ধর্মীয় পরিস্থিতি ও রামকৃষ্ণ

ধর্মীয় পরিস্থিতি ও রামকৃষ্ণ

ঊনবিংশ শতাব্দীর ধর্মীয় পরিস্থিতির মধ্যে আমরা প্রথম দেখি কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অভ্যুদয়, খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তরিতকরণ ও ব্রাহ্মধর্মের উত্থান ও বিকাশ। সকলের শেষে আমরা শুনি দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মুখে সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী।

দুই

অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাঙলার দলিত পতিত অন্ত্যজ জাতিসমূহের মুক্তির জন্য হরিচাঁদ ঠাকুর মতুয়া ধর্ম নামে এক ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন। আবার কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অভ্যুদয়ও হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে একদিন নদীয়ার উলা গ্রামের (এখন কল্যাণী) বাসিন্দা মহাদেব বারুই নিজ পানের বরোজের মধ্যে এক পরিত্যক্ত শিশুকে কুড়িয়ে পান। তিনি তাকে এনে পালন করেন। তিনি তার নাম রাখেন পূর্ণচাঁদ। একটু বড় হয়ে পূর্ণচাঁদ উদাসীন হয়ে চব্বিশ পরগনা ও সুন্দরবনের নানাস্থানে ঘুরে বেড়ায়। নানা জাতির লোক তাঁর অনুরাগী হয়। তখন তাঁর নাম হয় আউলচাঁদ। সাতাশ বছর বয়সে বেজরা গ্রামে তিনি ধর্মগুরু হিসাবে প্রকট হন। এখানেই তাঁরা বাইশ জন শিষ্য জুটে যায়। আউলচাঁদকে তাঁর ভক্তরা শ্রীচৈতন্যদেবের অবতার বলে মনে করেন। তাঁরা বলেন—শ্রীচৈতন্যদেব যবনপ্রীতি ও হরিজনসেবায় মনোমত পথ পাননি তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে, তাই নতুন পথ প্রবর্তনের জন্য তিনি ঘোষপাড়ায় আউলচাঁদরূপে আবির্ভূত হন।’ এদের মতে কর্তা বা ঈশ্বরই জগতের স্রষ্টা এবং গুরুই ঈশ্বরের প্রতিনিধি। আরও এঁদের মতে সাধনা ও উপাসনার ক্ষেত্রে জাতি বা সম্প্রদায়-বিচার নেই, স্ত্রী-পুরুষ ভেদ নেই।

১৭৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দে আউলচাঁদের মৃত্যু হয়। তখন রামশরণ পাল কর্তা হন। রামশরণের মৃত্যুর পর প্রথমে তাঁর স্ত্রী সতীমা ও তাঁর পরে রামদুলাল ও ঈশ্বরচন্দ্র বংশানুক্রমে কর্তাভজাদলের গদির অধিকারী হন।

শ্রীরামপুরের মিশনারীদ্বয় মার্শম্যান ও কেরী প্রায়ই ঘোষপাড়ায় রামদুলালের কাছে যেতেন ও তাঁর সঙ্গে pantheism সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করতেন (‘Calcutta Review’, Sixth Part, 1846, Page 407)।

১৮২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজাণ্ডার ডাফ ভারতে আসার পর, তিনিও ঘোষপাড়ায় যেতেন এবং কর্তাভজাগণের সঙ্গে ধর্মালোচনা করতেন। পঞ্চানন অধিকারী কৃত এক পুরানো হস্তলিখিত পুঁথিতে এর বিবরণ আছে। তাতে লেখা আছে—রাজা রামমোহন রায় যেতেন তাঁর পাশ/অমৃত রস পান করি মিটাইতে আশ/ অনেক সাহেব তিনি সাথে লয়ে যান/অনেকেই লন আশ্রয় করি প্রণিধান॥/ডাফ সাহেব পাদরী যেতেন তাঁর পাশে। লইতেন শিক্ষা যেয়ে ঘোষপাড়া আবাসে।’ (শ্রীরামাশ্রয় বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক এই পুঁথিখানি প্রকাশিত হয়েছিল)।

শুধু রাজা রাহমোহন রায় কেন, কলকাতার বহু সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ঘোষপাড়ায় যেতেন ও কর্তাভজাবলম্বী ছিলেন। তাঁদের অন্যতম ছিলেন ভূকৈলাসের মহারাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল। (সুকুমার সেন, ভারতকোষ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৭)। ভূকৈলাসের ঘোষাল পরিবারের সকলের নামকরণে ‘সত্য’ শব্দ সংযুক্ত হওয়া ওই পরিবারের ওপর কর্তাভজা দলের প্রভাব সূচিত করে। প্রসিদ্ধ গণিতজ্ঞ ও জেনারেল এসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনের (স্কটিশ চার্চেস কলেজের) অধ্যাপক গৌরীশঙ্কর দে কর্তাভজা সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন (সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান, পৃষ্ঠা ১৪১)। কলকাতার বহু সম্ভ্রান্ত পরিবারে এখনও সতীমার ঘট সংরক্ষিত আছে ও নিত্যপূজাদি হয়ে থাকে।

বাঙলাদেশের অনেক গ্রামের অধিকাংশ মুসলমানই সতীমায়ের ভক্ত। মূর্শিদাবাদের কুমিরদহ এরূপ একটি গ্রাম। এ-সম্বন্ধে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত শ্রীঅশোক মিত্র, আই. সি. এস. সম্পাদিত ‘পশ্চিমবঙ্গের পূজা- পার্বণ ও মেলা’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে লিখিত হয়েছে—’এই গ্রামের অধিকাংশ অধিবাসী মুসলমান সম্প্রদায়-ভুক্ত। কিন্তু ইহারা ঘোষপাড়ার সতীমায়ের সত্যধর্মে দীক্ষিত হইয়া তাঁহাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন। ডিম, মাংস, মদ্য কেহ গ্রহণ করেন না। কেহ সত্যধর্মবহির্ভূত কার্য করিলে বা প্রকাশ পাইলে তাহাকে সমাজে দণ্ড পাইতে হয়।’

ভক্তরা বলে, ‘যার কেউ নেই, তার সতীমা আছেন।’ মানিক সরকার লিখেছেন—’মধ্যযুগের বাঙলায় সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ‘যার কেউ নেই – দের সংখ্যাই ছিল বেশি। আর্থিক অনটন ও সামাজিক নিষ্পেষণে জর্জরিত কৃষকসমাজের দরিদ্র অংশের অগণিত নর-নারীর মধ্যে একটি অংশ কর্তাভজা ধর্মমতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। তাই দেখা যায় ভক্তদের অধিকাংশই দরিদ্র ও নিঃস্ব কৃষিসমাজের মানুষ। তারা সমাজজীবনে অন্ত্যজ, অর্থনীতিতে নিঃস্ব। সম্ভবত বাঁচার আশাতেই সতীমার উপর নির্ভর করে। (‘পশ্চিমবঙ্গ’, ২৯ জুন ১৯৭২, পৃষ্ঠা ১২৪৭)। বিশেষ করে সতীমা অন্ত Jজসমাজের অবহেলিত-বঞ্চিত নারীসমাজকে কর্তাভজা মতের প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নের পূর্বেই কর্তাভজা-সম্প্রদায়ের ‘সত্যধর্ম’ এমন জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, নবপ্রসূত ব্রাহ্মধর্মের প্রচারকরা তাতে বিচলিত হয়ে ওঠেন, এবং কর্তাভজাবলম্বীদের বিপক্ষে তির্যক মন্তব্য করতে থাকেন। কিন্তু দায়িত্বশীল প্রাজ্ঞ প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে আমরা কর্তাভজা-সম্প্রদায় সম্বন্ধে সঠিক বিবরণ পাই। এরূপ একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন কবি নবীনচন্দ্র সেন। তিনি যখন নদীয়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন তখন তাঁকে ঘোষপাড়ার মেলার সুবন্দোবস্তের জন্য, এক সপ্তাহ পূর্ব থেকেই মেলা-প্রাঙ্গণের এক পাশে তাঁবু ফেলে অবস্থান করতে হয়। তিনি তাঁর ‘আমার জীবন’ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে লিখেছেন :

‘এখন যে ‘harmony of scriptures’ বা ধর্মের সামঞ্জস্য বলিয়া একটা কথা শুনিতেছি, দেখা যাইতেছে এই রামশরণ পালই তাহা সর্বপ্রথম অনুভব করিয়াছিলেন। সকল ধর্ম, সকল আচার সত্য—এমন উদার মত এক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভিন্ন অন্য কোন ধর্মসংস্থাপক প্রচার করেন নাই। অতএব রামশরণ পাল আমি তোমাকে নমস্কার করি।’ ক্রীশ্চান ধর্মের ‘দশ আদেশ’-এর মত কর্তাভজা ধর্মেও দশটি কর্ম নিষিদ্ধ। এই সকল নিষিদ্ধ কর্মের মধ্যে তিনটি হচ্ছে কায়কর্ম – পরস্ত্রী-গমন, পরদ্রব্যহরণ ও পরহত্যাকরণ। তিনটি মনঃকর্ম হচ্ছে—পরস্ত্রী-গমনের ইচ্ছা, পরদ্রব্যহরণের ইচ্ছা ও পরহত্যাকরণের ইচ্ছা। চারটি বাক্যকর্ম হচ্ছে— মিথ্যাকথন, কটুকথন, অনর্থকবচন ও প্রলাপভাষণ। এই দশটি নিষিদ্ধ কর্ম পরিহার করাই হচ্ছে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ‘সত্যধর্ম’।

তিন

বাণিজ্য উপলক্ষে পর্তুগীজদের আসার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙলাদেশে রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের প্রচার শুরু হয়েছিল। পর্তুগীজরা জোর করে এদেশের লোকদের খ্রিস্টান করত। এ সম্বন্ধে মুঘল সম্রাট আকবরের অনুমোদন ছিল। খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের জন্য পর্তুগীজরা বাংলা গ্রন্থও রচনা করত। এরূপ এক গ্রন্থ হচ্ছে ডোম এন্টনিও রোজারিও রচিত ‘ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’। ডোম এন্টনিও আগে হিন্দু ছিল। ধর্মান্তরিত হবার পর ডোম এন্টনিও শুধু এই গ্রন্থখানিই রচনা করেনি, ঢাকা অঞ্চলে ২০,০০০ নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছিল। তাছাড়া, পর্তুগীজরা এদেশের মেয়েদের বিবাহ করা ও রক্ষিতা হিসাবে রাখার ফলে এদেশে বেশ এক সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টান সমাজ গড়ে উঠেছিল।

ইংরেজরা গোড়ার দিকে ধর্মপ্রচারের বিরোধী ছিল। সেজন্যই মার্শম্যান, কেরী প্রমুখ ধর্মপ্রচারকদের দিনেমার সরকার শাসিত শ্রীরামপুরে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তার ফলে, শ্রীরামপুরে প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টান মিশনারীদের একটা কেন্দ্র গঠিত হয়ে উঠেছিল। প্রথম যে বাঙালীকে তারা খ্রিস্টান করে, সে একজন ছুতোর মিস্ত্রি, নাম কৃষ্ণচন্দ্র পাল। তার ভাঙা হাত চিকিৎসা করে তারা ঠিক করে দিয়েছিল। সাহেবদের দয়া দেখে সে খ্রিস্টান হয়েছিল।

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদের বলে খ্রিস্টান মিশনারীরা এদেশে ধর্মপ্রচারের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। তার ফলে দলে দলে খ্রিস্টান মিশনারীরা এদেশে আসতে থাকে। বিশ বছরের মধ্যে তারা বহু হিন্দুকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে। শুধু তাই নয়। তারা হিন্দুধর্মের নিন্দা ও কুৎসা এবং হিন্দু দেবদেবী ও মহাপুরুষদের সম্বন্ধে ব্যাঙ্গোক্তি করতে থাকি। নিম্ন-শ্রেণীর লোকদের তারা জীবিকা অর্জনের সুযোগ দিয়ে অপর পাঁচজনকেও খ্রিস্টধর্ম অবলম্বন করতে উৎসাহ দেয়। মিশনারী বালিকা বিদ্যালয়সমূহে তারা প্রকাশ্যে খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষা দিতে শুরু করে।

১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে আলেকজাণ্ডার ডাফ এদেশে আসবার পর খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তরিতকরণের অভিযান আরও জোরদার হয়। এতদিন নিম্ন-শ্রেণীর লোকরাই খ্রিস্টান হত। এখন হিন্দুসমাজের উচ্চশ্রেণীর লোকরা খ্রীস্টধর্মের প্রতি আগ্রহী ও অনুরক্ত হতে থাকে। কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮১৩-১৮৮৫), মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩), প্রসন্নকুমার ঠাকুরের (১৮০১-১৮৬৮) একমাত্র পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহনের খ্রিস্টান হওয়া তার দৃষ্টান্ত। খ্রিস্টান মিশনারীদের এই অভিযানকে অনেক পরিমাণে দমিত করেছিল ব্রাহ্মধর্ম।

চার

রামমোহন রায়কে (১৭৭২-১৮৩৩) ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক বলা হয়। ব্ৰাহ্মধর্ম বলতে তিনি বেদান্ত-প্রতিপাদ্য ‘সত্যধর্ম’ বুঝতেন। ‘সত্যধর্ম’ অনুযায়ী প্রতিমাদিতে পরমেশ্বরের আরাধনা নিষিদ্ধ ছিল। সেজন্য ব্রাহ্মরা ছিলেন ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’-এর উপাসক। তবে তিনি প্রাচীন হিন্দুধর্মের বিরোধী ছিলেন না। এটা বুঝা যায় ব্রাহ্মধর্মের সঙ্গে রামানুজাচার্য প্রবর্তিত বিশিষ্ট দ্বৈতবাদের সাদৃশ্য থেকে। মোটকথা, রামমোহন হিন্দুধর্ম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাননি। এটা প্রকাশ পায় তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত উপবীত ধারণ করা ও ব্রাহ্মণেতার জাতির সঙ্গে এক পংক্তিতে আহার না করা থেকে।

১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগস্ট তারিখে রামমোহন ব্রাহ্মদের উপাসনার জন্য আপার চিৎপুর রোডে (বর্তমান রবীন্দ্র সরণী) ব্রাহ্মদের এক নিজস্ব উপাসনা গৃহ স্থাপন করেন। এটাই পরবর্তীকালে ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিত হয়।

১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর তারিখে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭- ১৯০৫), অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২৫-১৮৮৬) প্রমুখ উনিশজন রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের (১৭৮৬-১৮৪৫) কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। এরপর ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের জন্য সংগঠনও তৈরী করা হয়। প্রথম ব্রাহ্ম প্রচারক হাজারীলাল, দেবেন্দ্রনাথের প্রেরণায় অল্প সময়ের মধ্যে বহুসংখ্যক লোককে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করেন। ঢাকা, মেদিনীপুর, রংপুর, কুমিল্লা, বাঁশবেড়িয়া, সুখসাগর, প্রভৃতি স্থানে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপিত হয় দেবেন্দ্রনাথের একজন বিশিষ্ট সহযোগী ছিলেন রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬- ১৮৯৯)। তিনিও দেওঘরে ব্রাহ্মসমাজের এক উপাসনা গৃহ স্থাপন করেন, যদিও আজ তা ভগ্নস্তূপ ও জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।

কেশবচন্দ্র সেনের (১৮৩৮-১৮৮৪) ব্রাহ্মধর্ম বাঙলার যুবসমাজে এক নতুন প্রাণচাঞ্চল্য ও আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং সুদূর মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রভৃতি স্থানে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপিত হয়। তিনি ব্রাহ্মধর্মকে সর্বধর্মসমন্বয়কারী ধর্ম বলে ঘোষণা করেন এবং এর ‘নববিধান’ নাম দেন। মেছুয়াবাজার স্ট্রীটে নববিধান সম্প্রদায়ের নতুন উপাসনা মন্দির স্থাপিত হয়। এর নাম দেওয়া হয় ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজ’। কিন্তু কেশবচন্দ্রের সঙ্গে তরুণ ব্রাহ্মদের (যথা শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু প্রমুখ) গুরুতর মতভেদ হওয়ায়, তারা ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে কর্নওয়ালিস স্ট্রীটে (বর্তমান বিধান সরণী ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে।

ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যুব আন্দোলন, শিক্ষা বিস্তার, নারীসমাজ উন্নয়ন, অস্পৃশ্যতা নিবারণ, স্বাধীনতা আন্দোলন ইত্যাদি বিশেষভাবে জড়িত ছিল।

আজ ব্রাহ্মরা দাবী করছে, তারা এক নতুন ধর্মসম্প্রদায়। এটা ঠিক নয়। ব্রাহ্মরা হিন্দুসমাজেরই এক প্রগতিশীল সম্প্রদায় বিশেষ। তারা যে হিন্দুই এটা প্ৰকাশ পায় রামমোহনের উপবীত ধারণ ও ব্রাহ্মণেতর জাতির সঙ্গে এক পংক্তিতে আহার না করা, কেশবচন্দ্রের হিন্দুশাস্ত্রানুযায়ী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজ কন্যার বিবাহ দেওয়া ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর দিন পর্যন্ত (১৯০৫) নিজ পরিবারের ছেলেদের উপনয়ন দেওয়া ও অসবর্ণে মেয়েদের বিবাহ না দেওয়া থেকে। রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম সম্বন্ধে বলেছেন—”জ্ঞান ও প্রেম-সমেত আত্মাকে ব্রহ্মে সমর্পণ করার সাধনাই ব্রাহ্মধর্মের সাধনা—তদ্ভাবগতেন চেতনা এই সাধনা করতে হবে। ইহা নীরস তত্ত্বজ্ঞান নহে। ইহা ভক্তি প্রতিষ্ঠিত ধৰ্ম।

পাঁচ

সনাতনী হিন্দুসমাজ গোড়া থেকেই খ্রিস্টান ও ব্রাহ্মধর্মের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিক্রিয়ামূলক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। এটা প্রশমিত হয়, যখন দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ‘সর্বধর্ম এক’, এই বাণী প্রচার করেন।

রামকৃষ্ণদেবের (১৮৩৬-১৮৮৬) জন্ম হয় উনবিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শেষে হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে। পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন, মাতা চন্দ্রমণি সরলতা ও দয়ার প্রতীক ছিলেন। রামকৃষ্ণের ছেলেবেলার নাম ছিল গদাধর। পড়াশোনায় মন ছিল না, কিন্তু নিবিষ্টমনে শুনতেন কথকঠাকুরদের মুখে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, শ্রীমদ্‌ভাগবতের কথা ও কাহিনীসমূহ। বাল্যকাল থেকেই ধর্মভাবাপন্ন ছিলেন ও নিজের মনের আবেগে গৃহে রঘুবীরের বিগ্রহের সেবা করতেন।

ষোল-সতেরো বৎসর বয়সে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রামকুমারের সঙ্গে কলকাতায় আসেন। রামকুমার রানী রাসমণি (১৭৯৩-১৮৬১) প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বরের কালী- বাড়ির পূজারী নিযুক্ত হন। রামকুমারের মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণ ওই পদে অধিষ্ঠিত হন। পূজারী হয়ে তিনি মৃন্ময়ী দেবীমূর্তিতে চিন্ময়ীর দর্শন পান। পূজা করতে বসেন, পূজা হয় না। মায়ের মাথায় ফুল না দিয়ে নিজের মাথায় ফুল দেন। মাকে ভোগ দেবার আগে নিজেই ভোগ এঁটো করে ফেলেন। দিনরাত মা, মা করে কাঁদেন। শেষকালে আর পূজা করতে পারলেন না। উন্মাদের ন্যায় ঘোরাফেরা করতে থাকেন। রাসমণির জামাই মথুরবাবু মহাপুরুষ বোধে তাঁর সেবা করতে থাকেন। অতঃপর বিভিন্ন ধর্মমার্গের সাধনায় রামকৃষ্ণ সিদ্ধিলাভ করেন। সব ধর্মের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। ফলে, ধর্মের গূঢ়তত্ত্ব তিনি হৃদয়ঙ্গম করেন। তখন তিনি প্রচার করেন : ‘সব ধর্মই সত্য, যত মত তত পথ’।

তেইশ বছর বয়সে, ছ’বছরের মেয়ে সারদামণির সঙ্গে বিবাহ হয়। কখনও দৈহিক সম্পর্ক হয়নি। উনিশ বছর বয়সে সারদামণি যখন দক্ষিণেশ্বরে এলেন, রামকৃষ্ণ তাঁকে সাক্ষাৎ জগদম্বা জ্ঞানে পূজা করেন ও মা বলে সম্বোধন করেন।

শীঘ্রই কলকাতার শিক্ষিত সমাজ তাঁর সাধনালব্ধ জ্ঞান, কামিনী-কাঞ্চন বিমুক্ত জীবন, সংগীত ও সরল দৃষ্টান্ত দিয়ে ধর্মের কঠিন তত্ত্বসমূহ বোঝানোর শক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত শুরু করে ও তাঁকে যুগাবতার পরমহংস বলে ঘোষণা করে। দক্ষিণেশ্বর তীর্থস্থানে পরিণত হয়। শিবনাথ শাস্ত্রী, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, কেবশচন্দ্র সেন, গিরিশচন্দ্ৰ ঘোষ, ড. মহেন্দ্রলাল সরকার, মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (শ্রীম) প্রমুখ বহু ব্যক্তি তাঁর সংস্পর্শে আসেন। এছাড়া, ছিল তাঁর অন্তরঙ্গ ভক্তমণ্ডলী। তাদের মধ্যে তার প্রিয় শিষ্য ছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, পরবর্তীকালের স্বামী বিবেকানন্দ।

রামকৃষ্ণই বঙ্গীয় যুবকসমাজকে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার প্রভাবে সাহেবিয়ানার অনুকরণ থেকে মুক্ত করেন। তাঁর মতে সমাজের মঙ্গল ও সেবার মধ্যে বাঁচার আদর্শ ঈশ্বরলাভের প্রকৃষ্ট পথ। তাঁর প্রচারিত শক্তি উপাসনাই বিংশ শতাব্দীতে বিপ্লবীদের অস্ত্রধারণ করার মনোবল যোগায়।

ছয়

তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর প্রিয় শিষ্য বিবেকানন্দ বরাহনগরে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর পরিব্রাজক হয়ে ভারতের নানা স্থান ঘুরে, বিদেশে গিয়ে বক্তৃতা করে ভারতের ধর্মমত ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে বিদেশীদের ভ্রান্ত ধারণা দূর করে বিদেশীদের শ্রদ্ধা বহুগুণে বর্ধিত করেন। ভারতকে তিনি এক নবজাগরণের বাণী শোনান ও যুবসমাজকে নতুন কর্মপন্থার নির্দেশ দেন। নিজে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি না করলেও তিনি ভারতীয় যুবসমাজের প্রাণে ও রাষ্ট্রজীবনে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি ও উদ্বোধন এনে দেন, যার ফলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক নতুন কর্মশক্তি পায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *