অধ্যায় সাত
শাওয়ার পর্দার আড়াল দিয়ে খুব ক্ষীর্ণ একটা আলো আসছিল। সম্ভবত আমাদের রুমের আলোর রশ্মিই ছিল ওটা। ঐ আলোতেই দেখলাম অ্যাকলি বিছানায় শুয়ে আছে। খুব ভালো করেই জানতাম যে সে জেগে আছে। তবুও জিজ্ঞেস করলাম, ‘অ্যাকলি? জেগে আছো?’
‘হ্যাঁ।’
রুমটায় অনেক অন্ধকার ছিল। হাঁটতে গিয়ে মেঝেতে কারো জুতায় হোঁচট খেয়ে প্রায়ই পড়তেই বসেছিলাম। অ্যাকলি তখন বিছানায়া আধশোয়া অবস্থায় উঠে বসেছে। তার মুখে সাদা সাদা কী যেন লাগানো ছিল। সম্ভবত ব্রণের কোনো ওষুধ হবে। অন্ধকারে তাকে দেখতে অনেকটাই ভূতের মতো লাগছিল। ‘কী করছো তুমি?’ বললাম।
‘আমি কী করছি মানে? ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। এরপরই তো তোমরা চেঁচামেচি শুরু করলে। কী নিয়ে তর্ক করছিলে?’
‘লাইটের সুইচটা কই?’ পুরো দেওয়াল হাতড়েও লাইটের সুইচটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
‘লাইট দিয়ে কী করবে? …সুইচটা তোমার হাতের পাশেই।’
শেষমেশ সুইচটা খুঁজে লাইট জ্বালালাম আমি। লাইট জ্বলতেই দেখি অ্যাকলি তার চোখ হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে।
‘খোদা!’ বলল ও। ‘তোমার হয়েছেটা কী?’ মুখের রক্ত দেখে বলল ও।
‘স্ট্র্যাডলেটারের সাথে একটু ঝামেলা হয়েছে,’ বলে মেঝেতে বসলাম আমি। তাদের রুমে কোনো চেয়ার ছিল না। তারা আসলে তাদের চেয়ারগুলোর কী করেছে সেটায় সবসময়ই কৌতুহল ছিল আমার। ‘শুনো,’ আমি বললাম। ‘তাস খেলার মুড আছে তোমার?’ সে আবার তাসের ভক্ত ছিল।
‘তোমার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। আগে ওটার কিছু একটা করো।’
‘রক্ত এমনিই থেমে যাবে। তাস খেলার কি ইচ্ছা আছে তোমার?’
‘তাস, ওহ খোদা! তুমি কি জানো এখন রাত কয়টা বাজে?’
‘রাত তো খুব বেশি হয়নি। এগারো-সাড়ে এগারোটার মতো বাজে মাত্র।’
‘এটা মাত্র!’ অ্যাকলি বলে উঠলো। ‘শোনো, আমাকে কিন্তু সকালে ঘুম থেকে ওঠে আশ্রমে যেতে হবে। ঘুমাচ্ছিলাম আর তখনই তোমরা দুজনে চিৎকার-চেঁচামেচি… যাই হোক, ঝামেলা হয়েছে কী নিয়ে?’
‘অনেক কথা! ওসব বলে তোমাকে বিরক্ত করার কোনো ইচ্ছা নেই, অ্যাকলি। তোমার কাজে বাঁধা দিতে চাই না।’ বললাম তাকে। তার সাথে আমি কখনোই আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো আলোচনা করতাম না। অ্যাকলি স্ট্র্যাডলেটারের থেকেও বেশি স্টুপিড ছিল। তার সাথে তুলনা করলে স্ট্র্যাডলেটার জিনিয়াস লেভেলের বলা যায়। ‘আচ্ছা, আজ রাতে আমি অ্যালি’র বিছানায় ঘুমালে কি কোনো অসুবিধা হবে? সে তো কাল রাতের আগে আর ফিরছে না?’ আমি খুব ভালো করেই জানতাম অ্যালি ঐ রাতে আর ফিরবে না। অ্যালি প্রতি উইক-এন্ডেই বাসায় চলে যেতো।
‘আমি ঠিক জানি না সে কখন ফিরে আসবে,’ অ্যাকলি বলল।
খোদা, মানুষ কতটা বিরক্তিকর হতে পারে। ‘তুমি জানো না মানে? সে তো কখনোই রবিবার রাতের আগে ফিরে আসে না।’
‘না, তবে আমি তো কাউকে চাইলেই বলতে পারি না যে সে অ্যালির বিছানায় ঘুমাতে পারবে।’
উফফ, বিরক্তিকর। বসা থেকে একটু ওঠে তার কাঁধে আলতো একটা চাপড় দিলাম। বললাম, ‘তুমি খুব ভালো ছেলে, অ্যাকলি কিড। তুমি জানো এটা?’
‘না, আমার কথার অর্থ—আমি তো কাউকে এটা বলতে পারবো না…’
‘তুমি আসলেই খুব ভালো একটা ছেলে। তুমি একজন ভদ্রলোক এবং বিদ্বান,’ আমি বললাম। সে আসলেই ওরকম ছিল। ‘তোমার কাছে তো কোনো সিগারেট নেই, না?’
‘না, নেই। আর… তোমরা ঝগড়া করছিলে নিয়ে আসলে?’
জবাবে কিছু বললাম না। মেঝে থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে জানালার দিকে গেলাম। হঠাৎই কেমন যেন কী একাকীত্ব বোধ করছিলাম। আমার আসলেই তখন মরে যেতে ইচ্ছা করছিল।
‘কী নিয়ে ঝগড়া করছিলে তোমরা?’ বলতে গেলে প্রায় পঞ্চাশতম বারের মতো জিজ্ঞেস করল অ্যাকলি। সে আসলেই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক আগ্রহী ছিল।
‘তোমাকে নিয়ে,’ বললাম।
‘আমাকে নিয়ে? আসলেই?’
‘হ্যাঁ। তোমাকে ডিফেন্ড করছিলাম। স্ট্র্যাডলেটার বলেছে তোমার ব্যক্তিত্ব নাকি খুবই ফালতু। আমি তো নিশ্চয় তাকে এরকম কিছু বলার পর ছেড়ে দিতে পারি না।’
কথাটা শুনে খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠলো অ্যাকলি। ‘সে আসলেই এটা বলেছে? মজা করছো না তো? সত্যিই?’
তখন বললাম আমি শুধু মজা করছি। বলে এগিয়ে গেলাম অ্যালির বিছানার দিকে। খুবই বাজে অনুভূতি হচ্ছিল আমার তখন। নিজেকে প্রচণ্ড একা মনে হচ্ছিল।
‘রুমটায় প্রচুর দুর্গন্ধ,’ বললাম। ‘এতো দূর থেকে ঠিকই তোমার মোজার বাজে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তুমি কি ওগুলো কখনো লন্ড্রিতে দাও না?
‘তোমার যদি এটা পছন্দ না হয়, তাহলে তোমার হাতে কী অপশন আছে তা তুমি জানো,’ অ্যাকলি বলল। খুব চটজলদি উত্তর দিতে পারতো ছেলেটা। ‘যাইহোক, লাইটটা কি এখন একটু নিভিয়ে দিতে পারবে?’
যদিও সাথে সাথেই লাইটটা নিভালাম না আমি। কোনো জবাব না দিয়ে অ্যালির বিছানায় শুয়ে থাকলাম। শুয়ে ভাবছিলাম জেনের কথা। মোটকা এড ব্যাঙ্কির গাড়িতে তার আর স্ট্র্যাডলেটারের কথাটা ভাবতেই আবারো মাথায় রাগ চড়ে গেল। যতবারই এই কথাটা মাথায় আসছিল, ততবারই ইচ্ছা করছিল জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে। ব্যাপারটা হলো, স্ট্র্যাডলেটারকে আমি খুব ভালোভাবে চিনতাম। পেন্সিতে বেশির ভাগ ছেলেরাই সবসময় মেয়েদের সাথে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারটা আলাপ করত। এই যেমন অ্যাকলি। তার আগ্রহও ছিল এসব বিষয়ে আলাপ করা নিয়েই। তবে স্ট্র্যাডলেটার শুধু কথা বলাতেই আটকে থাকত না, সে আসলেই যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হতো। তার সাথে গভীর ভালোবাসায় ডুবেছে এমন দুইজন মেয়ের সাথে আমার পরিচয়ও ছিল। এটাই সত্য। এইজন্যই জেনের সাথে তার গাড়িতে ডেটের কথাটা ভাবলেই আমার রাগ উঠছিল শুধু।
‘তোমার ঘটনাবহুল জীবনের কাহিনি বলো আমাকে, অ্যাকলি কিড,’ আমি বললাম।
‘লাইটটা নেভাতে কি সমস্যা তোমার? আমার তো সকালে ঘুম থেকে উঠে আশ্রমে যেতে হবে।’
বিছানা থেকে লাইটটা নিভালাম। এটাই যদি তাকে খুশি করতে পারে, তাহলে তাই করা উচিৎ আমার। তারপর আবারো গিয়ে শুয়ে পড়লাম অ্যালির বিছানায়।
‘অ্যালির বিছানায় কী করবে… ঘুমাবে?’ অ্যাকলি জিজ্ঞেস করল। খোদা, সে ছিল একদম পারফেক্ট অতিথিসেবক।
‘ঘুমাতেও পারি। নাও পারি। ওটা নিয়ে তোমার দুঃশ্চিন্তা করতে হবে না।’
‘আমি দুঃশ্চিন্তা করছি না। শুধু ভাবছি অ্যালি যদি ফিরে এসে দেখে তার বিছানায় কেউ একজন ঘুমাচ্ছে, তাহলে কিন্তু আমি…’
‘রিল্যাক্স! আমি এখানে ঘুমাবো না। তোমার অতিথিপরায়ণতার অপব্যবহার করবো না।’
কয়েকমিনিট পর গভীরভাবে নাক ডাকতে শুরু করল অ্যাকলি। আর আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম অন্ধকারের দিকে। চেষ্টা করছিলাম এড ব্যাঙ্কির গাড়িতে জেন আর স্ট্র্যাডলেটারের ডেটের ব্যাপারটা চিন্তা না করার। কিন্তু কাজটা খুবই অসম্ভব ছিল। সমস্যা হলো, আমি স্ট্র্যাডলেটারের কৌশলগুলো জানতাম। এটাই ভাবনাটাকে আরো খারাপ বানিয়ে দিচ্ছিল। তার সাথে এড ব্যাঙ্কির গাড়িতে একবার ডাবল-ডেটে গিয়েছিলাম আমি। স্ট্র্যাডলেটার তার ডেটকে নিয়ে পিছনের সিটে বসেছিল আর আমি আমার ডেটকে নিয়ে সামনের সিটে ছিলাম। ঐদিন তার কৌশলটা দেখেছি। ঐদিন সে প্রথমে তার ডেটের সাথে খুবই মোলায়েম, আন্তরিক গলায় কথা বলা শুরু করেছিল। মোলায়েম গলায় মেয়েটির প্রশংসা করছিল শুধু। মানে তার ভাবটা এমন ছিল যে সে শুধু সুদর্শন ছেলেই না, প্রচণ্ড আন্তরিক ও খাঁটি মনের মানুষও। তার কথা শুনতে শুনতে ঐদিন প্রায় বমিই করে দিতে নিয়েছিলাম। তার ডেট তখন শুধু বলছিল, ‘না, প্লিজ। প্লিজ, না। প্লিজ।’ তারপরও স্ট্র্যাডলেটার সেদিন আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো মোলায়েম গলায় তেল মেরে যাচ্ছিল। শেষে একসময় গাড়িতে শুধু অস্বস্তিকর নীরবতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ব্যাপারটা খুব লজ্জাজনক ছিল। আমার মনে হয় না ঐ রাতে সে মেয়েটাকে সেরা সময় দিতে পেরেছিল—তবে অনেক কাছে পৌঁছে গিয়েছিল ও। অনেক কাছে।
শুয়ে শুয়ে জেনের সাথে ডেটের ব্যাপারটা যখন ভাবনা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছিলাম সেসময়ই টয়লেট থেকে স্ট্র্যাডলেটারের রুমে ফিরে আসার শব্দ শুনতে পেলাম। সে আবার সতেজ বাতাসের ভক্ত। এর আরো কিছুক্ষণ পর দেখলাম রুমের লাইট নিভিয়ে দিয়েছে। হারামিটা একবারও খোঁজ করে দেখেনি আমি রুমে আছি নাকি নেই।
রাস্তাটাও ঐদিন খুব বিষণ্ণ ছিল। রাস্তা দিয়ে যাওয়া কোনো গাড়ির শব্দও পাওয়া যাচ্ছিল না। আমার তখন এতটাই একা আর খারাপ লাগছিল যে একাকীত্ব কাটানোর জন্য অ্যাকলিকেই ঘুম থেকে জাগানোর ইচ্ছা জেগে উঠলো।
‘হেই, অ্যাকলি,’ শাওয়ার পর্দার ফাঁক দিয়ে স্ট্র্যাডলেটার যেন শুনতে না পায় সেজন্য ফিসফিসিয়ে ডাকলাম।
অ্যাকলি যদিও আমার ডাক শুনতে পায়নি।
‘অ্যাকলি!’
তখনও সে শুনতে পায়নি। কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছিল সে।
‘হেই, অ্যাকলি!’
ঐ ডাকটা শুনতে পেল।
‘তোমার সমস্যাটা কী ভাই?’ বলে উঠলো। ‘আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম।’
‘একটা প্রশ্ন ছিল। আশ্রমে জয়েন করার নিয়মটা কি জানো?’ জিজ্ঞেস করলাম। ভাবটা এমন যেন আমার আশ্রমে ঢোকার খুব ইচ্ছা আছে। ‘ক্যাথলিক না হলে কি ঢোকা যাবে না?’
‘তোমাকে অবশ্যই ক্যাথলিক হওয়া লাগবে। আর তুমি কি আমাকে এই সাধারণ একটা প্রশ্নের জন্য ঘুম থেকে ডেকে তুলে…’
‘হ্যাঁ, আবার ঘুমিয়ে যাও। আমার আসলে এমনিতেও কোনো আশ্রমে জয়েন করার ইচ্ছা নাই। আমার যেই ভাগ্য, তাতে খুব সম্ভবত এমন কোনোটাতে ঢুকবো যেটাতে সব বেজাত সন্যাসী থাকবে। সবগুলো হবে গবেট, মূর্খ।’
ঐ কথাটা বলার সাথে সাথেই লাফিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো অ্যাকলি। বলল, ‘শোনো, আমার ব্যাপারে তোমার বা অন্যদের ধারণা কী, সেটাকে আমি বিন্দুমাত্রও পাত্তা দিই না। তবে তুমি যদি এখন আমার ধর্ম নিয়ে কৌতুক করা শুরু করো, তাহলে…’
‘আহা, শান্ত হও,’ আমি বললাম। ‘কেউ তোমার ধর্ম নিয়ে কোনো কৌতুক করছে না।’ বলে অ্যালির বিছানা থেকে উঠে দরজার দিকে পা বাড়ালাম। ঐ বাজে গন্ধওয়ালা রুমে আমার আর একমুহূর্তও থাকতে ইচ্ছা করছিল না। তবে যাওয়ার সময় থেমে অ্যাকলির হাত টেনে তুলে তার সাথে মেলাতে কোনো ভুল করলাম না। যদিও পুরোটাই ন্যাকামি ছিল, তারপরও ভদ্রতা দেখানো বলে কথা। তবে অ্যাকলি নিজেই তার হাত নামিয়ে নিয়েছিল। ‘তোমার মাথায় আসলে কী চলছে?’ সে বলল।
‘কিছুই চলছে না। আমি শুধু তোমাকে পরিষ্কার মনের একজন মানুষ হওয়ার জন্য ধন্যবাদ দিতে চাচ্ছি,’ একদম মোলায়েম কণ্ঠে বললাম। ‘তুমি একজন খাটি মানুষ, অ্যাকলি কিড,’ বললাম। ‘তুমি জানো এটা?’
‘তুমি নিজেকে খুবই চালাক ভাবো। তবে সাবধানে থেকো। কোনো একদিন কেউ কিন্তু বিরক্ত হয়ে তোমার মাথা…’
তার কথাটা শোনার প্রয়োজনও মনে করলাম না। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে করিডোরে বেরিয়ে এলাম।
অনেকেই উইক-এন্ডে বাড়ি চলে গিয়েছিল, আর যারা উইংয়ে ছিল তারাও ঘুমিয়ে গেছে ততক্ষণে, তাই করিডোরটাও একদম নীরব ও শান্ত ছিল। লিহি আর হফম্যানের দরজার সামনে কলিনোস টুথপেস্টের একটা খালি বাক্স পড়েছিল। সিঁড়ির দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় বক্সটায় লাথি দিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার পায়ে তখন স্লিপার পরা ছিল, তাই তেমন একটা শব্দ হচ্ছিল না। যাওয়ার সময় ভাবছিলাম, সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে মেল ব্রোসার্ডের সাথে দেখা করবো। তবে হঠাৎ কেন যেন দেখা করতে ইচ্ছা হলো না। হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি ঐ রাতেই পেন্সি থেকে চলে যাবো। মানে বুধবার পর্যন্ত আর অপেক্ষা করবো না। আর একটুও থাকতে ইচ্ছা করছিল না ওখানে। এতে করে আরো বেশি দুঃখ ও একাকীত্ব বোধ হচ্ছিল। তাই তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে পেন্সি থেকে বেরিয়ে নিউইয়র্কের সস্তা কোনো হোটেলের একটা রুম ভাড়া করবো আর বুধবারের আগ পর্যন্ত ওখানেই থাকবো। তারপর বুধবার বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করবো। ধরে নিয়েছিলাম, আমাকে বের করে দেওয়া নিয়ে থার্মারের দেওয়া চিটিঠা আমার বাবা-মা খুব সম্ভবত মঙ্গল বা বুধবারের আগে হাতে পাবে না। আর আমারও তারা চিঠি পাওয়ার আগে বাসায় যাওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। তারা আগে চিটিঠা পাবে, ওটা নিয়ে বিস্তারিত ভাববে, তারপর বাসায় যাবো। চিটিঠা তারা হাতে পাওয়ার মুহূর্তটায় আমার তাদের সামনে থাকার কোনো ইচ্ছা ছিল না। আমার মা খুব বেশি হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তবে কোনোকিছু নিয়ে পুঙ্খানুভাবে ভাবার পর মা আবার ঠিকই স্বাভাবিক হয়ে যায়। তাছাড়া আমার নিজেরও একটা হালকা ছুটি দরকার ছিল। আমার স্নায়ুর অবস্থা খুবই বাজে হয়েছিল তখন।
যাইহোক, ওটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রুমে ফিরে গিয়ে লাইট জ্বালালাম ব্যাগ-পত্র গোছানোর জন্য। অবশ্য এর আগেই কিছু জিনিস গুছিয়ে রেখেছিলাম। স্ট্র্যাডলেটারও ঘুমিয়েছিল তখন, আমার শব্দেও ঘুম ভাঙেনি তার। তাই একটা সিগারেট জ্বালিয়ে কাপড়-চোপড় পরে গ্ল্যাডস্টোনের স্যুটকেস দুটো গুছিয়ে নিলাম। সবমিলিয়ে মাত্র দুই মিনিট সময় লাগলো। ব্যাগ গোছাতে আমার কখনোই খুব বেশি সময় লাগতো না।
ব্যাগ গোছানোর সময় আইস স্কেটগুলো ব্যাগে ঢুকানোর সময় খুব খারাপ লাগছিল। একদম নতুন ছিল আইস স্কেটগুলো। বহিষ্কৃত হওয়ার মাত্র অল্প কয়েকদিন আগে আমার মা ওগুলো পাঠিয়েছিল। চোখে ভাসছিল স্পন্ডিংয়ে গিয়ে মা দোকানিকে হাজারটা জেরা করে আমার জন্য এই স্কেটগুলো কিনছে, আর আমি কি না আরো একবার বহিষ্কার হয়ে ফিরে যাচ্ছি। ব্যাপারটায় খুব খারাপ লাগছিল। যদিও মা ভুল স্কেট কিনেছে—আমি চেয়েছিলাম রেসিং স্কেট আর মা কিনেছিল হকি স্কেট—তবে যাইহোক, ব্যাপারটা কল্পনা করে অনেক খারাপ লাগছিল। প্রায় সময়ই কেউ আমাকে কোনো উপহার দিলে, সেটা একসময় আমাকেই খারাপ লাগাতো।
ব্যাগ গোছানোর পর আমার কাছে থাকা টাকাগুলো গুনে নিলাম একবার। এখন ঠিক মনে নেই ঐ সময় আমার কাছে ঠিক কত টাকা ছিল, তবে টাকার পরিমাণটা বেশ ভালোই ছিল। এর আগের সপ্তাহেই আমার দীদা আমাকে একটা বান্ডিল পাঠিয়েছিল। আমার দীদা আসলে টাকার অপচয় করে অনেক বেশি। বয়স অনেক বেশি হওয়ায় দীদার আসলে খুব একটা খরচ লাগতো না। সেজন্যই আমাদেরকে টাকা দিতো অনেক। আমার জন্মদিনের জন্য বছরে প্রায় চারবার টাকা পাঠাতো। যাই হোক, আমার পকেট বেশ ভরাই ছিল, তারপরও মনে হলো আরো কিছু টাকা থাকলে ভালো হয়। বলা তো যায় না কখন কোন দরকার লেগে যায়। তাই রুম থেকে বেরিয়ে ফ্রেডরিক উড্রাফের রুমে গেলাম। এই ছেলেটাই আমার টাইপরাইটার ধার নিয়েছিল। তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করলাম, টাইপরাইটার তার কাছে বিক্রি করে দিলে আমাকে কত দিতে পারবে। সে যথেষ্ট ধনী পরিবারের ছেলে। সে বলল সে জানে না। তাছাড়া তার ওটা কেনারও কোনো ইচ্ছা ছিল না। তবে শেষমেশ সে ওটা কিনেছিল ঠিকই। টাইপরাইটারটার এমনিতে দাম ছিল নব্বই ডলারের মতো, তবে সে আমাকে দিয়েছিল মাত্র বিশ ডলার। হুটহাট ঘুম থেকে ডেকে তোলার জন্য আমার ওপর অনেক রেগেওছিল সে।
সব গুছানোর পর ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ব্যাগপত্র নিয়ে সিঁড়ির কাছে গিয়ে একবার থামলাম। থেমে শেষবারের মতো ফিরে তাকালাম করিডোরটার দিকে। কেন জানি তখন খুব কান্না পাচ্ছিল। যাই হোক, চোখ মুছে লাল শিকারি টুপিটা মাথায় লাগিয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, ‘ভালোভাবে ঘুমা, হারামজাদা গর্দভরা!’ আমি নিশ্চিত চিৎকার শুনে ঐদিন পুরো ফ্লোরের সবারই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। এরপর না দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে দৌড় লাগালাম সিঁড়ি দিয়ে। কোন গবেট যেন পুরো সিঁড়ি জুড়েই বাদামের খোসা ফেলে রেখেছিল। আরেকটু হলেই ঘাড় ভাঙতে বসছিলাম বাদামের খোসায় পা হড়কে।