দ্য হোয়াইট হাউজ ইন দ্যা কোল্ড ফরেস্ট

দ্য হোয়াইট হাউজ ইন দ্যা কোল্ড ফরেস্ট

একসময় আমি ঘোড়ার আস্তাবলে থাকতাম। আস্তাবলটায় ঘোড়া ছিল তিনটা। পুরো জায়গাটা তারা সারাক্ষণ হাগামুতা করে ভরিয়ে রাখত।

“তুই না থাকলে, এখানে আরেকটা ঘোড়া ঢোকানো যেত,” বিরক্ত সুরে আমার খালা বলেছিলেন।

আস্তাবলের দেয়ালের নিচের অর্ধেকটা ছিল পাথর দিয়ে তৈরি। আর উপরের অর্ধেক অংশ ছিল কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো। পাথরগুলো চারকোনা করে না কেটে গোলাকার পাথরগুলোকে স্রেফ একটার উপর আরেকটা রেখে চুন বালি দিয়ে জোড়া দিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমি যদি আস্তাবলের এক কোনায় গুটিসুটি মেরে না শুতাম তাহলে ঘোড়াগুলো আমাকে ভর্তা করে ফেলত। শোয়ার সময় আমি সবসময় পাথরগুলোর দিকে মুখ করে শুতাম। বিভিন্ন আকারের পাথরগুলোকে দেখতে আমার কাছে মানুষের মুখের মত লাগত। কোন কোনটাকে দেখে আবার মানুষের হাত, পায়ের পাতা, বুক, এমনকি ঘাড়ের মত মনে হত।

ঘোড়ার গোবরের গন্ধ ছিল খুবই তীব্র, কখনো দুর হত না। কিন্তু তারপরেও আস্তাবলই ছিল একমাত্র জায়গা যেখানে আমি থাকতে পারি। আমার বাড়ি। শীতের রাতগুলোতে প্রচুর ঠান্ডা পড়ত। একগাদা খড় জড়ো করে তার নিচে ঘুমানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু তারপরেও কাঁপুনি থামাতে পারতাম না।

***

আমার কাজ ছিল আস্তাবলের গোবর পরিস্কার করা। কাজটা কখনো শেষ হত না। আস্তাবলের পেছন দিকে সার বানানোর জন্য পাহাড় সমান বিশাল গোবরের স্তূপ জমানো হয়েছিল। প্রতিদিন সেই স্তূপের উপর আমি নতুন করে আরও গোবর ফেলতাম। সেই সাথে খালুর নির্দেশ অনুযায়ী সেই গোবর সার আবার মাঠেও নিয়ে যেতাম। খালু যা যা বলতেন তাই আমাকে করতে হত। তিনি কখনো আস্তাবলের ধারে কাছে আসতেন না। দূর থেকে নাক কুঁচকে সব আদেশ করতেন।

খালার ছেলেমেয়ে ছিল তিনজন-দুই ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলে দুটো প্রায়ই আস্তাবলে খেলতে আসত। বড়টা ছড়ি দিয়ে আঘাত করত আমাকে। সেটা দেখে ছোটটা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ত। ছড়ির আঘাতে চামড়া ফেটে রক্ত বের হত আমার।

সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হয়েছিল যখন ওরা আমাকে ঘোড়ার সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিয়েছিল। ঘোড়ার লাথি খেয়ে আমার চেহারা বদলে গিয়েছিল, সেটা আর ঠিক হয়নি। ছেলেগুলো দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। পরে এমন ভাব করেছিল যেন এই ঘটনার কিছুই তারা জানে না।

লাথি খেয়ে আমার মুখের এক অংশের মাংস খসে গিয়েছিল। আমি মাংসের দলাটা তুলে নিয়ে আস্তাবল থেকে বেরিয়ে মূল বাড়িতে গিয়েছিলাম সাহায্যর জন্য। বাইরে তখনো দিনের আলো ছিল। লনের উপর ছিল সবুজ ঘাসের সমুদ্র। হাঁটার সময় ঝুলে পড়ছিল আমার মুখ।

খালা তার কুকুর আর মুরগিগুলো ঘরের ভেতর রাখেন, সেগুলো উঠোনে ঘোরাঘুরি করছিল। আমি ঘরের দরজায় টোকা দিলাম, কোন শব্দ করলাম না। আমার মুখ থেকে জানি না কী খসে পড়েছিল, কিন্তু সেটা আমি শক্ত করে মুঠোর মধ্যে ধরে রেখেছিলাম।

খালা দরজা খুলে আমাকে দেখে চিৎকার করে পিছিয়ে গেলেন। তিনি কখনো চান না যে আমি তার বাড়ির ধারে কাছে যাই।

“বাসা ভর্তি মেহমান,” তিনি বললেন। “আস্তাবলের ভেতরে থাকবি। মেহমানরা এভাবে তোকে দেখলে ঘেন্নায় মরে যাবে।”

তিনি হাত দিয়ে তাড়িয়ে আমাকে আস্তাবলে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। রাত নামার পর ঘোড়ার পানি খাওয়ার চৌবাচ্চায় বসে ক্ষত পরিস্কার করলাম। কুয়ার পরিস্কার পানি ব্যবহার করা আমার জন্য নিষেধ। ব্যথায় কয়েকবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেও একসময় ঘুমাতে পেরেছি।

আমার কাজিনরা এরপর থেকে ভয়ে আস্তাবল এড়িয়ে চলতে লাগল। না খেয়ে মরে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে আমি ঘোড়ার জন্য দেয়া জাব খেতে লাগলাম। আমার খালা রাতের উচ্ছিষ্ট আমার জন্য নিয়ে এসে অবাক হয়ে গেলেন। “একি? তুই এখনো বেঁচে আছিস? তোর শরীর নিশ্চয়ই শক্ত কোন ধাতুতে তৈরি।”

আমি পুরো একটা মাস পার করলাম মুখে যেন কিছুর ছোঁয়া না লাগে। সেই চেষ্টা করে। প্রায় ছয় মাসের মত ব্যথা ছিল। মুখের যে অংশটা খুলে আলাদা গিয়েছিল সেটা আমি জমিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু এক সময় মাংসের টুকরোটায় পঁচন ধরল। রঙ বদলে কালো হয়ে গেল আর দুর্গন্ধ বের হতে লাগল। তারপরেও আমি অনেকদিন টুকরোটাকে আমার সাথে রেখেছিলাম। আস্তাবলের দেয়ালের পাথরগুলোকে আমার কাছে মানুষের মুখ মনে হত। মাঝে মাঝে আমি আমার মুখের টুকরোটা পাথরগুলোর উপর রেখে নানান জিনিস কল্পনা করতাম। একসময় ক্ষত শুকিয়ে গেল, কিন্তু আমার চেহারা স্থায়ীভাবে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল।

***

মাঝে মাঝে খালার লাল চুলো ছোট মেয়েটা আস্তাবলে এলে আমাদের মধ্যে কথা হত। সে আমার খালা আর তার ছেলে দুটোর চেয়ে একদম অন্যরকম। ছিল, কখনো আমাকে আঘাত করেনি। মাঝে মাঝে সে আমার জন্য বই নিয়ে আসত। ওর দয়াল মনোভাবের কারনে আমি পড়তে শিখেছিলাম। পড়া শিখতে আমার বেশি সময় লাগেনি।

“কি মিথ্যুক রে বাবা!” মেয়েটা আমাকে একদিন বলল। “এত সহজে কেউ বই পড়া শিখতে পারে নাকি”

আমি যে মিথ্যা বলছি না তা ওকে দেখানোর জন্য একটা বই খুললাম আর কিছু অংশ পরে শোনালাম। মেয়েটা অবাক হয়ে গেল।

আমি পুরো বই মুখস্ত করে ফেলতাম। আস্তাবলের ভেতর রাতে কোন আলো ছিল না। দিনের বেলা ফাঁক ফোঁকর দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকত। সেই আলোতে আমি সারাদিন বই পড়তাম। মেয়েটা আমাকে বলেছিল বইগুলোর কথা যেন আর কেউ না জানে। অনেক সময় আমি মাত্র একবার দেখেই বইয়ের লেখাগুলো মনে রাখতে পারতাম।

লাল চুলো মেয়েটা আমাকে অংক কষাও শিখিয়েছিল। পাটিগনিত। সেইসাথে বই পড়েও অনেক সূত্র সম্পর্কে জানলাম। অনেক জটিল হিসাব যা মেয়েটা নিজেও পারত না, সেগুলোও আমি নিমিষেই করতে পারতাম।

“তুমি সত্যি অনেক বুদ্ধিমান!” সে বলেছিল।

একবার খালা আস্তাবলে এসে আমাকে বই পড়া অবস্থায় ধরে ফেললেন। বইটা খড়ের নিচে কানোরও সময় পাইনি। খালা এসে বইটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেন। আমাকে বললেন বই খুবই মূল্যবান জিনিস, সেগুলো কোনভাবেই আমার স্পর্শ করা উচিত না। তারপর একটা ছড়ি দিয়ে আমাকে পেটাতে লাগলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন না কি করে বইটা এখানে এল।

“মা থামো!” লাল চুলো মেয়েটা চিৎকার করে বলল, সে মাত্রই তখন আস্তাবলের ভেতর ঢুকছিল। “এই ছেলেটার মাথা অনেক ভাল! অন্তত আমার দুই ভাইয়ের চেয়ে সে অনেক মেধাবী!”

আমার খালা ব্যাপারটা মেনে নিতে পারলেন না। প্রমাণ দেয়ার জন্য মেয়েটা আমাকে বলল স্মৃতি থেকে বাইবেলের একটা অংশ আবৃত্তি করে শোনাতে। আমি ওর কথামত আবৃত্তি করে শোনালাম।

“হেহ, এতে কোন প্রমাণ হয় নাকি?” অবজ্ঞার সুরে খালা বললেন। কথাটা বলে নড়তে গিয়ে ঘোড়ার গোবরে পা পিছলে ধপাস করে পড়লেন।

***

আস্তে আস্তে আমাদের সবার বয়স বাড়ল। ছেলে দুটো সাধারণত আস্তাবল থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলত। শুধু শিকারে যাওয়ার জন্য ঘোড়ার দরকার পড়লেই তারা আস্তাবলে আসত। লাল চুলো মেয়েটা দূরের কোন একটা বোর্ডিং স্কুলে চলে গিয়েছিল পড়াশুনা করতে। এমনকি আমার খালাও উচ্ছিষ্ট আনা বন্ধ করে দিলেন। খালু আস্তে আস্তে তার জমিগুলো অন্য লোকদের কাছে বিক্রি করে দিতে লাগলেন।

আমি আস্তাবলের এক কোনায় পড়ে থাকতাম। সবাই ভুলেই গিয়েছিল আমার কথা। কারো সাথে আমার দেখা হত না। বছরের পর বছর খড়ের নিচে লুকিয়ে থাকার কারনে লোকজন হয়ত ধরে নিয়েছিল আমি বোধহয় অনেক আগেই কোথাও পালিয়ে গিয়েছি। রাতের বেলা আস্তাবল পরিস্কার করতাম। কেউ আস্তাবলের কাছে এলে কোথাও লুকিয়ে পড়তাম। দেয়ালের পাথরগুলোকে আমার কাছে তখনো মানুষের চেহারার মত লাগত। আমি তাদের হাত আর গোড়ালিও দেখতে পেতাম। দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়ে পড়তাম।

মাঝরাতে উঠে হামাগুড়ি দিয়ে ময়লার ঝুড়ির কাছে যেতাম যেখানে রাতের উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলা হত। এক রাতে খালা আমাকে সেখানে দেখে ফেললেন।

“তুই এখনো এখানে পড়ে আছিস?” তিনি বললেন। তারপর কিছু টাকা ছুঁড়ে ফেলে বললেন, “টাকাগুলো নিয়ে চলে যা এখান থেকে।”

***

এরপর আমি শহরে গেলাম। উঁচু উঁচু বিল্ডিং সবখানে। চারিদিকে খালি মানুষ আর মানুষ। কারো সাথে চোখাচোখি হলে, তারা আমার চেহারা দেখে ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নিত। কেউ কেউ আড়চোখে তাকাত। কেউ কেউ আবার হা করেও তাকিয়ে থাকত।

খালার দেয়া টাকাগুলো সামনের বুকপকেটে রেখেছিলাম। এক রাতে এক নির্জন গলিতে কিছু লোক আমাকে ধরল। তারা আমার সাথে বাজে কিছু কাজ করল। আমি উপলদ্ধি করলাম শহর থেকে আমাকে দূরে থাকতে হবে। কেউ যায় না কিংবা ভুলে গিয়েছে এমন সব পথ বেছে নিলাম আমি হাঁটার জন্য।

হাঁটতে হাঁটতে এক সময় এক বনে গিয়ে পৌঁছলাম। আমার মনে হল এখানেই আমি আমার জীবন নতুন করে শুরু করতে পারব। আমি সবসময় লোজন থেকে দূরে থেকেছি। যখনই কোন মানুষের সাথে দেখা হয়েছে তখনই কিছু না কিছু বাজে ঘটনা ঘটেছে। আমি জানতাম থাকার জন্য আমাকে একটা বাড়ি বানাতে হবে। আস্তাবলের পাথরের দেয়ালগুলোর কথা আমার খুব মনে পড়ত। সেরকম কোন কিছু আমাকে বানাতে হবে। পুরো বন ঘুরে মুখ, হাত বা পায়ের সাথে মিল আছে এরকম পাথর খুঁজলাম। কোথাও কোন পাথর পাওয়া গেল না। বনে শুধু গাছ ছাড়া আর কিছু ছিল না। যতদুর যাই খালি গাছ আর গাছ, সেই সাথে পাতা পচা নরম মাটি।

পাথর খুঁজতে গিয়ে পর্বতে উঠার রাস্তায় এক যুবকের সামনে পড়ে গেলাম। সে সেখানে হাইকিং করতে এসেছিল। আমার মনে হয়েছিল মানুষ মানেই জঘন্য ব্যাপার, তাই তাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

তারপর সেটাই করলাম। খুন করলাম যুবকটাকে।

ওর চেহারাটা পরিচিত লাগছিল। আস্তাবলের দেয়ালের একটা পাথরের সাথে কোথায় যেন যুবকটার চেহারার মিল ছিল। তারপর লাশটা বনের

গভীরে বয়ে নিয়ে গেলাম। অবশেষে নিজের বাড়ি বানানোর জন্য কিছু একটা পাওয়া গেল।

মানুষের দহ দিয়ে আমি আমার বাড়ি বানাতে লাগলাম। লাশের উপর লাশ শুয়ে বাড়ির দেয়াল উঠতে লাগল। মৃতদেহ সংগ্রহের জন্য আমাকে বন থেকে বেরিয়ে লোকালয়ের দিকে যেতে হত।

এক মহিলা, বুকে কাপড়ের একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আমি রাস্তার পাশের এক ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে বসে ছিলাম। মহিলাটাকে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলাম। তারপর ঝোপ থেকে বেরিয়ে পিছু পিছু যেতে লাগলাম। পায়ের শব্দ পেয়ে মহিলাটা পিছনে ফিরে তাকাল। তার চিৎকার ছিল অত্যন্ত জোরালো। বেশিরভাগ মানুষ, আমার বিকৃত চেহারা দেখার পর হয় ভয়ে চিৎকার করে নতুবা রেগে যায়। আমি দু হাত দিয়ে তার গলা চেপে ধরলাম। বুকের কাপড়ের ব্যাগটা খসে পড়ে ভেতর থেকে সবজিগুলো গড়িয়ে গেল। একটা আলু গড়িয়ে আমার পায়ের সাথে এসে লাগল।

মহিলাটার ঘাড়ের হাড় ভাঙা একদম সহজ ছিল। মুহূর্তের মধ্যে যেন তার চিৎকার হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। চোখগুলো কোটর ছেড়ে প্রায় বেরিয়ে পড়েছিল। মরার পরেও লোকজন আমার চেহারার দিকে আতংকিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। মৃতদেহটা টেনে ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে গেলাম। তারপর সবজিগুলো সব এক জায়গায় জড় করলাম। পরবর্তীতে ওর ঠান্ডা দেহটা আমার বাড়ির মূল খুটি হিসেবে ব্যবহৃত হল। ঠান্ডা, পাতা পচা মাটিতে শুয়ে থেকে দেহটা দেয়ালে স্তূপ করে রাখা মৃতদেহগুলোর ভারসাম্য ধরে রাখত।

মাথায় টুপি পরা একটা লোক একটা হাতে টানা কার্ট নিয়ে ব্রিজ পার হচ্ছিল। কাঠের ছোট ব্রিজ। ছোট নদীটার দুপার আগাছা দিয়ে ভরা ছিল। কাঠের ব্রিজটার ছায়া পড়ছিল নিচের পানিতে। আমি ব্রিজের নিচে লুকিয়ে ছিলাম। কার্টটা আমার মাথার উপর দিয়ে যেতেই লাফিয়ে উঠলাম। সাবধান ছিলাম যেন কোন শব্দ না হয়। লোকটা প্রথমে খেয়ালও করেনি। কিন্তু কার্টটা হঠাৎ ভারি মনে হওয়ায় সে ঘুরে তাকাল। আর আমি হাতে ধরে থাকা পাথরটা দিয়ে তার মাথা দুভাগ করে ফেললাম। লোকটা এমনকি চিৎকার দেয়ার সময়টুকুও পায়নি।

লাশটা কার্টে তুলে নিলাম। কার্টের ভেতরে কাঠের বাক্স রাখা। বাক্সগুলোর উপর ভেতরে রাখা ফলের নাম লেখা। লোকটা সম্ভবত শহরে যাচ্ছিল সেগুলো বিক্রি করতে। আমি পুরো কার্ট ধরে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গেলাম। অন্যান্য লাশগুলোর মত লোকটার লাশও দেয়ালের অংশ হয়ে গেল, বাড়ি তৈরির মাল মশলা।

এইসব মাল মশলা আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে জোগাড় করতাম। গ্রাম থেকে শহরের যাওয়ার পথে লোকজনকে খুন করে এক জায়গায় নিয়ে জড় করতাম। তারপর কার্টে ভরে খড় দিয়ে ঢেকে রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে নিয়ে আসতাম।

এক রাতে আমি কার্ট ঠেলে ফিরছি এমন সময় পেছন থেকে একটা গলার আওয়াজ এল, “থামুন!” একজন পুরুষের গলার আওয়াজ। দ্রুত আমি আমার মুখ লুকিয়ে ফেললাম। কোনভাবেই কাউকে আমার চেহারা দেখানো যাবে না। নয়ত অমঙ্গল কিছু একটা ঘটে যেতে পারে।

“এরকম মাঝরাতে কি মনে করে এখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন অ্যাঁ? জানেন না নাকি? লোকজন বলাবলি করছে এখানে নাকি ইদানিং কিডন্যাপারদের উৎপাত শুরু হয়েছে?”

লোকটার হাতে একটা ইলেকট্রিক ল্যাম্প ছিল। বয়স্ক লোক, কিন্তু আবার অতটা বড়োও ছিল না। লোকটা আমার দিকে এগিয়ে এল। একহাত আমার কার্টের উপর দিয়ে রেখেছে। কার্টের উপরের খড় দেখে বলল, “কিডন্যাপারটা আশেপাশের কয়েকটা গ্রামে হানা দিয়েছে। কেউ জানে না নিখোঁজ লোকগুলোর ভাগ্যে কি ঘটেছে। আমার নাতি-নাতনিদের ধারণা মানুষগুলোকে নাকি কেটেকুটে রান্না করে খেয়ে ফেলেছে সে।”

এমন সময় লোকটার চোখ পড়ল খড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে থাকা এক মহিলার গোড়ালির উপর। সে অবাক হয়ে হাত বাড়াল সেটা স্পর্শ করার জন্য। মত শরীরের শীতলতা অনুভব করে কেঁপে উঠল। আমি। লোকটার গলা টিপে মেরে ফেলে তাকেও কার্টের উপর উঠিয়ে রাখলাম।

বনের ভেতরটা ছিল একদম নিস্তব্ধ। গাছের পর গাছ, গোড়াগুলো লোহার মত শক্ত। বছরের সবচেয়ে ঠান্ডা সময় ছিল সেটা। পাতাগুলো তাদের নিজস্ব রঙ হারিয়ে ফেলেছিল, বেশির ভাগই ঝরে পড়ে গিয়েছিল। আমি লাশগুলো নিয়ে জায়গামত নামিয়ে রাখলাম যেখানে কিনা একটা দেয়াল তৈরি করব।

একদম সাধারণ ধরনের একটা বাড়ি বানালাম, চার কোনা বাক্স আকৃতির। দেয়ালের জন্য লাশগুলো একটা আরেকটার উপর স্তূপ করে রেখেছিলাম, ভেতরে কোন ফাঁক-ফোঁকর ছিল না। কিছু লাশ ছিল পুরুষদের, আর কিছু নারীদের। কেউ কেউ ছিল গ্রামের অধিবাসী, কেউ কেউ ছিল স্রেফ পথিক। বনে নেয়ার পর আমি তাদের পোশাকগুলো খুলে নিয়েছিলাম। তারা ছিল সবাই নগ্ন আর সবার চামড়ার রঙ ছিল একদম সাদা।

দেয়ালটা ঠিক রাখার জন্য কিছু দেহ দেয়ালের ভেতর শুয়ে ছিল আর কিছু বসে ছিল। তাদের কেউ কেউ হাঁটু ভাঁজ করে জড়িয়ে ছিল, কারো কারো হাত অন্যদের গলা ধরে ছিল। দেয়ালগুলো পাতলা ছিল না। এক মানুষ সমান পুরু হলে দেয়ালগুলো দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না, দুর্বল হয়ে পড়ত। যে কারনে কয়েক জনের লাশ দিয়ে পুরু করতে হয়েছে। কিছু জায়গায় অতিরিক্ত ঠেক দিতে কাঠ ব্যবহার করতে হয়েছে। বাড়ির কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। মাল মশলা শেষ হয়ে এলে আমি আরো সংগ্রহ করে আনতে যেতাম। দেয়ালগুলো যথেষ্ট উঁচু ছিল। মাল মশলার রঙ যেহেতু সাদা ছিল, বাড়িটার রঙও তাই সাদা ছিল।

শীতের দিন চলতেই থাকল। আমি অর্ধসমাপ্ত দেয়াল ঘেসে ঘুমাতাম। লোকজনের সাথে থাকা খাবারগুলো খেতাম। দেয়ালগুলোর কাজ শেষ হওয়ার পর ছাদের কাজ ধরলাম। গাছের বড় বড় ডাল এনে দেয়ালের উপর রাখলাম তারপর তার উপর আরো কিছু লাশ শুইয়ে দিলাম। ছাদ তৈরি হয়ে গেল। তুষার এখন আর কোন সমস্যা করবে না।

বাড়ির কাজ শেষ। নিরব এক বনের ভেতর ছোট্ট সাদা একটা বাড়ি। লাশগুলোর ত্বক ছিল শীতল আর চাঁদের আলোয় ভয়ংকর রকমের সাদা দেখাত। মনে হত জ্বলজ্বল করছে। গোড়ার কাছের যে লাশগুলো ছিল সেগুলো উপরের ভারে আস্তে আস্তে করে পাতা পচা নরম মাটিতে দেবে যাচ্ছিল।

ভেতরে এক মানুষ দাঁড়ানোর মত জায়গা ছিল। কাঠামোটা ছিল একদম সাধারণ। একটা ছাদ, চারটা দেয়াল আর ঢোকার জন্য একটা মুখ। কিন্তু ঠান্ডা বাতাস ঠেকানোর জন্য এইটুকুই যথেষ্ট ছিল। মৃতদেহগুলোর সবগুলোর চোখ খোলা ছিল, আমার দিকে তাকিয়ে থাকত তারা। ঠিক আস্তাবলের দেয়ালের পাথরগুলোর মত। দেহগুলো জটিলভাবে একটা আরেকটার সাথে পেঁচিয়ে ছিল। এক মহিলার চুল এত বড় ছিল যে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঝুলে ছিল, সেই সাথে তার নিচের দেহগুলোর মুখগুলোও সে ঢেকে দিয়েছিল।

আমার জীবন ছিল একদম সাধারণ, চুপচাপ। এই বনে তেমন একটা পাখিও ছিল না, শুধু ছিল আমার এই সাদা বাড়ি। যে বাড়ির সবগুলো চোখ সবসময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকত।

দেয়ালের মৃতদেহগুলোর মধ্যে এক লোকের কনুই ভাঁজ করা ছিল। ফলে পাশের লোকের শরীরও বাঁকিয়ে ওই কনুইয়ের সাথে মেলাতে হয়েছে। একটা কম বয়সি ছেলে মাটির উপর সোজা দাঁড়িয়ে মাথার উপর অন্যদের ভার বহন করছিল। সবার হাত-পা এমনভাবে উল্টোপাল্টা পেচিয়ে ছিল যে দেখে মনে হত অনেকগুলো সাপ একসাথে এক জায়গায় কিলবিল করছে। এর মাঝে হাঁটু ভাঁজ করে জড়িয়ে আমি ঘুমাতাম। শীতের ঠান্ডা রাতগুলো শেষ হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না।

প্রায়ই খালার বাসায় থাকার সময়ের কথা আমার মনে পড়ত। যখনই চোখ বুজতাম, সাথে সাথে সেই আস্তাবলে ফিরে যেতাম। লাল চুলো মেয়েটার কথা মনে পড়ত। যে বাড়িতে আমার বাবা-মা এর সাথে থাকতাম সেটার কথাও মনে পড়ত। আমরা তেমন বড়লোক কোন পরিবার ছিলাম না। শীতের সময় বাবা বাইরে গিয়ে ঠান্ডায় জমাট বাধা মাঠে চাষের জন্য মাটি খুঁড়তেন। মা তাকে নিজের হাত লাল না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সাহায্য করতেন। এক বৃষ্টির দিনে তারা ভয়াবহ এক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান। একটা ছুটতে থাকা ঘোড়ার গাড়ির সাথে তারা কিভাবে যেন পেঁচিয়ে গিয়েছিলেন। অন্তত আমাকে সেরকমই বলা হয়েছিল

এরপর খালা আমার দায়িত্ব নেন। আমাকে তাদের আস্তাবলে থাকতে দেয়া হয়। মূল বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি ছিল না, কারন আমার শরীর থেকে সবসময় ঘোড়ার গোবরের গন্ধ আসত। আস্তাবলের দেয়ালের নিচের অর্ধেকটা গোলাকার পাথর দিয়ে তৈরি ছিল, যেগুলো দেখে মানুষের মুখের মত মন হত।

সাদা বাড়িতে এভাবে কিছুদিন কাটানোর পর, সেখানে একটা মেয়ে এল।

আমি বাড়িতে বসে চিন্তা করছিলাম এমন সময় বাইরের পড়ে থাকা পাতার উপর কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। কেন জানি মনে হল কেউ নিশ্চয়ই এই গভীর বনে সেফ এই বাড়িটার খোঁজেই এসেছে। ধসর আকাশে একটা মলিন সূর্য বাড়ির প্রবেশ পথে আলো ফেলছিল। একটা ছোট্ট ছায়া সেই আলো ঢেকে ফেলল। কে এসেছে দেখতে আমি মাথা তুললাম। মেয়েটা প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে ছিল।

একদম ছোট একটা বাচ্চা। মুখে ভয়ের চিহ্ন। তার পোশাকের রঙ ছিল খুবই গাঢ় নীল রঙের, প্রায় কালোর কাছাকাছি। মেয়েটার ত্বকের রঙ ছিল ফ্যাকাসে সাদা। ঠোঁট ছিল নীলচে, ঠান্ডা বা ক্ষুধা থেকে নয় বরং ভয় থেকে।

“তুমি কি এখানে থাক?” সে আমাকে প্রশ্ন করল, গলা কাঁপছিল। মেয়েটার হাতগুলো ভাঁজ করে বুকের উপর শক্ত করে ধরা, মাথা দুলছিল। “তোমার বাড়ি তো দেখি মানুষ দিয়ে তৈরি!”

সে আমার ছোট বাড়িতে ঢুকে স্তূপ করে রাখা সাদা মৃতদেহগুলো দেখতে লাগল। আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। “তোমার মুখে দেখি একটা গর্ত!”

গর্তটা নিয়ে ওকে আগ্রহী দেখাল, আমার কাছে এগিয়ে এল।

“বেশ বড় একটা গর্ত, পাখি বাসা বানানোর মত যথেষ্ট বড়। গভীর আর অন্ধকার। ঠিকমত দেখতেও পারছি না।” ওকে দেখে মনে হল সে আমার চেহারা নিয়ে সত্যি সত্যি চিন্তিত।

“তুমিই কি ওদের সবাইকে এখানে নিয়ে এসেছ?” ওকে এতটা চিন্তিত দেখাল যে মনে হচ্ছিল যে কোন সময় অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। “আমার সবসময় মনে হত, লোক আমার ভাইকে তুলে নিয়ে গিয়েছে সে এখানেই কোথাও আছে, এই বনের গভীরে কোথাও। আমাকে আমার ভাই ফিরিয়ে দাও! আমি এতদুর এসেছি শুধু আমার ভাইয়ের জন্য।”

মেয়েটা লাশগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল যে কোন মুহূর্তে কেঁদে ফেলবে। শীতল জঙ্গলে, সূর্যের মলিন আলোতে সাদা লাশগুলো মনে হচ্ছিল জ্বল জ্বল করছিল।

“আমি নিশ্চিত আমার ভাই এখানেই কোথাও আছে। সে খুবই সুদর্শন আর স্মার্ট।”

সদর্শন, স্মার্ট দেখতে একটা ছেলে ভেতরের দেয়ালে আছে। ছেলেটা দাঁড়িয়ে থেকে ওর মাথার উপর অন্য দেহগুলোর ভার ধরে ছিল। আমি মেয়েটাকে লাশটা দেখালাম। সে তার ভাইকে দেখতে পেয়ে নাম ধরে ডাকতে লাগল। ওর কণ্ঠের জোর দেখে চমকে গেলাম আমি। মেয়েটা ওর ভাইয়ের মৃতদেহের কাঁধ ধরে দেয়ালের ভেতর থেকে বের করে আনতে চাইল। আমি ওকে বাধা দিলাম। ছেলেটাকে সরিয়ে নিলে পুরো বাড়িটা ভেঙে পড়বে।

“কিন্তু আমাকে আমার ভাইকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।” মেয়েটা কাঁদছিল। আমার বাবা আমার চেয়ে আমার ভাইকে বেশি পছন্দ করেন। সবসময় মেজাজ খারাপ থাকে তার। তিনি সবসময় আমার গায়ে হাত তুলেন। আমার ভাই নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে বাবা অনেক মনমরা হয়ে থাকেন। তিনি সবসময় আমার মা আর ভাইয়ের সাথে একসাথে বসে খাবার খেতে পছন্দ করতেন। মা এখন বিদেশে গিয়েছেন কাজে, তিনি ফেরত আসার আগেই আমি আমার ভাইকে বাসায় নিয়ে যেতে চাই। প্লিজ আমার ভাইকে ফিরিয়ে দাও।”

মেয়েটা মরা পাতার উপর হাঁটু গেড়ে বসে আমার কাছে ভিক্ষা চাইতে লাগল। আমি ওর অনুরোধ নাকচ করে দিতে বাধ্য হলাম কারন ওর ভাইকে ছাড়া বাড়ি ভেঙে পড়বে। মেয়েটার চোখ অশ্রুতে ছলছল করছিল। সে আমাকে বলল, “আমি নাহয় ওর জায়গায় দাঁড়াব।”

এই কথার পর আমি ছেলেটার দেহ বের করে আনলাম। মেয়েটা দ্রুত খালি জায়গাটার মধ্যে ঢুকে গেল, যেখানে ওর ভাইয়ের দেহ ছিল এতদিন। সেখানে সে চমৎকারভাবে খালি জায়গাটায় খাপে খাপে লেগে গেল। ও ওর পোশাক পরে ছিল যে কারনে সাদা দেয়ালে একমাত্র রঙটাও ছিল ওর পোশাকের। ছেলেটার দেহ বের করে আনার পরেও লাশটা একইরকম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

“প্লিজ আমার ভাইকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে এসো…”

ওর কথায় কষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছিল। সে আমাকে তার বাড়িতে কিভাবে যেতে হবে তা ব্যাখ্যা করে বলল। তথ্যটা মনে রাখতে আমার কোন কষ্টই হল না।

“তুমি তো দেখি খুব দ্রুত শিখতে পার।” মৃতদেহের ভিড়ের ভেতর থেকে মেয়েটা অবাক হয়ে বলল। আমি ছেলেটার দেহ বাড়ির বাইরে নিয়ে গেলাম আর এমন ভাব করলাম যেন বাসায় ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছি। আসলে আমি লাশটা কিছুদূর নিয়ে ফেলে দিলাম। তারপর সেটার পাশে বসে আমার সাদা বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। লাশটা ফিরিয়ে দিয়ে আসার কোন ইচ্ছাই আমার ছিল না। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমি চলে গেলে মেয়েটা দেয়াল থেকে বেরিয়ে পালানোর চেষ্টা করবে।

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম কিন্তু মেয়েটা বের হল না। একটা পুরো দিন পার হয়ে গেল। মেয়েটার বাসায় গিয়ে ফিরে আসতে আমার এরকম সময়ই লাগার কথা। সুতরাং আমি বাড়িতে ফিরে গেলাম আর ভান করলাম যেন ছেলেটাকে বাসায় রেখে এসেছি। মেয়েটা তখনো দেয়ালের ভেতরেই ছিল, এক বিন্দু নড়ছিল না।

“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমার ভাইকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসার জন্য। আমি নিশ্চিত যে বাবা এখন খুশি হবে, মাও যখন বিদেশ থেকে ফিরে আসবে সেও খুশি হবে।” খুশিতে কাঁদছিল মেয়েটা। একগাদা সাদা মতদেহের ভেতর মেয়েটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথার উপরের দেহগুলোর ভার রক্ষা করছিল।

এভাবে মেয়েটার সাথে আমার জীবন শুরু হল। সে কথা বলতে পছন্দ করত। ছোট্ট বাড়িটা ওর গলার আওয়াজে পরিপুর্ণ হয়ে থাকত। দেয়ালের অন্য দেহগুলোর চোখগুলো তখনো খোলা থাকত। কিন্তু প্রতিটা দিন পার হত আর দেহগুলোর আকৃতি একটু একটু করে বদলে যাচ্ছিল।

মেয়েটা প্রথম প্রথম একটু ব্ৰস্ত থাকলেও কথা বলতে শুরু করা পর থেকে হাসতে শুরু লাগল। নিস্তব্ধ বনের ভেতর ঠান্ডা, শীতল ছোট ঘরটায় ওর হাসি ছিল সূর্যালোকের মত।

“আমাকে বল তো, তোমার চেহারা ওরকম হল কি করে?” সে জানতে চাইল। আমি ওকে আমার খালার বাড়ি সম্পর্কে জানালাম।

“কি দুঃখজনক,” সে সহানুভূতির সরে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল। ওর বাবাও ওকে পেটাত। সে নিজেও বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে আস্তাবলে থাকত। আস্তাবলে ঘোড়ার গোবরের গন্ধের কথা মনে পড়তে নাক কুচকাল।

“এই ঘরের গন্ধও বেশ তীব্র, কিন্তু আস্তাবলের গন্ধের মত নয়।”

এভাবে আমরা একজন আরেকজনকে নিজেদের গল্প বলে সময় পার করতে লাগলাম। আমি ওকে খালার বাসায় পড়া বইগুলোর কথা বলতে ভুললাম না।

দিনগুলো তখন বড়ই অদ্ভুত ছিল। এই দিনগুলোর আগে আমি নিঃসঙ্গ ছিলাম। সারাদিন শুধু হাঁটু ভাঁজ করে বসে দেয়ালের খোলা চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আগে যে ভয় আমার ভেতর কাজ করত তা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে আমার হৃদয় শান্তিতে ভরে উঠছিল।

মেয়েটা ঘুমালোও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। কিছুদিন পর ও কথা বলা কমিয়ে দিল। ওর মুখ আরো ফ্যাকাসে হয়ে যেতে লাগল আর এক সময় ওকে আশেপাশের লাশগুলোর মতই সাদাটে দেখাতে লাগল। আমার মনে হল ও বোধ হয় ঠান্ডা আর ক্ষুধায় মারা যাবে।

“একটা গল্প শোনাও,” মেয়েটা আমাকে বলল। আমি আমার মুখস্ত করা বই থেকে একটা অংশ শোনালাম।

একসময় মেয়েটার চোখের পলক পড়া থেমে গেল। চোখগুলো বিস্তৃত হয়ে ছিল। একটা হালকা হাসি ওর মুখে ছড়িয়ে ছিল।

ওর উচ্চতাও খানিকটা কমে গেল। আমি বুঝতে পারছিলাম আস্তে আস্তে ওর মাথার উপর মৃতদেহগুলোর ভার বাড়তে শুরু করেছে। এমনিতে ও ওর ভাইয়ের চেয়ে একটু লম্বা ছিল। মেয়েটার মুখ ঠান্ডায় সাদা হয়ে গেলে শুধু পোশাকের গাঢ় নীল রংটাই বাড়ির একমাত্র রঙ হয়ে রইল। হাঁটু ভাঁজ করে জড়িয়ে আমি মাঝখানে বসে থাকলাম। কথা বলার কেউ যখন আর নেই কথা বলার সব প্রয়োজনও আমার ফুরিয়ে গিয়েছিল। মৃতদেহের। স্তূপ দিয়ে তৈরি বাড়িটায় আবার আগের মত নীরবতা নেমে এল। আমি বুকের ভেতর কোথাও অনুশোচনা অনুভব করছিলাম। মেয়েটাকে দেয়া কথাটা না রাখার জন্য। আমি ঠিক করলাম মেয়েটার বাড়িতে যাব। ওর ভাইকে ফিরিয়ে দিয়ে আসব।

বাইরে ছেলেটার লাশ তখনো পড়ে ছিল। সূর্যের আলোর কারনে পঁচে গলতে শুরু করেছে। লাশটা তুলতে গেলে নরম টুকরোগুলো ভেঙে খসে পড়তে লাগল। মেয়েটাকেও আমি ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইছিলাম কারন সে তার বাবা-মাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসত।

মেয়েটার কাঁধ ধরে টেনে দেয়াল থেকে বের করে আনলাম। পুরো বাড়িটা থর থর করে কাঁপতে শুরু করল। লাশটা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতেই আমার সাধের সাদা বাড়ি পুরো ভেঙে পড়ল। প্যাঁচানো দেহগুলোকে একসাথে দেখে আর মানব দেহ বলে চেনা সম্ভব ছিল না। বরং ওগুলোকে দেখতে বড় এক তাল গোবরের মত লাগছিল।

নীরব, নিস্তব্ধ, শীতল বনের ভেতর অসংখ্য গাছের সারির মাঝে পর্বতের মত একতাল মাংসের স্তূপ পড়ে রইল। যেই কাঠের বাক্সটা আমি লাশ পরিবহনের কাজে ব্যবহার করতাম সেটা কাছেই পড়ে ছিল। একসময় সেটায় ফলমূল পরিবহন করা হত। কোন বাক্সে কোন ফল রাখা তা উপরে লেখা ছিল। মেয়েটা আর ওর ভাইয়ের পঁচে যাওয়া, দেহ আমি বাক্সটায় নিয়ে ভরলাম। ছেলেটার গলে যাওয়া দেহ সুন্দর মত মেয়েটার ভাঁজ করা দেহের সাথে ফাঁক ফোঁকরে ঢুকে গেল। ঢাকনাটা লাগিয়ে বাক্সটা নিয়ে ওদের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।

ওদের বাড়ির দরজার কাছাকাছি পৌঁছুতে খেয়াল করলাম একজন মহিলা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। মহিলার হাতে বড় একটা ব্যাগ। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল মহিলাটা মেয়েটার মা হবে, বিদেশ থেকে ফিরছে।

আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে মহিলাটার কাছে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। একসময় সে আমার সামনে এসে থামল। তার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল।

“আহ তুমি! তুমি বেঁচে আছ!” সে এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রাখল।

“ইশ্বরকে ধন্যবাদ। তোমার চেহারা আগের মতই রয়েছে, ওই যে ঘোড়ার লাখি খাওয়ার পর যেমন ছিল, ঠিক তেমনই। গত কয়েক বছর আমি যে কতবার তোমার কথা চিন্তা করেছি!”

মেয়েটার বয়স বাড়লেও চুল এখনো আগের মতই লাল রয়েছে। “তুমি এখন থেকে আমার বাড়িতে কাজ করতে পার। আমি বিদেশে গিয়েছিলাম, অনেকদিন পর ফিরছি। এতদিন পর ছেলেমেয়েদের আবার দেখতে পাওয়ার জন্য তর সইছে না।”

লাল চুলো মহিলাটা আমার হাতে ধরা বাক্সটার দিকে তাকাল। ঢাকনাটা খুলে দেখতে চাইলে আমি তাকে বাধা দিলাম।

“বাজে গন্ধটা কিসের? ভেতরের ফলগুলো নির্ঘাত পঁচে গিয়েছে। তুমি কি আমার হয়ে এটা পিছনের সারের স্তূপে নিয়ে ফেলতে পারবে?”

আমি বাক্সটা নিয়ে বাড়ির আস্তাবলের পেছনে গোবরের স্তূপের দিকে গেলাম। সেখানে সার বানানোর জন্য পাহাড় সমান গোবর স্তূপ করে রাখা, ঠিক যেমনটা আমি ছোট থাকতে দেখেছিলাম। ছেলেটা আর মেয়েটার মৃতদেহগুলোকে আমি ওই গোবরের স্তূপের ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম। তারপর আস্তাবলে গিয়ে ঢুকলাম। জায়গাটা ঠিক আগের মতই রয়েছে। আস্তাবলের দেয়ালের পাশে হাঁটু ভাঁজ করে গুটিসুটি মেরে শুয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *