দ্য মার্ডার্স ইন দ্য রু মার্গ
আমরা যে-সব মানসিক অবস্থাকে বিশ্লেষণাত্মক বলে চিহ্নিত করি প্রকৃতপক্ষে কিন্তু সেগুলো আদৌ বিশ্লেষণের আওতায় পড়ে না। কেন? এমন কথা কেন বলছি? হ্যাঁ, কারণ তো কিছু-না-কিছু অবশ্যই আছে। কারণ, তাদের ফলাফলই আমাদের এ-কথা ভাবতে উৎসাহি করে।
একটা কথা কি জানেন? আসলে সে সব মানসিক পরিস্থিতির অধিকারীদের কাছে। সেগুলো যারপরনাই আনন্দবর্ধক ব্যাপার হয়ে ওঠে।
একজন অমিত শক্তিধর যেমন শক্তি কসরতের খেল ও কেরামতি দেখাতে পারলে খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনই একজন বিশ্লেষণধ্যক্ষ জটিলতা নাশকারীর বুক নৈতিক কাজকর্মের ব্যাপারে গর্বে রীতিমত ফুলে ওঠে। আর এটা মোটেই অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। আশা করি, এ-যুক্তিটাতে সবাই আমার সঙ্গে অবশ্যই একমত হবেন।
একজন বিশ্লেষণধর্মী মানুষ নিজের ধী-শক্তি আর জ্ঞান-বুদ্ধিকে প্রয়োগ করার একটু-আধটু সুযোগ পেলেও যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ার যোগাড় হয়। সাংকেতিক লিপি, ধাঁধা আর হেঁয়ালির প্রতি তার খুবই প্রবণতা। সে সব সমস্যার সমাধান করতে যতটুকু প্রতিভা আর বুদ্ধি প্রয়োগ করার প্রয়োজনবোধ করে অন্য পাঁচজন সাধারণ মানুষ সেটাকে অত্যাশ্চর্য ব্যাপার জ্ঞান করে। নিতান্ত অসাধারণ ভেবে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে। রহস্যভেদি সে-সব সমস্যার সমাধান যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধান করে, তাতে বোধির প্রকাশটাই প্রকৃতপক্ষে বেশি গুরুত্ব পায়।
একটা কথা হচ্ছে, সমস্যার জটিলতার সমাধানের এ-ক্ষমতা হয়তো বা গণিতচর্চার মাধ্যমে যথেষ্ট বৃদ্ধি করা যেতে পারে। গণিতের যে সর্বোচ্চ শাখা বিশ্লেষণ নামে যাকে অভিহিত করা হয় তার কথাই এখানে বিশেষভাবে বলা হচ্ছে। অতএব বলা যেতে পারে বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে হয়তো বা সমস্যা সমাধান সম্ভব।
তবে আর একটা কথা কিন্তু খুবই সত্য যে, গনামাত্রই বিশ্লেষণ নয়। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, একজন দাবাড় কিন্তু বহু হিসাব-নিকাশ করে তবেই দাবার চাল দেয়। এক্ষেত্রে সে কিন্তু বিশ্লেষণ-টিশ্লেণের ধারের কাছ দিয়েও যায় না। এ ব্যাপারটা থেকে এটাই ভেবে নেওয়া যেতে পারে যে, দাবা খেলা দাবাড়ুর মনের ওপর যে প্রভাব বিস্তার করে তাকে খুব বেশি করে ভুলের মাপকাঠি দিয়ে বিচার করা হয়। খুবই ভুল বোঝা হয়।
কোনো প্রবন্ধ রচনা করা বর্তমানে আমার উদ্দেশ্য নয়। সে চেষ্টা আমি করবও না। অনিয়মিতভাবে দীর্ঘদিন ধরে চাক্ষুষ করা একটা কাহিনীর ভুমিকা রচনা করছি, ব্যস, এর বেশি কিছু নয়। তাই এ সুযোগে এ-কথাটাই বলতে চাইছি যে, আনাড়ি দাবা খেলার চেয়ে আড়ম্বরহীন ড্রাফট চিন্তা-ভাবনা ও বুদ্ধি খরচের দরকার ঢের বেশি।
দাবাড়ুরা জানেন, এ খেলায় বিভিন্ন গুটিকে বিভিন্নভাবে চলতে হয় বলে, আর তাদের শক্তিও বিভিন্ন রকম হওয়ার জন্য তার জটিল পদ্ধতিকেই প্রতিভা, পাণ্ডিত্বের মর্যাদা দিয়ে ভুল করা হয়।
সত্যি কথা বলতে কি, দাবাড়রাও অবশ্যই এক বাক্যে স্বীকার করবেন, এ-খেলার সবচেয়ে বেশি যেটার দরকার তা হচ্ছে, গভীর মনঃসংযোগ।
এক মুহূর্তের জন্যও যদি খেলোয়াড়ের মন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে, চিন্তা ছিন্ন হয়ে যায়, একটা চাল কোনোক্রমে নজর এড়িয়ে গেলেই সর্বনাশের চূড়ান্ত হয়ে যাবে। তাকে পরাজয়ের গ্লানি গায়ে মাখতে হবেই হবে।
প্রয়োজনীয় সম্ভাব্য চালগুলো যে কেবলমাত্র একাধিক তাই নয়, অতিমাত্রায় জটিলও অবশ্যই। আর এ কারণে অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশিই থাকে। সে দাবাড়ই প্রখর বুদ্ধিমত্তা আর মনংসযোগ সম্বল করে জয়মাল্য ছি নিয়ে নিতে সক্ষম হয়।
অন্যদিকে ড্রাফট খেলার কথা আলোচনা করতে গিয়ে বলতেই হয়, এ খেলায় প্রতিটা চাল খুব বেশি একক, যার ফলে অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ার সম্ভাবনা এতে খুবই কম, নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। আর মনোযোগের পরিবর্তে খেলার নৈপুণ্যই জয়মাল্য এনে দেয়।
এবার যা বলতে চাইছি তা হচ্ছে, এমন একটা ড্রাকট খেলার প্রসঙ্গে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে, যেখানে রাজার আকাঙ্খ চালে কমানো হলো। সে ক্ষেত্রে তা দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার তিলমাত্রও সম্ভাবনা নেই। এক্ষেত্রে জয়-পরাজয় নির্ধারণটা কিভাবে হবে, তাই না? আমি বলব, অবশ্যই হেরফেরের জন্যই জয় বা পরাজয়ের দিকে পাল্লা ঝুঁকবে।
হুইস্ট খেলার প্রভাবের খ্যাতি দীর্ঘদিন ধরেই বিচার শক্তির ওপর প্রচলিত রয়েছে। যারা তীক্ষ্মতম প্রতিভার অধিকারী, তারা এ-খেলায় অহেতুক আনন্দ উপভোগ করে। তাদের মতে দাবা খেলা নিছকই একটা তুচ্ছাতিতুচ্ছ খেলা।
নিঃসন্দেহে বলা চলে, হুইস্ট খেলার মতো অন্য আর কোনো খেলায় বিশ্লেষণ ক্ষমতার কিছুমাত্রও হয় না।
হুইস্ট খেলায় যে সুদক্ষ জীবনের অন্য যেসব পরিস্থিতিতে মনের সঙ্গে মনের দ্বন্দ্ব চলে, সে ক্ষেত্রেও জয়মাল্য লাভের হিম্মত তার আছে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, হুইস্ট খেলায় সুদক্ষ বলতে কি বুঝায়? আমার মতে, সুদক্ষ হচ্ছে সেই পূর্ণতা, ন্যায়সঙ্গত সুবিধা লাভের যাবতীয় উৎস যেখানে করায়ও। সে উৎস বলতে কেবলমাত্র বহু সংখ্যক নয়। বিভিন্ন ধরনেরও বটে। সাধারণত অন্তরের অন্তরতম কোণে যেগুলো সঞ্চিত থাকে, সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধিতার ধারে কাছেও যেতে পারে না।
একটা কথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে, সহজ-সরল বুদ্ধি আর বিশ্লেষণাত্মক শক্তিকে একটা দাঁড়িপাল্লায় ফেলে বিচার করা উচিত নয়। তবে তো উভয়কে গুলিয়ে ফেলাই হবে। কারণ যে ব্যক্তি বিশ্লেষক তাকে তো অবশ্যই বুদ্ধির অধিকারী হতেই হবে।
এমনও তো হতে পারে, একজন বুদ্ধিমান মানুষ বিশ্লেষণের ব্যাপার স্যাপারে নিতান্তই অক্ষম হতে পারে।
বিশ্লেষণ ক্ষমতা আর বুদ্ধিমত্তার যে পার্থক্য তা কল্পনার পার্থক্যের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি। উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও কল্পনার পার্থক্যের চেয়ে অনেক বেশি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
প্রকৃতপক্ষে যা দেখা যায়, সত্যিকারের কল্পনাশক্তিসম্পন্ন মানুষ কোন অবস্থাতেই বিশ্লেষক ভিন্ন অন্য কিছু হয় না।
উপরোক্ত বক্তব্যের সমর্থনে পাঠক-পাঠিকাদের কাছে যে কাহিনীর উল্লেখ করছি, তা যথোপযুক্ত হবে বলেই আমি মনে করছি।
আঠারো–সালের বসন্ত আর গ্রীষ্মের অংশবিশেষ, আমি প্যারিসে কাটিয়েছিলাম। তখন যেখানে বসবাসকালে মি. সি. অগাস্ত দুর্পর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আর সে পরিচয় ক্রমে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়ে ওঠে।
মি. দুপঁ এক সুপ্রতিষ্ঠিত পরিবারের যুবক ছিল।
এক সময় মি. দুপঁ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির চাপে পড়ে দারিদ্রের চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। আর দারিদ্রের নিষ্ঠুর আঘাতে আঘাতে তার চারিত্রিক শক্তি চাপা পড়ে যায়। ক্রমে সে মনের দিক থেকে এতই ভেঙে পড়ে যে, বাইরের জগতের সঙ্গে মেলামেশা অথবা খোয়া-যাওয়া পৈত্রিক সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করার ব্যাপারে পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিয়েছিল।
তবে উত্তমর্ণের সহানুভূতি ও উদার মানসিকতার দৌলতে পৈত্রিক সম্পত্তির কিঞ্চিৎ তখনও তার দখলে ছিল। তা থেকে যৎসামান্য যা-কিছু আয় হতো তা থেকেই কোনোরকমে বেঁচে থাকার অত্যাবশ্যক সামগ্রি সংগ্রহ করে দিন গুজরান করত। অবান্তর ব্যাপার স্যাপার নিয়ে সে মোটেই মাথা ঘামাত না না।
মি. দুঁপের একমাত্র বিলাসিতা বলতে ছিল, পুঁথিপত্র সংগ্রহ করা। আর তা প্যারিস শহরে সহজেই সংগ্রহ করা যায়। ব্যস, এ ছাড়া অন্য কোনো বস্তুর দিকে তার। কিছুমাত্র ঝোঁকও ছিল না।
মি. সি. আগস্ত দুঁপের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা, পরিচয় হয় একটা অখ্যাত গ্রন্থাগারে। সেটা রুম মর্তার নামক অঞ্চলে অবস্থিত। আর পরিচয়ের সূত্রটাও ছিল অত্যাশ্চর্য। ঘটনাচক্রে আমরা উভয়েই খুবই নামকরা এবং দুপ্রাপ্য একটা বইয়ের খোঁজ করছিলাম। সে উপলক্ষ্যেই আমাদের মধ্যে পরিচয় ঘটে। দীর্ঘসময় ধরে উভয়ের মধ্যে কথাবার্তা হয়। তার পরই ক্রমে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা জন্মে।
প্রথম পরিচয়ের পর থেকে আমাদের মধ্যে ঘন ঘন দেখা হতে লাগল।
ফরাসিদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নিজের সম্বন্ধে, নিজের পরিবার সম্বন্ধে কথা বলার ব্যাপারে তারা যারপরনাই উৎসাহবোধ করে। সে-ও ঠিক একই রকমভাবে আমাকে তার পরিবারের ইতিকথা গল্পাকারে শুনিয়েছিল। আমিও খুবই আগ্রহের সঙ্গে, ধরতে গেলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথাগুলো শুনেছিলাম।
মি. দুঁপের পরাশুনার ব্যাপকতা আমাকে কেবল বিস্মিতই নয়, মুগ্ধও কম করেনি। সবচেয়ে বড় কথা, তার কল্পনার উচ্ছ্বাসে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
আমি ভেতরে ভেতরে খুশিই হয়েছিলাম, তখন পারিসে যে সব বস্তু হন্যে হয়ে খুঁজে বেরিয়েছি, সে দিক থেকে চিন্তা করলে এরকম একজনের সান্নিধ্য লাভ করায় আমি এমনই খুশি হয়েছিলাম যে, এক বহুমূল্য সম্পদ যেন আমার হস্তগত হয়েছে। একদিন গল্পচ্ছলে কথাটা খোলাখুলি বলেই ফেলেছিলাম।
আমরা কথাবার্তার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি যতদিন সেখানে থাকব ততদিন আমরা দুজন এক সঙ্গেই বাস করব।
আমার সাংসারিক অবস্থা তার চেয়ে কিছুটা অন্তত কম বিপন্ন, তার চেয়ে আমি কম বিধ্বস্ত হওয়ার জন্য বাড়ি ভাড়া করা আর আমাদের বিচিত্র মেজাজ মর্জি অনুযায়ী তার ব্যবহার উপযোগি আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করার দায়িত্বটা আমার ওপরেই বর্তে গেল।
অদ্ভুত ধরনের পুরনো, একেবারেই জীর্ণ একটা বাড়ি আমি ভাড়া করলাম। বাড়ি না বলে সেটাকে অট্টালিকা বললেই যথাযথ বলা হবে। কুসংস্কারের জন্য বাড়িটা দীর্ঘদিন যাবৎ যে কেন পরিত্যক্ত, সে খোঁজ খবরও আমরা নিলাম না।
তাছাড়া কাল-জীর্ণ প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে অট্টলিকাটা কুবুর্গ স্যাঁত জার্মেনের একনির্জন নিরালা অঞ্চলে অবস্থিত ছিল।
যা-ই হোক, কাল-জীর্ণ অট্টলিকাটায় আমরা ছকবাঁধা জীবননির্বাহ করতে লাগলাম। আর সেখানে জীবনযাত্রা নির্বাহের বিবরণ যদি এ পৃথিবীর মানুষ জানতে পারত তবে সবাই আমাদের নির্ঘাৎ পাগল জ্ঞান করত। তবে এমন পাগল যারা কারও কিছুমাত্রও অনিষ্ট করে না।
আমাদের নির্জর-নিরালা অট্টলিকায় বাস সম্পূর্ণ নিখুঁত। আমরাই নিজেদের নিয়ে মেতে থাকতাম। আমাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করার জন্য কোনো অতিথি অভ্যাগতরই পদচিহ্ন পড়ত না। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদেরনির্জনতায় জীবন যাপনের কথা আমাদের পরিচিতজনদের কাছ খুবই সতর্কতার সঙ্গে গোপন রেখেছিলাম।
আরও আছে, বহুকাল আগে থেকেই মি. দুপঁ প্যারিসের যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে, সবার কাছ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। আবার অন্যভাবেও বলা যেতে পারে, প্যারিসের মানুষরাও এখন আর তার খোঁজখবর নেয় না।
তারা যেন তাকে মন থেকে ঝেড়ে-মুছে ফেলে দিয়েছে। ফলে আমরা সে বাড়িটায় পুরোপুরি নির্জন-বাসের মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করতে লাগলাম।
এদিকে আমার নতুন বন্ধুবর তো নিজের মেজাজ মর্জি মাফিক এখানকার রাত নিয়ে পুরোপুরি মজে গেল। আর তার অন্য সব খেয়ালের মতোই আমি নিজের ব্যক্তিত্ব হারিয়ে তার খপ্পরে পড়ে গিয়ে তার অদ্ভুত সব খেয়ালের মধ্যেই ডুবে গেলাম।
তবে এও সত্য যে, অভাবনীয় সে অন্ধকার যে আমাদের প্রতিনিয়ত ঘিরে রাখছে এমন কথাও বলা যাবে না। কিন্তু আমরা কখন-সখন প্রয়োজনবোধে সকল অন্ধকারময় পরিস্থিতি তৈরি করে নিতেও ছাড়িনি।
প্রথমদিনের ভোরের কথা বলছি। পুব-আকাশে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে আমরা দুজনে মিলে জরাজীর্ণ বাড়িটার জানালা-দরজাগুলো দমাদম বন্ধ করে দিলাম। আর ঘরের ভেতরে তীব্র গন্ধযুক্ত দুটো মোমবাতি জ্বেলে আমাদের কাজকর্ম ও চলাফেরার ব্যবস্থা করে নিলাম। আর সে দুটো থেকে কেবলমাত্র ভৌতিক ক্ষীণ আলোর রেখা বেরোতে লাগল। আমাদের বাঞ্ছিত, স্বাভাবিক আলো কিছুতেই পেলাম না।
সেই ক্ষীণ আলোর রেখা সম্বল করেই আমরা যেন স্বপ্নপুরীর বাসিন্দাদের মতো লেখালেখি, পড়াশুনা আর অত্যাবশ্যক কাজকর্ম অব্যাহত রাখলাম।
ঘড়িটা যতক্ষণ আমাদের প্রকৃত অন্ধকারের আগমনবার্তা না জানিয়ে দেয় ততক্ষণ আমরা মোমবাতির ক্ষীণ আলোর রেখার মধ্যে এভাবেই কাজকর্ম চালিয়ে যেতে লাগলাম।
অন্ধকার নেমে এলেই আমরা দুজন তখন চার দেওয়ালের সীমানা ছেড়ে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে পথে নেমে পড়ি, দিনের আলোচনার জের চালিয়ে যাই। আর সে জনাকীর্ণ নগরটার কখনও উজ্জ্বল আলো আবার কখনও বা ছায়ায় ঢাকা পথ দিয়ে বহু দূরবর্তী অঞ্চল দিয়ে ঘোরাঘুরির মাধ্যমে মানসিক উত্তেজনার অসীমতার খোঁজ করি যা কেবলমাত্র শান্ত পর্যবেক্ষণের পথেই পাওয়া সম্ভব। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমরা মাঝে-মাঝে বহু দূরবর্তী অঞ্চলে চলে যাই।
আমরা যখন হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর চলে যাই তখন আমার নতুন বন্ধু দুঁপের মধ্যে বিশ্লেষণশক্তির একটা বিশেষ গুণ আমার নজরে পড়ে। আর এ-গুণ চোখের সামনে দেখে আমি পঞ্চমুখে প্রশংসা না করে পারি না। সত্যি কথা বলতে কি, সে অবশ্যই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।
আমার বন্ধুবর দুঁপের সঙ্গে মেলামেশা করে আমি তার সম্বন্ধে যে ধারণাটুকু করেছি তা হচ্ছে, তার বিশ্লেষণ ক্ষমতা লোক-দেখানো না হলেও অন্তত অনুশীলনের তার আগ্রহ যথেষ্টই রয়েছি। আর এ-কাজে সে যে নির্ভেজাল আনন্দ লাভ করে, সে কথা নির্দিষ্কাতেই আমার কাছে ব্যক্ত করে। সে বরং সম্পূর্ণ নিঃসঙ্কোচে আমাকে বলে–শুনুন পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই তার সম্বন্ধে অন্তরের অন্তঃস্থলে একটা জানালা উন্মুক্ত রাখে। আর তারা যে আমার সম্বন্ধে অনেক কিছুই অবগত আছে সেটাকে সোজাসুজি আর খোলসাভাবেই ব্যক্ত করতেই অভ্যস্ত। সে-সব মুহূর্তে তার কথাবার্তা চালচলন নির্জীব হয়ে ওঠে। তার চোখ দুটো শূন্য দৃষ্টি হয়ে ওঠে। কিন্তু তার গলা রীতিমত পঞ্চমে চড়ে যায়। এ মুহূর্তে তার অবস্থা দেখে আমার প্রায়ই দ্বৈতসত্তার দার্শনিক তত্ত্বের কথা মনে পড়ে যায়।
আমি কল্পনা করি, বন্ধুবর দুঁপের মধ্যে দুটো মন বাস করছে। তাদের একটা বিশ্লেষণধর্মী আর অন্যটি সৃষ্টিধর্মী।
আমি এ পর্যন্ত যা-কিছু বলেছি, তাতে করে আপনারা কিন্তু ভুলেও ভাববেন না যে, আমি আপনাদের সামনে কোনো রোমাঞ্চকর বা রহস্যের মোড়কে মোড়া কোনো কাহিনী তুলে ধরার মতলবে আছি। আমি ফরাসি বন্ধুর কথা যা-কিছু বলেছি তা হয়তো বা রোগগ্রস্ত মেধাশক্তি, নতুবা উত্তেজনার ফলশ্রুতি ছাড়া কিছু নয়। তবে তার তখনকার কথাবার্তার ধরন-ধারণ একটা উদাহরণের সাহায্যে সম্যক উপলব্ধি করা যাবে।
প্যালেস রয়েলের অদূরবর্তী একটা নোংরা পথ দিয়ে এক রাতে আমরা দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিলাম। তখন আমরা উভয়েই নিজের নিজের ভাবনা-চিন্তা নিয়ে এতই আত্মমগ্ন ছিলাম যে, কেউ কারো সঙ্গে কোনো কথাই বলিনি। আসলে আমাদের কারোই কিছু বলার মতো মানসিক পরিস্থিতি ছিল না।
আরও কিছুটা পথ এগিয়ে আমার সহযাত্রী-বন্ধু দুপঁ হঠাৎ বলে উঠল–বেটেখাট লোকটা সম্বন্ধে তোমার কী ধারণা, বল তো?
আমি চিন্তার জগৎ থেকে অকস্মাৎ নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এসে নীরবে জিজ্ঞাসুদৃষ্টি মেলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার কথার ইঙ্গিতটা বুঝতে না পারায় মুখ বুজে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই।
সে আমার জিজ্ঞাসা দূর করতে গিয়ে বলল–বলছি কি, খুবই বেঁটেখাট এ লোকটা থিয়ের দ্য ভ্যারায়েতস-এ চলে গেলে সে অনেক ভালো কিছু করতে পারত, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই।
আমি তার বক্তব্য সম্বন্ধে কোনোরকম চিন্তা-ভাবনা না করেই বলে উঠলাম– অবশ্যই। সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই।
মুহূর্তের মধ্যেই ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এবার সবিস্ময়ে বললাম–দেখুন মি. দুর্প, ব্যাপারটা সম্পূর্ণরূপে আমার জ্ঞান-বুদ্ধি বহির্ভূত। আমি নিঃসঙ্কোচেই বলছি, আর যারপরনাই অবাক হয়ে গেছি। ভাবছি আমার ইন্দ্রিয়গুলোই কি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। হয়তো বা তাই হয়েছে বন্ধু। একটা কথা ভেবে আমি আরও অবাক হচ্ছি, আমি মনে মনে কি ভাবছি তা আপনি বুঝলেন কী করে?
তিনি ম্লান হেসে বলল–চাতিলির কথা বলছেন তো? আরে, আপনি তো নিজের মনকেই প্রশ্ন করছিলেন, বেঁটেখাট চেহারাটার জন্যই সে বিয়োগান্ত নাটকে একেবারেই বেমানান, ঠিক কি না?
আমি বললাম–আশ্চর্য ব্যাপার তো! হ্যাঁ, আমি সত্যি সত্যি এ ব্যাপারটা নিয়েই গভীরভাবে চিন্তা করছিলাম। সে লোকটা চাতিলি রু স্যাঁৎ ডেমিস-এর এক প্রাক্তন মুচি। দিব্যি জুতা সেলাই করে দিন কাটাচ্ছিল। ব্যস, নাটক থিয়েটারের ভূত চাপল তার মাথায়। ক্রিবিলিয়র লেখা জারাকেসস নামক নাটকটায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করতে মঞ্চে নেমে দর্শকদের গালাগালি কম খায়নি। এক কথায় দর্শকরা তাকে তুলাধূনা করে ছেড়েছে।
এবার আমি প্রায় গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠলামআল্লাহর দিব্যি। আমাকে বল, কোন উপায়ে কিভাবে তা সম্ভব হল? তবে হ্যাঁ, যদি কোনো নির্দিষ্ট উপায় থাকে তবেই অবাক হচ্ছি, আপনি কিভাবে এ ব্যাপারটা, মানে আমার মনের কথা জানতে পারলেন, বলুন তো?
মুচকি হেসে বন্ধুবর দুপঁ আমার কথার উত্তর দিতে গিয়ে বলল–আরে বন্ধু, ওই ফলওয়ালাই তো আপনাকে খোলাখুলি বুঝিয়ে দিয়েছে যে, মোটামোটা চেহারাধারী জারাকেসসের ভূমিকার অভিনয় করার মতো দৈহিক উচ্চতা সে মুচিটার অবশ্যই নেই। মোদ্দা কথা, এ চরিত্রে সে একেবারেই বেমানান।
কী? কার কথা বলছেন? ফলওয়ালা! আরে ভাই আপনি তো আমাকে রীতিমত অবাক করে দিলেন দেখছি! কোনো ফলওয়ালাকেই আমি চিনি বলে তো মনে হচ্ছে না! মুহূর্তের জন্য কপালের চামড়ায় ভাঁজ এঁকে ভেবে আবার বললাম–না, কোনো ফলওয়ালার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে বলে তো কিছুতেই মনে পড়ছে না।
একটু আগেই, পনেরো মিনিট আগেই একটা লোক ছুটতে ছুটতে এসে আপনার গায়ে পড়েছিল, এর মধ্যে ভুলে গেলেন?
হ্যাঁ, তা পড়েছিল বটে।
তবে?
এবার ব্যাপারটা আমার মনে পড়ল। আমরা হাঁটতে হাঁটতে রুসি থেকে এ সদর রাস্তাটায় ওঠার সময় এক ফলওয়ালা এক ঝুড়ি আপেল মাথায় করে ছুটে যাচ্ছিল। আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় এমন জোরে এক ধাক্কা দেয় যে, আমি হুমড়ি খেয়ে পথের ওপর পড়ে যাই।
এই তো বেশ মনে পড়েছে।
সে না হয় হলো, কিন্তু সে ঘটনার সঙ্গে চাতিলির কী সম্পর্ক থাকতে পারে, মাথায় আসছে না তো?
দুপঁ অবান্তর কথার ধার কাছ দিয়েও যায় না। সে ম্লান হেসে বলল–বলছি, সবকিছু খোলসা করেই বলছি; আর পুরো ব্যাপারটা যাতে আপনি ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন সে জন্যই আমাদের উভয়ের আলোচনার গোড়া থেকেই, মানে ফলওয়ালার সঙ্গে আপনার ধাক্কা লাগা ও পড়ে যাওয়া পর্যন্ত আপনার চিন্তার সম্পূর্ণ ধারাটাই আমি একের পর এক বলছি। শুনুন, এ চিন্তার বড় বড় গাঁটগুলো হচ্ছে, চাতিলি, ওচিয়ন, ড. নিক ল্স, এপিকিউরাস, স্পিরিও টমি, পথে ছড়িয়ে পড়ে থাকা পাথর আর ফলওয়ালা।
আমি তার বক্তব্য শুনে বললাম–হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন মি. দুঁপ।
বন্ধুর দু আবার বলতে লাগল–আমার যেটুকু মনে পড়ছে, রুসি ছেড়ে আসার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আমরা ঘোড়ার আলোচনায় মগ্ন ছিলাম। ঘোড়ার ব্যাপার স্যাপার নিয়ে আমাদের আলোচনা জোর জমে উঠেছিল। আর আমাদের আলোচনার শেষ বিষয়বস্তু। তারপরই আমরা রাস্তাটা অতিক্রম করার উদ্যোগ নিলাম। ঠিক সে মুহূর্তেই এক ফলওয়ালা তার ফলভর্তি ঝুড়িটা মাথায় নিয়ে ছুটতে ছুটেতে আপনার গা-ঘেঁষে চলে যাওয়ার সময় আচমকা আপনাকে এমন জোরে একটা ধাক্কা মারল যে, আপনি টাল সামলাতে না পেরে প্রায় পথের ওপর পড়ে থাকা পাথরের ঢিবির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।
একটা পাথরের টুকরোয় পড়ে আপনার পা হড়কে যায়। আপনি পায়ে চোট পেলেন। পায়ের কবজিটা মচকে যায়। আপনি মুখ বিকৃত করে প্রায় ফিসফিসিয়ে কি যেন বললেন, কিছুই বুঝতে পারলাম না। আপনি বিতৃষ্ণাভরে পাথরের ঢিবিটার দিকে তাকালেন। আবারও বিড়বিড় করে কি যেন বললেন। পর মুহূর্তেই আবার হাঁটা জুড়লেন।
তবে এও সত্য যে তখন আমি যে সবকিছু গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম তা-ও সত্য নয়। আসলে ইদানিং সবকিছুকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। ইচ্ছে করলেও কোনো ব্যাপারেই উদাসিন থাকতে পারি না।
হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম বন্ধুবর দুপঁ আবার বলতে লাগল–তখন আপনি মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে। চোখে-মুখে জমাটবাধা বিরক্তির ছাপ এঁকে আপনি বার বার রাস্তাটার ছোট বড় গর্তগুলোর দিকে তাকাচ্ছিলেন।
আমরা আবার হাঁটতে লাগলাম। আগের মতোই পাশাপাশি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আমরা হাঁটতে লাগলাম। এক সময় আমরা লামটিন নামক গলিটায় হাজির হলাম, গলিটা চমৎকারভাবে পাথরে বাঁধানো। তখন আপনার মুখটা জ্বল জ্বল করে উঠল। আপনাকে প্রায় অস্ফুটস্বরে ঠোঁট নাড়তে দেখে আমি ভাবলাম, আপনি নির্ঘাৎ স্টিরিওটমি কথাটাই বার বার উচ্চারণ করে চলেরছন। এ রকমভাবে বাঁধানো রাস্তাঘাটের এ নামকরণই করা হয়।
মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে বন্ধুবর আবার মুখ খুললেন একটা কথা কি জানেন? পরমাণুর কথা আর এপিকিউরাসের মতবাদ সম্বন্ধে কথা আগেই জানা না থাকলে আপনার মুখ দিয়ে তো কিছুতেই স্টিরিওয়টসি কথাটা বেরোবার কথা নয়।
আর একটা কথা, এই তো মাত্র কয়দিন আগেই আমি আপনাকে বলেছিলাম, এ বিখ্যাত গ্রিক পণ্ডিতের অনুমানটা অস্পষ্ট হলেও সেটা কী অত্যাশ্চর্যভাবে অধুনা নীহারিকা তত্ত্বের তত্ত্ব কর্তৃক বিশেষভাবে সমর্থন লাভ করেছে।
আর ঠিক তখনই আপনি যে ওরিয়ন নক্ষত্রমণ্ডলির নীহারিকার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবেন, সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম।
আমি সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলাম—
আপনি নিঃসন্দেহ ছিলেন?
অবশ্যই। আপনি কিন্তু কার্যতও তাই করেছিলেন, নক্ষত্রমণ্ডলির নীহারিকার দিকে তাকিয়েও ছিলেন। ঠিক কি না?
আমি নিঃসঙ্কোচে তার কথার জবাব দিলাম–তা আর অস্বীকার করিই বা কি করে?
মি. দুপঁ পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে এবার বললেন–যাক গে, যে কথা বলছিলাম–আপনার চিন্তার প্রতিটা পদক্ষেপ আমি সতর্কতার সঙ্গে অনুসরণ করে চলছিলাম। কিন্তু গতকাল চাতিলি যে মিউজি পত্রিকায় তিক্ত সমালোচনা করেছেন, সে ব্যাপারে মুচি মশাই অভিনয় করার অত্যুগ্র আগ্রহ নিয়ে নিজের নামটাও যে পাল্টে ছিল, কিছুটা অসম্মানজনকভাবে সে কথা বলতে গিয়ে একটা লাতিন উক্তির সাহায্য নিয়েছেন। আপনাকে তো আমি আগেও বলেছি, সে উক্তিটায় রিয়া-এর কথাই ব্যকত করা হয়েছে।
আমি নীরবে ম্লান হাসলাম।
সঁসিয়ে দুঁপ বলেই চললেন–খুবই সত্য কথা যে, আপনি চাতিলি আর ওরিয়ন শব্দ দুটো আপনার অন্তরের অন্তঃস্থলে একই সঙ্গে ভেবে উঠতে বাধ্য। কার্যত হলও তা-ই।
আমি ভ্রূ দুটো কুঁচকে বললাম–কিন্তু মি. দুপঁ, আমার মনের কথা আপনি এমন করে।
আমাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে মি. দুপঁ বলে উঠলেন–আপনার ঠোঁটের কোণে ফুটে-ওঠা হাসির ছাপটুকুই আমাকে এরকমটা ভাবতে সাহায্য করেছে। শব্দ দুটো একই সঙ্গে আপনার অন্তরের অন্তঃস্থলে ঘুরপাক খাচ্ছে।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, ঠিক তাই। পনি বেচারা মুচিটার আত্মনিবেদনের কথা ভেবেই এক সার হচ্ছিলেন।
আর কিছু?
আর? এতক্ষণ লক্ষ্য করছিলাম, আপনি সামনের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকেই হাঁটছিলেন। আর এখন দেখছি রীতিমত সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এতেই আমি সন্দেহ হয়ে পড়লাম যে, চাঁতিলির বেটেখাট চেহারার মানুষটার কথাই আপনার মাথায় পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। ঠিক তখনই আমি আপনার চিন্তার ছেদ ঘটিয়ে বলে উঠলাম– এ চাতিলি লোকটা খুবই বেঁটেখাটো হওয়ায় থিয়েতের দ্য ভারায়েতেস-এ খুবই ভালো অভিনয় করতে পারত। আর মানাতও দারুণ।
এবার গেছেৎ দ্য ব্রাইকনোর একটা সান্ধ্য পত্রিকা পড়তে পড়তে নিচের অনুচ্ছেদটার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল–
হত্যাকাণ্ড!
ভয়ঙ্কর এক হত্যাকাণ্ড! আজ সকালেরই কথা। আজ রাত তিনটির কাছাকাছি পর পর তিন তিনটি ভয়ঙ্কর আর্তস্বর শোনা গেল। বিকট আর্তস্বর শুনে মাৎ-রোচ নগরের বাসিন্দাদের ঘুম চটে গেল। অনুমানে বুঝা গেল, রু মর্গ-এর একটা সুবিশাল বাড়ির চার তলার একটা ঘর থেকে আর্তস্বরটা ভেসে আসছে।
যে ঘরটায় কেবলমাত্র মাদাম ল এম্পালয়ে আর তার মেয়ে সাদামোয়াজেল ক্যাসিল ল এস্পালয়ের।
আর্তস্বরটা শোনার পর প্রতিবেশীরা ছুটাছুটি করে গিয়ে কিছুতেই বাড়িটার ভেতরে ঢুকতে পারছিল না। স্বাভাবিক পথে ভেতরে ঢোকার জন্য সাধ্যাতীত প্রয়াস চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে তারা কিছুটা দেরি হয়ে গেলেও এবার ছুটাছুটি করে শাবল, হাতুড়ি আর গাঁইতি দিয়ে দমাদম ঘা মেরে সদর দরজাটা ভেঙে ফেলল। শেষপর্যন্ত দুজন সশস্ত্র পুলিশকে নিয়ে আটজন প্রতিবেশী হন্তদন্ত হয়ে বাড়িটার ভেতরে ঢুকে গেল।
ইতিমধ্যে আর্তনাদ থেমে গেছে। তবে তারা ব্যস্তপায়ে সিঁড়ি বেয়ে প্রথমের দিকের ধাপগুলো অতিক্রম করার সময় দু বা তার চেয়ে বেশি ক্রোধান্বিত মোটা গলা তাদের কানে এলো। মোটা গলায় তারা যেন অনবরত বকাবকি করেই চলেছে।
তারা উত্তর্ণ হয়ে ওই কণ্ঠস্বরগুলো সম্বন্ধে ধারণা করে নেবার চেষ্টা করল। কয়েক মুহূর্ত নীরবে লক্ষ্য করার পর তারা অনুমান করল, এ বাড়িটা থেকেই মোটা কুদ্ধ স্বরগুলো ভেসে আসছে।
তারা আরও ব্যস্তভাবে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে লাগল। প্রথম ধাপটা অতিক্রম করে তারা দ্বিতীয় চাতালটায় পা দিতে না দিতেই সে সব ক্রুদ্ধস্বরও থেমে, মিলিয়ে গেল। ব্যস, সব চুপচাপ, একেবারে শুনশান।
এবার সশস্ত্র পুলিশসহ প্রবেশকারী দলটা উদ্রান্তের মতো এ-ঘর ও-ঘর অনবরত ছুটাছুটি দাপাদাপি করতে লাগল।
সবাই ছুটাছুটি করে চারতলার পিছনের দিককার একটা ঘরের দরজার সামনে পৌঁছে দেখল, দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। বারকয়েক ধাক্কাধাক্কি করে কোনো ফল না পেয়ে শাবল আর হাতুড়ির ঘা মেরে মেরে দরজাটা ভেঙে ফেলল।
দরজাটা ভাঙার পরই সবাই হুড় মুড় করে ঘরে ঢুকে গেল। দরজা চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভেতরে পা দিয়েই সবাই আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আকস্মিক আতঙ্কে সবাই যেন হতবাক হয়ে পড়ল।
ঘরগুলো একেবারে তছনছ হয়ে রয়েছে। চারদিকে ভাঙা আসবাবপত্রের ছড়াছড়ি। ঘরে একটা মাত্র খাট, ভাঙা। তার ওপরকার বিছানাপত্র ঘরময় ছড়ানো ছিটানো।
আর দুপা এগিয়ে ঘরটার প্রায় কোণার দিকে চোখ পড়তেই সবার চোখের মণি স্থির হয়ে গেল। কাৎ হয়ে পড়ে থাকা একটা চেয়ারের ওপরে রক্তমাখা একটা ক্ষুর। টকটকে লাল টাটকা রক্ত।
আতঙ্কিত চোখের মণি সরিয়ে নিয়ে চুল্লিটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই আর একটা অভাবনীয় দৃশ্য চাক্ষুষ করে সবাই নতুন করে বিস্মিত হলো। দেখল, চুল্লিটার ওপরে দু-তিনটি ইয়া লম্বা, ঘন, রক্তাক্ত পাকা চুলের বেণী এলোমেলোভাবে পড়ে রয়েছে। চুলগুলোকে টেনে হিঁচড়ে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে।
আর মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখা গেল, চারটি ফরাসি স্বর্ণমুদ্রা নেপোলিয়ন। আরও আছে–তিনটি বড়সড় রূপার চামচ, পোখরাজের কানের দুল একটা, প্রায় হাজার চারেক সোনার ঐ দুটো বড় বড় বস্তায় বোঝাই করা আর ছোট ধাতব চামচ তিনটি এবং খুটিনাটি কিছু সামগ্রি।
ঘরের এক কোণে একটা আলমারি। তার ড্রয়ারগুলো সবই খোলা। দেখে মনে হল, বুঝি লুটপাট করে কে বা কারা চম্পট দিয়েছে। খাটের তলায় নয়, বিছানাপত্রের তলায় ছোট্ট একটা লোহার সিন্দুক দেখা গেল। বিছানাটা ওল্টানো থাকায় সেটাকে ভালোভাবেই দেখা গেল। সেটাকে খোলা হয়েছিল, ভাঙা নয়। ভেতরের জিনিসপত্র খাটের ওপর ইতস্তত ছড়ানো। সিন্দুকটা খোলা যে হয়েছিল তার প্রমাণ, চাবিটাকে তার গায়েই ঝুলে থাকতে দেখা গেল।
আমরা এগিয়ে গিয়ে সিন্দুকটার ভেতরের জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। হতাশই হতে হলো। কারণ, কিছু অ-দরকারি কাগজপত্র আর পুরনো চিঠিপত্র ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না।
সর্বত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মাদাম ল এস্পালয়ের কোনো চিহ্নই নজরে পড়ল না।
এবার চুল্লিটার ওপরের চিমনিটার দিকে আমাদের নজর গেল। সেটার গায়ে অস্বাভাবিক ঝুল দেখতে পেয়ে আমাদের সন্দেহ হলো। ফলে ব্যস্তপায়ে এগিয়ে গেলাম। বার-কয়েক উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে সেটার ভেতরটা ভালোভাবে পরীক্ষা করলাম।
উফ! কী বীভৎস দৃশ্য! চোখের সামনে ফুটে উঠল! শরীরের সব কয়টা স্নায়ু যেন একই সঙ্গে ঝনঝ নিয়ে উঠল। শিরা উপশিরায় রক্তের চাপ বেড়ে গেল। নিজেদের চোখ দুটোর ওপরও যেন আস্থা রাখতে পারছে না।
কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার! তার মেয়ের লাশটা নিচের দিকে মাথা নামানো অবস্থায় চিমনিটার ভেতরে গুঁজে রাখা হয়েছে।
এবার সবাই মিলে টানাটানি করে চিমনির ভেতর থেকে মেয়েটার লাশটাকে বের করে আনলাম। ব্যাপারটা বোঝা গেল, সরু চিমনিটার ভেতর দিয়ে সেটাকে কোনোরকমে ঢুকিয়ে শক্ত ও মোটা কিছু একটা দিয়ে ঠেলে ঠেলে যতটা সম্ভব ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
মৃতদেহটাতে হাত দিয়ে দেখা গেল, তখনও বেশ গরম। নিঃসন্দেহ হওয়া গেল, কিছুক্ষণ আগেই আত্মা দেহখাঁচাটা ছেড়ে গেছে।
মৃতদেহটাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেল, বেশ কিছু জায়গায় চামড়া উঠে গেছে আবার কিছু জায়গার চামড়া গুটিয়ে গেছে। ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। মৃতদেহটাকে জোর করে ফেলে ধাৰ্কে চিমনিটার ভেতরে ঢোকাতে গিয়েই চামড়া এমন বিচ্ছিরিভাবে গুটিয়ে গেছে।
আর মৃতদেহটার মুখ জুড়ে বেশ কয়েকটা গভীর কাটা দাগ। গলায় কালসিটে পড়ে রয়েছে। আর তাতে নখের ক্ষত, গভীর ক্ষত। মৃত–মেয়েটাকে যে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে তাতে কোন সন্দেহই রইল না।
এবারের কাজ হলো বাড়িটাতে আবার তল্লাসি চালানো। দীর্ঘসময় ধরে সশস্ত্র পুলিশ আর বহিরাগতরা তন্নতন্ন করে বাড়িটার সর্বত্র, এমনকি আনাচে-কানাচে পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করেও সম্পূর্ণরূপে হতাশ হতে হলো।
ঘরগুলোতে তল্লাসি চালিয়ে হতাশ হয়ে পুরো দলটা এবার ভেতর বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইরে গিয়ে খোঁজাখুঁজিতে মেতে গেল।
বাড়িটার পিছন দিকে এক ফালি ফাঁকা জায়গা। শান-বাঁধানো চত্বর। ছোট একটা ওঠোনও বলা চলে। সেখানে পৌঁছে কোণের দিকে ঘাড় ঘুরাতেই দেখা গেল, একটা মৃতদেহ। বৃদ্ধ মহিলার মৃতদেহ।
মৃতদেহটা থেকে গলাটাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নই মনে হলো। তবে ঘাড়ের সঙ্গে লেগে রয়েছে।
মৃতদেহটাকে সামান্য উঁচু করতেই মাথাটা দুম করে পড়ে গেল। সেটাকে প্রথম দর্শনেই সবাই সর্বাঙ্গে অস্বাভাবিক কল্পনা অনুভব করল। মৃতদেহটা যে কী ভয়ঙ্কর রীতিমত বীভৎস হয়ে পড়েছে, তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। শুধু মাথাই কেবল নয়, সারাটা দেহই অস্বাভাবিক রকম ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি বীভৎস হয়ে পড়েছে তার দেহটা। এমনই বিকৃত হয়ে পড়েছে যে, মানুষের দেহ বলে না দিলে কিছুতেই বুঝার উপায়ই নেই। উফ্! কোন মানুষের দেহ যে এমন ভয়ঙ্কর দর্শন হতে পারে, ভাবাই যায় না।
বহু খোঁজ খবর নেওয়ার পরও ভয়ঙ্কর সে রহস্যটা ভেদ করার মতো তিলমাত্র সূত্রও খুঁজে পাওয়া গেল না।
ব্যাপারটা কিন্তু এখানেই থেমে থাকল না। পরদিন ভোরের খবরের কাগজে ফলাও করে এসব অতিরিক্ত বিবরণ ছাপা হলো।
রুমর্গের শোকসন্তপ্ত ঘটনা। এ ভয়ঙ্কর ও অদ্ভুত ঘটনাটার ব্যাপারে আরও বহু লোককে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। কিন্তু সর্বত্রই হতাশ হতে হলো।
অত্যক্তৃত রহস্যটা ভেদ করার মতো কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রই পাওয়া গেল না। তবে তদন্ত করতে গিয়ে যেসব সাক্ষ্য প্রমাণ যোগাড় করা সম্ভব হয়েছে সেগুলোকে একের পর এক নিচে উল্লেখ করছি–
পলিন দুবুর্গ, লন্ড্রির মালিক নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন–মৃত দুজনকেই তিনি চেনেন। গত তিন বছর যাবৎ তাদের সঙ্গে তার পরিচয়। এ সময়ে তিনি তাদের যাবতীয় পোশাক পরিচ্ছদ ধোলাই করেছেন। এ-সুবাদে তাদের মধ্যে পরিচয় খাতির যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতরই হয়েছে।
লন্ড্রির মালিক পলিন দুবুর্গ মুখে এও জানা গেছে, বৃদ্ধা আর তার মেয়ের মধ্যে কোনোরকম অসদ্ভাব কোনোদিন ঘটেছে বলে তার জানা নেই। বরং তাদের আচার আচরণ ও কথাবার্তা শুনে তার মনে হয়েছে, উভয়ের মধ্যে হৃদ্যতার সম্পর্ক–মা মেয়ের মধ্যে যেটুকু হৃদতা থাকা সম্ভব তা পুরো মাত্রায়ই ছিল। অর্থকড়ির ব্যাপারেও তারা ছিলেন উদার। তবে তাদের জীবনযাত্রা ও অর্থাগমের ব্যাপারে তার কিছু জানা নেই। কিন্তু সে এটুকু শুনেছে। তারা অর্থের মালিক ছিল।
লন্ড্রির মালিক পলিন দুবুর্গের কাছ থেকে এও জানা গেছে, কাপড় চোপড় আনতে ও ধোলাই করা কাপড়-চোপড় ফেরৎ দিতে গিয়ে তাদের বাড়িতে কোনোদিনই অন্য কোনো লোককে দেখতে পাননি। আর এও বলেছেন, তিনি পুরোপুরি নিঃসন্দেহ যে, তাদের বাড়িতে কোনো পরিচারক বা পরিচারিকা কোনো দিনই ছিল না। যদি থাকত তবে কোনো-না-কোনোদিন তাঁর নজরে অবশ্যই পড়ত।
তিনি আরও যা বলেছেন তা হচ্ছে, তাঁদের বাড়ির চারতলা ছাড়া অন্য কোনো তলাতেই কোনো আসবাবপত্রই তার চোখে কোনোদিনই পড়েনি।
বার দেখা যাক তামাকের দোকানের মালিক তার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে কি বলেছেন। তিনি গোড়াতেই বলেছেন, তিনি মাদাম ল এস্পালয়কে চিনতেন। তবে তিনি তার কাছে নস্যি ও তামাক খুব কম দিন এবং সামান্য পরিমাণেই বেঁচেছেন।
তিনি জেরার জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, সেখানেই তার জন্ম হয়েছে। আর প্রথম থেকে আজ অবধি সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন।
যে পুরনো প্রাসাদোপম বাড়িটায় মৃতদেহ দুটোকে পাওয়া গেছে, সে বাড়িতে মৃতা বৃদ্ধা আর তার মেয়ে দুবছরেরও বেশিদিন বাস করেছে, মানে মৃত্যুও সে বাড়িতেই হয়েছে। এর আগেও সে বাড়িটায় এক স্বর্ণকার বসবাস করত। শুধু নিজেই নয়, বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ওপরের ঘরগুলোকে ভাড়াও দিত। আসলে বাড়িটার মালিকানা স্বত্ব কিন্তু মাদাম ল এস্পালয়-এরই।
বাড়িটার স্বত্বাধিকারিণী মাদাম ল এস্পালয়। আর সেটাকে নিয়ে ভাড়াটিয়া বিভিন্নভাবে জোর জুলুম খাটাতে থাকায় তিনি শেষপর্যন্ত নিতান্ত অনন্যোপায় হয়ে ভাড়াটিয়ার অন্যায় আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে নিজেই নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন। আর কাউকে বাড়িটা ভাড়া দিতে রাজি হলেন না।
স্বর্ণকার আর যা বলল তা হচ্ছে, বৃদ্ধা মহিলার মনোভাব ছিল শিশুসুলভ। আর স্বাক্ষী গত দুবছরের মধ্যে মেয়েটাকে মাত্র পাঁচ-ছয় বার দেখেছে।
তারা মা-মেয়ে দুজনই পুরোপুরি তার চেয়ে বরং মাত্রাতিরিক্ত অবসর জীবন যাপন করতেন। আর তাদের প্রচুর বিত্ত সম্পদ ছিল বলেই জানা যায়।
সাক্ষী স্বর্ণকার প্রতিবেশীদের মুখে শুনেছেন, মাদাম ল এস্পালয় তাদের ধন। সম্পদের কথা সবাইকে বলে বেড়াতেন, কিন্তু তিনি মোটেই তা বিশ্বাস করতেন না।
সাক্ষী আর যা-কিছু বলেছেন তা হচ্ছে, বৃদ্ধা আর তার মেয়ে ছাড়া তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে কোনোদিন তাদের বাড়িতে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেননি। তবে কেবলমাত্র এক বা দুদিন কুলিকে বাড়িতে যাতায়াত করতে দেখেছেন। আর যাকে সে বাড়িতে ঢুকতে দেখেছেন তিনি হচ্ছেন একজন ডাক্তার। তিনি আট দশদিন সে বাড়িতে যাতায়াত করেছেন।
কেবলমাত্র লন্ড্রির মালিক আর স্বর্ণকারই নয়, আরও বহু প্রতিবেশি ওই একই রকম সাক্ষ্যদান করেছেন। কেউই কিন্তু সে বাড়িতে করার কথা বলেননি।
আর একটা কথা, বৃদ্ধা মাদাম ল এস্পালয় আর তার মেয়ের মধ্যে কোনোদিন কোনোরকম ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে কারো জানা নেই, কারো মুখে কিছু শোনেও নি।
হ্যাঁ, আর যা-কিছু জানা গেছে, বাড়িটার সামনের দিককার জানালাগুলোর খড়খড়ি কালে-ভদ্রে খুলতে দেখা গেছে। চারতলার পিছনের বড়সড় ঘরটা ছাড়া পিছনের অন্যসব ঘরের জানালার পাল্লাগুলোও সর্বদাই বন্ধ করে রাখা হত। বাড়িটার পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো। পুরনো, তবে খুব বেশি পুরনো বলা যাবে না।
এবার সাক্ষ্যদান করতে গিয়ে সশস্ত্র পুলিশের বক্তব্য তুলে ধরছি। তার নাম ইসিদোর মুসেৎ। তিনি জানতেন, ভোর তিনটার সময় তাকে তলব করা হয়।
পুলিশ ইসিদোর আরও বলেছেন, জরুরি তলব পেয়ে তিনি ছুটে এসে দেখেন, বাড়িটার সদর দরজায় বিশ-ত্রিশটা লোক দাঁড়িয়ে। সবাই বাড়িটার ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। কিন্তু সদর দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। উপায়ন্তর না দেখে শেষমেশ বেয়নেট দিয়ে দরজাটা খোলা হলো। শাবল, গাঁইতি আর হাতুড়ি ব্যবহার করে দরজাটা অবশ্যই ভোলা হয়নি।
সদর দরজাটা সহজেই খোলা সম্ভব হওয়ার কারণও রয়েছে যথেষ্ট। দরজাটা দো-আঁজ করা। তাছাড়া নিচে আর ওপরে কোনো খিল বা ছিটকিনি নেই।
দরজাটা না খোলা অবধি তীব্র চিল্লাচিল্লি চলেছিল। দরজাটা খোলা হয়ে গেলে চিল্লাচিল্লি থেমে সবকিছু শুনশান হয়ে গেল।
চিল্লাচিল্লি শুনে মনে হতে লাগল, একটা বা বহুকণ্ঠের আর্তনাদ বলেই মনে হচ্ছিল। আর তা খুবই তীব্র আর একনাগাড়ে দীর্ঘসময় ধরে হচ্ছিল না, একটু বাদ বাদ মুহূর্তের জন্য বিরতি দিয়ে হচ্ছিল আর খুব দ্রুতও ছিল না।
সাক্ষী সশস্ত্র পুলিশ ইসিদোর সুমেৎ-ই সবার আগে আগেই সিঁড়ি বেয়ে ওপর তলায় উঠে যান। লম্বা-লম্বা পায়ে ওপরের চাতালে উঠেই তিনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন, তীব্র স্বরের কথা কাটাকাটি তার কানে এলো। দুজনে জোর ঝগড়ায় মেতেছে। একটা গলা খুবই কর্কশ আর দ্বিতীয় গলাটা অপেক্ষাকৃত সরু আর তীক্ষ্ণ। প্রথম কণ্ঠস্বরটা কোনো এক ফরাসি পুরুষের। আর তার ব্যবহৃত কয়েকটা শব্দ তিনি বুঝতে পেরেছেন। উৎকর্ণ হয়ে তিনি আবারও কণ্ঠস্বরটাকে ভালোভাবে শোনার চেষ্টা করলেন। হ্যাঁ, তিনি ঠিকই ধরেছেন, কোনো-না-কোনো পুরুষের কণ্ঠই বটে। অবশ্যই কোনো নারীর কণ্ঠস্বর নয়। স্যাকরে আর ডায়েবল শব্দ দুটো তিনি পরিষ্কার শুনতে ও বুঝতে পেরেছেন।
তিনি নিঃসন্দেহ হয়েছেন, তীক্ষ্ণ কণ্ঠটা নির্ঘাৎ কোনো বিদেশির। তবে সে কণ্ঠস্বরটা কোনো নারী, নাকি পুরুষের তা তিনি নিশ্চিত হতে পারলেন না। তবে কথার ধরন-ধারণ শুনে বুঝতে পারলেন, কণ্ঠস্বরটার মালিক স্পেন দেশীয়। কারণ, ভাষাটা স্পেন দেশীয় বলেই তার মনে হলো।
সাক্ষী পুলিশ ইসিদোর মুসেৎ ঘরটা আর মৃতদেহ সম্বন্ধে যে বিবরণ দিয়েছেন তার সঙ্গে গতকাল খবরের কাগজের যে বিবরণ ছাপা হয়েছে, তার সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাদৃশ্য রয়েছে।
আঁরি দুভাল। একজন রৌপ্যকার। ওই বাড়িটার কাছাকাছিই আঁরি ভালোর বাড়ি। মাদাম ল এস্পালয়ের প্রতিবেশী।
ওই বাড়িটায় যারা প্রথম ঢুকেছিল, আঁরি দুভালো তাদের অন্যতম, সে ঘটনাটার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে মুসেৎ যে বিবরণ দিয়েছেন, তিনিও সেটাকে সমর্থন করলেন, অর্থাৎ উভয়ের বক্তব্য মোটামুটি একই রকম।
তারা সদর দরজা দিয়ে বাড়িটার ভেতরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। কারণ, শেষ রাত সত্ত্বেও যারা তাড়াহুড়ো করে বাড়িটার সামনে জড়ো হয়েছিল তারা যাতে ভেতরে প্রবেশ করতে না পাওে, সেজন্য এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
আঁরি দুভালোর মতে ওই তীক্ষ্ণ কণ্ঠের মালিক একজন ইতালিয়। কিন্তু ফরাসি যে কিছুতেই নয়, এ বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহও তার নেই। তবে সেটা যে অবশ্যই পুরুষের কণ্ঠ, এ ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নন কোনো নারীর কণ্ঠ হলেও অবাক হবেন না।
আঁরি দুভালো দাও সিদ্ধান্ত নিবেদন করলেন ওই কণ্ঠের অধিকারী একজন ইতালীয়? তিনি কথাগুলো বুঝতে পানেনি। তবে কথার টান ও বলার ভঙ্গি দেখে তিনি এমন নিশ্চিত করে কথাটা বলতে পারছেন।
আঁরি দুভালো মাদাম ল আর তার মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল ভালোই চিনতেন। উভয়ের সঙ্গে সামনাসামনি কথাও বলেছেন বহুবার। অতএব তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরটার মালিক যে তাদের মধ্যে কেউ-ই নন, এ ব্যাপারে তার মনে সামান্যতম সন্দেহও নেই।
আর ওদেন হাইসার। মাঝবয়সী একজন ভদ্রলোক।
ওদেন হাইসার এক রেস্তোরাঁর মালিক। রেস্তোরাঁটা তিনি নিজেই পরিচালনা করেন। তিনি স্বেচ্ছায় এ বিষয়ে সাক্ষ্যদান করতে এসেছিলেন। ফরাসি ভাষার অ, আ, ক, খ,ও জানেন না। তাই বক্তব্যকে ফরাসি ভাষায় তর্জমা করে দেওয়ার জন্য তিনি একজন দোভাষীকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন।
রেস্তোরাঁর মালিক ওদেন হাইমার আমস্টারডামের একজন বাসিন্দা। আকাশ ফাটা আর্তনাদটা যখন বাড়িটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, তখন তিনি জরুরি কাজের তাগিদে ও-পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। চিৎকার চাঁচামেচি শোনামাত্র তিনি আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। বেশ কয়েক মিনিট ধরে আর্তস্বরটা চলছিল–দশ মিনিটও হতে পারে। অতএব সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, আর্তস্বরটা ছিল তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী। আর সেটা ছিল রীতিমত ভয়ঙ্কর আর হৃদয়বিদারকও বটে।
আর্তস্বর শুনে যারা হুড়মুড় কওে বাড়িটার ভেতরে ঢুকেছিলেন, ওদের সাথে হাইমারও সঙ্গ নিলেন।
ইতিপূর্বে যারা, যে সাক্ষ্যদান করেছেন, তাদের মধ্যে একটা ছাড়া বাকি সব কয়টাকে ওদেন হাইমার নির্দিধায় মেনে নিলেন। ওই কণ্ঠস্বরটার কথা বলতে চাইছি। সে কণ্ঠস্বরের মালিক যে একজন পুরুষ এ বিষয়ে তার মনে এতটুকুও সন্দেহ নেই। কিন্তু সে কথাগুলোকে তিনি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি। কারণ কণ্ঠস্বরটা ছিল খুবই তীক্ষ্ণ আর খুবই দ্রুত উচ্চারিত হয়েছিল। আর বক্তা অস্বাভাবিক ক্রোধে ও ভয়ে। ভয়ে কথাগুলো বলছিল। আর ছিল খুবই কর্কশ। আর এত তাড়াতাড়ি কথাগুলো উচ্চারিত হয়েছিল, যা বলে বোঝানো যাবে না। কর্কশ কণ্ঠস্বর খুবই তাড়াতাড়ি সেরে, ডায়েবে ল আর মন ডিউ শব্দগুলো উচ্চারণ করেছিল। শব্দগুলো একবার নয়, বার বারই উচ্চারিত হয়েছিল।
এবার সাক্ষী মিগনোর কথায় আসা যাক।
জ্বলে মিথুনো রুদোলোরা-র অন্তর্গত এৎ ফিলস ফার্মের একজন ব্যাংকার। বড় মিথুনো নামেই তিনি বেশি পরিচিত।
আট বছর আগেকার কথা। গত সালের বসন্তে মাদাম ল এস্পালয় তার ব্যাঙ্কে। একটা হিসেব খুলেছিলেন। মাদাম ল এস্পালয়ের কিছু ধন-সম্পদ ছিল।
মাদাম ল এস্পালয় মাঝে মাঝে তার ব্যাঙ্কে কিছু কিছু অর্থ জমা দিতেন। তিনি মৃত্যুর তিনদিন আগে নিজে ব্যাঙ্কে এসেছিলেন। চার হাজার ফ্ৰা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নেন। নগদ নয়, উপরোক্ত পরিমাণ অর্থের সোনা ব্যাঙ্ক তার হাতে তুলে দিয়েছিল। ব্যাঙ্কের একজন কেরানি নিজে তার সঙ্গে গিয়ে তাঁর বাঞ্ছিত অর্থমূল্যের সোনা বাড়িতে পৌঁছে দেন।
মিগনো এৎ ফিলস্ ব্যাঙ্কের কেরানি ভদ্রলোকের নাম এডলফ লৌ বো। তিনি সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছেন যে, সেদিন দুপুর দুটোয় তিনি মাদাম ল এস্পালয়ের সঙ্গে তার বাড়ি যান এবং চার হাজার ফ্র পৌঁছে দেন।
দরজা খুলে মদাম ল এস্পালয় তার হাত থেকে সোনাসমেত থলেটা নেন। আর অন্য আর একটা থলে নেন বৃদ্ধা মহিলাটি।
বৃদ্ধার হাতে থলে দুটো তুলে দিয়ে তিনি অভিবাদন সেরে পথে নামলেন। তখন পথ ছিল নির্জন। ধারে কাছে কোনো লোককেই দেখতে পাননি। সেটা আসলে সদর রাস্তা ছিল না, উপ-রাস্তা।
এবার সাক্ষ্য দিলেন উইলিয়াম বার্ড। তিনি একজন স্থানীয় দর্জি।
পোশাক পরিচ্ছদ সেলাইয়ের কাজে তার খুবই নামডাক। বাড়িটার ভেতরে যারা প্রথমে ঢুকেছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি। তিনি প্যারিস শহরে দুবছর বসবাস করছেন।
দর্জি উইলিয়াম বার্ড এবং তার সঙ্গিরা বাড়িটার ভিতর থেকে ভেসে আসা ঝগড়াঝাটি, কথা কাটাকাটি শুনতে পায়। খুবই তীব্র স্বরে কথা হচ্ছিল।
যার কণ্ঠস্বর অধিকতর কর্কশ ছিল সে একজন ফরাসি। উইলিবার্ড কথাগুলো ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু এখন আর সেগুলো স্মরণ করতে পারছেন না। তবে যে কয়টা শব্দ এখনও মনে আছে তাদের মধ্যে খ্যাকরে এবং মন ডিট শব্দ কয়টা এখন পর্যন্ত তাঁর বুকে যেন গেঁথে রয়েছে। ঠিক তখনই চিত্তার চাচামেচি এমন তুঙ্গে উঠে গিয়েছিল যার ফলে সব কথা তিনি ভালোভাবে শুনতেও পাননি। আর ঘুষোঘুষি আর হুড়হাঙ্গামা শুরু হয়ে যায়, যার ফলে তাদের বাকবিতণ্ডার সব কথা শোনা সম্ভব হয়নি।
কিন্তু তীব্র কণ্ঠস্বরটা ছিল খুবই উচ্চাগ্রামের। সংক্ষেপে বলতে গেলে, তীব্রর চেয়েও অনেক, অনেক বেশি জোরালো। উকর্ণ হয়ে শুনে তিনি নিঃসন্দেহ হয়েছিলেন, সেটা কোনো ইংরেজি ভাষা-ভাষীর কণ্ঠস্বর নয়। কোনো একজন জার্মানের কণ্ঠস্বর বলেই তার মনে হলো। আর সেটা নির্ঘাৎ কোনো মহিলার কণ্ঠস্বর। জার্মান ভাষায় কথা বলতে সে জানে না। তবে তিনি বার বারই বলেছেন সেটা যে মহিলার কণ্ঠস্বও, তাতে সামান্যতম সন্দেহ তার নেই।
এই মাত্র যে চারজনের সাক্ষ্যের কথা বলা হলো তাদের সবাইকে ডাকা হলো।
চারজন সাক্ষীই একই কথা বলেছেন। মাদামোয়জেলের মৃতদেহ যে ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে সে ঘরটার দরজায় পৌঁছেই তারা থমকে যেতে বাধ্য হন। কারণ, দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ, ছিটকিনি দেওয়া। না, কেবল ছিটকিনিই দেওয়া ছিল না, তালাবন্ধও ছিল। ভেতর থেকে সামান্যতম আওয়াজও ভেসে আসছিল না, শুনলাম। কোনোরকম আর্তনাদ তো নাই, কথাবার্তার আওয়াজও শোনা যাচ্ছিল না।
বাইরে থেকে দমাদম আঘাত হেনে অনেক কষ্টে দরজাটা ভেঙে ফেলা হলো। হুড়মুড় করে সবাই ভেতরে ঢুকে হতভম্ব হয়ে যাবার যোগাড় হলেন। কাউকেই দেখা গেল না।
সামনের আর পিছনের, উভয় দিকের জানালাই বন্ধ ছিল। ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দেওয়া। দুটো ঘরের মাঝের দরজাটাও ছিল বন্ধ। তালা দেওয়া নয়, খিল আঁটা।
সামনের ঘর থেকে বারান্দায় যাবার জন্য একটা দরজা ছিল। সেটাও বন্ধ। তালাবন্ধ। আর তার চাবিটা ভেতরে রাখা ছিল।
চারতলা বাড়িটার সামনের দিকের বারান্দার শীর্ষে একটা ছোট ঘর ছিল। তার দরজা ছিল খোলা। ঘরটার ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখা গেল, বাক্স আর বিছানাপত্র গাদা মেরে ফেলে রাখা হয়েছে।
সবাই মিলে হুড়মুড় করে ঘরটার ভেতরে ঢুকে বাক্স আর বিছানাপত্র তল্লাশি করা হলো। হতাশই হতে হলো। কিছু পাওয়া গেল না। সত্যি কথা বলতে কি, বাড়িটার
এক ইঞ্চি জায়গাও তল্লাসি করতে বাদ দেওয়া হলো না। এমনকি চুল্লির ওপরকার চিমনিটাও বাদ দেওয়া হলো না। ওপর-নিচ তন্ন তন্ন করে ঝাঁট দিয়ে খোঁজাখুঁজি করা হলো। কিন্তু ফয়দা বলতে কিছুই হলো না।
আগেই বলা হয়েছে, বাড়িটা চারতলা। সবার ওপরে একটা চিলেকোঠা। ছাদের চাপ-দেওয়া দরজাটাকে মোটা গজাল চালিয়ে চালিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভালোই বোঝা গেল, দীর্ঘ বছর কয়েক সেটাকে ভোলা হয়নি।
এবার স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাড়িটার ভেতর থেকে ভেসে-যাওয়া চিৎকার চাচামেচি আর তা শুনে দল বেঁধে হুড়মুড় করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যাওয়ার মধ্যে সময়ের ব্যবধান কতখানি ছিল এ বিষয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন রকম মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। জিজ্ঞাসা করলে কেউ বলল, তিন মিনিট; কেউ বলল পাঁচ মিনিট।
দরজাটা খুলতে কী যে কষ্ট হয়েছিল তা আর বলার নয়।
এবার সাক্ষ্য দিল, আলফনজো গার্চিও। তিনি মুদাফরাসের কাজ করেন। তিনি নিজের আবাসস্থলের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, মর্গেই তার বাড়ি। সে দলটা বাড়ির ভেতরে গিয়েছিলেন তিনি তাদের দলেই ছিলেন।
অন্যান্যদের সঙ্গে বাড়ির ভেতরে গিয়েছিলেন সত্য। কিন্তু সবার সঙ্গে ওপরতলায় ওঠেন নি। আসলে উঠতে ভরসা পাননি। স্নায়ু খুবই দুর্বল। উত্তেজনার ফলে কি হতে পাওে, এ নিয়ে তার আশঙ্কা করে তিনি সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে থেমে গিয়েছিলেন। তবে তর্কাতর্কি শুনতে পেয়েছিলেন ঠিকই।
তীব্র ও কর্কশ স্বরে চিল্লাচিল্লি করছিল সে কোনো এক ফরাসি, এ বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ। আরও নিশ্চিত যে, লোকটা ইংরেজি ভাষা অজ্ঞ। তবে কথা বললে উচ্চারণ থেকে মোটামুটি একটা ধারণা করে নিতে পারেন।
এবারের সাক্ষী আলবের্তো তানি–রুটির ব্যবসায়ী তিনি। সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন–হৈ হল্লা শুনে যারা ছুটাছুটি করে বাড়ির ভেতরে ঢুকেছিল আর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেছিল, তিনি তাদের দলেই ছিলেন।
উপরোক্ত সাক্ষীদের মতামতের সঙ্গে আলবের্তো তানি একমত। কর্কশ স্বরের মালিক যে একজন ফরাসি, তিনিও এ ব্যাপারে একমত। তর্কাতর্কি হওয়ার সময় তিনি যা-কিছু শুনেছেন তাদের মধ্যে কয়েকটা কথা বুঝতে পেরেছেন। তিনি রীতিমত দৃঢ়তার সঙ্গে মতামত করতে গিয়ে বললেন–তীব্র কণ্ঠস্বরের মালিক কোনো একটা প্রসঙ্গে প্রতিবাদ করছিল।
তবে রুটির ব্যবসায়ী আলবের্তো তানি এও স্বীকার করলেন, তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরটা সম্বন্ধে তিনি কিছুই অনুমান করতে পারেননি। তার কথার একটা বর্ণও হৃদয়ঙ্গম করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সে খুবই দ্রুত কথা বলছিল। আর কণ্ঠসরটা এত ঘন ঘন ওঠা-নামা করছিল যার ফলে তিনি কিছুই ধরতে পারেননি। তবে লোকটাকে একজন রুশীয় বলেই তার মনে হয়েছে।
আলবের্তো তানি নিজে একজন ইতালীয়। আর কোনো রুশের সঙ্গে কোনোদিন কথা বলার সুযোগও তার হয়নি।
এবার জনাকয়েক সাক্ষীকে দ্বিতীয়বার সাক্ষ্যদান করতে হলো। তাদেরই একজন বলল–চারতলার ঘরের চুল্লির চিমনিগুলো খুবই সরু। সেগুলো এতই সরু যে, তার ভেতর দিয়ে একজন মানুষের পক্ষে কিছুতেই গলে-যাওয়া সম্ভব নয়।
চিমনিগুলো সরু হওয়া সত্ত্বেও একটা চিমনি খোঁচাবার ঝাড়ন বার বার খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখতেও ত্রুটি রাখা হলো না।
বাড়িটায় কোনো গুপ্তপথও নেই। কোনো বহিরাগত যখন বাড়ির ভেতরে ঢোকে, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠে, তখন কেউ গুপ্তপথ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাবে, এমন কোনো ব্যবস্থাও নেই।
এদিকে মাদামোয়াজেল ল স্পোলয়ের লাশটা চিমনির ভেতরে এমনভাবেআটকে গিয়েছিল যে, সেটা বের করা কঠিন সমস্যা হয়ে দেখা দিল। শেষপর্যন্ত কয়েকজন দাঁতে দাঁত চেপে টানা হেঁচড়া করে সেটাকে কোনোরকমে বের করে আনা হলো।
এবারের সাক্ষী পল দুমা। তিনি একজন কৃতী চিকিৎসক। সাক্ষ্য দেবার জন্য তাকে কাকডাকা ভোরে তলব করে নিয়ে আসা হয়েছিল।
ডাক্তার পল দুমাকে সোজা ওপরে, যে ঘরে মাদামোয়া জেল ল-র মৃতদেহটা ছিল। সে ঘরের কারুকার্যমণ্ডিত খাটের ওপর শোয়ানো ছিল। তারই পাশে শুইয়ে রাখা হয়েছিল তার মেয়ের মৃতদেহটা।
ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন, যুবতির দেহের অনেকাংশ ছিঁড়ে গিয়ে ছাল চামড়া উঠে গেছে। তার চেহারাটা এমন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার কারণ, চিমনিটার ভেতর থেকে মৃতদেহটাকে টানাটানি করে বের করা হয়েছে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে ডাক্তার পল দুমা যুবতিটার গলায় ঘন কালো–কালসিটে পড়ার একটা দাগ স্পষ্ট দেখতে পেলেন। আসলে সেটা ঘটানির দাগ। থুতনির তলায় কয়েকটা গভীর ক্ষতও দেখতে পেলেন। তার মুখটা অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে, চকের মতো সাদা। মাঝে-মধ্যে কালসিটে পড়ার দাগগুলো, যে আঙুলের দাগ, এতে কিছুমাত্রও সন্দেহের অবকাশ ছিল না।
মুখটাই যে কেবলমাত্র ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল তাই নয়, চোখের মণি দুটো কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল। আর দাঁতের চাপে জিভের কিছুটা অংশও কেটে গিয়েছিল।
আর পাকস্থলির গায়ে একটা বড়সড় কাটা-দাগ দেখে মনে হলো হাঁটু দিয়ে জোর করে চেপে ধরার ফলেই ওটা সৃষ্টি হয়েছে। ডাক্তার পল দুমা যা বললেন, তাতে করে বোঝা গেল, অপরিচিত কোনো ব্যক্তি বা কয়েকজন তার গলা চেপে ধরেছিল। আর এরই ফলে তার মৃত্যু হয়েছে। মেয়ের চেয়েও মায়ের দেহটা, বিশেষ করে চোখ-মুখ খুব বেশি রকম বিকৃত হয়ে পড়েছিল। মাদাম ল এস্পালয়-এর ডান পা আর হাতের সবকটা হাড়গোড়াই ভেঙে গিয়েছিল, কিছুটা অংশ গুঁড়ো গুঁড়োও হয়ে গিয়েছিল। আরও আছে, বাঁ পায়ের হাড় আর বাঁ দিকের সব কটা পাঁজরই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। মোদ্দা কথা, সম্পূর্ণ দেহটাই মারাত্মক রকম কেটে, হাড়গোড় ভেঙেচুরে বিকট আকৃতি ধারণ করেছিল। কিভাবে যে সে সব ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল, ডাক্তার পল দুমার নিশ্চিত করে বলতে পারলেন না।
পেশীবহুল কোনো অতি বলবান ব্যক্তি মোটা লোহার টুকরো বা কাঠের ভারী গদা জাতীয় কোনোকিছু বা ভারী কোনো চেয়ার প্রভৃতি কোনো ভারী বড় অস্ত্রপাতি দিয়ে আঘাতের মাধ্যমেই এরকম ক্ষতের সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। ডাক্তার পল দুমারের দৃঢ় বিশ্বাস, কোনো মহিলা কাউকে এত জোরে আঘাত করতে পারে না।
স্বাক্ষী অকুস্থানে পৌঁছে যখন দেখলেন, তখন মৃতের মাথাটা ধড় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে পড়েছিল আর খুব তেলে ভেঙেচুড়েও গিয়েছিল। গলাটা কি দিয়ে ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল? এ ব্যাপারে তার মতো, নির্ঘাৎ কোনো সুতীক্ষ অস্ত্র দিয়ে কাজটা সারা হয়েছিল। তিনি নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও ক্ষুর দিয়ে কাজটা সারা হয়েছিল, এরকম ইঙ্গিত দিলেন।
মৃতদেহ দুটোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য সার্জন ডাক্তার পল দুমার সঙ্গে সার্জন আলেকজান্দার এতিয়েনকেও খবর দিয়ে আনা হয়েছিল। তিনি ডাক্তার পল দুমার সিদ্ধান্তকেই মেনে নিলেন।
পরবর্তীকালে এক এক করে আরও কয়েকজনকেও মা-মেয়ের মৃত্যুর ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের মুখ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য কোনো কথাই জানা সম্ভব হয়নি।
সত্যি কথা বলতে কি, প্যারিস শহরের বুকে সবদিক থেকে এমন জটিল ও গভীর রহস্যপূর্ণ কোনো হত্যাকাণ্ড ইতিপূর্বে কোনোদিন ঘটেনি। অবশ্য যদি এটা মৃত্যু না হয়ে হত্যার ব্যাপার হয়।
এরকম দু-দুটো অস্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যাপার নিয়ে পুলিশ রীতিমত হিমসিম খাচ্ছে। হণ্যে হয়ে চেষ্টা করেও নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রের হদিস পেল না।
খবরের কাগজটার সান্ধ্য সংস্করণে ছাপা হয়েছে, কায়োতিয়ের স্যাৎ রোচ-এর পরিস্থিতি এখন অবধি শান্ত তো হয়নি বরং সেখানকার মানুষ উত্তেজনায় আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতোই ফুটছে। অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে যাওয়া বাড়িটাতে আবারও রহস্যের সূত্র লাভের আশায় সতর্কতার খোঁজাখুঁজি করা হয়েছে। স্বাক্ষীদের আরও ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই ফায়দা কিছুই হয়নি।
তবে সান্ধ্য পত্রিকায় বলা হয়েছে, এ দল্ফ লি বোঁ-কে পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেলখানায় আটক করেছে। তবে এও সত্য যে, বর্ণিত বিবরণ ছাড়া এমন সূত্রের সন্ধান মেলেনি যাতে এ ব্যাপারে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব।
সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যালোচনা করে লক্ষ করা যাচ্ছে ঘটনাটা নিয়ে মি. সি. অগাস্ত দুপঁ খুবই আগ্রহান্বিত। আর কিছু না হোক তার মতিগতি দেখে আমার এরকমই বিশ্বাস। সবচেয়ে বড় কথা, সে ব্যাপারটা নিয়ে ভালো-মন্দ কিছুই বলছে না। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম লি বে-কে গ্রেপ্তার করে জেরে আটক করার কথা খবরের কাগজ মারফৎ প্রচার হবার পরই সে হত্যার ব্যাপারটা নিয়ে প্রথম আমার মতামত জানার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে।
এ রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড দুটোর রহস্যভেদের অতীত রহস্য বলে জ্ঞান করা সম্বন্ধে প্যারিসের সব মানুষের সঙ্গে আমি নির্দিধায় সহমত পোষণ করছি। এ হত্যাকাণ্ডের রহস্যভেদের সূত্রের সন্ধান করার কোনো উপায়ই আমার মাথায় আসেনি।
বন্ধুবর দুপঁ মুখ খুললেন–দেখুন মি., রহস্যভেদের ব্যাপারে এসব কেবলমাত্র তদন্তের বাইরের দিকটা দেখে সে পথ সম্বন্ধে বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়া সঙ্গত হবে না।
প্যারিসের পুলিশের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্বন্ধে অনেকেই বহুভাবে ভূয়সি প্রশংসা করেন সত্য। কিন্তু তাদের বুদ্ধিমত্তা আছে যথেষ্টই। ব্যস, এটুকুই। আর তাৎক্ষণিক উপায় অবলম্বন ছাড়া তাদের কাজকর্মে লক্ষ্যনীয় কোনো পদ্ধতিই থাকে না। তারা হম্বিতম্বিসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করে ফেলে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই কাজের বেলা দেখা যায়, উদ্দেশ্য সিদ্ধির ব্যাপারে সেগুলো মোটেই সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা হয় না। তাদের কাজের ফল যা দেখা যায় সেগুলো চমক লাগানোর মতোই বটে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে ফল লাভ সম্ভব হয় অল্প পরিশ্রম আর সহজ-সরল কাজকর্মের মাধ্যমে। কার্যক্ষেত্রে এসব গুণাবলী যেখানে অনুপস্থিত থাকে সেখানেই তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
উল্লেখিত হত্যাকাণ্ড দুটোর রহস্যভেদের ব্যাপারে পুলিশের মতামত ব্যক্ত করার আগে আমরা নিজেরাই কিছুটা অগ্রসর হই, তদন্ত করে দেখি কতদূর কি করা যায়।
সত্যি কথা বলতে কি, রহস্যটা নিয়ে তদন্তে নামলে কিছুটা অন্তত আনন্দ তো পাওয়াই যাবে, কৌতূহলও নিবৃত্ত হবে। সবচেয়ে বড় কথা, লি বে কোনো এক সময় আমার কিছু উপকার করেছিল। এ কারণেই আমি তার কাছে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ।
পুলিশ দপ্তরের প্রিফেক্টসির সঙ্গে আমার যথেষ্ট পরিচয় রয়েছে। ফলে তদন্তের ব্যাপারে অনুমতি লাভ করতে কোনো সমস্যাই হওয়ার কথা নয়।
কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, আমার অনুমানই সত্য, পুলিশ দপ্তরের প্রিফেক্ট জির কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত কম সময়ের মধ্যেই হত্যাকাণ্ডটার তদন্তের অনুমতি পেয়ে গেলাম।
ব্যস, পুলিশের অনুমতিপত্রটা হাতে পাওয়ার পর মুহূর্তমাত্রও সময় নষ্ট না করে আমরা রুমর্গের উদ্দেশে পা-বাড়ালাম।
নির্দিষ্ট স্থানটায় যখন আমরা পৌঁছলাম তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যার আলো আঁধারির খেলা শুরু হয়ে গেছে।
আমাদের আশ্রয়স্থল আর নির্দিষ্ট সে জায়গাটার মধ্যে ব্যবধান যথেষ্টই।
আমাদের বাঞ্ছিত সে বাড়িটার হদিশ পেতেও মোটেই বেগ পেতে হলো না। এর কারণও আছে। বাড়িটার পাশের রাস্তার বিপরীত দিকে বহু লোকই উদ্দেশ্যহীন কৌতূহলের শিকার হয়ে বন্ধ-জানালাগুলোর খড়খড়ির দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সেটা প্যারিস শহরের খুবই সাদামাটা একটা বাড়ি। একটা সাধারণ ফটক আছে।
বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগে আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে পাশের একটা গলিতে ঢুকলাম। তারপর আর একটা বাঁক ঘুরে বাড়িটার একেবারে পিছন দিকে হাজির হলাম।
আমরা বাড়িটার পিছন দিকটায় যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমার সহযাত্রী বন্ধু দুঁপ বাড়িটাসহ সম্পূর্ণ অঞ্চলটা এত বেশি কৌতূহল ও মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল, যাকে আমি অহেতুক কাজ বলেই ধরে নিলাম।
বাড়িটার পিছন দিকটায় এক চক্কর মেরে আমরা আবার হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে চলে এলাম। আমি প্রধান ফটকের গায়ের ঘণ্টাটা বার-কয়েক বাজালাম। দরজা খুলে গেল। বাড়িটার রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ব্যক্তিরা আমাদের পরিচয়পত্র দেখে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিল।
বাড়িটার ভেতরে ঢুকে আমরা সিঁড়ি ভেঙে ওপর তলায় উঠে গেলাম।
ঘরের ভেতরে পা দিয়েই খাটের ওপর মাদামোয়াজেল এলো। এস্পালয়ের মৃতদেহটা দেখতে পেলাম। কেবল তার মৃতদেহটাই নয়। তার মেয়ের মৃতদেহটাও পাশেই শুইয়ে রাখা হয়েছে দেখলাম।
ঘরের ভেতরে যে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে গিয়েছিল, সে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিটা তখনও তেমনই দেখতে পেলাম।
ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখে আমি লক্ষ্য করলাম, গজেট দ্য দিবিড, পত্রিকার পাতায় যা ছাপা হয়েছিল তার অতিরিক্ত কিছুই নেই।
আমার চেয়ে অনেক বেশি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু সঁসিয়ে দুর্পস দেখলেন। তিনি অনুসন্ধিৎসু নজরে মৃত-দুজনের লাশ দেখতেও বাদ দিলেন না।
মৃত-ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা অন্য ঘরগুলো ও উঠানে গেলাম। একজন সশস্ত্র পুলিশ প্রথম থেকে শেষাবধি আমাদের পিছনে আঁঠার মতো লেগে রইল। রাতের অন্ধকার নেমে-আসা অবধি আমরা তদন্তের কাজে লেগে রইলাম।
সে বাড়ি থেকে বেরোবার পর বাড়ি ফেরার সময় পথের ধারের এক দৈনিক পত্রিকার দপ্তরে এক মুহূর্তের জন্য ঢু মারলেন।
আমার বন্ধুবরের হরেকরকম খামখেয়ালির কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি। তাই লক্ষ্য করলাম, ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডটা সম্বন্ধে পরদিন দুপুরের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মুখ না খোলার খেয়ালটাই তার মাথায় চেপেছে।
এক সময় আচমকা তিনি আমায় প্রশ্ন করলেন একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছি, দয়া করে উত্তর দেবেন কী?
তার মুখে এমন আকস্মিক প্রশ্নটা শুনে আমি কেমন হকচকিয়ে গেলাম। পরমুহূর্তেই নিজেকে একটু সামলে নিয়ে, মুচকি হেসে বললাম সে কী কথা! উত্তর না দেওয়ার কী হলো! আপনি কি জানতে চাইছেন, নির্দিধায় বলতে পারেন।
হত্যাকাণ্ডের বাড়িটায় তো গেলেন, বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো কিছু নজরে পড়েছিল কী?
আমি ভ্রূ দুটো কুঁচকে তার দিকে তাকালাম। কি বলব ভেবে না পেয়ে নিস্পলক চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
তিনি বিশেষভাবে শব্দটার ওপর অধিকতর চাপ দিয়ে কথাটা আবারও আমার কাছে পাড়লেন।
আমি আমতা আমতা করে বললাম–বিশেষ কিছু?
হ্যাঁ, বিশেষ কিছু নজরে পড়েছে কী?
না, তেমন কিছু তো নজরে পড়েনি। খবরের কাগজের পাতায় যা কিছু পড়েছিলাম তার চেয়ে বেশি কিছু তো আমার নজরে অন্তত পড়েনি মি. দুপঁ।
আশা করি আপনার স্মরণ আছে, রহস্যজনক ঘটনাটার আতঙ্কের ব্যাপারটা নিয়ে খবরের কাগজ কিছু বলেনি, ঠিক কি না?
গেজেটের কথা বলছেন তো?
হ্যাঁ, যাক গে, ছাপানো পত্রিকার হালকা আলোচনার কথা ছেড়েই দেওয়া যাক। আমার তো বিশ্বাস, সে জন্য এ রহস্যজনক ঘটনাটাকে সমাধানযোগ্য মনে করা দরকার। ঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেই ঘটনাটাকে সমাধান সম্ভব নয় বলে মনে করা হচ্ছে।
মুহূর্তের জন্য থেমে তিনি আবার সরব হলেন–দেখুন মি. হত্যা করার উদ্দেশ্যটা নয়, কিন্তু এ-হত্যার পাশবিকতার উদ্দেশ্যের আপাত অভাব লক্ষ্য করেই পুলিশ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে।
আর তর্কাতর্কি সম্বন্ধে দ্রুত বিভিন্ন রকম কণ্ঠস্বরের সঙ্গে নিহত মাদামোয়াজেল ল এস্পালয়ে ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিকে ওপর তলায় খুঁজে না পাওয়া ও বহিরাগত যারা ওপরে গিয়েছিল তাদের চোখে ধুলো দিয়ে বাড়িটা থেকে বাইরে বেরিয়ে যাবার কোনো দরজা বা উপায় না থাকার জন্য ঘটনাগুলোকে একসঙ্গে জড়ো করে একটা সুতোয় গাঁথার অসম্ভব ব্যাপারটাই পুলিশকে আরও বেশি করে অস্থির করে তুলেছে।
এবার ঘরটার এলোমেলো, একেবারে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার দৃশ্যটা, লাশটার মাথাটাকে নিচে ঝুলিয়ে রেখে শক্ত লাঠি বা সেরকম কোনো শক্ত দণ্ড দিয়ে ঠেলে ধাকে ভেতরে গুঁজে দেওয়ার ব্যাপারটা, বৃদ্ধা মাদামোয়াজেল ল এস্পালয়ের দেহটার ছাল চামড়া তুলে বিশ্রিরকম বিকৃত করে দেওয়া আরও অনেকগুলো টুকরো টুকরো ঘটনা সরকারের পোষা বাছাধনদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে, একেবারে ঘোলাপান্তা খাইয়ে ছেড়েছে।
দুর্বোধ্যতা আর অস্বাভাবিকতাকে এক সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিয়েই সাধারণ ভুলে হাবুডুবু খাচ্ছে।
আমি প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করলাম–হুম!
বন্ধুবর বলে চললেন–দেখুন, এ সাধারণ গাঁটটাকে অতিক্রম করতে পারলেই বুঝি সত্য পথটার হদিস পেয়ে যাবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সত্যি কথা বলতে কি, এ রহস্যটা পুলিশের দৃষ্টি যত দুর্বোধ্য এবং সমাধান অসম্ভব বলে মনে হয়েছে ঠিক তত সহজেই আমি রহস্যটা ভেদ করতে পারব বলেই দৃঢ় বিশ্বাস রাখি। সমাধান করে বলেও মনে করতে পারেন।
আমি অতর্কিতে বিস্ময়-মাখানো দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে নীরব চাহনি মেলে তাকালাম। কি যে বলব, ভেবেই পেলাম না।
আমাদের সদর-দরজার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সে বলল–এ মুহূর্তে আমি এমন এক ব্যক্তির পথ চেয়ে রয়েছি যে এ দু-দুটো ভয়ঙ্করতম ও জঘন্যতম খুনের নায়ক না হলেও কিছু না কিছু অংশে দায়ী। এর সবচেয়ে মারাত্মক কাজের ব্যাপারে সে নিরপরাধ হতে পারে বটে। তবে আমি এও অনুমান করছি, আমার ধারণাটা অভ্রান্ত, কারণ তাকে কেন্দ্র করেই আমি চক্রটাকে দেখার চেষ্টায় রয়েছি।
কিন্তু কে এমন জঘন্যতম–
আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সে আবার বলতে আরম্ভ করল–আরে বন্ধু, যে কোনো মুহূর্তে তাকে এ ঘরটায় দেখা যেতে পারে। অবশ্য সে না-ও আসতে পারে, কিন্তু তার আসার সম্ভাবনাই বেশি বলে আমি মনে করছি।
ভালো কথা, আপনার বাঞ্ছিত লোকটা যদি এখানে এসেই পরে, তবে?
যদি এসেই পড়ে তবে তাকে আটকে রাখতে হবে।
আটকে রাখবেন?
অবশ্যই।
আমরা বললেই সে লক্ষ্মী ছেলের মতো
আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বন্ধুবর মি. দুপঁ বলে উঠলেন–আরে ধ্যুৎ! তা হবে কেন? কথা বলতে বলতে তিনি কোটের পকেট থেকে দুটো পিস্তল বের করে আমার সামনে ধরে বললেন–
এই যে, এ দুটোর সাহায্যে। প্রয়োজনের তাগিদে এ দুটোর ব্যবহার তো আমাদের কারো আর অজানা নয়, কী বলেন?
হুম!
দরকার হলে এ দুটো ব্যবহার করে আমরা সে শয়তানটাকে কজায় আনবই আনব।
আমি কি করতে চলেছি, না ভেবে, না বুঝেই অথবা যা-কিছু শুনলাম, বিশ্বাস করেই তার হাত থেকে পিস্তল দুটোকে নিলাম।
বন্ধুবর দুপঁ স্বগতোক্তির মতোই প্রায় অনুচ্চারিত কণ্ঠে বলতে লাগলেন–আমি ইতিপূর্বেই বলে রেখেছি, এমন সব মুহূর্তে তিনি যেন কেমন নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠে।
এবার অধিকতর স্পষ্টভাবে, চড়া গলায় না হলেও একটু জোরে জোরেই সে বলল–দূরে অবস্থানরত কাউকে যেন বলছে এমন স্বরেই বলল–দেখুন, বহিরাগত যে দলটা বাড়িটার ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় চিল্লাচিল্লি কথা কাটাকাটিতে লিপ্ত লোকগুলোর কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিল, তা গৃহীত সাক্ষীদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, সেগুলো কোন মহিলা বা মহিলাদের কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়নি, তাই নয় কী?
আমি আমতা আমতা করে বললাম–হ্যাঁ, তা হয়েছে বটে।
মি. দুপঁ বলে চললেন–এবার মন দিয়ে শুনুন আমি কি বলতে চাইছি–বৃদ্ধা মহিলা মাদামোয়াজেল ল এস্পালয়ের আগে মেয়েকে খুন করে, তারপর আত্মহত্যা করেছে কি না এরকম সন্দেহ যদি কারো মনে জেগে থাকে তবে এটা থেকেই সে সন্দেহের অবসান ঘটে যাবে।
আমি স্তম্ভিতের মতো গোল গোল চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
মি. দুপঁ আমার জিজ্ঞাসা দূর করার জন্য এবার বললেন–আমার এ-কথাটা বলার উদ্দেশ্য তদন্ত পদ্ধতির কথা ব্যক্ত করা। কারণ, চুল্লির ওপরের চিমনিটা থেকে মেয়ের লাশটা বের করতে গিয়ে যা মনে হয়েছে, যথেষ্ট বল প্রয়োগ করেই সেটাকে তার ভেতরে ঢোকাতে হয়েছিল। এমনভাবে সেটাকে ঠেলে ধাক্কে ভেতরে খুঁজে দেওয়ার মতো অমিত শক্তি-সামর্থ্য মাদাম ল এম্পালয়ের দেশে ছিল বলে মনে করা যায় না।
আমি মুখ খোলার চেষ্টা করতেই তিনি নিজেই আমার মনের উদ্ভুত জিজ্ঞাসার জবাব দিতে লাগলেন–হ্যাঁ, মাদাম ল এস্পালয়ের মৃতদেহের বিভিন্ন স্থানে যে সব ভয়ঙ্কর ক্ষতচিহ্ন লক্ষ্য করা গেছে তাতে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত দূরে সরে যেতেই হয়। তা-ই যদি মনে করা হয় তবে ধরেই নিতে হয় কোনো তৃতীয় পক্ষের দ্বারা হতাকাণ্ড দুটো ঘটেছে। আর ওই তৃতীয় পক্ষ একজন নয়, একাধিক। কারণ, তর্কাতর্কির সময় অনেকগুলো কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছিল, সাক্ষীরা সবাই বলেছেন।
হুম!
শুনুন মি., এবার আমি বলছি, এসব কণ্ঠস্বর সম্বন্ধে সাক্ষীরা যে সব সাক্ষ্যদান করেছেন, সে-সব তথ্য সম্বন্ধে নয়, তবে সেগুলোরই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রসঙ্গে। মুহূর্তের জন্য থেমে তিনি এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন– আচ্ছা, এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু কী আপনার নজরে ধরা পড়েছিল?
দেখুন মি. দুঁপ, কর্কশ কণ্ঠস্বরটার মালিক কোনো-না-কোনো এক ফরাসির, এ কথা সব সাক্ষী একমত ব্যক্ত করলেও তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরটা সম্বন্ধে কিন্তু সবাই ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন।
আরে মি., ও তো সাক্ষীদের মতামতের ব্যাপার।
তবে?
তবে আমি বিশেষ কোনো দিকের প্রতি দৃষ্টিপাত করছি এবং আপনার দৃষ্টি আকর্ষণও করতে চাইছি। এবার আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন– আচ্ছা, ভালো করে ভেবে দেখুন তো, সেখানে কী আপনার নজরে বিশেষ কিছুই পড়েনি? আমি কিন্তু বলব, লক্ষ্য করার মতো অবশ্যই কিছু ছিল।
ছিল! বিশেষ কিছু আপনার নজরে পড়েছে?
কেবলমাত্র আমার কথাই বা বলেন কেন, আপনিও তো বলেছেন, সাক্ষীরা কর্কশ কণ্ঠস্বরটা সম্বন্ধে সহমত পোষণ করেছেন। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে সামান্যতম মতপার্থক্যও নেই, ঠিক কি না?
হ্যাঁ, তা-তো বলেছিই।
আর তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরটার ব্যাপারে কিন্তু একটা বিশেষত্ব অবশ্যই ছিল।
বিশেষত্ব। বিশেষত্ব ছিল?
অবশ্যই ছিল, এ প্রসঙ্গে সাক্ষীরা যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মতো ব্যক্ত করেছেন, তা-ও নয়। ইংরেজ, ইতালীয়, স্পেনীয়, ফরাসি বা ওলন্দাজ যা-ই হোক না কেন সে কণ্ঠস্বর সম্বন্ধে মত ব্যক্ত করতে গিয়ে কিন্তু সবাই বলেছেন সেটা একটা বিদেশির কণ্ঠস্বর। সেটা সে তার দেশবাসী কারো নয় এ ব্যাপারে প্রত্যেকেই নিঃসন্দেহ। আর কণ্ঠস্বরটা সম্বন্ধে মত ব্যক্ত করতে গিয়ে সবাই দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, এমন কারো কণ্ঠস্বর নয় যার দেশের ভাষার ওপর তার দখল রয়েছে–বরং সম্পূর্ণ বিপরীত।
হ্যাঁ, এ-কথা স্বীকার করতেই হয়, আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম।
তিনি আমার কথা শেষপর্যন্ত শোনার জন্য অপেক্ষা না করেই আবার বলতে শুরু করলেন–সাক্ষীদের বক্তব্যগুলোকে আমরা পাশাপাশি রাখলে দেখতে পাব, ওলন্দাজ সাক্ষী ভেবেছেন, কণ্ঠস্বরটা কোনো-না-কোনো ফরাসির। কিন্তু কার্যত দেখা গেছে, ফরাসি ভাষায় দখল না থাকার জন্য দো-ভাষীর সাহায্যে সাক্ষীর সঙ্গে কথাবার্তা বলা হয়েছে। ফরাসি লোকটা সেটাকে স্পেনীয় ভাষা বলেই মতো প্রকাশ করেছেন। এও স্পষ্ট ভাষায়ই তিনি বলেছেন, স্পেনীস ভাষায় তার দখল থাকলে তিনি তাদের বাদানুবাদের কারণ সম্বন্ধে ধারণা করতে পারতেন। ইংরেজ সাক্ষীর মতে লোকটা জার্মানি। আর জার্মান ভাষায় তার অজ্ঞতার জন্যই তিনি বক্তব্যটা বোঝা তো দূরের ব্যাপার, সামান্যতম আঁচও করতে পারেননি।
আর স্পেনীয় সাক্ষীর মতে, সে কণ্ঠস্বরের মালিক কোনো এক ইংরেজি। ইংরেজি ভাষা তিনি তিলমাত্রও জানেন না। তবে তিনি কি করে এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হচ্ছেন? তিনি বক্তার কথা বলার ভাব-ভঙ্গি দেখেই নিশ্চিত হতে পেরেছেন।
এদিকে ইতালীয় সাক্ষীর মতে, কণ্ঠস্বরটা ছিল কোনো-না-কোনো রুশের। কিন্তু ইতিপূর্বে তিনি কোনোদিন কোনো রাশিয়ানের সাথে কথা বলেননি।
দ্বিতীয় ফরাসি সাক্ষী প্রথম ফরাসি সাক্ষী থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মতো ব্যক্ত করেছেন। তিনি নিজের মতো ব্যক্ত করতে গিয়ে রীতিমত দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, নিঃসন্দেহে কণ্ঠস্বরটা কোনো এক ইতালিয়ের।
উপরোক্ত সাক্ষীদের বক্তব্য থেকে স্পষ্টই প্রমাণিত হচ্ছে, কণ্ঠস্বরটা যারপরনাই বিচিত্র প্রকৃতির, ঠিক কি না।
আমি, ঘাড় নেড়ে তার বক্তব্যটা সমর্থন করলাম। আর তার বাচনভঙ্গি এমনই অদ্ভুত ধরনের ছিল যার ফলে সাক্ষীরা এমন মতামত ব্যক্ত না করে পারেননি। আর এরই জন্য ইউরোপের পাঁচ-পাঁচটা বড়সড় দেশের বাসিন্দারা তাতে তাদের জানা কোনো শব্দ পেলেন না, সামান্যতম আঁচও করতে পারলেন না।
হুম! আমি প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করলাম।
মঁসিয়ে দুপঁ এবার আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, মি., আপনি হয়তো এবার বলবেন, কণ্ঠস্বরটা কোনো আফ্রিকাবাসী বা এশিয়াবাসীর হওয়া সম্ভব। কিন্তু কথা হচ্ছে, প্যারিস শহরে দলে দলে আফ্রিকাবাসী বা এশিয়াবাসী বাস করে না।
আমি কিন্তু–
আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মি. দুপঁ আবার বলতে লাগলেন–দেখুন, আপনার সে ধারণার পূর্ণ মর্যাদা দিয়েই তিনটি ব্যাপারের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি।
বলুন, কি বলতে চাইছেন, বলুন?
আশা করি আপনার অবশ্যই স্মরণ আছে, সাক্ষীদের মধ্যে একজন মন্তব্য করেছেন যে, কণ্ঠস্বরটা তীক্ষ্ণ ছিল বটে, কিন্তু তার চেয়ে, অনেক বেশি ককৰ্শ ছিল।
হুম!
অন্য দুজন সাক্ষীর মতে, কণ্ঠস্বরটা ছিল খুবই দ্রুত আর অসমান। অতএব এতে বোঝা যাচ্ছে, কোনো শব্দ বা কোনো শব্দের অনুরূপ উচ্চারণকেই কোনো সাক্ষীই বোধগম্য বলেননি, সত্য কি না?
আমি আমতা আমতা করে বললাম–হ্যাঁ, তা অবশ্য সত্য।
বন্ধুবর দুর্পস তার বক্তব্য অব্যাহত রাখলেন–আমি বুঝতে পারছি না মি., আপনার জ্ঞান-বুদ্ধির ওপর আমার বক্তব্য কতখানি ছায়াপাত করতে পেরেছে। তবে এ-কথা কিন্তু আমিনিসংকোচে বলতে পারি, সাক্ষীর সাক্ষ্যদানের তীক্ষ্ণ আর কর্কশ কণ্ঠস্বর কথাটা দুটো থেকেই যে যুক্তিগ্রাহ্য ও সঙ্গত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব সেটাই এখন একটা সন্দেহের উদ্রেক করতেই পারে। আর তার মাধ্যমেই রহস্যটার অবশিষ্ট তদন্তের পথ বেছে নেওয়া সম্ভব। যুক্তিগ্রাহ্য এবং সঙ্গত সিদ্ধান্তের মাধ্যমেও কিন্তু আমার বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত হয়নি।
আপনার ইঙ্গিতটা আমার কাছে পরিষ্কার হলো না।
আমি আপনাকে এটাই বোঝাতে চাইছি যে, একমাত্র সিদ্ধান্তের কথা আপনাকে বললাম তা থেকেই সন্দেহটা নিশ্চিতভাবে মনে জাগে।
কিন্তু সে সন্দেহটা—
সন্দেহটা সম্বন্ধে আমি কিন্তু এখন কিছুতেই মুখ খুলব না।
তবে আমাকে আপনি কী করতে বলছেন?
আপনার কাছে আমি কেবলমাত্র এটুকুই বলতে চাইছি, আমার সঙ্গে আপনিও এ-কথাটা মনে রাখবেন, আমার মনের উদ্ভুত সন্দেহটা ভবিষ্যৎ তদন্তকে পথ দেখাবার ক্ষেত্রে খুবই শক্তিশালী। আপাতত এটুকু বুঝলেই চলবে।
আমি নীরবে ঘাড় কাৎ করলাম।
বন্ধুবর দুপঁ আবার মুখ খুললেন–এখন আমরা বরং এখানে বসইে অকুস্থল, মানে ওই ঘরটা সম্বন্ধে কল্পনার মাধ্যমে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখি। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা সেখানে কীসের তল্লাশ করব? হত্যাকাণ্ড সেরে হত্যাকারীরা কোন পথে বাড়িটা থেকে চম্পট দিয়েছিল? আশা করি এ-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের মধ্যে কেউ-ই অতিপ্রকৃত ঘটনায় আস্থাবান নই। অতএব আমরা বলব, মাদামোয়াজেল ল এস্পালয়ে আর মাদামকে অবশ্যই কোনো অশরীরী হত্যা করেনি। তাই বলতেই হয়, দু-দুটো খুন যাদের বা যার হাতে হয়েছে সেনির্ঘাৎ কোনো-না কোনো রক্তমাংসে গড়া মানুষ। আর সে অবশ্যই কোনো একটা না একটা বাস্তব পথ দিয়েই গা-ঢাকা দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, খুনি কাজ হাসিল করে কোন্ পথে গা-ঢাকা দিয়েছে? ভাগ্যগুণে আমাদের সামনে একটামাত্র পথই খোলা রয়েছে। আর সে পথ অনুসরণ করে এগোলেই আমরা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে হাজির হতে পারব বলেই আমি মনে করছি।
এবার সে বাড়িটা থেকে কেটে পড়ার স্বাভাবিক পথগুলোর কথা একটা একটা করে বিচার বিশ্লেষণ দেখা যেতে পারে। একটা ব্যাপারে কিন্তু কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয় যে, চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনে বাইরে থেকে ছুটে বাড়িটার ভেতরে যে লোকগুলো ঢুকে ছিলেন এবং সিঁড়ি দিয়ে ব্যস্তপায়ে ওপরে উঠে যান তখন মাদামোয়াজেল যে ঘরে ছিলেন সে ঘরেই খুনিরাও ছিল। আর তা যদি না-ও থাকে তবে তার লাগোয়া ঘরটায় ছিল। এ-কথা যদি আমরা মেনে নেই তবে কেবলমাত্র দুটো ঘর থেকেই পালিয়ে যাবার মতো পথের খোঁজ করতে হবে।
এবার পুলিশী তৎপরতার কথা ভাবা যাক। তারা মেঝে আর শিলিং দু-ই খুলে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। আরও আছে, চারদিকে দেওয়ালের পলেস্তারা তুলে তছনছ করে দিয়েছে। কিন্তু গোপন কোনো পথেরই হদিস তারা পায়নি।
আমি পুলিশের ওপর আস্থা না করে নিজে সবকিছু ঘাটাঘাটি করে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছি। সিদ্ধান্ত নিতেই বাধ্য হয়েছি, কোনো গুপ্তপথের অস্তিত্বই নেই।
ঘটনার সময় ঘর থেকে বারান্দায় বেরোবার দু দুটো দরজাই ভেতর থেকে বন্ধ, তালাবন্ধ ছিল। অতএব এদিক থেকেও নতুন কোনো চিন্তায় পৌঁছানো সম্ভব নয়।
আমরা এবার বরং চুল্লিটার কাছে যাই। তার ওপরকার চিমনিটার দিকে নজর দেই, কেমন? সেটা চুল্লি থেকে আট-দশ ফুট অবধি সাধারণ ব্যাসযুক্ত ঠিকই। কিন্তু একটা বিভাগ পর্যন্ত গোড়া থেকে শেষাবধি সেটার ভেতর দিয়ে গলে যেতে পারবে না। এতই সরু।
চিমনি-পথে খুনি বা খুনিদের পক্ষে বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তা যখন একেবারেই অবাস্তব তখন শেষমেশ জানালাগুলোর কথা ভেবে দেখা যাক। সামনের দিকের জানালা দিয়ে পথে ভিড় করে দাঁড়িয়ে-থাকা মানুষগুলোর চোখে ধুলো দিয়ে কারো পক্ষে চম্পট দেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তবে? আততায়ী কোন পথে গা-ঢাকা দিতে পারে? পিছনের দিককার ঘর দিয়ে? আমাদের মাথায় যখন এ-চিন্তাটা একবার উঁকি দিয়েছে তখন যুক্তির তাগিদে নিছকই অসম্ভব বলে তাকে কেটে হেঁটে ফেলতে পারি না, উচিতও নয়।
অতএব উপরোক্ত আপাত অবাস্তবগুলো বাস্তবক্ষেত্রে অবাস্তব নয়, এটা আমাদের প্রমাণ করা দরকার হয়ে পড়েছে।
আমরা আবার অকুস্থলে, অর্থাৎ ঘরটায় ফিরে যাই। ঘরটায় দুটো জানালা। তাদের মধ্যে একটাকে সম্পূর্ণরূপে দেখা যায়, আসবাবপত্রে ঢাকা পড়ে যায়নি।
আর অন্য জানালাটার খুব কাছাকাছি বড় খাটটা রয়েছে। আর তার মাথাটা জানালাটাকে ঢেকে রেখেছে, যার ফলে চোখেই পড়ে না। আর প্রথম জানালাটা ভেতর থেকে ছিটকিনি আঁটা থাকতে দেখা গেছে। বহু চেষ্টা করেও সেটাকে খোলা সম্ভব হয়নি। বড় একটা গজাল ব্যবহার করে আরও পোক্তভাবে আটকে দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় জানালাটায়ও গজাল দিয়ে সাঁটা। সেটাকেও খোলার চেষ্টা করে হতাশ হতে হয়েছে। তাই কেউ যে ঘর থেকে পালিয়ে যেতে পারেনি এ ব্যাপারে পুলিশ পুরোপুরি নিঃসন্দেহ। তাই কোনোই দরকার নেই ভেবে গজাল তুলে জানালা দুটোকে খুলে ফেলা হয়েছে। ব্যস, এ পর্যন্তই।
একটা কথা, আমার নিজের পরীক্ষাটা কিন্তু একটু আলাদা প্রকৃতির। কারণ, আমার তো জানাই ছিল, ঐ ক্ষেত্রে যাকে সম্ভব জ্ঞান করা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে সে তা নয়, এটা প্রমাণ করাই আমার দায়িত্ব।
ব্যস, আমি এ রকমভাবেই ভাবনা চিন্তা আরম্ভ করলাম। তবে তা অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে।
আমি বলছি, পালাতে গিয়ে খুনিরা যে কোনো একটা জানালাই ব্যবহার করেছিল। তা যদি হয় তবে তো জানালার পাল্লাটা ভেতর থেকে আটকানো সম্ভব হতো। এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই পুলিশ এ পর্যন্ত এগিয়ে তদন্তের কাজ বন্ধ করেছে। কার্যক্ষেত্রে তো সেগুলোকে তো আটকানো অবস্থাতেই দেখা গেছে। তা যদি হয় তবে তো স্বীকার করতেই হয় জানালাগুলো নিজে থাকতেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ রকম সিদ্ধান্ত না নিলে উপায়ও তো কিছু নেই।
আমি চাপা না-পড়ে থাকা জানালাটার কাছে এগিয়ে গেলাম। গজালটা উপড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম। আমার সব প্রয়াস মাঠে মারা যাবে ভেবেছিলাম। বাস্তবে হলও ঠিক তাই। আমি নিশ্চিত ছিলাম, গোপন একটা স্প্রিং কোনো-না-কোনো জায়গায় ব্যবহার করা আছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে গিয়ে বাঞ্ছিত স্পিংটার হদিশ ঠিক মিলে গেল। ব্যস, স্পিংটার গায়ে একটু চাপ প্রয়োগ করতেই দুম করে কাঁচটা উঠে গেল। আমার মন আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠল।
এবার গজালটাকে তার আগের জায়গায় আবার বসিয়ে দিয়ে অনুসন্ধিৎসু নজরে লক্ষ্য করতে লাগলাম। নিঃসন্দেহ হলাম, কোনো একজনের পক্ষে জানালাটা দিয়ে গলে বাইরে চলে গিয়ে সেটাকে আবার বন্ধ করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে। স্প্রিংটার পক্ষেও আগের মতো কাজ করা সম্ভব।
এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। কিন্তু গজালটা? সেটাকে তো আর আবার যথাস্থানে পুঁতে দেওয়া সম্ভব নয়। সিদ্ধান্তটা একেবারে পানির মতোই পরিষ্কার।
এবার আমার তদন্তের ব্যাপারটার পরিধি ছোট হয়ে গেল। খুনিরা নির্ঘাৎ অন্য কোনো পথ ব্যবহার করে চম্পট দিয়েছে। এবার যদি মনে করা হয়, দুটো জানালার কাঁচের স্প্রিং একই রকম, আর তা হওয়াই স্বাভাবিক; তবে গজাল দুটোর মধ্যে অবশ্যই কোনো-না-কোনো পার্থক্য থাকতে বাধ্য। আর কিছু না হলেও তাদের আটকাবার কৌশলের কোনো পার্থক্য অবশ্যই ছিল।
এবার আমার কাজ হলো দ্বিতীয় জানালাটার দিকে নজর দেওয়া। খাটের ওপর উঠে সেটাকে পরীক্ষা করে দেখলাম। ওপরের দিকে বোর্ডের পিছনে চোখ ফেরাতেই স্প্রিংটা নজরে পড়ে গেল। সেটার ওপর চাপ দিলাম। দেখলাম এ প্রিংটা আগেরটার মতোই বটে। আবার গজালটাও আগেরটার মতোই মোটাসোটা। ওপর। ওপর দেখে মনে হলো আগেরটার পদ্ধতিতেই বসানো। চেপে প্রায় মাথা পর্যন্ত ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বন্ধু, আপনি ভাবছ, আমি কর্তব্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। আপনি যদি তা-ই ভেবে থাকেন তবে আমি বলব, আমার অনুমানের পদ্ধতিটাকেই আপনি ভুল বুঝেছেন। আসলে কিন্তু আমার দিক থেকে কোনো ভুলই হয়নি। এমনকি ক্ষণিকের জন্য আমার ঘ্রাণশক্তিও লোপ পায়নি। আর আমার কাজের ধারার মধ্যেও কোনো দোষ-ত্রুটি ছিল না।
এবার কি বলছি ধৈর্য ধরে শুনুন, গোপন কথাটাকে শেষ অবধি অনুসরণ করেছি। আর ওই গজালটাই হচ্ছে তার ফলশ্রুতি। আমার কথা বিশ্বাস করুন, সেটা সর্বতোভাবে অন্য গজালটার আকৃতি বিশিষ্টই বটে। এ পর্যন্তই সূত্রটা শেষ হয়েছে ধরে নিয়ে বিচার করতে বসলে দেখা যাবে, গজাল দুটোর সাদৃশ্যটাই পুরোপুরি অবাস্তব।
আমি এবার আর মুখ বুজে থাকতে পারলাম না। বললাম–দেখুন মি. দুৰ্প, গজালটা সম্বন্ধে অবশ্যই কোনো-না-কোনো ভুল করা হয়েছে। কথাটা বলতে বলতে আমি গজালটার ওপর হাত রাখলাম। ব্যস, সেটা পৌনে এক ইঞ্চিসহ মাথাটা খুলে আমার হাতে চলে এলো। আর অবশিষ্ট অংশ রয়ে গেল কাঠের গায়েই। ভেঙে যাওয়ার ব্যাপারটা নতুন নয়, পুরনো। কারণ ভাঙা জায়গাটায় মরচে পড়ার জন্যই। এমনটা সম্ভব নয়। আর একটা হাতুড়ির আঘাতের মাধ্যমে সেটা করা হয়েছে। আর এরই ফলে গজালের মাথাটা শার্সির তলায় বসে গিয়েছিল।
আমি আবার গজালের মাথাটাকে ভাঙা জায়গাটাতেই বসিয়ে রাখলাম। ব্যস, সেটা দেখে কেউ অস্বীকার করবেন না যে, সেটা একটা আস্ত গজাল নয়। কোনো ভাঙা-দাগ দেখা নয়া যাওয়ায় সেটা যে আস্ত গজাল নয়, এমন ধারণা কারো মাথায়ই আসার কথা নয়।
এবার স্প্রিংটার গায়ে চাপ প্রয়োগ করে শার্সিটাকে ইঞ্চি কয়েক ওপরে উঠিয়ে দিলাম। দেখা গেল, গজালের ভাঙা মাথাটা যথাযথভাবে থেকে শার্সিটার সঙ্গে উঠে এসেছে। এবার জানালার পাল্লা ঠেলে বন্ধ করে দিলাম। দেখতে পেলাম, সম্পূর্ণ গজালের চেহারার সঙ্গে সাদৃশ্যটা আবার সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে।
রহস্যটার সমাধান এ পর্যন্ত করা সম্ভব হলো।
আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম। খুনি কাজ সেরে জানালা দিয়েই গা-ঢাকা দিয়েছিল না। সে চলে গেলে জানালাটা কেউ বন্ধ করে দিক বা নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যাক, ম্প্রিংয়ের চাপে সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তদন্ত করার সময় পুলিশ স্প্রিংটাকে গজাল মনে করে ভুল করেছে। আর এরই ফলে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর তদন্ত করার দরকার নেই।
এ পর্যন্ত বলে বন্ধুবর দুপঁ মুহূর্তের জন্য থেমে একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল–চলুন, এবার ঘরটার ভেতরের দিকটা ঘুরে দেখা যাক। সাক্ষীরা সাক্ষ্যদানের সময় বলেছেন, ঘরের ট্রাঙ্কাগুলো লুঠ করে নেওয়া হয়েছিল, যদিও তনও তার ভেতরে প্রচুর অলঙ্কারদি রয়ে গিয়েছিল। আমি রীতিমত জোর দিয়েই বলছি, এটা অবশ্যই একটা অবাস্তব ধারণা। আরও খোলসা করে বললে,নির্ঘাৎ একটা বাজে ধারণা করা হয়েছিল।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। তিনি পূর্ব প্রসঙ্গে জের টেনেই বললেন–দেখুন অলঙ্করাদি; মানে ট্রঙ্কের ভেতরে যেসব জিনিস দেখা গিয়েছিল কেবলমাত্র সেগুলোই যে প্রথম থেকেই সেখানে রক্ষিত ছিল, তা আমাদের তো জানার উপায় নেই। আর একটা কথা ভেবে দেখার আছে, মাদাম ল এস্পালয়ে আর তার মেয়ে বিশাল বাড়িটাতে নির্বাসিতার মতো, মানে পুরোপুরি নির্জন-নিরালায় দিন। কাটাতেন। কারো সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের বালাই ছিল না। আর তাদের বাইরে যাওয়ার দরকার খুব কমই হতো।
আর যেহেতু বাইরের লোকজনের সঙ্গে তাদের প্রায় যোগাযোগই ছিল না, তাই বার বার পোশাক পাল্টাবারও দরকার হতো না। ঘরটায় যেসব জিনিস নজরে পড়েছে সেগুলো সবই উন্নতমানের এবং অবশ্যই এ মহিলা দুজনের উপযোগি। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, কেউ যদি চুরি করার উদ্দেশ্য নিয়েই ঘরটায় ঢুকত তবে তো সবচেয়ে দামি জিনিসটাই হাতিয়ে নেবে, তাই না?
আমি প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করলাম–হুম!
মঁসিয়ে দুপঁ পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলে চলল–কেবলমাত্র সবচেয়ে দামি জিনিসই নয়, সবই নিয়ে তো অনায়াসে চম্পট দিতে পারত। তা করল না-ই বা কেন? সংক্ষেপে বলতে গেলে, চার হাজার ফ্লার সোনার অলঙ্কার তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ফেলে রেখে কেবলমাত্র পোশাকের একটা গাট্টি নিয়ে গিয়ে নিজেকে বঞ্চিত করারই বা কারণ কি? যা-ই হোক সোনাদানায় হাত দিল না।
ব্যাঙ্কের মালিক মি. মগিনো তার সাক্ষ্যতে যে পরিমাণ সোনার কথা বলেছেন, তা পুরোটাই থলির মধ্যে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। অতএব সাক্ষ্যতে সে বাড়িতে এসে ফ্রর থলে পৌঁছে দেবার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর সে কথা বিবেচনা করে পুলিশের মনে খুনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। আমি চাই সেটাকে আপনি মাথা থেকে ঝেড়ে মুছে ফেলে দিন।
ফ্রাঁর থলে দিয়ে যাবার তিন দিনের মধ্যে খুন হয়ে যাওয়ার চেয়ে দশগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আমাদের জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে আকছারই ঘটতে দেখা যায়। আমরা কিন্তু সেদিকে ভুলেও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি না, চেষ্টাও করি না।
এ ঘটনাটাতে যদি সোনাদানাগুলো চুরি হয়ে যেত ততে তিনদিন আগেই সেটা উদ্ধার করে দেওয়ার কাজটাকে নিতান্তই যোগাযোগের বেশিকিছু বলেই মনে করে নেওয়া যেত। আর সেটাকেই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য বলে মনে করা হতো, ঠিক কি না?
আমি কিছু বলার জন্য যেই না মুখ খুলতে যাব অমনি মি. দুপঁ নিজেই আবার বলতে লাগলেন–এ পর্যন্ত যা-কিছু বললাম তাতে বাস্তবে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে সোনাদানাগুলোকে হত্যার উদ্দেশ্য বলে মনে করা হয় তবে তো আমাদের এটাও বিবেচনা করা দরকার যে, হত্যাকারী এমনই এক আহাম্মক যে এক সঙ্গেই দুটোকেই বাতিল করেছে।
আমি ঐ দুটোকে কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বললাম–এক সঙ্গে দুটোকেই বাতিল করেছে বলতে আপনি কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছেন, মি. দুঁপ?
মি. দুপঁ মুচকি হেসে বললেন–সোনা আর তার উদ্দেশ্যটার কথা বলতে চাইছি, বুঝেছেন?
আমি ঠোঁটের কোণে অনুরূপ হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে নীরবে ঘাড় নাড়িয়ে তার কথার জবাব দিলাম।
দুপঁ বলে চললেন এবার অদ্ভুত যে সব কথাবার্তা, মানে কণ্ঠস্বরের ইঙ্গিত দিচ্ছি, কাজ হাসিল করার উদ্দেশ্যে অতিমাত্রা ক্ষিপ্রতা, এমন ভয়ঙ্কর একটা মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পিছনে কোনোই উদ্দেশ্য না-থাকা, এসব ব্যাপার-স্যাপারকে মনের কোণে স্থায়ীভাবে গেঁথে নিয়ে মনের ঘটনাটার দিকেই আমরা মনপ্রাণ সঁপে দেই, কী বলেন?
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই মঁসিয়ে দুঁপই আবার বলতে লাগলেন– অকুস্থলে পৌঁছলে আমরা কি দেখতে পাব? দেখতে পাব, এক মহিলাকে গলা টিপে খুন করা হয়েছে। তার লাশটার মাথাটাকে ওপরের দিকে রেখে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চেপে চেপে সেটাকে চুল্লির ওপরকার চিমনিটাতে গুঁজে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ হত্যাকারীদের খুনের পদ্ধতি এটা অবশ্যই নয়। আর লাম গায়েব করার পদ্ধতিও মোটেই এটা নয়।
এবার আপনি কি মেনে নেবেন, লাশটাকে যেভাবে চিমনিটার ভেতরে খুঁজে দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে এমনকিছু লুকিয়ে আছে যা ভাবতে খুবই কষ্টকর। যাকে মানুষের স্বাভাবিক কাজের পর্যায়ে ফেলা সম্ভব নয়। মানুষের প্রবৃত্তি যতই হীন হয়ে পড়ুক না কেন, যে চিমনির ভেতর থেকে লাশটাকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনতে বেশ কয়েকজনের শক্তিকে একত্রিত করতে হয়েছে। অতএব সেটাকে ওই সরু চিমনিটার মধ্যে গুঁজে দিতে কী পরিমাণ বলপ্রয়োগ করতে হয়েছিল, আশা করি অনুমান করতে অসুবিধা হচ্ছে না।
এ পর্যন্ত তো শুনলেন। এবার অবাক হবার মতো বলপ্রয়োগের অন্যসব কাজের দিকে চোখ ফেরান। সাক্ষীর সাক্ষ্যে আছে, মানুষের পাকা চুলের মোটা বিনুনির কথা। খুবই মোটা মোটা বিনুনি। আর এ কারো মাঝখাপার, অশনি আর আমি খুবই মোটা মোটা বিনুনি। আর এও বলা হয়েছে, সেগুলোকে গোড়া থেকে উপড়ে আনা হয়েছে। এবার ভেবে দেখুন, কারো মাথা থেকে বিশ ত্রিশটা চুল একই সঙ্গে উপড়ে নেওয়া যে কী শক্তির দরকার ও কষ্টকর ব্যাপার, আশা করি তা আপনাকে অন্তত বলে বোঝানো যাবে না। সে চুলের গোছাগুলো তো আপনি আর আমি উভয়েই দেখি, মনে পড়ছে? আর এও মনে থাকার কথা, চুলের গোড়াগুলোতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাংস লেগেছিল। এক সঙ্গে লক্ষচুল মুঠো করে ধরে উপড়ে ফেলতে হলে যে কী ভীষণ শক্তি প্রয়োগ করতে হয়, সে চুলগুলো তারই প্রমাণ দিচ্ছে।
এবার অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। বৃদ্ধা মাদাম ল এস্পালায়ের ধড় থেকে যে কেবলমাত্র মাথাটাকে কেটে ফেলা হয়েছে তা-ই নয়, দুটোকে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। তাই কাজটা হাসিল করতে ক্ষুর ব্যবহার করা হয়েছে। বন্ধু, এ-কাজগুলো পশুসুলভ হিংস্রতার দিকটা একবারটি বিবেচনা করে দেখ। তবে মাদামের গায়ে চামড়া কেটে-ছিড়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।
মি. দুমা আর তার অভিজ্ঞ সহকর্মী মি. ইতেনের বক্তব্য অনুযায়ী বলতে হয়, কোনো ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে খুনটা করা হয়েছে। হ্যাঁ, এ পর্যন্ত তাদের বক্তব্য ঠিকই আছে। এ বক্তব্যটা এখন খুব সহজ সরল ও স্বাভাবিক মনে হলেও এদিকে পুলিশের নজরই আকৃষ্ট হয়নি।
এবার বলছি কি, উপরে বর্ণিত ব্যাপারগুলো ছাড়াও ঘরটার ভয়ানক রকমের এলোমেলো পরিস্থিতির দৃশ্যটার কথা তো তোমার মাথায় ভালোভাবেই চেপে বসে রয়েছে, ঠিক কিনা? তোমার চিন্তা ভাবনার সঙ্গে আমি সংযোজন করেছি তাক লাগার মতো কর্মক্ষমতা। পাশবিক নিষ্ঠুরতা ও হিংস্রতা, অলৌকিক শক্তি রীতিমত অমানবিক আচরণ আর উদ্দেশ্যবিহীন হত্যাকাণ্ড ও এমন একটা বিস্ময়কর কণ্ঠস্বর যা বহু দেশের মানুষের কাছেই ভিনদেশীয় বলে মনে হয়েছে, যাতে কোনো স্পষ্ট আর অর্থবহ শব্দের খোঁজ মেলেনি। এবার বলুন তো ফল কী পাওয়া গেল?
মুহূর্তের জন্য থেমে তিনি এবার বললেন–আপনার কল্পনায় আমার বক্তব্য কী কিছুমাত্রও প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে, খোলসা করে বলুন তো?
বন্ধুবর দুপঁ যখন আমাকে লক্ষ্য করে এ প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল, তখন আমার শরীরের সব কয়টা স্নায়ু যেন একই সঙ্গে সচকিত হয়ে উঠল, আর মাংসপেশীতে অভাবনীয় কম্পন অনুভুত হলো। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে উঠলাম–এটা কোনো পাগলের কর্ম? অদূরবর্তী ম্যাসন্ ডি স্যান্টে পাগলাগারদ থেকে কোনো পাগল করেছে নাকি?
আমার কথা শুনে তিনি বললেন–আপনার অনুমানটা একেবারে অমূলক নয়। বাড়িটায় ঢুকে-পড়া লোকগুলো সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় যে অদ্ভুত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিল, তীব্রতম পরিস্থিতিতেও কোনো বদ্ধ পাগলের কণ্ঠস্বরের সঙ্গেও তার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে, মন্ত্রমুগ্ধের মতোই তার যুক্তি সঙ্গত বক্তব্য শুনতে লাগলাম।
তিনি বলে চললেন–আরে বন্ধু, পাগল হলেও সে তো কোনো-না-কোনো দেশ আর অঞ্চলের মানুষ তো বটে। আর তারনিজস্ব একটা ভাষাও থাকবেই থাকবে। কারো বক্তব্য যত অসংলগ্নই হোক না কেন তাতে প্রচলিত শব্দের উল্লেখ তো লক্ষিত হবেই। আরও আছে বন্ধু।
আরও? যেমন?
কোনো পাগলের চুল হলে সেগুলো অবশ্যই আমার হাতের চুলের গোছার মতো কিছুতেই হতো না। এবার কয়েকটা চুল আমার দিকে এগিয়ে ধরে বললেন–এ চুল কটার রহস্য কী, বলতে পারেন?
কী? কী ব্যাপার ঐ রহস্যের?
এগুলো আমি যোগাড় করেছি মাদাম ল এস্পালয়ের মুঠো করা হাতের আঙুলের ফাঁক থেকে।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, ঠিক তা-ই।
শুনুন মি. দুর্প, মুহূর্তের জন্য আরও চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে নিয়ে আমি বললাম–এ চুলগুলো অবশ্যই সাধারণ, মানে মানুষের চুলই নয়। মানুষের এরকমটা হতে পারে না। কিছুতেই না।
মঁসিয়ে দুপঁ বললেন–কই, এগুলো মানুষের চুল এমন কথা তো আমি বলিনি। এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমি চাই আমার নিজের হাতে আঁকা এ রেখাচিত্রটা আপনি একবার দেখুন।
আমি তার হাতের কাগজটার দিকে তাকালাম।
তিনি বলে চললেন–দেখুন, সাক্ষীদের কারো কারো সাক্ষ্যের এক জায়গায় যাকে মাদামোয়াজেল ল এস্পালায়ের গলার ওপরের থেঁতলে যাওয়ার জন্য কালো দাগ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে আর বলা হয়েছে, নখের আঁচড়, আবার এমনও বলা। হয়েছে আঙুলের চাপের জন্য কালসিটে পড়ার দাগ, এটাকে তারই কার্বনকপি বলে মনে করতে পারেন। মোদ্দা কথা, সে চিহ্নগুলোকেই আমি রেখাচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছি।
কথা বলতে বলতে বন্ধুবর দুপঁ হাতের নক্সাটাকে টেবিলের ওপর রাখলেন। সেটাকে খুলে এক জায়গায় অঙ্গুলি-নির্দেশ করে বললেন–একটু লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন এ রেখাচিত্রটা থেকে একটা বজ্রমুষ্ঠির ধারণা পাবেন। হাত ফসকে বা পিছনে যাবার কোনো চিহ্নও নেই। এই দেখুন, প্রতিটা আঙুলের গোড়াতেই শেষ অবধি সেভাবে গভীরভাবে চেপে গিয়েছিল, হয়তো বা আক্রান্ত মাদামমায়াজেল ল এম্পানায়ের মৃত্যু হওয়া অবধি ভয়ঙ্কর সে সুদৃঢ় মুষ্টিকে অব্যাহত রাখা হয়েছিল।
আমি ছবিটার ওপর অনুসন্ধিৎসু নজর বুলাতে লাগলাম।
তিনি এবার আমাকে লক্ষ্য করে বললেন–মি., আপনার আঙুলগুলোকে ছবিটার প্রতিটা আঙুলের ছাপের ওপর স্থাপন করার চেষ্টা করে দেখুন তো।
আমি তার কথামত ছবির চিহ্নগুলোর ওপর আমার হাতের আঙুলগুলোকে রাখার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। বার-কয়েক বৃথা চেষ্টা করে হাতটাকে কাগজটা থেকে তুলে নিলাম।
আমাকে ব্যর্থ হয়ে হাতটা সরিয়ে নিতে দেখে তিনি বললেন–দেখুন, কাজটা হয়তো ঠিক ঠিকভাবে করা হচ্ছে না।
মানে? আপনার কথাটা আমি–।
আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই তিনি এবার বললেন–আমরা তো একটা সমতল টেবিলের ওপর কাগজটা ছড়িয়ে রেখেছি, তাই না?
হ্যাঁ, তা-তো বটেই।
কিন্তু মানুষের গলার আকৃতি তো আর সমতল নয়, গোলাকার। কথা বলতে বলতে একটা কাঠের টুকরো আমার সামনে ধরে বললেন–এ কাঠের টুকরোটা মানুষের গলার আকৃতি বিশিষ্ট মনে করা যেতে পারে ঠিক কি না?
হ্যাঁ, সে রকম মনে করা যেতে পারে বটে।
এবার কাঠের টুকরোটার গায়ে রেখাচিত্রটা জড়িয়ে নিয়ে চেষ্টা করে আবার দেখুন তো আপনার হাতের আঙুলগুলো ছবির চিহ্নগুলোর ওপর পড়ে কি না?
তার পরামর্শ অনুযায়ী আমি তা-ই করার চেষ্টা করলাম বটে। কিন্তু দেখলাম এবারের কাজটা আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি শক্ত।
আমি বাধ্য হয়ে বেশ জোর গলায়ই বললাম–ধ্যুৎ! এটা অবশ্যই কোনো মানুষের আঙুলের ছাপ নয়।
আমার কথা শুনে বন্ধুবর দুঁপ ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললেন। তারপর একটা চটি বইয়ের একটা জায়গার ওপর অঙ্গুলি-নির্দেশ করে বললেন–এ অংশটুকু একবারটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন তো। লেখাটা কুড়িয়ের পড়ন।
আমি বইটাকে হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখলাম। ওরাংওটাং-এর অঙ্গ সংস্থানসহ সাধারণ বিবরণ সম্বলিত কয়েক রং বিশিষ্ট একটা বই। পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে বৃহদাকার প্রাণীটার দেখা মেলে। বিশালদেহী স্তন্যপায়ী প্রাণী। দেহে অমিত শক্তি ধরে। কর্মক্ষমতাও যথেষ্টই। অসাধারণ হিংস্র প্রকৃতির। আর এদের অনুকরণ ক্ষমতার কথা কার না জানা আছে।
বইটার দিকে তাকিয়ে ওরাংওটাং সম্বন্ধে ওপরের কথাগুলো মনের কোণে উঁকি দেওয়ামাত্র হত্যাকাণ্ডটার ভয়ঙ্করতা সম্বন্ধে আমার মধ্যে স্পষ্ট একটা ধারণা খেলে গেল।
বন্ধুবর দুঁপের পরামর্শ অনুযায়ী বইটা পড়ে ফেললাম। লক্ষ্য করলাম বইটাতে অতিকায় প্রাণীটার আঙুলের যে বিবরণ দেওয়া আছে তা রেখাচিত্রটার ছাপগুলোর সঙ্গে অবিকল মিলে যায়।
আমি এবার বললাম–মি. দুঁপ, স্পষ্টই বুঝতে পারছি, রেখাচিত্রটায় যে আঙুলের ছাপ আপনি এঁকেছেন তা ওরাংওটাং ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। কুভিয়ের যে কটা রঙের লোমের বিবরণ দিয়েছেন, তা যেন অবিকল সে চুলের গোছার মতোই বটে। কিন্তু আমি খুবই ধন্ধে পড়েছি।
ধন্ধ? কী সে ধন্ধ, বলুন তো?
ভয়ঙ্কর এ হত্যাকাণ্ডটার ছোটখাট ব্যাপারগুলো আমার মাথায় ঠিক ঢুকছে না। আর কথা কাটাকাটির সময় দুটো কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছিল, আর তার একটা যে কোনো এক ফারসীর কণ্ঠস্বর সে বিষয়ে তো তিলমাত্রও সন্দেহই নেই।
অবশ্যই। সাক্ষীরা তাদের নিজনিজ সাক্ষ্য দিতে গিয়ে যা বলেছেন, তার মধ্যে প্রত্যেকেই একটা কথা উল্লেখ করেছেন। কথাটা কি তা-তো আমরাও বারবারই বলেছি–মন ডিউ। সাক্ষীদের একজন এ কথাটাতে আপত্তি প্রকাশ করতে গিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন, ঠিক কি না?
হ্যাঁ, তা বটে।
অতএব রহস্যটার সমাধানের ব্যাপারে এ শব্দ দুটোতেই আমার সব আশা লুকিয়ে রয়েছে।
আরও বলতেই হয়, হত্যাকাণ্ডটার কথাটা একজন ফরাসি জানতে পেরেছিলেন। হয়তো বা সে এ ভয়ঙ্কর কাণ্ডটার সঙ্গে কোনোক্রমেই লিপ্ত ছিল না। ব্যাপারটা এমনও হতে পারে ওই ওরাংওটাংটা তার কাছ থেকে পালিয়ে আছে। হয়তো বা তাকে অনুকরণ করেই সে ঘরটায় ঢুকে গিয়েছিল। ব্যস, তারপরই সে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে যায়। তাতে করে তার পক্ষে জানোয়ারটাকে কিছুতেই আটকে ফেলা সম্ভব হয়নি। যাক, এটা নিয়ে আর বেশি কিছু বলার আগ্রহ নেই, আর আমার অধিকারও তো নেই।
কারণ কী?
কারণ, যুক্তিটার ওপর যে আমিই পুরোপুরি নির্ভর করতে পারছি না। তাই এটাকে একটা অনুমান হিসেবেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। উপরোক্ত ফরাসি লোকটা যদি আমার ধারণা অনুযায়ী সত্যি সত্যি নির্দোষই হয় তবে তো গতরাতে বাড়ি ফেরার সময় পথে যে বিজ্ঞাপনটা আমি লে মোদে–জাহাজ চলাচল সংক্রান্ত পত্রিকার দপ্তরে ছাপার জন্য দিয়ে এসেছি। চোখে পড়লেই সে আমার বাড়ি চলে আসবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।
কথাটা বলতে বলতে সে এক চিলতে কাগজ আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।
আমি হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে পড়তে লাগলাম–এ মাসের প্রথম দিকে প্রত্যূষে বর দ্য বুলোম নামক শহরে অতিকায় একটা ওরাংওটাং ধরা পড়েছে। সেটা বোর্নিও শ্রেণির ওরাংওটাং। সেটার গায়ের রঙটা। জানা গেছে সেটা মল্টাগামী জাহাজের মালিকের। যা-ই হোক, সেটার মালিক উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে তার আটক করা ও খাই-খরচ বাবদ অর্থ পরিশোধ করে সেটাকে খালাস করে নিয়ে যেতে পারেন। যোগাযোগের ঠিকানা–নং, র, ফবুর্গ স্যাঁৎ জার্মেন।
আমি মুহূর্তের জন্য নীরবে ভেবে নিয়ে বন্ধুবরকে বললাম একটা কথা; কিছুতেই আমি ভেবে পাচ্ছি না।
কী? কথাটা কি জানতে পারি কী?
কথাটা হচ্ছে, ওরাংওটাংটার মালিক যে একজন জাহাজের নাবিক, আর জাহাজটা মল্টাগামী তা আপনি কিভাবে জানতে পারলেন, বলবেন কী?
অবশ্যই জানি না। নিঃসন্দেহও নই।
তবে এমন একটা অসম্ভব ব্যাপার আপনার পক্ষে কীভাবে জানা সম্ভব হয়েছে?
এই যে একটা ফিতের টুকরো দেখতে পাচ্ছেন, এর দৈর্ঘ্য ও আকৃতি এবং তেল-ময়লা জড়ানো অবস্থাটাই আমাকে এ রকমটা ভাবতে উৎসাহিত করছে।
মানে কী বলতে চাইছেন মি. দুঁপ?
নাবিকরা পরচুলা বাঁধার কাজে সাধারণত এরকম ফিতেই ব্যবহার করে থাকে। নাবিকরা ছাড়া এরকম গিটও অন্য কারো পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। আর মল্টাবাসী নাবিকরাই সবচেয়ে বেশি করে এটা ব্যবহার করে।
ভালো কথা, এ ফিতেটা আপনার হাতে কিভাবে এলো?
সে বাড়িটায় তদন্ত চালাতে চালাতে বাড়ির গায়ের একটা জায়গায় পড়ে ছিল। কুড়িয়ে পকেটে রেখেছিলাম। ফিতেটা যে মৃত দুজনের কারো নয় এ বিষয়ে তো নিঃসন্দেহ হওয়া চলে। আমার এ ধারণাটা ভুল হলেও তো ক্ষতি বৃদ্ধি কিছুই নেই। আর যদি সত্য হয় তবে লাভ বিশালই হবে। এখন ধরে নেওয়া যেতে পারে, ফরাসিটা যদি নিরপরাধও হয়ে থাকে তবুও বিজ্ঞাপনটা পড়ে সে ওরাং ওটাংটা নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে গড়িমসি করবে।
তবে তো আপনার বিজ্ঞাপনের পরিকল্পনাটা মাঠে মারা যাবে, তাই না মি. দুর্প?
হ্যাঁ, তা অবশ্য যাবে। কিন্তু ফরাসি ভদ্রলোক নিজেকে নানাভাবে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করবে, যেমন ধরুন–আমি নিরপরাধ, আমি গরিব, আমার ওরাংওটাংটার মূল্য অনেক, আমার মতো একজন গরিবের কাছে ওটা একটা সম্পত্তি ছাড়া কিছু নয়, অনিশ্চিত ও অহেতুক বিপদের ভয়ে এমন একটা সম্পত্তি যে কেন বে-হাত করতে যাবে? ওরাংওটাংটা তো আমার প্রায় কজায়ই চলে এসেছে। আর বয় দ্য চুলেনে সেটাকে পাওয়া গেছে। আর সেটা অকুস্থল, অর্থাৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল থেকে দূরে বহুদূরে অবস্থিত।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল থেকে দূরে বহুদূরে অবস্থিত।
চমৎকার! চমৎকার!
আরও আছে, একটা পা-ও যে এমন একটা রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডের নায়ক হতে পারে এমন সন্দেহ কারো মনে জাগবেই বা কি করে? ব্যর্থতা তো পুলিশ দপ্তরের? তারা এত চেষ্টা করে সামান্যতম সূত্রও বের করতে সক্ষম হয়নি। ব্যর্থ হয়েছে। তারা জনোয়ারটার হদিস পেলেও, সে ক্ষেত্রেও আমি যে হত্যাকাণ্ডটার কথা জানতাম, সে কথা কিছুতেই প্রমাণ করতে পারবে না, অথবা আমি জানতাম বলেই যে অপরাধের জন্য আমাকে অভিযুক্ত করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়বে।
হুম! আমি গম্ভীর মুখে প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করলাম। বন্ধুবর দুপঁ পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে এবার বললেন–পুলিশ ফরাসি লোকটাকে অপরাধী ভাবার কোনো সূত্রই খুঁজে পাবে না। সে অবশ্যই ভাববে, আমি তো সবারই পরিচিত। আর বিজ্ঞাপনদাতা
তো আমাকেই ওরাংওটাংটার মালিক ধরে নিয়েছে, বিজ্ঞাপনের তা উল্লেখও করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি কতটা কি জানেন তা আমার পরিষ্কার জানা নেই। জানতে পেরেও এরকম দামি জানোয়ারের দাবি না করে আমি নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলে তো আমার ওপর সন্দেহ পড়তে বাধ্য। আমার বা আমারই জানোয়ারটার ওপর সবার নজর পড়ক এটা তো অবশ্যই আমার কাম্য হওয়া উচিতও নয়। বিজ্ঞাপনের ঠিকানা অনুযায়ী আমি উপস্থিত হব। ওরাংওটাংটাকে হাতে পেয়ে যাব। আর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারটা যতদিন না ধামাচাপা পড়ে যায়, ততদিন আমি সব কথা আমার মনের গোপন করেই চাপা দিয়ে রাখব।
বন্ধুবরের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই সিঁড়ি থেকে পায়ের শব্দ ভেসে আসতে লাগল।
মুহূর্তের জন্য উৎকর্ণ হয়ে শব্দটা শুনে নিয়ে দুনিচু গলায় বললেন–এক কাজ করুন, পিস্তলটা নিয়ে তৈরি হয়ে থাকুন। তবে মনে রাখবেন, আমার ইঙ্গিত না পাওয়া অবধি ওটা অবশ্যই ব্যবহার করবেন না, আর যাতে দেখতে না পায় সতর্ক থাকবেন।
বাড়ির সদর দরজাটা খোলা পেয়ে আগন্তুক ঘণ্টা না বাজিয়ে বা ডাকাডাকি না করেই সোজা ভেতরে ঢুকে এলো। লম্বা লম্বা পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লক্ষ্য করলাম, লোকটা দ্বিধায় পড়েছে। এবার দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ার শব্দ কানে এলো। পরমুহূর্তেই আবার ওপরে উঠে আসার শব্দ শুনতে পেলাম। ব্যস, দ্বিতীয়বার তার আর নেমে যাওয়ার শব্দ শোনা গেল না। এবার মনে হলো, সে যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মুহূর্তের মধ্যেই সে সিঁড়ির বাকি ধাপ কয়টা অতিক্রম করে দরজার কড়া নাড়তে আরম্ভ করল।
বন্ধুবর দুপঁ বললেন–আসুন, ভেতরে চলে আসুন।
তার কথা শেষ হতে না হতেই দেখতে নাবিকের মতো এমন একজন ঘরে ঢুকে এলো। সুঠাম ও দীর্ঘদেহী আর পেশীবহুল চেহারা। মনে হলো গায়ে গতরে শক্তিও ধরে যথেষ্টই। দেখতে সুশি না হলেও খুব কুশিও বলা চলে না। তবে চোখে মুখে একটা বেপরোয়াভাব লক্ষিত হলো। আর মুখটাকে একটু বেশি রকমই রোদে পোড়া মনে হলো। জুলফি আর গোঁফে মুখের প্রায় অর্ধেকটা ঢেকে দিয়েছে। একটা মোটাসোটা কাঠের লাঠি তার হাতে ধরা। লাঠিটা ছাড়া আর কোনো অস্ত্রপাতি সঙ্গে নেই বলেই মনে হলো। বিচিত্র ভঙ্গিতে অভিবাদন সারল। এতেই মনে হলো আগন্তুক একজন প্যারিসের বাসিন্দা।
মুচকি হেসে দুঁপ বললেন–বসুন বন্ধু। আমার মনে হচ্ছে, আপনি ওরাং ওটাংটার খোঁজেই এসেছেন। একটা কথা, এমন দামি একটা জানোয়ারের মালিক হওয়ার জন্য আমি কিন্তু আপনাকে হিংসাই করছি। একটা কথা জানতে পারি কী?
আগন্তুক বিজ্ঞ বিনয়ের সঙ্গেই বললেন–কী জানতে চাইছেন, বলুন। আপনার জিজ্ঞাসা নিরসন করার ক্ষমতা থাকলে আমি তা অবশ্যই করব।
আপনার জানোয়ারটার বয়স কত বলুন তো?
দেখুন সঠিক বয়স বলা মুশকিল। তবে চার পাঁচ বছরের বেশি নয় বলেই আমার বিশ্বাস। আচ্ছা, সেটাকে কী এখানেই রাখা হয়েছে?
না। ওটাকে এখানে কি করে রাখব! এখানে জায়গা কোথায়, দুবুর্গের একটা খোয়াড়ে সেটাকে রাখা হয়েছে। কাল সকালে পেয়ে যাবেন, অসুবিধা হবে না। তবে সেটা যে আপনার, সেটা প্রমাণ করার চিন্তা-ভাবনা আপনি অবশ্যই করেছেন, তাই না?
হ্যাঁ, আমি তৈরি হয়েই এসেছি।
কয়দিন আমার জিম্মায় আছে, আমার মায়া পড়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবার তিনি বললেন–জানোয়ারটাকে ছেড়ে দিতে আমরা কিন্তু খুবই কষ্ট পাব।
আরে মি., আমি আপনাকে শুধুশুধু ঝামেলা পোহাতে বলব না। আমি তা চাইবই বা কেন? আমার প্রিয় ওরাংওটাংটাকে ফিরে পাবার বিনিময়ে আনন্দের সঙ্গে একটা পুরস্কার আপনাকে দিতে চাইছি। পুরস্কার না বলে তাকে আপনার ন্যায্য পাওনা মনে করাই ভালো।
হুম!
হ্যাঁ, আমি খুশি হয়েই আপনাকে সন্তুষ্ট করার জন্য–
এ তো আনন্দের কথা মি.! কেউ খুশি হয়ে কিছু দিলে তা হাত পেতে নেয়াই তো ভদ্রতা।
তবে অনুগ্রহ করে বলুন, কী পেলে আপনি খুশি হবেন?
খুশি হব? ভালো কথা, আমাকে তবে একটু ভাববার সময় দিন।
ঠিক আছে! তবে ভেবেই বলুন।
দেখুন, আমি এমনকিছু আপনার কাছ থেকে প্রত্যাশা করি না যাতে আপনাকে অর্থব্যয় করতে হবে!
তবে?
রু মার্গের খুনের ব্যাপারটা সম্বন্ধে আপনি আমাকে সাধ্যমত জানালে আমি সবচেয়ে খুশি হব।
বন্ধুবর দুঁপ শান্তস্বরেই কথাটা শেষ করলেন। কথা বলতে বলতে চেয়ার থেকে উঠে ধীরপায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজায় তালা দিয়ে চাবিটা কোটের পকেটে চালান করে দিলেন। আগের মতো ধীরেই টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালেন। কোটের ভেতরের বুক পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে আলতোভাবে টেবিলের ওপরে রাখলেন।
আগন্তুক নাবিক অতুত্র আগ্রহের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন। আমি আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে তার চোখ মুখের আকস্মিক পরিবর্তনটুকু লক্ষ্য করতে লাগলাম। দেখলাম, তার মুখটা ক্রমে লাল হয়ে উঠল। আর এও আমার নজর এড়াল না, এখনই বুঝি তার শ্বাস বন্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়বে। টু-শব্দটি করল না। তার আকস্মিক মর্মান্তিক পরিস্থিতিটা দেখে করুণার উদ্রেক হলো।
আমার বন্ধুবর দুপঁ তার পরিকল্পনামাফিক একের পর এক ধাপ এগোতে লাগলেন। কণ্ঠস্বরে সহানুভূতি প্রকাশ করে এবার বললেন–শুনুন মি., আপনি কিন্তু মিছেই ভয় পেয়ে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন। বিশ্বাস করুন, আপনার তিলমাত্রও ক্ষতি করার ইচ্ছা আদৌ আমাদের নেই। সত্যি বলছি, একজন ভদ্রলোক, একজন ফরাসি হিসেবে আপনার মান সম্মানের দোহাই দিয়ে বলছি, আপনার গায়ে আঘাত করা তো দূরের ব্যাপার, ফুলের টোকা দেয়ার ইচ্ছাও আমাদের নেই।
মুহূর্তের জন্য থেমে দুপঁ আবার বলতে আরম্ভ করলেন–আমার কিন্তু ভালোই জানা আছে মি., রুমর্গের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আপনি নিরপরাধ–নির্দোষ। তবে খুনের ঘটনাটার সঙ্গে নিজেকে যে একটু লিপ্ত করে ফেলেছেন তা অস্বীকার করে ফয়াদা কিছু হবার নয়।
আমাদের অতিথি-দ্রলোকটা নীরবে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আগের মতোই লাল হয়ে ওঠা মুখটা তুলে নীরবে তাকিয়ে রইলেন।
দুপঁ পূর্বপ্রসঙ্গের জের টেনেই বলে চললেন–শুনুন মি., আমি যা-কিছু বলেছি তা থেকে আপনি নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন, এ ঘটনাটা সম্বন্ধে সব কথা জানাবার মতো সব পথ আমার অবশ্যই আছে, যা আপনার পক্ষে স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি। যাক, পরিস্থিতিটা মোটামুটি এ রকম হয়ে পড়েছে–আপনি এমন কোনো কাজ করেন নি যা আপনার পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। অর্থাৎ খুনের ব্যাপারটা নিয়ে আপনার ওপরে দোষ চাপিয়ে দেয়া যেতে পারে এমন কোনো কাজই আপনি করেন নি। আবার ডাকাতির জন্যও আপনার ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে কি, কাজটা কিন্তু আপনি নির্বিপরেই সেরে ফেলতে পারতেন বলেই আমি মনে করি। গোপন করার মতো কিছুই আপনার নেই। আর চেপে যাওয়ার মতো কাজও তো আপনি কিছুই করেন নি। তবে এটাও সত্য, নিজের মান সম্মানের কথা চিন্তা করে আপনার যেটুকু জানা আছে, তা প্রকাশ করতে বাধ্য।
আমি লক্ষ্য করলাম, আগন্তুকের মুখটা আগের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি লাল হয়ে উঠল।
বন্ধুবর দুপঁ কিন্তু নাছোড়বান্দা। তিনি বলেই চললেন–একটা কথা মন দিয়ে শুনুন মি., যে অপরাধীকে আপনি অনায়াসেই ধরিয়ে দিতে পারেন, তার কৃত অপরাধের দায়ে একটা নিরপরাধ মানুষ কিন্তু জেলে পঁচে মরছে।
বন্ধুর কথা শুনে আগন্তুক নাবিকের মনোবল বেশ কিছুটা ফিরে এলেও আগের সে সাহসিকতা কিন্তু আর তার মধ্যে লক্ষিত হলো না।
কয়েক মুহূর্ত নীরবে ভেবে, পায়ের বুড়ো আঙুল মেঝেতে ঘষতে ঘষতে এক সময় আগন্তুক বলল–ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি, হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে যা-কিছু আমার জানা আছে সবই খোলাখুলি আপনাকে বলছি। আমি তিলমাত্র গোপন না করলেও আমার বক্তব্যের অর্ধেকটাও আপনি বিশ্বাস করবেন বলে আমি আশা করি না। আপনার কথা না হয় ছাড়ানই দিলাম। আমি নিজে একটা আহাম্মক না হলে বিশ্বাস করতাম না। তবুও আমি নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপরাধ মনে করি বলেই সবই খোলসা করে আপনাকে বলব। এতে যদি আমাকে মৃত্যুবরণও করতে হয় তবুও এটা কথাও চাপার চেষ্টা করব না। কথা দিচ্ছি।
তারপর সে যা-কিছু বলল, সংক্ষেপে এরকম–বর্তমানে ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ দর্শনে বেরিয়েছে। বোর্ণিও বন্দরে তার সহযাত্রীরা নেমে যায়। প্রমোদ ভ্রমণের জন্য বন্দর থেকে বেরিয়ে তারা শহরে চলে যায়। হঠাৎ সে ওরাংওটাংটাকে দেখতে পেয়ে সেটাকে ধরার জন্য তৎপর হয়। তারপর একজন সহযাত্রীর সাহায্যে বহু কষ্ট স্বীকার করে সেটাকে ধরতে পারল। অচিরেই সঙ্গিটার মৃত্যু হয়। ব্যস, এবার সে একাই ওরাংওটাংটার মালিক বনে যায়। জানোয়ারটা তার অধীনেই বন্দি-জীবন যাপন করতে থাকে।
বন্দি ওরাংওটাংটা খুবই হিংস্র আর গোঁয়ারগোবিন্দও বটে। বাড়ি ফেরার পথে হাজারো হাঙ্গামা-হুঁজ্জতি সহ্য করে সে শেষপর্যন্ত কোনোরকমে প্যারিস শহরে ফিরে আসতে সক্ষম হলো।
প্যারিসে ফিরে আসার পর প্রতিবেশীদের কৌতূহল ও ঝামেলার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যেই সে জানোয়ারটাকে বাড়ি থেকে দূরে এক নির্জন প্রান্তরে লুকিয়ে রাখল। জাহাজে থাকার সময়ে একটা কাঠের টুকরো আঘাত লেগে পায়ের কিছুটা অংশ কেটে যায়। দগদগে ঘা হয়ে যায়। ভাবল যে দাম পেলে বিক্রি করে দেবে। বিক্রি করে দেবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই নেয়।
যে রাতে হত্যাকাণ্ডটা ঘটেছিল সে রাতের কথা। সে ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে আনন্দ-স্ফূর্তি সেরে সে প্রায় ভোরের দিকে বাড়ি ফিরে অত্যাশ্চর্য এক ঘটনার মুখোমুখি হন। সে দেখল, জানোয়ারটা তার নিজের খেয়াড় ছেড়ে এসে মনিবের শোবার ঘরে ঢুকে টেবিল থেকে ক্ষুরটা তুলে নিয়ে দিব্যি দাড়ি কামানোর কাজে মেতে গেছে। কোনোদিন হয়তো সে দরজার ছিদ্রে চোখ লাগিয়ে মনিবকে আয়নার সামনে বসে দাড়ি কামাতে দেখেছিল।
ওরাংওটাংটার কাণ্ড দেখে তার মনিব নাবিক তো রীতিমত স্তম্ভিত। একটা বন্য পশুকে ক্ষুর দিয়ে অবিকল মানুষের মতো দাড়ি কামাতে দেখলে কার না চোখ ছানাবড়া হবে। সে ঘরে ঢুকেই দেওয়াল থেকে চাবুকটি টেনে নিয়ে আচ্ছা করে তাকে ভড়কে দিল। ইতিপূর্বে হিংস্র জানোয়ারটাকে বশে রাখার জন্য বহুবারই এ অস্ত্রটা তাকে ব্যবহার করতে হয়েছে।
দু-চার ঘা খেয়েই অসহ্য যন্ত্রণায় বিশ্রি স্বর করে আতনাদ করতে করতে জানোয়ারটা খোলা জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোজা রাস্তায় চলে যায়।
ক্রোধোন্মত ফরাসি নাবিকটা জানোয়ারটার পিছনে ধাওয়া করল। আর সেটা ক্ষুর-হাতে ক্রোধে গর্জন করতে করতে ছুটছে আর মাঝে মাঝে পিছন ফিরে মুখ বিকৃত করে তাকে ভ্যাংচাতে লাগল। সে কিন্তু এতটুকুও হতাশ না হয়ে সেটাকে অনুসরণ করেই চলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কমতে কমতে লোকটা জানোয়ারটার একেবারে কাছাকাছি চলে এলো।
তখন ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। ঘরিতে ভোর তিনটা বাজে। রাস্তাঘাট নির্জন নিরালা, একেবারে শুনশান। রু মর্গের পিছন দিককার একটা ফাঁকা গলি দিয়ে চলার সময় নিজের বাড়ির চারতলায় মাদময়জেল ল এম্পানয়ের খোলা-জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসা আলোর সাহায্যে ঘরের ভেতরের খাটটার দিকে তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়।
হিংস্র জানোয়ার ওরাংওটাংটা একলাফে এগিয়ে গিয়ে বাড়িটার বজ্র-প্রতিরোধক দণ্ডটা বেয়ে অত্যাশ্চর্য দ্রুততার সঙ্গে ওপরে উঠে গিয়ে বাড়িটার খোলা জানালাটায় পৌঁছে যায়। সেখান থেকে এক লাফে খাটের মাথায় চলে যায়। ঘরটায় ঢোকার সময়ই সে এক লাথি মেরে শার্সিটাকে খুলে দিল। একটা মাত্র মিনিটের মধ্যেই পুরো ব্যাপারটা ঘটে গেল। ব্যস, সব শেষ।
ফরাসি নাবিক তখন হাসি ও বিমর্ষের জোয়ারে ভাসছে, এবার সেটাকে ধরতে পারবে বলেই সে আশান্বিত। কারণ, যে কাঠগড়ায় সে মাথা গলিয়েছে সেখান থেকে আবার নিজেকে মুক্ত করার সম্ভাবনা মোটেই নেই।
সে যদি বজ্রনিরোধক দণ্ডটাকে রেখে নেমে আসতে প্রয়াসী হয় তবে তাকে ধরে ফেলতে পারবে বলেই বিশ্বাস।
আর নাবিকটার এ আশঙ্কাও কম নয় যে, বাড়ির ভেতরে ঢুকে জানোয়ারটা কোন্ অপকর্ম করে বসে তাই বা কে জানে? অতএব যে করেই হোক, সেটাকে ধরতে হবেই। আর সেটা পিছু না নিলে কেলেঙ্কারীর চূড়ান্ত ঘটে যাওয়াও কিছুমাত্র সন্দেহও নেই।
সে একজন দক্ষ নাবিক। একটা বজ্র নিরোধক দণ্ড বেয়ে ওপরে উঠে যাওয়া তার পক্ষে কোনো কঠিন কাজ নয়। সে কারলও তাই।
জানালাটার কাছে পৌঁছেই সে থমকে থেমে গেল। বুঝতে পারল, ওই নির্দিষ্ট জানালাটা অনেক উঁচুতে অবস্থিত। উপায়ন্তর না দেখে সে সেখানেই থেমে গেল। দীর্ঘসময় ধরে বহুভাবে চেষ্টা করার পর সে কোনোরকমে ভেতরে দৃষ্টিপাত করতে পারল। কিন্তু ভেতরে যে ভয়ঙ্কর দৃশ্য, সে দেখতে পেল, তাতে তার যে কেবলমাত্র চক্ষুস্থিরই হয়ে গেল তা নয়, অন্তর-আত্মা খাঁচা ছাড়া হয়ে যাবার যোগাড় হলো। কোনোরকমে নিজেকে সামলেম নিল, নইলে হাত ফসকে পড়েই যেত।
ব্যস, ঠিক সে মুহূর্তেই ঘরের ভেতর থেকে এমন বুক-কাঁপানো আর্তনাদ উঠল যা শুনে রুমর্গের বাসিন্দারা শুধু চমকেই উঠল না, ধরতে গেলে আধমরা হয়ে গেল।
বৃদ্ধা মাদামোয়াজেল ল এম্পানায়ে আর তার মেয়ে রাতের পোশাক পরেই লোহার সিন্দুকটাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরের মাঝখানে নিয়ে আসার জন্য প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সিন্দুকটা খোলা। ভেতরের জিনিসপত্র মেঝেতে স্তূপ করে রাখা। কাজ কিছুটা সেরে, সিন্দুকটাকে ঘরের মাঝামাঝি এনে তারা দুজনই জানালার কাছে বসে একটু জিরিয়ে নিতে লাগল। উভয়েই জানালার দিকে পিঠ রেখে বসে। তাই হিংস্র জানোয়ারটা কখন যে ঘরের ভেতরে ঢুকে এসেছে তারা টেরই পায়নি। তারপর থেকে তার আর্তনাদের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্তও তারা কেউ তার উপস্থিতি এতটুকু অনুমানও করতে পারেনি।
মুহূর্তকাল আগে শার্সিটা থেকে অকস্মাৎ ক্যাচ্ করে একটা শব্দ হয়েছিল বটে। মা বা মেয়ে কেউ-ই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কারণ, তার নিঃসন্দেহ হয়েছিল, শার্সিটায় বাতাস লাগার ফলেই এমনতর অবাঞ্ছিত শব্দটার উদ্ভব হয়েছে।
ফরাসি নাবিক ভেতরে উঁকি দিয়েই আঁতকে উঠল। সে দেখল, বিশালদেহী ওরাংওটাংটা মাদামোয়াজেল ল এস্পালয়ের চুলের মুঠি ধরে নাপিতের দাড়ি কামানোর কায়দার হাতের সুতীক্ষ ক্ষুরটাকে তার সারা মুখে অনবরত টেনে চলেছে। তার তখন খোলা থাকার ফলে চুলের গোছা মুঠো করে ধরা জানোয়ারটার পক্ষে সহজ হয়।
মাদামোয়জেলের মেয়েটা মেঝেতে পড়ে। নিশ্চল-নিথর। সম্বিৎ লোক পাওয়ার জন্যই সে এমন এলিয়ে পড়ে রয়েছে।
আর বৃদ্ধা মাদামোয়াজেল ল এস্পালয়ে আর্তনাদ ও বাধা দেবার চেষ্টা করায় জানোয়ারটা তার শান্ত ভাবটা কাটিয়ে ক্রমে ক্রোধোন্মত্ত হয়ে পড়তে লাগল। সে ইতিমধ্যে শরীরের সর্বশক্তি নিয়োগ করে বৃদ্ধার মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে প্রায় ন্যাড়া করে দিয়েছে। এবার তার ক্রোধ পঞ্চমে চড়ে গেল। সে হাতের ক্ষুরটা দিয়ে অতর্কিতে এমন মোক্ষম একটা পোচ দিল, যাতে তার ধড় থেকে মুণ্ডুটা মেঝেতে আছড়ে পড়ল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল। রক্ত দেখে ক্রোধোন্মত্ত জানোয়ারটা যেন মুহূর্তে উন্মাদ-দশাপ্রাপ্ত হলো।
হিংস্র ক্রোধোন্মত্ত জানোয়ারটা এবার বৃদ্ধার দিক থেকে ফিরে মেয়েটার দিকে নজর দিল। মেয়েটা তখনও সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মেঝেতে এলিয়ে পড়ে রয়েছে। সে অতর্কিতে তার নিশ্চল-নিথর দেহটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তীক্ষ্ণ নখগুলো দিয়ে তার গলাটাকে জব্বর কায়দায় চেপে ধরল। প্রাণপাখি খাঁচাছাড়া না হওয়া অবধি সে হাতের চাপ এতটুকুও শিথিল করল না।
হিংস্র জানোয়ারটা উন্মাদের মতো ঘরের চারদিকে দৃষ্টি ফেরাতে লাগল। হঠাৎ বিছানার ওপরের দিকে গিয়ে এক জায়গায় তার চোখ দুটো থমকে গেল। সেখানে সে তার মনিবের মুখটাকে দেখতে পেল। সে মুখটা আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেছে। চোখ দুটো স্থির।
ব্যস, মনিবের মুখটার দিকে ক্রোধোন্মত্ত জানোয়ারটার চোখ পড়ামাত্র সে চাবুকটার ভয়ঙ্করতার কথা তার মনে পড়তেই মাথায় যেন মুহূর্তের মধ্যে খুন চেপে গেল। পরমুহূর্তেই তার ক্রোধ প্রশমিত হয়ে তার মধ্যে নিদারুণ আতঙ্ক সৃষ্টি করল। নিশ্চিত শাস্তির ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে সে তার কৃত রক্তাক্ত কাণ্ডটাকে লুকিয়ে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অস্থিরভাবে ঘরময় দাপাদাপি জুড়ে দিল।
অস্থিরচিত্ত অতিকায় জানোয়ারটা উন্মাদের মতো ঘরের আসবাবপত্র ভাঙাভাঙি শুরু করে দিল। বিছানাপত্র খাট থেকে মাটিতে ফেলে লন্ডভন্ড করতে লাগল।
এতেও জানোয়ারটা শান্ত হলো না। সে এবার মেয়েটার মৃত দেহটাকে টেনে চুল্লিটার কাছে নিয়ে গেল। সেটাকে চিমনিটার ভেতরে ঢুকিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শরীরের সবটুকু শক্তি নিঙড়ে সেটাকে ঠেলে ধাকে চিমনিটার ভেতরে খুঁজে দিল।
উন্মাদপ্রায় জানোয়ারটা এবার এক লাফে মাদামোয়াজেলের মৃতদেহটার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত ক্রোধে ফুঁসতে লাগল। তারপরই তার বিকৃত মৃতদেহটাকে যন্ত্রচালিতের মতো মাথার ওপরে তুলে এক লাফে খোলা জানালাটার কাছে চলে গেল। পরমুহূর্তেই জানালা দিয়ে সেটাকে সজোরে ছুঁড়ে একেবারে বাইরে ফেলে দিল।
ক্রোধোন্মত হিংস্র জানোয়ারটা যখন মৃতদেহটাকে মাথার ওপরে তুলে জানালার কাছে চলে যায় ঠিক তখনই বজ্র-নিরোধক দণ্ডটা ধরে ঝুলে থাকা ফরাসি নাবিকটা ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে সেটা বেয়ে দ্রুত নিচে নেমে গেল। ব্যস, আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াল না। উৰ্দ্ধশ্বাসে বাড়ির দিকে ছুটতে লাগল। আসলে এ খুন দুটোর পরিণতির কথা ভেবে ভয়ে সে সিঁটিয়ে যাবার যোগাড় হলো। তাই তার পোষা ওরাংওটাংটার কি গতি হবে তা নিয়ে ভাবার মতো মন ও সময় তার আদৌ ছিল না।
এবার পুরনো কথায় ফিরে যাওয়া যাক। বহিরাগতরা চিৎকার চাঁচামেচি শুনে বাড়ির ভেতরে ঢোকার পর ব্যস্তপায়ে সিঁড়ি-বেয়ে ওপরে ওঠার সময় যেসব কথা, তর্কাতর্কির শব্দ শুনেছিল তা আসলে ফরাসি নাবিকটার আতঙ্কিত চিৎকার আর জানোয়ারটার অর্থহীন বকবকানি মিলে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিরই ফল। এ পরিস্থিতিটাকেই সাক্ষীরা এক-একজন নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছিলেন। এর পর আর কিছু-ই বা বলার থাকতে পারে? এর পরের কথা যা-কিছু বলার তা তো আগেই বলা হয়ে গেছে।
তবে জিজ্ঞাস্য থাকতে পারে, ঘটনার নায়ক ওরাংওটাংটার গতি শেষপর্যন্ত কী হল? জানোয়ারটা হয়তো বা দরজা ভেঙে ফেলার আগেই খোলা-জানালাটা দিয়ে বাইরে গলে গিয়ে বজ্রনিরোধক দণ্ডটা ঘর থেকে, ঘটনাস্থল থেকে চম্পট দিয়েছিল। আর জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাবার পর সেই হয়তো আবার জানালাটাকে বন্ধ করে দেয়। আর এটা হলেও হতে পারে।
না, জানোয়ারটা বেশিদূর যেতে পারেনি। তার মনিব, ফরাসি নাবিক তাকে ধরে ফেলে। তারপর বহু অর্থের বিনিময়ে জার্দ দ্য প্লাহেঁসে বিক্রি করে দেয়।
আমরা ফরাসি নাবিককে সঙ্গে করে পুলিশ স্টেশনে গেলাম। সেখান থেকে বড় সাহেবের দপ্তরে হাজির হলাম। তার কাছে ঘটনার আদ্যোপান্ত খোলাখুলি বলা হলো। তিনি সবকিছু শুনে কিছু সময় গুম হয়ে বসে কি যেন ভাবলেন। তারপরই লি বোকে ছেড়ে দিলেন।
আমার বন্ধুবর দুপের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল থাকা সত্ত্বেও পুলিশের বড় সাহেব ভদ্রলোক কিন্তু তাকে ঘটনাটাকে কেন্দ্র করে একটু-আধটু জ্ঞান দেয়ার সুযোগটা হাতছাড়া করলেন তো না-ই বরং নিজের জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে আমার বন্ধুর জ্ঞানের ঘাটতিটুকু পূরণ করতে প্রয়াসী হলেন।
আমার বন্ধুবর দুঁপ তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললেন–মি, একে বলার সুযোগ দিন। কিছু বলুক। এর ফলে এর বিবেক একটু হলেও শান্ত হবে। একে ঘায়েল করতে পারার জন্যই আমি যথেষ্ট আনন্দিত হয়েছি। তবু এর পক্ষে যে রহস্যটা ভেদ করা সম্ভব হয়নি তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ, আসলে আমাদের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু পুলিশের এ বড় সাহেব চালাক সন্দেহ নেই। কিন্তু ইনি যতটা চালাক ততখানি বুদ্ধি কিন্তু রাখেন না। তবে সব মিলিয়ে মানুষ হিসেবে বড়ই ভালো, স্বীকার না করে উপায় নেই। আমি কিন্তু একে মনে প্রাণে ভালোবাসি, এর বাছা বাছা কথাবার্তার জন্য যা সম্বল করে ইতি-খ্যাতি অর্জন করেছেন। কথাটা বলা শেষ করেই তিনি রুশোর একটা বাণী গড় গড় করে বলে গেলেন।
আমি সবিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
গোয়েন্দা সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল বিখ্যাত এই গল্পের মধ্য দিতে। এডগার অ্যালান পো’র এই গল্পটি, বর্ণনাকারী ও সহযোগী এবং রহস্যভেদীর এই সূত্র অনুসরণ করেই বিখ্যাত হয়েছেন বহু লেখক – স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, সত্যজিৎ রায় তাদেরই দুজন।
ভালো লাগলো। গোয়েমদা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রথম রহস্যভেদের গল্পে অপরাধী যে কোন মানুষ ছিল না – এটা খুব আনন্দদায়ক!