ধনীরাম
ধনীরামের কাহিনী প্রায় সমস্ত পত্র-পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে। একটি ইংরেজি দৈনিক, ধনীরামকে রীতিমতো গুরুত্ব দিয়ে, তাঁর ওপরে সম্পাদকীয় নিবন্ধ রচনা করেছেন।
এখন যখন রাজাগজারা কাঠগড়ায়; জোচ্চুরি, প্রবঞ্চনার মামলায় রথী মহারথীদের মধ্যে কে যে অভিযুক্ত, কে যে অভিযুক্ত নয় তাই মনে রাখা কঠিন, তখন শ্রীযুক্ত ধনীরামকে এত গুরুত্ব দেওয়া কেন, ধনীরামও তো ফেঁসে গেছেন ওই জোচ্চুরিরই মামলায়।
ধনীরামের জীবনকাহিনী একটু সংক্ষিপ্ত করে বলি, তাতে তাঁর কৃতিত্বের কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে।
অন্য আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো যৌবন বয়েসে শ্রীযুক্ত ধনীরাম চাকরিতে ঢুকেছিলেন। রেলের হেড অফিসের চাকরি, এসটাব্লিশমেন্ট দপ্তরে। বদলি, প্রমোশন, অবসরগ্রহণ সবই এই দপ্তরের মাধ্যমে হয়।
দুঃখের বিষয়, দু’-তিন বছরের মধ্যে ধনীরামের চাকরিটি গেল দুর্নীতির দায়ে পড়ে।
ধনীরাম অফিস ছাড়তে বাধ্য হলেন। কিন্তু এতে তাঁর বিশেষ কোনও ক্ষতি হল না। বরং লাভই হল। চাকরি ছেড়ে চলে আসার সময় তিনি গোপনে অফিসের একটি রাবার স্ট্যাম্প, কয়েক রকম ছাপানো ফর্ম ইত্যাদি নিজের ব্যাগে ভরে নিয়ে এলেন। এই সঙ্গে তিনি অফিসের ফাইল থেকে কোন কোন স্টেশনের স্টেশনমাস্টার ছুটির দরখাস্ত করেছেন তার একটা তালিকা তৈরি করে সঙ্গে নিলেন।
এর পরের কাজ খুব সোজা। সব চেয়ে জরুরি, ছুটির দরখাস্ত যে স্টেশনমাস্টারমশায়ের, যাঁর বৃদ্ধ বাবা মৃত্যুশয্যায় কিংবা দেশের বাড়িতে যাঁর সন্তানসম্ভবা পূর্ণগর্ভা স্ত্রী একাকিনী রয়েছেন সেই স্টেশনমাস্টারের ওখানে গেলেন ধনীরাম।
অফিস থেকে চুরি করে নিয়ে আসা সরকারি ফর্মে শূন্যস্থান পূরণ করে ছুটি মঞ্জুর করে তার নীচে রবার স্ট্যাম্পের ছাপ লাগিয়ে সঙ্গে অস্পষ্ট সরকারি স্বাক্ষর, ধনীরাম কাগজটা স্টেশনমাস্টারের হাতে দিলেন। সেই সরকারি কাগজের নীচে একথাও মুদ্রিত রয়েছে যে প্রয়োজনের গুরুত্ব বুঝে রেল কর্তৃপক্ষ ছুটির সময়ে বর্তমান স্টেশনমাস্টারের স্থলাভিষিক্ত যিনি হবেন তাঁর মারফতই এই বার্তা পাঠাচ্ছেন।
বলা বাহুল্য, শ্রীযুক্ত ধনীরাম তাঁর স্বল্প মেয়াদি চাকরি জীবনে হেড অফিসের টেবিলে বসে এ রকম দু’-চারটি অর্ডার দেখেছেন, এবার সেটাই ব্যবহার করলেন।
এই অর্ডার পেয়ে স্টেশনমাস্টারমশায় যেন হাতে চাঁদ পেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সরল মনে ধনীরামকে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে স্বগৃহে যাত্রা করলেন।
ধনীরাম এখন এই স্টেশনের সর্বেসর্বা। আর কিছু নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই শুধু দৈনিকের টিকিট বিক্রির টাকা গুনে গুনে নিয়ে রসিদ দিয়ে দেন।
তিরিশ দিন পরে এক মাসের ছুটির শেষে, আগের স্টেশনমাস্টারমশায় ফিরবেন। শ্রীযুক্ত ধনীরাম তার কিছু আগেই কেটে পড়লেন ছাব্বিশ দিনের মাথায়, এই ছাব্বিশ দিনের টিকিট বিক্রির টাকা, জরিমানা, লাইসেন্স ফি যা কিছু রেল কোম্পানির আয় তার এক পয়সাও ধনীরাম কোম্পানির সদর অফিসে জমা দেননি।
ধনীরাম নিরুদ্দেশ হলেন। পুরনো স্টেশনমাস্টারমশায়ের ফিরে এসে ব্যাপারটা বুঝতে সপ্তাহখানেক লাগল। তার পরেও হেড অফিসের লাগল তিন মাস।
এরই মধ্যে আরও দুটো স্টেশনে ভারপ্রাপ্ত স্টেশনমাস্টারকে ছুটি দিয়ে, একজনকে বিয়ে করতে পাঠিয়ে এবং অন্যজনকে গয়াধামে মা-বাবার পিণ্ড দিতে অবকাশ দিয়ে, ধনীরাম উনিশ দিন এবং সতেরো দিন স্টেশনমাস্টারি করেছেন।
ধনীরাম অবশেষে ধরা পড়েছিলেন।
ক্রমশ ধনীরামের সাহস ও আত্মপ্রত্যয় খুব বেড়ে গিয়েছিল। একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলেন। তা ছাড়া স্টেশনে স্টেশনে উড়ো খবর রটে গিয়েছিল। ধনীরাম ধরা পড়লেন চতুর্থ স্টেশনে, তাঁর হাজতবাস শুরু হল।
পর পর কয়েকটা প্রতারণার মামলায় ধনীরামকে বহুবার ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হল। ফৌজদারি আদালতের কর্মপদ্ধতি বুঝে নিতে তাঁর অসুবিধে হল না। বছর কয়েক জেল খেটে তিনি যখন খালাস হয়ে বেরলেন তখন পরবর্তী কার্যকলাপ ঠিক করে ফেলেছেন।
এক ছুটি প্রার্থী ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে জাল ছুটির অর্ডার ধরিয়ে দিয়ে তাঁকে বিদায় করে বিচারকের আসনে বসলেন ধনীরাম। এর পর টাকা নিয়ে খুন-ডাকাতি-রাহাজানির মামলার আসামিদের বেকসুর খালাস করে দিতে লাগলেন।
এবারও একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। একের পর এক গোলমেলে রায় দেখে পুলিশের মনে কেমন খটকা লাগল। এক মাসের মধ্যেই ধনীরাম গ্রেপ্তার হলেন। তিনি এখন আবার হাজতে।
ধনীরামের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা জানবার জন্যে এবার আমাদের আবার কয়েকবছর অপেক্ষা করতে হবে।
হয়তো ধনীরাম তাঁর জেলের জেলার সাহেবকে ছুটি দিয়ে নিজেই জেলার সেজে বসবেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ফাঁসির আসামিদের জেল থেকে ছেড়ে দেবেন।
তার পূর্বেই অবশ্য ধনীরামের নাম গিনেস বুক অফ রেকর্ডে ওঠা উচিত।