দ্য গোল্ড-বাগ
মি. উইলিয়াম লিগ্র্যান্ড!
প্রাচীন হুগেনট বংশোদ্ভুত একদল বিত্তশালী পুরুষ। এক সময় তিনি অগাধ ধন সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে সবকিছু খুঁইয়ে অর্থাভাবের মধ্য দিয়ে তাকে দিনাতিপাত করতে হয়।
বেশ কয়েক বছর আগে মি. লিগ্র্যান্ডের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তারপর ক্রমে তার সঙ্গে আমার হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
প্রথম জীবনে তিনি পূর্বপুরুষেরনিউ অর্লিয়েন্স মহলেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন। কিন্তু ধনসম্পত্তি খুইয়ে প্রায় নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে পড়ার পর নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে দক্ষিণ কালিফোনিয়ার অন্তর্গত চার্লসটনের অদূরবর্তী সুলিভাস দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানেই ঘর বেঁধে পাকাপাকিভাবে বসবাস করতে থাকেন।
সুলিভান দ্বীপটা বাস্তবিকই বৈচিত্র্যে ভরপুর। এর দৈর্ঘ্য প্রায় তিন মাইল। আর মাইলের পর মাইল জুড়ে কেবল সমুদ্রের বালি আর বালি। প্রস্থ যেখানে সবচেয়ে বেশি সেটা সিকি মাইলের বেশি নয়।
মূল ভূখণ্ড আর দ্বীপটার মধ্যে একটা খাড়ি অবস্থান করছে, যেটা পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
বালির রাজ্য দ্বীপটার এখানে-ওখানে গুটি কয়েক ছোট ছোট ঝোঁপঝাড় ছাড়া আর কিছুই নেই। দ্বীপটায় দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকালে যতদূর দৃষ্টি চলে বড়সড় কোনো গাছের চিহ্নও নজরে পড়ে না।
দ্বীপটার পশ্চিম দিকের একেবারে শেষ প্রান্তে মূল দূর্গটি অবস্থিত। দূর্গটাকে ঘিরে রেখেছে বহু পুরনো প্রায় ধসে-পড়া কয়েকটা বাড়ি। ধূলোবালি আর জ্বরাজরির ভয়ে চার্লসটন শহর ছেড়ে পালিয়ে এসে কিছু লোক গরমকালে এসব ভাঙাচোরা বাড়ি ভাড়া নিয়ে মাথা গুঁজে কোনোরকমে দিন গুজরান করে। আর বেঁটেখাট কিছু তালগাছও এ অঞ্চলটায় দেখা যায়।
আরও আছে। দূর্গ, ভাঙাচোরা পুরনো বাড়ি আর তালগাছের, সারি ছাড়া এ ছাড়া দ্বীপটায় আর যা-কিছু নজরে পড়ে তা হচ্ছে, সম্পূর্ণ দ্বীপটাই জুড়ে রয়েছে মার্টন ফুলের ঝোঁপঝাড়ে ভর্তি। এ মনোলোভা ফুল ইংল্যাণ্ডের ফুল-চাষীদের কাছে খুব প্রিয়। এগুলো পনেরো-ডবশ ফুট লম্বা গাছের ঝোঁপ। আর কিছুদিনের মধ্যেই এমন গভীর জঙ্গলে পরিণত হয়ে যায় যে, কারো পক্ষে সেখানে ঢোকা সম্ভব নয়। তবে এ ফুলের উগ্র গন্ধ বাতাস-বাহিত হয়ে দ্বীপময় জড়িয়ে পড়ে এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করে।
মি. লিগ্র্যান্ডের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় একেবারেই আকস্মিকভাবে। আমাদের মধ্যে যখন পরিচয় তখন তিনি মুলিভান দ্বীপেরই পূর্বপ্রান্তে ছোট এক কুড়েঘর তৈরি করে কোনোরকমে দিন গুজরান করছেন।
আমাদের প্রথম পরিচয় ক্রমে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তারপর সে বন্ধুত্ব দ্রুত গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে। কিন্তু কেন? এর কারণ অবশ্যই ছিল। দ্বীপবাসী লোকটার মধ্যে এমনকিছু আকর্ষণীয় ছিল, যা আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে তার প্রতি শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়ে তোলে আর যারপরনাই আগ্রহান্বিত হয়ে পড়ি।
প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম, লোকটা খুবই শিক্ষিত, মানসিক দৃঢ়তাও অতুলনীয়। কিন্তু তার মানসিক দৃঢ়তার একটা বিশেষত্ব অবশ্যই ছিল। বিশেষত্বটা কি? মানুষের প্রতি চরম বিদ্বেষ। তাকে কখনও দেখা উৎসাহ-উদ্দীপনার। ভরপুর আবার পরমুহূর্তেই দেখা গেছে তিনি যেন এক বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি।
মি. লি গ্র্যান্ডের কুড়ে ঘরে অনেক পুঁথি-পুস্তক ছিল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, তিনি খুব কমই সেগুলোর পাতায় চোখ বুলাতেন।
তার বিনোদনের সবচেয়ে বড় অবলম্বন ছিল মাছ ধরা আর শিকারের মধ্যে নিজেকে লিপ্ত রাখা। আর তা নইলে সমুদ্র সৈকতের লাগোয়া মার্টল ফুলের ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে কীটপতঙ্গের পিছন-পিছন ছুটে বেড়ানো বা ঝিনুকের খোঁজ করে মহানন্দে সময় কাটানোতেই ছিল তার মনের মতো বিনোদন। তার কীটপতঙ্গের নমুনা-সংগ্রহটা বাস্তবিকই অবাক হয়ে দেখার মতোই বটে। এসব অভিযানে তার সঙ্গি হিসেবে সারাক্ষণ পাশে পাশে থাকত এক বুড়ো নিগ্রো। নাম তার জুপিটার।
জুপিটার এক সময় ক্রীতদাস ছিল। দুর্বিষহ জীবন যাপন করত।
মি. লিগ্র্যান্ড পরিবারের দুঃসময় দেখা দেওয়ার আগেই জুপিটারকে ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। যুবক মাসা উইলের পথ অনুসরণ করাকে সে কর্তব্য বলে মনে করত। আর এটাকে সে তার অধিকার বলেও মনে প্রাণে বিশ্বাস করত। কোনো লোভ বা ভয়-ভীতিই তাকে নিজের অধিকার থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারেনি।
আবার এমন হওয়াও কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয় যে, লোকটাকে সহজ সরল বোকা হাঁদা পেয়ে মি. লিগ্র্যান্ডের আত্মীয়স্বজনরাই এ বিশ্বাসটুকু দৃঢ়ভাবে তার বুকে গেঁথে দিয়েছে, যাতে এ ছন্নছাড়া যুবকটার দেখভালে নিজেকে লিপ্ত রাখে।
মুলিভান দ্বীপটাকে চারদিক থেকে উত্তাপ-উদ্দাম সমুদ্র ঘিরে থাকায় এখানে শীত কোনোদিনই জাঁকিয়ে পড়তে পারে না। বছরের শেষের দিনগুলোতেও খুব কম দিনই ঘরে আগুন জ্বালাবার দরকার হয়। তবে আঠার-র অক্টোবরের মাঝামাঝি একদিন শীত রীতিমত জাঁকিয়ে পড়ল।
আমি সূর্যপাটে বসার ঠিক আগে সবুজ গাছগাছালির ভেতরের এক-পেয়ে রাস্তা ধরে লম্বা-লম্বা পায়ে হেঁটে আমি কোনোরকম বন্ধু লিগ্র্যান্ডের কুড়েঘরের দরজায় হাজির হতে পারলাম।
দীর্ঘ সপ্তাহ কয়েক বন্ধুর সঙ্গে আমার দেখা নেই। এর কারণ, ছিল বটে। তখন আমি চার্লসটন শহরে। মুলিভান দ্বীপ থেকে নয় মাইল দূরে ছিল, মুলিভন শহরের দূরত্ব বেশি নয়, মাত্র ন’ মাইল। কিন্তু তখনকার দিনে সেখান থেকে দ্বীপে যাতায়াতের ব্যবস্থা এখনকার মতো ভালো ছিল না।
বন্ধুবর লিগ্র্যান্ডের কুড়েঘরের দরজায় পৌঁছে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ।
অভ্যাস মতো দরজায় বার-কয়েক টোকা দিলাম। না, দরজা খোলার কোনো লক্ষণ দেখতে পেলাম না, আমার ভুল ভেঙে গেল, দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করা নয়, ঘরের ভেতরে কেউ নেই। এরকম নিঃসন্দেহ হয়ে গোপন স্থানটা থেকে হাতড়ে হাতড়ে চাবিটা বের করে আনলাম। দরজাটা খুলে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলাম।
ঘরে ঢুকে দেখলাম, চুল্লিটিতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ঘটনাটা অদ্ভুতই বটে। কিন্তু সে দিনটার কথা বিচার করলে স্বীকার করতেই হবে, চুল্লিতে আগুন জ্বেলে রাখার ব্যবস্থাটা অবশ্যই সঙ্গত ছিল। ঘরে ঢুকে আমি গা থেকে ওভারকোটটা খুলে ফেললাম। এবার চেয়ারটাকে টানতে টানতে জ্বলন্ত চুল্লিটার কাছে নিয়ে জুত করে বসলাম। আমেজ করে আগুন পোহাতে পোহাতে বাড়ির মালিকের ফিরে-আসার জন্য ধৈৰ্য্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কনকনে ঠাণ্ডা থেকে ঘরে ঢুকেই জ্বলন্ত চুল্লিটা পেয়ে যাওয়াতে নিজেকে ভাগ্যবান না ভেবে পারলাম না।
রাতের অন্ধকার নেমে আসার একটু পরেই মি. লিগ্র্যান্ড তার অনুগত ভৃত্য জুপিটারকে নিয়ে ঘরে নিয়ে এলেন। দরজায় পৌঁছেই আমাকে ঘরের ভেতরে দেখেই তিনি উচ্ছ্বসিত আবেগের সঙ্গে আমাকে স্বাগত জানালেন।
জুপিটার দাঁতের পাটি বের করে হাসতে হাসতে রাতের খাবার রান্না করতে চলে গেল। সে ব্যস্ত হাতে মুরগির মাংস রান্না করতে লাগল।
আমার বন্ধুবর গৃহকর্তা লিগ্র্যান্ডের বুক জুড়ে তখন উৎসাহের তুফান বয়ে চলেছে। এ ছাড়া অন্য কোনো ভাষাতেই বা তার তখনকার মানসিক অবস্থার বর্ণনা দেওয়া যাবে। অজানা-অচেনা দ্বীপে বেড়াতে বেড়িয়ে তিনি নতুন প্রজাতির ঝিনুক পেয়েছেন; আর ধরতে পেরেছেন জুপিটারের সাহায্য সহযোগিতায় এমন একটা নতুন ধরনের ঝিঁঝি পোকা যেটাকে পরদিন সকালে উৎসাহের সঙ্গে আমাকে দেখিয়ে আমার অভিমত জানতে চেয়েছেন। সকাল হলে সেটাকে দেখাবার পূর্ণ প্রতিশ্রুতি দিলেন।
আমি তার কথা শুনে চুল্লির আগুনের ওপর হাত দুটোকে ঘষতে ঘষতে মুচকি হেসে বললাম–কাল সকালে? সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার কী? এখনই– আজ রাতেই বা নয় কেন, জানতে পারি কী?
আমি ঠোঁটের হাসিটুকু অব্যাহত রেখেই ছোট্ট করে বললাম–‘তাই বুঝি? তবে আর
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বন্ধু আক্ষেপসূচক শব্দ উচ্চারণ করে বললেন ‘আহা! রাত না পোহালেও সকাল হবার আগে তো সেটাকে দেখানো সম্ভব হচ্ছে না। এক কাজ করুন, আজ রাতটা এখানে কাটিয়ে দিন। সকালে জুপিটারকে পাঠিয়ে লেফটেন্যান্ট জে-র কাছ থেকে পোকাটা আনাব। তাই বলছি, কাল সকালের আগে পোকাটা আপনাকে দেখানো সম্ভব হবে না। আরে ভাই, একটা মাত্র তো রাতের ব্যাপার, আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দিন। সূর্য উঠলেই জুপিটারকে পাঠিয়ে দেব, এক দৌড়ে গিয়ে সেটা নিয়ে আসবে। উফ্! কী সুন্দর যে পোকাটা ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। এমন সুন্দর পোকা এর আগে চোখে পড়েনি।
‘কী? কি বললেন? সূর্যোদয় হলে–‘
‘হ্যাঁ, ভোর হলেই। পোকাটার সৌন্দর্য যে কী মনোলোভা, চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবেন না। ঝকমকে সোনালি তার রঙ আকার বড় একটা বাদামের মতো। আর পিঠের এক কোণায় গাঢ় কালো ফোঁটা; আর অন্য ধারে লম্বাটে একটা দাগ। সব মিলে যে কী দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে, তা আর বলার নয়। আর তার শুঁয়া। দুটো তো রীতিমত
জুপিটার তাকে আর অগ্রসর হতে না দিয়ে বলে উঠল–‘হুজুর, আপনাকে তো বহুবারই বলেছি, ওটা সোনার ঝি ঝি পোকা, আরনির্ঘাৎ সেনার ঝি ঝি পোকা-নিরেট সোনার, ভেতর-বাইরে সবটাই সোনা। সত্যি বলছি, এমন ভারি ঝি ঝি পোকা আমি জীবনে আর কোনোদিনই দেখিনি। দেখলে চোখ ট্যারা হয়ে যায়।
আমি ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বললাম–‘সোনা?নিরেট খাঁটি সোনা?’
‘হ্যাঁ, ঠিক তা-ই।
বন্ধু লিগ্রান্ড প্রায় ধমকের স্বরে বলল–‘ভালো ভালো, তা যা-ই হোক, দেখুন ‘দেখুন ভাই, সত্যি কথা বলতে কি, পাকাটার রঙ এমন ঝকমকে যে, জুপিটার যে
ওটাকে সোনার তৈরি মনে করছে তা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়।
‘তাই বুঝি?
‘তবে আর বলছি কি ভাই। পোকাটার গা থেকে এমন অত্যুজ্জ্বল আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল তার চেয়ে বেশি উজ্জ্বল কোনো ধাতব আলোকচ্ছটা কেবলমাত্র আমিই নই, আপনিও আগে কোনোদিন দেখেননি, আমি হলফ করে জোর গলায় বলতে পারি।’
আমি কি বলব ভেবে না পেয়ে নীরবে তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
লিগ্র্যান্ড এবার হতাশার স্বরে বলে চললেন–‘কিন্তু ভাই, ভোর হবার আগে তো আপনাকে সেটা দেখানো সম্ভব হচ্ছে না। আর আপনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারছেন না। তবে আপাতত ওই পোকাটার আকৃতি সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ ধারণা আপনাকে দেওয়া যেতে পারে। এতেও আপনার মন কিছুটা অন্তত ভরতে পারবে।
কথাটা বলতে তিনি দু-পা সরে গিয়ে ছোট টেবিলটার কাছে গেলেন। চেয়ার টেনে বসলেন। টেবিলের ওপর কালি-কলম রয়েছে, কিন্তু কাগজ নেই। ড্রায়ারটা খুলে দেখলেন, সেখানেও কাগজ পেলেন না। শেষপর্যন্ত তিনি জ্যাকেটের পকেটে হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন–ঠিক আছে, এতেই কাজ মিটে যাবে।’
কথাটা বলেই তিনি জ্যাকেটের পকেটে হাত চালিয়ে দিয়ে এক চিলতে নোংরা ভাঁজ করা কাগজ বের করে আনলেন। এবার কাগজটার ভাঁজ খুলে টেবিলে পেতে তার গায়ে কল দিয়ে একটা রেখাচিত্র আঁকলেন।
আমি তীব্র শীতের জন্য তখনও জ্বলন্ত চুল্লিটার পাশেই বসে রইলাম। সেখান থেকেই আগ্রহের সঙ্গে কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলাম। রেখাচিত্রটা আঁকা শেষ হলে তিনি চেয়ারে বসে থেকেই আমার দিকে সামান্য ঝুঁকে এগিয়ে দিলেন।
আমিও তাঁর দিকে সাধ্যমত ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিতেই তীব্র একটা গর্জন কানে এলো। অবিশ্বাস্য রকম তীব্র সে গর্জনটা কানে যেতেই ভয়ে আমার বুকের ভেতরে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল।
পর মুহূর্তেই ঘরের বন্ধ-দরজাটার গায়ে কর্কশ মচ্ মচ শব্দ হতে লাগল। মনে হলো তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে কেউ দরজার পাল্লার গায়ে ক্রমাগত আঁচড় কেটে চলেছে। ব্যাপারটা কিছুতেই আমার মাথায় এলো না নিগ্রো জুপিটার দরজা খুলে দিতেই চোখের পলকে আতঙ্ক উবে গেল। দেখলাম, বন্ধু লিগ্র্যান্ডের চেহারাধারীনিউসাউন্ড ল্যান্ড কুকুরটা সবেগে ছুটে আমার কাছে এলো। এক লাফে আমার কাঁধে উঠে উন্মাদের মতো আমার মুখে মাথায় বার বার মুখ ঠেকিয়ে আদর জানাতে লাগল।
ইতিপূর্বে যতদিনই আমি এ বাড়িতে এসেছি ততবারই কুকুরটাকে খুব করে আদর করেছি।
দীর্ঘ সময় ধরে কুকুরটা আমার গায়ে-মাথায় মুখ ঘষে আদর আপ্যায়ন সারায়– আমি হাতের কাগজটার দিকে মন দেওয়ার সুযোগ পেলাম।
কাগজটার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিয়েই আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সে যে রেখাচিত্রটা এঁকেছে সেটা বিস্ময় উৎপাদন করার মতোই বটে।
আমি হাতের কাগজটার গায়ে আঁকা রেখাচিত্রটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বললাম–‘মি. লিগ্র্যান্ড, এটা যে নিসন্দেহে একটা অদ্ভুত প্রজাতির ঝি ঝি পোকা এ বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহের অবকাশও নেই।
সত্যি কথা বলতে কি, এরকম একটা পোকা এই প্রথম দেখলাম। এর আগে কোথাও কোনোদিন দেখা তো দূরের কথা শুনিও নি কারো মুখে।
আমি বললাম–‘ছবির রেখাচিত্রটা যদি করোটি বা মরার মাথার খুলি হয়ে থাকে তবে আমার আর কিছু বলার নেই, আলাদা কথা বটে। এছাড়া এ বস্তুটা আমার দেখা যে কোনো জিনিস অপেক্ষা অবিকল ওই দুটো বস্তুরই মতো। তা ছাড়া আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বন্ধুবর লিগ্র্যান্ড সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন–‘া, আপনার অনুমান অভ্রান্তই বটে-মড়ার মাথা। অন্তত কাগজের রেখাচিত্রটা দেখে এরকম ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক।
‘হ্যাঁ, আমিও তা-ই তো ভাবছি।
‘ওপরের কালো বিন্দু দেখে দুটো চোখ বলে মনে হচ্ছে, তাই না?
‘আমি তো চোখ বলেই মনে করেছি।’
‘আর নিচের লম্বাটে কালো দাগ দুটোকে অবিকল মুখ বলে মনে হচ্ছে, ঠিক কি?
‘হ্যাঁ, ঠিক তাই।
আর পুরো চিত্রটাকেই ডিম্বাকৃতি দেখাচ্ছে, কী বলেন?
‘অন্তত আমার চোখে তো এরকমই মনে হচ্ছে! কিন্তু মি. লিগ্র্যান্ড, আমি কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি, শিল্পী হিসেবে আপনার দক্ষতা তেমন নেই।’
মি. লিগ্র্যান্ড ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুললেন।
আমি বলেই চললাম–দেখুন মি. লি এ্যান্ড, ঝি ঝি, পোকাটার আকৃতি সম্বন্ধে ধারণা করতে হলে সবার আগে আমার চেষ্টা করে দেখা দরকার।’
তার চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল। কণ্ঠস্বরেও কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন–দেখুন বন্ধু, আমার ঠিক জানা নেই, তবে এটুকু অন্তত বলতে পারি, আমি মোটামুটি আঁকি। ভালো না হলেও মোটামুটি কাজ চালিয়ে নেবার মতো অবশ্যই।
আমি তার কথার কি জবাব দেব ভেবে না পেয়ে মৌন হয়ে থাকাই শ্রেয় জ্ঞান করলাম।
তিনি নিজের কৃতিত্বের কথা বলেই চললেন–একটা কথা কি জানেন, আমি একাধিক শিল্প-শিক্ষকের কাছে তালিম নিয়েছিলাম আর আমার নিজের সম্বন্ধে ধারণাটুকুও অবশ্যই আছে। ছাত্র হিসেবে আমি নেহাৎ খারাপও ছিলাম না।
‘বন্ধু লিগ্র্যান্ড, তবে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি আমার সঙ্গে রসিকথায় লিপ্ত হয়েছেন। আমি কিন্তু আবারও বলব, এটাকে অনায়াসেই একটা মড়ার মাথা বলে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে শারীরবিদ্যার সাধারণ ধারণার ওপর নির্ভর করে বলতেই হয়, মাথার খুলি হিসেবে বিচার করলে চিত্রটা খুবই ভালো আঁকা হয়েছে।
তিনি নীরবে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে মুচকি হাসলেন।
আমি বক্তব্য অব্যাহত রাখলাম–একটা কথা, আপনার সংগৃহীত ঝিঁঝি পোকাটা যদি দেখতে অবিকল এ ছবিটার মতো হয়, তবে স্বীকার করতেই হবে, ওটা পৃথিবীর আশ্চৰ্যতম ঝি ঝি পোকা। একটা জিনিস কিন্তু ছবিটাতে অনুপস্থিত দেখছি।’
মি. লিগ্র্যান্ড অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠলেন–‘কী? কীসের কথা বলছেন?
‘শুঁয়া–আপনি যে স্ট্রয়ার কথা বললেন তা তো ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে না।’
তিনি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন–‘শুঁয়া! শুঁয়ার কথা বলছেন?
আমি কিন্তু খুব ভালোই জানি, শুঁয়াগুলোকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন মূল পতঙ্গটার গায়ে, ঠিক যেমন আছে আমি তো অবিকল সেভাবেই এঁকেছি। আমি আবারও বলব, আমার বিশ্বাস, আমি সবকিছুই স্পষ্ট এঁকেছি।
‘বহুৎ আচ্ছা! বহুৎ আচ্ছা! আপনি হয়তো বা ঠিকঠাকই এঁকেছেন, তবু সেগুলো আমার নজরে ধরা পড়ছে না। হয়তো বা আমার দেখারই ভুল।
আমি আর একটা কথাও না বলে হাতের কাগজটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই ঘটনাটা যে দিকে বাঁক নিল, তাতে আমার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। তার বিরূপ ভাবভঙ্গি আমার মধ্যে বিস্ময়ের সঞ্চার করল। সত্যি কথা বলতে কি, ঝি ঝি পোকার ছবিটা সম্বন্ধে যদি বলতেই হয় তবে আমি এ কথা অবশ্যই বলব, ছবিটাতে সত্যি সত্যি কোনো শুঁয়াই দেখানো হয়নি। আর যে বস্তুটার সঙ্গে ছবিটার হুবহু মিল রয়েছে, সেটা হচ্ছে মড়ার খুলি।
আমার নজর এড়াল না, বন্ধু লিগ্র্যান্ড আমার হাত থেকে কাগজটা ফিরিয়ে নেওয়ার সময় মুখটাকে যারপরনাই বিকৃত করেছিল। তারপর হাতের মুঠোর মধ্যে দলা পাকিয়ে জ্বলন্ত চুলিটার মধ্যে ফেলার জন্য তৎপর হলেন। কিন্তু কার্যত তা করলেন না। আসলে ছবিটার দিকে চোখ পড়তেই সেটার ওপরেই তার মনোযোগ সম্পূর্ণরূপে আকৃষ্ট হয়ে পড়ল।
আমি আচমকা তার মুখের দিকে চোখ পড়তেই লক্ষ্য করলাম, মুখটা অস্বাভাবিক লাল হয়ে গেছে। পর মুহূর্তেই সেটা অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে চেয়ারটায় বসেই তিনি হাতে ছবিটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেকক্ষণ ভরে দেখলেন। তারপর মোমবাতিটাকে কাছে নিয়ে এসে আরও ভালোভাবে, অনুসন্ধিৎসু নজর মেলে সেটা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
তার রকম সকম দেখে খুবই অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু রেগে মেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যাবার আশঙ্কায় টু শব্দটিও করলাম না।
মি. লিগ্র্যান্ড এবার কোটের পকেট থেকে একটা থলে বের করে হাতের দলা পাকানো কাগজটাকে তার ভেতরে চালান দিয়ে দিলেন। তারপর থলেটাকে টেবিলের দেরাজের মধ্যে ঢুকিয়ে তালাবন্ধ করে দিলেন।
এবার দেখা গেল, তার মেজাজ অনেকটা নরম হয়ে এসেছে। কিন্তু একটু আগেও তার মধ্যে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখেছিলাম, তা একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
রাত যত বাড়তে লাগল তিনি স্বপ্নের ঘোরে ততই তলিয়ে যেতে লাগলেন। আমার ঠাট্টা তামাশা তার এ স্বপ্নালু অবস্থাটাকে দূর করে তাকে কিছুতেই স্বাভাবিক করে তুলতে পারল না।
আমি গোড়াতে মনস্থ করেছিলাম রাতটা বন্ধুর এ কুটিরেই কাটিয়ে দেব। কিন্তু তার কাণ্ডকারখানা দেখে ভাবলাম, এখান থেকে কেটে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমি বিদায় নেবার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি আমাকে থাকার জন্য অনুরোধ করলেন না। তবে দরজা খুলে পা বাড়াবার উদ্যোগ নিলে হঠাৎ আমার হাত দুটো চেপে ধরে বার কয়েক ছোট্ট করে ঝাঁকুনি দিলেন।
পরবর্তী এক মাসের মধ্যে বন্ধু লিগ্র্যান্ডের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। প্রায় এক মাস পর তার নিগ্রো সহকারী জুপিটার আমার কাছে এলো। বিন্ন মুখে আমার সামনে দাঁড়াল। সত্যি বলছি, এর আগে তাকে কোনোদিনই এমন বিমর্ষ দেখিনি।
তার বিষণ্ণতা ও নীরবতায় আমার বুকের ভেতরে ধড়াম করে উঠল। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল এই ভেবে যে, বন্ধু লিগ্র্যান্ড বুঝি বড় রকম কোনো বিপদে জড়িয়ে পড়েছে।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বললাম–‘ব্যাপার কী, বল তো জুপিটার’? তোমার মনিবের খবর কী? কেমন আছেন তিনি?’
সে বিষণ্ণ কণ্ঠে জবাব দিলেন–‘হুজুর, সত্যি কথা বলতে কি, তার অবস্থা তেমন ভালো নয়।
‘সে কী! ভালো নয়। কথাটা কানে যেতেই আমার বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা অবর্ণনীয় ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল। তার ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করলাম–‘ভালো নয়? ভালো নয় বলতে তুমি কী বলতে চাইছ?’
‘সে কথাই তো আপনাকে বলার জন্য ছুটে এসেছি হুজুর।
‘কিন্তু খোলসা করে বলছও না তো কিছু।
‘হুজুর, সেটাই তো কথা; আসলে তিনিই যে খোলসা করে কিছুই বললেন না।
‘তবু তুমি কী বুঝলে?
‘সত্যি কথা বলতে কি, আমি তার অবস্থা দেখে নিশ্চিত কোনো ধারণা করতে পারিনি। তবে এটুকু অন্তত আপনাকে বলতে পারি, তিনি গুরুতর অসুস্থ।
‘অসুস্থ! তিনি কী খুবই অসুস্থ জুপিটার?
‘হ্যাঁ, ঠিক তা-ই।’
‘তুমি এতক্ষণ এ কথা না বলে চেপে ছিলে কেন?
জুপিটার বিষণ্ণমুখে আমার দিকে তাকিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলটা মেঝেতে ঘষতে লাগল।
আমি কণ্ঠস্বরে যারপরনাই উকণ্ঠা প্রকাশ করে এবার বললাম–আচ্ছা জুপিটার, সত্যি করে বল তো, তিনি কী একেবারে শয্যাশায়ী?
‘না, হুজুর। শয্যাশায়ী বলতে পারব না। আর তাকে দেখে তো কিছুই বোঝার উপায় নেই। আসলে তিনি যে মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলেনই না। আর বিপদ তো এখানেই। বেচারার কথা ভেবে আমার মনটা সব সময় বিষিয়েই থাকে হুজুর।’
আমি প্রায় ধমকের স্বরেই বললাম–‘জুপিটার, ধানাই পানাই রেখে যা বলবার খোলসা করে বল। তুমি বার বারই বলছ, আমার বন্ধু গুরুতর অসুস্থ। কিন্তু তার কি অসুখ–কি অসুবিধা একবারও কী বলেননি? এও কি কখনও হতে পারে।
‘হুজুর, এজন্যই তো আমি পাগল হয়ে যাবার যোগাড় হয়েছি। তার যে কি হয়েছে বার বার জিজ্ঞেস করেও তার মুখ থেকে কিছু বের করতে পারা যায়নি।
‘তিনি কেমন হাবভাব, মানে আচরণে কী লক্ষ্য করা যায়, বল তো?’
‘হুজুর, একটা কথা আপনিই বলুন তো, তার যদি কিছু না-ই হয়ে থাকে তবে তিনি সব সময় হন্যে হয়ে কিছু খুঁজে বেড়ান কেন?’
‘খুঁজে বেড়ান? কী খোঁজেন, বুঝতে পারনি?
‘দীর্ঘশ্বাস ফেলে জুপিটার বলল–বুঝতে পারলে তো ব্যাপারটা কিনারা করাই যেত। আসল সমস্যাটা তো এ জায়গাতেই। সব সময় পাগলের মতো কি খোঁজেন আর বাকি সময় মুখ গোমড়া করে, মাথানিচু করে বসে থাকেন। আর কেনই বা তার শরীর, বিশেষ করে মুখটা চকের মতো সাদাটে হয়ে যাচ্ছে? আরও আছে,
আমি তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলাম–‘আরও আছে?’ কী? আর কোন অদ্ভুত লক্ষণ তার মধ্যে লক্ষ্য করেছ জুপিটার?
‘কত আর বলব হুজুর!’ অধিকাংশ সময়ই একটা বক-যন্ত্র হাতে নিয়ে অদ্ভুত সব কাণ্ড
কী? কী হাতে নিয়ে?
‘বকযন্ত্র। একটা বকযন্ত্র স্লেটের মূর্তিগুলোর ওপর ধরে কি যেন করতে চান।
‘বকযন্ত্র? সেল্টের মূর্তি? এ কী আশ্চর্য–’
আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সে এবার বলল–এসব কাণ্ড দেখেই তো আমি অবাক হচ্ছি। বিশ্বাস করুন হুজুর, এমন অদ্ভুত অদ্ভুত মূর্তি যে তিনি কোত্থেকে জোগাড় করেছেন–যা আমার চোদ্দ পুরুষও চোখে দেখেনি।
মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে একটু দম নিয়ে সে আবার মুখ খুলল–‘হুজুর, আমি বলছি, তিনি নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবেন। আমি তো প্রতিটা মুহূর্ত তাকে চোখে চোখে রাখি। একটা সেকেন্ডের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেই না।’
‘হ্যাঁ, যা শুনছি তাতে তো ব্যাপারটা খুবই দুশ্চিন্তার–গোলমেলে বলেই মনে হচ্ছে।’
‘হুজুর, একজন বয়স্ক পুরুষ মানুষ কতক্ষণ আর চোখে চোখে রাখা যায়, আপনিই বলুন? এই তো আজই, আমার চোখে ধুলো দিয়ে সারাটা দিন কোথায় যেন কাটিয়ে এলেন।
আমি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম–সে তো নিশ্চয়ই। তুমিই বা একা কতক্ষণ তাকে আগলে রাখবে। তোমারও তো বয়স হয়েছে বুড়ো হয়েছ।
‘বিশ্বাস করুন হুজুর, আজ আর আমি মাথা ঠিক রাখতে, নিজেকে সামাল দিতে পারিনি। সারাদিন পর তিনি বাড়ি ফিরে এলে আমার মাথায় যেন খুন চেপে গিয়েছিল। নিজেকে সামাল দিতে না পেরে একটা লাঠি নিয়ে তার দিকে তেড়ে গিয়েছিলাম। এবার সে হতাশার স্বরে বলল–‘না, পারলাম না। চোখ-মুখ কাচুমাচু করে এমন অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন যে, মুহূর্তে আমি একেবারে মিইয়ে গেলাম।
আমি সবিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ মিশ্রিত বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম–সে কী হে! এ তুমি বলছ কী!’
‘হুজুর মিথ্যে বলব না, তার আচরণে নিজেকে সামলে রাখাই আমার পক্ষে দায় হয়ে পড়েছিল বলেই, যা কখনই উচিত নয় তা-ই করতে আমি উদ্যত হয়েছিলাম।
আমি এবার বললাম–‘জুপিটার, তোমাকে একটা কথা বলছি, মন দিয়ে শোন, বেচারির ওপর এত নির্দয় হইও না। ভুলেও যেন কোনোদিন তাঁর গায়ে হাত তুলা না। এমন নির্মম-নিষ্ঠুর আচরণ তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। আর একটা কথা, তার এ আকস্মিক ব্যাধিটা সম্বন্ধে তুমি কিছু অনুমান করতে পারছ কি?
জুপিটারের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল। সে যে গভীর মনোযোগ সহকারে ভাবছে। তার লক্ষণ প্রকাশ পেল সদ্য ফুটে ওঠা ভাঁজ কাটার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সে মুখে কিছুই বলল না।
আমি তার চিন্তাক্লিষ্ট মুখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললাম–একটা কথা, ভালোভাবে ভেবে জবাব দাও তো, তোমাদের সঙ্গে আমার শেষবারের মতো ছাড়াছাড়ি হবার পর কোন অপ্রিয়, বা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল কি?
‘না হুজুর, তেমন কিছু আমার চোখে অন্তত পড়েনি। তবে–
আমি তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম–‘তবে’
‘তবে কি?
‘আপনি আমাদের ওখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার পর অবাক হবার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি সত্য। কিন্তু আপনি যে দিন চলে এলেন ঠিক সেদিনই, আপনি থাকতে থাকতেই সেদিন–‘
‘সেদিন–আমি যখন সেখানে ছিলাম তখনই–‘।
‘হ্যাঁ, সে দিনই।’
‘জুপিটার, হেয়ালি রেখে তুমি কি বলতে চাইছ খোলসা করে বল।
‘হুজুর ওই যে ঝিঁঝি পোকাটা’।
‘হ্যাঁ, সেটার কথা আমি নিজেই কিছু কিছু শুনে এসেছিলাম। কেন? ওই পোকাটাকে কেন্দ্র করে অঘটন ঘটেছি কী? ভালো কথা, সেটা কি এখনও সেখানে আছে।
‘আছে। আছে। অবশ্যই আছে হুজুর।
‘পোকাটা করেছে কি যে, সেটার প্রসঙ্গ উঠতেই তোমার মধ্যে এমন উৎকণ্ঠা জেগেছে।
‘হুজুর, আমার বিশ্বাস, নচ্ছাড় ওই সোনালি পোকাটা আমার মনিবের মাথায় কামড় বসিয়ে দিয়েছে।’
‘কী? কি বললে জুপিটার। পোকাটা মি. লিগ্র্যান্ডের মাথায় কামড় দিয়েছে?
‘হতেই হবে হুজুর। শয়তানটানির্ঘাৎ প্রভুর মাথায় মরণ কামড় বসিয়ে দিয়েছে।’
‘তোমার এমন বদ্ধমূল ধারণাটা হলো কী করে? বলবে কি?
‘শুনুন তবে হুজুর, ওই শয়তান পোকাটাকে আমিই প্রথম দেখেছিলাম। কিন্তু প্রভুই তাকে প্রথম ধরেছিলেন। ঠিক সে মুহূর্তেই শয়তানটা তার মাথায় মোক্ষম কামড় বসিয়ে দিয়েছিল।
‘তবে তুমি নিঃসন্দেহ যে, ওই পোকাটা তোমার মাথায় কামড়ে দিয়েছিল?
এবার সে আমতা আমতা করে বলল–‘দেখুন হুজুর, আমি তো আর সেটাকে নিজের চোখে কামড়াতে দেখিনি। তবে আমার এটাই ধারণা। তা যদি না হবে তবে এতদিন কিছু ঘটল না, তিনি সোনালি পোকাটা যেদিন ধরলেন, ঠিক সেদিন থেকে এমন একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলই বা কেন, আপনিই বলুন?
‘ভালো কথা, তোমার মনে এমন একটা ধারণা কেনই বা দানা বাঁধল, খোলসা করে বল তো জুপিটার?
‘হুজুর, আমার ধারণা যদি সত্যি না-ই হয় তবে আমার মনিব কেনই বা চোখ বুঝলেই সোনার স্বপ্ন দেখেন।
আমি হৃদুটো কুঁচকে, কপালের চামড়ায় ভাঁজ একে বললাম–‘তিনি যে চোখ বুজলেই কেবল সোনার স্বপ্ন দেখেন তা-ই বা তুমি জানলে কী করে?
‘সোনার কথা কী করে জানলাম?
‘হ্যাঁ, এটাই তো আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি।’
‘হুজুর, তিনি যদি সোনার স্বপ্ন না-ই দেখবেন তবে ঘুমের ঘোরে কেবল ‘সোনা সোনা’ বলেন কেন? অন্য কোনো কথাও তিনি উচ্চারণ করতে পারতেন, ঠিক কি না?
‘শোন জুপিটার, এমনও হতে পারে, তোমার কথাই ঠিক। একটা কথা, কোন্ ভাগ্যগুণে তুমি এখানে এসে আমাকে সম্মানিত করলে, বল তো?’
জুপিটার থতমত খেয়ে বলে উঠল–‘হুজুর, ব্যাপার কি, আমার মাথায় আসছে না তো। দয়া করে একটু খোলসা করে–
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আমি বলে উঠলাম ‘সত্যি করে বল তো জুপিটার, তুমি কি আমার বন্ধু মি. লিগ্র্যান্ডের কাছ থেকে আমার জন্য কোনো খবর নিয়ে এসেছ?
খবর? খবর আর কি আনব হুজুর? তবে আপনার জন্য এ চিঠিটা কেবল নিয়ে এসেছি।’
‘চিঠি? কোথায় সে চিঠি?
জুপিটার তার কুর্তার পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে আমার হাতে তুলে দিতে দিতে বলল–এইনিন, আমার হুজুর এটাই আপনাকে দিতে বলেছেন।
আমি হাত বাড়িয়ে তার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে ব্যস্ততার সঙ্গে ভাঁজ খুলে চোখের সামনে ধরলাম। তাতে লেখা রয়েছে–
প্রিয় বন্ধু
এমন দীর্ঘকাল আপনার দেখা না পাওয়ার কারণ কী, বলুন তো? আমার বিশ্বাস এত বোকা নন যে, আমার দু-একটি কটু ব্যবহারেই আমার ওপর ক্ষুব্ধ হবেন। কিন্তু সেটা তো হবার নয়।
একটা কথা, আপনার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হবার পর আমার ব্যস্ততা, উৎকণ্ঠার কারণ যথেষ্টই রয়েছে। আপনাকে আমি কিছু বলতে চাই, বলা দরকারও বটে। কিন্তু না, বলার কোনো উপায়ই তো দেখছি না, আবার আদৌ বলা সঙ্গত হবে কিনা, ভেবে পাচ্ছি না।
তবে এটুকু বলছি যে, গত দিন কয়েক ধরে আমার শরীর ও মন কিছুই সুস্থ নয়। আর বুড়ো জুপিটারও এমনই হতভাগা যে, আমার ভালোর জন্য আমাকে এত বেশি উত্ত্যক্ত করছে যা আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তার তদ্বির তদারকি আমি আর মোটেই বরদাস্ত করতে পারছি না। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে কি বন্ধু। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, তাকে না বলে, লুকিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। তারপর মূল ভূখণ্ডে গিয়ে পাহাড়ে সারাটা দিন কাটিয়ে আসি।
একমাত্র যে অপরাধ, এ-অপরাধেই জুপিটার আমাকে মারার জন্য লাঠি নিয়ে তেড়ে গিয়েছিল। আরও আছে, আমাকে মারধর করার জন্য সে ইদানিং একটা বেশ বড় লাঠি তৈরি করে রেখেছে। আমি হলফ করেই বলতে পারি, আমার অসহায় দৃষ্টিই তার লাঠির আঘাত থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
এবার আমার সাংসারিক পরিস্থিতির কথা বলছি, শোন–ইতিমধ্যে আমার সংসারে সামান্যতম পরিবর্তনও হয়নি। যা ছিলাম, আজও তা-ই আছি।
আমার অনুরোধ, যে করেই হোক, জুপিটারের সঙ্গেই চলে আসবেন। আমার একান্ত অনুরোধ, অতি অবশ্যই বলে আসবেন। আমি চাই, আজ রাতেই আপনার সঙ্গে দেখা হোক। খুবই জরুরি দরকার, মনে রাখবেন। আপনাকে আরও জোর দিয়ে, নিশ্চিত করে বলছি, কাজটা খুবই জরুরি।
ধন্যবাদান্তে
উইলিয়াম লিগ্র্যান্ড
চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে আদ্যোপান্ত পড়ার পর সেটা ভাজ করতে করতে ভাবলাম, চিঠিটার মধ্যে এমন একটা বিশেষ সুর রয়েছে যা আমার মনকে যারপরনাই অস্থির করে তুলল।
কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার মনে খটকা লাগল যে, চিঠিটার লেখার কায়দা কৌশল আমার বন্ধু লিগ্রন্ডের লেখার পদ্ধতির সঙ্গে সাদৃশ্য তো নেই-ই, বরং বৈসাদৃশ্যই পুরোদস্তুর। তিনি কোন স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকেন?
কোন কল্পনাই বা তার মাথায় পাকাপাকিভাবে চেপে বসেছে।
আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার জন্যই বা তিনি এখন অস্থির হয়ে পড়েছেন? ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে আমি কিছুতেই কিনারা করতে পারছি না।
জুপিটার যা-কিছু বলল তা মোটেই সুবিধার নয়। এ-মুহূর্তে আমার একটাই আশঙ্কা হচ্ছে, নিরবচ্ছিন্ন দুর্ভাগ্যের চাপ সহ্য করতে না পেরে আমার বন্ধু লিএ্যান্টের মাথার দোষই হয়তো দেখা দিয়েছে।
বুড়ো নিগ্রো জুপিটারের বিবরণ শুনে এবং বন্ধুর চিঠিটা পড়ার পর আমি তার বাড়ি যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
আমি জুপিটারের সঙ্গে বাড়ি থেকে রওনা হয়ে জাহাজ ঘাটের দিকে চললাম।
জাহাজঘাটে পৌঁছে আমি রীতিমত ভড়কে গেলাম। দেখলাম আমাদের নৌকার খোলের ভেতর তিনটি কোদাল আর একটা কাস্তে রাখা আছে। সবগুলোই নতুন, চকচকে ঝকঝকে।
আমি বস্তুগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে জুপিটারের দিকে তাকালাম। চোখে-মুখে জিজ্ঞাসার ছাপ একে বললাম–কী ব্যাপার জুপিটার, এসব কেন?
সে স্বাভাবিক স্বরেই জবাব দিল–‘হুজুর, এগুলো তো তারই জন্য জোগাড় করে এখানে রাখা হয়েছে।’
‘সে না হয় বুঝলাম; কিন্তু আমি জানতে চাইছি, এগুলো এখানে রাখার অর্থ কী?
‘আমার মনিব আমাকে শহর থেকে এগুলো কিনে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’
‘হুম।
‘আর এগুলোর জন্য আমাকে বহু টাকা ব্যাটাদের দিতে হয়েছে।
‘আমি যেটা জানতে চাইছি কোদাল আর কাস্তে দিয়ে মি. লিগ্র্যান্ড কোন কাজ করবেন ভেবেছেন, বলতে পার?
‘এত কথা তো আমি বলতে পারব না হুজুর। আর তিনি নিজের জানেন না। তবে এটুকু বলতে পারি, কোদাল আর কাস্তে সবই ওই হতচ্ছাড়া পোকাটার জন্য।’
জুপিটারের সঙ্গে কথা বলে বুঝে নিলাম, তার মুখ থেকে কিছুই জানা যাবে না। কারণ, তার মাথায় এখন ওই সোনালি পোকাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে।
যাই হোক, বুড়োনিগ্রো জুপিটারের কাছ থেকে কোনো তথ্য জানার আশা ছেড়ে দিয়ে নৌকায় পাল তুলে দিলাম। পালে বাতাস পেয়ে নৌকাটা গন্তব্যস্থলের দিকে উল্কার বেগে ছুটে চলতে লাগল।
অচিরেই আমাদের ময়ুরপঙ্খী নৌকাটা মূলট্রি দুর্গের উত্তরে পৌঁছে গেল। নৌকা নোঙর করা হল।
নৌকা থেকে নেমে দুমাইল পথ পায়ে-হেঁটে পাড়ি দিয়ে আমরা বন্ধু মি. লিগ্র্যান্ডের কুড়ে ঘরে হাজির হলাম।
তখন বিকেল, তিনটা বাজে।
বন্ধু মি. লিগ্র্যান্ড আমাদের জন্য অধীর প্রতীক্ষায় বারান্দায় পায়চারী করছেন। দেখলাম।
আমাকে কাছে পেয়েই তিনি এমন স্নায়ুবিক বিহ্বলতায় আমার হাত দুটো চেপে ধরলেন, যা আমার মধ্যে রীতিমত ভীতির সঞ্চার করল। আমার বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে-বসা সন্দেহটা আরও অনেকগুণ দৃঢ় হয়ে উঠল।
তার মুখের দিকে চোখ সরিয়েই আমি চমকে উঠলাম। মুখটা অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে, একেবারে চকের মতো হয়ে গেছে। গর্তে বসা চোখ দুটো খুবই জ্বল জ্বল করছে।
তার মুখোমুখি হয়ে কুশলবার্তাদি লেনদেনের পর জিজ্ঞাসা করার মতো কোনো প্রসঙ্গ হাতড়ে না পেয়ে প্রথমটায় চেপেই গেলাম। পরমুহূর্তে, এমন একটা ভান করলাম যেন নিছকই মামুলি একটা প্রশ্ন করছি–ও ব্যাপারটি কী হলো বলুন তো মি. লিগ্র্যান্ড।
তিনি ঠোঁটের কোণে ছোট্ট হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললেন–‘কী? কোন ব্যাপারটা?
‘ওই যে, ঝি ঝি পোকাটা! সেটা তো লেটেন্যান্ট জি-র কাছে ছিল বলছিলেন?
‘হ্যাঁ, পোকাটাকে ধরার পর তার জিম্মাতেই রেখে এসেছিলাম।
‘এখনও কী সেটা তার কাছেই রয়ে গেছে?
‘না, পরদিন সকালেই তিনি আমাকে দিয়ে গেছেন। আরে ভাই, সেটাকে এখনও তার কাছে ফেলে রাখব সে বান্দা আমি নই। কোনো প্রলোভনেই ঝি ঝি পোকাটাকে আমি বেহাত করতে নারাজ।
‘হ্যাঁ, সে দিন আপনার কথায় আমিও তা-ই ভেবেছিলাম!
একটা কথা কি জানেন, পোকাটার ব্যাপারে জুপিটারের কথাই ঠিক।
আমি মনে মনে বিপদের আশঙ্কা করেই এবার বললাম–‘জুপিটারের কথা? কোন কথাটার ইঙ্গিত দিচ্ছেন, বলুন তো মি. লিগ্র্যান্ড?
‘জুপিটারই তো বলেছিল, পোকাটা সোনার,নিরেট সোনার তৈরি।
মি. লিগ্র্যান্ড কথাটাকে খুবই গম্ভীরভাবে ছুঁড়ে দিলেন বটে। কিন্তু আমি যারপরনাই বিমর্ষ হলাম।
আমাকে নীরব দেখে তিনিই আবার ভাববিমুগ্ধ কণ্ঠে বলতে লাগলেন–‘আপনি কী ভাবছেন জানি না, তবুও আমি বেশ জোর দিয়েই বলছি, ঝি ঝি পোকাটাই আমার ভাগ্য ফিরিয়ে দেবে।
আমি এবারও মৌন রইলাম।
তিনি বলে চললেন–সেটার দৌলতেই আমার হাল ফিরে যাবে, আমি নিঃসন্দেহ। আমায় পারিবারিক ঐশ্বর্যের আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে দেবে। তাই তো
আমি সেটাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছি। অতএব ব্যাপারটা নিয়ে অবাক হবার কিছুমাত্র কারণও নেই।’
‘তাই বুঝি?
‘অবশ্যই। একেবারে শতকরা একশো ভাগ সত্যি। যেহেতু বিধাতাপুরুষ আমাকেই এ-অমূল্য সম্পদের অধিকারী মনে করে লক্ষ্মীমন্ত পোকাটাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন, তাই তো আমি সেটাকে যথাযথভাবে ব্যবহারের মাধ্যমেই সে সোনার খনির অধিকারী হব, এ পোকাটা যার প্রতীক।
‘তা যদি হয় তবে তো মঙ্গলের কথা।’
আমার কথা শেষ হতে না হতেই মি. লিগ্র্যান্ড ঘাড় ঘুরিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে-থাকা বুড়োনিগ্রো জুপিটারকে বলল, এক কাজ কর, সে-পোকাটাকে নিয়ে এসো তো।
‘কোনটা? সেই পোকাটা? রাগ করবেন না হুজুর, আমার দ্বারা এ-কাজ হবে না।
তিনি একটু গম্ভীর স্বরেই বললেন–কেন?
‘আমি ওসব ঝামেলায় নেই। আপনি নিজে গিয়েই বরং নিয়ে আসেন।
মি. লিগ্র্যান্ড আর কথা না বাড়িয়ে নিজেই উঠে রীতিমত রাজকীয় ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই ঝি ঝি পোকাসমেত একটা কাঁচের পাত্র হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।
আমি কৌতূহল মিশ্রিত বিস্ময়ের ছাপ চোখে এঁকে বহুকথিত ঝিঁঝি পোকাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যি স্বীকার না করে উপায় নেই, পোকাটা বাস্তবিকই সুন্দর, বড়ই দৃষ্টিনন্দন। আর আর প্রকৃতি-বিজ্ঞানীদের এসব খবর জানা না থাকায় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এর মূল্য অসীম।
আমি বন্ধুর হাতের কাঁচ পাত্রটার দিকে সাধ্যমত ঝুঁকে অনুসন্ধিৎসু নজরে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে দেখলাম, সেটার আঁশগুলো অস্বাভাবিক শক্ত আর চকচকে ঝিল্লা দিচ্ছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ঠিক যেন পালিশ করা সোনা। আর ওজনও যথেষ্টই।
সবকিছু বিচার-বিবেচনা করলে জুপিটারকে দোষারোপ করা চলে না। কারণ, পোকাটা সম্বন্ধে সে যে অভিমত ব্যক্ত করেছে, কার্যত চোখের সামনে দেখছিও ঠিক তা-ই।
ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেন গোলমেলে মনে হল। ব্যাপারটা হচ্ছে, আমার বন্ধুবর লিগ্র্যান্ড কি করে তার বক্তব্যকে সমর্থন করছে?
আমি যখন বন্ধুর হাতে রক্ষিত ঝিঁঝি পোকাটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ব্যাপারটা নিয়ে আকাশ পাতাল ভেবে চলেছি, তখন সে রীতিমত ভাবাপুতকণ্ঠে বলল–একটা কথা কী জানেন মি.’।
আমি যেন অকস্মাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলে উঠলাম–‘কী? কীসের কথা বলছেন মি. লিগ্র্যান্ড।
‘কথাটা হচ্ছে, ভাগ্যদেবতা আর এ-ঝিঁঝি পোকাটার নির্দেশকে বাস্তব রূপ দিতে আপনার বুদ্ধি-পরামর্শ আর সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা পাবার প্রত্যাশা নিয়ে আপনাকে কষ্ট দিয়ে এখানে নিয়ে আসা।
আমি অকস্মাৎ উন্মাদের চেঁচিয়ে উঠলাম–‘বন্ধু লিগ্র্যান্ড, আমি নিসন্দেহ, আপনি অবশ্যই অসুস্থ। আপনি নির্ঘাৎ স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলেছেন। আমি বার বার আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, এখনও সময় আছে, সাবধান হোন।
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে তিনি বললেন–‘তাই নাকি? কী যে বলেন ভাই।
‘হ্যাঁ যা সত্যি, ঠিক তা-ই বলছি। আমার পরামর্শ যদি সত্যি নিতে চান তবে বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আপনি সম্পূর্ণ নিরাময় না হওয়া অবধি আপনার কাছেই থাকব, কথা দিচ্ছি।’
‘অসুখ? আমি অসুস্থ-–’
‘না, আপনি অবশ্যই সুস্থ নন। জ্বরে ভুগছেন আর আপনি—’
আমার মুখের কথা শেষ হবার আগেই তিনি হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–‘ভালো কথা, আমার নাড়িটা দেখুন তো।’
আমি তার নাড়ি টিপে ধরে চোখ বুজে মিনিট খানেক কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু কই, জ্বরের সামান্যতম লক্ষণও পেলাম না।
মি. লিগ্র্যান্ড ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপাত্মক হাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন–‘কী? কী বুঝছেন?’
‘না, জ্বরের কোনো লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে না বটে।
‘তবে?
‘কিন্তু জ্বরের লক্ষণ প্রকাশ না পেলেও-জ্বর না হলেও আপনি অসুস্থ হতে পারেন। আমার ওপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন লিগ্র্যান্ড। আমার প্রথম নির্দেশ হচ্ছে, আপনি গিয়ে বিছানায় চুপটি করে শুয়ে পড়ুন। তারপর আমি যা—’
আমাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলে উঠলেন–‘আমি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলছি, আপনি ভুল করছেন।
‘ভুল। আমি ভুল করছি।
‘অবশ্যই। সত্যি কথা বলতে কি উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে আমার দিন, প্রতিটা মুহূর্ত কাটছে সে পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করলে আমি খুবই সুস্থ আছি। বরং আপনি যদি যথার্থই আমার সুহৃদ হয়ে থাকেন তবে আমাকে এ-উত্তেজনার কবল থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করুন।
‘সেটা কী করে সম্ভব হতে পারে, আপনিই বলুন।
‘খুবই সহজ ও সরল।’
‘খোলসা করে বলুন, আপনার বক্তব্য কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না মি. লিগ্র্যান্ড।
‘হ্যাঁ ঠিক তাই। আপনার ওপর আমি সব দিক থেকে ভরসা করতে পারি। মোদ্দা কথা, আমাদের বিশ্বাসযোগ্য একমাত্র লোকই হচ্ছেন আপনি।
‘এরকম ধারণা আপনার মধ্যে—’
আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই তিনি এবার বললেন–‘দেখুন, আমরা সামান্য লাভ করি আর বিফলমনোরথই হই, উভয়ক্ষেত্রেই আপনি আমাকে সে উত্তেজনার মধ্যে দেখেছেন সেটা সমানভাবে প্রশমিত হবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আমি সহানুভূতির সঙ্গে বললাম–‘মি. লিগ্র্যান্ড, আপনি আমার কথা কতখানি বিশ্বাস করবেন আমার জানা নেই। তবে আমার সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা লাভের ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
‘অবশ্যই অবশ্যই! এ-বিশ্বাসটুকু আমার আছে বলেই তো আপনাকে কষ্ট দিয়ে এখানে ডেকে এনেছি।’
‘একটা কথা আমাকে খোলাখুলি বলুন তো মি. লিগ্র্যান্ড, আপনার আসন্ন পর্বত অভিযানের সঙ্গে নরকের কীট এ-সোনালি ঝি ঝি পোকাটার কোনো সম্পর্ক আছে কী?
মুচকি হেসে তিনি ছোট্ট করে জবাব দিলেন–‘হ্যাঁ, তা আছে বটে। আমি বিষণ্ণমুখে বললাম–মি. লিগ্র্যান্ড, তা-ই যদি হয় তবে আমি আপনার এ কাজের সহায়ক হতে রাজি নই, এমন একটা যুক্তিবিরুদ্ধ কাজ–
‘সে কি কথা! আপনি আমাকে হতাশ করবেন ভাই।
‘আমি নিরুপায়! আমাকে মাফ করবেন।
চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন–‘যদি তা-ই হয় তবে আমি দুঃখিত। বড়ই দুঃখিত। তবে কাজটা আমাকে করতেই হবে।
‘আপত্তির কি থাকতে পারে। আপনারা নিজেরাই অভিযান চালিয়ে দেখুন।
আমি বুঝলাম, লোকটারনির্ঘাৎ মাথার দোষ দেখা দিয়েছে।
আমি তার বিমর্ষ মুখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললাম–‘মি. লিগ্র্যান্ড, আপনারা কতক্ষণ এ-বাড়ির বাইরে থাকবেন বলে মনে করছেন।
‘এমনও হতে পারে সারা রাতই আমাদের বাইরে কাটাতে হবে।’
‘আপনারা কখন বেরোতে চাচ্ছেন?
‘এখনই। আর বোধহয় সকালের আগে ফেরা হবে না।’
‘একটা কথা, আপনার সম্মানের খাতিরে আমি কি আপনার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেতে পারি, আপনার মাথার পোকা যখন নেমে যাবে, অর্থাৎ এ-উদ্ভট খেয়ালটা যখন কেটে যাবে, বাড়ি ফিরবেন তখন আপনার চিকিৎসকের পরামর্শের মতোই আমার সব উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন?
‘ঠিক আছে তা-ই হবে।’
‘ধন্যবাদ। খুবই খুশি হলাম। তবে আমি আপনাদের সঙ্গদান করব।’
‘এবার তবে আমরা যাত্রা করি, কি বলেন, কারণ দেরি করলে আবার কাজটা ভেস্তে যেতে পারে।’
বিষণ্ণমনে হলেও আমি তাদের অনুসরণ করে চললাম। আমরা চারটার সময় রওনা দিলাম।
আমরা মোট চারটা প্রাণী, বন্ধু লিগ্র্যান্ড, জুপিটার, আমি আর বিশালদেহী কুকুরটা–লম্বা লম্বা পায়ে পথ পাড়ি দিতে লাগলাম।
কোদাল আর কাস্তে কটা জুপিটার হাতছাড়া করল না।
সেগুলো সে নিজের জিম্মায়ই রাখল। লিগ্র্যান্ড চাইলেও সে কোনো একটাও দিতে সম্মত হলো না।
একটা ব্যাপার আমার নজর এড়ালো না। জুপিটারকে সারাটা পথ গোমড়া মুখে কেবল বিরক্তির সঙ্গে ঘোৎ ঘোঁৎ করতেই দেখলাম। কেবল থেকে থেকে বেশ রাগতস্বরেই বলতে লাগল–‘হতচ্ছাড়া শয়তান পোকা! শয়তানটা জাহান্নামে যাক।
আমি হাতে করে বইতে লাগলাম–কেবলমাত্র কালি-ঝুলি মাখা দুটো লণ্ঠন।
আর বন্ধুবর লিগ্র্যান্ডের হাতে এ-কর্মকাণ্ডের নায়ক যে সোনালি ঝিঁঝি পোকাটা সে একটা চামড়ার চাবুকের মাথায় সেটাকে ঝুলিয়ে নিয়েছে। চাবুকটাকে বার বার এদিক ওদিক দোলাতে দোলাতে সে যাদুকরের বিশেষ ভাব নিয়ে পথ চলতে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা তড়িঘড়ি পথ পাড়ি দিয়ে দ্বীপটার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম! ছোট্ট একটা ডিঙি নৌকার সাহায্যে অপ্রশস্ত খাড়িটা পাড় হলাম।
খাড়ির বিপরীত পাড়ে পৌঁছে আমরা পা-টিপে টিপে মূল ভূখণ্ডের উঁচু জমিতে হাজির হলাম।
এবার আমাদের গতি মূল ভূখণ্ডের উত্তর-পশ্চিম দিকে। দেখলাম, পুরো অঞ্চলটাই ঝোঁপঝাড়ে ছেয়ে রেখেছে। জনমানুষের চিহ্নও চোখে পড়ল না। মানুষ তো দূরের কথা পথে-প্রান্তরে কোনো মানুষের পায়ের চিহ্নও নজরে পড়ল না।
বন্ধুবর লিগ্র্যান্ড সবার আগে আগে নিঃসঙ্কোচে পথ পাড়ি দিতে লাগল।
আমাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই মুখে যেন কলুপ এঁটে পথ পাড়ি দিচ্ছি। এমনকি আমাদের সঙ্গি কুকুরটাও টু-শব্দটি করছে না।
আমরা এভাবে নীরবে প্রায় ঘণ্টা দুই পথ চললাম। তারপর সারা দিনের কর্মক্লান্ত সূর্যটা যখন পশ্চিমে আকাশের গায়ে বিদায় নেবার জন্য উন্মুখ হয়ে পড়ল তখন আমরা এমন একটা জায়গায় পৌঁছালাম সেটাকে অধিকতর নির্জন-নিরালা আর ভয়ঙ্কর বলে মনে হতে লাগল।
আমরা ঝোঁপঝাড়ের মাঝখান দিয়ে পথ কওে নিয়ে এমন একটা প্রায় সমতল ভূমিতে হাজির হলাম, যার সামনে সদম্ভে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রায় দুরারোহ একটা পর্বত, পর্বতের চূড়া।
চোখ বুলিয়ে দেখলাম পর্বতটার পাদদেশ থেকে একেবারে চূড়া পর্যন্ত ঘন ঝোঁপঝাড়ের বিচিত্র সমারোহ। আর চারদিকে–এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু গিরিখাত।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে পুরো অঞ্চলটা, বিশেষ করে পর্বতটার আগাগোড়া অনুসন্ধিৎসু চোখের মণি দুটো বুলিয়ে নিয়ে উপলব্ধি করলাম, পুরো দৃশ্যটাতেই অবর্ণনীয় একটা গাম্ভীর্য বিরাজ করছে। আর অধিকতর রুক্ষতার স্পর্শ।
আমরা আবার এগিয়ে চললাম। বহু কষ্টে আরও কিছুটা এগিয়ে আমরা আকাশ ছোঁয়া একটা টিউলিপ গাছের তলায় গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়লাম। তার লাগোয়া, একেবারে গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আট-দশটা ওক গাছ।
টিউলিপ গাছটার তলায় পৌঁছেই লিগ্র্যান্ড দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমরা পা থামাতে বাধ্য হলাম।
টিউলিপ গাছটার গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত মুহূর্তের জন্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে লিগ্র্যান্ডনিগ্রো জুপিটারের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন–‘গাছটাকে একবারটি ভালোভাবে পরখ করে নিয়ে বল তো এটার শেষ মাথায় উঠে যেতে পারবে?
তার মুখে আচমকা এমন একটা প্রশ্ন শুনেই বুড়ো মানুষটা দারুণ ভড়কে গেল। কি জবাব দেবে ভেবে না পেয়ে চুপ করেই রইল।
লিগ্র্যান্ড কণ্ঠস্বরে একটু বিদ্রুপের রেশ টেনেই এবার বলল–‘কি হে জুপিটার। তুমি নানিগ্রো সন্তান। আর গাছটা দেখেই একেবারে মিইয়ে গেলে! সত্যি তুমি তোমাদের জাতের বদনাম করলে বটে।
মনে হলো কথাটায় জুপিটারের আঁতে ঘা লাগল। সে মুখ গোমড়া করে কয়েক পা এগিয়ে টিউলিপ গাছটার একেবারে গোড়ায় দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর ওটাকে কেন্দ্র করে একটা পাক ঘুলে এলো। ঘাড়টাকে একেবারে পিঠের সঙ্গে লাগিয়ে দিয়ে গাছটার মাথার দিকে চোখ বুলিয়েনিল। তারপর মুখ খুলল–
‘হ্যাঁ, হুজুর, আমি জীবনে যত গাছ দেখেছি তার সবগুলোতেই চড়তে পারি।’
লিগ্যান্ড উল্লসিত হয়ে বলল–‘তবে এক কাজ কর, যত শীঘ্র সম্ভব কাজে লেগে যাও জুপিটার।
আমি এতক্ষণ নীরবে তাদের কথাবার্তা শুনছিলাম। কিন্তু গাছটার প্রসঙ্গে বন্ধুর আগ্রহ এমন অত্যুগ্র দেখে আমি ব্যাপারটা সম্বন্ধে কিছু বুঝতে না পেরে ভেতরে ভেতরে বড়ই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম।
কিন্তু আমি মুখ খোলার আগেই মি. লিগ্র্যান্ডই আবার বলতে লাগলেন– ‘শোন জুপিটার, যত শীঘ্র সম্ভব গাছটায় উঠে পড়। নইলে কিছুক্ষণের মধ্যেই এমন অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে যে, আমরা যে অমূল্য সম্পদের খোঁজে এখানে হন্যে হয়ে ছুটে এসেছি তার আর দেখাই মিলবে না। আমাদের সব প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যাবে।’
‘কিন্তু হুজুর, বলে দিন আমাকে কতটা ওপরে উঠতে হবে।
‘এক কাজ কর, সবার আগে মূল কাণ্ডটা বেয়ে ওপরে উঠতে থাক। তারপর কোন দিকে যেতে হবে আমি বলে দেব।’
বুড়োনিগ্রো জুপিটার মনিবের হুকুম তামিল করার উদ্যোগ নিতেই লিগ্র্যান্ড ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল–‘আরে করছ কী! করছ কী! থাম থাম!’
জুপিটার হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
জুপিটার বলল–‘তুমি যে খালি হাতেই উঠতে শুরু করেছ হে! ঝি ঝি পোকাটাকে সঙ্গে নিয়ে যাও।
চমকে উঠে জুপিটার বলল–পোকা? ওই পোকাটাকে সঙ্গে নিতে হবে কেন? হুজুর, ওটাকে কি সঙ্গে না নিলেই নয়? কিন্তু ব্যাপারটা তো আমার মাথায়ই–‘।
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই লিগ্র্যান্ড বিদ্রুপের সুরে বলে উঠলেন–এ কী অবিশ্বাস্য কথা জুপিটার। বুড়ো হয়েছ বটে, কিন্তু তোমার মতো বিশালদেহী ও অমিত শক্তিধর একটানিগ্রো যদি এ-সামান্য পোকাটাকে দেখে এমন কুঁকড়ে যায় তবে যে অবাক হবারই কথা। তার ওপর পোকাটা মরা।’
জুপিটার নীরবে দাঁড়িয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলটা মাটিতে ঘষতে লাগল।
লিগ্র্যান্ড বলে চললেন–শোন জুপিটার, পোকাটাকে যদি তোমার খুবই ভয় লাগে তবে এক কাজ কর না কেন, ওটাকে এভাবে দড়িতে ঝুলিয়ে নিলেই তো আর সমস্যা থাকে না।
জুপিটার তবুও নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।
লিগ্র্যান্ড এবার হঠাৎ রেগেমেগে একেবারে আগুন হয়ে গিয়ে গর্জে উঠলেন– ‘আমার সাফ কথা শোন জুপিটার, তুমি যদি পোকাটাকে কিছুতেই সঙ্গে নিতে রাজি না হও তবে আমি এ-কোদালটা দিয়ে তোমার মাথাটাকে দু টুকরো করে দেব। এখনও সময় আছে, ভেবে দেখ, কী করবে?
জুপিটার জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল–‘আরে ধৎ! কি যে বলেন, হুজুর! আমি তো মস্করা করছিলাম। আচ্ছা হুজুর, আপনি কথায় কথায় বুড়ো মানুষটার সঙ্গে এমন রসিকতা করেন কেন, বলুন তো? কি যে বলেন, আমি ওই নচ্ছাড় পোকাটাকে ভয় পাব। আমি ওটাকে মোটেই পরোয়া করি না, জেনে রাখবেন।
জুপিটার কথা বলতে বলতে একটা দড়ির শেষ প্রান্তে ঝি ঝি পোকাটাকে বেঁধেনিল। তারপর দড়ির অন্য প্রান্তটাকে নিজের কোমড়ের সঙ্গে এমনভাবে বাধল যাতে শরীর ও পোকাটার মধ্যে বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় থাকে।
ব্যস, জুপিটার এবার গাছে চড়ার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিয়ে গাছের গোড়াটাকে জাপ্টে ধরল। তারপর দু-একবার পা হড়কে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়ে বহু চেষ্টার পর প্রথম দো-ডালটায় পা রাখতে পারল। এবার সে যেন কিছুটা অন্তত হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
গাছের ওপর থেকে জুপিটার গলা-ছেড়ে বলল–হুঁজুর, এবার কোন ডালটা বেয়ে উঠতে হবে বলে দিন।
লিগ্র্যান্ড গলা চড়িয়েই জবাব দিলেন–এক কাজ কর, ওই মোটা ডালটা ওই, ওই যে ওই ডালটা বেয়ে সোজা ওপরে উঠে যাও।’
মনিবের নির্দেশ পাওয়া মাত্র বুড়োনিগ্রো জুপিটার এবার দ্রুততালে হাত পা চালিয়ে মনিবের নির্দেশিত ডালটা বেয়ে সোজা ওপরে উঠে যেতে লাগল।
জুপিটার তরতর করে ওপরে উঠছে তো উঠছেই। অচিরেই সে হাত দিয়ে ডালপালা সরিয়ে সরিয়ে এত ওপরে উঠে গেল যে, তাকে আর চোখেই পড়ছে না।
কিছুক্ষণ বাদে ডালপালা দুহাতে দুদিকে ঠেলে ধরে সামান্য ফাঁক করে চেঁচিয়ে বলল–‘হুজুর, আর কত ওপরে উঠতে হবে, বলুন?
‘তুমি কতটা ওপরে উঠেছ আমার তো পরিষ্কার মালুম হচ্ছে না।
‘অনেক অনেক ওপরে হুজুর। এখান থেকে আকাশটাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।’
‘সামনেই একটা দো-ডালা আছে মনে হচ্ছে, ঠিক কী?
‘হ্যাঁ হুজুর, ঠিকই বলেছেন। আকাশের দিকে–’
‘আকাশের কথা ছাড়ান দাও।
‘সে না হয় ছাড়ানই দিলাম হুজুর। কিন্তু আপনি আমাকে এখন কী করতে বলছেন?
‘সমন দিয়ে শোন, গাছের নিচের দিকে চোখ মেলে এদিকে যতগুলো দো-ডাল আছে গুনে ফেল তো। আর একটা কথা, তুমি ইতিমধ্যে কতগুলো দো-ডালা পার হয়েছ, খেয়াল আছে কী?
‘হ্যাঁ, আছে হুজুর।
‘কটা?’
‘এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ–হ্যাঁ, পাঁচটা দো-ডালা পার হয়েছি হুজুর।
‘বহুৎ আচ্ছা! আরও একটা দো-ডালা উঠে যাও। তারপর আবার আমার সঙ্গে কথা বলবে।’
মিনিট কয়েকের মধ্যেই আবার জুপিটারের গলা শোনা গেল–‘হুজুর, আমি এবার সপ্তম দো-ডালটায় বসে আছি। এবার কী করব, বলুন।
‘শোন জুপিটার লিগ্র্যান্ড গলা ছেড়ে বললেন। এবার তাঁর গলায় রীতিমত উত্তেজনা প্রকাশ–‘যাও, এগিয়ে যাও। আমার ইচ্ছা, ওই ডালটা বেয়ে যতটা পার এগিয়ে যাও। মন দিয়ে শোন, অত্যাশ্চর্য কোনো কিছু চোখে পড়ামাত্র আমাকে বলবে কিন্তু।
আমার বন্ধু লিগ্র্যান্ডের অসুস্থতা সম্বন্ধে আমার মনে যা কিঞ্চিৎ দ্বিধা ছিল এবার তা-ও নিঃশেষে উবে গেল। তাকে পুরোপুরি একজন পাগল ভাবা ছাড়া আর কোনো উপায়ই রইল না। যে মুহূর্তে আমার একটাই চিন্তা কিভাবে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
আমিনিবিষ্ট মনে বন্ধুকে বাড়ি ফিরিয়ে নেবার উপায় সম্বন্ধে ভেবে চলেছি, ঠিক তখনই গাছের ওপরে থেকে বুড়ো নিগ্রো জুপিটারের গলা শোনা গেল–‘হুজুর, ডালটা একেবারে মরা। এটা ধরে এগোতে ভরসা হচ্ছে না।’
‘কী? কি বললে, ডালটা মরা?
‘হ্যাঁ হুজুর, দরজার পেরেকের মতোই ‘মরা। এক্কেবারেই মরা! ডালটার কম্ম কাবার হয়ে গেছে।’
লিগ্র্যান্ড যেন একেবারে হায় হায় করে উঠল–কী, কী বললে জুপিটার, মরা ডাল। হায় ঈশ্বর! এখন আমার কর্তব্য কি!
আমি এমন একটা মওকা পেয়ে চুপ করে থাকতে পারলাম না। তাই সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম–‘কর্তব্য? একটাই কর্তব্য, বাড়ি ফিরে যাওয়া। বাড়ি ফিরে গিয়ে বিছানায় টান-টান হয়ে শুয়ে পড়ন মি. লিগ্র্যান্ড। আপনি তো আমাকে প্রতিশ্রুতিই দিয়ে রেখেছেন। চলুন, একান্ত বাধ্য ছেলের মতো বাড়ি ফিরে বিছানায় আশ্রয় নেবেন।
আমার কথাটাকে না শোনার ভান করে লিগ্র্যান্ড ওপরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললেন–‘জুপিটার, আমার কথা কী তোমার কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে?
‘হ্যাঁ হুজুর। আপনার সব কথাই আমি শুনতে পাচ্ছি।
‘তাই যদি সত্য হয় তবে তোমার পকেট থেকে ছুরিটা বের করে কাঠটা পরীক্ষা করে দেখ তো। ভালোভাবে পরীক্ষা কর, সেটা খুব পচা কিনা।
‘পচা। অবশ্যই পচা। কিন্তু খুব বেশি পচা নয় হুজুর।
তবে এত ঘাবড়াচ্ছ কেন?
‘আমি একা হলে হয়তো আরও বেশ কিছুটা ওপরে উঠে যেতে পারতাম।
‘এ কী অদ্ভুত কথা বলছ জুপিটার। একা হলে! ব্যাপারটা কি খোলসা করে বলে তো?’
‘অবাক হচ্ছেন কেন হুজুর? আমি হতচ্ছাড়া পোকাটার কথা বলছি।
‘পোকাটা সঙ্গে থাকার জন্য তোমার এমনকি সমস্যা।
‘সমস্যা তো অবশ্যই। পোকাটা কী ভারি! এটা সঙ্গে না থাকলে, আমি একা হলে অনায়াসেই আরও বেশ কিছুটা ওপরে উঠে যেতে পারতাম। কিন্তু আমার মতো একটানিগ্রোর ভারে ডালটা ভাঙবে না জানবেন।
লিগ্র্যান্ড এবার কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে বললেন–‘পাগলের মতো কি যা তা বলছ, জুপিটার! শুনে রাখ, জুপিটার, ঝি ঝি পোকাটাকে যদি ফেলে দাও তবে কিন্তু কোদালের ঘায়ে তোমার মাথাটা দুভাগ করে দেব। আমার কথাগুলো তোমার কানে ঢুকছে তো?
‘পাচ্ছি। সামান্য একটা নিগ্রোর ওপর এমন চটাচটি করার কী খুবই দরকার ছিল হুজুর?
‘যাক গে, এবার কি বলছি, মন দিয়ে শোন, তুমি নিজে যতদূর উঠে যাওয়া সম্ভব মনে কর ততটা উঠে যাও। তবে ঝি ঝি পোকাটাকে যেন কিছুতেই ফেলে দিও না, বুঝলে?
‘বুঝেছি হুজুর।
‘আমার কথামতো কাজ করলে নিচে নেমে এলেই আমি তোমাকে একটা ভালো পুরস্কার দেব, কথা দিচ্ছি।’
জুপিটার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল–ঠিক আছে, আমি এখনই উঠছি।
পরমুহূর্তেই সে ভয়ার্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল–‘উফ! উফ! ওটা কি! গাছের ওপরে ওটা কি!
তাই তো, লিগ্র্যান্ড তার কথার মাঝেই বলে উঠলেন–কী? কী ওটা?
‘আরে, এটা তো একটা মাথার খুলি! কেউ হয়তো এটাকে গাছের ওপর ফেলে গেছে! হ্যাঁ, সত্যি, মাথার খুলিই বটে। কাকগুলো খুবলে খুবলে ওর মাংসগুলো খেয়ে নিয়েছে।’
‘খুলি! কী বললে? খুলি? ভালো কথা, ওটাকে ডালের সঙ্গে কী দিয়ে আটকানো আছে বল তো?’ লিগ্র্যান্ড বললেন।
‘দেখছি। দেখছি হুজুর। আরে, কী আশ্চর্য ব্যাপার। খুলিটাকে গাছের ডালের সঙ্গে পেরেক দিয়ে আটকানো।’
‘পেরেক দিয়ে? ঠিক আছে জুপিটার। এবার আমি যা-যা বলব, করবে। আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ, সবই শুনতে পাচ্ছি।’
‘ভালো, এবার যা বলছি মন দিয়ে শোন, খুলির বাঁ চোখটার দিকে তাকিয়ে দেখ তো?’
‘আচ্ছা। কিন্তু হায়! কোনো চোখই তো আমার নজরে পড়ছে না! কী তাজ্জব ব্যাপার!
‘আরে, তুমি একেবারেই একটা বোকা হাঁদা নাকি হে, ডান-বা বোধও কি তোমার
নেই। কোনটা তোমার ডান হাত, আর কোনটাই বা বাঁ-হাত বোঝ না?’
‘বুঝি। এই তো, এটা আমার বা-হাত, আর এটা ডান-হাত। এটা দিয়েই তো আমি কাঠ কাটি, সব কাজ করি।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বলেছ ঠিকই। তুমি তো আবার ন্যাটা। বাঁ-হাতে সব কাজ কর। আর তোমার বাঁ-চোখটা তো তোমার বাঁ-হাতের দিকেই রয়েছে, এ-বোধটুকুও হারিয়ে বসেছ নাকি! এবার তো আর মড়ার খুলির বাঁ চোখটা খুঁজে পাওয়ার সমস্যা হওয়ার কথা নয়। খোঁজ, দেখ। কী, পেয়েছ?
বেশ কিছুটা সময় নীরবে কাটানোর পরনিগ্রো জুপিটার মুখ খুলল–‘হুজুর আর একটা ধন্দ দেখা দিয়েছে যে।
‘ধন্ধ? আবার কী হল?
‘খুলিটার বাঁ-চোখটা কী খুলিরও বা-হাতের দিকে হবে?
‘আরে ধৎ! খুলিটার আবার বাঁ-হাত’
তার কথা শেষ হবার আগেই জুপিটার বলে উঠল–‘হুজুর, এটাই তো মহাধন্ধ! খুলিটার যে আবার বাঁ বা ডান কোনো হাতই নেই। যাক গে, ঘাবড়াবেন না। পেয়েছি পেয়ে গেছি।
‘পেয়েছ? কি-কি পেয়ে গেছ জুপিটার?
‘বাঁ-চোখ, এই তো বাঁ চোখ। এবার কী করতে হবে বলে দিন।
‘চমৎকার! চমৎকার! বাঁ-চোখটা পেয়ে গেছ! এবার এক কাজ কর, ঝি ঝি পোকাটাকে খুলির বাঁ-চোখটার মধ্যে ঢুকিয়ে দাও।’
‘কতদূর? কতটা ভেতরে?
‘যতদূর পর্যন্ত দড়িটা যায় পোকাটাকে ততদূর পর্যন্ত ঢুকিয়ে দাও। খবরদার দড়িটাকে যেন ভুলেও হাত থেকে ছেড়ে দিও না। দড়ির বিপরীত প্রান্তটা শক্ত করে ধরে রাখ।
‘হুজুর, আপনি যা-যা বলেছেন সবই তো করেছি। আরে পোকাটাকে গর্তের ভেতরে সিঁধিয়ে দেওয়া তো সহজ, খুবই মামুলি একটা কাজ নিচ থেকে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই আপনি নিজেই ব্যাপারটা দেখতে পাবেন। দেখতে পাচ্ছেন কি হুজুর।’
এবার কথাবার্তা বিনিময়ের সময় বুড়ো নিগ্রো জুপিটারের শরীরের কোনো অংশ দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু খুলির ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া পোকা বেরিয়ে দড়ির প্রান্তটা দেখা যেতে লাগল।
বিদায়ী সূর্যের শেষ রক্তিম আভা পোকাটার গায়ে পড়ায় সেটা রীতিমত ঝলমলিয়ে উঠল। কাঁচাসোনার গা থেকে যেন অত্যুজ্জ্বল আলোকচ্ছটা ঠিকরে বেরোতে লাগল।
আমি নিচে দাঁড়িয়ে ঝকমকে পোকাটার দিকে তাকিয়ে তার গা থেকে ঠিকরে বেরিয়ে-আসা আলোকচ্ছটার শোভা উপভোগ করতে লাগলাম। সে মুহূর্তে আমার মনে হলো পোকাটি কোনোক্রমে ফসকে নিচে পড়ে গেলে একেবারে আমাদের পায়ের কাছে আছাড় খেয়ে পড়বে।
বন্ধুরা লিগ্র্যান্ডের মধ্যে দারুণ ব্যস্ততা লক্ষ্য করলাম। সে আমাদের চারদিকের কিছুটা অংশের জঙ্গল পরিষ্কার করতে মেতে গেল।
জঙ্গল মোটামুটি পরিষ্কার করা হয়ে গেলে সে এবার ওপরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল–‘জুপিটার, এবার দড়িটাকে হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে তুমি নিচে নেমে এসো।
জুপিটার মনিবের নির্দেশ পালন করল।
জুপিটার দড়ির প্রান্তটা হাত থেকে ছেড়ে দিতেই ঝি ঝি পোকাটা যখন আছাড় খেয়ে পড়ল, লিগ্র্যান্ড ঠিক সেখানে ছোট্ট একটা খুঁটি পুঁতে চিহ্ন দিয়ে দিলেন। সে এবার কোটের পকেট থেকে একটা ফিতে বের করলেন। মাপের ফিতে।
লিগ্র্যান্ড এবার ফিতেটা দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে মাপামাপি করে গাছটাকে কেন্দ্র করে তার চারদিকে মাটির বুকে চারফুট ব্যাসযুক্ত একটা বৃত্ত অঙ্কন করল। এবার একটা কোদাল নিয়ে গর্ত খুঁড়তে লেগে গেলেন। আর জুপিটার আর আমাকেও বললেন কোদাল দিয়ে গর্ত খুঁড়তে।
জুপিটার আর আমি উভয়েই তার গর্ত খোঁড়ার রহস্য আমরা তার হুকুম তামিল করতে গিয়ে উন্মাদের মতো গর্ত খুঁড়তে মেতে গেলাম।
একটা কথা, একেবারে আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলছি, এরকম মজার নিছক খেয়ালের বশবর্তী হয়ে আমি কোনো কাজ করার সম্পূর্ণ বিরোধী।
বিশেষ করে এরকম একটা কাজে, এমন বিশেষ মুহূর্তে আমি হয়তো তীব্র প্রতিবাদই করতাম। কারণ, রাত ঘনিয়ে আসছে, এক নাগাড়ে দীর্ঘ পরিশ্রমে শরীর ক্লান্ত, অবশ্য আমার অন্য দুজন সঙ্গি আমার চেয়ে বেশি ছাড়া কম ক্লান্ত নন। তা সত্ত্বেও ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ হলেও ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ, এ-পরিস্থিতিতে বন্ধু লিগ্র্যান্ডের যা মানসিক পরিস্থিতি তাতে করে তার বিরুদ্ধাচরণ করে তাকে মানসিক দিক থেকে উত্ত্যক্ত করা নিরাপদ হবে না।
একবার ভাবলাম লিগ্র্যান্ডকে বলপূর্বক বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু পরিস্থিতি যেখানে পৌঁছে গেছে তাতে এ-কাজে নিগ্রো জুপিটারের কাছ থেকে কোনোরকম সাহায্য সহযোগিতা পাওয়ার প্রত্যাশা করা বৃথা।
সত্যি কথা বলতে কি, দু-চারদিনের পরিচয় হলেও এরই মধ্যে বুড়োনিগ্রোটার পরিচয় আমি ভালোই পেয়ে গেছি। তার মনিবের মতের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করতে গেলে, লড়াই বাঁধলে সে মনিবের বিরুদ্ধে, আমার পক্ষ অবশ্যই অবলম্বন করবে না।
তাই তো, বন্ধুর কাজে যতই বিরক্ত হই, যতই ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকি না কেন শেষ মেশ তার নির্দেশে মাটি খোঁড়ার কাজেই মেতে গেলাম।
আর আমার ব্যস্ততার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, মাটি খোঁড়ার কাজটা যত তাড়াতাড়ি মিটে যাবে ততই দুঃস্বপ্নে বিভোর আমার বন্ধুর নিঃসন্দেহ হবে যে, তার স্বপ্নটা নিছকই মরিচিকা, মিথ্যা।
আমরা এক নাগাড়ে দুঘণ্টা ধরে মাটি খোঁড়াখুঁড়ির কাজে মেতে রইলাম। মাটিতে একের পর এক কোদালের কোপ পড়তেই লাগল। কারো মুখে টু-শব্দটিও নেই।
আমরা মুখে কলুপ এঁটে কোদাল চালিয়ে যাচ্ছি বটে, কিন্তু আমাদের সঙ্গি কুকুরটা কিন্তু আমাদের খোঁড়া জায়গাটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল।
শেষপর্যন্ত জুপিটার বিরক্তির সঙ্গে হাতের কোদালটা রেখে গর্ত থেকে উঠে এলো। কুকুরটাকে ধরে একটা দড়ি দিয়ে তার মুখটাকে আচ্ছা করে বেঁধে দিল। তারপর দড়ির একটা প্রান্ত গলার সঙ্গে এমনভাবে বেঁধে দিল যাতে মুখের বাঁধনটা কোনোক্রমেই আলগা হয়ে না যায়।
কুকুরটার ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি বন্ধ করে জুপিটার আবার গর্তটার ভেতরে নেমে দমাদম কোদাল চালাতে লাগল।
তিন-তিনজন মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অচিরেই পাঁচ ফুট গভীর একটা গর্ত কাটা হয়ে গেল। কিন্তু হায়! কোথায় গুপ্তধন, কোথায়ই বা বন্ধুবর লিগ্র্যান্ডের বহু আকাঙ্ক্ষিত সোনা।
হতাশায়নিগ্রো জুপিটার আর আমার হাত শিথিল হতে হতে এক সময় পুরোপুরি থেমে গেল।
আমরা হাত থেকে কোদালটা নামিয়ে রাখলে কি হবে, লিগ্র্যান্ড কিন্তু মোটেই আশাহত হলেন না। তিনি আগের মতো পুরোদমে কোদাল চালিয়েই চললেন। বাঁ হাত দিয়ে ঘামে ভিজে ওঠা কপালটিকে মুছে নিয়ে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে কোদাল চালাতেই লাগলেন।
বার ফুট ব্যাসযুক্ত গর্তটাকে তিনি একাই আরও কিছু বড় করে গভীরতা আর দুফুট বাড়িয়ে ফেললেন। এতেই আমি নিঃসন্দেহ হলাম, তিনি হতাশ তো নন বরং আরও উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে কাজ করছেন।
না, তবুও আকাঙ্ক্ষিত বস্তুর হদিস মিলল না।
এক সময় দেখা গেল স্বর্ণসন্ধানী ও স্বর্ণলোভাতুর নিজেই চোখে মুখে হতাশার ছাপ এঁকে ঘামে জবজবে শরীরে গর্তটা থেকে উঠে এলেন।
তিনি আমাদের সঙ্গে একটাও কথা বললেন না। আমরাও গর্তটার প্রসঙ্গে তো দুরের কথা অন্য কোনো প্রসঙ্গেও তার সঙ্গে কোনো কথা বললাম না।
বন্ধুবর লিগ্র্যান্ড গর্তটা থেকে উঠে হাত দিয়ে পিঠের ঘাম বার কয়েক মুছে নিয়ে বিষণ্ণ মুখে কোটটা পরতে লাগলেন।
জুপিটার মনিবের নির্দেশ পেয়ে যন্ত্রপাতিগুলো গুছিয়ে কাঁধে ও হাতে তুলেনিল।
কুকুরটাকে মুখের বাঁধন খুলেনিদারুণ অস্বস্তি থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হল।
আমরা নিঃশব্দে পদচারণ করতে করতে বাড়ির দিকে এগোতে লাগলাম।
আমরা হয়তো বড়জোর দশ-বারো পা এগিয়ে গেছি, এমন সময় লিগ্র্যান্ড আচমকা তীব্র স্বরে একটা গর্জন করে উন্মাদের মতো দৌড়ে গিয়ে জুপিটারের গলাটা চেপে ধরলেন।
আকস্মিক আক্রমণের কারণ বুঝতে না পেরে হতভম্ভের মতো মনিবের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তার হাত ও কাঁধ থেকে কোদালগুলো মাটিতে পড়ে গেল। আর সে নিজে হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে পড়ল। কিন্তু তার মনিবের এমন অভাবনীয় কারণ জানার জন্য সামান্যতম চেষ্টাও করল না।
আমার বন্ধুবর লিগ্র্যান্ড দাতে দাঁত ঘষতে ঘষতে বলতে লাগল–নচ্ছাড় শয়তান! বল, বল নচ্ছাড়! এখনই এ মুহূর্তেই আমার প্রশ্নের জবাব চাই।’
ব্যাপারটা সম্বন্ধে সামান্যতমও ধারণা করতে না পেরে বুড়োনিগ্রোটা নিতান্ত অপরাধীর মতো ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ক্রোধান্মত্ত মনিবের মুখের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইল।
লিগ্র্যান্ডের তর্জন গর্জন অব্যাহত রইল। তিনি ক্রোধে যুঁসতে ফুঁসতেই এবার বলেন–‘শয়তান’, বল, তোর বা চোখ কোনটা? এক্ষুনি বলতে হবে কোনটা তোর বাঁ চোখ?’
কপালে করাঘাত করে জুপিটার বলল–‘হায় ঈশ্বর! হুজুর এটাই কী আমার বাঁ চোখ নয়, আপনিই বলুন?
কথা বলতে বলতে সে ডান চোখটার ওপর হাত রাখল।
ব্যস, আর যাবে কোথায়, জুপিটারের কথাটা কানে যেতেই আমার বন্ধুবর বদ্ধ উন্মাদের মতো চেঁচিয়ে উঠে সজোরে এক লাফ দিলেন। নাচতে নাচতে বললেন– ‘আমিও এরকমটাই অনুমান করেছিলাম। কালো শয়তানটা যে এমন একটা ভুল করে বসতে পারে, মোটমুটি ধরেই নিয়েছিলাম।’ কথাটা বলতে বলতে তিনি চাকরের সামনেই এমন বিশ্রি অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে আরম্ভ করলেন যে, ভাষার মাধ্যমে তা দশজনের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা না করাই ভালো, যথাযথভাবে প্রকাশ করাও সম্ভব নয়।
জুপিটার ব্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে একবার মনিবের মুখের দিকে, পরমুহূর্তেই আবার আমার মুখের দিকে পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল।
মিনিট দু-তিনের মধ্যেই লিগ্র্যান্ড নাচ থামিয়ে মুহূর্তের জন্য আমাদের মুখের ওপর চোখের মণি দুটোকে বুলিয়ে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন–‘এসো চলে এসো।
আমি স্ববিস্ময়ে বললাম–‘চলে আসব মানে? কোথায় যাবে?
‘আবার ফিরে যেতে হবে। আবার সেখানে, সেই গাছতলায়ই যেতে হবে।’
‘কেন? ফিরে যেতে হবে কেন?
আমার হাত দুটো ধরে জোরে জোরে দু-তিনটি ঝাঁকুনি দিয়ে সে বলে উঠল– ‘আরে, কাজ এখনও শেষ হয়নি।’
তিনি আগে আগে পথ দেখিয়ে আমাদের নিয়ে আবার সুদীর্ঘ টিউলিপ গাছটার তলায় নিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। গলা নামিয়ে প্রায় স্বগতোক্তি করলেন ‘আমি আগেই ভেবেছিলাম, কালো আহাম্মকনিগ্রোটা গণ্ডগোল করেছে, ডান চোখকে ভুল করে বা চোখ ভেবে নিয়েই তো গণ্ডগোলটা বাঁধিয়েছে।
এবার জুপিটারের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি বললেন–‘এই যে, কালো মানিক, একবারটি আমার কাছে এসো তো।
জুপিটার মুখ কাচুমাচু করে কয়েক পা এগিয়ে এলো।
লিগ্র্যান্ড বললেন–‘বাছাধন, ভালো করে ভেবে নিয়ে বল তো, মাথার খুলিটা গাছের ডালের সঙ্গে মুখটাকে বাইরের দিকে রেখে, নাকি গাছের ডালের দিকে মুখ রেখে পেরেক দিয়ে আটকানো ছিল?
‘হুজুর খুলির মুখটা বাইরের দিকে ছিল। আমার মনে হয়, কাকগুলো যাতে অনায়াসেই তার চোখ দুটোকে দেখতে পায় সে জন্যই এরকমটা করেছিল।
‘চমৎকার! চমৎকার! এবার আরও ভালো করে ভেবে নিয়ে আমার কথার জবাব দাও–এই চোখ, নাকি ওই চোখটার ভেতর দিয়ে তুমি সোনালি ঝিঁঝি পোকাটাকে গলিয়ে দিয়েছিলে? বল, কোনটা দিয়ে?’ কথাটা বলার সময় লিগ্র্যান্ড হাত বাড়িয়ে জুপিটারের একের পর এক চোখে হাত রাখলেন।
‘হুজুর, এ-চোখটা। এই যে এ বাঁ চোখটা। আপনি তো এটার কথাই বলেছিলেন, তাই না? কথাটা বলার সময় সে নিজের ডান চোখটায় হাত রাখল।
‘ব্যাস, আর বলার দরকার নেই, এতেই আমি পুরো ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছি। আমরা আবার কাজে লাগব, চেষ্টা করে দেখব।
আমার বন্ধুটি আবার কোটের পকেট থেকে মাপার ফিতেটা বের করে মাপজোক শুরু করে দিলেন। আগের জায়গাটা থেকে বেশ কয়েক গজ দূরে একটা জায়গা নির্ধারণ করলেন। তারপর আগের চেয়ে বড় ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট একটা বৃত্ত এঁকে ফেললেন।
আমি এবারও নীরব চাহনি মেলে বন্ধুর কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলাম।
মাপঝোঁক সেরে নিয়ে তিনি এবার আমাদের লক্ষ্য করে বললেন–‘আর একবার আমাদের গায়ের ঘাম ঝরাতেই হবে। আসুন, আবার কোদাল নিয়ে গর্ত তৈরির কাজে মেতে যাই।
জুপিটার আর আমি উভয়েই নিঃশব্দে কোদাল হাতে তুলে নিয়ে তার সঙ্গে গর্ত খোঁড়ার কাজে মেতে গেলাম।
আমার শরীর ও মন উভয়েই তখন ক্লান্ত। এত কিছু সত্ত্বেও কেন যে বন্ধুর কাজটার প্রতি এবার আমার আগ্রহ হঠাৎ অস্বাভাবিক বেড়ে গেল–আমি নিজেই জানি না। এমনও হতে পারে বন্ধুর হঠকারী কথাবার্তা ও হাবভাবের মধ্যেও এবার কম-বেশি চিন্তা-ভাবনার ছাপ আমি উপলব্ধি করতে পেরে গেছি। তাই এবার আমি অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে কোদাল চালাতে আরম্ভ করলাম।
সত্যি আমি নির্দিদায় স্বীকার করছি, তখন আমার মধ্যেও আশার সঞ্চার হতে আরম্ভ হয়েছে। আর এটিও সত্য যে, এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে আমি সঠিক জবাব দিতে পারব না।
এভাবে প্রায় দেড় ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে মাটি কোপানোর পর আমাদের সঙ্গি কুকুরটা গলা ছেড়ে তর্জন গর্জন আরম্ভ করে দিল। কি যেন একটা অজানা আক্রোশে সে এমন ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি শুরু করছে।
বুড়ো নিগ্রো জুপিটার মুখ বুজে মাটি কোপাতে থাকলে ক্রোধোন্মত্ত কুকুরটা তাকে বাধা দিতে লাগল। সে গর্জন করতে করতে অতর্কিতে গর্তটার মধ্যে লাফিয়ে পড়ে সামনের থাবা দুটো দিয়ে পাগলের মতো মাটি আঁচড়াতে শুরু করল।
পাগলের মতো মাটি খুঁড়ে কুকুরটা কয়েক মিনিটের মধ্যেই এমন একটা হাড়ের পাঁজা বের করে ফেলল, সেগুলো জোড়া দিয়ে দিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ নরকঙ্কাল তৈরি করা যেতে পারে।
আরও আছে। হাড়ের স্তূপটা ছাড়া সে উদ্ধার করল প্রায় মাটিতে পরিণত হয়ে যাওয়া কিছু পশম আর অক্ষত কয়েকটা ধাতব বোতাম।
আমরা কোদাল চালানোর কাজ অব্যাহত রাখলাম। আরও ঘা কতক কোদাল মারতেই মাটির সঙ্গেই উঠে এলো অতিকায় একটা খেপনীর ছুরির ফলা। অবাক হলাম।
আর কিছুটা খোঁড়াখুঁড়ি করতেই তিন-চারটি সোনা ও রূপার মুদ্রা উঠে এলো। ব্যাপারটা আমার মধ্যে যারপরনাই উৎসাহের সঞ্চার করল।
মাটির তলা থেকে উঠে-আসা বস্তুগুলো দেখে জুপিটার যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবার জোগাড় হল। তার বেড়ানো গালের হাসির রেখাটুকুই আমাকে এরকম ভাবতে উৎসাহিত করল।
কিন্তু আমার বন্ধুকে ব্যাপারটা মোটেই সন্তুষ্ট করতে পারল না। তার চোখে মুখে দেখা দিল গভীর অসন্তোষ। তা সত্ত্বেও তিনি আমাদের কোপানোর কাজ অব্যাহত রাখতে নির্দেশ দিলেন। তার কথা শেষ হবার আগেই আমি কি যেন একটা বস্তুতে আচমকা হোঁচটা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। ব্যস্ত হাতে মাটি সরিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম, মাটির ভেরে থেকে উঁকি মারা একটা লোহার আংটায় আমার জুতার সামনের দিকটা ঢুকে যাওয়ার জন্যই সমস্যাটা বেঁধেছিল।
ব্যাপারটা আমাদের সবার মধ্যেই অবর্ণনীয় উৎসাহ জাগিয়ে তুলল। ব্যস, আর মুহূর্তমাত্র দেরি না করে আমরা নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে কাজে মেতে গেলাম। মাটিতে দমাদম কোদালের ঘা মারতে লাগলাম।
একটা মিনিট পার হতে পারেনি, আমরা এরই মধ্যে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করে একটা কাঠের সিন্দুক আবিষ্কার করে ফেললাম। এতে আমাদের মনে কী অপার আনন্দ জেগে উঠল তা ভাষায় বর্ণনা করা বাস্তবিকই সাধ্যাতীত।
বাক্সটার দৈর্ঘ্য সাড়ে তিন ফুট, প্রস্থ তিন ফুট আর গভীরতা আড়াই ফুট। আর তার চারদিকে পেটা লোহার পাত দিয়ে দৃঢ়ভাবে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। আর সিন্দুকটার গায়ে আটকানো রয়েছে মোট ছটা আংটা–দুদিকে তিনটি করে। আর সেগুলো এমনভাবে সিন্দুকটার গায়ে আটকে দেওয়া হয়েছে যাতে দুজন শক্তভাবে মুঠো করে সিন্দুকটাকে ধরে তুলতে পারে।
আমরা সবাই মিলে শরীরের সবটুকু শক্তি নিঙড়ে, দাঁতে দাঁত চেপে টানাটানি করে সিন্দুকটাকে সামান্য নাড়াতে পারলাম–ব্যস, এর বেশি নয়।
আমরা নিঃসন্দেহ হলাম, সিন্দুকটা এত ভারী যে, এটাকে এখান থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া একেবারেই সম্ভব নয়।
ভাগ্য ভালো যে, সিন্দুকটার ডালার পেটিগুলো দুটো হুড়কোর সঙ্গে শক্তভাবে আটকে দেওয়া হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দারুণ হাঁপাতে হাঁপাতে আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে কোনোরকমে হুড়কো দুটোকে খুলে ফেলতে পারলাম।
আরে বাবা! একি অকল্পনীয় অত্যাশ্চর্য ব্যাপার! চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়ার জোগাড় হল। আর সে সঙ্গে আমার বুকের ভেতর যেন ক্রমাগত হাতুড়ির ঘা পড়তে লাগল। আমাদের চোখের সামনে অগাধ ধন সম্পদ আচমকা ঝলমলিয়ে উঠল। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো কিছু পরিমাণ সোনা দানা সিন্দুকটাতে রক্ষিত আছে। কিন্তু এ যে দেখছি সাত রাজার ধন সম্পদ এক সঙ্গে জড়ো করলেও এমন একটা স্তূপ তৈরির করার কল্পনাও করা যায় না। সোনা। সোনা। যেন কাটা সোনার একটি স্তূপকে সিন্দুকটার ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে।
লণ্ঠনের শিখা গর্তের ভেতরে পড়ে সিন্দুকের ভেতরের আর হীরা-মুক্তার গায়ে লাগায় অত্যুজ্জ্বল আলোকচ্ছটা যেন চারদিকে ঠিকড়ে পড়তে লাগল। সত্যি বলছি, এমন চোখ ধাঁধানো আলো দেখার সৌভাগ্য ইতিপূর্বে আমার চোখ দুটোর হয়নি।
অভাবনীয় দৃশ্যটার মুখোমুখি হয়ে আমরা সবাই যারপরনাই স্তম্ভিত–যেন বাশক্তি হারিয়ে ফেললাম।
আমার নিজের তখনকার মানসিক অবস্থার কথা না-ই বা বললাম। আকস্মিক ও নিরবচ্ছিন্ন উত্তেজনায় আমার বন্ধু লিগ্র্যান্ড একেবারে ভেঙে পড়লেন; বজ্রাহতের মতো নিশ্চল-নিথরভাবে দাঁড়িয়ে সিন্দুকটার ভেতরের স্তরে স্তরে সাজানো সোনাদানা আর হীরা-মুক্তোর স্তূপের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন। মুখে একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না। করলেন না বললে হয়তো ঠিক বলা হবে না। আসলে করতেই পারলেন না।
কয়েক মুহূর্তে মনে হলো কোনো অদৃশ্য হাত যেন বুড়োনিগ্রোটার মুখে দোয়াত দোয়াত কালি ঢেলে দিল। তার মুখের দিকে চোখ পড়তেই মনে হলো আকস্মিক আতঙ্কে সে যেন পাথরের মূর্তির মতো, বজ্রাহত রোগীর মতো নিশ্চল-নিথর হয়ে পড়েছে।
জুপিটার গর্তের মধ্যে দাঁড়িয়েই সিন্দুকের ভেতরে হাত দুটোকে সোনা আর হীরা মুক্তোর স্তূপের মধ্যে ঢুকিয়ে মুখে কলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে রইল। তার কাণ্ড দেখে আমার মনে হলো সে যেন সোনার স্পর্শের অভাবনীয় সুখ-শান্তিতে মন-প্রাণ কানায় কানায় ভরে নিচ্ছে।
কয়েক মুহূর্তে নিশ্চল-নির্বাকভাবে কাটিয়ে দিয়ে এক সময় সে স্বগতোক্তির মতোই প্রায় অস্ফুট স্বরে বলে উঠল–সবই ওই সোনালি ঝি ঝি পোকাটার নাম? আমার আদর সোহাগের পোকা! তাকে আমি কত না ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি।’
আমার বন্ধু আর তার নিগ্রো ভৃত্য জুপিটারের মাথায় এলো ব্যাপারটা নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই দেখে ভাবলাম, আমাকেই তাদের মাথায় ব্যাপারটা ঢোকাতে হবে–ধন-সম্পদের পাহাড়টাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া একান্ত দরকার। এমনিতেই বেশ দেরি হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ পরই পূর্ব আকাশে ভোরের আলো উঁকি দেবে। অন্ধকার কাটার আগেই যদি ধন-সম্পদগুলো বাড়িতে নিয়ে তোলা না হয় তবে কেলেঙ্কারি ঘটে যেতে পারে।
সিন্দুকের অপরিমিত সোনাদানা হীরা মুক্তোগুলোকে কিভাবে আমার বন্ধুর বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাবে সে আলোচনা করতে করতেই বেশ কিছু সময় চলে গেল।
শেষমেশ সিন্দুকের ভেতরের দুই তৃতীয়াংশ সোনাদানা বের করে সেটাকে কিছুটা হালকা করে নিলাম। এবার তিনজনে টানা হেচড়া করে কোনোরকমে সেটাকে গর্তের ভেতর থেকে ওপারে তুলে আনতে পারলাম। আর সে সব সোনাদানা একটা ঘন ঝোপের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে কুকুরটাকে পাহারায় রেখে সিন্দুকটাকে নিয়ে আমরা বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম।
অমানুষিক পরিশ্রম করে গায়ের ঘাম ঝরাতে ঝরাতে আমরা রাত একটার কাছাকাছি সময় সিন্দুকটা বয়ে নিয়ে বন্ধুবর লিগ্র্যান্ডের বাড়ির দরজায় পৌঁছাতে পারলাম।
এক ঘণ্টার মধ্যে বিশ্রাম ও আহারাদি সেরে আমরা আবার রাত দুটো নাগাদ পাহাড়টার পাদদেশের গর্তটার উদ্দেশে ব্যস্ত পায়ে হাঁটা জুড়লাম। সঙ্গে করে বেশ বড়সড় বস্তা নিয়ে গেলাম।
জায়গামতো পৌঁছে আমরা মালপত্র তিনটি বস্তায় প্রায় সমানভাবে বোঝাই করে ফেললাম। এবার কোদাল দিয়ে মাটি ফেলে ফেলে গর্তটা ভালোভাবে বুজিয়ে শুকনো লতাপতা ছড়িয়ে এমনভাবে ঢেকে দিলাম যাতে সহজে কারো নজরে না পড়ে। আর জনমানবশূন্য অঞ্চলটায় যাবেই বা কে যে নজরে পড়বে।
সোনাদানা বোঝাই বস্তাগুলো মাথায় করে বয়ে আমরা যখন দ্বিতীয়বার বাড়ি ফিরলাম তখন গাছের মাথার ওপর দিয়ে পূব-আকাশের ভোরের রক্তিম আভা সবে উঁকি দিতে শুরু করেছে।
এবার আমরা ক্লান্তিতে সত্যি সত্যি ভেঙে পড়েছি। শরীর যেন আর চলতে চায় না। হাত-পাগুলো বিশ্বাসঘাতকতা করতে চায়। দীর্ঘ সময় একটানা বিশ্রাম করলে হয়তো ক্লান্তি অপনোদন করা সম্ভব হত। কিন্তু যে অন্তহীন অবর্ণনীয় উত্তেজনা আমাদের মধ্যে ভর করেছে তা-তো আমাদের স্বস্তিতে বিশ্রাম করতেও দেবে না। সত্যি কথা বলতে কি আমি, না আমি একা নই আমরা সবাই নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতার শিকার হয়ে রীতিমত ছটফট করছি।
শরীর টলতে লাগল। নিতান্ত অনিচ্ছায়, ধরতে গেলে অনন্যোপায় হয়েই আমরা তিন-চার ঘণ্টা আশান্ত ঘুমের ঘোরে কাটিয়ে এক এক করে হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম।
এবার আমরা তিনজন ঘরের দরজা বন্ধ করে পাশাপাশি বসে সোনাদানা আর হীরা-মুক্তোর হিসাব-নিকাশ করতে মেতে গেলাম।
সিন্দুক বোঝাই ধনরত্ন। সবগুলো মেঝেতে পাঁজা করে নিয়ে একটা একটা করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মোটামুটি দাম করতে করতে পুরোটা দিন তো গেলই, এমনকি রাতেরও বেশ কিছুটা অংশ কেটে গেল।
যত সহজে ব্যাপারটাকে বললাম আসলে কাজটা কিন্তু এত সহজে সারা সম্ভব হয়নি। সোনাদানা আর হীরা-মুক্তাগুলোকে প্রথমে যত্ন করে আলাদা আলাদা ভাগে ভাগ করে ফেললাম। এবার আমরা নিঃসন্দেহ হলাম, আমরা একটু আগে পর্যন্ত ধন সম্পদের দাম সম্বন্ধে যে অনুমান করেছিলাম, প্রত্যাশা করেছিলাম আসলে এদের দাম অনেক, অনেক বেশি। বিচার করে দেখলাম, তাতে আছে বেশ কিছু সংখ্যক বৃটিশ গিনি, আর বাকি সব বিচিত্র মুদ্রার পাহাড়-জার্মানি, ফরাসি, স্পেনীয় প্রভৃতি দেশিয় গিনি, আর অবশিষ্ট গিনিগুলো যে কোনো দেশিয় তার হিসেব আমাদের কারোরই জানা নেই। একটা কথা খুবই সত্য যে গিনির পাহাড় ঘাটাঘাটি করে, তন্নতন্ন করে খুঁজে একটাও মার্কিন মুদ্রা হাতে পেলাম না।
আর মুদ্রাগুলো ছাড়া যত সব হীরা-মুক্তা পেলাম তাদের মূল্য নির্ধারণের বৃথা চেষ্টা আমরা করতে পারলাম না। আসলে আমাদের সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলোয়নি।
শুধু কি মুদ্রা আর হীরা-মুক্তাই? নিরেট সোনার গহনা যে কত তার হিসেব করা গেল না। আর যা-কিছু পেলাম তাদের মধ্যে কানের দুল, আংটি–অন্তত ত্রিশটা ইয়া মোটা মোটা গলার হার আর কত রকমের গয়না আর জিনিস তার ইয়ত্তা নেই।
শেষপর্যন্ত অনুমান-নির্ভর ভুলে ভরা হিসেব-নিকাশ সারার পর আমাদের চরম উত্তেজনা যখন একটু একটু করে প্রশমিত হতে হতে মোটামুটি থিতিয়ে পড়ল তখন আমার বন্ধুবর লিগ্র্যান্ড আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, আমি তার এমন অগাধ ধনরত্ন সমৃদ্ধ গুপ্তধনের আবিষ্কার তিনি কিভাবে করলেন, এমন একটা রহস্যের সমাধান তিনি কী করে সম্ভব করলেন, সেটা জানার জন্য কৌতূহল আমার বুকের ভেতরটা তোলপাড় করছে।
তাই আমার কৌতূহলনিবৃত্ত করতে বন্ধুবর তার রহস্যটার সমাধানের একটা সংক্ষিপ্ত অথচ মনোজ্ঞ বিবরণ আমার সামনে তুলে ধরলেন–
দু ঠোঁটের ফাঁকে একটা চুরুট আঁকড়ে ধরে লিগ্যান্ড তাতে অগ্নি সংযোগ করলেন। একগাল ধোয়া ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে এবার বলতে শুরু করলেন–‘আশা করি সে রাতটার কথা আমার ভালোই মনে আছে যখন ঝি ঝি পোকাটার একটা রেখাচিত্র আমি আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলাম? আর আশা করি এও আমার স্মৃতি ভ্রষ্ট হয়নি যে, আপনি বলেছিলেন রেখাঁটি এটা একটা মরার খুলির মতো দেখতে, আপনার মুখে এ কথা শুনে আমি তখন খুবই বিরক্ত হয়েছিলাম।’
দেখুন, সত্যি কথা বলতে কি, আপনার মুখে প্রথম ও কথাটা শোনার পর আমি ভেতরে ভেতরে রাগে গজগজ করছিলাম। কারণ আমি নিঃসন্দেহ হয়েছিলাম যে, আপনি আমার সঙ্গে মস্করা করছেন।
কিন্তু একটু পরেই যখন পোকাটার পিঠের বিন্দু দুটোর কথা মনে পড়ে গেল তখনই আপনার সম্বন্ধে আমার ভুলটা ভেঙে গেল। এবার মনে হলো আপনার কথায় কিছুটা সত্যতা থাকলেও থাকতে পারে। তবুও আমার শিল্পকীর্তি নিয়ে রসিকতা করার বিরক্তিটুকু মন থেকে মুছে ফেলতে পারলাম না। এরও যথেষ্টই কারণ রয়েছে। আমার পরিচিতজনদের মতে শিল্পকর্ম সম্বন্ধে আমার দক্ষতা যথেষ্টই রয়েছে। আর আপনি কিনা শিল্পী হিসেবে আমাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না!
তাই রেখাচিত্রটার ওপর মুহূর্তের জন্য চোখ বুলিয়েই আপনি যখন চোখে-মুখে বিতৃষ্ণার ছাপ এঁকে কাগজটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তখন আমি রাগে একেবারে কাই হয়ে গিয়ে সেটাকে দলা পাকিয়ে জ্বলন্ত চুল্লিটায় ফেলে দিতে গিয়েছিলাম, মনে পড়ছে।
আমি মুচকি হেসে নীরবে ঘাড় কাৎ করলাম। তিনি এবার ঠোঁটের চুরুটটায় লম্বা একটা টান দিয়ে হাসতে হাসতেই বললেন। সত্যি, আপনার ওপর আমি তখন রাগে একেবারে ব্যোম হয়ে গিয়েছিলাম।
আমি কপালের চামড়ায় পর পর কয়েকটা ভজ এঁকে বললাম–‘বোধ হয় ওই ছেঁড়া কাগজের চিলতেটার কথা আপনি বলছেন, তাই না?
লিগ্র্যান্ড সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলেন–‘ধ্যুৎ! কী বাজে কথা বলছেন ভাই! ওটা ছেঁড়া ফাটা বাজে কাগজ অবশ্যই ছিল না। তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, গোড়ার দিকে আমিও সেটাকে বাজে কাগজ বলেই ভেবেছিলাম। আর তার গায়ে রেখাচিত্রটা আঁকতে গিয়ে নিঃসন্দেহ ওটা সাধারণ কাগজ না, উন্নতমানের পার্চমেন্ট কাগজ। এ পর্যন্ত বলে তিনি মুখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন–‘আশা করি আপনার অবশ্যই মনে আছে যে, কাগজটা খুবই নোংরা ছিল। আর একটা কথা, কাগজটাকে হাতে নিয়ে মুঠোর মধ্যে দলা পাকানোর সময় যে কাগজটা আপনি দেখেছিলেন, তার ওপর যেখানে ঝি ঝি পোকার রেখাচিত্রটা আমি এঁকেছিলাম ঠিক সে জায়গাই একটা মড়ার মাথা দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়ি।
আমার তো খুব ভালোই জানা ছিল, যে রেখাচিত্রটা আমি এঁকেছিলাম, এ আঁকাটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকৃতির। তবে এও মিথ্যে নয়, উভয়ের মধ্যে বৈসাদৃশ্য থাকলেও সুদৃশ্যও কম ছিল না।’
আমি কেমন একটা অবর্ণনীয় ধন্ধে পড়ে গেলাম। রহস্যটা ভেদ করার জন্য আমি একটা মোমবাতি নিয়ে ঘরের এক কোণে চলে গেলাম। কাগজটা বার বার উলটেপাল্টে ছবিটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। এবার নজরে পড়ল, ঝি ঝি পোকাটাকে আমি যেখানে এঁকেছিলাম তার ঠিক নিচেই মড়ার মাথাটা আঁকা হয়েছে।
আমি যার পর নাই অবাক হলাম, আমার আঁকা ছবিটা যেন অবিকল মরার মাথার খুলিটারই মতো। যাকে বলে যেন একেবারে কার্বন কপি। আমি বিস্মিত না হয়ে পারলাম না।
একেবারে আমার মনের কথাই বলছি। ছবি দুটোর মধ্যে সাদৃশ্যটুকু চাক্ষুষ করে আমার বুদ্ধিসুদ্ধি যেন কেমন ভোঁতা হয়ে গেল। কিন্তু সে ঘোর কেটে গেলে আমার স্পষ্টই মনে পড়ে গেল। আমি যখন পার্চমেন্ট কাগজটার গায়ে ঝি ঝি পোকার রেখাচিত্রটা আঁকি তখন তার গায়ে কোনো চিত্র তো দূরের কথা, একটা দাগও আঁকা ছিল না। হ্যাঁ, এ ব্যাপারে তিলমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই।
মড়ার মাথার খুলির চিত্রটা নিয়ে আমার এত মাথাব্যথা কেন, আর কেনই বা আমি এমন আগ্রহী হয়ে পড়েছি, তাই না? আমি ঝি ঝি পোকার রেখাচিত্রটা আকার সময় ময়লা কাগজটার গায়ে একটুখানি পরিষ্কার জায়গা খুঁজতে গিয়ে সেটা বার বার এদিক ওদিক উলটেপাল্টে দেখেছিলাম। মড়ার খুলির ছবিটা যদি তার গায়ে আঁকা থাকতই তবে তো আমার চোখে পড়তই পড়ত। এমন জটিল একটা রহস্যের কুলকিনারা আমি কিছুতেই করতে পারলাম না, কোনো ব্যাখ্যা করাই সম্ভব হলো না।
আমি যে মুহূর্তে যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুত সেখান থেকে উঠে পড়লাম। আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম, একেবারে একা না হতে পারলে রহস্যটা ভেদ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। হাতের পার্চমেন্ট কাগজটাকে নিরাপদ স্থানে রেখে দিয়ে আমি অস্থিরভাবে ঘরময় পায়চারি করতে লাগলাম।
নিদারুণ অস্থিরতার মধ্যে রাতটুকু কাটিয়ে দিলাম। ভোরের আলো ফুটলে আপনি নিজের বাড়ি যাবার জন্য পা বাড়ালেন। জুপিটার তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি বাঞ্ছিত সুযোগ পেয়ে গেলাম। এমন একটা সুযোগ আমি অবশ্যই হাতছাড়া করলাম না। পার্চমেন্ট কাগজটা নিয়েনিবিষ্ট মনে নতুন করে ভাবনায় মেতে গেলাম। গোড়াতেই ভাবলাম, পার্চমেন্ট কাগজটা কিভাবে আমার হাতে পড়েছিল।
দ্বীপটার মাইল খানেক পূবদিকে মুল ভূখঞ্জে সমুদ্রতীরের লাগোয়া একটা অঞ্চল থেকে আমরা ঝি ঝি পোকাটাকে পেয়েছিলাম। সেটাকে ধরার জন্য আমি আদাজল খেয়ে লেগে গেলাম। সেটাকে ধরার সময়ই আমার আঙুলে খুব জোরে কামড়ে দিয়েছিল। আকস্মিক যন্ত্রণা সইতে না পেরে আমি সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।
আমার বুড়ো ও অভিজাত নিগ্রো ভৃত্য জুপিটার খুবই সাবধানী প্রকৃতির। সে পোকাটাকে চেপে ধরার উপযোগ্য কোনো গাছের পাতা বা ক্রমশই কোনো একটা জিনিসের খোঁজে বারবার এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। ঠিক সে মুহূর্তেই তার ও আমার উভয়েরই চোখে পার্চমেন্ট কাগজের টুকরোটা ধরা পড়ল। আমরা তখন সেটাকে খুবই মামুলি একটা কাগজ ভেবেছিলাম।
পার্চমেন্ট কাগজটার অর্ধেক মাটিতে পোঁতা অবস্থায় ছিল। বাইরে থেকে একটা কোন্টা সমেত বাকি অর্ধেকটি দেখা যাচ্ছিল।
পার্চমেন্ট কাগজটা যেখানে ছিল তার কাছেই কোনো একটা জাহাজের সংবোট এর খোলের ভাঙা অংশবিশেষ পড়েছিল। প্রথম দর্শনেই আমার মনে হয়েছিল, দীর্ঘ দিন সেটা সেখানে পড়ে রয়েছে। কারণ, সেটাকে দেখে মনেই হচ্ছিল না যে, সেটা কোনো জাহাজের অংশ।
থাক, যে কথা বলছিলাম, জুপিটার পার্চমেন্ট কাগজটা তুলে সেটা দিয়ে ঝি ঝি পোকাটাকে মুড়ে হাতে তুলেনিল। তারপর সে হাতেই সেটাকে আমার হাতে দিল।
এবার আমরা বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। কিছুটা পথ পাড়ি দিতেই লেফটেন্যান্ট জি-র সঙ্গে আমাদের মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। তিনি পোকাটিকে আমার হাতে দেখে উৎসাহ প্রকাশ করলেন। তিনি সেটাকে দুর্গে, তার আবাসস্থলে নিয়ে যেতে চাইলেন।
আমি তার প্রস্তাবে আপত্তি করলাম না, বরং এক কথাতেই পোকাটাকে পার্চমেন্ট কাগজে মোড়া অবস্থাতেই তার ওয়েস্টকোটের পকেটে পুরে দিতে চাইলাম। তিনি মুচকি হেসে আমার হাতে থেকে নিয়ে পোকাটাকে কোটের পকেটে চালান দিয়ে দিলেন। আর পার্চমেন্ট কাগজটা আমারে ফিরিয়ে দিলেন। হয়তো বা ভালো-মন্দ কোনো চিন্তা না করেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি পার্চমেন্ট কাগজের টুকরোটা নিজের জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম।
লেফটেন্যান্ট জি এবার দুর্গের দিকে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটতে লাগলেন, আর আমরা বাড়ির পথ ধরলাম।
অনেকক্ষণ ধরে এক নাগাড়ে কথা বলে বন্ধুবর লিগ্র্যান্ড মুহূর্তের জন্য থেমে দম নিয়ে আবার বলতে লাগলেন–‘আশা করি আপনি অবশ্যই ভুলে যাননি, ঝি ঝি পোকাটার রেখাচিত্র আঁকার জন্য কাগজের খোঁজে আমি টেবিলটার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। হাতের কাছে কোনো কাগজ না পেয়ে দেরাজ খুলে ঘাটাঘাটি করলাম না। ব্যবহারোপযোগী কোনো এক চিলতে কাগজও পেলাম না। তাই নিতান্ত অন্যান্য পায় হয়েই যে কোনো একটা পুরনো চিঠির খোঁজে জ্যাকেটের পকেটে হাত চালিয়ে দিয়েছিলাম। পকেট হাতড়ে পার্চমেন্ট কাগজের চিলতেটাকে বের করে আনলাম।’– ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে তিনি এবার বললেন- ‘আমার মুখে এরকম কথা শুনে আপনি হয়তো আমাকে অস্বাভাবিক ভাবপ্রবণ বলেই ভাবছেন, ঠিক কি না? আসল ব্যাপার হচ্ছে, সে মুহূর্তেই আমি এসব ঘটনা পরম্পরার মধ্যে একটা যোগসূত্রের হদিস পেয়েছিলাম। নিজের মনে দুটো চিন্তা-শৃঙ্খলের দুটো বিশেষ অংশে পাশাপাশি জুড়ে দিলাম। ভাবলাম, সমুদ্রের ধারে একটা জাহাজের ভাঙা অংশকে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। আর তারই কাছাকাছি পেয়েছিলাম এক চিলতে পার্চমেন্ট কাগজ। মামুলি একটা কাগজের একটা টুকরো অবশ্যই নয়–পার্চমেন্ট কাগজ। আর তার গায়ে আঁকা ছিল একটা মড়ার খুলি।’
এবার মুখ তুলে সরাসরি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন–খুবই সঙ্গতকারণেই আপনি হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, এখানে আমি যোগসূত্রের গন্ধ কি করে পাচ্ছি, ঠিক কি না?
আপনার জিজ্ঞাসা দূর করতে আমি বলব, মড়ার মাথার খুলি জলদস্যুদের বহুল ব্যবহৃত একটা প্রতীক চিহ্ন। তাদের সব জাহাজের মাথাই ওড়ে মড়ার খুলি আঁকা পতাকা। হয়তো এ দৃশ্য আপনার চোখেও পড়ে থাকতে পারে।
আর একটা কথা আমি তো সবেই বলেছি, এক চিলতে পার্চমেন্ট কাগজ, মামুলি একটা কাগজ নয়। কার না জানা আছে যে, পার্চমেন্ট কাগজ দীর্ঘস্থায়ীই কেবল নয়, অক্ষয় বললেও অত্যুক্তি করা হবে না।
অতএব সহজেই অনুমান করা যেতে পারে, মামুলি কোনো কাজ করতে গিয়ে কেউ পার্চমেন্ট কাগজ ব্যবহার করে না। আরও আছে, ছবি আঁকা বা এরকম কোনো কাজে পার্চমেন্ট কাগজের চেয়ে সাধারণ কাগজ বেশি উপযোগি। এতে রঙ আর তুলিতে মনের মতো ছবি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়।
হ্যাঁ, এরকম চিন্তার ফলেই আমার মাথায় মড়ার খুলির ব্যাপারটা পানির মতোই পরিষ্কার হয়ে গেল। ব্যাপারটার পিছনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা লুকিয়ে থাকতে পারে চিন্তাটা আমার মাথায় পাকাপাকিভাবে চেপে গেল। অতএব তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আমি বলে উঠলাম–একটু আগেই আপনি আমাকে বললেন, ঝি ঝি পোকার রেখাচিত্রটা আঁকার সময় পার্চমেন্ট কাগজের গায়ে মড়ার খুলিটার চিহ্নও আপনার চোখে পড়েনি, ঠিক কি না?
লিগ্র্যান্ড সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন–‘অবশ্যই, অবশ্যই দেখতে পাইনি।’
তা-ই যদি সত্য হয় তবে মরার খুলি আর জাহাজটার মধ্যে আপনি যোগসূত্রটা পেলেন কোথায় জানতে পারি কি? আপনার বক্তব্য অনুযায়িই বলছি, মরার খুলিটা আঁকা হয়েছিল আপনার ঝি ঝি পোকাটার রেখাচিত্র আঁকার পর কোনো বা কোনো এক সময়ে। সেটা কে এবং কিভাবে এঁকেছিল তা একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন। ব্যাপারটা যদি একটু খোলসা করে–
আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন–‘আরে ভাই, আসল রহস্যটাতো এখানেই।
‘রহস্য? আসল রহস্য?’
‘হ্যাঁ, রহস্য তো বটেই? তবে এও সত্যি যে, যে রহস্যের কিনারা আমি সহজেই কবে ফেলতে পেরেছিলাম। আর এও বলে রাখছি, আমার চিন্তার ধাপগুলো ছিল সম্পূর্ণ সুনিশ্চিত। আর তাদের ঝাড়াই বাছাই করে একটা মাত্রই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। আমার চিন্তার ধারাটা ছিল এ রকম–আমি পার্চমেন্টে কাগজের চিলতেটার গায়ে ঝি ঝি পোকার রেখাচিত্র আকার সময় তখন তাতে মড়ার খুলির চিত্রটার নাম গন্ধও ছিল না।
আঁকার কাজ সেরেই আমি কাগজের চিলতেটাকে আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলাম, সত্যি কিনা?
‘হ্যাঁ, তা দিয়েছিলেন বটে।’
‘আর সেটাকে আমার হাতে ফিরিয়ে না দেওয়া অবধি আমি আপনার মুখের ওপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিলাম। অতএব আপনি যে মড়ার খুলির ছবিটা আঁকেননি। এ বিষয়ে আমার মনে তিলমাত্র সন্দেহের অবকাশ থাকার কথাই নয়।
‘হ্যাঁ, এ রকম দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়াই যেতে পারে।’
‘আর তখন সেখানে তৃতীয় ব্যক্তিও কেউ-ই ছিল না।
তবে নিঃসন্দেহ হওয়া যেতে পারে, কোনো মানুষ সেটা আঁকেনি। ঠিক বলেছি?
‘শতকরা একশো ভাগই সত্য।’
‘কিন্তু কাজটা যে করা হয়েছিল তা-ও তো অস্বীকার করা যায় না, ঠিক কি না?’
আমি নীরবে ঘাড় কাত করে তার বক্তব্যকে সমর্থন করলাম।
‘এবার আমি ভাবনা-চিন্তার এ জায়গাটায় পৌঁছে নীরবে আলোচ্য সময়ের প্রতিষ্ঠিত ঘটনাকে একের পর এক স্মৃতির পাতায় এনে জড়ো করতে চেষ্টা করতে শুরু করলাম। আমার প্রয়াস সার্থকও হয়েছিল। আমি ঠিকই স্মরণ করতে পারলাম। প্রথমেই আমার মনের কোনে উঁকি দিল, সে দিনের আবহাওয়া ছিল বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। আর চুল্লিটাতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল।
আমি চুল্লি থেকে দূরে, টেবিলে বসেছিলাম। কারণ, কঠোর পরিশ্রমের ফলে আমি এমনিতেই গরম বোধ করছিলাম। তাই চুল্লিটা থেকে দূরের টেবিলটায়ই বসেছিলাম।
আর আপনি চেয়ারটাকে টানাটানি করে চুল্লিটার কাছে নিয়ে গিয়ে গাট হয়ে বসলেন, মনে পড়ছে?
আমি ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে তুলে ঘাড় কাৎ করে তার বক্তব্য সমর্থন করলাম।
তিনি বলে চললেন–‘আমি পার্চমেন্ট কাগজটা আপনার হাতে তুলে দিলাম। আপনি সেটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। ঠিক সে মুহূর্তেই আমার প্রিয় কুকুর শিউফাউন্ড ল্যান্ড লেজ নাড়তে নাড়তে ঘরে ঢুকে এক লাফে বার-কয়েক আদর করে। ছোট্ট একটা ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন। আর তখনই আপনার ডান হাতটা, যে হাতে পার্চমেন্ট কাগজটা ধরা ছিল সেটা ঝুলে আগুনের কাছাকাছি চলে গেল। মনে হলো কাগজটার গায়ে বুঝি আগুন লেগে গেল।
ব্যাপারটা আমার নজরে পড়তেই আমি আপনাকে সতর্ক করে দিতে যাচ্ছিলাম।
কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে সে সম্বন্ধে আপনাকে সতর্ক করে দেবার আগেই আপনি নিজেই কাগজটা সমেত হাতটাকে তুলে নিলেন। পর মুহূর্তেই পার্চমেন্ট কাগজটাকে আবার মুখের সামনে ধরলেন।
আপনি আমার কথা কতখানি বিশ্বাস করবেন, জানি না। তবুও বলছি। সে ঘটনার মুহূর্তে আমি কিন্তু ভুলেও ভাবিনি, অর্থাৎ মুহূর্তের জন্য আমার মনে তিলমাত্র সন্দেহ জাগেনি, যে তাপশক্তিই কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ তাপশক্তির বলেই পার্চমেন্ট কাগজটার গায়ে মড়ার খুলির ছবিটা ধীরে ধীরে ফুটে উঠেছিল।
আমি স্থবিরের মতো নিশ্চল-নিথরভাবে রুদ্ধশ্বাসে বন্ধুর কথাগুলো শুনতে লাগলাম।
সে বলে চলল–‘আপনার তো ভালোই ধারণা আছে যে, ক্রমশ মিশ্রণের অস্তিত্ব আছে। বহু যুগ থেকেই আছে। কাগজ বা ভেলাসের গায়ে যা দিয়ে লেখা সম্ভব যা কেবলমাত্র আগুনের সংস্পর্শে নিলে স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে, চোখে দেখা সম্ভব। আবার যার গায়ে কিছু আঁকা হয় বা লেখা হয় তা ঠাণ্ডা হয়ে গেলেই অদৃশ হয়ে যায়। আবার যখনই তাপের সংস্পর্শে নেওয়া যাবে তা স্পষ্ট হয়ে পড়ে জানা নেই?
‘অবশ্যই অবশ্যই জানি।
‘ব্যস, এবার আমি সাধ্যমত যত্নসহকারে মড়ার খুলিটাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে মেতে গেলাম। পার্চমেন্ট কাগজটার কিনারার রেখাগুলো অন্যান্য রেখার তুলনায় অনেক, অনেক বেশি স্পষ্ট। কেন বলুন তো?
আমি ব্যাপারটা ধরতে না পেরে তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
আমার অসহায় অবস্থার কথা চিন্তা করে তিনিই আবার মুখ খুললেন ‘ব্যাপারটা হচ্ছে, রাসায়নিক পদার্থের ওপর তাপের ক্রিয়া সব জায়গায় সমানভাবে না পড়ার জন্যই এমনটা ঘটেছে–এটাই স্বাভাবিক। তখনই আগুন জ্বেলে পার্চমেন্টের সম্পূর্ণ জায়গায় সমানভাবে তাপ প্রয়োগ করলাম। ফলে সবার আগে মড়ার খুলিটার রেখাগুলো ক্রমে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠল। এবার বার বার কাগজটাকে আগুনের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ায় মড়ার খুলিটার বিপরীত কোণে ক্রমশ একটা মূর্তি
স্পষ্ট হয়ে উঠল যাকে প্রথমে একটা ছাগল ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারিনি। তবে দীর্ঘ সময় ধরে আরও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিঃসন্দেহ হলাম কোনো একটা কিড (kid)-এর জন্য এটা আঁকা হয়েছিল।
বন্ধুর কথায় আমার দারুণ হাসির উদ্রেক হল। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে সুমলে নিয়ে আমি বললাম–‘মি. লিগ্র্যান্ড আপনার কথায় আমার হাসার অধিকার নেই। এ তো আর মিথ্যে নয় যে, পনেরো কোটি টাকা তো আর হেসে উড়িয়ে দেবার ব্যাপার নয়। কিছু মনে করবেন না, কথাটা না বলে পারছি না।’
তিনি বিস্ময়-মাখানো জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে আমার মুখের দিকে তাকালেন।
আমি সাহসে ভর করে আচমকা বলে উঠলাম–‘আপনি এবার নির্ঘাৎ জলদস্যু আর ছাগলের মধ্যে একটা যোগসূত্রের কথা পেড়ে বসবেন। তবে আশা করি, আপনার অবশ্যই জানা আছে যে, জলদস্যু আর ছাগলের মধ্যে কোনো সম্পর্কই আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।’
‘আরে ভাই, আমি তা একটু আগেই আপনাকে বললাম, ওটা ছাগলের মূর্তি নয়।
‘তা যদি হয়ও ছাগল আর ছাগল ছানার মধ্যে কতটুকুই বা পার্থক্য? অনেকটা তো একই রকম।
‘অনেকটা একই রকম আর সম্পূর্ণ অভিন্ন তো আর এক কথা নয়–’
লিগ্র্যান্ড একটু বেশ গম্ভীর স্বরেই কথাটা ছুঁড়ে দিলেন। মুহূর্তের জন্য থেমে তিনিই আবার মুখ খুললেন–আশা করি কোনো এক ক্যাপ্টেন কিডের কথা আপনি শুনেছেন, কী বলেন?
আমি নীরবে ঘাড় কাৎ করে তার কথার জবাব দিলাম।
তিনি বলে চললেন–‘আমি কিন্তু, পার্চমেন্ট কাগজের মড়ার খুলির গায়ের জন্তুটাকে এক বিশেষ দ্ব্যর্থবোধক চিহ্ন বা কারো স্বাক্ষর বলেই মনে করলাম। আমার স্বাক্ষর বলার অর্থ এই যে, পার্চমেন্ট কাগজটার গায়ে তার অবস্থানই আমাকে এরকম ভাবতে উৎসাহিত করেছে। আর একই ধারণার বশবর্তী হয়ে একেবারে কোণাকুণি, বিপরীত দিকে অবস্থিত মড়ার খুলিটাকেও আমি কোনো একটা প্রতীক বা মোহর মনে করেছিলাম। তবে এও খুবই সত্য যে, আমার কল্পিত চিঠির অবশিষ্ট অংশটা পার্চমেন্ট কাগজটার ওপর অনুপস্থিত দেখে আমি মনের দিক থেকে খুবই ভেঙে পড়লাম।
আমি বন্ধুর কথার ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে বললাম–‘মনে হচ্ছে, স্বাক্ষর ও মোহরের মধ্যবর্তী অংশে একটা চিঠি দেখতে পাবেন বলেই আপনার বিশ্বাস ছিল, কী বলেন?
‘হ্যাঁ, প্রায় সে রকমই বটে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, বিরাট একটা সম্পত্তি লাভের প্রত্যাশা তখন আমার মন-প্রাণ জুড়ে ছিল। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে কিন্তু আমি সঠিক জবাব আপনাকে দিতে পারব না। কিন্তু ঝি ঝি পোকাটা যে নিরেট সোনার তা কী আপনার জানা আছে?
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বন্ধুর এ অর্থহীন কথাগুলো আমার কল্পনাকে দারুণ প্রভাবিত করেছিল। তা ছাড়াও একের পর এক কতগুলো আকস্মিক ঘটনা এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক–একে রীতিমত অসাধারণ ছাড়া আর কি-ই বা বলা যেতে পারে? এবার আমার দিকে তাকিয়ে একেবারে সরাসরিই কথাটা ছুঁড়ে দিল’-আর একটা ব্যাপার কি আপনার নজরে পড়েছে যে, এতগুলো ঘটনা একের পর এক যেদিন ঘটে গেল সেদিন ঠাণ্ডা এমনই জাঁকিয়ে পড়েছিল যে, চুল্লিতে আগুন না জ্বেলে ঘরে বসাই দায় হয়ে পড়েছিল? এবার ভেবে দেখুন তো চুল্লিটা জ্বালা না থাকলে আপনি চুল্লিটার কাছে না বসলে, আমার প্রিয় কুকুরটা ঘরে ঢুকে লাফিয়ে আপনার কাঁধে উঠে না পড়লে কি আপনি পার্চমেন্ট কাগজটাকে আগুনের কাছে নিয়ে যেতেন, বলুন? আর আপনি যদি তা না-ই নিতেই তবে মড়ার খুলির কথা আমার পক্ষে জানা সম্ভব হত না। আর অগাধ ধন সম্পদের অধিকারীও আমরা কিছুতেই হতে পারতাম না।’
‘মি. লিগ্র্যান্ড, চালিয়ে যান। চালিয়ে যান! আমার পক্ষে আর ধৈর্য ধরা সম্ভব হচ্ছে । যা বলার তাড়াতাড়ি বলে আমার উৎকণ্ঠা দূর করুন।
‘ঠিকআছে! আমি সাধ্যমত আপনার জিজ্ঞাসা দূর করার চেষ্টা করছি। ক্যাপ্টেন কিড আর তার সাগরেদরা আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলবর্তী কোনো এক স্থানে অপরিমিত ধন-সম্পদ মাটির তলায় লুকিয়ে রেখেছে–এরকম হাজার হাজার মুখরোচক গল্প আর গুজব অবশ্যই আপনার শোনা থাকবে, আমি বলব, এসব প্রচলিত গল্পের বাস্তব সত্যতা অবশ্যই ছিল আর আজও আছে। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক
কেন সে সব মাটির তলার ধন-সম্পদ–গুপ্তধন আজ অবধি অনাবিস্কৃতই রয়ে গেছে। আর যদি আবিষ্কৃত হয়েও থাকে তবে তার বিবরণ আজ অবধি পাওয়া যায়নি। সত্যি করে বলুন তো, সমুদ্র উপকূলবর্তী কোনো অঞ্চল থেকে গুপ্তধন আবিষ্কারের কোনো কাহিনী কী আপনার কানে কোনোদিন এসেছে?
আমি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম না। তবে অন্য কেউ শুনেছে কিনা জানা নেই, আমি অন্তত শুনিনি।
‘তবে এও সত্যি যে ক্যাপ্টেন কিডের ধন-সম্পত্তি অগাধ ছিল তা সবারই জানা আছে। তাই আমিও নিঃসন্দেহই ছিলাম সে তার অগাধ ঐশ্বর্য আজও মাটির তলায় রয়ে গেছে। আশা করি আপনি শুনে অবাক হবেন না যদি আমি বলি আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে একটা আশার সঞ্চার ঘটেছিল। মনে করতে পারেন, দৃঢ় আর প্রায় নিশ্চিত আশা।
‘আশা? কিন্তু কী সে আশা?’
‘আশাটা হচ্ছে, যে অদ্ভুত উপায় আর পরিস্থিতিতে পার্চমেন্ট কাগজটা, সে গুপ্তধনেরই খোলা-যাওয়া নথি–দলিল।
‘চমৎকার! তারপর? তারপর আপনি কোন পথ ধরলেন?’
‘তারপর? আগুনের তাপ অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়ে পার্চমেন্ট কাগজের চিতেটা যতটা সম্ভব তার কাছাকাছি নিয়ে গেলাম। হতাশই হতে হল। না, কিছুই চোখে পড়ল না, কাগজটাকে দু-একবার উলটেপাল্টে দেখে নিয়ে ভাবলাম, কাগজটার গায়ে ময়লার প্রলেপ পড়ায় এ ব্যাপারটা ঘটেছে।
আমার ধারনাটা সত্য হলেও হতে পারে ভেবে পার্চমেন্ট কাগজটাকে গরম পানিতে ধুয়ে ফেললাম। এবার একটা শুকনো তোয়ালে দিয়ে আলতোভাবে মুছে নিয়ে মড়ার খুলিটাকে নিচের দিকে রেখে সেটাকে একটা টিনের পাতের ওপর পেতে দিলাম। এবার সেটাকে জ্বলন্ত চুল্লিটার ওপর মিনিট কয়েকের জন্য রাখলাম।
অল্পক্ষণের মধ্যেই টিনের পাতটা গরম হয়ে গেলে সেটাকে চুল্লির ওপর থেকে নামিয়ে আনলাম।
ব্যস, কাগজটার দিকে আমার চোখ পড়তেই আমি বিকট চিৎকার করে, পাগলের মতো নাচতে শুরু করলাম।
‘এমন আকস্মিক উল্লাসের কারণ, জানতে পারি কী?
‘আমার উল্লাসের কারণ, পার্চমেন্ট কাগজটার গায়ে এমন কতগুলো বিন্দু স্পষ্ট হয়ে উঠল, সেগুলোকে সারিবদ্ধ কিছু সংখ্যক সংখ্যা বলেই মনে হল। পার্চমেন্ট কাগজটাকে আবার টিনের পাতটার ওপর ভালোভাবে পেতে আরও মিনিটখানেক অপেক্ষা করলাম। তারপর টিনের পাতটা থেকে তুলে চোখের সামনে ধরতেই পুরো চিত্রটা আমার চোখের সামনে ছবির মতো স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল। আপনি এ মুহূর্তে ঠিক যেমনটা দেখতে পাচ্ছেন।
বন্ধুবর লিগ্র্যান্ড পার্চমেন্ট কাগজটা আবার টিনের পাতটার ওপর রেখে উপযুক্ত সময় ধরে গরম করে নিয়ে আমার চোখের সামনে মেলে ধরল। তারপর সেটাকে আমার হাতেই তুলে দিল।
আমি কৌতূহল মিশ্রিত উৎসাহের সঙ্গে তার হাতে ধরে-রাখা কাগজটার ওপর চোখ বুলাতে লাগলাম। দেখলাম, মড়ার খুলি আর ছাগলের চিত্রটার মধ্যবর্তী অঞ্চলে লাল রঙবিশিষ্ট প্রায় আড়াই সারি সংখ্যা আর বিভিন্ন চিহ্নের সমন্বয়ে গঠিত একটা চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আমি কপালের চামড়ায় পরপর কয়েকটা চিন্তার রেখা এঁকে এবং জ দুটো কুঁচকে সংখ্যা ও চিহ্নগুলোর মর্মার্থ উদ্ধার করার ব্যর্থ প্রয়াস চালাতে লাগলাম। শেষপর্যন্ত হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে পার্চমেন্ট কাগজের টুকরোটা বন্ধু লিগ্র্যান্ডের হাতে ফিরিয়ে দিলাম।
কাগজটা তার হাতে তুলে দিয়ে ম্লান হেসে বললাম ‘কিন্তু বন্ধু, আমি তো যে তিমিরে ছিলাম সে তিমিরেই রয়ে গেলাম। একটা বর্ণও যে আমি উদ্ধার করতে পারলাম না।
সে নীরবে ছোট্ট করে হাসল।
আমি বললাম–‘বন্ধু, এ-ধাঁধাটার সমাধান করা সম্ভব হলে যদি সমগ্র বিশ্বের যাবতীয় ধন-রত্ন আমার হস্তগত হত তবুও তা অর্জন করা আমার পক্ষে সম্ভব হত না। এ-কথা আমি বেশ জোর দিয়েই বলতে পারি।
আমার বন্ধু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে বলল দেখুন, সংখ্যাগুলোকে মাত্র এক ঝলক দেখে নিয়ে আপনি যত অবোধ্য ভাবছেন, আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়। একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলে যে কারোর পক্ষেই ধারণা করে নেওয়া সম্ভব যে, এ সংখ্যাগুলো আসলে সাধারণ মানুষের পক্ষে অবোধ্য এক বিশেষ ধরনের সাংকেতিক চিহ্ন ছাড়া কিছু নয়। আমি বলতে চাচ্ছি, সংখ্যাগুলো একটা বিশেষ নির্দেশ করছে, বুঝেছেন?’
আমি সে মুহূর্তে এ কথার কি জবাব দেব ভেবে না পেয়ে নীরবে তার পরবর্তী বক্তব্য শোনার জন্য অধীর প্রতীক্ষায় রইলাম।
তিনি বলে চললেন–দেখুন ভাই, ক্যাপ্টেন কিড সম্বন্ধে যেটুকু শুনেছি, তিনি যে খুব কঠিন গাণিতিক ধাঁধা তৈরি করতে পারতেন বলে আমি অন্তত বিশ্বাস করি না। তাই আমি ছকটা দেখামাত্রই বুঝে নিলাম, ধাঁধাটা খুবই সহজ-সরল। তবে এও স্বীকার করতেই হবে, একজন ভোতা বুদ্ধি নাবিকের পক্ষে এমন একটা ধাঁধার সমাধানের সূত্রটা একেবারেই অজানা থাকলে অর্থ বের করা সম্ভব নয়–একেবারেই নয়।
একটা কথা, আপনি কী সত্যি সত্যি ধাঁধাটার সমাধান করেছিলেন মি. লিগ্র্যান্ড?
‘আরে ভাই, মুহূর্তের মধ্যেই।
আমি স্ববিস্ময়ে বললাম–‘মুহূর্তের মধ্যেই!
‘অবশ্যই। সত্যি কথা বলতে কি, এর চেয়ে দশ হাজার গুণ শক্ত ধাঁধার সমাধান আমি ইতিপূর্বে বহুবারই করেছি। একটা কথা তো আর অস্বীকার করার নয় যে, মানুষের যে-মাথা ধাঁধার জন্মদাতা, সেই মানুষই সঠিক পথে ধৈর্যের সঙ্গে অগ্রসর হলে তার সমাধান অনায়াসেই করা সম্ভব। আসল কথা হচ্ছে, সঠিক পথটা খুঁজে বের করা।’
‘কিন্তু সঠিক পথটাই তো ধরা’
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে লিগ্র্যান্ড বলে উঠলেন–‘এবার এ ধাঁধাটার ব্যাপারে, প্রকৃতপক্ষে যাবতীয় সাংকেতিক চিহ্নের ব্যাপারেই সাংকেতিক চিহ্নটার সমাধানের উপায়টা স্থির করাই প্রথম ও প্রধান বাধা। আমাদের আলোচ্য ধাঁধাটার যত কিছু বাধা সবই ওই স্বাক্ষরটাই সমাধান করে দিয়েছে। আর এর কিড শব্দটার মধ্যে যে দু-দুটো অর্থ লুকিয়ে রয়েছে, কেবলমাত্র ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় বুঝে অর্থ নির্ণয় করা সম্ভব হত না। আমি যদি গোড়াতেই এ শব্দটার অর্থ উদ্ধার করতে না পারতাম তবে আমাকে হয়তো ফরাসি বা স্পেনীয় ভাষাই হাতড়ে বেড়াতে হত।
‘এত ভাষা থাকতে ফরাসি আর স্পেনীয় ভাষার কথা বলার কারণ কি, জানতে পারি কী?
‘কারণ অবশ্যই আছে, আমার বন্ধু ছোট্ট করে হেসে বললেন–কারণটা কি বলছি, স্পেনীয় জলদস্যুদের পক্ষে এরকম সাংকেতিক চিহ্ন ওই দুটো ভাষার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি, তবে এ ব্যাপারে আমি অবশ্য ইংরেজি ভাষাটাকেই অবলম্বন করেছিলাম।
আমি দীর্ঘ সময় ধরে ধাঁধাটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে যে অর্থ উদ্ধার করলাম তা হচ্ছে–‘অপদেবতার আমলের বিশপের হোস্টেলের ভালো কাঁচ এক টুকরো। একচল্লিশ ডিগ্রি ত্রিশ মিনিট উত্তর-পূর্ব আর উত্তর প্রধান ডালের সপ্তম ডালের পূর্ব দিকে, মড়ার মাথার খুলির বাঁ চোখ থেকে গুলি চালিয়ে দাও। গাছটা থেকে মৌমাছির রেখার পঞ্চাশ ফুট দূরে।’
আমি ব্যাপারটা সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নিতে না পারায় চোখে-মুখে হতাশার ছাপ এঁকে তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে নীরবে তাকিয়ে রইলাম।
আমার অসহায় অবস্থার কথা বুঝতে পেরে বন্ধু লিগ্র্যান্ড আবার বলতে লাগলেন–‘আমিও দিন-কয়েক আপনার মতো হতাশায়, তিমিরেই ডুবেছিলাম। এবার আমার কাজ হলো সুলিভান দ্বীপের ধারে-কাছে ‘বিশপের হোস্টেল’ নামক কোনো বাসস্থান আছে কিনা খুঁজে বের করা। তবে ‘হোস্টেল’ শব্দটার প্রচলিত অর্থটাকে মন থেকে মুছে ফেললাম।
এক সকালে অন্যমনস্কভাবে পায়চারি করতে করতে একেবারেই আচমকা আমার মনে পড়ে গেল, দ্বীপটার উত্তর প্রান্তে, প্রায় চার মাইল দূরবর্তী অঞ্চলে ‘বেসপ নামধারী এক পুরনো পরিবারের একটা পুরনো জমিদার বাড়ির মালিক তো আছে। তার সঙ্গে হোস্টেল শব্দটা জুড়ে দেওয়ায় ‘বিশপের হোস্টেল’ কথাটার উদ্ভব হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক নয়।
ব্যস, আমিনিগ্রোদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে এক বৃদ্ধার সামনে হাজির হলাম। তিনি বললেনড়বাছা, ‘বেসপ খ ক্যাসল’ নামক একটা জায়গার কথা আমি শুনেছি। তুমি যদি চাও আমি তোমাকে সঙ্গে করে সেখানে নিয়েও যেতে পারি।’
‘বুড়িমা, তুমিই আমাকে নিয়ে যাবে?
‘বললাম তো, তুমি চাইলেই নিয়ে যাব। কিন্তু বাছা, সেটা কিন্তু আসলে কোনো প্রাসাদ বা দুর্গ কোনোটাই নয়।
‘তবে?’
‘একটা উঁচু পাহাড়ের নাম ‘বসপ-খ ক্যাস।
সে তো নিজে থাকতেই আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েই রয়েছে, তার ওপর তার সময় নষ্ট ও পরিশ্রমের মজুরি স্বরূপ কিছু অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতেই সে আমাকে নিয়ে বাঞ্ছিত পর্বতটার উদ্দেশে হাঁটা জুড়ল।
আমি তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম।
জায়গাটায় পৌঁছাতে আমাকে বেশি পরিশ্রম করতে হলো না। কাছাকাছি পৌঁছে বাঞ্ছিত জায়গাটার হদিস পেয়ে আমি বুড়িটার হাতে কিছু গুঁজে দিয়ে তাকে বিদায় করে দিলাম।
আমি লম্বা-লম্বা পায়ে এগিয়ে এমন একটা জায়গায় হাজির হলাম যেখানে ছোট বড় কয়েকটা পাহাড় ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না।
আমি টুকরো-টুকরো অনেক কথা ভাবতে ভাবতে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার ওপরে উঠে গেলাম। কিন্তু এবার আমার কর্তব্য কি হঠাৎ করে স্থির করে উঠতে পারলাম না।
পর মুহূর্তে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়েই চারদিকে চোখের মণি দুটোকে বুলিয়ে নিতে নিতে হঠাই আমার চোখে পড়ে গেল পাহাড়ের গায়েরই একটা তাকের দিকে।
আমি মুহূর্তমাত্র দেরি না করে হন্তদন্ত হয়ে পাহাড়টার পূর্বদিককার সে তাকটার কাছে হাজির হলাম।
দেখলাম, তাকটা বাইরের দিকে প্রায় আঠারো ইঞ্চি বেরিয়ে রয়েছে। এক ফুটের বেশি প্রস্থ নয়। আর তার ঠিক ওপরে পাহাড়েরগায়ে একটা কুলুঙ্গি থাকায় সেখানে অবিকল আমাদের পূর্বসূরীদের ব্যবহৃত পিঠওয়ালা চেয়ারের মতো দেখতে।
চেয়ার-আসন! চেয়ারটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই আমি ভাবতে লাগলাম, পাণ্ডুলিপিটায় যে ‘অপদেবতার আসন’-এর উল্লেখ রয়েছে, এ-চেয়ারটাই তার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ব্যস, আসনের রহস্যটাও আমি উদ্ধার করে ফেললাম। এবার আমার নজর পড়ল ভালো কাঁচ কথাটার দিকে। ভাবলাম, ‘ভালো কাঁচ’ বলতেনির্ঘাৎ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের কথাই বলা হয়েছে। আমি জানি, অন্য কোনো অর্থ বোঝাতে জাহাজের নাবিকরা কাঁচ শব্দটা ব্যবহার করে না।
আমি যখন ‘কাঁচ’ আর দূরবীক্ষণ যন্ত্রের কথা ভাবছি ঠিক তখনই নজরে পড়ল বিশেষ পদ্ধতিতে একটা বড়-সড় একটা দূরবীক্ষণ যন্ত্রকে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
আর আমি নির্দিধায় বিশ্বাস করে নিলাম, দূরবীক্ষণ যন্ত্রটাকে বসাবার দিক নির্দেশ করার জন্যই একচল্লিশ ডিগ্রি ও ত্রিশ মিনিট আর উত্তর ও উত্তরপূর্ব কথাগুলো বলা হয়েছে।
এবার এসব আবিষ্কারের ফলে আমি দ্রুত বাড়ি ফিরে গেলাম। তখন আমার সবচেয়ে বড় কাজ একটা দূরবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে পাহাড়ের ওপর হাজির হওয়া। করলামও তা-ই।
তারপর আমি পাহাড়ের ওই তাকটার ওপর নেমে গেলাম। নামার পর বুঝতে পারলাম, বিশেষ একটা কায়দায় ছাড়া সেখানে কিছুতেই বসা সম্ভব নয়। আমার অনুমান অনুযায়ীই প্রকৃত ব্যাপারটা মিলে গেল।
আমার এবারের কাজ দূরবীক্ষণ যন্ত্রটাকে নির্দেশ অনুযায়ী স্থাপন করা। ‘একচল্লিশ ডিগ্রি আর ত্রিশ মিনিট কথা দুটোর কথা ভেবে দেখলামনির্ঘাৎ দিকচক্ররেখা থেকে উচ্চতার পরিমাপের কথাই নির্দেশ করেছে। এ ছাড়া অন্য কোনো কিছু তো নয়। যদি উত্তর-পূর্ব কথাটার কথা বিবেচনা করা হয় তবে দেখা যাবে, দিকচক্রের কথাই স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। অবশ্যই, এ ছাড়া অন্য কিছু তো ভাবাই যায় না।
ব্যস, আর এক মুহূর্তও দেরি না করে জ্যাকেটের পকেট থেকে কম্পাস যন্ত্রটা বের করে নিলাম। সেটার সাহায্যে বাঞ্ছিত উত্তর-পূর্ব দিকটানির্ণয় করে ফেললাম।
দিক নির্ণয়ের কাজ তো হল। এবারের শব্দ দূরবীক্ষণ যন্ত্রটাকে একচল্লিশ ডিগ্রি কোণের উচ্চতায় ধরে সতর্কতার সঙ্গে পর্যায়ক্রমে ওঠা-নামা করাতে লাগলাম।
এভাবে দূরবীক্ষণের মুখটাকে বারবার ওঠা-নামা করাতে করাতে গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে একটা বেশ বড়সড় ফাঁকা জায়গা নজরে পড়ল। আর সেটার দিকে গভীর আগ্রহে অনুসন্ধিৎসু নজরে তাকিয়ে থাকার পর একটা সাদা দাগের দিকে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। গোড়ার দিকে ব্যাপারটা মোটেই আমার মাথায় ঢুকল না।
সত্যি ওই সাদা দাগটাকে নিয়ে আমি রীতিমত ধন্দে পড়ে গেলাম। এবার মুশকিল আসানের জন্য দূরবীক্ষণ যন্ত্রের ফোকাসটাকে যথাসাধ্য ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ করলাম। তারপর আবার যন্ত্রটায় চোখ লাগিয়েই চমকে উঠলাম। আপন মনেই বলে উঠলাম, এ কী! এ একটা মাথার খুলি!’ নিঃসন্দেহ হবার জন্য আবারও সে দিকে তাকালাম। দেখলাম, সত্যি মাথার খুলিই বটে।
এতখানি এগিয়ে, এতকিছু আবিষ্কার করার পর আমি তা মোটামুটি নিঃসন্দেহই হয়ে পড়লাম, ধাঁধাটার সমাধান হয়েই গেল। কারণ, প্রধান শাখা থেকে সপ্তম প্রশাখা আর পূর্বদিকে’ বলা একমাত্র গাছটার ওপর মড়ার খুলিটা যেখানে রয়েছে সে জায়গাটা নির্দেশ করা। হতে পারে। এবার রইল ‘মড়ার খুলির বাঁ চোখ থেকে গুলি করার ব্যাপারটা, ঠিক কিনা?
আমি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম—
‘হ্যাঁ।’
‘নির্দেশ আছে মড়ার খুলির বাঁ চোখ থেকে গুলি কর’। সবগুলো কথা এক সঙ্গে জড়ো করলে খোঁজ খবর সম্বন্ধে একটা মাত্র অর্থই বেরিয়ে আসে।
সবকিছু বিচার-বিবেচনা করার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, মড়ার খুলির বাঁ চোখের কোটরের ভেতর দিয়ে একটা বন্দুকের গুলিকে গলিয়ে গলিয়ে মাটিতে ফেলে দিতে হবে। সেটা গাছটার গোড়া থেকে যত দূরে, যেখানে পড়বে সে পর্যন্ত একটা সরল রেখা টানলে এবং সেটাকে পঞ্চাশ ফুট পর্যন্ত বাড়িয়ে দিলে বিন্দুর উদ্ভব হবে সেটাই বাঞ্ছিত স্থান যার তলায় গুপ্তধন পোঁতা রয়েছে।
আমি সবিস্ময়ে বলে উঠলাম–আরে বাবা! তোমার উদ্ভাবনী শক্তির প্রশংসা না করে পারছি না বন্ধু।
সে চুরুটটার শেষাংশ লম্বা একটা টান দিয়ে সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে দিতে বলল–‘আগেই তো বলেছি, গোড়ার দিকে ধাঁধাটা নিয়ে আমি খুবই সমস্যায় পড়েছিলাম। পরে কাজে নামার পর একটা একটা করে গিঁট খুলতে গিয়ে দেখলাম, এটাকে যতটা কঠিন ভেবেছিলাম আসলে তা নয়।’
আমি চোখে-মুখে বিস্ময়ের ছাপটুকু অব্যাহত রেখেই বললাম–সবই আমার কাছে খোলসা হয়ে গেল। পুরো ব্যাপারটা কৌশলের জালে জড়িয়ে রাখা হলেও প্রকৃতপক্ষে কিন্তু খুবই সহজ-সরল। একটু ধৈর্যের সঙ্গে, বুদ্ধি খরচ করে রহস্যটার সমাধান করার চেষ্টা করলে কাজ হাসিল হবেই হবে। আর একটা কথা, আপনি তো বিশপের হোস্টেল ছেড়ে গেলেন। তারপর।
একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি, বিশপের হস্টেলে আমি একা যাইনি। সঙ্গি হিসেবে নিগ্রো ভৃত্য জুপিটার ছিল। আসলে তখন সে আমাকে একা কোথাও যেতে দিত না।
কিন্তু পরদিন সূর্য ওঠার মুখে মুখে আমি তাকে কিছু না বলে লুকিয়ে পাহাড়টার উপরে চলে যাই। দীর্ঘ সময় ধরে, বহু কষ্ট স্বীকার করে হণ্যে হয়ে খোঁজাখুঁজির পর বাঞ্ছিত গ্রন্থটাকে খুঁজে বের করতে পারলাম।
কাজ হাসিল করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। আমাকে দেখেই জুপিটার তো রেগে একেবার অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। এমনকি একটা লাঠি নিয়ে তেড়ে এলো। মারবে বলে রীতিমত শাসাল। হয়তো মেরেই বসত। কিন্তু আমি মুখ কাচুমাচু করে এমন অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম যা দেখে সে মাথার ওপর থেকে লাঠিটাকে নামিয়ে না নিয়ে পারল না। যা কোনো রকমের সে যাত্রায় বেঁচে গেলাম।
মুহূর্তের জন্য থেমে তিনি এবার বললেন–‘যাক গে, অভিযানের যা-কিছু কথা তো আপনিও জানেন।
‘হ্যাঁ তা জানি বটে। তারপর আমি না বলে পারছি না, আপনার বাগ্মিতা আর ওই ঝি ঝি পোকাটাকে নিয়ে যা-কিছু করেছেন তা কি অদ্ভুত নয়। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমরা; বিশেষ করি আমি তো রীতিমত নিঃসন্দেহই হয়ে পড়েছিলাম, আপনার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। একটা কথা জানার জন্য আমি উৎকণ্ঠা বোধ করছি মি. লিগ্র্যান্ড আপনি কি অনুগ্রহ করে
তিনি মুচকি হেসে বললেন–এত ভনিতার কি আছে, বুঝছি না তো? কি আপনার জিজ্ঞাস্য নির্দিধায় বলতে পারেন?
‘মড়ার খুলির চোখের কোটরের ভেতর দিয়ে বন্দুকের গুলির পরিবর্তে ঝি ঝি পোকাটাকে মাটিতে ফেলার জন্য আপনার এত জোরাজুরি করার কারণ কী ছিল? সেটাকে নাচালেনই বা কেন? ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই আমার নজর এড়ায়নি যে, আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধে আপনি এত বেশি সন্দেহ করতে লাগলেন যা দেখে আমি ভেতরে ভেতরে খুবই অসন্তুষ্ট হয়ে পড়লাম। আর এরই জন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, সম্পূর্ণ ব্যাপারটাকে সাধ্যাতীত রহস্যমণ্ডিত করে তুলে, আপনাকে গভীর উৎকণ্ঠার মধ্যে ফেলে আপনাকে একটু শাস্তি দেব। আর একই কারণে, কিছুমাত্র প্রয়োজন ছাড়াই আমি ঝি ঝি পোকাটাকে দীর্ঘ সময় ধরে নাচিয়েছিলাম। আর একই কারণে সেটাকেই মড়ার খুলির চোখের কোটরের ভেতর দিয়ে মাটি ফেলার ব্যবস্থা করেছিলাম। আশা করি এবার আপনার জিজ্ঞাসা দূর করতে পেরেছি।’
‘হ্যাঁ। তবে পুরোপুরি নয়, আংশিক।’
‘আংশিক। আপনি আর কী জানতে চাইছেন?
‘ওই নরকঙ্কালটার ব্যাপারে আমার একটা জিজ্ঞাস্য আছে।
তিনি হেসে বললেন ‘হ্যাঁ, নরকঙ্কালটার ব্যাপারে আমি কোনোই আলোকপাত করিনি বটে। ভালো কথা, ওটার ব্যাপারে কী জানতে চাইছেন, বলুন?
‘ওখানে, মাটির তলায় নরকঙ্কাল কী করে এলো?’
‘দেখুন, এটা যেমন আপনার কাছে রহস্যজনক মনে হচ্ছে, আমার কাছেও ঠিক তাই। আসলে এর উত্তর আপনার মতো আমারও জানা নেই। তবে চিন্তা-ভাবনা করে এরও একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো সম্ভব। কিন্তু ব্যাপারটা এমনই নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক যে, বিশ্বাস করা বড়ই কঠিন। একটা কথা তো অবশ্যই স্বীকার্য যে, ক্যাপ্টেন কিড একদম একা এত বড় একটা কাজ করেননি। এক বা একাধিক সহযোগি অবশ্যই তার ছিল, ভুল বলছি?
‘না। এত বড় একটা কর্মযজ্ঞ একজনের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।’
‘তাই যদি সত্যি আর গুপ্তধন যদি কিডের নেতৃত্বেই ওখানে মাটির তলায় লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়ে থাকে। যাক গে, যে কথা বলছিলাম, ধন রত্ন মাটির তলায় লুকিয়ে রাখার পর তার মাথায় হয়তো মতলব এসেছিল এ-কাজের যারা সাক্ষী তাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে না ফেললে ভবিষ্যতে প্রবঞ্চিত হতে হবে। তখন চোখের পানি ফেলে বুড়ো আঙুল চোষা ছাড়া কোনো উপায়ই থাকবে না। তাই সহযোগিদের হত্যা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর তা অতিসহজেই এবংনির্বিঘ্নেই সম্পন্ন করে ফেলা যেতে পারে। এরকম চিন্তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য কোদালের একটা ঘা-ই যথেষ্ট। তিনি কার্যত তা-ই করেছিলেন কি না তা-ই বা কে জানে। আবার দশ-বারোটা আঘাতও লেগে যাওয়াও অসম্ভব নয়।