ধন্বন্তরি
চ্যারিটেবল ডিসপেন্সারি।
দাতব্য চিকিৎসালয় বলেই দাতার হস্ত অকৃপণ নয়; রিমাইণ্ডার দিতে দিতে ডাক্তার খগেন দাস এলএমএফ-এর কলমটার নিব অর্ধেক হয়ে এসেছে। লাল ফিতেয় বাঁধা ফাইলগুলোর ওপর ধুলোর স্তর জমছে দিনের পর দিন। সেগুলো খুলে ঘাঁটবার মতো সময় নেই কারও, উৎসাহও না।
ডাক্তার খগেন দাস এলএমএফ কিন্তু দমবার পাত্র নন। শেষপর্যন্ত হুংকার ছাড়লেন, কম্পাউণ্ডারবাবু?
পাশের কম্পাউণ্ডিং রুম থেকে বিবর্ণ কাটা দরজাটা ঠেলে কম্পাউণ্ডার যতীন সমাদ্দার প্রবেশ করলে। চেহারা দেখলেই বোঝা যায় মাসে আটাশ টাকা মাইনে পায় লোকটা। বাদুড়চোষা শরীর, মাথার সাদা-কালো চুলগুলো সমান মাপে নিরপেক্ষভাবে ছাঁটাই করা যেন শুয়োরের গায়ের রোঁয়া। কপালে একটা মস্ত আব, তার ওপর দু-তিনগাছা চুল গজিয়েছে। তোবড়ানো গাল, চোখের কোটরে কালির পোঁচড়া। গায়ের ময়লা ফতুয়ার দুটো বোতাম ছেঁড়া, হাঁটু পর্যন্ত ভোলা কন্ট্রোলের ধুতির নীচে বকের মতো সরু সরু দুটি পা ক্যাম্বিসের ফিতেহীন জুতোয় অলংকৃত হয়ে আছে।
কম্পাউণ্ডার যথানিয়মে বিনয়াবনত হয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।
ডাকছিলেন আমাকে?
হ্যাঁ, দেখুন তো মশাই এক বার কান্ডটা। এত লেখালেখির পরে জবাব দিচ্ছে our attention is drawn to the matter! রসিকতার একটা সীমা তো থাকা দরকার।
উত্তরে কী বলা উচিত ভেবে পেল না কম্পাউণ্ডার।
টেবিলে একটা কিল মেরে খগেন ডাক্তার বললেন, চালিয়ে যান ওই সিঙ্কোনা আর কার্মিনেটিভ মিক্সচার। কলেরা, টাইফয়েড, ডিপথিরিয়া, ব্ল্যাকওয়াটার, ম্যালেরিয়া, নিমোনিয়া —যাতে লাগে। যেটা বাঁচে বাঁচুক, বাকিগুলো মরে হেজে ডিসপেন্সারির ভিড় হালকা করে দেবে।
জীর্ণ চেহারার মতো জীর্ণ গলায় আটাশ টাকা মাইনের কম্পাউণ্ডার বললে, আজ্ঞে।
আর শুনুন, ছোটো আলমারির চাবিটা আমাকে দিয়ে দেবেন।
কম্পাউণ্ডার চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ ফিরে দাঁড়াল। ভীরু দুটো চোখের সঙ্গে মিলল কুটিল তীক্ষ্ণ চোখের সন্ধানী দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে সিগারেট দুলিয়ে এক ধরনের বিচিত্র চাপা গলায় ডাক্তার বললে, শুনছি ভালো দু-চারটে ওষুধ যা আছে সেগুলো নাকি ইঁদুরে খাচ্ছে।
কথাটা রূপক হলেও ইঙ্গিতটা এত স্পষ্ট যে কম্পাউণ্ডারের ঘোলা চোখ দুটো পর্যন্ত ক্ষণিকের জন্যে চকচক করে উঠল। যেন ওষুধ একাই চুরি করে বিক্রি করে কম্পাউণ্ডার, ডাক্তার একেবারে দেবতার মতো নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক। কম্পাউণ্ডারের শীর্ণ স্নায়ুগুলো এক মুহূর্তের জন্যে ধনুকের ছিলের মতো দৃঢ় হয়ে উঠতে চাইল। কিন্তু আটাশ টাকা মাইনের কম্পাউণ্ডার কোনো কথা বললে না, নিঃশব্দে কোমর থেকে চাবিটা খুলে এনে ডাক্তারের টেবিলে রাখলে, তারপরে কাটা দরজাটা ঠেলে আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। লোকটা এমনভাবে চলে যে পায়ের শব্দটুকু পর্যন্ত শোনা যায় না। যেন পৃথিবীকে নিজের অস্তিত্বটুকু জানাতেও সংকোচ বোধ করে সে।
অর্থপূর্ণ গলায় ডাক্তার শুধু বললেন, হুঁ।
ডিসপেন্সারি ছোটো, আয়োজনও প্রচুর নয়। কিন্তু ডিসপেন্সারির দিকে তাকিয়েই মানুষের আধি-ব্যাধিগুলো অপেক্ষা করে থাকে না। ঋতুতে ঋতুতে মহাকবি কাল নির্ভুল নিয়মে তাঁর ঋতুসংহার কাব্য রচনা করে চলেন— ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, কলেরা, বসন্ত, আমাশয়। ঠোঁটের কোণে সিগারেট ধরিয়ে ডাক্তার দ্রুতগতিতে প্রেসক্রিপশন লিখে যান। একই মিক্সচার কম্পাউণ্ডারের হাতের গুণে বহুরূপীর মতো রং বদলায়। বিশ্বাসে মিলায়ে কৃষ্ণ-রোগমুক্তি না হোক, কৃষ্ণপ্রাপ্তি ঠেকাবে কে।
ওরই ফাঁকে ফাঁকে রোগী পরীক্ষাও চলে।
দেখি, জিভ দেখি। আঃ, অতটুকু কেন? লজ্জায় যেন জিভ কাটছে। আরও বার কর একটুখানি, আর একটু—হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। এদিকে এসো তো বাপ, পেটটা এক বার দেখাও। ওরে বাপ রে! পিলে তো নয় যেন দেড়মনি একটা কচ্ছপ। অতবড়ো পিলে হয়ে ব্যাটা হাঁটিস কী করে?
কথা চলে, লেখাও চলে সঙ্গে সঙ্গে। কলমটার সুর বাঁধাই আছে—চোখ বুজে কাগজের ওপর ধরে দিলেই নির্ভুল প্রেসক্রিপশন বেরিয়ে আসবে, এমনকী ডাক্তারের দস্তখতটা পর্যন্ত। যেমন ডিসপেন্সারি, তেমনি ওষুধের ব্যবস্থা। দানের উপযোগী দক্ষিণা। আড়াই পয়সায় অক্রুর সংবাদ হয় না।
সার্ভিং রুমে কম্পাউণ্ডার দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের সামনে। এক হাতে মেজার গ্লাস, এক হাতে কাঁচি। টেবিলের ওপর একরাশ কাগজ, এক শিশিতে গঁদের আঠা। মেজার গ্লাসে করে ওষুধ মাপে, কাঁচি দিয়ে দাগ কাটে, কেটে আঠা দিয়ে আঁটে। প্রেসক্রিপশনগুলোও আর পড়বার দরকার হয় না আজকাল।
তবু ওরই ভেতরে নীচু গলায় রোগীদের সঙ্গে কথা জমাতে চেষ্টা করে কম্পাউণ্ডার।
কী রে, তোর ছেলে কেমন আজকাল?
জ্বর তো ছাড়ে না বাবু। আজ যদি একটু ভালো করে ওষুধ দেন…
ওষুধ–ওষুধ! আরে ওষুধে কি আর অসুখ সারে! বাড়িতে ডাক্তার নিয়ে গিয়ে দেখা, তবে তো।
রোগীর অভিভাবক ম্লান হয়ে যায়। বিষণ্ণ ক্লান্ত মুখের ওপরে স্পষ্ট হয়ে বেদনার নিবিড় ছায়া পড়ে। ক্ষীণ গলায় বলে, দু-টাকা করে ডাক্তারবাবুর ভিজিট লাগবে। কোথায় পাব বাবু?
কম্পাউণ্ডারের ঘোলা চোখ দুটো অকস্মাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। লোভের রেখায় চিহ্নিত হয়ে ওঠে সমস্ত মুখাবয়ব। একটা অবজ্ঞাবাচক ভঙ্গি করে কম্পাউণ্ডার বলে, আরে চেয়ারে বসে খালি সই করলেই যদি ডাক্তার হওয়া যেত তাহলে তো আর কথাই ছিল না। এ হল হাতেকলমের কাজ। ডাক্তারবাবু তো লিখেই খালাস, কিন্তু ভেবেচিন্তে হিসেব করে ওষুধ কে দেয় শুনি?
আজ্ঞে আপনি।
তবে? কম্পাউণ্ডারের সর্বাঙ্গে বিজয়গর্ব ফুটে ওঠে। লোকটা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে, কম্পাউণ্ডার কী বলতে চায় বোঝবার চেষ্টা করে।
একটা ঢোঁক গিলে কম্পাউণ্ডার তেমনি নীচু গলায় বলে, আর তা ছাড়া দেখছিস তো–একেবারে চামার। চোখের পর্দা বলে বালাই নেই। গরিবের ঘরে ভাত নেই, কিন্তু দু-টাকার কমে উনি কোনো কথা কইবেন না। কাগজে সই করেও দু-দুটো টাকা—এ মামাবাড়ির আবদার নাকি!
বোকা লোক তবুও বুঝতে পারে না, তেমনি তাকিয়ে থাকে।
একটা টাকা দিতে পারবি? তাহলে আমিই যেতাম।
আপনি! মেজার গ্লাসটা টেবিলের ওপরে ঠক করে নামিয়ে রাখে কম্পাউণ্ডার। শিরাসর্বস্ব হাতের গাঁট-বেরুনো আঙুলগুলো অশান্ত চঞ্চলতায় নড়ে ওঠে।
হ্যাঁ, আমি। কেন, ওই সই-করা ডাক্তারের চাইতে বিদ্যেটা আমার কম বলে ভাবিস বুঝি? বেশ তো, টের পাইয়ে দেব একদিন। আমার হাত দিয়েই তো যায়, রুগিকে পটল তুলিয়ে দিতে এ শর্মার এক মিনিট।
আতঙ্কে চমকে ওঠে লোকটা। বলে, আজ্ঞে না না, তা নয়। গরিব মানুষ, একটা টাকা…
মুখের কথা লুফে নেয় কম্পাউণ্ডার। তা হলে বারো আনা? কী, পারবি না? নাহয় দু আনা কম দিস। আচ্ছা, আচ্ছা নাহয় ওই আট আনাই হল। এক সের ধান নয় বেচে দিস, অত ভাবছিস কেন? ছুরির ডগায় দ্রুতবেগে মলম তৈরি করতে করতে কম্পাউণ্ডার বলে, বুঝলি, আমি সই-করা ডাক্তার নই। লোকের রক্ত শুষে ভিজিট নেওয়া আমার পেশা নয়। নেহাত তোদের ভালোবাসি বলেই…।
মুখস্থ করা বুলির মতো অবলীলাক্রমে বেরিয়ে আসে বক্তৃতাটা। প্রেসক্রিপশন সার্ভ করার সঙ্গে সঙ্গে কথাগুলোও অঙ্গাঙ্গি হয়ে গেছে। রেলগাড়ির ক্যানভাসারদের মতো একটানা ক্লান্ত গলায় বলে যায় কম্পাউণ্ডার। মাঝে মাঝে নিশ্বাস নেওয়ার জন্যে থামে, গলার শ্বাসনালিটা ঢেউয়ের মতো ওঠাপড়া করে, কপালের আবটার ওপরে ঘাম জমে উঠে চিকমিক করে রাজটিকার মতো।
কেউ রাজি হয়, কেউ হয় না। খুশি হয়ে ওঠে না কম্পাউণ্ডার, দুঃখিতও না। মরা নদীতে জোয়ারের জল আসা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক দিন আগে। আটত্রিশ বছরের শিরা-স্নায়ুর রক্তধারাকে অবরুদ্ধ করে দিয়েছে আটাশ টাকার জগদ্দল পাথর।
বেলা আটটা থেকে বারোটা। ডাক্তার মাঝে মাঝে বেরিয়ে যায়, সাইকেল করে দুটো চারটে রোগী দেখে ঘরে আসে। কিন্তু বিশ্রাম নেই কম্পাউণ্ডারের, অবকাশও নেই। হাত চলে, মুখও চলে সমানে পুরোনো যন্ত্রের মতো একটানা অবসন্ন ছন্দে। যেদিন দুটো-চারটে এমার্জেন্সি কেস থাকে, ড্রেস করতে হয়, সেদিন আরও বেলা হয়ে যায়। দেড়টা-দুটোর সময় মাতালের মতো টলতে টলতে কোয়ার্টারে ফিরে আসে কম্পাউণ্ডার।
কোয়ার্টারই বটে। দাতব্য চিকিৎসালয়ের মর্যাদারক্ষার সম্পূর্ণ উপযোগী। বাখারির বেড়ার ওপরে মাটিলেপা, ওপরে খড়ের চাল। মেটে দাওয়ায় এদিক-ওদিকে মাঝে মাঝে এক-একটা কালো কালো গর্ত ফুটে বেরোয়, রোজ সেগুলোর ওপর মাটি চাপাতে হয় সাপের ভয়ে। দুখানা ঘর, একটুকরো রান্নাঘর, একটা পাতকুয়ো আর তিনটে পেঁপে গাছ। তার ভেতরে কম্পাউণ্ডারের জমজমাট সংসার।
স্ত্রী, পাঁচ-ছটা ছেলে-মেয়ে। দিবারাত্র স্ত্রীর ভাঙা কাঁসরের মতো গলা ক্যানক্যান করে পেতনির কান্নার মতো বাজতে থাকে। স্ত্রীর রক্তহীন ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে কম্পাউণ্ডার ভাবে ভিটামিন বি দরকার। ছেলে-মেয়েগুলোর হাতে পায়ে এগজিমা, ক্যালশিয়াম ডিফিসিয়েন্সিতে ভুগছে ওরা।
রাঙাচালের ভাত আর পেঁপের তরকারি খেয়ে একটুখানি ঘুমিয়ে নিতে চেষ্টা করে কম্পাউণ্ডার। কিন্তু ঘুম আসে না। স্ত্রীর গর্জন চলতে থাকে, ছেলে-মেয়েগুলোর চিৎকারে কানের পোকা বেরিয়ে আসবার উপক্রম করে। নাঃ, অসম্ভব!
স্ত্রীকে খানিকটা কটু গালিগালাজ এবং ছেলেপিলেদের দু-একটা চড়চাপড় বসিয়ে বিরক্ত বিতৃষ্ণ কম্পাউণ্ডার বাইরের বারান্দায় এসে বসে। একটা বিড়ি ধরিয়ে নেয়, তারপরে অর্থহীন চোখে তাকিয়ে থাকে সম্মুখে প্রসারিত অবারিত দিগন্তের দিকে।
একটা ধু-ধু করা মাঠ। বছরে একমাত্র ফলন হয় এদেশে আমন। ধানকাটা শেষ হয়ে গেলেই চক্রবাল-বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠটা পড়ে থাকে একটা বিপুল ব্যাপ্ত শ্মশানের মতো। দূরে দূরে দাঁড়িয়ে রোদে পোড়া খেজুর গাছগুলো ডাইনির মতো মাথা নাড়ে, চিৎকার করে উড়ে যায় শঙ্খচিল। কোথাও হয়তো-বা একটা মরা কুকুরের চারদিকে গোল হয়ে বসে সভা করে শকুনেরা, মাঝে মাঝে সাঁড়াশির মতো লম্বা গলা বাড়িয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে নাড়িভুড়ি খায়।
খরিস গোখরোর ছেঁড়া খোলসের মতো এবড়োখেবড়ো মেটে রাস্তাটা মাঠের ভেতরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ছোটো ছোটো ঘূর্ণি তার ওপরে এক-একটা প্রেতচ্ছায়ার মতো অবয়ব নিয়ে উঠতে গিয়ে মিলিয়ে যায়। ধুলোর গন্ধ বয়ে গরম বাতাস এসে কম্পাউণ্ডারের মুখে চোখে ঝটকা মারে।
কম্পাউণ্ডার ভাবে স্ত্রীর ভিটামিন বি দরকার, ছেলে-মেয়েদের ক্যালশিয়াম। কিন্তু শ্মশানের মতো ফাঁকা মাঠটার দিকে তাকিয়ে তার ভাবনাও বিস্তীর্ণ হয়ে যায়, ছাড়িয়ে যায় সাপের-গর্তে-ভরা দুখানা মেটেঘরের সীমানা। চৈত্রের আগুনঝরা আকাশ আর মাঠের ওপরে ইতস্তত ছড়ানো গোরুর হাড় হঠাৎ একটা ভয়ংকর নিষ্ঠুর সত্যকে পরিস্ফুট করে তোলে তার কাছে। মৃত্যু আসছে জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে, অলক্ষ হয়ে আসছে তার নিশ্চিত পদপাত। শুধু তার ঘরেই নয়, তারই পরিবারে নয়, সমস্ত দেশটাই অপমৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে টলমল করছে। চারদিক থেকে হাত বাড়িয়ে আসছে কালাজ্বর, নিমোনিয়া, কলেরা, বসন্ত, ম্যাল নিউট্রিশন। দাতব্য চিকিৎসালয়ের সিঙ্কোনার জল আর কার্মিনেটিভ মিক্সচার তারই পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছে মাত্র।
ঢিলে রগগুলো হঠাৎ টানটান হয়ে উঠতে চায় কম্পাউণ্ডারের, মরা রক্তে হঠাৎ যেন জোয়ার নেমে আসতে চায়। একটা অসহ্য অস্থিরতা হাত দুটোয় নিশপিশ করতে থাকে। কিছু-একটা করা চাই, কিছু-একটা করতেই হবে। তবে ডাক্তার খগেন দাস এলএমএফ-এর মতো বসে বসে সই করা নয়, রোগীর বুকে স্টেথিসকোপ ঠেকিয়েই দুটো টাকা আদায় করে নেওয়া নয়। সে হাতেকলমে কাজ করে, কাজের মানুষ। বইপড়া বিদ্যা নিয়ে ডাক্তারি করা হয় না, তার জন্যে চাই সাধনা, চাই নিষ্ঠা।
সাধনা, নিষ্ঠা। আটাশ টাকা মাইনের কম্পাউণ্ডার হঠাৎ যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠে। কীসব এলোমেলো ভাবছিল সে, স্বপ্ন দেখছিল না কি! কী করতে পারে সে, কী করবার ক্ষমতা আছে তার? তার ঘরে মৃত্যুর ছায়ানৃত্য পরিষ্কার চোখে সে দেখতে পাচ্ছে, বুঝতে পারছে নিজের শরীরের মধ্যে ঘনিয়ে আসছে অনিবার্য ভাঙন। তার রক্তের ভেতরে বালির ডাঙা জেগে উঠছে। সেদিন আর দূরে নয়, যেদিন ওই গোরুর হাড়ে পরিকীর্ণ ফসলহীন মাঠটার মতো ধু-ধু শূন্যতা এসে দেখা দেবে। সাধনা, নিষ্ঠা! ওই ভালো ভালো কথা দুটো কবে ছেলেবেলায় সে পড়েছিল কোন বইতে, আর তা মনে করবারও উপায় নেই।
কম্পাউণ্ডারবাবু!
কম্পাউণ্ডার মুখ ফেরায়। সকালের সেই লোকটি এসে দাঁড়িয়েছে।
কী রে, খবর কী?
ছেলেটা বড়ো ছটফট করছে বাবু। ওষুধ খেতে পারছে না, গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে।
কম্পাউণ্ডার বিড়ি ধরায় আর একটা। অনাসক্ত গলায় বলে, তবে আর কী, এবার কাফনের ব্যবস্থা কর গে। তোর ছেলের হয়ে এসেছে।
লোকটা কেঁদে ফেলে, দোহাই বাবু, এক বারটি চলুন। যদি কিছু করতে পারেন।
মাঠের গরম বাতাসে একমুখ কড়া বিড়ির ধোঁয়া ছড়িয়ে দেয় কম্পাউণ্ডার। বারো গন্ডা পয়সা লাগবে। তখন আট গন্ডায় রাজি হয়েছিলুম, সে তো ভালো লাগল না। গরিবের কথা বাসি হলে ফলে। বারো আনার কমে এখন পারব না। কম্পাউণ্ডারের গলার স্বর গম্ভীর হয়ে। আসতে থাকে, খগেন দাস এলএমএফ-এর ধরনটা সে আয়ত্ত করবার চেষ্টায় আছে।
তাই নাহয় দেব বাবু, মেহেরবানি করে এক বার চলুন। কম্পাউণ্ডারবাবু উঠে দাঁড়ায়। ঘর থেকে একটা ময়লা শার্ট আর পুরোনো স্টেথিসকোপ নিয়ে এসে বলে, চল।
ক্রমে এদিকে মনোযোগ আকৃষ্ট হল ডাক্তারের। কম্পাউণ্ডার তাঁর পসার মাটি করছে। দু টাকার রোগী আট আনায় দেখে আসছে। আর আট আনা হলেও-বা একটা কথা ছিল, যেখানে পয়সা পায় না সেখান থেকে লাউটা কুমড়োটা যা পারে সংগ্রহ করে আনছে। বেশ জুতসই প্র্যাকটিস জমিয়ে নিয়েছে কম্পাউণ্ডার।
প্রথম প্রথম ডাক্তার ব্যাপারটা তেমন লক্ষ করেনি, বরং কৌতুকবোধ করেছে, হাসাহাসি করেছে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। কম্পাউণ্ডারও প্র্যাকটিস করছে, আরশুলাও পাখি হয়ে উড়তে চায়! যেমন সব রোগী জুটছে, তাদের ডাক্তারও জুটেছে তেমনি! এলএমএফ খগেন দাস ঠাট্টা করে কম্পাউণ্ডারের নাম দিয়েছে ধন্বন্তরি।
এই যে ধন্বন্তরি, কীরকম চিকিৎসাপত্তর চলছে?
উত্তরে বেড়ানো মুখে একটুখানি চরিতার্থতার হাসি হেসেছে কম্পাউণ্ডার।
ডাক্তার আরও রসান দিয়ে বলেছে, চিত্রগুপ্তের সঙ্গে ধন্বন্তরির বেশ বন্ধুত্ব দেখা যাচ্ছে। তা বেশ, তা বেশ। আজ ক-টি রোগী ভবপারে যাত্রা করল?
কম্পাউণ্ডার এবারে সংক্ষেপে জবাব দিয়েছে, আপনাদের আশীর্বাদ।
টেবিলের ওপরে পা দুটো তুলে দিয়ে উচ্চাঙ্গের হাসি হেসেছে ডাক্তার। উপদেশ দিয়ে বলেছে, এ কাজ এত সোজা নয় মশাই, তা হলে লোকে আর এত খরচপত্তর করে ডাক্তারি পড়তে যেত না, হাতুড়ে বিদ্যে নিয়েই করে খেতে পারত। লোকের জীবন-মরণের ব্যাপার–ইয়ার্কি নয়। ছাগল দিয়ে কি কখনো হালচাষ হয়? নিজের ওজন বুঝে কাজ করবেন। সহস্ৰমারি হয়ে পটাপট রুগি মারতে শুরু করলে শেষে প্র্যাকটিস চালাবেন কাদের নিয়ে?
কিন্তু ক-দিন যেতে-না-যেতেই উচ্চাঙ্গের হাসিটা বন্ধ হয়ে গেল ডাক্তারের। ভীষণ সত্যটা ক্রমে আত্মপ্রকাশ করতে লাগল। কম্পাউণ্ডারের অত্যাচারে ডাক্তারের প্র্যাকটিস বন্ধ হবার উপক্রম।
খগেন দাস এলএমএফ-এর অবস্থাও যে খুব সমদ্ধ তা নয়। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড কাটা গিয়ে মাইনে মেলে বাষট্টি টাকা বারো আনা। সুতরাং প্র্যাকটিসের ওপরই তারও নির্ভর। কিন্তু কম্পাউণ্ডার অক্টোপাসের মতো যেভাবে চারদিকে বাহু বাড়াচ্ছে তাতে চিন্তিত হবার কারণ ঘটছে। আট আনার ডাক্তার ডাকবার আগেই ছুটে যায়, সুতরাং বিস্তর সাধাসাধি করে দু টাকার ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার কোনো সঙ্গত কারণ নেই—আশপাশের লোকের মনে এই বিশ্বাসটাই বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। এ ঝড়ের সংকেত।
অবস্থার গুরুত্বটা কল্পনা করতেই রাগে ডাক্তারের ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত জ্বালা করে উঠল। আচ্ছা বেকুব এই পাড়াগেঁয়ে হতভাগাগুলো। ভেবেছে ওই কম্পাউণ্ডারই তাদের ত্রাণকর্তা। যে লোকটা ডাক্তারির ক অক্ষরটা অবধি জানে না, মিক্সচার মলম তৈরি করে আর ব্যাণ্ডেজ বেঁধে হাত পাকিয়েছে খালি, তাকেই ওরা ভবার্ণবের কান্ডারি ঠাউরে বসল শেষটাতে! অকৃতজ্ঞ অপদার্থের দল যত! পৃথিবীতে ভালো লোকের আর জায়গা নেই দেখা যাচ্ছে।
ক্রোধের উত্তেজনায় মাথার দু-গাছা কাঁচা চুল ঠিক ব্রহ্মতালুর ওপরটা থেকে উপড়ে আনলেন ডাক্তার। কম্পাউণ্ডারের ওপরে একটা বিষাক্ত বিদ্বেষে এক মুহূর্তে সমস্ত মনটা কালো হয়ে গেছে। নাঃ, বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে, এর আর প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। যাহোক একটা ব্যবস্থা করতেই হবে, এবং সেটা অবিলম্বে।
পর পর তিনটে সিগারেট শেষ করে খগেন দাস আত্মস্থ হলেন খানিকটা। ইচ্ছে করলে একটা কলমের খোঁচাতেই তিনি কম্পাউণ্ডারের চাকরি খেয়ে দিতে পারেন, দিতে পারেন সমস্ত লম্বাই-চওড়াই বন্ধ করে। কিন্তু অতটা অবিবেচক নন তিনি, একটা লোকের অন্ন মারবার মতো অভিপ্রায় তাঁর নেই। আগে একটু ওয়ার্নিং দেওয়া দরকার, তারপর…
কিন্তু ওয়ার্নিংটাই-বা দেওয়া যাবে কেমন করে? আসল কথাটা কম্পাউণ্ডারকে বলা যাবে, আত্মসম্মানে বাধে। ডাক্তারের মনে হল সেটা করুণাভিক্ষার শামিল। সুতরাং অন্য উপায় অবলম্বন করতে হবে।
পাড়াগাঁয়ের ডিসপেন্সারি। সাতটায় খোলবার আইন আছে, কিন্তু পৃথিবীতে আরও অসংখ্য আইনের মতোই এটাকেও কেউ কখনো মনে রাখে না। আটটার সময় কম্পাউণ্ডার এসে চাবি খোলে, চা খেয়ে ডাক্তারের পৌঁছুতে পৌঁছুতে নটা বেজে যায়। আবহমানকাল থেকে এই রীতিটাই চলে আসছে।
হঠাৎ এর ব্যতিক্রম হয়ে গেল।
ডিসপেন্সারি খোলার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার এসে ঢুকলেন। ডাকলেন, কম্পাউণ্ডারবাবু?
কম্পাউণ্ডার আশ্চর্য হয়ে গেল। সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলে, আজ এত সকাল সকাল এলেন যে?
সকাল সকাল! বজ্রগম্ভীর স্বরে ডাক্তার বললেন, ক-টা বেজেছে খেয়াল আছে?
দেওয়ালে ঘড়িটার দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে কম্পাউণ্ডার জবাব দিলে, এই তো আটটা বাজল।
আটটা, কিন্তু ক-টার সময় খোলবার রুল আছে, সেটা জানেন কি?
কম্পাউণ্ডার বিহব্বলদৃষ্টি ফেলল ডাক্তারের মুখের ওপর, বরাবরই তো…
বরাবর! বরাবর এমনি বেআইনি কাজ করেই মাসে মাসে মাইনে গুনে নেবেন? ডিসপেন্সারি আপনার ইয়ের নয় যে নবাবের মতো যখন খুশি এসে অনুগ্রহ করে দোর খুলবেন। এটা পাবলিকের ব্যাপার। কাল থেকে ঠিক নিয়মমতো যদি ডিসপেন্সারি খোলা না হয় তাহলে আপনার নামে আমি রিপোর্ট করতে বাধ্য হব।
তেমনি বিহ্বলভাবে কম্পাউণ্ডার বললে, কিন্তু আপনি তো আগে আমাকে…
আমি বলতে যাব কেন? আপনার ডিউটি নিজে বোঝেন না আপনি? আপনার নিজের একটু রেসপন্সিবিলিটি নেই? ডাক্তারের কন্ঠ যেন বিষ হয়ে ঝরে পড়তে লাগল, ওদিকে তো দিনরাত এপাড়া-ওপাড়া খুব রুগি দেখে বেড়াচ্ছেন, কাঁচকলা আর চালকুমড়ো জোগাড় করছেন। অত চালকুমড়ো খাওয়ার শখ হয়ে থাকলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেই ডিসপেন্সারি খুলে বসুন!
অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে গেছে কম্পাউণ্ডার। একটা কথাও তার মুখে জোগাচ্ছে। ওদিকে ডাক্তারের চোখ দুটো হিংস্রতায় দপ দপ করছে, সমস্ত মুখটা কুটিল হয়ে গেছে ক্ষিপ্ত ঈর্ষায়, তাঁর গলা চড়ছে পর্দায় পর্দায়। ওষুধ নেবার জন্যে যারা দোরগোড়ায় ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল, তারা অবাকবিস্ময়ে শুনে যাচ্ছে ডাক্তারের কটু-কঠোর মন্তব্যগুলো!
ডাক্তার হয়েছেন? প্র্যাকটিস করা হচ্ছে? একটা প্রেসক্রিপশন রিপিট করতে পর্যন্ত ভুল করেন, লজ্জা হয় না আপনার? আর সরকারি কাজ ফেলে ধন্বন্তরি হওয়ার চেষ্টায় আছেন। যদি মন দিয়ে কাজ না করেন তাহলে আপনার নামে রিপোর্ট আমাকে পাঠাতেই হবে, একথা আর এক বার জানিয়ে যাচ্ছি।
গর্জনে ঘর কাঁপিয়ে বেরিয়ে গেলেন ডাক্তার। বাইরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাঁর জুতোর শব্দ বাজতে লাগল।
কম্পাউণ্ডারের ঘোলা চোখে এতদিন পরে সত্যিকারের আগুন ঝিকিয়ে উঠল, বাঁকা মেরুদন্ডটাকে আশ্রয় করে বয়ে গেল পৌরুষের দীপ্তি। ডাক্তারকে সে বুঝতে পেরেছে। ঈর্ষা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা! এ এক নতুন অস্ত্র সে হাতে পেয়েছে। এতদিন সে ডাক্তারকে ভয় করে এসেছে, এইবার ডাক্তার ভয় করতে শুরু করেছে তাকে। তার প্র্যাকটিসের ফলে আজ ডাক্তারের প্রেস্টিজ এবং পসার বিপন্ন হতে বসেছে।
ভয় হল না কম্পাউণ্ডারের, দুঃখও না। বহুদিন পরে পিঠটাকে সোজা করে দৃঢ় হয়ে দাঁড়াল সে। এতগুলো লোকের সামনে ডাক্তার তাকে অপমান করে গেছে, কিন্তু তারই সঙ্গে নিজের মধ্যে একটা কঠিন লৌহবর্মের অস্তিত্ব অনুভব করেছে কম্পাউণ্ডার। যে-বর্মে লেগে তুচ্ছতার সমস্ত আঘাতগুলো অতি সহজেই প্রতিহত হয়ে যায়। এতদিন পরে স্বীকৃত হয়ে গেছে তার জীবনের, তার স্বাতন্ত্রের দাবি। এইবার নিজেকে প্রমাণ করবার সময় এসেছে। তার। আটত্রিশ বৎসর বয়সে আটাশ টাকার পাথর চাপা পড়েই তার মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু হয়নি। এইবার কাজ করতে হবে তাকে, কিছু-একটা করতেই হবে।
কম্পাউণ্ডিং রুমে ঢুকে পাশের আলমারিগুলোর দিকে তাকাল সে। খালি শিশি বোতলগুলো স্তরে স্তরে সাজানো। ওখানে কিছু করবার নেই, উপায়ও নেই কিছু করবার। নিজেকে প্রমাণ করবার শক্তি নেই তার। ছোটো আলমারির চাবি আগেই হস্তগত করেছে। ডাক্তার, দু-চারটে ভালো ওষুধপত্র যে সেখান থেকে সংগ্রহ করা যাবে সে-পথও বন্ধ।
কিন্তু তবু, তবু চেষ্টা করতে হবে। অস্তিত্বের দাবি আজ প্রমাণিত হয়ে গেছে। ভিটামিন বির অভাবে তার স্ত্রীর বিবর্ণ পাড়ুর মুখের ওপরে ছড়াচ্ছে মৃত্যুর ছায়া। ছেলে-মেয়েগুলোর সর্বাঙ্গে সংক্রামক অস্বাস্থ্যের কুৎসিত বহিঃপ্রকাশ। শুধু তার ঘরে নয়—দিকে দিকে, যতদূর চোখ যায় ততদূর-রৌদ্রদগ্ধ শূন্য প্রান্তরের মতো একটা শ্মশান আকীর্ণ হয়ে পড়েছে। কিছু কি করবার নেই, কিছুই না?
দাঁতে দাঁত চেপে কম্পাউণ্ডার ভাবতে লাগল। আঙুলগুলো অধৈর্যভাবে আঁকড়ে ধরতে লাগল মলম-তৈরি-করা ছুরিটার হাড়ের বাঁটটা। আর কিছু না হোক এইটে দিয়ে একটা মানুষও তো খুন করতে পারে সে!
কিন্তু ডাক্তারের সঙ্গে ঠোকাঠুকির আর বিরাম নেই।
কী করে রেখেছেন টেবিলগুলো? দেখুন দেখি এক বার। একটা কাগজ মানুষে খুঁজে পায় এখানে!
কম্পাউণ্ডার নিরুত্তর।
বলেছিলাম প্রেসক্রিপশনের বইটা ফুরিয়ে গেছে, একটা নতুন প্যাড বার করে রাখবেন। কিন্তু কোনো দিকে লক্ষই নেই আপনার। খালি ভাবছেন কখন কোন ফাঁকে বেরিয়ে লাউ কুমড়োর ব্যবস্থা করে আসবেন। নাঃ, আপনাকে দিয়ে আমার পোষাবে না মশাই হয় আপনাকে ট্রান্সফার করুক, নয় আমাকে। এ ছাড়া আর তো কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না।
সার্ভিং টেবিলটার কাছে দাঁড়িয়ে কম্পাউণ্ডার ভাবতে লাগল— ঠিক কথা। আর কোনো পথ নেই। এক আকাশে দুই সূর্য শোভা পেতে পারে না। আজ তার নবজন্ম হয়েছে, সে শুধু ডাক্তারের সমকক্ষ নয়, তার উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। কাগজের বিদ্যাই বড়ো নয়, হাতের বিদ্যা তার চাইতে ঢের বেশি। এই সত্যকে সে প্রচার করবে, সে প্রতিষ্ঠা করবে।
গতানুগতিক বাঁধা নিয়মে একই ওষুধ নানা শিশিতে ঢালতে ঢালতে কম্পাউণ্ডার তার নতুন রোগীর কথা চিন্তা করতে লাগল। পুরোনো অসুখ, বহুদিন থেকে ভুগছে। ডাক্তার খগেন দাস তিন মাস নিয়মিত ভিজিট গুনে নিয়েছে, কিন্তু কিছু করতে পারেনি। এবার তার পালা।
কিছু করা চাই, কিছু করতে হবে অথচ ওষুধ নেই, উপায় নেই! কম্পাউণ্ডারের দাঁতে দাঁত আবার চেপে বসতে লাগল। উপায় নেই! ওষুধ চাই—ভালো ওষুধ। এক বার সুযোগ পেলে সে দেখিয়ে দিতে পারে তারও ক্ষমতা আছে। কম্পাউণ্ডারের মাথার ভেতরে রক্তের উচ্ছাস যেন ফেটে পড়তে লাগল। কিছু তাকে করতেই হবে—যেমন করে হোক, যে উপায়েই হোক।
ছোটো আলমারিটা খুঁজলে কিছু মিলতে পারে, কিন্তু তার চাবিটা আগেই হাত করেছে ডাক্তার। সবদিক থেকে তার পথরোধ করে দাঁড়াতে চায়। বেশ, এই ভালো। এ বাধা ভেঙে সেও এগিয়ে যেতে জানে, সেও…
বলি ও কম্পাউণ্ডারবাবু, ও সহস্ৰমারি ধন্বন্তরি মশাই! কুৎসিত কটুগলায় ডাক্তার তাকে ডাকছে। কম্পাউণ্ডারের কপালের রেখাগুলো কুঁচকে উঠল এক বার, তারপর সহজ স্বাভাবিকভাবে সাড়া দিলে, ডাকছেন আমাকে?
হ্যাঁ, ডাকছিলাম তো অনেকক্ষণ থেকে, কিন্তু আপনি তা শুনতে পাননি বোধ হয়। বিকৃত স্বরে ডাক্তার বলে যেতে লাগলেন, আজকাল আপনি একেবারে স্যার নীলরতন সরকার হয়ে উঠেছেন, এসব গরিবের ডাক আপনাদের মতো বড়ো বড়ো ডাক্তারের কানে পৌঁছুবে কেন!
কম্পাউণ্ডারের জীর্ণ হাতে দুর্বল মাংসপেশি আর রক্তহীন শিরাগুলো যেন অকস্মাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। প্রচন্ড বেগে একটা ঘুসি সে ডাক্তারের মুখের ওপরে বসিয়ে দেবে না কি! কিন্তু কিছুই করলে না কম্পাউণ্ডার, শুধু তেমনি নিষ্কম্প গলায় বললে, কী করতে হবে?
অধমকে একটু অনুগৃহীত করতে হবে। সিগারেটের ধোঁয়াটা একেবারে কম্পাউণ্ডারের মুখের ওপরেই ছেড়ে দিলেন ডাক্তার। এই উণ্ডটা একটু ড্রেস করে দিতে হবে। ধন্বন্তরির মূল্যবান সময়টা একটু নষ্ট হবে, কিন্তু এ দুর্ভাগা নিতান্তই নাচার।
ডাক্তারের ঠোঁটের কোণে সিগারেটটা দুলতে লাগল। কম্পাউণ্ডার নীরবে সেলফ থেকে তুলোর প্যাকেট গজকাঠি আর আইডিনের শিশিটা তুলে নিলে।
ফাঁকা মাঠের ওপরে ঘনিয়েছে কৃষ্ণা রাত্রি। আকাশে তারার রোশনাই তেমন জ্বলছে না, লঘু বিচ্ছিন্ন মেঘ তাদের ওপর দিয়ে আবরণ টেনে দিয়েছে। কালো অন্ধকারের মধ্যে সামনের মাঠটা থেকে যেন প্রেতলোকের সন্ধান দিচ্ছে এলোমেলো আলেয়া। হু-হু করে বয়ে যাচ্ছে গরম বাতাস। দিনের প্রখর উত্তাপের রেশটা জুড়িয়ে যায়নি এখনও। শেষরাত্রে বোধ হয় বৃষ্টিবাদল হবে কিছু। বহুদূরের দিগন্তে মাঝে মাঝে চমকাচ্ছে বিদ্যুতের রক্তদীপ্তি। ডিসপেন্সারির চারদিকে নিচ্ছেদ স্তব্ধতা।
অন্ধকারে চাবি ঘোরাবার শব্দ হল— খুট। হাওয়ার সঙ্গে শব্দ মিলিয়ে দরজাটাও খুলে গেল। কালো রাত্রির সঙ্গে একাকার হয়ে কম্পাউণ্ডারের ভৌতিক মূর্তিটা প্রবেশ করলে ডিসপেন্সারিতে। উত্তেজনায় সর্বাঙ্গ কাঁপছে।
থেকে থেকে চমকে উঠছে হৃৎপিন্ড। কপালের আবটার ওপরে ঘামের বিন্দু জমে উঠেছে।
কিন্তু ঘাবড়ালে চলবে না, পিছোলেও চলবে না। তার শক্তির পরীক্ষা—তার আত্মপ্রতিষ্ঠার অধিকার। যেমন করে হোক তার রুগিকে সারিয়ে তুলতে হবে, তার প্রথম আত্মোপলব্ধির মূল্য বিচার করে দেখতে হবে। বেড়ালের মতো গুড়ি মেরে এগোতে লাগল কম্পাউণ্ডার। ওষুধের বহুবিচিত্র মিশ্র-গন্ধে-ভরা থমথমে অন্ধকার যেন তার দম আটকে আনতে লাগল। কিছু জোর করে একটা নিশ্বাস ফেলতেও ভরসা পাচ্ছে না সে। পাছে বেশি করে শব্দ হয়, পাছে এক মুহূর্তে বিদীর্ণ হয়ে যায় রাত্রির এই সমাহিত স্তব্ধতা!
তারপর, তারপর কম্পাউণ্ডারের কম্পিত হাত স্পর্শ করলে ছোটো আলমারির ডালাটা। কবজাটা ধরে একটা মোচড় দিলেই…।
টর্চলাইটের তীব্র ঝাঁকালো আলো কম্পাউণ্ডারের গায়ে এসে পড়ল বন্দুকের গুলির মতো। তড়িদবেগে লাফিয়ে উঠল কম্পাউণ্ডার। অন্ধকারের ভেতরে ডাক্তারের সংক্ষিপ্ত হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল, যেন একটা গোখরো সাপ প্রবল বেগে ছোবল বসিয়ে দিলে কোথাও।
ডাক্তার বললে, চমৎকার! ভাগ্যিস ঘুম আসছিল না বলে বারান্দার অন্ধকারে চুপচাপ পড়ে ছিলাম, সেইজন্যই তো ধন্বন্তরির এ দেবলীলাটা দেখতে পেলাম। চুরিচামারিতে প্র্যাকটিসটা বেশ জমে উঠেছে তাহলে!
কম্পাউণ্ডারের বিবর্ণ মুখের ওপর টর্চের আলো আগুনের জ্বালার মতো জ্বলতে লাগল।
ভালো, ভালো। ডাক্তার শান্তস্বরে বললে, কিন্তু ভদ্রলোকের ছেলেকে আমি জেলে পাঠাতে চাই না। তবে কাল থেকে ডিসপেন্সারির চাবিটাও আমার কাছে থাকবে আর একটা চৌকিদারেরও বন্দোবস্ত হবে। তা হলেই আর ওষুধ চুরির ভয় থাকবে না, কী বলেন কম্পাউণ্ডারবাবু?
পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল কম্পাউণ্ডার। শরীরটা একচুল নড়ল না, একটা নিশ্বাস পড়ল না পর্যন্ত।
পরদিন দুপুরে কম্পাউণ্ডারের বাড়ি থেকে একটা বিশ্রী মড়াকান্নার শব্দে ডাক্তার ছুটে এলেন।
কী হল? ব্যাপার কী?
কম্পাউণ্ডার কোনো জবাব দিলে না। সামনে মেঝের ওপর কম্পাউণ্ডারের স্ত্রী হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে। বড়ো বড়ো শ্বাস উঠছে-পড়ছে, চোখ দুটো ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসছে তার। সমস্ত গাল মুখ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে—রক্তবমি করেছে সে।
ডাক্তার শিউরে উঠলেন। কম্পাউণ্ডারকে একটা সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, কথা বলছেন না যে? ব্যাপার কী?
অর্থহীন দৃষ্টিতে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে কম্পাউণ্ডার বললে, পেটে একটা যন্ত্রণা হচ্ছিল, ঠিক ডায়গোনাইজ করতে পারিনি। ওষুধ দিয়েছিলাম।
ওষুধ! কী ওষুধ?
তা তো জানি না। আপনার ছোটো আলমারিতে তো হাত দেবার উপায় নেই। তাই সামনে যা পেয়েছিলাম— আইডিন, মরফিয়া, রেকটিফায়েড স্পিরিট, কার্বলিক অ্যাসিড, স্ট্রিকনিন, সিঙ্কোনা সব মিলিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করবার চেষ্টা করেছিলাম।
ডাক্তার পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলেন, আপনি মার্ডারার, আপনার স্ত্রীকে নিজের হাতে আপনি খুন করেছেন! আপনার ফাঁসি হওয়া উচিত, Yes, you deserve it! এক্সপেরিমেন্ট! কেন আপনি আমাকে এক বার জিজ্ঞাসা করলেন না? এক বার ডাকলেন না?
ঘষা চোখে, জীর্ণ গলায় আটাশ টাকার কম্পাউণ্ডার জবাব দিলে, আপনাকে ভিজিট দেবার পয়সা ছিল না।