দ্য পিকউইক পেপার্স – ২১

একুশ

ক’সপ্তাহ পর মি. পিকউইক লন্ডনের জর্জ ইনে ফিরে এলেন। ট্রায়ালের পর দু’মাস পেরিয়ে গেছে। ফেরার পর তৃতীয় দিন সকালে, ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে স্যাম, এসময় উদ্ভট টাইপের এক লোক কোচে চেপে হাজির হলো। জমকালো পোশাক পরনে তার, গায়ের গয়না-গাঁটি দেখে মহিলারাও লজ্জা পাবে। সে পৌঁছতে রাস্তার ওপার থেকে জীর্ণ পোশাক পরা এক লোককে এদিকে এগিয়ে আসতে দেখল স্যাম। সুবেশ লোকটির আগমনের হেতু অনুমান করে, তার আগে ইনে ঢুকে দরজা আগলে দাঁড়াল স্যাম।

ওকে ঠেলে লোকটা ভেতরে ঢুকতে চাইলে বাধা দিল ও। নোংরা পোশাক এসময় কাছে এসে জানতে চাইল, ‘কি ব্যাপার?’

‘এ লোক আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না।’ বলল অলঙ্কৃত লোকটি।

আরও ঠেলাঠেলি বিনিময় হলো, কিন্তু স্যাম যখন ময়লা পোশাককে নিয়ে ব্যস্ত সেই ফাঁকে হামাগুড়ি মেরে সেঁধিয়ে পড়ল দ্বিতীয়জন, মুহূর্তে তাকে অনুসরণ করল স্যাম। এক ওয়েটার লোকটাকে মি. পিকউইকের ঘর চিনিয়ে দিল। অনাহৃত অতিথি যখন ঘরে ঢুকল মি. পিকউইক তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। স্যাম ও লোকটির তর্কাতর্কিতে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর।

‘শেভিঙের পানি নিয়ে এসো, স্যাম,’ শুয়ে থেকেই বললেন তিনি।

‘আমি এখুনি আপনাকে কামিয়ে দিচ্ছি, মি. পিকউইক,’ বলল আগন্তুক, একটা বেড কার্টেন* সরাল। ‘আপনার জন্যে ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছি। এই যে আমার কার্ড। চলুন, রওনা হয়ে যাই।’

[বেড কার্টেন: সে যুগে রাতের বাতাসের প্রবেশ ঠেকাতে বেড কার্টেন ব্যবহারের চল ছিল। রাতের বাতাসকে তখন বিপজ্জনক, ক্ষতিকর মনে করা হত।]

মি. পিকউইক বালিশের তলা থেকে চশমা বের করে নাকে গলালেন। ‘ন্যাম্বি, অফিসার টু দ্য শেরিফ অভ লন্ডন, বেল অ্যালি, কোলম্যান স্ট্রীট।’ পড়লেন তিনি।

মি. ন্যাম্বি এবার নোংরা পোশাক, অর্থাৎ স্মাউচের উদ্দেশে গলা ছাড়ল। বন্দীর কাপড় পরা হলে তাঁকে নিয়ে যাবে সে। নির্দেশ দান করে চলে গেল ন্যাম্বি। মি. পিকউইককে তাড়া লাগিয়ে দরজার কাছে চেয়ার পেতে বসল স্মাউচ।

কিছুক্ষণ পরে, স্যাম ও স্মাউচকে নিয়ে একটা কোচে চেপে, কোলম্যান স্ট্রীটে শেরিফের অফিসে গেলেন মি. পিকউইক। স্যামকে পাঠালেন তিনি মি. পার্কারকে খবর দিতে।

‘আহা, প্রিয় স্যার,’ বলল বেঁটে শেরিফ। ‘ধরা পড়লেন শেষ পর্যন্ত? খরচাপাতি আর ক্ষতিপূরণের অঙ্কটা লিখে রেখেছি আমি। কি, চেক কে লিখবে? আপনি নাকি আমি?’ চুপ করে রইলেন মি. পিকউইক।

‘পার্কার,’ ভদ্রলোক পৌছলে বললেন মি. পিকউইক, ‘আমি আর এদের ফালতু কথা শুনতে রাজি না। এখানে বসে থাকার কোন অর্থ নেই, আজই জেলে যেতে চাই আমি।’

‘আপনি যদি জেলে যাবেনই ঠিক করে থাকেন তবে দ্য ফ্লীটে যেতে পারেন,’ বললেন উকিল ভদ্রলোক।

‘চলবে,’ বললেন মি. পিকউইক। ‘নাস্তাটা সেরে নিয়েই চলে যাব।

নানা আনুষ্ঠানিকতার পর দ্য ফ্লীটের পেয়াদার হাতে তুলে দেয়া হলো মি. পিকউইককে। জানানো হলো ক্ষতিপূরণ সহ সমস্ত টাকা শোধ না করা পর্যন্ত জেলেই থাকতে হবে তাঁকে

‘সে লম্বা সময়ের ব্যাপার,’ হাসতে হাসতে বললেন মি. পিকউইক। ‘চলো হে, স্যাম। পার্কার, বন্ধু আমার, বিদায়।’

‘চলুন, আমিও যাব, আপনার নিরাপত্তার দিকটা দেখতে হবে না?’ বললেন পার্কার।

‘দরকার নেই, বন্ধু,’ বললেন মি. পিকউইক। স্যাম একা গেলেই চলবে, ওখানে একটু থিতু হয়েই চিঠি লিখব তোমাকে। আপাতত বিদায়।’

দ্য ফ্লীটে এসে পৌঁছল কোচ। একটা ভারী গেটের কাছে মি. পিকউইককে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। কারাগারের ওয়ার্ডাররা একে একে এসে দীর্ঘ সময় ধরে দেখে গেল তাঁকে। এখন আর ওয়ার্ডারদের বন্দী ও সাক্ষাৎপ্রার্থীদের পরস্পর গুলিয়ে ফেলার ভয় রইল না। এবার জেলখানার অভ্যন্তরে পা রাখতে বলা হলো মি. পিকউইককে।

[দ্য ফ্লীট: ঋণখেলাপীদের জন্য লন্ডনের প্রাচীন জেলখানা। বহু আগেই লুপ্ত।]

‘রাতে কোথায় শোব আমি?’ জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।

সামান্য আলোচনার পর জানা গেল জনৈক ওয়ার্ডার একটি খাট ভাড়া দিতে ডধ* আজ রাতের জন্যে, কাল তাঁর জন্যে অন্য ব্যবস্থা করা যাবে। (*১৮২০ খ্রীষ্টাব্দের কারাগারের সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে না বর্তমানের জেলখানার। সে কালে বন্দী তার নিজের খাবার, পোশাক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা কিনে নিতে পারত। ওয়ার্ডাররা স্বচ্ছল বন্দীদের কাছে ঘর, বিছানা, আসবাবপত্র ইত্যাদি ভাড়া দিয়ে বেশ দু’পয়সা আয় করত। ফলে, ধনী বন্দীরা জেলখানায় রীতিমত আরাম- আয়েশের সঙ্গে বাস করতে পারত। দিনের বেলা দর্শনপ্রার্থীদের অনুমতি দেয়া হত এবং ড্রিঙ্ক বিক্রি করা হত কারাবন্দীদের কাছে। কিন্তু অভাবী বন্দীরা নিদারুণ দুর্দশাগ্রস্ত জীবনযাপনে বাধ্য হত। খাদ্য ও পোশাকের জন্যে করুণা ভিক্ষে করতে হত তাদের, ভোগ করতে হত দুর্বিষহ বন্দীজীবন। সে সব নিয়ম এখন আর নেই- ডিকেন্স এই পরিবর্তনের প্রয়োজনের বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।) ইনার গেট পেরিয়ে ক’ধাপ নিচে নামলেন তাঁরা। পেছনে তালা লেগে গেলে জীবনে এই প্রথমবার ঋণখেলাপীদের কারাকক্ষে নিজেকে আবিষ্কার করলেন মি. পিকউইক। গাইডের পেছন পেছন সিঁড়ি বেয়ে ও ভেঙে, একাধিক প্যাসেজ পেরিয়ে, অনেকগুলো দরজা দিয়ে প্রবেশ করে শেষ অবধি একটা ঘরে এসে হাজির হলেন তাঁরা। আট-নটা বিছানা রয়েছে এ ঘরে।

‘সেরা হোটেলটাতেও এরচাইতে ভাল রূম পাবেন না, কি বলেন?’ গর্বিত সুরে বলল ওয়ার্ডার

স্যামের প্রশ্নের জবাবে জানা গেল কোণের মরচে ধরা একটি খাট মি. পিকউইকের জন্যে বরাদ্দ হয়েছে। ‘খাটটা এত নরম যে ঘুম এসে যায়,’ বলল ওয়ার্ডার।

স্যাম খাটটা হতাশ চোখে পরখ করে ভাবতে লাগল ঘরের অন্যান্য ‘ভদ্রলোকরা’ কি ধরনের কে জানে।

খানিক বাদে বিদায় নিয়ে, স্যাম কাছের একটি সরাইখানায় উঠল। পরদিন সকালে মনিবের কাপড়-চোপড় নিয়ে ফিরবে সে।

ঘরটা অস্বচ্ছন্দ হলেও মি. পিকউইক মন খুশি রাখলেন। লোহার খাটটার কিনারে বসে হিসেব করতে লাগলেন, ওয়ার্ডার বছরে কত টাকা কামাতে পারে এসব খাট ভাড়া দিয়ে। হিসেব-নিকেশ শেষে গা এলিয়ে দিলেন এবং শীঘ্রিই ঘুমিয়ে পড়লেন।

চেঁচামেচি আর অট্টহাসির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। খাটে উঠে বসে হতবিহ্বল চোখে সামনের দৃশ্যটা দেখতে লাগলেন তিনি।

সবুজ কোট, করডুরর নী প্যান্ট ও গ্রে স্টকিং পরা এক লোক ঘরের মাঝখানটিতে নর্তন কুর্দন করছে। আরেক পাঁড় মাতালকে তার বন্ধুরা ঠেসে ধরেছে খাটে, সে লোক একটা হাসির গানের স্মরণযোগ্য অংশবিশেষ গাইছে হেঁড়ে গলায়। তৃতীয় আরেকজন, খাটে দর্শক সেজে বসে হাততালি দিয়ে উৎসাহ যোগাচ্ছে। দীর্ঘদেহী লোকটার মাথায় লম্বা কালো চুল, মুখে দাড়ির জঙ্গল, মি. পিকউইককে সবার আগে তার চোখে পড়ল। নর্তকটির উদ্দেশে চোখ টিপে, কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল ও, ‘ভদ্রলোক ঘুমাচ্ছেন দেখতে পাচ্ছ না?’

‘আহারে, নিষ্পাপ ভদ্রলোকটির ঘুম ভেঙে গেছে দেখছি!’ আরেকজন বিস্ময়ের ভান করল।

‘ভদ্রলোক মনে হয় কিছু পান করতে চাইছেন,’ বলল দেড়েল। ‘কি খাবেন উনি জিজ্ঞেস করো না।’

‘ওহ হো, ভুলেই গেছিলাম,’ বলল অন্যজন। ‘কি খাবেন, স্যার? পোর্ট ওয়াইন না শেরি, স্যার? দেন, আপনার নাইটক্যাপটা ঝুলিয়ে দেই।

অচেনা লোকটি ছোঁ মেরে মি. পিকউইকের নাইটক্যাপ কেড়ে নিয়ে গাইয়েটির মাথায় পরিয়ে দিল।

তিড়িং করে খাট ত্যাগ করলেন ভদ্রলোক, দুম করে নর্তকটির বুকে এক ঘুসি বসিয়ে দিয়ে, পুনরুদ্ধার করলেন তাঁর সাধের নাইটক্যাপ, তারপর প্রতিরোধের ভঙ্গিতে দু’মুঠো পাকিয়ে রাখলেন।

‘এবার এসো দেখি, সাহস থাকলে, দু’জনেই এসো,’ আহ্বান জানালেন তিনি।

লোক দু’জন থমকে দাঁড়িয়ে, পরস্পরের দিকে দু’মুহূর্ত চেয়ে থেকে পরক্ষণে বেদম হাসিতে ফেটে পড়ল।

‘সাহসী লোক পছন্দ করি আমি,’ শেষমেশ বলল নাচিয়ে। ‘এবার আরেক লাফে বিছানায় উঠে পড়েন তো, সাহেব, নাইলে আবার ঠাণ্ডা বাধিয়ে বসবেন। মনে কিছু নিয়েন না, স্যার।’

‘না, না, ঠিক আছে,’ এবার তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন মি. পিকউইক।

‘আপনার নামটা কি, স্যার?’ বলল দেড়েল, হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ করমর্দনের মধ্য দিয়ে পরিচয় পর্ব সাঙ্গ হলো। লোকটির নাম স্ম্যাঙ্গল এবং তার বন্ধুর নাম মিভিনস।

নতুন বন্ধুদের সঙ্গে ভাঙা মগে শেরি পান করে, আন্তরিকতা বৃদ্ধির প্রয়াস পেলেন মি. পিকউইক। একটু পরে ফের ঘুমে ডুব দিলেন তিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *