছে না অতীশ। রানা নিজের ঘর থেকে বেরোল। হাতে ঝুলছে নতুন একটা এক্সিকিউটিভ ব্যাগ। বলল, আজ ক্যুরিয়ারে এসেছে। তোমার যা যা চুরি হয়েছিল, সবটাই কম্পেনসেট করেছে কোম্পানি। ল্যাপটপ, চার হাজার টাকার চেক…

ব্যাগটা অতীশের সামনে রাখে রানা। অতীশ একটু হতভম্ব মতো হয়ে গেছে। বলে, এবার তা হলে কী হবে? আগের ব্যাগটা তো ফেরত পেয়ে গেছি।

কেয়া বলে, তাতে কী হয়েছে! তুমি আগের ব্যাগটা পেয়েছ, ওই লোকটা ছাড়া আর তো কেউ জানে না। তোমার অফিসে জানাতেও যাবে না সে। এটা তোমার লাক। এবার থেকে নতুন ব্যাগ নিয়ে অফিস যাবে। মডেলটাও লেটেস্ট। আগেরটা আমি তুলে রাখব।

রানা বলে, আমি তোমার আগের ল্যাপটপ ইউজ করব। কবে থেকে তোমায় কিনে দিতে বলেছি।

কেয়া বলে, বাড়তি চার হাজার কিন্তু আমার। সুমনার বুটিকে একটা দারুণ শাড়ি এসেছে। তোমার চাপ পড়ে যাবে বলে কিনে দিতে বলিনি। এবার কিনব।

অতীশ কী বলবে, ভেবে পায় না। বুঝতে পারে কোথাও একটা অন্যায় হচ্ছে, কিন্তু কতটা? টেবিল থেকে বোতল তুলে ঠান্ডা জল খেতে থাকে অতীশ।

সারাটা দিন ঘোরাঘুরির কারণে অতীশ খেয়েদেয়ে শুতেই ঘুম এল ঝাঁপিয়ে। চোখ জুড়ে গেছে আঠার মতো। এমন সময় ঝপাস করে শব্দ। দুলে উঠল বিছানা। কী ব্যাপার হল? ঠিক যেন নদীতে তলিয়ে গেল কিছুটা ভূমিখণ্ড। কিন্তু এই শব্দের অভিজ্ঞতা তো অতীশের নেই। শুনেছে ব্ৰজলালের কাছে। খানিক পরেই আবার সেই শব্দ। এবার অনেক বড় করে। ধড়মড় করে উঠে বসে অতীশ, ভূমিকম্প হচ্ছে কি? নাইট ল্যাম্পের আলোয় দেখল, পাশে কেয়া নেই। ধক করে ওঠে বুক। লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ে অতীশ। দৌড়ে গিয়ে

দরজা খোলে। সামনে গাঢ় অন্ধকার! শরীর অবশ হয়ে যায় অতীশের, হাঁটুতে জোর পায় না। ফ্ল্যাটের বাকি অংশটা কি ধসে গেল? অন্ধকারের অতল খাদের দিকে তাকিয়ে অতীশ আর্তনাদ করে ওঠে, কেয়া! রানা!

আলো জ্বলে ওঠে। এই তো সব ঠিকঠাক আছে। দেখা যাচ্ছে ড্রয়িং কাম ডাইনিং। ভয় পাওয়া চোখমুখ নিয়ে এগিয়ে আসছে কেয়া। সম্ভবত বাথরুমে গিয়েছিল। কেয়া জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে, ওরকম চিৎকার করলে কেন?

রানাও বেরিয়ে এসেছে ওর ঘর থেকে, হোয়াট হ্যাপেনড বাবা?

অতীশ কোনও উত্তর দেয় না, ঘুরে দাঁড়ায়। ছেলে বউ দু’পাশের কাঁধ ধরেছে। কেয়া ফের জানতে চায়, খারাপ কোনও স্বপ্ন দেখেছ?

অতীশ পা টিপে টিপে বিছানার দিকে এগোতে থাকে। যেভাবে ধসপ্রবণ এলাকায় হাঁটাচলা করে মানুষ।

দেশ, অক্টোবর ২০১০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *