ধর্মতলা-টু-কলেজ-স্কোয়ার

ধর্মতলা-টু-কলেজ-স্কোয়ার 

ধর্মতলার মোড়ে ট্রামে উঠিলাম, “চিঠি’র অফিসে যাইতে হইবে। 

একটু অগ্রসর হইয়াছি এমন সময় রব উঠিল, এই, বাঁধো, বাঁধো—লেডি!

একদমসে বাঁধ করকে; স্ত্রীলোক উঠতা হ্যায়! 

ঘুরিয়া দেখিলাম, একটি চব্বিশ-পঁচিশ বৎসরের যুবক মন্দগতি ট্রামের পাশে পাশে পা চালাইয়া অগ্রসর হইতেছে। রডটা ধরিবার জন্য ডান হাতটা উঁচু করা। উঠিবার উপক্রম করিতেছে, কিন্তু উপযুক্ত সাহস সঞ্চিত না হওয়ায় একেবারে থামিয়া না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিতেছে। 

আমার পাশের বেঞ্চে অত্যন্ত মোটা কাচের চশমা পরা একটি প্রবীণ ভদ্রলোক বসিয়া ছিলেন। হাত-পাঁচেকের পরেই সব ঝাপসা দেখেন বলিয়া বোধ হইল, এবং সেই জন্য হাত-পাঁচেকের বাহিরে চারিদিকেই দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রহিয়াছে মনে করিয়া খুব সতর্ক। একবার পিছন ফিরিয়া দেখিয়া লইয়া একটু রাগতভাবে ড্রাইভারকে বলিলেন, এই, ডেড স্টপ করো। লেডি উঠতা হ্যায়, শুনতা হ্যায় নেহি? 

হাসি পাইল, লেডিই বটে। 

তুলতুলে মেয়েলি ঢঙের চেহারা। ফাঁপা চাদর, সিল্কের পাঞ্জাবি আর লটপটে কাপড়েও অনুরূপ ভাব। সলজ্জ এবং সংকুচিত—এই ট্রাম সম্পর্কিত ব্যাপারে লজ্জা—সংকোচে যেন আরও লুটাইয়া গিয়াছে। ট্রামটা নিশ্চলভাবে থামিয়া গেলে উঠিয়া কয়েকজনের দিকে চকিতভাবে চাহিয়া দৃষ্টি নত করিল। 

একটি মেয়ে ট্রামের পিছনের বারান্দাটিতে একটা রড ধরিয়া দাঁড়িয়াছিল। যুবক উঠিতেই নিম্নস্বরে বলিল, চলো, সামনের সিটটায় গিয়ে বসি, খালি আছে। 

এতক্ষণে ভুলটা বুঝিতে পারিলাম, এই তাহা হইলে ‘লেডি’। 

কালোর উপর বেশ সুশ্রী। একটা টকটকে লাল শাড়ি পরা। পায়ে অল্প একটু উঁচু—গোড়ালির জুতা, হাতে একটি খর্বাকৃতি ছাতা। সঙ্গীর অবস্থায় একটু লজ্জিত হইয়া পড়িয়াছে, তবুও ভাবটা বেশ সপ্রতিভ। 

দুইজনে একটু অগ্রসর হইল। 

যুবক বলিল, তুমি এই লেডিজ সিটেই বসো না। আমি বরং ওখানটায় গিয়ে বসছি। 

অর্থাৎ গা-ঝাড়া দিতে চায় ও। ভিড়ের মধ্যে মেয়েটির সান্নিধ্যে যে কুণ্ঠা, তাহা কোনও মতেই কাটাইয়া উঠিতে পারিতেছে না। মেয়েটি নিশ্চয় তাকে চেনে, বেশ একটু দৃঢ়তার স্বরে বলিল, আচ্ছা, এস তো তুমি। 

আমার সামনে একটি বেঞ্চ খালি ছিল; সেইটিতে গিয়া দুইজনে বসিল। একটু চুপচাপ গেল, তাহার পর মেয়েটি মাথা নামাইয়া ধীরে ধীরে বলিল, আমার এমন হাসি পাচ্ছে! 

যুবক কারণটা যে বুঝে নাই এমন নয়, তবু জড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, কেন? 

মেয়েটা ঘুরিয়া একবার পিছনে চাহিল। আমি একটা খবরের কাগজ পড়িতেছিলাম, সেটা সঙ্গে সঙ্গেই তুলিয়া ধরিতে আমার মুখ দেখিতে পাইল না। নিজের পড়া লইয়া আছি ভাবিয়া নিশ্চিন্তস্বরে কহিল, কেন আবার।তোমার কাণ্ড দেখে। সবাই ‘লেডি হ্যায়—বাঁধকে, লেডি হ্যায়—বাঁধকে’ করছে, লেডির সাহস হচ্ছে না যে টপ করে উঠে পড়বেন। আগেভাগে উঠে পড়ে এমন লজ্জা করছিল আমার। তোমায় ঠাট্টা করে সব লেডি বলছে, কী আমায় ইঙ্গিতে টম-বয় বলছে!…এমন জ্বালায়ও পড়ে মানুষে 

একটু তরল হাসি উঠিল। 

উত্তর হইল, গেলে কেন উঠতে না থামতেই? 

অপরাধ হয়েছিল। লেডি সঙ্গিনীকে আগে তুলে দেওয়া উচিত ছিল বটে।

আর একটু হাসি ছলছল করিয়া উঠিল। তারপর— 

আজকে কেমন আমার অনেকদিন পরে স্কুলের খেলাধুলো ড্রিল, স্কিপিঙের কথা মনে পড়ে গেল, বাপু! অতশত ভাববার আগেই টুপ করে কখন উঠে পড়লাম। আর ট্রামটা তখন মোটে চলতে আরম্ভ করেছে। তবু কী ভাবলে লোকে কে জানে ভাবুক গে! বয়ে গেল। 

আঃ, সবাই শুনতে পাবে; কী করছ? 

সাহেব মেম আর কী বুঝবে? 

ফিসফিস করিয়া প্রশ্ন হইল, আর পেছনে? 

ফিসফিস করিয়া উত্তর হইল, হিটলার অস্ট্রিয়া দখল করছে—ছ’ ইঞ্চি টাইপের বোল্ড হেডলাইন।—উনি এখন জার্মেনিতে; সেখান থেকে ধর্মতলার কথাবার্তা শোনা যায় না। 

হাসির ছলছলানি একটু লাগিয়াই আছে। 

যুবক একবার নিশ্চয় ঘুরিয়া দেখিল। সত্যই কাগজ পড়িতেছি দেখিয়া অনেকটা আশ্বস্ত হইয়া থাকিবে, বলিল, না শোনা যায় না। বরং— 

মেয়েটি প্রশ্ন করিল, বরং কী, বলেই ফেল। কেউ আমাদের আলাপ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। আর ঘামালেও শুনতেই পাব বড়! পুরোনো ট্রামের এই একটা মস্ত সুবিধে। এটার আবার কোথায় কী একটা ঢিলে হয়ে গেছে। 

বলছিলাম—বরং কাছে সুন্দরী বসে থাকলে হিটলারের বিজয়ের কথাই অতি সামান্য বলে মনে হয়। 

কালো আবার সুন্দরী! 

সুন্দরী আবার কালো! 

এবার তাহার একলার হাসি নয়, দুইটি ঘরের মিশ্র হাসি উঠিল, অবশ্য চাপা,— যুবকটির বেশি চাপা 

একটু নীরব। আবার হিটলারে মনসংযোগ করিব, প্রশ্ন হইল, আচ্ছা, আমি কাছে রয়েছি বলে তুমি এমন গুটিসুটি মেরে রয়েছ কেন বলো দিকিন? যেন ভয়ে সারা! আমি প্রথমেই বলেছিলাম—তোমার কর্ম নয়। ল কলেজের ফার্স্ট বয় হলেই হয় না, বড্ড মর‍্যাল কারেজের অভাব তোমার। আমি তো তোমার সঙ্গে রয়েছি বলে কাউকেই গ্রাহ্য করি না। পাশে যখন নিজের— 

এই সময় ট্রামটা দাঁড়াইয়া পড়ায় বাক্যটা অসমাপ্ত রহিল। 

আমাদের সামনে এই সময় কয়েকটা সিট খালি হইল। একটি ইংরেজ যুবক আসিয়া একটাতে বসিতে যাইয়া হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল এবং আমাদের যুবক দম্পতির সামনের সিটে উপবিষ্ট সাহেবটির দিকে চাহিয়া বলিয়া উঠিল, হ্যালো জোন্‌স, তুমি এখানে! জামালপুর থেকে কবে এলে? 

জোন্‌স করমর্দনের জন্য হাত বাড়াইয়া বলিল, পরশু এসেছি। তোমাকে আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দি। তোমার ঠিকানা কোনওমতেই জোগাড় করতে পারলাম না, খবর দিতে পারিনি, মার্জনা করো। 

আগন্তুক বন্ধু পত্নীর সহিত করমর্দন করিয়া কুশলাদি প্রশ্ন করিল। ওদের একেবারে সামনের দুটো সিট—তিনজনের কথাবার্তা জমিয়া উঠিল। ইতিমধ্যে ট্রাম ছাড়িয়া আওয়াজটা বাড়িয়াছে। মেয়েটি প্রশ্ন করিল, আচ্ছা, যাচ্ছ তো আমায় নিয়ে ওভারটুন হলের মিটিঙে। ধরো, যদি কোনও বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়, এই রকম ভাবে ইনট্রোডিউস করে দিতে পারবে? 

যুবকটি শুষ্ক কণ্ঠে বলিল, নিশ্চয়, এ আর কী শক্ত? 

কী বলবে? 

বলব— 

কন্ডাকটার আসিয়া দাঁড়াইল। আমি মাসিক টিকিট তুলিয়া ধরিলাম। যুবকটির সামনে গিয়া দাঁড়াইল। সঙ্গটা মন্দ লাগিতেছিল না। আমি কাগজের উপর দিয়া দেখিতে লাগিলাম কত দূরের দৌড়। যুবক একটু ইতোস্তত করিল, তাহার পর একটা আট-আনি বাহির করিয়া বলিল, শ্যামবাজার 

মেয়েটি একটু আশ্চর্য হইয়া বলিল, সে কী? কলেজ-স্কোয়ারে নামবে না?

যুবক একটু অপ্রতিভভাবে দুর্বলকণ্ঠে বলিল, শ্যামবাজার চলো না! 

বাঃ রে! মিটিং কলেজ স্ট্রিটে, ওভারটুন হলে, আর যাবে শ্যামবাজারে? 

আরও দুর্বল সন্ত্রস্ত কণ্ঠে উত্তর হইল, আঃ, আস্তে। 

কন্ডাকটার একটু অসহিষ্ণুভাবে বলিল, কোথাকার দোব ঠিক করে ফেলুন।

মেয়েটির মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কলেজ-স্কোয়ার? 

কাগজের উপর হইতে দেখিলাম—মেয়েটি একবার সঙ্গীর দিকে চাহিল। মুখ দেখিতে না পাইলেও বুঝিলাম তাহার অবস্থা তখন অতীব শোচনীয়। 

মেয়েটি কন্ডাকটারের দিকে চাহিয়া বলিল, না, শ্যামবাজার। 

স্বর হঠাৎ গম্ভীর হইয়া গিয়াছে। ট্রাম তখন মোড় ফিরিয়া ওয়েলিংটন স্ট্রিটে প্রবেশ করিতেছে। টিকিট লওয়ার পর মেয়েটি ঘুরিয়া পার্কের দিকে মুখ করিয়া বসিল। 

বুঝিলাম—রসভঙ্গ হইয়াছে, এবার নিঃঝুমের পালা চলিবে। কাগজগুলা ঠিক করিয়া লইয়া আবার হিটলার অভিযানে মনোনিবেশ করিয়াছি, এমন সময় জার্মেনি থেকে শুনিলাম—গাঢ়, অনুতপ্ত, ভাবাকুল স্বরে অনুযোগ হইতেছে, রাগ করেছ? 

স্বর লক্ষ করিয়া বুঝিলাম—মুখটাও রোষান্বিতার ঘাড়ের কাছাকাছি আসিয়া পড়িয়াছে, নিতান্ত যদি ঘাড়ে নাই পড়িয়া থাকে। একটু শঙ্কিত হইলাম, ছেলেমানুষদের কাণ্ড, ট্রামের মধ্যেই জ্ঞান হারাইয়া কিছু একটা করিয়া না বসে। একটু গলা খাঁকারি দিলাম। 

কিন্তু আমাকে যাহারা জার্মেনি প্রবাসের অপবাদ দিয়াছিল, তাহারা নিজেই এখন শুধু অন্য দেশে নয়, একেবারে অন্য লোকে। কোনও ফল হইল না। 

শুনছ? রাগ হল নাকি? 

একটু চুপচাপ। আবার — 

কেন যে শ্যামবাজারের টিকিট করতে চাইছিলাম, একবার তো জিজ্ঞেসও করলে না। রাগ! 

বুঝতে পেরেছি; জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। ওভারটুন হলে যদি আবার কারুর কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় সেই ভয়ে। 

যে পরিচয়ে গর্ব, তাতে ভয়? 

থামো, খুব গর্ব!—গর্ব না লজ্জা–কালো নিয়ে; তাই তো এড়িয়ে যাচ্ছ।

আরও চাপা গদগদ স্বরে উত্তর হইল, আমার কালোর কাছে কোনও ফরসা দাঁড়াত একবার দেখতাম— 

ওঃ! তা কেন শ্যামবাজারের টিকিট করা হচ্ছে শুনি? 

স্বর পরিবর্তন হইয়াছে, কঠিন বরফে তরলতা আসিয়াছে একটু। যাক, ল কলেজের ফার্স্ট বয়, বাঙালি যুবক, সে চলতি ট্রামে উঠিতে না পারুক, কথায় সে মন ভিজাইতে পারিয়াছে, ইহাতে আশান্বিত হইলাম; ওই করিয়াই তো খাইবে। প্র্যাকটিসও হইতেছে জজ সাহেবের চেয়ে কড়া এজলাসেই। আহা, ভালো! 

যুবক সেই রকম গাঢ় স্বরে বলিল, বলব? 

শুনিই না। 

আজ মিটিং-ফিটিং ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে, দুজনে সব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আজকের দিনটা কাটাই। কতটুকুই বা পাই তোমায় নন্দা? 

কথাটা নিশ্চয় অন্য তরফের মর্ম স্পর্শ করিল। কোনও উত্তর হইল না খানিক্ষণ আবার আপিল হইল, কী মত তোমার? 

আমার আবার আলাদা মত আছে নাকি? তা কোথায় কাটাবে? সিনেমা?

সিনেমায় কি পরস্পরকে পাওয়া যায়, নদু। এদিকে কায়ার ভিড় ওদিকে ছায়ার ভিড়—বাস্তবে অবাস্তবে ওখানে অনুভূতিটাকে আধখেঁচড়া করে দেয়।—তুমি থাকবে পাশে অথচ সে কথা ভুলে এক অলীক ছায়ালোকে তোমার পেছনে ঘুরব, কখনও নাগাল পাব না। আমি তোমায় চাইছি, পেয়েওছি, অথচ বিরহী যক্ষের মতো—

ট্রাম বউবাজারের মোড়ে দাঁড়াইল। একটু উঠানামা চলিল, পুরাতনের স্থানের নূতনরা আসিয়া বসিল। বিশ্রম্ভালাপ একটু স্থগিত রহিল। আমি অস্ট্রিয়া অভিযানের আর একটা প্যারাগ্রাফ শেষ করিলাম। সামনে সাহেব-দম্পতির পরিত্যক্ত সিটে একটি বৃদ্ধ বাঙালি ভদ্রলোক আসিয়া বসিলেন। মেয়েটি অতি সাধারণ ঔৎসুক্যের কণ্ঠে কতকটা জোরেই যুবককে প্রশ্ন করিল, আচ্ছা, এপ্রিল থেকে শুনেছি আমাদের ই, আই, আর, কর টাইম অনেক চেঞ্জ করবে, সত্যি নাকি? 

অর্থাৎ এই ধরনের কথাই এতক্ষণ হইতেছিল এবং পরেও হইবে; প্রতিবেশী আমাদের অযথা ঔৎসুক্যের প্রয়োজন নাই। অস্ট্রিয়ার স্বাধীনতার লোপ সুখের না হইলেও আমায় কাগজের আড়ালে হাসিতে হইল। এরা আমাদের ভাবে কী? অথবা আমরাও বোধ হয় এককালে এই করিয়াছি সবাইকে এই রকমই ভাবিয়াছি—আজ আর মনে নাই। ট্রাম চলিয়া আবার শব্দ আরম্ভ হইল। 

যুবক আবার নিম্নকণ্ঠে বলিল, এই ধরো ‘দেশবন্ধু পার্ক’ কিংবা আরও দূরে দমদম এরোড্রোমের দিকে, কিংবা— 

মেয়েটি উল্লসিত হইয়া উঠিল। বলিল, চলো, সত্যি চলো। দমদমাই ভালো; না, আর দ্বিধায় কাজ নেই। 

আঃ, আস্তে। 

বাবাঃ, ভয়েই সারা! 

বলছ তো যেতে, কিন্তু হবার উপায় নেই যে! 

শঙ্কিতকণ্ঠে উত্তর হইল কেন? 

ওভারটুন হলের সামনে যতীন আর তিমির দাঁড়িয়ে থাকবে বলেছে—তোমার অভ্যর্থনা করবে। 

একটু চুপচাপ গেল। এদিকে অভ্যর্থনা ওদিকে দমদমা। তাহার পর মেয়েটি মীমাংসার স্বরে বলিল, না, দমদমা যেতেই হবে কোনও রকমে। 

একটু আবদারের সুরে উত্তর হইল, আমি কিছু শুনব না—আমার মিটিং-ফিটিং একেবারে ভালো লাগছে না। বিয়ের আগে ওসব হুডুন্দুম করে বেড়ানো শোভা পেত। আর এখন— 

এখন দমদমায় গিয়ে উড়ে বেড়ানো! 

ঠাট্টা রাখো। বুঝিলাম মুখ আবার অন্যদিকে ফিরিয়াছে! 

বিমুখভাবেই উত্তর হইল, বাবা-মা ভাগলপুর থেকে ফিরলেই বলব, তাঁরা নেই দেখে আমায় ভুজুংভাজুং দিয়ে মিটিঙে একপাল লোকের মধ্যে নিয়ে গিয়ে— 

স্ক্রিয়াশ্চরিত্র! ভদ্রসন্তানকে তো বড়ই ফাঁফরে ফেলিল মেয়েটা। কিন্তু আমার হাতে তো কোনও রকম উপায় ছিল না, থাকিলেই বা ট্রামের এই ক্ষণরচিত অন্তঃপুরে প্রবেশের পথ কোথায়? অধিকারই বা কী? চুপ করিয়া বসিয়া ঘটনা কী ভাবে বিকশিত হয় তাহারই অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। 

শানু! 

ওই যুবক ওই মেয়েটিকেই ডাকিল। এরিই মধ্যে ‘নন্দ’, ‘নদু’, ‘সনু’ আবার এই ‘শানু’। টুকরা এই পাপড়িগুলির মূলপুষ্প কি—সুনন্দা? যাই হোক বড় বেদনা বোধ হইতেছিল। নামের প্রতি অক্ষরের মধ্যে যে এতটা মধু পাইয়াছে, তাহার এই বঞ্চনা।

কোনও উত্তর নাই। প্রশ্ন হইল, কিন্তু এ অবস্থায় করাই বা যায় কী বলো না? যা বলবে, তাই করা যাবে না হয়। 

সংক্ষিপ্ত উত্তর হইল, দমদমা। 

কিন্তু কী করে হবে? তারা পথ আগলে রয়েছে যে। 

এ পথ ছেড়ে দাও। 

ঘুরে? বউবাজার দিয়ে? 

একটু থামিয়া আবার করুণকণ্ঠে, কিন্তু কন্ডাকটারটা জানে আমরা শ্যামবাজারের টিকিট করেছি—পাশের সব ভদ্রলোকেরাও দেখেছে শ্যামবাজারের টিকিট করতে। কী ভাববে বলো তো?—উঠলেই কন্ডাকটার বলবে শ্যামবাজার এখানে নয় বাবু। আর গাড়িসুদ্ধ লোক শ্যামবাজার কোথায় তা বলবার জন্যে হামড়ে উঠবে;—সঙ্গে মেয়েছেলে দেখলে উপকার করবার জন্যে কী রকম হন্যে হয়ে ওঠে সব দ্যাখোনি তো… 

সেই সংকোচপীড়িতা ব্রীড়াময়ী লেডি! 

এত আপিল-উপরোধের পর আবার একটি সংক্ষিপ্ত উত্তর হইল, কন্ডাকটারকেই খুশি করো তা হলে। 

যুবক বিপন্নভাবে একবার এদিক-ওদিক চাহিল; অস্ফুটস্বরে বলিল, কী যে করি! মেডিকেল কলেজ এসে পড়ল এদিকে। 

আমিও উদবিগ্ন হইয়া পড়িতেছিলাম। আদ্যোপান্ত শুনিয়া উদবিগ্ন না হইয়া গতি ছিল না। আহা! আর বোধ হয় দুটো মিনিট, তাহার পরই সংসারের ভাণ্ডার থেকে অতি কষ্টে অপহৃত এই কয়টি ঘণ্টা একেবারে নিষ্ফল হইয়া যাইবে। ওদের ওভারটুন—হলে আর মন নাই। যুবকের বোধ হয় সংকোচ, কিন্তু তাহার সঙ্গিনীর মন যে সত্যই মুক্তপক্ষ হইয়া উধাও হইয়াছে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। বাড়ির তুলনাই ওভারটুন ছিল মুক্ত, কিন্তু দমদমার কাছে তাহাই হইয়া পড়িয়াছে পিঞ্জর। দুইটি মিনিট, ওদের আজকের দিমের চরম কথাটি এরই মধ্যে। 

—কোনও উপায় নাই? 

এই সময় সামনে একটা রিকশা বাঁচাইতে ট্রামের হঠাৎ ব্রেক দেওয়ায় সবাই যেন হোঁচট খাইয়া সামনে ঝুঁকিয়া পড়িলাম। আমি কাগজসুদ্ধ যুবকটির বেঞ্চের পিঠে গিয়া পড়িলাম। নিজেকে সামলাইতে হাতের কাগজটা তাহার পাশে ছিটকাইয়া পড়িল। যুবক উঠিয়া বসিয়া কাগজটা আমার হাতে তুলিয়া দিল; একটু যেন সন্দেহের সহিত আমার চোখের দিকে একবার চকিত দৃষ্টি হানিল। আমি কাগজটা লইয়া সহজভাবে বলিলাম, থ্যাঙ্কস। 

আবার না-পড়ার পড়া শুরু হইল। 

ট্রাম আবার চলিতে আরম্ভ করিল। যুবক কতকটা নিজের মনে কতকটা সঙ্গিনীকে শুনাইয়া বলিল, যদি একটা খবরের কাগজও হাতে থাকত, তা হলেও 

মেয়েটি গ্রীবা ঘুরাইয়া প্রশ্ন করিল, কী হত তা হলে? 

তা হলে ওই জায়গাটুকু—ওভারটুনের সামনে দুজনে আড়াল হয়ে বসতাম— কাগজের আড়াল দিয়ে। ওরা তো আর ট্রামে উঠে দেখতে আসত না! 

মনে হইল, যেন স্বামী-গরবিনি প্রশংসাদীপ্ত নেত্র তুলিয়া চাহিল।—এটা আমার নিছক কল্পনা হইতে পারে, কিন্তু এর পরের নীরবতাটুকুতে যেন এই ছবিই ফুটিয়া উঠিল। অন্তত সে যে ঘুরিয়া বসিয়াছে, তাহাতে আর সন্দেহ রহিল না আমার। 

একটু পরে শুনিলাম, খবরের কাগজ তো রয়েছে। 

কই? 

পেছনে। 

ধ্যাৎ, চাওয়া যায় কখন। 

মেয়েটি ঘেঁষিয়া আসিল। আরও নিম্নকণ্ঠে বলিল, এক উপায় ঠাউরেছি; কিন্তু তুমি যা মেয়ে-মুখো। আমি শুনিয়ে শুনিয়ে তোমায় জিগ্যেস করি—কোয়ালেশন মিনস্ট্রি ফরম করবার কী হল বলতে পার? তুমি বলবে—না, আজকের কাগজটা মোটেই পড়া হয়নি, অথচ ভয়ানক আগ্রহ জেগে রয়েছে। তা হলেই ভদ্রলোক ভদ্রতা করে কোনও না কাগজটা একবার বাড়িয়ে দেবেন। অর্ধেক পড়ে অমৃতবাজারটা যদি না ফেলে আসতে তাড়াতাড়ি…। তা হলে আমি শুরু করছি (প্রকাশ্যকণ্ঠে)—আচ্ছা, কোয়ালি…। যুবক এরকম শিহরিয়া উঠিয়া তাহার বাম হাতটা চাপিয়া ধরিল, চাপা ত্রস্তস্বরে বলিল, না না না, না নদু, ছিঃ। 

আবার সেই ‘লেডি’! 

ট্রাম কলেজ-স্কোয়ারের সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। কী নীরব অসহায় উদ্‌বেগ! আমিও নিশ্চিন্ত ছিলাম না। মাথায় একটি মতলবও আসিয়াছে, কিন্তু দারুণ দ্বিধায় মনস্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না। আর কিন্তু সময় নাই; এর পরের স্টপেজ একেবারে ওভারটুন-হলের সামনে। 

আমি কাগজটি সিটে রাখিয়া দিয়া বেশ জানান দিয়া সাড়ম্বরে উঠিয়া পড়িলাম। দরজার দিকে পা বাড়াইতে এক মাড়োয়ার ভদ্রলোক বলিলেন, বাবুজি, আপনার অখবার রইল যে! 

আমি ঘুরিয়া দেখিলাম। পলক মাত্রের দ্বিধা, তাহার পর বিমূঢ়দৃষ্টি যুবকটিকে দেখাইয়া ভদ্রলোকটিকে বলিলাম, না, কাগজটা ওর; পড়তে নিয়েছিলাম। 

ফল কী হইল, আর ফিরিয়া না দেখিয়া তাড়াতাড়ি নামিয়া পড়িলাম। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *