দ্য মিস্টিরিয়াস ট্রাভেলার

দ্য মিস্টিরিয়াস ট্রাভেলার

অনুবাদ : অসীম গিয়াস

আগের দিন সন্ধ্যায়, মহাসড়ক দিয়ে আমার গাড়িটাকে হুয়নে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আর পরদিন ট্রেনে করে আমি হুয়নে রওনা হলাম। উদ্দেশ্য ছিল কয়েক জন বন্ধুর সাথে দেখা করা। এই বন্ধুদের সবার বাড়ি সিন নদী ঘেঁষে।

প্যারিসে, ট্রেন ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে, সাত জন ভদ্রলোক আমার কামরায় এসে ঢুকল। সাত জনের মধ্যে পাঁচ জনের হাতেই সিগারেট। যাত্রাটা যত ছোটো-ই হোক না কেন, এ-রকম লোকজনের সাথে ভ্রমণ করতে মন সায় দিচ্ছিল না, বিশেষ করে বগিটা পুরনো মডেলের হওয়ায়, করিডোরও ছিল না। আমার ওভারকোট, সাথের পত্রিকা এবং টাইম-টেবিলটা তুলে নিয়ে, পাশের কামরায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম তাই।

নতুন কামরায় ছিলেন একজন মহিলা, আমাকে দেখামাত্র-ই উনি যে বিরক্ত হওয়ার একটা ভঙ্গি করলেন, সেটা নজর এড়াল না আমার। সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একজন ভদ্রলোকের দিকে ঝুঁকে পড়লেন মহিলা, সন্দেহ ছাড়াই বলে দেওয়া যায় যে লোকটা মহিলার স্বামী। লোকটা কড়া চোখে পর্যবেক্ষণ করলেন আমাকে, তবে দেখা গেল যে আমার চেহারা ছবি দেখে অসন্তুষ্ট হলেন না, কারণ উনি হেসে তার স্ত্রীকে নির্ভয় দিয়ে, একটা ভয় পাওয়া বাচ্চাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ঢংয়ে কথা বলতে লাগলেন। মহিলাও হাসলেন, এবং আমার দিকে বন্ধুসুলভ নজরে তাকালেন এক ঝলক; যেন উনি বুঝতে পেরেছেন আমি সেই ধৈর্যশীল লোকদের একজন যার সাথে একজন মহিলা কোনো আশঙ্কা ছাড়াই একটা ছয় বর্গফুটের ছোট্ট বক্সে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য বন্দি থাকতে পারেন।

মহিলার স্বামী তাকে বললেন:

“আমার খুব জরুরি একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে সোনা, আর থাকতে পারব না এখন। বিদায়।”

লোকটা মমতা নিয়ে চুমু খেলেন মহিলাকে, তারপর চলে গেলেন। মহিলাও তার স্বামীকে কয়েকটা উড়ন্ত চুমু ছুড়ে দিয়ে নিজের রুমালটা নেড়ে বিদায় জানালেন। হুইসেল শোনা গেল সামান্য পরে-ই। চলতে শুরু করল ট্রেন।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই, গার্ডদের বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও বগির দরজা খুলে গেল, এবং একটা লোক হুড়মুড় করে এসে ঢুকল আমাদের কামরায়। আমার সফরসঙ্গী মহিলা, যিনি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের মালপত্র গুছিয়ে রাখছিলেন, আতঙ্কের একটা চিৎকার দিয়ে উঠে ধপ করে বসে পড়লেন নিজের আসনে। আমি কাপুরুষ নই; বরং সেটার উলটো প্রান্তের মানুষ বলেই মনে করি নিজেকে-কিন্তু স্বীকার করতেই হবে যে এরকম শেষ মুহূর্তের অনধিকার প্রবেশ ব্যাপারটা সবসময়ই কেমন যেন বিরক্তিকর। ব্যাপারটায় একটা সন্দেহজনক, অস্বাভাবিক গন্ধ থাকে।

যা-ই হোক, নবাগতের চেহারাসুরত অবশ্য তার সদ্য কৃত হঠকারী কর্মকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট অসন্তোষজনক মনোভাবের অনেকটা-ই দূরীভূত করে দিলো। একদম ফিটফাট এবং মার্জিত পোশাক পরে আছে সে, গলায় চমৎকার একটা ক্রুভাট (গলায় বাঁধার রুমাল) বাঁধা, হাতে মানানসই দস্তানা, আর চেহারাও পরিমার্জিত এবং বুদ্ধিদীপ্ত। কিন্তু কোন দুনিয়ায় এই ব্যাটাকে দেখেছিলাম আমি? কারণ, কোনো সন্দেহ নেই যে আগেও এই চেহারাটা দেখেছি। তবে সেই স্মৃতি এতটা-ই অস্পষ্ট এবং আবছা যে, ওই সময়ে সেটা মনে করার চেষ্টা করাটা বৃথা বলে মনে হলো।

তারপরেই, মহিলার দিকে খেয়াল করতেই, তার চেহারার ফ্যাকাশে ভাব এবং উদ্বিগ্নতা দেখে খানিকটা অবাকই লাগল। কামরায় উলটো দিকের আসনগুলোতে বসে থাকা তার দু’জন সফরসঙ্গীর দিকেই তীব্র শঙ্কার একটা অভিব্যক্তি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন উনি, এবং খেয়াল করলাম যে তার কাঁপতে থাকা একটা হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে ওনার থেকে বিশ ইঞ্চি মতো দূরে একটা আসনের ওপরে পড়ে থাকা একটা ছোট্ট ট্রাভেল ব্যাগের দিকে। ওটাকে পাকড়ে ধরে, নার্ভাস ভঙ্গিতে নিজের কাছে টেনে নেওয়ার পরে একটু যেন শান্ত হলেন ভদ্রমহিলা। চোখাচোখি হলো আমাদের, এবং আমি ওনার দৃষ্টিতে এত বেশি দুশ্চিন্তা এবং ভীতি দেখতে পেলাম যে কথাটা না বলে থাকতে পারলাম না:

“আপনি কি অসুস্থ, ম্যাডাম? জানালা খুলে দেবো না কি?”

জবাবে মহিলা শুধুমাত্র এমন একটা ইশারা করলেন যেটায় বোঝা গেল যে উনি আমাদের নতুন সফরসঙ্গীকে ভয় পাচ্ছেন। হাসলাম আমি; ওনার স্বামী যেমনটা করেছিলেন, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে, শব্দ না করে শুধু মুখ নাড়িয়ে ওনাকে বুঝিয়ে বললাম যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমিতো আছি এখানে, তাছাড়া ভদ্রলোককে দেখে মনে হচ্ছে একদমই নিরীহ একজন। ওই মুহূর্তেই লোকটা ঘুরে তাকালো আমাদের দিকে, দুজনের-ই আপাদমস্তক দেখে নিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, তারপর নিজের আসনটায় জাঁকিয়ে বসে, আমাদের দিকে আর কোনো ভ্রুক্ষেপও করল না।

কিছুক্ষণ নীরবতার পর মহিলা ডাকলেন আমাকে। কোনো একটা মরিয়া কাজ করার জন্য সকল সাহসকে জড়ো করেছেন এমন একটা ভঙ্গিতে। প্রায় শোনাই যায় না এমন আওয়াজে বললেন:

“আপনি কি জানেন যে আমাদের ট্রেনে কে আছে?”

“কে?”

“উনি… উনি… আমি নিশ্চিত…”

“কে উনি?”

“আর্সেন লুপাঁ!”

আমাদের সফরসঙ্গীর ওপর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও চোখ সরাননি মহিলা, আর ওই ভীতি জাগানিয়া নামটা উচ্চারণ করার সময়ও আমার দিকে না তাকিয়ে, উনি তাকিয়ে ছিলেন ওই লোকের দিকে। লোকটা নিজের মাথার টুপিটা টেনে নামিয়ে দিলো চেহারার ওপর। সেটা কি তার উৎকণ্ঠা আড়াল করার জন্য, না কি এমনিতেই ঘুমানোর প্রস্তুতি হিসাবে? তারপর আমি মহিলাকে বললাম:

“গতকালকে-ই আদালত অবমাননার দায়ে আর্সেন লুপাঁকে বিশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আজকেই আবার সবার সামনে হাজির হওয়ার মতো এতটা বেকুবি কাজ মনে হয় না সে করবে। তাছাড়া, পত্রিকায় লিখেছে সাঁৎ থেকে পালানোর পরে না-কি সর্বশেষ তুরস্কে দেখা গিয়েছে তাকে।”

“কিন্তু এই মুহূর্তে সে আমাদের এই ট্রেনেই আছে,” জোর গলায় বলে উঠলেন মহিলা, স্পষ্ট বোঝা গেল আমাদের সফরসঙ্গীর কানে কথাটা দেওয়াই ওনার উদ্দেশ্য; “আমার স্বামী পেনিটেনশিয়ারি সার্ভিসের (অপরাধীদের সংশোধনাগার) একজন পরিচালক, স্টেশনমাস্টার নিজে আমাদেরকে বলেছেন যে ট্রেনের মধ্যে আর্সেন লুপাঁর খোঁজ করা হচ্ছে।”

“ওরা মনে হয় কোনো ভুল করেছে–”

“না; তাকে না-কি ওয়েটিং রুমে দেখা গিয়েছে। হুয়নের ফার্স্ট-ক্লাস টিকিট কিনেছিল। কিন্তু তারপর গায়েব হয়ে গিয়েছে। ওয়েটিং রুমের দরজার গার্ড তাকে আর বের হতে দেখেনি, আর এই জন্য-ই সবাই ধরে নিয়েছে আমাদের দশ মিনিট পরে যে এক্সপ্রেসটা ছাড়বে সেটায় সম্ভবত গিয়ে উঠেছে।”

“তাহলে তো নিশ্চিতভাবে-ই এবার ধরা পড়ে যাবে আর্সেন লুপাঁ।”

“যদি না একদম শেষ মুহূর্তে সে নিজের ট্রেন থেকে নেমে গিয়ে এখানে উঠে আসে, মানে আমাদের ট্রেনে… যেমনটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি… আর সম্ভবত এমনটা-ই হয়েছে।”

“সে-রকমও যদি হয়, তাহলেও লুপাঁ এবার ধরা পড়বেই; কারণ ট্রেনের কর্মী আর গার্ডরা অবশ্যই তাকে এক ট্রেন থেকে অন্য ট্রেনে উঠতে দেখে থাকবে, এবং সুবিধামত পাকড়াও করবে।”

“গ্রেপ্তার করবে? আর্সেন লুপাঁকে? জীবনেও পারবে না! পালানোর একটা না একটা উপায় বের করে নেবেই সে।”

“তাহলে, তার জন্য ‘বন ভয়াজ।”

“আচ্ছা, কিন্তু ভেবে দেখেন এই সময়টাতেই সে কী কী করতে পারে!”

“কী?”

“জানি না। চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে।”

মহিলা খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন, এবং সত্যি কথা হচ্ছে পরিস্থিতিটাও এমনই যে তার এই স্নায়বিক উত্তেজনাকেও কিছুটা যথার্থ বলে মনে হলো। আমি তাকে বলতে বাধ্য হলাম:

“আরে, আজব সব কাকতালীয় ঘটনা তো ঘটে-ই, তবে আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যদি ধরেও নেই যে আর্সেন লুপাঁ এই ট্রেনে আছে, উলটাপালটা কিছু করার সাহস করবে না; যে বিপদে পড়েছে সেটা থেকে পালাতে পারলে-ই আপাতত খুশি হয়ে যাবে।”

আমার কথায় আশ্বস্ত হলেন না মহিলা, তবে চুপ করে গেলেন কিছুক্ষণের জন্য। হাতের পত্রিকাটা খুলে আর্সেন লুপাঁর বিচারকার্যের প্রতিবেদনটা পড়তে লাগলাম আমি, কিন্তু আমার জানা নেই এমন কিছুই ওখানে না থাকায়, খুব একটা মজা পেলাম না পড়ে। তার ওপর, আমার খুব ক্লান্ত লাগছিল এবং ঘুম পাচ্ছিল। টের পেলাম যে চোখের পাতা ভারী হয়ে, চুলে পড়ছে মাথাটা।

“আরে, মশাই, ঘুমাবেন না যেন!”

আমার হাতের পত্রিকাটায় টান দিয়ে, আমার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন মহিলা।

“আরে না না,” বললাম আমি।

“খুবই বোকার মতো কাজ হবে সেটা।”

“তা তো বটেই,” সায় দিলাম আমিও।

জেগে থাকতে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছিল। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য এবং ভাসমান মেঘরাজি দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে-ই সবকিছু ঘোলা আর ঝাপসা হয়ে এলো; উদ্‌বিগ্ন মহিলা এবং নিদ্রালু ভদ্রলোকটার কথা মুছে গেল স্মৃতি থেকে, আর আমি ডুবে গেলাম গাঢ় ঘুমের শান্তিময় গভীরতায়। শীঘ্রই আমার এই প্রতিক্রিয়ার শান্তি নষ্ট হলো নানান আজেবাজে স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে একটা চরিত্র ছিল এক ভৌতিক অবয়ব, তার নাম আবার আর্সেন লুপাঁ এবং পুরো ব্যাপারটাতেই সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেখি যে, সে পিঠভর্তি নানান মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে; তারপর একটা প্রাচীর লাফিয়ে পার হয়ে গিয়ে লুট করে নিয়ে আসে একটা দুর্গ। এরপর আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে সে, এবং অবয়বটার রূপরেখা আরও স্পষ্ট একটা আকার ধারণ করতে থাকে, তখন আর আর্সেন লুপাঁ থাকে না সে, একটু একটু করে বড়ো হতে থাকে তার আকার, শেষে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্রেনের কামরাটায়, এবং সোজা আমার বুকের ওপর এসে আছড়ে পড়ে। আতঙ্ক এবং ব্যথার মিশেলে একটা চিৎকার দিয়ে ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠি আমি। দেখি যে লোকটা, মানে ওই যাত্রী, আমাদের সফরসঙ্গী, আমার বুকের ওপর তার হাঁটু দিয়ে চাপ দিয়ে, আমার গলা টিপে ধরেছে।

দৃষ্টি একদম ঝাপসা লাগছিল আমার, কারণ চোখজোড়ায় সম্ভবত রক্ত জমে গিয়েছিল। কামরার এক কোনায় মহিলাকে চোখে পড়ল, ভয়ের চোটে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছেন। আমি এমনকি প্রতিরোধ করারও চেষ্টা করলাম না। তাছাড়া, গায়ে শক্তিও ছিল না। মাথার পাশটা দপদপ করতে লাগল; শ্বাস রোধ হয়ে প্রায় মরার জোগাড় হলো আমার। আর এক মিনিট পেরোলেই শেষে নিঃশ্বাস নেওয়া হয়ে যেত। লোকটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারল সেটা, কারণ তার মুঠিতে ঢিল পড়ল, তবে গলা থেকে হাত সরাল না। তারপর সে একটা রশি বের করল, সেটায় একটা স্লিপ-নট দিয়ে আমার দুই কব্জি বেঁধে দিলো একসাথে। মুহূর্তের মধ্যেই, বাঁধা হাত এবং মুখে কাপড় নিয়ে একেবারে অসহায় হয়ে পড়লাম আমি।

লোকটা এমন অনায়াস দক্ষতায় পুরো কাজ শেষ করলো যে নিশ্চিতভাবে-ই বোঝা গেল এসব কাজে তার দক্ষতা বহুদিনের। সন্দেহ নেই লোকটা পেশাদার চোর। একটা শব্দ বের হলো না মুখ দিয়ে, সামান্য খাপছাড়া নড়াচড়াও না; কিন্তু তবুও বোঝা গেল তার কুশলতা এবং আস্পর্ধা। আর আমি ওখানে পড়ে থাকলাম, ট্রেনের বেঞ্চের ওপর বসে, মমির মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা অবস্থায়, আমি-স্বয়ং আর্সেন লুপাঁ!

ব্যাপারটা আর যা-ই হোক হাসির ব্যাপার নয়, কিন্তু তবুও, পরিস্থিতি এমন গুরুতর হওয়া সত্ত্বেও, পুরো ব্যাপারটার হাস্যকার আর বিদ্রূপাত্মক দিকটাকে বেশ ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পারছিলাম আমি। আর্সেন লুপাঁ কিনা একটা নবিশের মতো আটক হয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে! এমনভাবে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছি যেন আমি একটা সাদাসিধা গ্রামের লোক। কারণ, নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন যে, বদমাইশটা আমার পার্স এবং ওয়ালেট নিয়ে নিয়েছে! আর্সেন লুপাঁ কিনা নিজেই এখন ভুক্তভোগী, ঠক খেয়েছে, পরাস্ত হয়েছে… এ কী কাণ্ড!

মহিলা জায়গা থেকে নড়লেন না। লোকটা এমনকি খেয়ালও করল না তার দিকে। মেঝেতে পড়ে থাকা মহিলার ট্রাভেল ব্যাগটা তুলে নিয়ে সেটার ভিতর থেকে গয়না, পার্স, এবং সোনা-রূপার ছোটোখাটো অলংকার বের করে নিয়ে-ই সন্তুষ্ট হলো সে। মহিলা চোখ খুললেন, তারপর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিজের আঙুল থেকে আংটিগুলো খুলে নিয়ে লোকটাকে এমনভাবে ধরিয়ে দিলেন যেন তাকে অযথা ঝামেলা থেকে বাঁচাতে চাচ্ছেন। লোকটা আংটিগুলো নিয়ে ফিরে তাকালো মহিলার দিকে। তাতেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন উনি।

সব শেষে, যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভঙ্গিতে লোকটা আবার বসে পড়ল নিজের আসনে, আর একটা সিগারেট ধরিয়ে এতক্ষণ ধরে যে ধনসম্পত্তি হাতিয়েছে সেগুলোকে দেখতে লাগলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। দেখে মনে হলো পরীক্ষণ প্রক্রিয়াটা তার মনে যারপরনাই ফুর্তি এনে দিচ্ছে।

কিন্তু আমি এতটা সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। অন্যায্য ভাবে একটু আগে আমার কাছ থেকে যে বারো হাজার ফ্রাঁংক কেড়ে নেওয়া হলো সেটা নিয়ে কোনো কথা ছিল না আমার: সেটা একটা সাময়িক লোকসান, কারণ জানতাম যে সামান্য দেরি হলেও নিশ্চিতভাবেই ওই টাকাটা আমার হাতে ফেরত আসবেই, সাথে আমার ওয়ালেটে থাকা গুরুত্বপূর্ণ সকল কাগজ-সমেত নানান পরিকল্পনা, বিবরণী, ঠিকানা, সংবাদদাতাদের তালিকা, এবং নানান স্পর্শকাতর তথ্য সম্বলিত চিঠিপত্র। তবে, সেই মুহূর্তে, আরও জরুরি এবং আরও গুরুতর একটা প্রশ্ন আমার মনের ভিতরে খচখচ করতে লাগলো: কীভাবে শেষ হবে এই ব্যাপারটা? এই অ্যাডভেঞ্চারের ফলাফল কী হবে?

আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, সেইন্ট-লাজারে স্টেশন দিয়ে আমার যাতায়াতের কারণে যে গোলমালের সূত্রপাত হয়েছে সেটা আমার নজর এড়ায়নি। আমি যে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলাম তারা আমাকে চেনে গিয়োম বারলাট নামে, আর ওদের কাছে আর্সেন লুপাঁর সাথে আমার সাদৃশ্যটা অনেকগুলো নির্দোষ হাস্যরসের বিষয়ের একটা, সেই কারণেই আমি কোনো ছদ্মবেশ নিতে পারিনি, এবং আমার উপস্থিতি নজরে পড়ে গিয়েছে কারও-না-কারও। তাই নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যায়, হুয়নের পুলিশকে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ইতোমধ্যে-ই। আর অসংখ্য এজেন্টের সহযোগিতায়, ট্রেনটা পাকড়াও করার জন্য অপেক্ষা করে আছে ওরা, লাগলে সকল সন্দেহজনক যাত্রীকে জিজ্ঞাসবাদ করবে, এবং ট্রেনের বগিগুলোতেও খুঁজে দেখবে।

অবশ্যই আমি আগেই টের পেয়েছিলাম ব্যাপারটা, কিন্তু সেটা আমাকে বিচলিত করেনি মোটেও, কারণ নিশ্চিত ছিলাম যে হুয়নের পুলিশের ঘটে প্যারিসের পুলিশের চাইতে বেশি ঘিলু নেই এবং সহজেই ধোঁকা দিতে পারবো ওদেরকে; সেইন্ট-লাজারের দারোয়ানের কাছে ‘রাষ্ট্রদূত’ হিসাবে আমার যে কার্ডটা দেখিয়ে সম্পূর্ণ প্রত্যয় জন্মাতে পেরেছিলাম, সেটাকেই আনমনে হুয়নে ওদের নাকের সামনে দোলালে-ই কি কাজ হয়ে যেত না? কিন্তু পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে বদলে গিয়েছে। সচরাচর যেসব কৌশল অবলম্বন করি সেসব খাটানো ছিল অসম্ভব। ট্রেনের একটা কামরাতেই, পুলিশের কমিসারি হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেই পেয়ে যাবে আর্সেন লুপাঁকে, ভেড়ার মতোই নিরীহ, একেবারে প্যাকেট করা অবস্থায়, শুধু তুলে নিয়ে প্রিজন ভ্যানে উঠানোর অপেক্ষা। তাকে শুধু পার্সেলটাকে ডেলিভারি নিতে হবে, ঠিক যেভাবে কোনো সওদা বা ফল কিংবা সব্জির ঝুড়ি গ্রহণ করা হয়। এই মানহানিকর সর্বনাশ থেকে বাঁচতে কী করা যায়? হাত-পা বাঁধা, মুখে কাপড়, এমন অবস্থায়? ট্রেনটা ছুটে চলেছে হুয়নের দিকে, পরবর্তী এবং একমাত্র স্টেশন সেটা।

নতুন একটা ঝামেলা দেখা দিলো, সেটায় অবশ্য আমার আগ্রহ কম। কিন্তু আগ্রহ কম থাকলেও নতুন এই ঝামেলার সমাধানটা আমার পেশাগত কৌতূহলকে জাগিয়ে তুলল। আমার বদমাইশ সফরসঙ্গীর মতলবটা আসলে কী? যদি আমি একা হতাম, তাহলে সে চাইলে, হুয়নে পৌঁছামাত্র বগিটা থেকে ধীরে সুস্থে সিনা টানটান করে বেরিয়ে যেতে পারত। কিন্তু মহিলা? কামরার দরজা খোলা মাত্র, মহিলাটা, যিনি এখন চুপচাপ এবং ভদ্র হয়ে আছেন, চিৎকার করে সাহায্য চাইতে থাকবেন। এই উভয় সংকটটা-ই আমাকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিলো! মহিলাকেও কেন আমার মতোই একই রকমের অসহায় অবস্থা করা হলো না? তাহলে লোকটা এই জোড়া অপরাধের ব্যাপারটা আবিষ্কার হওয়ার আগেই গায়েব হয়ে যাওয়ার জন্য প্রচুর সময় পেয়ে যেত হাতে।

তখনও সিগারেট খেয়ে চলেছে লোকটা, আর তার চোখ সেঁটে আছে জানালায়, যেটায় বৃষ্টির ছিটা লেগে ছোপ ছোপ হয়ে গিয়েছে। ওখান থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে, আমার টাইম-টেবিলটা তুলে নিয়ে সেটার ভেতরে পড়ে দেখতে লাগল সে।

শত্রুকে ধোঁকা দেওয়ার অভিপ্রায়ে মহিলা এতক্ষণ ধরে জ্ঞান না থাকার অভিনয় চালিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সিগারেটের ধোঁয়ার কারণে কাশির দমক উঠে যাওয়ার তার সত্যিকার অবস্থাটা ফাঁস হয়ে গেল। আর এদিকে, আমার খুবই অস্বস্তি লাগছিল এবং ক্লান্তিও পেয়ে বসেছিল তীব্র ভাবে। ধ্যান করার চেষ্টা করতে লাগলাম। মাথায় বাজিয়ে দেখতে লাগলাম, নতুন কোনো ফন্দি আসে কিনা।

ছুটে চলেছে ট্রেন।

সেইন্ট এতিয়েন পার হতে শুরু করল ট্রেন!… ঠিক সেই মুহূর্তে, লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো দুই কদম, আর তাতে মহিলা এবার প্রচণ্ড ভয়ের একটা চিৎকার দিয়ে উঠে আবার মূর্ছা গেলেন। এবারেরটা আর অভিনয় নয়, সত্যি সত্যিই মূর্ছা গেছেন। করতে চাচ্ছে কী লোকটা? আমাদের দিকের জানালাটা খানিকটা নামিয়ে দিলো সে। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, এবং একটা ভঙ্গি করে সাথে ছাতা বা ওভারকোট না থাকায় নিজের বিরক্তি প্রকাশ করল সে। কামরার তাকের দিকে চোখ গেল তার। মহিলার ছাতাটা আছে ওখানে। নিয়ে নিল সেটা। সাথে আমার ওভারকোটটাও নিয়ে পরে নিল

আমরা তখন সিন নদী পার হচ্ছি। নিজের প্যান্টের পায়া জোড়া ভাঁজ করে নিল লোকটা, তারপর ঝুঁকে পড়ে দরজার বাইরের দিকের ছিটকিনিটা তুলে দিলো। কী ব্যাপার? রেললাইনের ওপরে ঝাঁপ দেবে না কি? যে গতিতে ট্রেন আগাচ্ছে তাতে তো মারা পড়বে সাথে সাথে। একটা টানেলের ভেতরে ঢুকে পড়লাম আমরা। লোকটা দরজাটা অর্ধেক খুলে সিঁড়ির প্রথম ধাপের ওপরে দাঁড়িয়ে রইল। বেকুব না-কি! টানেলের অন্ধকার, ধোঁয়া, শোরগোল, সব মিলিয়ে লোকটার কার্যক্রমকে আরও বেশি উন্মত্ত দেখাতে লাগল। কিন্তু আচমকাই গতি কমে গেল ট্রেনের। এক মুহূর্ত পরেই বেড়ে গেল গতি, তারপর আবার ধীর হয়ে গেল। সম্ভবত টানেলের একটা অংশে কোনো ধরনের মেরামতের কাজ চলছে, যে কারণে ট্রেনগুলো বাধ্য হচ্ছে গতি কমাতে, আর লোকটারও জানা আছে সেই ব্যাপারটা। সে সাথে সাথে নিচের সিঁড়িতে নেমে গিয়ে, পেছনে দরজা বন্ধ করে দিয়ে লাফ দিলো মাটিতে। তারপরই হারিয়ে গেল।

মহিলার বুদ্ধিশুদ্ধি ফিরে এলো সাথে সাথেই, আর তার প্রথম কাণ্ড ছিল নিজের হারানো গয়নাগাটির জন্য কান্নাকাটি করা। সনির্বন্ধ অনুরোধের একটা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। বুঝতে পারলেন উনি, এবং দ্রুত আমার কণ্ঠ রোধ করে থাকা কাপড়টাকে সরিয়ে দিলেন। বেঁধে রাখা রশিগুলোও খুলে দিতে চাইলেন, তবে নিষেধ করলাম আমি।

“না, না, যেটা যেভাবে আছে, পুলিশকে সেভাবেই দেখতে দিতে হবে। আমি চাই ওরা দেখুক যে বদমাইশটা কী হাল করেছে আমাদের।”

“অ্যালার্ম-বেলটা টেনে দেবো না কি?”

“লাভ নেই। লোকটা যখন আমাকে চেপে ধরেছিল তখন করা উচিত ছিল কাজটা।”

“কিন্তু তাহলে তো ব্যাটা আমাকে মেরেই ফেলত। আহ! মশাই, আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম যে সে আছে এই ট্রেনে। ছবি দেখেই চিনে ফেলেছিলাম। আর এখন আমার গয়নাগাটি নিয়ে ভেগে গেল।”

“চিন্তা করবেন না। পুলিশ ধরে ফেলবে ওকে।

“আর্সেন লুপাঁকে ধরে ফেলবে! জীবনেও না।’

“সেটা নির্ভর করছে আপনার ওপর, ম্যাডাম। শুনুন, যখন আমরা হুয়নে পৌঁছাব, সাথে সাথে দরজায় পৌঁছে চ্যাঁচামেচি শুরু করবেন। শোরগোল জুড়ে দেবেন। পুলিশ আর রেলের কর্মচারীরা ছুটে আসবে। তাদেরকে জানাবেন যে আপনি কী দেখেছেন: আমার ওপরে যে হামলা হয়েছে সেটা এবং আর্সেন লুপাঁর পলায়নের ঘটনা। ভালো করে ওদেরকে তার বর্ণনা দেবেন—উলের টুপি পরনে, আপনার ছাতা, ছাই রঙা ওভারকোট…

“আপনার,” বলল সে।

“মানে! আমার? আরে নাহ। সেটা ওর-ই ছিল। আমার কোনো ওভারকোট নেই।”

“আমার তো মনে পড়ছে যে সে যখন ট্রেনে উঠে তখন তার কাছে কোনো ওভারকোট ছিল না।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ… তার মানে সম্ভবত কেউ একজন ভুলে তাকের ওপরে ফেলে গিয়েছিল কোটটা। সে যা-ই হোক, লোকটা পালানোর সময় নিয়ে গিয়েছে তা, আর সেটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। একটা ছাই রঙা ওভারকোট-মনে রাখবেন! আহ! ভুলেই গিয়েছিলাম। সবার আগে, আপনি নিজের নামটা বলবেন। আপনার স্বামীর পদমর্যাদা শুনলে পুলিশ আরও বেশি তৎপর হয়ে উঠবে।”

স্টেশনে এসে পৌঁছলাম আমরা। খানিকটা কর্তৃত্বপূর্ণ গলায় মহিলাকে আরও কিছু নির্দেশনা দিয়ে দিলাম:

“ওদেরকে আমার নামও বলবেন-গিয়োম বারলাট। যদি দরকার মনে হয়, তো বলবেন যে আমাকে চেনেন আপনি। তাহলে সময় বাঁচবে। চেষ্টা করতে হবে পুলিশ যেন খুব তাড়াতাড়ি তদন্তের কাজ শুরু করে দেয়। সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে আর্সেন লুপাঁকে খুঁজে বের করা। আপনার গয়নাগুলোর কথা মনে আছে তো! কোনো ভুল করবেন না। গিয়োম বারলাট, আপনার স্বামীর বন্ধু।’

“বুঝতে পেরেছি… গিয়োম বারলাট।”

মহিলা ততক্ষণে চিৎকার করতে করতে নানান অঙ্গভঙ্গি করতে শুরু করে দিয়েছেন। ট্রেনটা থেমে দাঁড়াতে-ই, বেশ কয়েকজন লোক উঠে এলো কামরায়। সবচেয়ে গুরুতর সময় উপস্থিত।

দম নেওয়ার জন্য হাঁপাতে হাঁপাতে মহিলা হাউমাউ করে বলতে লাগলেন:

“আর্সেন লুপাঁ… আমাদেরকে হামলা করেছিল… আমার গয়নাগাটি সব চুরি করে নিয়েছে… আমি ম্যাডাম রেনৌ… আমার হাজব্যান্ড পেনিটেনশিয়ারি সার্ভিসের একজন পরিচালক… আর! এই তো আমার ভাই, জর্জ আর্ডেল, ক্রেডি হুয়ানেসের পরিচালক… আপনারা তো চেনেন…”

মাত্রই এসে যোগ দেওয়া এক তরুণকে জড়িয়ে ধরলেন মহিলা, আর পুলিশের কমিসারি স্যালুট দিলো তাকে। তারপর আবার শুরু করলেন মহিলা ফোঁপাচ্ছেন:

“হ্যাঁ, আর্সেন লুপাঁ… এই মশাই যখন ঘুমাচ্ছিলেন, তখন সে ওনার গলা টিপে ধরে… মঁসিয়ে বারলাট, আমার স্বামীর বন্ধু।”

কমিসারি জিজ্ঞেস করলো:

“কিন্তু আর্সেন লুপাঁ কোথায়?”

“ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে গিয়েছে, একটা টানেলের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময়।”

“আপনি নিশ্চিত যে ওটা লুপাঁ-ই ছিল?”

“একশ ভাগ নিশ্চিত! একদম ঠিকঠাক চিনতে পেরেছি আমি তাকে। তাছাড়া, তাকে সেইন্ট-লাজারে স্টেশনেও দেখা গিয়েছে। মাথায় উলের টুপি…”

“না, শক্ত হ্যাট, ওটার মতো,” আমার হ্যাটের দিকে আঙুল দেখিয়ে কমিসারি বলল।

“তার মাথায় ছিল উলের টুপি, আমি নিশ্চিত,” আবার বললেন ম্যাডাম রেনৌ, “গায়ে ছাই রঙের ওভারকোট।”

“হ্যাঁ, সেটা ঠিক,” জবাব দিলো কমিসারি, “টেলিগ্রামে বলা আছে যে কালো ভেলভেটের কলারওয়ালা একটা ছাই রঙের ওভারকোট পরা ছিল তার।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, কালো ভেলভেটের কলার,” বিজয়ী ভঙ্গিতে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন ম্যাডাম রেনৌ।

আটকে ফেলা দমটা ছাড়লাম আমি। আহ! এই বেচারি মহিলা আমার কত ভালো একজন বন্ধুর কাজ করলেন।

পুলিশের লোকজন আমার সব বাঁধন খুলে দিলো। হাতে পায়ে রক্ত চলাচলের আগ পর্যন্ত ঠোঁট কামড়ে ধরে রইলাম আমি। তারপর চেহারার ওপর রুমাল চেপে, মাথা নিচু করে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। বেকায়দা অবস্থায় দীর্ঘ সময় কেউ আটকা থাকলে, এবং যার চেহারাতেই দেখা যাচ্ছে যে মুখ বেঁধে রাখার কারণে রক্ত জমে আছে, তার জন্য এমন আচরণ করাটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, দুর্বল গলায় কমিসারিকে ডাকলাম আমি:

“মশাই, ওটা আসলেই আর্সেন লুপাঁ ছিল। সেই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। যদি তাড়াতাড়ি করেন, তাহলে এখনও ধরা সম্ভব তাকে। আমি মনে হয় কিছুটা সাহায্য করতে পারব আপনাদেরকে।”

যে বগিটায় অপরাধটা সংঘটিত হয়েছে, সেটাকে ট্রেন থেকে আলাদা করে ফেলা হলো আনুষ্ঠানিক তদন্তের একটা নির্বাক সাক্ষী হিসাবে। আর ট্রেনটা ছুটে চললো হাভ্রের উদ্দেশ্যে। তারপর আমাদেরকে কৌতূহলী দর্শনার্থীদের ভিড় পেরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো স্টেশন-মাস্টারের অফিসে।

হঠাৎ করেই একটা দ্বিধা এবং ভাবনা জেগে উঠল আমার মধ্যে। কোনো- না-কোনো অজুহাতে, যে করেই হোক আমার গাড়িটাকে উদ্ধার করে নিয়ে পালাতে হবে। বেশিক্ষণ এখানে থাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। কিছু একটা ঘটে যেতে পারে; হয়তো দেখা গেল, প্যারিস থেকে কোনো টেলিগ্রাম চলে এসেছে, আর তাহলে গাড়িটাকে উদ্ধার-ই করা যাবে না।

হ্যাঁ, কিন্তু আমার চোরের কী হবে? নিজের সব জিনিসপত্র হারিয়ে, একটা অচেনা জায়গায় ব্যাটাকে ধরতে পারার আশা আমার ছিল না।

“বাহ! আমাকে একটা প্রচেষ্টা চালাতেই হবে,” নিজেকেই বললাম আমি। “হতে পারে যে খেলাটা কঠিন, কিন্তু দারুণ মজার খেলা, আর বিনিময়ে যা পাওয়া যাবে সেটার জন্য এই ঝামেলাটুকু করাই যায়।”

কমিসারি যখন আবার আমাদেরকে ডাকাতির ঘটনাটা খুলে বলতে বলল, আমি হড়বড় করে বলে উঠলাম:

“মশাই, আর্সেন লুপাঁ কিন্তু আমাদের হাত ফসকে যাচ্ছে। আমার গাড়িটা স্টেশনের চত্বরেই আছে। আপনারা যদি সদয় অনুমতি দেন ওটাকে ব্যবহার করার, তাহলে চেষ্টা…”

কমিসারি হাসলো, আর বলল:

“বুদ্ধিটা ভালোই; খুবই ভালো আসলে, তবে কাজটা ইতোমধ্যে করা হয়ে গিয়েছে। আমাদের দু’জন লোক বাইসাইকেলে করে বেরিয়ে পড়েছে। তারা গিয়েছেও বেশ কিছুক্ষণ হচ্ছে।”

“কোথায় গিয়েছে তারা?”

“টানেলের প্রবেশমুখে। ওখানে তারা তথ্য প্রমাণ খুঁজবে, সাক্ষী জোগাড় করবে, আর আর্সেন লুপাঁর ফেলে যাওয়া সূত্র অনুসরণ করবে।”

জবাব দিতে গিয়ে কাঁধ না ঝাঁকিয়ে পারলাম না আমি :

“আপনার লোকেরা কোনো তথ্য প্রমাণ বা সাক্ষী কিছুই জোগাড় করতে পারবে না।”

“আসলেই!”

“আর্সেন লুপাঁ জীবনেও টানেল থেকে বের হওয়ার সময় কারও চোখে পড়তে দেবে না নিজেকে। প্রথম সুযোগেই—”

“হুয়নে যাওয়ার রাস্তা ধরবে, আর আমরা তাকে গ্রেপ্তার করব সেখানে।”

“হুয়নে যাবে না সে।”

“তাহলে সে আশেপাশেই থাকবে। তাতেও তাকে গ্রেপ্তার করাটা আরও বেশি সহজ হবে।”

“সে জীবনেও আশেপাশে থাকবে না।“

“ওহ! তাহলে সে লুকাবে কোথায়?”

নিজের ঘড়ির দিকে তাকালাম আমি, আর বললাম :

“এই মুহূর্তে, আর্সেন লুপাঁ দার্নেতালের স্টেশনের আশেপাশে চুপিচুপি ঘোরাঘুরি করছে। দশটা পঞ্চাশে, মানে এখন থেকে বাইশ মিনিট পরে, সে হুয়ন থেকে আমিনসে যে ট্রেনটা যায় সেটায় চেপে বসবে।”

“তাই না কি? আপনি কীভাবে জানেন?”

“ওহ! ব্যপারটা খুবই সোজা। ট্রেনে থাকতে, আর্সেন লুপাঁ আমার রেলওয়ে গাইডটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিল। কেন করেছিল কাজটা? সে যেখানে ট্রেন থেকে নেমেছে, সেটার কাছাকাছি কি অন্য কোনো রেললাইন ছিল, আর সেই লাইন ধরে কি কোনো রেল স্টেশন আছে, আর সেই স্টেশনে কি কোনো ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে? আমার রেলওয়ে গাইডটি ঘেঁটে দেখে, আমি নিজেই খুঁজে পেয়েছি সেটা।”

“আসলেই মশাই,” কমিসারি বলল, “দারুণ জিনিস বের করেছেন, আপনার বুদ্ধি দেখে আমি অভিভূত।”

এবার আমি বুঝে ফেললাম যে এতটা বুদ্ধির ঝলক দেখিয়ে আসলে ভুল করে বসেছি। কমিসারি আমাকে অবাক চোখে দেখছে এখন, আর আমার মনে হলো যে তার দারোগা বুদ্ধিতে খানিকটা সন্দেহও ঢুকে গেল কিনা… ওহ! সেরকম হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ পুলিশ ডিপার্টমেন্ট নানান সংবাদমাধ্যমে যে আমার ছবিটা বের করেছে সেটার অবস্থা একদমই বাজে; তারা এমন একটা আর্সেন লুপাঁকে উপস্থাপন করেছে যেটা কমিসারির সামনে বসে থাকা লোকটার চাইতে এতটাই আলাদা যে ওই ছবি দেখে আমাকে শনাক্ত করা তার পক্ষে সম্ভবপর হবে না। কিন্তু একইসাথে লোকটা বেশ অস্থির, বিভ্রান্ত আর হতবুদ্ধি হয়ে আছে।

“খোদার কসম! নিজের টাকার ব্যাগ হারানো, এবং সেটাকে উদ্ধার করার আকাঙ্ক্ষা আপনার মগজকে যতটা উদ্দীপ্ত করতে পারবে, অন্য কিছুই সেভাবে পারবে না। আর আমার মনে হচ্ছে যে আপনি যদি আমাকে আপনার দুটো লোক দেন, তাহলে আমরা হয়তো…”

“ওহ! আপনাকে বিনীত অনুরোধ করছি, মঁসিয়ে কমিসারি,” আর্তনাদ করে উঠলেন ম্যাডাম রেনৌ, “মঁসিয়ে বারলাটের কথাটা শুনুন।”

আমার চমৎকার বন্ধুটির এই বাগড়া দেওয়াটাই কাজে দিলো শেষ পর্যন্ত। একজন প্রভাবশালী সরকারী কর্তার স্ত্রীর মুখ থেকে বেরিয়েছে বলে কথা! বারলাট নামটা আসলেই আমার নাম হিসাবে পরিগণিত হলো, এবং আমাকে এমন একটা পরিচয় এনে দিলো যেটা কোনো মামুলি সন্দেহ বিনষ্ট করতে পারবে না। কমিসারি উঠে দাঁড়িয়ে বললো:

“বিশ্বাস করেন, মঁসিয়ে বারলাট, আপনি সফল হলে আমি খুবই খুশি হব। আর্সেন লুপাঁকে ধরতে আপনি যতটা আগ্রহী, আমিও ঠিক ততটাই।”

কমিসারি নিজেই আমাকে আমার গাড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে তার দু’জন লোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। এদেরকে আমাকে সাহায্য করার জন্য নিযুক্ত করা হলো। শোফার গাড়ি চালু করে দিলে, হুইলের পেছনে নিজের জায়গায় চড়ে বসলাম আমি। কয়েক সেকেন্ড পরে, বেরিয়ে আসলাম স্টেশন ছেড়ে। বেঁচে গেলাম এ যাত্রা।

আহ! স্বীকার করতেই হবে যে এই প্রাচীন নরম্যান শহরটাকে ঘিরে রাখা মহাসড়কটা দিয়ে, পঁয়ত্রিশ হর্স-পাওয়ারের মরৌ-লেপ্টন গাড়িটা চালাতে চালাতে, আমার মধ্যে গর্বের একটা গভীর অনুভূতি ভর করলো, এবং আমার ইচ্ছার প্রতি সদরদে সাড়া দিলো গাড়িটাও। ডানে বামে গাছগুলো আমাদেরকে ছাড়িয়ে উড়ে যেতে লাগল চমকে দেওয়া দ্রুততায়, এবং আমিও এখন মুক্ত এবং নিরাপদ, শুধু পেছনে বসে থাকা হুয়ন পুলিশের দু’জন সৎ প্রতিনিধির সাথে আমার ছোটোখাটো ব্যক্তিগত বিষয়গুলো ঠিকঠাক করে নিলেই হবে। আর্সেন লুপাঁ যাচ্ছে আর্সেন লুপাঁকে খুঁজতে।

সামাজিক আইন-শৃঙ্খলার বিশিষ্ট রক্ষক-গ্যাস্তন ডেলিভেট এবং অনর ম্যাসোল-আপনাদের সহযোগিতা যে কতটা মূল্যবান ছিল! আপনারা না থাকলে আমার যে কী হতো? আপনারা না থাকলে, কতবার যে চৌরাস্তাগুলোয় হয়তো আমি ভুল পথে চলে যেতাম! আপনারা না থাকলে এক আর্সেন লুপাঁ ভুল করে বসত, আর অন্যটা পালিয়ে যেত!

কিন্তু কাজ এখানেই শেষ না। দিল্লি বহুত দূর। আমাকে এখনও ওই চোরটাকে ধরতে হবে এবং চুরি যাওয়া কাগজগুলোকে উদ্ধার করতে হবে। কোনো পরিস্থিতিতেই, কাগজগুলো আমার এই দুই সঙ্গীর হাতে পড়া তো দূরে থাক, চোখে পড়াও চলবে না। আর এই ব্যাপারটাই সম্ভবত আমাকে কিছুটা ঝামেলায় ফেলতে পারে।

আমরা দার্নেতালে পৌঁছলাম ট্রেন ছাড়ার তিন মিনিট পরে। এটা ঠিক, আমি অন্তত এটা জেনে সান্ত্বনা পেলাম যে কালো ভেলভেটের কলারওয়ালা ছাই রঙা ওভারকোট পরা একজন লোককে আসলেই এই স্টেশন থেকে ট্রেনে চাপতে দেখা গিয়েছে। আমিনসের একটা সেকেন্ড-ক্লাস টিকিট কেটেছিল সে। নিশ্চিতভাবে-ই বলা যাচ্ছে যে গোয়েন্দা হিসাবে আমার অভিষেকটা বেশ দারুণ হলো।

ডেলিভেট আমাকে বললো;

“এটা একটা এক্সপ্রেস ট্রেন, এরপরে থামবে মন্তেরোলিয়ে-বুশি স্টেশনে, আর উনিশ মিনিট পরে। আমরা যদি ওখানে আর্সেন লুপাঁর আগে পৌঁছাতে না পারি, তাহলে সে আমিনসে নেমে পড়তে পারে, বা ট্রেন বদলে ক্লেয়াতে যাওয়ার ট্রেনেও উঠে যেতে পারে, আর পরে ওখান থেকে ডিয়েপ্পে বা প্যারিসে চলে যেতে পারবে।”

“মস্তেরোলিয়ে কত দূর?”

“তেইশ কিলো।”

“উনিশ মিনিটে তেইশ কিলো… ওর আগেই আমরা ওখানে পৌঁছে যাব।”

আবারও রাস্তায় নেমে পড়লাম আমরা! এর আগে কখনোই মরৌ- লেপটনটাকে আমার ব্যাকুলতার প্রতি এতটা উদ্যম এবং নিয়মনিষ্ঠা নিয়ে সাড়া দিতে দেখিনি। গাড়িটাও যেন নিয়ে নিল আমার দুশ্চিন্তার ভাগ। আমার দৃঢ়সংকল্পকে নিজের করে নিল। ওই বদমাইশ আর্সেন লুপাঁর প্রতি আমার বৈরিভাবকে নিজের মধ্যে ধারণ করল। শালা হতচ্ছাড়া! শালা বেইমান!

“ডানে যান,” আর্তনাদ করে উঠলো ডেলিভেট, “তারপর বামে।”

বলা যায় প্রায় উড়ে চললাম আমরা, মাটি স্পর্শ করছিলাম-ই না বলা চলে। মাইল-স্টোনগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল ছোটা ছোটো সম্ভ্রস্ত জানোয়ার, যেগুলো আমাদেরকে দেখেই ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই, একটা মোড় পার হওয়ার পর, দেখি যে ধোঁয়ার ঘূর্ণি দেখা যাচ্ছে। সেটাই ছিল নর্দান এক্সপ্রেস। প্রথম এক কিলোমিটার, দুটোর মধ্যে পাশাপাশি সমানে সমান লড়াই চলল, তবে প্রতিযোগিতাটা যে অসম সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল খানিক পরেই। রেসটা আমরা জিতলাম প্রায় বিশ লেংথের ব্যবধানে।

তিন সেকেন্ডের ভেতরে আমরা প্লাটফর্মে ওঠে, সোজা গিয়ে দাঁড়ালাম সেকেন্ড-ক্লাসের বগির সামনে। দরজা খুলে গেল, এবং নেমে এলো কয়েক জন যাত্রী, কিন্তু আমার চোরা ব্যাটা নামল না। কামরাগুলোয় খোঁজাখুঁজি করে দেখলাম আমরা। তবে আর্সেন লুপাঁর কোনো নিশানা দেখা গেল না।

“গুড হেভেন!” বিলাপ করে উঠলাম আমি, “ট্রেনের সাথে প্রতিযোগিতা করার সময়, নিশ্চিত গাড়িতে আমাকে দেখে চিনে ফেলেছে সে, আর আবারও ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে গিয়েছে।”

“আরে! ওইতো সে! লাইন পার হচ্ছে।”

লোকটাকে ধাওয়া করা শুরু করলাম আমি, আমার দুই অনুচরও পিছু নিল, বা বলা যায় যে ওদের একজন পিছু নিল, অন্য জন না, কারণ নিজেকে একজন অসামান্য গতি এবং দমসম্পন্ন দৌড়বাজ হিসাবে প্রমাণ করল ম্যাসোল। কয়েক মুহূর্তে পরে-ই, সে আমাদের ফেরারিকে প্রায় ধরে ফেলতে পারার মতো দূরত্বে এগিয়ে চলে গেল। লোকটাও খেয়াল করল সেটা, লাফিয়ে সে পেরিয়ে গেল একটা ছোটো বেড়া, তারপর একটা মাঠের ভেতর দিয়ে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ছুট দিয়ে, একটা ঘন উপবনের ভিতরে ঢুকে পড়ল। আমরা উপবনটার কাছে পৌঁছে দেখি, ম্যাসোল অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। সে আর ভেতরে যায়নি, কারণ তাতে আমরা হয়তো পথ খুঁজে পেতাম না।

“সমস্যা নেই, ভাইয়েরা,” বললাম আমি। “এরকম একটা দৌড়ের পর, আমাদের শিকারের নিশ্চিত দম ফুরিয়ে গিয়েছে। এখন তাকে ধরা কোনো ব্যাপার হবে না।”

আশেপাশের জায়গাটা খুঁজে দেখলাম আমি, মাথায় এই চিন্তা নিয়ে যে ফেরারিটাকে আমি একাই যেন ধরতে পারি, যাতে করে আমার কাগজপত্রগুলো আমার হাতেই পড়ে, কারণ ওগুলো ফাঁস হলে কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু বেমানান প্রশ্ন করে বসবে, কোনো সন্দেহ নেই। তারপর আমি আমার সঙ্গীদের কাছে ফিরে গিয়ে বললাম:

“কাজটা খুব সহজ হবে। ম্যাসোল, আপনি বাম দিকে যান; আপনি, ডেলিভেট, যান ডান দিকে। সেখান থেকে আপনারা বনটার পুরো পেছনের দিকটা খেয়াল করতে পারবেন, তাতে শুধু ওই খাদটা বাদে আপনাদের নজরে না পড়ে সে পালাতে পারবে না, আর আমি যাচ্ছি ওখানে খুঁজে দেখতে। যদি যে স্বেচ্ছায় ধরা না দেয়, তাহলে আমি খাদের ভেতরে নেমে গিয়ে, ধাওয়া করে আপনাদের দুজনের একজনের দিকে নিয়ে যাব। আপনারা শুধু চোখ-কান খোলা রেখে বসে থাকেন। আহ! ভুলেই গিয়েছিলাম: যদি আপনাদেরকে আমার দরকার হয়, তাহলে ফাঁকা গুলি করব।”

ম্যাসোল এবং ডেলিভেট যার যার জায়গায় হেঁটে এগিয়ে গেল। ওদের দু’জন দৃষ্টির আড়ালে যাওয়া মাত্রই, আমি বনটার ভেতর প্রবেশ করলাম সর্বোচ্চ সতর্কতা নিয়ে; যাতে কেউ আমাকে না দেখে বা শোনে। ভেতরে ঢুকে দেখি, গাছ কেটে একটা সরু পথ বানানো আছে, কিন্তু ঝুলে থাকা ডালপালার জন্য মাথা নামিয়েই এগিয়ে যেতে হলো। পথগুলোর একটা গিয়ে মিশেছে একটা ফাঁকা মতো জায়গায় যেখানে ভেজা ঘাসের ওপরে পায়ের ছাপ চোখে পড়ল আমার। সেটা অনুসরণ করে এগোলাম আমি; ছাপগুলো আমাকে নিয়ে গেল একটা ঢিবির গোঁড়ায়, যেটার চূড়ায় দেখা গেল একটা খালি, ভাঙাচোরা বাড়ি।

“ব্যাটা নিশ্চিত ওখানেই গিয়েছে,” নিজেকেই বললাম আমি। “লুকানোর জন্য জায়গাটা একেবারে খাপে খাপ। “

বাড়িটার একপাশে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলাম আমি। মৃদু একটা শব্দ আমাকে জানিয়ে দিলো যে বদমাইশটা ওখানেই আছে; এবং, তারপরেই একটা ছিদ্র দিয়ে দেখতে পেলাম তাকে। আমার দিকে পিঠ দিয়ে আছে। দুই লাফ দিয়ে চড়াইটা পেরিয়ে এসে, চড়াও হলাম লোকটার ওপরে। হাতে ধরে রাখা রিভলভারটা দিয়ে গুলি করার চেষ্টা করল সে। কিন্তু সময় পেল না। ধাক্কা দিয়ে এমনভাবে মাটিতে ফেলে দিলাম, যেন তার হাতটা মুচড়ে গিয়ে শরীরের নিচে বেকায়দা হয়ে থাকে, আর আমি তার বুকের ওপরে ওঠে, হাঁটু চাপা দিয়ে ধরে রাখলাম মাটির সাথে।

“শোন, ব্যাটা,” ওর কানে কানে ফিসফিস করে বললাম আমি। “আমি আর্সেন লুপাঁ। তুই এখন ঝটপট সুন্দও মতো আমার ওয়ালেট, আর ওই ভদ্রমহিলার গয়নাগাটি যা নিয়েছিস তা ফেরত দিয়ে দে, বদলে আমি তোকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাব, এবং তোকেও আমার বন্ধুদের একজন করে নেব। এক কথায় বল: হ্যাঁ না-কি না?”

“হ্যাঁ,” বিড়বিড় করে বলল সে।

“খুব ভালো। আজকে সকালে তোর পালানোর ব্যাপারটা দারুণ বুদ্ধির ছিল। এজন্য অভিনন্দন।”

উঠে দাঁড়ালাম আমি। কিন্তু লোকটা নিজের পকেট হাতড়ে, একটা বিশাল ছুরি বের করে এনে আমাকে কোপ বসানোর চেষ্টা করল সেটা দিয়ে।

“মুর্খ,” হতাশ হয়ে গেলাম আমি।

এক হাত দিয়ে আমি আটকালাম আঘাতটা; অন্যটা দিয়ে তার ক্যারোটিড আর্টারিতে দড়াম করে একটা রদ্দা বসিয়ে দিলাম। পড়ে গেল সে-অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে!

আমার পার্স থেকে কাগজপত্র এবং ব্যাংক-নোটগুলো উদ্ধার করলাম। কৌতূহলবশত, বের করে নিলাম তারটাও। একটা খাম পেলাম, যেটায় লোকটার ঠিকানা লেখা, সেখানে নাম পড়তে পারলাম: পিয়েরে অনফ্রে। চমকে গেলাম আমি। পিয়েরে অনফ্রে, অত্তয়-এর লাফতে রাস্তার খুন! পিয়েরে অনফ্রে, যে কিনা ম্যাডাম ডেলবইস এবং তার দুই কন্যার গলা কেটে হত্যা করেছে। লোকটার উপর ঝুঁকে পড়লাম আমি। হ্যাঁ, এই বৈশিষ্ট্যগুলো- ই ট্রেনের কামরায় আমার স্মৃতিকে জাগরুক করে তুলেছিল একটা চেহারার ব্যাপারে, তখন মনে করতে পারছিলাম না।

কিন্তু সময় চলে যাচ্ছে। আমি একটা খামে দুটো একশো ফ্রাঁংকের ব্যাংক-নোট রেখে, ভেতরে একটা চিরকুট লিখলাম:

‘যোগ্য সহকর্মী অনর ম্যাসোল এবং গ্যাস্তন ডেলিভেটের প্রতি আর্সেন লুপাঁ, কৃতজ্ঞতার সামান্য নিদর্শন স্বরূপ।’

তারপর খামটাকে ঘরের মধ্যে ভালোমতো চোখে পড়ে এমন একটা জায়গায় রাখলাম, যাতে ওরা দু’জন নিশ্চিতভাবে খুঁজে পায় সেটাকে। পাশেই, রাখলাম ম্যাডাম রেনৌ-এর হাত ব্যাগ। যে মহিলার সাথে আমার এত খাতির হয়ে গিয়েছে, তার জিনিস কেন আমি ফেরত দিতে পারব না? এটা ঠিক যে, আমার পছন্দ হয়েছে বা মূল্যবান যা কিছু ছিল সেই সবই অবশ্য আগেই ভেতর থেকে বের করে নিয়েছিলাম, শুধু ছিল একটা শামুকের খোলসের তৈরি চিরুনি, ঠোঁটের জন্য একটা ব্যবহৃত ডোরিন লিপিস্টিক, আর একটা খালি পার্স। কিন্তু, জানেন-ই তো, বিজনেস ইজ বিজনেস। আর তাছাড়া, সত্যিটা হচ্ছে, তার স্বামী একটা অত্যন্ত অসম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত আছেন।

লোকটার জ্ঞান ফিরে আসছে। কী করা যায় এখন? আমার পক্ষে তাকে বাঁচানো সম্ভব ছিল না আবার ধরিয়ে দেওয়াও না। তাই আমি তার রিভলভারটা তুলে নিয়ে বাতাসে গুলি করলাম একটা।

“আমার দুই সঙ্গী এসে ব্যাপারটা দেখবে এখন,” নিজেকেই বললাম আমি, আর খাদটার ভেতর দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে সরে যেতে লাগলাম ওখান থেকে। বিশ মিনিট পর, নিজের গাড়িতে গিয়ে চড়ে বসলাম।

চারটার সময়, হুয়নে আমার বন্ধুদেরকে টেলিগ্রাম করলাম যে একটা অনিবার্য কারণবশত আমি আমার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ঘুরতে আসতে পারছি না। যেহেতু আমার বন্ধুরা এতক্ষণে নিশ্চিত জেনে গিয়েছে যা জানার, তার মানে হলো আমার ভ্রমণটা আসলে পিছিয়ে গিয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। ওদের জন্য কী নিষ্ঠুর মোহভঙ্গ হলো আসলে।

ছয়টার সময় আমি পৌঁছে গেলাম প্যারিসে। সান্ধ্য পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম যে পিয়েরে অনফ্রেকে পাকড়াও করা সম্ভব হয়েছে অবশেষে।

যথাযোগ্য বিজ্ঞাপনের কেরামতিকে অবজ্ঞা করা উচিত না আসলে-সেটার জোরেই পরের দিন নিচের দারুণ খবরটা প্রকাশ করে ‘একো দ্য ফ্রান্স’:

‘গতকাল, বুশির কাছে, বেশ কিছু উত্তেজনাকর ঘটনার পর, পিয়েরে অনফ্রের গ্রেপ্তারের অভিযানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আর্সেন লুপাঁ। লাফতে রাস্তার এই কুখ্যাত খুনি, প্যারিস-হাত্রের লাইনের একটা ট্রেনের বগিতে পেনিটেনসিয়ারি সার্ভিসের একজন পরিচালকের স্ত্রী- ম্যাডাম রেনৌকে ছিনতাই করে। মাদাম রেনৌকে তার গয়না রাখা ব্যাগটা ফেরত দিয়েছে আর্সেন লুপাঁ, এবং এই নাটকীয় গ্রেপ্তার অভিযানে তাকে সহযোগিতা করেছে যে দু’জন গোয়েন্দা তাদেরকেও দিয়েছে বেশ মোটা বখশিশ।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *