দ্য সিগন্যালম্যান

দ্য সিগন্যালম্যান

মূল গল্প  The Signal Man (Charles Dickens)

‘ও দাদা শুনছেন? আরে এদিকে৷’

চিৎকারটা আমি জোর গলাতেই করেছিলাম৷ তা সত্ত্বেও লোকটা কিন্তু আগের মতোই লাইনের উপর তাকিয়ে থাকল৷ যেন আমার গলাটা সেদিক থেকেই আসছে৷ অথচ দিক ভুল হবার তো কথা নয়৷ আমাদের মাঝের দূরত্ব মিটার দশেকের বেশি নয়৷ অবশ্য রেললাইনের দু-পাশের জমি যেখানে খাদের মতো উঠে গেছে সেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি৷ ফলে তার মাথার বেশ খানিকটা উপর থেকে হাঁক দিয়েছি৷ এখনও কিন্তু সে একই ভাবে লাইনের দিকে তাকিয়ে আছে৷ শেষ বেলার সূর্যের আলো তার চোখে পড়ছে বলে ডানহাতটা ভাঁজ করে চোখের উপর ধরেছে৷

‘আরে ও দাদা৷ এদিকে, এদিকে৷’

এইবার যেন দিকটা বুঝতে পারল সে৷ উপরে তাকিয়ে দেখতে পেল আমাকে৷ তাতে মুখের হাব-ভাবে অবশ্য কোনও পরিবর্তন এল না৷ আমি আগের মতোই গলা তুলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বলছি এখান থেকে নীচে যাবার কোনও রাস্তা আছে? দুটো কথা বলব আপনার সাথে৷’

সে আমার কথার উত্তর দিল না৷ তার কারণটা অবশ্য আমিও বুঝেছি৷ রেলের লাইন থেকে তাড়াহুড়ো করে সরে দাঁড়াল সে৷ লাইনটা কাঁপছে৷ অনেকটা দূর থেকে গনগনে একটা শব্দ ভেসে এসে জানিয়ে দিচ্ছে ট্রেন আসছে৷ কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা৷ তারপরেই আমাদের মাঝের রেললাইনটার উপর দিয়ে ক্ষুধার্ত দানবের মতো চলে গেল মস্ত ট্রেনটা৷ লোকটা এতক্ষণে একটা সবুজ রঙের পতাকা হাতে তুলে ধরেছে৷ যতক্ষণ না ট্রেনটা আমাদের ছাড়িয়ে চলে যায় ততক্ষণ সেটাকে নাড়াতে লাগল সে৷ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় খাড়াইয়ের গা বেয়ে একটা পথ দেখিয়ে দিল৷ দেখলাম সত্যি সাপের মতো একফালি আঁকাবাঁকা রাস্তা সেখানে আছে বটে৷ আমি বিনা বাক্যব্যয়ে সেটা ধরে নেমে আসতে লাগলাম নীচের দিকে৷

ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ার শহরের বাইরের দিকে রেল চলাচলের পথে এরকম বেশ কিছু দীর্ঘ টানেল আছে৷ ট্রেনের ভিতরের যাত্রীদের কাছে সেটা সেকেন্ড খানেকের বেশি না হলেও আসলে কিন্তু বেশ লম্বা৷ তো এই টানেল থেকে ট্রেন বেরিয়ে এলে তাকে সবুজ অথবা লাল সঙ্কেত দেখানোর জন্য থাকে একজন সিগন্যালম্যান৷ আমার কাজ হল এদের কাজকর্ম ঠিক-ঠাক চলছে কি না সেটাই ঘুরে-ফিরে দেখা৷ গোটা হ্যাম্পশায়ারের কাজ শেষ করে প্রায় ফেরারই তোড়জোড় করছিলাম৷ এমন সময় খেয়াল হল, শহরের শেষপ্রান্তে আরেকটা টানেল বাকি রয়ে গেছে৷ এ টানেলটা নতুন৷ সদ্য পাহাড় কেটে বানানো৷ গাড়ি কম যায় বলে সেদিকটায় লোকজনও প্রায় থাকে না বললেই চলে৷ টানেল যেখানে শেষ হয়েছে সেখানেই সিগন্যালম্যানের ছোট্ট হাট৷ তার খোঁজেই আপাতত আমার এখানে আসা৷

লোকটা কিন্তু এখনও আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে৷ তার বাঁ হাতটা থুতনির নীচে রাখা৷ আর সেই হাতের কনুইটা রাখা আছে ডান হাতের তালুতে৷ দেখে মনে হয় মন দিয়ে যেন কিছু ভাবছে৷ আমি সেদিকে আর না তাকিয়ে নীচে নেমে এলাম৷ রেললাইনের দু-পাশ দিয়ে পাথুরে মাটি সোজা উঠে গেছে৷ যেদিকের খাড়াইতে এতক্ষণ আমি দাঁড়িয়েছিলাম তার উল্টো দিকেই কাঠের একফালি ঘর৷ সিগন্যালম্যানের ঘর৷ টানেল শেষ হবার ঠিক মুখে লাল রঙের একটা আলো জ্বলছে৷

আমি নীচে নেমে আসতে লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে একবার শুকনো হাসি হাসল৷ মনে হল যেন আমি আজ এই সময়ে খাড়াইয়ের উপরে ঠিক ওই জায়গাটাতেই এসে উপস্থিত হব সেটা সে আগেই জানত৷ একবার আড়চোখে তার কুটিরের দিকে তাকিয়ে নিলাম৷ কাঠের বেশিরভাগ জায়গাতেই ফুটোফাটা হয়ে শ্যাওলা জমে আছে৷ তার ফাঁক দিয়েই মনে হল ভিতরে সাদা রঙের আলো জ্বলছে৷ চারপাশে পুরনো স্যাঁতসেঁতে মাটির গন্ধ৷ শরীরটা কেমন যেন শিরশির করতে লাগল৷ চেনা-জানা পৃথিবীর থেকে বেশ খানিকটা বাইরে এসে পড়েছি৷

আমি তার কাছে এসে পড়তে আমার থেকে দু-পা সরে দাঁড়াল সে৷ চোখ দুটো কিন্তু স্থির হয়ে আছে৷ টানেলের মুখের লাল আলোটার দিকে তাকাল একবার৷ কেমন যেন অজানা ভয়ের রেখা দেখা দিল তার মুখে৷ আমি সেটা লক্ষ করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার? মনে হল ভয় পেয়েছেন আমাকে দেখে?’

লোকটা ইতস্তত মাথা নাড়াতে-নাড়াতে বলল, ‘কী জানি৷ ভাবছিলাম আগে আপনাকে দেখেছি কি না৷’

‘দেখেছেন!’ অবাক হলাম আমি, ‘কোথায়?’

‘ওই যে ওখানে—’ আঙুল দিয়ে রেল লাইনের উপরে টানেলের মুখটা দেখিয়ে দিল সে৷

আমি হাসলাম৷ ‘ধুর, কী যে বলেন! আমি আগে আসিইনি এখানে৷’

সে আরও গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমার কিন্তু মনে হচ্ছে দেখেছি৷’

আমি আর কিছু বললাম না৷ এমন নির্জন জায়গায় একা-একা থাকে লোকটা৷ ফলে এরকম ছোটখাটো মাথার গন্ডগোল হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়৷ মানুষের সাথে কথা বলার সুযোগই বা পায় কোথায়৷ অবশ্য কাজকর্ম তার তেমন বেশি কিছু নেই৷ ট্রেনের টাইম টেবিল দেখে হাতল ঘোরানো, লাল আলোকে সবুজ করা আর নিজের খাওয়া-দাওয়ার জন্য মাঝে মধ্যে শহর থেকে বাজার করে আনা৷ সত্যি কথা বলতে কী লোকটার ছোট কুটিরটা দেখে তার জন্য খানিকটা লোভ হল আমার৷ বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এমন একটা জনমানবহীন প্রান্তরে একদম একা জীবনযাপন৷ একরকম গায়ে পড়েই তার সাথে ভাব জমালাম আমি৷ খানিক কথাবার্তা এগোনোর পরে বুঝলাম কিছুক্ষণের জন্যে হলেও একটা কথা বলার মতো লোক পেয়ে খুশিই হয়েছে সে৷ সে আমন্ত্রণ জানাতে দু-জনে গিয়ে ঢুকলাম তার কুটিরের ভিতর৷ ঘরের ভিতরটা কিন্তু বেশ সাজানো-গোছানো৷ একপাশে আগুন জ্বলছে৷ তার থেকে একটু দূরেই একটা মাঝারি কাঠের টেবিল৷ তার উপরে একটা খাতায় কিছু দরকারি ফোন নম্বর আর কিছু হাবিজাবি লিস্ট৷ একখানা ল্যান্ডফোনও আছে দেখলাম৷ টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়লাম দু-জনেই৷

লোকটা সদালাপী৷ আমাকে সামনে বসিয়ে রেখে একটার পর একটা গল্প বলতে লাগল সে৷ সবই এই টানেলের মুখে সিগন্যালম্যান হিসেবে তার বাস্তব অভিজ্ঞতার মামুলি বর্ণনা৷ আমারও শুনতে খুব একটা খারাপ লাগছিল না৷ ভালো লাগছিল এই ভেবে যে আর কিছু না হোক তার এতদিনকার জমে থাকা গল্পগুলোর একান্ত শ্রোতা হতে পেরেছি৷

কথাবার্তা শেষ হলে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে-উঠতে বললাম, ‘সব মিলিয়ে আপনার তার মানে এখানে মন্দ কাটছে না৷’

লোকটাও উঠে পড়েছিল৷ আমার দিকে এক পা এগিয়ে এসে বলল, ‘হপ্তাখানেক আগে অবধি তাই ছিল৷ কিন্তু ইদানীং… একটা সমস্যা হচ্ছে স্যার৷’

‘সমস্যা বলতে? কীরকম সমস্যা?’

‘সেটা যে কী করে আপনাকে বোঝাব তাই ভেবে পাচ্ছি না৷ আপনি যদি আর একদিন আমার এখানে আসেন…’

শেষ কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল সে৷ এই প্রথম মনে হল সে আমার থেকে কিছু চাইতে সংকোচ বোধ করছে৷

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই৷ কবে আসব বলুন৷’

‘আমি তো সারাদিন এখানেই আছি৷ তবে রাতের দিকে হলে ট্রেনের ঝামেলা থাকবে না৷’

‘বেশ তাহলে কাল রাত এগারোটায় আসব৷’

সে খুশি হয়ে আমার সাথে বাইরে বেরিয়ে এল৷ এতক্ষণে বাইরেটা অন্ধকার হয়ে এসেছে৷

‘আমি আপনাকে এগিয়ে দিচ্ছি স্যার৷ হ্যারিকেন আছে আমার কাছে৷ শুধু একটা অনুরোধ আছে…’

‘হ্যাঁ বলো৷ কী অনুরোধ?’ তাকে আশ্বস্ত করলাম আমি৷

‘আমাকে ওইভাবে ওপর থেকে ডাকবেন না৷’

অদ্ভুত ঠান্ডা গলায় কথাটা বলল লোকটা৷ কী রকম যেন কৌতূহল হল আমার৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন? অসুবিধা কী আছে ডাকলে?’

‘না অসুবিধা কিছু নেই৷ তবে… ওই কথাগুলো আমি আগেও শুনেছি৷’

‘হ্যাঁ কিন্তু কী হয়েছে তাতে? আপনি নীচে ছিলেন, আমাকে দেখতে পাননি তাই ডাক দিয়েছিলাম৷’

লোকটা মাথা নামিয়ে কী যেন ভাবতে-ভাবতে বলল, ‘শুধু সেই জন্যই ডেকেছিলেন?’

‘আর কী জন্য ডাকব!’ এবার বেশ অবাক লাগতে শুরু করেছে আমার৷

‘মানে ধরুন আপনার মনে হয়নি যে-কোনও অলৌকিক উপায়ে ঠিক ওই শব্দগুলোই বললেন আপনি?’

‘অলৌকিক উপায়!’ আমার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা খেলে গেল৷ লোকটার মাথায় খানিক ছিট আছে বটে৷ ‘কই না তো…’

সে আর কথা বাড়াল না৷ আমিও রেললাইনের পাশ দিয়ে ফেরার পথ ধরলাম৷ যেতে-যেতে মনে হল যেন অনেক দূর থেকে ট্রেন আসছে৷ ঠিক বাঘ আসার আগে যেমন বনের পশুরা চঞ্চল হয় ওঠে, তেমনি চারপাশের মৃদু হাওয়াটাও যেন দুলে উঠছে বারবার৷ লাইন থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা হোটেল ভাড়া করে আছি আমি৷ সেখানেই ফিরব আপাতত৷

পরদিন রাত ঠিক এগারোটায় সিগন্যালম্যানের কুটিরের সামনে উপস্থিত হলাম আমি৷ সে বাইরেই আলো হাতে অপেক্ষা করছিল৷ আমি নিঃশব্দে নীচে নেমে এসে একগাল হেসে বললাম, ‘আজ কিন্তু ডাকিনি৷’ তারপর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এবার কথা বলা যায়?’

‘নিশ্চয়ই স্যার৷ আসুন ভিতরে আসুন৷’

ঘরটা কালকের থেকে খুব একটা পাল্টায়নি৷ আগের মতো লাল আলো জ্বলছে৷ চেয়ারগুলোও কালকের মতোই রাখা আছে৷ তার উপরে আবার বসে পড়লাম দু-জনে৷ সে আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে পরে নীচু গলায় বলল, ‘আপনাকে আজ যা বলব তা আগে কাউকে বলিনি৷ সত্যি বলতে বলার মতো লোকই বা পেলাম কোথায়?’ বলে সে দু-দণ্ড থেমে আবার বলল, ‘কাল বিকেলে আমি আপনাকে অন্য কেউ ভেবে ভুল করেছিলাম৷’

‘অন্য কেউ ভেবেছিলে? কে?’

‘তা জানি না৷ তার মুখ দেখিনি আমি৷ তার বাঁ হাতের কনুইটা চোখের উপর রাখা থাকে আর ডান হাতটা সজোরে নাড়াতে থাকে আমার দিকে৷’

কথাগুলো বলতে-বলতে সেও একইভাবে চোখ ঢেকে হাত নাড়াতে লাগল৷ তার হাবভাব দেখে কেমন যেন ভয় লাগল আমার৷ মাথা নামিয়ে নিলাম৷ এই ঘরের ভিতরে আলো কম৷ বাইরেও ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ নিস্তব্ধতার মাঝে আমাদের নিঃশ্বাস যেন ক্ষীণ প্রতিধ্বনির জন্ম দিচ্ছে৷ আগের মতোই মৃদুস্বরে বলতে লাগল সে—

‘সেদিন ছিল পূর্ণিমা৷ এখানেই বসেছিলাম আমি৷ হঠাৎ মনে হল দূর থেকে কেউ যেন চিৎকার করছে৷ ‘ও দাদা! শুনছেন, এদিকে, এদিকে…’ আমি বাইরে বেরিয়ে মুখ তুলে দেখি টানেলের লাল আলোটার কাছে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে৷ খুব আবছা তাও বোঝা যায় ফুট ছয়েক লম্বা একটা মানুষ৷ মুখ চোখ অস্পষ্ট৷ যেভাবে এক্ষুনি দেখালাম সেভাবে হাত নাড়ছে৷ ক্রমাগত চিৎকার করেই চলেছে ‘তাকাও, তাকাও এদিকে… আমি আলোটা বাগিয়ে ধরে ছুটে গেছিলাম সেদিকে৷ কাছেও এসে পড়েছিলাম৷ এমন সময় দেখলাম সে নেই৷’

‘নেই মানে? টানেলের ভিতরে ঢুকে গেল?’

‘না৷ তা হতে পারে না৷ আমি প্রায় একশো মিটার দৌড়েছিলাম টানেলের ভিতর দিয়ে৷ সেখানে কেউ ছিল না৷ তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকে দেখতে পাইনি৷ শেষে ঘরে ফিরে এসে হেড অফিসে ফোন করেছিলাম কোনও গন্ডগোল হয়েছে কি না জানতে৷ তারা বলল কিছুই হয়নি৷’

ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দিলাম না আমি৷ বললাম, ‘রাতের দিকে এখানটা যা অন্ধকার দেখছি তাতে চোখের ভুল দেখাটা মোটেই আশ্চর্যের কিছু না৷ আর চারপাশে গাছপালার জঙ্গলে রাতের হাওয়া ধাক্কা খেয়ে অমন মানুষের চিৎকারের মতো শোনাতেই পারে৷’

ধীরে-ধীরে মাথা নাড়াল লোকটা৷ তার গল্প এখনও শেষ হয়নি৷

‘এই ঘটনার ছ-ঘণ্টার মধ্যে লাইনের উপরে একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে৷ ট্রেনে কাটা পড়া একটা লাশ উদ্ধার হয় ঠিক ওই সিগন্যালের মুখ থেকেই৷’

এই প্রথম বরফের মতো ঠান্ডা একটা চোরাস্রোত খেলে গেল আমার মেরুদণ্ড দিয়ে৷ অথচ ব্যাপারটা বিশ্বাস করতেও মন চাইল না৷ দুর্ঘটনাটাকেও কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় বটে৷ কিন্তু একসাথে একই জায়গায় একই মানুষের চোখে এতগুলো কোইন্সিডেন্স পরপর ঘটবে সেটা মেনে নেওয়াও মুশকিল৷ কথাগুলো বলার পর সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল৷ ঘড়ির দিকে তাকালাম আমি৷ রাত প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে৷

‘এটা প্রায় বছর খানেক আগের কথা৷ তারপর ছ-মাস কেটে গেছে৷ ঘটনাটার কথাও প্রায় ভুলেই গেছি আমি৷ একদিন, তখনও ভোরের আলো ফোটেনি, আমি এই দরজার কাছেই দাঁড়িয়েছিলাম৷ হঠাৎ ওই লাল আলোটার দিকে তাকিয়ে তাকে আবার দেখতে পেলাম৷’ এবার আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল সে৷ দৃষ্টি স্থির৷

‘আগের মতো চিৎকার করছিল?’

‘না৷ কোনো শব্দ করেনি৷ চুপ করে আলোর উল্টোদিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল৷’

‘হাত নাড়ায়নি?’

‘না৷ শুধু হাত দুটো মুখের সামনে জড়ো করে মুখ ঢেকেছিল৷ এইভাবে—’ প্রবল দুঃখ-যন্ত্রণা বা হতাশায় আমরা যেভাবে মুখ ঢেকে ফেলি অনেকটা সেইভাবে মুখ ঢাকল লোকটা৷

‘তুমি তার দিকে এগিয়ে যাওনি?’

‘আমি ঘরে ফিরে এসে বসে পড়েছিলাম৷ প্রথমে মনে হয়েছিল আবার চোখের ভুল দেখছি৷ উঠে গিয়ে আবার যখন সেদিকে তাকালাম আর দেখতে পেলাম না তাকে৷’

কীরকম যেন একটা সন্দেহ দানা বাঁধছিল আমার মনে, জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ ঘটনার পরে আর কিছু ঘটেনি?’

‘সেদিনই বিকেলে একটা ট্রেন টানেল থেকে বের হয়ে আসছিল৷ আমিও আনমনে পতাকা দোলাচ্ছিলাম৷ হঠাৎ খেয়াল হল একপাশের জানলা দিয়ে কার যেন একটা মাথা বেরিয়ে আছে৷ সাথে একটা হাতও৷ আতঙ্কে শিউরে উঠলাম আমি৷ একজন মহিলা৷ মনে হল বেঁচে নেই৷ আমি দৌড়ে গিয়ে ট্রেন থামানোর সিগন্যাল করলাম৷ ড্রাইভার ব্রেক কষল৷ ট্রেনটাও ততক্ষণে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছে৷ আমি দৌড় দিলাম সেদিকে৷ কিছুক্ষণ পরে তল্লাশি করে দেখা গেল ট্রেনেরই একটা কম্পার্টমেন্টে এক মহিলা খুন হয়েছেন৷ লোকজন মৃতদেহটা ধরাধরি করে নিয়ে এল এখানে৷ আমার ঘরের এই মেঝেতেই পড়েছিল সেটা৷’

আড়চোখে আমি একবার মাটির দিকে তাকালাম, সেখানটা এখন ফাঁকা৷

‘ঠিক যেমনটা ঘটেছিল তাই বললাম আপনাকে৷’

এবার আর কী বলব বুঝতে পারলাম না আমি৷ গলাটাও শুকিয়ে এসেছে মনে হয়৷ এতক্ষণ ধরে গল্প শুনতে-শুনতে সেদিকে খেয়ালই পড়েনি৷

‘তারপর থেকেই সারাক্ষণ কেমন যেন ভয় করে আমার৷ মনে হয় খারাপ কিছু হবে৷ সপ্তাহখানেক হল তাকে রোজই দেখতে পাই আমি৷’

‘রোজ দেখতে পাও?’ আমার এতক্ষণের শিরশিরানি ভয়টা একলাফে হৃৎপিণ্ডের কাছে উঠে এল৷ ‘ওই আলোটার কাছেই?’

‘হ্যাঁ৷ ওই লাল আলোটার কাছে৷’

‘দেখে কী করছে বলে মনে হয়৷’

‘ওই যে আপনি যা বলেছিলেন৷ বলে ‘দাদা শুনছেন৷ এদিকে সরে যান, সরে যান ওখান থেকে…’, বলে ওইভাবে হাত নাড়াতে থাকে৷ আমার ঘরের অ্যালার্মটাও যেন বাজতে থাকে ঠিক সেই মুহূর্তে৷’

হঠাৎ একটা কথা মাথায় আসতেই তাকে থামিয়ে দিলাম আমি, ‘তার মানে কাল আমি যখন তোমাকে ডেকেছিলাম, তখনও তোমার অ্যালার্ম বাজছিল?’

‘হ্যাঁ৷’

এবার আমার মুখে স্বস্তির হাসি খেলে গেল৷ বললাম, ‘দেখ কাণ্ড৷ আমার স্পষ্ট মনে আছে কাল যে সময়ে আমি তোমাকে ডেকেছিলাম ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার ঘরের টেলিফোনটা বাজছিল৷ সেটাকেই তার মানে অ্যালার্ম ভেবে ভুল করেছ তুমি?’

সে কিন্তু আশ্বস্ত হল না৷ মাথা নাড়াতে-নাড়াতে বলল, ‘তা কী করে হয়! টেলিফোনের রিঙের আওয়াজ আর অ্যালার্মের শব্দ আমি এত বছর ধরে শুনছি… দুটো গুলিয়ে ফেলব!’

বুঝলাম আমার ব্যাখ্যায় সে শান্ত হবে না৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা কাল যখন তাকিয়েছিলে তাকে দেখতে পেয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ৷ দেখেছিলাম৷’

আমি এক মুহূর্তে উঠে দাঁড়ালাম৷ মনে এতক্ষণ ধরে জমা হতে থাকা কৌতূহলগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে৷ দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘চল তো দেখি৷ এখন দেখা যায় কি না৷’

প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে উঠে দরজার ঠিক বাইরে আমার পাশে এসে দাঁড়াল৷ দূরে সিগন্যালের লাল আলোটা জ্বলছে৷ সেই আলোর আভা ছড়িয়ে রয়েছে টানেলের মুখটায়৷ সেখানে কাউকে এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না৷

‘দেখতে পাচ্ছ এখন?’

‘না৷’

‘হুম…’

দরজা বন্ধ করে আবার ঘরের ভিতরকার চেয়ারে এসে বসলাম আমরা৷ সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে এখনও পরিষ্কার নয়৷ ব্যাপারটা যদি অলৌকিকও হয় তাহলেও ব্যাখ্যা নেই কোনও৷ ছায়ামূর্তিটা দেখার পরেই দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে৷ কিন্তু তার উদ্দেশ্যটা কী? কে সে?

আমাকে চিন্তান্বিত দেখে সে নিজেই বলল, ‘লোকটা কে হতে পারে বলুন তো?’

আমি খানিকের জন্য তার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম, ‘তার থেকেও বড় প্রশ্ন হল মুখ দিয়ে ওই ক-টা শব্দ করে, ঠিক ওইভাবে হাত নেড়ে সে কিসের সঙ্কেত দিতে চায়? কী বিপদ আসতে চলেছে? আগের দু-বার তার পূর্বাভাস মিথ্যে হয়নি৷ এবারও হবে বলে তো মনে হয় না৷’

সে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল৷ ‘এবার আমি কী করি বলুন তো? হেড অফিসে গিয়ে যদি এইসব কথা জানাই তবে তারা আমায় পাগল ভাববে৷ বলবে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে৷ কী জানি হয়তো ইস্তফাও দিতে বলবে৷ আমি গরিব মানুষ স্যার৷ কাজ গেলে না খেয়ে মরব৷’

কথাগুলো শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল৷ এ ধরনের অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার সামর্থ্য লোকটার নেই৷ সে পাকেচক্রেই এর মাঝে এসে পড়েছে৷ এর থেকে বোধহয় তার নিরিবিলি একঘেয়ে জীবনই বেশি পছন্দের ছিল৷ সে বলে চলল, ‘মাঝে-মাঝে মনে হয় সব কিছু যদি সে আমায় বলে দিত তাহলেই আর সমস্যা থাকত না৷ যেমন ধরুন দুর্ঘটনাটা কোথায় ঘটবে, কীভাবে ঘটবে৷ অথবা কীভাবে এড়ানো যাবে সেটা৷ সেসব কিছু নয়, শুধু চোখ ঢেকে হাত নাড়াতে থাকে৷ অর্থাৎ কিছু একটা ঘটবে৷ এখন আমি এসব জেনে কী করব বলুন তো?’

আমি তার কাঁধে একটা হাত রেখে বললাম, ‘তোমার সমস্যাটা আমিও বুঝতে পারছি৷ কিন্তু মুশকিল কী জানো তো, তোমাকে এখান থেকে বদলি করতে গেলে আমাকে কিছু কারণ দেখাতে হবে৷ সেটাই যে কী দেব বুঝতে পারছি না৷’

এইবার একটা বড়সড় হাসির রেখা ফুটে উঠল তার মুখে, ‘বদলি করতে হবে না স্যার৷ এখানে আমি চোখ বুজে থাকলেই হল৷ লোকটা ভূত হোক আর যাই হোক, আমার কোনও ক্ষতি তো করছে না৷’

‘তুমি সত্যি বদলি হতে চাও না?’

সে আগের থেকে আরও জোরে মাথা নাড়ল৷ তারপর আমার দিকে আরও খানিকটা এগিয়ে এসে কিছুটা নীচু গলায় বলল, ‘আপনাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি…’

‘কী কথা বল তো?’

তার মুখে একটা রহস্যের হাসি খেলে গেল, ‘খাড়াইয়ের এইদিকে পুরনো ট্রেনের একটা ভাঙা অংশ পড়ে আছে৷ কাল সকালের দিকে আসলে তার ভিতরে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখাতে পারি আপনাকে৷’

‘কী জিনিস বল তো?’

‘উঁহু৷ এখন না৷ কাল দেখাব৷’

আমি মাথা নাড়লাম, ‘কাল তো একটু কাজ আছে৷ পরশু আসতে পারি৷’

‘বেশ৷ তাই আসুন৷’

আজও আমাকে লাইন পর্যন্ত এগিয়ে দিল সে৷ বেরনোর সময় আমার চোখ লাল আলোটার দিকে নিজে থেকেই চলে গেল৷ তারপরেই সিগন্যালম্যানের মুখের দিকে৷

‘শুভরাত্রি স্যার৷’

‘হ্যাঁ শুভরাত্রি৷’

দু-দিন ধরে কাজের ব্যস্ততায় লোকটার কথা ভুলেই গেছিলাম৷ আজও মনে ছিল না৷ সকালবেলা মেন রোড দিয়ে যেতে-যেতে খানিকদূরে খাড়াইটা যেখানে লাইনের উপর নেমে গেছে সেই খাদটা চোখে পড়ল৷ কী মনে হতে এগিয়ে গেলাম সেদিকে৷ হাঁটতে-হাঁটতে টানেলটা চোখে পড়ল৷ সাথে সিগন্যালম্যানের সেই কুটিরটাও৷ আজ কিন্তু বহু লোকজনের সমাগম হয়েছে সেখানে৷ শুধু সিগন্যালম্যানকে দেখা গেল না৷ কৌতূহল হতে নীচে নেমে এলাম আমি৷ সামনেই হর্তাকর্তা গোছের একটা লোককে চোখে পড়ল৷ বুকে রেল কোম্পানির লোগো৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে দাদা? এত ভিড় কেন এখানে?’

লোকটা বিরক্ত হয়ে মাথা দুলিয়ে বলল, ‘আর বলবেন না৷ এই লাইনের সিগন্যালম্যান রেলে কাটা পড়েছে৷’

একটা আকস্মিক যন্ত্রণার স্রোত আমার সারা শরীর অসাড় করে দিল৷ কোনওরকমে উচ্চারণ করলাম, ‘কী… কীভাবে কাটা পড়ল?’

‘তা কী জানি মশাই! লোকটা কালা আর অন্ধ দুটো একসাথে ছিল এমন তো জানতাম না৷ অথচ ট্রেন আসার সময় সে নাকি ঠায় লাইনে দাঁড়িয়েছিল৷’

‘টানেল থেকে ট্রেন বেরিয়ে আসতে দেখেও সরেনি?’

‘না৷ যে ছোকরা ট্রেন চালাচ্ছিল তার সাথে আমি নিজে কথা বলেছি৷ লোকটাকে লাইনের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ড্রাইভার ব্রেক চাপে৷ সাথে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘সরে যান, সরে যান, ওখান থেকে সরে যান৷ ও দাদা সরে যান…’ কিন্তু কিসের কী! সে লোকটা একইভাবে সেইদিকে তাকিয়েছিল৷ শেষে মৃত্যু অনিবার্য দেখে ড্রাইভার হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে৷ লোকটাকে চাকার তলায় পিষে দিয়ে তবে থামে ট্রেনটা৷’

আমার আর এসব শুনতে ভালো লাগছিল না৷ ধীর পায়ে লাইনের একদিকে সরে এলাম৷ কিছু অদ্ভুত চিন্তা মাথার ভিতর খেলা করছে৷ ব্রেক কষার ঠিক আগে যে কথাগুলো বলে ড্রাইভার চিৎকার করছিল তার সাথে সিগন্যালম্যানের দেখা সেই ছায়ামূর্তির কোথাও একটা অদ্ভুত মিল আছে৷ তারও দু-হাতে মুখ ঢাকা ছিল৷ সেও হাতদুটো প্রবল বেগে নাড়ছিল সামনের দিকে৷ তবে কি দু-সপ্তাহ ধরে নিজের মৃত্যুসঙ্কেতই ঘুরে-ফিরে আসছিল তার চোখের সামনে! মনে পড়ল কাছেই একটা ভাঙা ট্রেনের পরিত্যক্ত বগিতে কী যেন দেখাবে বলেছিল সে৷ আমার আর সেটা দেখতে ইচ্ছা করল না৷ আমার পায়ের পাশেই লাইনের ধার জুড়ে লাল রক্তের দাগ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে৷ এও কি তবে কিছুর সঙ্কেত? মুখ তুলে তাকালাম আমি৷ টানেলের ঠিক মুখেই একটা আলো জ্বলছে৷ বিপদসংকেত৷ লাল… টকটকে লাল রং…

অনূদিত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *