ধবলদম্ভ

ধবলদম্ভ

জর্জিক জাহাজে সেদিন ভারতীয়দের প্রতি যে অদ্ভুত ব্যবহার করা হইল তাহা ধবলদম্ভের, স্বাধিকার প্রমত্ততার বিকৃত রূপ। এই সম্পর্কে আমার আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়িল। সে অনেক দিনের কথা; কিন্তু বহু ভারতীয় বিদেশে যান, ঘটনাটি মনে রাখিলে তাহারা উপকৃত হইবেন।

১৯২৮ সালে প্রচণ্ড শীত কাবুলে প্রচণ্ডতর হইয়া পড়িয়াছিল। সেই সময় আমানউল্লা বাচ্চা-ই-সকাওর হস্তে পরাজিত হইয়া রাতারাতি কাবুল ত্যাগ করিয়া কান্দাহার চলিয়া যান। বাচ্চা তখনও শহরে প্রবেশ করেন নাই। সেখানে তখন নির্মম বীভৎস অরাজকতা চলিয়াছে। রাজা নাই; পুলিশ, মিলিটারি প্রাণরক্ষার্থে উর্দি ছাড়িয়া আত্মগোপন করিয়াছে। শহরে রাস্তায় রাস্তায় প্রকাশ্য লুটতরাজ, খুন-খারাবি চলিয়াছে। বাচ্চার অগ্রগামী সৈন্যরাই প্রধান দস্যু, তাহাদের সঙ্ঘবদ্ধ অত্যাচার রুদ্ধ করিবার মতো কোনও প্রতিষ্ঠান তখন কাবুলে ছিল না।

দোকান-পাট বন্ধ। রাস্তায় বাহির হইবার উপায় নাই। ওভারকোটের লোভে যে কোনও দস্যু আপনাকে গুলি করিতে প্রস্তুত। চাহিলে পর দিলে গুলি করার রেওয়াজ আফগান দস্যুদের মধ্যে প্রচলিত নাই।

খাস কাবুলিরা এরকম বিদ্রোহ ও লুটতরাজ ব্যাপারে অভ্যস্ত। বিশৃঙ্খলতার গন্ধ পাইবা মাত্রই তাহারা বছর দুইয়ের খোরাক বাড়িতে যোগাড় করিয়া রাখে। বিপদে পড়িলেন বিদেশি অধ্যাপক ও শিক্ষকেরা। ইহারা সকলেই কাবুলে নবাগত– কাবুলি কায়দা জানেন না। আহারাদি সঞ্চয় করিয়া রাখেন নাই। পক্ষাধিককাল যাইতে না যাইতেই তাহাদের নিরস্তু একাদশী আরম্ভ হইল– কারণ কলের জল পর্যন্ত বন্ধ হইয়া গিয়াছে।

বাচ্চা সিংহাসনে আরোহণ করিয়া প্রথম সৎকর্ম করিলেন অধ্যাপক শিক্ষকদের বরখাস্ত করিয়া। প্রাপ্য বেতনও তাঁহাদিগে দেওয়া হইল না। সে-যুগে কাবুলে কোনও ব্যাংক ছিল না বলিয়া অধ্যাপক-শিক্ষকেরা সঞ্চিত অর্থ পেশাওয়ার বা লাহোরের ব্যাংকে রাখিতেন। তাঁহারা তখন কপর্দকহীন; সে দুর্দিনে ধারই-বা দিবে কে? কাবুলের সঙ্গে তখন বহির্জগতের কোনও যোগাযোগ নাই।

পরিস্থিতি আলোচনা করিবার জন্য ফরাসি, জর্মন ও ভারতীয় শিক্ষকেরা একত্র হইয়া জিরগা করিলেন। তখন প্রথম অসুবিধা হইল ভাষা লইয়া। সকলে জানেন এমন কোনও ভাষা খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। সে সভায় মাত্র একজন বাঙালি ছিলেন। তিনি ফারসি ফরাসি জর্মন তিনটি ভাষাই জানিতেন বলিয়া তাঁহাকেই সভাপতি করা হইল। সভায় স্থির হইল যে, যেহেতু অধ্যাপকেরাই সর্বাধিক বিপদে পড়িয়াছেন, তাঁহাদিগের জন্য যদি সদাশয় ব্রিটিশ লিগেশন কোনও উপায় অনুসন্ধান করিয়া দেন, তবে তাহারা কৃতাৰ্থৰ্ম্মন্য হইবেন। এই মর্মে ডেপুটেশন পাঠানো স্থির হইল।

লিগেশন হইতে উত্তর আসিল ফরাসি-জর্মনরা যেন স্ব স্ব লিগেশনের দৌত্যে নিজ নিজ অসুবিধা পেশ করেন। ভারতীয়দের সঙ্গে দেখা করিতে লিগেশনকর্তা হিজ এসেলেন্সি লেফটেনান্ট-কর্নেল শ্রীযুক্ত সর ফ্রান্সিস হমফ্রিস রাজি আছেন।

ইতোমধ্যে সর ফ্রান্সিস বাচ্চার সঙ্গে আলাপ করিয়া পেশাওয়ার হইতে কাবুলে রোজ একখানা, দুইখানা হাওয়াই জাহাজ আনাইবাবু সন্দোবস্ত দিয়া ফেলিয়াছেন। ফরাসি জর্মন ইতালীয়দের সেই জাহাজগুলিতে করিয়া ভারতে পাঠানো আরম্ভ হইয়া গিয়াছে।

ডেপুটেশন নিবেদন করিল যে, ভারতীয় শিক্ষকেরা উপবাসে প্রায় মরিবার উপক্রম। ভারতে যাইবার অন্য সব পন্থা যখন রুদ্ধ তখন সায়েব যদি তাহাদিগকে হিন্দুস্থান পাঠাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সায়েব বলিলেন, দেখুন কাবুলের ব্রিটিশ লিগেশন লন্ডনস্থ ব্রিটিশ সরকারের সিন জেমস (অথবা ওই জাতীয় অন্য কিছু বিজাতীয়) কোর্টের মুখপাত্র (Representative)। ভারতীয়েরা হক্কের জোরে (as a matter of right) আমাদিগের নিকট হইতে কোনও সাহায্য দাবি করিতে পারেন না। মেহেরবানি-রূপে (as a matter of favour) চাহিতে পারেন।

ডেপুটেশনের বাঙালি মুখপাত্রটি বলিলেন, সে কী কথা সায়েব, এই যে হাওয়াই জাহাজ আসিতেছে সেগুলি তো ইন্ডিয়ান আর্মির পয়সায় কেনা, পাইলট মেকানিক ভারতীয় তনখা খায়, যে জায়গায় গিয়া জাহাজ খানা লইবে সে-ও তো ভারতের জমি। তুমি আবার পরের ধনে পোদ্দারি না হউক, পরের জাহাজে কাপ্তেনি কেন করিতেছ! অবশ্য একথা তিনি জিজ্ঞাসা করেন নাই।

চোর বরঞ্চ ধর্মের কাহিনী শোনে না হইলে বাল্মীকি উদ্ধার পাইতেন না কিন্তু ধবলদম্ভ হড়াঈর দ্বিরদরদস্তম্ভে গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিলেন। বাঙালিটি তখন লক্ষ করিলেন যে, ডেপুটেশনের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে চিত্তচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছে। তখন তিনি গাত্রোত্থান করিয়া বলিলেন, সাহেব, এই যে হক আর মেহেরবানি লইয়া কথা বলিলাম, তাহা নিতান্ত আমার ব্যক্তিগত মতামত। এখন জীবনমরণ সমস্যা। ডেপুটেশনের অন্যান্য সদস্যগণের সঙ্গে আলোচনা করিয়া কর্তব্য স্থির করুন। সদস্যগণ একবাক্যে সায় দিলেন যে, হ মেহেরবানি লইয়া কথা-কাটাকাটি করা বাতুলতা। আত্মানাং সততং রক্ষে দারৈরপি ধনৈরপি।

বাঙালিটি বলিলেন, বিলক্ষণ, কিন্তু সায়েব, আমি ভারতে, স্বদেশে মেহেরবানিরূপে যাইব না, যদি যাই, যাইব হক্কের জোরে। বন্ধুগণ, নমস্কার, সায়েব, সেলাম।

সন্ধ্যাকালেই ভদ্রলোক খবর পাইলেন যে, তাহার নাম ভারত প্রত্যাগমনকামীদের নির্ঘণ্ট হইতে নাকচ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। খবরটি দিলেন ভদ্রলোকটির বন্ধু, ব্রিটিশ লিগেশনের অরিয়েন্টাল সেক্রেটারি, খান বাহাদুর শেখ মহবুব আলী খান, বন্ধুভাবে, সরকারি খবর হিসাবে নয়। তার পর সেইসব জাহাজে করিয়া ফরাসি গেল, জর্মন গেল, ইতালি গেল, তুর্ক গেল, ইরানি গেল, ব্রিটিশ লিগেশনের মেয়েরা গেলেন। তার পর সর্বশেষে ভারতীয় মেয়েদের খোঁজ পড়িল। তাঁহাদের অনেকেই পুরুষ অভিভাবক ছাড়া হাওয়াই জাহাজে চড়িয়া পেশোয়ার যাইবার হিম্মত পান না– কেহ কেহ গেলেন, কেহ কেহ রহিলেন। ভদ্রলোকটি রীতিমতো জোর-জবরদস্তি করিয়া রবীন্দ্রনাথের শিষ্য, (পরে) শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক স্বর্গীয় মৌলানা জিয়াউদ্দিনের স্ত্রীকে হাওয়াই জাহাজে তুলিয়া দিয়া আসিলেন। তার পর অতি সর্বশেষে ভারতীয় পুরুষদের পালা আসিল। কিন্তু ভদ্রলোকটির নামে তো ঢেরা পড়িয়াছে; তিনি পেটে কিল মারিয়া কাবুলের মাটি কামড়াইয়া পড়িয়া রহিলেন।

এদিকে ভারতবর্ষে ভদ্রলোকের পিতা-পুত্রের কোনও খবর না পাইয়া আহারনিদ্রা ত্যাগ করিয়াছেন ও টেলিগ্রাফ অফিসে থানা বাঁধিয়াছেন। দিল্লি-সিমলা যেখানে যাহাকে চিনিতেন, অহরহ তার করিতেছেন, আমার পুত্রের কী খবর? আসামের বর্তমান রাজস্বসচিব (?) মৌলবি আবদুল মতীন চৌধুরীও একখানা তার পাইলেন। সেইদিনই সর ডেনিস ব্রের সঙ্গে তাঁহার দেখা। ভোট সংক্রান্ত কী একটা ব্যাপারে সর ডেনিস মতীন সাহেবের কাছে যান। তিনি বলিলেন, তোমরা যে কাগজে ছাপাইতেছ ভারতীয়দের আনা হইতেছে, অমুকের খবর কী?

সর ডেনিস কাবুলে বেতার পাঠাইলেন সর ফ্রান্সিসকে, অমুককে তার-পাঠ পাঠাও। সাইমন কমিশন তখন আসিব-আসিব করিতেছে অথবা আসিয়াছে। সর ডেনিস সেন্ট্রাল এসেমব্লির সদস্যকে সস্তায় খুশ করিতে কেন নারাজ হইবেন। কোনও ভারতীয়কে বাঁচাইবার জন্য ওই একটিমাত্র বেতার সেই সময় ভারতবর্ষ হইতে কাবুল যায়! পেশাওয়ার সরকার ও কাবুলের ব্রিটিশ লিগেশনে বেতার চলিত, বলা বাহুল্য যে, সে-বেতারের সুবিধা ভারতীয়দের দেওয়া হয় নাই। কাবুলে বসিয়া ভদ্রলোক অবশ্য এসব খবর পান নাই।

সে-বেতার লিগেশনে কী অলৌকিক কাণ্ড বা তিলিসমাত করিল তাহা স্থানাভাবে বাদ দিলাম। পরদিন ভদ্রলোক খবর পাইলেন, তাহার জন্য আগামীকল্যের হাওয়াই জাহাজে একটি স্থান রিজার্ভ করা হইয়াছে। ফেবার না রাইট তাহার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আর হইল না।

সর্বস্ব কাবুলদস্যদের জিম্মায় ফেলিয়া মাত্র দশ সের (অথবা পৌন্ড) লগেজ লইয়া ভদ্রলোক হাওয়াই জাহাজে করিয়া পেশাওয়ার ফিরিলেন। বিমানঘাঁটিতে সর ফ্রান্সিস করমর্দন করিয়া বলিলেন, আমরা ভারতীয়দের যথাসাধ্য সাহায্য করিবার চেষ্টা করিয়াছি, আশা করি, আপনি ভারতবর্ষে ফিরিয়া সব কথা বলিবেন।

ভদ্রলোকটি বলিলেন, নিশ্চয়ই সব কথাই বলিব। দেশে ফিরিয়া তিনি জমিয়ত-উল উলেমার নেতা মৌলানা হুসেন আহমদ মদনীকে আদ্যোপান্ত বলেন। আন্দোলনও হইয়াছিল কিন্তু কোনও ফল হয় নাই। লিগেশন-কর্তা প্রমোশন পাইয়া ইরাক না কোথায় চলিয়া গেলেন।

বর্ণনা শেষ করিয়া ভদ্রলোকটি বলিলেন, কিন্তু আমার চরম শিক্ষা হইয়া গেল। কাবুল গিয়াছিলাম টাকা রোজগার করিয়া ইউরোপে পড়িতে যাইবার জন্য। কোন দেশে যাইব বহুদিন মনস্থির করিতে পারি নাই। এই ঘটনার পর নির্ঘ মনে ইংলন্ড বর্জন করিলাম। পড়িতে গেলাম অন্য দেশে ও ফরাসি জাহাজে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *