দ্য প্রিম্যাচিওর বেরিয়াল
এমন কিছু কিছু বিষয় আছে যা দেখে বা শুনে মানুষ ভয়ে আবিষ্ট না হয়ে পারে না। কিন্তু সেগুলো এমনই ভয়ঙ্করতায় ভরপুর যে সেগুলোকে নিয়ে গল্প-উপন্যাস রচনা করাও সম্ভব নয়।
ইতিহাসের পাতা ঘাটাঘাটি করলে বহু রোমহর্ষক ঘটনা চোখে পড়বে, যেমন– লন্ডনে মহামারীরূপে প্লেগের প্রাদুর্ভাব, লিসবনের ভয়াবহ ভূকম্পন আর কলকাতার নারকীয় হত্যাকাণ্ড অন্ধকূপ হত্যা যেখানে একশ তেইশজনকে দম আটকে মারা হয়েছিল। তবে খুবই সত্য যে, এসব ঘটনা, ব্যাপার স্যাপার বিতৃষ্ণার সঙ্গে দূরে সরিয়ে রাখাই শ্রেয় এবং বাঞ্ছনীয়।
সে যা-ই হোক, জীবন্ত সমাহিত হওয়ার মতো র্দৈব-মর্মান্তিক ঘটনা মানুষের বরাতে যেন না জোটে; অথচ তা কিন্তু প্রায়শই ঘটে চলেছে। চিন্তাশীল ব্যক্তিরা সে সব খবরাখবর রাখেন বলে তাচ্ছিল্যভরে দূরে সরিয়ে রাখতেও পারেন না।
যে প্রাচীরটা জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে অবস্থান করছে তা আজও পরিষ্কার নয়–ঝাপসা ধারণার মাধ্যমেই গড়ে তোলা হয়েছে। ঠিক কোনখানে যে একটার শেষ আর কোনখানে যে অন্যটা আরম্ভ হয়েছে, কেউ সঠিকভাবে তা জানেন না, আমাদের ধারণাই বা দেবেন কিভাবে?
দেহ থাকলে রোগ ব্যাধি হবেই। কিন্তু এমন বহু রোগের কথা আমাদের জানা আছে যা দেহের যন্ত্রপাতিগুলোকে এমন অকেজো করে দেয় যে আপাতদৃষ্টিতে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় পুরো যন্ত্রটাই নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে যন্ত্রপাতির এরকম। নিষ্ক্রিয়তা সাময়িক ব্যাপার ছাড়া কিছুই নয়। কিছু সময়ের জন্য দুর্বোধ্য যন্ত্রপাতি নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। তারপর হঠাই কি এক রহস্যজনক নিয়মে আবার ঘড়ির কাটার মতো টিক্ টিক্ করে চলতে থাকে। আবার চাকায় চাকায় লেগে যায়। যাদু যন্ত্র চলতে আরম্ভ করে।
রূপার সুতো দিয়ে বাঁধা আত্মা দেহখাঁচা থেকে বেরিয়ে যায় না ঠিকই। কিন্তু যখন যন্ত্রপাতি স্তব্ধ হয়ে তাকে তখন আত্ম কোথায়? কি অবস্থায় থাকে, সেটাই তো জিজ্ঞাসা? কিন্তু এত প্রশ্নের সঠিক উত্তর আজ-অবধি পাওয়া যায়নি।
এখন এরকমই একটা ঘটনা এখানে তুলে ধরছি। বাল্টিমোরে এক বিখ্যাত আইনজীবী ছিলেন। তার সহধর্মিনী হঠাৎ-ই অত্যাশ্চর্য এক রোগের কবলে পড়ে পৃথিবী ছেড়ে গেলেন। বাইরে থেকে লক্ষণ দেখে তাকে মৃত বলেই মনে হয়েছিল।
সে মৃত চোখের মণি দুটো নিশ্চল-নিথর আর নিষ্প্রভ, ঠোঁটদুটো স্বেতপাথরের মতো সাদা, গায়ে হাত দিলে উত্তাপের লেশমাত্রও মেলেনি আর নাড়ির গতিও স্তব্ধ হয়ে গেছে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসকরা তাদের জ্ঞান বুদ্ধির ওপর নির্ভর করে তো রায় দেবেনই, রোগী আর জীবিত নেই।
চিকিৎসকরা রায় দেবার পরও মৃতদেহটাকে তিন-তিনদিন রেখে দেওয়া হয়েছিল। তার শরীর শক্ত হয়ে পাথর বনে গিয়েছিল। তারপর পচন শুরু হবার লক্ষণ দেখা দিতেই তাকে কবরস্থ করার ব্যবস্থা করা হয়। কারণ, মিথ্যা আর মৃতদেহটাকে পচিয়ে লাভই বা কী?
এ পরিবারেরনিজস্ব কবর ছিল ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে। কফিনে মৃতদেহটাকে রেখে সেটাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর কফিনটাকে সেখানকার একটা তাকের ওপর রেখে সবাই বাইরে বেরিয়ে আসে। লোহার দরজাটা বন্ধ করে বাড়ি ফিরে আসে।
তারপর তিন বছর পেরিয়ে যায়। ইতিমধ্যে আর কোনো মৃতদেহ সে কবরখানায় নেওয়া হয়নি।
তিন বছর পর ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে আর একটা মৃতদেহ কফিন ঢোকাবার জন্য লোহার দরজাটা খোলার জন্য সজোরে টান দেওয়া মাত্রই কড়কড় শব্দ করে সাদা চাদর জড়ানো পুরো একটা নরকঙ্কাল এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। পত্নীহারা সে আইনজীবির বাহু দুটোর ওপর। কার কঙ্কাল, তাই না? সে আইনজীবির মৃত স্ত্রীর।
মৃতা স্ত্রীর মৃতদেহটাকে তো কফিনে ভরে কবরখানার তাকটার ওপর রেখে আসা হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এসে লোহার দরজার ওপরে ঝুললেন কি করে? ব্যাপারটা তো তাজ্জব বনে যাওয়ার মতোই বটে। উত্তরটা। শোনার পর সবারই মাথার চুল সজারুর কাঁটার মতো একদম খাড়া হয়ে যায়।
ব্যাপারটা এরকম–কবরস্থ করার দিন দুই পরই মরা বলে চিহ্নিত, মড়ার মতো। দেখতে দেহটার ভেতরে প্রাণচাঞ্চল্য জেগে ওঠে। জীবন্ত মানুষ। প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরে পেয়ে সেনির্ঘাৎ হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু করে দেয়। ফলে কফিনসমেত দেহটা নিচে পড়ে যায়। আছাড় খেয়ে কফিনটা যায় ভেঙে।
আইনজীবির স্ত্রীর দেহটাকে কফিন-বন্ধ অবস্থায় রেখে যাওয়ার সময় কফিন বাহকরা ভুল করে একটা জ্বলন্ত প্রদীপ রেখে যায় কবরস্থানে ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে।
প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যাওয়ার পর, সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে সে আইনজীবির স্ত্রী জ্বলন্ত প্রদীপটাকে হাতে করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসেছিল। তারপর ভাঙা কফিনটার
কাঠ দিয়ে লোহার দরজার পাল্লায় বার বার আঘাত হেনে লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কারো সাড়াই পাননি। কিন্তু কাজ যা হলো তা হচ্ছে– সিঁড়ির ওপর কফিন ভাঙা কাঠ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। এদিকে দীর্ঘ চেষ্টার পরও কারও সাড়া না পেয়ে মহিলাটি অন্তহীন আতঙ্কের শিকার হয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে সিঁড়ির ওপরই লুটিয়ে পড়েছিলেন। অথবা শেষমেষ মরাই যান। আর সাদা কাপড়? সেটা লোহার দরজার পাল্লার গায়ে খোঁচা লেগে আটকে যাওয়ার জন্য কাপড়ে জড়ানো দেহটা তিন তিনটা বছর ধরে ঝুলে থাকার ফলে সাদা কঙ্কালে পরিণত হয়ে গিয়েছে।
অত্যাশ্চর্য ঘটনাকে ইংরেজিতে আখ্যা দেওয়া হয় সত্য কপাল কল্পিত গল্পের চেয়ে ভয়ঙ্কর।’ ঠিক এরকমই এক সত্য ঘটনাকে লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ না করে পারছি না।
১৮১০ খ্রিস্টাব্দের কথা।
সে বছর ফরাসির এক অপরূপ দেহ গ্রাম্য কবরখানায় কবরস্থ করা হয়েছিল। অপরূপা সে কিশোরী বিয়ের আগে এক গরিব সাহিত্যিক সাংবাদিককে ভালোবাসত। সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে তো আর লেখকের গলায় বরমাল্য দিয়ে বংশের মুখে কালি দিতে পারে না। তাই সে সমাজের মাথা এক টাকার কুমিরকে বিয়ে করে পতিত্বে বরণ করে নিয়েছিল।
বিয়ের পর সে অপরূপার বরাতে স্বামীর কাছ থেকে আদর সোহাগ তো দূরের ব্যাপার, অসম্মান আর বল্গাহীন নির্যাতন ছাড়া কিছুই জোটেনি। আর বুকে অনেক জ্বালা যন্ত্রণা নিয়ে সে ইহলোক ত্যাগ করে, শহর থেকে দূরে, বহু দূরে তার মৃতদেহ কবরস্থ করা হয়। ব্যস, তার সবকিছু মিটে গেল।
ভালোবাসার কাঙাল সে সাহিত্যিক সাংবাদিক যুবকটা এক গভীর রাতে হাঁটতে হাঁটতে কবরস্থানে হাজির হয়েছিল। তার ইচ্ছা ছিল, কবর খুঁড়ে তার প্রেমিকার মাথার চুল কেটে নিয়ে নিজের কাছে রেখে দেবে। আমৃত্যু সেগুলোকে দেখে দেখেই তাঁকে না পাওয়ার বেদনা ভুলে থাকবে।
কিন্তু সে কবর খুঁড়ে প্রেমিকার মাথার চুল কাটার জন্য কাঁচি চালাতে গিয়েই আচমকা থমকে যায়। সে দেখল, অপরূপার চোখ দুটো খোলা, সে চোখ মেলে তারই দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
সে অসম সাহসি লেখক সাংবাদিক কিন্তু আকস্মিক আতঙ্কে অস্বাভাবিক ঘাবড়ে গেলেও দৌড়ে পালায়নি। সে তার প্রেমিকাকে এক সরাইখানায় নিয়ে আসে। নিজের ঘরে রেখে দেয়। এবার সালসাটালসা খাইয়ে তাকে রীতিমত চাঙা করে তোলে।
সে কিশোরীটি সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে এলে প্রেমিক-প্রেমিকা আমেরিকায় পালিয়ে যায়।
কিশোরীটি হিসেবী বলে অখ্যাতি থাকলেও হৃদয়হীন কিন্তু অবশ্যই নয়। যে স্বামী তাকে জীবন্ত অবস্থায় কবরস্থ করেছিল তার সঙ্গে আর সংসার করতে সে উৎসাহি হয়নি, রাজিও হয়নি। লেখক-সাংবাদিক যুবকের সঙ্গে বিশ বছর সংসার করেছে।
তারপর তার ধারণা হয়েছিল, এবার ফ্রান্সে ফিরতে আর কোনো সমস্যা নেই। দীর্ঘ বিশ বছরে চেহারার অনেক রদবদল হয়ে গেছে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের স্বামী এখন তাকে সামনে দেখলেও চিনতে পারবে না। অতএব ফ্রান্সে ফেরার কোনো সমস্যাই নেই।
কিন্তু টাকার কুমির আইনজীবি বিশ বছর পরও প্রথম একঝলক দেখেই তার মৃতা-স্ত্রীকে চিনে ফেলেছিল। স্ত্রী বলে দাবি করতেও ছাড়েনি। আদালতে মামলা দাখিল করল। কিন্তু আদালত তার দাবি স্বীকার করে নেয়নি। কারণ, দীর্ঘ বিশ বছরে তার স্বামীত্বের অধিকার আইনগতভাবেই চলে গেছে। অতএব স্ত্রীকে ফিরে পাবার প্রশ্নই ওঠে না, পাওয়াও যায়নি।
আরও একটা গায়ের রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা মাথার ভেতরে এসে জড়ো হয়ে গেছে। অতএব লেখনির মাধ্যমে তা তুলে না ধরে পারছি না।
ভদ্রলোক গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসারের পদে বহাল ছিলেন। লম্বা-চওড়া-পেটা চেহারা। বাগ-না-মানা এক তেজি ঘোড়ার পিঠ থেকে আচমকা মাটিতে আছড়ে পড়ে গিয়েছিলেন। মাথায় ভীষণ আঘাত পান। ছিটকে পড়ামাত্র পথের মাঝেই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন।
আছাড় খেয়ে পড়ায় তার মাথার খুলিটা সামান্য ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ ঘটেছিল। কিন্তু সে মুহূর্তে জীবনের কোনো আশঙ্কা দেখা দেয়নি।
চিকিৎসকরা মাথার খুলি ছিদ্র করে রক্তক্ষরণ করেছিলেন। এ ছাড়াও চিকিৎসার মাধ্যমে আরও বহুরকম স্বস্তির ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু তবুও দেখা গেল, অফিসার ভদ্রলোক ক্রমেই ঝিমিয়ে পড়তে লাগলেন। শেষমেশ যখন একেবারেই এলিয়ে পড়লেন, তখন নিঃসন্দেহ হওয়া গেল তিনি মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিয়েছেন। শেষ! সব শেষ!
তখন খুব গরম পড়েছিল। তাই দেরি না করে তাড়াতাড়ি অফিসারটির দেহটাকে সাধারণ কবরখানায় কবরস্থ করা হল।
বৃহস্পতিবার তার পারলৌকিক কাজকর্ম চুকিয়ে ফেলা হল। তাই সঙ্গত কারণেই পরের রবিবার কবরখানায় ভিড় জমে গিয়েছিল।
সবাই যখন তার কবরস্থলে দাঁড়িয়ে তখন ভিড়ের ভেতর থেকে এক চাষী গলা ছেড়ে কেঁদে ওঠে। আকুলি বিকুলি করে কাঁদতে আরম্ভ করে। তাকে কান্না না বলে আর্তনাদ বলাই হয়তো শ্রেয়।
হতভাগ্য সে চাষীটা সদ্য কবর দেওয়া অফিসারের ঠিক কবরটার ওপরে। সে পরিষ্কার শুনতে পেয়েছে, কবরের মাটির তলায় কে যেন জোর ধস্তাধস্তি করছে।
চাষীটার কথায় গোড়ার দিকে কেউ কান দেয়নি। কিন্তু চাষীটা তবুও চেঁচিয়ে বার বার একই কথা বলায় তখন আর সবাই তার কথার গুরুত্ব না নিয়ে পারল না। তার স্বাভাবিক আতঙ্কও সবার মন ঘুরে যেতে বাধ্য হয়। তাড়াতাড়ি কোদাল, গাঁইতি আর শাবল আনার জন্য হুকুম দেওয়া হল।
তাড়াতাড়ি কবর দেওয়ার কাজ সেরে ফেলা হয়েছিল বলে তখন মাটি বেশি গর্ত করা হয়নি। তাই কিছুটা খোঁড়াখুড়ি করতেই কফিনের ডালাটা নজরে পড়ে গেল।
হায়! এ কী রকম হল! কফিনের ডালাটা যে আধ খোলা! একটা দিক, কজার বিপরীত দিকটা সামান্য উঁচু হয়ে রয়েছে। আর যে অফিসারকে কবরস্থ করা হয়েছিল তিনি বসে। না, বসা বলাটা ঠিক হবে না, বরং আধবসা বলাই উচিত। তিনিনির্ঘাৎ মাথা দিয়ে ঠেলেঠুলে কোনোরকমে সে দিকটা সামান্য উঁচু করে বসেছেন তবে মাটির পরিমাণ কম আর আলগা থাকার জন্যই তার পক্ষে এমনটা করা সম্ভব হয়েছে। তবে তার হুঁশ নেই। আর খুব বেশিক্ষণ আগে সংজ্ঞা লোপ পেয়েছে বলেও মনে হলো না।
সংজ্ঞা পেলইবা লোপ। মুহূর্তমাত্র দেরি না করেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন অফিসার ভদ্রলোক জীবিত। অবশ্যই মারা যাননি। দম বন্ধ হয়ে রয়েছে মাত্র। ঘণ্টখানেক সেবা-যত্নের ফলে তিনি ধীরে ধীরে শ্বাসক্রিয়া চালাতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখেই শ্বাসক্রিয়া চালাবার পর তিনি চোখ মেলে তাকালেন। চোখের মণি দুটোকে বার কয়েক উপস্থিত সবার মুখের ওপর বুলিয়ে নিয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মুখে বিষাদের হাসির রেখা ফুটে উঠল। ভাঙা ভাঙা গলায় প্রায় অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলেন ‘যন্ত্রণা!’
উপস্থিত সবাই তার মুখের ওপর সামান্য ঝুঁকলেন।
কেউ কিছু বলার আগেই অফিসার ভদ্রলোক আগের মতোই যন্ত্রণাকাতর গলায় প্রায় অস্ফুট স্বরে আবার উচ্চারণ করলেন যন্ত্রণা! খুব যন্ত্রণা! কবরবাসের যন্ত্রণা!
জানা গেল, কবরস্থ করার সময় তার নাকি ভালোই জ্ঞান ছিল। সবই শুনতে পাচ্ছিলেন, বুঝতেও পারছিলেন সবই। ব্যস, তারপরই ক্রমে সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে আসতে থাকে। তারপর যে কি হলো কিছুই তার মনে নেই। জমাটবাধা আতঙ্কই তার মন থেকে সবকিছু নিঃশেষে মুছে দিয়েছে।
কফিনের ওপর কাকড়ের মতো গুঁড়ো মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল। ফলে কবরের ভেতরে অনেক বাতাসই ছিল। এটাই রক্ষা। কবরের ওপরে বহু লোকের হাঁটাহাঁটি দাপাদাপি চলছে। ব্যাপারটা যখন তিনি বুঝতে পেরেছেন তখনই হুটোপাটা করে উঠে বসতে গেলেন। তখন কফিনে মাথাটা ঠেকে যায়। ব্যস, মুহূর্তমাত্র দেরি না করে শরীরের সবটুকু শক্তি নিঙড়ে সেটাকে ওপরের দিকে চাপ দিয়ে ডালাটাকে ওপরের দিকে তুলে ফেলেন।
রোগী অফিসারটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিকতা ফিরে পেলেও শেষের দিকে কিছু আনাড়ি চিকিৎসকের খপ্পরে পড়ে যান। তার ওপর হরেক রকম চিকিৎসার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হতে থাকে। এমনকি গ্যালভানিক ব্যাটারির প্রয়োগও করা হয়।
এ অবস্থায় চিকিৎসা চলাকালীন খিচুনি হতে থাকে। আর খিচুনিটা মাঝে মধ্যেই দেখা দিতে লাগল। একবার এরকম অস্বাভাবিক খিচুনিতে তিনি প্রাণ হারান। দেখা গেল খিচুনির ব্যাপারটাই শেষপর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়ায়।
প্রসঙ্গক্রমে গ্যালভানিক ব্যাটারির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে হঠাৎ লন্ডনের এক অ্যাটর্নির কথা মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে। তাকে দু-দুটো দিন কবরখানায় কফিনের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছিল দেখা গেল, গ্যালভানিক ব্যাটারি তার শরীরে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে এ ঘটনাটি ঘটেছিল। শহরের বিভিন্ন মহলে ব্যাপারটা নিয়ে রীতিমত তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছিল।
এডোয়ার্ড স্টেপলটন সে ভদ্রলোকের নাম ছিল। টাইফাস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু কয়েকটা নাম না জানা বিশেষ লক্ষণ তার মধ্যে লক্ষ্য করে চিকিৎসক সমাজ বিশেষ কৌতূহলাপন্ন হয়ে পড়েছিলেন।
চিকিৎসকরা মৃত স্টেপলটনের বন্ধুদের কাছে তার দেহটা পোস্টমর্টেম করার অনুমতি চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা সে অনুমতি দেয়নি।
অনুমতি না পাওয়ায় চিকিৎসকরা কিন্তু হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন না। অনুরোধে যখন কাজ হলই না তখন বাঁকা পথ নিতেই হবে। পথটা কি, তাই না। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায় এরকম গোপনে কবর খুঁড়ে
মরাটাকে তুলে আনবেন। যে করেই হোক, উদ্দেশ্য সিদ্ধ তাদের করতেই হবে।
লন্ডন এক বিচিত্র শহর। সেখানে যখন হরেক রকম জাঁকজমকের ব্যবস্থা রয়েছে। ঠিক তেমনি করবচোরদেরও অভাব নেই। প্রচুর নগদ অর্থের বিনিময়ে তারাই কাজটা সেরে ফেলল। মৃতদেহটাকে রাতের অন্ধকারে কবর খুঁড়ে তুলে নিয়ে এলো। তারপর সেটাকে খুবই গোপনে নিয়ে একটা বেসরকারি হাসপাতালের অপারেশন রুমের টেবিলের ওপর শুইয়ে দিল।
কবরে আশ্রয় পাবার তৃতীয় রাতে কফিনের লোকটা আবার টেবিলে এসে হাজির হল।
চিকিৎসকরা এবার গ্যালভানিক ব্যাটারির চার্জ দেওয়ার জন্য তার তলপেটের চামড়া চিড়ে দুভাগ করে ফেললেন।
চিকিৎসকরা এবার নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে স্থির করলেন, রোগীর শরীরে যখন পচনের কোনো চিহ্ন লক্ষিত হচ্ছে না তখন চার্জ দেওয়া অবশ্যই চাই-ই চাই।
দেখা গেছে, গ্যালভানিক চার্জে মড়া মানুষও হুড়মুড় করে উঠে পড়ে। কিন্তু এক্ষেত্রে হুড়মুড় করে ওঠার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্য রকমই মনে হল। জীবন্ত মানুষ যেমন ধড়ফড় করে ঠিক সেরকমই তাকে করতে দেখা গেল।
রাত বাড়তে বাড়তে গম্ভীর হয়ে এলো। চিকিৎসকদের পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজ চলতেই লাগল। ক্রমে পূব-আকাশ ফর্সা হয়ে এলো। চিকিৎসকদের ধৈর্য ফুরিয়ে আসার যোগাড় হল।
এক যুবক চিকিৎসক তখন নিজস্ব একটা পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়েছিল। সে রোগীর বুকের কাছের কিছুটা মাংস চিড়ে তার মধ্যে গ্যালভানিক ব্যাটারির চার্জ দিতে না দিতেই স্টেপলটন আগে ছটফট না করে হঠাৎ উঠে সোজাভাবে বসে পড়েছিলেন।
তিনি একেবারে হঠাৎ-ই টেবিল থেকে নেমে যুবক চিকিৎসকের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তারপর স্পষ্ট অথচ ভাঙা ভাঙা জড়িত স্বরে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। দুম করে পড়ে গেলেন। মেঝেতে শরীর এলিয়ে পড়ল।
আকস্মিক এ ব্যাপারটায় সবাই তো রীতিমত তাজ্জব বনে গেলেন। ব্যস, সবাই সে মুহূর্তেই ছুটাছুটি দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলেন। সবাই ব্যস্ত কিন্তু পর মুহূর্তেই নিজেদের সামলে নিয়ে আবার জায়গামতো ফিরে এলেন। স্টেপলটনকে কয়জন মিলে। জাপ্টে ধরে আবার টেবিলে শুইয়ে দিলেন। দেখা গেল তিনি বেঁচে থাকলেও সংজ্ঞা নেই। মেঝেতে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার সংজ্ঞা লোপ পেয়েছিল।
সংজ্ঞাহীন স্টেপলটনের নাকে ইথারের শিশি ধরা হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি জ্ঞান ফিরে পেলেন। এবার তাকে আত্মজনের হাতে তুলে দেওয়া হল। সবাই খুশি। তবে কিভাবে তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন এ-কথা আর তাকে বা তার আত্মীয়জনদের বলা হয়নি।
ঘটনাটার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও রোমাঞ্চকর ব্যাপার হচ্ছে–‘স্টেপলটন কি প্রথম থেকে শেষ অবধি জানতেন, তাকে নিয়ে, মানে তার শরীরে কি কি করা হয়েছে–তার সে সংজ্ঞা সম্পূর্ণ লোপ পায়নি এ-কথা আর বলার অপেক্ষা করে না। তবে পুরো ব্যাপারটা তার মাথায় কেমন যেন জট পাকিয়ে গিয়ে তাকে রীতিমত বে-সামাল করে দিয়েছিল।
আর এও সত্য যে, অস্পষ্টভাবে হলেও তিনি বুঝতে পারছিলেন, চিকিৎসকরা তাকে মৃত সাব্যস্ত করে গেছেন। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই তাকে সমাধিস্থলে নিয়ে গিয়ে যথাযথভাবে ও সমারোহের সঙ্গে সমাহিত করা হয়। দুই দিন আর দুই রাত তিনি কবরখানার কাঁকড়মুক্ত গুঁড়ো মাটির তলায় কদিন বন্দি হয়ে অসহায়ভাবে পড়ে রইলেন।
তারপর কবর থেকে উদ্ধার করে তাকে শুইয়ে দেওয়া হলো পোস্টমর্টাম-ঘরের টেবিলের ওপর। উপরোক্ত প্রক্রিয়ায় তার বুকে তড়িৎ প্রবাহিত করে দেওয়ায় অচিরেই মোহগ্রস্ত অবস্থাটা কেটে যায়। সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে টেবিল থেকে নেমে এলেন। প্রায় স্বাভাবিক কণ্ঠেই উচ্চারণ করলেন ‘বেঁচে আছি! আমি তো দিব্যি বেঁচে আছি! এই তো আমি।’ কথাটা শেষ করার আগেই তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললেন।
উপরোক্ত ঘটনাগুলো থেকে অবশ্যই বিশ্বাস করা যায় আর সিদ্ধান্তও নেওয়া চলে যে, বহু ক্ষেত্রেই মানুষকে মৃত্যু না হতেই সমাহিত করা হয়েছে। মাটি খুঁড়ে, কবরে এমন ঘটনাও বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে। দেহটা কঙ্কালসহ যেভাবে থাকার কথা ছিল, অবিকল সেভাবে নেই। তবে কি ঘটনাটা খুবই সন্দেহযোগ্য নয়? তা-ই যদি স্বীকার করে নেওয়া হয় তবে বলা যেতে পাওে, জীবন্ত মানুষ মাটির তলায়, কবরে অবস্থানকালে কোনো মানুষ যখন উপলব্ধি করতে পারে, ছোট খুপড়িটা থেকে তার আর কোনোদিনই, অর্থাৎ ইহজীবনে আর মুক্তি পাবার সামান্যতম আশাও নেই। আর অনন্যোপায় হয়েই বেশ কিছু সময় ধরে তাকে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ শুঁকতে হবে। তারপর? তারপর? পোকা তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে, আক্রমণ করবে। তার প্রাণবন্ত দেহটাকে দিয়ে মৌজ করে ভোজ সারবে। সে হতভাগ্য মানুষটার মন তখন কী ভয়ঙ্কর হাহাকারের শিকার হয়ে পড়ে, ভাবা যায়! উফ! এর চেয়ে মর্মান্তিক, এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে? অথচ, এমন একটা দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার সে জীবন্ত মানুষটাকে মুখ বুজে, দাঁতে দাঁত চেপে হজম করতেই হয়।
এমন এরকমই একটা দুর্বিষহ ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছিল। কোথায়, কিভাবে সেটা ঘটেছিল? বলছি–
অত্যাশ্চর্য একটা ব্যাধি বছর কয়েক আগে আমার শরীরে ভর করে দাপাদাপি করেছে। আর সে ব্যাধিটা কেবলমাত্র আমাকে যে দুর্বিষহ যন্ত্রণার মধ্যে রেখেছে তা-ই নয়, চিকিৎসকদেরও ধোয়ার আস্তরণের মধ্যে রেখে কম বিভ্রান্তিতে ফেলেনি। সংক্ষেপে বলতে গেলে তাদের একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে।
আমার ওপর দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে ব্যাধিটার কোনো হদিস করতে না পেরে কোনো উপায় না থকাতে তার মৃগীরোগ নাম দিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করেছিলেন। মৃগী রোগের কারণ এর নির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ধারণ করতে না পারলেও ব্যাধিটার লক্ষণ আর চরিত্রটা কেউই অবিদিত নয়। ব্যাধির কম-বেশি লক্ষণ ধারা সম্ভব হয় মাত্রা ভেদের জন্যই।
ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তি কখনও কিছু সময় আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অল্প অল্প সময় করে প্রায় সারাটা দিন আলসে মানুষের মতো বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকে, তবে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় সত্য। বাহ্যিক জ্ঞান থাকে না। কিন্তু হৃদযন্ত্রের ক্ষীণ নড়াচড়ার মাধ্যমে বোঝা যায়, গায়ে উচ্চতাও সামান্য হলে উপলব্ধি করা যায় আর গাল দুটোর কেন্দ্রস্থলে হালকা লাল আভাও চোখে পড়ে। আর? ঠোঁটের সামনে একটা আয়না রেখে অনুসন্ধিৎসু নজরে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় নির্দিষ্ট ছন্দ মাফিক না হলেও ফুসফুস দুটো মৃদুভাবে তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায়। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে, কখনও বা মাসের পর মাস ধরে সংজ্ঞাহীনতার ঘোর। অব্যাহত থাকে। তার তখনকার পরিস্থিতি দেখে দক্ষ চিকিৎসকও অবধারিত মৃত্যু আর জীবন্ত অবস্থার মাঝে বস্তুগত পার্থক্যটুকু বুঝতে পারেন না। তারা উপায়ান্তর না দেখেনিদারুণ হতাশার শিকার হয়ে পড়েন।
রোগীর শরীরে পচন শুরু না হওয়ার দরুণ, আর ইতিপূর্বেও এরকম মৃত্যুর মতো দশা লক্ষিত হয়েছে বলে তার আত্মজন ও হিতাকাঙ্খী বন্ধু-বান্ধবরা তার জীবন্ত সমাধি কোনোরকমে বিলম্বিত করতে থাকে, ঠেকিয়ে রাখে।
তবুও ভাগ্য ভালো যে, এ ব্যাধির লক্ষণ ও প্রকোপ খুবই ধীরে ধীরে এবং ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে। আক্রমণ করার পর পরই এ ব্যাধি আক্রান্ত ব্যক্তিকে সম্পূর্ণরূপে মৃতের মতো করে তোলে না। অল্প-অল্প করে, ধাপে ধাপে প্রকোপ বাড়তে থাকে। কিন্তু সে অদৃষ্টবিড়ম্বিত ব্যক্তির গোড়াতেই, ব্যাধিগ্রস্ত হওয়ামাত্র প্রকোপ চূড়ান্তভাবে বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে তা ঘটেও থাকে। তখন রোগাক্রান্ত হতভাগা একেবারে হঠাই মড়ার মতো হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে তো তাকে জীবন্ত সমাধিস্থ করতেই হয়। এ ছাড়া উপায়ও তো কিছু থাকে না।
চিকিৎসা বিজ্ঞান গ্রন্থে রোগটার বর্ণনা যে রকম দেখা যায় ঠিক সেরকমই ছিল আমার ব্যাধি আর লক্ষণগুলো।
আমি মাঝে মধ্যেই প্রাণচঞ্চল আত্মজন–প্রাণ চঞ্চল বন্ধু-বান্ধব মাঝখানে অর্ধ সংজ্ঞাহীনভাবে এলিয়ে পড়ে থাকতাম। সবার মুখেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছাপ আর আমার মধ্যে ব্যাধির প্রকোপ। তারপরই হঠাৎ আমি সংজ্ঞা ফিরে পেতাম, যাকে সম্পূর্ণ সংজ্ঞা ফিরে পাওয়া বলে।
আবারও আমি ব্যাধির শিকার হয়ে পড়তাম। অল্প অল্প করে ব্যাধির লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকত। তারপর আবার হঠাই রেহাইও দিয়ে দিত। আবার হয়তো হঠাৎ ব্যাধিটা আমাকে জড়িয়ে ধরত, আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলত। আমি ঠাণ্ডায় ঠক্ঠক্ করে কাঁপতে আরম্ভ করতাম, শরীর এলিয়ে পড়ত, অনবরত পুঁকতাম, মাথা ঝিমঝিম করত। থেকে থেকে চক্কর মারত। সে মুহূর্তে টান টান হয়ে শুয়ে পড়া ছাড়া উপায়ই থাকত না। দু-এক মুহূর্ত বা দু-এক ঘণ্টা নয়, একের পর এক সপ্তাহ আমার যাবতীয় সত্তা যেন অন্তহীন স্তব্ধতায়, নিঃসীম অন্ধকারের অতল গহ্বরে তালিয়ে যেত। একইভাবে পড়ে থাকত হত ব্যাধির কবলে নিজেকে অসহায়ভাবে সঁপে দিয়ে।
সেনিদারুণ ব্যাধিগ্রস্ত অবস্থায় আমার কাছে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোনো ধারণাই থাকত না। আমি খুবই ধীরে ধীরে সংজ্ঞা ফিরে পেতাম। নচ্ছাড় ব্যাধিটা যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় আমার দেহটা ছেড়ে খুবই ধীর-পায়ে বিদায়নিত। আর হতভাগা আমার আত্মাটা যেন অন্ধকার জগৎ থেকে ক্রমে আলোয় ফিরে আসত।
আমার মধ্যে সমাধিস্থ হয়ে যাওয়ার একটু-আধটু প্রবণতা যা ছিল তা ছাড়া আমার শরীর স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালোই ছিল। তবে ঘুম থেকে জাগার পর সবকিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে যেত, চট করে কিছু স্মৃতিতে আনতে পারতাম না। মিনিট কয়েক কোনো কর্তব্যই স্থির করতে পারতাম না। আর অনুভূতি শক্তিকে নতুন করে আয়ত্বে আনতে অনেকক্ষণ লেগে যেত। মোদ্দা কথা, আমার বেহাল অবস্থা স্বাভাবিকতা ফিরে পেতে অনেকটা সময় লেগে যেত।
তবে একটা কথা খুবই সত্য যে, তখন আমি শরীরে কোনোরকম যন্ত্রণা উপলব্ধি করতাম না। তবে মনটা অস্বাভাবিকভাবে বিষিয়ে থাকত, পীড়িত হত। কবরের চিন্তা সর্বক্ষণ আমাকে বিভোর করে রাখত। আমার ভাবনা কবর, কফিন, পোকা আর সমাধি স্তম্ভ ও ফলকের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ত।
অস্বীকার করব না। বীভৎস এ মৃত্যুর ভীতি আর বিপদের আশঙ্কা আমাকে দিন রাত সারাক্ষণ অস্থির করে রাখত। ঘুমানোর আগে মাথার মধ্যে একটা চিন্তা দানা বাঁধত, ঘুম থেকে জেগে উঠে অবশ্যই দেখতে পাব আমি কফিনের ভেতরে, কবরে শুয়ে রয়েছি। কোনোক্রমে যদিও ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি, দুঃস্বপ্ন আমাকে সারারাত বদ্ধপাগল না হলেও আধপাগল করে রাখত। উফ্! সে যে কী অবর্ণনীয় অস্থিরতা তা কেবলমাত্র নিজস্ব উপলব্ধির ব্যাপার, অন্য কাউকে বুঝিয়ে বলে তার মধ্যে সম্যক ধারণা জন্মানো সম্ভব নয়।
আমার দেখা অগণিত দুঃস্বপ্নের মধ্য থেকে আমি একটাই এখানে উল্লেখ করছি। কবরস্থ হওয়ার পর একটা বরফ শীতল হাতের ছোঁয়ায় হঠাৎ-ই আমার ঘোর কেটে যায়। কপালে হাত ঠেকিয়ে অস্থির অথচ ক্ষীণ ও জড়িত কণ্ঠে বলে ওঠে–‘ওঠ জাগ, উঠে পড়।
যন্ত্রচালিতের মতো ঝট করে খাড়াভাবে বসে পড়লাম। এমন ঘুটঘুঁটে অন্ধকার যাকে একমাত্র নিশ্চিদ্র বলে বর্ণনা করা চলে। যার হাতের স্পর্শে আমার ঘুম টুটে গেছে, যার হুকুম তামিল করতে গিয়ে আমি উঠে বসে পড়েছি তাকে কিছুতেই দেখতে পেলাম না, এমনকি তার ছায়াও না।
আমি যে কখন শুয়েছিলাম, কখন ঘুমের কোলে আশ্রয় নিয়েছিলাম, ঘোরের মধ্যে কতক্ষণ কাটিয়েছিলাম–এসবে বিন্দুবিসর্গও আমি স্মৃতিতে আনতে পারছি না। এমনকি আমি কোথায় যে রয়েছি তা-ও খেয়াল মাত্র নেই।
নির্বাক নিস্পন্দভাবে হৃতস্মৃতিকে জাগ্রত করার জন্য আমি মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। আবার বরফ-শীতল হাতটা আমাকে স্পর্শ করল। না, কেবল স্পর্শ করল বললে ঠিক বলা হবে না। কারণ, সে হাতটা এবার আমার কবজিটাকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরেছে। আর সে ধরা স্বাভাবিক ধরা অবশ্যই নয়, নির্মমভাবে চেপে ধরা যাকে বলে।
কবজিটা ধরেই সে বার-কয়েক দারুণ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল–‘কি হে চুপ করে বসে আছ যে বড়! ওঠ উঠে এসো!’
আমি আর নিজেকে সামলে সুমলে রাখতে না পেরে বাজখাই গলায় বলে উঠলামকে? কে তুমি? কোথাকার মাতব্বর?
মুহূর্তের মধ্যেই গলাটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল। সে গলা নামিয়ে এবার বলল–কে আমি?
‘হ্যাঁ, স্পষ্ট ভাষায় বল, কে তুমি?
‘শোন, আমি যেখানকার বাসিন্দা সেখানে আমার কোনো নাম নেই। সেখানে কারো নাম ধরে সম্বোধন করার কোনো ব্যাপারই নেই।’
আমি বিস্মিত হয়ে বলে উঠলাম সে কী! এরকম জায়গা আবার কোথাও আছে
আছে। আগে আমি মরলোকের বাসিন্দা ছিলাম আর এখন আমি পিশাচ। এক সময় আমি দারুণ নির্মম ও নিষ্ঠুর ছিলাম এখন কিন্তু আমি মরমী। আমার দশা দেখেই তো বুঝতে পারছ, দারুণভাবে কাঁপছি। আর এও হয়তো লক্ষ্য করছ, দাঁতে দাঁত লেগে কেমন ঠক্ ঠক্ আওয়াজ হচ্ছে। আমার এ-কম্পন, এ-শিহরণ অন্তহীণ। কেন? এ নিশ্চিদ্র অন্ধকার আর নিঃসীম শৈত্যের জন্য ভাবছ? না, অবশ্যই নয়। কী অসহ্য, গা জ্বালা এবং কদাকার।
‘হুম!’ আমি প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করলাম।
আমি অবাক হচ্ছি, এমন নিশ্চিন্তে বা প্রশান্তিতে ঘুমোচ্ছ কী করে? নিদারুণ মর্মবেদনা, হতাশা আর হাহাকারের মধ্যে আমার চোখে তো মুহূর্তের জন্যও ঘুম আসছে না। তার ওপর যা-কিছু দেখছি তা যে আমার পক্ষে কিছুতেই সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। আচ্ছা! একেবারেই অসহ্য। এবার আগের মতোই অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলে উঠল–তোমার ব্যাপারটা কি! তখন থেকে বলছি, উঠে এসো। আর তুমি কিনা পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল-নিথরভাবে বসেই রয়েছ! কি হল–ওঠো। বাইরের রাতে এসো। তোমার সামনেই কবরের দরজা খুলে দিচ্ছি। দ্যাখো–ভালো করে দ্যাখো। এর চেয়ে ভয়ানক, এর চেয়ে অসহনীয় দুঃখের দৃশ্য আর কোনোদিন দেখেছ কোথাও? ওঠ।
আমি দেখলাম, স্পষ্টই দেখলাম। অদৃশ্য সে হাত আমার কবজিটাকে সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরে রেখেই মানুষের সব কটা কবরের দরজা মুহূর্তের মধ্যেই দমাদম খুলে দিল।
সব কয়টা কবরের দরজা অপাটে খোেলা। আর সব কটা থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসছে পচনের ক্ষীণ ফসফরাস আলোর রশ্মি। তাই ভেতর পর্যন্ত দেখতে কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না। বরং স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচিছ, সাদা কাপড়ে মোড়া একের পর এক মূর্তিকে ছোট-বড় পোকায় ছেয়ে রেখেছে। তারা সবাই চিরন্দ্রিায় শায়িত। সারিবদ্ধ লক্ষ লক্ষ এ শবের সবাই কিন্তু ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে নেই। তবে শক্ত হয়ে আসা দেহগুলো যে অবস্থায় কফিনের ভেতরে শুইয়ে দিয়ে কবরস্থ করা হয়েছিল তারা কিন্তু এখন আর সে অবস্থায় নেই। বেশ কয়েকটা দারুণভাবে পরিস্থিতির রদবদল করে ফেলেছে। আবার কোনো কোনো কফিনের ভেতর থেকে অস্পষ্ট একটা খস খস আওয়াজ ভেসে আসছে। উকৰ্ণ হয়েও তার একটা বর্ণও বোঝা গেল না।
আমি যখন একের পর এক এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে দেখে চলেছি ঠিক তখনই আমার কানের কাছে মুখ এনে একেবারে ফিস ফিস করে সে বলতে লাগল–‘বল, তুমিই বল, এমন করুণ, এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য মুহূর্তের জন্যও সহ্য করা যায়? অসহ্য!নিদারুণ অসহ্য! চোখের সামনে এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করা ছাড়া কিছু তো করারও নেই।
কল্পনা, নিছকই কাল্পনিক বিভীষিকা। আর রাতের এ কাল্পনিক বিভীষিকা কেবলমাত্র রাতের সীমিত গণ্ডির মধ্যেই যে আটকা পড়ে রইল তা নয়। তা এবার থেকে দিনের বেলায়ও সক্রিয় হয়ে দেখা দিল। আমার স্নায়ুগুলো এমনভাবে আহত হয়েছে, নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে যে তা আর বলার নয়। জাগ্রত অবস্থায় আমি বিভীষিকার আতঙ্কে সর্বদা কুঁকড়ে থাকি। নিরবচ্ছিন্ন বিভীষিকা।
তখন বাড়ি থেকে বেশি দূরে যেতে মন চাইত না। যেতামও না। আমার মৃগী ব্যারামের কথা যাদের জানা ছিল তাদের কাছছাড়া হতে ভরসা হত না। ভুলেও সে চেষ্টা করতাম না। কারণ, যদি হঠাৎ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ি, যদি সংজ্ঞা হারিয়ে এলিয়ে পড়ি তবে তো কেলেঙ্কারীর সীমা থাকবে না। আরও কারণ অবশ্যই ছিল। যারা আমার ব্যামোটার কথা জানে তাদের সামনে রোগাক্রান্ত হয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়লে অবশ্যই জীবন্ত অবস্থায় কবরস্থ করে দেবে না।
একটা আতঙ্ক আমার মনটাকে প্রতিক্ষণ এমন আতঙ্কিত করে রাখত যে, আচমকা আর এমন বাকা পথ ধরে আমাকে আক্রমণ করে ফেলতে পারে যখন আমার লক্ষণ দেখে ধরেই নেওয়া যেতে পারে আমি আর ইহলোকে নেই। ইহ জীবনে এ ব্যামো আমার দেহটাকে কোনোদিনই ছেড়ে যাবে না।
হ্যাঁ, আশঙ্কা অনেকেরই ছিল। আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধব এমন একটা মওকা হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে আমার মতো এক মূর্তিমান আপদকে বিদায় করবে, মাটির তলায় চালান করে দিয়ে চিরদিনের জন্য ল্যাটা চুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা যদি কওে, তাতে তো অবাক হবার কিছু নেই। আমার মনের অবস্থা সম্বন্ধে অনেকেই যে কম বেশি অনুমান করতে পারেনি তা-ও নয়। তাই কেউ কেউ কৌশলে আমাকে প্রবোধ দিতেও ভোলেনি। মিছেই আমি এমন অমূলক আতঙ্কের শিকার হয়ে কষ্ট পাচ্ছি।
আমি আগেই সব কয়জনকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছিলাম, এ রকম শঙ্কটে যদি কোনোদিন পড়ি, যদি নিতান্তই নিস্তব্ধ হয়ে যাই তবে শরীরে পচন ধরার আগেই যেন আমাকে সমাহিত, মাটির তলায় চালান দেওয়া না হয়। তবু আমার মন থেকে আতঙ্ক। কিন্তু একেবারে দূর হয়নি। তাই কিছু কিছু ব্যবস্থাও আমি আগেভাগেই করে রেখেছিলাম।
সে ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে, পারিবারিক সমাধিক্ষেত্র যাতে ভেতর থেকে খোলা সম্ভব সে ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। লোহার দরজাটা যাতে সামান্য চাপ প্রয়োগের মাধ্যমেই খোলা যেতে পারে এ রকম একট লম্বা লোহার দণ্ড যোগাড় করলাম। আর সেটাকে সমাধির ভেতরে অনেকখানি ঢুকিয়ে রেখে দিলাম। আলো বাতাসের অভাব যাতে না ঘটে সেদিকেও নজর দিতে ভুলিনি।
আর যা-কিছু ব্যবস্থা করেছিলাম তা হচ্ছে, আমার জন্য যে কফিনটা তৈরি করে রেখেছি তার মধ্যে পানীয় জল খাবার দাবার রাখার ব্যবস্থা এমন জায়গায় করা ছিল যাতে সেগুলোকে হাতের নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়। আর কফিনের ভেতরে তুলা বিছিয়ে নরম গদি তৈরি করার ব্যবস্থাও করে রেখেছিলাম। আর তাতে স্প্রিংগুলো এমন কায়দায় বসানো হয়েছিল যাতে স্প্রিংয়ে সামান্য চাপ লাগামাত্র কফিনের ডালাটা খুলে যেতে পারে। একটা ঘণ্টার দড়িকে সমাধিক্ষেত্রের ছাদ থেকে ঝুলিয়ে রেখে দিলাম। তার একটা প্রান্ত ছিল কফিনটার ভেতরে, মৃতদেহের একটা কবজিতে যাতে বাঁধা সম্ভব হয় সে রকম দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট ছিল দড়ির প্রান্তটা।
ভাগ্য! সবই ভাগ্যের ফের। নইলে এত কিছু সুচিন্তিত পাকাপাকি ব্যবস্থা করে রাখা সত্ত্বেও আমাকেই মৃত্যুযন্ত্রণার থেকে অনেক, অনেক বেশি যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল। সে যে কী দুঃসহ যন্ত্রণা তার উল্লেখ না-ই বা করলাম।
একটু একটু করে আমার ঘোর কাটতে শুরু করেছে। চোখের পাতা খোলাও সম্ভব হচ্ছে না। কিছুই মনে নেই। বহু চেষ্টা করেও একটা কথাও মনে পড়ছে না। পাথরের মতো ভারি হয়ে যাওয়া মগজে এসব অনুভূতি তিলে তিলে জেগে ওঠায় শুধুমাত্র এটুকুই বুঝতে পেরেছিলাম, ব্যাধিটা আবার চেপে বসতে শুরু করেছে তা না হলে আমার এমন দশা কেনই বা হবে।
দুরু দুরু বুকে জোর করে চোখ মেলে তাকিয়ে ছলাম। না, বৃথা চেষ্টা। জমাট বাঁধা অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই আমার চোখে পড়েনি। মনে হলো আমি বুঝি অন্ধকার যক্ষপুরীতে অবস্থান করছি।
ভাবলাম চিল্লাচিল্লি করি। বৃথা প্রয়াস। তবুও সাধ্যাতীত প্রয়াস চালাতে লাগলাম। তাতেও ফায়দা কিছুই হলো না। কণ্ঠনালী দিয়ে সামান্যতম আওয়াজ বেরল না। ঠোঁট দুটো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। বুকের ওপরে কে যেন অতিকায় একটা পাথর চাপিয়ে রেখেছিল। শ্বাসক্রিয়া চালাতেও রীতিমত কষ্ট হচ্ছিল।
ভাবলাম, গলা ছেড়ে চিল্লাচিল্লি করার চেষ্টা করে দেখি। সে চেষ্টা করতেই চোয়াল দুটোকে নাড়াতে হয়েছিল। ব্যাপারটা এবার মাথায় গেল। আরে, চোয়াল দুটোকে তো পাটি দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছিল। মৃতদেহের চোয়াল যে এভাবেই শক্ত করে বেঁধে রাখাই প্রচলিত রীতি।
এবার লক্ষ্য করলাম, আমি যে শক্ত কোনো বস্তুর ওপর শুয়ে রয়েছি। আর দুধারেও শক্ত বস্তু অবস্থান করছে। আর হাত দুটোকে বুকের ওপর আড়াআড়ি ভাবে রেখে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছিল, এখনও বাধাই রয়েছে। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত দুটোকে ওপরে তোলার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। কিন্তু তামার মতোই শক্ত বস্তু ওপরের দিকেও হাতে ঠেকল। এবার বুঝতে আর কোনো অসুবিধাই হলো না। আমাকে কফিনের ভেতরে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। নিচে কফিনের কাঠের শক্ত পাটাতন আর ওপরেও কাঠের ডালা যার জন্য শক্ত বোধ হচ্ছিল। কফিন! হ্যাঁ, এ অভাগাকে কফিনের ভেতরেই শুইয়ে দেওয়া হয়েছে বটে। তৎক্ষণাৎ আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠেছিল, এরকম সম্ভাবনার কথা ভেবে আমার আগেভাগে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ব্যাপার স্যাপারগুলোর কথা। ব্যবস্থাগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য এবার তৎপর হওয়া দরকার।
আমি কিন্তু আমার মন্দ ভাগ্যের কথা ভেবে একটুও অবাক হইনি এবং হতাশায় ভেঙেও পড়িনি। শরীরের সর্বশক্তি নিয়োগ করে কফিনের ডালাটার গায়ে দমাদম ধাক্কা মারতে লাগলাম। স্প্রিংগুলো কাজ করেনি, ডালাটা খোলাও সম্ভব হলো না।
এবার ঘণ্টার দড়ির প্রান্তটাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে হাতড়ে বেড়াতে লেগেছিলাম।
আমি যখন দড়ির প্রান্তটা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম ঠিক তখনই মাটির সোঁদা গন্ধ নাকে অনুভব করেছিলাম।
আতঙ্ক! নিরবচ্ছিন্ন আতঙ্ক তখন আমার মধ্যে ভর করেছিল। শরীরের রক্ত ক্রমেই হিম শীতল হয়ে পড়ছিল। এবার আমার কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল–আমি নিঃসন্দেহ হয়েছিলাম, আমি অপরিচিত লোকের মাঝে ব্যামোটার শিকার হয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছিলাম। ফলে যা আশঙ্কা করে ছিলাম, ঘটেছিলও ঠিক তাই। তারা ধরেই নিয়েছিল আমার আত্মা দেহ ছাড়া হয়ে গেছে–অবশ্যই মৃত্যু ঘটেছে।
আমাকে মৃত ভেবে কফিন বন্দি করে অন্য দশজনের কবরখানার মাটি খুঁড়ে তলায় চালান করে দিয়ে শবযাত্রীরা কর্তব্য পালন করে বিদায় নিয়েছে।
কিন্তু কোথায়? জায়গাটা কোথায়? কোন কবরখানায় আমাকে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে তা আমার পক্ষে কিছুতেই বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। মাটির তলায়, অন্ধকার পাতালপুরীতে অবস্থান করে তা কি করেই বা বুঝতে পারব, একেবারেই যে অসম্ভব ব্যাপার। আমি এবার কণ্ঠনালী দিয়ে বুক ফাটা চিৎকারের মাধ্যমে জমাটবাধা আতঙ্ককে প্রকাশ করার চেষ্টা চালাতে লাগলাম। যাকে বলে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালানো। আমার সে চিৎকারে পাতাল রাজ্যের মাটি বুঝি বার বার কম্পনের মাধ্যমে শিউরে শিউরে উঠছিল।
প্রথমবার আর্তনাদ করতে পারিনি। কিন্তু দ্বিতীয় আর্তনাদ শুরু করে আর যেন থামাতেই পারছিলাম না। এমন ভয়ঙ্কর বুকফাটা আর্তস্বর যে আমার গলা দিয়ে অনবরত বেরিয়ে আসতেই থাকে তা আমি স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবিনি।
ঠিক তখনই আমার কানের কাছে কর্কশ এক ধমক শুনেছিলাম–‘আরে এমন ষাঁড়ের মতো হেড়ে গলায় চিল্লায় কে? কে? কে চিল্লাচ্ছে?
দ্বিতীয় কণ্ঠের কথা কানে এলো–‘আর্তনাদ! ভূতটুত দেখে এমন বুকফাটা আর্তনাদ করছে নাকি?
তৃতীয় কণ্ঠ শোনা গেল–‘বেরোও, বাইরে বেরোও।
এবার চতুর্থ কণ্ঠ কানে এলো। গভীর রাতে, এমন হেড়ে গলায় চিল্লাচিল্লি কেন, বুঝছি না তো? তার বক্তব্য শেষ হতে না হতেই হঠাই চারদিক থেকে অনেকগুলো হাত এগিয়ে এসে আমাকে একেবারে সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরল। তারপরই আমাকে এমন জোরে জোরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল যে মাথার ঘিলু পর্যন্ত নড়ে উঠল। ব্যস এবার সবকিছু বিদ্যুতের ঝলকানির মতোই মুহূর্তের মধ্যে এক এক করে আমার মনে পড়ে গেল।
ভার্জিনিয়ার অন্তর্গত রিচমন্ড শহরের কাছে ঘটনাটা ঘটেছিল। আমার এক বন্ধুর সঙ্গে জেমস নদীর তীরবর্তী এক জঙ্গলে বন্দুক কাঁধে শিকার করতে গিয়েছিলাম।
তখন আমরা জঙ্গলে ছিলাম। একটু রাত হতে তুমুল ঝড় উঠল। আমাদের নৌকাটা পাড়ের কাছেই নোঙর করা হয়েছিল। একটা কেবিনে আমাদের থাকার। জায়গা। নৌকায় বাগান তৈরির প্রয়োজনীয় সামগ্রি ঠাসা ছিল।
ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়েই আমরা হুটোপাটা করে নৌকায় ফিরে এলাম।
নৌকার পাটাতনের ওপর সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর নৌকার দুটোমাত্র বার্থের একটার ওপর আমি ঘুমিয়েছিলাম। বার্থ বলতে কাঠের পাটাতন ছাড়া আর কী-ই বা বলা চলে? কারণ, বিছানার নামগন্ধও ছিল না। এতটুকু একটা নৌকার বার্থ তো আর বেশি চওড়াও হতে পারে না। তাই মাত্র ফুট দেড়েক জায়গায় বুকের ওপরে হাত দুটো রেখে কোনোরকমে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। আর নৌকার পাটাতন বলতে যাকে বোঝাতে চাচ্ছি সেটা আমার মাত্র দুই ইঞ্চি ওপরে ছিল।
আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমে বিভোর হয়ে পড়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙল তারপর বেশ কিছুক্ষণ কিছু স্মৃতিতে আনতে না পারার জন্য আর জীবন্ত সমাধিস্থ হওয়ার। নিরবচ্ছিন্ন আতঙ্কের জন্য আমার মনে হচ্ছিল আমি বুঝি কফিনবন্ধ হয়েই পড়ে রয়েছি।
নৌকার খালাসিরা এটা-ওটা ধরে নাড়ানাড়ি করার ফলে যে গন্ধ বাতাসে মিশে গিয়েছিল তাতে আমার বোধ হয়েছিল বুঝি বা এটা কবরের ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। আসলে যে ওটা মালপত্রের গন্ধ তা আমার মাথায়ই আসেনি। তখন আমার ভেতরে যে আতঙ্ক যেমন দানা বেঁধেছিল তাতে এসব কথা কিছুতেই আমার মনে আসার কথাও ছিল না। এবারে চোয়ালে বাঁধা পট্টির কথা বলছি, আসলে সেটা আমার নিজেরই সিল্কের রুমাল। সেটা দিয়ে মুখ জড়িয়ে নিয়ে নাইটক্যাপের অভাব পূরণ করেছিলাম। কার্যত দেখা গেল, সবই আমার মনের ভুল, আকস্মিক আতঙ্কের ফল ছাড়া কিছুই নয়।
কিন্তু আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে যে আকস্মিক আতঙ্ক জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল, তার ফল হলো অদ্ভুত রকমের।
বার্থ থেকে নেমে সোজা ডেকের ওপরের উঠে গেলাম। কিছুক্ষণ ধরে আচ্ছা করে শরীরচর্চা করলাম। তারপর নদীর পানিতে আচ্ছা কওে গোসল করার পরই শরীরও মন চনমনে হয়ে উঠল। ফিরে পেলাম পূর্বের স্বাভাবিকতা।
মৃত্যুর আগেই কবরের অন্ধকার গহ্বরে আশ্রয় নেবার আতঙ্ক মন থেকে মুছে গেল। চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত যাবতীয় পুঁথিপত্র ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার পর মানসিক স্বস্তি আরও অনেকাংশে ফিরে পেলাম।
সমাধিস্থলের যা-কিছু চিন্তা-ভাবনা মনের কোণে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছিল তাও ঝেড়ে মুছে পরিস্কার করে নিলাম। অবান্তর চিন্তা-ভাবনা আর আমাকে বিভোর করে রাখতে পারল না।
দিন কয়েকের মধ্যেই আমি সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে গেলাম। ব্যস, অদ্ভুত সে ব্যামোটা আমাকে চিরদিনের মতো ছেড়ে চলে গেছে। সেটা আর কোনোদিনই আমার দেহে আশ্রয় নেয়নি। আমি এবার অন্য দশজনের মতোই একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ।