ধর্ম্মপরায়ণতা
ফরাসি দেশে এক বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহার বাটীর সন্নিকটে এক বৃদ্ধা বিধবা বাস করিত। অতিশয় দরিদ্রা, তাহার কতকগুলি অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান ছিল। বৃদ্ধা অতি কষ্টে তাহাদের লালন পালন করিত। সচ্চরিত্রা ও ধর্ম্মপরায়ণা বলিয়া, সে আপন প্রতিবেশী এক সম্পন্ন ব্যক্তির বিলক্ষণ স্নেহপাত্র ও সম্পূর্ণ বিশ্বাসভাজন ছিল।
১৭৯২ খৃষ্টাব্দে, এক দিবস, তিনি সেই বৃদ্ধাকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, দেখ, আমি, কোনও কার্য্যের অনুরোধে, কিছু দিনের জন্য, স্থানান্তরে যাইতেছি, ত্বরায় আমার প্রত্যাগমনের সম্ভাবনা নাই, আমার যে কিছু সম্পত্তি আছে, তোমার হস্তে ন্যস্ত করিয়া যাইতেছি, যদি প্রত্যাগমনের পূর্ব্বে আমার মৃত্যু হয়, এবং আমার পুত্র কন্যা না থাকে, তাহা হইলে, তুমি আমার এই সমস্ত সম্পত্তির অধিকারিণী হইবে, আর, যদি তৎপূর্বে অর্থের অভাব জন্য তোমার দুরবস্থা ঘটে, তাহা হইলে, এই সম্পত্তির কিয়ৎ অংশ লইয়া, ব্যয় করিতে পারিবে। এই বলিয়া, আপন সমস্ত সম্পত্তি বৃদ্ধার হস্তে সমর্পণ করিয়া, তিনি প্রস্থান করিলেন।
বৃদ্ধা প্রতিদিন পরিশ্রম করিয়া যাহা উপার্জ্জন করিত, তদ্দ্বারা কোনও রূপে নিজের ও সন্তানগুলির ভরণপোষণের ব্যয় নির্ব্বাহ হইত। সেই সম্পন্ন ব্যক্তির প্রস্থানের কিছু দিন পরেই, সে অতিশয় পীড়িত হইল, সুতরাং প্রতিদিন পরিশ্রম করিয়া যে কিছু উপার্জ্জন করিত, তাহা রহিত হইল, এজন্য তাহার ও সন্তানগুলির কষ্টের পরিসীমা রহিল না। সম্পন্ন ব্যক্তির যেরূপ অনুমতি ছিল, তদনুসারে সে, এমন অবস্থায়, তাঁহার সম্পত্তিব কিয়ৎ অংশ লইয়া, কষ্ট দূর করিতে পারিত। কিন্তু, যেমন অবস্থা ঘটিলে, তাঁহার অনুমতিক্রমে, তদীয় সম্পত্তির কিয়ৎ অংশ লইতে পারি, অদ্যাপি আমার সে অবস্থা ঘটে নাই, এই ভাবিয়া, সে তাহাতে হস্তক্ষেপ করিল না।
কিয়ৎ কাল পরে সেই স্ত্রীলোক ঐ সম্পন্ন ব্যক্তির অবধারিত মৃত্যুসংবাদ পাইল। কিন্তু, তিনি নিঃসন্তান মরিয়াছেন, অথবা তাঁহার সন্তান আছে তাহার কিছুমাত্র জানিতে পারিল না। এজন্য তখনও সে তাঁহার সম্পত্তিতে হস্তাৰ্পণ করিল না। ক্রমে চারি বৎসর অতীত হইল, তথাপি সে ঐ সম্পত্তি স্পর্শ করিল না। সে মনে মনে এই বিবেচনা করিতে লাগিল, যদিও তাঁহার সন্তান না থাকে, অন্য কোনও উত্তরাধিকারী থাকা অসম্ভব নহে, যদি উত্তরাধিকারীও না থাকে, তাহার কেহ উত্তমর্ণও থাকিতে পারে। আমি তাঁহার সম্পত্তি গ্রহণ করিব, আর তাঁহার উত্তরাধিকারী বা উত্তমর্ণেরা বঞ্চিত হইবেন, ইহা কোনও ক্রমে ন্যায়ানুগত নহে।
ক্রমে ক্রমে রোগ ও কষ্ট ভোগ করিয়া বৃদ্ধার শরীর অবসন্ন হইয়া আসিতে লাগিল, তথাপি সে সেই সম্পত্তি আত্মসাৎ করা কিংবা সেই সম্পত্তির কিয়ৎ অংশ লওয়া উচিত বিবেচনা করিল না, কিন্তু, পাছে ন্যস্ত সম্পত্তি যথার্থ অধিকারীর হস্তে অর্পণ না করিয়া মরিয়া যাই, এ দুর্ভাবনায় অস্থির ও অসুখী হইতে লাগিল এবং এ বিষয়ে সবিশেষ অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিল।
অবশেষে বৃদ্ধা শুনিতে পাইল, ঐ সম্পত্তির অধিকারী প্রুশিয়াদেশে বিবাহ করিয়াছিলেন এবং পত্নী ও কতিপয় শিশু সন্তান রাখিয়া গিয়াছেন। তখন বৃদ্ধার আহ্লাদের সীমা রহিল না। সে অবিলম্বে তাঁহার পত্নীর নিকট এই সংবাদ পাঠাইল যে, আপনার স্বামী আমার নিকট প্রচুর অর্থ রাখিয়া গিয়াছেন, আপনি সত্বর আসিয়া লইয়া যাইবেন। তদনুসারে, তিনি বৃদ্ধার ভবনে উপস্থিত হইলে, সে সমস্ত সম্পত্তি তদীয় হস্তে অর্পণ করিয়া কহিল, আজ আমি নিশ্চিন্ত হইলাম, আমার সকল দুর্ভাবনা দূর হইল। বোধ হয়, আমি অধিক দিন বাঁচিব না, আব কিছু দিন, আমি আপনাদের সংবাদ না পাইলে, আপনারা এই সম্পত্তিতে বঞ্চিত হইতেন।
এই বলিয়া, বৃদ্ধা, যেরূপে ঐ সম্পত্তি তাহার হস্তে ন্যস্ত হইয়াছিল, সবিশেষ সমস্ত বর্ণন করিল। ধনস্বামীর পত্নী, অসম্ভাবিত রূপে প্রভূত সম্পত্তি লাভ করিয়া, যত আহ্লাদিত হইয়াছিলেন, সেই বৃদ্ধা দরিদ্রার বাক্য শ্রবণে ও ব্যবহার দর্শনে, তদপেক্ষা সহস্র গুণে অধিক আহ্লাদিত হইলেন। ফলতঃ, তিনি, তাহার ঈদৃশ অসাধারণ ন্যায়পরতা ও ধর্ম্মপরায়ণতা দর্শনে, অত্যন্ত চমৎকৃত হইয়া, আন্তরিক ভক্তি সহকারে ভূরি ভূরি ধন্যবাদ দিতে লাগিলেন, এবং মনে মনে বিবেচনা করিলেন, এই স্ত্রীলোক যেরূপ সাধু, ইহার তদনুরূপ পুরস্কার করা উচিত, না করিলে, আমি নিঃসন্দেহ অধর্ম্মগ্রস্ত হইব।
এই স্থির করিয়া তিনি সেই বৃদ্ধাকে কহিলেন, অয়ি ধর্ম্মশীলে। তুমি আমাদের যে মহোপকার করিলে, কিয়ৎ অংশে আমায় তাহার পরিশোধ করিতে দাও। বলিয়া, তিনি তাহাকে বহু সহস্র মুদ্রা দিতে উদ্যত হইলেন। তখন বৃদ্ধা কহিলেন, অর্থের লোভ থাকিলে, আমি আপনার সর্ব্বস্বই লইতে পারিতাম, আপনার স্বামী আমায় যথেষ্ট স্নেহ ও অনুগ্রহ করিতেন, আমি যে তাঁহার ন্যস্ত সম্পত্তি যথার্থ উত্তরাধিকারীর হস্তে অৰ্পণ করিতে পারিলাম, তাহাতেই আমি চরিতার্থ হইয়াছি, আমার অপর পুরস্কারের প্রয়োজন নাই, আপনি যদি আমার উপর তাঁহার ন্যায় স্নেহদৃষ্টি রাখেন, তাহাই আমি প্রভূত পুরস্কার জ্ঞান করিব।