দ্য জিপসি প্রফেসি

দ্য জিপসি প্রফেসি

‘আমার সত্যি মনে হচ্ছে,’ বলল ডাক্তার, ‘আমাদের যে কারও একজনের গিয়ে দেখে আসা উচিত ব্যাপারটা ভুয়া নাকি সত্যি।’

‘ভালোই বলেছ!’ বলল কনসিডাইন। ‘ডিনারের পরে সিগার ফুঁকতে ফুঁকতে আমরা ক্যাম্পটিতে একবার ঢুঁ মেরে আসব।’

নৈশভোজ শেষে জোশুয়া কনসিডাইন এবং তার বন্ধু ডা. বার্লে জলার পুব দিকে হাঁটতে বেরুল। ওদিকেই জিপসিদের ঘাঁটি। ওরা বেরুবার সময় মেরি কনসিডাইন বাগান থেকে হাঁক ছেড়ে তার স্বামীকে বলল :

‘ওদের কিন্তু একটা ফেয়ার চান্স দিয়ো, জোশুয়া। তবে ফরচুনের ব্যাপারে কোনোরকম ক্লু দেয়া চলবে না—আর হ্যাঁ, কোনো জিপসি মেয়ের সঙ্গে কিন্তু ফষ্টিনষ্টি করতে যেয়ো না-জেরাল্ডের দিকেও খেয়াল রেখো, ও যেন কারও ফাঁদে না পড়ে।’

জবাবে কনসিডাইন শপথ নেয়ার ভঙ্গিতে হাত তুলল। তারপর শিসের সুরে গাইতে লাগল পুরানো গানটি- দ্য জিপসি কাউন্টেস’। জেরাল্ডও গলা মেলাল। তারপর দুই বন্ধু ফেটে পড়ল হো হো হাসিতে। মেরির দিকে মাঝে মাঝেই ফিরে হাত নেড়ে দেখাল। মেরি ফটকের গায়ে হেলান দিয়ে আছে। গোধূলির আলোয় লক্ষ করছে ওদের।

গরমকাল। চমৎকার একটি সন্ধ্যা। ঝিরঝির বাতাসে ফুরফুরে মন। নতুন বিয়ে করেছে কনসিডাইন। তার ঘটনাবিহীন জীবনে এটিই একমাত্র উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মেরি উইনস্টনের পাণিপ্রার্থী ছিল সে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু মেরির উচ্চাভিলাষী বাবা-মা তাঁদের একমাত্র মেয়ের জন্য আরও যোগ্য পাত্র খুঁজছিলেন। তাই শুরু থেকেই ওঁরা মেরি-জোশুয়ার প্রণয়ের সম্পর্কে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। মি. এবং মিসেস উইনস্টন যখন তরুণ ব্যারিস্টারটির সঙ্গে তাদের মেয়ের ভাব ভালোবাসার বিষয়টি আবিষ্কার করেন, দুজনকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে মেয়েকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েকে দিয়ে এমন প্রতিজ্ঞাও করিয়েছিলেন সে কোনোভাবেই তার প্রেমিকের সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। কিন্তু প্রেম কোনো বাধা মানলে তো! প্রেমিকার অনুপস্থিতি কিংবা অবহেলার কোনোটিই তরুণকে তার অবস্থানচ্যুত করতে পারেনি। আর তার আশাবাদী প্রকৃতির মধ্যে হিংসা বা ঈর্ষা বিষয়টিই নেই। দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরে মেরির বাবা-মা হাল ছেড়ে দেন এবং দুই তরুণ-তরুণী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়।

ওরা কয়েকদিন ধরে একটি কটেজে থাকছে। এখানে মানিয়েও নিয়েছে বেশ। সপ্তাহখানেক আগে ওদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে জোশুয়ার কলেজজীবনের পুরানো বন্ধু জেরাল্ড বার্লে, যে নিজেও একদা মেরির রূপের দিওয়ানা ছিল। লন্ডনের প্রচণ্ড কাজের চাপ থেকে কিছুদিনের জন্য রেহাই পেতে তার এখানে আগমন।

স্বামী চলে যাওয়ার পরে মেরি বাড়িতে ঢুকল। পিয়ানোয় বসে মেন্ডেলসনের সুর বাজাতে লাগল।

জিপসি ক্যাম্প অল্পক্ষণের রাস্তা। ওখানে যেতে যেতে দুই বন্ধুর নতুন সিগারেট ধরানোরও অবকাশ মিলল না। জায়গাটি জিপসি ক্যাম্পের মতোই মনোহর। কয়েকজন মানুষ আগুনের ধারে বসে হাত দেখাচ্ছে। গরিবগুর্বোরা চৌহদ্দির বাইরে। সতৃষ্ণ নয়নে দেখছে ক্যাম্পের ভেতরে কী ঘটছে।

ওরা দুই বন্ধু হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে, এখানকার গ্রামবাসীদের অনেকেই জোশুয়াকে চেনে, তীক্ষ্ণ চোখের, সুন্দর দেখতে একটি ছোট মেয়ে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এল এবং বলল ওদের ভাগ্য বলে দেবে। জোশুয়া তার হাত বাড়িয়ে দিল, তবে মেয়েটি ওর হাতের দিকে না তাকিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মুখের দিকে। জেরাল্ড ওকে কনুই দিয়ে ঠেলা মারল :

‘ওর হাতে রুপোর মুদ্রা দিতে হবে,’ বলল সে। ‘এটা না দিলে ও মুখ খুলবে না।’

জোশুয়া পকেট থেকে একটি হাফ ক্রাউন বের করে মেয়েটিকে দিল কিন্তু সে ওদিকে না তাকিয়েই বলল :

‘জিপসির হাতে সোনা দিতে হবে।’

হাসল জোশুয়া। বলল, ‘ঠিক আছে, ছোট্ট মেয়ে। তাই পাবে। তবে আমার ভাগ্য গণনা করে খুব ভালো কিছু বলতে হবে।’ সে একটি স্বর্ণমুদ্রা দিল মেয়েটিকে। মেয়েটি মুদ্রা নিয়ে বলল :

‘আমি কারও ভালো কিংবা মন্দ ভাগ্য দিতে পারি না, তবে রাশিফল কী বলে তা বলতে পারি।’ সে জোশুয়ার ডান হাতটি টেনে নিল এবং সোজা . করে ধরল তালু। কিন্তু হাতের তালুতে চোখ রাখামাত্র ছেড়ে দিল হাত যেন জ্বলন্ত কয়লা স্পর্শ করেছে। তার চোখেমুখে দারুণ বিস্ময় এবং ভয়, এক ছুটে চলে গেল ওখান থেকে। ক্যাম্পের মাঝখানে, বড়সড় একটি তাঁবুর পর্দা তুলে তার ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

জোশুয়া অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। দুজনেই বড় তাঁবুটি লক্ষ করছে। একটু পরেই তাঁবুর পর্দা তুলে বেরিয়ে এল-না, ছোট মেয়েটি নয়, বেশ কর্তৃত্বপরায়ণ চেহারার, ঋজু দেহের মধ্যবয়ষ্ক এক নারী।

তাকে দেখামাত্র গোটা ক্যাম্প যেন স্থির এবং নিশ্চল হয়ে গেল। হইহল্লা, হাসি, কথাবার্তা সব বন্ধ। যেসব নারী-পুরুষ মাটিতে বসে ছিল কিংবা শুয়ে ছিল সকলেই ঝট করে উঠে দাঁড়াল, বিনীত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকল রাজকীয় চেহারার মহিলাটির দিকে।

‘এ নিশ্চয় রানি,’ বিড়বিড় করল জেরাল্ড। ‘যাক, আমাদের ভাগ্যটা ভালোই।’

জিপসি রানি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে গোটা ক্যাম্পে একবার চোখ বুলাল, তারপর এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে গটগট করে হেঁটে এসে দাঁড়াল জোশুয়ার সামনে।

‘আপনার হাতটা দেখি,’ হুকুমের সুরে বলল সে।

জেরাল্ড চাপা গলায় মন্তব্য করল, ‘স্কুলে পড়ার পর থেকে কেউ আমার সঙ্গে ওভাবে কথা বলেনি।’

‘জিপসিকে আপনার সোনা দিতে হবে।’

‘তা তো দিতেই হবে,’ ফিসফিস করল জেরাল্ড। জোশুয়া তালুতে একটি স্বর্ণমুদ্রা রেখে বাড়িয়ে দিল হাত।

জিপসি রানি ভুরু কুঁচকে হাতের দিকে তাকাল। তারপর ঝট করে চাইল ওর মুখের দিকে। বলল :

‘আপনার মনে কি জোর আছে-আপনার হৃদয় কি প্রকৃত হৃদয় যেটি আপনার ভালোবাসার মানুষের জন্য সাহস দেখাতে পারে?’

‘নিশ্চয় পারে,’ জবাব দিল জোশুয়া।

‘তাহলে আপনার প্রশ্নের জবাব আমি দেব, কারণ আপনার চেহারায় আমি সংকল্প দেখতে পাচ্ছি-প্রয়োজনে সংকল্প হয়ে উঠতে পারে বেপরোয়া এবং দৃঢ়। আপনি আপনার স্ত্রীকে ভালোবাসেন?’

‘অবশ্যই,’ জোর গলায় বলল জোশুয়া।

‘তাহলে ওকে এক্ষুনি ছেড়ে দিন-ওর মুখ আর জীবনেও দর্শন করবেন না। ওর কাছ থেকে চলে যান আপনার ভালোবাসা তাজা থাকতে থাকতে এবং মন অশুভ অভিপ্রায় থেকে মুক্ত থাকতে। জলদি যান—অনেক দূরে কোথাও যাবেন এবং আর কখনো আপনার স্ত্রীর কাছে ফিরে আসবেন না।’

জোশুয়া ওর হাতটি চটজলদি টেনে নিল। বলল, ‘ধন্যবাদ!’ তার গলার স্বর আড়ষ্ট এবং ব্যঙ্গাত্মক। সে হাঁটা দিয়েছে।

‘আরে, এভাবে চলে যাচ্ছ কেন?’ বলল জেরাল্ড। ‘নক্ষত্র, ভবিষ্যদ্বাণী এসবের ওপর রুষ্ট হয়ে লাভ নেই। তা ছাড়া টাকাও তো দিয়েছ-তার কী হবে? উনি আর কী বলেন সেটুকু অন্তত শুনে যাও।’

‘আপনি চুপ করুন!’ খেঁকিয়ে উঠল রানি। ‘কী করতে হবে আপনি জানেন না। উনি যেতে চাইছে যাক-কিছু না জেনেই চলে যাক। সাবধান না হলে আমার কী!’

জোশুয়া সঙ্গে সঙ্গে ফিরল। ‘ম্যাডাম, আপনাকে আমি টাকা দিলাম আমার কপালে অর্থকড়ির ভাগ্য আছে কিনা জানতে, বদলে আপনি কিনা আমাকে কিছু উপদেশ দিলেন!’

‘সাবধান!’ বলল জিপসি। ‘রাশিফল কিন্তু দীর্ঘদিন নীরব ছিল; ওই রহস্য এখনো অবগুণ্ঠনেই থাকতে দিন।’

‘মাই ডিয়ার ম্যাডাম, প্রতিদিন আমার জীবনে রহস্য আসে না এবং আমি টাকা খরচ করছি কিছু জানার জন্য, অন্ধকারে থাকার জন্য নয়।’

জিপসি রানি জোশুয়ার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল : ‘আপনার যা ইচ্ছা। আপনিই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং আপনাকে সাবধানও করা হয়েছে। এখন আপনিই আপনার নিয়তি বেছে নেবেন।

‘আমেন!’ বলল জেরাল্ড।

উদ্ধত ভঙ্গিতে জোশুয়ার হাতখানা আবার টেনে নিল রানি। ওর ভাগ্য বলতে শুরু করল।

‘এখানে রক্তের নহর বইছে দেখতে পাচ্ছি; শিগগির এ রক্ত প্রবাহিত হবে; আমার দৃষ্টিপথে এ প্রবাহিত হচ্ছে। একটি কাটা আঙুলের আংটির মাঝ দিয়ে বইছে রক্ত।’

‘বলে যান!’ বলল জোশুয়া, হাসছে। জেরাল্ড নিশ্চুপ।

‘আরও পরিষ্কার করে বলব?’

‘নিশ্চয়। আমরা সাধারণ মানুষ নির্দিষ্টভাবেই কিছু জানতে চাই।’

শিউরে উঠল জিপসি তারপর নাটুকে গলায় বলল, ‘এটা এক খুনির হাত-তার স্ত্রীর হত্যাকারী।’ হাতখানা ছেড়ে দিয়ে সে ঘুরে দাঁড়াল।

হেসে উঠল জোশুয়া। ‘কী জানেন, আপনার জায়গায় আমি হলে বিজ্ঞান এবং দর্শনের মিশেল দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতাম। যেমন আপনি বললেন, ‘এটা এক খুনীর হাত।’ ভবিষ্যতে এটা যা-ই হোক বা সম্ভাবনা যা-ই থাকুক—বর্তমানে সেরকম কোনো সম্ভাবনাই নেই। আপনার ভবিষ্যদ্বাণী হওয়া উচিত ছিল এরকম—’এটি সেই হাত যেটি হবে খুনির।’ কিংবা ‘এটি সেই লোকের হাত যে হবে তার স্ত্রীর হত্যাকারী।’ রাশিফলের বিষয়টি আসলে টেকনিক্যাল প্রশ্নের সঙ্গে যায় না।’

জিপসি এ কথার কোনো জবাব দিল না। মাথা নিচু করে, মনমরা ভাব নিয়ে এগোল তার তাঁবুর দিকে। পর্দা তুলে ঢুকে গেল ভেতরে।

ওরা দুজন কোনো কথা না বলে বাড়ির পথ ধরল। জলার পাশ দিয়ে হাঁটছে। কিছুক্ষণ পরে একটু ইতস্তত করে নীরবতা ভঙ্গ করল জেরাল্ড।

‘ওল্ডম্যান, এটা স্রেফ একটা ঠাট্টা, বাজে রসিকতা। ঠাট্টা ঠাট্টাই। এটা আমাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই কি ভালো হয় না?’

‘মানে?’

‘না মানে এ নিয়ে তোমার স্ত্রীকে কিছু বোলো না। সে হয়তো ভয় পাবে।‘

‘ভয় পাবে! মাই ডিয়ার জেরাল্ড, তুমি এসব কী বলছ? বোহেমিয়ার সমস্ত জিপসি এসেও যদি বলে আমি ওকে হত্যা করব তবু ও ভয় পাবে না কিংবা আতঙ্কিত হবে না। এসব নিয়ে ও চিন্তাই করবে না।’

আপত্তি করল জেরাল্ড। ‘বন্ধু, মহিলারা পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তাদের নার্ভাস সিস্টেমের সঙ্গে আমাদেরটা মেলে না। আমরা ও সম্পর্কে জানিও না। আমি কর্মক্ষেত্রে এরকম বহু দেখেছি। তাই বলছি ওকে এ বিষয়ে কিছু বলার দরকার নেই। বললে ও ভয় পেয়ে যাবে।’

জবাব দেয়ার সময় অজান্তেই কঠোর হয়ে এল জোশুয়ার মুখ। ‘বন্ধু, আমি আমার স্ত্রীর কাছে কিছুই গোপন করি না। বরং দুজনের মধ্যে এটা দিয়ে নতুন একটা শুরু হবে। পরস্পরের কাছে আমাদের গোপন করার কিছু নেই। কখনো এমনটি ঘটলে দেখবে আমাদের সম্পর্কটাই বদলে গেছে।’

‘তবু,’ বলল জেরাল্ড, ‘আমি বলছি কাজটা করা ঠিক হবে না।’

‘তুমি দেখছি জিপসির প্রতিটি কথা বিশ্বাস করে বসে আছো,’ বলল জোশুয়া। ‘তোমার সঙ্গে মহিলাকে মনে হচ্ছে একই সুতোয় গাঁথা। আচ্ছা, এটা কোনো সাজানো ব্যাপার নয় তো? তুমিই আমাকে জিপসি ক্যাম্পের কথা বলেছ-রানির সঙ্গে আগে যোগসাজশ করে কিছু করোনি তো?’ পরিহাসের ছলে কথাটা বলা। জেরাল্ড তাকে আশ্বস্ত করল ক্যাম্পের কথা সে মাত্র জেনেছে সকালে, কাজেই এর মধ্যে দুই নম্বরি করার কোনো অবকাশ ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে সে তার বন্ধুর প্রতিটি কথা নিয়ে ঠাট্টা- তামাশা করল। কিছুক্ষণ পরে তারা পৌঁছে গেল কটেজে।

মেরি পিয়ানোয় বসে আছে, তবে বাজাচ্ছে না। গোধূলির আলো তার ভেতরে কী এক আবেগের সৃষ্টি করেছে, চোখ হয়ে উঠেছে অশ্রুসজল। ওরা দুজন ঘরে ঢুকলে মেরি স্বামীর কাছে গিয়ে তাকে চুম্বন করল। জোশুয়া করুণ একটি মুখভঙ্গি করল।

‘মেরি,’ গভীর গলায় বলল সে, ‘তোমাকে আমাদের নিয়তির কথা জানানো দরকার। রাশিফল বলছে আমাদের ভাগ্য সংকটাপন্ন ‘

‘কী হয়েছে, ডিয়ার? আমাদের রাশিফলের কথা বলো। তবে দয়া করে ভয় পাইয়ে দিয়ো না।’

‘না, আমি তোমাকে ভয় পাইয়ে দিতে চাই না। তবে একটি সত্য কথা তোমার জানা উচিত। নাহ্, বলাটা প্রয়োজন যাতে আগেভাগেই তুমি সকল প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারো।’

‘বলতে থাকো, ডিয়ার, আমি শুনছি।’

‘মেরি কনসিডাইন, তোমার প্রতিমূর্তি মাদাম তুশোর জাদুঘরে দেখা যেতে পারে। রাশিফল বলছে আমার এই হাত রক্তে লাল হয়ে যাবে—তোমার রক্তে, মেরি! মেরি! মাই গড!’ সে লাফ দিয়ে সামনে বাড়ল, তবে ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেছে মেরি।

‘আমি তোমাকে মানা করেছিলাম,’ বলল জেরাল্ড। ‘বলেছিলাম আমি মেয়েদের যেভাবে চিনি তুমি ততটা তাদের জানো না।’

খানিক বাদে মূর্ছা ভাঙল মেরির। তবে হিস্টিরিয়া রোগীর মতো সে হাসল এবং কাঁদল, উন্মত্ত আচরণ করল এবং চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘ওকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখো-আমার কাছ থেকে আমার স্বামী জোশুয়াকে দূরে সরিয়ে রাখো।’ সে ভয়ে বারবার একই সকাতর অনুরোধ করে যেতে লাগল।

জোশুয়া কনসিডাইন বৌয়ের অবস্থা দেখে তীব্র মর্মবেদনায় ভুগতে লাগল। মেরি যখন অবশেষে একটু সুস্থির হলো, সে তার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে তার হাত-পা এবং চুলে চুম্বন করতে করতেআবোল তাবোল যা খুশি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে লাগল। সারা রাত মেরির পাশে বসে তার হাত মুঠোয় পুরে জেগে রইল জোশুয়া। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠল মেরি। তার স্বামী তাকে শান্ত করল, মেরি যখন বুঝতে পারল তার স্বামী তার পাশেই আছে, কান্না থামাল সে।

পরদিন সকালে নাশতা করতে দেরি হয়ে গেল। জোশুয়ার কাছে একটি টেলিগ্রাম এসেছে। যেতে হবে কুড়ি মাইল দূরের উইদারিংয়ে। কিন্তু সে যেতে চাইছিল না। মেরি তাকে জোর করে পাঠাল। দুপুরের আগে আগে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল জোশুয়া।

সে চলে যাওয়ার পরে মেরি ঢুকল নিজের কামরায়। লাঞ্চের আগে তার চেহারা দেখা গেল না। তবে বিশাল উইলোগাছের নিচের লনে টেবিল পেতে যখন বৈকালিক চা পরিবেশন করা হলো, তখন মেহমানের সঙ্গে যোগ দিল মেরি। আগের রাতের ধকল অনেকটাই সামলে উঠেছে সে। এটা সেটা নিয়ে মামুলি আলাপ শেষে সে জেরাল্ডকে করুণ গলায় বলল, ‘কাল রাতে আমি খুব বোকার মতো আচরণ করেছি। তবে ভয়টাকে কিছুতেই সামাল দিতে পারিনি। ওটা নিয়ে ভাবলে এখনো ভয় লাগবে আমার। তবে এসব লোক এগুলো স্রেফ কল্পনা করেই বলে থাকে। আমি একটি পরীক্ষা করে দেখব যে ভবিষ্যদ্বানীটা ভুয়া কিনা।’

‘তোমার মতলব কী?’ জিজ্ঞেস করল জেরাল্ড।

‘আমি নিজেই জিপসি ক্যাম্পে যাব এবং জিপসি রানিকে বলব আমার ভাগ্যে কী আছে বলতে।’

‘বেশ বেশ। আমিও তোমার সঙ্গে যাই?’

‘না, না। তাহলে সব ভন্ডুল হয়ে যাবে। মহিলা তোমাকে চিনে ফেলতে পারে এবং আমার মতলব টের পেয়ে গেলে সেই রকমভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করবে। আমি আজ একাই যাব ওখানে।‘

অপরাহ্নের আলো ফুরিয়ে এলে মেরি কনসিডাইন জিপসি ক্যাম্পের পথ ধরল। আধঘণ্টা পরেই সে ফিরে এল। ঢুকল ড্রইংরুমে। জেরাল্ড তখন সোফায় শুয়ে বই পড়ছে। মেরির মুখখানা খড়ির মতো সাদা, উত্তেজনায় কাঁপছে। দোরগোড়াও পার হতে পারেনি, হুড়মুড় করে পড়ে গেল মেঝেতে। গোঙাচ্ছে। জেরাল্ড ছুটে গেল ওর কাছে। তবে মেরি জেরাল্ডের সাহায্য ছাড়া নিজেই উঠে বসল। ওকে চুপ থাকতে ইশারা করল। অপেক্ষা করছে জেরাল্ড। মেরিকে সামলে উঠতে সময় দিচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে সুস্থির হলো মেরি। তারপর খুলে বলল কী ঘটেছে।

‘আমি ক্যাম্পে গিয়ে দেখি,’ বলতে লাগল মেরি, ‘ওখানে কোনো জনমানুষ নেই। আমি ক্যাম্পের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। হঠাৎ এক লম্বা মহিলা এসে হাজির আমার পাশে। ‘আমাকে নাকি কেউ খুঁজছে,’ বলল সে। আমি আমার হাতটি বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে একটি রৌপ্যমুদ্রাসহ। সে নিজের গলা থেকে একটি সস্তা ক্ষুদ্র অলংকার খুলে নিয়ে মুদ্রাটির পাশে রাখল। তারপর দুটি একত্রিত করে পাশের নালায় ছুড়ে দিল। তারপর সে আমার হাত তার হাতে নিয়ে বলল, ‘এই পাপিষ্ঠ জায়গায় রক্তস্রোত বইবে।’ তারপর ঘুরে দাঁড়াল চলে যাওয়ার জন্য। আমি খপ করে তার হাত চেপে ধরে অনুরোধ করলাম আরও কিছু বলার জন্য। একটু ইতস্তত করে সে বলল, ‘হায়! হায়! আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি তোমার স্বামীর পায়ের কাছে পড়ে আছ। তার হাত রক্তে রঞ্জিত।’

মেরির গল্প অস্বস্তিতে ফেলে দিল জেরাল্ডকে। সে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল ব্যাপারটা। ‘এ মহিলার দেখছি খুনখারাবির দিকে প্রবল ঝোঁক।’

‘হেসো না,’ বলল মেরি। ‘আমি সইতে পারব না।’ তারপর আকস্মিক আবেগের তাড়নায় একরকম ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

কিছুক্ষণ পরে ফিরল জোশুয়া। হাসিখুশি, উজ্জ্বল। খিদেয় চোঁ চোঁ করছে পেট। তার উপস্থিতি আনন্দিত করে তুলল মেরিকে। তবে ও যে জিপসি ক্যাম্পে গিয়েছিল তা স্বামীকে জানাল না। তাই জেরাল্ডও কিছু বলল না। যেন উভয় পক্ষের মৌন সম্মতিতেই বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা হলো না সেই সন্ধ্যায়। যদিও মেরির চেহারায় কেমন অদ্ভুত, আড়ষ্ট একটা ভাব ফুটে রইল যা নজর এড়াল না জেরাল্ডের।

দুই

সকালে জোশুয়া নাশতা খেতে এল নির্দিষ্ট সময়ের খানিক বাদে। মেরি অনেক সকালেই উঠে পড়েছে ঘুম থেকে। তবে সময় যত গড়াতে লাগল মনে হলো সে একটু নার্ভাস হয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝেই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে।

জেরাল্ড লক্ষ না করে পারল না যে নাশতার টেবিলে কেউই ঠিকমতো খাবার তুলছে না মুখে। চপগুলো খুব শক্ত নয় কিন্তু ছুরি দিয়ে কাটা যাচ্ছে না। সবগুলো ছুরিই ভোঁতা। অতিথি বলে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত রইল জেরাল্ড, তবে দেখল জোশুয়া অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে তার ছুরির ধার পরীক্ষা করছে ফলায় বুড়ো আঙুল ঘষে। তাকে অমন করতে দেখে মেরির মুখ শুকিয়ে গেল। প্রায় অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়।

নাশতা শেষে সকলে গেল বাগানে। মেরি ফুলের তোড়া বানাচ্ছে, স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে কয়েকটা টি-রোজ দাও তো, ডিয়ার।’

জোশুয়া বাড়ির সামনের একটা ঝাড় ধরে টান মারল। কাণ্ড বাঁকা হয়ে এল কিন্তু ঝাড়টা তোলা গেল না। পকেটে হাত ঢোকাল সে ছুরি বের করতে। পেল না।

‘তোমার ছুরিটা আমাকে দাও তো, জেরাল্ড,’ বলল সে। কিন্তু জেরাল্ডের কাছে ছুরি নেই। জোশুয়া ব্রেকফাস্ট রুমে গিয়ে একটা ছুরি নিয়ে এল। ওটার ধার পরীক্ষা করতে করতে অসন্তোষে বিড়বিড় করে বলল, ‘ছুরিগুলোর সব হলো কী- সব কটার ধার কমে গেল?’ মেরি চট করে ঘুরে ঢুকে পড়ল বাড়িতে।

জোশুয়া ভোঁতা ছুরি দিয়ে গাছের কাণ্ড কাটার চেষ্টা করল। বেশ ধস্ত াধস্তি করে কাজটা শেষ করল সে। এদিকে ঝোপের ঝাড় ঘন হয়ে জন্মেছে। ঝাড়গুলো কেটে ফেলবে ঠিক করল সে।

যেখানে বাসনকোসন, ছুরি ইত্যাদি রাখা হয় সেই জায়গাটি খুঁজেও কোনো ধারাল ছুরি পেল না জোশুয়া। মেরিকে ডাকল ও। মেরি এলে তাকে ছুরিগুলোর দশা বর্ণনা করল। মেরিকে খুব উত্তেজিত এবং বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। সব শুনে সে যেমন অবাক হলো তেমনি ব্যথিত। মেরিকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমিই সবগুলো ছুরি ভোঁতা করে রেখেছ?’

কান্নায় ভেঙে পড়ল মেরি। ‘ওহ্, জোশুয়া, আমি এমন ভয় পেয়েছিলাম!’

রক্তশূন্য দেখাল জোশুয়ার চেহারা। ‘মেরি!’ বলল সে, ‘এই-ই বিশ্বাস করো তুমি আমাকে? আমার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে!’

‘ওহ, জোশুয়া! জোশুয়া!’ হাউমাউ করে কাঁদছে মেরি। ‘আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও।’ সে অঝোরে কাঁদতেই লাগল।

জোশুয়া একটু ভেবে বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। হয় এটার অবসান ঘটাতে হবে নয়তো আমরা পাগল হয়ে যাব।’

সে ছুট দিল ড্রইংরুমে

‘কোথায় যাচ্ছ তুমি?’ প্রায় হাহাকারের মতো শোনাল মেরির কণ্ঠ 1

জেরাল্ড যা ভয় করছিল তা-ই দেখতে পেল। ফ্রেঞ্চ উইন্ডো থেকে মস্ত একটা গুর্খা চাপাতি হাতে জোশুয়াকে বেরিয়ে আসতে দেখে সে জন্যই অবাক হলো না।

এটি সেন্টার টেবিলে সারাক্ষণ পড়ে থাকে। উত্তর ভারত থেকে জোশুয়ার ভাই তাকে ছুরিটি পাঠিয়েছিল। এটি একটি হান্টিং নাইফ। গুর্খারা মারামারির সময় প্রচণ্ড ধারাল এবং ভারী এ ছুরিটি ব্যবহার করে। এ জিনিস দিয়ে এক কোপে একটা ভেড়ার কল্লা নামিয়ে দেয়া যায়।

জোশুয়াকে চকচকে অস্ত্রটি হাতে কামরা থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে ভয়ে ত্রাহি চিৎকার দিল মেরি এবং গত রাতের হিস্টিরিয়ার ঘটনাটি পুনরাবৃত্তি হলো

মেরিকে পড়ে যেতে দেখে ছুটে গেল জোশুয়া, হাত থেকে ছুড়ে ফেলেছে ছুরি, চেষ্টা করল স্ত্রীকে ধরতে।

তবে এক সেকেন্ড দেরি হয়ে গেছে জোশুয়ার। দুই বন্ধু ভয়ে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল নগ্ন ফলার ওপর মেরিকে পড়ে যেতে দেখে।

জেরাল্ড দৌড়ে গিয়ে দেখে মেরির বাঁ হাতখানা ঘাসের ওপর পড়ে থাকা ছুরির ফলার গায়ে লেগেছে। আঘাতে তার হাতের ছোট ছোট কয়েকটি শিরা কেটে গেছে এবং ক্ষতস্থান থেকে গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে। ক্ষতস্থান বেঁধে দেয়ার সময় সে জোশুয়াকে ইঙ্গিতে দেখাল ফলার আঘাতে বিয়ের আংটিটি খণ্ডিত হয়ে গেছে।

অজ্ঞান মেরিকে ধরাধরি করে ওরা বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। অনেকক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরল মেরির। হাতখানা বাঁধা স্লিংয়ের সঙ্গে। তবে ওকে খুশি খুশিই লাগছিল। সে স্বামীকে বলল, ‘জিপসির ভবিষ্যদ্বাণী প্ৰায় ফলে যাচ্ছিল। প্রায় বাস্তব হতে চলছিল তার প্রফেসি।’

জোশুয়া প্রত্যুত্তরে ঝুঁকে স্ত্রীর আহত হাতে চুম্বন করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *