আট
সাপার তৈরি, টেবিলে বসার আয়োজন করছে সবাই।
‘র্যাচেল কোথায়?’ জানতে চাইলেন মি. ওয়ার্ডল
হ্যাঁ, আর জিঙ্গল?’ মি. পিকউইকের প্রশ্ন।
কোথাও দেখা গেল না তাদের। রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে খেতে বসে পড়ল সবাই।
মি. পিকউইক খাবারে ছুরি ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতেই চেঁচামেচির শব্দ উঠল বাইরে। দড়াম করে দরজা খুলে যেতে, সব ক’জন চাকর-বাকরকে নেতৃত্ব দিয়ে ধেয়ে এল এক লোক, দস্তুরমত হাঁপাচ্ছে।
‘এসবের মানে কি?’ গর্জে উঠলেন মনিব।
‘ওরা চলে গেছেন, হুজুর–চলে গেছেন।’
‘কারা চলে গেছে?’ ক্রুদ্ধ মি. ওয়ার্ডল প্রশ্ন ছুঁড়লেন।
‘মি. জিঙ্গল আর মিস র্যাচেল, মাগলটনের কোচে। আমি ছিলাম ওখানে। ওঁদের অনেক চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারিনি, তাই দৌড়তে দৌড়তে এসেছি আপনাদের জানাতে।’
‘ওর ভাড়া আমি দিয়েছি!’ বলে পাগলের মতন লাফিয়ে উঠলেন মি. টাপম্যান। ‘আমার দশ পাউন্ড নিয়ে গেছে রে!- ঠেকাও ওকে!- ব্যাটা আমাকে ঠকিয়েছে!- সহ্য করব না!- ন্যায্য বিচার চাই আমি, পিকউইক!- কিছুতেই সহ্য করব না!’ ক্ষুব্ধ ভদ্রলোক টাকার শোকে রীতিমত ছোটাছুটি শুরু করলেন ঘরময়। খাওয়া মাথায় উঠল সবার।
‘ও পাগল হয়ে গেছে দেখছি! চেঁচিয়ে উঠলেন মি. পিকউইক, ‘এখন কি করা?’
‘আর কি!’ গর্জে উঠলেন বৃদ্ধ নিমন্ত্রণকর্তা। ‘ফলো করতে হবে এই মুহূর্তে!’ উত্তেজনাকর মুহূর্তগুলোর মাঝে প্রস্তুত হয়ে গেল ক্যারিজ, মি. ওয়ার্ডল ও মি. পিকউইক কোট-স্কার্ফ পরে, গ্রাম্য সরু রাস্তা ধরে শত্রুর উদ্দেশে ছুটলেন।
উন্মাদের মত ক্যারিজ চালানো হলো সারা রাত, থামা হলো শুধু ঘোড়া পাল্টানোর জন্যে ও টোল আদায়ের গেটে স্টেজ কোচটির খোঁজ নিতে। চাঁদ প্রথমটায় ঝকঝকে আলো বিতরণ করলেও পরে মুখ লুকাল কালো মেঘের আড়ালে। ধুম বৃষ্টি নামল। সংকীর্ণ রাস্তাগুলোয় ঝেঁটিয়ে যাচ্ছে বাতাস। মি. পিকউইক অনেকবারই যাত্রাবিরতি করতে চাইলেন। কিন্তু মি. ওয়ার্ডল নাছোড়বান্দা। সর্বোচ্চ গতিতে রাতভর ঝাঁকুনি হজম করে অনুসরণ পর্ব চলল। শেষমেশ ভোর নাগাদ, সামনে দেখা পাওয়া গেল ছোট্ট ক্যারিজটির।
সে কি উত্তেজনা! তীরের মত পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে মাঠ-গাছ-ঝোপ-ঝাড়। শত্রু ক্যারিজটির প্রায় পাশাপাশি এসে গেছেন ওঁরা। ড্রাইভারকে তাড়া লাগাচ্ছে জিঙ্গল তার ভাঙা ভাঙা বাক্য আওড়ে। ‘ছোটাও- জলদি- ধরে ফেলল- পালাও!’ উত্তেজনায় ও রাগে হিংস্র হয়ে উঠেছেন মি. ওয়ার্ডল। গর্জন ছাড়লেন তিনি, ‘বদমাশ! শয়তান!’ মুঠো ঝাঁকালেন ঘৃণার পাত্রটির উদ্দেশে। কিন্তু মি. জিঙ্গল কেবল মুচকি হাসল এবং তার ঘোড়াগুলো প্রতিপক্ষকে পেছনে ছিটকে ফেলে এক ঝটকায় এগিয়ে যেতে জয়ধ্বনি করে উঠল।
ঠিক সে মুহূর্তে মি. পিকউইক সহসা একটা বাড়ি খেলেন- সশব্দ সংঘর্ষ- গড়িয়ে চলে গেল একটা চাকা, উল্টে গেল ক্যারিজ। ধ্বংসস্তূপ থেকে তাঁকে টেনে বের করা হলে ভদ্রলোক দেখতে পেলেন শত্রু ক্যারিজটি দূরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। পিছের দিকে পরম সন্তুষ্টিতে চেয়ে রয়েছে জিঙ্গল।
‘ছোটলোক কোথাকার!’ বাঘা গলায় চেঁচালেন মি. ওয়ার্ডল।
‘হা! হা!’ গা জ্বালানো হাসি হাসল জিঙ্গল, তারপর ক্যারিজের ভেতর আঙুল দেখাল। ‘ও বহাল তবিয়তে আছে- আপনাদের বলছে আর ঝুট-ঝামেলা না পাকাতে- টাপম্যানকে আমার ভালবাসা পৌঁছে দেবেন- কি, আরও তাড়া করার শখ আছে নাকি?- তাহলে জোরসে ছোটেন! হা! হা! হা!’
টগবগিয়ে ছুটল ওর ক্যারিজ, জানালা দিয়ে একটা সাদা রুমাল ওড়াচ্ছে জিঙ্গল।
‘লোকটার সঙ্গে আবার যদি দেখা হয়…’ আরম্ভ করলেন মি. পিকউইক।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ,’ কথা কেড়ে নিলেন মি. ওয়ার্ডল। ‘কিন্তু আমরা যতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকব ততক্ষণে বিয়ের লাইসেন্স হাতে পেয়ে যাবে ওরা, লন্ডনে বিয়েটা সেরেও ফেলবে।
কাজেই অগত্যা মি. পিকউইক তাঁর গোস্সা তখনকার মত বোতলবন্দী করে রাখলেন। এবার ঝুম বৃষ্টির মধ্যে দুই বুড়ো হাঁটা শুরু করলেন, ছ’মাইল দূরের পরবর্তী সরাইটার উদ্দেশে।
.
পরদিন সকালে, লন্ডনের অন্যতম প্রাচীন সরাইখানা, দ্য ওয়াইট হার্টের উঠনে বসে, এক লোককে এক জোড়া বুটের ধুলো-কাদা পরিষ্কারে ব্যস্ত দেখা গেল। ডোরাকাটা ওয়েস্ট কোট, কালো ক্যালিকো পীভস, বাদামী চোগা, লেগিং আর প্রাচীন একটা সাদা হ্যাট তার পরনে। দু’সারি জুতো সামনে তার— পরিষ্কার ও নোংরা। পরিষ্কার সারিতে এক পাটী করে জুতো রাখছে, আর কাজে বিরতি নিয়ে মুগ্ধ নয়নে প্রতিবার নিজের দক্ষতা বিচার করছে। ভাবখানা যেন, কি করে পারলাম!
একটি বেডরূমের বেল জোরাল শব্দে বেজে উঠল এবং তার পরপরই ব্যানিস্টারের ওপর থেকে এক মেইড চেঁচিয়ে বলল, ‘স্যাম! বাইশ নম্বর তার জুতো চাইছে!’
‘এই যে, অন্য জুতোগুলো দেখো— এগারো জোড়া; একটা হচ্ছে ছয় নম্বরের, কেঠো পা যার। বারো নম্বর এমন কে যে সবার আগে তারটা দিতে হবে? না, না। সবাই একে একে, ফাঁসির দড়িতে যেভাবে লটকায়।’ পূর্ণোদ্যমে কাজে লেগে পড়ল সাদা হ্যাট।
আরেকটি উচ্চকিত ঘণ্টাধ্বনি এবং সরাইখানার সদাব্যস্ত বৃদ্ধা ল্যান্ডলেডি একজোড়া লেডিস শূ নিয়ে এলেন। ‘এগুলো এক্ষুণি সাফ করো, স্যাম, তারপর প্রাইভেট সিটিংক্রমে, পাঁচ নম্বরে পৌঁছে দেবে।’
রেলিঙের ওপর তখনও ঝুঁকে রয়েছে মেইডটি। ‘পাঁচ নম্বর আজ ভোরে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে ক্যারিজে চড়ে এসেছে। সেই লোকই বাইশ নম্বরের জুতোওয়ালা। তারটাও সেরে দিয়ো!’
‘আগে বলতে কি হয়েছিল?’ বুট জোড়া তখুনি তুলে নিয়ে বলল স্যাম। ‘প্রাইভেট রূম, আবার সঙ্গে মহিলাও। ভদ্দরলোকের ছেলে হলে একটা শিলিং অন্তত না দিয়ে পারবে না।’ ক’মিনিট পরই পাঁচ নম্বরের দরজায় পৌঁছে গেল দু’জোড়া জুতো।
ভেতরে এসো,’ স্যামের টোকার জবাবে এক লোক বলল। স্যাম ঢোকার পর তার শ্রেষ্ঠ বাউটা উপহার দিল। নাস্তায় বসেছে এক লোক ও এক মহিলা। যার যার জুতো তার পাশে রেখে পিছিয়ে যেতে শুরু করল ও।
‘এই ছেলে,’ বলল লোকটি, এই শর্মাই যে মি. জিঙ্গল তা আর বলে দেয়ার প্রয়োজন আছে কি? ‘জানো নাকি- নামটা কি?- ডক্টরস কমনস?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘জ্বী, স্যার। পলস চার্চ ইয়ার্ড, স্যার। আর্চওয়ের নিচে
নিচে। একদিকে বুকসেলার; আরেকদিকে হোটেল আর মাঝখানে লাইসেন্সের দুই দালাল।’
‘কি করেটা কি তারা?’ জিঙ্গলের প্রশ্ন।
‘কি করে না, স্যার? লাইসেন্স বিক্রি করে- সব ধরনের। বুড়োমানুষদের মগজে এমন সব বুদ্ধি সেধিয়ে দেয় যেগুলোর কথা তারা জন্মেও ভাবেনি! আমার বাবা, স্যার, কোচোয়ান। তার বউ মারা যাওয়ার সময় তার জন্যে চারশো পাউন্ড রেখে গেছে। তাই সে ডক্টরস কমনসে উকিলের কাছে যায় টাকাটা হাতে পাওয়ার জন্যে। আর্চওয়ে দিয়ে ঢুকতেই একটা দালাল তাকে ক্যাঁক করে ধরে। ‘লাইসেন্স, স্যার, লাইসেন্স?’ জানতে চায়। ‘কিসের লাইসেন্স?’ বাবা জিজ্ঞেস করে। বিয়ের লাইসেন্স,’ বলে দালাল। ‘আপনার লাগবে মনে হচ্ছে, স্যার।’ আমার বাবা থেমে একটু ভাবে। ‘না,’ বলে সে, ‘আমার বয়স হয়ে গেছে বেশি, চেহারাও দশাসই। ‘মোটেই না, মোটেই না, স্যার,’ বলে দালালটা। ‘গত সোমবার আপনার দ্বিগুণ সাইজের এক লোকের বিয়ে দিলাম। আর কি, আমার বাবা ওর পেছন পেছন একটা ছোট্ট অফিসে গিয়ে ঢোকে, ওখানে এক লোকে বসে বসে কাজের ভান করে। ‘নাম?’ জানতে চায় উকিল। ‘টনি ওয়েলার,’ বলে আমার বাবা। ‘মহিলার নামটা কি?’ বলে উকিল। বাবা কি বলবে ভেবে পায় না। ‘জানলে তো কথাই ছিল না,’ বলে, ‘পরে বসিয়ে দিলে চলে না?’ ‘অসম্ভব,’ বলে উকিল। ‘বেশ,’ একটুখানি ভেবে বলে বাবা, ‘লিখুন সুসান ক্লার্ক, মারকুয়েস অভ গ্র্যানবি ইন, ডর্কিং। আমি বললে রাজি হবে আশা করি। এখনও কিছু বলিনি তবে আপত্তি করবে না ও যদ্দূর জানি।’ লাইসেন্স হয়ে গেল এবং বাবাকে গ্রহণ করে নিল মহিলা; আর ওই চারশো পাউন্ডের এক আনাও আমার কপালে জুটল না, হায় রে পোড়া কপাল!’
স্যাম তার দুঃখের পাঁচালি গেয়ে তবে ঘর ত্যাগ করল।
‘সাড়ে নটা— একদম পাক্কা- চার্চে নোটিস দেব- কাল তোমাকে নিজের করে পাব,’ মিস ওয়ার্ডলের হাতে চাপ দিয়ে বলল জিঙ্গল।
‘বেশি দেরি কোরো না কিন্তু,’ আবেগরুদ্ধ সুরে বললেন ফুফু।
‘তোমাকে ছেড়ে বেশিক্ষণ দূরে থাকা যায়? যা বলো না তুমি!’ মি. জিঙ্গল নাচের পায়ে কুমারী ফুফুটির কাছে এসে তাঁকে চুম্বন করে বেরিয়ে গেল।
মধুমাখা চোখে ওর চলে যাওয়া দেখলেন মহিলা।
‘মিষ্টি ধাড়ি মেয়ে, বারান্দা ধরে হাঁটার সময় মনে মনে আওড়াল জিঙ্গল।
সেদিন সকালে দু’জন মোটা ও একজন রোগা ধরনের ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন সরাইখানার উঠনে, স্যাম ওয়েলার তখন আবার জুতো পরিষ্কারে ব্যস্ত। মি. ওয়ার্ডল, মি. পিকউইক ও মি. ওয়ার্ডলের উকিল, লিকলিকে মি. পার্কার এসেছেন কিছু তল্লাশী চালাতে।
সামান্য জেরা ও একটি স্বর্ণমুদ্রা খয়রাতের পর স্যামের জবান ফুটল। এবার পাঁচ নম্বর রূমের দিকে তাঁদের নিয়ে চলল স্যাম।
মি. ওয়ার্ডল দরজা খুলতে তিনজন প্রবেশ করলেন ভেতরে। মি. জিঙ্গল, ওঁরা আসার একটু আগে ফিরেছে, মিস র্যাচেলকে উপহার দিল বিয়ের দলিল।
ভদ্রমহিলা ভাই ও তাঁর বন্ধুদের দেখে তীক্ষ্ণ চিৎকার ছেড়ে চেয়ারে ধপাস করে পড়লেন, মুখ ঢেকেছেন দু’হাতে। জিঙ্গল লাইসেন্সটা রেখে দিল পকেটে।
‘অ্যাই- অ্যাই শয়তান!’ চেঁচিয়ে উঠলেন মি. ওয়ার্ডল, রাগে শ্বাসরুদ্ধ প্রায়। ‘আমার বোনকে আমারই বাড়ি থেকে ভাগিয়ে আনার সাহস পাও কোথায়?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ,’ বললেন মি. পার্কার। ‘সাহস পান কোথায়?’
‘কে আপনি?’ মি. জিঙ্গল চোখ পাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠতে খর্বাকৃতি উকিল বেচারা দু’কদম পিছু হটলেন।
‘উনি আমার উকিল, বদমাশ কোথাকার।’ হস্তক্ষেপ করলেন মি. ওয়ার্ডল। ‘এই লোককে আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব। আমি- আমি ওকে ধুলোয় মিশিয়ে দেব। আর র্যাচেল, তুমিও! এই বয়সে একটা ফকিরের হাত ধরে পালালে, বংশের মুখে চুনকালি মাখিয়ে… শিগগির বনেট পরে চলে এসো…একটা কোচ ডাকো তো, এই তুমি, আর এই মহিলার বিল নিয়ে এসো! কানে যাচ্ছে?’
‘জ্বী, স্যার,’ বলল স্যাম, মি. ওয়ার্ডলের ডাকে সাড়া দিয়ে বিজলির মতন আবির্ভূত হয়েছে— এতক্ষণ আরকি চাবির ফুটোয় চোখ রেখে আধ ভেজানো দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
‘কই, তৈরি হও,’ তাড়া লাগিয়ে বললেন মি: ওয়ার্ডল I
‘ওঁর কথা কানে তুলো না! বলল জিঙ্গল। ‘ঘর ছাড়ুন, স্যার। ভদ্রমহিলা নিজের ইচ্ছায় যা খুশি করতে পারেন- একুশ বছরের বেশি হয়ে গেছে- সাবালিকা।’
‘একুশ বছরের বেশি!’ অবজ্ঞায় গর্জে উঠলেন মি. ওয়ার্ডল। ‘আরে, বলো একচল্লিশের বেশি!’
‘কক্ষনো না,’ কাঁদো কাঁদো স্বরে প্রতিবাদ জানালেন ফুফু।
‘ইহ, বললেই হলো,’ মি. ওয়ার্ডল ধমক মারলেন। ‘তোমার আসল বয়স তো পঞ্চাশ পেরিয়েছে।’
একথা শুনে তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার করে মূর্ছা গেলেন ফুফু আম্মা।
‘মাথায় এক গ্লাস পানি ঢেলে দিন,’ দয়ালু মি. পিকউইক বললেন।
‘এক গ্লাস!’ ক্রুদ্ধ মি. ওয়ার্ডলের হুঙ্কার। ‘বলুন এক বাতি! তবে যদি একটু হুঁশ জ্ঞান হয়।’
‘কোচ তৈরি, স্যার,’ বলল স্যাম, দোরগোড়ায় হাজির।
‘এসো!’ ডাকলেন মি. ওয়ার্ডল। ‘ওকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
হস্তক্ষেপ করল জিঙ্গল। ‘একটা পুলিস ডাকো তো,’ স্যামকে বলল। দেখি কোন্ বাপের ব্যাটা ওকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়- ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে।
‘আমি যাব না,’ বিড়বিড়িয়ে বললেন ফুফু। ‘আমি তোমার কাছে থাকব।’
‘আপনারা একটু শুনুন, স্যার,’ অনুচ্চ স্বরে মি. ওয়ার্ডল ও মি. পিকউইককে একপাশে ডেকে নিয়ে গেলেন উকিল সাহেব। বড্ড বেকায়দা অবস্থায় পড়ে গেছি আমরা, স্যার। মিস র্যাচেলকে নিয়ে যাওয়ার অধিকার আমাদের নেই। আগেই বলেছিলাম, সমঝোতার চেষ্টা করতে হবে। মি. ওয়ার্ডলকে কিছু টাকা-পয়সা গচ্চা দিতে হবে।’
‘টাকার জন্যে চিন্তা করবেন না,’ বললেন ভদ্রলোক।
‘তাহলে সামলে নিতে পারব,’ বললেন উকিল। ‘মি. জিঙ্গল, পাশের ঘরে একটু আসবেন এক সেকেন্ডের জন্যে?’
জিঙ্গল সায় জানাতে চারজনে পাশের একটি খালি ঘরে গেলেন। ‘এখন কথা হচ্ছে,’ জিঙ্গলকে একপাশে সরিয়ে এনে শুরু করলেন উকিল, ‘ব্যাপারটার ফয়সালা কিভাবে করা যায়? আমরা, স্যার, ভাল করেই জানি টাকার জন্যেই মহিলাকে ফুসলে এনেছেন আপনি। ভ্রূ কুঁচকাবেন না, স্যার, ভ্রূ কুঁচকাবেন না! কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে মার মৃত্যুর আগে উনি কিছুই পাচ্ছেন না। আপনার কি মনে হয়- মানে, স্যার, বলছিলাম কি- পঞ্চাশ পাউন্ড আর স্বাধীনতা নিশ্চয়ই মিস ওয়ার্ডলের চাইতে অনেক বেশি লোভনীয় আপনার কাছে?’
‘হবে না- অর্ধেকও বলেননি,’ চেয়ার ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করল জিঙ্গল।
‘কি বলছেন, স্যার,’ প্রতিবাদ করলেন উকিল। টাকার অঙ্কটা রীতিমত সম্মানজনক; পঞ্চাশ পাউন্ডে অনেক কিছু করা সম্ভব, স্যার।’
‘আরও বেশি সম্ভব দেড়শো পেলে, ঠাণ্ডা সুরে জবাব দিল জিঙ্গল।
‘তর্কাতর্কি করতে চাইছি না, স্যার। আচ্ছা, ঠিক আছে, সত্তর পাউন্ড।’
‘হবে না। খরুচে ঝামেলা কোচের ভাড়া, নয় পাউন্ড- লাইসেন্স, তিন পাউন্ড- ক্ষতিপূরণ, একশো- সম্মানহানি- প্রেমিকা খোয়ানো…’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ,’ মৃদু হেসে বললেন খাটোকায় উকিল, ‘শেষের আইটেম দুটোর কথা বাদ দিন। তাহলে হচ্ছে একশো বারো- মানে, ওই একশোই আরকি।’
‘একশো বিশ,’ বলল জিঙ্গল
‘আসুন, আসুন, চেক লিখে দিচ্ছি,’ বলে চেক লেখার জন্যে বসলেন উকিল। পরে মি. ওয়ার্ডলের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে নেবেন। মি. জিঙ্গল ত্বরিত পকেটে পুরল ওটা।
‘এক্ষুণি এই বাড়ি ছেড়ে দূর হও!’ তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বললেন মি. ওয়ার্ডল।
‘এখুনি যাচ্ছি,’ বলল নির্লজ্জ বেহায়া জিঙ্গল, ‘এই, পিকউইক, চলি। এই নাও!’ বিয়ের দলিলটা ছুঁড়ে দিল। ‘নামটা পাল্টে নিয়ো- মহিলাকে বাড়ি নিয়ে যাও- এটা টাপম্যানের কাজে লাগবে!’
‘তবে রে…’ রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল মি. পিকউইকের, একটা দোয়াত জিঙ্গলের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কিন্তু সে লোক ততক্ষণে পগার পার। বিমর্ষচিত্তে দুই বন্ধু, ভগ্নহৃদয়া মহিলাটিকে নিয়ে ধীরে ধীরে ডিংলি ডেলে ফিরে এলেন। মি. টাপম্যান ইতোমধ্যে মনোবেদনায় আতিথ্যত্যাগ করেছেন। মি. পিকউইক, মি. স্নডগ্রাস ও মি. উইঙ্কলও উপলব্ধি করলেন এবার বিদায়ের পালা। প্রাণঢালা সম্বর্ধনা নিয়ে, শীঘ্রিই আবার আসবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে, রওনা দিলেন তিন বন্ধু।