ধর্মীয় ও জাগতিক তাৎপর্যবহ কোরআন

ধর্মীয় ও জাগতিক তাৎপর্যবহ কোরআন

অবশ্য, এ কথা ভুললেও চলবে না যে, কোরআন মূলত একখানি ধর্মগ্রন্থ। সুতরাং, কোরআনের সববাণী ও বক্তব্যে যদি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ধ্যান-ধারণা ও বিজ্ঞানের তত্ত্ব খুঁজতে যাই, তবে ভুল হবে নিঃসন্দেহে। বরং, কোরআনের বাণী ও বক্তব্যে পরম স্রষ্টার যে সৃষ্টিকুশলতা, প্রাকৃতিক বিধি-বিধানের রহস্যের যে বর্ণনা রয়েছে, তারমধ্যে যুগে যুগে মানুষের দৃষ্টিতে যতটা ধরা পড়েছে কিংবা মানুষের জ্ঞানের-আলোকে যতটা প্রতিভাত হয়েছে, শুধু ততটুকু তথ্যেরই পর্যালোচনা করা যায়। কোরআনের বাণী ও বক্তব্যে প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের এই যে প্রতিফলন, আধুনিক যুগে সেই প্রতিফলনই একান্ত তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ধরা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, কোরআনের যেসব বাণী ও বক্তব্য এতদিন যাবত ছিল অজ্ঞেয়, দুৰ্জেয় ও রহস্যময়, আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণা ও আবিষ্কারে তার অনেক কিছুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এখন মানব-জ্ঞানের পরিসীমায় ধরা দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, কোরআনের বাণীর এই বৈশিষ্ট্যই এখন বৈজ্ঞানিক-মনের কাছেও একান্ত বিস্ময়কর হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।

এ কথার দ্বারা অবশ্য এটা বুঝাও উচিত হবে না যে, মানবসৃষ্টি-সম্পর্কিত কোরআনের সকল কিছু, আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্য-জ্ঞানের গবেষণা ও আবিষ্কারে আলোকিত ও বিশ্লেষিত হয়ে শেষ হয়েছে। সত্যি কথা, বলতে কি, মানব-সৃষ্টির বিষয়টা বাইবেল ও কোরআনে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, তা এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণের আওতা-বহির্ভূত বিষয় হিসেবেই বিদ্যমান। এ কারণে, এখন যখন বাইবেলের নতুন নিয়ম (ইঞ্জিল) কিংবা কোরআন আমাদের জানায় যে, যীশুখ্রিস্ট অর্থাৎ হযরত ঈসার (আঃ) জন্ম হয়েছিল বিনা পিতায়, তখন বিজ্ঞানের প্রতিবাদ এ সম্পর্কে তেমন সোচ্চার হতে পারে না। যদিও বিজ্ঞান জানে যে, শারীরবিজ্ঞানের নিয়মানুসারে কোন মানব সন্তানের পক্ষে বিনা পিতায় জন্ম হওয়াটা অসম্ভব। কারণ, পিতার বীর্য নিঃসৃত শুক্রকীট সন্তানকে শুধু জন্মই দেয় না, প্রতিটি নবজাতকই তার পিতার থেকে অর্ধেক জেনেটিক উত্তরাধিকারও লাভ করে থাকে। মূলত, বিজ্ঞান কোন অলৌকিকত্বের ব্যাখ্যা প্রদান করে না; কেননা, অলৌকিকত্বের সংজ্ঞাই হচ্ছে–এমনকিছু, যা ব্যাখ্যার অতীত। এভাবে কোরআন ও বাইবেল যখন বলে যে, মানুষ পরিগঠিত হয়েছে মাটি থেকে, তখন সেই বক্তব্যে কার্যত ধর্মের একটি মৌলিক সত্য লাভ করে। যেখান থেকে আগমন, সেখানেই প্রত্যাগমন; যার শয়ান যেখানে, শেষ বিচারের দিনে তার পুনরুত্থান ঘটবে সেখান থেকেই।

কোরআনে ধর্মীয় তাৎপর্যমণ্ডিত বক্তব্য তো রয়েছেই; সেইসঙ্গে মানব সম্পর্কিত বক্তব্যের পাশাপাশি আরো এমনসব তথ্য ও বক্তব্য পাওয়া যায় যা একান্তভাবেই জাগতিক বা বস্তুগত। কোন বিজ্ঞানী যখন কোরআনের মত একটি ধর্মগ্রন্থে এ ধরনের একান্ত বাস্তব-জ্ঞানসম্মত তথ্য ও বক্তব্য পেয়ে যান, তখন তিনি চমকে উঠে থমকে না যেয়ে পারেন না। উদাহরণ হিসেবে কোরআনে প্রাণের সৃষ্টি-সংক্রান্ত বক্তব্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রাণের আদি উৎস সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট বক্তব্য কোরআনে রয়েছে।

শুধু তাই নয়, মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারটা যে শারীরবিজ্ঞানের রূপান্তরের ধারায় সম্পাদিত হয়েছে, সে সম্পর্কেও কোরআনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে বিস্তারিত বর্ণনা। কোরআনে এই তথ্যও স্পষ্ট ভাষায় পরিবেশিত হয়েছে যে, আল্লাহ্ মানুষকে নিজস্ব ইচ্ছানুসারে সুষমামণ্ডিত করেছেন। অনুরূপভাবে, আমরা কোরআনে আরো দেখা যায়, মানব-প্রজনন-সংক্রান্ত এমনসব সঠিক বর্ণনা, যার সঙ্গে শুধু আধুনিক বিজ্ঞান-গবেষণায় প্রাপ্ত সুপ্রমাণিত তথ্যজ্ঞানেরই তুলনা চলে।

এ কথা অবশ্য ঠিক যে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এসব বর্ণনা কোরআনের সুনির্দিষ্ট কোন স্থানে পাওয়া যাবে না। ১৯৭৬ সালে এ বিষয়ে ড. মরিস বুকাইলির যে বিশ্লেষণাত্মক গবেষণা-নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল, তা প্রণয়নের বেলায় তিনি গোটা পাশ্চাত্যজগতে প্রকাশিত কোরআন সম্পর্কিত নানা গ্রন্থ মন্থন করেও এ বিষয়ে কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি। খুঁজে-পেতে শেষপর্যন্ত আরবি ভাষায় প্রকাশিত কিছু পুঁথি-পুস্তক পেয়েছিলেন। সেগুলো পড়লেই বুঝা যায়, এসব বিষয়ে কোরআনের বক্তব্য কি, বিজ্ঞান বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু দুই-একজন গবেষক লেখক তা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন মাত্র। কিন্তু ‘ওভার অল স্টাডি’ বা সামগ্রিকভাবে গবেষণা বলতে যা বুঝায় তার হদিস কোথাও মেলেনি।

বিষয়টা অবশ্য সহজও নয়। কেননা, এ ধরনের কোন বিষয়ে তেমন গভীর কোন গবেষণাকর্ম পরিচালনার জন্য সর্বাধিক প্রয়োজনীয় হল, আধুনিক বিজ্ঞানের সুবিস্তৃত শাখা-প্রশাখার বিশদ জ্ঞান ও সুগভীর অনুসন্ধান। এদিকে ইসলামী তত্ত্ববিদ বা ধর্মবিশারদ হিসেবে যারা পরিচিত, তারা বেশিরভাগই মলত, ধর্মীয় জ্ঞান-প্রজ্ঞাসম্পন্ন ভাষাবিদ পণ্ডিত। কিন্তু ইসলামীতত্তের বিষয়ে যে-কেউ যতই বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ পণ্ডিত বা বিদগ্ধসুধীজন হোন-না-কেন, তিনি তাঁর গবেষণা প্রকাশনায় কোরআনের বিজ্ঞান-সম্পর্কিত বিষয়ে ঠিক একজন বিজ্ঞানী গবেষকের মত গুরুত্ত্ব আরোপ করবেন, এটা আশা করা চলে না। কথাটা পাশ্চাত্যের ইসলামীতত্ত্ববিদদের বেলায় বেশি খাটে।

বস্তুত, এ কাজের জন্য প্রয়োজন এমন একজন আগ্রহী ও অনুসন্ধিৎসু মানুষ যিনি একাধারে বিজ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখার সর্বাধুনিক তথ্যজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক অবহিত এবং এই সঙ্গে আরবী ভাষায়ও সমান ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন। এ রকম কোন মানুষ যখন মূল আরবীতে কোরআন পড়বেন, তখন তার পক্ষেই শুধু অনুধাবন করা সম্ভব হবে যে, কোন্ বিষয়ে কোরআনে সঠিক অর্থে কোন্ বক্তব্য দেওয়া হয়েছে; আর আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক জ্ঞান-গবেষণা সে সম্পর্কে কি তথ্য পরিবেশন করছে। এ রকম অনুসন্ধানী মানসিকতা নিয়ে যখন কেউ এগিয়ে আসবেন শুধু তখনই তাঁর পক্ষে এতদুভয়ের মধ্যে যথাযথ বিচার বিশ্লেষণ ও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে : তার আগে নয়।

কোরআনে প্রকৃতি ও বিজ্ঞান-বিষয়ক এ-সব বাণী ও বক্তব্যের উপস্থিতি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, কোরআন যে-কালে নাজিল হয়েছিল তখন এসব বিষয় সম্পর্কে মানুষের কোন ধারণাই ছিল না। হাজার-দেড় হাজার বছর পরে এসে শুধু আধুনিক বিজ্ঞানই নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা-বিশ্লেষণ ও আবিষ্কার-অনুসন্ধানে এসব বিষয়কে মানুষের নাগালের মধ্যে এনে দিয়েছে। এখানেই যে বিষয়টা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, তাহল : প্রায় দেড় হাজার বছর আগেকার কোরআনের বাণী বক্তব্যে কিভাবে এমন সব বিষয় স্থান পেল এবং কিভাবে সে-সব বিষয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত তথ্য পরিসংখ্যানের সাথে এত বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারল?

এই পর্যায়ে একটা কথা সবিনয়ে নিবেদন না করে পারা যায় না। তাহল, কোরআনের প্রচলিত বিভিন্ন অনুবাদ ও তাফসীরসমূহে এসব বিষয়ে যে-সব অর্থ ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য-বর্জিত। ফলে, অনেকক্ষেত্রে ওইসব অর্থ ও ব্যাখ্যা হয়ে পড়েছে অগভীর–এমনকি বিভ্রান্তিকর। অনেক বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ তফসীরকার মোহম্মদকে (দঃ) একজন সুদক্ষ চিকিৎসক হিসেবে দেখানোর প্রয়াস পেয়েছেন। কেউ কেউ কোরআনের মধ্যে খুঁজেছেন নানান রোগ-ব্যাধীর সমাধান। প্রকৃতপক্ষে, কোরআনে যা রয়েছে তা হল, স্বাস্থ্যবিধি, খাদ্য-অখাদ্য-সম্পর্কিত নির্দেশ। যেমন, মদ ইত্যাদি মাদকদ্রব্যের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা এতে রয়েছে। রমজান মাসে রোজা রাখার নির্দেশটাও স্বাস্থ্যবিধিসম্মত বলে ধরে নেয়া যায়। কোরআনে মধুর উপকারিতার কথা বলা হয়েছে; কিন্তু নির্দিষ্ট কোন ব্যাধি নিরাময়ের কথা সেখানে নেই।