দ্য ট্রুথ ইজ আ কেভ ইন দ্য ব্ল্যাক মাউন্টেনস

দ্য ট্রুথ ইজ আ কেভ ইন দ্য ব্ল্যাক মাউন্টেনস

নিজেকে কি আমি আদৌ ক্ষমা করতে পেরেছি? আমি জানি আমার অপরাধের ফিরিস্তি অনেক বড়। কিন্তু এ-ও জানি, নিজের অনেক অপরাধই আমি ক্ষমা করতে পেরেছি। এই যেমন লোকটাকে ওই জায়গাটায় ফেলে আসা বা তার সাথে আমার ব্যবহার। কিন্তু এক বছর ধরে নিজ মেয়েকে ঘৃণা করার অপরাধ, আমি ক্ষমা করতে পারিনি। ভেবেছিলাম ও পালিয়ে গিয়েছে, হয়তো বা শহরে। ফ্লোরার প্রসঙ্গ তো দুরে থাক, সেই বছর ওর নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করতে দেইনি কাউকে। কখনো যদি প্রার্থনায় ওর নাম এসেও থেকে, তাহলে এসেছে অভিশাপ দিতে-যেন মেয়েটা একদিন বুঝতে শেখে ওর অপরাধ, যেন উপলব্ধি করতে পারে আমাদের জন্য কতটা কলঙ্ক বয়ে এনেছে সে, যেন মায়ের চোখ কান্নায় লাল করার শাস্তি কড়ায় গণ্ডায় বুঝে পায়।

হ্যাঁ, একমাত্র এই অপরাধের জন্যই নিজেকে ঘৃণা করি। আর সে ঘৃণা কোনক্রমেই উপশম হবার নয়। এমনকি সেই রাতে পাহাড়ের ধারে ঘটা ঘটনার পরও না।

দশ বছর ধরে খুঁজে বেড়িয়েছি লোকটাকে, অনেক বার হারিয়ে ফেলেছি পথের দিশা। যদি কাকতালীয় ঘটনায় বিশ্বাস করতাম, তাহলে বলতাম-কপাল জোরে পেয়ে গিয়েছি ওকে। কিন্তু আমি কাকতালীয় ঘটনায় বিশ্বাস করি না। রাস্তা ধরে হাঁটলে, কখনো না কখনো গন্তব্যে ঠিকই পৌঁছানো যায়।

কিন্তু সেই গল্প পরে। প্রথমে বলি মেইন ল্যাণ্ডে দেখা উপত্যকার কথা। আরও ঠিকভাবে বলতে গেলে চুনকাম করা বাড়িটার কথা। ছিমছাম, ছোট্ট সুন্দর বাড়ি। একপাশে বয়ে চলেছে একটা ছোট নদী। দূর থেকে দেখে মনে হয়, বাড়িটা যেন এক সমুদ্র সবুজের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা এক টুকরা সাদা আকাশ!

বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার কথাও ভুলিনি। কাঁটাঝোপ থেকে উল তুলছে। আমাকে আসতে দেখেনি। আমি কাছে গিয়ে মুখ খোলার আগে টেরও পায়নি, ‘আমিও এ কাজটা করতাম। কাঁটাঝোপ আর গাছের ডালে লেগে থাকা উল সংগ্রহ করতাম। আমার মা ওগুলোকে ধুয়ে পরিষ্কার করতেন। বিভিন্ন জিনিস বানাতেন। কখনো বল, আবার কখনো পুতুল।’

অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়াল ছেলেটা, যেন আমি আসমান থেকে ওর সামনে এসে পড়েছি। কিন্তু তাই কি কখনো হয়? আমি অনেক পথ ঘুরে আজ এখানে, সামনে আরও অনেক পথ বাকি আছে। বললাম, ‘আমি প্রায় নিঃশব্দে চলাচল করি। এটা কি ক্যালাম ম্যাকইনেস-এর বাড়ি?’

ছেলেটা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সোজা হয়ে দাঁড়ালে টের পেলাম, আমার চেয়ে দুই এক আঙুল লম্বাই হবে। বলল, ‘আমি ক্যালাম ম্যাকইনেস।’

‘এই নামে কি আরও কেউ আছে? আমি যাকে খুঁজছি, তিনি প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ।’

ছেলেটা কিছুই বলল না, কাঁটাঝোপে লেগে থাকা এক টুকরা উল হাত দিয়ে খুলে নিল। আমি বললাম, ‘তোমার বাবা কি আছেন? আর নাম কী? ক্যালাম ম্যাকইনেস?’

ছেলেটা এবার কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকাল, ‘তুমি কে?’

‘আমি ছোটখাট একজন মানুষ।’ বললাম, ‘কিন্তু মানুষ বটে। যাই হোক, আমি ক্যালাম ম্যাকইনেসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’

‘কেন?’ ইতস্তত করল ছেলেটা। কিন্তু তা কাটিয়ে উঠে বলল, ‘আর, তুমি এত খাট কেন?’

উত্তর দিলাম, ‘কেন এসেছি? কারণ আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলতে চাই-বড়দের একটা ব্যাপার নিয়ে।’ ছেলেটার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠতে দেখে যোগ করলাম, ‘ছোটখাট হওয়াটা খুব একটা খারাপ ব্যাপার না, ক্যালাম। এক রাতের কথা বলি। সে-রাতে ক্যাম্পবেলরা আমার খোঁজে এসেছিল। দল বেধে, লাঠি-সোটা আর ছুরি নিয়ে। না হলেও বারো জন হবে। আমার স্ত্রী, মোরাগকে সাবধান করে দিয়েছিল যেন আমাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টাও না করে। ওদের উদ্দেশ্য ছিল আমাকে খুন করা। কেন? আমার কোন কল্পিত অপরাধের জন্য! মোরাগ বলেছিল, ‘জনি! যাও তো। তোমার বাবাকে ডেকে আনো। বলবে আমি আসতে বলেছি।’ ক্যাম্পবেলদের চোখের সামনে দিয়ে বালকটা বের হয়ে গিয়েছিল সেদিন 1 ওরা জানত, আমি ভয়ংকর। কিন্তু কেউ জানত না, আমি এতটা ছোট আর খাট। আগে শুনে থাকলেও, বিশ্বাস করেনি।’

‘ছেলেটা কি তোমাকে ডেকে এনেছিলো?’

‘ছেলেটা? ছেলেটা কোথায় পেলে?’ উত্তর দিলাম, ‘আসলে আমিই ছিলাম সেখানে।’

হেসে ফেলল সামনে দাঁড়ানো তরুণ। বলল, ‘ক্যাম্পবেলরা তোমার পিছে লেগেছিল কেন?’

‘গরুর মালিকানা নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। ওদের মতে, সব গরুর মালিক ওরা। আর আমার মতে, যে-মুহূর্তে গরুগুলো আমার জমিতে এসে ঢুকেছে, সে মুহূর্ত ওগুলোর মালিকানা আমি পেয়ে গিয়েছি।’

‘এখানে দাঁড়াও,’ তরুণ ক্যালাম ম্যাকইনেস বলল।

ছোট নদীটার পাশে বসে রইলাম, বাড়িটাকে মন দিয়ে দেখছি। ছোট্ট হলেও যথেষ্ট সুন্দর। আগে থেকে জানা না থাকলে ধরে নিতাম, বাড়িটা কোন ডাক্তার বা উকিলের। কোন চোরাচালানকারীর বলে কল্পনাও করতাম না। মাটিতে নুড়ি পাথর ছড়িয়ে আছে দেখে স্তূপাকারে সাজিয়ে রাখলাম পায়ের কাছে। এরপর ছুঁড়ে মারলাম এক এক করে। আমার সই বেশ ভাল। ছোট নদীটা আর আমার মাঝখানের ঘাসটুকু পার করে পানির উপর পড়ল প্রায় সবগুলো নুড়ি। তরুণ ফিরতে ফিরতে কম করে হলেও একশ’ নুড়ি ছোঁড়া হয়ে গিয়েছে। তরুণের সাথে একজন লম্বা লোক বেশ বড় বড় পা ফেলে আসছে। চুলে রুপালি রঙ ধরেছে লোকটার। চেহারা লম্বাটে আর অনেকটা নেকড়ের মতো। এই পাহাড়ে অবশ্য এখন আর নেকড়ে পাওয়া যায় না, ভালুকও না।

‘শুভ সকাল,’ সম্ভাষণ জানালাম।

বিনিময়ে পেলাম নীরবতা। এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল লম্বা, নেকড়ের মতো দেখতে মানুষটা। অবশ্য লোকজন হরহামেশাই আমার দিকে এভাবে তাকায়, তাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। পাত্তা দিলাম না, ‘আমি ক্যালাম ম্যাকইনেসকে খুঁজছি। তুমিই যদি ক্যালাম হও, তবে তোমাকে সম্ভাষণ জানাই। আর যদি যদি না হও, আমাকে বলে দাও, নিজের পথ ধরি।

‘ক্যালাম ম্যাকইনেস-এর সঙ্গে কী কাজ?’

‘আমি তাকে গাইড হিসেবে নিয়োগ করতে চাই।’

‘কোথায় যেতে চাও?’

এবার আমার তাকাবার পালা। ‘বলা কঠিন, উত্তর দিলাম। কেননা, কেউ কেউ বলে—সে জায়গাটার কোন অস্তিত্ব নেই। যেতে চাই এক বিশেষ কুয়াশা-ঘেরা দ্বীপের এক বিশেষ গুহায়।’

একটা কথাও না বলে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল লোকটি। এরপর ঘুরে বলল, ‘ক্যালাম, ঘরে যাও।’

‘কিন্তু, বা–’

‘তোমার মাকে বলো, আমি বলেছি তোমাকে কিছু ট্যাবলেট দিতে; তোমার ওই পছন্দেরগুলো থেকে। যাও।’

তরুণের চেহারায় একই সাথে অনেকগুলো অনুভূতি খেলে গেল—বিভ্রান্তি, ক্ষুধা, আনন্দ! কিন্তু শেষ পর্যন্ত দৌড়াতে দৌড়াতে চলে গেল সাদা চুনকাম করা বাড়িটায়।

ক্যালাম ম্যাকইনেস বলল, ‘কে পাঠিয়েছে তোমাকে?

ছোট নদীটার দিকে ইঙ্গিত করলাম আমি, পাহাড়ের দিকে বয়ে চলছে একমনে। ‘এটা কী?’ জিজ্ঞেস করলাম।

‘নদী।’ উত্তর এল।

‘সবাই বলে, এই নদীর ওপারে একজন রাজা আছে।’ বললাম ওকে।

তখনও লোকটাকে অত ভাল ভাবে চিনতাম না। কিন্তু পরিষ্কার দেখতে পেলাম, ওর চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে এক দিকে। ‘তুমি যে সত্যি দাবী করছ, তা আমি কীভাবে জানব?’

‘এখন পর্যন্ত তো কোন কিছুই দাবী করিনি।’ বললাম, ‘শুধু বলেছি, একদল লোকের কাছে শুনেছি কুয়াশাছন্ন দ্বীপে একটা গুহা আছে। আর তুমি সেখানে যাবার রাস্তাটা চেন।’

বলল, ‘আমি তোমাকে গুহার অবস্থান কখনোই জানাব না।’

‘আমি তো পথ-নির্দেশনা জানতে আসিনি। এসেছি গাইড খুঁজতে। আর জানোই তো, একজনের চেয়ে দুইজন একত্রে চলা বেশি নিরাপদ।’

আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরখ করে দেখল যেন। ভেবেছিলাম, আমার উচ্চতা নিয়ে ঠাট্টা করবে। কিন্তু না, তেমন কিছু বলল না। ভাল লাগল ব্যাপারটা। শুধু বলল, ‘গুহায় কিন্তু আমি ঢুকব না। সোনা তোমার নিজ হাতেই বের করে আনতে হবে।’

‘আমার কোন সমস্যা নেই।’

লোকটার কথা তখনও শেষ হয়নি, ‘শুধু মাত্র ততটুকুই বের করে আনবে, যতটুকু নিজে বইতে পার। আমি ওই জিনিস ছুঁতেও চাই না। তবে হ্যাঁ, তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে আমার কোন আপত্তি নেই।’

আমিও বললাম, ‘তোমাকে এর জন্য উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়া হবে।’ জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ছোট একটা কাপড়ের ব্যাগ বের করে আনলাম। ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে। ‘আমাকে নিয়ে যাবার জন্য অগ্রিম দিলাম। এরকম আরও দুই ব্যাগ পাবে আমরা ফিরে এলে।’

বিশাল থাবার মতো হাতটায় কয়েনগুলো ঢালল। খুশী হয়ে বলল, ‘রুপা! ভাল, আমি রুপা পছন্দ করি।’ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বউ বাচ্চার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি।’

‘কিছু সাথে নেবে না?’

‘আমি একজন চোরাচালানকারী, এখনও বুড়োও হয়নি। আর চোরাচালানকারীরা সঙ্গে খুব কম জিনিস নিয়ে বের হয়। তবে একটা দড়ি নেব ভাবছি, পাহাড় বেয়ে ওঠার কাজে সাহায্য হবে। আর…’ কোমরে ঝোলানো খঞ্জরে আদরের সাথে চাপড় দিল সে, ‘এটা থাকবে।’

বিদায় নেবার জন্য ক্যালাম উধাও হয়ে গেল চুনকাম করা বাড়িটাতে। আমি একবারের জন্যও লোকটার স্ত্রীকে দেখিনি। তখনো না, পরেও কখনো না। এমনকী আমি এও জানি না, মহিলার চুলের রঙ কী!

অপেক্ষা করতে করতে আরও খান পঞ্চাশেক নুড়ি নদীর এ-পাড় থেকে ওপারে চালান হয়ে গেল। অবশেষে দেখা পেলাম লোকটার, কাঁধে সোনালি দড়ি ঝোলানো। চোরাচালানকারী বাড়ি হিসেবে বেমানান বাড়িটা থেকে আরও দূরে, আরও পশ্চিমে রওনা দিলাম।

***

পথে অনেকগুলো পাহাড় পড়ল। দূর থেকে দেখে মনে হয়-নম্র, বেগুনি, ঝাপসা কোন বস্তু; অনেকটা মেঘের মতো, হাতছানি দিয়ে ডাকছে যেন। পাহাড়গুলো চড়তে কোন কষ্ট হলো না, টিলা বেয়ে ওঠার মতোই সহজ। কিন্তু ওগুলো তো আসলে পাহাড়, একদিন লেগে গেল শুধু উঠতেই। সারাদিন পাহাড় বাইতাম আমরা, রাতে ঠাণ্ডায় কাঁপতাম।

এখন গ্রীষ্মের মধ্যভাগ, কিন্তু চূড়ায় তুষার নজরে এল।

প্রথম দিন খুব একটা কথাবার্তা হয়নি আমাদের মাঝে, কী-ই বা আছে বলার মতো? কেউ কাউকে ভাল মতো চিনি না। আর আমাদের গন্তব্য কোথায় তা তো দু’জনেই জানি।

ভেড়ার শুকানো বিষ্ঠা আর মরা ডাল ব্যবহার করে আগুন ধরাতাম; তাতে পানি গরম করে পরিজ রান্না করতাম। রান্নার প্যানটা আমার। ওতে পানি গরম হলে দু’জনেই এক মুঠো করে ওটমিল আর এক চিমটি করে লবণ ছেড়ে দিতাম। আমার মুঠো আমার আকারের মতোই ছোট, আর ওরটা ওর আকারের মতো বিশাল। হাসত সে। বলতো, ‘আশা করি পরিজের অর্ধেকটা খেয়ে ফেলবে না!’

নিশ্চিত করতাম ওকে, বলতাম অবশ্যই না! আর হতোও তাই। কেননা অন্য সব প্রাপ্ত বয়স্কদের চেয়ে আমার ক্ষুধাও লাগত কম। ব্যাপারটা ভাল, কেননা আমার বিশ্বাস, শুধু বুনো বাদাম আর জাম খেয়েই আমি টিকে থাকতে পারব দীর্ঘদিন। যা পূর্ণ-আকৃতির কেউ পারবে না।

কপাল ভাল, পাহাড়ের মাঝ দিয়ে একটা পথ মতো চলে গিয়েছে। আমরা সেই পথ অনুসরণ করে এগোলাম। প্রায় কাউকে দেখতে পাইনি। শুধু গাধাসহ একজন ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীকে দেখলাম। সাথে একটা মেয়েও দেখতে পেলাম, গাধাটার লাগাম হাতে ছিল তার। পণ্য বলতে একগাদা পুরনো তৈজসপত্র। মেয়েটা মনে হয় আমাকে দেখে ছোট বাচ্চা মনে করেছিল, তাই হাসল। যখন বুঝতে পারল আমি বাচ্চা নই, আরেকটু হলে তো এক টুকরা পাথর ছুঁড়ে মারত! তবে কপাল ভাল, ব্যবসায়ী বাধা দেয়ায় পারল না। এরপর পথে পড়ল এক বৃদ্ধা আর তার নাতী। ঘরে ফিরছেন তারা। একসাথে বসে খেলাম আমরা। বৃদ্ধা আমাদের জানালেন-নাতীর বাচ্চার জন্ম দেখতে বেড়িয়েছিলেন তারা। এ-ও বললেন, পয়সার বিনিময়ে আমাদের হাত দেখে দেবেন। দিলাম পয়সা। ডান হাতের তালুটা নিজের দিকে নিয়ে খুব ভাল করে দেখলেন তিনি, ‘তোমার নিকট ভবিষ্যতে আমি মৃত্যু দেখতে পাচ্ছি।’

‘আমাদের সবার জন্যই মৃত্যু অপেক্ষা করছে।’

একটু থামলেন তিনি; সেই উঁচু এলাকার উঁচুতম জায়গায়, যেখানে গ্রীষ্মের বাতাসও শীতের মতো ঠাণ্ডা, যেখানে বাতাস ছুরির মতো ধারালো, সেই জায়গায় একটু বিরতি নিয়ে বললেন, ‘অতীতে এক মেয়েকে গাছে ঝুলতে হয়েছিল। আর ভবিষ্যতে ঝুলতে হবে এক পুরুষকে।’

‘আমার সাথে এর কী সম্পর্ক?

‘এক দিন হয়তো বুঝবে,’ বললেন তিনি। ‘সোনার ব্যাপারে সাবধান, রুপাই তোমার বন্ধু।’ আমার হাত দেখা শেষ।

ক্যালাম ম্যাকইনেসকে বললেন, ‘তোমার তালু তো দেখি আগুনে পোড়া।’ নড করে সম্মতি জানাল ক্যালাম। ‘তোমার অন্য হাত, মানে বাঁ হাতটা দাও।’ আদেশ করলেন যেন। পালন করল ক্যালাম। খুব মনোযোগের সাথে হাতটাকে পরখ করে দেখলেন তিনি। বললেন, ‘তুমি এমন এক জায়গায় ফিরবে, যেখান থেকে সব কিছু শুরু হয়ে ছিল। অন্য যে-কোন মানুষের চেয়ে উঁচু জায়গায় পৌঁছাবে। আর যেখানে যাচ্ছ, সেখানে তোমার কবর নেই।’

ক্যালাম বলল, ‘তারমানে আমার এই সফরে মৃত্যু নেই?’

‘বাঁ হাতে যা লেখা! আমি যা জানি, তা বলে দিয়েছি। এর বেশি কিছু বলার নেই।’

যাত্রার দ্বিতীয় দিনটাতে একমাত্র এটাই ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

খোলা আকাশের নিচে ঘুমালাম সে রাতে। পরিষ্কার কিন্তু ঠাণ্ডা একটা রাত। আকাশে তারার মেলা। মনে হচ্ছিল যেন সব সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যেন হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। চাইলে জামের মতো এক এক করে ছিঁড়েও নিয়ে আসা যাবে।

তারার নিচে পাশাপাশি শুয়ে রইলাম আমরা-আমি আর ক্যালাম ম্যাকইনেস। বেশ কিছুক্ষণ কাটার পর ক্যালাম বলল, ‘তোমার জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করছে—বললেন বৃদ্ধা। আমার জন্য করছে না। আমার কপাল মনে হয় তোমার চেয়ে ভাল।’

‘সম্ভবত।’

‘তবে,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে, ‘এসব বিশ্বাস করাটাও এক মস্ত বোকামি। বুড়ো লোকের গাল-গল্প। মিথ্যা কথা।’

সকালের কুয়াশার মাঝে ঘুম ভাঙল আমার। চোখ খুলেই দেখতে পেলাম একটা হরিণকে। কৌতূহলী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

তৃতীয় দিনে উঠে এলাম পাহাড়ের চূড়ায়। এবার নিচে নামার পালা।

আমার সঙ্গী বলল, ‘যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন একদিন বাবার খঞ্জর পড়ে গিয়েছিল রান্নার জন্য গরম করা পানির মাঝে। আমি টেনে বের করেছিলাম; কিন্তু, ধাতুর বাঁটটা ছিল আগুনের মতো গরম। আমি ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারিনি। এদিকে খঞ্জরটাকে ছাড়তেও পারিনি। আগুনের থেকে দূরে নিয়ে, পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। এখন মনে পরে, বাষ্প উঠছিল পানি থেকে। তালু পুড়ে গিয়েছিল, হাতটাও গিয়েছিল বেঁকে। কিন্তু এমনভাবে যে দেখে মনে হয়, কেয়ামতের আগ পর্যন্ত তলোয়ার ধরার জন্যই ওটাকে বানানো হয়েছে।’

আমি বললাম, ‘তুমি, তোমার বাঁকা হাত আর আমার মতো একজন ছোটখাট মানুষ-অসাধারণ এক দল আমরা। যাচ্ছি নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে।’

গর্জনের মতো করে হাসলে সে। হাসিতে কৌতুকের ছিটে-ফোঁটা নেই, ‘অসাধারণ দল!’ বলল শুধু।

ঠিক তখনই শুরু হলো বৃষ্টি। থামল তার পরেরদিন। রাতটা কাটল একটা ছোট একটা গোলাবাড়িতে। দূর থেকে চিমনীতে ধোঁয়া দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু অনেক ডাকাডাকি করেও, মালিককে খুঁজে পাইনি।

তাই বাধ্য হয়েই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে হলো। আবার ডাকলাম মালিককে। অন্ধকার একটা বাড়ি। কিন্তু নাকে এল চর্বির গন্ধ। যেন কেউ একজন অনেকক্ষণ ধরে মোম জ্বালিয়ে রাখার পর, এই মাত্র ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়েছে।

‘কেউ নেই,’ বলল ক্যালাম। কিন্তু আমি মাথা নাড়লাম। সামনে এগিয়ে খাটের নিচে উঁকি দিলাম।

‘দয়া করে ওখান থেকে বেড়িয়ে আসবেন?’ অনুরোধ করলাম। ‘আমরা পথিক। উষ্ণতা, আশ্রয় আর আতিথেয়তা প্রার্থনা করছি। আমাদের কাছে আছে ওটমিল আর হুইস্কি। সেগুলোও ব্যবহার করতে পারেন। আর কথা দিচ্ছি-আমরা আপনার কোন ক্ষতি করব না।’

প্রথমে বিছানার তলে লুকিয়ে থাকা মহিলা কোন কথাই বললেন না। বেশ কিছুক্ষণ পর আওয়াজ পেলাম, ‘আমার স্বামী পাহাড়ে গিয়েছেন। বলেছিলেন, অপরিচিত কাউকে দেখলে যেন লুকিয়ে থাকি। কেননা, কে না কে আসে—বলা যায়?’

অভয় দিলাম মহিলাকে, ‘আমি ছোটখাট একজন মানুষ। লম্বায় একটা বাচ্চার সমান। আপনার হাতের এক আঘাতেই উড়ে যাব। আমার সঙ্গী যদিও আকৃতিতে বেশ বড়, কিন্তু তাও প্রতিজ্ঞা করছি-আপনার চুলটাও সে স্পর্শ করবে না। শুধু আপনার আতিথেয়তা দরকার। আমাদের জামা কাপড় ভিজে গিয়েছে। দয়া করে বের হয়ে আসুন।’

বের হলে দেখলাম, ধুলো আর মাকড়সার জাল সারা দেহে লেগে আছে মহিলার। কিন্তু মলিন অবস্থাও তার সৌন্দর্যের হানি ঘটাতে পারেনি। খুব সুন্দরী মহিলা। জাল আর ধুলো লেগে ধুসর রঙ ধারণ করেছে একমাথা চুল। কিন্তু বোঝা যায়, ওগুলো বড়, ঘন আর রঙ লালচে-সোনালি। এক মুহূর্তের জন্য আমার মেয়ের কথা মনে পড়ল। কিন্তু আমার মেয়ে হলে সরাসরি চোখের দিকে তাকাত। এই মহিলা ভয়ার্ত চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন ভয় পাচ্ছে এক্ষুণি তাকে আঘাত করা হবে।

আমি তাকে কিছু ওটমিল দিলাম। ক্যালাম দিল শুকনো মাংস। মহিলা ক্ষেত থেকে একজোড়া ছোট ছোট শালগম নিয়ে এসে, আমাদের তিনজনের জন্য খাবার তৈরি করলেন।

পেট ভরে খেলাম। মহিলা প্রায় কিছুই মুখে দিলেন না। ক্যালামের সম্ভবত পেট ভরেনি। কিন্তু কী আর করা! খাবার শেষ করে তিন জনের জন্য হুইস্কি ঢালল সে। পানিও মেশাল। বৃষ্টির পানি এখনও বাড়ির ছাদে আওয়াজ করে চলছে। বেয়ে বেয়ে ঝড়ে পড়ছে কিনারা দিয়ে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো আমার-ভিতরে আসতে পেরেছি বলে।

ঠিক সেই সময় দরজা গলে একজন লোক ঢুকল। কিছুই বলল না, কিন্তু অবিশ্বাসের সাথে তাকাল আমার দিকে। গা থেকে ভেড়ার চামড়ার আলখাল্লা খুলল সে, এর পর হ্যাট। ফেলে দিল মেঝেতে। মেঝেটা মাটির। পানি জমে কাদা হয়ে গেল। নীরবতাটুকু স্নায়ুর উপরে যেন চেপে বসল।

ক্যালাম ম্যাকইনেস বলল, ‘আপনার স্ত্রী আমাদেরকে আতিথেয়তা দিয়েছেন। যদিও তাকে খুঁজে বের করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে।’

‘আমরা আতিথেয়তার জন্য অনুরোধ জানিয়ে ছিলাম আপনার স্ত্রীর কাছে,’ যোগ করলাম আমি। ‘এখন আপনাকেও অনুরোধ করছি।’

লোকটা উত্তরে কিছুই বলল না, শুধু ঘোঁত করে উঠল।

এই রকম পাহাড়ি এলাকায়, লোকেরা গুণে গুণে কথা বলে। যেন পয়সা খরচ করছে। কিন্তু এখানে প্রথা অনেক বেশি শক্তিশালী। কেউ যদি আতিথেয়তা প্রার্থনা করে, তাহলে তাকে তা দিতেই হবে। সে যদি জন্ম শত্রু হয়, তাহলেও।

মহিলাটি বাচ্চা মেয়েদের মতোই ছোটখাট। কিন্তু তার স্বামীর চুল দাড়ি সাদা হয়ে গিয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তো লোকটা তার বাবা। কিন্তু না, ঘরে বিছানা একটাই। এতটা ছোট যে, দুই জনের জায়গা হওয়াই দুষ্কর। মহিলা ঘর থেকে বের হয়ে ভেড়ার খোঁয়াড়ের দিকে এগোল। একদম কাছেই খোঁয়াড়টা। কিন্তু ওট কেক আর শুকানো শুকরের মাংস নিয়ে ফিরল সে। পাতলা করে কেটে খেতে দিল লোকটাকে।

ক্যালাম হুইস্কি ঢেলে দিল। প্রশ্ন করল, ‘আমরা কুয়াশা-ঘেরা দ্বীপটাকে খুঁজছি। এখন আগের জায়গাতেই আছে কি না, সে ব্যাপারে কিছু জানেন?’

লোকটা আমাদের দিকে ভাল করে তাকাল। পাহাড়ে বাতাসও ভয়ংকর, যেন মুখের কথা বের হবার আগেই উড়িয়ে নিয়ে যায়। ‘হ্যাঁ। চূড়া থেকে আজ সকালে দেখেছি। ওখানেই আছে। কাল থাকবে কি না-তা জানি না।’

কুঁড়ের শক্ত মাটিতে রাতটা কাটালাম। আগুন নিভে গিয়েছে বেশ দ্রুতই, তাই ঠাণ্ডা লাগল বেশ। লোকটা আর মহিলা ঘুমালো পর্দার আড়ালে নিজেদের খাটে। ঘুমাবার আগে, বেশ খানিকক্ষণ মারল মহিলাকে। অপরাধ-আমাদেরকে ঢুকতে দেয়া আর খাবারের ব্যবস্থা করা। ইচ্ছা না থাকলেও, সবই শুনতে পেলাম। রাতে ঘুমানোটা বেশ কঠিন একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল।

গরীবের ঘরে রাত কাটিয়েছি আমি, আবার প্রাসাদেও। খোলা আকাশের নিচেও শুয়েছি। এই রাতের আগে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম, আমার কাছে সব জায়গাই এক। ঘুম ভাঙল সকালের আলো ফোঁটার আগেই। কেন জানি মনে হচ্ছিল, এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যাওয়া দরকার। কেন? তা বলতে পারব না। ক্যালামকে জাগিয়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ওখান থেকে। এর আগে কোন ঘর থেকে বেরোতে পেরে এত খুশী হইনি।

প্রায় এক মাইল পথ পার হবার পর জানতে চাইলাম, ‘দ্বীপটার ব্যাপারে একটা কথা জানতে চাই। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে, ওটা এখনো আগের জায়গায় আছে কি না? কেন?’

ক্যালাম ইতস্তত করল। মনে হচ্ছিল যে কী বলবে তা গুছিয়ে নিচ্ছে। বলল, ‘কুয়াশাছন্ন দ্বীপ অন্য সব জায়গার মতো না। আর সেই দ্বীপের কুয়াশাও সাধারণ কুয়াশা না।’

এখন যে পথে চলছি, সেটা আসলে পশু চলার পথ। শত বছর ধরে ভেড়া আর হরিণ এই পথ ধরে চলে আসছে। মানুষও ব্যবহার করেছে, কিন্তু অনেক কম।

আরও যোগ করল, ‘এই দ্বীপকে উড়ন্ত দ্বীপও বলা হয়। কারণ, অনেকে বলে উপর থেকে দেখলে দ্বীপটা দেখে মনে হয় যেন প্রজাপতির ডানা। সত্যি না মিথ্যা তা জানি না।’ একটু থেমে বলল, ‘আর তাছাড়া-সত্যের স্বরূপ-ই বা কেমন?’ (বাইবেলের বাণী)

উপরে ওঠার চেয়ে নিচে নামাটা কঠিন বলে মনে হলো।

কিছুক্ষণ ভাবলাম ক্যালামের কথাটা নিয়ে, ‘আমার মাঝে মাঝে মনে হয়- সত্য হলো আসলে একটা জায়গা। আমার মনের মাঝে এমন একটা জায়গা আছে…শহরের মতো। একটা শহরে প্রচুর রাস্তা থাকতে পারে, একশো বা এক হাজার! কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব রাস্তা একটা গন্তব্যের দিকেই যায়। তাই ঠিক কোন রাস্তা বেছে নিলে, সেটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। যদি সত্যের দিকে এগোও, তাহলে একদিন না একদিন তাকে ঠিকই খুঁজে পাবে।’

ক্যালাম ম্যাকইনেস আমার দিকে তাকাল, ‘ভুল বলেছ। সত্য আসলে কালো পাহাড়ের গুহায় লুকোনো। রাস্তা কেবল একটাই। আর তা-ও বিপদসংকুল ও ভয়ানক। যদি ভুল রাস্তা বেছে নাও-মারা পড়বে। লাশ পড়ে থাকবে পাহাড়ের পাশে।

অবশেষে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছালাম আমরা। কালো পাহাড়টাকে দেখতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি সমুদ্রকে। পাহাড়টা যেন কুয়াশা ভেদ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

ক্যালাম বলল, ওই যে তোমার গুহা, ওই পাহাড়ে আছে।

এমনি এমনি কি আর পাহাড়কে পৃথিবীর হাড় বলে, ভাবলাম আমি। হাড়ের কথা ভাবতে অস্বস্তিবোধ হলো। তাই মন অন্য দিকে ফেরাতে বললাম, ‘কতবার গিয়েছ ওখানে?’

‘একবারই।’ একটু দোনোমনো করে জবাব দিল, ‘জীবনের প্রথম ষোলোটা বছর কেটে গিয়েছে জায়গাটা খুঁজে পেতে। খুঁজেছি কারণ-জায়গাটাকে নিয়ে বলা গল্পগুলো শুনেছি। বিশ্বাস করেছি—খুঁজলেই পাবো। যখন অবশেষে পেলাম, তখন আমার বয়স সতেরো। যতটা সোনা বহন করতে পেরেছি, ততটা নিয়েও এসেছি।’

‘অভিশাপের ভয় পাওনি?’

‘বয়স কম ছিল। কোন কিছুকেই ভয় পেতাম না। ‘

‘সোনা দিয়ে কী করেছ?’

‘এক অংশ এমন এক জায়গায় পুঁতে রেখেছি, যার হদিস আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। বাকি অংশ ব্যবহার করে বিয়ে করেছি আমার ভালবাসার মেয়েটিকে, আর বানিয়েছি আমাদের থাকার জন্য একটা বাড়ি।’

অনেক কিছু বলে ফেলেছে, এমন ভাব করে থেমে গেল সে।

জেটিতে মাঝিকে দেখা গেল না। তবে একটা নৌকা দেখতে পেলাম। ছোট নৌকা। তিনজন মানুষ আঁটবে, তবে টায়-টায়; একটা গাছের গুঁড়ির সাথে বাঁধা। পাশে একটা বেল পড়ে আছে।

বাজালাম বেলটা। অল্প কিছুক্ষণ পরেই একটা মোটা লোককে দেখতে পেলাম। ক্যালামকে বলল মাঝি, ‘তোমার জন্য ভাড়া এক শিলিং। আর বাচ্চাটার জন্য তিন পেনি।’

সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। অন্যদের মতো লম্বা না হতে পারি, কিন্তু আত্মসম্মানবোধ যথেষ্ট লম্বা। ‘আমিও,’ বললাম, ‘এক শিলিং ভাড়া দেব। আমি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ। ‘

মোটা লোক, মানে মাঝি আমাকে খুব ভাল করে পরখ করল, এরপর দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘ক্ষমা চাচ্ছি। চোখে আগের মতো ভাল দেখি না। আপনাদেরকে দ্বীপ পর্যন্ত অবশ্যই নিয়ে যাব।’

এক শিলিং ধরিয়ে দিলাম তাকে। হাতে নিয়ে ওজন করে দেখল। ‘চাইলেই আমাকে ধোঁকা দিয়ে নয় পেন্স বাঁচাতে পারতেন। এই মন্দার সময় নয় পেন্স অনেক টাকা।’ পানির রঙ স্লেটের (ধুসর, সবুজ বা নীল রঙের বহুরঙ্গা পাথর বিশেষ) মতো, কিন্তু আকাশটা এখনো নীল, ওপরে সাদা সাদা ফেনা যেন একে অপরকে তাড়া করে বেরোচ্ছে। মাঝি নৌকাটা পানিতে নামিয়ে আমাদেরকে চড়ে বসতে বলল। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল—আমরা ভাসছি।

সমুদ্রের পানিতে দাঁড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম আমরা। মাঝির কাছে বসেছি আমি। বললাম, ‘নয় পেন্স, কম না। কিন্তু আমি একটা গল্প শুনেছি। ওই সামনের কুয়াশা- ঘেরা দ্বীপে নাকি একটা গুহা আছে। অনেক সোনা দানা রাখা আছে ওতে। গুপ্তধন বলা চলে।’

বাদ দেবার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে।

ক্যালাম আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, ঠোঁটজোড়া এত শক্ত হয়ে চেপে বসেছে যে সাদা দেখাচ্ছে। ওকে পাত্তা দিলাম না। আবার মাঝিকে প্রশ্ন করলাম, ‘গুহা ভর্তি সোনা। ভাইকিং বা দক্ষিণবাসী বা এমন কেউ রেখে গিয়েছে, যারা এখানে আমাদের জন্মের অনেক আগে বাস করত। যারা নতুন লোক এখানে এলে পালিয়ে গিয়েছিল আরও পশ্চিমে।’

‘শুনেছি,’ জবাব দিল মাঝি। ‘অভিশাপের কথাও জানি। তাই লোভটা সামলে রেখেছি।’ সমুদ্রে থু থু ফেলল সে, ‘আপনি সৎ লোক, ক্ষুদে মানুষ; দেখেই বোঝা যায়। গুহায় না যাওয়াই উত্তম। ওখান থেকে ভাল কিছু আশা করা বৃথা।’

‘আমারও তাই মনে হয়।’ বললাম ওকে।

‘আপনার তো মনে হয়, আর আমি নিশ্চিত।’ বলল সে, ‘কেননা, সবদিন আমি একটা চোরাচালানকারী আর একজন ক্ষুদে মানুষকে দ্বীপে নিয়ে যাই না। পৃথিবীর এই দিকটায় একটা কথা প্রচলিত—যারা পশ্চিমে চলে গিয়েছে, তাদের ব্যাপারে কথা না বলাই শ্রেয়।’

বাকি পথটুকু বিনাবাক্য ব্যয়ে কাটিয়ে দিলাম। পথটা শেষের দিকে একটু বিপদ- সংকুল হয়ে উঠেছিল। ঢেউ বাড়ছিল, বার বার এসে বাড়ি খাচ্ছিল নৌকার সাথে। দুই হাত দিয়ে নৌকাটাকে আঁকড়ে ধরতে হয়েছিল শেষে মেষ। নাহলে হয়তো সাগরে পড়ে যেতাম।

মনে হচ্ছিল প্রায় এক যুগ ধরে চলার পর, অবশেষে নৌকা এসে থামল কুয়াশাছন্ন দ্বীপে; কালো পাথরে বানানো একটা জেটিতে। জেটি ধরে এগোলাম, ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল আমাদের আশেপাশে। লোনা পানি এসে ছোবল বসাচ্ছে মুখে, চেহারায়। পিঠে কুঁজঅলা এক লোক বসে বসে ওট কেক আর বরই বিক্রি করছে। শুকিয়ে পাথর হয়ে আছে যেন ওগুলো। এক পেনি খরচ করে পকেট ভর্তি করে নিয়ে নিলাম।

এরপর ঢুকে পড়লাম কুয়াশা-ঘেরা দ্বীপের ভেতরে।

বয়স আমার কম হয়নি। তাই যাই দেখি না কেন, কোন না কোন কিছুর কথা মনে পড়ে যায়। বলা বাহুল্য—সবই কেন যেন পরিচিত মনে হয় আমার। বয়সের দোষ, অন্য কিছুর প্রতিবিম্ব দেখতে পাই সবকিছুর ভেতরেই।

তবে কুয়াশা-ঘেরা দ্বীপের কথা আলাদা, যে দ্বীপটাকে অনেকে উড়ন্ত দ্বীপও বলে। এখানকার অভিজ্ঞতা এর আগে কখনো হয়নি। পরেও সম্ভবত হবে না।

জেটি থেকে কালো পাহাড়ে পৌঁছুতে প্রায় এক দিন লেগে যায়।

ক্যালাম ম্যাকইনেস আমার দিকে একবার তাকিয়ে লম্বা-লম্বা পায়ে হাঁটা শুরু করল। আমি আকারে ওর অর্ধেক হব, তাও টেনে-টুনে। তাই এ কাজটাকে মনে হলো ওর তরফ থেকে ছুঁড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জ। লম্বা-লম্বা পায়ে এগিয়ে চলল ক্যালাম, পায়ের নিচে পড়ছে ফার্ণ আর হেদার। পাত্তাই পাচ্ছে না।

মাথার উপরে ভেসে বেড়াচ্ছে মেঘ। ধুসর আর সাদা আর কালো। এই লুকাচ্ছে একে অন্যের পিছনে, আবার এই উঁকি দিচ্ছে।

আমার সামনে হাঁটতে দিলাম ওকে। বৃষ্টিতে হাঁটছে সে। যতক্ষণ পর্যন্ত না ভেজা, ধুসর ধোঁয়ায় হারিয়ে গেল, ততক্ষণ পর্যন্ত দৌড়ালাম না।

এই ব্যাপারটা আমি সবার কাছ থেকে গোপন করে রেখেছি। কেবল মোরাগ, আমার বউ; জনি আর জেমস, আমার ছেলেরা; আর ফ্লোরা আমার মেয়ে (ছায়ারা ওর আত্মাকে শান্তি দিক) জানে। আমি দৌড়াতে পারি। আর বেশ ভালই পারি। যদি চাই তাহলে যে-কোন পূর্ণ আকৃতির পুরুষের চেয়ে জোরে আর বেশিক্ষণ ধরে দৌড়াতে পারি। সেভাবেই দৌড়ালাম, কুয়াশা আর বৃষ্টি ভেদ করে।

ক্যালাম অনেকটা সামনে চলে গিয়েছিল। কিন্তু খুব দ্রুতই দেখতে পেলাম ওকে। দৌড়ে পারও হয়ে গেলাম। এখন আমরা উঁচু একটা জায়গায়। আমাদের মাঝে এখন শুধু একটা শৈল-পার্শ্ব। নিচে একটা ঝর্ণাধারা আছে। আমি না থেমে দিনের পর দিন দৌড়াতে পারি। আমার অনেকগুলো গোপন বৈশিষ্ট্যের একটা।

দ্বীপে নেমে প্রথম রাতে ক্যাম্প কোথায় করব, সেটা অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছি আমরা। ক্যালাম জানিয়েছে, প্রথম রাতটা আমরা কাটাব একটা পাথরের নিচে। পাথরটাকে সবাই ম্যান অ্যাণ্ড ডগ (মানুষ ও কুকুর) বলে ডাকে। কারণ প্রথম দেখায় মনে হয় যেন, একজন বৃদ্ধ লোক তার কুকুর নিয়ে বসে আছে। বিকাল ঘনিয়ে এলে পৌঁছালাম সেখানে। পাথরের নিচে থাকার মতো জায়গা আছে। সুরক্ষিত আর শুকনো। আগেরবার যারা ছিল, তারা আমাদের জন্য আগুন ধরাবার কাঠ রেখে গিয়েছে। আগুন ধরিয়ে জামা কাপড় শুকিয়ে নিলাম। মনে হলো, হাড় থেকে যেন কেউ ঝেঁটিয়ে বিদায় করল ঠাণ্ডা। ধোঁয়া ছড়িয়ে পরেছে চারিদিকে।

ক্যালাম আসতে আসতে রাত হয়ে গেল। আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল সে, যেন ভেবেছিল মাঝরাতের আগে আমি পৌঁছাতেই পারব না। বললাম, ‘এত সময় লাগল যে, ক্যালাম ম্যাকইনেস?’

চুপ করে রইল সে, আমাকে দেখছে শুধু। বললাম, ট্রাউট ধরেছি। পাহাড়ের পানিতে সিদ্ধ করা হয়েছে। তোমার ঠাণ্ডা হাড়গুলোকে গরম করার জন্য আগুনের ব্যবস্থাও করা হয়ে গিয়েছে।’

উত্তরে কেবল মাথা নাড়ল সে। ট্রাউট খেলাম আমরা, পান করলাম হুইস্কি। পাথরের ঠিক গা ঘেঁষে এক স্তূপ হেদার আর ফার্ণ জড়ো করা। শুকনো, নরম পাতার স্তূপে ঘুমালাম আমরা। তা-ও ভেজা আলখেল্লা গাঁয়ে পেঁচিয়ে নিতে হলো।

মাঝরাতের দিকে ঘুম ভেঙে গেল আমার, গলায় হিমশীতল ইস্পাতের স্পর্শে।  তবে সৌভাগ্যের কথা হলো, ছুরির ভোঁতা দিকটা গলায় ধরা, ধারালোটা না। ‘ক্যালাম ম্যাকইনেস, রাতের আঁধারে আমাকে খুন করার ইচ্ছা হলো কেন? আমাদের পথ অনেক লম্বা, যাত্রা এখনো ফুরায়নি।’

উত্তরে বলল, ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না, ক্ষুদে মানুষ।’

‘আমাকে বিশ্বাস করার দরকার নেই।’ বললাম আমি, ‘কিন্তু আমি যাদের হয়ে কাজ করি, তাদেরকে বিশ্বাস করলেই ভাল করবে। কেননা তারা জানে আমি কার সাথে এসেছি। যদি তুমি আমাকে ছাড়া ফিরে যাও, তাহলে ছায়ারা পর্যন্ত তোমার পিছু নেবে।’

ঠাণ্ডা ইস্পাতটা সরানোর কোন লক্ষণ দেখতে পেলাম না। ক্যালাম জানতে চাইল, ‘আমার আগে এখানে কীভাবে পৌঁছালে?’

‘ভাবতে অবাক লাগছে, এই আমি কি না তোমার মতো লোকের জন্য আগুন ধরিয়েছি? মাছ রান্না করেছি? আমি লোকটা কম চালু নই। আর আজকে তুমি যা করেছ, গাইড হিসেবে তা একেবারেই উচিত হয়নি। এখন দয়া করে খঞ্জর সরিয়ে আমাকে ঘুমাতে দাও।’

এবারও কিছু বলল না ক্যালাম। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পর ঠিকই সরিয়ে নিল খঞ্জর। দীর্ঘশ্বাস ফেলার সাহস হলো না। মনে মনে প্রার্থনা করলাম, আমার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি যেন শুনতে না পায়। ও আরও একটা ব্যাপার, সে রাতে চোখ এক করার সাহস হলো না।

সকালে নাস্তার জন্য পরিজ রান্না করলাম, নরম করার জন্য তাতে যোগ করলাম কিছু বরই।

পাহাড়গুলো সাদা আকাশে পটভূমিতে দেখতে কালো ধুসর বলে মনে হচ্ছিল। ঈগল দেখতে পেলাম আমরা, বিশাল একেকটা। বড় বড় পাখাগুলো মেলে দিয়ে আমাদের মাথার উপর উড়ছে। আজকে ক্যালাম গতকালের তুলনায় অনেক আস্তে হাঁটছে। তাল মেলাতে কোন কষ্ট হচ্ছে না। ওর একেক পদক্ষেপ এর জন্য আমাকে দু’বার করে পা ফেলতে হচ্ছে শুধু।

‘আর কতদূর?’ জিজ্ঞেস করলাম ওকে।

‘আরও এক দিনের পথ। সময় বেশি লাগলে দুই দিন। আবহাওয়ার উপর নির্ভর করছে। যদি মেঘ নিচে নেমে আসে, তাহলে এমনকি তিন দিনও …’

মেঘ দুপুর নাগাদ নিচে নেমে এল, আশপাশের পৃথিবীকে যেন মুড়িয়ে কুয়াশার চাদরে দিল। বৃষ্টির চেয়েও খারাপ এই কুয়াশা: বাতাসে পানি ভাসছে। প্রথমে আমাদের কাপড় ভেজালো। এরপর স্পর্শ করল আমাদের চামড়া। পায়ের নিচের পাথরগুলো হয়ে গেল পিচ্ছিল আর বিপজ্জনক। ক্যালাম আর আমি, আমাদের হাঁটার গতি কমিয়ে দিলাম। দেখে-শুনে পা ফেলছি এখন। পাহাড়ে হেঁটে উঠছি, বাইতে হচ্ছে না। হাঁটছি তো হাঁটছিই। কখনো পিছলে যাচ্ছি, কখনো বা হুমড়ি খেয়ে পড়ছি। কিন্তু কুয়াশার মাঝেও ক্যালাম পথ হারায়নি। আমি কাছ থেকে অনুসরণ করলাম ওকে।

পথে একটা ঝর্ণা পড়ল। আমাদের পথের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে। খুব একটা বড় না, আবার একেবারে ছোটও না। কাঁধ থেকে দড়িটা হাতে নিল ক্যালাম, বাঁধল একটা পাথরের সাথে।

‘এটা তো আগে এখানে ছিল না,’ আমাকে বলল সে। ‘আমি প্রথমে যাচ্ছি।’ দড়ির অন্য মাথা নিজের কোমরের সাথে বেঁধে নিল সে। খুব ধীরে আর সাবধানতার সাথে ঝর্ণার পানিতে পা ফেলল। আস্তে আস্তে এগোল পানির মাঝ দিয়ে।

ভয় পাচ্ছিলাম, চিন্তিতও হচ্ছিলাম ওর জন্য। আমার জন্যও, দম বন্ধ হয়ে এসেছে কখন-টেরই পাইনি। ঝর্ণাটা ক্যালাম পার হলে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। দড়ির বাঁধন টেনে পরীক্ষা করল সে। এরপর ইঙ্গিতে আমাকে আসতে বলল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে পায়ের নিচের একটা পিচ্ছিল পাথরে পা পড়ল ক্যালামের, খাদের ভেতর পড়ে গেল।

ভাগ্য ভাল যে দড়িটা ছেঁড়েনি। এপাশের পাথরটাও উপড়ায়নি। ক্যালাম ম্যাকইনেস দড়ির অন্য মাথায় বাঁধা অবস্থায় ঝুলছে। চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল সে, দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। নিজেকে আগে স্থির করে নিলাম, এরপর গাল বকতে বকতে টেনে তুললাম ভারী মানুষটাকে।

উপরে তোলার পর ক্যালাম বলল, ‘দেখে মনে হয় না তুমি এতটা শক্তিশালী।’ নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই গাল দিলাম। চেহারা দেখে ক্যালাম সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল যে কী ভাবছি। কুকুরের মতো করে গা ঝাড়া দেবার পর বলল, ‘আমার ছেলে, ক্যালাম তোমার কথা বলেছিল। তুমি ওকে যে গল্পটা শুনিয়েছ, সেটা I ক্যাম্পবেলরা তোমার খোঁজে এসেছিল। তোমার স্ত্রী তোমাকে কায়দা করে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ওরা বুঝতেও পারেনি। মহিলাকে ভেবেছিল মা, আর তোমাকে তার ছেলে।’

‘গল্প গল্পই।’ বললাম আমি, ‘সময় কাটাবার জন্য গল্প করা আরকি।’

‘তাই?’ বিদ্রূপের সুরে বলল ক্যালাম, ‘আমি কিন্তু এই গল্প আগেও শুনেছি। ক্যাম্পবেলরা একটা দলের গল্প! বেশ কয়েক বছর আগের কথা, উদ্দেশ্য ছিল ওদের গরু চুরি করেছে এমন একজনকে পাকড়াও করা। বের হয়েছিল সেই দল, কিন্তু ফিরে আসেনি আর। যদি তোমার মতো ছোট এক মানুষ বারো জন ক্যাম্পবেলকে হত্যা করতে পারে, তাহলে তো… তুমি অবশ্যই শক্তিশালী, আর খুব দ্রুত।’

আমি আসলে বোকা, হতাশ হয়ে ভাবলাম। ছেলেটাকে এই গল্প বলার কী দরকার ছিল!

একজন একজন করে খুন করেছি ওদেরকে, যেমন করে খরগোশ শিকার করি। প্রস্রাব করার জন্য বের হলে খুন করেছি, খুন করেছি প্রথম কেন ফিরছে না-তা দেখতে এলেও! আমার স্ত্রী প্রথম খুনটা করার আগেই, সাত জনকে পরপারে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। গিরি-সংকটে কবর দিয়েছিলাম ওদের। পাথর চাপা দিয়ে দিয়েছিলাম কবরের উপর, যেন ওদের আত্মা বেরোতে না পারে। চিন্তিতও কম হইনি, ক্যাম্পবেলরা আমাকে মারার জন্য এতদূর পর্যন্ত চলে এসেছে! মানুষ খুন করতে ভাল লাগে না, কিন্তু সেদিন বাধ্য হয়েছিলাম।

কোন মানুষেরই খুন করতে ভাল লাগা উচিত না, না পুরুষের না নারীর। মাঝে মাঝে মৃত্যু প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু খুন সব সময় শয়তানী কাজ। এই কালো পাহাড়ে যা ঘটেছে, তার পরও আমি একথা বলি আর বিশ্বাস করি।

ক্যালাম ম্যাকইনেসের হাত থেকে দড়িটা নিলাম আমি। ঝর্ণা ধরে বেয়ে উঠলাম খুব সহজে। খুব সরু একটা জায়গা খুঁজে পেলাম চূড়ায়। পার হতে কোন কষ্টই হলো না। পিচ্ছিল হলেও, পা হড়কায়নি। ভাল একটা জায়গা খুঁজে দড়িটা বাঁধলাম, এর পর নিচে নেমে ক্যালামকে পথ দেখিয়ে উপরে নিয়ে এলাম।

ধন্যবাদ আশা করিনি, পেলামও না। ওকে উদ্ধার করার জন্যও না, ঝর্ণা পার হবার রাস্তা খুঁজে বের করার জন্যও না। তবে যা বলল, সেটা মনে হয় না আমি কোনদিন ভুলতে পারব, ‘তুমি কোন পূর্ণাঙ্গ মানুষ নও, দেখতেও বাজে। তোমার স্ত্রী- ও কি তোমার মতোই খাট আর কুৎসিত?’

অপমানিতবোধ করব না বলে সিদ্ধান্ত নিলাম, তা ক্যালাম আমাকে অপমান করতে চাক বা না চাক। বললাম, ‘না। আমার স্ত্রী লম্বা একজন ভদ্রমহিলা। প্রায় তোমার সমান হবে। কম বয়সে তাকে নিচু ভূমির সবচেয়ে সুন্দর একজন বলে মনে করা হত। চারণ কবিরা তার সবুজ চোখ আর লম্বা লালচে-সোনালি চুলকে নিয়ে গান বাঁধত।’

মনে হলো, কথাটা শুনে মুখ কুঁচকে ফেলেছে। কিন্তু আমার ভুলও হতে পারে। অথবা হয়তো তাই দেখতে চেয়েছিলাম বলে দেখেছি।

‘কীভাবে পটালে?’

সত্যি কথাটাই বললাম, ‘আমি তাকে চেয়েছিলাম। আর আমি যা চাই, তা পাই। হাল ছাড়ি না। আমার স্ত্রী বলে, আমি জ্ঞানী আর দয়ালু। যদি সবসময় তাকে দেখে রাখি, তাহলে কোন অসুবিধা নেই। আমি দেখে রেখেছি।’

মেঘ আরও নিচে নেমে আসা শুরু করেছে। পৃথিবী আবারও ঝাপসা হয়ে আসছে। ‘সে এ-ও বলে, আমি বাবা হিসেবে ভাল। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি আমার ছেলে মেয়েদেরকে ভালভাবে বড় করতে। ওরাও, তোমার অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি, আকারে স্বাভাবিক।’

‘আমি ক্যালামকে পিটিয়ে শিখাই,’ বড় ক্যালাম বলল। ‘ছেলে হিসেবে বেশ ভাল আর অনুগত সে।’

যতক্ষণ তোমার ধারে-কাছে থাকবে, ততক্ষণ এভাবে শেখাতে পারবে।’ বলেই চুপ করলাম। মনে পড়ে গেল সেই বিশাল বছরটারও কথা, সেই সাথে ফ্লোরাকে। যখন সে বড় হয়নি, মেঝেতে বসে বসে খাচ্ছে। জ্যাম লেগে আছে মুখে। চোখ তুলে আমাকে এমনভাবে দেখছে যেন, আমিই বিশ্বের সবচেয়ে জ্ঞানী লোক!

‘পালিয়ে যাবে ভাবছ? আমি গিয়েছিলাম। তখন বয়স ছিল বেশি হলে বারো। পানির ওই পাশে রাজার সভা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। বর্তমান রাজার বাবা ছিল তখন ক্ষমতায়।’

‘সবাই এই কথা স্বীকার করার সাহস পায় না

‘আমি ভীতু নই।’ বলল সে, ‘আর শুনছেই বা কে? ঈগল? আমি দেখেছি রাজাকে। মোটা এক ব্যক্তি। তবে বিদেশিদের ভাষা খুব ভাল জানত, যদিও আমাদের ভাষা খুব একটা ভাল জানত না! কিন্তু তারপরও সে আমাদের রাজা।’ বিরতি দিল সে, যদি আর কখনো আমাদের কাছে ফিরে আসে তাহলে আসবে সোনার জন্য। যাতে সেগুলো ব্যবহার করে নৌকা, অস্ত্র আর তার সৈন্যদলের জন্য খাবার কিনতে পারে।

বললাম, ‘আমিও তাই মনে করি। এ জন্যই গুহায় যাচ্ছি।’

উত্তরে বলল, ‘কিন্তু ওই সোনা অভিশপ্ত। বিনামূল্যে ওটা পাওয়া যাবে না। দাম দিতে হবে।’

‘কোন জিনিসটার দাম দিতে হয় না?’

যাত্রাপথের প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন মনে রাখলাম আমি: ভেড়ার খুলির মতো দেখতে জায়গাটা, প্রথম তিনটা সরু ঝর্ণা পার হবার জায়গা, এরপর চতুর্থটার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে পাঁচটা বিশেষভাবে জড়ো করে রাখা পাথর-কিছুই বাদ গেল না।

এমনভাবে মুখস্থ করে নিলাম সবকিছু যেন চাইলে একাই ফিরে যেতে পারি। যে জিনিসটা আমাকে ভোগালো তা হলো কুয়াশা।

পাহাড়ের অনেক উঁচুতে একটা হ্রদে এসে উপস্থিত হলাম আমরা। পরিষ্কার পানি পেলাম, বিশাল সাদা সাদা কিছু প্রাণীও ধরতে পারলাম। দেখতে কেমন জানি-চিংড়ি, লবস্টার বা ক্যাটফিশের মতো হলেও, আসলে এগুলোর কোনটিই না। রান্না না করেই খেলাম ওগুলোকে। রান্না করব কীভাবে? এত উঁচুতে আগুন ধরাবার মতো কাঠ পেলে তো।

পাশেই শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে নিলাম কিছুক্ষণ। সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভাঙল, পৃথিবী এখনও ধুসর আর নিল। মেঘ ঘিরে রেখেছে আমাদেরকে।

‘ঘুমের মাঝে কাঁদছিলে।’ বলল ক্যালাম।

‘স্বপ্ন দেখেছি।’ জানালাম ওকে।

‘আমি বাজে স্বপ্ন দেখি না।’ বলল ক্যালাম।

‘বাজে স্বপ্ন দেখিনি।’ বললাম। কথাটা সত্যি। স্বপ্নে দেখেছি, ফ্লোরা এখনো বেঁচে আছে। গ্রামের ছেলেদের নামে বিচার দিচ্ছে। পাহাড়ে গরু নিয়ে যাবার সময় কী কী হয়েছে, তা বলছে আমাকে। হাসছে সেই মনোমুগ্ধকর হাসি। লালচে-সোনালি চুলগুলো দোল খাচ্ছে হাসির সাথে সাথে। চুলগুলো ওর মায়ের মতোই, যদিও এখন মোরাগের চুলে পাক ধরেছে।

‘ভাল স্বপ্ন দেখে কোন পুরুষের ওভাবে কাঁদার কথা না।’ বলল ক্যালাম। একটু বিরতি দিয়ে বলল, ‘আমি কোন স্বপ্নই দেখি না। ভাল বা মন্দ, কোনটাই না।’

‘তাই?’

‘ছোট বেলায় দেখতাম, এখন আর দেখি না।’

দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা, রওনা দেবার জন্য তৈরি। হঠাৎ একটা কথা মাথায় এল, ‘গুহায় ঢোকার পর থেকে তোমার স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়েছে?’

উত্তর দিল না ক্যালাম। পাহাড়ের ধার ধরে হাঁটলাম সেদিন, ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছি কুয়াশার আরো ভেতরে। সূর্য উঠি উঠি করছে।

সূর্যের আলো ঘন হবার সাথে সাথে যেন কুয়াশাও ঘন হচ্ছে। বুঝতে পারলাম, এটা আসলে কুয়াশা না, মেঘ। পৃথিবী যেন জ্বলছে। মনে হলো, আমার সামনে একটা ছায়া দেখতে পেলাম। দেখতে আমারই মতো, আমারই আকারের। যেন কোন ভূত বা দেবদূত। আমি নড়লে নড়ছে, হাঁটলে হাঁটছে। সমস্যা হলো, ঠিক কতটুকু দূরে আছে তা বলতে পারছিলাম না। আমি অলৌকিক ব্যাপার ঘটতে দেখেছি, বাজে জিনিসও কম দেখিনি। কিন্তু এমন জিনিস এই প্রথম।

‘জাদু নাকি?’ আপন মনে বলে উঠলাম, যদিও বাতাসে জাদুর কোন গন্ধ পাচ্ছি না। ক্যালাম বলল, ‘এসব তো কিছুই না। আলোর ধর্ম। ছায়া, প্রতিবিম্ব। আমিও আমার পাশে একজনকে দেখতে পাচ্ছি।’ আমি ফিরে তাকালাম ওর দিকে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।

এক সময় ছোট মানুষটা হারিয়ে গেল, সেই সাথে মেঘও। দিন শুরু হয়ে গিয়েছে, আমরা এখন একা।

সারাদিন লাগিয়ে উপরে উঠলাম। গতকাল পিছলে পড়ে, ক্যালাম পায়ে ব্যথা পেয়েছে। এখন ফুলে ঢোল হয়ে আছে। লাল বর্ণ ধারণ করেছে। কিন্তু অবাক বিষয়, এক মুহূর্তের জন্যও তার গতি কমল না। ব্যথা যদি পেয়েও থাকে, চেহারায় তার কোন ভাব দেখতে পেলাম না।

জানতে চাইলাম, ‘আর কতদূর?’ ততক্ষণে সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে।

‘বড়জোর এক ঘণ্টা হবে। গুহায় পৌঁছে আমরা রাতটা বিশ্রাম নেব। তুমি গুহায় ঢুকতে চাইলে দিনের আলোয় ঢুকবে। যত চাও সোনা নিয়ে আসতে পার, তারপর আমরা ফেরার পথ ধরব।

ওর দিকে তাকালাম আমি-পাক খাওয়া চুল, ধূসর চোখ, আকারে বিশাল আর নেকড়ের মতো দেখতে মানুষ। বলল, ‘গুহার বাইরে ঘুমাবে?’

‘হ্যাঁ। গুহায় কোন দানব নেই যে তোমাকে বা আমাকে খেতে আসবে। কিন্তু তা- ও, দিনের আলো না ফুটলে গুহায় প্রবেশ করা ঠিক হবে না।’

এক ঘণ্টা পর, পথের বাঁকে কিছু পাথর দেখতে পেলাম। বাঁক ঘুরতেই নজরে এল গুহামুখ।

‘এ-ই?’

‘তুমি কি মার্বেল দিয়ে বানানো পিলার আশা করেছিলে? নাকি বিশাল কোন গুহা?’

‘আলাদা কিছু একটা আশা করেছিলাম।’ স্বীকার করলাম আমি, ‘দেখে তেমন বিশেষ কিছু মনে হয় না। পাহাড়ের দেয়ালে একটা গর্ত শুধু। কোন প্রহরী নেই?

‘নাহ। যা দেখছ-তাই।’

‘গুপ্তধন ভর্তি গুহা! আর তুমি ছাড়া কেউ খুঁজে পাবার রাস্তা জানে না!

ক্যালাম কাশল, যেন কোন শিয়াল খেঁকিয়ে উঠল। ‘দ্বীপবাসীরা জানে। কিন্তু এও জানে, এখানে আসা উচিত না। সোনায় হাত লাগানোও বিপদ বয়ে আনতে পারে। ওরা বলে, এই গুহা মানুষকে পরিবর্তন করে দেয়। ভাল লোক মন্দ মানুষ হয়ে যায়। মন্দ মানুষ আরও মন্দ। এখানে ঢুকলে সোনা পাবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার দাম চুকাতে হবে আত্মার একটা অংশ দিয়ে।

‘কথাটা কি সত্যি? আসলেই মন্দ লোক বানিয়ে ফেলে?’

‘…না। কিন্তু ঠিক আগের অবস্থায় ফিরিয়েও দেয় না। ভাল বা মন্দের কোন ব্যাপার না। সোনা নিতে কোন বাঁধা নেই। কিন্তু পরে সবকিছু কেমন জানি—’ বিরতি নিল সে—নিরস মনে হয়। রঙধনুর রঙ মনে হয় হালকা। সদুপদেশ তার ওজন হারিয়ে ফেলে। স্ত্রীর চুম্বনের মজা… .’ গুহামুখের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল সে। মনে হলো চোখে পানি দেখতে পেলাম, ‘হারিয়ে যায়।’

বললাম, ‘কারো কারো কাছে কিন্তু রঙধনুর রঙের চেয়ে সোনার মূল্য অনেক বেশি।’

‘এই যেমন আমি। অন্তত যখন যুবক ছিলাম। তুমিও আরেকজন।’

‘তাহলে সকালে ঢুকব আমরা?’

তুমি ঢুকবে। আমি এখানেই তোমার জন্য অপেক্ষা করব। ভয় পেয়ো না। গুহায় কোন দৈত্য বা দানব নেই। সোনা অদৃশ্য করে দেয়ার মতো কোন জাদু বাক্য নেই।’

ক্যাম্প ফেললাম। এরপর ঠাণ্ডা পাথুরে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইলাম। আজ রাতে আর ঘুম আসবে না।

নীরবতা ভাঙতেই যেন বললাম, ‘তুমি তো এখান থেকে সোনা নিয়েছ। আমি নেব কালকে। কাজে লাগিয়েছ ভালভাবেই। বিয়ে করেছ, বাড়ি বানিয়েছ, নামও কামিয়েছ।’

অন্ধকারে ভেসে এল ওর গলা, ‘হ্যাঁ। আর এসবের কোন মূল্য আমার কাছে নেই। আর যদি তোমার সোনা কাজে লাগিয়ে সমুদ্রের ওপারের রাজাকে এখানে নিয়ে আসো, তিনি যদি স্বর্গ রাজ্য প্রতিষ্ঠাও করেন, তাহলেও তোমার তাতে কিছু যাবে আসবে না। মনে হবে তুমি নও, অন্য কেউ করেছে এসব। গল্পের কোন চরিত্র।’

‘সারা জীবন ধরে চেষ্টা করছি রাজাকে ফিরিয়ে আনার জন্য।’ বললাম।

‘সোনা নিয়ে যাও, দেখবে তোমার রাজা আরো সোনা চাইছেন। কারণ, রাজাদের স্বভাবই এমন। প্রতিবার ফিরে আসবে এখানে, দেখবে জীবন একটু একটু করে অর্থ হারিয়ে ফেলছে। রঙধনু? অর্থহীন। কাউকে খুন করা? সে-ও অর্থহীন।’

এরপর অন্ধকার আর নীরবতা। কোন পাখির আওয়াজ পর্যন্ত নেই। শুধু বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ। মনে হচ্ছে, কোন শিশু হারানো মায়ের কান্নার আওয়াজ।

বললাম, ‘আমরা দু’জনেই পুরুষ খুন করেছি। আচ্ছা ক্যালাম, কখনো কোন মহিলাকে খুন করেছ?’

‘নাহ। কোন মহিলা বা মেয়েকে খুন করিনি।’

অন্ধকারে আমার খঞ্জরের উপর হাত বুলালাম। বাঁটটা কাঠ আর রুপা দিয়ে বানানো, দেহটা ইস্পাতের। হাতেই আছে, তবে সেটা ক্যালামকে জানাবার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। এখান থেকে বের হবার পর ওকে আঘাত করতে চাই। একবারই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মুখ দিয়ে কথাগুলো আপনাআপনি বের হয়ে আসছে। ‘শুনেছি তুমি নাকি এক মেয়েকে খুন করেছ।’ বললাম ওকে, ‘একটা কাঁটাঝোপের…’

নীরবতা। বাতাসের সোঁ সোঁ আওয়াজ। ‘তোমাকে কে বলেছে?’ প্রশ্ন করল। এরপর, বাদ দাও। আমি কোন মেয়েকে খুন করিনি। আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন কোন পুরুষ কখনো খুন করতে পারে না…

জানতাম—এখন যদি আর একটাও কথা বলি, তাহলে ওর মুখ খোলানো যাবে না। তাই চুপ করে রইলাম।

ক্যালাম ম্যাকইনেস বলতে শুরু করল। শব্দগুলো খুব সাবধানতার সাথে উচ্চারণ করছে। এমনভাবে কথা বলছে যেন ছোট বেলার ভুলে যাওয়া কোন গল্প শোনাচ্ছে। ‘শুনেছিলাম, নিচু ভূমির গরুর পাল খুব নাদুস-নুদুস হয়। দক্ষিণের নিচু ভূমিতে অভিযান চালিয়ে এমন নাদুস-নুদুস গরুর পাল নিয়ে ফিরতে পারাটা খুব সম্মান আর সাহসের কাজ বলে ধরা হত। তাই আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম-দক্ষিণে যাব। কিন্তু অনেক খুঁজেও নাদুস-নুদুস কোন গরু দেখতে পেলাম না। ফেরার পথে নজরে পড়ল এক পাল গরু। আমার দেখা সবচেয়ে মোটা, লাল আর সেরা; চুরি করে ফেললাম সেই পাল।

‘বিশ্বাস করবে না, হাতে একটা লাঠি নিয়ে মেয়েটা আমার দিকে দৌড়ে এসেছিল! গরুগুলো আমার বাবার-বলেছিল দৃঢ় কণ্ঠে। আমাকে চোর, ডাকাত, বাটপারসহ আরও অনেক কিছু বলে গালিও দিয়েছিল। কিন্তু রাগান্বিত অবস্থায়ও দেখতে খুবই সুন্দর লাগছিল মেয়েটাকে। নিজের ঘরে যদি যুবতী স্ত্রী না থাকত, তাহলে হয়তো আরও নরম ব্যবহার করতাম ওর সাথে। কিন্তু সেদিন ছুরিটা বের করে গলায় ধরেছিলাম, আদেশ দিয়েছিলাম চুপ করতে। কথা শুনতে দ্বিধা করেনি।

‘আমি তো আর কোন মেয়ে মানুষকে খুন করতে পারি না-সত্যি বলছি-তাই বেঁধে রেখেছিলাম মেয়েটাকে। একটা কাঁটাঝোপের সাথে। তা-ও ওর নিজের চুল দিয়ে। কোমর থেকে ছুরিটা খুলে ফেলে দিয়েছিলাম দূরে, যেন তাড়াতাড়ি নিজেকে ছাড়াতে না পারে। বাঁধার পর আর দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাইনি। গরু নিয়ে চলে এসেছিলাম।

‘এর প্রায় এক বছর পরের কথা। ওদিক দিয়েই যাচ্ছি। তবে এবার আর গরু চুরি করতে নয়। জায়গাটা ঠিক পথের উপরে না, নিরিবিলি। জানা না থাকলে, কেউ ওদিকে খুঁজতেও যাবে না। হয়তো তাই হয়েছিল।’

‘শুনেছি খুব খোঁজা হয়েছিল মেয়েটাকে।’ বললাম আমি, কেউ কেউ বলেছিল ওকে চোরাচালানকারীরা অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেছিল, হয়তো কারও সাথে পালিয়ে গিয়েছে। হয়তোবা শহরে পালিয়েছে। কিন্তু তা-ও, খুঁজেছিল মেয়েটিকে।’

‘হুম। আমিও দেখেছি, আমার কাজ কী ফল বয়ে এনেছে। হয়তো ঠিক যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানে না দাঁড়ালে কেউ দেখতেও পেত না। হয়তো…খুব খারাপ একটা কাজ করে ফেলেছিলাম।’

‘হয়তো?’

‘এই গুহা থেকে সোনা নিয়েছি আমি। এখন আর জানি না, কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ। তাও একটা বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে কাছের এক সরাইখানায় খবর পাঠিয়েছিলাম। জানিয়েছিলাম, মেয়েটাকে কোথায় পাওয়া যাবে।’

চোখ মুদলাম আমি, কিন্তু রাত এখানে এতটাই অন্ধকার যে কোন পার্থক্য টের পেলাম না।

‘ভাল আর মন্দের মাঝে পার্থক্য আছে।’ বললাম।

মনের চোখে যেন দেখতে পেলাম সবকিছু-মেয়েটার কঙ্কাল থেকে কাপড় খসে পড়েছে, হাড় থেকে মাংস। যেভাবে আছে, তার চেয়ে নগ্ন আর সাদা আর কেউ হতে পারবে না। বাচ্চা কোন মেয়ের খেলার পুতুলের মতো ঝুলছে ঝোপ থেকে। লালচে-সোনালি চুল দিয়ে বাঁধা।

‘সূর্যের আলো ফুটলে,’ ক্যালাম ম্যাকইনেসের কথায় সম্বিত ফিরল। ও এমনভাবে কথা বলছে, যেন এতক্ষণ ধরে আমাদের মাঝে খাবার-দাবার বা আবহাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছিল। ‘খঞ্জরটা এখানে রেখে যাবে। কারণ এটাই এখানকার রীতি। গুহায় ঢুকে যতটা পার সোনা নিয়ে আসবে। মেইন ল্যাণ্ড পর্যন্তও তোমাকেই বইতে হবে সে সোনা। এখানে এমন কোন পাগলকেও খুঁজে পাবে না, যে ওই সোনায় হাত লাগাবে। রাজাকে পাঠিয়ে দিয়ো। তিনি ওই সোনা ব্যবহার করে অস্ত্র কিনবেন, তার সেনাদের খাওয়াবেন। এরপর এক দিন ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে। সেদিন, ক্ষুদে মানুষ, আমাকে ভাল আর মন্দের পার্থক্য বুঝিয়ো।’

***

সূর্য উঠলে গুহায় প্রবেশ করলাম আমি। ভিতরটা স্যাঁতস্যাঁতে। দেয়াল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ার আওয়াজ কানে এল, মুখে অনুভব করলাম বাতাসের স্পর্শ। আশ্চর্যের বিষয়, কেননা পাহাড়ের ভেতরে বাতাস আসার কথা না।

মনে করেছিলাম, গুহাটায় থরে থরে সাজানো থাকবে সোনা। একদিন থাকবে সোনার ইট, অন্যদিকে সোনার পয়সা। সোনার চেন আর আংটিও থাকবে। আর সোনার প্লেট, এমনভাবে সাজানো থাকবে যেমনটা চায়না প্লেট সাজানো থাকে ধনীর ঘরে।

অনেক ধন সম্পদের কথা কল্পনা করেছিলাম, কিন্তু পেলাম কী? শুধু ছায়া, আর পাথর।

তবে কিছু একটা আছে এখানে, অপেক্ষা করছে।

আমার অনেক গোপন কথা আছে। কিন্তু এমন একটা গোপন কথা আছে, যা আর কেউ জানে না। এমনকি আমার ছেলেরাও না। তবে, মোরাগ সম্ভবত আঁচ করতে পারে। গোপন কথাটা হলো-আমার মা ছিলেন এক মরণশীল মানবী, এক মিলের মালিকের মেয়ে। কিন্তু আমার বাবা তার কাছে এসেছিলেন পশ্চিম থেকে। ফিরেও গিয়েছেন পশ্চিমে। তবে আমার তা নিয়ে মন খারাপ হয় না। আমি জানি, বাবা আমার মায়ের কথা একেবারেই ভাবেন না। আমার অস্তিত্ব সম্পর্কেও জানেন কি না সন্দেহ। কিন্তু তার জন্যই আমার দেহ ছোট, দ্রুত আর শক্তিশালী; হয়তো আরও অনেক বৈশিষ্ট্যও পেয়েছি তার কাছ থেকে, যার সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই নেই। আমি কুৎসিত, কিন্তু মার মতে বাবা ছিলেন সুদর্শন।

আমার কেন যেন তা মনে হয় না।

মাঝে মাঝে ভাবি, আমার বাবা যদি নিচু ভূমির কোন সরাই মালিক হতেন—তাহলে আমি গুহায় কী দেখতে পেতাম?

সোনা দেখতে পেতে, ফিস ফিস করে বলল কেউ। পাহাড়ের গভীর থেকে ভেসে এল আওয়াজ। একাকী, বিরক্ত আর অন্যমনস্ক মনে হলো সেই গলার মালিককে

‘সোনা দেখতে পেতাম!’ উঁচু স্বরে বললাম, ‘আসল সোনা? নাকি নকল?’

ফিসফিসানি গলাটা শুনে মনে হলো মজা পেয়েছে। তুমি মরণশীল মানুষের মতো করে ভাবছ। ভাবছ হয় এমন হবে আর না হলে অমন। এমন মানুষ সোনা দেখতে পেত, ধরতে পারত। নিজের সাথে নিয়েও যেতে পারত। চাইলে অন্যান্য মরণশীলদের সাথে বিনিময়ও করতে পারত। আসল হলেই বা কী আর নকল হলেই বা কী? ওরা চায় সোনা, আর আমি তা ওদেরকে দিয়ে দেই।

‘বিনিময়ে কি নাও তুমি?’

খুব সামান্য কিছু। আমার প্রয়োজন অতি অল্প আর আমি বৃদ্ধ; এতটাই যে আমার বোনকে অনুসরণ করে পশ্চিমে যাওয়া এখন অসম্ভব। তাই যারা এখানে আসে, তাদের আনন্দ আর হাসিতে ভাগ বসাই। অল্প পরিমাণে নিয়ে নেই এমন সব জিনিস যেগুলো ওদের কাছে অপ্রয়োজনীয়, যেগুলো ওদের কাছে মূল্যহীন। হৃদয়ের একটু অংশে কামড় দেই, বিবেকের খানিকটা চুষে খাই, আত্মার কিছু অংশ উপভোগ করি। আর তার বিনিময়ে আমার ক্ষুদ্র একটা অংশ ওদের সাথে গুহা থেকে বের হয়। ওদের চোখ দিয়ে দেখে পৃথিবীটাকে। ওরা মারা গেলে ফিরিয়ে আনি আমার অংশটুকু।

‘আমাকে তোমার স্বরূপ দেখাবে?’

অন্ধকারে যে-কোন মানব-মানবীর সন্তানের চেয়ে পরিষ্কার দেখতে পাই আমি। ছায়ায় কিছু একটার নড়া-চড়া তাই নজরে পড়ল। এরপর ছায়াগুলো গলে মিশে এক হয়ে গেল। পরিণত হলো আকারহীন বস্তুতে। ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্যতার শেষ মাথায় নিয়ে গেল আমাকে, যেখানে তা কল্পনার সাথে এক হয়ে যায়। ভয় পেয়ে গেলাম। তাই এমন পরিস্থিতিতে যে কথাটা বলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে তাই বললাম, ‘এমন এক রূপ নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হও, যেটা আমার কোন ক্ষতি করবে না।’

তোমার তাই ইচ্ছা?

দূরে কোথাও পানি পড়ার আওয়াজ শোনা গেল। ‘হ্যাঁ।’

ছায়ার ভেতর থেকে সে এগিয়ে এল আমার দিকে। চক্ষুহীন কোটর নিবদ্ধ করে দেখল আমাকে, আইভরির মতো হাত বের করে হাসল আমাকে দেখে। শুধু হাড়। তবে চুল আছে। লালচে-সোনালি। কাঁটাঝোপের ডালে বাঁধা

‘দৃশ্য আমার চোখের জন্য খুব একটা সুখকর নয়।’

তোমার মনের গহীন থেকে এই রূপটা বেছে নিয়েছি। কঙ্কালটাকে ঘিরে রাখা ফিসফিসানি জবাব দিল। চোয়াল এক বিন্দু নড়েনি। আমি বেছে নিয়েছি তোমার ভালবাসার একজনকে। এ কি ফ্লোরা, তোমার মেয়ে নয়? শেষ বার কি ওকে এভাবে দেখনি?

চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিন্তু আকৃতিটা যেন সেখানেই রইল।

বলল, চোরাচালানকারী তোমার জন্য ঠিক গুহার মুখে অপেক্ষা করছে। ভাবছে, যখন বের হবে তখন তুমি নিরস্ত্র; সোনার ভারে ক্লান্ত। তোমাকে খুন করে মৃত হাত থেকে সোনাগুলো কেড়ে নিতে চায় সে।

‘কিন্তু বের হবার সময় আমার সাথে তো সোনা থাকবে না, তাই না?’

ক্যালাম ম্যাকইনেসের কথা ভাবলাম। ওর চুলের ধুসর অংশ, চোখের রঙ আর খঞ্জরের স্পর্শ। আমার চেয়ে আকারে অনেক বড় লোকটি। তবে সত্যি বলতে, সবাই আমার চেয়ে বড়। কিন্তু আমি অনেক বেশি শক্তি ধরি, দ্রুততাও কম না।

লোকটা আমার মেয়েকে খুন করেছে, ভাবলাম আমি। এরপরই মনে একটা চিন্তা এল। এই ভাবনাটা কি আমার? নাকি ওই ছায়া থেকে এসেছে? জোর গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই গুহা থেকে বের হবার আর কোন রাস্তা নেই?’

যেভাবে এসেছ, সেভাবেই বেরোতে হবে। আমার ঘরের মুখ দিয়ে 1

চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। কিন্তু মন শান্ত নেই। সে ভেবে চলছে। নিজেকে ফাঁদে পড়া জন্তু মনে হলো। একের পর এক উপায় বের করে চলছি। কিন্তু কোনটাই মনে ধরছে না।

‘আমার কাছে কোন অস্ত্র নেই। ক্যালাম বলেছে অস্ত্রহীনভাবে গুহায় প্রবেশ করাই নাকি এখানকার রীতি।’

এখন এটাই রীতি। কিন্তু সবসময় ছিল না। আমাকে অনুসরণ করো, আমার মেয়ের কঙ্কাল বলল।

পিছু নিলাম তার, কেননা আশপাশে এতটাই অন্ধকার যে কেবল ওকেই দেখতে পাচ্ছিলাম।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর বলল, তোমার হাতের নিচেই আছে।

হাঁটু গেঁড়ে বসতেই, হাতে লাগল জিনিসটা। হাড়ের মতো মনে হলো—অথবা কোন হরিণের শিং। অন্ধকারে সাবধানতার সাথে জিনিসটায় হাত বুলালাম আমি। মনে হলো, হাতে যে জিনিসটা আছে সেটাকে ছুরি না বলে লম্বা সুঁই বলাই ভাল। একেবারে চিকন। তবে মাথাটা তীক্ষ্ণ। মন্দের ভাল আরকি।

‘বিনিময়ে কি কিছু দিতে হবে?’

সবসময় দিতে হয়।

‘দেব তাহলে। আর আরেকটা জিনিস চাই। তুমি বলেছিলে যে, তুমি এখান থেকে সোনা নিয়ে যাওয়া মানুষের চোখে পৃথিবীকে দেখতে পাও।’

খুলিতে চোখ বলতে কিছু নেই, কিন্তু সে নড করল।

‘তাহলে ক্যালাম ঘুমালে আমাকে জানিয়ো।’

কোন কিছু না বলে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সে। নিজেকে একা আর পরিত্যক্ত মনে হলো।

সময় বয়ে চলল। পানির আওয়াজ লক্ষ্য করে খুঁজে পেলাম জমাটবদ্ধ পানি। পান করে তৃষ্ণা মেটালাম। ওটের অবশিষ্ট অংশটুকু ভিজিয়ে খেয়ে নিলাম। মুখে গলে যাওয়া না পর্যন্ত চিবালাম। ঘুমিয়ে পড়লাম, জাগলাম আর আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্ন দেখলাম মোরাগের। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। যেমনটা আমরা অপেক্ষা করেছিলাম ফ্লোরার জন্য।

কিছু একটা, সম্ভবত একটা আঙুল, আমার হাত স্পর্শ করল। আঙুল হলেও, শক্ত আর হাড়ের মতো না। বরং নরম, অনেকটা জীবিত মানুষের মতো।

ঘুমাচ্ছে।

সূর্য ওঠার ঠিক আগে আগে গুহা থেকে বের হলাম। গুহার ঠিক মুখে বিড়ালের মতো শুয়ে ঘুমাচ্ছে ক্যালাম। আমি জানতাম, হালকা স্পর্শ পেলেও জেগে উঠবে সে। অস্ত্রটাকে সামনে নিয়ে আগে বাড়লাম। ওকে না উঠিয়েই নিয়ে নিলাম আমার আরাধ্য বস্তু।

এরপর আরও কাছে চলে এলাম। ক্যালামের হাত আমার গোড়ালি আঁকড়ে ধরল, চোখ খোলা,

‘সোনা কোথায়?’ জানতে চাইল ক্যালাম ম্যাকইনেস।

‘নেই।’ পাহাড়ের পাশের বাতাসটা অনেক ঠাণ্ডা। আমি লাফ দিয়ে পিছনে সরে এলাম, ওর নাগালের বাইরে। এখনো মাটিতে শুয়ে আছে সে, একটা কনুই ব্যবহার করে একটু উঠে বসল।

প্রশ্ন করল, ‘আমার খঞ্জর কই?’

‘আমার কাছে।’ জানালাম, ‘তুমি ঘুমাচ্ছিলে। আমি নিয়ে নিয়েছি।’

আমাকে ঘুমন্ত চোখে দেখল সে। ‘কী দরকার ছিল? যদি তোমাকে খুন করতেই চাইতাম, তাহলে এরই মাঝে না হলেও দশবার খুন করতে পারতাম।’

‘কিন্তু তাহলে তো আর তোমার কপালে সোনা জুটত না, তাই না?

কিছুই বলল না সে।

আমি বললাম, ‘যদি ভেবে থাক, আমাকে ব্যবহার করে গুহা থেকে সোনা বের করে এনে সেগুলো আত্মসাৎ করবে, আর নিজের জঘন্য আত্মাটা অক্ষুণ্ণ রাখবে, তাহলে তুমি বোকা।’

ঘুম ঘুম ভাবটা উধাও হয়ে গেল, ‘আমি বোকা?’

লড়বার জন্য ক্যালাম তৈরি। তবে, এমন লোককে আরও রাগিয়ে দিলে শেষ পর্যন্ত অনেক বেশি সুবিধা পাওয়া যায়।

বললাম, ‘নাহ, বোকা না। আমি অনেক বোকাকে দেখেছি। তারা তাদের বোকামি নিয়ে সন্তুষ্ট। তুমি বোকা নও। তুমি চাও ক্লেশ, যেখানেই যাও সেখানেই ক্লেশ সঙ্গে নিয়ে যাও।’

কথা-বার্তার এই পর্যায়ে উঠে দাঁড়াল সে, হাতে বিশাল বড় এক পাথর। কুঠারের মতো করে ধরে দৌড়ে এল আমার দিকে। আকারে আমি ছোট, কিন্তু আঘাত লাগাতে পারল না। অবশ্য যদি আমার জায়গায় স্বাভাবিক আকারের কেউ হত, তাহলে আঘাত এড়াতে পারত না। ঝুঁকে এল আমার দিকে, আবার আঘাত হানবে ক্যালাম ম্যাকইনেসের জীবনের সবচেয়ে ভুল।

হাতে ধরা অস্ত্রটাকে চালিয়ে দিলাম উপরের দিকে। সুঁই-এর মাথাটা যেন ছোবল হানল লক্ষ্যে। জেনে বুঝেই আঘাত করেছি, এ-ও জানি আঘাতের ফল কী হতে পারে।

হাত থেকে পাথরটা পড়ে গেল, আঁকড়ে ধরল সে ডান কাঁধটা। ‘আমার হাত,’ আকুতি জানাল যেন, ‘আমার হাতে কোন সাড়া পাচ্ছি না।’

এরপর শুরু হলো গালাগালি। আশপাশের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল ওর গালাগালিতে। ভোরের আলোয় পাহাড় চূড়ার সবকিছু দেখতে নীল আর অসাধারণ সুন্দর লাগছে। এমনকি ক্যালামের জামা ভিজিয়ে দেয়া রক্তবিন্দুগুলোকেও সুন্দর দেখাচ্ছে। এক পা পিছিয়ে এল সে। এখন আমার আর গুহার মাঝে অবস্থান করছে ও। নিজেকে অরক্ষিত মনে হলে, সূর্য আমার পিছনে।

‘তোমার সাথে সোনা নেই কেন?’ জানতে চাইল আমার কাছে, অবশ হাতটা একপাশে ঝুলছে।

‘আমার মতো লোকদের জন্য গুহায় কোন সোনা নেই।’ বললাম।

নিজেকে যেন ছুঁড়ে দিল সামনে। এরপর গাল বকতে বকতে দৌড়ে এল আমার দিকে। লাথি ছুঁড়ল। আমার হাত থেকে অস্ত্রটা উড়ে গিয়ে পড়ল দূরে। আমি হাত দুটো দিয়ে ওর পা আঁকড়ে ধরলাম। দু’জনেই যখন ঢাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ছি, তখনও ওকে ছাড়িনি।

আমার উপরে ছিল ওর মাথা, চেহারায় জয়ের আনন্দ ফুটে উঠল ওর। এরপর দেখতে পেলাম পরিষ্কার আকাশ। তারপর দেখলাম উপত্যকার মাটি। মাথার উপর ভাসছে আর আমি ছুটে চলছি তাকে স্পর্শ করার জন্য। পরমুহূর্তেই পায়ের কাছে চলে এল তা, আর মনে হলো আমি আমার মৃত্যুর মুখে পড়ে যাচ্ছি।

একবার আমি উপরে, আরেক বার সে। জানতাম আমি মারা যেতে চলেছি। কিন্তু তা-ও ছাড়িনি।

সোনালি এক ঈগল দেখতে পেলাম, উড়ছে। কিন্তু আমার উপরে না নিচে, তা বুঝতে পারলাম না। ভোরের আকাশে ফুটে আছে সে, সময় আর ইন্দ্রিয়ের ভগ্ন খণ্ডাংশ জুড়ে। ভয় পাচ্ছিলাম না, ভয় পাবার সময় কোথায়? আসমান থেকে পড়ছি যেন, আঁকড়ে ধরে আছি আমাকে যে খুন করতে চাইছে তার পা। পাথরে বাড়ি খাচ্ছি, ছিলে কেটে যাচ্ছে শরীর আর তারপর…

…থেমে গেল আমাদের পতন।

আচমকা থেমে যাওয়ায়, আমার সারা শরীর যেন কেঁপে উঠল। ক্যালাম ম্যাকইনেস যেন ছুটে যাচ্ছিল হাত থেকে। মনে হচ্ছিল আবার আমার পতন শুরু হবে। নিচে হাঁ করে অপেক্ষা করছে মসৃণ পাথর। বহু যুগ ধরে ক্ষয়ের ফলে এই রূপ হয়েছে তার। কাচের মতোই মসৃণ। কিন্তু তা আমাদের নিচে। আর আমরা এখন আছি একটা শৈলশিরার উপরে। শিরায় দেখতে পেলাম একটা মিরাকল। যেখানে কোন গাছ জন্মাবার কথা না, সেখানে দেখতে পেলাম একটা কাঁটাগাছ। খুব একটা ।বড় না, ঝোপের মতো। আর জন্মেছেও পাহাড়ের ঢালে। এই কাঁটাগাছটা নিজের হাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে আমাদের।

পাটা ছেড়ে দিলাম। ক্যালাম ম্যাকইনেসের দেহ থেকে আলাদা হয়ে শৈলশিরায় এসে দাঁড়ালাম। নিচের পাথরগুলো চোখে পড়তেই যেন মাথাটা ঘুরে উঠল। নাহ, নিচে যাবার কোন পথ নেই।

উপরে তাকালাম এবার। হ্যাঁ, সম্ভব-ভাবলাম। যদি কপাল ভাল হয়, তাহলে আস্তে আস্তে বেয়ে ওঠা যাবে। বৃষ্টি হলে-আশা শেষ; বাতাস জোরে বইলেও। কিন্তু মৃত্যু ছাড়া আর কী বিকল্প আছে হাতে?

পরিচিত একটা গলা শুনতে পেলাম: ‘আমাকে কি এখানেই ফেলে যাবে, ক্ষুদে মানুষ?’

উত্তর দিলাম না, দেবার মতো কিছু নেই।

ক্যালামের ছোট দুটো খোলা, সজাগ। বলল, ‘আমার ডান হাত নাড়াতে পারছি না। মনে হয়, পড়ে গিয়ে পা ও ভেঙে ফেলেছি। আমি বাইতে পারব না।’

আমি বললাম, ‘সফল হতেও পারি আবার নাও পারি।’

‘পারবে। আমি তোমাকে বেয়ে উঠতে দেখেছে। ওই যে ঝর্ণাটা বেয়ে উঠেছিলে। তুমি কাঠবিড়ালির মতোই দক্ষ।’

হায়, যদি ওর মতো আমারও নিজের উপর এতটা আস্থা থাকত!

‘প্রতিজ্ঞা করো। তোমার জীবনে যেসব জিনিসকে পবিত্র মনে কর, সেগুলোর নামে প্রতিজ্ঞা করো। প্রতিজ্ঞা কর তোমার রাজার নামে, তোমার ছেলে মেয়ের নামে। বলো, আমার জন্য ফিরে আসবে।’

‘তুমি কি জানো, আমি আসলে কী?’

‘জানি না। জানতে চাইও না। শুধু জানি-আমি বাঁচতে চাই।’

আমি ভাবলাম। ‘প্রতিজ্ঞা করলাম। ছায়াদের নামে আর নীরবতার নামে। সবুজ টিলা আর পাথরের নামে-আমি তোমার জন্য ফিরে আসব।’

‘আমি তোমাকে খুন করতে চেয়েছিলাম।’ কাঁটাগাছে আটকে থাকা লোকটা বলল। এমনভাবে, যেন খুব মজার কোন কথা বলেছে, ‘তোমাকে খুন করে সব সোনা নিয়ে নিতে চেয়েছিলাম।’

‘আমি জানি।’

চুলগুলো সামনে এসে চেহারাটাকে যেন আরও নেকড়ের মতো করে ফেলেছে। গালে রক্তের দাগ, ঢাল বেয়ে পড়ার সময় কেটে গিয়েছে। ‘দড়ি নিয়ে ফিরে এসো।’ বলল সে, ‘উপরে এখনো আমার দড়িটা রাখা আছে। গুহার ঠিক মুখে। কিন্তু আমাকে তুলতে হলে তো…’

‘চিন্তা কোরো না।’ অভয় দিলাম, ‘আমি দড়ি নিয়ে ফিরে আসব।’ আমাদের উপরে অবস্থিত পাথুরে দেহটাকে ভাল মতো দেখলাম। কখনো কখনো ভালভাবে দেখা জীবন আর মৃত্যুর মাঝে পার্থক্য করে দিতে পারে। বিশেষ করে পাহাড় যারা বেয়ে ওঠে, তাদের জন্য। কীভাবে উঠব, কোথায় কোথায় পা রাখব, তা ঠিক করে নিলাম। যেখান থেকে পড়ে গিয়েছি, সেই জায়গাটা দেখতে পেলাম। হ্যাঁ, পারা যাবে।

ফুঁ দিয়ে হাতের তালু থেকে ঘাম ঝরাবার প্রয়াস পেলাম। ওঠা শুরু করার আগে হাত শুকনো করে নেয়া দরকার। ‘আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে, তোমার জন্য ফিরে আসব।’ বললাম, ‘দড়ি নিয়েই ফিরব।’

‘কখন?’ জিজ্ঞেস করে চোখ মুদল সে।

‘এক বছর পর।’ বললাম ওকে লক্ষ্য করে, ‘এক বছর পর ফিরব।’

ওঠা শুরু করে দিলাম। লোকটার চিৎকার ভেসে এল। কোনক্রমে টেনে হিঁচড়ে নিজেকে নিয়ে এলাম পাহাড়ের মাথায়। এমন কি কুয়াশা-ঘেরা দ্বীপ ছেড়ে আসার পরও কানে শুনব সেই চিৎকার। ঘুমাবার সময়, ঘুম থেকে উঠে প্রথম চোখ খুলে। একেবারে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

ভাগ্য ভাল, বৃষ্টি হয়নি। বাতাস ছিল, কিন্তু আমাকে উড়িয়ে নেবার মতো জোরালো না। আমি পাহাড় বাইলাম, শেষ পর্যন্ত উঠে এলাম উপরে।

দুপুরের আলোতে যেন গুহামুখটাকে রাতের চেয়েও বেশি অন্ধকার মনে হলো। ঘুরে দাঁড়িয়ে, পাহাড় থেকে নেমে এলাম। বুঝতে পারছি, কালো ছায়াগুলো একটু একটু করে আমার মস্তিষ্কের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। কুয়াশা-ঘেরা দ্বীপকে বিদায় জানিয়ে ঘরের দিকে রওয়ানা হলাম। শত শত রাস্তা আর সহস্র পথ আমাকে নিয়ে যাবে নিচু ভূমিতে। আমার ঘরে। যেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে আমার স্ত্রী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *