ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

ধর্মের আলো

ধর্মের আলো

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বিংশ শতাব্দীর চারের দশক পর্যন্ত যে সময়, সেই সময়কালে আমরা আমাদের আদর্শের অভ্যুত্থান দেখেছি। মানুষ দেখেছি, বড় বড় মানুষ। দেখেছি চিন্তাবিদ। কালটিকে জাগরণের কাল বলতে পারি। মহাপ্রভু সংক্ষিপ্ত জীবনে যে আলোড়ন তুলে দিয়েছিলেন, সেটি মন্থর হতে হতে একটি ধর্ম, একটি বিশেষ গোষ্ঠীতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছিল। চর্চার চেয়ে আচার, মুক্তির চেয়ে, সংস্কার, স্বাধীনতার চেয়ে প্রথাই বড় হল, যেমনটি হয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষেত্রে। আশ্রমভিক্তিক গুরুবাদ, আমার ধর্মই একমাত্র ধর্ম, এইরকম একটা সংকীর্ণতা আচরিত হত। শাক্ত শৈব, বৈষ্ণবে ঘোরতর লাঠালাঠি। ধর্ম রইল, মানুষ পড়ল ঘুমিয়ে।

ইসলাম সংস্কৃতি শাসন ও ধর্ম হিন্দুধর্মকে গ্রাস করতে পারেনি। যেমন বুদ্ধদেবের নিরীশ্বরবাদ, জগৎ পলায়নী মন্ত্র ধাক্কা খেল শংকরের অদ্বৈত বেদান্তে। স্বতন্ত্র একটা ধর্ম হতে গিয়েও বেদান্তে নিমজ্জিত হয়ে স্বাতন্ত্র্য হারাতে বাধ্য হল। শুধু তাই নয়, শংকর শূন্যবাদ, মায়াবাদকে, নিরাকার ব্রহ্মকে স্বীকার করেও সাকারকে মেনে নিলেন আমজনতার সাধন সুবিধার জন্য। এমনকী গুরুবাদকে ধর্মে স্থান দিলেন।

‘শরীরং সুরূপং তথা বাকলত্রং,

যশশ্চারু চিত্রং ধনং মেরুতুল্যম।

গুরোরঙ্ঘ্রি পদ্মে মনশ্চেম্ন লগ্ন,

তত: কিং তত: কিং তত: কিং তত: কিম।।

জীবের অন্ত:স্থলে সরাসরি আঘাত। বুঝে নাও নিত্য ও অনিত্যের পার্থক্য। ভুমি ও ভূমার পার্থক্য। প্রথম দুটি ছত্রে বৌদ্ধ দর্শন, সুরূপ দেহ, তদনুরূপ রূপবতী ভার্ষা, তোমার নির্মল অদ্ভুত যশ, মেরুতুল্য ধন, তোমার সবই আছে, কিন্তু বৎস! এ সবই তো অনিত্য। এইসব আছে, থাক, তুমি গুরুর কাছে যাও। ‘গু’ হল ধর্ম গুহ্যতত্ব, ‘রু’ যিনি দান করেন। ধর্ম যিনি দান করেন তিনিই গুরু। সেই গুরুদেবের চরণকমলে চিত্ত সংলগ্নই যদি না হয়, তবে ওইসবে কী ফল, কী ফল, কী ফল?

শংকর নির্গুণ, নিরাকার, সাধারণের দুরধিগম্য ব্রহ্মধারণার পাশাপাশি সগুণ সাকারকে প্রতিষ্ঠিত করে ধর্মের সাধারণী করলেন। এক ধরনের প্রাোলেটারাইজেসান।’ এমনকী গোবিন্দ বন্দনাও করলেন, জ্ঞানের পাশে ভক্তির প্রতিষ্ঠা :

গোবিন্দং গোকুলানন্দং গোপালং গোপীবল্লভম।
গোবর্দ্ধনধরং ধীরং তং বন্দে গোমতীপ্রিয়ম।

গীতায় শ্রীভগবান যে পথ দেখালেন, কর্মের পথ ধরে ভক্তিতে, ভক্তি খুলে দেবে জ্ঞানের সিংহদুয়ার। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ ও জননী সারদা—এই ত্রয়ী, এই ট্রিনিটি আসবেন বেশ কিছু পরে। তার আগে আসবেন মহাপ্রভু। ভারতভূমের আদি সোসালিস্ট। ধর্মের কারামুক্তি ঘটবে। জাতপাতের কুসংস্কার ঘুচে যাবে। তিনিই বলবেন, ভক্তের আবার জাত কী? ভক্তের জাত ভক্ত। হরি ভক্তি হলে চণ্ডালও দ্বিজশ্রেষ্ঠ। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ বহু পরে এসে এটিকে ‘আন্ডারলাইন’ করবেন। তৎশিষ্য নরেন্দ্রনাথ মহাপ্রভুকে এইভাবে দেখবেন, ‘একবার মাত্র এক মহতী প্রতিভা সেই ‘অবিচ্ছিন্ন অবচ্ছেদক’ জাল ছেদন করিয়া উত্থিত হইয়াছিলেন—ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য। একবার মাত্র বঙ্গের আধ্যাত্মিক তন্দ্রা ভাঙিয়াছিল, কিছুদিনের জন্য উহা ভারতের অপরাপর প্রদেশের ধর্মজীবনের সহভাগী হইয়াছিল।’

‘কিছুদিনের জন্য’ আবার ঘোলাটে হতে সময় লাগেনি, অধিক; কারণ অর্থনীতির মতো ধর্মও শোষণের হাতিয়ার। সতীকে দাহ করলে সম্পত্তি যদি হাতে আসে, তাহলে পতির চিতায় সতীকে তোলা অক্ষয় পুণ্যের কাজ। প্রত্যেকেই যদি প্রথম সন্তানটিকে জলে বিসর্জন দেন তাহলে লোকসংখ্যার বৃদ্ধি আয়ত্তে থাকতে পারে। ধর্মকে ঈশ্বর লাভের উপায় না ভেবে, ভয়ের আকারে জনসমাজে উপস্থিত করতে পারলে ধর্ম ব্যবসায়ীরা অবশ্য লাভবান হবেন। মন্দির ও অর্জিত সম্পত্তির ওপর ধর্মগুরুর ভোগরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে। শাসকগোষ্ঠী ধর্মকে বিভেদ সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করবেন। মতুয়ার বুদ্ধি বলবে, আমার ধর্মই ধর্ম। ইংরেজ শাসক কায়দা বের করবেন—ডিভাইড অ্যান্ড রুল। আমাদের স্বাধীনতায় কর্তিত হবে দেশ। চির বৈরিতার পথ প্রশস্ত হবে। তৃতীয় বিশ্বের এই বৃহৎ ভূখন্ডটি চিরকাল অনগ্রসর থাকবে। শ্রেষ্ঠ মণীষার অস্ত, গুণ্ডারাজের উদয়। ধর্মের সঙ্গে কর্ম যুক্ত হবে না কোনওদিন। ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হবে পলায়নী বৈরাগ্য। ধর্ম হবে গুহাশায়িত। দ্বিতীয় কোনও অশোকের অথবা উদার কোনও ইসলাম আকবরের অভ্যুত্থান হবে না।

আমাদের পরাধীনতার সঙ্গে আমাদের ধর্মের প্রবল যোগ। ধর্ম দুর্গের মতো কাজ করেছে নি:সন্দেহে। পরাধীনতায় অর্থনৈতিক অধীনতা সমাজের ক্ষতি করলেও ভারতের অসংখ্য মানুষের নৈতিকতা, স্বাজাত্যাভিমান, দেশাত্মবোধ অনেক উগ্র হয়েছিল, এমন দেশটি কোথাও তুমি পাবে নাকো খুঁজে, এই আবেগ তখন ব্যাঙ্গার্থে প্রযুক্ত হত না। প্রভুদের কোনো জাত নেই। বিদেশি প্রভুদের আমলে আমরা রামমোহন, দয়ানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, দ্বারকানাথ, কেশবচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি, বিনোবা প্রমুখ জ্যোতিষ্কদের পেয়েছি। দেশি প্রভুদের পঞ্চাশ বছরের নর্তনকুর্দনে চারপাশ থইথই করছে বড় বড় চোরে। পঞ্চাশ বছরের কৃতিত্ব, আন্তর্জাতিক সমীক্ষার খেতাব—পৃথিবীর পুরোধা দুর্নীতিপরায়ণ দেশগুলির অন্যতম এই ভারত। সেই অর্থে ভারত একটি রত্ন। ইংরেজরা ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন কেক কাটা ছুরির মতো। বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠ’ এ সন্ন্যাসী-বিদ্রোহের মডেল তৈরি করেছিলেন, মা যা ছিলেন, মা যা হইয়াছেন, মা যা হইবেন, এই উত্তরণের চিত্রে ইস্ট ঈশ্বরের আসনে দেশ জননীকে স্থাপন করে, প্রাণপ্লাবনে যে নতুন তরঙ্গ তুলেছিলেন তার সঙ্গে আইরিশ চিন্তাধারার যোগাযোগ সাযুজ্য খুঁজে নিতে অসুবিধা হয় না। জননী, জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি…। শ্রীঅরবিন্দে এই ভাবেরই কর্ম সম্প্রসার। ধর্ম আর প্রেমে বস্তুগত পার্থক্য, ভাবগত পার্থক্য নেই। সেই ভক্তমালের ‘বিল্বমঙ্গল’ উপাখ্যানে উপস্থাপিত। শ্রীঅরবিন্দ আইরিশ ‘লোটাস অ্যান্ড ড্যাগার।’ আন্দোলনের ভাবগ্রহণ করে মানিকতলার বোমা দিয়ে দেশমাতার শৃঙ্খলমোচন করতে চেয়েছিলেন। সমকালের সাহিত্যে শরৎচন্দ্র একে করলেন, ‘পথের দাবি।’ মুকুন্দ দাস ও ভারতচন্দ্র ছন্দোবদ্ধ ক্ষোভে ফেটে পড়লেন রঙ্গলাল, নবীনচন্দ্র বারেবারে ধাক্কা মারলেন, স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়। নজরুল বের করলেন তরোয়াল। এ সবই আধ্যাত্মিকতা। শ্রীঅরবিন্দ আশ্রিত সন্ত্রাসবাদ, তদউদ্ভুত, যুগান্তর, অনুশীলন, বাঘা যতীন, বিনয়, বাদল দীনেশ, করিডর যুদ্ধ গোটাকতক ইংরেজ হত্যা, আগে প্রাণ কে করিবে দানের পিছনে উদ্দীপনা একটাই ‘বন্দেমাতরম। এর থেকে যে সর্বনাশটি হয়েছে, সেটির সঙ্গে তুলনীয় বৌদ্ধধর্ম, বৈষ্ণব ধর্ম এবং তন্ত্রের অধ:পতন।

স্বামীজির এই ভয়ঙ্কর উক্তিটি অনুধাবন করলে, স্বাধীনতার জন্য সন্ত্রাসবাদী দলগুলির সশস্ত্র অভ্যুত্থান, বিশ্বপটে নেতাজির অগ্নিরেখা ও বর্তমানের পার্লামেন্ট, একটি যোগসূত্র স্পষ্ট হবে। স্বামীজি বলছেন, ‘ক্রমশ রূপ-সনাতন ও জীব গোস্বামী প্রভৃতি মহাপুরুষগণের আসন বাবাজিগণ অধিকার করিলেন। তাহাতে শ্রীচৈতন্যের সম্প্রদায় ক্রমশ ধ্বংসাভিমুখে যাইতেছিল…।’ বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কেও স্বামীজির বক্তব্য অতি স্পষ্ট। রাজাশ্রয়ী বৌদ্ধধর্ম বিকশিত হয়েছিল, কারণ, ‘এ যুগের শক্তিকেন্দ্র সামগায়ী যজুর্যাজি পুরোহিতে নাই, রাজশক্তিও ভারতের বিকীর্ণ ক্ষত্রিয়বংশ—সম্ভুত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মণ্ডলীপতিতে সমাহিত নহে, এ যুগের দিগদিগন্ত ব্যাপী অপ্রতিহত শাসন আসমুদ্রক্ষিতীশগণই মানবশক্তি কেন্দ্র। এ যুগের নেতা আর বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠ নহেন, কিন্তু সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত ধর্মাশোক প্রভৃতি। বৌদ্ধযুগের একচ্ছত্র পৃথিবীপতি সম্রাটগণের ন্যায় ভারতের গৌরববৃদ্ধিকারী রাজগণ আর কখন ভারত সিংহাসনে আরূঢ় হন নাই।’

পরিণতি কী হল! এইকালে যা হয়েছে। স্বামীজির অনুধাবনে, ‘এ যুগের শেষে আধুনিক হিন্দুধর্ম ও রাজপুতাদি জাতির অভ্যুত্থান। ইঁহাদের হস্তে ভারতের রাজদণ্ড পুনর্বার অখণ্ড প্রতাপ হইতে বিচ্যুত হইয়া শতখণ্ড হইয়া যায়। এই সময় ব্রাহ্মণ্যশক্তির পুনরভ্যুত্থান রাজশক্তির সহিত সহকারিভাবে উদযুক্ত হইয়াছিল।’ (সাতচল্লিশ থেকে সাতানব্বই, ভারত রাজনীতির ক্রমপরিণতি—বিদায় বিদেশি—সিংহাসনে আসীন নেহেরু—আসমুদ্রহিমাচল দোর্দন্ডপ্রতাপ কংগ্রেস—নেহেরুর অবসান—ইন্দিরা-রাজীব-নরসিংহ-গুজরাল-সীতারাম-লালু-মুলায়াম-চন্দ্রবাবু-জ্যোতি-সন্ত্রাস-কংগ্রেসের নাভিশ্বাস—এবং!)

আবার ফিরে আসি স্বামী বিবেকানন্দে। স্বামীজি লিখছেন, ‘যে পুরোহিত-শক্তির সহিত রাজশক্তির সংগ্রাম বৈদিককাল হইতেই চলিতেছিল, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অমানব প্রতিভা স্বীয় জীবদ্দশায় যাহার ক্ষত্রপ্রতিবাদিতা প্রায় ভঞ্জন করিয়া দিতে সক্ষম হইয়াছিল, যে ব্রাহ্মণ্যশক্তি জৈন ও বৌদ্ধ উপপ্লাবনে ভারতের কর্মক্ষেত্র হইতে প্রায় অপসৃত হইয়াছিল, অথবা প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মের আজ্ঞানুবর্তী হইয়া কথঞ্চিৎ জীবনধারণ করিতেছিল, যাহা মিহিরকুলাদির (হুনজাতীয় রাজা) ভারতাধিকার হইতে কিছুকাল প্রাণপণে স্থাপন করিতে চেষ্টা করিয়াছিল, এবং ওই প্রাধান্য স্থাপনের জন্য মধ্য এশিয়া হইতে সমাগত ত্রুরকর্মা বর্বরবাহিনীর পদানত হইয়া, তাহাদের বীভৎস রীতিনীতি স্বদেশে স্থাপন করিয়া বিদ্যবিহীন বর্বর ভুলাইবার সোজা পথ মন্ত্র-তন্ত্রে মাত্র-আশ্রয় হইয়া, এবং তজ্জন্য নিজে সর্বতোভাবে হতবিদ্য, হতবীর্য, হতাচার হইয়া আর্যাবর্তকে একটি প্রকাণ্ড বাম-বীভৎস ও বর্বরাচারের আবর্তে পরিণত করিয়াছিল এবং যাহা কুসংস্কার ও অনাচারের অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ সারহীন ও অতি দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল, পশ্চিম হইতে সমুত্থিত মুসলমানাক্রমণরূপ প্রবল বায়ুর স্পর্শমাত্রই তাহা শতধা ভগ্ন হইয়া মৃত্তিকায় পতিত হইল।

পুনর্বার কখনও উঠবে কি, কে জানে?’

শ্রীঅরবিন্দ সন্ত্রাস ছেড়ে চলে গেলেন মননের পথে। তিনি বুঝেছিলেন আরোহণই শেষ কথা। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণেরই প্রতিধ্বনি, মানুষ নয়, মানহুঁস চাই। তাঁর শেষ আশীর্বাদ, তোমাদের চৈতন্য হোক নয়, তোমরা চৈতন্য হও। এটি আবার শংকরাচার্যেরই সহজ রূপ। শংকর বলছেন, তিনটি জিনিস এই ভূমন্ডলে দুর্লভ, প্রথম হল মনুষ্য জন্ম। আমি মানুষ হয়ে জন্মেছি, পশু নয়, এ আমার ভাগ্য। কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মাবার পর আমি যদি মুমুক্ষু হতে চাই, জীবন্মুক্তির অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হই, তাহলে সেটি হবে ভাগ্যেরও ভাগ্য। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলছে, মর্তসীমা চুর্ণিতে চাই। ‘মানুষ চুর্ণিল যবে নিজ মর্তসীমা।’ শংকর বলছেন,

দুর্লভং ত্রয়মেবৈতং দৈবানুগ্রহহেতুকম।
মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাপুরুষসংশ্রয়:।।

মুমুক্ষাই মানুষকে উচ্চভাব গ্রহণে আগ্রহী করবে।

গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে এই শতকের স্বাধীনতার প্রাক্কাল পর্যন্ত রাজনৈতিক আন্দোলনের সমান্তরালে ভাবান্দোলন প্রবল হয়েছিল। হিন্দুধর্ম থেকে ব্রাত্যজনেরা ইসলাম হয়েছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে। কিন্তু মিশনারিরা যে ধর্মাধীনতা আমাদের ওপর চাপাতে চেয়েছিল, তা আরও সাংঘাতিক। ভোগবাদে মানুষকে জর্জরিত করে যন্ত্রে পরিণত করা, ইন্দ্রিয়পরতা। শিক্ষিতা, ভোগবাদী, হেয়ার, হিন্দুর ছেলেদের ‘ইট, ড্রিংক, বি মেরি অ্যান্ড ডাই’-এর সাংঘাতিক প্রলোভন থেকে বাঁচাবার জন্য এল ব্রাহ্ম ধর্ম। সেটিও যথেষ্ট নয়।

তখন দক্ষিণেশ্বরের রানি রাসমণির কালীবাড়ি থেকে প্রসারিত হল প্রবাহ, যার সার কথা যত মত তত পথ। যার সার কথা, ঈশ্বর নয় মানুষ। জীবে দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীব সেবা। যার সার কথা, আত্মনোমোক্ষার্থং জগদ্বিতায় চ। মুক্তোহপি। যেখান থেকে উৎসারিত হল ধর্মের শেষ কথা, পাপ বলে কিছু নেই, ভক্তের কোনও জাত নেই। অর্ন্তসন্ন্যাসই সন্ন্যাস। খালি পেটে ধর্ম হয় না। আগে অন্ন, পরে ধর্ম। মানুষই শেষ কথা। শিবরূপী। জীবের আরাধনা। ঈশোপনিষদের সেই প্রথম সুক্তটি :

ইশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধ: কস্যস্বিদ ধনম।
 

এই উৎস থেকে প্রকাশিত হলেন নরেন্দ্রনাথ, পরবর্তীকালের বিবেকানন্দ। যিনি বললেন, বিবেকের জাগরণই ধর্ম। বিচারই পথ। আত্মবিচার। আমার মানুষ হতে আর কতটা বাকি আছে—এ সেনসিবল ম্যান, এ রিজিনেবল ম্যান, এ লাভিং অ্যান্ড লাভেবল ম্যান। মানুষ চাই, মানুষ চাই, বীর্যবান, সম্পূর্ণ অকপট, তেজস্বী, বিশ্বাসী যুবক। লোহার মতো দৃঢ় মাংসপেশি ও ইস্পাতের মতো স্নায়ু….।’

গুরুর মন্ত্রে, আদর্শে, ভাবে মেশালেন নিজের মনস্বীতার আগুন। হিরোসিমায় বিস্ফোরিত হয়েছিল জড়বিজ্ঞানীর বিধ্বংসী আণবিক মারণাস্ত্র, তার অনেক আগেই এখানে বিস্ফোরিত হল চৈতন্যের আণবিক বোমা, অল নিগেসান Negation ইজ ডেথ। নেই নেই করতে করতে সাপের বিষও নেই হয়ে যা, পালাবে কোথায়!

পক্ষহীন শোন বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার
বারংবার পাইছ আঘাত, কেন কর বৃথায় উদ্যম,
ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল,
দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম—অগ্নিশিখা করি আলিঙ্গন।

এক হাতে গীতা, আর এক হাতে স্বামীজির বাণী, স্বদেশি যুবকের দল ছুটছে, কে প্রাণ আগে করিবক দান। মহাত্মাজি রাসকিনের ‘আনটু দিস লাস্ট’-এর মডেলে যে ভারত গড়তে চেয়েছিলেন সেও এই রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ মডেল। মানুষকে স্বরাট ও বিরাট করার স্বপ্ন—

ব্রহ্ম হতে কীট-পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়
মন প্রাণ শরীর অর্পণ কর সখে, এ সবার পায়।
বহুরূপে সন্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজছি ঈশ্বর?

অন্তেবাসী মানুষের নিজস্ব জাগরণ চাই। একালের প্রভুর গদির স্বার্থে তীরধনুকের আন্দোলন নয়, গদা দিয়ে একটা মসজিদ ভেঙে শঙ্খচক্রগদাপদ্মের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার ‘মতুয়া-ধর্ম’ নয়। অন্ন, স্বাধিকার, আত্মিক জাগরণই ধর্ম। ‘তোরা কাজ করতে করতে মরে যা’—মঠের সন্ন্যাসীদের উজ্জীবিত করছেন স্বামীজি। ‘নতুন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙল ধরে, চাষার কুটীর ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে।’

একালের চটকদারি স্লোগান, ‘গ্লোবালের’ ভারত নয়, হাওলা, গাওলা, তিহার জেলবাসী গুরু, প্রাোমোটারের ভারত নয়, শৌখিন মজদুরির ভারত নয়। দীর্ঘ এক প্রবন্ধের ভূমিকামাত্র এই লেখাটি শেষ করব স্বামীজির এই কথাটি (যা অতিশয় প্রাসঙ্গিক) দিয়ে : ‘আলো আলো নিয়ে এসো। প্রত্যেকের কাছে জ্ঞানের আলো নিয়ে এসো। যতদিন না সকলেই ভগবান লাভ করে, ততদিন তোমাদের কাজ শেষ হবে না। দরিদ্রের কাছে আলো নিয়ে চলো, ধনীর কাছে নিয়ে এসো আরও অধিক আলো—কারণ দরিদ্রের চেয়ে তার আলোর প্রয়োজন বেশি।’

মৎ সংযোজন—পার্লামেন্টে আলো, অ্যাসেম্বলিতে আলো, মাল্টিস্টোরিতে আলো, গদিতে গদিতে আলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *