দ্য সেভেন অভ হার্টস

দ্য সেডেন অভ হার্টস

অনুবাদ: নজরুল ইসলাম

একটা কথা আমাকে প্রায়ই শুনতে হয়: “তোমার সাথে আর্সেন লুপাঁর পরিচয় হলো কীভাবে?”

আমার সাথে আর্সেন লুপাঁর সম্পর্কের কথা সর্বজন স্বীকৃত। রহস্যময় ব্যক্তিটি সম্পর্কে যে বিশদ বিবরণ আমি সংগ্রহ করতে পারি, যে অকাট্য সত্য আমি উপস্থাপন করি, নিত্য নতুন যে প্রমাণাদি আমি সামনে নিয়ে আসি, নির্দিষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে সকল ব্যাখ্যা আমি প্রদান করি-যা কিনা জনগণ কোনো প্রকার গোপন কারণ উদ্ঘাটন ছাড়াই প্রকাশিত হতে দেখে, এগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, তার সাথে যদি আমার দহরম-মহরম নাও থাকে অন্ততপক্ষে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে।

কিন্তু আমার সাথে ওর পরিচয়টা হলো কীভাবে? কেন আমি ওর ইতিহাস রচয়িতা হিসাবে মনোনীত হলাম? কেন আমি? কেন অন্য কেউ নয়?

উত্তরটা খুব সোজা: আমার মেধা নয়, বরং ভাগ্য আমার ইচ্ছের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে। একটা কাকতালীয় ঘটনা আমাকে ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। দৈবযোগে আমি আর্সেন লুপাঁর সবচেয়ে অদ্ভুত এবং রহস্যময় অভিযানের সঙ্গী হয়েছিলাম; এবং দৈবক্রমে আমি ওর পরিচালিত মঞ্চ নাটকে অভিনেতা হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। নাটকটি রোমাঞ্চকর ঘটনায় পরিপূর্ণ। দুর্বোধ্য এবং জটিল। ঘটনাটা বর্ণনা করতেও কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।

ওর সাথে দেখা হওয়ার প্রথম স্মরণীয় ঘটনাটা ঘটেছিল জুনের ২২ তারিখ রাতের বেলা। কথাটা ইতোমধ্যে অনেকবার বলা হয়েছে। আর আমার দিক থেকে, সে ঘটনার পর বাড়ি ফিরে আমি যে অন্যরকম এক খ্যাতি পেয়েছি তার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হয়। সেদিন সন্ধ্যায় আমার কিছু বন্ধু সমেত ক্যাসকেড রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। সিগারেটে টান দিতে দিতে এবং মৃদুলয়ে বিষণ্ন সুরে বাজতে থাকা অর্কেস্টা শুনতে শুনতে, আমরা অপরাধ এবং চৌর্যবৃত্তি, ভয়ানক ভয়ানক সব ষড়যন্ত্র নিয়ে কথা বলছিলাম। রাতের ঘুমের জন্য এই ধরনের কথাবার্তা মোটেই সুখকর কিছু নয়।

জেন ডাসপ্রি সদা হাস্যোজ্জ্বল আর কেমন যেন অমনোযোগী একটা মানুষ। ছয় মাস পরে মরক্কোর সীমান্তে নির্মমভাবে খুন হয়েছিল সে। তো সেই জেন ডাসপ্রি আর আমি অন্ধকার উষ্ণ রাতে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম। বুলেভার্দ ম্যালিয়টে, নিউলির যে বাড়িটায় আমি এক বছর ধরে থাকছিলাম সেটার সমানে পৌঁছাতেই, ও আমাকে বলল-

“তোমার কি ভয় করে না?”

“তোমার কী মনে হয়!”

“না, এই বাড়িটা এত দূরে অবস্থিত, কোনো প্রতিবেশী নেই… এতগুলো খালি লট… সত্যি বলতে, আমি ভীতু নই, কিন্তু তবুও…”

“বুঝলে, বলতেই হচ্ছে, তুমি বেশ বিনোদন দিতে পারো।”

“ওহ! আচ্ছা এই প্রসঙ্গ বাদ দেই। অসাধারণ অপরাধগুলো নিয়ে ওই গল্পগুলো সত্যিই ভালো লেগেছে।”

এর পরে আমরা হাত মিলিয়ে শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিলাম। পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুললাম।

“বাহ, বেশ বেশ।” আমি বিড়বিড় করতে লাগলাম। “আন্তোনি মোমবাতি জ্বালাতে ভুলে গিয়েছে।”

ঠিক তখনই আমার মনে পড়ল যে আন্তোনি আসলে বাসায় নেই। ওকে আগে আগে ছুটি দিয়েছিলাম। গভীর অন্ধকার এবং রাতের নিঃশব্দতা আমাকে ঘিরে ধরল। পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে যত দ্রুত সম্ভব আমার রুমে পৌঁছে গেলাম। তারপরে, সচরাচর যা করি না সেটাই করলাম। রুমের দরজায় চাবি লাগিয়ে হুকড়ো টেনে দিলাম।

মোমবাতির আলোয় আমার হারানো সাহস কিছুটা ফিরে এলো। তবুও খুব সবাধানে খাপ থেকে আমার লম্বা, শক্তিশালি রিভলভারটা বের করে বিছানার পাশে রাখলাম। রিভালভারটা একধরের নিরাপত্তার অনুভূতি দিলো। বিছনায় শুয়ে, সচরাচর যা করি তাই করলাম। পড়তে পড়তে ঘুমাব বলে পাশের টেবিল থেকে একটা বই তুলে নিলাম। বইটা নিয়েই অবাক হয়ে গেলাম। যতটুকু পড়ে গিয়েছিলাম সেখানে কাগজের বুকমার্ক পাওয়ার বদলে, একটা এনভেলাপ পেলাম। খামটা লাল মোমের পাঁচটি সিল দিয়ে আটকানো। দ্রুত সেটা খুললাম। এনভেলাপের লেখাটা আমাকেই সম্বোধন করে লেখা হয়েছে এবং জরুরি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

চিঠি! আমাকে উদ্দেশ্য করে চিঠি! এখানে রাখার মতো কে থাকতে পারে? কাঁপা কাঁপা হাতে, আমি এনভেলাপ খুলে পড়তে শুরু করলাম:

‘যে মুহূর্তে তুমি চিঠিটা খুলবে, যা-ই ঘটুক না কেন, মা-ই শুনে থাকো না কেন, একচুলও নড়বে না, একটুও চিৎকার করবে না। তা না হলে তুমি শেষ।’

আমাকে খুব একটা ভীতু বলা যাবে না। আমি সত্যিকারের বিপদ মোকাবেলা বেশ ভালোই করতে পারি। কিন্তু, আপনাদের বুঝতে হবে, সন্ধ্যার ঘটনার পর মনের দিক থেকে আমি ছিলাম নাজুক। তাছাড়াও, সেটা যদি নাও হতো, আমার বর্তমান পরিস্থিতিতে, সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তিকেও চমকপ্রদ এবং রহস্যময় পরিস্থিতিতে দু’বার চিন্তা ভাবনা করতে হতো।

আমার জ্বরাক্রান্ত আঙ্গুল চিঠির সাথে সেঁটে রইল। আমি বারবার হুমকি দেওয়া কথাগুলো পড়ে যাচ্ছিলাম: ‘একচুলও নড়বে না, একটুও চিৎকার করবে না। তা না হলে তুমি শেষ।’

‘বাকওয়াজ!’ আমি ভাবতে লাগলাম। ‘কোনো উজবুক রসিকতা করছে নিশ্চয়ই।’

আমি প্রায় হেসে দিচ্ছিলাম—উচ্চস্বরে হাসি যাকে বলে। কিন্তু কীসে আমাকে থামাল? কীসের ভয় আমার টুটি চিপে ধরল? অন্ততপক্ষে, আমি মোমবাতিটা ফুঁ দিয়ে নেভাতে পারি। না, আমি সেটা পারব না। ‘একচুলও নড়বে না, একটুও চিৎকার করবে না। তা না হলে তুমি শেষ।’ এই বাক্যটাই সে লিখেছে।

ব্যাপারটাকে বহুকষ্টে মাথা থেকে সরিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।

ঠিক সেই মুহূর্তে, ক্ষীণ একটা আওয়াজ শুনলাম। যে ঘরটাকে আমি লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহার করি, শব্দটা সেখান থেকে আসছিল। আমার শোবার ঘর এবং লাইব্রেরির মাঝে একটি ছোটো ঘর আছে।

এতক্ষণে সত্যিকারের বিপদের গন্ধ আমাকে অনেকটা উত্তেজিত করে তুলল। বিছানা থেকে উঠে রিভলভারটা হাতে নিয়ে লাইব্রেরির দিকে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু আমি উঠলাম না; বাম পাশের জানালার একটা পর্দা সরে যেতে দেখলাম। একটা পর্দা নিজ জায়গা থেকে সরে গিয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর পর্দাটা এখনও ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে এবং তখনই দেখলাম—ওহ! পর্দা এবং জানালার সরু ফাঁক দিয়ে স্পষ্টভাবে মানুষের আকৃতি দেখতে পেলাম। এবং কোনো সন্দেহ নেই, লোকটিও আমাকে দেখতে পেয়েছে। তখনই, আমি পুরো পরিস্থিতিটা আঁচ করতে পারলাম। লোকটির মিশন ছিল আমাকে পাহারা দেওয়া যাতে অন্যরা কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়া লুঠ করতে পারে। আমার কি রিভলভারটা তাক করা উচিত? অসম্ভব! লোকটি জলজ্যান্ত ওখানে উপস্থিত! যত কম নড়াচড়া করা যায়, আমার সর্বনাশ হওয়ার সুযোগ ততই কম।

তারপরে একটা ভয়ানক শব্দে বাড়িটা কেঁপে উঠল। এরপর আরও দু-তিন বার তুলনামূলক ভয়ানক শব্দ শোনা গেল। যেন হ্যামার পেটানো হচ্ছে। অন্ততপক্ষে, আমার বিভ্রান্ত মস্তিষ্ক এরকমটাই ধরে নিল। শব্দগুলো অন্যান্য শব্দের সাথে মিলে যাচ্ছিল, সবকিছু মিলিয়ে বিশাল শোরগোল হচ্ছিল। যা প্রমাণ করে অনুপ্রবেশকারীরা শুধু সাহসী-ই নয়, কেউ তাদের বাঁধা দিবে না এই ব্যাপারে নিশ্চিত।

ওদের ধারণা সত্যিই বলা চলে। আমি একচুলও নড়াচড়া করিনি। এটাকে কি ভীরুতা বলে? না, বরঞ্চ দুর্বলতা বলা যায়। এই চিঠিটা যে পাঠিয়েছে তাকে সাহায্য করার জন্য কমপক্ষে দশ-বারো জন আছে। আমার কি ছোটোখাটো টুকিটাকির জন্য নিজের এই মূল্যবান জীবনটা ঝুঁকিতে ফেলা উচিত?

এভাবে সেই রাত শেষ হলো, সাথে শেষ হলো আমার ওপর চলা ওই অদ্ভুত নির্যাতন। অসহনীয় নির্যাতন, ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা! শব্দ থেমে গিয়েছে, কিন্তু আবার শুরু হবে কিনা এই ভয়ে ভীত ছিলাম আমি। আর লোকটি! আমাকে পাহারা দেওয়া অস্ত্র হাতের লোকটি। আমার ভীত চোখ জোড়া সেদিকে নিবদ্ধ ছিল। আমার বুক ধুকপুক করছিল! সারা শরীর জুড়ে ঘাম ঝড়ছিল।

হঠাৎ বুলেভার্দের পাশ দিয়ে যাওয়া দুধের ওয়াগনের পরিচিত শব্দে, আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। একই সময়ে কল্পনায় দেখতে পেলাম বন্ধ জানালা পেছনের অন্ধকার হটিয়ে আলো জায়গা দখল করে নিচ্ছে।

অবশেষে, দিনের আলো ঘরে প্রবেশ করল। অন্যান্য যানবাহন বুলেভার্দের পাশ দিয়ে যাতায়ত করতে লাগল। রাতের সকল বিভীষিকা থেকে যেন এতক্ষণে মুক্তি পাওয়া গেল। একমাত্র তখনই, ধীরে এবং সাবধানতার সাথে বিছানার নিচ থেকে একটা হাত বের করলাম। আমার চোখ পর্দার ঠিক ওই অংশে সেঁটে রইল, যেখানটায় গুলি ছোঁড়া উচিত। ঠিক কতটুকু নড়াচড়া করা উচিত সেটুকু মেপে নিলাম আমি। তারপরে খুব দ্রুত, আমার রিভলভারটা তুলে নিয়ে গুলি করলাম।

একটা চিৎকার দিয়ে বিছানা থেকে উঠে জানালার দিকে গেলাম। গুলি পর্দা এবং জানালার গ্লাস ভেদ করেছে কিন্তু লোকটিকে ছুঁতে পারেনি। কারণটা হতে পারে তখন আসলে ওখানে কেউ ছিল না। কেউ না! তার মানে সারা রাত ভাঁজ করা পর্দা দিয়ে আমাকে সম্মোহন করে রাখা হয়েছিল। আর সে সময়ে দুর্বৃত্তরা… প্রচণ্ড রেগে, আমাকে কেউ রুখতে পারবে না এমন একটা মনোভাব নিয়ে দরজা চাবি দিয়ে খুললাম। তারপরে পাশের ঘর অতিক্রম করলাম। আরেকটা দরজা খুললাম এবং লাইব্রেরির দিকে ছুটে গেলাম। কিন্তু আমাকে অবাক হয়ে থেমে যেতে হলো। যে সকল জিনিস চুরি হবে বলে আমি চিন্তা করেছিলাম—আসবাবপত্র, বই, ছবি, পুরাতন ট্যাপস্ট্রে সবকিছু-ই জায়গা মতো আছে।

ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ওইসব শোরগোলের কথা বলছি না। টেনে টেনে সবকিছু সরাবার শব্দের কথা বলছি। পুরো জায়গায় একটা চক্কর দিলাম। ঘরের দেয়ালগুলো পরীক্ষা করলাম। পরিচিত সকল বস্তুর হিসাব মনে মনে করতে লাগলাম। কিছুই হারায়নি।

এবং সবচেয়ে অসংলগ্ন বিষয় হচ্ছে, অনুপ্রবেশের কোনো সূত্র নেই, একটা চিহ্নও না। একটা চেয়ারও সরানোর চিহ্ন নেই, একটা পায়ের ছাপও নেই।

“বেশ!! বেশ!!” নিজেকেই নিজে বললাম, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে হাত দুটো মাথায় চেপে ধরে।

“আমি নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যাইনি, অবশ্যই কিছু একটা শব্দ শুনেছিলাম!”

খুব সবাধানে প্রতিটা ইঞ্চি পরীক্ষা করলাম। কিন্তু সবকিছুই বৃথা গেল। যদি না এটাকে আবিষ্কার বলা যায়: একটা পার্সিয়ান কার্পেটের নিচে, একটা কার্ড খুঁজে পেলাম। একটা সাধারণ খেলার কার্ড। একটা সেভেন অভ হার্টস; অন্য সকল ফ্রেঞ্চ খেলার কার্ডের মতোই ছিল সেভেন অভ হার্টসটি (বাংলায় হরতন), প্রায় সবটুকু-ই এক, শুধু অল্প একটু ব্যতিক্রম ছাড়া। ব্যতিক্রমটা হচ্ছে সাতটি লাল স্পটের সবগুলো হার্ট-ই মাঝ দিয়ে ফুটো করা। গোল এবং সাধারণ যেন সুঁইয়ের খোঁচায় তৈরি হয়েছে সেগুলো।

আর কিছুই না। একটা কার্ড এবং বইয়ের ভাঁজে পাওয়া একটা চিঠি। এই চিঠিটাই কি এটা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট না যে আমি কাল রাতে স্বপ্ন দেখিনি?

***

সারাটা দিন আমি লাইব্রেরিতে খোঁজাখুঁজি অব্যাহত রাখলাম। রুমটা বিশাল, এ-রকম একটা বাড়িতে যেরকম ঘর থাকা প্রয়োজন সে তুলনায় অনেক বড়ো। মেঝে হরেক রকমের পাথরের মোজাইক করা। দেয়ালগুলো একই মোজাইক দিয়ে সারিবদ্ধভাবে আবৃত; পম্পেই-এর অনুরূপ নকশা, বাইজেন্টাইলের কৃত্তি, মধ্যযুগের দেওয়াল চিত্র। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ঘন দাড়ির একজন রাজা সোনালী মুকুট পরে আছে, ডান হাতে একটা তলোয়ার।

আরেকটু ওপরে,নানা দেশের চিত্র শিল্পীদের শৈল্পিক প্রদর্শনীর শেষে, একটা বড়ো জানালা আছে। রুমের একমাত্র জানালা। জানালাটা সারা রাত খোলা থাকে। সম্ভবত দুর্বত্তরা মইয়ের সাহায্যে জানালা দিয়েই ঘরে ঢুকেছে। কিন্তু আবারও, ঘরে ঢোকার কোনো প্রমাণ নেই। মইয়ের একদম নিচে জানালা বরাবর নরম মাটিতে ছাপ থাকার কথা। কিন্তু আঙ্গিনার কোথাও একটাও পায়ের ছাপ নেই।

পুলিশকে জানানোর কোনো ইচ্ছে-ই নেই, কারণ সবকিছু দেখে শুনে আমার নিজের কাছেই কিছুটা হাস্যকর এবং অনেকটা দুর্বোধ্য লাগছে। ওরা আমার কথা শুনে হাসবে। যাহোক, সেই সময়ে আমি যেহেতু “গিল ব্লাস’ পত্রিকার প্রতিবেদক ছিলাম, তাই পরের দিনের পত্রিকায় আমার অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ বড়োসড়ো একটা প্রতিবেদন ছাপা হলো। প্রতিবেদনটা কিছুটা মনোযোগ আকৃষ্ট করতে সমর্থ হলেও, কেউ ব্যাপারটাকে মোটেও গুরুত্ব দেয়নি। সবাই ব্যাপারটাতে উত্তেজিত মস্তিষ্কেও অতি উত্তেজনার ফলাফল হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। একমাত্র ডাসপ্রি ব্যাপারটাকে খুব গুরুত্ব সহকারে নিয়ে, আমার সাথে দেখা করতে এলো। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে অনেক আলোচনা, গবেষণা করল কিন্তু কোনো উপসংহারে পৌঁছতে পারল না।

বেশ কিছুদিন পরের কথা। একদিন সকালে আমার ডোর বেল বেজে উঠল। আন্তোনি এসে জানালো একজন ভদ্রলোক আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। লোকটি নিজের নাম বলেনি।

আন্তোনিকে বললাম লোকটিকে নিয়ে আসার জন্য। লোকটির বয়স চল্লিশের মতো হবে। গায়ের রং কালো। বেশ চটপটে, রুচিসম্মত কিন্তু কিছুটা মলিন হয়ে যাওয়া পোশাকটা তার অভদ্র আচরণের সম্পূর্ণ বিপরীত। কোনো প্রকার ভূমিকা ছাড়া, সে যখন বেশ রুক্ষ গলায় আমাকে প্রশ্ন করল, ঠিক তখনই লোকটির সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে আমি ধারণা পেয়ে গেলাম:

“মঁসিয়ে, একটা ক্যাফেতে আমি ‘গিল ব্লাস’-এর এক কপি পেয়ে আপনার প্রতিবেদন পড়েছি। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ কৌতূহল উদ্দীপক মনে হয়েছে।”

“ধন্যবাদ।”

“আর দেখুন, আমি এখানে উপস্থিত হয়ে গিয়েছি।”

“আচ্ছা!”

“হ্যাঁ, আপনার সাথে কথা বলার জন্য। পুরো ব্যাপারটাই আপনার সাথে সত্যি সত্যিই ঘটেছে, তাই না?”

“হ্যাঁ। একদম।”

“আচ্ছা। সেক্ষেত্রে, আমি আপনাকে কিছুটা তথ্য দিতে পারি।”

“খুব ভালো; বলে যান।”

“না। এখনই না। প্রথমে, আমাকে নিশ্চিত হতে হবে ঘটনাটা আপনি যেভাবে বলেছেন সেভাবে ঘটেছে।”

“হ্যাঁ আমি যেভাবে বলেছি সেভাবেই ঘটেছে। আমি নিজেই প্রমাণ। এর চেয়ে বড় প্রমাণ আপনি আর কী চান?”

“আমি এই ঘরটাতে একটু একা থাকতে চাই।“

“বুঝতে পারলাম না।” আমি বললাম, বেশ অবাক হয়ে।

“আপনার প্রতিবেদনটি পড়ার সময় ধারণাটা আমার মাথায় এসেছে। আমার নজরে এসেছে, নির্দিষ্ট কিছু বর্ণনা অন্য একটা কেসের সাথে হুবুহু মিলে যায়। তবে আমার যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে এই ব্যাপারে আমার আর কিছু- ই বলা উচিত হবে না। আর সত্যিটা জানার জন্য আমাকে এই ঘরে একা থাকতে হবে।”

লোকটার এই প্রস্তাবের পেছনে কি সন্দেহজনক কোনো ব্যাপার থাকতে পারে? প্রস্তাবে অবাক হলেও লোকটাকে বিশ্বাস করা যায় বলেই মনে হলো। তার ওপরে, আমার মধ্যেও বেশ কৌতূহল জেগে উঠেছিল। একটু থেমে তাই জবাব দিলাম:

“ঠিক আছে। কতক্ষণ সময় লাগবে আপনার?”

“ওহ! মাত্র মিনিট তিনেক… এর বেশি না। এখন থেকে তিন মিনিট পরে আমি আপনার সাথে বাইরে যোগ দিব।”

ঘর ছেড়ে নিচে নামলাম আমি। আমার ঘড়িটা হাতে নিলাম। এক মিনিট অতিবাহিত হলো। দুই মিনিট। আমার কেন হতাশ লাগছে? কেন মুহূর্তগুলো নিঃসঙ্গ এবং অদ্ভুত লাগছে? দুই মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড… দুই মিনিট পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড। তারপরে হঠাৎ পিস্তলের আওয়াজ শুনলাম।

দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উঠে রুমে ঢুকলাম। ভয়ের ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল আমার শরীর দিয়ে। ঘরের মধ্যেখানে, লোকটি বাম কাত হয়ে শুয়ে আছে, একদম নিশ্চল। লোকটির কপালের আঘাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। হাতের একদম কাছেই একটা রিভলভার থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে।

কিন্তু ভয়ের কথা হলো, অন্য একটা বস্তুর দিকে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। পড়ে থাকা লোকটির দুই ফিট সামনের মেঝেতে, আমি একটা কার্ড পড়ে থাকতে দেখলাম। ওটা ছিল একটা সেভেন অভ হার্টস। কার্ডটা তুললাম। সাতটি হার্টের প্রতিটির একদম নিচের দিকে ছোটো ফুটো করা।

***

আধা ঘণ্টা পরে পুলিশ কমিশনার এলো। এরপরে এলো করোনার এবং সিভিল পুলিশ ফোর্সের চিফ মঁসিয়ে দুদো। লাশটা ছুঁয়ে দেখার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করেছিলাম। প্রাথমিক তদন্ত ছিল খুব সংক্ষিপ্ত এবং জানানোর মতো তেমন কিছুই ছিল না। মৃত ব্যক্তির পকেটে কোনো কাগজ ছিল না; কিংবা লোকটির জামা কাপড়ের কোথাও নাম লেখা ছিল না; তার পরিচয় বের করা যায় এমন কোন কিছুই পাওয়া যায়নি। ঘরটা আগে যেমন ছিল খুনের পরেও সার্বিক অবস্থা হুবুহু একই। আসবাবপত্র কোনোটা একচুলও নড়েনি। আর লোকটি আমার বাসায় নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করার জন্য আসেনি, অথবা আমার বাসা আত্মহত্যা করার জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গা এমনটা ভেবেও আসেনি! আবার লোকটির আত্মহত্যা করার অবশ্যই কোনো কারণ ছিল। আর সেই কারণটা নিশ্চিতভাবে-ই যে তিন মিনিট লোকটি একা ছিল সেই সময়ে তার চোখে ধরা পড়েছে।

ঘটনাটা কী ছিল? লোকটি কী দেখেছিল? কোনো ভয়ঙ্কর গুপ্ত রহস্য তার কাছে উন্মোচিত হয়েছিল? প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর নেই। কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে এমন একটা ঘটনা ঘটল যা আমাদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলো। দু’জন পুলিশের লোক যখন লাশটা স্ট্রেচারে তোলার জন্য উঠাচ্ছিল, বাম হাতটা সরে গেল। আর তা থেকে একটা কুঁচকে যাওয়া কার্ড পড়ল। কার্ডটায় লেখা ছিল: ‘জর্জ অ্যান্ডারম্যাট, ৩৭ রু ডি বেরি।’

এর মানে কী? জর্জ অ্যান্ডারম্যাট হচ্ছে প্যারিসের সবচেয়ে ধনী ব্যাংকারদের একজন, মেটাল এক্সচেঞ্জ-এর ফাউন্ডার এবং প্রেসিডেন্ট। এই অ্যান্ডারম্যাট লোকটা রীতিমত রাজপুত্রের মতো চলাফেরা করেন। বহু মোটরগাড়ি, কোচ এবং দামি রেসিং স্ট্যাবলের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। উনি খুব বাছা বাছা লোকজনের সাথে মেলামেশা করেন। এবং মাদাম অ্যান্ডারম্যাট তার বদান্যতা এবং সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত।

“লোকটি কি উনি-ই না কি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সিভিল পুলিশ ফোর্সের চিফ লাশটার ওপর ঝুঁকে এলেন।

“না। তিনি নন। মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাটের গড়ন সরু এবং গায়ের রং কিছুটা ধূসর।”

“কিন্তু এই কার্ডের ব্যাপারটা কী?”

“আপনার কি টেলিফোন আছে না কি, মঁসিয়ে?”

“হ্যাঁ, টেরেসে। আমার সাথে আসুন।”

সে ডিরেক্টরিতে চোখ বুলিয়ে ৪১৫.২১-তে সংযোগ দিতে বলল।

“মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট কি বাসায় আছে?… দয়া করে ওনাকে বলবেন যে মঁসিয়ে দুদো চাচ্ছেন উনি যেন ১০২ বুলেভার্দ ম্যালিয়টে চলে আর্সেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

বিশ মিনিট পরে,মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট ওনার গাড়িতে চড়ে এসে পৌঁছলেন। পুরো বিষয়টা ওনাকে ব্যাখ্যা করার পরে, লাশ দেখাতে নিয়ে যাওয়া হলো ওনাকে। লাশটা দেখে উনি আবেগে আপ্লুত হয়ে অনিচ্ছা স্বত্বেও আস্তে করে বলল, “এচিয়েন্না ভারিন।”

“আপনি ওনাকে চিনেন?”

“না… অথবা নিদান পক্ষে কিঞ্চিৎ হ্যাঁ বলা যায়। ওর ভাই…”

“আহ! ওনার ভাই আছে না কি?”

“হ্যাঁ, আলফ্রেড ভারিন ওর নাম। কোনো একটা ব্যাবসায়িক কাজে ওর ভাই আমার কাছে এসেছিল। কী কাজে এসেছিল সেটা মনে নেই।”

“উনি কোথায় থাকেন?”

“দুই ভাই এক সাথেই থাকে… যতদূর মনে পড়ছে রু ডি প্রভিন্সে।”

“আত্নহত্যার কোনো কারণ জানেন না কি আপনি?”

“নাহ।”

“ওনার হাতে একটা কার্ড পাওয়া গিয়েছে। তাতে আপনার নাম এবং ঠিকানা দেওয়া ছিল।”

“বিষয়টা আমার মাথায় ঢুকছে না। কী কারণে ওটা লাশের কাছে পাওয়া গিয়েছে আশা করি তদন্তে বের হয়ে আসবে।”

সম্ভাবনা খুবই কম, আমি মনে মনে ভাবলাম। আমার ধারণা, ঘটনাস্থলে উপস্থিত অন্যান্যরাও একই চিন্তা করছে।

পরের দিন পত্রিকাগুলোর খবরে আমি একই জিনিস খেয়াল করলাম, এবং আমি যে সকল বন্ধুবান্ধবের সাথে এ-নিয়ে আলোচনা করলাম তারাও একই মত প্রকাশ করল। সেভেন অভ হার্টের সাতটা হার্টে ফুটো পাওয়ার ঘটনা দু’বার ঘটনার ফলে এবং আমার বাসায় দুইটি অবর্ণনীয় ঘটনা ঘটার পরে রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছিল। ভিজিটিং কার্ড খুঁজে পাওয়াটা আশার আলো হয়ে এসেছে আমাদের জন্য। এর মাধ্যমে হয়তো-বা সত্য উদ্ঘাটিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের আশার আলোতে ফুঁ দিয়ে মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না। উনি বললেন:

“আমি যা জানি সবই আপনাদের বলেছি। আর কী করতে পারি আমি? এ- রকম একটা জায়গায় আমার কার্ড পাওয়া গেছে দেখে আমি খুবই বিস্মিত হয়েছি। আশা করছি খুব শীঘ্রই সবকিছু খোলাসা হবে।”

কিছুই খোলাসা হলো না। অফিশিয়াল তদন্তে বেরিয়ে আসলো যে, ভারিন ভাইদের আদিভূমি হচ্ছে সুইজারল্যান্ড। সময়ে সময়ে নিজেদের নাম পরিচয় বদলাতে হয়েছে, নিয়মিত জুয়ার আসরে যেত, ব্যাংক ডাকাতির সাথে জড়িত একদল বিদেশির সাথে তারা জড়িত ছিল, যাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় ওরা বিমানে ওঠার পরে। রু ডি প্রভিন্সের ২৪ নাম্বার যে বাড়িটাতে ভারিন ভাইদ্বয় থাকত সেটা ছেড়েছে তারা আরও ছয় বছর আগে। এখন তারা কোথায় থাকে কেউ জানে না।

আমি স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি ভেবেছিলাম, কেসটা এতটাই জটিল এবং রহস্যময় ছিল যে কোনোদিন এটা সলভ হবে না। তাই আমি এর পেছনে সময় নষ্ট করা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

কিন্তু জেন ডাসপ্রি, যার সাথে ওই সময় আমার নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ হতো, ও দিনকে দিন এই রহস্যময় ঘটনাগুলো নিয়ে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠতে শুরু করল। ডাসপ্রি-ই আমাকে একটা বিদেশি পত্রিকার সংবাদ দেখালো। সংবাদটা ছিল এ-রকম :

‘নতুন মডেলের সাবমেরিন জাহাজটা যা কিনা নৌযুদ্ধে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা যাচ্ছে, সেটা প্রাক্তন সম্রাটের উপস্থিতিতে গোপন একটা স্থানে প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করা হবে। হঠকারী কেউ একজন সাবমেরিনটার নাম প্রকাশ করে দিয়েছে। সাবমেরিনটার নাম দিয়ে দিয়েছে দ্য সেভেন অভ হাটর্স।’

দ্য সেভেন অভ হার্টস! নতুন খটকার উদয় হলো। আমার বাসায় ঘটা ঘটনা এবং সাবমেরিনের কি কোন প্রকার সংযোগ থাকতে পারে? কিন্তু সংযোগটা কীসের? এখানে যা ঘটেছে সেটার সাথে সাবমেরিনের কোনো সংযোগ থাকতে পারে না।

“এই ব্যাপারে তোমার মতামত কী?” ডাসপ্রি আমাকে বলল।

“সম্পূর্ণ কাকতালীয় ঘটনা।” উত্তর দিলাম।

দুই দিন পরে, একটা পত্রিকাটায় নিচের লেখাটা প্রকাশিত হলো:

‘বলা হচ্ছে যে ‘সেভেন অভ হার্টস’ নামের নতুন সাবমেরিনটার পরিকল্পনা মূলত করেছিল ফ্রেঞ্চ ইঞ্জিনিয়ারা। দেশপ্রেমিক এই ইঞ্জিনিয়াররা মূলত চেয়েছিল, তাদের তৈরি সাবমেরিন দেশের কাজে লাগুক। কিন্তু খোদ ফ্রান্সের একটা গোষ্ঠীর অসহযোগিতায় তা সম্ভব হয়নি। সাবমেরিনটি নিয়ে এরপরে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সাথেও দর কষাকষি হয়েছিল। কিন্তু কোনো ফল আসেনি।’

এরকম একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মুখরোচক গল্প করার কোনো মানসিকতা আমার নেই। আর এ নিয়ে আগেও আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। তবে এখন যেহেতু ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে আর কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই ‘একো দ্য ফ্রান্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত আর্টিকেলটি সম্পর্কে একটু ধারণা দিতে কোনো সমস্যা দেখছি না। আর্টিকেলটি ‘সেভেন অভ হার্টস’ রহস্যের ব্যাপারে বেশ ভালোই ধারণা দিয়েছিল। নিচে আর্টিকেলে যা লেখা হল সেটা এ-রকম:

‘দ্য সেভেন অভ হার্টস বিষয়ে।
পর্দা উন্মোচিত হলো।‘

দশ বছর আগে, একজন তরুন মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার, লুইস লাকোম্বে, একটি নিদিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য, চাকরি ছেড়ে দিলো। এবং প্রচণ্ড মনোযোগে তার আগ্রহের বিষয়টা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করল। সে ১০২ বুলেভার্দে ম্যালিয়টের একটা ছোটো কামরা ভাড়া নিল এবং সেখানের নিজের পড়াশোনা আর গবেষণা চালিয়ে গেল। ভারিন ভাইদ্বয়ের এজেন্সির মাধ্যমে সেই তরুণ ইঞ্জিনিয়ার পরিচিত হলো মেটাল এক্সচেঞ্জের ফাউন্ডার জর্জ অ্যান্ডারম্যাটের সাথে।

বেশ কয়েক বার দেখা-সাক্ষাতের পরে সেই তরুণ ইঞ্জিনিয়ার সাবমেরিন জাহাজটার ব্যাপারে জর্জ আন্ডারউডকে আগ্রহী করে তুলতে পেরেছিল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আন্ডারম্যাটের সাথে তার চুক্তি হলো সাবমেরিনের কাজ শেষ হওয়ার পর মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট নৌমন্ত্রণালয়ে ওনার প্রভাব খাঁটিয়ে সরকারের অধীনে বেশ কয়েকটা ট্রায়ালের ব্যবস্থা করে দিবেন। পরবর্তী দুই বছর ধরে, অ্যান্ডারম্যাটের বাড়িতে নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল লুইস লাকোম্বের আর আন্ডারম্যাটের কাছে তার বানানো সাবমেরিনের প্রটোটাইপের নানান ভার্সনও জমা দিয়েছিল। একসময় ফাইনাল ডিজাইনটা রেডি হয়ে গেল। অ্যান্ডারম্যাটকে নৌমন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করল লাকোম্বে।

নিখোঁজ হওয়ার দিন লুইস লাকোম্বে মসিয়ে অ্যান্ডারম্যাটের বাসায় ডিনার করে। সেখান থেকে সাড়ে এগারোটার দিকে বের হয় সে। এরপরে আর কখনোই তাকে দেখা যায়নি।

ওই সময়ের পত্রিকা ঘাঁটলে দেখা যাবে লাকোম্বের পরিবার সম্ভাব্য সকল উপায়েই তাকে খোঁজের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সবাই ধরে নিল, লুইস লাকোম্বে নামক স্বপ্নদ্রষ্টা যুবক—অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে।

আপাতত অকল্পনীয় এই গুজবকে মেনে নিলাম। এবার আরেকটা প্রশ্ন বিবেচনা করা যাক, প্রশ্নটা আমাদের দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, লাকোম্বের সেই সাবমেরিনের নকশার কী হলো? নিখোঁজ হওয়ার আগে কি লুইস লাকোম্বে সেটা নিজের সাথে নিয়ে গেছে?

বিশদভাবে অনুসন্ধান করার পরে, আমরা প্রমাণ পেয়েছি, এখনও নকাশাটার অস্তিত্ব আছে এবং বর্তমানে সেটা ভারিন ভাইদ্বয়ের দখলে আছে। জিনিসটা ওদের দখলে কীভাবে গেল? এই প্রশ্নের উত্তর এখন পাওয়া যাচ্ছে না। সাথে সাথে এটাও বোঝা যাচ্ছে না যে, কেন তারা নকশাটা বিক্রি করার চেষ্টা করেনি।

তারা কি ভয় পেয়েছিল তাদের নামে বিক্রি করলে কেউ প্রশ্ন তুলবে? যদি তাই হয়, তাহলে তারা সে ভয় কাটিয়ে উঠেছে, আর আমরা এখন নিশ্চিতভাবে-ই বলতে পারি যে, লুইস লাকোম্বের নকশাটা এখন বিদেশি একটা পরাশক্তির হস্তগত হয়েছে। আর ভারিন ভাইয় এবং সেই পরাশক্তির প্রতিনিধিদের মধ্যে বিনিময় হওয়া চিঠিপত্র আমরা প্রকাশ করতে চলেছি। লুইস লাকোম্বের ডিজাইন কাজে লাগিয়ে সেভেন অভ হার্টস তৈরি করে ফেলেছে আমাদের-ই এক প্রতিবেশি।

এখন প্রশ্ন হলো, হাতছাড়া হয়ে যাওয়া বা হাতছাড়া হতে দেওয়া সাবমেরিনটা আমাদের স্বদেশি বিশ্বাসঘাতকদের কূটচালকে কতটা সফলতা এনে দেবে।’

এবং প্রতিবেদনের শেষে একটা ফুটনোট যোগ করা:

‘পরে—আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি জানিয়েছে যে সেভেন অভ হার্টস-এর প্রাথমিক ট্রায়াল আশানুরূপ হয়নি। মনে হচ্ছে যে ভারিন ভাইচুয় যে নকশা বিক্রি করেছিল সেটা লুইস লাকোম্বের পূর্ণাঙ্গ নকশা ছিল না। নিখোঁজ হওয়ার রাতে মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাটকে যে ফাইনাল ডিজাইনটা দেখিয়েছিলেন সেটা সম্ভবত ভিন্ন ছিল। পুরো ডিজাইনটাকে ভালোভাবে কাজ করানোর জন্য যে ডকুমেন্ট প্রয়োজন ছিল তা সম্ভবত প্রতিবেশি রাষ্ট্রের হাতে পড়েনি। ফাইনাল ডিজাইনে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য ছিল, যা অন্য কাগজপত্রে ছিল না। সম্ভবত ওটা ছাড়া বাকি সব কাগজপত্র অসম্পূর্ণ।

এখনই সময়, যা আমাদের তা উদ্ধার করে নিয়ে আসা। এটা হয়তো-বা অনেক কঠিন হতে পারে, কিন্তু আমরা মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাটের ওপর বিশ্বাস রাখতে চাই। এ-যাবৎকাল পর্যন্ত অদ্ভুত এবং অবর্ণনীয় যা যা করেছেন এখন সেগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় এসেছে। তাকে শুধু এচিয়েন্না ভারিনের আত্মহত্যার সময় কেন তিনি জেনেও সব কথা গোপন করেছেন সেটার ব্যাখ্যা দিলেই হবে না, সবকিছু খুব ভালোভাবে জানা স্বত্ত্বেও কেন তিনি কাগজপত্রগুলোর হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করেনি সেটারও ব্যাথা দিতে হবে। ওনাকে বলতে হবে, কেন তিনি গত ছয় বছর ধরে ভারিন ভাইদ্বয়ের চলাফেরার ওপর নজর রাখার জন্য গুপ্তচরদের টাকা দিয়ে এসেছেন। আমরা এখন আর ওনার কাছে শুধু মুখের বুলি শুনতে চাই না। এবং মত দ্রুত সম্ভব। নাহলে…’

হুঁশিয়ারিটা সহজভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, কিন্তু এতে কতটুকু সত্য আছে? সালভাদর ছদ্মনামের একজন লেখক আর্টিকেলটি লিখেছেন। মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাটের ওপর কি লেখকের কোনো ক্ষোভ আছে?

এরপর সাংবাদিকরাও যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল মঁসিয়ে আন্ডারম্যাটের ওপর। এবং তিনি দশ জন ইন্টারভিউয়ার ওনার দ্বারা অশোভন আচরণের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘একো দ্য ফ্রান্স’ ঘোষণা করল:

‘ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক, আমরা যে কাজটা হাতে নিয়েছি, এখন থেকে মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট আমাদের সাথে সহযোগী হিসেবে কাজ করবেন।’

***

যখন ঘোষণাটা প্রকাশিত হয় তখন ডাসপ্রি এবং আমি একত্রে খেতে বসেছিলাম। সেদিন সন্ধ্যায়, আমার টেবিলে পত্রিকাটা ছড়িয়ে রেখে, প্রত্যেকটা সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা করছিলাম। বিষয়টা অন্ধকার কানাগলিতে হোঁচট খাওয়ার মতো।

হঠাৎ, কোনোরকম আগাম সতর্কতা না দিয়েই, দরজা খুলে একজন মহিলা প্রবেশ করল। মহিলার চেহারা পাতলা নেকাবের আড়ালে ঢাকা ছিল। আমি উঠে ওনার দিকে এগিয়ে গেলাম।

“এই বাড়ির বাসিন্দা কি আপনি, মঁসিয়ে?” সে জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ, মাদাম। কিন্তু বুঝলাম না…”

“গেট লক করা ছিল না।” মহিলা ব্যাখ্যা করল।

“কিন্তু সদর দরজা?”

মহিলা উত্তর দিলো না। তবে আমি বুঝতে পারলাম উনি চাকরদের প্রবেশ পথ ব্যবহার করেছেন। পথের হদিস উনি জানলেন কী করে? নীরবতা ঘরের মধ্যে অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ তৈরি করল। ডাসপ্রির দিকে তাকালেন মহিলা। ওকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। তারপরে মহিলাকে বসতে বলে এখানে আসার কারণ জানতে চাইলাম। মহিলা নেকাব সরাল। মহিলা দেখতে ঠিক সুন্দরী বলা যায় না, কিন্তু আকর্ষণীয়। বিশেষ করে তার চোখ দুটো।

“আমি মাদাম অ্যান্ডারম্যাট,” মহিলা নিজের পরিচয় দিলো।

“মাদাম অ্যান্ডারম্যাট?” আমি হতবুদ্ধি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শান্ত স্বরে তিনি বলতে শুরু করলেন:

“আমি ওই বিষয়টা নিয়ে আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি। আমার মনে হয় আমার কাছে কিছু তথ্য আছে…”

“হায় খোদা, মাদাম। পত্রিকায় যা ছাপা হয়েছে এর চেয়ে বেশি কিছু আমি জানি না। কিন্তু আপনি যদি আমাদের আশার আলো দেখাতে পারেন তাহলে…”

“আমি জানি না… আমি সত্যি জানি না…”

তখনই আমি বুঝতে পারলাম, তার এই শান্ত সমীহ ভাবের অন্তরালে লুকিয়ে আছে তীব্র দুঃখ। কিছুক্ষণের জন্য,আমরা নীরব হয়ে গেলাম। তখন ডাসপ্রি আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসে বলল,

“যদি অনুমতি দেন তো আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করি?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ” মহিলা প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল। “আমি যতটা পারি উত্তর দিতে চেষ্টা করব।”

“যে-কোনো ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিবেন তো আপনি?”

“হ্যাঁ।”

“আপনি কি লুইস লাকোম্বেকে চিনতেন?” ও প্রশ্ন করল।

“হ্যাঁ। আমার স্বামীর মাধ্যমে।”

“ওনাকে শেষ কবে দেখেছিলেন আপনি?”

“যেদিন আমাদের সাথে ডিনার করেছিল সেদিন।”

“সেদিন কি আপনি এমন কোনো আভাস পেয়েছিলেন, যাত মনে হয় ওনার সাথে আপনার আর কোনোদিন দেখা হবে না?”

“না। কিন্তু উনি রাশিয়ার একটা ট্রিপের কথা বলেছিলেন অস্পষ্টভাবে।”

“তারমানে ওনার সাথে আবারও দেখা হওয়ার আশা করেছিলেন?”

“হ্যাঁ, দুদিন পরে ওনার সাথে আমাদের ডিনার করার কথা ছিল।”

“ওনার নিখোঁজ হয়ে যাওয়াটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?”

“আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না।”

“আর মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট?”

“আমি জানি না।”

“একো দ্য ফ্রান্স-এ প্রকাশিত আর্টিকেলটি ইঙ্গিত করে…”

“হ্যাঁ, ভারিন ভাইদের হাত থাকতে পারে নিখোঁজের সাথে।”

“এটা কি আপনার মতামত?”

“হ্যাঁ।”

“কীসের ভিত্তিতে?”

“লুইস লাকোম্বে যখন আমাদের বাসা থেকে বের হয়, তখন তার সাথে একটা ঝোলা ছিল। যাতে তার আবিষ্কার সম্পর্কিত সকল কাগজপত্র ছিল I দুদিন পরে, আমার স্বামীর সাথে ভারিন ভাইদের কথোপকথনে জানতে পারি সেই কাগজ তখন ওদের দখলে ছিল।”

“তিনি ওদের কিছু বলেননি?”

“না।”

“কেন?”

“কারণ সে ঝোলাতে লুইস লাকোম্বের কাগজ ছাড়াও আরও একটা জিনিস ছিল।”

“সেটা কী?”

কথাটা বলতে গিয়ে মহিলা কিছুটা দ্বিধা করল, তারপরে চুপ হয়ে গেল। ডাসপ্রি বলে যেতে লাগল :

“আমি ধরে নিচ্ছি আপনার স্বামী এই কারণেই পুলিশকে জানানোর পরিবর্তে ওদের গতবিধির উপর নজরদারি রেখেছিলেন। উনি আশা করেছিলেন সুযোগ বুঝে কাগজপত্রগুলো এবং একইসাথে সেই রহস্য ফাঁস করে দেওয়ার

মতো আর্টিকেলটাও উদ্ধার করবেন। সন্দেহজনক আর্টিকেলটি প্রকাশ করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ভারিন ভাইয়েরা ওনাকে ব্ল্যাকমেইলের ভয় দেখাচ্ছিল।”

“ওকে এবং আমাকেও।”

“ওহ! আপনাকেও?”

মহিলা শেষ কথাটি শূন্য কণ্ঠে বলল। ডাসপ্রি বিষয়টা খেয়াল করল। ও কিছুক্ষণ পায়চারি করল।

তারপরে, ওনার দিকে ফিরে বলল:

“আপনি কি লুইস লাকোম্বেকে চিঠি লিখেছিলেন?”

“অবশ্যই, আমার স্বামীর সাথে ব্যাবসা ছিল ওনার …”

“ব্যাবসায়িক চিঠি বাদে, আপনি কি উনাকে অন্য কোনো চিঠি লিখেছিলেন? আপনাকে জোরাজুরি করছি বলে ক্ষমা করবেন, কিন্তু সত্যিটা জানা আমার জন্য খুবই জরুরি। আপনি কি অন্য কোনো চিঠি লিখেছিলেন?”

“হ্যাঁ,” লজ্জায় লাল হয়ে তিনি উত্তর দিলেন।

“আর সে চিঠিগুলো ভারিন ভাইদের দখলে চলে গিয়েছিল?”

“হ্যাঁ।”

“মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট কি বিষয়টা জানত?”

“ও চিঠিগুলো দেখেনি, কিন্তু আলফ্রেড ভারিন ওকে সেগুলোর কথা বলেছিল আর যদি আমার স্বামী ওদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় তাহলে প্রকাশ করার হুমকি দিয়েছিল। আমার স্বামী মানহানির ভয় পেয়েছিল।”

“কিন্তু তিনি চিঠিগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন?”

“আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু সত্যিটা আমি জানি না। আলফ্রেড ভারিনের সাথে ওর কথোপকথনের পরে, ওর সাথে আমার বাবিতণ্ডা হয়েছিল। এরপর থেকে আমরা প্রায় অপরিচিতের মতো বসবাস করছি।”

“সেক্ষেত্রে তো আপনার হারানোর কিছু নেই, কীসের ভয় পাচ্ছেন?”

“আমি হয়তো ওর প্রতি উদাসীন ছিলাম। কিন্তু ও তো আমাকেই ভালোবেসেছে, ভালোবেসেই যাবে-ওহ! আমি এই ব্যাপারে একদম নিশ্চিত।” মহিলা আকুল কণ্ঠে বিড়বিড় করল। “যদি সেই অভিশপ্ত চিঠিগুলো ওর হাতে নাও আসত তবুও ও আমাকে ভালোবাসত…”

“দাঁড়ান দাঁড়ান! উনি কি সফল হয়েছিলেন?… কিন্তু দুই ভাই তবুও ওনাকে কাঁচকলা দেখিয়েছে?”

“হ্যাঁ, এবং একটা নিশ্ছিদ্র লুকানোর জায়গা নিয়ে ওরা অহংকার করেছিল।

“এর পরে?”

“আমার মনে হয়, আমার স্বামী সে জায়গাটা বের করে ফেলেছিল।”

“আহ! কোথায় সেটা?”

“এখানে।”

“এখানে!” আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম।

“হ্যাঁ। এ-নিয়ে আমার সবসময়-ই সন্দেহ ছিল। অবসর সময়ে লুইস লাকোম্বে বিভিন্ন লোহার সিন্দুক এবং তালা বানিয়ে নিজেকে আমোদিত করত। কোনো সন্দেহ নেই, ভারিন ভাইয়েরা এই বিষয়টা জানত এবং খুব সম্ভবত লাকোম্বের একটা সিন্দুক ব্যবহার করেছিল চিঠিগুলো লুকিয়ে রাখতে।”

“কিন্তু ওরা তো এখানে বাস করত না,” আমি বললাম।

“আপনি এখানে ওঠার আগে, প্রায় চার মাস আগে বাড়িটা কিছুদিনের জন্য খালি পড়ে ছিল। ওরা হয়তো ভেবেছিল, কাগজগুলো নেওয়ার সময় আপনার উপস্থিতি ওদের কোনো সমস্যায় ফেলবে না। কিন্তু ওরা আমার স্বামীকে গোনায় ধরেনি, ও ২২শে জুন এসে সিন্দুক খুলে, যা খুঁজছিল সেটা নিয়ে গেছিল। এবং ওর কার্ডটা ফেলে রেখে গিয়েছিল ভারিন ভাইদের জানাতে যে, ও এখন আর ওদের পরোয়া করে না। আর তাদের অবস্থা এখন উলটে গিয়েছে। দুদিন পরে, ‘গিল ব্লাস’-এ আর্টিকেলটি পড়ার পরে এচিয়েন্না ভারিন এখানে আসে। রুমে একা একা ঢুকে দেখে সিন্দুক খালি এবং… আত্মহত্যা করে।”

কিছুক্ষণ পরে ডাসপ্রি বলল :

“খুব সাধারণ থিওরি। এরপর থেকে কি মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট আপনার সাথে কথা বলছে?”

“না।”

“ওনার আচার আচরণে কি কোনোরকম পরিবর্তন লক্ষ করেছেন? ওনাকে কি হতাশ কিংবা চিন্তিত মনে হয়েছে?”

“না, আমি সেই রকম কিছু লক্ষ করিনি।”

“তবুও, আপনি মনে করছেন উনি চিঠিগুলো নিরাপদে রেখেছেন। আমার মতে, ওনার কাছে চিঠিগুলো নেই। ২২ জুন রাতে উনি আর্সেননি এখান“

“তাহলে কে?”

“রহস্যময় সেই ব্যক্তি যে কিনা সম্পূর্ণ বিষয়টা তদারকি করছে, যার হাতে নাটাইয়ের সুতা। দূর থেকে যার অদৃশ্য ক্ষমতা আমরা অনুধাবন করেছি। সে এবং তার বন্ধুরা ২২ জুন রাতে এখানে এসেছিল। সে লুকিয়ে রাখা কাগজগুলো উদ্ধার করেছিল। সে-ই মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাটের কার্ড রেখে গিয়েছিল। একমাত্র তার কাছেই ভারিন ভাইদ্বয়ের বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণপত্র এবং দলিল আছে।”

“কে সে?” আমি অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“একো দ্য ফ্রান্স-এ যে লোকটা চিঠি দিয়েছিল… সালভাদর! এ-বিষয়ে আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণাদি আছে না? ওর চিঠিতে এমন এমন বর্ণনা ছিল যা ভারিন ভাইদের গোপন কথা জানা লোক ছাড়া অন্য কারও পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না, তাই না?”

“ঠিক আছে তাহলে,” মাদাম অ্যান্ডারম্যাট সতর্ক হয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, “তার কাছে আরও চিঠি আছে, আর সে এখন আমার স্বামীকে হুমকি দিচ্ছে, হায় খোদা! আমি এখন কী করব?”

“ওর কাছে লিখুন,” ডাসপ্রি বলল। “ওনার ওপর বিশ্বাস রাখুন। আপনি যা যা জানেন সব ওনাকে বলুন এবং সামনে যা জানবেন সেগুলোও জানাবেন বলুন। আপনার এবং তার উদ্দেশ্য এক। সে মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাটের বিরুদ্ধে কাজ করছে না, বরং আলফ্রেড ভারিনের বিরুদ্ধে কাজ করছে। ওনাকে সাহায্য করুন।”

“কীভাবে?”

“আপনার স্বামীর কাছে কি লুইস লাকোম্বের ডকুমেন্টগুলো আছে যা দিয়ে নকশাটা সম্পূর্ণ করা যাবে?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে সালভাদরকে সেটা বলুন আর যদি সম্ভব হয় ওনাকে কাগজপত্রগুলো পাঠান। অন্তত ওনাকে একবার হলেও লিখুন। এই মুহূর্তে আপনার যা অবস্থা তাতে বলাই যায় যে, আপনার আর হারানোর কিছু নেই।”

উপদেশটা ছিল বেশ সাহসী, প্রথম দেখায় এমন পরামর্শ বেশ বিপদজনক। কিন্তু মাদাম অ্যান্ডারম্যাটের কাছে আর কোনো উপায় নেই। তাছাড়া, যেমনটা ডাসপ্রি বলেছে, ওনার হারানোর কিছু নেই। অপরিচিত লেখক যদি শত্রুও হয়, তাহলেও আবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। সে যদি কোনো অচেনা লোক হয়, তার যদি সে নিদিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য সম্পন্ন করতে চায়, তাহলে চিঠিগুলো গুরুত্ব তার কাছে সবার আগে হবে না। যা-ই ঘটুক না কেন, একমাত্র এই একটা সমাধান-ই মাদামকে দিতে পারি, আর তিনি এই দুশ্চিন্তার মধ্যেও খুশি হয়ে উঠলেন। তিনি আমাদের ধন্যবাদ জানালেন। আর নতুন কোনো তথ্য পেলে জানানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন।

সত্যি সত্যিই দুদিন পরে তিনি আমাদের নিম্নের চিঠিটা পাঠালেন। চিঠিটা সালভাদরের কাছ থেকে পেয়েছিলেন:

‘চিঠিগুলো পাইনি, কিন্তু আমি সেগুলো পাবোই। নিশ্চিতে থাকুন। আমি সব-ই নজরে রাখছি। – এস.’

আমি চিঠিটার দিকে ভালো করে তাকালাম। ২২ জুন রাতে আমার বইয়ের ভাঁজে পাওয়া নোটের সাথে চিঠির হাতের লেখার হুবুহু মিল।

ডাসপ্রি ঠিকই বলেছিল। সালভাদর-ই আছে সবকিছুর মূলে।

***

ঘোর অন্ধকারে একটু আলোক রশ্মির দেখা পেলাম আমরা। দুটি সেভেন অভ হার্টস খুঁজে পাওয়াটাকে অনেকটা কিছু সময়ের জন্য এরকম যেন, অপ্রত্যাশিত আলোক রশ্মিটা একটা নির্দিষ্ট দিকে ছোঁড়া হয়েছে, কিন্তু বাকিটুকু এখনও আঁধারে নিমজ্জিত। কার্ড দুটির সাতটি স্পটে ছিদ্রগুলো নিয়ে আমি অহেতুক খুব বেশি চিন্তা করছি! তবুও আমি নিজেকে প্রশ্ন না করে থাকতে পারিনি: এই নাটকে কার্ডগুলোর ভূমিকা কী? এগুলোর গুরুত্ব কী? লুইস লাকোম্বের নকশা থেকে করা সাবমেরিনের নাম ‘সেভেন অভ হার্টস’ রাখার সাথে কি-এর কোনো সম্পর্ক আছে?

ডাসপ্রি কার্ড দুটোর দিকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। ও আরেকটা সমস্যার দিকে সমস্ত মনোযোগ দিলো। ব্যাপারটা ওর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। সেটা হলো লুকানোর জায়গাটার খুঁজে বের করা।

“আর কে জানে,” ও বলছিল, “সালভাদর যা খুঁজে পায়নি হয়তো-বা আমি সেটা খুঁজে পাব। যে জিনিসটা ভারিন ভাইদের আছে এতটাই মূল্যবান এবং যে স্থানটাকে ওরা দুর্ভেদ্য বলে মনে করেছিল, সেখান থেকে সরিয়ে ফেলবে বলে মনে হয় না।”

ওর খোঁজাখুঁজি চলতে লাগল। অল্প সময়ের মধ্যে, বিশাল রুমটার কিছু-ই আর বাকি থাকল না। এই রুমটা শেষ হওয়ার পর ওর তদন্ত অন্যান্য রুমে বিস্তার লাভ করল। ও ভিত্তি প্রস্তরের পাথর, দেয়ালের ইট-সহ সবকিছুর ভেতর বাহির পরীক্ষা করে দেখল। এমনকি ছাদের স্লেট পর্যন্ত উঠিয়ে দেখল।

একদিন, ও একটা গাঁইতি এবং কোদাল নিয়ে এলো। আমাকে কোদাল ধরিয়ে দিয়ে নিজের কাছে গাঁইতিটা রাখল। সংলগ্ন খালি লটের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, “এসো।”

আমি ওকে অনুসরণ করলাম ঠিকই, কিন্তু কোনো উৎসাহ পাচ্ছিলাম না। পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য ও খালি জমিটাকে কয়েকটা সেকশনে ভাগ করল। অবশেষে, দুই প্রতিবেশীর মালিকানাধীন দেওয়ালে যেখানে একটা কোনা সৃষ্টি করেছে, সেখানে নুড়ি পাথরের স্তূপ দেখা যাচ্ছে। জায়গাটা ঘাস ও কাঁটাঝোপে আবৃত। সেটা ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ও সেখানে হামলে পড়ল।

ইচ্ছে কম থাকা সত্ত্বেও ওকে সাহায্য করতে বাধ্য হলাম আমি। এক ঘণ্টা ধরে তীব্র গরমের মধ্যে শ্রম দিয়ে গেলাম। ফলাফল শূন্য। আমি নিরুৎসাহিত হয়ে পড়লাম। কিন্তু ডাসপ্রি আমাকে প্রেরণা দিয়ে গেল। ওর উৎসাহের পারদ বরাবরেরই মতোই এক মাত্রা বেশি।

অবশেষে, ওর গাঁইতির কোপে কিছু হাড়গোড় বেরিয়ে এলো। কঙ্কালটার গায়ে তখনও কিছু কাপড়ের অবশিষ্টাংশ লেগে ছিল। হঠাৎ আমার চেহারা থেকে রক্ত সরে গেল। আয়তক্ষেত্র আকারের একটা ছোটো লোহার ধাতু মাটিতে গেঁথে রয়েছে আবিষ্কার করলাম। আমার মনে হলো যেন ওতে আমি লাল দাগ দেখালাম। কাজ থামিয়ে ধাতুর পাতটা তুলে নিলাম। ধাতুর ছোটো পাতটা খেলার কার্ডের সমান। লাল সিসার অক্সাইড দিয়ে তৈরি লাল দাগগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে ঠিক যেন সেভেন অভ হার্টের মতো। আর প্রতিটি দাগেই এমনভাবে গোল করে ছিদ্র করা হয়েছে ঠিক যেমনটা খুঁজে পাওয়া খেলার কার্ডের গায়ে ছিদ্র করা ছিল।

“দেখো, ডাসপ্রি। আমার জন্য অনেক হয়েছে। তোমার যদি ইচ্ছে থাকে তাহলে তুমি থাকো। আমি গেলাম।”

ব্যাপারটা আমার উত্তেজিত নার্ভের বহিঃপ্রকাশ ছিল? না কি তীব্র গরমে কায়িক শ্রমের কারণে ঘটে ছিল? আমার জানা নেই। আমি শুধু কাঁপতে কাঁপতে এলোমেলো পায়ে হেঁটে গেলাম, এবং গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ওখানেই আটচল্লিশ ঘণ্টা কেটে গেল। জ্বরের ঘোরে দেখলাম কতগুলো কঙ্কাল আমাকে তাড়া করছে। আমার চারপাশে নাচছে। ওদের রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড আমার আমার মাথার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছে।

ডাসপ্রি আমার প্রতি নিবেদিত ছিল। ও প্রতিদিন আমার বাসায় আসত। ঘণ্টা তিন-চার বড়ো রুমটায় কাটিয়ে দিত ঠুকাঠুকি এবং এখানে ওখানে ফাঁকা আছে কিনা খুঁজে দেখে কিংবা ফেরাট দিয়ে শিকার করে।

“চিঠিগুলো এখানেই আছে, এই রুমে-ই।” ও মাঝে মাঝেই কথাটা বলত। “ওগুলো এখানেই আছে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি।”

তৃতীয় দিন সকালে আমি উঠে দাঁড়ালাম। দুর্বল কিন্তু সুস্থ। জম্পেশ ব্রেকফাস্ট কিছুটা উজ্জীবিত করে তুলল। কিন্তু বিকালে পাওয়া একটা চিঠি-ই মূলত আমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে সাহায্য করল। একইসাথে আমার আগ্রহ জাগিয়ে তুলল। চিঠিটা ছিল এ-রকম:

‘মঁসিয়ে,

২২ জুন রাতে যে নাটকের শুরু হয়েছিল, এখন সেটার যবনিকাপাত হচ্ছে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নাটকের প্রধান দুই কুশীলবকে মুখোমুখি আনতে বাধ্য হচ্ছি আমি। আর আমি চাচ্ছি মিটিংটা যেন আপনার বাসায় হয়। আপনার যদি সদয় কৃপা হয় তাহলে রাত নয়টা থেকে এগারোটা পর্যন্ত আপনার ঘরটা ব্যবহারের অনুমতি দিন। আপনার ভৃত্যকে সন্ধ্যার পর ছুটি দিলে ভালো হয়। আর সম্ভব হলে আপনি দুই কুশীলবের জন্য ময়দান উন্মুক্ত করে দিলে ভালো হয়। আপনার মনে থাকার কথা ২২ জুন রাতে আমি যখন আপনার বাসায় গিয়েছিলাম তখন আপনার বাসার জিনিসপত্রের কী দারুণ খেয়াল রেখেছি। আপনি এতে সম্মত না, এমনটা ভাবলে আপনার প্রতি আমার অন্যায় হবে। আপনার একান্ত বাধ্যগত।

-সালভাদর।’

চিঠিতে ওর রসিকতায় আমি বেশ অভিভূত হয়ে গেলাম। একইসাথে ওর অদ্ভুত অনুরোধে চমকে গেলাম। চিঠিতে লোকটার আত্মবিশ্বাস ও অকপটতা আমাকে এতটা-ই মুগ্ধ করল যে পৃথিবীর কোনোকিছুর বিনিময়েও ওর নাটকের শেষটা আমি দেখতে চাই।

আমি আমার ভৃত্যকে থিয়েটারের টিকেট ধরিয়ে দিয়েছি। ঠিক রাত আটটায়ও বাড়ি ছেড়ে গেল।

এর কিছু সময় পরে, ডাসপ্রি এলে ওকে আমি চিঠিটা দেখালাম।

“তো?” ও বলল।

“আমি বাগানের বাম পাশের গেটটা আনলক করে রেখেছি, যাতে যে কেউ ঢুকতে পারে।”

“আর তুমি…তুমি কী কোথাও যাচ্ছ?”

“একদম না। আমি আজকে রাতে এখানে থাকতে চাই।”

“কিন্তু ও তো তোমাকেও চলে যেতে বলেছে…”

“আমি আজকে যাচ্ছি না। আমি সতর্ক থাকব, এখানে কী ঘটে সেটা না দেখে যাচ্ছি না কোথাও।”

“হায় খোদা!” ডাসপ্রি অবাক হলো। হাসতে হাসতে বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ, তোমার সাথে আমারও থাকা উচিত। আমার কিছুতেই এটা মিস করা উচিত না।”

দরজায় করাঘাতে আমাদের কথায় ব্যাঘাত ঘটাল।

“এখনই চলে এসেছে না কি?” ডাসপ্রি জিজ্ঞেস করল। “নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বিশ মিনিট আগে! অবিশ্বাস্য!”

দরজা খুলতে গেলাম আমি। অতিথিকে ভেতরে ঢুকালাম। অতিথি আর কেউ না, মাদাম অ্যান্ডারম্যাট। ওনাকে ভীরু এবং আতঙ্কিত দেখাচ্ছিল। কম্পিত কণ্ঠে, তিনি প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল:

“আমার স্বামী… আসছে… ওর একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে… ওরা ওকে চিঠিগুলো দিতে চাচ্ছে…”

“আপনি কীভাবে জানলেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“ঘটনাক্রমে। আমরা যখন ডিনারে বসেছিলাম আমার স্বামীর জন্য একটা বার্তা আসলো। আমাদের ভৃত্য ভুলক্রমে আমার কাছে দিয়ে ফেলেছিল। আমার স্বামী আমার হাত থেকে দ্রুত কেড়ে নিয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। আমি পড়ে ফেলেছি।”

“আপনি পড়েছেন?”

“হ্যাঁ। লেখাটা ছিল ঠিক এ-রকম: ‘আজ রাত নটায়, ঘটনার সাথে সম্পর্কিত কাগজ নিয়ে বুলেভার্দ ম্যালিয়টে থাকবেন। বিনিময়ে, চিঠি পাবেন।’ তাই, ডিনারের পরে, আমি দ্রুত চলে এলাম।

“আপনার স্বামী ব্যাপারটা জানে না, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“তোমার কী মনে হয়?” ডাসপ্রি আমার দিকে ফিরে বলল।

“তুমি যা ভাবছ, আমারও তাই মনে হচ্ছে। মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে একজন।”

“হ্যাঁ, কিন্তু কোন উদ্দেশ্যে?”

“সেটাই আমাদের খুঁজে দেখতে হবে।’

আমি সবাইকে বড় রুমটাতে নিয়ে এলাম। আমরা তিন জনে ফায়ারপ্লেসের পর্দার আড়ালে আরামসে লুকিয়ে থাকতে পারব। আর এই ঘরে কী ঘটে সব দেখতে পারব। আমরা গিয়ে ওখানে বসলাম, মাদাম অ্যান্ডারম্যাট আমাদের দুজনের মাঝে বসল।

ঘড়িতে নয়টা বেজে উঠল। কিছুক্ষণ পরে, বাগানের গেটের কবজা খুলে গেল। অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমি খুবই উত্তেজিত ছিলাম। রহস্যের মূল চাবিকাঠি জানার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি আমি

গত কয়েক সপ্তাহের চমক জাগানো বর্ণনা বহুল ঘটনার ব্যাখ্যা এই এলো বলে। আমার চোখের সামনে এখন যুদ্ধ শুরু হবে। ডাসপি মাদাম অ্যান্ডারম্যাটের হাত ধরে বলল:

“একটা কথাও বলবেন না, নাড়াচাড়া তো করবেন-ই না। যা-ই দেখে থাকুন না কেন, চুপ থাকবেন! “

কেউ একজন ভেতরে প্রবেশ করল। লোকটা আলফ্রেড ভারিন। আমি তাকে এক দেখাতেই চিনতে পারলাম কারণ ওর ভাই এচিয়েন্নার সাথে ওর চেহারার মিল আছে। একই রকম জবুথবু চলাফেরা; একই রকম কালো দাড়িওয়ালা ফ্যাকাশে চেহারা।

টোপ ফেলে কোনো ফাঁদে ফেলা হচ্ছে কিনা সেই ভয়ে লোকটি বেশ অস্বস্তি নিয়ে ভেতরে ঢুকল। লোকটি ঘরের চারদিকে নজর বুলাল। আমি নিশ্চিত ফায়ারপ্লেসের মখমলের পর্দা লোকটি সন্তুষ্টির দৃষ্টিতে দেখল না। সে আমাদের দিকে তিন কদম এগোল, ঠিক তখনই কিছু একটা তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল; সে পুরনো হয়ে যাওয়া মোজাইকে আঁকা রাজার ছবির দিকে এগিয়ে গেল। মোজাইকের ছবিতে রাজার দাড়ি উড়ছে, তলোয়ারটা সুসজ্জিত। সে একটা চেয়ারের ওপর উঠে ছবির রাজার দিকে কয়েক মিনিট তাকিয়ে থেকে পরখ করে নিল। চেহারা, মাথায় এবং তারপরে কাঁধের চারপাশে আঙুল বুলাতে লাগল। হঠাৎ কারও এগিয়ে আসার পদশব্দ শুনতে পেয়ে, চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে নেমে ছবিটা থেকে দূরে সরে গেল সে। মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট দরজায় উদয় হলো।

“আপনি! আপনি!” মঁসিয়ে আন্ডারম্যাট চিৎকার করে বলে উঠল। “আপনি-ই কি আমাকে এখানে ডেকে এনেছেন?”

“আমি? কক্ষনো না,” ভারিনকে কর্কশ, কম্পিত কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে দেখে ওর ভাইয়ের কথা মনে পরে গেল। “আপনার চিঠি পেয়ে-ই তো আমি এখানে এসেছি।”

“আমার চিঠি?”

“আপনার সাক্ষর করা চিঠি, ওতে আপনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন…”

“আমি কখনোই আপনাকে চিঠি লিখিনি।” মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট ঘোষণা দিলো।

“চিঠিটা আপনি লিখেননি!”

সহজাত প্রবৃত্তি বশে, ভারিন আত্নরক্ষার ভঙ্গিতে দাঁড়াল। ব্যাংকারের বিরুদ্ধে নয় বরং অচেনা শত্রু যে কিনা তাকে এই ফাঁদে এনে ফেলেছে তার উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয়বারের মতো সে আমাদের দিকে তাকাল, তারপরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট ওর পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল।

“তো, কোথায় যাচ্ছেন আপনি, ভারিন?”

“ব্যাপারটা আমার কাছে সুবিধাজনক লাগছে না। আমি বাসায় যাচ্ছি। শুভ রাত্রি।”

“এক মিনিট!”

“তার কোনো প্রয়োজন নেই, মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট। আপনাকে আমার কিছুই বলার নেই।”

“কিন্তু আমার আপনাকে বলার আছে, এবং কথাগুলো বলার এটাই সেরা সময়।”

“আমাকে যেতে দিন।”

“না, আপনি যেতে পারবেন না।

মঁসিয়ে আন্ডাম্যাটের স্থির সংকল্পের সামনে ভারিন পিছিয়ে এলো, বিড়বিড় করে বলল, “ঠিক আছে, যা বলার দ্রুত বলুন।“

একটা বিষয় আমাকে বিস্মিত করল। আমি নিশ্চিত আমার দুই সঙ্গীরও একই রকম অনুভুতি হচ্ছিল। কেন সালভাদর এখানে নেই? সে কি এই আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ কেউ না? না কি দুই প্রতিপক্ষকে নিজেদেরে মধ্যে লড়তে দিয়ে ও সন্তুষ্ট? সামনে ঘটে চলা এই নাটকের পরেও, তার অনুপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বড়ো হতাশা। যদিও সেটা বর্তমান নাটকীয় অবস্থার গুরুত্বে কোনো হেরফের করছে না।

কয়েক মুহূর্ত পরে, মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট ভারিনের দিকে এগিয়ে মুখোমুখি হলেন। চোখে চোখ রেখে বললেন:

“এতগুলো বছর পরে, আপনার তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনি অকপটে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। সত্যি করে বলুন, লুইস লাকোম্বের সাথে কী করেছেন আপনি?”

“এটা কেমন প্রশ্ন! এমনভাবে বলছেন যেন আমি ওর সম্পর্কে সব জানি।”

“আপনি সব জানেন! আপনি আর আপনার ভাই ছিলেন ওর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। বলতে গেলে ওর সাথে আপনারা এই ঘরেই বাস করতেন। ওর সমস্ত পরিকল্পনা এবং কাজ সম্পর্কে জানতেন আপনারা। সেদিন রাতে যখন ওর সাথে আমার শেষ দেখা হয়, সেদিন দরজায় দাঁড়িয়ে আমি যখন ওকে বিদায় জানাচ্ছিলাম, তখন দু’জন লোককে গাছের ছায়ায় হারিয়ে যেতে দেখেছি।”

“এর সাথে আমার কী সম্পর্ক?”

“সে দু’জন লোক ছিলেন আপনি আর আপনার ভাই।”

“প্রমাণ করুন।”

“সবচেয়ে ভালো প্রমাণ হচ্ছে, এর ঠিক দুদিন পরে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে আপনি আমাকে লাকোম্বের নকশা এবং কাগজপত্র দেখালেন। কাগজগুলো আপনার দখলে এলো কেমন করে?”

“আমি আপনাকে আগেই বলেছি মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট, যেদিন লুইস লাকোম্বে নিখোঁজ হয়ে যান, তার পরের দিন সকালে ওনার টেবিলে পেয়েছি আমরা ওগুলো।”

“ডাহা মিথ্যা!”

“প্রমাণ করুন।”

“আদালত সেটা প্রমাণ করবে।”

“আদালতে আপিল করছেন না কেন তাহলে?”

“কেন? আহ! কেন…” কিছুটা আবেগের বহিঃপ্রকাশ করে, তোতলাতে লাগল মঁসিয়ে আন্ডারম্যাট।

“আপনি খুব ভালো করেই জানেন মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট, আপনি যদি আমাদের অপরাধ সম্পর্কে সামান্যতম নিশ্চয়তাও পেতেন, আমাদের ছোটোখাটো হুমকিকে আপনি পরোয়া করতেন না।”

“কীসের হুমকি? আপনি কি মনে করেছেন চিঠিগুলো নিয়ে এক মুহূর্তও চিন্তা করেছি?”

“চিঠিগুলো নিয়ে যদি আপনি পরোয়া না করতেন, তাহলে কেন আপনি আমাকে সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার বদলে হাজার ফ্রাঁ দিতে চেয়েছিলেন? কেন আমাকে এবং আমার ভাইকে বন্য জন্তুর মতো ট্র্যাক করে বেড়িয়েছেন।’

“নকশাটা উদ্ধারের জন্য।”

“ফালতু কথা! আপনি চিঠিগুলো চাচ্ছিলেন। আপনি জানতেন যে মুহূর্তে চিঠিগুলো আপনার দখলে আসবে, সেই মুহূর্তে আপনি আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন। ওহ! না, আমি এর সাথে যোগ দিতে পারব না!”

তারপরে সে হো হো করে হাসতে লাগল, কিন্তু হঠাৎ করে চুপ হয়ে বলল:

“কিন্তু অনেক হয়েছে এসব! আমরা শুধু পুরোনো কেচ্ছা গেয়ে যাচ্ছি। আসল কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আমাদের উচিত সবকিছু যেমন আছে তেমনই চলতে দেওয়া।”

“এভাবে চলতে দেওয়া যায় না।” ব্যাংকার বলল। “আর যেহেতু আপনি চিঠির কথা তুললেন-ই, একটা কথা শুনে রাখুন চিঠিগুলো ফেরত না দেওয়ার আগ পর্যন্ত এই বাড়ি ছেড়ে আপনি কোথাও যেতে পারবেন না। “

“আমার যখন মনে চায় তখন যাব।”

“আপনি পারবেন না। “

“সাবধান মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট। আপনাকে আমি সাবধান করছি…”

“আমি বলছি, আপনি যেতে পারবেন না…”

“দেখা যাবে,” ভারিন চিৎকার করে বলে উঠল। এত জোরে চিৎকার করল যে মঁসিয়ে আন্ডারম্যাট সেটাকে অবজ্ঞা করতে পারল না। ভারিন সম্ভবত ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে। তাই সে বের হওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে লাগল। মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট ওকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঠেলে দিলো। ভারিনকে কোটের পকেটে হাত দিতে দেখলাম।

“শেষবারের মতো বলছি, আমাকে যেতে দিন।” সে চিৎকার করে বলে উঠল।

“আগে চিঠি!”

ভারিন রিভলভার বের করে মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাটের দিকে তাক করে বলল: “যেতে দিবেন কি দিবেন না?”

মঁসিয়ে আন্ডারম্যাট দ্রুত থেমে গেল। হঠাৎ পিস্তলের গুলির আওয়াজ শোনা গেল। ভারিনের হাত থেকে অস্ত্রটা পড়ে গেল। আমি অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম। গুলির আওয়াজটা আমার খুব কাছ থেকেই হয়েছে।

গুলিটা ডাসপ্রি করেছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ডাসপ্রি তাদের দুজনের মাঝে গিয়ে দাঁড়াল। ভারিনের দিকে তাকিয়ে টিটকারির মেরে বলল :

“তোমার ভাগ্য ভালো বন্ধু। আমি তোমার হাতে গুলি করেছি।”

দু’জন-ই ওর দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকাল। তারপরে মঁসিয়ে আন্ডাম্যাটের দিকে তাকিয়ে ডাসপ্রি বলল:

“অনধিকার চর্চার জন্য গুস্তাকি মাফ করবেন জনাব। কিন্তু সত্যি বলতে, আপনি খুব বাজেভাবে খেলাটা খেলছেন। কার্ডগুলো আমাকে দিন।”

ভারিনের দিকে আবারও ফিরে তাকিয়ে ডাসপ্রি বলল:

“এখন ব্যাপারটা আমাদের দুজনের মধ্যে হবে, কমরেড। সঠিকভাবে খেলো। হার্ট হচ্ছে ট্রাম্প এবং আমি সেভেন নিয়ে খেলব।”

তারপরে ডাসপ্রি ভারিনের বিমূঢ় চোখের সামনে সাতটি লাল দাগ দেওয়া ছোটো ধাতুর পাত উঁচু করে ধরল। ভারিনের জন্য সেটা ছিল দারুণ ধাক্কা। হচকচিত চোখে এবং পাংশু মুখে ও বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখের সামনে জিনিসটা দেখে লোকটি মনে হচ্ছে সম্মোহিত হয়ে গেল।

“আপনি কে?” সে খাবি খেয়ে জিজ্ঞেস করল।

“যারা অন্যের কাজের মধ্যে বাম হাতে ঢুকায় সেরকম একজন।”

“আপনি কী চান?”

“আজকে আপনি সাথে করে যা নিয়ে এসেছেন।”

“আমি কিছুই আনিনি।”

“হ্যাঁ এনেছেন, নয়তো আপনি এখানে আসতেন না। আজকে সকালে এখানে রাত নয়টায় আসার আমন্ত্রণ পেয়েছেন আপনি। সাথে করে সকল কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল আপনাকে?”

ডাসপ্রির আচরণে এবং কণ্ঠে কর্তৃত্বের ছোঁয়া ছিল যা আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না; ওর আচরণ ছিল ঠান্ডা এবং কর্তৃত্বপূর্ণ। ভারিন ওর নিজের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল:

“কাগজপত্রগুলো এখানে আছে।”

“সবগুলো?”

“হ্যাঁ।’

“লুইস লাকোম্বের থেকে যেগুলো নিয়ে পরে যেগুলো মেজর ভন লিবেনের কাছে বিক্রি করেছিলেন?”

“হ্যাঁ।”

“এগুলো কী ফটোকপি না কি আসল?”

“আমার কাছে যা আছে সবগুলো আসল।”

“এগুলোর জন্য আপনি কত চান?”

“এক লক্ষ ফ্রাঁ।”

“আপনি পাগল,” ডাসপ্রি বলল। “কেন? মেজর আপনাকে মাত্র বিশ হাজার দিয়েছিল। তাও সেটা সাগরে ছুঁড়ে ফেলার মতোই হয়েছে, যেহেতু প্রাথমিক ট্রায়াল পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।”

“ওরা নকশা বুঝেনি।”

“নকশাটা সম্পূর্ণ ছিল না।”

“তাহলে, আপনি সেগুলো নিয়ে আসতে বললেন কেন?”

“কারণ আমি সেগুলো চাই। আমি আপনাকে পাঁচ হাজার ফ্রাঁ দিতে পারবো… আর এক সউও বেশি না।”

“দশ হাজার। এক সউও কম হবে না। “

“রাজি,” বলল ডাসপ্রি। ও তারপরে মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাটের দিকে ফিরে বলল:

“মঁসিয়ে দয়া করে চেক সাইন করে দিন।”

“কিন্তু… আমার কাছে তো…”

“আপনার চেক বই? এই এখানে।”

বিস্মিত হয়ে ডাসপ্রি যে চেক বইটা মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাটের হাতে দিলো, সেটা পরীক্ষা করতে লাগল।

“এটা আমার,” সে খাবি খেয়ে বলল। “কিন্তু আপনার কাছে আসলো কীভাবে?”

“কোনো অতিরিক্ত কথা নয়, মঁসিয়ে। দয়া করে আপনাকে শুধুমাত্র সই করতে হবে।“

আন্ডারম্যাট পকেট থেকে ফাউন্টেন পেন বের করে চেকে সই করল। ভারিন জিনিসটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়াল।

“হাত নামাও,” ডাসপ্রি বলল। “আরও কিছু জিনিস বাকি রয়ে গেছে।” তারপরে আন্ডারম্যাটকে উদ্দেশ্য করে বলল: “আপনি কিছু চিঠি নিয়ে আসতে বলেছিলেন, তাই না?”

“হ্যাঁ”

“একটা তাড়া চিঠি।”

“সেগুলো কোথায়, ভারিন?”

“আমার কাছে নেই ওগুলো।’

“সেগুলো কোথায়, ভারিন?”

“আমি জানি না। আমার ভাই ওগুলোর দায়িত্বে ছিল।”

“এগুলো এই ঘরেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে।”

“সেক্ষেত্রে আপনি জানেন, সেগুলো কোথায়।“

“আমি কীভাবে জানব?”

“আপনি-ই না লুকানোর জায়গাটি খুঁজে পেয়েছিলেন? সালভাদরের মতোই আপনি সবকিছু সম্পর্কে জানেন।”

“চিঠিগুলো গুপ্ত কুঠুরিতে নেই।”

“ওগুলো সেখানেই আছে।”

“বের করুন তাহলে।”

ভারিন তার দিকে তাকাল। ডাসপ্রি আর সালভাদর কি একই ব্যক্তি না?

সবকিছু-ই সেদিকে ইঙ্গিত করে। সেক্ষেত্রে, ইতোমধ্যে খুঁজে পাওয়া গুপ্ত কুঠুরি সম্পর্কে জানাতে ভারিনের কোনো ঝুঁকি নেই।

“খুলুন,” আবারও বলল ডাসপ্রি।

“আমার কাছে সেভেন অভ হার্টস নেই।”

“হ্যাঁ,আছে,” ডাসপ্রি ওর হাতে ধাতুর পাতটা বুঝিয়ে দিয়ে বলল। ভারিন আতঙ্কে জমে গেল।

চিৎকার করে বলে উঠল:

“না, না। আমি খুলব না।”

“বাদ দিন,” ডাসপ্রি মোজাইকে দাড়িওয়ালা রাজা ছবির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে উত্তর দিলো। ও চেয়ারে উঠে তলোয়ারের নিচের অংশে ধাতুর পাতের সেভেন অভ হার্টস এমনভাবে জোড়া লাগিয়ে দিলো যেন তলোয়ার এবং ধাতুর পাতের দুই অংশ মিলে যায়। তারপরে একটা সুঁইয়ের মাধ্যমে ধাতব পাতের সাতটি ফুটোয় ঢুকিয়ে দিয়ে, সাতটি ছোটো মোজাইকের পাথরে ছাপ দিলো। সপ্তম পাথরে চাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, একটা ক্লিক শব্দ শোনা গেল। আর সাথে সাথেই রাজার ছবিটা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। ভেতর থেকে একটা ষ্টিলের ফায়ারপ্রুফ গোপন কুঠুরি উন্মুক্ত হয়ে এলো।

“আপনি দেখতেই পাচ্ছেন ভারিন, কুঠুরিটা সম্পূর্ণ খালি।“

“তাই তো দেখছি। আমার ভাই তাহলে চিঠিগুলো সরিয়ে নিয়েছে।”

ডাসপ্রি চেয়ার থেকে নেমে এলো। ভারিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল :

“আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। আরেকটা গোপন কুঠুরি আছে। সেটা কোথায়?”

“আর কোনো গোপন কুঠুরি নেই।”

“আপনি কি টাকা চাচ্ছেন? কত টাকা?”

“দশ হাজার।”

“মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট, চিঠিগুলো কি আপনার কাছে দশ হাজার ফ্রাঁ’র যোগ্য?”

“হ্যাঁ,” বলল অ্যান্ডারম্যাট, স্থিরভাবে।

ভারিন কুঠুরিটা বন্ধ করল, সেভেন অভ হার্টস আবারও তলোয়ারের একই জায়গায় স্থাপন করল। সে সাতটি ফুটোর সবকটিতে সুঁই প্রবেশ করাল। সেই একই ক্লিক শব্দই হলো, কিন্তু অদ্ভুতভাবে এবার, কুঠুরির অল্প একটা অংশ শুধুমাত্র উন্মুক্ত হলো। ছোটো কুঠুরিটা বড়ো কুঠুরির দরজায় ওপর বানানো হয়েছে। চিঠির প্যাকেটটা সেইফের ভেতরে ছিল, টেপ দিয়ে মোড়ানো। ভারিন প্যাকেটটা ডাসপ্রির হাতে দিলো। চিঠিগুলো ব্যাংকারের দিকে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল:

“চেক কি রেডি আছে, মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট?”

“হ্যাঁ।”

“আর আপনার কাছে কি লুইস লাকোম্বের দেওয়া শেষ ডকুমেন্টটা আছে যেটাতে কি না সাবমেরিনের সম্পূর্ণ নকশা আছে?”

“হ্যাঁ।”

বিনিময় হয়ে গেল। ডাসপ্রি চেক এবং ডকুমেন্ট পকেটে পুরলো, এবং মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাটকে চিঠিগুলো দিলো।

“আপনি কি এগুলো-ই চাচ্ছিলেন, মঁসিয়ে?”

ব্যাংকার কয়েক মুহূর্তের জন্য দ্বিধা করল, যেন অভিশপ্ত চিঠিগুলো ধরতে ভয় পাচ্ছেন। যেগুলো মাত্রই তিনি কিছুক্ষণ আগে পেতে চাইছিলেন। তারপরে, কিছুটা দ্বিধা করে, তিনি ওগুলো নিলেন।

আমি পাশ থেকে গোঙানির শব্দ শুনতে পেলাম। মাদাম অ্যান্ডারম্যাটের হাত ধরে ফেললাম আমি। সেগুলো একদম ঠান্ডা।

“আমার মনে হয়, মঁসিয়ে” অ্যান্ডারম্যাটের দিকে তাকিয়ে বলল ডাসপ্রি, “আমাদের ব্যাবসা এখানেই শেষ। ওহ! না ধন্যবাদ। ভাগ্যক্রমে আমি আপনার উপকার করতে পেরেছি। শুভ রাত্রি।”

লুইস লাকোম্বেকে লেখা ওনার স্ত্রীর চিঠিগুলো নিয়ে মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট চলে গেলেন।

“চমৎকার!” উৎফুল্ল হয়ে ডাসপ্রি বলল। “সবকিছু আমাদের পরিকল্পনা মতো এগোচ্ছে। এখন আমাদের নিজেদের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা উচিত, কমরেড। আপনার কাছে কাগজগুলো আছে?”

“এই যে এখানে… সবগুলো।”

ডাসপ্রি সবগুলো কাগজ সাবধানে খুঁটিয়ে দেখল। তারপরে পকেটে পুরে ফেলল।

“সব ঠিক আছে। আপনি আপনার কথা রেখেছেন।” সে বলল।

“কিন্তু…”

“কিন্তু কী?”

“চেক দুটো? টাকা?” ভারিন বলল আগ্রহ নিয়ে।

“আপনার তো দেখি ব্যাবসায়িক লেনদেন নিয়ে ভালো জ্ঞান আছে, বন্ধু। আপনি কীভাবে এটা আশা করেন?”

“আমি আমার প্রাপ্যটাই চাইছি।”

“যে জিনিস চুরি করেছেন সেটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আপনি টাকা চাইছেন? আমার মনে হয় না।”

ভারিন ওর সামনে এসে দাঁড়াল। রাগে কাঁপতে লাগল সে। চোখগুলো রক্তবর্ণ ধারণ করল।

“টাকা… বিশ হাজার…” সে তোতলাতে লাগল।

“অসম্ভব! আমার নিজের জন্য প্রয়োজন সেটা।”

“টাকা!”

“আরে বসেন বন্ধু। এত উত্তেজিত হবেন না। এতে ভালো কিছু হবে না।” ডাসপ্রি ভারিনের হাত এত জোরে মুচড়ে ধরল যে বেচারা ব্যথায় চিৎকার করে উঠল। ডাসপ্রি বলতে থাকল :

“এখন আপনি বিদেয় হতে পারেন। চলুন আমি-ই পথ দেখিয়ে দিই। আহ! হ্যাঁ। একসাথে আমরা কাছেই একটা খালি জায়গায় যাব। আমি আপনাকে পাথর এবং মাটির একটা স্তুপ দেখাব। ওর নিচে …”

“ডাহা মিথ্যা! এটা ডাহা মিথ্যা!”

“অহ! না, একদম সত্যি। সাতটা দাগওয়ালা ধাতুর পাতটা ওখানেই পাওয়া গেছে। লুইস লাকোম্বে সবসময় সাথে রাখতো। আর আপনি সেটা ওর লাশের সাথে করব দিয়ে দিয়েছেন। আরও কিছু ছোটোখাটো বিষয় জাজ এবং জুরিদের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক মনে হতে পারে।“

ভারিন হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বিড়বিড় করল:

“ঠিক আছে। আমি হেরে গেছি। আর কিছু বলার নেই। কিন্তু আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই। আমি জানতে চাই…”

“কী জানতে চান আপনি?”

“সেখানে কি একটা বড়ো বাক্সের মধ্যে ছোটো কৌটা ছিল?”

“হ্যাঁ।”

“জুনের ২২ তারিখ রাতেও কি সেটা ওখানে ছিল?”

“হ্যাঁ।”

“ওতে কী ছিল?”

“আপনারা ওখানে যা যা রেখেছিলেন… ডায়মন্ড এবং মুক্তার বেশ ভালো একটা কালেকশন।“

“আপনি সেগুলো সব নিয়ে গেছেন?”

“অবশ্যই। আমি নিয়েছি। আপনি কি এ-জন্য আমাকে দোষ দিতে চাচ্ছেন?”

“এখন বুঝতে পারলাম… সেই কৌটাটা খুইয়ে ফেলাটাই আমার ভাইয়ের আত্নহত্যার কারণ ছিল।”

“সম্ভবত। চিঠিপত্র হারিয়ে যাওয়াটা পর্যাপ্ত মোটিভ না। কিন্তু কৌটা হারিয়ে যাওয়াটা ভালো মোটিভ হতে পারে… আপনার কি শুধু এইটুকু-ই জিজ্ঞেস করার ছিল?”

“আরেকটা জিনিস-আপনার নাম?”

“আপনি কি প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা করছেন না কি?”

“হায় ঈশ্বর! পাশার দান হয়তো ঘুরে যেতে পারে। আজকে, আপনি ভালো অবস্থানে আছেন। কালকে…”

“আপনি থাকতে পারেন।”

“সেটাই আশা করছি। আপনার নাম?”

“আর্সেন লুপাঁ।”

“আর্সেন লুপাঁ!”

ভারিন টলে উঠল, কেউ যেন ওকে ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করেছে। এই শব্দ দুটো ওর সমস্ত আশা বিলীন করে দিলো।

ডাসপ্রি হেসে উঠে বলল:

“আহ! আপনি কী আশা করছেন মঁসিয়ে ডুরান্ড অথবা ডুপন্ট এই ব্যাপারটা সামলাতে পারবে? না, এটা সামলাতে আর্সেন লুপাঁর মতো দক্ষতা এবং চাতুরতা প্রয়োজন। এখন, যেহেতু আপনি আমার নাম জেনে গিয়েছেন, যান প্রতিশোধের প্রস্তুতি নিন গিয়ে। আর্সেন লুপাঁ আপনার অপেক্ষায় থাকবে।”

তারপরে সে হতভম্ব ভারিনকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো।

“ডাসপ্রি! ডাসপ্রি!” পর্দাটা সরিয়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম। ও আমার দিকে দৌড়ে এলো।

“কী? কী হয়েছে?”

“মাদাম অ্যান্ডারম্যাট অসুস্থ হয়ে গেছেন।”

ও দ্রুত ওনার কাছে গিয়ে কিছুটা লবণ খাইয়ে দিলো। ওনার যত্ন নিতে নিতে আমাকে প্রশ্ন করল:

“এ-রকম হলো কী করে?”

“লুইস লাকোম্বের যে চিঠিগুলো তুমি ওনার স্বামীকে দিয়েছিলে।”

ও নিজের কপাল চেপে ধরে বলল:

“উনি কী মনে করেছেন আমি এ-রকম একটা কাজ করব!… কিন্তু, অবশ্যই, উনি এটাই চিন্তা করবেন। কী নির্বোধ আমি!”

মাদাম অ্যান্ডারম্যাট এখন স্বাভাবিক হয়েছেন। ডাসপ্রি ওর পকেট থেকে মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাট যেরকম প্যাকেট নিয়ে গিয়েছে সে-রকম ছোটো একটা প্যাকেট বের করল।

“এই যে নিন আপনার চিঠি, মাদাম। একেবারে আসল চিঠি।”

“কিন্তু… অন্যগুলো?”

“অন্যগুলো সাবধানে শব্দচয়ন করে আমার লেখা। আপনার স্বামী ওগুলোতে আপত্তিকর কিছু খুঁজে পাবে না। আর যেহেতু ওনার চোখের সামনেই সেইফ থেকে বের করা হয়েছে তাই অদলবদলের বিষয়টা উনি ধরতে পারবেন না।”

“কিন্তু হাতের লেখা…”

“এমন কোনো হাতের লেখা নেই যেটা নকল করা যায় না।”

মহিলা ওকে এমনভাবে ধন্যবাদ দিলো যার কোনো তুলনা হয় না। তাই আমি ধরে নিলাম মহিলা ভারিন এবং আর্সেন লুপাঁর মধ্যকার নাটকের শেষ অংশ দেখেননি।

কিন্তু আকস্মিক উদ্ঘাটন আমাকে লজ্জায় ফেলে দিলো। লুপাঁ! আমার ক্লাবের সহযোগী আর কেউ নয়, আর্সেন লুপাঁ। আমি ঘুণাক্ষরেও সেটা বুঝতে পারিনি। কিন্তু ও খুব সহজে বলল:

“তুমি এখন জেন ডাসপ্রিকে বিদায় বলতে পারো।”

“আহ!”

“হ্যাঁ, জেন ডাসপ্রি একটা লম্বা যাত্রায় যাবে। আমি ওকে মরোক্কোতে পাঠাব। সেখানে ও হয়তো ওর জুতসই উপায়ে মৃত্যুকে খুঁজে পাবে। আমি হয়তো বলতে পারি এটা ওর চাওয়া।

“কিন্তু আর্সেন লুপাঁ তো থাকবে?”

“হ্যাঁ! নিশ্চতভাবে-ই। আর্সেন লুপাঁ শুধুমাত্র ওর অভিযাত্রা শুরু করেছে। এবং তার আশা…”

আমি কৌতূহলে মরে যাচ্ছিলাম। তাই ওর কথার মাঝে বাধা দিয়ে মাদাম অ্যান্ডারম্যাট যাতে শুনতে না পায় এমন দূরত্বে নিয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম:

“সবচেয়ে ছোটো সিন্দুকটা কি তুমি আবিষ্কার করেছ… যেটাতে চিঠিগুলো ছিল?”

“হ্যাঁ। অনেক ঝামেলার পরে, গতকাল বিকালে তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে আমি তখন সেটা খুঁজে পেয়েছিলাম। হায় খোদা! কে জানত ব্যাপারটা এত সোজা ছিল! কিন্তু সবচেয়ে সহজ জিনিসগুলোই আমাদের নজর এড়িয়ে যায়।” তারপরে আমাকে সেভেন অভ হার্টস দেখিয়ে আরও যোগ করল:

“বড়ো সিন্দুকটা খুলতে যে মোজাইকের রাজার তলোয়ারে এই কার্ডটা রাখতে হবে, সেটা আমি আগেই ধারণা করেছিলাম।”

“কীভাবে?”

“খুব সহজে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে, যখন ২২ জুন সন্ধ্যায় আমি এখানে এসেছি তখন থেকেই জানতাম…”

“তুমি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পরে…”

“হ্যাঁ। আমাদের কথাবার্তা অপরাধ, ডাকাতি এসবের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম, যাতে তুমি নার্ভাস থাকো এবং আমাকে খোঁজাখুঁজিতে বাঁধা না দিতে পারো।”

“পরিকল্পনাটা খুব ভালোভাবে কাজে দিয়েছে।”

“আসলে, আমি যখন এখানে আসি আমি জানতাম গোপন লক দেওয়া সিন্দুকে ছোটো একটা বাক্স লুকিয়ে রাখা আছে। আর সেই লকের চাবি হচ্ছে সেভেন অভ হার্টস। আমাকে শুধু জায়গামতো কার্ডটা বসাতে হতো। আর এক ঘণ্টার কসরতে সঠিক জায়গাটা পেতে সমস্যা হয়নি।”

“এক ঘণ্টা!”

“মোজাইকের লোকটাকে পর্যবেক্ষণের জন্য।”

“বুড়ো রাজা?”

“এই বুড়ো রাজা-ই প্লেয়িং কার্ডের কিং অভ হার্টস-এর প্রতিনিধিত্ব করছে।”

“সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু সেভেন অভ হার্টস কীভাবে একবার বড়ো সিন্দুক আরেক বার ছোটো সিন্দুক খোলে? আর তুমি কেন প্রথমবার শুধুমাত্র বড়ো সিন্দুকটা-ই খুললে? আমি বলতে চাচ্ছি ২২ জুন রাতে আরকি।”

“কেন? কারণ সেভেন অভ হার্টস আমি সবসময়-ই একইভাবে রেখেছিলাম। আমি কখনোই স্থান পরিবর্তন করিনি। কিন্তু গতকাল, আমি খেয়াল করলাম যে কার্ডটা উলটে দিলে, মোজাইকের সাতটা বিন্দু পরিবর্তন হয়ে যায়।”

“হায় ঈশ্বর!”

“অবশ্যই, সব কিছুই ঈশ্বরের কাজ! কিন্তু একজন ব্যক্তিকে এসব চিন্তা করতে হয়।“

“আরেকটা বিষয়: মাদাম অ্যান্ডারম্যাট বলার আগ পর্যন্ত তো মনে হয় তুমি চিঠিগুলোর ব্যাপারে জানতে না…”

“এ ব্যাপারে আমার সাথে আগে কথা হয়েছিল কি না? না, কারণ সিন্দুকের ভেতরে বাক্সের পাশে আমি দুই ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতার পরিকল্পনার চিঠিপত্র ছাড়া কিছুই পাইনি।”

“তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছ—ভাগ্যের জোরে, প্রথমে তুমি দুই ভাইয়ের পেছনের ইতিহাস নিয়ে তদন্ত করেছ, এবং এরপর সাবমেরিন বিষয়ক নকশা ও ডকুমেন্ট খোঁজাখুঁজি করেছ?”

“শুধুই ভাগ্যের জোরে।”

“আসলে কেন তুমি খোঁজাখুঁজি করেছিলে?”

“হায় খোদা!” ডাসপ্রি অবাক হলো। হাসতে হাসতে বলল, “ঠিক কতটুকু আগ্রহী তুমি?”

“বিষয়টা আমাকে মুগ্ধ করেছে।”

“ঠিক আছে। এই মুহূর্তে, মাদাম অ্যান্ডারম্যাটকে ক্যারিজে তুলে দিয়ে এবং ‘একো দ্য ফ্রান্স’-এর জন্য একটা ছোটো লেখা লিখে ফিরে আসব আমি। তখন তোমাকে সব বলব।”

ও তখনই বসে একটা ছোটো, সুস্পষ্ট আর্টিকেল লিখল যা মানুষকে বিনোদন দিয়েছিল এবং একইসাথে বিহ্বল করে দিয়েছিল। আর্টিকেলটা প্রকাশিত হওয়ার পরে সারা দুনিয়া জুড়ে যে রোমাঞ্চ ছড়িয়ে দিয়েছিল সেটা নিশ্চয়ই অনেকেই মনে আছে।

‘সালভাদর সম্প্রতি যে সমস্যা উত্থাপন করেছিল আর্সেন লুপাঁ তা মীমাংসা করেছে। লুইস লাকোম্বের সকল ডকুমেন্ট এবং আসল কাগজপত্র ও নকশা উদ্ধার করে নৌমন্ত্রণালয়ের হাতে হস্তান্তর করেছে। দেশের প্রথম সাবমেরিন তৈরির জন্য অনুদানকারীদের তালিকা তৈরি করে দিয়েছে। তার নিজের অনুদান ছিল বিশ হাজার ফ্রাঁ।’

“বিশ হাজার ফ্রাঁ! মঁসিয়ে অ্যান্ডারম্যাটের চেক দুটো?” যখন ও আমাকে লেখাটা পড়তে দিলো আমি তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“একদম। ভারিনের তো বিশ্বাসঘাতকতা থেকে মুক্তি পাওয়া উচিত।”

***

আর এভাবেই আমার আর্সেন লুপাঁর সাথে জানাশোনার শুরু হলো। এভাবে-ই আমি জানতে পারলাম, আমার ক্লাবের এক সদস্য, জেন ডাসপ্রি আর কেউ না, স্বয়ং ‘জেন্টলম্যান বার্গলার’ আর্সেন লুপাঁ।

এভাবেই আমি বিখ্যাত মানুষটার সাথে শক্ত বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম। এবং পরবর্তীতে ওর নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচয়িতা হিসাবে সম্মানিত হলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *