ধর্ম রাজ্য
………র সম্পাদক সাহেব ধরিলেন : তাহার কাগজের জন্য একটা গল্প চাই।
বিষম ভাবনায় পড়িলাম। দ্বিজেন্দ্রলালের বীরবর ‘হাতে পার্তামের’ মত চেষ্টা করিলে আমিও যে একজন গল্প-লেখক হইতে পারিতাম তাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু হইতে যে পারি নাই তাতেও সন্দেহ নাই। অথচ গল্প একটা দিতেই হইবে।
তাই এই ভাবনা।
সেদিন অফিস হইতে সকাল-সকাল বাসায় ফিরিয়া টেবিলের সামনে দোয়াত-কলম লইয়া বসিলাম। অনেক ভাবিলাম, কাগজে অনেক আঁচড় কাটিলাম, বন্ধু-বান্ধব স্ত্রী-শালী যাহার কথা মনে আসিল তাহারই নাম লিখিলাম। মানুষের মাথা আঁকিলাম পাখির ঠ্যাং আঁকিলাম কিন্তু গল্পের কোনও কিনারাই করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
মনে করিলাম : একটু তামাক না খাইলে মাথা পরিষ্কার হইবে না। নিজ হাতে তামাক সাজিলাম, একা-একা অনেকক্ষণ তামাক টানিলাম; অনেক কালের অনেক কথা মনেও পড়িল, কিন্তু গল্পের প্লট একটাও আসিল না।
তামাক পুড়িয়া গেল। হুঁক্কাটা সরাইয়া রাখিয়া আবার ভাবিতে বসিলাম।
ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ মনে পড়িল : বসিয়া লিখিতে হলে আমার কলমে লেখা আসে না; বুকের নিচে বালিশ দিয়া উপুড় হইয়া লেখা শুরু করিলে আমার ভাবের অভাব হয় না।
এতক্ষণ এই কথাটা মনে না হওয়ায় নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে শয্যা গ্রহণ করিলাম।
প্রথমতঃ পা গুটাইয়া বুকের নিচে বালিশ দিয়া লেখার ভংগিতেই বসিলাম। কিন্তু অতি অল্পক্ষণেই পা দুইটা সটান লম্বা হইয়া গেল। বালিশটাও দুষ্টামি করিয়া আস্তে-আস্তে বুকের নিচ হইতে ক্রমে মাথার দিকে আসিতে লাগিল। আমার তাতে আপত্তি ছিল না মোটেই।
আমি বালিশের উপর মাথা রাখিয়া গল্পের প্লট আবিষ্কারের গভীরভাবে মনোনিবেশ করিলাম।
.
দুই
হঠাৎ বাহিরে কোলাহল শুনিলাম।
দৌড়িয়া আসিলাম।
দেখিলাম : বিরাট ব্যাপার! কাতারে-কাভারে হাজার-হাজার মুসলমান ইট পাটকেল ছুরি লাঠি গাছের ডাল ইত্যাদি হতে করিয়া দ্রুতগতিতে শহরের পশ্চিম অংশের দিকে অগ্রসর হইতেছে।
আমি কিছুতেই বুঝিতে পারিলাম না শহরের মধ্যে এত বড় একটা ব্যাপার ঘটিয়াছে, অথচ আমি তার কিছুই জানি না।
অবশেষে সাহস করিয়া অপেক্ষাকৃত অল্প-দ্রুতগামী একজনকে জিজ্ঞাসা করিলাম : ব্যাপার কি সাহেব, আপনারা এত লোক কোথায় যাইতেছেন?
লোকটি আমার দিকে চোখ রাংগাইয়া বলিলেন : তুমি কোথাকার লোক বটে হে? ইসলাম আজ বিপন্ন, তুমি তার কোনো খবর রাখ না?
–বলিয়াই তিনি আবার ছুট দিলেন।
আমি একটা খবরের কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি; অথচ কলিকাতায় ইসলাম বিপন্ন হওয়ার মতো এত বড় একটা খবর জানি না।
নিতান্ত শরমিন্দা হইলাম।
তাই দ্রুতগতিশীল লোকটির পিছনে দৌড়াইতে-দৌড়াইতে মিনতি করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম : আমি একটা খবরের কাগজের সম্পাদক; সব কথা আমাকে খুলিয়া বলুন, আমি কাগজে ভীষণ আন্দোলন শুরু করিব।
লোকটি গতি একেবারে থামাইয়া ফেলিলেন। আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন : কাগজের সম্পাদক? হিন্দু কাগজ নয়ত?
আমি আমার দাড়িতে হাত দিয়া বলিলাম : আমি নিজে খাঁটি মুসলমান, এবং এক মুসলমান কাগজে সম্পাদকতা করি।
লোকটি মুখ ভেংচাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন : স্বরাজ্য দলের টাকা খাও?
আমি খুব জোরের সঙ্গে বলিলাম : এক কানাকড়িও না।
ভদ্রলোক খুশী হইলেন।
বলিলেন : হিন্দুরা মসজিদের সামনে দিয়া বাদ্য বাজাইয়া মিছিল বাহির করিবে। আমরা বাধা দিব। সে বাধা ঠেলিয়া হিন্দুরা দলে বলে লাঠি সোটা লইয়া অগ্রসর হইবে। তাই আমরা ইসলামের ইযযতের জন্য জান নেসার করিতে ছুটিয়াছি। তোমার যদি মুরাদ থাকে, তবে ধর্মের জন্য প্রাণ দিয়া শহীদ হইবার এই সুযোগ ছাড়িও না।
–বলিয়াই লোকটি হাতের লাঠি ঘুরাইতে ঘুরাইতে অগ্রগামী জনতার সঙ্গে মিশিবার জন্য ছুটিতে লাগিলেন।
আমি কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া ভাবিলাম।
মনে হইল : ইসলামের ইয়ৎই যদি নষ্ট হয়, তবে আমাদের বাঁচিয়া লাভ কি? দুষ্ট হিন্দুরা পবিত্র মসজিদের সামনে দিয়া বাদ্য বাজাইয়া যাইবে, ইহাও কি আমাদিগকে চোখ মেলিয়া বরদাশত করিতে হইবে? না, ইহা হইতেই পারে না।
আমি রাস্তা হইতে একটা লাকড়ি কুড়াইয়া লইয়া জনতার সহিত মিশিবার আশায় প্রাণপণ ছুটিলাম।
আমি যখন জনতার সঙ্গে আসিয়া মিশিলাম, তখন জনতা একটা বড় মসজিদের সামনে কাতার করিয়া দাঁড়াইয়া গিয়াছে। দৌড়াইয়া হাঁপাইয়া পড়িয়াছিলাম। এইবার খানিকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া চারিদিকে চাহিবার সুযোগ পাইলাম।
দেখিলাম : বিরাট ব্যাপার।
শহরের চারিদিক হইতে দলে-দলে মুসলমান আসিয়া সেখানে বিরাট জনতার সৃষ্টি করিয়াছে। রাস্তায় একটি সুই ফেলিবার জায়গা নাই। সবারই মুখ ধর্মের জ্যোতিতে জ্যোতিষ্মান।
কলিকাতার মুসলমানদের মধ্যে এরূপ ধর্ম-জ্ঞান দেখিয়া আমার মৃত প্রাণে আশার সঞ্চার হইল। তবে ত মুসলমান আজো মরে নাই। সত্যই ত এরা আজো একটা জীবন্ত জাতি।
প্রাণে বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো একটা পুলকের ঢেউ আসিয়া লাগিল।
আপন মনে ইসলামের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ছবি আঁকিয়া তাহাই নিরীক্ষণ করিতে ল্যাগিলাম।
হঠাৎ বিপুল ‘কালী মাইকি জয়’-ধ্বনিতে আমার চমক ভাংগিয়া গেল।
সম্মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলাম : ব্যাপার আরও বিস্ময়কর! হাজার হাজার হিন্দু কাতার করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। গুজরাটী, মদ্রাজী, কাশ্মিরী, মাড়োয়ারী, বিহারী, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, কায়স্থ, শুদ্র প্রভৃতি নানা জাতের নানা বর্ণের হিন্দু গায়ে-গায়ে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়া হিন্দু জাতির ঐক্য ঘোষণা করিতেছে। তাহারা নিশ্চয় হিন্দু ধর্মের ইজ্জত রক্ষায় প্রাণদানের জন্যই অপেক্ষা করিতেছে। হিন্দু জনতার মধ্যে ঐ যে শিখ পাশী বৌদ্ধ জৈন প্রভৃতির দু’চার জন দেখা যাইতেছে! তবে কি তাহারাও নিজেদের হিন্দুত্বে সচেতন হইয়া উঠিয়াছে? তাহারাও কি তবে মসজিদের সামনে বাদ্য বাজাইয়া হিন্দুর নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হইয়াছে?
আমার পুলকানন্দ দ্বিগুণ হইয়া গেল। স্বধর্মে শিথিল ও আস্থাহীন বলিয়া আমি এতদিন হিন্দুদের নিন্দা করিতাম। বিভিন্ন বর্ণের হিন্দুর মধ্যেকার তীব্র অনৈক্যের জন্য আমি হিন্দু বন্ধুদের অনেক সময় তিরস্কারও করিয়াছি। সেই বিচ্ছিন্ন হিন্দু সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে, ধর্ম ত বড় কথা, বাদ্যের জন্য এমন করিয়া প্রাণ দিতে প্রস্তুত দেখিয়া আমি হিন্দুদের সম্বন্ধে আমার পূর্বের ধারণা বদলাইলাম।
এমন সময় হিন্দু ধর্ম কি জয়’ ধ্বনি গগন বিদীর্ণ করিল। আমার সামান্য সন্দেহটুকু দূর হইয়া গেল।
মুসলমান জনতা এর জবাব দিল। তাহাদের ‘আল্লাহু-আকবর’ ধ্বনি আসমান ফাটাইল।
আমি বুঝিলাম : ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যখন এমন ধর্মভাব জাগরুক হইয়াছে, তখন স্বরাজ না হইবার আর কোন কারণ থাকিল না। কংগ্রেস-খেলাফত নেতারা এতদিন এই বস্তুটির অভাবের জন্য আফসোস করিতেছিলেন।
গান্ধী টুপি-পরা মালকাছা-মারা কয়েকজন কংগ্রেস নেতা মিলিটারী ভংগিতে হিন্দু জনতা তদারক করিয়া বেড়াইতেছিলেন।
সব ঠিক আছে দেখিয়া তাহারা জনতাকে মার্চিং অর্ডার দিলেন।
হিন্দু মিছিল অগ্রসর হইবার চেষ্টা করিল।
চান-তারা মার্কা মোহাম্মদ আলী ক্যাপ-পরা খেলাফতী নেতারা মুসলিম জনতার নেতৃত্ব করিতেছিলেন।
তাঁহারা বিউগল বাজাইলেন।
মুসলমান জনতা মুযবুত হইয়া পথ আগুলিয়া দাঁড়াইল।
ইট-পাটকেল ছুড়াছুড়ি চলিল।
ক্রমে দুইপক্ষের জনতার দূরত্ব কমিতে লাগিল।
অবশেষে ছুরি খেলায় হাত সাফাইর প্রতিযোগিতা আরম্ভ হইল।
তুমুল সংগ্রাম বাধিয়া গেল।
সমবেত পুলিশ ফুটপাতে কাতার করিয়া উপরওয়ালার হুকুমের অপেক্ষা করিতে লাগিল। গোরা সার্জেন্টরা ঘোড়ায় চড়িয়া ধর্ম-যুদ্ধে রত ভারতবাসীর স্বর্গগমনের ধারা পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল।
যুদ্ধ ঘণ্টাখানেক চলিল।
উভয় পক্ষে শত শত লোক হতাহত হইল। সুতরাং যুদ্ধ থামিল।
পুলিশের কর্তব্য করিবার সময় হইল; উপরওয়ালার হুকুম আসিল। তাহারা উভয় পক্ষের হাজার কয়েক লোক গ্রেফতার করিল।
একজন দর্শক গোছের ভদ্রলোক পুলিশের বড় সাহেবের কাছাকাছি গিয়া বলিলেন : যতক্ষণ দাংগা-হাংগামা হইতেছিল, ততক্ষণ আপনার পাশে দাঁড়াইয়া বেশ তামাশা দেখিতেছিলেন; এখন সেই দাংগা থামিয়া গিয়াছে, এতক্ষণে আসিয়াছেন আপনারা গ্রেফতার করিতে। এই বুঝি পুলিশের শান্তিরক্ষা?
পুলিশের বড়কর্তা একজন ইংরাজ।
তিনি বক্তার মুখের উপর তীব্র দৃষ্টিপাত করিয়া একটা শিস দিয়া বলিলেন : আমরা কি করিতে পারি? হিন্দু-মুসলমান উভয় পক্ষ বলিতেছে এটা তাহাদের ধর্মযুদ্ধ। ভারতবাসীর ধর্ম-কার্যে বাধা দেই বলিয়া আমরা ইংরাজ জাতির ইতিমধ্যেই অনেক বদনাম হইয়া গিয়াছে। আমাদের সে বদনামের পাল্লা আর ভারি করিতে চাই না।
পুলিশ সাহেবের সহকারীরা হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন।
ভদ্রলোক আস্তে আস্তে সেখান হইতে সরিয়া পড়িলেন।
গ্রেফতার চলিতে লাগিল।
ধর্ম-যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া শহরময় ছড়াইয়া পড়িল। কারণ যেসব মহলায় ইতিমধ্যেও যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হইল না, সে সব স্থানেও তদন্ত ও গ্রেফতার করিয়া পুলিশ তথায়ও যুদ্ধ মনোভাব ছড়াইয়া দিল। ফলে হিন্দুপল্লীতে হিন্দুরা মুসলমানের উপর এবং সলমান পল্লীতে মুসলমানেরা হিন্দুর উপর মারপিট ও লুটপাট চালাইতে লাগিল।
হিন্দু-পল্লীর মুসলমানেরা এবং মুসলমান-পল্লীর হিন্দুরা পালাইতে লাগিল।
যাহারা পালাইতে পারিল না, তাহারা শহীদ হইতে লাগিল।
.
তিন
অবশেষে হাতের লড়াই থামিল।
কিন্তু দাঁতের লড়াই থামিল না। বাঁশের লড়াইর বদলে বাঁশীর লড়াই চলিতে লাগিল। হিন্দু কাগজওয়ালারা মুসলমানদিগকে এবং মুসলমান কাগজওয়ালারা হিন্দুদিগকে প্রাণ ভরিয়া গালি দিতে লাগিল।
নেতারা নিজেদের দলের মধ্যে সভা করিয়া বিপক্ষের বিরুদ্ধে দেহ ভরিয়া নৰ্তন ও গলা ভরিয়া গর্জন করতে লাগিলেন। সত্যসনাতন ধর্ম অধিকতর বিপন্ন হইয়াছে বলিয়া হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নেতাদের ও সম্পাদকদের তথ্য হাহাকার পড়িয়া গেল।
ইংরজি সরকারের নিকট বিচার চাওয়া হইল : মসজিদের সামনে বাদ্য বাজনা চলিবে কি না?
সরকার তাঁহার নিরপেক্ষতা নীতি অনুসারে ফরমান জাতি করিলেন : এ বিষয়ে চির প্রচলিত প্রথা অনুসারে কাজ হইবে। সুতরাং প্রথা কি তাহা সরকারকে জানতে হইবে।
মুসলমান নেতারা সকলে এক বাক্যে জানাইলেন : তাঁহারা সারা বাংলাদেশ তন্ন-তন্ন। করিয়া তালাশ করিয়া দেখিয়াছেন, হিন্দুরা চিরকাল সর্বত্রই সকল মসজিদের সামনে বাজনা বন্ধ করিয়া আসিয়াছে।
হিন্দু নেতারা সর্বসম্মতিক্রমে জানাইলেন : সূর্য একদিন পশ্চিম দিকে উদিত হইয়া থাকিলেও থাকিতে পারে, কিন্তু হিন্দুরা কুত্রাপি কস্মিনকালেও মসজিদের সামনে বাদ্য বন্ধ করে নাই।
বেচারা ইংরাজ সরকার বিদেশী মানুষ। এদেশের প্রাচীন প্রথার কথা তাঁহাদের জানা নাই। তবে দুই পক্ষের কথাই যে সত্য হইতে পারে না, ইহা তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন।
তাই তাঁহারা বিষম ভাবনায় পড়িলেন।
অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া সরকার উভয় পক্ষের প্রতি সমান হাতে ইনসাফ করিবার উদ্দেশ্যে আবার হুকুম জারি করিলেন : যেসব জায়গায় মসজিদের সংখ্যা খুব বেশি, সেইসব অঞ্চল মুসলমান-মহল্লা বলিয়া ঘোষিত হইবে। তথায় দুই-একটা মন্দির থাকিলেও সে অঞ্চলে মসজিদের সামনে বাদ্য বাজান চলিবে না। পক্ষান্তরে, যে-সব অঞ্চলে মন্দিরের সংখ্যা খুব বেশি, সেইসব অঞ্চল হিন্দু-পল্লী বলিয়া ঘোষিত হইবে; সেখানকার মসজিদের সামনে হিন্দুরা যত ইচ্ছা বাজনা বাজাইতে পারিবে। আর, যে সময়টাতে মুসলমানরা নামাজ পড়িবে না, সেই সময়ে হিন্দুরা মুসলমান মহল্লার মন্দিরে গিয়া পূজা দিয়া আসিবে, এবং যে সময়টা হিন্দুদের পূজার সময় নয়, সেই সময়ে মুসলমানরা হিন্দু পল্লীস্থ মসজিদসমূহে গিয়া আজান দিয়া আসিবে।
এই সরকারি আদেশ প্রকাশ্য সভায় এবং মুদ্রিত ইশতাহারে ঘোষিত হইল।
হিন্দু-মুসলমান উভয় দল এই আদেশ শুনিয়া ঠোঁট কামরাইতে-কামড়াইতে বাড়ি ফিরিল।
সারা রাত পরামর্শ হইল, হৈ চৈ হইল, গোলমাল হইল, ঠুকঠাক ও ধুপধাপ শব্দ। হইল, ‘আল্লাহু-আকবর’ ও ‘কালী মায়কি জয়’ ধ্বনি হইল।
গোলমালে সাহেবদের ঘুম টুটিয়া গেল বটে, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান কোনো ধর্ম কার্য করিতেছে মনে করিয়া আবার তাহারা পাশ ফিরিয়া শুইল।
শেষ রাতে শখ-কাঁসরের অসহ্য আওয়াজে ভীষণ গোলমালে সাহেবদের ঘুম ছুটিয়া গেল।
তাহারা উঠিয়া দেখিল : আজব কাণ্ড! কলিকাতার সেই বিরাট চৌতালা পাঁচতালা বাড়ির একটাও আর বাড়ি নাই,-সবগুলিই মন্দির ও মসজিদ হইয়া গিয়াছে। বাড়ি-ঘর স্কুল কলেজ মকতব-মাদ্রাসা-অফিস-আদালত দোকান-পাট কিছুরই আর অস্তিত্ব নাই-সব মন্দির আর মসজিদ, মসজিদ আর মন্দির! আর হিন্দু-মুসলমান ছাত্র-শিক্ষক কেরানী চাপরাশি দোকানদার খরিদ্দার ছেলে-বুড়ো মেয়ে-পুরুষ সবাই যাহার তাহার কাজ ছাড়িয়া সেইসব মন্দির ও মসজিদে ননস্টপ পূজা করিতেছে এবং নামাজ পড়িতেছে।
লাট সাহেব আসিয়া ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করিলেন।
হিন্দুরা কি বলিল কাসরের আওয়াজে তাহা বুঝা গেল না! মুসলমানরা বলিল : মসজিদে চব্বিশ ঘণ্টাই নামাজ পড়া ফরজ। লাট সাহেব আবার ভাবনায় পড়িলেন।
কিন্তু নিজে কিছুই ঠিক করিতে না পারিয়া বড়লাট সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করিবার জন্য সংগপাংগসহ শিমলা চলিয়া গেলেন।
এদিকে হিন্দুরা অষ্টপ্রহর শঙ্খ-ঘণ্টা-কাঁসর বাজাইয়া পূজা অর্চনা করিতে থাকিল!
মুসলমানরা চব্বিশ ঘণ্টা আজান দিয়া নামাজ পড়িতে থাকিল।
সমস্ত বাড়ি-ঘর মন্দির ও মসজিদ হইয়া পড়াতেও লোকজনের রাত্রি বাসের কোনই অসুবিধা হইল না; কারণ চব্বিশ ঘণ্টাই যাহারা পূজা অর্চনা ও এবাদত-বন্দেগিতে ব্যস্ত, তাহাদের আবার রাতদিন অথবা অন্দর বাহির কি?
সমস্ত হিন্দু পূজা-অর্চনায় এবং সমস্ত মুসলমান নামাজ-বন্দেগিতে চব্বিশ ঘণ্টা ব্যস্ত থাকায় কলিকাতার কাজকর্ম থামিয়া গেল। ব্যবসায়-বাণিজ্য-দোকানপাট হোটেল-রেস্তোরাঁ গাড়ি-ঘোড়া ট্রাম-ট্যাক্সি সমস্ত বন্ধ হইয়া গেল।
সাহেবরা অন্তত নিজেদের অসুবিধা দূর করিবার জন্য গাড়ি-ঘোড়া চালাইবার চেষ্টা করিল।
কিন্তু পূজা ও নামাজ ছাড়িয়া কোন হিন্দু বা মুসলমান কাজ করিতে রাজি হইল না।
লোকাভাবে সাহেবদের চেষ্টা ব্যর্থ হইল।
কিছুদিন গেল এইভাবে। যাইতও আরো কিছুকাল–
কিন্তু লোকজনের ক্ষুধা লাগিল। অথচ ধর্মকাজ ফেলিয়া পেটের আয়োজন করিতে কেহই প্রস্তুত ছিল না।
কিন্তু ক্ষুধা বাড়িয়া চলিল। সকলের নাড়ি-ভুড়ি চু-চু করিতে লাগিল।
উভয় পক্ষেই দুই একজন অপেক্ষাকৃত কম ধার্মিক লোক ছিল। তাহারা প্রস্তাব করিলঃ কিছুক্ষণের জন্য উপাসনা মুলতবি রাখিয়া পেট ভরিয়া খাইয়া লওয়া যাক।
খাইয়া যে লওয়া উচিত, তা সকলেই স্বীকার করিল। কিন্তু খাইবে কি? খাবার কোথায়? চাউল-ডালও ত নাই। রাঁধিবে বা কে? কোথায় বা রাঁধিবে? মন্দির-মসজিদে ত আর রান্না চলে না?
বিবেচনা করিয়া দেখা গেল : খাইতে গেলে আবার দোকানপাট খুলিতে হয়, মন্দির মসজিদকে আবার রান্নাঘর বানাইতে হয়। কিছুক্ষণের জন্যও কোন উপাসনা বন্ধ করিলেই যে অপরপক্ষে তাহাদের মহল্লায় প্রবেশ করিয়া উপাসনা করিয়া যাইবে। খ্রিস্টান লাট সাহেবের যে হুকুম তাই!
কাজেই আহার করা আর হইল না।
নামাজ ও পূজা চলিতেই থাকিল।
ক্ষুধার জ্বালায় ক্রমে সকলে অচেতন হইয়া পড়িল।
.
চার
আমি ছিলাম বরাবরের অজীর্ণ অগ্নিমান্দ্যের রোগী। কাজেই ক্ষুধা আমাকে তেমন কাবু করিতে পারিল না।
তথাপি অনেক দিনের অনাহারে নিতান্ত দুর্বল হইয়া পড়িলাম; মাথা ঘুরিতে লাগিল, চোখে অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম! খুবই ঘুম পাইতে লাগিল। কিন্তু ঘুমাইয়া পড়িলে হিন্দুরা পাছে আবার বাদ্য বাজাইয়া যায় এই ভয়ে ঘুমাইলাম না, তাই বসিয়া-বসিয়া ঝিমাইতে লাগিলাম।
অবশেষে নিজের অজ্ঞাতেই ঘুমাইয়া পড়িলাম।
হঠাৎ কাহার ধাক্কায় ঘুম ভাংগিয়া গেল। চোখ মেলিয়া দেখিলাম : লাট সাহেব।
আমি তাহাকে ভক্তিভরে কুর্ণিশ করিতে গেলাম।
বাধা দিয়া তিনি নিঃশব্দে আমার হাত ধরিলেন এবং টানিয়া মসজিদের বাহিরে রাস্তায় আনিয়া আমাকে দাঁড় করাইলেন। তারপর হাতের ইশারায় চারদিক দেখাইলেন।
আমি ভাল করিয়া চোখ মুছিয়া চাহিয়া ভয়ে বিস্ময়ে শিহরিয়া উঠিলাম! দেখিলাম : সারি সার মৃতদেহ স্তূপাকারে পড়িয়া আছে। চিনিলাম : ইহারা সবাই আমার সহকর্মী উপাসনা-রত হিন্দু-মুসলমান। তাহাদের পচা দেহ হইতে দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে বটে, কিন্তু মুখ তাহাদের ধর্মের জ্যোতিতে উজ্জল! বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করিলাম : হিন্দু মৃতদেহগুলির বুকের উপর এক-এক খণ্ড গৈরিক বস্ত্রে আবিরের অক্ষরে লেখা রহিয়াছে—’আর্য বীর’ এবং মুসলমানদের বুকের উপর সবুজ-সবুজ বস্ত্রখণ্ডে রূপালী হরফে লেখা রহিয়াছে—’শহীদ’।
পুলকের আতিশয্যে আমার কান ভোঁ ভোঁ করিতে লাগিল। আমি সগর্বে লাট সাহেবের দিকে চাহিলাম।
বুকে একটি ক্রসচিহ্ন আঁকিয়া লাট সাহেব বলিলেন : বাঙালি জাতটা আজ ধর্মের জন্যেই প্রাণ দিল। ধন; এই জাতি। আফসোস! বড়লাট সাহেবের সংগে পরামর্শ করিতে-করিতে দেরি হইয়া গেল। আর একদিন আগে আসিতে পারিলে এই মহান জাতির অন্ততঃ দু’একজন লোককে বাঁচাইতে পারিতাম।
–তাঁহার চোখ হইতে দুই ফোঁটা পানি টস টস করিয়া পড়িয়া গেল।
আমি লাট সাহেবের এই অশ্রুপাতে কিছুমাত্র প্রভাবিত না হইয়া মাথা উঁচু করিয়া বলিলাম : খোদাকে ধন্যবাদ, আপনি একদিন আগে আসেন নাই। আসিলে গোটা বাঙালি জাতি ধর্মের জন্য এমন করিয়া নিঃশেষ প্রাণদান করিতে পারিত না। আমাদের ধর্মে হস্তবে উদ্দেশ্যে আপনারা যে ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন, খোদাই তাহা ব্যর্থ করিয়াছেন।
লাট সাহেব বলিলেন : আমাদের প্রতি আপনি অবিচার করিতেছেন। অন্য সময় হইলে এই অপরাধে আপনাকে অন্তরীণে আবদ্ধ করিতাম। কিন্তু মহান বাঙালি জাতির আপনি একমাত্র জীবিত লোক বলিয়া আপনাকে রেহাই দিলাম। ধর্মপ্রাণ বাঙালি জাতির প্রতি আমরা কতটা শ্রদ্ধাবান তাহার প্রমাণ চান?
–বলিতে বলিতে তিনি অদূরে অবস্থিত স্বীয় এরোপ্লেনের দিকে অগ্রসর হইলেন এবং তাহা হইতে খুঁটিতে-বাঁধা একটি সাইনবোর্ড আনিয়া স্তুপাকার লাশের মধ্যে পুঁতিয়া দিলেন।
দেখিলাম : সাইনবোর্ডে উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা রহিয়াছে—’ধর্ম-রাজ্য’।
বুঝিলাম : লাট সাহেব শুধু আমাদের ধর্মপ্রাণতায় শ্রদ্ধাবানই নন, ভবিষ্যৎদ্রষ্টাও বটে; তাই তিনি আগে হইতেই সব ঠিকঠাক করিয়াই আনিয়াছেন।
আমি লাট সাহেবের কাছে মাফ চাহিলাম এবং তাঁহাকে ধন্যবাদ দিলাম।
তিনি সিল্কের রুমালে চোখ, গাল এবং কপাল মুছিয়া গুড়াই বলিয়া এরোপ্লেনে চড়িলেন এবং দিল্লী কিংবা বিলাত রওয়ানা হইলেন।
আমি নড়িতে পারিলাম না। লাট সাহেব আকাশে উড়িতে উড়িতে আমার দিকে রুমাল উড়াইতে লাগিলেন, একদৃষ্টে তাহাই দেখিতে লাগিলাম।
লাট সাহেবের এরোপ্লেন অদৃশ্য হইলে সেই জনহীন দুর্গন্ধময় শ্মশানে লক্ষ-লক্ষ মৃতদেহের মাঝখানে আমি নিঃসঙ্গ বোধ করিলাম এবং ভয়ে মূৰ্ছিত হইয়া পড়িলাম।
কিছুক্ষণ পরে দেখিলাম : আসমান হইতে একজন ফেরেশতা একথাল মেওয়া লইয়া আসিয়া আমার শিহরে বসিলেন এবং আমার হাত ধরিয়া টানতে-টানতে বলিতে লাগিলেন : বেহেশতে সমস্ত শহীদানের খাওয়া হইয়া গিয়াছে। তুমি খাইবে কখন? শিগগির উঠ।
ফেরেশতার টানাটানিতে আমি জাগিয়া উঠিলাম। দেখিলাম, আমার রুমমেট আমার হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে বলিতেছেন : রাত নয়টা বাজিয়া গিয়াছে, মেসের সক্কলের খাওয়া হইয়া গিয়াছে তুমি খাইবে কখন? শিগগির উঠ।