দ্য মিস্ট্রি অব হান্টারস লজ

দ্য মিস্ট্রি অব হান্টারস লজ 

সেবারে প্রবল ইনফ্লুয়েঞ্জায় দিন কতক ভুগে উঠেছি আমি। সুস্থ হয়ে উঠতে না উঠতেই জ্বরে শয্যাশায়ী হল পোয়ারো। জ্বরের ঘোরে বেহুঁশের মতো পড়ে রইল দিন কতক। বকবকানি দূরে থাক মুখে রা পর্যন্ত ছিল না। 

এখন জ্বর ছেড়েছে। বিছানায় বালিশে ঠেস দিয়ে উঠে বসেছে। সুন্দর কাজ করা একটা সুতির চাদর টেনে বুক পর্যন্ত ঢাকা। গলায় জড়ানো পশমের মাফলার। ম্লান মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 

একগ্লাস বার্লি এনে ধরিয়ে দিয়েছি হাতে। তাতে গোটা দু-চার চুমুক দিয়েই বলে উঠল, নাঃ, বুঝতে পারছি এ-যাত্রায় আর ধরা হল না। তোমার এই বার্লি মনে বেশ জোর এনে দিয়েছে। আবার স্বমহিমায় উঠে দাঁড়াবে সুবিখ্যাত রহস্যসন্ধানী এরকুল পোয়ারো, যথারীতি শয়তান অপরাধীদের হৃদকম্প উপস্থিত হবে আর সংবাদপত্রগুলো দুর্ধর্ষ সত্যান্বেষীর গুণকীর্তনে মুখর হয়ে উঠবে। 

ছেলেমানুষি কথাগুলো শুনতে বেশ ভালোই লাগল। ওর সুরে সুর মিলিয়ে বললাম, রহস্যসন্ধানের ক্ষেত্রে তুমি যে অদ্বিতীয় তাতে আর সন্দেহ কি। দেশজুড়ে তোমার সুখ্যাতি। 

—বিলক্ষণ বিলক্ষণ। এ পর্যন্ত কোনো মামলায় ব্যর্থকাম হয়েছি এমন রেকর্ড এরকুল পোয়ারোর নেই, নিশ্চয়ই তুমি স্বীকার করবে। 

মনের আনন্দে নিজের ঢাক নিজেই পিটিয়ে যাচ্ছিল পোয়ারো। এমন সময় বাধা পড়ল। ল্যান্ডলেডি এসে বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। এই যে ওঁর কার্ডটা দিয়ে দিয়েছেন। 

ছোট্ট আইভরি কার্ডটা হাতে নিয়ে নামটা পড়ে শোনালাম পোয়ারোকে মাস্টার রোজার হোভারিং। বই রাখার সেলফের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে ক্লান্ত স্বরে পোয়ারো বলল, একটু দেবে? 

এসময়ে কোনো বইয়ের দরকার তা বুঝতে পেরে হু ইজ হু বইটা বার করে ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম। 

দ্রুত হাতে পাতা ওলটালো। পড়তে শুরু করল, হোভারিং–এই তো হোভারিং… হ্যাঁ…পঞ্চম ব্যারন উইন্ডসরের দ্বিতীয় পুত্র, বিবাহ ১৯১৩ খ্রিঃ উইলিয়াম ক্র্যাবের চতুর্থ কন্যা… জো- 

—জো—অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। জো মানে…ওহো, নিজের বোকামি সামলে নিয়ে বলে ফেললাম, উনি তো জো ক্যারিসক্রফ—চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। শুনেছিলাম লন্ডনের এক তরুণকে নাকি বিয়ে করেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই। 

পোয়ারো বই বন্ধ করে শিয়রের পাশে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকে হাসল। বলল, ঠিকই ধরেছ হেস্টিংস। তুমি যাও নিচে। আমার হয়ে দেখা করো, তাঁর আসার কারণটা জেনে এসো ভালো করে। 

নিচে থেকে ঘুরে এসে পোয়ারোকে জানালাম, ভদ্রলোক খুবই উদ্বিগ্ন অবস্থায় তোমার জন্য নিচে অপেক্ষা করছেন। ডার্বিশায়ারে ওঁর মামা গতকাল রাত্রে খুন হয়েছেন। আজ সকালে স্ত্রীর টেলিগ্রামে খবরটা জানতে পেরে ছুটে এসেছেন তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার জন্য। তোমার অসুস্থতার কথা জানাতে বললেন, অনেক আশা নিয়ে ছুটে এসেছেন। 

পোয়ারো হাসিমুখে বলল, উত্তম, তোমার গোয়েন্দা-বুদ্ধি যাচাই করবার একটা বেশ জুৎসই সুযোগ পাওয়া গেল। আমার অনুসন্ধান পদ্ধতি তো তোমার অজানা নয়—যাও, আমার হয়ে ঘুরে আসো গিয়ে। 

আর শোন প্রতিদিনই আমাকে চিঠি লিখবে—প্রতিটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে। কোনো নির্দেশ দেবার থাকলে তার পেয়ে যাবে। 

মনে মনে খুশি না হয়ে পারলাম না। এখন বুঝতে পারছি আমার মনোগত ইচ্ছেটাও এরকমই ছিল। 

মিডল্যান্ড রেলপথের গাড়িতে আমি আর মিঃ হোভারিং রওনা হয়ে পড়লাম ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। ট্রেন ছুটে চলেছে হু হু করে। আমরা দু-জন মুখোমুখি বসে গল্প জুড়েছি। 

কথায় কথায় একসময় মিঃ হোভারিং জানালেন, তাঁদের আসল বাড়ি নিউ মার্কেটের কাছে সেখানেই তাঁরা বসবাস করেন। ডার্বিশায়ারের বিস্তীর্ণ নির্জন প্রান্তরে শিকারীদের অবস্থানের জন্য তাঁদের একটা হান্টারস লজ আছে। দেখাশোনা করবার জন্য একজন পরিচারিকা সেখানে রাখা হয়েছে। কেউ যখন ওখানে আসে সেই তাদের দেখভাল করে। মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটা ঘটেছে এই লজেই। 

নিউইয়র্কের বিখ্যাত ধনী পরিবারের মেয়ে মিস পেস হোভারিং-এর মা। মামার নাম মিঃ হেরিংটন পেস। ভাগ্নেকে বিশেষ স্নেহ করেন বলে গত তিন বছর ধরে তিনি তাদের সঙ্গেই বসবাস করছিলেন। 

মামা বিরাট ধনী ব্যক্তি, তবু মনের আনন্দেই ভাগ্নের আটপৌরে সংসারে মানিয়ে নিয়েছিলেন। 

দিনকতক ডার্বিশায়ারে হই-হুল্লোড় করে কাটাবেন বলে মামা, ভাগ্নে ও ভাগ্নে বৌকে সঙ্গে নিয়ে হান্টারস হাউসে এসে ওঠেন দিন দুই আগে। 

গতকাল সন্ধ্যায় একটা জরুরি কাজে হোভারিং লন্ডনে চলে আসেন। তাঁর স্ত্রী আর মামা হান্টার্স হাউসেই থেকে যান। তার মধ্যে আজ ভোরেই স্ত্রীর টেলিগ্রাম পেয়ে মামার খুন হবার কথা জানতে পারেন। 

দুর্ঘটনার খবরের সঙ্গে তিনি একজন গোয়েন্দা সঙ্গে করে নিয়ে যাবার কথাও জানিয়েছেন। এই তার পেয়েই ছুটে গিয়েছিলেন পোয়ারোর কাছে। পোয়ারোর সুযোগ্য সহকারী হিসেবে আমার নামের সঙ্গেও তিনি বিলক্ষণ পরিচিত। 

আমরা ট্রেন থেকে নামলাম এলমারস ডেল স্টেশনে। বেলা তখন তিনটে। সেখান থেকে মাইল পাঁচেক গাড়িতে চেপে যথাস্থানে এসে পৌঁছলাম। ফটক পার হয়ে একটা সংকীর্ণ পথ ধরে সদর দরজার সামনে এসেই দেখা হয়ে গেল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইনস্পেক্টর মিঃ জ্যাপের সঙ্গে। তিনি এগিয়ে এসে অন্তরঙ্গভাবে জড়িয়ে ধরলেন। যথারীতি সৌজন্য বিনিময়ের পরে পোয়ারোর খবর জানতে চাইলেন। অসুস্থ শুনে খুবই দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং আন্তরিকভাবেই তার দ্রুত আরোগ্য কামনা করলেন। 

জ্যাপ মিঃ হোভারিং-এর দিকে তাকিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে জানালেন তিনিই এই কেসের ভারপ্রাপ্ত অফিসার। 

পরে বললেন, মিঃ হোভারিং এখানে যা কিছু দেখার সব দেখা হয়ে গেছে। আপনার স্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলেছি। ভারি চমৎকার ভদ্রমহিলা। এখুনি আমাকে একটা জরুরি কাজে একবার গ্রামে যেতে হবে। যাবার আগে আপনার সঙ্গে দু-একটা কথা বলতে চাই। 

মিঃ হোভারিং বললেন, আমি তো এইমাত্র এসে পৌঁছলাম। এখানকার কিছুই এখন পর্যন্ত আমি জানি না। স্ত্রীকেও আমার পৌঁছ সংবাদটা একবার দেওয়া দরকার। 

—সে এমন কিছু জরুরি ব্যাপার নয়। ক্যাপ্টেন হেস্টিংস যখন এসে পড়েছেন, তিনিই ভেতরে গিয়ে খবরটা আপনার স্ত্রীকে পৌঁছে দেবেন। তার জন্য আপনি ভাবিত হবেন না। 

মিঃ হোভারিংকে নিয়ে ইনস্পেক্টর একপাশে চলে গেলেন। আমিও দাঁড়িয়ে না থেকে সদর দরজায় পৌঁছে কলিং বেলের বোতাম টিপলাম। মাঝবয়সি এক পরিচারিকা এসে দরজা খুলে দিল। 

আমি বললাম, মিঃ হোভারিং ইনস্পেক্টরের সঙ্গে কথা বলছেন, এখুনি আসবেন। আমি ওর সঙ্গেই লন্ডন থেকে এসেছি এই কেসটার ব্যাপারে। গতরাত্রের ঘটনাটা আশা করি আমাকে বলতে পারবেন। 

পরিচারিকা দরজা বন্ধ করে আমাকে একটা হলঘরে এনে বসাল। তারপর আমার প্রশ্নের উত্তরে সপ্রতিভভাবে বলল, গতকাল সন্ধ্যার পর এক ভদ্রলোক মিঃ পেসের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বৈঠকখানায় যেখানে শিকারের সাজসরঞ্জাম বন্দুক ইত্যাদি রাখা থাকে, আমি ভদ্রলোককে সেখানে বসিয়ে এসে ওপরে মিঃ পেসকে খবর দিলাম। 

আগন্তুক নিজের নামধাম কিছু বলেননি। মিঃ পেস খবর পেয়েই বাড়ির কর্ত্রীকে একটু অপেক্ষা করতে বলে নিচে বৈঠকখানার দিকে চলে গেলেন। আমিও রান্নাঘরে ফিরে গেলাম। কয়েক মিনিট পরেই কানে এলো বৈঠকখানায় কথা কাটাকাটি হচ্ছে। মনে হল তাঁরা ঝগড়া করছেন। আমি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ব্যাপারটা দেখতে গেলাম। 

হলঘরেই কর্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। উনিও বৈঠকখানার দিকে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময়েই একটা বন্দুকের শব্দ শোনা গেল। সঙ্গে-সঙ্গে কথাবার্তা সব বন্ধ হয়ে গেল। 

আমরা দু-জন ছুটে গেলাম বৈঠকখানায়। দেখলাম দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। জোরে জোরে ধাক্কা দিলাম কয়েকবার। কিন্তু খুলল না। 

তখন আমরা দু-জনেই ছুটে সদর দরজার দিকে জানালার কাছে এলাম। খোলা জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম মিঃ পেস চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছেন—ঘরের মেঝে ভেসে যাচ্ছে রক্তে। 

—লোকটার কী হল? আমি জানতে চাইলাম। 

—কোথাও দেখতে পেলাম না। আমরা পৌঁছবার আগেই নিশ্চয় জানলা টপকে পালিয়ে গেছে। দিদিমণি তখুনি আমাকে পুলিশে খবর দিতে পাঠাল। আমার সঙ্গেই পুলিশ এলো। সারারাত একজন কনস্টেবল পাহারা দিল। ভোরে লন্ডন থেকেই ওই ভদ্রলোক এলেন। 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, মিঃ পেসের সঙ্গে যে লোকটা দেখা করতে এসেছিল সে দেখতে কেমন বলো তো? 

কয়েক সেকেন্ড একটু ভেবে নিয়ে সে বলল, কথার ধরন থেকে মনে হল আমেরিকান। মাঝবয়সি। মুখে কালো চাপ দাড়ি। গায়ে লম্বা ওভারকোট ঝোলানো ছিল। এটুকুই আমার মনে আছে। 

—খুব মুশকিল হল তো। আচ্ছা, মিসেস হোভারিং-এর সঙ্গে একবার দেখা করব যে, বলবেন লণ্ডন থেকে ওঁর স্বামীর সঙ্গে যে ভদ্রলোক এসেছেন তিনি একবার কথা বলতে চান। 

পরিচারিকাটি আমাকে বসিয়ে রেখে ওপরে চলে গেল। 

.

মিনিট কয়েকের মধ্যেই অনিন্দ্য সুন্দর এক যুবতী ঘরে ঢুকলেন। তন্বী। গলাবন্ধ একটা সোয়েটার গায়ে—টকটকে লাল রং। তার উপস্থিতিতে ঘর যেন আলোকিত হল। এমন একটা শোকাবহ মর্মান্তিক ঘটনাও তাঁর ব্যক্তিত্বকে ম্লান করেনি। 

চেয়ার ছেড়ে উঠে আমি নিজের পরিচয় দিলাম। আমাকে বসতে ইঙ্গিত করে নিজেও বসলেন। 

ক্ষণিকের জন্য একটা কুঞ্চনরেখা কপালে জেগে উঠল। পরক্ষণেই হেসে বললেন, আপনার এবং মঁসিয়ে পোয়ারোর নাম আমার পরিচিত। আমার স্বামী যে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন জেনে স্বস্তি পাচ্ছি। আমাকে কিছু জেরা করবেন নিশ্চয়ই 

স্মিত হেসে বললাম, ধন্যবাদ মিসেস হোভারিং, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন। আপনার নিশ্চয়ই খেয়াল আছে, ঠিক কটার সময় ভদ্রলোক মিঃ পেসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন?

—রাত নটা আন্দাজ। সবে রাত্রির খাওয়া শেষ করে আমরা কফির টেবিলে বসে গল্প করছি। 

—আপনার স্বামী তখন এখানে ছিলেন না? 

—উনি সকাল ছটাতেই লন্ডনে যাবেন বলে বেরিয়ে যান। 

—সাক্ষাৎপ্রার্থী আগন্তুকের কথা শোনার পরে মিঃ পেসের মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলেন? মানে অস্বাভাবিক কিছু— 

—না, না, উনি খুবই স্বাভাবিক ছিলেন। 

—আগন্তুক লোকটির একটু বর্ণনা দিতে পারবেন নিশ্চয়। 

—আমি দুঃখিত ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। তাকে আমি আগে চোখেই দেখিনি। তাকে নিচে বসিয়ে রেখে পরিচারিকা ওপরে খবর দিতে এসেছিল। 

—খবরটা শুনে মিঃ পেস কী বললেন? 

—প্রথমে একটু বিরক্তই হলেন মনে হল। তারপর আমাকে বললেন, একটু বোসো, আসছি এখুনি, বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। 

মিনিট পাঁচেক পরে একটা হই-চই শুনে নিচে নেমে আসি, হলঘরের সামনেই পরিচারিকার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ঠিক সেই সময়েই গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। ছুটে গিয়ে দেখি বৈঠকখানার দরজা বন্ধ। 

ধাক্কাধাক্কিতে খুলল না। তখন সদর দরজার দিকের জানালার দিকে গেলাম। আমাদের মিনিট দুই সময় হয়তো লেগেছিল— 

বলতে বলতে বিষণ্ণ চোখজোড়া নামিয়ে নিলেন তিনি। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এলো। সামলে নিয়ে আবার বললেন, জানালা দিয়ে চোখে পড়ল মামা চিৎ হয়ে পড়ে আছেন মেঝেয়, গালচেতে চাপ চাপ রক্ত। 

গুলিটা মাথায় লেগে সঙ্গে সঙ্গেই মারা গিয়েছিলেন। আমি পরিচারিকাকে পুলিশে খবর দিতে পাঠিয়ে ওপরে চলে আসি। 

—আগ্নেয়াস্ত্রটা কী ধরনের ছিল বলে আপনার ধারণা? 

—স্পষ্ট করে বলা কষ্ট। তবে যদ্দুর মনে হয় রিভলভার। দেয়ালেই আমার স্বামীর একজোড়া রিভলবার সাজানো ছিল। সেই দিন থেকে তার একটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশকেও আমার সন্দেহের কথা জানিয়েছি। তাঁরা অন্য রিভলবারটা নিয়ে গেছে। পোস্টমর্টেমের পর নিশ্চয়ই নিশ্চিতভাবে পুলিশ জানতে পারবে। 

এরপর আমি ওর সঙ্গে এলাম বৈঠকখানাটা একবার সরেজমিনে দেখতে। এই সময় মিঃ হোভারিং হলঘরে প্রবেশ করলেন। 

মিসেস হোভারিং আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে স্বামীর দিকে দ্রুত ছুটে গেলেন।

এই সুযোগে আমি যথাসাধ্য অনুসন্ধান করলাম। কিন্তু কোনো সূত্রই ঘরে কোথাও পাওয়া গেল না। 

গালচেতে রক্তের দাগ তখনও ছিল। মৃতব্যক্তি কোথায় পড়েছিল বুঝতে অসুবিধে হল না। আমি খুঁটিয়ে দেখলাম। সঙ্গের ক্যামেরা দিয়ে দুটো ছবিও তুললাম। সদর দরজার জানলার বাইরের জমিটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম অজস্র পায়ের ছাপ। সেখানে আমার দেখবার মতো আর কিছু অবশিষ্ট নেই। 

আমার অনুসন্ধানের কাজ যা ছিল হয়ে গেল। এর পর মিঃ হোভারিং-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হলাম। 

.

ম্যাটলক আর্মসে এসে ইনস্পেক্টর জ্যাপের সঙ্গে দেখা করলাম। ওঁর সঙ্গে গিয়ে মৃতদেহটা দেখলাম। ছোটো-খাটো চেহারার মানুষ, পরিষ্কার কামানো চিবুক। আমেরিকান বলে চিনতে ভুল হয় না। 

পরীক্ষা করে বুঝতে পারলাম মাথার পেছন দিক থেকে গুলি করা হয়েছে, খুব কাছে থেকেই। 

ইনস্পেক্টর জ্যাপও আমাকে সমর্থন করলেন। বললেন, আপনার অনুমান যথার্থ, উনি ঘুরে দাঁড়াতেই খুব কাছে থেকেই গুলি ছোঁড়া হয়েছে। বৈঠকখানা ঘরে শুনেছি একজোড়া রিভলবার ছিল। তার একটা আমরা মিসেস হোভারিং-এর কাছ থেকে সংগ্রহ করে এনেছি। সম্ভবত দ্বিতীয়টার গুলিতেই মিঃ পেস মারা যান। কিন্তু একটা ব্যাপার ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, দু-দুটো রিভলবার, দুটোই গুলিভরা, দেয়ালে কেন টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল, কিছুতেই বুঝতে পারছি না। ওখান থেকে বেরিয়ে আসার আগে ইনস্পেক্টর বললেন, মিঃ হোভারিংকে আমরা নজরে রাখার কথা ভাবছি। কেন না, ওর অতীতটা খুব পরিচ্ছন্ন নয়। অক্সফোর্ডে পড়বার সময় একবার চেকে বাবার সই জাল করেছিলেন। 

খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এখনও বাজারে ওর অনেক ঋণ। একারণে মামা খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন। গোড়া থেকেই তার ওপর আমার সন্দেহ ছিল। সেকারণেই স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই আলাদা ডেকে কথা বলেছিলাম। কিন্তু দু-জনের বিবৃতিতে কোনো গরমিল নেই। 

ছ-টার পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাড়ে দশটা নাগাদ লন্ডনে পৌঁছে সরাসরি ক্লাবে যান। কিন্তু দাড়ির ছদ্মবেশে রাত ন-টায় ফিরে এসে মামাকে খুন করা তার পক্ষে আদৌ অসম্ভব বলে মনে করছি না—এই ব্যাপারটাই তদন্ত করে দেখার বাকি। 

মিঃ পেসের পরিচিত আমেরিকানদের মধ্যেও খুনির সন্ধান করে দেখতে হবে। মিসেস মিডলটন—পরিচারিকাটি সেই লোকটিকে দেখেছিল। তার বিবৃতি থেকেই জানা যাচ্ছে দাড়ির কথা। মিসেস হোভারিং আগন্তুক লোকটিকে দেখার সুযোগ পাননি। দাড়ির ব্যাপারটা সত্যি হলে সন্দেহের কারণ থেকেই যায়। কেন না এপর্যন্ত আমি যত আমেরিকান দেখেছি, তাদের প্রত্যেকেরই চিবুক পরিষ্কার কামানো। 

.

সেদিনই ঘটনার বিবরণ ও আনুষঙ্গিক খবরাখবর বিস্তারিতভাবে জানিয়ে পোয়ারোকে চিঠি লিখে দিয়েছি। 

মৃতদেহ থেকে বুলেটটা বার করে পুলিশ জানতে পেরেছে, তাদের হস্তগত করা একই রিভলবারের গুলি সেটা। তাছাড়া তদন্তে জানা গেছে নিজের গতিবিধির সম্পর্কে মিঃ হোভারিং যে বিবৃতি দিয়েছেন তা যথার্থ। 

একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনা হল, পরদিন ভোরবেলা স্থানীয় এক ভদ্রলোক হেভেন গ্রীন স্টেশনের রেলিঙের ধারে একটা কাগজের মোড়ক পান। মোড়কের ভেতরে একটা রিভলবার পাওয়া যায়। 

ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে সেটা স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে জমা দেন। হান্টারস লজ থেকে জোড়া রিভলবারের যেটি খোয়া গিয়েছিল, এটাই সেটা। দেখা গেছে তার থেকে একটি মাত্র গুলি খরচ করা হয়েছে। 

এই সমস্ত খবরই আমি পোয়ারোকে চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছিলাম। পরদিন ভোরেই ব্রেকফাস্টের সময় পোয়ারোর টেলিগ্রাম পেলাম। সে জানিয়েছে—তুমি আর জ্যাপ গুলিয়ে ফেলছ—কালো দাড়িওয়ালা লোকটি হোভারিং নয়। 

ঘরের ছবিও অত খুঁটিয়ে দেখার কিছু নেই। পরিচারিকার ওপর নজর রাখো। ওর চেহারার বর্ণনাটা আমার দরকার। 

সেদিন সকালে মিসেস হোভারিং এবং পরিচারিকা কী রঙের পোশাক পরেছিল সেই খবরটাও আমার দরকার। এগুলো অবশ্যই জানাতে ভুলো না। 

পোয়ারোর টেলিগ্রাম পেয়ে আমি একটু দমে গেলাম। সেদিন সকালে দু-জন মহিলা কী পোশাক পরেছিল এই সংবাদের সঙ্গে এই খুনের ঘটনার কী সম্পর্ক তা অনেক ভেবেও বুঝতে পারলাম না। 

জানতে যখন চেয়েছে এবং আমিও যখন এখানে আসার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলাম তখন তাকে সবই জানাতে হবে। পোয়ারোর অনুসন্ধান পদ্ধতি বরাবরই এমনি বিদঘুটে রকমের। 

বেলা এগারোটার মধ্যেই আমার টেলিগ্রামের জবাব এসে গেল। রীতিমতো সাংঘাতিক কথা জানিয়েছে ও। 

—জ্যাপকে বলো অবিলম্বে পরিচারিকাকে গ্রেপ্তার করতে। 

কিছুই বুঝতে পারলাম না। বিমূঢ় অবস্থাতেই তারবার্তা জ্যাপের হাতে তুলে দিলাম। 

বার কয়েক খবরটা পড়ে কাগজটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে চিন্তিত স্বরে বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারোকে কোনোদিনই বুঝে ওঠা সম্ভব হল না। নিরর্থক কিছু বলা ওঁর স্বভাব নয়। পরিচারিকার ওপরে আগে থেকেই আমার নজর ছিল। কিন্তু কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া…চলুন একবার ঘুরেই আসা যাক বরং 

এমনভাবে বোকা বনে যেতে হবে ভাবতে পারিনি। মিসেস মিডলটন যেন রাতারাতি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। মধ্যবয়স্কা শান্ত স্বভাবের মহিলাটিকে আমার বেশ ভালোই লেগেছিল। তার বাক্স-প্যাঁটরা সবই পড়েছিল। 

তন্নতন্ন করে হাতড়ালাম। কিন্তু মহিলা কোথায় গেছে বা যেতে পারে তা অনুমান করবার মতো কোনো সূত্রই পাওয়া গেল না। 

মিসেস হোভারিং অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, ওকে আমি খুবই পছন্দ করতাম। কিন্তু ও যে এমন শয়তানি ঘুণাক্ষরেও কোনোদিন বুঝতে দেয়নি। 

সে আসার আগে ছিল মিসেস ইমেরী। দিন কুড়ি আগে সে কাজে বহাল হয়েছিল। মাউন্ট স্ট্রিটের একটা নামি সংস্থা মিসেস সেলবোর্নস এজেন্সির তরফ থেকে কয়েকজন মহিলাকে পাঠানো হয়েছিল। তাদের মধ্যে তাকেই আমার পছন্দ হয়েছিল। 

রহস্যটা যে কোথায় ঠিক ধরতে পারা গেল না। তবে এটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, মিসেস মিডলটন নিজে হাতে মিঃ পেসকে খুন করেনি। কেন না, যেই সময়ে গুলি করা হয়, তখন ও মিসেস হোভারিং-এর সঙ্গে হলঘরেই ছিল। 

কিন্তু কোনো না কোনোভাবে খুনীর সঙ্গে যোগসাজস না থাকলে হঠাৎ এভাবে হাওয়া হয়ে গেল কেন? 

খবরটা পাবার সঙ্গে সঙ্গেই পোয়ারাকে তার করে দিলাম। জানতে চাইলাম সেলবোর্নস এজেন্সিতে খোঁজখবর করবার জন্য লন্ডনে যাব কিনা। 

যথা সময়ে পোয়ারোর জবাবও পেয়ে গেলাম। সে জানাল-এজেন্সিতে যাওয়া নিরর্থক। ওখানে কেউই ওর নাম পর্যন্ত শোনেনি। তার চেয়ে বরং খোঁজ নাও কোন গাড়িতে প্রথম হান্টারস লজে পৌঁছেছিল। 

পোয়ারোর তারবার্তা তো নয়, রীতিমতো এক-একটা ধাঁধা। তা হোক, এবারে আর দ্বিধা করলাম না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল এলমারস ডেলে পরিবহন বলতে দুটো ফোর্ড গাড়ি আর দুটো টাঙ্গা। 

কিন্তু এগুলোর কোনোটাই মিসেস মিডলটন ব্যবহার করেননি। 

মিসেস হোভারিং এ-প্রসঙ্গে জানালেন, ডার্বিশায়ার থেকে হান্টারস লজ পর্যন্ত ট্যাক্সিতে আসাও অসম্ভব নয়। হয়তো যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ তাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। 

অগত্যা লন্ডনে মিসেস সেলবোর্ন এজেন্সিতে ফোন করতে হল। তারা যা জানাল, তাতে পোয়ারোর ধারণাই সত্য প্রতিপন্ন হল। তাদের খাতায় মিসেস মিডলটন বলে কোনো মহিলার নাম নেই। 

তারা আরও জানাল, মিসেস হোভারিং পরিচারিকার জন্য যে চিঠি লিখেছিলেন, তার জবাবে কয়েকজন প্রার্থীকে তারা পাঠিয়েছিল। ওই পদে প্রার্থী নির্বাচন করার পর মিসেস হোভারিং চিঠিতে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তিনি কোনো নির্দিষ্ট মহিলার নাম উল্লেখ করতে সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন। 

হালে পানি না-পেয়ে পরের দিনই আমি লন্ডনে ফিরে এলাম। ঘরে ঢুকে দেখি ফায়ার প্লেসের পাশে একটা চেয়ারে গা এলিয়ে পোয়ারো বসে আছে। 

আমাকে দেখে উল্লসিত স্বরে বলে উঠল, আরে হেস্টিংস তুমি এসে গেছ। বসে বসে তোমার কথাই ভাবছিলাম। 

আমি ঘরে শুয়ে বসে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি, আর তুমি মনের আনন্দে ইচ্ছেমতো দিব্যি ঘুরে বেড়োচ্ছে। তারপর, ওদিককার খবর কী? 

তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে আমি বললাম, পোয়ারো, আমার হাবুডুবু অবস্থা। এ-রহস্যের সমাধান সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। কিছুতেই তলের নাগাল পাচ্ছি না। 

—কিন্তু হেস্টিংস, আমি তো তল হাতড়ে সবই উঠিয়ে নিয়ে এসেছি। 

আমি বিহ্বল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি জানতে পেরেছ? কে খুন করেছে? 

‘অবিশ্বাস্য’ কথাটা বলতে গিয়েও গিলে ফেললাম। বরং বললাম, তুমি জানলে কেমন করে? 

—তোমার পাঠানো বিবরণই আমাকে এই রহস্য সমাধানে সাহায্য করেছে। প্রতিটি ঘটনাকে পর পর সাজিয়ে পর্যালোচনা করলে তোমার পক্ষেও সত্যে পৌঁছতে অসম্ভব হবে না। 

বেশ, লক্ষ্য করো, মিঃ হেরিংটন পেস ইংলন্ডের একটি বনেদি পরিবারের মানুষ, প্রভৃত অর্থের মালিক। তার অবর্তমানে একমাত্র যার লাভবান হবার কথা সে হল তাঁর ভাগনে মিঃ হোভারিং। উচ্ছৃঙ্খল আর অমিতোব্যয়ী ভাগ্নেকে তিনি আদপেই পছন্দ করতেন না। আকণ্ঠ দেনার দায়ে ডুবে আছে জেনেও তিনি তাকে এক কপর্দকও দেননি। 

মামার জীবিত অবস্থায় তার অর্থসম্পদ পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরেই একটা পরিকল্পনা ছকে নিয়েছিলেন মিঃ হোভারিং। 

আমি অসহিষ্ণুভাবে বলে উঠলাম, কিন্তু পুলিশ প্রমাণ পেয়েছে, সেদিন হান্টারস লজ থেকে বেরিয়ে তিনি সোজাসুজি লন্ডনে চলে এসেছিলেন। 

পোয়ারো হেসে বলল, ধীরে ব্রাদার ধীরে। আমি তো একবারও বলিনি যে উনি লন্ডনে আসেননি। তাছাড়া, একথাও তোমাকে বলিনি যে মিঃ হোভারিং তার মামাকে খুন করেছেন। 

তবে এটা খুবই পরিষ্কার যে, মিঃ হোভারিং হান্টারস লজ থেকে বেরিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত মিঃ পেসের খুন হবার সুযোগ ছিল না। ডাক্তাররাও খুনের সময় রাত ন-টা বলে স্বীকার করেছেন। সুতরাং কোনো সন্দেহ নেই যে মিঃ হোভারিং তার মামাকে খুন করেননি। তাহলে খুনটা করল কে? 

কৌতুকদীপ্ত মুখে ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল পোয়ারো। আমি রুদ্ধনিঃশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলাম ওর মুখে খুনির নামটি শোনার জন্য। 

—এত সহজে মিসেস হোভারিংকে ভুলে গেলে চলবে কেন বন্ধু। 

—অসম্ভব। আমি দৃঢ় স্বরে বলে উঠলাম। গুলিটা যখন করা হল তখন পরিচারিকা তাঁর সঙ্গে হলঘরে উপস্থিত ছিল। 

—সে আমিও জানি। কিন্তু এ-ঘটনার একমাত্র সাক্ষী সেই পরিচারিকা এখন বেপাত্তা।

–আপাতত। 

—না হেস্টিংস, চিরতরেই। কোনোদিনই আর মিসেস মিডলটন নামের পরিচারিকাটিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই রহস্যময় ভূমিকাটুকুর জন্যই তার আবির্ভাব হয়েছিল। সে তা নিখুঁতভাবে সম্পূর্ণ করেছে। 

—বিষয়টা পরিষ্কার হল না পোয়ারো। 

—অপরিষ্কার থাকবার তো কথা নয়। গুলি ছোঁড়ার মুহূর্তে মিসেস হোভারিংয়ের অ্যালিবাইকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার কাজটুকুই ছিল পরিচারিকার একমাত্র ভূমিকা। সেটুকু সমাধা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে আর নেই, কোনোদিন ছিলও না কোথাও 

—শেক্সপীয়রের উদ্ধৃতিটা প্রয়োগ করলে বটে, আমার কিন্তু বিশেষ কিছু মাথায় ঢুকল না।

—না ঢুকবার তো কোনো কারণ দেখছি না। তুমি তো ভালো করেই জান, নামকরা অভিনেত্রী জো ক্যারিসব্রুকই বিয়ের পর হয়েছেন জো হোভারিং। তুমি আর জ্যাপ হলঘরে মাঝামাঝি বয়সের পরিচারিকাকে একবারের জন্যই দেখেছিলে। তারপর স্থানীয় পুলিশ বা তোমরা সেদিন রাত্রে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাকে আর দেখনি। 

তাছাড়া মিসেস হোভারিং এবং পরিচারিকা দু-জনকে একসঙ্গে আর কখনও দেখনি হেস্টিংস, বরাবরই আমি দেখেছি, দরকারি সূত্রগুলো তোমার চোখ এড়িয়ে যায়। এই পয়েন্টটা তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত ছিল। 

যাই হোক, দুঃসাহসী অভিনেত্রী প্রায় একই সময়ে দ্বৈতভূমিকায় নিপুণ অভিনয় করে তোমাদের শিশুর মতো ভুলিয়ে রেখেছিল। তোমাকে বসার ঘরে বসিয়ে রেখে পরিচারিকা ওপরে খবর দিয়ে দ্রুত হাতে রূপসজ্জার সামান্য হেরফের ঘটিয়ে দীপ্ত লাবণ্যময়ীর ভঙ্গিতে নিচে নেমে এসেছিল। 

রূপসী জোকে দেখে তোমাদের কারোর মনেই সন্দেহ হয়নি যে একই মানুষকে দুইবারে দুই ভূমিকায় দেখছ। 

পরিচারিকার সঙ্গে এই ঘটনার যোগসূত্র এতই ক্ষীণ ছিল যে, তোমরা তাকে খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করোনি। পরিচারিকার অ্যালিবাই মিসেস হোভারিং জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। 

যুক্তির সিঁড়ি ধরে সন্নিবদ্ধ ঘটনা পরম্পরা মেনে না নিয়ে উপায় ছিল না। তবু একটা কথা মনে পড়ে যাওয়াতে বললাম, কিন্তু রিভলবারটা তো পাওয়া গিয়েছিল হেভেন গ্রীন রেল স্টেশন রেলিং-এর ধারে। তুমি কি বলতে চাও, মিসেস হোভারিং সেটা সেখানে রেখে এসেছিলেন? 

পোয়ারো রহস্যময় হাসি হেসে বলল, না বন্ধু, ওটা হল রোজার হোভারিংয়ের সুচতুর কর্ম। ওটা আবিষ্কার হবার সংবাদ পাবার পরই আমার পথ পরিষ্কার হয়ে যায়। 

খুনি নিজের রিভলবার ব্যবহার করেনি। সেই অবস্থায় এটাই ছিল যুক্তিসংগত স্বাভাবিক ঘটনা যে, ওটা ঘটনাস্থলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু সেটা পাওয়া গেল কোথায়, না ঘটনাস্থল থেকে অনেকটাই দূরে। 

এই কৌশলের একটাই কারণ, পুলিশের দৃষ্টিকে যথাসম্ভব বিভ্রান্ত করে দেওয়া। 

হেভেন গ্রীনে যে রিভলবার পাওয়া গিয়েছিল, মিঃ পেসকে হত্যার জন্য সেটি ব্যবহার করা হয়নি। রোজার হোভারিং রিভলবার থেকে একটা গুলি বার করে রেখে সেটা সঙ্গে নিয়েই লন্ডনে চলে যান। 

সেখান থেকে সরাসরি তাঁর ক্লাবে। এই জরুরি অ্যালিবাই-ই তাঁর নির্দোষিতা প্রমাণ করে দিল। 

কিন্তু ক্লাবে সময় ব্যয় না করে তিনি চলে আসেন হেভেন গ্রীনে। রিভলবার জড়ানো প্যাকেটটা রেলিঙের ধারে ফেলে দিয়েই দ্রুত ফিরে আসেন লন্ডনে। মাত্র মিনিট কুড়ির মধ্যেই এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তিনি সেরে ফেলেন। 

ইত্যবসরে আসল কাজটা তাঁর স্ত্রী নিখুঁতভাবে সেরে ফেলেন। নৈশ ভোজের পরেই তিনি সুযোগমতো মিঃ পেসকে গুলি করেন। 

তুমি নিজেই ম্যাটলক আর্মসে গিয়ে দেখে এসেছিলে গুলিটা করা হয়েছিল মাথার পেছন দিক থেকে। এটা খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ পয়েন্ট। 

রোজার হোভারিংয়ের রেখে যাওয়া গুলিটা এরপর তিনি যথারীতি হাতের রিভলবারে ভরে যথাস্থানে রেখে দেন। 

এরপর থেকেই আরম্ভ হয় তাঁর দুঃসাহসিক এবং সুনিপুণ অভিনয়। 

—এ রীতিমতো কষ্টকল্পিত ব্যাপার। কোনোক্রমে আমি বলবার চেষ্টা করলাম। 

—কষ্টকল্পিত বা অবিশ্বাস্য যাই বলো, এটাই প্রকৃত ঘটনা। পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল।

পরে বলল, জ্যাপকে আমি সবই খুলে জানিয়েছি। এরপর যা ভালো বুঝবে সে করবে। কিন্তু আমার ধারণা তার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের আগেই পাখি হাওয়া হয়ে যাবে। সে গিয়ে কাউকেই পাবে না। 

আমি ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলাম কেবল, কিন্তু পোয়ারো, এ-ঘটনা বিশ্বাস করতে বড়ো কষ্ট হচ্ছে। 

তবে শেষ পর্যন্ত বিনা দ্বিধায় আমাকে পোয়ারোর সবকথাই মেনে নিতে হয়েছিল। কেন না অচিরেই তার ভবিষ্যদ্বাণী অভ্রান্ত প্রমাণ হয়েছিল। 

পোয়ারোর পাঠানো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইনস্পেক্টর জ্যাপ আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে যথেষ্ট দেরি হয়ে গিয়েছিল। কাউকেই তিনি মুঠোর মধ্যে পাননি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *