দ্য লরেলস

দ্য লরেলস

বাড়িটাকে কোনোদিনই পছন্দ হয়নি আমার। আজ যখন বাড়িটার কথা ভাবছি তখনো মনে হচ্ছে না অ্যান কোনোদিন বাড়িটাকে পছন্দ করতে পেরেছে। তবে বাড়িটা মোটামুটি ভালোই, যদিও প্রথম দিনেই আমরা দুজনই সেখানে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করেছি।

সেটা ছিল আগস্ট মাসের উজ্জ্বল একটি দিন। আগের সপ্তাহে আমরা অন্তত কুড়িটা বাড়ি দেখেছি। তখন আমরা সুসজ্জিত একটি ফ্ল্যাটে থাকতাম; আর নিজস্ব একটি আলাদা বাড়ির খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরেছিলাম। খুব বেশি টাকা খরচ করার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। বাড়িটা দেখেই মনে হলো, এজেন্ট ভদ্রলোক বাড়িটার দাম বলতে গিয়ে নিশ্চয় ভুল করেছে। অন্তত বাইরেটা দেখলে মনে হয় বাড়ির দাম যা চাওয়া হয়েছে তার চেয়ে বেশি হওয়াই উচিত।

বললাম, ‘বাড়িটা বেশ ভালোই, তবে ছাদটা যেন কেমন দেখতে।’

অ্যান সন্দিগ্ধ গলায় বলল, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। দেখতে তো ভালোই লাগছে। যদিও বাড়িটা এমন ‘সাধারণ’ না হলেই ভালো হতো।’

বাড়িটা সত্যি সাধারণ। ২৬ নম্বর ব্রায়ারফিল্ড অ্যাভেনিউ-এর বাড়িটা শহরতলির অন্য সব বাড়ির মতোই; সামনে টিউডর আমলের নকল পাশকপালি লাগানো আর ঢালাই-লোহার একটি বিশ্রী ফটক। কোনো গ্যারেজও নেই। অবশ্য এটুকু ছাড়া বাড়িটার আর তেমন দোষ চোখে পড়ল না।

অ্যান বলল, ‘পাশের বাড়িটা কিন্তু অনেক বেশি সুন্দর। ঠিক আমার মনের মতো। বিচলিত বোধ করলাম। ২৬ নম্বর বাড়ির অন্য অংশটাই ২৪ নম্বর। দুটো বাড়ি মোটামুটি একই রকমের।

অ্যান বলল, ‘না, না, ওটা নয়। ওই পাশের বাড়িটা।’

ও পাশের বাড়িটা এখানকার সাদামাটা পরিবেশের তুলনায় সত্যি অনেক আকর্ষণীয়। ভিক্টোরীয় ছাদের গঠন, লম্বা জানালা, গম্বুজ। বাগানের গাছগুলো অযত্নে বেড়ে উঠেছে। দেখলেই বোঝা যায় বাড়িটা অনেক দিন খালি পড়ে আছে।

‘হ্যাঁ, খুব সুন্দর। তবে বড্ড বড়। মেরামত করতে অনেক টাকা ঢালতে হবে।

অ্যান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ।’ ও গাড়ি থেকে নামল। ‘বেশ তো, ২৬ নম্বর বাড়িটাই দেখা যাক।’

যে লোকটি ফটক খুলে দিল সে আমার বয়সী; ফ্যাকাশে চেহারা, চোখে চশমা, গায়ে সবুজ কার্ডিগান। মনে হলো আমার বাড়িয়ে দেয়া হাতটা সে দেখতেই পায়নি, অথবা দেখতে চায়নি। বলল, ‘আমার নাম ট্যাপলো। আর আপনি নিশ্চয়ই-’

‘ডেভিড টার্নার। ইনি আমার স্ত্রী।’

‘ঠিক আছে। ভেতরে আসুন।’

হলে ঢুকলাম। অ্যান আবহাওয়া সম্পর্কে কী যেন বলল, কিন্তু ট্যাপলো তার দিকে ফিরেও তাকাল না। হঠাৎ বলে বসল, ‘বাড়িটা ভালো। মনে হয় আপনাদের পছন্দ হবে। এটা বৈঠকখানা।’

এক জোড়া মেষের মতো ট্যাপলোর সঙ্গে বাড়িটা ঘুরে দেখলাম। ভেতরটা বাইরের মতো নিতান্ত সাধারণ। খুব সম্প্রতি কিছুটা সাজানো হয়েছে। ট্যাপলোই বলল ওয়্যারিংটা নতুন। আসবাবপত্র এবং কার্পেট নতুন বলেই মনে হলো। অ্যানের মুখ দেখেই বলে দেয়া যায় বাড়িটা দেখে সে মোটেই খুশি হয়নি, কিন্তু আমার কাছে বেশ ভালোই লাগল, আর বেশ সস্তাও বটে। দামটা যদি ঠিকঠাক বলা হয়ে থাকে এবং বাড়িটার যদি গোপন কোনো ত্রুটি না থাকে, তাহলে কথাটা পাকা করে ফেলাই ভালো। দরকার হলে পরে আমরা এটা বিক্রি করে দিয়ে একটা আধুনিক প্যাটার্নের বাড়ি কিনতে পারব।

রান্নাঘরে পৌঁছে আমাদের যাত্রা শেষ হলো। ট্যাপলো আমার দিকে ফিরে বলল, ‘দামটাও ন্যায্য বলেই আমার ধারণা। আপনাকে খোলাখুলিই বলছি, বাড়ি বিক্রির ব্যাপারটা আমি তাড়াতাড়ি চুকিয়ে ফেলতে চাই।’ আমার চোখে-মুখে নিশ্চয়ই একটা সন্দেহ ঝিলিক দিয়েছিল, কারণ সে তখনই বলে উঠল, ‘বাড়িটার যে কোনো সমস্যা আছে তা কিন্তু নয়। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমরা-আমি মাত্র ছয় মাস এ বাড়িতে বাস করেছি, আর বাড়িটা তৈরি করাও হয়েছে বেশ মজবুতভাবে। প্রতিবেশীরাও ভদ্র। রাস্তাটাও ভালো। এটা একটা আদর্শ বাড়ি।’

বুঝলাম অ্যানের আগ্রহ বেড়েছে। বাড়িটা তাকে খুশি না করুক, ট্যাপলো করেছে। তার স্বভাবই ওইরকম; কোনো বস্তুর চাইতে মানুষের প্রতি টান বেশি।

ট্যাপলো তার সহানুভূতিটা ধরতে পারল। একটু কেশে বলল, ‘কয়েক সপ্তাহ আগে আমার স্ত্রী মারা গেছেন। স্মৃতি বড়ই বেদনাদায়ক… কাজেই বুঝতেই পারছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই।’ একটু থেমে যোগ করল, ‘ঠিক আছে। তাহলে ওই কথাই রইল। ভালো কথা, ওই দামের মধ্যেই কার্পেটগুলো পাচ্ছেন। আর রাতে ব্যবহারের জন্য হিটারগুলোও।’

আমি পরিষ্কার বলে দিতে পারি, ট্যাপলোর স্ত্রীর কথা জানবার জন্য অ্যানের মন উশখুশ করছে। সংকোচের সঙ্গেই সে প্রশ্ন করল, ‘অনেক- অনেকদিনের অসুখ বুঝি?’

‘কী বললেন? না, না, মোটেই তা নয়। খুবই আকস্মিক-অপ্রত্যাশিত।’ এই প্রথম তার মুখে হাসি দেখলাম। জোর করা হাসি, তবু হাসি তো বটে। ‘তিনি এ বাড়িতেও মারা যাননি, আপনারা সে ভয় করবেন না। বাড়িটা ভুতুড়েও নয়।’ সে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠল ‘এটা ভুতুড়ে বাড়ি নয়।’

এবার অ্যানের বিচলিত হবার পালা। কষ্টে হাসি হেসে সে জানালার কাছে গেল। বলল, ‘আরে, দেখ, বাগানটা দেখ। বাগানের কথা তো আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।’

ট্যাপলো বলল, ‘ভুলটা আমারই। সেজন্য ক্ষমা চাইছি।’ পেছনের দরজাটা খোলা হলো। তার পেছন পেছন আমরাও বাইরে গেলাম।

বাগানটা লম্বা ও সরু এবং বাড়িটার মতোই সাধারণ। লনটার দিকে এখনই নজর দেওয়া দরকার। একেবারে শেষ প্রান্তের সব্জি বাগানটার অবস্থাও তথৈবচ। অ্যানের খুব বাগানের শখ। তাই আমি ট্যাপলোকে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম, আর সে বাগানে ঘুরে বেড়াতে লাগল। একটা ওষধি গাছের সারি সে খুব ভালো করে দেখছে।

ট্যাপলো বলল, ‘এখানে একটা ভালো বাগান করার পরিকল্পনা আমাদের ছিল, কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।’

‘করলে ভালোই হতো,’ কথার পিঠে কথা বললাম।

‘খোলা হাওয়ায় খাবারের স্বাদই বেড়ে যায়,’ মন্তব্য করল ট্যাপলো। আমাদের কথা আর তেমন এগোল না। অ্যানের দিকে তাকালাম। সে বাগানের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের গম্বুজওয়ালা ভিক্টোরীয় বাড়িটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ। তার দীর্ঘ চুলের রাশি সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে।

বললাম, ‘ওই বাড়িটা আমার স্ত্রীর বেশ পছন্দ হয়েছে। ওটা তো খালি, তাই না?’

ট্যাপলো জবাব দিল না। সে তাকিয়ে আছে অ্যানের দিকে। তার মুখে একটা অদ্ভুত ভঙ্গি।

আবার শুধালাম, ‘ওই বাড়িটা। ওটা কি খালি?’

ট্যাপলো আমার দিকে মুখ ফেরাল। ‘ওই বাড়িটা? হ্যাঁ, ওটা খালি।’ একটু কেশে তাড়াতাড়ি বলল, ‘আপনার স্ত্রীর ভেতরে আসা উচিত। বেশ ঠান্ডা পড়েছে…’ সে থামল। মৃদু হাসল। আগস্টের রৌদ্রস্নাত দিনে মোটেই ঠান্ডা ছিল না। সে আবার বলল, আমি দুঃখিত। আপনি যেন কী বলেছিলেন? ও, হ্যাঁ, বাড়িটার কথা। কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছেন, দেয়ালটা খুবই উঁচু; তাছাড়া বাড়িটা শিগগিরই ভেঙে ফেলা হবে; নতুন বাড়ি বানানো হবে।’

ট্যাপলো বলতে লাগল, ‘অবশ্য তাতে কোনো ক্ষতি হবে না। আধ ডজন আধুনিক ধরনের বাড়ি তৈরি হবে বা ওই রকমই একটা কিছু। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়েই সবকিছু করা হবে।’ তার চেহারা আগের মতোই নির্বিকার।

আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। অ্যান তখনো পাশের বাড়িটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করলাম। মনে হলো, দোতলার একটা জানালার দিকে সে তাকিয়ে আছে। জানালাটা বেশ বড়; বড় কাচের ছোট ছোট টুকরো দিয়ে অদ্ভুত একটা বর্ডার টানা হয়েছে। উল্লেখ করার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ল না।

ডাকলাম, ‘অ্যান! এবার আমাদের ফিরতে হবে।’

একটু নীরবতা। তারপর অ্যান প্রথমে ধীর পায়ে, তারপর দ্রুত পদক্ষেপে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। তাকে বিচলিত দেখাচ্ছে। সে এলে বললাম, ‘এবার আমাদের যেতে হবে। এমনিতেই মি. ট্যাপলোর অনেক সময় নষ্ট করেছি।’

‘মোটেই না,’ ট্যাপলো বলল। সে একদৃষ্টিতে অ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে।

অ্যান শুধাল, ‘পাশের বাড়িটাতে কেউ থাকে কি? আমি জানি ওটা খালি, কিন্তু—’

‘কিন্তু কী?’ ট্যাপলো বলল।

অ্যান হাসল। ‘জানালায় কাকে যেন দেখলাম। কে যেন জানালায় দাঁড়িয়েছিল আর সেই মহিলা-’

‘মহিলা?’ ট্যাপলো বলল। ‘আপনি বলছেন মহিলা?’

অ্যান তার দিকে তাকাল। ‘না, অবশ্য এটা আমার কল্পনাও হতে পারে। বাড়িটা তো খালি। একতলার জানালাগুলো কাঠ মেরে আটকে দেয়া হয়েছে। তবু–’

আমি বললাম, ‘হয়তো কোনো ভবঘুরে হবে। অথবা কোনো অনধিকার প্রবেশকারী, ওরকম খালি বাড়িতে লোকজন ঢুকে পড়তেই পারে।’

ট্যাপলো বলল, ‘না। দরজাগুলো তক্তা দিয়ে এঁটে দেয়া হয়েছে। কেউ ঢুকতে পারবে না। ‘

অ্যান বলল, ‘তাহলে তো মিটেই গেল। হয়তো চোখে ভুল দেখেছি।

‘ঠিক তাই।’ বলে ট্যাপলো হঠাৎ মুখ ঘোরাল। আমরাও তাকে অনুসরণ করে বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। হল থেকেই আমরা বিদায় নিলাম। বলে এলাম বাড়ির ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই আমরা এজেন্টকে জানিয়ে দেব। গাড়িতে ওঠার আগে অ্যান একটি কথাও বলল না।

তারপর বেশ জোর দিয়েই বলল, ‘একটা কিছু আমি নিশ্চয় দেখেছি। জানালায় কেউ একজন ছিল।’

আমি অস্বস্তি বোধ করলাম। ‘বেশ তো, তুমি না হয় জানালায় কাউকে দেখেছ। তাতে কী হলো? বাড়িতে কেউ ছিল, ব্যস মিটে গেল।’

অ্যান আবার বলল, ‘একটি মেয়েকে দেখেছি। সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।’

আমি তার দিকে ঘুরে তাকালাম। ‘আচ্ছা, এটাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছ কেন? অ্যান ভুরু কুঁচকে বলল, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না। কিন্তু-না, ও কিছু না। তুমি ঠিকই বলেছ। এটা মোটেই গুরুতর কিছু নয়।

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তা কেন হবে? তুমি নিশ্চয়ই এটাকে গুরুতর মনে করছ। তা না হলে কথাটা বলতেই না।’

‘বাদ দাও। এখন বাড়ি চলো।’

আমি কঠিন গলায় বললাম, ‘তুমি যতক্ষণ এ ব্যাপারে জানালার ওই মেয়েটির ব্যাপারে সব কথা না বলছ, ততক্ষণ আমি যাব না।’

‘আমার কথা তুমি বিশ্বাস করবে না।’

‘আগে তো বলো। তারপরে দেখা যাবে।’

অ্যান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘বেশ, তাহলে শোনো। মেয়েটি দেখতে একদম সাদামাটা। লাল চুল। কিন্তু মুখটা…’ অ্যান শিউরে উঠল। ‘বেশ ঠান্ডা পড়েছে, তাই না?’

তার হাতে হাত রাখলাম। ‘মোটেই ঠান্ডা পড়েনি। কথা ঘুরিয়ো না। মুখের কথা কী বলছিলে?’

‘মুখ-মুখটা বিবর্ণ, সন্ত্রস্ত। তার চোখ…সে যেন আমাকে কিছু বলতে চাইছিল। মনে হলো-দেখ, আমি হলফ করে বলতে পারি, সে আমার কাছে সাহায্য চাইছিল। সাহায্যের জন্য মিনতি জানাচ্ছিল। কোনো কিছু থেকে তাকে উদ্ধার করতে বলছিল।’ অ্যান মাথা নাড়ল। ‘হয়তো এসবই আমার কল্পনা। কিন্তু তাকে এমন মরিয়া লাগছিল…’

কী বলব বুঝতে পারছি না। অ্যান সেরকম কল্পনাপ্রবণ মেয়ে নয়। আমার বিশ্বাস সে জানালায় কাউকে দেখেছে, কিন্তু বাকিটা….। ট্যাপলো বলেছে বাড়িটা খালি, আর দরজা ভেঙে কেউ বাড়িটাতে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু বাগানে তার আচরণও তো খানিকটা বেখাপ্পা ছিল।

হালকাভাবে বললাম, ‘রোদে তোমার ভিরমি লেগেছে।’

ঠাট্টাটা কাজে লাগল না। অ্যান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।

‘জানতাম তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কাজেই এসব ভুলে যাওয়াই ভালো। ধরে নাও এরকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ঠিক আছে?’

‘অ্যাজ ইওর উইশ।’ আমি অস্বস্তির সঙ্গে বললাম।

অ্যান বলল, ‘বেশ। এসব কথা আমরা ভুলেই যাব। এবার বাড়ি চলো। আমার একটু ড্রিংক দরকার।’

মদ্যপান আমারও প্রয়োজন। গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিলাম। চললাম নিজ আবাসে।

বাড়ি ফিরে বাড়িটা নিয়ে অনেক কথা হলো। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, বাড়িটা কেনা হবে। যদিও বাড়িটা আমাদের কারোরই খুব পছন্দ নয়, তবু দাঁওটা হাতছাড়া করতে চাই না। দরকার হলে পরে আর একটা ভালো বাড়ি কিনে নেব।

নতুন বাড়িতে প্রথম কয়েকটা সপ্তাহ কোনো অঘটন ঘটল না। বাড়িতে নতুন করে কিছু করারও ছিল না। কেবল ঘরের যে রঙের পরিকল্পনা ট্যাপলো করেছিল সেটা আমাদের পছন্দ হয়নি; দুএকটা ঘর নতুন করে সাজানোও হলো। এটুকু ছাড়া আর কোনো অদলবদলই হলো না।

বাড়িতে আসার কয়েক সপ্তাহ পরে ২৪ নম্বরের পাশের বাড়ির দম্পতির সঙ্গে পরিচয় হলো। এর আগে তারা আমাদের এড়িয়েই গেছে। দুটো বাগানের মাঝখানে বেড়ার দুদিক থেকে মাঝেমধ্যে কিছু কথা হয়েছে মাত্র, কিন্তু কোনো না কোনো ছুতোয় তারা বাড়িতে ঢুকে গেছে। মধ্যবয়সী দম্পতি-তাদের নামটাও জানা হয়নি—শিগগিরই অবসর গ্রহণে উন্মুখ। একদিন নানা কথায় ভুলিয়ে সেই নাম না জানা মিসেসের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিলাম এবং কথা প্রসঙ্গে ট্যাপলোদের কথাটাও তুললাম।

নামটা শুনেই মিসেসের মুখ কঠিন হয়ে গেল, তবে একটু পরেই অনেকটা সহজভাবেই তাদের সম্পর্কে দুএকটা কথা বলল। অবশ্য নতুন তথ্য বিশেষ কিছু ছিল না। ট্যাপলো দম্পতি খুবই সুবিবেচক প্ৰতিবেশী ছিল, শান্তশিষ্ট, ভদ্র। কিন্তু কিছুদিন পরেই ট্যাপলোর বউয়ের ব্যবহার কেমন যেন হাস্যকর মনে হতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাগানে দাঁড়িয়ে থাকত, বিড়বিড় করত, কাঁদত। আর কিছুদিন পরেই… নাম না জানা মিসেস আর কিছু বলতে চাইল না। চুল্লিতে রান্না চাপিয়ে এসেছে, তক্ষুনি সেটা নামাতে হবে। কিন্তু রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতেই সে বলে গেল, কী লজ্জার কথা, মিসেস ট্যাপলো এমন সুন্দর মেয়ে, লাল চুলো…

এই বাক্যালাপের কথা অ্যানকে জানালাম না। বলা দরকারও মনেও হয়নি। জানালায় দেখা সেই মুখের প্রসঙ্গ যত না ওঠে ততই মঙ্গল। ওটাকে আমরা দুজনেই ভুলে যেতে চাই।

নাম না জানা মিসেসের সঙ্গে কথাবার্তার কয়েকদিন পরে কাজ থেকে বাড়ি ফিরে দেখি অ্যান বাগানে। পুরানো বাড়িটার জানালার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার দুই চোখে ভয় ও হতাশা! লক্ষ করে আমি চমকে গেলাম। তাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। সে একটা কথাও বলল না। দুজনের জন্য পানীয় নিলাম। অ্যানের শরীর তখন কাঁপছে।

একটু পরে বললাম, ‘তুমি আবার ওকে দেখেছ, তাই না?’

‘হ্যাঁ,’ সে অস্ফুট গলায় জবাব দিল।

‘সেই একই মুখ? একই মেয়ে?’

‘হ্যাঁ।’

নাম না জানা মিসেসের দেয়া বিবরণ মনে পড়ে গেল, বললাম, ‘মাথায় লাল চুল, তাই না?’

‘হ্যাঁ। …দেখো, আমি খুবই দুঃখিত। …আমি জানি কথাগুলো বোকার মতো শোনাচ্ছে…’

আমি জোর গলায় বললাম, ‘না, না, বোকার মতো কেন হবে? ও বাড়িতে নিশ্চয় কেউ বাস করে।’

‘তা কী করে হবে? বাড়ি তো তালাবন্ধ।’ আর্তস্বরে বলে অ্যান। ‘সে আমার সাহায্য চায়। আমাকে তার দরকার…’

‘বাজে কথা। তোমাকে তার দরকার হবে কেন?’

অ্যান কাঁধ ঝাঁকাল। ‘আমি জানি, সে আমাকে চাইছে।’

গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বললাম, ‘বেশ তো, তাহলে চলো, গিয়ে দেখে আসি ব্যাপারটা কী। লাল মাথা মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করেই আসি।’

অ্যান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘এটা হয়তো আমার কল্পনা। হ্যাঁ, নিশ্চয় কল্পনা।’

‘বেশ তো, চলো না। ওখানে গিয়ে সন্দেহ মিটিয়ে আসি।’ বলে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। আমার হাত ধরে সে গম্ভীরভাবে আমার দিকে তাকাল। ‘আমার আচরণ তোমার কাছে হাস্যকর লাগছে না তো? এই সব যা তা দেখা। ভ্রান্তদর্শন।’

বললাম, ‘না, আমি মোটেই তা মনে করি না। জানালায় তুমি কাউকে দেখেছ। তার মানে ওখানে কেউ থাকে। আর কোনোরকম সাহায্যের যদি তার দরকার থাকেই তাহলে তো সাহায্য করাই কর্তব্য। চলো।’

বাড়িটার নাম দ্য লরেলস। ফটক থেকে সামনের সিঁড়ি পর্যন্ত রাস্তাটা ভাঙাচোরা ও আগাছায় ভর্তি; ফটকের দশাও তেমন ভালো নয়। পৌঁছে দেখি, সামনের দরজাটা তালাবন্ধ, আর রঙিন কাচের পাল্লার উপর তক্তা মেরে দেয়া হয়েছে। জানালায় দেখা নারী যে এই দরজা দিয়ে ঢোকেনি সেটা সহজেই বোঝা যায়। বাড়িটা ঘুরে দেখলাম। বাগানটা ঝোপ জঙ্গলে ভর্তি; এখানে-ওখানে আবর্জনার স্তূপ, পরিত্যক্ত বাড়িতে যেরকম হয়ে থাকে। একতলার জানালাগুলো মজবুতভাবে বন্ধ করা হয়েছে। পেছনের দরজাটাও সামনের দরজার মতোই বন্ধ।

আবার সামনের দরজায় ঘুরে এসে অ্যানের দিকে ফিরে বললাম, ‘দেখো, তোমার সেই রহস্যময়ী বান্ধবীটি এক তলা দিয়ে ঢুকেছে বলে তো মনে হয় না। হয়তো জলের পাইপ বেয়ে উঠে দোতলার জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে।

অ্যান চটে গেল। ‘ঠাট্টা করছ? তুমি তো আগাগোড়াই আমাকে অবিশ্বাস করছ। বেশ তো, তাহলে সবটাই আমার কল্পনা। না হয় আমি মিথ্যা বলেছি। তোমার যা খুশি তাই মনে করতে পারো।’ সে মুখ ঘুরিয়ে রাস্তায় চলে গেল।

তাড়াতাড়ি তার পিছু নিলাম। ‘আমি কী ভাবব বলে তুমি আশা করো? তোমাকে অবশ্যই বিশ্বাস করি। তুমি জানালায় কাউকে দেখেছ। কিন্তু নিজের চোখেই তো দেখলে বাড়িটা বন্ধ। তাহলে সে ঢুকল কোথা দিয়ে?’

ততক্ষণে আমরা আমাদের বাড়ির ফটকে পৌঁছে গেছি। অ্যান ফটক খুলে কোনো কথা না বলেই দরজা দিয়ে ঢুকে গেল। ওর পেছন পেছন হলে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। ধীরে ধীরে বললাম, ‘তোমার বিশ্বাস জানালায় কাউকে দেখেছ। কিন্তু ও বাড়িতে কেউ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।’

অ্যান তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? আমি একটা হাঁদা?’

‘আমি জানি না। আমি জানি না।’ বৈঠকখানায় ঢুকে একটা গ্লাস নিয়ে বসলাম। অ্যান দোতলায় উঠে গেল। সে সন্ধ্যায় আর নিচে নামল না।

অবশ্য রাতে নেমে এল। রাতে তিনটে নাগাদ ঘুম ভাঙতে দেখি অ্যান বিছানায় নেই। বাথরুমে নেই, একতলায়ও নেই। গোটা বাড়ির কোথাও তাকে খুঁজে পেলাম না। ভয় পেয়ে গেলাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম সে কোথায় গেছে। পেছনের শোবার ঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে বাগানে তাকালাম। সেখানে চাঁদের আলোয় অ্যান দাঁড়িয়ে আছে; একদৃষ্টিতে পাশের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে।

সেই থেকেই অ্যান কেমন যেন বদলে গেল। হাসিখুশি চটপটে মেয়েটি ধীরে ধীরে কেমন চুপচাপ, চাপা স্বভাবের মানুষ হয়ে গেল। আমি তাকালেই মুখ ফিরিয়ে নেয়, হাত বাড়ালে সরে যায়। এমন ভাব দেখায় যেন কিছুই হয়নি, যেন জানালায় দেখা নারীর কথা সে ভুলেই গেছে; কিন্তু আমি তো জানি প্রতিদিন সকালে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই সে সোজা বাগানে চলে যায়। সন্ধ্যায় যখন ফিরে আসি তখন সে রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু তার মুখের ক্লান্তি দেখেই আমি বুঝতে পারি সেই নারীকে সে আবার দেখতে পেয়েছে। রাতে বিছানায় সে আমার দিকে পেছন ফিরে শুয়ে অন্ধকারে জেগে থাকে। যখনই জাগি দেখি সে নেই। সে কোথায় গেছে তা নিয়ে এখন আমি ভাবি না। আমি জানি।

ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে বাধ্য মেয়ের মতোই সে আমার সঙ্গে গেল। কিন্তু ডাক্তার যে ওষুধ খেতে দিল তাতে কোনোই পরিবর্তন হলো না। হয়তো সে ওষুধ সে খায়ইনি। বললাম, চলো এখান থেকে চলে যাই, আর বাড়িটা বিক্রি করে দিই, কিন্তু তার তীব্র আপত্তিতে চুপ করে গেলাম। আমি বাগানে গিয়ে কী দেখে সেটা জানবার জন্য দু-একবার বাগানে গিয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়েও থেকেছি। সেই নারীকেও দেখতে চেয়েছি। কিন্তু ধূলিমলিন কাচের উপর আলো ও গাছপালার ছায়া ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। কী করব বুঝতে পারছি না। আমার এত ঘনিষ্ঠ সঙ্গিনী স্ত্রী যেন ক্রমেই আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

তারপর, একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি ঘর খালি। পেছনের দরজা দিয়ে বাগানে গেলাম। কিন্তু বাগানও জনশূন্য। সে কোথায় গেছে তার কোনো সূত্র যদি পাওয়া যায় এই আশায় বাড়িময় ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। কোথাও কিছু পেলাম না। টেলিফোনটা বেজে উঠল। ছুটে নিচে গেলাম, নিশ্চয় অ্যান কোনো বান্ধবীর বাড়ি থেকে ফোন করেছে, হয়তো সেখানেই ডিনারের জন্য বান্ধবী আটকে দিয়েছে; অথবা শহরে গিয়ে ফিরতে দেরি হয়েছে। কিন্তু টেলিফোন করেছে অন্য লোকে-আমার ভাই; যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কথা শেষ করলাম।

ঘণ্টা বেজেই চলল। আকাশ অন্ধকার হয়ে এল। আবার বাগানে গিয়ে দ্য লরেলস-এর দিকে তাকালাম। হঠাৎ মনে হলো, অ্যান ওখানেই গেছে। ছুটে রান্নাঘরে গেলাম, সেখান থেকে হলে সশব্দে দরজা ও ফটক বন্ধ করে আমাদের বাড়ি ও দ্য লরেলস-এর মাঝখানের কয়েক গজ জায়গা ছুটে পার হয়ে গেলাম। অন্ধকার জানালাগুলো অন্ধের চোখের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাঙা সিঁড়ি ও কাঠ লাগানো দরজায় যাবার পথে বার কয়েক হোঁচট খেলাম। কেন যাচ্ছি, কিসের আশায় যাচ্ছি তাও জানি না। শুধু এটুকু নিশ্চিত জানি যে সে ওই বাড়িতে আছে, আর তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।

সামনের দরজাটা খোলা দেখে আমার বিস্মিত হওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু আমি অবাক হইনি। দরজাটা কেন খোলা, আর কে খুলেছে সে কথা একবারও না ভেবে ওপাশের অন্ধকার, ধুলোভর্তি হলঘরে ঢুকে পড়লাম। সিঁড়ির ওপরের স্কাই লাইট দিয়ে আসা একটা আবছা আলো হলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘরের দুই পাশের বন্ধ দরজাগুলোর দিকে কোনোরকম নজর না দিয়েই আমি চওড়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। একবার কান পাতলাম। কিছুই শুনতে পেলাম না। নিস্তব্ধতার একটা শ্বাসরোধকারী কালো কম্বল যেন আমাকে ঘিরে ধরেছে; আমার পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কোথাও নেই। দোতলার চাতালে পৌঁছে একবার থামলাম। তবু কোনো শব্দ নেই। আমার ডান দিকে একটা বারান্দা চলে গেছে; সেটা ধরে এগিয়ে গেলাম।

শেষ প্রান্তে একটা দরজা, তার ফাঁক দিয়ে রুপোলি আলোর একটি রেখা বারান্দায় এসে পড়েছে। থামলাম, আমি জানতাম, অ্যান সেই দরজার অপর দিকে, আর এই প্রথম আমি তাকে ডাকলাম, ‘অ্যান! অ্যান! তুমি কোথায়?’ কোনো উত্তর এল না। একটা শব্দ পর্যন্ত নেই। ধীরে ধীরে খোলা দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। ইচ্ছা হলো, ছুটে যাই, এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে ফেলি, অ্যানকে ঘরের ভেতরে টেনে নিয়ে আসি। কিন্তু তার সঙ্গে আর কে আছে তা তো আমি জানি না। দরজার কাছে পৌঁছে আবার থামলাম। আস্তে একটু ধাক্কা দিলাম। দরজাটাও আস্তে ভেতরের দিকে খুলে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে একটা কিছু-একটা মাকড়সার জাল অথবা হাওয়া এসে আমার গালে লাগল। ঘরের মধ্যে তাকালাম। আমার মুখোমুখি একটা জানালা। রঙিন কাচের ছোট ছোট টুকরো দিয়ে তৈরি বিচিত্র পাড় বসানো একটা মস্ত বড় জানালা।

ঘরের মধ্যে অ্যান একা। আর কেউ নেই, কোনো লাল চুলের মেয়ে নয়, কিছু নয়। শুধু অ্যান। ধুলোভর্তি মেঝেতে সে তালগোল পাকিয়ে পড়ে আছে। লম্বা চুলের রাশি তার মুখের উপর ছড়ানো। চুলের গোছা এক পাশে সরাতেই দেখলাম সে হাসিমুখেই মারা গেছে।

একটি যুবক দম্পতি আজ বাড়িটা দেখতে এসেছে। আমারই বয়সী, একটু বেশি লাজুক। বাড়িটা দেখে তারা বেশি কিছু বলল না, তবে মনে হলো তাদের পছন্দ হয়েছে বাড়ি। পছন্দ হবারই কথা। বাড়িটা ভালো, পরিবেশটাও ভালো। আর কোনোরকম অযৌক্তিক দামও আমি চাইনি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িটা বিক্রি করে দিতেই আমি চাই; তাদের শুধু বললাম, এ দামে যদি তারা এর চাইতে ভালো বাড়ি পায় তবে তাদের ভাগ্য ভালো বলতেই হবে।

অবশ্য বাগানে দাঁড়িয়ে মেয়েটির আচরণ কেমন যেন অদ্ভুত মনে হলো। পাশের পুরানো বাড়িটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে আমার কাছে জানতে চাইল, ও বাড়িতে কে থাকে। আমি যখন বললাম যে বাড়িটা খালি পড়ে আছে, তখন সে ভুরু কুঁচকে বলল, সে শপথ করে বলতে পারে যে দোতলার একটা জানালায় সে কাউকে দেখেছে। মেয়েটার মাথায় লম্বা চুল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *