দ্য জিপসি প্রফেসি
মূল গল্প The Gypsy Prophecy (Bram Stoker)
‘আরে ভণ্ড হোক আর যাই হোক৷ একবার গিয়ে দেখে আসতে তো ক্ষতি কিছু নেই৷’ জনের দিকে তাকিয়ে আমি বলে উঠলাম৷ তার চোখ-মুখ দেখে মনে হল আমার প্রস্তাবে সে রাজিও হয়েছে৷ মাথা নাড়িয়ে সে বলল, ‘বেশ তো৷ তাহলে খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই যাওয়া যাবে না হয়৷’
খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে অবশ্য বেশিক্ষণ লাগল না৷ দীর্ঘক্ষণ ট্রেন জার্নির পর আমার অমানুষিক খিদে পেয়েছিল৷ শহর থেকে এতটা দূরে, জল-জঙ্গলের মাঝে, খিদেটা এমনিতেই দিব্যি চনমনিয়ে ওঠে৷ সেই সাথে যোগ হয়েছে জনের স্ত্রী মেরীর হাতের সুস্বাদু রান্না৷
ফলে ডিনার সেরেই জিপসি ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়লাম আমরা৷ মেরী যেতে রাজি হল না৷ বাড়িতে নাকি হাজাররকম কাজ রয়েছে তার৷ আমাদের সাথে বাগানের শেষপ্রান্ত অবধি হেঁটে এল সে৷ তারপর জনের পিঠে একটা টোকা দিয়ে হাসিমুখে বলল, ‘জিপসি মেয়েগুলো শুনেছি খুব একটা সুবিধের নয়৷ দেখো বাবা, ফাঁদে পা দিয়ে ফেলো না আবার৷’
‘বাব্বা! এ খবরটা কী করে জানলে?’ মেরীর দিকে তাকিয়ে হাসল জন৷
‘না জানার কী আছে? যারা হাত দেখে মানুষের ভাগ্য বলে দিতে পারে তাদের কাছে কিছু অসম্ভব নাকি?’
‘ধুর! ভাগ্য না ছাই৷ একটা মানুষের দিকে ভালো করে তাকালে তার সম্পর্কে অনেক কিছুই বলে দেওয়া যায়৷ আরে শার্লক হোমস পড়নি? যেমন এই ধর এখন তোমার সম্পর্কে আমার না জানা কিছু বলে দিতে পারি আমি৷’
‘তাই নাকি? বল দেখি৷’
জন মুচকি হাসে, তারপর চারদিকে একবার তাকিয়ে নীচু গলায় বলে, ‘কিচেনে বোধহয় ডিম ভাজতে দিয়ে এসেছিলে…’
‘কী করে জানলে?’ মেরী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে৷ কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা না করেই আচমকা ডুকরে ওঠে সে, ‘এ বাবা, গেল-গেল, সব পুড়ে ঝুল হয়ে গেল৷ আমারও যেমন আক্কেল, শোন, জেরাল্ডেরও খেয়াল রেখো৷ ও তো নতুন এখানে৷ আর ফিরতে দেরি করো না৷’
কথাগুলো ক্রমশ কিচেনের দিকে মিলিয়ে গেল৷ আমরাও হাসিমুখে জলার দিকে পা বাড়ালাম৷
সকালের আলো এতক্ষণে ফিকে হয়ে এসেছে৷ বিকেলের শান্ত ঝিরঝিরে হাওয়ায় মখমলের মতো রোদ খেলা করছে৷ তার মাঝেই জন আর মেরী কন্সিডাইনের ছোট বাড়িটা একটুকরো পাখির বাসার মতো মনে হচ্ছে৷ আমার বন্ধু জন কন্সিডাইনের জীবন অত্যন্ত সাদামাটা৷ সেই কলেজ জীবন থেকে ঝামেলা ঝঞ্ঝাটের মধ্যে সচরাচর জড়াতে দেখিনি তাকে৷ একমাত্র ব্যতিক্রম দেখেছিলাম শুধু মেরী উইনস্টনের বেলায়৷ সে ছিল বনেদি পরিবারের একমাত্র মেয়ে৷ আর জন তখন অখ্যাত পাড়াগেঁয়ে উকিল৷ তার না ছিল টাকাপয়সার জোর না ছিল ঠাঁটবাট৷ ফলে প্রথম দিকে মেরীর বাবা-মা কিছুতেই মেনে নিতে চায়নি তাকে৷ মেয়েকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিলেতে পড়াশোনা করতে পাঠিয়ে দেন তাঁরা৷ ভেবেছিলেন এতগুলো দিন দূরে কাটালে ভালোবাসার টানও কমে আসবে৷ কিন্তু এর ফল হল ঠিক উল্টো৷ অবশেষে মেরী বিলেত থেকে ফেরার পর মিস্টার আর মিসেস উইনস্টন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিলেন তাদের৷
তারপর থেকে মাত্র মাসকয়েক কেটেছে৷ শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছোট একটা কটেজ কিনে নির্বিঘ্নে সংসার করছিল তারা৷ তার মাঝে আজ সকালেই এসে উপস্থিত হয়েছি আমি৷ জেরাল্ড বার্লি৷ সত্যি কথা বলতে কী, কলেজে একসাথে পড়ার সময় মেরী উইনস্টনের পাণিপ্রার্থী যে আমিও ছিলাম না তা নয়৷ কিন্তু ওই যা হয়, বন্ধুর কথা ভেবে আত্মবলিদান৷ আপাতত সপ্তাখানেক এখানে না কাটিয়ে লন্ডন ফিরছি না আমি৷
জিপসি ক্যাম্পটা কটেজ থেকে বেশি দূরে না৷ আমার আর জনের দু-খানা সিগারেট শেষ হবার আগেই রংবেরঙের তাঁবুগুলো চোখে পড়ল৷ আজব জাত এই জিপসিরা৷ পার্মানেন্ট ঘরবাড়ি বা থাকার জায়গা এদের নেই বললেই চলে৷ বেদুইনের মতো এক শহর থেকে আরেক শহর, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম ঘুরে-ঘুরেই জীবন কাটিয়ে দেয় এরা৷ সেই সাথে সঞ্চয় করে নানারকম আজগুবি ক্ষমতা৷ এদের কেউ মুখের ভিতর লোহার গরম রড আস্ত ঢুকিয়ে দিতে পারে, কেউ তারের উপর দিব্যি হেঁটে-চলে বেড়াতে পারে আবার কেউ হাতের তালু দেখে গড়গড় করে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে৷ জলার একপ্রান্তে এমনই একদল জিপসি এসে ঘাঁটি গেড়েছে কিছুদিন হল৷ গোটা মাঠ জুড়ে ছোটখাটো একটা মেলা বসেছে যেন৷ রংবেরঙের তাঁবু আর তার সামনে কিম্ভুত জামাকাপড় পরা জিপসি ছেলে-মেয়েদের কী হম্বিতম্বি!
হঠাৎ একটা তাঁবুর দিকে তাকিয়ে থমকে গেল জন৷ আমার কনুইটা চেপে ধরে সেদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ওই দেখ৷ সাক্ষাৎ ভাগ্যদেবতা নেমে এসেছেন৷’
আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম তাঁবুর গায়ে হরেকরকম জবড়জং লেখা-জোখার মাঝে ‘প্রফেসি’ শব্দটা দেখা যাচ্ছে৷ অর্থাৎ ওই তাঁবুতে ভাগ্যগণনা চলছে৷ এ ব্যাপারটায় আমারই আগ্রহ ছিল বেশি৷ বললাম, ‘চল তাহলে, কপাল ঠুকে দেখাই যাক, কী আছে৷’
একগাল হেসে বড়-বড় পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে গেল জন৷ পিছন- পিছন আমিও৷ তাঁবুর ঠিক সামনেই অল্পবয়সি একটা জিপসি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল৷ জনকে দেখেই একটা হাত বাড়িয়ে দিল সে৷ ‘মিস্তা… পোফেসি মিস্তা৷’
জন কী বলবে বুঝতে পারল না৷ হাতটা আড় করে বাড়ানো নয়৷ অর্থাৎ হ্যান্ডশেক করতে চাইছে না মেয়েটি৷ আমি তার কাঁধে খোঁচা দিয়ে বললাম, ‘হাতে ক-টা টাকা গুঁজে দাও আগে৷’
জন পকেট থেকে কয়েকটা খুচরো কয়েন বের করে তার হাতের উপর রাখল৷ সাথে-সাথে বিদ্যুতের মতো হাত সরিয়ে নিল মেয়েটি, ‘নো মেতাল মিস্তা৷ পেপা… পেপা৷’
অর্থাৎ সে ধাতু ছোঁয় না৷ কাগজের টাকা চাই তার৷ জনের মুখের এককোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল, ‘কাগজের টাকা পছন্দ না হলে আবার ব্যাঙ্ক চেক চেয়ে বসবে না তো?’
আমি পিছন থেকে বললাম, ‘আরে যা চাইছে দিয়ে দাও৷ দেখাই যাক না কী করতে পারে…’
জন আবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা নোট বের করে বলল, ‘বেশ, দিলাম৷ এবার দেখ দেখি হাতখানা৷ টাকাপয়সার কথা কী বলছে সেইটেই আগে দেখ না হয়৷’
ছোট মেয়েটা আলতো হাতে তুলে ধরল জনের ডান হাতখানা৷ চোখের সামনে রাখল৷ আর সাথে-সাথে আমাদের দু-জনকে অবাক করে দিয়ে একটা আর্ত চিৎকারে পিছনে ছিটকে পড়ল সে৷ মনে হল যেন জনের হাত থেকে বিদ্যুৎপ্রবাহ প্রবেশ করেছে তার শরীরে৷ আমাদের দিকে আর কিন্তু ফিরেও তাকাল না সে৷ এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে উধাও হয়ে গেল তাঁবুর ভিতরে৷
‘যাহ বাবা! হলটা কী?’ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল জন৷
আমি হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে বললাম, ‘বোধহয় ভয়ানক কিছু দেখেছে তোমার হাতে৷’
‘আমার হাতে! ভয়ানক!’ মেয়েটার মিলিয়ে যাওয়া পথের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকল সে৷ চিৎকারে আশপাশে লোক জড়ো হয়েছে৷ তারা তাঁবুর ভিতরে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল৷ মিনিট খানেক পরে ভিড়টা একপাশে সরে গিয়ে রাস্তা করে দিল৷ জন ফিসফিস করে বলল, ‘রানিমা আসছেন মনে হয়৷ স্পেশাল কেস না হলে ইনি দেখেন না৷’
পরমুহূর্তেই বিশাল চেহারার এক মাঝবয়সি মহিলাকে তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল৷ এনার জামাকাপড় আরও কিম্ভূত ধরনের৷ আলখাল্লার মতো সবুজ ঝুলের গোটা কাপড়৷ কোমরে সেই একই রকম কাপড়ের বেল্ট৷ তার উপরে রংবেরঙের চাবিজাতীয় কিছু ঝুলছে৷ দশাসই চেহারার রানিমা এসে দাঁড়াতেই চারিদিকের হট্টগোল থেমে গেল৷ এক মুহূর্তে নিস্তব্ধতা নেমে এল জিপসি ক্যাম্প জুড়ে৷
‘কই দেখি হাতটা৷’
রানিমার গলা শান্ত৷ অথচ এমন গম্ভীর গলা এর আগে শুনিনি আমি৷ বাধ্য স্কুলছাত্রের মতো জনের হাতটা উঠে এল৷ নিষ্পলক চোখে হাতের আঁকা-বাঁকা রেখগুলোর দিকে কিছুক্ষণ একটানা তাকিয়ে রইলেন তিনি৷ মনে হল শুধু চোখদুটোই খোলা আছে তার৷ আসলে ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ একটু পর ধীরে-ধীরে চোখের পাতা নেমে এল৷ জনের মুখের দিকে তাকিয়ে আগের মতোই শান্ত গলায় রানিমা বললেন, ‘তোমার হাত বলছে তুমি সাহসী৷’
জন বোকার মতো তাকিয়ে ছিল৷ বলল, ‘হ্যাঁ… মানে, হবে হয়তো৷’
‘তাহলে নিজের ভালোর জন্য যা করা দরকার করতে পারবে?’
‘কী করতে বলছেন?’ জনের কণ্ঠস্বরে আর আগের মতো ঔদ্ধত্যের চিহ্ন নেই৷
‘তোমার স্ত্রীকে তুমি ভালোবাসো?’
‘বাসি৷’
‘তাহলে এই মুহূর্তেই তার থেকে দূরে কোথাও চলে যাও৷ এত দূরে যাতে চাইলেও সে তোমার ধারে-কাছে আসতে না পারে৷’
কথাগুলো শুনতে-শুনতে জনের মুখ শক্ত হয়ে উঠল৷ এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে নীচু গলায় ‘ধন্যবাদ’ বলে বেশ খানিকটা দূরে সরে এল সে৷ আমি আবার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলাম তাকে, ‘আরে টাকা যখন দিয়েছ তখন শুনেই যাও না হয় ব্যাপারখানা৷’
আমার কথাগুলো তার কানে পৌঁছানোর আগেই রানিমা চাপা গলায় গর্জন করে উঠলেন, ‘থাক৷ যেতে দাও ওকে৷’
জন ঘুরে দাঁড়াল৷ তার বাঁকা ভুরু আর শক্ত চোয়াল স্পষ্ট রাগ ও অভক্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে৷ আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘টাকা তো দিয়েছিলাম ভবিষ্যতে আমার কপালে কী আছে সেটা দেখার জন্য৷ অ্যাডভাইস দেওয়ার জন্য দিয়েছিলাম কি?’
রানিমার চোখ কিন্তু তার দিক থেকে সরেনি৷ একই রকম শান্ত দৃষ্টিতে একটানা তাকিয়ে আছেন জনের দিকে৷ ধীরে-ধীরে তার মুখে কথা ফুটল, ‘সত্যি জানতে চাও কী আছে তোমার হাতে?’ বলে তিনি আর উত্তরের অপেক্ষা করলেন না৷ আগের মতোই তুলে ধরলেন জনের হাতখানা৷ এবার কিন্তু তার চোখ দুটো বন্ধ৷ চোখের পাতাগুলো তিরতির করে নড়ছে৷ যেন তার আঁখিপল্লবেই ছায়াছবির মতো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন রানিমা৷ ছাড়া- ছাড়া কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে, ‘রক্ত… হাত… ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত… খুন…’
এই শেষ শব্দটা আমাদের দু-জনকেই স্তম্ভিত করে দিল৷ এরপরে কী শুনব ভাবছি এমন সময় চোখ খুলে জনের হাতখানা ছেড়ে দিলেন রানিমা৷
‘এ হাত কোনও খুনির হাত৷’
‘মানে আমি খুন করব?’ জনের গলার স্বর গম্ভীর৷ আমি অবাক হয়ে গেলাম৷
‘কিন্তু কাকে?’
‘তোমার স্ত্রী, মেরী কন্সিডাইনকে৷’
কথাটা বলে আর দাঁড়ালেন না রানিমা৷ ধীর পায়ে হেঁটে তাঁবুর ভিতর ঢুকে পড়লেন তিনি৷ আমরা দু-জনেই নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আধ মিনিট৷ আমিই কথা বললাম প্রথম, ‘ব্যাপার কী বল তো? চুপচাপ হয়ে গেলে কেন? কথাগুলো বিশ্বাস করলে নাকি?’
‘হুস… বিশ্বাসের প্রশ্নই আসে না৷ আমি ভাবছি অন্য কথা৷’
‘কী বল তো?’
‘এ মহিলা মেরীর নামটা জানল কী করে?’
‘সেটা তেমন কঠিন কিছু না৷ তোমাদের বাড়িটা তো এ অঞ্চলে বেশ বিখ্যাত৷ তাছাড়া তুমি উকিল মানুষ৷ স্থানীয় লোকজন তোমার খোঁজ রাখে বই কী…’
‘তা একদিক থেকে ঠিকই বলেছ… কিন্তু…’
আমি হাসলাম, ‘খুনের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছ৷ তাই তো?’
‘যাই বল৷ মহিলার হাবেভাবে কী যেন একটা আছে৷ সহজে অবিশ্বাস করা যায় না৷’
‘আর তাতেই তুমি ভড়কে গেলে?’
‘যেভাবে চোখ বন্ধ করে গড়গড় করে বলে গেল তাতে মনে হল ঘটনাটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে৷ জেরাল্ড, একটা কথা রাখবে আমার?’
‘হ্যাঁ বল না৷’
‘এই প্রফেসির কথাটা মেরীকে বলার দরকার নেই৷ বুঝতেই পারছ, ও একটু বিশ্বাসী আরকী…’
‘বেশ৷ বলব না৷’
আরও দু-একটা তাঁবুতে ঘোরাফেরা করে আমরা ফেরার পথ ধরলাম৷ এতক্ষণে জলা জমিটার উপরে সন্ধের অন্ধকার নেমেছে৷ ঘাসবন থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝির শব্দ আর দূরে তক্ষকের ডাকের মধ্যে কেমন যেন চাপা আশঙ্কা লুকিয়ে আছে৷ টর্চ জ্বালিয়ে হাঁটতে লাগলাম দু-জনে৷ মনে হল আগের থেকে আরও গম্ভীর হয়ে পড়েছে জন৷ তাকে সচরাচর এত কম কথা বলতে শুনিনি আমি৷
‘আবার কী ভাবছ বল তো?’
‘ভাবছি মেরীকে কথাটা বলেই দেব৷ আমি তো কোনওদিনই কিছু লুকাইনি তার থেকে৷’
আমি এবার তার পিঠে একটা হালকা চাপড় মেরে বললাম, ‘তুমি এখনও সেই প্রফেসি নিয়ে পড়ে আছ! ভেবে নাও ওটা একটা প্রাক্টিক্যাল জোক৷’
‘উঁহু… তা কী করে হয়! খামোখা একটা অচেনা জিপসি মহিলা আমার সাথে মজা করতে যাবে কেন৷ আর একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ?’
‘কী?’
জনের গলায় ভয়ার্ত ভাবটা ক্রমশ বেড়ে উঠছে৷ ‘সাধারণ জ্যোতিষীরা ভাগ্যগণনা করে খারাপ কিছু পেলে সাধারণত সেটা যাতে না ঘটে তার একটা উপায়ও বাতলে দেয়৷ এই মহিলা কিন্তু সেসব কিছুই করলেন না৷ শুধু বললেন যা ঘটবার সেটা ঘটবেই৷ তুমি বা আমি চাইলে কিছু বদলাতে পারব না৷’
আমি আর কিছু বললাম না৷ তার একটা কারণ হল যে আমরা আবার কটেজের সামনে এসে পড়েছি৷ ভিতর থেকে পিয়ানোর আওয়াজ শুনে বুঝলাম মেরী কাজকর্ম সেরে এখন বাদ্যযন্ত্রে মন দিয়েছে৷ আমাদের পায়ের শব্দে কি না জানি না, একটু পরেই সেটা থেমে গেল৷ আমরা ভিতরে ঢুকে এলাম৷ পিয়ানোর উপরে রাখা খোলা নোটবুকের দিকে তাকিয়েছিল মেরী৷ জানলার বাইরে থেকে আসা উজ্জ্বল নীল আলো এসে পড়েছে তার বুকে৷ চোখের কোনায় একফোঁটা জল তিরতির করে কাঁপছে৷ জন তার চেয়ারের পিছনে গিয়ে দাঁড়াতেই চটকা ভাঙল তার৷ পিছন ফিরে তাকাতেই মৃদু হাসি খেলে গেল তার মুখে৷ সেই সাথে তাড়াতাড়ি মুছে নিল চোখের জলটা৷ জন একটা হাত তার দিকে তুলে ধরে বলল, ‘দাঁড়াও৷ আমার কাছে আসার আগে একটা কথা বলার আছে তোমাকে৷’
‘কী বল তো?’ মেরীকে দেখে মনে হল সে কিছুটা অবাক হয়েছে৷
জন চুপ করে কী যেন ভাবতে লাগল৷ শেষে আমিই মুখ খুললাম, ‘জিপসি ক্যাম্পে এক জ্যোতিষী বলেছে যে ওর হাতেই তুমি খুন হবে৷’
‘মানে! কী বলছ তুমি?’ আমার দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে এল মেরী৷ অথবা বলা যায় জনের দিক থেকে সরে এল৷
‘আরে! তোমরা দু-জনেই ব্যাপারটা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন বল তো? সামান্য একটা প্রফেসি…’
আমার কথাটা ঘরের দেওয়ালের মাঝে ধাক্কা খেয়ে মিলিয়ে গেল৷ আমি ছাড়া ঘরের বাকি দুটো মানুষ যেন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে৷ কীরকম যেন অস্বস্তি হতে লাগল আমার৷ সেটা কাটাতেই বললাম, ‘আচ্ছা, সত্যি করে বল তো, এসব তোমরা দু-জনে প্ল্যান করে করছ না তো? মানে আমাকে বোকা বানানোর জন্য? আমি কিন্তু বিশ্বাস করিনি৷ আগে থেকেই বলে দিলাম৷’
‘ওকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও এখান থেকে৷’ ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলল মেরী৷ এই প্রথম আমার অস্বস্তিটা কেটে গিয়ে ভয় লাগতে শুরু করেছে৷ যে মেরীকে আমি কলেজ জীবনে চিনতাম তার সাথে এই মহিলার কোনও মিল নেই৷ ভাগ্যগণনা-তন্ত্রমন্ত্রে মানুষ বিশ্বাস করতেই পারে, কিন্তু তা বলে এক ভবঘুরে জিপসির গণনায় ভালোবাসার মানুষকে এভাবে ছেড়ে চলে যেতে পারে তেমন মেয়ে মেরী ছিল না৷ যাই হোক, আমরা আর কথা বাড়ালাম না৷ দু-জনেই ঘরের বাইরে পা রাখলাম৷ মেরী নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল৷ সন্ধেটা দু-জনে গল্প করেই কাটালাম৷ রাতের দিকে আমি গেস্টরুমে এসে শুয়ে পড়লাম৷ সারাদিনের ছোটখাটো ঘটনা একসাথে ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়৷ এমনিতে জ্যোতিষশাস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই৷ আবার তেমন এককাট্টা অবিশ্বাসও করি না৷ এত দেশ ঘুরে বেড়াবার ফলে জিপসিদের যে আশ্চর্য কিছু ক্ষমতা জন্মায় একথা মেনে নিলেও একটা মানুষের হাত দেখে তার ভবিষ্যতের কথা চোখ বুজে গড়গড় করে বলে দেওয়া যায় তা আমারও বিশ্বাস হয় না৷ কিন্তু তার থেকেও আশ্চর্যের হল মেরীই বা সেটা বিশ্বাস করল কী করে? এতদিন অবধি জন তাকে যেভাবে ভালোবেসেছে তাতে আমার চোখে কোনও খামতি ধরা পড়েনি৷ অবশ্য মাসছয়েক ওদের সাথে কোনও যোগাযোগই ছিল না আমার৷ তার মধ্যে যদি কিছু ঘটে থাকে…
কথাগুলো ভাবতে-ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ কতক্ষণ পরে জানি না ঘুমটা ভেঙে গেল৷ মনে হল আমার ঘরে এই মুহূর্তে কেউ আছে৷ উঠে বসতে গিয়ে বুঝলাম আগন্তুক বিছানায় আমার পায়ের কাছেই বসে আছে৷ আমাকে উঠে বসতে দেখে তার গলা ভেসে এল, ‘জেরাল্ড… জেরাল্ড শুনছ?’
মেরী কন্সিডাইন৷ আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ এত রাতে! আমার ঘরে! ঘুমের ভাবটা আকস্মিক উত্তেজনায় কেটে গেছে, জিজ্ঞেস করলাম, ‘মেরী! কী ব্যাপার বল তো? জন কোথায়?’
‘ঘুমাচ্ছে৷ আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে৷’
‘আলোটা আগে জ্বালো৷ এত রাতে এভাবে…’
‘না জ্বালতে হবে না৷ আমি কিছু কথা বলেই চলে যাব৷ আমাকে তুমি বাঁচাও ভাই৷’
শেষ কথাটা বলে সে আমার পায়ের গোড়ালি খামচে ধরল৷ আমি তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম, ‘আগে বল দেখি সামান্য একটা প্রফেসিতে এতটা ঘাবড়ে গেলে কেন তুমি?’
আন্দাজে বুঝতে পারলাম সে দু-হাতে চোখের জল মুছছে৷ খানিক পরে কাটা-কাটা কয়েকটা শব্দ ভেসে এল, ‘গতকাল আমি নিজে জিপসি ক্যাম্পে গেছিলাম৷’
‘তাই নাকি? জন জানে সে কথা?’
‘না৷ তাকে না জানিয়ে গেছিলাম৷’
‘বেশ৷ তারপর?’
‘রানিমাকে দিয়ে আমিও ভাগ্যগণনা করিয়েছি৷’
‘তো? কী বললেন রানিমা, আই মিন… কী দেখলেন?’
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে মেরী উত্তর দিল, ‘দেখলেন আমি রক্তাক্ত অবস্থায় ঘরের মেঝেতে পড়ে আছি আর সেই ছুরি হাতে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আততায়ী…’
‘জন?’
‘হ্যাঁ…’
আমি আর কিছু বললাম না৷ সত্যি বলতে, কী বলব বুঝতে পারলাম না৷ শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছি আন্দাজে ঢিল ছোঁড়েননি রানিমা৷ এক যদি না তার গণনা ভুল হয় তাহলে নববিবাহিত এই দম্পতির জীবনে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে৷ যদি তাই সত্যি হয় তাহলে আমার কিছু করার নেই তাতে৷
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মেরী বলল, ‘তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো ওকে নিয়ে যাও এখান থেকে৷’
কথাটা বলে উঠে চলে গেল মেরী৷ আমি কিছু বলার সুযোগ পেলাম না৷ বাকি রাতটা আর ঘুম এল না আমার৷ দূরে জিপসি ক্যাম্প থেকে বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে৷ দেশি মদ খেয়ে সবাই একসাথে নাচছে তারা৷ বেশ বুঝতে পারছি আমার পাশের ঘরে দুটি প্রাণীর চোখেও ঘুম নেই৷
পরদিন সকালে কিন্তু দু-জনের হাবেভাবে বিশেষ কিছু পরিবর্তন লক্ষ করলাম না৷ তারা নিজেদের মধ্যে কিছু মানিয়ে নিয়েছে না আমি সামনে আছি বলে অভিনয় করছে সেটা বুঝতে পারলাম না৷ বাইরে বেরিয়ে দেখলাম বাগানে গোলাপের চারার তদারকি করছে জন৷ কালরাতের দিকে নাকি সামান্য ঝড় হয়েছে৷ তাতেই নুয়ে পড়া চারাগুলোর পরিচর্যা করছে সে৷ মেরীকে চোখে পড়ল রান্নাঘরে৷ চায়ের জল গরম করছে সে৷ আমাকে দেখে ম্লান মুখে একগাল হাসল৷ আমি বাগানের দিকে নেমে এলাম৷ জনের মুখ কিন্তু ভার৷ আমি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাপার কী হে, সাত সকালে মুখ ব্যাজার কেন?’
‘আর বল না৷ এত আগাছা হয়েছে যে না কাটলেই নয়৷ এদিকে ছুরিগুলো আজ সকাল থেকেই গায়েব হয়েছে৷ হাত দিয়ে কি আর এসব কাটা যায়?’
‘ছুরি…’ কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম আমি৷ বাড়ির সবক-টা ছুরির একসাথে গায়েব হয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা আপাতত একটাই৷
‘হ্যাঁ ছুরি৷ আছে তোমার কাছে?’
আমি মাথা নাড়লাম৷ বললাম, ‘কাল রাত থেকে আমারটাও খুঁজে পাচ্ছি না৷ আমার ব্যাগের ভিতরেই ছিল…’
আমাকে কথাগুলো শেষ করতে দিল না জন৷ তার মুখ লাল হয়ে উঠছে ক্রমশ, সেটা সূর্যের তাপে কি না বুঝতে পারলাম না৷ কপালের শিরাগুলো অস্বাভাবিক রকম ফুলে উঠছে৷ আমার দিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই ডঁzচু গলায় ডাক দিল সে, ‘মেরী… একবার এস এদিকে৷’
রান্না ঘর থেকে ধীর পায়ে বাগানে নেমে এল মেরী৷ জনের সামনে এসে দাঁড়াল৷ কথা কিন্তু বলল না৷
‘ছুরিগুলো লুকিয়ে রেখেছ তুমি?’
‘আ… আমি… আসলে খুব ভয় পেয়ে…’
‘ভয়!’ গর্জে ওঠে জন, ‘এই তোমার বিশ্বাস! আমি খুন করব তোমাকে? দাঁড়াও৷ আজ এর শেষ দেখে ছাড়ব৷’
কথাগুলো বলতে-বলতেই সে কটেজের ভিতরের দিকে দৌড় দিল৷ এমন উন্মত্ত অবস্থায় আগে জনকে দেখিনি আমি৷ সত্যি বলতে কী আমারও কানের পাশ গরম হয়ে উঠল৷ মেরী একবার ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে নিল৷ কে যেন আমাদের কানের কাছে বলে দিল—রানিমার প্রফেসি ভুল হওয়ার নয়৷ যা ঘটার তা ঘটবেই৷ একটু পরেই আবার জনকে কটেজ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল৷ তবে খালি হাতে নয়৷ তার ডান হাতে ধরা আছে একটা লম্বা গোর্খা ছুরি৷ আমি ভালো করেই জানি এ ছুরির এককোপে একটা আস্ত মানুষ দু-আধখানা হয়ে যেতে পারে৷ ছুরিটা নিয়ে দ্রুত পায়ে সে এগিয়ে আসতে লাগল আমাদের দিকে৷ আড়চোখে বুঝতে পারলাম এক পা-এক পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে মেরী৷ ভয়ে আমারও দু-পা কাঁপছে৷ সূর্যের তাজা আলোয় জনের ছুরিটা চকচক করে উঠল৷ আরও খানিকটা এগিয়ে এল সে৷ ভয়ে একটা আর্ত চিৎকার করে জ্ঞান হারাল মেরী৷ এতক্ষণে মেরীর ভয়ের কারণটা বুঝতে পারল জন৷ বুঝতে পেরেই সে ছুঁড়ে ফেলে দিল হাতের ছুরিটা৷ কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ মেরীর জ্ঞানহীন শরীরটা গিয়ে পড়ল মাটিতে সদ্য এসে পড়া ছুরিটার উপরেই৷ তারপরেই রক্তের স্রোত এসে নামল সিমেন্টের মেঝেতে৷ আমার হাত-পা মুহূর্তে অবশ হয়ে এল৷
‘জেরাল্ড, ফার্স্ট এইড, কুইক৷’
কথাটা কানে যেতেই শরীরে জোর এনে দৌড় দিলাম কটেজের দরজা লক্ষ্য করে৷ ফাস্ট এইড বক্সটা খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগল না৷ বাগানে এসে দেখলাম মেরীর রক্তাক্ত দেহের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে জন৷ ঠিক যেইভাবে রানিমা দেখেছিলেন৷ আমার হাত থেকে বক্সটা ছিনিয়ে নিয়ে তড়িঘড়ি করে মেরীর হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধতে লাগল সে৷ তার অস্থির কণ্ঠস্বরের অসংলগ্ন কয়েকটা শব্দ শোনা গেল৷ ‘তেমন কিছু হয়নি৷ হাতের কাছটা অনেকটা কেটে গেছে৷ রক্তটাও বন্ধ হয়েছে আপাতত৷ তবে যাই হোক৷ অল্পের উপর দিয়েই গেছে… ছুরিটা আরেকটু ভিতরের দিকে পড়লে…’
দু-জনে মিলে তাকে ধরে কটেজের ভিতরে এনে শুইয়ে দিলাম৷ বেশ কিছুক্ষণ সেবা-শুশ্রূষার পরে জ্ঞান ফিরল মেরীর৷ সে অবাক চোখে একবার আমার দিকে আর একবার জনের দিকে তাকাতে লাগল৷ আমি একগাল হেসে বললাম, ‘ছুরি… রক্ত আর জ্ঞানহীন দেহ মানেই সবসময় খুন হয় না৷ যেমন দুইয়ে-দুইয়ে সবসময় চার হয় না৷ বুঝলে? তবে তোমার বিয়ের আংটিটা একেবারে ভেঙে গেছে৷ নতুন একটা বানিয়ে দেবে জন৷ কী বল?’
জন পাংশু মুখে মাথা নাড়াল৷
মেরী কী যেন ভেবে বলল, ‘কিন্তু জেরাল্ড তোমার ছুরিটা তো আমি সরাইনি… কোথায় গেল ওটা?’
আমি হাসলাম, ‘ওটা আমিই তুলে রেখেছি৷ একজনকে খুন করার আছে৷’
‘সেকি! কাকে?’ দু-জনে একসাথে জিজ্ঞেস করল৷
‘আরে… রানিমাকে৷’
আমরা তিনজনেই হেসে উঠলাম৷ একসাথে৷
অনূদিত