ধর্ম

ধর্ম

প্রথমেই প্রশ্ন উঠবে, আজকের দিনে ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামায় কে, ওটার কীই-বা প্রয়োজন? প্রশ্নটির ভিতরে অনেকখানি সত্য লুকানো আছে।

স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ধর্ম তাঁর রাজত্ব ভাগ-বাঁটোয়ারা করে প্রতিদিনই ভিন্ন ভিন্ন। রাজপুত্রকে বিলিয়ে দিচ্ছেন। একদা গঙ্গাস্নান পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত হত বলে সেটি ধর্মের আদেশরূপে মেনে নেওয়া হত, কিংবা বলা যায়, ধর্মের আদেশ বলে সেটি পুণ্য বলে বিবেচিত হত। এখন সেটা ডাক্তারই স্ট্রংলি রেকমেন্ড করেন, এবং অধুনা বিজ্ঞানও নাকি সপ্রমাণ করেছে, গঙ্গাজলে কতকগুলি বিশেষ গুণ আছে যেগুলো অন্য জলে নেই। ধর্ম এখানে বৈদ্যের হাতে এ পুণ্যকর্ম করার আদেশ ছেড়ে দিয়েছেন, কিংবা বলা যায়, বৈদ্য সেটা কেড়ে নিয়েছে। আর কিছুটা কেড়ে নিয়েছে নিসিপ্যালিটি কোনও কোনও দেশে মুনিসিপ্যালিটিই ফরমান জারি করে, বাড়ি বানাবার সময় প্রতি কখানা ঘরপিছু একটি বাথরুম রাখতেই হবে। না হলে প্ল্যান মঞ্জুর হবে না। আহারাদিতেও তাই। ডাক্তারই বলে দেয় কোনটা খাবে, কোনটা খাবে না– অর্থাৎ কোনটাতে পুণ্য আর কোনটাতে পাপ। এবং আকছারই তিনি ধর্মের বিরুদ্ধে অনুশাসন দেন। যেমন খেতে বলেন চিকেনস্যুপ–হিন্দুধর্মে, অন্তত বাঙলা দেশের হিন্দুধর্মে সেটা পাপ।

দান করা মহাপুণ্য। ধর্মের সনাতন আদেশ। কিন্তু আজকের দিনে আপনি-আমি এ অনুশাসন মেনে চলি আর না-ই চলি, সরকার কান পকড়কে তার ইনকাম এবং অন্যান্য বহুবিধ ট্যাক্স তুলে নেবেই নেবে এবং সভ্যদেশে তার অধিকাংশই ব্যয় হয় দীন-দরিদ্রের জন্য। (আজ যে মুরারজিভাই দিবারাত্র অস্তি নাস্তি ন জানাতি দেহি দেহি পুনঃপুনঃ করছেন তাতে আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু তিনি যদি সে পয়সা দু হাতে খরচা করে যুদ্ধের জন্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাড়ান– সঙ্গে সঙ্গে বেকার-সমস্যা অনেকখানি ঘুচবে, বেকার-সমস্যা ঘুচল বলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে তিনি যদি কষি করেন, তবেই হবে আমাদের চরম বিপদ কিন্তু এটা অর্থনীতির একটা উকট সমস্যা এবং হিটলারই সর্বপ্রথম এর সমাধান করেন দু হাতে পয়সা খরচ করে; পক্ষান্তরে অন্যান্য দেশের প্রাচীনপন্থী অর্থমন্ত্রীরা তখন দেশের দুরবস্থা দেখে আকুল হয়ে, পাছে ভবিষ্যতে আরও কোনও নতুন বিপদে পড়তে হয় সেই ভয়ে সরকারের খরচা প্রাণপণ কমিয়ে রিজার্ভ ফান্ড নামক দানবের ভুড়ি মোটার চেয়ে মোটা করতে থাকেন। তাদের দেখাদেখি ব্যাংকার সাহুকাররাও ক্রেডিট দেওয়া বন্ধ করে কিংবা কমিয়ে দেয়। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও কমতে থাকে এবং সৃষ্ট হয় দুষ্টচক্র ভিশাস্ সারকল। সরকার ব্যাংকার টাকা দেয় না বলে দেশের উৎপাদন শক্তি বাড়ে না, আর দেশের উৎপাদন শক্তি বাড়ে না বলে সরকার খাজনা ট্যাক্সো পায় আরও কম এবং তারস্বরে চিৎকার করে, আরও ছাঁটাই কর, আরও ছাঁটাই কর।)* [*এরকম ক্রাইসিসের সময় আরও একটা মজার ব্যাপার ঘটে। ওই সময় বড় বড় প্রাচীন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান যখন ব্যাংকের কাছে আরও ক্রেডিট চায় তখন ব্যাংক ভাবে, এদের বিস্তর টাকা দিয়েছি আর কত দেব? এতকালের বড় ব্যবসা নিশ্চয়ই টিকে যাবে। ব্যাংকার তখন ছোট ব্যবসাকে টাকা দেয়, পাছে তারা দেউলে হয়ে যায় এবং ব্যাংকের আগের দেওয়া সব টাকা মারা যায়। ফলে বিপদ কাটার পর দেখা যায় অনেক প্রাচীন, খানদানি ব্যবসা দেউলে হয়ে গিয়েছে, আর ছোট ব্যবসাগুলো টিকে গেছে। অবশ্য এর একটা নৈসর্গিক– অতএব দুর্বোধ্য কারণও থাকতে পারে। মহামারীতে বাড়ির রোগা-পটকাটাই যে মরে এমন কোনও কথা নয়। অনেক সময় তাগড়াটাই মরে। হয়তো মা রোগা-পটকাটারই যত্ন বেশি করেছিল বলে! ব্যাংকার বড় ব্যবসাকে যেরকম যত্ন না করে করেছিল ছোটটার!]

এই পরিস্থিতি হতে পারে বলেই ধর্ম প্রাচীন দিনে তার একটা ব্যবস্থা করেছিল।

দোল-দুর্গোৎসবে দান। এতে মহাপুণ্য।

বহুকাল পূর্বে আমি বাচ্চাদের মাসিকে একটি অনুপম প্রবন্ধ পড়ি। অসাধারণ এক পণ্ডিত সেই প্রবন্ধ লিখেছিলেন। দুর্গোৎসবের সময় প্রতিমা নির্মাণ থেকে আরম্ভ করে জমিদারকে অন্ন, বস্ত্র, ছত্র, তৈজসাদি, পাদুকা, খটু, অলঙ্কার দুনিয়ার কুল্লে জিনিস দান করতে হত। এতে করে চাষা, জোলা, ছাতাবানানেওলা, কাঁসারি, কামার, মুচি, মিস্ত্রি বস্তৃত গ্রামের যাবতীয় কুটিরশিল্প এক ধাক্কায় বহু-বিস্তর বিক্রি করে রীতিমতো সচ্ছল হয়ে যেত। শুধু তাই নয়, কাঁসারি দু পয়সা পেত বলে সে ছাতা কিনত, ছাতাওয়ালার চার পয়সা হল বলে সে শাখা কিনত–ইত্যাদি ইত্যাদি, আদ ইনফিনিতুম। এবারে আর নষ্টচক্র বা ভিশাস সারক্ল নয়– এখন যাকে বলে স্পায়ারেল মুভমেন্ট— চক্রাকারে স্বর্গ-বাগে!

তার পর লেখক দুঃখ করেছিলেন, আজ যদি-বা জমিদার পুণ্য সঞ্চয়ার্থে পূর্ববর্ণিত সর্বদানই যথারীতি করেন তবু মূল উদ্দেশ্য সফল হয় না। বস্ত্র এসেছে বিলেত থেকে (তখনকার দিনে দিশি কাপড় অল্পই পাওয়া যেত), ছত্র রেলি ব্রাদার্সের, বাসনকোসন অ্যালুমিনিয়মের এবং অন্যান্য আর সব জিনিসের পনেরো আনা এসেছে হয় বিদেশ থেকে, নয় দেশেরই বড় বড় শহর থেকে (শাখা জাতীয় মাত্র দু-একটি জিনিস আপন গ্রামের কিংবা গ্রামের বাইরের কুটিরশিল্প থেকে)। মোদ্দা মারাত্মক কথা– জমিদারের গ্রাম এবং কিংবা আর পাঁচখানা গ্রাম নিয়ে যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাগোষ্ঠী (ইউনিট) সে কোনও সাহায্যই পেল না। আখেরে দেখা যাবে কোনও কুটিরশিল্পই ফায়দাদার হল না, হল শিল্পপতিরা দিশি এবং বিদেশি।

এবং লাওৎসে বলেছেন- অবশ্য বর্তমান চীনা সরকার সেটা মানে না–যখনই দেখতে পাবে বড় শহরে বড় বড় ইমারত তখনই বুঝতে হবে, এগুলো গ্রামকে শুষে রক্তসঞ্চয় করেছে। পতন অনিবার্য।

ধর্ম এখন পুণ্যের দোহাই দিয়ে দানের কথা জমিদারের সামনে তোলে না– আর জমিদারকে সে পাবেই-বা কোথায়? হয়তো তিনি শহরে থাকেন কিংবা সরকারের নতুন নীতির ফলে লোপ পেয়েছেন। তা সে যাই হোক, এ কথা তো ভুললে চলবে না, দান মাত্রই দান, পেরসে, পুণ্য নয়। গ্রাম পোড়াবার জন্য কেউ যদি দেশলাই চায় তবে আমি তো তাকে দেশলাই দান করে পুণ্যসঞ্চয় করিনে!

শিল্পের উন্নতির জন্য অর্থব্যয় করলেই যে দান হত তা নয়। জামি মসজিদ নির্মাণ করে শাহ-জাহান নিশ্চয়ই পুণ্যসঞ্চয় করেছিলেন, কিন্তু তাজ বানাতে– অর্থাৎ খাসপেয়ারা বেগম সাহেবার জন্য গোর বানাতে– কোনও পুণ্য আছে বলে ইসলাম ফতোয়া দেয় না। তাই বোধহয় পাশে মসজিদ বানিয়ে দিয়ে একটুখানি পুণ্যের ছোঁয়াচ লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

শুধু যে রাজা-বাদশা-জমিদার এসব পুণ্যকর্ম করতেন তাই নয়। বছর কুড়ি পূর্বে আমি মোটর-বাসে করে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার পথে পাগলা গ্রামের কাছে এসে দেখি এক বিরাট মসজিদ। ড্রাইভার বলল, এক জেলে হাওর-বিলের ইজারা নিয়ে বিস্তর পয়সা জমানোর পর এ মসজিদ গড়িয়েছে*। [*ঈষৎ অবান্তর হলেও এই নিয়ে একটি সমস্যার কথা তুলি। রোজার মাসে অসুস্থ ছিল বলে একজন লোক উপবাস করতে পারেনি। এখন ঈদ পরবের পর সে রোজা রাখতে যাবে, এমন সময় সে মসজিদ (কিংবা কুয়ো, কিংবা পান্থশালা– এ সবকে সবীল-আল্লা ঐশ মার্গ, যে পথ আল্লার দিকে নিয়ে যায় বলা হয়) বানাতে চাইল। তখন প্রশ্ন, সে উপবাস করা মুলতবি রেখে মসজিদ বানাবে কি না? ভারতের মুসলমান যে মানবধর্মশাস্ত্র মানেন তাঁর মতে, রোজা পরে রাখবে। এ অনুশাসন যিনি দিয়েছেন তিনি আসলে ইরানি।]

এই বীরভূমে যে শান্তিনিকেতন গড়ে উঠেছে তার পরোক্ষ কারণে কিছুটা পুণ্য কিছুটা স্বার্থ আছে। মহর্ষিদেব এখানে আশ্রম গড়ার সময় সর্বপ্রথম জলের চিন্তা করেছিলেন। কুয়ো তো খোঁড়াবেন, সে তো পাকা কথা, কিন্তু যদি সেটা শুকিয়ে যায়? শান্তিনিকেতনের অতি কাছে ভুবনডাঙা। রাইপুরের জমিদারবাবু ভুবনমোহন সিংহ সেখানে তাঁদের মাটি খনন করে নিচু জমির উপরে উত্তর-দক্ষিণ লম্বা একটি উঁচু বাঁধ (দিঘি) পূর্বেই তৈরি করে দিয়েছিলেন। (মতান্তরে এটি রাইপুরের ঘোষালদের– এরা সিংহ পরিবারের পুরোহিত– ব্রহ্মত্র ছিল।) এই পুণ্য-স্বার্থে মেশানো বাঁধের ওপর ভরসা রেখে মহর্ষিদেব এখানে আশ্রম গড়েন।* [*অঘোর চট্টোপাধ্যায়, শান্তিনিকেতন আশ্রম, পৃ. ৯ ও পরবর্তী।]

এখন আর কেউ বাঁধের জন্য ধর্মের দোহাই দেয় না। এখন অন্য পন্থা। গত নির্বাচনের সময় এই বীরভূমেরই একটি গ্রাম তিনজন প্রার্থীকে বলে– সরকারের সাহায্যে বা অন্য যে কোনও পন্থায় যে প্রার্থী তাদের গ্রামে ছটি টিউবওয়েল করে দেবে তাকে তারা একজোটে দেবে ভোট!

ভাবি, কোন শ্রাদ্ধের না, কোন বাঁধের জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! ধর্ম তারই সঙ্গে ভেসে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *