দ্রব্যগুণ
বড়দিনের বাজার করিতে এটা-ওটা-সেটায় বোঝাটা বেজায় ভারি হইয়া গেল। এই দুঃখে বাজারে বড় একটা আসি না। সবার টানাটানিতে পড়িয়া কিছু কিছু করিতে বিষম হইয়া পড়ে।
সবশেষে পড়িয়াছিলাম মুদীর পাল্লায়। আমার প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের অপেক্ষা না রাখিয়াই ছোট বড় নানা রকম পুলিন্দা বাঁধিয়া ঝুড়ির ফাঁকটাকে বুজাইয়া দিতেছিল। শেষ হইলে ঝুড়ির চারিদিক একবার ভালো করিয়া নিরীক্ষণ করিয়া হাত দুইটা সশব্দে ঝাড়িয়া বলিল, “এই কপির পাশটা খালি রয়েছে—বাঃ, কপি বটে একখানি! জিনিস কেনেন তো শৈলেনবাবু! সেই কাপড়-কাচা সাবান একটা বের কর তো রে।”
বলিলাম, “সাবান আর চাই না এখন।”
“নাঃ, চাই না! বড়দিন—বলে বসলেন কিনা কাপড়-কাচা সাবান চাই না? হাসালেন আপনি!”
সত্যই কিছু হাসির কথা হইল নাকি? নিজের নিকট সংশয়ের উত্তর না পাইয়া চুপ করিয়া গেলাম।
একটা হাতখানেকেরও উপর চৌকা সাবান বাহির হইল।
বাচ্চা চাকর-ছোঁড়াটা একটু দূরে অশ্বত্থতলায় হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজিয়া এক-একবার পরিবর্ধমান মোটটার পানে আড়চোখে চাহিয়া অসহায় ভাবে ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতেছিল। সাবানটা গুঁজিতে দেখিয়া ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠিল, “বাপ রে, হামরা জান লে লি সব!”
মুদী ঘুরিয়া বলিল, “একটা সাবানের ভারে অমনই তোর জান চলে যাবে?”
তাড়াতাড়ি তাহার হাতে দুইটা পয়সা জিয়া দিয়া বলিল, “নেঃ, পুরনো খদ্দের বাবু—লাভ তো নিতে পারলামই না, উলটে ট্যাঁক থেকে দুটা পয়সা—তা হোক গিয়ে, বাবুর চাকর তুই, খুশি থাক।”
যাহারা পরার্থে প্রাণ দান করে, তাহাদের মতো মহৎ ঔদাসীন্যের সহিত ছোঁড়াটার মাথায় মোটটা তুলিয়া দিল। সে ডান হাতে চোখ মুছিতে মুছিতে বাড়িমুখো হইতেই বলিলাম, “দাঁড়া একটু, এই বোতল দুটো হাতে ঝুলিয়ে নে।”
পাজি তাড়াতাড়ি দুই-একবার টলমল করিয়া ডান হাতটাও ঝুড়িতে লাগাইয়া নাকিসুরে বলিল, “দুনো হাত তো বঝল বা”—অর্থাৎ দুটো হাতই তো জোড়া।
রাগে গা-টা রি-রি করিয়া উঠিল; কিন্তু চটাইতে গেলে আবার টলিতে পারে—চাই কি আরও জোরে টলিতে পারে, এই আশঙ্কায় আর আপাতত কিছু বলিলাম না।
নিরুপায় হইয়া ছড়িটা কাঁখে চাপিয়া বোতল দুইটা দুই হাতে তুলিয়া লইলাম। কিন্তু কয়েক পা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেমন একটা অস্বস্তির ভাব যেন বোতল দুইটার মসৃণ অঙ্গ বাহিয়া, আমার হাত দুখানা বাহিয়া, আমার সমস্ত শরীরটা আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। কেমন যেন মনে হইল, এ ঠিক হইতেছে না—সন্ধ্যার ঐ গা-ঢাকা অন্ধকারে দুই হাতে দুইটা বোতল, বগলে ছড়ি, এ যেন কি রকম কি রকম বলিয়া বোধ হয়! বাজারের সব লোকের চোখের মধ্য দিয়া নিজের দিকে চাহিলাম। এ কি হইয়া গিয়াছি! মনটা যেন নিজের প্রতি নিজেই ইয়ারকির ঢঙে বলিয়া উঠিল—আরে, কে ও! কোত্থেকে?
ছড়িটা বোতলের সঙ্গে ডান হাতে লইলাম, দৃশ্যটা কিন্তু বেশ শুধরাইল বলিয়া বোধ হইল না। তখন দুইটা বোতলই বাম কাঁখে পুরিলাম, ডান হাতে ছড়ি। এ যেন আরও মারাত্মক হইয়া উঠিল; মাথা ক্রমেই গুলাইয়া আসিতেছিল। র্যাপারটা জড়াইয়া লইলাম, ঠিক সেই সময় পিছনে গা ঘেঁষিয়া একটা লোক চলিয়া যাওয়ায় বোতল-জোড়ায় একটু ঠোকাঠুকি হইয়া একটা প্রচ্ছন্ন তরল শব্দ হইল। মনে হইল, যেন র্যাপারের মধ্যে আত্মগোপন করিতে গিয়া অপরাধী হীনচরিত্র বোতল দুইটি হাটের মাঝখানে জাহির হইয়া গেল।
আমি ঘামিয়া উঠিতেছিলাম, চাকর ছোঁড়াটার তাগাদায় হুঁশ হইল। ভাবিলাম, আচ্ছা দুর্বলচিত্ত লোক তো আমি! একটা শরবতের খালি বোতল আর একটা ফেনাইলের বোতল রাস্তা দিয়া বেপরোয়া ভাবে লইয়া যাইবার সৎসাহসটুকু নাই? অন্ধকার? তাহা হইলে কোনো সাধু ব্যক্তিই অন্ধকারে আর নিজের গৃহস্থালীর কাজ করিবে না? শিশি কিংবা বোতল না হইলে একদণ্ড চলে?
বেশ সহজভাবে বোতল দুইটার লেবেল সামনে করিয়া দুই হাতে ধরিলাম এবং সমস্ত জড়তা দূর করিয়া মুখে একটা সহজ প্রসন্নতার ভাব ফুটাইয়া তুলিলাম।
একটুর মধ্যেই বুঝিতে পারিলাম, অত প্রসন্নতার ভাবটা ফুটাইয়া তোলা সমীচীন হয় নাই। বাজারের নীচেই বিদ্যুতালোকিত প্রশস্ত চৌমাথা রাস্তা, সেখানে নামিয়া অবিলম্বেই টের পাওয়া গেল যে, এই পাপ-পৃথিবীতে এমন লোকের অভাব নাই, যাহারা চাকরের মাথায় ভোজের গুরু আয়োজন এবং মনিবের হাতে বোতল ও তৎসঙ্গে প্রচুর প্রসন্নতার ভাব দেখিলে একেবারে উল্টা রকম মীমাংসা করিয়া বসে।
একজন আড়চোখে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি হানিয়া গেল। আর একটু যাইতে এক ছোকরা তাহার বন্ধুর গা ঠেলিয়া আমায় দেখাইয়া দিল। একটু দূরে পানের দোকানের সামনে কয়েকজন হিন্দুস্থানী দাঁড়াইয়া জটলা করিতেছিল, একজন সকলের দৃষ্টি আমার দিকে আকর্ষণ করিয়া মাথা দুলাইয়া বলিল, “আলবৎ বড়াদিন হ্যায় ইয়ার; বড়ে খুশ-মেজাজমে হ্যায়!”
ইচ্ছা হইল, ব্যাটার মাথার উপর বোতল দুইটা আছড়াইয়া প্রমাণ করিয়া দিই যে তাহার মধ্যে এমন কিছু ব্যাপার নাই, যাহাতে তাহাদের অর্থে খুশমেজাজ হইবার সম্ভাবনা আছে। কোনো রকমে রাগটা চাপিয়া চৌমাথাটা ছাড়াইয়া গেলাম। মুখের প্রসন্ন ভাবটা আর টানিয়া রাখা যুক্তিসঙ্গত বলিয়া মনে হইল না; বেশ সহজে মিলাইয়াও গিয়াছিল। বোতল দুইটা কিন্তু সেই ভাবেই রহিল। দুর্বল মনের সঙ্গে যে তর্কটা হইতে লাগিল, তাহাতে এই কথাটাই আমি ধরিয়া রহিলাম—কেন, আমার ভিতরে যখন কোনোরকমে কু নাই, বিশেষ করিয়া যখন বোতলের ভিতরেও কোনোরকম কু নাই, তখন ভয় পাইতে যাইব কেন? কাল এই সময় এই পথ দিয়াই এক হাতে একটা পশমের বান্ডিল আর অন্য হাতে সাবানের বাক্স লইয়া গিয়াছি। তফাৎটা কি হইল এমন? আমায় যাহারা চেনে না, তাহারা যা ইচ্ছা মনে করুক; চেনে যাহারা, তাহারা তো আর—”
চেনা লোকের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হইয়া গেল, আর বেশ ভালো লোকের সঙ্গেই। করুণাময়বাবু, জেলা বোর্ডের আপিসে কাজ করেন। বয়স হইয়াছে, অথচ খুব আমুদে আর মিশুক। এই জন্য আর তাঁহার নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের জন্য সবাই চায় তাঁহাকে। বেহারে চার পুরুষ আছেন,–এইটি প্রয়োজন-ভেদে কখনও সগৌরবে, কখনও বা দুঃখের সহিত জাহির করিবার একটি বাতিক আছে; ভাষার মধ্য দিয়াও বেহার মাঝে মাঝে উঁকি মারে।
একটু দূর হইতেই দুই হাত তুলিয়া নমস্কার করিয়া একগাল হাসিয়া বলিলেন, “এই যে শৈলেনবাবু, ভালো তো? আরে, এ যে বড়কা ভোজের আয়োজন! কি কপি মশায়! বেহারে চার পুস্ত কেটে গেল, কিন্তু এমন কপি তো দেখি নি–বাঃ! সঙ্গ নেব নাকি?”
একটু কম দেখেন, কাছে আসিতে বোতল দুইটিতে নজর পড়িল। আমি হাসিয়া উত্তর দিতে যাইতেছিলাম, তাঁহার মুখের হঠাৎ নিষ্প্রভ ভাব দেখিয়া আর রা সরিল না। কুণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও দুটা—?”
আমি একটা ঢোক গিলিয়া হাসির সঙ্গে সহজভাবে বলিবার চেষ্টা করিলাম, “কিছু নয়। বোতল দুটো,—একটাতে ফেনাইল আছে, আর একটা খালি; নারকোল-তেল রাখবার জন্যে কিনে নিয়ে—”
করুণাবাবু খুব আগ্রহের সহিত এবং অতি সহজে বিশ্বাস করিয়া লইলেন; আমাকে কথা শেষ করিতে না দিয়াই বলিলেন, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই—সে কি কথা, রাম কহো—ওই তো সাফ লেখা রয়েছে ‘ফেনাইল’; আমি কানা মানুষ পড়তে পারছি, আর কার সন্দেহ হবে? ছি-ছি, সে কি ভাবতে আছে?”
শীতেও আমার কপালে ঘাম জমিয়া উঠিতেছিল। অনেক কষ্টে কাষ্ঠহাসি হাসিয়া বলিলাম, “হ্যাঁ, সঙ্গ নেবেন বললেন, চলুন না, আজ বড়দিনের রাতটা পাঁচজনে একসঙ্গে বসে একটু আমোদ-প্রমোদ—”
হঠাৎ চমক ভাঙিল, ভাষা আমায় এ কোন্ দিকে লইয়া যাইতেছে? সামলাইয়া লইয়া বলিলাম, “আজ আপনার মতো আমুদে-আহ্লাদে লোকই তো—”
আরও সাংঘাতিক হইয়া যায় দেখিয়া থামিয়া তাঁহার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া আন্তরিকতার ও সৌজন্যের হাসি হাসিবার চেষ্টা করিলাম এবং বেশ অনুভব করিলাম, সেটা মৃতের হাসির মতো মুখটাকে বিকৃত করিয়া তুলিয়াছে মাত্ৰ।
করুণাবাবুও কেমন এক অপ্রতিভ হাসি হাসিয়া তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, “না, আমি ‘বাজ’ আসছি, আমায় আজ মাফ করবেন। যেতুম নিশ্চয়। আপনার বাড়ি যাব, তাতে আর—! তবে কথা হচ্ছে, কি রকম শীত পড়েছে দেখেছেন? বেহারে চার পুস্ত কেটে গেল মশায়, কিন্তু এবারের মতো শীত—এক্কেবারে যাকে বলে ঠাড়—”
বলিলাম, “শীতেই তো বড়দিনের খাওয়া-দাওয়ায় জুত বেশি করুণাবাবু, একটু গান- বাজনারও বন্দোবস্ত করেছি। যখন পাওয়া গেছে ভাগ্যক্রমে আপনাকে, তখন আর—”
করুণাবাবুর চোখ দুইটা আর একবার বোতলের উপর গিয়া পড়িল, তাহার পর নাছোড়বান্দা মাতালের হাতে পড়িলে লোকে যেমন বিব্রত হইয়া পড়ে, অনেকটা সেই ভাবে তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, “না না শৈলেনবাবু, শীত এমনই কথায় কথায় বলছিলাম। চার পুস্ত বেহারের জান-নেকলানো শীতের মধ্যে দিয়ে কেটে গেল, আর এ তো সামান্য। একটা কাজ আছে এই দিকে—আচ্ছা, তবে আসি।”
হঠাৎ নমস্কার করিয়া হনহন করিয়া চলিয়া গেলেন।
নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। এ কি বিষম ফাঁপরে পড়া গেল! আমি যেন অপরিচিত একজন কে! এই দশ মিনিট পূর্বে যে আমি ছিলাম, যেন সে নয়। বোতল দুইটার পানে চাহিলাম; ইচ্ছা হইল, সামনে লোহার পোস্টে ঘা দিয়া চূর্ণ করিয়া ফেলি। এই হতভাগা দুইটার জন্য নিতান্ত সহজ সাদা কথা যাহা বলিয়াছি, তাহারও মানে এক ধার হইতে বিগড়াইয়া গিয়াছে।
ছোঁড়াটাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “হ্যাঁ রে পুনিয়া, পোঁটলার মধ্যে গুঁজেগাঁজে দিলে বোতল দুটো নিয়ে যেতে পারবি নি?”
বলিল, “কাহে না? উতার দিঁ মোটরিঠো।”—অর্থাৎ কেন পারব না? মোটটা নামাইয়া দাও।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া তাড়াতাড়ি মোটটা নামাইয়া দিলাম। পুনিয়া ঘাড়ে গোটা তিন-চার ঝাঁকানি দিয়া এবং হাত দুইটা কয়েকবার ঝাড়িয়া দুই-তিনবার পায়চারি করিয়া লইল।
রাস্তার ধারে মোটটা নামিতেই গোটাকতক চ্যাংড়া জুটিয়া হাজার রকম আন্দাজ করিয়া তর্কবিতর্ক জুড়িয়া দিল। একটা বলিল, “সাদি হ্যায়।” মানে বিয়ে আছে।
একটা বলিল, “কভি নেহি, বাঙালীলোক সাদিমে দারু পিতা নহি হ্যায়।” বলিয়া ইশারা করিয়া বোতলের দিকে দেখাইয়া দিল।
“ভাগো হারামজাদা সব।”—বলিয়া খেদাইয়া দিয়া বোতল দুইটা গুঁজিবার জন্য একটা পোঁটলার গেরো খুলিতেই চাকরটা নাকিসুরে বলিয়া উঠিল, “মোটরি গিরেসে হাম্নিকে না কহব।”
চোখ তুলিয়া বিস্মিত ভাবে কহিলাম, “মোট পড়ে গেলে তোকে কিছু বলতে পারব না? বটে! এই দুটা বোতলের চাপেই তোর মোট পড়ে যাবে? বেয়াকুব পেয়েছিস আমায়?” তাহার পর আমার কাছে উপর-চাল দিয়া খানিকটা ও-রকম আরাম করিয়া লইবার জন্য অত্যন্ত রাগ হওয়ায় বোতল দুইটি জবরদস্তি পোঁটলার মধ্যে ঠুসিতে ঠুসিতে বলিলাম, “ফেল্ পুঁটলি, তোর যদি সাহস থাকে, ব্যাটা হারামজাদা কোথাকার! যত কিছু বলি না—”
বোতল বহাইতামই, সেও কিছু ফেলিতে সাহস করিত না, আর এইখানেই আমার বোতল-বিড়ম্বনার অবসানও হইত; কিন্তু ঠিক এই মোহড়ায় হঠাৎ অনাথ আসিয়া আমার ‘মরাল কারেজ’—কিনা সৎসাহসে উৎসাহিত করিবার জন্যে একেবারে মরণবাঁচন জিদ করিয়া পড়িল।
.
অনাথের সঙ্গে আজিকার পরিচয় নয়,—সে আমার বাল্যবন্ধু। তাহার কথা মনে হইলেই সঙ্গে সঙ্গে খুব ছেলেবেলার একটি দৃশ্য চোখের সামনে ভাসিয়া উঠে। রেলের পুলের নীচে দুই পা ফাঁক করিয়া, বুক চিতাইয়া অনাথ নাকের মধ্য দিয়া দুইটি নিরেট- গোছের ধোঁয়ার স্রোত ছাড়িতেছে; ডান হাতে একটি দগ্ধপ্রান্ত সিগারেট, সামনে আমরা হাঁ করিয়া সপ্রশংস বিস্ময়ে চাহিয়া আছি।
এন্ট্রান্স ক্লাস পর্যন্ত একসঙ্গে ছিলাম, তাহার পর কে কোথায় ছিটকাইয়া পড়ি। আবার কালের স্রোতে ভাসিতে ভাসিতে আমরা দুইজনে এক জায়গায় আসিয়া পড়িয়াছি- অনাথের পক্ষে সুরার স্রোতেও বলা চলে। শুনা যায় একদিন নাকি খুব গুলজার আড্ডা হইলে রাত করিয়া টলিতে টলিতে ফিরিবার সময় তাহার মনে এই কথাটা হঠাৎ গাঁথিয়া যায় যে, টাকাই যত অনিষ্টের মূল। মাহিনার টাকাটা পকেটে ছিল। কোনো রকমে পাপ বিদায় করিবার জন্য সে দৃঢ়সঙ্কল্প হইয়া উঠিল। কিছু স্টেশনের হোটেলে দিল; দিয়া সদ্য-বৈরাগ্যের তাড়নায় ঁপুরীধামের একখানি টিকিট কাটিয়া ফেলিল। তাহার পর দেরাদুন এক্সপ্রেসে চড়িয়া কেমন করিয়া পাটনায় গঙ্গা পার হইয়া একেবারে এখানে মজঃফরপুরে। তাহারই মুখে শোনা গল্প। বলে, “ভাই, ভুলটা বুঝতে পেরে সারাদিন সারারাত যতই গাড়ি বদলাতে যাই, যতই আঁকুপাঁকু করি, ততই দেখি, উল্টো পথে চলেছি। রেলগাড়িকে কখনও বিশ্বাস করিস নে শৈলেন; তবে এও একটা কথা, মহাপ্রভু রথের কাছি দিয়ে না টানলে তো হবার জো নেই কিনা!”
এখানে এক জমিদার-জহুরী এই মানিকটিকে চিনিতে পারিয়া মাথার মণি করিয়া রাখিয়াছেন। অনাথ বলে, “যাক ভাই, নেপালের পশুপতিনাথের খুব কাছেই রইলাম, বুড়ো একটা ডাক দিলেই গাড়িতে গিয়ে উঠব।”
একটা বোতল পোঁটলায় পুরিয়া আর একটা তুলিয়াছি, অনাথ আসিয়া সামনে দাঁড়াইল। পা দুইটা একটু একটু টলিতেছে, চক্ষু অর্থনিমীলিত। গাঢ় জড়িতস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “আমাদের শৈলেন না? ব্যাপার কি রাজা?”
বলিলাম, “অনাথ যে! ব্যাপার কিছু নয়, দুটো বোতল ছোঁড়াকে নিয়ে যেতে বলছি, তা নানান রকম ছুতো লাগিয়েছে, তাই—”
চক্ষু দুইটিকে যথাসম্ভব বিস্ফারিত করিয়া অনাথ বলিল, “বোতল! দুটো বোতল! কবে থেকে তোর এ সুমতি –”
চাকরটা বোধ হয় তাহার মনিবের মান বাঁচাইবার জন্য বলিল, “ফিনাইল তো বা—”
অনাথ আমার পানে চাহিয়া একটু মুচকিয়া হাসিল, তাহার পর কৃত্রিম রাগের সহিত চাকরটাকে ধমক দিয়া বলিল, “ফেনাইল নেহি তো ক্যা রহেগা? হাম জানতা নেহি? আলবত ফেনাইল হ্যায়। চোপ রও।”
তাহার পর আমার প্ল্যান তাহার বুঝিতে বাকি নাই, আর সে চাকরের কাছে ফাঁস করিবার ছেলে নয়—চতুর দৃষ্টিভঙ্গীতে আমায় এই কথা জানাইয়া প্রশ্ন করিল, “আর এই শরবতের বোতলটা—এতে দিশী শরবত, না বিলিতী শরবত ভাই?” স্মিত হাস্যে চাহিয়া ঈষৎ টলিতে লাগিল।
বিরক্ত হইয়া বলিলাম, “আঃ, কি পাগলামি করিস? এই দেখ না বাপু, কি রকম বিলিতী শরবৎ নিয়ে যাচ্ছি!”—বলিয়া খালি বোতলটা উল্টাইয়া দেখাইতে যাইব, অনাথ খপ করিয়া হাতটা ধরিয়া বলিল, “আমি তোকে অবিশ্বাস করতে পারি শৈলেন? তোকে আজ দেখছি?”
বিব্রত হইয়া বলিলাম, “তা হলে পথ ছাড়, এখন যাই; রাস্তার মাঝে একটা হৈ-চৈ করিস নি।”
অনাথ আমার ডান হাতটা মুঠায় ধরিয়া হঠাৎ কাঁদ কাঁদ হইয়া সুরাদ্রব আবেগের সরু মোটা নানান সুরে বলিল, “ছাড়ছি পথ। আর কখনও তোমার পথ আগলে দাঁড়াব না, কিন্তু প্রাণে যে কি চোট দিলি শৈলেন—ও-ফ!”
কি গেরো! আজ কাহার মুখ দেখিয়া যাত্রা করিয়াছিলাম! জিজ্ঞাসা করিলাম, “দেখ দিকিন! কি আবার চোট দিলাম প্রাণে তোর?”
অনাথ ‘ও-ফ’ করিয়া আর একটা বুক-ভাঙা শব্দ করিয়া গদগদ স্বরে বলিল, “আজ অনাথ এতই পর হল? ধরেছিস তো তাকেও লুকোতে হয়?”
বলিলাম, “ভ্যালা বিপদ! পর হতে যাবি কেন? কিন্তু ধরেছি তোকে কে বললে?”
অনাথ অভিমানভরে বলিল, “কেউ না। তুই নিজেই যখন লুকোচ্ছিস তো অন্য আর কে বলতে যাবে ভাই!”
বলিলাম, “কি আশ্চর্য! লুকোবার কোনও কথাই নেই তো লুকোতে যাব কেন?”
আমার হাত দুইটা চাপিয়া ধরিয়া অনাথ বলিল, “এই কথাই তো শুনতে চাই ভাই। আমার কাছে—তোর এই ছেলেবেলার অনাথের কাছে—এ কোন একটা লুকোবার কথা শৈলেন?”
এ কি ভাষার প্যাঁচে পড়া গেল মাতালের হাতে! এখন ইহাকে বুঝাই কি করিয়া? এর মুখ দিয়াই কথাটার জট খুলিয়া লইবার জন্য প্রশ্ন করিলাম, “কি কোন একটি লুকোবার কথা বলছিস বল্ দিকিন?”
“যেটা লুকোচ্ছিলি?”
“কিছুই তো লুকোই নি; তুই বিশ্বাস না করলে কি করব?”
অনেকটা আশান্বিত হইয়া বলিলাম, “কি বিশ্বাস করেছিস বল্ তো?”
“যা আর লুকোচ্ছিস না।”
একেবারে হতাশ হইয়া গেলাম। আপাতত নিস্তার পাইবার জন্য বলিলাম, “এমন ফ্যাসাদে মনিষ্যি পড়ে! আচ্ছা ভাই, স্বীকার করছি, ধরেছি; এখন পথ ছাড়, দেরি হয়ে যাচ্ছে। ঐ দেখ, চাকরটা আবার মোড়লি করে ছোঁড়াগুলোর সামনে পরিচয় দিতে লেগেছে। পুনিয়া, এদিকে আয় হারামজাদা।”
অনাথের কাঁদ-কাঁদ ভাবটা যেমন হঠাৎ আসিয়াছিল, তেমনই হঠাৎ অদৃশ্য হইয়া গেল। আমার হাতটা ছাড়িয়া সিধা হইয়া দাঁড়াইল এবং আমার মুখের উপর সুরালস চক্ষু দুইটি খানিকক্ষণ নিবদ্ধ করিয়া গম্ভীরভাবে কহিল, “ছাড়ছি পথ, তোমার পথ রাখবার আমি কে? শুধু একটি কথা জিজ্ঞেস করব, দয়া করে উত্তর দেবে কি ভাই শৈলেন?”
এ আর এক ভাব! অত দুঃখেও হাসি রুখিতে পারিলাম না, বলিলাম, “না দয়া করলে তো উদ্ধার নেই, বল।”
“আমরা না স্বরাজ চাই?”
উদ্দেশ্য বুঝিতে না পারিয়া উত্তর করিলাম, “তা চাই বইকি।”
“অথচ আমাদের এমন মর্যাল কারেজ নেই যে, রাস্তা দিয়ে নিজের জিনিস দুটো বুক ফুলিয়ে হাতে লটকে নিয়ে যাব! ধিক কোন মুখে আমরা—”
রাগ সামলাইতে পারিলাম না: বিশেষ করিয়া এই জাতীয় একজনের উপর ঝাল ঝাড়িবার দরকারও ছিল; বলিলাম, “দোষ কি? জিনিসটা তোমাদের হাতে পড়ে এমন সুযশ লাভ করেছে যে, একটু আবছায়া হলে গঙ্গাজল ভর্তি করে নিয়ে যেতেও পা ওঠে না। এইটুকু আসতেই যে দুর্ভোগ হয়েছে!”
অনাথ ত্রিভঙ্গ হইয়া টলিতে টলিতে আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “দুর্ভোগ! এই আমি বোতল নিয়ে যাচ্চি, একটি কথা যে বলবে, তার দুসারি দাঁতের ওপর এই দুটো বোতল ভাঙব।”
একটা মতলব ঠাহর করিলাম। নিচু হইয়া কহিলাম, “হ্যাঁ, তাহলে আর দুর্ভোগের মোটেই ভয় থাকে না। কিন্তু তোর অত হাঙ্গামা করে কাজ কি অনাথ? আমি এইটুকু পথ কাটিয়ে যাব’খন। তোকে দেখেই বোধ হচ্ছে, যেন বিশেষ একটা দরকারী কাজে যাচ্ছিস; তোকে আর আটকে রাখতে চাই না।”
দরকারী কাজের কথায় অনাথের মনটা যেন একটু ভিজিল; ভারিক্কে হইয়া বলিল, “দরকারী! এত দরকারী যে—”
ঔষধ ধরিয়াছে আশা করিয়া তাড়াতাড়ি তাহার পিঠে হাত দিয়া বলিলাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমায় বলতে হবে না, আমি বুঝি না? তা হলে আয় গিয়ে। নে পুনিয়া, তোল।”
পুনিয়া পা বাড়াইতেই অনাথ হাত উঠাইয়া তাহাকে বারণ করিল। আমার পানে চাহিয়া বলিল, “কিন্তু খুব দরকারী বলেই আরো যাবো না; তা নাহলে আর স্যাক্রিফাইস হল কি? আমি মর্যাল কারেজের জন্যে আজ সব দরকারী কাজ ত্যাগ করতে চাই, এই দরকারী জীবনটা পর্যন্ত।”
বুদ্ধিমান মাতালের উপর বেশি রাগ ধরে, ও যে আমার কথাটাই এ রকম কাজে লাগাইবে, তাহা ভাবি নাই। বিরক্ত হইয়া বলিলাম, “নে ছাড়, রাস্তার মাঝখানে একটা কেলেঙ্কারি—”
চাকরটাকে ধমকাইয়া বলিলাম, “আয় না ব্যাটা বদমাইশ, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে তখন থেকে!”
অনাথ বোতল দুইটা বগলে করিয়া রাস্তায় বসিয়া পড়িল। বলিল, “সত্যাগ্রহ করলাম—আমি গান্ধীর চেলা, মাড়িয়ে যাও।”
বোতল দুইটা হাতের মুঠায় চাপিয়া ধরিয়া বলিল, “জান যায় তবভি নিমক নেহি দেগা।”
বেশ ভিড় দাঁড়াইয়া গিয়াছে; এমন কি একটা ঝালচানাওয়ালা তাহার খঞ্চে নামাইয়া বেশ দুই পয়সা করিয়া লইতেছে। নানা রকম টিপ্পনী, পরামর্শ, উৎসাহবাণী।
লজ্জায় অপমানে আমি সত্যই ধৈর্য হারাইতেছিলাম। অনাথ বোধ হয় সেটা একটু একটু বুঝিল। বলিল, “আচ্ছা এস, রফা করা যাক—গান্ধী-আরউইন প্যাক্ট। হয় আমায় নিয়ে যেতে দাও, না হয় তুমি বুক ফুলিয়ে নিয়ে যাও—ইস মাফিক। চাকরকে দিতে পারবে না, আমি চাই মর্যাল কারেজ—নিজের মাল নিজে নিয়ে যাব, তার আবার—”
তাড়াতাড়ি বলিলাম, “আচ্ছা দে, আমিই নিয়ে যাচ্ছি।”—বলিয়া বোতল দুইটা তাহার হস্ত হইতে লইলাম, এবং এই সুযোগ হারাইবার ভয়ে তাড়াতাড়ি চাকরটার মাথায় মোটটা তুলিয়া দিয়া দ্রুত পা চালাইয়া দিলাম।
কানে গেল, অনাথ সমবেত দর্শকদের বুঝাইতেছে, “হামারা লঙ্গোটিয়া ইয়ার হ্যায়, নয়া শুরু কিয়া—ডরতা হ্যায়।”
ইহার পর কলেজের একদল ছাত্র রাস্তায় পড়ে। তাহাদের অনেকেই আমার সহিত পরিচিত। কিন্তু হঠাৎ তাহাদের ভাবপরিবর্তন দেখিয়া মনে হইল, তাহারা যেন আমার যথেষ্ট পরিচয় এতদিন পর্যন্ত পায় নাই বলিয়া ঠাহর করিয়া ফেলিয়াছে।
ভাবিতে ভাবিতে বাড়ি ফিরিলাম, আচ্ছা অভিশপ্ত জিনিস তো, সূর্যাস্তের পরে যেন মানেই বদলাইয়া যায়; তখন সঙ্গে লইয়া আর রাস্তা চলিবার জো নাই!
প্রসন্নমুখে চলিলে বলিবে, ফূর্তি আর ধরে না; লজ্জিতভাবে চলিলে বলিবে, এখনও আনাড়ী; যদি সহজভাবে চল, বলিবে, বোঝে কার সাধ্য, একেবারে ঝানু; খোলাখুলি লইয়া গেলে বলিবে, ঘাগী, বেপরোয়া; একটু পর্দার মধ্যে লইয়া গেলে বলিবে, চোখে ধুলো দিচ্ছে, রাগিলে বলিবে, বেহেড; না রাগিলে বলিবে, পাঁড়, বেমালুম হজম করে ফেলেছে।
সবচেয়ে বিপদের কথা এই যে, বুঝাইতে গেলে এত গভীর বিশ্বাসে এবং এত সহজে বুঝিয়া বসিবে যে, প্রমাণ দিয়া যে ধারণাটা মন হইতে একেবারে নির্মূল করিব, তাহার অবসরই পাওয়া যাইবে না।
বলা বাহুল্য এত আড়ম্বর করিয়া বাজার করাই সার হইল, মনের সে অবস্থায় আর বড়দিন জমিতে পাইল না।
সমস্ত রাত ভাল ঘুমই হইল না। কেবল এলোমেলো স্বপ্ন—বোতলগুলার যেন হাত- পা গজাইয়াছে, তাহাদের নানা ভঙ্গীতে নাচ, এদিকে গৃহস্থালির বাকি তৈজসপত্র যে অত বড় মিটিং করিয়া তাহাদের হুঁকা, তামাক বন্ধ করিয়া জাতে ঠেলিল, স্ফূর্তির চোটে সেদিকে ভ্রুক্ষেপও নাই। স্বপ্নের না আছে মাথা, না আছে মুণ্ড।
.
পরদিন সকাল হইতেই ইহার জের চলিল এবং সমস্ত দিন মনে হইল, সবাই অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ আপাতত মুলতুবী রাখিয়া আমার চরিত্র-সংশোধনের জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গিয়াছে।
সক্কালেই প্রতিবেশী বৃদ্ধ প্রসন্নবাবু লাঠি-হাতে ঠুকঠুক করিয়া হাজির হইলেন। আমতা আমতা করিয়া কথাটি পাড়িলেন, “শুনলাম নাকি কাল রাত্রে তুমি—”
আমি কথাটা কাড়িয়া লইয়া মুখের দিকে চাহিয়া উত্তর দিতে যাইতেছিলাম, তিনি নিজেই মাথা নাড়িয়া তাড়াতাড়ি বলিলেন, “না না, আমায় সে বলতে হবে না; আমি কি তোমায় জানি না যে লোকের কথায় বিশ্বাস করে বসব? হেঁ-হেঁ—তবে কথা হচ্ছে, কাজ কি ও বিলিতী ফেনাইল-টেনাইল—দিব্যি শুদ্ধ গোবরজল রয়েছে—”
আমি শেষ কথাটার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া মুখ তুলিতেই একটু হাসিয়া বলিলেন, “বুড়ো সেকেলে লোক আমরা, একটু হেঁয়ালিতেই কথা কওয়া অভ্যেস—তা তুমি বুঝবে বইকি। তা ওই যা বললাম বাবা, শরীর-টরির একটু খারাপ রইল নেহাত, একদলা সিদ্ধি চালিয়ে দিলে, দিশী শুদ্ধ জিনিস, শিবের ভোগে লাগে। আর ওসব? নাঃ, ছি ছি! ও বোতল-টোতলের ধার দিয়েও যেয়ো না। একটা বিশেষ কাজ ছিল যদু ডাক্তারের কাছে, তা ভাবলাম, আগে শৈলেনের সঙ্গে দেখাটাই করে যাই—ছেলেমানুষ, উঠতি বয়েস—”
প্রসাদের ঔষধের দোকানে একটা কাজ ছিল। যাইতেই বলিল, “হ্যাঁ রে, কাল কি কাণ্ড করেছিস? করুণাবাবু মুখ গম্ভীর করে ক্রমাগত বলে বেড়াচ্ছে, ‘বেহারে চার পুস্ত হয়ে গেল মশায়, এমন চাপা মাতাল তো একটাও চোখে পড়ল না!”
বিরক্তভাবে চাহিতে বলিল, “বিশ্রী রকম ঠাণ্ডা পড়েছে, যদি শরীর খারাপ হয়েছিল তো আমায় বললেই হত, একটা মেডিসিন ডোজ দিয়ে দিতাম। এই আমিই তো কখনও কখনও—তোর গিয়ে, শরীর-টরির ম্যাজম্যাজ করলে—”
মনটা তিক্ত হইয়া উঠিতেছিল, মরীয়া হইয়া গম্ভীর ভাবে বলিলাম, “আমার আর মেডিসিন ডোজে পোষায় না।”
অফিসে বড়বাবু বলিলেন, “ছিঃ শৈলেনবাবু, এখন এই গান্ধীর যুগে কোথায় লোক ছাড়ছে; আপনি এতদিন মতিস্থির রেখে—”
“মতিস্থির আর রইল না মশাই।”–বলিয়া মুখ ফিরাইয়া চলিয়া গেলাম।
কথাটা এক হিসাবে ঠিকই ছিল। কাল সন্ধ্যা হইতে যা অবস্থা চলিয়াছে, ইহাতে মতিস্থির থাকা দুষ্কর। অন্যে পরে কা কথা, এমন কি অনাথ পর্যন্ত আমার জন্য উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছে। দেখা করিয়া আগ্রহভরে কহিল, “না, তোকে ছাড়তেই হবে। এ যে কী পাপ জিনিস! আর একবার যদি ধরেছিস তো হাজার চেষ্টা করলে আর ছাড়তে পারবি নি।”
আমি বলিলাম, “কাল লাল চোখে না হয় বিশ্বাস করতে পারিস নি; কিন্তু আজ সাদা চোখে কেন বিশ্বাস করতে চাইছিস না যে আমি ধরি নি?”
“সেই কথাই তো বলছি, সাদা চোখে তো আর ভুল হবে না। কিন্তু যাক, আর ধরিস নি মাইরি।”
ওর সেই গোলমেলে তর্ক। উত্যক্ত হইয়া বলিলাম, “না, ছাড়তে আমি পারব না। যা, আর ত্যক্ত করিস নি।”
মনটা লজ্জা, রাগ, বিরক্তি প্রভৃতি নানান খানায় এমন খিঁচড়াইয়া রহিল যে, বিকেলবেলায় আর বাহির হইতে ইচ্ছা হইল না। বলা বাহুল্য, তাহাতে ফল ভালো হইল না; কেননা আমার দরদীর দল কাল্পনিক মূর্তিতে আমার শূন্য মনের মধ্যে আসিয়াই ভিড় জমাইলেন এবং তাঁহাদের সঙ্গে মানসিক দ্বন্দ্বে আমার মাথাটা সন্ধ্যা পর্যন্ত একেবারে উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। ভাবিলাম, এ কাজের কথা নয়, মাঠের দিকে গিয়া মাথায় একটু পরিষ্কার হাওয়া লাগানো দরকার। পাগল করিয়া দিবে নাকি!
হায়, সন্দেহও করি নাই যে শেষ চোপটি—আর সবচেয়ে মোক্ষম চোপটি—তখন ও বাকি, আর তা বাড়ির বাহিরেই আমরা মস্তকের প্রতীক্ষায় উদ্যত হইয়া রহিয়াছে। জুতা- জামা পরিয়া বাহির হইতে দেখি, খদ্দর আর গান্ধীটুপি-পরিহিত কতকগুলি ছেলের একটি মাঝারি গোছের দল দুয়ারগোড়ায় দাঁড়াইয়া; কালকের কয়েকজন কলেজের ছেলে ও তাহাদের মধ্যে। দেখা হইতেই অত্যন্ত বিনীতভাবে সবাই কপালে যুক্তকর ঠেকাইয়া অভিনন্দন করিল।
অতিমাত্র বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিতে যাইতেছিলাম, পূর্বাহ্নেই জাতীয় পতাকাধারী একটি যুবক অগ্রসর হইয়া আর একটি অধিকতর বিনীত অভিবাদন করিয়া বলিল, “আমাদের কর্তব্য অতি কঠিন, মাফ করবেন—আপনাকে আজ বেরুতে দিতে পারি না আমরা।”
বুঝিতে বাকি রহিল না শ্রাদ্ধ অনেক দূর পর্যন্ত গড়াইয়াছে,–এ বাড়ি বহিয়া লিকার- পিকেটিং। ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটিতেছিল, তবুও শান্তস্বরে জিজ্ঞাসা করিলম, “এ রকম কঠিন কর্তব্য করার আপনাদের উদ্দেশ্য?”
যুবক যুক্তকরেই দাঁড়াইয়া ছিল, বলিল, “উদ্দেশ্য দেশমাতাকে বন্ধনমুক্ত করা।”
প্রশ্ন করিলাম, “তার সঙ্গে আমায় আপাতত বন্ধনে ফেলার কোনো বিশেষ সম্বন্ধ আছে কি?”
সেই রকম বিনীত উত্তর হইল, “আপনি শিক্ষিত, আপনার সঙ্গে কী তর্ক করব? তবে একবার ভেবে দেখুন, জিনিসটা কতই গর্হিত। আমেরিকা সেইজন্যেই স্পেশাল ল করে জিনিসটাকে দেশছাড়া করেছে।”
বলিলাম, “আচ্ছা, আপনারা সত্যিই কি সন্দেহ করেন যে, আমি বাজার থেকে বোতলে করে মদ নিয়ে—”
যুবক সসঙ্কোচে তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “না না, সন্দেহ আমরা কি কখনও করতে পারি!”
“তা হলে কি আপনারা এ বিষয়ে একেবারে নিঃসন্দেহ? দেখুন, কাল থেকে এই ধরনের তর্ক শুনতে শুনতে আমার মাথার ঠিক নেই। অথচ ব্যাপারটা—”
দলের মধ্য হইতে আর একটি যুবক সামনে আগাইয়া আসিল এবং মাথা নীচু করিয়া গভীর বিনয়ের স্মিতহাস্যের সহিত বলিল, “আমার অপরাধ নেবেন না; আপনি মাথা ঠিক না থাকার প্রকৃত কারণটা বোধ হয় ধরতে পারেন নি; তবে মাথাটা যে ঠিক নেই, এইটুকু স্বীকার করে আমাদের কাজটা অনেক হালকা করে দিয়েছেন এবং সেইজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।’
হাঁ করিয়া রহিলাম, এর উপর আবার ‘ধন্যবাদ’ চাপায়!
প্রথম যুবকটি বলিল, “অনেকে এইটুকুও লুকোতে চান কিনা।”
আর একটি যুবক শীলতায় ইহাদেরও উপরে গিয়া বলিল, “অথচ লুকোবার জো নেই, কথাবার্তায় হাত-পার ভঙ্গীতে আপনি বেরিয়ে আসবে। আশা করি, আমাদের কথায় অফেন্স নেবেন না আপনি। আসলে আপনার এখনও কালকের ব্যাপারে আফটার-এফেক্ট চলছে।”
এমন বিনয়ের অত্যাচারের কখনও অভিজ্ঞতা ছিল না। অস্বস্তির চোটে মনে হইতেছিল, হাত-পা ছুঁড়িয়া চিৎকার করিয়া একটা কিছু করি। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করিয়া বলিলাম, “দেখুন, আপনারা সকলেই ভদ্রসন্তান, সহজেই বিশ্বাস করতে পারবেন। ব্যাপারটা হচ্ছে—কাল সন্ধ্যার সময় চাকরের মাথায় কিছু তরিতরকারি আর অন্য দু-একটা জিনিস নিয়ে নিজে একটা ফেনাইলের বোতল আর তেল রাখবার জন্যে একটা খালি বোতল কিনে নিয়ে আসছিলাম। শীতের কনকনানিতে বোতল দুটো র্যাপারের মধ্যে—”
পতাকাধারী যুবকটি বলিল, “আমাদের অত কষ্ট করে কিছুই বলতে হবে না আপনাকে। শুধু অনুরোধ, আপনি অভ্যেসটা ছাড়ুন।”
মাথায় যেন আগুন জ্বলিয়া উঠিল, মুখের চেহারাতেও তাহার উত্তাপ অনেকটা প্রকাশ পাইয়া থাকিবে। তবুও ধীরকণ্ঠেই বলিলাম, “বেশ, ছাড়ব; মাসে একটা করে ফেনাইলের বোতল আনলে এমন কিছু অভ্যেসও হয়ে যায় না। এখন অনুগ্রহ করে আমায় একটু পথ ছেড়ে দিন; একটু ঘুরে আসা নিতান্ত দরকার হয়ে পড়েছে।”
পতাকাধারী অন্য সবাইয়ের দিকে চাহিয়া ঠোঁট চাপিয়া একটু হাসিল। তাহার পর আমার পানে চাহিয়া বলিল, “দরকার হয়ে পড়াটা স্বীকার করি। কিন্তু যেতে দেওয়ার আমাদের অধিকার নেই; ক্ষমা করবেন।
আর একজন কথাটাকে একটু পরিষ্কার করিয়া দিল, “সন্ধ্যার সময়েই আমাদের বেশি সাবধান থাকতে হয় কিনা।”
ইহাদের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা; ইহাদের গালাগালও ক্রমে স্পষ্টতর হইয়া উঠিতেছে। অগ্রণী যুবকটির দিকে চাহিয়া বলিলাম, “আপনাদের অধিকার আমার মাথায় ঢুকছে না; আমি জানি, আমার যাবার অধিকার আছে।”—বলিয়া পা বাড়াইলাম।
যুবক আমার পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়া সঙ্গীদের দিকে ফিরিয়া বলিল, “তাহলে তোমাদের এইবার আত্মিক বল প্রয়োগ করতে হল।”
সেটা আবার কি আকৃতিতে দেখা দিবে, ভাবিয়া ঠিক করিবার পূর্বেই দলের সব কটি যুবক সটান রাস্তার এমুড়ো ওমুড়ো জুড়িয়া চিত হইয়া শুইয়া পড়িল; সামনে এতটুকু আর পা ফেলিবার জায়গা রহিল না।
আমার কান্না আসিতেছিল। রাস্তায় লোক জড়ো হইতেছিল। আমি কিছুক্ষণ একটা কথাও কহিতে পারিলাম না। অত্যাচারের মধ্যেও এইটুকু বুদ্ধি ছিল যে আর এ লইয়া ঘাঁটাঘাঁটি করিতে গেলেই সমগ্র পাড়া জাগাইয়া একটা গুলতান হইবে। অনেক চেষ্টায় মনটাকে সাধ্যমত গুছাইয়া লইয়া বলিলাম, “আচ্ছা, আপনারা যদি তাতেই সন্তুষ্ট হন তো আমি আর বার হব না, আপনারা যান।”
যুবক কোনো উত্তর না দিয়া নিশ্চল ভাবে ঘাড় হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অন্য সবাই সেই অবস্থায় পড়িয়া। রাস্তার ওদিক হইতে দর্শকদের প্রশংসাবাণী আমার কানে আসিয়া ধিক্কারের মতো বাজিতে লাগিল।
বলিলাম, “যান আপনারা, কেন আর কষ্ট করবেন! আমি বেরুব না তো বলছি।”
“শুধু বাইরের শত্রুকে না আনলেই তো হল না, ঘরের শত্রুকেও বিদেয় করতে হবে। আমরা এইজন্যে আপনার মধ্যে যে দেবতা আছেন তাঁর কাছে ধন্না দিয়ে রইলাম।”
আমি আর রাগ চাপিতে পারিলাম না। একটু গলা চড়াইয়া বলিলাম, “দেখুন, আমার মধ্যেকার দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে দানবকে চটাচ্ছেন মাত্র। আচ্ছা, আপনারা কি বলতে চান যে আমি বাড়ির মধ্যে বোতল ভরে—”
“আমাদের কেন লজ্জা দিচ্ছেন?”
“ও! আর আমার বুঝি লজ্জা বলে জিনিস নেই? ইঙ্গিতে কিছুই বলতে তো বাকি রাখলেন না? আর এদিকে বাইরেও যেতে দেবেন না, বাড়িতেও স্থির হয়ে থাকতে দেবেন না, যেন কত বড় অপরাধ করেছি! তাও ছাই যদি স্পষ্ট করে বলেন, কি করলে আপনাদের বিশ্বাস করাতে পারি, কি প্রমাণ দিলে—আচ্ছা বেশ, থামুন। এর চেয়ে তো আর বড় প্ৰমাণ হতে পারে না?”—বলিয়া রাগে মাথা গোঁজ করিয়া বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেলাম এবং তখনই যেখানে ফেনাইল প্রভৃতির বোতল থাকে, সেই কুলুঙ্গি হইতে ভরা বোতল একটা লইয়া বাহিরে আসিয়া তুলিয়া ধরিলাম এবং দলটির পানে চাহিয়া বলিলাম, “এই দেখুন কাল যা নিয়ে এসেছিলাম; না বিশ্বাস হয়, কেউ এসে শুঁকে দেখুন, ফেনাইল কিনা।”
সবাই অনড়; মুখে অমায়িক অবিশ্বাসের হাসি।
উদ্ব্যস্ত হইয়া বলিলাম, “তবুও বিশ্বাস করবেন না? এ যে মহা জ্বালা! আচ্ছা মশায়, আমি স্বীকার করছি, আমি অপরাধী—এটা ফেনাইল নয়, এটা এক্সট্রা-নম্বর ওয়ান—আমায় মার্জনা করুন আর অমন কর্ম করব না। এইবার যান। এ কি! এতেও নিস্তার নেই? আমার কোনও কথাই বিশ্বাস করবেন না? আচ্ছা নিন, আমায় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কিসে এতটা মিথ্যাবাদী চরিত্রহীন করে তুলেছে, এই আপনারাই বিচার করুন।”
সমস্ত শক্তি দিয়া সামনের দেওয়ালে হাতের বোতলটা আছড়াইয়া দিলাম। বলিলাম,
“বুঝুন, কিসের গন্ধ; এইবার তো আর অবিশাস রইল না যে—”
ক্রোধান্ধ হইয়া তাড়াতাড়ি কিসের বোতল যে বাহির করিয়া আনিয়াছিলাম খেয়াল হয় নাই। আমার কথা শেষ হইবার পূর্বেই চূর্ণ বোতল হইতে মেথিলেটেড স্পিরিটের উগ্র সুরাগন্ধ চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল।
দলটি ভূমিশয্যা ত্যাগ করিয়া গগন বিদীর্ণ করিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, “একবার বলো ভাই, গান্ধীজী কি জয়! ত্যাগী শৈলেনবাবু কি জয়!”
তাহার পর ক্যাপ্টেনের পরিচালনায় আমায় একটা নম্র অভিবাদন করিয়া সামরিক প্রথায় কুইক-মার্চ করিয়া চলিয়া গেল।
আমি মূঢ়ের মতো শূন্য দৃষ্টিতে সেইখানেই দাঁড়াইয়া রহিলাম।
.
যাক, সহৃদয় বন্ধুবান্ধবেরা শুনিয়া আশ্বস্ত হইবেন যে, আমার নষ্টচরিত্র পুনরায় ফিরিয়া পাইয়াছি। প্রমাণস্বরূপ আটাশে ডিসেম্বরের ‘বজ্রবাণী’ পত্রিকা হইতে “মজঃফরপুরে সুরা পিকেটিং” শীর্ষক সমাচার হইতে খানিকটা তুলিয়া দিলাম—”
…এই শোচনীয় সংবাদ শুনিয়া পরদিন সন্ধ্যার সময় স্থানীয় কংগ্রেস কমিটি একদল স্বেচ্ছাসেবককে শৈলেনবাবুর গৃহে সত্যাগ্রহ করিবার জন্য প্রেরণ করেন। শৈলেনবাবু প্রথমত দারুণ উগ্রভাব ধারণ করেন, ভৃত্য দিয়া স্বেচ্ছাসেবকদের সবিশেষ অপমান করান, এমনকি শেষে পুলিসের সাহায্য পর্যন্ত লইবার ভয় দেখান; কিন্তু পরিশেষে স্বেচ্ছাসেবকদের অটুট সহিষ্ণুতা ও অপরিসীম সৌজন্য এবং নম্রতায় মুগ্ধ হইয়া তাহাদের সমক্ষে সুরার বোতল, পানপাত্র, সোডার আধার প্রভৃতি যাবতীয় আনুষঙ্গিক দ্রব্য চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া ভবিষ্যতে সুরাত্যাগে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
আমরা স্বেচ্ছাসেবকদের সাধনা, ধৈর্য এবং শৈলেনবাবুর হৃদয়ের বল— এই উভয়েরই প্রশংসা করি এবং সুরাসেবী মাত্রকেই শৈলেনবাবুর মহনীয় দৃষ্টান্ত অনুকরণ করিতে মিনতি করি।