দ্য হন্টেড রুম
সপ্তাহ ছয়েক আগে এক ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী একটা সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাটের খোঁজ করছিলেন। একটা নির্জন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দেখলেন একটা বাড়ির জানালায় বোর্ড ঝুলছে। তাতে লেখা : আসবাবপত্রে সজ্জিত ফ্ল্যাট ভাড়া। পরিবেশ পছন্দসই হওয়ায় সপ্তাহখানেকের জন্য সেখানে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন। কিন্তু পুরো তিনদিনও সেখানে থাকতে পারলেন না। ফ্ল্যাটটা ছাড়তে বাধ্য হলেন।
কোনোরকমে দ্বিতীয় রাতটা কাটিয়ে পরের দিন সকালেই সেই বাড়ির পরিচারিকাকে জানালেন এই ঘর তাদের পছন্দ হয়নি বলে তারা পুরো এক সপ্তাহ থাকতে পারছেন না। পরিচারিকাটি বিরস বদনে বলল :
‘আমি জানি কেন আপনারা থাকতে পারছেন না। আপনারা অন্যদের থেকে বেশিদিন থেকেছেন। খুব কম লোকই এ ফ্ল্যাটে দুরাত কাটিয়েছে। তবে আমি স্বীকার করছি তেঁনারা আপনাদের ওপর সদয়।’
‘তেঁনারা-কারা?’ মৃদু হেসে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।
‘কেন, তাঁরা যাঁরা এই বাড়িতে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়-তাঁরা যে-ই হোক না কেন, আমি এ নিয়ে কিছু ভাবি না। অনেক দিন থেকেই আমি তেঁনাদের জানি। আর এও জানি তাঁরাই একদিন আমার মৃত্যুর কারণ হবে। এসব আমি পাত্তা দিই না। বয়স হয়েছে আমার, যেকোনো সময়েই মারা যেতে পারি। তখন তেঁনাদেরই একজন হয়ে যাব। আর এই বাড়িতেই থাকব।’
পরিচারিকাটি এমন শান্ত সহজ স্বরে কথাগুলো বলল যে এ ব্যাপারে আর বাড়াতে সাহস হলো না। এক সপ্তাহের টাকা মিটিয়ে সেখান থেকে চলে এলেন ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী।
একদিন আমার এক পণ্ডিত ও দার্শনিক বন্ধু আমার কাছে ব্যাপারটা বলতেই আমি বললাম, ‘তোমার কথা শুনে আমি কৌতূহল বোধ করছি। ভুতুড়ে বাড়িতে রাত কাটাতে আমি খুব মজা পাই। দয়া করে আমাকে সেই বাড়ির ঠিকানাটা দাও।’
আমার বন্ধু ঠিকানা দিয়ে বিদায় হলো। আমি সোজা সেই বাড়ি অভিমুখে রওনা দিলাম।
এ জায়গাটা অক্সফোর্ড স্ট্রিটের উত্তর দিকে নিরিবিলি, ভদ্র পাড়ায়। দেখলাম বাড়িটা বন্ধ, জানালায় বোর্ড নেই, দরজায় কড়া নাড়তেও কেউ সাড়া দিল না। আমি ফিরে চলে আসছি এমন সময় একটা ছোট ছেলে বিয়ারের বোতল কুড়োতে এসে আমাকে বলল :
‘স্যার, আপনি কি এই বাড়ির কাউকে খুঁজছেন?’
‘হ্যাঁ, শুনেছিলাম বাড়িটা ভাড়া দেয়া হবে।’
‘ভাড়া! যে পরিচারিকাটি থাকত সে আজ সপ্তাহ তিনেক আগে মারা গেছে। আর কাউকে ওখানে থাকতে দেখিনি। যদিও মি. জে-অনেক চেষ্টা করেছে। সে আমার মাকে তার টুকিটাকি কাজ আর বাড়িটার জানালা- দরজাগুলো খোলা ও বন্ধ রাখার জন্য সপ্তাহে দুই পাউন্ড করে দিতে চেয়েছিল। মা রাজি হয়নি।’
‘রাজি হয়নি কেন?’
‘এ বাড়িটা ভুতুড়ে। যে বুড়ি পরিচারিকাটি এই বাড়িটায় থাকত একদিন লোকে দেখে সে তার বিছানায় ড্যাবডেবে চোখ মেলে মরে পড়ে আছে।’
তুমি মি. জের কথা বলছ। সে-ই কি এ বাড়ির মালিক?’
‘হ্যাঁ।’
‘কোথায় থাকে সে?’
‘জি স্ট্রিটের ১০ নম্বর বাড়িতে।’
‘সে কী করে? কোনো ব্যবসা আছে তার?’
‘না স্যার, তেমন কিছু করেন না, তিনি তো একা।’
তথ্য দেয়ার জন্য ছেলেটিকে কিছু বকশিশ দিয়ে সেই ভুতুড়ে বাড়িটার কাছে জি স্ট্রিটে মি. জের খোঁজে চললাম। সৌভাগ্য, তাঁকে বাড়িতেই পেলাম। বেশ বয়স্ক লোক, চোখে-মুখে বুদ্ধির ছাপ, চালচলনও আকর্ষণীয়।
আমার নাম এবং আসার উদ্দেশ্য তাঁকে খোলাখুলি জানালাম। বললাম, শুনেছি বাড়িটা নাকি ভুতুড়ে। এমন সন্দেহজনক বাড়ি পরীক্ষা করার দারুণ ইচ্ছে। এক রাতের জন্য হলেও যদি বাড়িটা তিনি আমাকে ভাড়া দেন তো আমি বাধিত হব। তার বদলে তিনি যত ভাড়া চাইবেন আমি দিতে প্রস্তুত।
মি. জে সৌজন্য দেখিয়ে বললেন, ‘স্যার, আপনার যতদিন ইচ্ছা বাড়িটা ব্যবহার করতে পারেন। ভাড়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আপনি যদি এই অদ্ভুত ব্যাপারের কারণটা খুঁজে বের করতে পারেন আমিই তার জন্য কৃতার্থ হব। আমি এটা ভাড়া দিতে পারব না, কারণ কেউ এখানে আসতে চায় না, এমনকি কোনো কাজ করার লোকও না।
‘দুর্ভাগ্যবশত বাড়িটাতে শুধু রাতে নয় দিনের বেলাতেও ভূতের তাণ্ডবনৃত্য হয়। বেচারা বুড়ি যে তিন সপ্তাহ আগে এখানে মারা গেছে সে নিঃস্ব গরিব ছিল। তাকে আমিই ওয়ার্ক হাউস থেকে নিয়ে আসি। ছোটবেলায় সে আমাদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে আসত এবং একসময় সে আমার চাচার বাড়ি ভাড়া দিয়ে দেখাশুনো করত। সে লেখাপড়া জানা শক্ত মনের মহিলা ছিল। একমাত্র তাকেই আমি এ বাড়িতে থাকতে পীড়াপীড়ি করেছিলাম। বাস্তবিক, তার এই হঠাৎ মৃত্যুতে আশেপাশে বদনাম ছড়িয়ে পড়ায় কাউকেই বাড়িতে রাখতে পারছি না, ভাড়াটে তো নয়ই। যদি কেউ বাড়ির কর ইত্যাদি দিতে রাজি হয় তো এক বছরের জন্য তাকে আমি বিনা ভাড়াতেও রাখতে পারি।’
‘কতদিন ধরে বাড়িটার এমন বদনাম?’
‘আমি ঠিক বলতে পারব না, তবে অনেক বছর হলো। সেই বুড়ি বলত যখন সে এটা ভাড়া দিয়েছিল তার আগেও নাকি ভূতের অত্যাচার হতো, ধরুন তিরিশ চল্লিশ বছর আগে। পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে আমার জীবন কেটেছে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি করতাম।
‘গত বছর আমি ইংল্যান্ডে ফিরে আসি। চাচার সম্পত্তির সঙ্গে এই বাড়িটাও পাই। আমি বরাবরই এই বাড়িটা বন্ধ থাকতে দেখেছি এবং কাউকে এখানে বাস করতে দেখিনি। শুনেছিলাম এটা ভুতুড়ে বাড়ি, আর কেউই এ বাড়িতে থাকতে চায় না। তাদের সে কথা শুনে আমি আজগুবি গল্প মনে করে হেসে উড়িয়ে দিই।
‘এরপর বাড়িটা সারিয়ে রং করতে কিছু খরচপত্তর করি। সেই সঙ্গে পুরানো আসবাবপত্রের সঙ্গে নতুন কিছু এনে সাজাই। তারপর বিজ্ঞাপন দিয়ে এক বছরের মধ্যেই ভাড়াটে পেয়ে যাই। প্রথম ভাড়াটে ছিল একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। তার মাইনের অর্ধেক টাকা পেনশন হিসেবে পেত। সে তার পরিবারের সঙ্গে এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে আর চার-পাঁচজন চাকর নিয়ে এখানে আসে। কিন্তু পরের দিনই তারা বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। তারা এখানে অদ্ভুত কিছু দেখেছিল, যাতে তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
‘তারপর আমি ওই বুড়িকে পরিচারিকা হিসেবে এখানে রাখি এবং তাকে ঘর ভাড়া নেয়ার দায়িত্ব দিই। আমি কখনো এখানে পরপর তিন রাত থাকার মতো ভাড়াটে পাইনি। তাদের গল্প আপনাকে না বলাই ভালো। আপনি বরং নিজেই বিচার করে দেখুন, তবে কিছু দেখার বা শোনার জন্য তৈরি হয়েই থাকবেন এবং তার জন্য যা যা সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন মনে করেন, করবেন।’
আমি বললাম, ‘ওই বাড়িতে অন্তত এক রাত কাটাবার জন্য আপনার নিজের কখনো আগ্রহ হয়নি?’
‘হ্যাঁ, কাটিয়েছি। এক রাত নয়। দিনের বেলায় একা তিন ঘণ্টা। তবে একটা কথা খোলাখুলিই বলি, প্রচণ্ড সাহস না থাকলে আমার একান্ত অনুরোধ, এক রাতও আপনি ও বাড়িতে কাটাতে যাবেন না।’
আমি বললাম, ‘নানা বিপদের মধ্যে আমার সাহসের পরীক্ষা হয়ে গেছে, আর নিজের উপর আমার বিশ্বাসও আছে।’
মি. জে আর বিশেষ কিছু না বলে বাড়ির চাবিটা এনে আমাকে দিলেন ধন্যবাদ জানিয়ে আমি চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
আমার একজন খাস ভৃত্য ছিল। সে ছিল খুবই স্ফূর্তিবাজ, নির্ভীক এবং কুসংস্কারমুক্ত যুবক। ডাকলাম তাকে।
‘এফ,’ আমি বললাম, ‘তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে জার্মানিতে আমরা সেই পুরানো দুর্গে ভূত দেখতে না পেয়ে কীরকম হতাশ হয়েছিলাম, লোকে বলত সেখানে স্কন্দকাটা ভূত আছে? দেখ, এই লন্ডন শহরে একটা বাড়ি আছে। শুনেছি সেখানে নাকি ভূত আছে। সেখানে আমি আজ রাত কাটাব যা শুনেছি তাতে নিঃসন্দেহে কিছু নিশ্চয়ই দেখা বা শোনা যাবে-হয়তো এমন কিছু যা সত্যিই ভয়ংকর। তুমি কি আমার সঙ্গে ওখানে যেতে ইচ্ছুক?’
‘অবশ্যই, স্যার,’ সে বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলল।
‘বেশ, ঠিক আছে; এই নাও বাড়ির চাবি, আর এই ঠিকানা। ওখানে গিয়ে আমার শোবার জন্য একটা ঘর ঠিক করবে। ফায়ারপ্লেসে ভালো করে আগুন জ্বালাবে, বিছানা পরিষ্কার করে জানালা-দরজা খুলে আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা করবে। আর হ্যাঁ, দেখো সেখানে বাতি ও জ্বালানি যেন থাকে। আমার রিভলবার ও ছুরিটা তুমি নিয়ে যাও, আমার অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও তুমি নিজেকে তৈরি রাখবে। যদি আমরা এক ডজন ভূতের মোকাবিলা করতে না পারি তবে বৃথাই আমরা ইংরেজ।’
সারাদিন আমি জরুরি কাজের মধ্যে এমন ডুবে রইলাম যে নৈশ অ্যাডভেঞ্চারের কথা ভাববার কোনো অবকাশ পেলাম না। একা একা আহার সারলাম এবং বেশ দেরি করেই-অভ্যাসমতো খেতে খেতে পড়তে লাগলাম। যে বইটি আমি বেছে নিয়েছিলাম সেটা মেকলের একটা রচনা। সিদ্ধান্ত নিলাম বইটা সঙ্গে নিয়ে যাব। এই রচনাশৈলীর মধ্যে আধ্যাত্মিক উন্নতির যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে এবং বিষয়বস্তুর মধ্যে প্রত্যক্ষ জীবনের কুসংস্কারের প্রতিষেধক হিসেবে এটা বিশেষ উপযোগী।
রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ বইটা পকেটে পুরে হাঁটতে হাঁটতে সেই ভুতুড়ে বাড়ির দিকে যেতে লাগলাম। আমার প্রিয় বুল টেরিয়র কুকুরটাকেও সঙ্গে নিয়ে চললাম—খুব সাহসী। রাতে অন্ধকার কোনো জায়গায় ইঁদুরের খোঁজ পেলে বা অদ্ভুত কিছু দেখলেই চিৎকার করে ওঠে।
তখন গরমের রাত তবে বাতাসটা ঠান্ডা, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। আকাশে সরু এক ফালি চাঁদ, মৃদু আভা মেঘের ভেতর থেকে বেরুচ্ছে। অধিক রাতে মেঘ কেটে গেলে আলোটা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
গন্তব্যে পৌঁছে দরজায় কড়া নাড়তেই আমার চাকর এসে দরজা খুলে হাসিমুখে স্বাগত জানাল।
‘সব ঠিক আছে স্যার এবং বাড়িটি বেশ আরামদায়ক।’
‘ওহ!’ আমি একটু হতাশ হয়ে বললাম। ‘চোখে পড়ার মতো বিশেষ কিছু দেখোনি বা শোনোনি?’
‘হ্যাঁ স্যার, অদ্ভুত কিছু শব্দ শুনেছি।’
‘যেমন?’
‘আমার পেছনে পা ফেলে দ্রুতবেগে চলার শব্দ; দুএকবার আমার কানের কাছে ফিসফিস করে কে যেন কী বলল। আর কিছু নয়।’
‘তুমি ভয় পাওনি?’
‘আমি! একটুও নয় স্যার।’
এফ-এর দুঃসাহসিকতা আমাকে একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত করল যে যা কিছুই ঘটুক না কেন, সে আমাকে ছেড়ে যাবে না।
আমরা হলঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে, সদর দরজা বন্ধ, আমার মনোযোগ কুকুরটার দিকে। প্রথমে সে বেশ উৎফুল্ল হয়ে ঘরের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করল কিন্তু তারপরই বন্ধ দরজার কাছে গিয়ে মুখ নিয়ে কী যেন শুনতে লাগল আর বাইরে বেরোবার জন্য দরজায় আঁচড়াতে লাগল। আমি তার মাথায় আদর করে চাপড় দিতে সে যেন পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরে আমাকে ও এফ-কে অনুসরণ করল। বাড়ির ভেতরে সে আমার পায়ে পায়ে চলতে লাগল। তার স্বাভাবিক অভ্যাসমতো অজানা জায়গায় অনুসন্ধিৎসু হয়ে আগে যাবার প্রবণতা দেখা গেল না।
আমরা প্রথমে নিচের তলার ঘরগুলো দেখলাম, তারপর রান্নাঘর বিশেষ করে ভাঁড়ার ঘর। সেখানে দেখলাম দুতিনটে মদের বোতল ঝুড়িতে রয়েছে। চারদিক ঝুলে ভর্তি। বোঝা যায় অনেক দিন এখানে পরিষ্কার করা হয়নি। তবে ভূতেরা নিশ্চয় মদখোর নয়।
নজর কাড়বার মতো আর কিছুই নেই। পেছন দিকে একটা ছোট অপরিষ্কার বাগান উঁচু পাঁচিল দিয়ে চারদিক ঘেরা। ধুলোভর্তি পাথর বাঁধানো পথে যেখানে আমাদের পা পড়ছে সেখানে দাগ রয়ে যাচ্ছে।
এখানেই এই অজানা আশ্চর্য পরিবেশের মধ্যে আমি প্রথম বিস্ময়কর একটি ব্যাপার লক্ষ করলাম।
আমার সামনে দেখলাম হঠাৎ একটা পায়ের ছাপ ফুটে উঠেছে। থমকে দাঁড়িয়ে চাকরের হাতটা ধরে ইশারায় সেই দিক দেখালাম। সেই পায়ের ছাপের সামনে হঠাৎ আর একটা পায়ের ছাপ ফুটে উঠল। আমরা দুজনেই দেখলাম। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম, পায়ের ছাপও একটার পর একটা করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। একটা ছোট পায়ের ছাপ—শিশুর পা। খুব স্পষ্ট না হলেও বুঝতে অসুবিধা হলো না যে সেটা নগ্ন পায়ের ছাপ।
আমরা সামনের দেয়ালের কাছে যেতেই সেই অদ্ভুত ব্যাপারটা থেমে গেল। আমরা ফিরে আসার সময়ও সেটা আর দেখা গেল না।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিচের তলার ঘরগুলো দেখলাম-খাবার ঘর, পেছন দিকের একটা ছোট ঘর, তার থেকেও ছোট আর একটা ঘর হয়তো কোনো চাকর থাকত—সর্বত্র মৃত্যুর স্তব্ধতা বিরাজ করছে।
তারপর আমরা ড্রইংরুমে ঢুকলাম, চারদিক বেশ ঝকঝকে তকতকে। আমি একটা চেয়ারে বসলাম। এফ টেবিলের ওপর একটা বাতি জ্বালিয়ে দিল, ঘরটাতে বেশ আলো হলো। তাকে দরজা বন্ধ করে দিতে বললাম। সে ঘুরতেই দেখলাম একটা চেয়ার নিঃশব্দে দ্রুত দেয়ালের কাছ থেকে সরে এসে আমার সামনে গজ খানেকের মধ্যে এসে থেমে গেল।
আরে, এ যে দেখছি মন্তর পড়া টেবিল ঘোরানোর থেকেও চমকপ্রদ, মনে মনে ভেবে হাসতে গিয়ে দেখলাম আমার কুকুরটা একটু পিছিয়ে এসে ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে লাগল।
এফ ফিরে এল, সে চেয়ার নড়ার ব্যাপারটা লক্ষ করেনি। সে কুকুরটাকে শান্ত করতে ব্যস্ত হলো। আমি চেয়ারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছি, মনে হলো চেয়ারে বসে আছে বিবর্ণ, নীলচে, ধোঁয়াটে মানুষের মূর্তির এক দেহরেখা। কিন্তু সেটা এতই অস্পষ্ট যে আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। কুকুরটা এখন শান্ত হয়ে বসে রয়েছে।
‘আমার সামনের চেয়ারটা সরিয়ে দেয়ালের কাছে নিয়ে যাও,’ আমি এফকে বললাম। এফ তাই করল। হঠাৎ ঘুরে সে বলল, ‘আপনি কি, স্যার?’
‘আমি—কী?’
‘মনে হলো কেউ আমাকে মারল। কাঁধের ঠিক এইখানে,’ সে হাত দিয়ে জায়গাটা দেখাল।
‘না, তবে এখানে কোনো জাদুকর রয়েছে। যদিও তাদের চালাকি ধরতে পারছি না। আমাদের ভয় দেখাবার আগেই ওদের ধরে ফেলব।’
আমরা আর বেশিক্ষণ ড্রইংরুমে বসে থাকতে পারলাম না, কারণ ঘরটা ভীষণ স্যাঁতসেঁতে আর ঠান্ডা। উপরের ঘরে আগুনের সামনে বসার ইচ্ছা হলো। যাবার সময় ঘরটা তালাবন্ধ করে দিলাম-নিচের সব ঘরই পরীক্ষার পর তালা মেরে দিয়েছি।
ওপরের ঘরটায় ভৃত্যটি আমার শোবার বন্দোবস্ত করেছে, সেইটাই সব থেকে ভালো। ঘরটা বেশ বড়, রাস্তার দিকে দুটো জানালা। চারপেয়ে ছোট বিছানাটা ফায়ারপ্লেসের ঠিক উল্টো দিকে আগুনের তাপ লাগছে। বাঁ দিকে আমার বিছানা ও জানালার মাঝে দেয়ালে একটা মাত্র দরজা। সেই দরজা দিয়ে পাশের ঘরে আমার ভৃত্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে।
ফায়ারপ্লেসের দুধারে দুটো দেয়ালের সঙ্গে সাঁটানো দেয়াল আলমারি। আলমারিতে তালা লাগানো নেই। আমরা সে দুটো পরীক্ষা করে দেখলাম। মেয়েদের জামাকাপড় ঝোলানোর হুক ছাড়া আর কিছুই নেই। দেয়ালে ঘা মেরে দেখলাম সেটা নিরেট।
ঘরগুলো দেখা শেষ করে আগুনের কাছে বসে শরীর গরম করতে লাগলাম। তারপর সিগারেট ধরিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা মনে মনে ভাবতে লাগলাম। তখনো এফ আমার কাছে রয়েছে। সিঁড়ির মুখে দরজাটাও বেশ ভালোভাবেই বন্ধ।
অবাক হয়ে আমার ভৃত্যটি বলতে লাগল, ‘স্যার, যখন আমি এখানে প্রথম আসি তখন অন্য সব ঘরের সঙ্গে এই দরজার তালা খুলে রেখেছিলাম, ভেতর থেকে তা বন্ধ হতে পারে না, কারণ এটা একটা-
তার কথা শেষ হবার আগেই দরজাটা, যেটা আমরা দুজনের কেউই স্পর্শ করিনি, হঠাৎ আপনা থেকেই ধীরে ধীরে খুলে গেল। আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। একই চিন্তা আমাদের দুজনের মনে। কোনো মানুষের চালাকি নয় তো? আমি দৌড়ে সেদিকে গেলাম, আমার পেছনে ভৃত্য। একটা ছোট্ট, খালি আসবাবহীন ঘর। কতগুলো খালি বক্স ও ঝুড়ি ঘরের এক কোণে পড়ে আছে। একটা ছোট জানালা, খড়খড়ি বন্ধ-ফায়ারপ্লেস নেই-আমরা যে দরজা দিয়ে ঢুকেছি সেটা ছাড়া আর কোনো দরজা নেই। মেঝেয় কোনো কার্পেট নেই, অনেক দিনের পুরানো মেঝে, এবড়োখেবড়ো, উঁই ধরা, এখানে-সেখানে জোড়াতালি দেয়া, কাঠের ওপর সাদা দাগ দেখলেই বোঝা যায়, কোনো মানুষ নেই এবং লুকিয়ে থাকার মতো ঘরে কোনো জায়গা নেই।
আমরা দাঁড়িয়ে ঘরের চারদিক দেখছি এমন সময় যে দরজা দিয়ে আমরা ঢুকেছিলাম সেটা আস্তে আস্তে কোনো শব্দ না করেই বন্ধ হয়ে গেল। আমরা বন্দী হয়ে গেলাম।
এই প্রথম সারা শরীরে ভয়ের শিরশিরানি অনুভব করলাম। আমার ভৃত্যটির কিন্তু তেমন কোনো অনুভূতি হলো না।
‘ওরা আমাদেরকে ফাঁদে ফেলতে পারবে না, স্যার। আমি এক লাথি মেরে ওই ঝরঝরে পুরানো দরজাটা ভেঙে ফেলতে পারি।’
‘হাত দিয়ে খোলার চেষ্টা আগে করো।’ যে ভীতি আমাকে পেয়ে বসেছিল তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বললাম, ‘ততক্ষণে আমি জানালার খড়খড়ি খুলে দেখি বাইরে কী আছে।’
জানালার খড়খড়ি খুলে দেখি বাড়ির পেছন দিকের সেই বাগানটা দেখা যায়, যার কথা আগেই বলেছি। জানালার নিচে কোনো আলসে নেই, সোজা দেয়াল নেমে গেছে। জানালা দিয়ে কোনো মানুষের পালাবার উপায় নেই কারণ পা রাখার কোনো জায়গা না থাকায় তাকে একেবারে সোজা পাথরের ওপর গিয়ে পড়তে হবে।
এর মধ্যে এফ দরজাটা খোলার বৃথা চেষ্টা করছে। সে আমার দিকে নীরবে তাকিয়ে দরজা ভাঙার জন্য আমার আদেশের অপেক্ষা করছে। এই রকম এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েও সে যে ভয় না পেয়ে এবং সাহস না হারিয়ে ধীর স্থির রয়েছে তাতে তার প্রশংসা করতেই হয়। আমি তাকে অনুমতি দিলাম। যদিও সে একজন সবল পুরুষ কিন্তু তার সর্বশক্তি নিষ্ফল হলো, তার সজোর পদাঘাতে দরজা এক চুলও নড়ল না।
হাঁফাতে হাঁফাতে সে চেষ্টা বাদ দিল। আমি তখন নিজে চেষ্টা করলাম, তাও কাজ হলো না। আবার আমার দেহ ভয়ে শিরশির করে উঠল। মনে হতে লাগল ঘরের মেঝের ফাটল থেকে অদ্ভুত ও ভয়ংকর এক নিঃশ্বাস সমস্ত ঘর ভরিয়ে তুলছে।
দরজাটা যেন নিজের ইচ্ছেয় ধীরে ধীরে নিঃশব্দে খুলে গেল। আমরা এক ধাক্কায় সিঁড়ির সামনে গিয়ে পড়লাম। দুজনেই একটা বিবর্ণ আলোর আভা দেখলাম—ঠিক মানুষের আকৃতির মতো-কিন্তু আকারহীন-আমাদের আগে আগে সেটা সিঁড়ি দিয়ে ছাদের উপর উঠতে লাগল।
আমি আলোটা অনুসরণ করলাম। ভৃত্যটিও পেছন পেছন আসতে লাগল। আলোটা উপরে উঠে ডানদিকে একটা ছোট্ট চিলেকোঠার ভেতরে ঢুকল, দরজাটা খোলাই রইল। একই সঙ্গে আমিও ভেতরে ঢুকলাম। আলোটা একটা ক্ষুদ্র গোলকে পরিণত হয়ে জ্বলজ্বল করতে লাগল। তারপর সেটা ঘরের কোণে বিছানার ওপর কিছুক্ষণ থেকে কাঁপতে কাঁপতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমরা বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে সেটা পরীক্ষা করলাম-একটা পুরানো খাট, যা সাধারণত চাকর-বাকরেরা ব্যবহার করে। বিছানার কাছেই একটা খোলা ড্রয়ার; বিবর্ণ একটা সিল্কের রুমাল চোখে পড়ল। তাতে একটা সুচ গাঁথা রয়েছে, সেলাই কিছুটা হয়েছে। রুমালটা ধুলোয় ভর্তি, হয়তো এটা সেই বুড়ি পরিচারিকাটির। এ ঘরটা বোধ হয় বুড়িটার শোবার ঘর ছিল। অন্য ড্রয়ারগুলো খুলে দেখার কৌতূহল হচ্ছিল। মেয়েলি কিছু পোশাক আর একটা ফিকে হলদে রং-এর রিবনে দুটো চিঠি বাঁধা। চিঠি দুটো ছাড়া ঘরে লক্ষ করবার মতো আর কিছু চোখে পড়ল না। আলোটাও আর দেখা গেল না। এবার আমরা যখন ঘর থেকে বেরোবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছি ঠিক সেই সময় পরিষ্কার শুনতে পেলাম আমাদের আগে আগে পা ফেলার শব্দ হচ্ছে।
আমরা অন্য চিলেকোঠাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম-সবসুদ্ধ চারটে ঘর। পায়ের শব্দটা সব সময়েই আমাদের আগে আগে চলছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমার হাতে চিঠিগুলো রয়েছে। ঠিক যখন আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাব, স্পষ্ট অনুভব করলাম, আমার হাতের কব্জিটা যেন কেউ ধরেছে এবং মৃদু চাপ দিয়ে আমার হাত থেকে চিঠিগুলো নেবার চেষ্টা করছে। আমি আরো জোরে সেগুলো চেপে ধরে রইলাম। সে চেষ্টা থেমে গেল।
আমরা আবার আমাদের শোবার ঘরে ফিরে এলাম। কুকুরটা আমাদের সঙ্গে যায়নি। সে আগুনের খুব কাছে কাঁপছে। চিঠিগুলো যখন পড়ছিলাম তখন আমার ভৃত্যটি একটা ছোট বাক্স খুলে অস্ত্রগুলো বার করে আমার বিছানার মাথার দিকে একটা টেবিলের ওপর সেগুলো রাখল। তারপর সে কুকুরের কাছে গিয়ে তার গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করতে লাগল কিন্তু মনে হলো সে যেন কিছুই গ্রাহ্য করছে না।
চিঠিগুলো খুবই ছোট। তারিখ থেকে জানা গেল ঠিক ছত্রিশ বছর আগের লেখা। সেগুলো কোনো লোক হয়তো তার কোনো মেয়ে বন্ধুকে লিখেছে নতুবা কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে লিখেছে। তাতে পূর্ব সমুদ্রযাত্রার উল্লেখ থেকে বোঝা যায় যে লেখক একজন নাবিক। বানান ও হাতের লেখায় বোঝা যায় লোকটি অল্পশিক্ষিত। তবে ভাষা বেশ জোরালো। ভাষার আবেগের মধ্যে ভালোবাসার ইঙ্গিত রয়েছে; তবে মাঝে মাঝে কিছু অপরিস্ফুট; দুর্বোধ্য গুপ্ত কথার ইঙ্গিত রয়েছে, যা ভালোবাসার নয়-অপরাধের।
আমাদের দুজনের দুজনকে ভালোবাসা উচিত—এই রকম একটা কথা আমার মনে পড়েছে-যদি সবকিছু ফাঁস হয়ে যায় তবে প্রত্যেকেই আমাদের কী ভীষণ অভিসম্পাত করবে।
আবার রাতে তোমার সঙ্গে আর কাউকে ঘরে থাকতে দিয়ো না-কারণ তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলো।
আর এক জায়গায় : যা ঘটে গেছে তার আর কিছু নেই; আমি তোমাকে বলছি আমাদের বিরুদ্ধে কিছুই নেই যদি না মৃত পুনর্জীবন লাভ করে।
এখানে লাইনের মধ্যে পাকা হাতে লেখা (বোধ হয় মেয়ের)—তারা জানে। চিঠির শেষে পরের তারিখ দেওয়া একই মেয়ের হাতে লেখা-৪ জুন সমুদ্রে হারিয়ে গেল, একই দিনে যেমন—
চিঠিগুলো রেখে আমি চিন্তা করতে লাগলাম।
আমার চিন্তাধারা আমার সমস্ত স্নায়ুকে দুর্বল করে তুলতে পারে সেই ভয়ে মনকে আমি শক্ত করে তুললাম যাতে আসন্ন রাতের যেকোনো অবস্থার সম্মুখীন হতে পারি। আমি উঠে পড়লাম। চিঠিগুলো টেবিলে রেখে আগুনটা একটু খুঁচিয়ে আরো গনগনে করে তুললাম। তারপর আবার মেকলের বই খুললাম।
রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে বই পড়লাম। তারপর বিছানায় শুয়ে আমার চাকরকে বললাম সে তার নিজের ঘরে শুতে যেতে পারে, তবে যেন সজাগ থাকে। তাকে দুটো ঘরের মাঝের দরজাটা খুলে রাখতে বললাম। আমার মাথার কাছে টেবিলের ওপর দুটো বাতি জ্বেলে একা ঘরে রইলাম। অস্ত্রের পাশে আমার হাতঘড়িটা খুলে রেখে আবার মেকলে পড়তে শুরু করলাম। আমার বিপরীত দিকে আগুন জ্বলছে। কুকুরটা তার সামনে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। মিনিট কুড়ি পরেই অনুভব করলাম একটা ভীষণ ঠান্ডা হাওয়া আমার গালের পাশ দিয়ে বয়ে গেল। মনে হলো আমার ডানদিকে যে দরজাটা দিয়ে সিঁড়ির সামনে দালানের সঙ্গে যাতায়াত করা যায় সেটা বোধ হয় খোলা রয়েছে। কিন্তু না, সেটা বন্ধ।
বাঁ দিকে তাকালাম, দেখলাম বাতির শিখা বাতাসের বেগে ভীষণভাবে কাঁপছে। ঠিক সেই মুহূর্তে দেখি টেবিলের ওপর থেকে আমার হাতঘড়িটা সরে যাচ্ছে-আস্তে আস্তে-কোনো হাত দেখা যাচ্ছে না-ঘড়িটা চলে গেল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে এক হাতে রিভলবার অন্য হাতে ছোরাটা নিলাম; ঘড়ির মতো সেগুলোর অবস্থা হোক আমি চাই না।
অস্ত্র হাতে আমি ঘরের চারদিকে চোখ বুলাতে লাগলাম, ঘড়ির কোনো চিহ্ন নেই। বিছানার মাথার দিকে জোরে থেমে থেমে তিনবার স্পষ্ট আওয়াজ শুনলাম, আমার ভৃত্যটি চিৎকার করে বলে উঠল
‘আপনি নাকি, স্যার?’
‘না, তৈরি থাকো।’
ততক্ষণে কুকুরটাও উঠে পড়ে থাবা গেড়ে বসেছে, কান দুটো সামনে পেছনে দ্রুত নাড়ছে। সে এমন অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে যে আমার সমস্ত মনোযোগ তার উপরেই ন্যস্ত হয়ে রয়েছে। আস্তে আস্তে সে উঠে দাঁড়াল, তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে, কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
কুকুরটাকে দেখার মতো মানসিকতা বা সময় আমার ছিল না। আমার চাকর তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে; ভয়ে তার মুখের রেখা এমনভাবে বিকৃত হয়ে আছে যে রাস্তায় তাকে দেখলে আমি চিনতেই পারতাম না। সে আমার পাশ দিয়ে দ্রুতবেগে যেতে যেতে ফিসফিস করে বলল :
‘পালান! পালান! আমার পেছনে আসছে।’
সে দালানে যাবার দরজাটা খুলে সবেগে বেরিয়ে গেল।
আমি তার পেছন পেছন দৌড়ে তাকে থামতে বললাম কিন্তু সে মানা শুনল না। সিঁড়ির রেলিং ধরে দুতিনটে সিঁড়ি লাফিয়ে নামতে লাগল। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে শুনলাম সজোরে খোলা ও বন্ধ হওয়ার আওয়াজ।
আমি এই ভুতুড়ে বাড়িতে এখন একা।
কয়েক মুহূর্ত ভেবে ঠিক করতে পারলাম না যে ভৃত্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করব কিনা। তবে আমার অহংকার ও কৌতূহল এমন কাপুরুষের মতো পালিয়ে যেতে নিষেধ করল। আমার ঘরে আবার ফিরে এসে দরজাটা বন্ধ করে খুব সতর্কভাবে ভেতরের ঘরের দিকে এগোতে লাগলাম। তবে ভীতিকর কিছু ঘটল না।
আমি দেয়ালগুলো আবার পরীক্ষা করে দেখলাম, যদি কোনো গুপ্ত দরজার খোঁজ মেলে। কিন্তু কোনো চিহ্নই দেখতে পেলাম না। এমনকি যে বাদামি কাগজ দিয়ে দেয়াল মোড়া আছে তার মধ্যেও কোনো সেলাই চোখে পড়ল না। তাহলে কী করে সেই বস্তুটি—সে যা-ই হোক না কেন, যা চাকরটাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে, ঘরের মধ্যে ঢুকল?
আমার ঘরে ফিরে এসে মাঝের খোলা দরজাটা বন্ধ করে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত হয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম।
দেখি কুকুরটা দুটো দেয়ালের কোণে এমনভাবে দেয়ালে পিঠ দিয়ে শরীরটা কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে যেন সে দেয়ালের ভেতর ঢুকে যেতে চাইছে। তার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বললাম : বেচারা পশু। ভয়ে একেবারে গুটিয়ে গেছে। দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছে, মুখের দুপাশ দিয়ে লালা ঝরছে, তাকে আদর করতে গেলে নিশ্চয়ই আমাকে কামড়ে দিত। সে যেন আমাকে চিনতেই পারছে না। জন্তুটাকে শান্ত করবার সব চেষ্টাই বৃথা হলো বলে ওকে একা থাকতে দিলাম। আমার অস্ত্রগুলো আগুনের পাশে টেবিলের ওপর রেখে চেয়ারে বসে আবার মেকলে পড়তে শুরু করলাম।
বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য কোনো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে আমি যথেষ্ট পরিচিত বলে এরকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়েও আমার মনটা বেশ শক্ত করে তুললাম অথবা বলা যেতে পারে মনে সাহস আনলাম। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় নানারকম অদ্ভুত ও অচিন্তনীয় ব্যাপার প্রত্যক্ষ করেছি-অদ্ভুত সব ব্যাপার যা বললে একেবারে বিশ্বাসই হবে না বা অতিপ্রাকৃতের পর্যায়ভুক্ত হবে।।
আমার মতে অতিপ্রাকৃত শক্তি এক অসম্ভব জিনিস। অতিপ্রাকৃত বলতে যা বোঝায় সেটা প্রকৃতির নিয়মসংক্রান্ত কিছু, যার সম্বন্ধে আমরা একেবারে অজ্ঞ। সুতরাং আমার সামনে যদি ভূতের আবির্ভাব হয়, সেটা হয়তো অতিপ্রাকৃত কোনো শক্তিই হবে।
আমার বইয়ের পাতা ও আলোর মাঝে যেন কিসের একটা ছায়া, ক্ৰমে পাতাটা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল। মুখ তুলে তাকালাম, যা দেখলাম আমার পক্ষে বর্ণনা করা দুরূহ।
শূন্যে একটা আবছা অন্ধকার মূর্তি, সেটা যে ঠিক মানুষের তা বলা যাবে না তবে কিছুটা সেইরকম আকৃতি, একটা মানুষের ছায়ার মতো। সেই মূর্তিটা এত বিরাট যেন তার মাথাটা কড়িকাঠে গিয়ে ঠেকেছে।
তার দিকে তাকিয়ে আমার শরীরের মধ্যে শীতল শিহরণ খেলছে, সামনে একটা বড় বরফের চাঁই থাকলেও আমি হয়তো এমন কাঁপতাম না। সেদিকে তাকিয়ে লক্ষ করলাম দুটো জ্বলন্ত চোখ আমার দিকে দেখছে। সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তবে অন্ধকারের মধ্যে দুটো ফিকে নীল রঙের রশ্মি মাঝে মাঝে দেখা যেত লাগল।
আমি কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোল না। নিজের মনেই ভাবতে লাগলাম—এটাই কি ভয়? এটা তো ভয় নয়। উঠতে চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। মনে হলো বিশাল কোনো ওজন আমার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে আমাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আমি শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম-ক্রমে ভয়ে কাঠ হয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু ভেতরের আর একটি সত্তা আমাকে যুক্তি দিয়ে বলল ভয় না পেলে আমার কোনো ক্ষতি হবে না। আর একটি সত্তাও একে মানতে চাইল না-এটা একটা মায়া, ভয় নয়।
প্রচণ্ড মানসিক শক্তি প্রয়োগ করে অবশেষে আমার হাতটা টেবিলে রাখা অস্ত্রের দিকে বাড়াতে সক্ষম হলাম। আর তখনই আমার হাত ও কাঁধে হঠাৎ একটা ধাক্কা খেলাম। আমার হাত অসাড় হয়ে পাশে ঝুলে পড়ল। এ অবস্থায় লক্ষ করলাম বাতির শিখাটা ক্রমে কমে আসছে, তবে একেবারে নিভে গেল না। ফায়ারপ্লেসের আগুনও ঠিক একইভাবে কমে আসতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে সারা ঘর অন্ধকারে ডুবে গেল।
অন্ধকার ঘরের মধ্যে বসে সেই আবছা বস্তুর ভয় আমার মন থেকে কিছুতেই তাড়াতে পারলাম না। ক্রমে আমার সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলীতেই ভয়ের প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। প্রকৃতপক্ষে, আতঙ্ক এমন চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল যে হয় আমার সব ইন্দ্রিয়শক্তি হারিয়ে ফেলব না হয় সম্মোহিত হয়ে আমি ফেটে পড়ব।
সত্যি আমি বিস্ফারিত হয়েছিলাম।
আমার গলা দিয়ে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল। মনে পড়ে গেল একসময়, আমি বলেছিলাম-আমি ভয় করি না, আমার আত্মা ভয় পায় না। এবং একই সময় আমার শক্তি ক্রমেই বেড়ে উঠেছিল।
সেই গভীর অন্ধকারেও আমি একটা জানালার দিকে ছুটে গিয়ে জানালার পর্দা ছিঁড়ে ফেললাম, জানালার পাল্লা দুটো হাট করে খুলে দিলাম। আমার তখন একমাত্র চিন্তা—আলো-আলো চাই।
আকাশে চাঁদ উঠেছে। পরিষ্কার শান্ত তার আলো—ওপরে চাঁদের আলো আর নিচে নির্জন রাস্তায় গ্যাস লাইটের আলো। পেছনে ফিরে ঘরের ভেতরটা দেখলাম-ঘরের কিছুটা অংশে হালকা চাঁদের আলো পড়েছে। সেই অন্ধকার বস্তুটা আর নেই। শুধু একটা অস্পষ্ট ছায়া দেখতে পেলাম, মনে হলো সেটা আমার সামনের দেয়ালেরই ছায়া।
তারপর হঠাৎ আমার নজরে এল, টেবিলের তলা থেকে একটা হাত উঠে এসেছে, কব্জি অবধি দেখা যাচ্ছে। মনে হলো আমারই মতো রক্ত মাংসে গড়া একটা বয়ষ্ক লোকের হাত, রোগা কোঁচকানো, ছোট—একজন মহিলার হাত। হাতটা খুব আলতোভাবে টেবিলের ওপর রাখা চিঠি দুটো ধরে আছে। হাত ও চিঠিগুলো—হঠাৎই অদৃশ্য হয়ে গেল! আবার সেই মাপা তিনটে টোকার আওয়াজ শুনতে পেলাম, যা এই অদ্ভুত ঘটনা শুরু হবার আগে শুনতে পেয়েছিলাম।
ধীরে ধীরে শব্দটা মিলিয়ে যেতেই সমস্ত ঘরটা যেন অল্প কাঁপতে লাগল। আর সেই সঙ্গে ঘরের শেষ দিকে মেঝে থেকে বুদবুদের মতো আলোর ফুটকি উঠতে আরম্ভ করল-বিভিন্ন রঙের, সবুজ হলদে, লাল—ওপরে-নিচে, এপাশে-ওপাশে চারদিকে সেই আলোক ফুলকিগুলো ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। দেয়াল থেকে অদৃশ্য একটা চেয়ার এগিয়ে টেবিলের সামনে এসে থেমে গেল। পরক্ষণে সেই চেয়ারে একটা মহিলার অবয়ব ফুটে উঠতে লাগল। সেটা যেন জীবন্ত অথচ মৃত্যুর মতোই ভয়ংকর। মুখটা কোনো যুবতীর, একটা আশ্চর্য শোকাবহ সৌন্দর্য সেই মুখে, গলা ও কাঁধ খালি, বাকি শরীরটা একটা আলগা মেঘের মতো সাদা কাপড়ে ঢাকা। কাঁধের ওপর ছড়ানো চুলগুলো হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছে। তার চোখ দুটো কিন্তু আমার দিকে নেই, দরজার দিকে তার দৃষ্টি-কিছু যেন শুনছে, লক্ষ করছে, কারোর জন্য অপেক্ষা করছে। পেছন দিকের ছায়াটা ক্রমে আরো গাঢ় অন্ধকার হয়ে আসছিল এবং আমার মনে হলো আমি যেন দুটো জ্বলন্ত চোখ দেখছি, দৃষ্টি তার চেয়ারে বসা মূর্তিটার দিকে।
দরজায় আর একটা মূর্তির আবির্ভাব ঘটল-সেই রকম স্পষ্ট, সেই রকম ভয়ংকর-একটা মানুষের, একজন যুবকের মতো, গায়ের পোশাকটা মনে হলো গত শতাব্দীর বা সেই ধরনের। ঠিক যখন পুরুষ মূর্তিটা নারীমূর্তির দিকে এগোচ্ছিল, তখন সেই অন্ধকারের ছায়া সামনের দিকে এগিয়ে এল। মুহূর্তের মধ্যে তিনটি মূর্তিই অন্ধকারে ডুবে গেল।
আলোটা আবার সেই দিকে দেখা যেতেই দেখা গেল দুজনের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে দুজনকেই ধরে রয়েছে। মেয়েটার বুকে রক্তরেখা। লোকটা ভুতুড়ে তরোয়ালের ওপর ঝুঁকে রয়েছে, তার ঘাড় থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে, মাঝের অন্ধকারে মূর্তিটা সেই রক্ত খাচ্ছে। হঠাৎ তারা সকলেই অদৃশ্য হয়ে গেল। আবার বুদবুদের মতো আলোর ফুলকি ঘুরতে ঘুরতে ক্রমশ সেগুলো বড় হতে লাগল।
ফায়ারপ্লেসের ডান দিকের দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল, সেখান থেকে বেরিয়ে এল একজন বয়স্কা মহিলা। তার হাতে তখনো চিঠিগুলো। তার পেছনে পায়ের শব্দ শোনা গেল। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করল। তারপর সে চিঠিগুলো খুলে মনে হলো পড়ছিল। তার কাঁধের ওপর দিয়ে একটা ফ্যাকাশে মুখ দেখা গেল—বহুদিন জলে ডুবে থাকা একজন মানুষের মুখ-বিবর্ণ, ফুলো, ভেজা চুলে জলজ আগাছা জড়ানো। দেখলাম মহিলার পায়ের কাছে একটা ছোট শবের আকৃতি পড়ে রয়েছে, তার পাশে গুটিসুটি মেরে একটা শিশু-দারিদ্র্যপীড়িত দুস্থ শিশু, গাল দুটো শুকনো, চোখে ভয়ংকর প্রতীক। বয়স্কা মহিলাটির মুখের দিকে তাকাতেই দেখলাম তার মুখের কোঁচকানো দাগ উবে গেছে এবং যুবতীর নিটোল মুখ ফিরে এসেছে। কঠিন চোখ, স্থির সেই ছায়ামূর্তি আবার ছুটে এসে সকল মূর্তিকে আগের মতো অন্ধকারে ঢেকে ফেলল। আবার ঘরটা কেঁপে কেঁপে উঠল। আবার তিনবার টোকার শব্দ শোনা গেল, তারপর আবার সবকিছু অন্ধকারের মধ্যে মিশে গেল। অন্ধকার থেকেই সবকিছুর আবির্ভাব, আবার অন্ধকারের মধ্যেই সবকিছু মিশে মিলিয়ে গেল।
অস্পষ্টতা দূর হতেই ছায়াগুলোও চলে গেল। ফায়ারপ্লেসে আগুন গনগনে হয়ে উঠল। বাতির শিখা আবার উজ্জ্বল হলো। সারা ঘরটায় আবার শান্তভাব ফিরে এল। সবকিছুই তখন পরিষ্কারভাবে দেখা যেতে লাগল।
দুটো দরজা তখনো বন্ধ। ভৃত্যের ঘরটা তালা দেয়া। দেয়ালের কোণে কুকুরটা হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখলাম, কুকুরটা মরে গেছে। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে, জিবটা মুখ থেকে বেরিয়ে পড়েছে, চোয়ালের দুপাশে ফেনা। কুকুরটাকে আগুনের কাছে নিয়ে এলাম।
প্রিয় কুকুরটার এরকম মৃত্যুতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। তার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছিল। আমার ধারণা ভয়েই বেচারা মারা গেছে। সব থেকে যেটা আমার কাছে আশ্চর্য লাগল সেটা হচ্ছে, ঘাড়টা তার ভাঙা। যেন কেউ তার ঘাড়টা মটকে দিয়েছে।
আর একটা অদ্ভুত ঘটনা-আমার ঘড়িটা যে রহস্যজনকভাবে উধাও হয়েছিল, আবার সেটা টেবিলে ফিরে এসেছে। তবে ওটা বন্ধ হয়ে আছে। চলছে না।
বাকি রাতটুকুর মধ্যে আর কিছুই ঘটল না। দিনের আলো না ফোটা পর্যন্ত আমি সেই ভুতুড়ে বাড়িতেই ছিলাম। চলে আসবার আগে সেই ছোট্ট ঘরটা আর একবার দেখতে গেলাম। যেখানে আমি ও আমার চাকর কিছুক্ষণের জন্য আটকে যাই।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদিও এই বিশ্বাসের সঠিক কারণ ব্যাখ্যা করতে পারব না, এই ছোট্ট ঘরটা থেকেই ভুতুড়ে কাণ্ডের সবকিছুর উৎপত্তি, যা আমি নিজের চোখে দেখেছি এবং সারা শরীর ও মন দিয়ে অনুভব করেছি।
যদিও দিনের আলোয় আমি এ ঘরে ঢুকেছি, জানালা দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করছে, তবু মেঝেয় দাঁড়িয়ে আমার গা ভয়ে শিরশির করে উঠল কারণ গত রাতে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা এ ঘরেই হয়েছে।
সত্যি বলতে কি আধ মিনিটের বেশি আমি সেই ঘরে থাকতে পারিনি। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে সেই পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। যখন সদর দরজা খুললাম তখন স্পষ্ট একটা চাপা হাসির শব্দ কানে এল। বাড়ি ফিরে আমার পালিয়ে যাওয়া চাকরকে দেখতে পেলাম না। এমনকি তিনদিন তার কোনো খবরও পেলাম না। তিনদিন বাদে লিভারপুল থেকে তার একটা চিঠি পেলাম—
প্ৰিয় মহাশয়,
সবিনয় নিবেদন এই যে, আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আপনি জানেন আমি কীভাবে পালিয়ে এসেছি। আমার শরীর ভালো নেই। কর্মক্ষমতা ফিরে পেতে আমার বেশ কয়েক বছর সময় লাগবে। আমি মেলবোর্নে আমার শ্যালকের কাছে যাচ্ছি। জাহাজ আগামীকাল ছাড়বে।… আমি এখন কোনো কাজ করি না, তবে মাঝে মাঝে হঠাৎ ভয় পেয়ে চমকে উঠি, মনে হয় আমার পেছনে কেউ যেন রয়েছে। আপনার কাছে আমার বিনীত প্রার্থনা মহাশয় যে আমার জামাকাপড় ও পাওনা মাইনে আমার মায়ের নামে ওয়ালওয়ার্নে পাঠিয়ে দিলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।