ধর্ম প্রসঙ্গে মার্কস : একটি সমকালীন মূল্যায়ন

ধর্ম প্রসঙ্গে মার্কস : একটি সমকালীন মূল্যায়ন
দেবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

সাধারণভাবে লোকসমাজে এরকম একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে— ধর্ম সম্পর্কে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি সম্পূর্ণই নেতিবাচক ও একমাত্রিক। আর আমাদের প্রজন্মের মধ্যবিত্ত বাঙালি পাঠক, যাদের নিবাস ‘বাইরে লেনিন ভিতরে শিব বেলেঘাটার গলি’তে, তারা তো ধর্মের কথা উঠলেই আপ্তবাক্যের মতো বলে উঠি ‘ধর্ম হল জনগণের আফিম’। এ কথা ঠিক যে, মার্কসের এই বাক্যটি সারা পৃথিবী জুড়েই ধর্ম সম্বন্ধে তাঁর সবচাইতে প্রচারিত বাক্য, কিন্তু এ বাক্যের ‘আফিম’ শব্দের ব্যাখ্যা নিয়েও তাত্ত্বিক মহলে চর্চা কিন্তু কম হয়নি। পরিপ্রেক্ষিত বিচ্ছিন্ন করে এরকম বাক্যের মাধ্যমে ধর্ম বিষয়ে মার্কসের ভাবনা বিচার করলে তা কিন্তু হয়ে উঠতে পারে নিতান্তই এক অতিসরলীকৃত ব্যাখ্যা। ধর্ম বিষয়ে মার্কসীয় চিন্তা অবশ্য বেশ জটিল এবং তার একটা বিবর্তনও ঘটেছে। তাই এক্ষেত্রে আমাদের চেষ্টা করতে হবে ধর্ম সম্বন্ধে মার্কসের চিন্তার বহুমাত্রিকতা ও তার বিবর্তনটিকে বুঝতে।

মার্কস ও এঙ্গেলস ধর্ম বিষয়ে স্বতন্ত্র কোনও গ্রন্থ রচনা করেননি। বিভিন্ন সময়ে রচিত নানা লেখায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো-ছেটানো রয়েছে ধর্ম সংক্রান্ত তাঁদের মূল বক্তব্য। তাঁদের নানা রচনা থেকে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক অংশ সংগ্রহ করে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অধীন ইনস্টিটিউট অফ মার্কসসিজ়ম লেনিনিজ়ম-এর উদ্যোগে ১৯৫৫ সালে রুশ ভাষায় প্রকাশিত হয় একটি গ্রন্থ, যা ১৯৫৭ সালে ইংরিজিতে অনূদিত হয় মার্কস এঙ্গেলস অন রিলিজিয়ন নামে। এই গ্রন্থটিতে ‘অন দ্য জুয়িশ কোয়েশ্চেন’ অথবা পারি বা প্যারিস পাণ্ডুলিপি-র মতো গুরুত্বপূর্ণ লেখার প্রাসঙ্গিক অংশ অন্তর্ভুক্ত না হলেও ইংরিজি জানা বৃহত্তর পৃথিবীর সাধারণ মানুষের কাছে দীর্ঘদিন অবধি এটাই ছিল মার্কস-এঙ্গেলসের ধর্মভাবনার নির্ভরযোগ্য ও একমাত্র সংকলন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, সেই গ্রন্থের ভূমিকাতেই স্পষ্ট ভাষায় বলে দেওয়া হল, ‘“ধর্ম হল মানুষের আফিং”, ১৮৪৪ সালে মার্কস এ কথা লিখেছিলেন। এই বাক্যটিই ধর্মপ্রসঙ্গে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির মূল কথা।’ অর্থাৎ, এভাবেই বর্জিত হল ধর্ম বিষয়ে মার্কসীয় ভাবনার বিশদ আলোচনার প্রয়াস, অস্বীকৃত হল মার্কসীয় চিন্তায় ধর্ম বিষয়ে বিকল্প ব্যাখ্যা অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা। আর পাঁচটা বিষয়ের মতো ধর্মের প্রশ্নেও ধ্রুপদি মার্কসবাদের সরকারি ভাষ্যে আবারও মার্কসবাদের সংকোচন ঘটানো হল, আর তা করা হল প্রবল পরাক্রমশালী সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে।

মার্কসের ধর্ম সংক্রান্ত বক্তব্যগুলির পরিপ্রেক্ষিত ব্যাখ্যা করে সেগুলির বিশদ আলোচনা, তাঁর কোনও কোনও বক্তব্যের মধ্যে বিকল্প ভাবনার আদৌ কোনও ইঙ্গিত ছিল কি না— তার সুনির্দিষ্ট বিচার, কোনওটাই এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে করা সম্ভব নয়। এমনকী বৃহত্তর মার্কসীয় ঐতিহ্যের মধ্যে অটো বাউয়ের, মাক্স অ্যাডলার, আন্তোনিও গ্রামশি বা ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকদের ধর্ম বিষয়ে খানিক অন্যরকম যে-ভাবনা, তার শিকড় আদৌ মার্কসের রচনার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না— এসব আলোচনাতেও আমরা সেভাবে ঢুকতে পারব না। আলোচনার শুরু থেকেই আমরা মনে রাখব, গোটা মার্কসীয় ঐতিহ্য নয়, আমাদের ফোকাস আবদ্ধ থাকবে মূলত মার্কসের ধর্ম সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার উপর। তাই প্রবন্ধের শেষে ইতি-উতি দু-একটি বিষয় উত্থাপনের আগে শুরুতে আমরা অতি সংক্ষেপে বুঝে নেবার চেষ্টা করব মার্কসের ধর্ম সংক্রান্ত ভাবনার বিভিন্ন পর্বগুলিকে।

ট্রেভর লিং-এর মতো গবেষকদের আলোচনা অবলম্বন করে আমরা দেখব, ধর্ম বিষয়ে মার্কসীয় ভাবনার তিনটি স্বতন্ত্র ও সুস্পষ্ট পর্ব রয়েছে। প্রথম পর্বটি হল তাঁর কিশোরবেলার স্কুলজীবনের দিনগুলি, যখন তিনি নৈতিক অনুশাসন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন খ্রিস্টধর্মকে। দ্বিতীয় পর্বটির সূচনা হল মার্কসের যৌবনে ১৮৩৬ সালে, যখন তিনি ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলেন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই পর্বে তিনি তাঁর দার্শনিক প্রত্যয়ের উপর দাঁড়িয়ে খ্রিস্টধর্ম সহ সকল ধর্মকে সরাসরি আক্রমণ করলেন। আর ধর্ম সংক্রান্ত মার্কসীয় ভাবনার তৃতীয় পর্বটির সূচনা হল ১৮৪২ সালে, যখন তিনি পেশাগতভাবে যুক্ত হলেন সাংবাদিকতার সঙ্গে। এই পর্বটি চলল তাঁর মৃত্যু অবধি। এই পর্বে ধর্ম নয়, মার্কসের লেখায় তীব্রভাবে সমালোচিত হল রাষ্ট্র ও প্রতিপত্তিশালী শ্রেণি কর্তৃক ধর্মকে ব্যবহার করবার বিষয়টি। ট্রেভর লিং-এর বলা এই তৃতীয় পর্বটিকে আবার ডেভিড ম্যাকলেলান-এর মতো মার্কস বিশেষজ্ঞ স্বতন্ত্র দু’টি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। ১৮৪৫ সালে মার্কস প্যারিস থেকে ব্রাসেলস্‌-এ চলে আসেন। ম্যাকলেলান মনে করেন, এই সময় থেকে মার্কসের চিন্তার অভিমুখ খানিক বদলে যেতে থাকে। এরপরে পরিণত মার্কসের রচনায় ধর্মের বিষয়টি আলোচিত হয় বেশ খানিকটা অন্যরকমভাবে। এই পর্বে মার্কসের রচনায় ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনা অনেকটাই কমে আসে বটে, তবে এ পর্বেই তিনি তাঁর সুবিখ্যাত ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার সূত্রাবলির সঙ্গে যুক্ত করেন তাঁর ধর্মসংক্রান্ত চিন্তাভাবনাকে।

মার্কসের পরিবার এঙ্গেলসের পরিবারের মতো অতটা ধর্মপ্রাণ ছিল না। মার্কসের পিতা ছিলেন ধর্মান্তরিত মানুষ। কাজের নিরাপত্তার খাতিরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁকে ইহুদি ধর্ম ছেড়ে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মে দীক্ষা নিতে হয়। তিনি ছিলেন এক ধরনের ঢিলেঢালা গোঁড়ামিমুক্ত যৌক্তিক একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী মানুষ। যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে প্রচলিত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে খুব বেশি আস্থা না রাখলেও ঈশ্বরের অস্তিত্বে তিনি ছিলেন বিশ্বাসী। তিনি তাঁর পুত্রকে লেখেন, নৈতিকতার পেছনে সমর্থন করাই হল ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখা। তাঁর এই জাতীয় ধ্যানধারণাই প্রতিফলিত হয়েছিল মার্কসের স্কুলজীবনের রচনাগুলিতে। মার্কস সেসময় এক দিকে যেমন ধর্মকে নৈতিকতার উৎস হিসেবে দেখতেন, আবার অন্য দিকে যুক্তিবাদের প্রভাবও তাঁর মধ্যে এসে গিয়েছিল। সেই কারণে তাঁর ওই পর্বের লেখাগুলিতে যথেষ্ট ধর্মীয় অভিব্যক্তি থাকলেও মূলত সেগুলি দাঁড়িয়েছিল একটা শক্তিশালী যৌক্তিক কাঠামোর উপর। শুধু তাই নয়, মানবতার সর্বোচ্চ নৈতিক বিকাশের জন্য খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাবের কেন প্রয়োজন ছিল— সেটি ব্যাখ্যা করাই ছিল তাঁর সেই পর্বের রচনাগুলির মূল লক্ষ্য।

কৈশোরে স্কুলজীবনেই মার্কস প্রথম ধর্ম বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করতে শুরু করেন এবং তাঁর ওই সময়ে লেখা কতগুলি রচনাতেও সেই চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়। মার্কসের স্কুলটি ছিল তাঁর জন্মশহর ট্রিয়ের-এ। সেখানে ১৮৩০-৩৫, অর্থাৎ তাঁর জীবনের সতেরো বছর বয়স অবধি মার্কস পড়াশুনা করেন। এ পর্বে বিদ্যালয় পরিত্যাগের সময় তিনি তিনটি প্রবন্ধ লেখেন যাতে উঠে আসে ধর্মের কথা। ট্রেভর লিং-কে অনুসরণ করে বলা যায়, ওই সময়কার লেখাগুলিতে মার্কস খ্রিস্টধর্মকে সদর্থকভাবে গ্রহণ করেন। মার্কসের এই প্রবন্ধগুলির একটি ছিল সরাসরি ধর্মবিষয়ক। প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘দ্য ইউনিয়ন অফ বিলিভারস উইথ ক্রাইস্ট অ্যাকরডিং টু জন ফিফটিন, ওয়ান টু ফোর, শোয়িং ইটস বেসিস অ্যান্ড এসেন্স, ইটস ইফেক্টস’ (The Union of Believers with Christ According to John 15, 1-4, Showing Its Basis and Essence, Its Effects)। এই প্রবন্ধে মার্কস বলেন, ইতিহাস আমাদের দেখায়, সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানবসমাজের লক্ষ্য হল নৈতিকতার আরও উচ্চতর স্তরে আরোহণ করা। আর সেই লক্ষ্যে ধাবিত হবার জন্য, মার্কসের ভাষায়, ‘মানুষের ইতিহাস আমাদের যিশুর সঙ্গে একাত্ম হওয়া প্রয়োজন এই শিক্ষাই দেয়’। মার্কসের মতে, আমরা যদি ব্যক্তির ইতিহাস ও প্রকৃতি বিচার করি তবে আমরা তার মধ্যেকার আধ্যাত্মিকতার ঝলক, সর্বজনীন মঙ্গলের প্রতি তার উৎসাহ, জ্ঞানের প্রতি তার আগ্রহ, সত্যের প্রতি তার অনুরাগ দেখতে পাব। কিন্তু এইসব আকাঙ্ক্ষাগুলো মানুষের পাপের কারণে বিষিয়ে ওঠে। তবে বিশ্বাসী মানুষ যদি যিশুর সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন তবে তিনি অতিক্রম করতে পারেন সব প্রতিবন্ধকতা। মার্কসের মতে, কেবলমাত্র বিশ্বাসী ব্যক্তিরা যদি যিশুর কাছে, এবং তাঁর মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে বাঁধা পড়েন তবেই তাঁরা স্বাদ পান এক পরম আনন্দের, আর এভাবেই তাঁদের জীবন হয়ে ওঠে আরও সূক্ষ্ম ও আরও উন্নত।

মার্কসের আরেকটি প্রবন্ধর শিরোনাম ছিল ‘রিফ্লেকশনস্ অফ এ ইয়ং ম্যান অন দ্য চয়েস অফ এ প্রফেশন’। এটির বিষয়বস্তু ছিল পেশা নির্বাচন। এখানে তিনি লেখেন, আমরা যদি এমন পেশা নির্বাচন করি যার মাধ্যমে আমরা মানবতার সর্বাধিক মঙ্গলসাধন করতে পারব, তাহলে আর কোনও কিছুকেই আমাদের বাড়তি বোঝা বলে মনে হবে না। কারণ সেগুলিকে তখন আমরা দেখব সকলের সুবিধার জন্য সামান্য আত্মত্যাগ হিসেবে। যে সর্বাধিক মানুষকে সুখী করতে পারে সে নিজে সবচেয়ে সুখী হয়। মার্কস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, মানবতার হিতার্থে ত্যাগস্বীকারের মহান শিক্ষাটি কিন্তু ধর্মই আমাদের দেয়। নিকোলায়েভস্কি এই প্রসঙ্গে সঠিকভাবেই মন্তব্য করেন, এই শিক্ষাটি মার্কসের জীবনের মূল অক্ষ হয়ে রয়ে গিয়েছিল, মানবতার স্বার্থে কাজ করাই হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবনের আদর্শ ও একমাত্র লক্ষ্য।

১৮৩৬ সালে মার্কস ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলেন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ট্রিয়ের, বা মাঝে অল্পদিনের জন্য বাস করা বন-এর তুলনায় বার্লিন ছিল সব দিক থেকেই আলাদা। আসলে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল দ্বারা বেষ্টিত বিরাট ও জনবহুল বার্লিন শহরের বৌদ্ধিক পরিবেশও ছিল অনেক উন্নত। বার্লিন ছিল এক দিকে প্রাশিয়া নামক রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কেন্দ্র, অপর দিকে একইসঙ্গে তা ছিল রাষ্ট্রবিরোধী বৈপ্লবিক বুদ্ধিজীবীদের মিলনকেন্দ্র।

বার্লিনে মার্কস ভর্তি হলেন আইনের ছাত্র হিসেবে, পাঠ্য হিসেবে থাকল— ফৌজদারি আইন, রোমান আইন ও নৃতত্ত্ব। কিন্তু এই সময় থেকেই তাঁর প্রবল আগ্রহ জন্মাল দর্শনে। আসলে সেই সময় বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে হেগেলের প্রভাব ছিল অপরিসীম। মাত্র পাঁচ বছর আগে ১৮৩১ সালে মারা যান হেগেল, আর তিনি আমৃত্যু ছিলেন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক। ব্যক্তিগত জীবনে হেগেল ছিলেন গভীরভাবে ধর্মবিশ্বাসী মানুষ। তিনি মনে করতেন, অতীন্দ্রিয় পরমাত্মার বিভিন্ন প্রকাশমাধ্যমের মধ্যে অন্যতম হল ধর্ম। তিনি ধর্মের ঐতিহাসিক ভূমিকা পর্যালোচনা করেছিলেন। হেগেলের মৃত্যুর পর তাঁর অনুগামীরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে যান। প্রাচীন হেগেলপন্থীরা ছিলেন রাজনৈতিকভাবে ও ধর্মের প্রশ্নে গোঁড়া ও রক্ষণশীল, অপর দিকে নব্য-হেগেলপন্থীরা বৈপ্লবিক মানবতাবাদী অবস্থান থেকে হেগেলকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে চাইছিলেন।

বার্লিনে ছাত্রজীবনের প্রথমদিকে মার্কস আইনের ছাত্র, কিন্তু তাঁর মন ডুবে আছে দর্শনে। তখন তিনি হেগেলের রচনা পড়ছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। কিন্তু এরপর থেকেই ধীরে ধীরে তাঁর হেগেলপ্রীতি কমতে থাকে ও তাঁর চিন্তা ধর্ম-বিরোধী খাতে বইতে শুরু করে। নব্য-হেগেলপন্থীদের সঙ্গে তখন তাঁর গভীর যোগাযোগ, আর সেই গোষ্ঠীর অন্যতম তাত্ত্বিক ব্রুনো বাউয়ের-এর সঙ্গে তখন তাঁর যথেষ্ট সখ্য। বাউয়ের এই সময় আরেক নব্য-হেগেলবাদী ডেভিড স্ট্রাউস-এর সঙ্গে সহমত হয়ে— বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট-এর প্রথম চার খণ্ডে বর্ণিত যিশুর জীবনী ও উপদেশকে আদৌ যিশুর ঐতিহাসিক জীবনীর সূত্র হিসেবে গ্রহণ করা যায় কি না— সে সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছেন। ফলত পবিত্র বাইবেলের ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনি তখন প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিস্টধর্মের মূল শত্রু। অপর দিকে মার্কসের তিনি মিত্র, যাঁর দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়ে ১৮৪১ সালে মার্কস তাঁর ডকটরাল থিসিস জমা দেন। সেই থিসিসের মূল নায়ক দু’জন। প্রথম জন এপিকিউরাস, যিনি মনে করতেন মানুষের আত্মার পরিপূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও বিকাশই মানুষকে সব ধরনের অতিজাগতিক তুরীয় বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে পারে। থিসিসের দ্বিতীয় নায়ক প্রমিথিউস, যাঁর সম্পর্কে মার্কস লেখেন, ‘প্রমিথিউস, যাঁর বিখ্যাত ঘোষণা: সকল দেবতাদের আমি ঘৃণা করি। দর্শন কোনওভাবে গোপন করার চেষ্টা করে না যে এটি হল দর্শনের নিজেরই ঘোষণা, কারণ এটি হল স্বর্গের ও মর্তের সমস্ত দেবতাকুলের প্রতি দর্শনের মনোভাব, কারণ এইসব দেবতাকুল— মানুষের আত্মচৈতন্যই যে সর্বোচ্চ দেবত্ব— তা মানতে অস্বীকার করে। এর তুল্য আর কোনও দেবতা থাকতে পারে না।’১০

মার্কস থিসিস জমা দিলেন বটে, কিন্তু ইতিমধ্যে চার্চের চাপে প্রাশিয়া রাষ্ট্র বাউয়েরকে বন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ থেকে অপসারিত করে। নব্য-হেগেলপন্থীদের ওপর এর প্রভাব পড়ে ব্যাপক। এরপর থেকে মার্কসের আলোচনার গতিমুখ পালটে যায় অনেকটা। ধর্ম, নৈতিকতা, মানবাত্মার আত্মচৈতন্য লাভ— এসব ছেড়ে এখন তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়ে— প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের উপর। থিসিস জমা দেবার পর মার্কস উপলব্ধি করেন, প্রাশিয়ার মতো রক্ষণশীল দেশে আর যাই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করা তাঁর হবে না। তিনি স্থির করেন সাংবাদিকতা করবেন, যোগ দেন রাইনিশে ৎজাইটুং সংবাদপত্রে। শুরু হয় তাঁর সাংবাদিক জীবন।

আমরা দেখলাম, জীবনের আদিপর্বেই মার্কস নিরীশ্বরবাদী হয়ে উঠেছিলেন। মানুষই ছিল তাঁর চোখে ঈশ্বর এবং ধর্ম, ধর্মীয় নৈতিকতা— এসবই হয়ে উঠেছিল তাঁর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। কিন্তু এই পর্বে এসে তাঁর চোখে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে— রাষ্ট্র ও ধর্মের পারস্পরিক সহযোগিতা ও জোটের বিষয়টি। এই পর্বের শুরুর দিকে সাংবাদিক হিসেবে রচিত তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি প্রাশিয়াতে রাষ্ট্র ও ধর্মের অশুভ জোটের সমালোচনা করতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ধর্মের ভিত্তিতে নয়, বরং স্বাধীন বিচারশক্তি ও যুক্তিবাদিতার উপর নির্ভর করেই গড়ে তোলা উচিত রাষ্ট্রকে। যেকোনও সমাজের মেরুদণ্ড ধারণ করে থাকে ধর্ম— এই চিরাচরিত ধারণাটিকে মার্কস তাঁর রচনায় সম্পূর্ণ উলটে দিলেন। ধর্ম রাষ্ট্রকে নয়, রাষ্ট্রই ধর্মকে ধারণ করে থাকে— এই মত প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মার্কস দেখালেন, প্রাচীন রাষ্ট্রগুলির পতন ঘটেছে প্রাচীন ধর্মগুলির পতনের জন্য নয়, বরং প্রাচীন ধর্মগুলির পতন হয়েছে প্রাচীন রাষ্ট্রগুলির পতনের কারণে।১১

এই পর্বে মার্কসের ধর্মচিন্তার ক্ষেত্রে আরেকটি পরিবর্তন ঘটে। হেগেলের রাজনৈতিক দর্শনের ক্রিটিক লিখবেন বলে যত তিনি পড়াশুনা করতে শুরু করেন, ততই এক দিকে যেমন তাঁর উপর হেগেলের প্রভাব কমতে শুরু করে, অপর দিকে তেমনি ধর্মের প্রশ্নে তাঁর যাত্রা শুরু হয় বাউয়ের থেকে ফয়েরবাখ-এর দিকে।১২ হেগেল ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যেকার পার্থক্য ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে যে, মানুষের জীবন হল আসলে দিব্যতার এক বস্তুগত প্রক্ষেপণ। মানবিক ও দৈবিকের মধ্যে যে আদৌ কোনও সত্তাতাত্ত্বিক পার্থক্য নেই— হেগেলের এ কথা মেনেও বস্তুবাদী ফয়েরবাখ বললেন, এক্ষেত্রে সম্পর্কটিকে ঠিক উলটে দেওয়া হয়েছে। ফয়েরবাখ দেখালেন, বস্তুগত জগৎটিই হল বাস্তব, আর দিব্যজগৎটি তার প্রক্ষেপণ। ১৮৪১ সালে প্রকাশিত তাঁর দ্য এসেন্স অফ ক্রিশ্চিয়ানিটি গ্রন্থে ফয়েরবাখ বললেন, মানবপ্রকৃতির মধ্যে যেসব সূক্ষ্মতম গুণাবলি দেখা যায় সেগুলিকে নিষ্কাশন করে মানুষ যখন মানব পরিসরের ঊর্ধ্বে আদর্শ কোনও দৈব পরিসরে কৃত্রিমভাবে তা প্রক্ষেপ করে— তখনই গড়ে ওঠে ঈশ্বর। আর মানুষের এই বিশেষ প্রবণতাই জন্ম দেয় ঈশ্বরবিশ্বাসের।১৩ লেকচারস অন দ্য এসেন্স অফ রিলিজিয়ন রচনাতে দেখা গেল ফয়েরবাখ যে হেগেলীয় বৌদ্ধিক পরিবেশে বড় হয়েছিলেন— তার প্রভাব সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠেছেন। জ্ঞানদীপ্তির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ফয়েরবাখ তখন ধর্মকে বিবেচনা করছেন মানুষের নিছক ভয়ভীতি ও অজ্ঞতার ফলশ্রুতি হিসেবে। তবে তাঁর সব রচনাতেই কিন্তু মূল সুর হিসেবে রয়ে গেল এই কথাটি: ধর্ম হল সব ধরনের সামাজিক ব্যাধি ও সামাজিক অকল্যাণের মূল উৎস।১৪ তিনি আরও বললেন, বাস্তব জগতে পারিপার্শ্বিকের চাপে মানুষের অস্তিত্ব বিচ্ছিন্ন ও বিপন্ন, এই বিচ্ছিন্নতাবোধকে অতিক্রম করতে মানুষ ধর্মের আশ্রয় খোঁজে। ফয়েরবাখের মতে, ধর্মের হাত থেকে মানুষের আত্মিক মুক্তি ঘটবে তখনই যখন তার এই খণ্ডিত, বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের অবসান হবে।১৫ ১৮৪৩-এর মধ্যেই মার্কস হেগেলের প্রভাব কাটিয়ে ফয়েরবাখের বস্তুবাদের দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকেন, চিন্তার দিক থেকে বাউয়ের-এর সঙ্গে তাঁর দূরত্বও ক্রমশ বাড়তে থাকে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই সময় থেকেই ধর্মের প্রতি তাঁর আগ্রহ কমতে শুরু করে, আর আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রতি, অর্থাৎ ধর্মের পেছনে যে রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা ক্রিয়াশীল তার প্রতি। এর পরবর্তী সময়ে জার্মান ফ্রেঞ্চ ইয়ারবুক-এ মার্কস দুটি প্রবন্ধ লেখেন যেগুলির বিষয়বস্তু অন্য হলেও সেগুলিতে ধর্মের প্রসঙ্গে তাঁর বেশ কিছু বিখ্যাত উক্তির সন্ধান পাওয়া যায়। প্রথম প্রবন্ধটি ‘অন দ্য জুয়িশ কোয়েশ্চেন’, যেখানে মার্কস জার্মানিতে ইহুদিদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন এবং এ প্রবন্ধেই তাঁর সঙ্গে বাউয়ের-এর বিচ্ছেদ চূড়ান্ত হয়। এই প্রবন্ধে তিনি লেখেন, ‘ধর্মের নিজস্ব কোনও সারবত্তা নেই এবং তার স্থান স্বর্গে নয়, মর্তে। যে বিপরীতধর্মী বাস্তবকে এটি তত্ত্বায়িত করে, তার অবলুপ্তি হলে সে আপনা হতেই বিলীন হয়ে যাবে।’

বাউয়ের বলেছিলেন জার্মান রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করবার কথা। মার্কস বললেন, সেটাই যথেষ্ট নয়, কারণ ‘যেহেতু ধর্মের অস্তিত্ব একটি ত্রুটির অস্তিত্ব, একমাত্র রাষ্ট্রের চরিত্রের মধ্যেই খোঁজ মিলবে এই ত্রুটির উৎসের’। বাউয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করবার। মার্কস বললেন, এর অর্থ হল ধর্মের সাপেক্ষে রাজনৈতিক মুক্তি, কিন্তু সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র যেহেতু বহাল তবিয়তে থেকেই যায়, তাই ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতার মতোই সেখানে আরেক ধরনের বিচ্ছিন্নতা কাজ করে। সেই কারণে মার্কস সুস্পষ্টভাবে বললেন, রাজনৈতিক মুক্তি নয়, চূড়ান্ত লক্ষ্য হল মানবিক মুক্তি।১৬

এই পর্বে দ্বিতীয় যে প্রবন্ধটি মার্কস লেখেন সেটি হল ‘ক্রিটিক অফ হেগেলস ফিলসফি অফ রাইট : ইন্ট্রোডাকশন’। ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ও বহুল প্রচারিত বক্তব্যগুলির হদিশ পাওয়া যায় এই প্রবন্ধে। তিনি বলেন, ‘মানুষই ধর্মের স্রষ্টা, ধর্ম মানুষকে সৃষ্টি করেনি। যে মানুষ নিজের প্রকৃত স্বরূপের সন্ধান পায়নি কিংবা পেয়েও যে নিজেকে আবার হারিয়ে ফেলেছে— ধর্ম হল সেই মানুষের আত্মচেতনা, আত্মানুভূতি। কিন্তু মানুষ তো জগতের বাইরে বসবাসকারী কোনও বিমূর্ত সত্তা নয়। তার নিজের জগৎ, রাষ্ট্র ও সমাজকে নিয়েই তার অস্তিত্ব, তার জীবন। এই রাষ্ট্র, এই সমাজ জন্ম দেয় ধর্মের। কিন্তু এই রাষ্ট্র, এই সমাজ হল উলটানো জগৎ, তাই ধর্ম হল এক ধরনের উলটে ফেলা জগৎচেতনা। অর্থাৎ কিনা ধর্ম হল সেই উলটানো জগতের সাধারণ তত্ত্ব, তার সর্বব্যাপী সংক্ষিপ্তসার, তার আত্মগৌরব, তার উদ্দীপনা, তার নৈতিক প্রেরণা, তার সান্ত্বনা আর বৈধতা প্রতিপাদনের সর্বব্যাপী উৎস। মনুষ্যত্বের নির্যাস বলে যেহেতু কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই, তাই ধর্ম হল সেই নির্যাসেরই কাল্পনিক রূপায়ণ। এই কারণে ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হল, ধর্ম যে বিশেষ জগতের আধ্যাত্মিক সৌরভ সেই বিশেষ জগতের বিরুদ্ধে পরোক্ষ সংগ্রাম।’ এই প্রবন্ধে অনবদ্য ভাষায় মার্কস আরও বললেন, ‘ধর্মীয় ক্লেশ হল একইসঙ্গে বাস্তব ক্লেশের অভিব্যক্তি এবং সেই বাস্তব ক্লেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও বটে। ধর্ম হল নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন পরিবেশের আত্মা। ধর্ম হল মানুষের আফিম। তাই যে দুঃখ-উপত্যকায় ধর্মের দিব্যজ্যোতির আশ্বাসে মানুষের পরিক্রমা, ধর্মের সমালোচনা হল প্রকৃতপক্ষে সেই দুঃখ-উপত্যকারই সমালোচনা। ধর্মের সমালোচনা আনে মোহমুক্তি, আর সেই মোহমুক্তির ফলে বিচারশীল মানুষ চিন্তা করতে, কাজ করতে, নিজের বাস্তবতা গড়ে তুলতে পারে। মানুষ তখন হয়ে ওঠে নিজের নিজের সূর্য, স্বকীয় অক্ষপটে তার গতিবিধি। অপর দিকে ধর্ম হল সেই কপটসূর্য যা পূর্ণচেতনা থেকে বঞ্চিত মানুষের চারপাশে ততক্ষণ অবধি ঘোরে যতক্ষণ-না সেই মানুষ ঘোরে নিজেকে কেন্দ্র করে।’১৭

ফয়েরবাখের বিশ্লেষণ মাথায় রেখে মার্কস এই প্রবন্ধে দাবি করলেন, জার্মানিতে ধর্মের সমালোচনা মোটের উপর পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করেছে। এক্ষেত্রে ফয়েরবাখের কৃতিত্ব স্বীকার করবার পাশাপাশি তিনি ধর্মের এক সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দিলেন যা ফয়েরবাখের বক্তব্যে ছিল না। আর যখন তিনি বললেন, ধর্মের সমালোচনা মোটের উপর পূর্ণাঙ্গ, তখন বোঝা গেল এ প্রশ্নে বলবার মতো অবশিষ্ট আর বিশেষ কিছুই নেই। মার্কসের মনোযোগ তখন ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছে অন্য কোনও দিকে। ফয়েরবাখ ধর্মবিশ্বাসের কারণ হিসেবে যে বিচ্ছিন্নতার প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন মার্কস এরপর গভীরভাবে চিন্তামগ্ন হবেন সেই বিচ্ছিন্নতার ধারণাটি নিয়ে। বিচ্ছিন্নতার কারণ ও রকমফের নিয়ে গভীর ভাবনা তাঁকে নিয়ে যাবে প্যারিস পাণ্ডুলিপি রচনার দিকে।

১৮৪৪ সালে রচিত হলেও প্যারিস পাণ্ডুলিপি প্রথম প্রকাশিত হয় মার্কসের মৃত্যুর প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে। ইকনমিক অ্যান্ড ফিলজফিক্যাল ম্যানুস্ক্রিপ্টস্ নামের এই রচনায় মার্কস ফয়েরবাখের বিচ্ছিন্নতার ধারণাটিকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে সেটিকে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করেন। এই গ্রন্থে তিনি দেখান, মানুষের বিচ্ছিন্নতার মূল উৎসটি মানুষের ধর্মবোধ কিংবা তার মতাদর্শ বা দার্শনিক ভাবধারাতে নিহিত থাকে না, তা নিহিত থাকে সমাজের অর্থনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে। ফয়েরবাখ যে ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতার কথা বলেছিলেন, তাকে অতিক্রম করে মার্কস দেখান— সমাজে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতাবোধের মূল কারণ তার অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা। পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ ক্রমান্বয়ে তার শ্রমের থেকে, তারপর তার সৃষ্ট বস্তুর থেকে, তারপর অন্য ব্যক্তির থেকে, এবং সবশেষে নিজের প্রজাতিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই সমাজে শ্রমিক যত বেশি পরিমাণে তার শ্রমকে উৎপাদনে নিয়োজিত করে ততই তার বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পায়, ততই তার নিজের তৈরি করা বস্তুজগৎ তার বিরোধী হয়ে ওঠে, তখন তার নিজস্ব বলে আর কিছু থাকে না, ততই সে হয়ে ওঠে নিঃস্ব। মার্কস বলেন, বিষয়টি ঠিক ধর্মের মতো। যত বেশি করে মানুষ সব কিছু ঈশ্বরকে সঁপে দেয়, ততই সে নিজের জন্য কম রাখে। ততই সে হয়ে ওঠে নিঃস্ব, রিক্ত, সর্বস্বান্ত।১৮ মার্কস বিশ্লেষণ করে দেখালেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণাটি নয়, শ্রম-বিচ্ছিন্নতাই হল মৌলিক সামাজিক প্রক্রিয়া। আসলে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা হল শ্রম-বিচ্ছিন্নতারই পরিণাম, যদিও আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তা শ্রম-বিচ্ছিন্নতার কারণ।১৯ আর এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কস প্রতিতুলনায় টেনে আনলেন ধর্মবোধ ও ঈশ্বরকে, বললেন, ‘যেমন দেবতারা আসলে মানুষের মনের বিভ্রান্তির কারণ নয়, পরিণতি, যদিও পরে এই সম্পর্কটা উলটে যায়।’২০

এই রচনাতে মার্কস দেখান, যেহেতু বিচ্ছিন্নতার মূল কারণটি অর্থনৈতিক, তাই অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা থেকে সমাজকে মুক্ত করতে পারলে তার সব বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটবে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রকৃত বিলোপ কেন দরকার তা বুঝিয়ে মার্কস লিখলেন, ‘ধর্ম, পরিবার, রাষ্ট্র, আইন, নৈতিকতা, বিজ্ঞান, কলা, এসবই উৎপাদনের নির্দিষ্ট প্রকাশ এবং তার নিয়মের অন্তর্ভুক্ত। ব্যক্তিগত সম্পত্তির সুনিশ্চিত বিলোপ এবং মানবজীবনের উদ্ধার তাই সমস্ত বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটায়— ধর্ম, পরিবার, রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে এসে মানবসত্তায়, অর্থাৎ, সামাজিক সত্তায় প্রত্যাবর্তনের সূচনা করে। ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতা ঘটে কেবল মানুষের চেতনার গভীরে, কিন্তু অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ঘটে বাস্তব জীবনে এবং তার অবসান এই দু’টি দিকের কথাই বলে।’২১

ম্যাকলেলান মনে করেন, ১৮৪৫ সালে প্যারিস থেকে ব্রাসেলসে চলে আসার পর মার্কসের চিন্তায় এক বড় পরিবর্তন আসে এবং এই পর্বেই মার্কস তাঁর ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার তত্ত্বটি গড়ে তুলতে শুরু করেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই পর্বে মার্কসের রচনায় ধর্ম প্রসঙ্গে আলোচনা অনেকটা কমে আসে। আসলে ১৮৪৪ সালেই মার্কস উপলব্ধি করতে শুরু করেন, ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামটা তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ‘মানুষের প্রকৃত সুখের জন্য প্রয়োজন ধর্মের নামে অলীক সুখের অবসান। একটি অলীক অবস্থানকে বর্জন করার দাবি হল সেই অবস্থানকে বর্জন করার দাবি যার প্রয়োজন হয় অলীক ভাবনার। তাই ধর্মের সমালোচনা আসলে হল জাগতিক দুঃখকষ্টের সমালোচনা, ধর্মের আলো যাকে আড়াল করে রাখে।’২২ এই কারণে ধর্ম থেকে মার্কসের নজর সরে আসে ধর্মের নেপথ্যে ক্রিয়াশীল আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার দিকে। আর সেই কারণেই তিনি উপলব্ধি করেন, স্বর্গের সমালোচনা রূপান্তরিত হয় মর্তের সমালোচনায়, ধর্মের সমালোচনা রূপান্তরিত হয় আইনের সমালোচনায় এবং ধর্মতত্ত্বের সমালোচনা রূপান্তরিত হয় রাজনীতির সমালোচনায়।২৩ তাঁর এই উপলব্ধির ফল হল দ্বিবিধ। এক দিকে তিনি গভীরভাবে আগ্রহী হয়ে উঠলেন মানব অস্তিত্বের বস্তুগত ভিত্তির অনুসন্ধানে, অপর দিকে তাঁর লেখাপত্রে ধর্মসংক্রান্ত আলোচনা ক্রমশই কমে আসতে শুরু করল। এরপর থেকে তাঁর লেখাপত্রে মূল আলোচ্য বিষয় আর ধর্ম রইল না, মানবসমাজের বস্তুগত ভিত্তির আলোচনায় কথাপ্রসঙ্গে কখনও-সখনও উঠে এল ধর্মের প্রসঙ্গ।২৪

১৮৪৫ সালে রচিত ‘থিসিস অন ফয়েরবাখ’ প্রবন্ধে মার্কস ধর্মের প্রশ্নে ফয়েরবাখের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য আলোচনা করতে গিয়ে ষষ্ঠ থিসিসে বলেন, ধর্মীয় নির্যাসকে (essence) ফয়েরবাখ মানবীয় নির্যাসে পর্যবসিত করেছেন। কিন্তু মানবীয় নির্যাস প্রতিটি আলাদা আলাদা ব্যক্তিমানুষের মধ্যে নিহিত বিমূর্ত কোনও ধারণা নয়, বাস্তবে তা হল সামাজিক সম্পর্কসমূহের যোগফল। পরের থিসিসে মার্কস বললেন, আর ঠিক সেই কারণেই ফয়েরবাখ বুঝতে পারেন না যে, ধর্মীয় অনুভূতি নিজেই হল একটি সামাজিক নির্মাণ এবং যে বিমূর্ত ব্যক্তিটির বিশ্লেষণ তিনি করছেন সেও প্রকৃতপক্ষে কোনও একটি নির্দিষ্ট সমাজেরই অন্তর্ভুক্ত। এই পর্বে মার্কস আর বিচ্ছিন্নভাবে ধর্ম নিয়ে আগ্রহী নন, তিনি আগ্রহী সামগ্রিকভাবে এই সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে। আর এই আগ্রহের তাগিদেই তিনি উপনীত হলেন একাদশ থিসিসে, যেখানে তিনি সেই বিখ্যাত উক্তি করলেন: ‘এতদিন অবধি দার্শনিকরা কেবল নানাভাবে জগৎকে ব্যাখ্যাই করেছেন, কিন্তু আসল কথা হল সেটাকে পালটানো।’২৫

এই ‘থিসিস অন ফয়েরবাখ’-এর মূল বক্তব্যটি নব্য-হেগেলবাদী চিন্তাবিদদের ক্রিটিক হিসাবে আরও বিশদে আলোচিত হল দ্য জার্মান ইডিয়োলজি-র প্রথমাংশে। এটি ছিল এঙ্গেলসের সঙ্গে যৌথভাবে রচিত এবং পরবর্তীকালে যা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে— তার প্রথম আভাস। এই গ্রন্থে মার্কস ও এঙ্গেলস ধর্মের সঙ্গে সমাজের উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ, শ্রমবিভাজন ও শ্রেণিসংগ্রামের যোগসূত্র তুলে ধরলেন। নব্য-হেগেলপন্থীরা কোনও-না-কোনওভাবে ধর্মীয় ভাবনার বিবর্তনটির উপর জোর দিতেন। এঁদের বিরোধিতা করে মার্কস ও এঙ্গেলস বারে বারে দেখালেন, ধর্মের কোনো স্বাতন্ত্র্য নেই, তা ভাবাদর্শের একটি বিশেষ রূপ মাত্র। তাঁরা বললেন, খ্রিস্টান ধর্ম বিভিন্ন সময়ে যত ভিন্ন রূপই ধারণ করুক না কেন, তার কোনও স্বতন্ত্র ইতিহাস নেই। কারণ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের এই ভিন্নরূপের পেছনে কাজ করেছে সমাজের বস্তুগত কারণসমূহ, ধর্মবোধের বিকাশ নয়। পরবর্তীকালে ১৮৫৯ সালে যখন মার্কস ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যাকে আরও সুসংহত আকারে উপস্থাপিত করেন, তখন দ্য জার্মান ইডিয়োলজি-র এই বক্তব্যই আরও স্পষ্টভাষায় উচ্চারিত হয় সেখানে। তিনি বলেন, ‘উৎপাদনের অর্থনৈতিক স্থিতির বাস্তব রূপান্তর, যাকে নির্ধারণ করা যায় প্রকৃতিবিজ্ঞানের মতো নিখুঁতভাবে, এবং আইনি, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নান্দনিক কিংবা দার্শনিক,— এককথায় মতাদর্শগত বিভিন্ন আদল, যার মাধ্যমে মানুষ এই বিরোধ সম্পর্কে সচেতন হয়ে সংগ্রামে লিপ্ত হয়,— এই দুইয়ের মধ্যে সর্বদাই একটি পার্থক্য করা প্রয়োজন।’২৬ প্রাচীন গ্রিক-রোমান যুগে যেমন রাজনীতি প্রাধান্যকারী ভূমিকা পালন করেছে, তেমনই মধ্যযুগে ধর্ম— এই জাতীয় ধারণার ওপর ভিত্তি করে যখন বিভিন্ন যুগে ধর্মের কম-বেশি স্বাতন্ত্র্যের যুক্তি দেওয়া হল, তখন এই জাতীয় চিন্তার বিরোধিতা করে ক্যাপিটাল গ্রন্থে মার্কস লিখলেন, ‘মধ্যযুগ যেমন ক্যাথলিকতন্ত্রের ওপর টিকে থাকেনি, প্রাচীনকালের পৃথিবীও তেমনি টিকে থাকেনি রাজনীতিকে ভরসা করে। বরং তাদের জীবিকা অর্জনের ধারাই ব্যাখ্যা করে কেন একটি ক্ষেত্রে রাজনীতি, অপর ক্ষেত্রে ক্যাথলিকতন্ত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল।’২৭ এইভাবে পরিণত মার্কসের রচনায়, তাঁর ঐতিহাসিক বস্তুবাদী তত্ত্বে, তার স্বাতন্ত্র্য শুধু অস্বীকৃতই হল না, উপরিকাঠামোর অংশ হিসেবে ধর্ম হয়ে উঠল অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর নির্ভরশীল ভাবাদর্শের একটি বিশেষ রূপ মাত্র। দ্য জার্মান ইডিয়োলজি বা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-তে মার্কস ও এঙ্গেলস এক দিকে যেমন সমাজতন্ত্র ও ধর্মকে মেলাবার যাবতীয় চেষ্টার বিরোধিতা করলেন, তেমনই তাঁরা তীব্রভাবে আক্রমণ করেন— হাতে হাত ধরে চলা সামন্ততান্ত্রিক সমাজতন্ত্র ও খ্রিস্টান সমাজতন্ত্রকে। অবশ্য ইউজিন ড্যুরিং ভবিষ্যতের মুক্ত সমাজে ধর্মকে নিষিদ্ধ করার কথা বলায় এঙ্গেলস তাঁর অ্যান্টি ড্যুরিং গ্রন্থে এর বিরোধিতা করেন। এঙ্গেলস ধর্মকে নিষিদ্ধ করার পরিবর্তে ধর্মের স্বাভাবিক মৃত্যুর যে কথা বলেন, তাই খানিক স্বতন্ত্রভাবে আলোচিত হয় মার্কসের লেখায়। ধর্মের বিলুপ্তির প্রশ্নে এঙ্গেলস জোর দিয়েছিলেন বিজ্ঞানের বিকাশের ওপর, মনে করেছিলেন ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি ধর্মের অবসানকে সুনিশ্চিত করবে। অপর দিকে ধর্মের অবলুপ্তির প্রশ্নে সমান আশাবাদী মার্কসের রচনায় আবার জোর পড়েছিল অন্য একটি বিষয়ের ওপর। তাঁর বিশ্বাস ছিল, ভবিষ্যতে সাম্যবাদী কমিউনিস্ট সমাজের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম অবলুপ্ত হবে চিরতরে।২৮ তিনি মনে করেছিলেন, ধর্ম যে বিচ্ছিন্নতাবোধের প্রতিফলন, সেই বিচ্ছিন্নতাবোধের গভীরে রয়েছে বিচ্ছিন্ন শ্রমের ধারণাটি। সাম্যবাদী সমাজে এই জাতীয় শ্রমবিচ্ছিন্নতার অবসান হওয়াতে ধর্মেরও আর কোনো প্রয়োজন থাকবে না বলে মতপ্রকাশ করেন। ক্যাপিটাল-এর প্রথম খণ্ডে ধর্মের উৎপত্তি ও বিবর্তন আলোচনা করে মার্কস বলেন, ‘বস্তুজগতের ধর্মীয় প্রতিফলন তাই তখনই অপসৃত হতে পারে যখন দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব সম্পর্কগুলি প্রতিবেশী মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক এক যথার্থ বৌদ্ধিক ও যৌক্তিক চেহারায় মানুষের সামনে হাজির হয়। সমাজজীবনের প্রক্রিয়া, যার ভিত্তি হল বাস্তব উৎপাদনপ্রক্রিয়া, এই রহস্যের পরদাকে ছিন্ন করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাকে স্বাধীনভাবে সংঘবদ্ধ মানুষের হাতে তৈরি এবং নির্দিষ্ট পরিকল্পনাভিত্তিক একটি নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয়।’২৯

এ কথা অনস্বীকার্য যে, ধর্মের প্রশ্নে মার্কসের বক্তব্য অন্তত সমাজতত্ত্বের দিক থেকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সমাজ ও ধর্মকে বোঝার ক্ষেত্রে, বা আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম কীভাবে বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থ পূরণে ব্যবহৃত হয়— তা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান অবলম্বন নিঃসন্দেহে মার্কসীয় ব্যাখ্যা। কিন্তু এই অবদান সত্ত্বেও মার্কসীয় ব্যাখ্যার দুর্বলতার দিকগুলিকেও বোধহয় অস্বীকার করা যায় না। উনিশ শতকের মধ্যভাগে পশ্চিম ইউরোপের সুনির্দিষ্ট বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মার্কস প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের, তাও আবার মূলত খ্রিস্টধর্মের, যে ভূমিকা লক্ষ্য করলেন, বোধহয় সেটিকেই সামান্যীকরণ করলেন সর্ব যুগের, সর্ব সমাজের, সব ধর্মের মূল চরিত্র হিসেবে।৩০ শুধু তাই নয়, অতীতের ধর্ম ও তার বিবর্তন থেকে শুরু করে ধর্মের ভবিষ্যৎ অবলুপ্তি নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যায় অনেক সমালোচকই লক্ষ করলেন— এক দিকে পর্যাপ্ত তথ্য ও দৃষ্টান্তের অভাব, অন্য দিকে একপেশে ও ভাসা ভাসা যুক্তিবিন্যাস। খ্রিস্টধর্ম ব্যতীত আর একটিমাত্র ধর্ম যেটি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল সেটি হল হিন্দুধর্ম। কিন্তু হিন্দুদের বিশ্বাস সম্পর্কে তাঁর কর্কশ ও কঠোর সমালোচনার পেছনে অবশ্য অনেক সমালোচকই দেখতে পেলেন সঠিক তথ্যের অভাব ও তৎকালীন ইউরোপীয় সভ্যতার সাংস্কৃতিক ঔদ্ধত্য।৩১ হিন্দুধর্ম সম্পর্কিত আলোচনায় মার্কসের গোটা প্রকল্পটিই দাঁড়িয়েছিল এই অনুমানের ওপর যে, ভারতীয় ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্থাবর ও পরস্পরবিচ্ছিন্ন গ্রামীণ কৌম নিয়ে গড়ে ওঠা এশিয়াটিক উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর। যে আদিম গ্রামীণ কৌমগুলোর ওপর এতটা জোর দিয়ে মার্কস হিন্দুধর্মকে, এই জাতীয় সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে প্রতিষঙ্গ বজায় রাখাকে, ‘স্বাভাবিক ধর্ম’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন, সেই গ্রামীণ কৌমগুলি আদৌ মার্কসের ধারণা মতো অতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বা গতিহীন ছিল কি না— আজকের গবেষকরা সেই প্রশ্নও তুলছেন।৩২

জার্মান ইডিয়োলজি-র সময় থেকে ইতিহাসের যে বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিতে মার্কস উদ্যোগী হলেন, সেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদে ধর্মের স্বাতন্ত্র্য সম্পূর্ণভাবে অস্বীকৃত হল, ধর্ম বিবেচিত হল অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল উপরিকাঠামোর অংশ হিসেবে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদের অভিযোগ উঠল মার্কসবাদের বিরুদ্ধে, আর মার্কসবাদী ঐতিহ্যের মূলস্রোতে সর্বরোগহর বটিকা হিসেবে উত্তরোত্তর উঠে এল ব্যক্তিগত সম্পদের অবলুপ্তির ধারণাটি। ভবিষ্যতের সাম্যবাদী সমাজ নিয়ে মার্কস-এঙ্গেলসের ধারণাটি যথেষ্ট অস্পষ্ট হলেও মার্কসবাদের সরকারি ভাষ্যে ধরে নেওয়া হল যে, সেই স্বপ্নের সাম্যবাদী সমাজে নারীমুক্তি থেকে শুরু করে পরিবেশের উন্নয়ন— সবই ঘটে যাবে অর্থনৈতিক ভিত্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। আর ধর্ম যেহেতু ভ্রান্ত চৈতন্য সুতরাং সেটিও নিশ্চিতভাবে অবলুপ্ত হবে সাম্যবাদী সমাজে। রাজনীতি বা সংস্কৃতি নিয়ে মার্কসের কোনও কোনও মতামতকে যদি হ্রস্বায়নবাদী/সংকোচনবাদী (Reductionist) বলে মেনে নেওয়া হয়, তবে সমালোচকদের কারোর কারোর মতে— ধর্ম সংক্রান্ত তাঁর গোটা আলোচনাটাই নিশ্চিতভাবে এক ধরনের অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ বা সংকোচনবাদের উদাহরণ।৩৩ এক্ষেত্রে বোধহয় মনে রাখা উচিত অবভাসবাদের সেই সাধারণ সূত্রটি যা দেখায়— কোনও জ্ঞাতা কীভাবে জ্ঞানলাভ করবে তা নির্ভরশীল জ্ঞাতার নির্দিষ্ট মনোভাব ও নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার উপর, অর্থাৎ জ্ঞেয় ব্যাখ্যাত হয় ও পরস্পরের সাপেক্ষে পৃথক হয়ে যায় জ্ঞাতার অভিপ্রেত অনুযায়ী— এই বক্তব্যকে মাথায় রেখে বলা চলে, মার্কস যেহেতু সমাজের অর্থনৈতিক বন্দোবস্তের প্রতিফলন হিসেবেই ধর্মকে দেখতে চেয়েছেন তাই তাঁর আলোচনায় উঠে এসেছে ধর্মের একটি শ্রেণিগত ও ক্রিয়াগত (functional) ব্যাখ্যা। আমরা কখনোই বলতে পারি না যে সে ব্যাখ্যাটি ভুল বা মিথ্যা, তবে এটুকু মনে করাও বোধহয় অন্যায় নয় যে সেটি হল ধর্মের এক অসম্পূর্ণ ও খণ্ডিত ব্যাখ্যা মাত্র।

হয়তো দার্শনিক দিক থেকে এটি ছিল অনিবার্য। মার্কস ছিলেন ইউরোপীয় আলোকদীপ্তির সার্থক উত্তরাধিকারী। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বজগৎ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল আলোকদীপ্তির যুক্তিবাদ (Enlightenment Rationalism)। এই বিশেষ ধরনের যুক্তিবাদের জন্যই মার্কস ও তাঁর গোঁড়া অনুগামীরা যেকোনও যুক্তি-বহির্ভূত উপাদানের উপর গড়ে ওঠা বহসের (non-rational modes of discourse) জ্ঞানাত্মক (cognitive) গুরুত্বকে খাটো করে দেখেন। স্বাভাবিকভাবেই ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তি হিসেবে যে প্রত্যাদেশ (Revelation), মরম অনুভূতি বা স্বজ্ঞার কথা বলা হয় তা যুক্তিবাদীদের চোখে বিবেচিত হয় অযৌক্তিক, ও সেই কারণেই সেগুলি জ্ঞানের উৎস হিসেবে হয় অস্বীকৃত। সমালোচকদের কেউ কেউ মতপ্রকাশ করেন, এই কারণেই শিল্পকলা সংক্রান্ত বা ধর্মীয় বহসগুলির সদর্থক কার্যকারিতা উপলব্ধি করতে শুধু মার্কসবাদই নয়, সব ধরনের যুক্তিবাদী দৃষ্টিকোণগুলি অনেকাংশে অক্ষম হয়ে পড়ে।৩৪

মার্কসের এই দার্শনিক অবস্থানটিকে মাথায় রাখলে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রথম জীবনে খুব অল্প সময় বাদে কখনোই তিনি ধর্ম নিয়ে খুব গভীর ভাবনাচিন্তা করেননি কেন। ধর্ম থেকে প্রথমে তাঁর মনোযোগ সরে যায়— ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের বোঝাপড়া ও রাষ্ট্রের দ্বারা ধর্মের ব্যবহৃত হওয়ার বিষয়টির ওপর। তারপর তিনি বিচ্ছিন্নতার সাপেক্ষে বিচার করেন ধর্মকে। পরবর্তী জীবনে ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতার উৎস অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা— এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে মার্কস আগ্রহী হয়ে ওঠেন সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তির বিষয়ে। ফলত অন্যান্য বিষয়ে তাঁর রচনায় যে পরিমাণ গবেষণা ও পরিণত মানসিকতার প্রতিফলন ঘটে, সমালোচকেরা অনেকেই মনে করেন, অন্তত ধর্মের ক্ষেত্রে তা ঘটে না। ধর্ম সংক্রান্ত যাবতীয় আলোচনার প্রায় সবটাই যেহেতু মার্কস খ্রিস্টধর্মের প্রসঙ্গ তুলেই করেছেন, তাই ধর্মের প্রতি, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, খ্রিস্টধর্মের প্রতি, মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করতে গিয়ে এন. লবকোভিজ বলেন, ‘ধর্মের, বিশেষত খ্রিস্টধর্মের, শত্রু চিরকালই ছিল এবং প্রতিটি ধর্মই কোনও-না-কোনও সময়ে সমালোচিত, আক্রান্ত বা নিপীড়িত হয়েছে। তবে মার্কসের মতো এতটা চরম “গুরুত্বহীন”ভাবে খ্রিস্টধর্মকে বোধহয় খুব কমই দেখা হয়েছে।’৩৫

ধর্ম প্রসঙ্গে মার্কসীয় চিন্তার এই দুর্বলতার দিকটি স্বীকার করে নেন ডেভিড ম্যাকলেলান-এর মতো মার্কস বিশেষজ্ঞও। একটু অতিসরলীকৃত শোনালেও, অন্তত ধর্মের প্রশ্নে মার্কসের ঘরানার সঙ্গে ভেবার ও দুর্খাইম-এর ঘরানার তুলনা করে তিনি বলেন, ‘প্রায়শই ভেবার এবং দুর্খাইমের পাশাপাশি মার্কসকে সমাজতত্ত্বের তিন প্রতিষ্ঠাতার একজন মনে করা হয়। ধর্মকে বোঝার ক্ষেত্রে, ভেবারীয় বা দুর্খাইমীয় ঘরানার তুলনায়, মার্কসবাদীদের অবদান সাধারণভাবে খুবই দুর্বল। সবসময় এটা যে আগ্রহের অভাব, তা নয়— ঘটনা এটাই যে অনেক মার্কসবাদীই ধর্মকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে পারেননি। মার্কস নিজেও ধর্মের আলোচনায় খুব কম সময়ই দিয়েছিলেন— ধর্ম প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত মতামতগুলি মোটামুটি যে ফয়েরবাখেরই পুনরাবৃত্তি— এ কথা তিনি নিজেই বলেছেন।’৩৬

ধর্মের বোধহয় কোনো সহজ ও সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। ধর্মের মতো জটিল ও বৈচিত্রময় বিষয়কে একটিমাত্র পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচার করলে সেই বিশ্লেষণ খানিকটা একপেশে ও যান্ত্রিক হয়ে উঠতে বাধ্য। ধর্মের অর্থগত ব্যঞ্জনার দিকটি এতই বিস্তৃত যে ঈশ্বর বা অতীন্দ্রিয় জগতের অস্তিত্বে বিশ্বাসের মতো প্রাথমিক বিষয়কেও অনিবার্যভাবে ধর্মের মৌলিক ও ন্যূনতম ভিত্তি বলে গ্রহণ করা যায় না।৩৭ এমন ধর্মের সন্ধান পাওয়া যায় যে-ধর্ম ঈশ্বর ও অতীন্দ্রিয় জগতের বিষয়ে যথেষ্ট উদাসীন। অর্থাৎ, ধর্মের ধারণাটি বেশ গোলমেলে, আর সেই কারণেই ধর্মের ধারণাটিকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করে কার্ল পপার থেকে শুরু করে এন. বারদিয়েভ, প্যারেটো থেকে শুরু করে জোসেফ শুম্পিটার— অনেকেই খোদ মার্কসীয় চিন্তার মধ্যেই ধর্মীয় প্রভাব লক্ষ্য করেছেন, কেউ কেউ তো আবার আরও এক কদম এগিয়ে, মার্কসবাদকেই এক ধরনের ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।৩৮ রবার্ট টাকার-এর মতো অধ্যাপক তো আবার যুক্তির জাল বিছিয়ে সেন্ট অগাস্টিন পরবর্তী খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে মার্কসবাদের চার দফা সাযুজ্যও খুঁজে বার করেছেন।৩৯ মূলস্রোত মার্কসবাদের মতো ঘোষিতভাবে ধর্ম-বিরোধী ঐতিহ্যের মধ্যেও এঁরা ধর্মের উপাদান খুঁজে পেয়েছেন, কারণ এঁরা ধর্মকে দেখেছেন ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে এবং ব্যাপকতর অর্থে। মার্কসবাদ আদৌ এক ধরনের ধর্ম কি না— এ বিতর্কে আমরা ঢুকব না। কারণ আমাদের প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট, তা হল— ধর্ম বিষয়ে মার্কসের চিন্তা ও আজকের দিনে তার প্রাসঙ্গিকতা বিচার করা। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আমরা বিষয়টির উল্লেখ করলাম কেবলমাত্র এটা মাথায় রাখার জন্য যে, ধর্মের ধারণাটি এতই ব্যাপক ও বিতর্কিত যে ভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে ভিন্ন যুক্তির সাপেক্ষে ধারণাটিকে ব্যাখ্যা করলে মার্কসবাদকেও এর অন্তর্ভুক্ত করা যায় বলে কোনও কোনও তাত্ত্বিক মত প্রকাশ করেন।

মূলস্রোত মার্কসীয় ঐতিহ্যে মনে করা হয়েছিল ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম অবলুপ্ত হবে। মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের যৌবনে আলোকদীপ্তির প্রভাবের বিষয়ে অতি আশাবাদী ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন, সমাজতন্ত্র আসার ঢের আগে, পুঁজিবাদী সমাজেই শিল্পায়ন এমন পরিবর্তন আনবে যেখানে মানুষকে আর ধর্মীয় ভ্রান্তির দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে থাকতে হবে না। জার্মান ইডিয়োলজি-তে তাঁরা আশা ব্যক্ত করেন, সকল সম্পর্কের বাণিজ্যিকীকরণ করবার মধ্যে দিয়ে শিল্পায়ন ধর্ম ও নৈতিকতাকে নিশ্চিহ্ন করবে, অথবা সেগুলিকে সর্বৈব মিথ্যা হিসেবে প্রতিপন্ন করবে। তাঁরা আশা করেন, এই লক্ষ্যে অনেকটাই অগ্রসর হওয়া যাবে আগামী শ-দেড়েক বছরের মধ্যেই। অতএব, ধর্ম যে বিলুপ্ত হবে— এ বিষয়ে তাঁরা ছিলেন স্থির নিশ্চিত।৪০ কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি ঘটল ঠিক উলটো। ধর্ম বিলুপ্ত তো হলই না, বরং সারা পৃথিবীব্যাপী এক দিকে বেড়ে চলল ধর্মের ইতিবাচক সক্রিয়তা, অন্য দিকে বেড়ে চলল ধর্মীয় উন্মাদনা ও অসহিষ্ণুতা।৪১ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলিতে আপাতদৃষ্টিতে ধর্মীয় প্রভাব কমে এসেছে বলে মনে হলেও পরবর্তীকালে দেখা গেল সেইসব দেশে ধর্ম মোটেই অবলুপ্ত হয়নি, বরং অবলুপ্ত হয়েছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। বর্তমানের এই জগৎজোড়া ধর্মীয় আবহে ধর্মকে আর অবহেলা, উপেক্ষা বা উপহাস করে প্রকৃত বাস্তবতাকে আদৌ প্রভাবিত করা যাবে বলে মনে হয় না। ধর্মকে ‘আফিম’ বলে কেবল সমালোচনা না করে বোধহয় দরকার ধর্ম নিয়ে নতুন করে ভাবা, গভীরভাবে ভাবা, দরকার ধর্মের সঙ্গে কথোপকথন।৪২

এই বাস্তবতা ছাড়া অন্য একটি তাগিদ থেকেও বোধহয় ধর্ম নিয়ে নতুন করে ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। বিষয়টি মার্কসীয় ভাবনার একটি অসম্পূর্ণতার সঙ্গে জড়িত। সমাজবিজ্ঞানী অশোক সেনের এক প্রবন্ধ৪৩ নিয়ে আলোচনার সূত্রে অনুরাধা রায় তাঁর সাম্প্রতিক এক গ্রন্থে বড় সু্ন্দরভাবে ও সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থিত করেছেন গোটা বিষয়টি। অশোক সেনের বিশ্লেষণটিকে মাথায় রেখে অনুরাধা রায় লিখেছেন, দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মার্কস প্রশ্ন তুলেছিলেন, কিন্তু তেমনভাবে ভাবনাচিন্তা করে উঠতে পারেননি। এই দু’টির মধ্যে একটি বিষয় ছিল মানবপ্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত— সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সম্ভব করতে হলে মানবচরিত্র পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। বারে বারে মার্কস ইঙ্গিত দিয়েছেন— সমাজতন্ত্র তৈরির পথে অনেক বাধা, সেসব মোকাবিলার জন্য মানুষের মানসিক গড়নে পরিবর্তন আনতে হবে। প্যারিস পাণ্ডুলিপি-তে তিনি স্থূল কমিউনিজ়মকে আলাদা করেন সত্যিকারের কমিউনিস্ট কাজকর্ম থেকে, এবং বলেন যে দ্বিতীয়টির জন্য লোভ, হিংসা, স্বার্থপরতা, ব্যক্তিসম্পত্তিকেন্দ্রিক মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে। জার্মান ইডিয়োলজি-তেও মার্কস বলেছিলেন— খুব বড় হারে মানুষ বদলাতে হবে। অবশ্য বিপ্লব এলেই সেটা সম্ভব এমন বিশ্বাসও ব্যক্ত করেছিলেন মার্কস। ফলে বিপ্লব কীভাবে আনা যায় সে ব্যাপারেই মনোযোগ দিলেন তিনি, নৈতিকতার প্রশ্নটা চাপা পড়ে গেল চিরতরের জন্য। মার্কস মানুষের অন্তঃস্থ নৈতিকতায় বিশ্বাস করতেন, কিন্তু এও জানতেন যে তার বিকাশ দরকার। বিকাশের প্রক্রিয়া নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ তিনি পাননি।৪৪

পরবর্তীকালে এঙ্গেলস ও দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের হাতে পড়ে মার্কসবাদ যতই ‘বিজ্ঞান’ হয়ে উঠতে থাকে ততই ‘বিষয়ীর নির্মাণ’-এর মতো বিষয়গুলি সমালোচিত হতে থাকে ভাববাদী প্রবণতা হিসেবে। ক্ষমতাসীন মার্কসবাদী বহসের দাপটে প্রান্তিক হয়ে পড়ে মার্কসীয় ঐতিহ্যের মধ্যেকার ভিন্ন স্বরগুলি। ফলস্বরূপ যা হবার তা-ই হয়। তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক সমাজে ফলিত মার্কসবাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় হার্বাট মারকিউস-এর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘সমাজতন্ত্রকে যদি নতুন ধাঁচের মানুষ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা না যায়, তাহলে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের অর্থ দাঁড়াবে এক ধরনের কর্তৃত্বের বদলে আর এক ধরনের কর্তৃত্বের বদল মাত্র।’৪৫ নৈতিকতার প্রশ্নটা, নতুন মানুষ গড়ার প্রশ্নটা মার্কসবাদে যে পরিমাণে উপেক্ষিত থেকে যায় মার্কসবাদও সেই পরিমাণেই সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বের একটি অসম্পূর্ণতাকে সূচিত করতে থাকে। এই কারণেই ধর্ম প্রসঙ্গে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করতে গিয়ে রোনাল্ড এন. স্ট্রমবার্গ টেনে আনেন আধ্যাত্মিকতার প্রশ্নটি; মারকিউস-এর বক্তব্যকেই সম্প্রসারিত করে তিনি দ্বিধাহীন ভাষায় বলেন, ‘অর্থাৎ, এক ধরনের আধ্যাত্মিক বিপ্লবের প্রয়োজন আছে’।৪৬ মার্কসীয় ঐতিহ্যে আধ্যাত্মিকতার ধারণাটি কেন উপেক্ষিত রয়ে গেল তার একটা সম্ভাব্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায় এরিক ফ্রম-এর বক্তব্যে। মার্কসেস কনসেপ্ট অফ ম্যান গ্রন্থের ‘দ্য ফলসিফিকেশন অফ মার্কসেস কনসেপ্টস’ অধ্যায়ে মার্কসের ধারণামৌলগুলিকে কীভাবে বিকৃত ও অপব্যাখ্যা করা হয়েছে তা আলোচনা করতে গিয়ে ফ্রম বলেন, ‘ধর্ম প্রসঙ্গে মার্কসের সমালোচনা সমস্ত রকমের অধি-জাগতিক মূল্যবোধের অস্বীকৃতি— এমনটাই ভাবা হল এবং যাঁরা অনুমান করে নিয়েছিলেন যে, আধ্যাত্মিক মানসিকতার জন্য ঈশ্বরবিশ্বাস হল পূর্ব শর্ত, তাঁদের মনে আরও জোরদার হল এই ভাবনা।’৪৭

এই পরিপ্রেক্ষিতে যদি আমরা ধর্মকে একটু খোলা মনে বিচার করি তবে আমরা দেখব ধর্মের দু’টি প্রধান দিক রয়েছে। একটি তার আচার-অনুষ্ঠানের দিক, যেদিক দিয়ে প্রতিটি ধর্ম অন্য ধর্মের থেকে পৃথক হয়ে পড়ে। অন্যটি ধর্মের নৈতিক প্রত্যয়ের দিক। যদি আমরা বিভিন্ন ধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থগুলো খুঁটিয়ে দেখি তবে দেখব সব ধর্মই সেবা, করুণা, ত্যাগ, অহিংসা, ভালোবাসা— এই জাতীয় কতগুলি মহান নীতি প্রচার করে, কতগুলি শাশ্বত মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে চায়। হয়তো এই জাতীয় নীতির মধ্যে অনেকসময় বেশ কিছু স্ববিরোধিতা থাকে, হয়তো নীতি প্রচারের গল্পকথায় বা কৌশলে থাকে বেশ কিছু রক্ষণশীল উপাদানও, কিন্তু কোটি কোটি ধর্মবিশ্বাসী মানুষের জীবনে এইসব ধর্মীয় নির্দেশের প্রভাব যে বহুপ্রসারী— তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না। তাই ধর্মকে নিদারুণ উপেক্ষা বা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান না করে বোধহয় উচিত ধর্মবোধের যেদিকটা নীতিবোধের সঙ্গে জড়িত সেই দিকটার দিকে নজর দেওয়া। মার্কসবাদের ‘নতুন মানুষ’ গড়ার কাজে সাহায্য করতে পারে ধর্মও। তাই প্রয়োজন ধর্ম নিয়ে নতুন করে ভাবা, গভীরভাবে ভাবা, ধর্মের সঙ্গে খোলামনে কথোপকথন। আর এ কাজটা যত দ্রুত করা সম্ভব ততই বোধহয় মঙ্গল, কারণ এটি করে উঠতে না পারলে কী ভবিতব্য অপেক্ষা করছে— তার একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন ডেভিড ম্যাকলেলান। যথার্থভাবেই তিনি বলেছেন, ‘মানুষের ক্রিয়াকলাপের কোনও-না-কোনও দিকের সঙ্গে ধর্ম গভীর ও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে— এবং এটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে যে অদূর ভবিষ্যতেও এই পরিস্থিতি বহাল থাকবে। বামপন্থীরা যদি একে নিষ্ক্রিয় উপেক্ষা কিংবা সরাসরি বর্জনের কথা ভাবেন, তাহলে দক্ষিণপন্থী মতাদর্শগুলি ধর্মের এই বিপুল শক্তির দখল নেবে।’৪৮ সতর্কবার্তাটি সারা পৃথিবীব্যাপী প্রযোজ্য। কিন্তু আজকের ভারতবর্ষে এটা বোধহয় আরও একটু বেশি প্রাসঙ্গিক, আরও একটু বেশি বাস্তব।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

১. উৎসাহী পাঠক দেখতে পারেন: Andrew M. Mckinnon, ‘Opium as Dialectics of Religion : Metaphor, Expression and Protest’, Critical Sociology, Vol. 31, No 1/2, 2005, pp. 15-38.

২. Karl Marx and Friedrich Engels, On Religion (Progress Publishers : Moscow, 1957).

৩. Marx and Engels, On Religion, p. 8.

৪. Trevor Ling, Karl Marx and Religion (The Macmillan Press : London & Basingstoke, 1980), p. 8.

৫. David Mclellan, Marxism and Religion (The Macmillan Press : Basingstoke & London), 1987), pp. 19-26.

৬. Mclellan, Marxism and Religion, pp. 7-8.

৭. Ling, Karl Marx and Religion, p. 5.

৮. Ling, Karl Marx and Religion, p. 6.

৯. Ling, Karl Marx and Religion, p. 6.

১০. Marx and Engels, On Religion, pp. 13-14.

১১. Marx and Engels, On Religion, pp. 15-36.

১২. Mclellan, Marxism and Religion, p. 10.

১৩. Ling, Karl Marx and Religion, p. 8.

১৪. Leszek Kolakowski, Main Currents of Marxism, Vol 1 : The Founders (W. W. Norton & Company: New York, 2008), p. 97.

১৫. শোভনলাল দত্তগুপ্ত ও উৎপল ঘোষ, মার্কসীয় সমাজতত্ত্ব (পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ : কলিকাতা, ২০০০), পৃ. ১৯৪।

১৬. Mclellan, Marxism and Religion, pp. 10-12.

১৭. Marx and Engels, On Religion, pp. 37-38.

১৮. Mclellan, Marxism and Religion, p. 16.

১৯. বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখা যেতে পারে: T. I. Oizerman, The Making of the Marxist Philosophy (Progress Publishers : Moscow, 1981), pp. 224-238.

২০. Mclellan, Marxism and Religion, p. 16.

২১. Mclellan, Marxism and Religion, p. 18.

২২. Marx and Engels, On Religion, p. 38.

২৩. Marx and Engels, On Religion, p. 38.

২৪. Ling, Karl Marx and Religion, p. 17.

২৫. Marx and Engels, On Religion, p. 64.

২৬. Mclellan, Marxism and Religion, pp. 19-20.

২৭. Mclellan, Marxism and Religion, p. 20.

২৮. ধর্মের বিলুপ্তির প্রশ্নে উভয়ের মতের সমান্য ফারাকের জন্য দেখা যেতে পারে: N. Lobkowicz, ‘Karl Marx’s Attitude Towards Religion’, The Review of Politics, vol. 26, no. 3, July 1964, pp. 325-27. https://www.jstor.org/stable/1405231 Accessed: 24:08:2018, 17:36

২৯. Karl Marx, Capital, vol. I (Progress Publishers : Moscow, 1968), p. 84.

৩০. Mclellan, Marxism and Religion, p. 170.

৩১. Mclellan, Marxism and Religion pp. 29-30.

৩২. Ling, Karl Marx and Religion, pp. 68-80.

৩৩. Mclellan, Marxism and Religion, p. 32.

৩৪. Mclellan, Marxism and Religion, p. 170.

৩৫. Lobkowicz, ‘Karl Marx’s Attitude Towards Religion’, p. 324.

৩৬. Mclellan, Marxism and Religion, pp. 2-3.

৩৭. উৎসাহী পাঠক দেখতে পারেন: Jitendra Nath Mohanty, ‘The Structure of the Religious World’ in The Self and its Other: Philosophical Essays (Oxford University Press : New Delhi, 2000).

৩৮. Mclellan, Marxism and Religion, pp. 157-58.

৩৯. Robert Tucker, Philosophy and Myth in Karl Marx, 2nd Edition (Cambridge University Press : London, 1972), pp. 21-27.

৪০. Tom Bottomore (ed.), A Dictionary of Marxist Thought, Indian edition (Maya Blackwell Worldview : New Delhi, 2000), p. 466.

৪১. Mclellan, Marxism and Religion, pp. 168-170.

৪২. এই জাতীয় কথোপকথনের প্রয়োজনীয়তা ও প্রচেষ্টা বুঝতে উৎসাহী পাঠক দেখতে পারেন: Mclellan, Marxism and Religion; Maxime Rodinson, Marxism and the Muslim World (Orient Longman : New Delhi, 1980), Rethinking Marxism, Special Issue: ‘Marxism and Spirituality’, vol. 28, issue 3-4, 2016.

৪৩. Ashok Sen, ‘The Incomplete Marx’ in Amiya Dev (ed.), History of Science, Philosophy and Culture in Indian Civilization, Vol. XV, Part 3, Science, Literature and Aesthetics (Centre for Studies in Civilization: Delhi, 2009).

৪৪. অনুরাধা রায়, মার্কসবাদ ও তার্কিক বাঙালি (সূত্রধর : কলকাতা, ২০১১), পৃ. ৪৬-৪৭।

৪৫. Herbert Marcuse, ‘Marxism and the New Humanity’, cited in Ronald N. Stromberg, ‘Marxism & Religion’, Studies in Soviet Thought, vol. 19, no. 3, April 1979, p. 214.

৪৬. Stromberg, ‘Marxism & Religion’, p. 214.

৪৭. Erich Fromm, Marx’s Concept of Man, Indian Edition (Continuum : Chennai, 2005).

৪৮. Mclellan, Marxism and Religion, p. 5.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *