ঢাকার একটি বিলাসবহুল হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে পাঁচজন যুবক। ওই পাঁচ ধর্ষকের দুজন মেয়ে দুটোর বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বন্ধুকে বিশ্বাস করে বন্ধুর আমন্ত্রণে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল মেয়ে দুটো। ঘটনা শুনে আমার মনে পড়েছে ৯১ সালে লেখা আমার নিমন্ত্রণ নামের ছোট উপন্যাসটির কথা। উপন্যাসে মনসুর নামের এক যুবকের প্রেমে পড়ে শীলা, এক কৌতূহলী কিশোরী। একদিন মনসুর তাকে নিমন্ত্রণ করে তার বাড়িতে। সেজেগুজে উপহার নিয়ে শীলা নিমন্ত্রণ খেতে যায় প্রেমিকের বাড়ি। সেই বাড়িতে মনসুর তার সাত বন্ধু নিয়ে সারা রাত ধর্ষণ করে শীলাকে। বইটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। অনেক মা-ই তাদের কিশোরী-কন্যাকে নিমন্ত্রণ বইটি কিনে দিয়েছেন পড়ার জন্য। পুরুষদের যেন ওরা সহজে বিশ্বাস না করে। আমার ওই বই পড়ে কজন মেয়ে সচেতন হয়েছে জানি না। পুরুষেরাও ওই বইটি পড়েছে। আদৌ কোনও পুরুষ শুদ্ধ হয়েছে কি?
বইটি জনপ্রিয় হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বইটি লিখেছি বলে অনেক গালিও খেয়েছি। লোকেরা আমাকে লাঞ্ছিত কম করেনি। ধর্ষণের নৃশংসতা আর বর্বরতার বর্ণনা দিয়েছি বলে আমি ‘নষ্ট মেয়ে’, আমি ‘সেক্স’-এর মতো নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখেছি, সমাজটাকে নষ্ট করছি, মেয়েদের বিপথে নিচ্ছি। মানুষকে নারী পুরুষের সমান অধিকার সম্পর্কে সচেতন করবো, নষ্ট সমাজকে বদলাবো— এই পণ করেছিলাম। এই পথ বড় কঠিন পথ। কত যে লাঞ্ছনা আমাকে সইতে হয়েছে, কত যে নির্বাসন! তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়েও লিখে গেছি। আজও লিখছি। আজও প্রতিবাদ করছি ধর্ষণ, নির্যাতন, নারী পুরুষের বৈষম্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে। মানুষ আমার বই পড়ে সচেতন হলে ভালো লাগে, সার্থক মনে হয় লেখালেখি। আজ চব্বিশ বছর আমি দেশে নেই। আমার বইগুলো মানুষের হাতের নাগালে নেই, প্রকাশকেরা আমার বই ছাপাতে ভয় পান। জানি না, নতুন প্রজন্মের কেউ ‘নিমন্ত্রণ’ পড়েছে কি না।
সমাজের একটি গোষ্ঠী চায় না মেয়েরা সচেতন হোক, ধর্ষণ-বাল্যবিবাহ-নারী নির্যাতনের শিকার না হোক। তাদের মন রক্ষার্থে বিভিন্ন সময়ে যে সরকার এসেছে, আমার বই নিষিদ্ধ করেছে, ওই গোষ্ঠীটির বাহবা পেয়েছে, বিনিময়ে ভোট চেয়েছে। না লিখলে বা প্রতিবাদ না করলে, কেবল নিজের কথা ভাবলে একটি নিরাপদ জীবন আমি পেতাম। আমার বই নিষিদ্ধ করে, আমার কণ্ঠ চেপে ধরে আমার ক্ষতি করছে না ওরা, বরং মানুষের ক্ষতি করছে, সমাজকে পিছিয়ে দিচ্ছে। যে সমাজে নারীবাদী লেখকদের ভুগতে হয়, সেই সমাজে নারীদেরও ভুগতে হয়। এটা সম্ভবত বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরাও বুঝতে পারেননি। তাই যখন সরকার মৌলবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে আমার বই নিষিদ্ধ করেছে, আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে, নির্বাসন দণ্ড দিয়েছে, তখন বুদ্ধিজীবীরা এটাকে ‘তসলিমার ব্যক্তিগত ব্যাপার’ বলে এড়িয়ে গেছে।
নারীবাদী, প্রতিবাদী লেখক হিসেবে জীবনের এতটা বছর পার করেও আমাকে শুনতে হয়, মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে, যৌন হেনস্তার শিকার হচ্ছে, ধর্ষিতা হচ্ছে, আত্মহত্যা করছে, আইনের মারপ্যাঁচে বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে। মেয়েরা যেন শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতা অর্জন করার জন্য সচেতন হয়, নিজের স্বাধীনতা এবং অধিকারের জন্য সংগ্রাম করার সাহস অর্জন করে— আমি এই উৎসাহই মেয়েদের দিচ্ছি আমার কিশোরী বয়স থেকে।
ধর্ষণের জন্য এখনও দায়ী করা হয় নারীর পোশাককে। বহু বছর ধরে নারীবাদীরা পৃথিবীর সর্বত্র সবাইকে বোঝাচ্ছে, এমনকি প্রমাণও দেখাচ্ছে যে, ধর্ষণ নারীর পোশাকের কারণে ঘটে না। ধর্ষণের কারণ : ১. বীভৎস কোনও কাণ্ড ঘটিয়ে পুরুষ তার পৌরুষ প্রমাণ করে, ২. নারীকে নিতান্তই যৌনবস্তু মনে করে পুরুষ। সুতরাং যৌনবস্তুকে ধর্ষণ করা অপরাধ নয় বলেই বিশ্বাস করে।
নারীবাদীদের আন্দোলনের ফলে ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাদের দায়ী করাটা সভ্য এবং শিক্ষিত লোকদের মধ্যে এখন অনেকটা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু যারা এখনও বন্ধ করছে না, তাদের নিশ্চিতই চক্ষুলজ্জা বলতে যে জিনিসটা প্রায় সবার থাকে, নেই।
আবার এক শ্রেণির মানুষ মনে করেন ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দিলেই সমাজে আর ধর্ষণ হবে না। এটা অনেকটা ধর্ষকদের দোষ দিয়ে ধর্ষণের মূল কারণকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা। ধর্ষক হয়ে কেউ জন্মায় না। এই পুরুষতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র, সমাজের কুশিক্ষা, ভুল শিক্ষা, নারী-বিদ্বেষ, নারী-ঘৃণা পুরুষকে ধর্ষক বানায়। ধর্ষিতাকে দোষ দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ করা যায় না। ধর্ষককে ফাঁসি দিয়েও ধর্ষণ বন্ধ করা যায় না। ধর্ষণের মূল কারণগুলোকে নির্মূল করতে পারলেই ধর্ষণ বন্ধ হবে।
নারীবাদীদের শত বছরের আন্দোলনের ফলে পৃথিবীতে নারী শিক্ষা শুরু হয়েছে, নারীরা ভোটের অধিকার পেয়েছে, বাইরে বেরোবার এবং স্বনির্ভর হওয়ার অধিকার পেয়েছে, কিন্তু এই অধিকারই সব নয়, নারীর যে অধিকারটি নেই এবং যে অধিকারটি সবচেয়ে মূল্যবান, সেটি নারীর শরীরের ওপর নারীর অধিকার। নারীর শরীরকে সমাজের এবং পরিবারের দাসত্ব থেকে মুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। নারীর শরীর কোনও সমাজের সম্পত্তি বা কোনও পরিবারের সম্মানের বস্তু নয়। যতদিন নারী তার শরীরের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা না পাচ্ছে, নারীর শরীর নিয়ে নারী কী করবে, সেই সিদ্ধান্ত নারীর না হবে, যতদিন এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার পুরুষের, আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের, ততদিন নারীর সত্যিকার মুক্তি সম্ভব নয়। আর যতদিন এই মুক্তি সম্ভব নয়, ততদিন নারীর পরিচয় পুরুষের ‘ভোগের বস্তু’ হয়েই থাকবে ঘরে, পতিতালয়ে, রাস্তায়, অফিসে, বাসে, ট্রেনে— সবখানে। ভোগের বস্তু নারীকে ভাবা হয় বলেই যৌন হেনস্তা বা ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ ঘটাতে পুরুষের কোনও অসুবিধে হয় না। পুরুষাঙ্গ মেয়েদের ধর্ষণ করে না, ধর্ষণ করে ঘৃণ্য পুরুষিক মানসিকতা। পুরুষাঙ্গ নিতান্তই একটা ক্ষুদ্র নিরীহ অঙ্গ। পুরুষিক মানসিকতা দূর করলে পুরুষেরা নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে না দেখে একই প্রজাতির সহযাত্রী স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে দেখবে। পুরুষের যৌনইচ্ছের চেয়ে নারীর যৌনইচ্ছে কিছু কম নয়। নারী যদি নিজের যৌনইচ্ছে সংযত করতে পারে, পুরুষের বিনা অনুমতিতে পুরুষকে স্পর্শ না করে থাকতে পারে, পুরুষ কেন পারবে না, পুরুষ কেন চাইলে নারীর বিনা অনুমতিতে নারীকে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে পারবে না? মানুষ মাত্রই এই ইচ্ছেকে সংযত করতে পারে, কিন্তু ধর্ষকদের মধ্যে সংযত করার এই চেষ্টাটা নেই, কারণ ধর্ষকদের মস্তিষ্কের গভীরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শিক্ষাটা অনেক আগেই ঢুকে গেছে যে নারী যৌনবস্তু আর পুরুষের জন্মগত অধিকার যখন খুশি যেভাবে খুশি যৌনবস্তুকে ভোগ করা। কিন্তু কে কাকে বোঝাবে যে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক যদি খাদ্য ও খাদকের বা শিকার ও শিকারির হয়, তবে এ কোনও সুস্থ সম্পর্ক নয়! কোনও বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে কখনও সুস্থ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না। নারী তার সমানাধিকার না পাওয়া পর্যন্ত নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনও সত্যিকার সুস্থ সম্পর্ক গড়ে উঠবে না। সমানাধিকার কে দেবে নারীকে? যারা ছিনিয়ে নিয়েছে, তাদের দায়িত্ব নারীর অধিকার নারীকে ভালোয় ভালোয় ফিরিয়ে দেওয়া।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ মে, ২০১৭