কৃষ্ণা (দ্রৌপদী, যাজ্ঞসেনী) – পাঞ্চাল রাজ দ্রুপদের কন্যা ও পঞ্চ পাণ্ডবের পত্নী। দ্রৌপদী পাঁচ সন্তানের জন্ম দেন (এঁরা সবাই পূর্বজন্মে বিশ্ব-নামধারী দেবতা ছিলেন) – প্রতিবিন্ধ্য (যুধিষ্ঠিরের), সুতসোম(ভীমের), শ্রুতকীর্তি (অর্জুনের),শতানীক (নকুলের) এবং শ্রুতসেন (সহদেবের)। রাজা দ্রুপদ (যজ্ঞসেন) বাল্যবন্ধু দ্রোণের কাছে অপমানিত হয়ে দ্রোণ-বধের নিমিত্তে পুত্রার্থে যে যজ্ঞ করেন, সেই যজ্ঞাগ্নি থেকে প্রথমে পুত্র (ধৃষ্টদ্যুম্ন) ও পরে যজ্ঞবেদী থেকে এক কন্যা (কৃষ্ণা) উত্থিত হন। কৃষ্ণার আবির্ভাব-কালে দৈববানী হয়েছিল যে, সর্বনারীর শ্রেষ্ঠা এই কৃষ্ণা থেকে ক্ষত্রিয় ক্ষয় ও কুরুবংশের মহাভয় উপস্থিত হবে। যজ্ঞের আচার্য ব্রহ্মর্ষি যাজের আশীর্বাদে ধৃষ্টদ্যুম্ন কৃষ্ণা দ্রুপদ ও তাঁর মহিষী পার্ষতীকে পিতা ও মাতা বলে জানলেন। দ্রুপদের ইচ্ছা ছিল তৃতীয় পাণ্ডব ধনুর্বীর অর্জুনের সঙ্গে কৃষ্ণার বিবাহ হোক। কিন্তু সেই ইচ্ছা প্রকাশ না করে তিনি একটি ধনু তৈরী করালেন যে, অসাধারণ ধনুর্বীর না হলে কেউ তাতে গুণ পরাতে পারবেন না। তারপর ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে এমন ভাবে একটি লক্ষ্য স্থাপন করলেন যাকে বিদ্ধ করতে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্য দিয়ে বাণ চালনা করতে হবে। এইবার কৃষ্ণার স্বয়ংবর সভার আয়োজন করে তিনি ঘোষণা করলেন, যে ঐ ধনুর্বাণ ব্যবহার করে লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন, তাঁকেই কৃষ্ণা বরমাল্য দেবেন। দ্রুপদ আশা করেছিলেন যে অর্জুন ব্যতীত কেউই এই কার্যে সক্ষম হবেন না। সমবেত রাজারা একে একে উঠে ধনুতে গুণ পরাতে গিয়ে পর্যুদস্ত হলেন। তখন কর্ণ উঠে এসে সহজেই ধনুতে গুণ পরিয়ে শরসন্ধান করলেন। তাই দেখে কৃষ্ণা বলে উঠলেন যে, তিনি সূতজাতীয়কে বরণ করবেন না। অপমানিত কর্ণ সূর্যের দিকে তাকিয়ে একটু কঠিন হাস্যে ধনুর্বাণ ত্যাগ করলেন। আরও কয়েকজন রাজার নিষ্ফল চেষ্টার পর ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন (পঞ্চপাণ্ডব তখন মাতা কুন্তিকে নিয়ে বারণাবত থেকে পালিয়ে এসে ব্রাহ্মণের বেশ ধরে আত্মগোপন করে আছেন) উঠে এসে মহাদেব ও কৃষ্ণকে স্মরণ করে বাণযোজনা করে লক্ষ্যভেদ করলেন আর কৃষ্ণাও স্মিতমুখে সেই ব্রাহ্মণবেশী বীরের গলায় বরমাল্য পরিয়ে দিলেন। ভীম ও অর্জুন কৃষ্ণাকে নিয়ে এসে মাতা কুন্তিকে বললেন যে,তাঁরা ভিক্ষা এনেছেন। কুন্তি ঘরের ভেতরে। কি আনা হয়েছে না দেখে বললেন, সকলে একসঙ্গে মিলে ভোগ কর। অর্জুন মাতৃবাক্য লঙঘণ করতে রাজি হলেন না। তখন পাণ্ডবরা স্থির করলেন কৃষ্ণা সবারই পত্নী হবেন। পঞ্চপাণ্ডবকে কন্যা দান করতে দ্রুপদ দ্বিধাগ্রস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাসদেব এসে তাঁকে বললেন যে, ইন্দ্র ও তাঁর পূর্ববর্তী চার ইন্দ্রকে তাঁদের দর্পের জন্য মহাদেব মনুষ্য হয়ে জন্মাতে বলেছেন আর এক লোকবাঞ্ছিতা রমনীকে তাঁদের ভার্যা করার জন্য আদেশ দিয়েছেন। সেই শ্রীরূপিণী রমণীটি পূর্বে ছিলেন এক ঋষিকন্যা, যাঁকে মহাদেব পঞ্চপতি পাবার বর দিয়েছিলেন। পঞ্চপাণ্ডব হলেন সেই শাপগ্রস্থ পঞ্চ ইন্দ্রের অংশ, যাঁদের ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্র ও অশ্বিনীকুমারদ্বয় মানুষীর গর্ভে উৎপাদন করেছেন, আর কৃষ্ণা হলেন সেই ঋষিকন্যা। মহাদেবের ইচ্ছাতেই কৃষ্ণা পঞ্চপাণ্ডবের পত্নী হবেন। এরপর আর কোনও বাধা রইলো না। এর কিছুদিন পর পাণ্ডবরা ধৃতরাষ্ট্রের নির্দেশে অর্ধরাজ্য লাভ করে ইন্দ্রপ্রস্থে বসবাস শুরু করলেন। দ্রৌপদীকে নিয়ে ভ্রাতাদের মধ্যে যাতে কোনও বিরোধ না হয় তারজন্য পাণ্ডবরা নিজেদের মধ্যে স্থির করলেন যে, দ্রৌপদীর সঙ্গে যিনি বাস যখন বাস করবেন, তখন তিনি ব্যতীত অন্য কেহ শয়নগৃহে প্রবেশ করবেন না। যদি করেন, তাহলে তাঁকে বার বৎসর বনবাসে গিয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে। এক ব্রহ্মণের গোধন রক্ষা করার জন্য অর্জুনকে এই নিয়ম ভঙ্গ করতে হয়েছিল। যুধিষ্ঠিরের বারণ সত্বেও অর্জুন বনবাসে গেলেন। পঞ্চ স্বামীকে ভলোবাসলেও অর্জুনই ছিলেন দ্রৌপদীর প্রিয়তম (কাম্যক বনে বনবাস কালে অর্জুন যখন তপস্যার জন্য হিমালয়ে গিয়েছিলেন, তখন অকপটেই কৃষ্ণা যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন যে, পাণ্ডবশ্রেষ্ঠকে দেখতে না পেয়ে, এই বনভূমি তাঁর আর ভালো লাগছে না)। তাই অর্জুন যখন বারো বৎসর পরে তাঁর নতুন ভার্যা সুভদ্রাকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে দ্রৌপদীর সঙ্গে দেখা করতে এলেন, তখন অভিমানিনী দ্রৌপদী বলতে শোনা যায়, নতুন বন্ধন হলে পুরনো বন্ধন শিথিল হয়ে যায়। অর্জুন সুভদ্রার কাছে গিয়েই থাকুন। দ্রৌপদীর অভিমান ভঙ্গ করতে অর্জুনকে বেগ পেতে হয়েছিল। পঞ্চপাণ্ডবের মত বীররা তাঁর স্বামী হলেও কৃষ্ণাকে সারা জীবন বহু অপমান সহ্য করতে হয়েছে। পণদ্যূতে হেরে যুধিষ্ঠির ভ্রাতা সহ কৃষ্ণার স্বাধীনতা হারিয়েছেন। ফলে দুরাত্মা দুর্যোধন দ্রৌপদীকে কেশ আকর্ষণ করে সভায় নিয়ে এসে দাসী বলে সম্বোধন করেছেন। তাঁর বস্ত্র পর্যন্ত হরণ করার চেষ্টা করেছেন। ধর্মপরায়ণ পতিদের কাছে কোনও সাহায্য না পেয়ে দ্রৌপদী কৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়েছেন। যোগবলে সুদূরে থাকা সত্বেও কৃষ্ণ তাঁকে চরম লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। পণদ্যুতে দ্বিতীয়বার পরাজিত হয়ে পাণ্ডবরা যখন বনবাস করছেন, তখন কৃষ্ণ ওঁদের দেখতে এসেছিলেন। দ্রৌপদী তখন সভাগৃহে তাঁর চরম লাঞ্ছনার কথা শুনিয়ে কৃষ্ণকে অনেক অনুযোগ করে বলেছেন যে, চারটি কারণে কৃষ্ণ যেন ওঁকে নিত্য রক্ষা করেন। প্রথমত, কৃষ্ণের সঙ্গে ওঁর সম্বন্ধ (তিনি কৃষ্ণের ভ্রাতৃবধূ – তিন পাণ্ডবভ্রাতা কৃষ্ণের পিসীমাতার পুত্র); দ্বিতীয়ত, ওঁর পবিত্রতা (উনি যজ্ঞবেদী সম্ভূতা); তৃতীয়ত, ওঁর সখ্যতা (তিনি কৃষ্ণের অনুগতা সখী); এবং চতুর্থত কৃষ্ণের শক্তিমত্বা। পঞ্চপাণ্ডব মহাবীর হওয়া সত্বেও রক্ষক হিসেবে কৃষ্ণকে তাঁর দরকার হয়েছে। সাধারণত বিপদে আপদে ভীমই ছিলেন দ্রৌপদীর ভরসা। ভীমও দ্রৌপদীকে রক্ষা করতে সবসময়েই তৎপরতা দেখিয়েছেন। কৌরব সভায় দ্রৌপদীর অপমান প্রত্যক্ষ করে ভয়ানক প্রতিজ্ঞা, দ্রৌপদী-হরণ প্রচেষ্টার জন্য জয়দ্রথকে অমানুষিক প্রহার, দ্রৌপদীর ওপর বলপ্রয়োগের জন্য পাপিষ্ঠ কীচককে বধ, কীচকের স্বজন কর্তৃক কীচকের সঙ্গে দ্রৌপদীকে দাহ করার অপচেষ্টা নষ্ট করা, ইত্যাদি ব্যাপারে ভীমকেই সচেষ্ট দেখা যায়। দ্রৌপদী তাঁর তেজস্বিতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। অজ্ঞাতবাস শেষ হবার পর কৌরবদের সঙ্গে শান্তিস্থাপনের আগ্রহে যখন যুধিষ্ঠির, অর্জুন, এমন কি ভীমসেন পর্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করছেন, তখন দ্রৌপদী কৃষ্ণকে বলছেন যে, রাজ্যার্ধ না দিলে কখনোই সন্ধির প্রস্তাব যেন না করা হয়। সবাই কি ওঁর লাঞ্ছনার কথা ভুলে গেছেন? তারপর নিজের উন্মুক্ত কেশগুচ্ছ কৃষ্ণের সামনে তুলে ধরে বলেছেন যে, কৃষ্ণ যেন মনে রাখেন – দুঃশাসন এই কেশগুচ্ছ স্পর্শ করেছে! তারপর ভীমার্জুনকে উদ্দেশ্য করেই কৃষ্ণকে বলেছেন যে, ভীমার্জুন যদি যুদ্ধ করতে না চান, তাহলে ওঁর বৃদ্ধ পিতা ওঁর ভ্রাতাদের এবং ওঁর পাঁচ পুত্র ও অভিমন্যুকে সাথে নিয়ে যুদ্ধ করবেন। দ্রৌপদীর এই তেজোস্বিতা পাণ্ডবদের, বিশেষ অরে ভীমকে যেরকম উদ্দীপ্ত করেছে, কৌরবদের সেই রকম ভীতি উৎপাদন করেছে। মহাযুদ্ধের শেষে গভীর রাত্রে অশ্বত্থমা পাণ্ডবশিবিরে ঢুকে দ্রৌপদীর ভ্রাতা ও পুত্রদের হত্যা করেছেন যেনে দ্রৌপদী শোকে দুঃখে বিহবল হয়েছেন। বলেছেন অশ্বত্থমা নিহত না হলে অনাহারে প্রাণত্যাগ করবেন। যুধিষ্ঠির যখন ওঁকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছেন, তখন তিনি ভীমকে বলেছেন অশ্বত্থমাকে বধ করে ওঁর মস্তকের সহজাত মণি এনে যুধিষ্ঠিরকে দিতে। ভীম তখন অশ্বত্থমার খোঁজে গেছেন। যুধিষ্ঠির যখন যুদ্ধজয় করেও বিষাদগ্রস্থ হয়ে বনবাসের কথা ভাবছেন, তখন দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁর এই চিন্তা ক্ষত্রিয়জনোচিত নয়। পুত্রদের হারিয়েও দ্রৌপদী বাঁচতে চাইছেন, তাহলে যুধিষ্ঠিরের এই অবস্থা কেন। ধর্মপথে যুধিষ্ঠির পৃথিবী শাসন করুন। মহাপ্রস্থানের পথে মহাশৈল মেরুর কাছে এসে কৃষ্ণাই প্রথমে পতিত হলেন। ভীমের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বললেন যে, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর পক্ষপাত ছিল। সেই দোষেই ওঁর পতন ঘটল। সেই দোষ সত্বেও দ্রৌপদীকে হিন্দুদের প্রাতঃস্মরণীয়া পঞ্চনারীর (কুন্তি, দ্রৌপদী, তারা, মন্দোদরী ও অহল্যা) অন্যতমা বলে গণ্য করা হয়।