ধরিত্রী – জীবন সরকার
সূর্যের আলো গাছের মাথায় হেলেছে। সোনা আলোয় শস্যের জমিতে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। একটা শান্ত স্নিগ্ধতা মাঠময়। ধরিত্রী ফিরছে। শরীর ক্লান্ত। আগের মত হাঁটতে পারছে না। একটু জোরে পা না চালালে বাড়ীতে পৌঁছুতে রাত হয়ে যাবে। রাত্রে চলতে পারে না ধরিত্রী। চোখটা একটু ঝাঁপসা।
তাছাড়া আগের মত মনের জোর নেই। সব যেন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। কাঁহাতক আর পারা যায়। এই ঘরে তো আর কমদিন আসা হল না। সবকিছু মনে এলে ধরিত্রীর চোখ বেয়ে জল আসে। অবশ্য কিছু ঠিকমত মনে পড়ে না। কোথায় জন্ম। কোথায় দেশ এসব কিছুই জানে না। শুধু জানে অন্যের বাড়ীতে মানুষ হয়েছে। প্রথম। প্রথম ভাবতোমাদের বাড়ীতে ছিল তারাই। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে বুঝতে পারছে ওরা কেউ নয়। ওদের আশ্রয়ে থাকে মাত্র। বিনিময়ে ওরা খেতে দেয়। বাড়ীর গিন্নীমাকে মা বলে। গিন্নীমাও ওকে মেয়ের মত স্নেহ করতেন। তিনিই ওকে বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের পর যার ঘরে এল তারও কুিলে কেউ ছিল না। ছিল থাকার মধ্যে একটা ছোট্ট বসত বাড়ী। আর লাগোয়া এক ফালি জমি। বাজারের ব্যবসায়ী মতিবাবুর এই জমিটার ওপর রাবারের লোভ। জমিটা এমন জায়গায় যেখানে এখন রমরমা বাজার। কি নেই ওখানে, বাজার, স্কুল, হাসপাতাল। একটু দুরে রেল স্টেশন। মতিবাবু জমিটার জন্য টাকার অফার দিয়েছে। ধরিত্রীও ফিরিয়ে দিয়েছে। এই জন্যে মতিবাবু কম পিছনে লাগেনি। উঠতে বসতে নানা ফন্দি ফিকির করছে, কি করে জমিটা হাতানো যায়।
মানুষটা থাকতে মতিবাবু কাছে আসতে সাহস পেত না। কিন্তু সেই মানুষটা হঠাৎ চলে গেল। কি যে ব্যামো হ’ল! হাসপাতালের ডাক্তাবাবুরা কিছু করতে পারেনি। ধরিত্রী। একটু ঘরকুণো স্বভাবের ছিল। লাজুক প্রকৃরি। কিন্তু সেই সময় ঘর থেকে বেরিয়েছে, ডাক্তারবাবুদের পায়ে পড়েছে। সিস্টারদের হাত ধরেছে। ধরিত্রীর বার বার যাতায়াতের ফলে ওরা ওকে কাছে টেনে নিয়েছে। ওর স্বামীর জন্যে আন্তরিক চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু কিছু করতে পারেনি। মানুষটা সব চেষ্টার মুখে ছাই দিয়ে পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছে।
এই সমস্ত পুরনো কথা মনে পড়ায় ধরিত্রীর চোখে জল এল। সংগে সংগে এক ঝক পাখী উড়ে গেল দূরের আকাশে। ধরিত্রী একটু থমকে দাঁড়ালো। কোমরে কিরম একটা ব্যথা অনুভব করছে। পা দুটোও খসে যাচ্ছে। আর পারছে না হাঁটতে। কি করে বাড়ী অবধি পৌঁছুবে সেটাই ভাবনা। এখন এই অবস্থায় কারুর সঙ্গে দেখা হোক, এটাও চাইছে না। কারণ দেখা হলেই অসুখের নানারকম ফিরিস্তি শুনতে হবে। কেউ কেউ। ওষুধের জন্যে ধরবে। নয়তো জোর করে ডেকে নিয়ে যাবে বাড়ি। হয়তো কারো জ্বর হয়েছে বা পায়খানা বমি বা কোন জায়গায় কেটেকুটে গেছে। কেননা ধরিত্রী ওদের কাছে। এখন মাদার। এই অঞ্চলে কাছাকাছি ডাক্তার নেই। বাড়াবাড়ি হলে শহরে যেতে হবে। তার সময় কোথায়, টাকা কোথায়। হারে কাছে মাদার— তার শরণাপন্ন হয়। ধরিত্রী কি করে যে ওই হাসপাতালের মাদার হয়ে গেল, তা আজ গল্পের মতো।
ধরিত্রী বসেছিল বাড়ীর দাওয়ায়। চুল এলোমেলো। কেঁদে কেঁদে মুখ-চোখ ফুলে গেছে। সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন হাসপাতালের সিনিয়র নার্স কমলা বোস। ধরিত্রীকে ঐ অবস্থায় দেখে থমকে দাঁড়ালেন। কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কাঁদছ কেন? ধরিত্রী কিছু বলল না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিল শুধু। কমলা বোসের তাড়া ছিল। অবাক চোখে তাকিয়ে শুধু বলেছিলেন, মনটা কোথায় রে? মানুষটা চলে যাওয়ার পর আরও অনেকে এসেছিল। গিন্নীমার বাড়ী থেকেও লোক এসেছিল। ওদের বাড়ীতে যেতে বলেছিল। ধরিত্রী নিজের ভিটে ছেড়ে যেতে চায়নি। অন্যান্য মানুষজনের মধ্যে মস্বািবুও ছিলেন। মতিবাবুও বলেছিলেন তার গরীবখানায় যেতে। ধরিত্রী যায়নি।
ও যেন বুঝতে পেরেছিল—অভিসন্ধি ভাল নয়। কারণ ধরিত্রী তরতাজা যুবতী। গরীব ঘরের মেয়ে হলে কি হবে। চাল-চলনে একটা দৃঢ়তা, চেহারায় একটা আলগা চটক—সকলকেই টানত। যার ফলে গিন্নীমা ঘরে রাখতে সাহস পায়নি। তাদেরই জানোনা হাবুলের সংগে বিয়ে দিয়েছিলেন। হাবুলও গিন্নীমাদের বাড়ীতে কাজ করতো। জমির চাষবাষ দেখত। গরুর দেখাশোনা করত। ধরিত্রীর তখন মনে হয়েছিল কষ্টের দিন বুঝি শেষ হ’ল। দীর্ঘদিন পরে নিজের করে বাড়ী আর একফালি জমি পেয়েছিল বলে মনে মনে ভীষণ খুশী হয়েছিল। কিন্তু সেই সুখ বেশীদিন টিকল না। নিজের কপালকেই মেনে নিয়েছে ধরিত্রী। কাউকে দোষী করেনি।
মানুষটা চলে যাবার পর বাড়ীতে ধরিত্রীর একা থাকা দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। চারিদিকে উৎপাত। বিশেষ করে মতিবাবুর খপ্পর থেকে বাঁচবার জন্যে একটা রাস্তা খুজছিল, কিন্তু কিছুতেই রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিল না। কোন কোনদিন আচমকা মতিবাবু বাড়ীতে ঢুকে যেত। কণ্ঠে সোহাগ মাখিয়ে বলত—ও ধরিত্রী, ভেবেছিস, কি করে চলবে?
ধরিত্রী সেই কথার কোন উত্তর দিত না। পাশ কাটিয়ে অন্য জায়গায় চলে যেত। মআিবুও ছাবার পাত্র নয়। বলতো—তোর যদি কোন কিছুর দরকার হয় তাহলে বলিস। ভয় কি! আমি তো আছি। টাকার দরকার হলে বলিস। হ্যাঁ, ভাল কথা। সামনের ওই চিলতে জায়গাটা তো খালি পড়ে রয়েছে। শুধু শুধু ফেলে রেখে লাভ কি? ওটা আমাকে দিয়ে দে আমি ভি ডি ও ঘর বসাবো। ভাল দাম পাবি।
জমির প্রসঙ্গ এসে পড়লেই ধরিত্রী রুখে দাঁড়াত। রাগে ওর শরীর কাঁপতে থাকত। চোখের দৃষ্টিতে আগুন হেনে বলত, খদার! ও কথা কখনও মুখে আনবেন না। জেনে রাখুন, এই আব্দার রাখা আমার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। মরািবু ঘাবড়াবার পাত্র নন। সেঁতো হাসি হাসতেন—ঠিক তা নয়। তোকেই যে দেখতে আসিনি সেটা কি করে ভাবলি। মতিবাবুর কথার এই ধরনের ইঙ্গিত বুঝতে অভ্যস্ত ধরিত্রী। তাই মতিবাবুর এই ধরনের কথার কোন উত্তর না দিয়ে বাড়ীর বাইরে বেরিয়ে পড়ত।
হাবুলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আজ ক’বছর। কিন্তু ঘরে নতুন মানুষ আসার আগেই আসল মানুষটা চলে গেল ধরিত্রীকে ফেলে। এই ঘরে নতুন মানুষ না আসার ব্যাপারটা নিয়ে আনাচে-কানাচে কানাঘুষো হতো। কেউ কেউ ঠাট্টাচ্ছলে হাবুলকে বলতো, ঘরের বউ দেখতেই সুন্দরী কাজের নয়। হাবুল মুচকি হাসত, কিন্তু কোনদিন কিছু বলেনি। চুপি চুপি ঘোষকাডাঙা শীতলা মার মন্দিরে গিয়ে মানত করে আসতো। সেই কথা ঘরে এসে ধরিত্রীকে বলতো। ধরিত্রী সেই কথা শুনে চুপ করে যেত। ইচ্ছে করতে কাঁদতে। এক একদিন কেঁদেই ফেলতো। হাবুল ওকে সান্ত্বনা দিত—কাঁদতে নেই বৌ। সময়কালে সব হবে। এত ব্যস্ত হওয়ার কি আছে। এই তো বেশ আছি। ধরিত্রী কাদ কাঁদ হয়ে উত্তর দিত, কবজ নেব। আমাকে নিয়ে যাবে জল্পেসের মেলায়?
—এখন কি! মেলার তো দেরী আছে। যাওয়া যাবে। কিন্তু জঙ্গেস আর যাওয়া হয়নি। তার আগেই মানুষটা হঠাৎ করে না বলে কোথায়। চলে গেল। মানুষটার কথা মনে হলেই চোখে জল আসে। সময়ে-অসময়ে আনমনা ভাবে ট্রেন লাইনের দিকে তাকিয়ে থাকে ধরিত্রী। ট্রেন ছুটে গেলে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ। এই ট্রেনে করেই জল্পেসের মেলায় যাবার কথা ছিল হাবুলের সঙ্গে।
এখন বাড়িতে একা নিঃসঙ্গ একটা জীবন। ছেলেটা যদি বাড়ীতে থাকত, তাহলে সহজেই মতিবাবুকে ঠেকাতে পারতো। মেয়ে মানুষ হয়ে ঐ পিশাচটাকে কি সহজে ঠেকানো সম্ভব? মনে মনে দিনের পর দিন মাথায় নানারকম ফন্দি-ফিকির এসেছে গেছে। এইরকম অবস্থায় মনের সংগে যুদ্ধ করে করে যখন ক্লান্ত একদিন সিনিয়ার সিস্টার। কমলাদি বললেন—চল, আমাদের সংগে হাসপাতলে। ধাইমার কাজ করবি। মাদার ট্রেনিং দিয়ে দেব। ধরিত্রী বলল, আমি তো মুখ মানুষ। লেখাপড়া জানি না। কি করে। ট্রেনিং নেব। কমলাদি ধমক দিয়ে বললেন, ওসব তোকে ভাবতে হবে না। আমরা সব। শিখিয়ে নেব।
সেই থেকে ধরিত্রী হাসপাতালের মাদার। আশেপাশের গ্রামের সব মানুষের মাদার। এখন রুহিডাঙ্গা, প্রেসের ডাঙ্গা, মাথাভাঙ্গা থেকেও লোকজন আসে। কারো জ্বর হয়েছে, কার পেটখারাপ হয়েছে, ধরিত্রী ঠিকঠাক ওষুধ দিয়ে দেয়। কারো আবার বাচ্চা হবে, তাতে মাদারের ডাক। মাদার নিপুণ হাতে প্ৰধ্ব করাবে। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল ধরিত্রীর জীবন। একদিন এভাবেই চিকিৎসার পর ফিরছিল পুণ্ডিবাতি থেকে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। কারণ জায়গাটা ওর বাসস্থানের থেকে বেশ কিছুটা দূরে। হঠাৎ শুনতে পেল শিশুর কান্না। রাস্তার পাশে ডাম্প করা আবর্জনার মধ্যে শুয়ে একটা বাচ্চা কাঁদছে।
ধরিত্রী অপলকে বাচ্চাটাকে দেখল কিছুক্ষণ তারপর ধীরে ধীরে বাচ্চাটাকে কোলে। তুলে নিজের কাপড় দিয়ে ভাল করে জড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল। কি এক নিশ্চিন্ততায় শিশুটির কান্না থেমে গেল। পাড়া-পড়শির নানারকম মন্তব্যকে উপেক্ষা করে ছেলেটাকে নিজের ছেলের মত মানুষ করতে লাগল। কারণ ওর মনে আশা জাগল, এই ছেলে বড় হলে ওর একটা অবলম্বন হবে। তখন দুজন মিলে রুখে দাঁড়ালে মতিবাবুকে প্রতিহত করা সম্ভব হবে। তাছাড়া আর একটা ভরসা ধরিত্রীকে আর একা একা নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলো অতিবাহিত করতে হবে না। ধরিত্রী ছেলেটাকে আনার ব্যাপারে সমস্ত কিছু হাসপাতালের ডাক্তার আর সিস্টারদের জানিয়েছিল। ওরা সমস্ত কিছু শোনার পর আর করেনি।
এদিকে মতিবাবু একদিন গন্ধে গন্ধে হাজির। খিক খিক্ করে হাসতে হাসতে বললে–কি রে, কার ছেলে ওটা? তা তোর যখন এতই ছেলের সাধ তখন আমাকে বললেই পারতিস। ধরিত্রী অশ্লীল ইঙ্গিতটা বুঝল। শয়তানটার চোখে-মুখে একটা জাম্ব লালসা। ধরিত্রীর মাথায় যেন কি একটা খেলে গেল। ক্রুদ্ধ হুংকারে বলল—বের হন। বলছি। বের হয়ে যান বাড়ি থেকে। এক্ষুনি। না গেলে চেঁচাব। মানুষ ডাকব। ফের যদি এ মুখো হন, দেখে নেব। মতিবাবু একটু থমকে দাঁড়িয়ে টেনে টেনে বললেন, এত রাগ ভাল নয়। একদিন না একদিন আমার কাছে আসতেই হবে। তখন বুঝতে পারবি আমাকে চোখ দেখানোর কি মজা। আমাকে রাগিয়ে কিভাবে ঘোষকাডাঙায় থাকিস দেখবো। দেখবো তোর যে কোন পেয়ারের সিস্টার তোকে বাঁচায়।
—তবে রে! বলেই ধরিত্রী তেড়ে এল। মতিবাবু ধরিত্রীর ঐ চেহারা দেখে আর দাঁড়াবার সাহস পেল না। এক পা এক পা করে পেছিয়ে গেল। ধরিত্রী তখন রাগে কাঁপছে। লোকটা বেরিয়ে যেতে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না ধরিত্রী। আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। এতক্ষণ যে দৃঢ়তায় লোকটাকে ঠেকিয়ে রেখেছিল, কোন মন্ত্রবলে সেটা অন্তর্হিত হ’ল। পোড়া চোখদুটোতে জলের স্পর্শ এঁকে দিল। বারবার মনে হতে লাগল, সে তো কারুর বাড়ি যায় না, তবে কেন এই অকারণ উৎপাত। তাকে ভালভাবে বাঁচবারও কি অধিকার দেবে না এই সমাজ।
ধরিত্রীর হঠাৎ একটা শিরশিরে ভয় অনুভূত হল। ভয়টা ওই মতিবাবুকে কেন্দ্র করে। লোকটা সুবিধের নয়। হাতে লোকজন আছে। টাকা-পয়সা আছে। পঞ্চায়েতের লোকজন মতিবাবুর কথায় ওঠে বসে। পার্টির লোকও হারে মুঠোয়। রাত-বিরেতে কি যে হয় কাজটা হয়ত ভাল হ’ল না। কিন্তু ঐ ভাবে না বললে হয়ত লোকটা নড়তো না। হাত বাড়াত। একবার মাথায় তুলে দিলে সহসা নামাতে পারতো না। নিজের মানুষের সখের জমিটা হাতানোর মতলব লোকটার। তাই ছুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুতে চায়।
প্রাণ থাকতে এটা বাধা দেবে ধরিত্রী। যদি একা না পারে, লোকজনদের কাছে যাবে। এখানে কি মানুষ নেই? নিশ্চয়ই আছে। ডাক্তারবাবুদের কাছে যাবে। সিস্টারদের কাছে যাবে। সমস্ত কিছু বলবে। সাহায্য চাইবে। একা থাকতে ভয় হয়। আশেপাশের লোকজন ভাল নয়। বড় সিস্টার ওকে বাব্বার হাসপাতালে চলে যেতে বলেছেন। তাহলে আর এই খুচরো উৎপাত আর থাকবে না। কিন্তু ধরিত্রী যায়নি। নিজের ভিটে ছেড়ে চলে যাবে, এটা ভাবতেও কষ্ট হয়। আপন বলতে তো আর কিছু নেই। এই বাড়ি আর সংলগ্ন জমিটুকু ছাড়া। এই বাড়ি যদি খালি রেখে ধরিত্রী অন্য জায়গায় থাকতে শুরু করে তাহলে মতিবাবু ঢুকে যাবে। আর শয়তানটা একবার ঢুকে গেলে আর বার করতে পারবে না। যা দিনকাল পড়েছে। এই সব সাতপাঁচ ভেবে এই আশ্রয়টুকু ছেড়ে যেতে চায় নি ধরিত্রী।
ওর ভাবনা শুধু ওর ছেলেকে ঘিরে আবর্তিত হত। ভাবত কখন ছেলেটা বড় হবে। কবে সেয়ানা হবে। ধরিত্রী ছেলেকে জমিটার ওপর ঘর তুলে দেবে। মনিহারী দোকান দেবে। ধরিত্রীর এই সাধ কি পূর্ণ হবে? যা ভাগ্য নিয়ে এসেছে একখানা! ধরিত্রীর নিজের বলতে কিছুই ছিল না। সেইখানে বাড়ী হ’লনিজের মানুষ হল। কিন্তু আসল মানুষটা—যার জন্যে কিছু সে রইল না। লোকটা নেই ঠিক কথা, তার রেখে যাওয়া জিনিসগুলো আছে। সেই অমূল্য সম্পদগুলো হারাতে রাজী নয় ধরিত্রী। প্রাণ থাকতে নয়।
সুতরাং জায়গাটা ছাড়ার কোন প্রশ্ন নেই। ছেলেটাকে নিয়েই নিজের আশা, মনের সাধ পূর্ণ করবে। দশজনের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। ছেলেকে মানুষের মতমানুষ করবে। ছেলে মানুষ হলে আর চিন্তা নেই। এই স্বপ্ন নিয়েই ধরিত্রী ভাবে, নিজের জীবনে যেমন কেউ ছিল না, ঐ ছেলেটার জীবনে যেন তা না হয়। ওকে ওর পরিচয় দিয়ে মানুষের মত মানুষ তৈরী করবে।
ধরিত্রী আর হাঁটতে পারছে না। আর কত দূর! বাড়ীটা যেন মনে হচ্ছে অনেক দূরে। আজকে অত-দূরে না গেলেই হোত। রুহিডাঙ্গার অমর সরকারের বাড়ি গিয়েছিল। ওখান থেকে ফিরছে। অমর সরকারের ছেলের বৌ-এর অবস্থা খুব খারাপ। বাচ্চা হবে। অথচ শরীরে রক্ত নেই। ধরিত্রী গিয়ে বৌটাকে দেখেই বলল, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। রক্ত লাগবে। বাড়ীতে রাখা চলবে না বাড়ীতে রাখলে বৌটাকে বাঁচান যাবে না।
অমর সরকার ধরিত্রীর কথার প্রতিবাদ করতে চেয়েছে। বলেছেন না। আমাদের বাড়ীর বৌরা কোনদিন হাসপাতালে যায়নি। আজকেও যাবে না।
ধরিত্রী শুধু দৃঢ়ভাবে বলেছে—যাবে! একটা মানুষকে জেনেশুনে মৃত্যুর হাতে ঠেলে দিতে পারব না।
–হকগে যাক!
—আমি কিন্তু থানায় যাব। বৌমাকে মরতে দেব না।
আসল কথা ধরিত্রী যা ভাল বোঝে তাই করে। যেকোন প্রব্বিদের ভাষাকে ও অগ্রাহ্য করে। অবহেলায় ঠেলে সরিয়ে দেয়। ভয়ানক রেগে যায়। তখন ওর ঐ মূৰ্ত্তি দেখলে সকলেই ভয় পেয়ে যায়। গ্রামের লোকেরাও জানে, ওর কথা না মানলে বিপদ। এইরকম ঘটনা ঘটেছে। ও যা বলেছে সে কথা না শুনে বিপদ টেনে এনেছে। অমর। সরকার ধরিত্রীর ঐ রাগ দেখে আর না করতে পারলো না।
পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সিস্টার আর ডাক্তারবাবুরা একযোগে বাহবা দিয়েছে। কারণ বৌটাকে সময় মত হাসপাতালে নিয়ে না যাওয়া হলে বাঁচানো যেত না। আসল কথা ধরিত্রী চট করে বুঝতে পারে কার অসুখ কি ভাবে যাবে। কি প্রলে ভাল হবে। কি ওষুধ দেবে। ডাক্তার বাবুরা ধরিত্রীর এই গুণ দেখে অবাক হয়ে যান। ধরিত্রী তাই সকলের কাছে ধন্বন্ত্রী। বিপদ-আপদে পড়লে তাই কলে তার কাছে ছুটে আসে। একদিন হারাণ জুয়াড়ী এসে ধরিত্রীকে বললো অপারেশন করাবো। ধরিত্রী কোন কিছুনা বলে চুপ করে রইল। হারাণ ধরিত্রীর দিকে তাকিয়ে আবার বলল—অত বাচ্চা হলে খাওয়াবো কি।
ধরিত্রী চট করে ওর মত বুঝতে পারল। বলল—তোর তো ছেলে-মেয়ে নেই। তুই কেন করাবি। তোর মতলব ভাল নয়। অপারেশন করে যা তা করে বেড়াবি, তা চলবে না।
হারাণ কিরকম যেন ক্ষেপে যায়। চীৎকার করে বলে আমি করাবো তুমি ব্যবস্থা করবে কিনা বলল। বলে বিশ্রী অংগভঙ্গি করে ধরিত্রীর মুরে কাছে হাত নাড়তে লাগল।
ধরিত্রীর শরীরে হঠাৎ যেন কি ঘটে গেল। ও দৌড়ে ঘরে ঢুকে লাঠিটা নিয়ে এল। হারাণের পিঠে জোরে এক ঘা বসিয়ে দিয়ে বললবল এবার, অপারেশন করার ইচ্ছে আছে কিনা। মজা লোটার বড় সখ। দেখাচ্ছি মজা। বলে লাঠিটা আবার তুলতেই হারাণ জুয়াড়ী পাকাল মাছের মত পিছলে দ্রুত র ছেড়ে পালিয়ে গেল। হারাণকে খরগোশের মত ছুটতে দেখে ধরিত্রীর কি হাসি! হাসি থামতে, ধরিত্রী অবাক হয় এই ভেবে কিরকম পুরুষ হারাণ! নিজের অপারেশন করিয়ে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবে। সত্যি বিচিত্র এই সংসারে মানুষজন। হারাণ যেমন জুয়াড়ী তেমনি এক মাতাল আছে। কলেই ডাকে যুবরাজ বলে, সকাল বিকেল আড্ডা দেবে আর রাতের বেলায় দেশী টানবে। মদ্যপ অবস্থায় বৌকে অত্যাচার করবে। এরই মধ্যে এক গণ্ডা বাচ্চা। শরীর ভেঙ্গে পড়ছে।বৌটা শান্ত প্রকৃত্রি। রারই মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করত। কিন্তু একদিন আর পারল না। কাঁদতে কাঁদতে ধরিত্রীর কাছে এসে হাজির।
ধরিত্রী ডাক্তারবাবুকে দিয়ে অপারেশন করিয়ে দিয়েছিল। কারণ ধরিত্রী বুঝেছিল বাচ্চা হওয়ার ধকল বৌটা আর বেশীদিন সহ্য করতে পারবে না। তাছড়া খাওয়াবেই বা কি? স্বামী তো মানুষের পর্যায় পড়ে না। ধরিত্রী বোঝে কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়। লেখাপড়া না জানলেও এ জিনিসটা ভালভাবেই বুঝতে পারে। অপারেশন হলে কিছু টাকা পাওয়া যায় বটে, কিন্তু টাকাটাই তো সব নয়। আগে পরে ভেবে সব কিছু করতে হবে। হুট করে একটা কিছু করলেই হবে না।
দেখা গেছে ছোটখাট অসুখ-বিসুখে ধরিত্রী যা বলে, যে ওষুধ দেয় তা অব্যর্থ। ডাক্তারবাবুরাও তা জানেন। তারা অবাক হন, কি করে ধরিত্রী এত সব শিখল! হাসপাতালের নার্সরাও অবাক হয়। কি করে ইংরাজীতে বিদঘুঁটে ওষুধের সব নাম মনে। রাখে! হয়তো ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারে না। ওষুধের দোকানদাররা বুঝে যায়। কেউ যদি বলে ‘জেলোচিল’ আছে, তাহলে ওরা ঠিক বুঝতে পারে মাদার পাঠিয়েছে। তারা ঠিক ঠিক ওষুধটা দিয়ে দেয়। কখনো কখনো ছোটখাট অপারেশনের সময় ধরিত্রী ডাক্তারবাবুদের সাহায্য করে অভিজ্ঞ নার্সের মতোই। ডাক্তারবাবুরা ধরিত্রীর এই গুণের জন্যে ভীষণ ভালবাসে। লোকের অফুরন্ত ভালবাসা ধরিত্রীর ঘরে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে না। ছেলেটাকে যেভাবে মানুষ করতে চেয়েছিল, তা আর হয়ে উঠল না। ছেলেটা যে এইরকম হবে কোনদিন ভাবতে পারেনি। ঘোষকাডাঙ্গা রেল স্টেশনে বাজে ছেলেদের খপ্পরে পড়ে গেছে। ঠিকমত বাড়ি ফেরে না। এই অল্প বয়সেই বদ হয়ে গেছে। দিন দিন ছেলেটা কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে। সেদিনকার ছেলে সব–কি তাদের ভাষা। কি চাল চলন। কিভাবে এত পরিবর্তন হল, ধরিত্রী কিছুতেই তা বুঝতে পারে না।
পাশপাশের গ্রাম থেকে দুস্থ মেয়েরা শাকজি সংগ্রহ করে শিলিগুঁড়ি নিয়ে যায়, রাত্রিবেলা স্টেশনেই থাকে। ওখানেই ভাত সেদ্ধ করে খায়। ভোরবেলা ট্রেন এলে যায়। এতদিন উৎপাত ছিল না। কিন্তু এই ক্ষুদে মাফিয়া চক্র গড়ে ওঠার পর অশান্তি দেখা দিয়েছে। ছেলেগুলো এসে মস্তানি করে। টাকা চায়। গালি-গালাজ দেয়। অশালীন আচরণ করে। একদিন তো দুঃখীর মাকে ধানক্ষেতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। সকলে মিলে রুখে দাঁড়িয়েছিল বলে সে যাত্রায় দুঃখীর মা রক্ষা পেয়েছিল। স্টেশন মাস্টারকে বলেও কিছু হয়নি। দুঃখীরা থানায়ও জানিয়েছিল। কিছুতেই কিছু হয়নি।
পেটের জ্বালায় এত কষ্টের মধ্যে আবার নয়া উৎপাত। ভাবতে কষ্ট হয় ধরিত্রীর তার ছেলে রাজা ঐ দলের ফাইফরমাস খাটে। অথচ এই রাজাকে মানুষ করার জন্য কত চেষ্টা তো করল। ধরিত্রী স্কুলে দিল, বাড়িতে পড়ার জন্যে মাস্টর ঠিক করে দিল। প্রথম প্রথম ভালোভাবেই পড়াশুনা করছিল। যেই প্রাইমারী স্কুলের পাঠ শেষ করে হাইস্কুলে ছুটল,—কি যে হল! খারাপ হয়ে গেল। কতবার্তা শোনে না। ঠিকমত থাকে না। ধরিত্রী প্রথম প্রথম গালমন্দ করতো। শাসাতো। বেশী বলায় আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে দেখে, বলাই ছেড়ে দিয়েছে। মনে মনে ভেবেছে, রাস্তার জিনিস কি কখনো ঘরে থাকে।
হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরাও কত বোঝাবার চেষ্টা করেছে, হিত উপদেশ দিয়েছে। সিস্টাররাও মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে, ভালোভাবে চলবার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। এই জন্যে ধরিত্রীর মনে অনেক দুঃখ। কিন্তু এই দুঃখের কথা। কাউকেই বলতে পারে না। তাছাড়া বলার তো বেশী লোক থাকে না। এই মতি সাউর জন্যে দুঃখের শেষ নেই। লোকটা ওদের চিলতে জমিটুকু গ্রাস করতে বদ্ধপরিকর। ঘোষকাডাঙ্গার সমস্তকিছুই ওদের দখলে। ভিন দেশী লোক হয়েও, কি করে যেন লোকটা বাঙালী হয়ে গেছে। ওরা যে এই দেশে কবে এসেছে তা কেউ বলতে পারবে না। ওরা কি করে এই গ্রামে চলে এল কে জানে!
ধরিত্রী সেই কথাটার কোন উত্তর পায় না। গিন্নীমা অবশ্য জানতেন ওদের কথা। কারণ ওদের সঙ্গে মতিবাবুদের একটা বিরোধ লেগেই ছিল। সেই মতিবাবু ধরিত্রীকে চাইছে। আজ থেকে নয়। গিন্নীমার বাড়িতে থাকার সময় থেকেই। রাজা যখন ছোট তখন একদিন রাত্রিবেলা এসে হাজির। ধরিত্রী চোর চোর বলে চীৎকার করে উঠছিল। অন্ধকারের মধ্যেই ধরিত্রী মতিবাবুকে পালাতে দেখেছিল। রাজা মাকে চীৎকার করতে দেখে বিছানায় বসে বলেছিল,—চোর কই মা? আমি চোর ধরব। চোরকে মারবো। চোর কই মা?
ঐটুকু ছেলের কথায় ধরিত্রী স্বস্তি পেয়েছিল। মনে মনে ধরিত্রী এই চেয়েছিল। রাজা তাড়াতাড়ি বড় হোক, তাহলে ধরিত্রীর আর কোন চিন্তা থাকবে না। আর একটু বড় হলেই মবুিকে ঠেকাতে পারবে। তখন আর ভয় থাকবে না। কিন্তু সেই রাজা কি হয়ে গেল! ধরিত্রী কি চেয়েছিল আর কি হল।
সেদিন রাত্রে ধরিত্রী ভীষণ রেগে ছিল। বড় দিদিমণির কোয়ার্টারে হামলা করেছিল। রাজা একলা নয়, ওর সঙ্গে কয়েকজন ছিল। বড় দিদিমণির কোয়ার্টারে একটা নারকেল গাছ আছে। নারকেল পাড়তে গিয়েই যত গণ্ডগোল। বড়দিদিমণি নালিশ করেছিল। ধরিত্রী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল আজকে একটা হেস্তনেস্ত করবেই। কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়। ধরিত্রী বাড়ি ফিরে দেখে খুব জোরে টেপ চালিয়ে রাজা ধেউ ধেই করে নাচছে। ধরিত্রী ঐ দেখে ভীষণ রেগে গেল, লাঠিঠা নিয়ে বেধড়ক মারতে লাগল। রাজা মার হাত থেকে বাবার জন্য চেঁচাতে লাগল আমাকে মারছ কেন? আমি কি করেছি? আমাকে মারছ কেন?
ধরিত্রী মারতে মারতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল—কি করেছিল। তুই মরতে পারিস না। তোকে আমি মুখে নুন দিয়ে মারবো। বের হ বাড়ি থেকে। তোর মত ছেলে আমরা চাই না। বাচ্চা ছেলে বাচ্চাদের মত থাকবি।
রাজা যেন প্রতিবাদে মুখর—তুমি তো মারবেই। তুমি তো আমার মা নও।
ধরিত্রী সাময়িক থমকে দাঁড়ালো। কথাগুলো শুনে ওর নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারলো না। পরক্ষণেই আরো দ্বিগুণ ক্রোধ ওকে ভর করল—কি, এখনই এই কথা, পরে তো আরো বলবি। মুখপোড়া! ছোট মুখে এত বড় কথা। হতচ্ছাড়া! শয়তান! কুকুর! তোর এত সাহস। আমি তোকে শেষ করবোই।
রাগে-যন্ত্রণায় ধরিত্রীর মাথা ফেটে যাচ্ছে। ধরিত্রী আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিল না। প্রচণ্ড অভিমানে ওর চোখ ফেটে অঝোর ধারায় জল পড়তে লাগল। রাজা আর দাঁড়াল না। দৌড়ে পালাল। কারণ রাজা মার ওই উগ্ৰমূর্তি দেখে একটা কথা বুঝেছিল পালাতে হবে।
সেই থেকে রাজা ঘরছাড়া। কোথায় যে গেল কে জানে। ধরিত্রী ওর খোঁজ করেনি। কিন্তু খোঁজ না করলেও মনে মনে চিন্তা করেছে। কোথায় গেল। কি খেল, কে জানে। জানবার উপায়ও নেই। অবশ্য ধরিত্রীর জানাশোনার যা পরিধি তাতে হয়ত চেষ্টা করলে পারে। কিন্তু চেষ্টা থেকে বিরত থেকেছে। নির্লিপ্ত থেকেছে। ঐ রকম ছেলের আর কি হবে। একদিন না একদিন দুর্ঘটনায় মারা পড়বে। ওদের কপালে আর কিছু লেখা থাকতে পারে না। ধরিত্রী তো ভালর জন্য কম চেষ্টা করেনি। স্কুলে দিয়েছে। মাস্টার রেখে দিয়েছে। কিন্তু যার দ্বার নয়, তার চেষ্টা করেও হবে না। হয়তো ভালো ঘরের ছিল। রাস্তার কোন বাজে মানুষের কামনার ফসল। তা না হলে এত চেষ্টা করেও কেন মানুষ করতে পারল না। সেটাই দুঃখের।
ধরিত্রীর বয়স এগুচ্ছে। এই বয়সে আর কষ্ট করতে পারছে না। ভেবেছিল, কি আর হল কি। যত দিন যাচ্ছে, শরীর মন ভেঙে যাচ্ছে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। রাজাকে ঘরে নিয়ে এসে কি যে ভুল করেছিল, তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। জীবনে অনেক ছেলেময়ে দেখেছে। বহু সন্তানের জন্ম দিয়েছে এই হাতে, কন্তু এই রকম ছেলে আর একটাও দেখেনি। পাড়ার কত ছেলেমেয়ে এখনো রাস্তায় দেখা হলে মা ডাকে। কি সুন্দরভাবে কুশল প্রশ্ন করে। ধরিত্রী তখন অন্য জগতে চলে যায়। ধরিত্রীর মন ভরে ওঠে।
পাশ দিয়ে সর সর করে কি একটা চলে যেতে ধরিত্রী চমকে বাস্তবে ফিরে এল। সাপ-খোপ হবে হয়ত। ওসবে আর ভয় নেই ধরিত্রীর। কারণ মানুষ সাপের চেয়েও খল, ভয়ঙ্কর। সেই মানুষই যখন ওর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারলো না, তাহলে সাপতো ছার।
সূর্যঠাকুর একদম বাঁশ ঝাড়ের নিচে নেমে গেছে। গাছে গাছে পাখীদের কিচির মিচির। সন্ধ্যা নামল। মাঠের সব পাখীরা ফিরে এসেছে ডেরায়। ধরিত্রী এখনো ফিরতে পারল না। রাস্তা যেন শেষ হতে চাইছে না। ভুল রাস্তায় এলো না তো! ধরিত্রী এদিক ওদিক ঘুরে দেখল ঘোষকাডাঙ্গার রেল স্টেশনটা দেখা যাচ্ছে। ওপারে কত বড় হয়েছে। দেখতে দেখতে কত লোজন এলো। আগে এখানে এত লোকই ছিল না। ওদিকে একটা বাজার হয়েছে। দুই একটা দোকানও আছে। সবসময় ভোলা থাকে।
ধরিত্রী আবার পা বাড়াল। ঠিক রাস্তায় চলেছে। দাঁড়াতে পারছে না কারণ দাঁড়ালেই পায়ে ব্যথা করে। নিজের শরীরটা সোজা করে টান করে রাখতে পারছে না। পাশের জলা জায়গা থেকে একটা পানকৌড়ি অন্ধকারে কিছুটা উড়ে গিয়ে হু করে বসল। পাট ক্ষেত থেকে জোনাকিরা বেরিয়ে পড়েছে মাঠে। ওরা মনের আনন্দে জ্বলছে আর নিভছে। কোথায় যেন একটা শিয়াল ডেকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা রাস্তার কুকুরের সমবেত চীৎকার শোনা গেল। দূরের বাড়িতে প্রদীপ জ্বলছে। মনে হয় দিন শেষে কোন বউ তুলসী মঞ্চে প্রদীপ জ্বেলেছে।
মতি সাউর বাড়িও দেখা যাচ্ছে। ইলেকট্রিক আলো জ্বলছে। সুদের টাকায় বড়লোক। ওদের বাড়িতে ইলেকট্রিক বাতি জ্বলবে না তো আর কোন বাড়িতে জ্বলবে। আবার বাজারে ভিডিও বসাবে। তারজন্যেই নাকি জমিটা দরকার। জমিটা নেবার জন্যে মতি সাউ কতরকম টোপ দিয়েছে। ধরিত্রী কিছুতেই রাজী হয়নি। কিছুতেই মতিবাবুর প্রলোভনে পা দেয়নি। সেই থেকে লোকটা পিছনে লেগেছে। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। তাও মিনরে শয়তানী অটুট আছে। রাজাকে নিয়ে শয়তানটাকে প্রতিহত করার স্বপ্ন দেখেছিল, সেটা চুরমার হয়ে গেল। এখন কি নিয়ে বাঁচবে। সব শেষ। স্বপ্নের সৌধটা ভেঙে খান খান। মনের সাহসও আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে।
চারপাশে অন্ধকার। অমাবস্যার কাল চলছে। তাই চাপ চাপ অন্ধকার। ধরিত্রীর হঠাৎ ভয় করছে। কোনদিন ওর এরকম ভয় করে নি। গা-টা শিউরে উঠছে। কেন এরকম হচ্ছে বুঝতে পারছে না। একটা ঝোড়ো দমকা হাওয়া হঠাৎ ধানক্ষেত্রে ওপর দিয়ে বয়ে গেল। ধরিত্রীর মনেও ঝড়ের সঙ্কেত। তবুও জোর করে সাহস এনে বাড়ির পথ ধরল ধরিত্রী জোর কদমে। আর একু এগুলেই মতিবাবুদের মুদি দোকান। ঐ পর্যন্ত গেলে প্রায় বাড়ি পৌঁছানো গেল। সামনের ক্ষেতটা পেরুতে পারাটাই সমস্যা। ক্ষেতটা এখন নেড়া। ধান সব কাটা হয়ে গেছে। জমিটা এবড়ো খেবড়ো। আগাছায় ভর্তি। আলপথও খুব সরু।
হাঁটতে হাঁটতে ধরিত্রীর হঠাৎ মনে হল, কেন আজ অতদূরে গেল। কিন্তু না গেলেও চলত কি? বৌটা প্রথম পোয়াতি। কি সুন্দর দেখতে। যেমন রঙ, তেমনি নাক চোখ। খুব কষ্ট পেল। ধরিত্রী না গেলে বিপদের সম্ভাবনা ছিল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ঠিকমত হয়েছে। কন্যা সন্তান। বাড়ির লোকেরা কিন্তু বলেছিল হাসপাতালে দেবার কথা। ধরিত্রী না করেছিল, বলেছিল বাড়িতেই হবে। কোন ভয় নেই। কে যেন বলেছিল সিজার টিজার হবে। ধরিত্রী বলেছিল, না ওসব করতে হবে না।
অবশ্য বাড়ির লেকেরা ধরিত্রী যা বলেছিল তাই মেনে নিয়েছিল। কোন প্রতিবাদ করেনি।
থমকে দাঁড়াল ধরিত্রী। আর হাঁটতে পারছে। না। শরীর বইছে না। কোন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে এখনো বাড়িতে পা রাখতে পারল না। বৌটাকে বাঁচাতে গিয়েই। ধরিত্রীর এত দেরী হয়ে গেল।
বাড়ি এখনো কতদূর। অন্ধকারটা যেন আজ খুব বেশি। দু’হাত দূরের জিনিসপত্রও নজরে আসছে না। পথে লোকজনও কেউ নেই। ধরিত্রী জোরে পা চালাল।
হঠাৎ ওর মনে হল পিছনে কেউ যেন আসছে। দাঁড়িয়ে পড়ল ধরিত্রী। শব্দটা শোনার চেষ্টা করল না। এ হয়ত ওর মনের ভুল। আবার হাঁটতে শুরু করল। সামনে মনসাডাঙ্গায় ঢোকার মুখে একটা বড় বাঁশ বাগান। সামনে মনসাডাঙ্গায় রাস্তায় ওঠা যাবে। ধরিত্রী নিজেকে যেন ভরসা দিল।
ঠিক তখনই পিছন থেকে থেকে জাপটে ধরল কেউ। ধরিত্রী চীৎকার করে উঠল। মুহূর্তেই বুঝে নিল এ আর কেউ নেই। মতি সাউ। শরীরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। জানোয়ারটা। ওকে রাস্তার উপর ফেলে বুকের ওপর চেপে বসতে চাচ্ছে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত ধরিত্রী বুঝি আর পারবে না নিজেকে রক্ষা করতে।
শেষ চেষ্টা হিসেবে কোনরকমে মুখের হাত সরিয়ে ধরিত্রী চীৎকার করে উঠল—কে আছো! বাঁচাও! সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার দিক থেকে আওয়াজ ছুটে এল–মা–মা!
এ যে রাজার গলা।
মতি সাউ উঠে দাঁড়াতে চাইছে। হয়তো পালাবে। এক ঝটকায় শয়তনটাকে মাটিতে ফেলে বুকের উপর উঠে দাঁড়ালো ধরিত্রী। রণরঙ্গিনী দুর্গার মত ধরিত্রী যেন এ মুহূর্তে চোখের আগুনে ভস্ম করতে চার পায়ের নিচের অসুরটাকে।