অধ্যায় তিন
আমি কিন্তু অনেক বড়ো মিথ্যুক। আমার মতো মিথ্যুক হয়তো আর একটাও পাওয়া যাবে না। ব্যাপারটা অবশ্যই খুব খারাপ। ধরুন, যদি আমি ম্যাগাজিন কেনার জন্য কোনো দোকানের দিকে যাচ্ছি, আর যাত্রার পথে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছি, তাহলে নির্দ্বিধায় বলে দেই যে, অপেরাতে যাচ্ছি। অভ্যাসটা খুব খারাপ জানি। স্পেন্সারকে যে জিম থেকে জিনিসপত্র নিয়ে আসার কথা বলে এসেছিলাম, সেটাও কিন্তু খুবই খাঁটি একটা মিথ্যা ছিল। আমি কখনোই ঐ জিমে আমার কোনো উপকরণ রাখিনি।
পেন্সিতে ওজেনবার্গার মেমোরিয়াল উইংয়ের নতুন ডর্মগুলোর একটিতে থাকতাম। ঐ উইংটা শুধু জুনিয়র আর সিনিয়রদের জন্য ছিল। আমি ছিলাম জুনিয়র, আর আমার রুমমেট ছিল সিনিয়র। উইংটার নামকরণ করা হয়ে পেন্সিরই এক প্রাক্তন ছাত্র ওজেনবার্গারের নামে। পেন্সি থেকে বেরিয়ে ব্যবসায় নেমে পড়েছিলেন, সেই ব্যবসা থেকে প্রচুর টাকা কামিয়েছেন তিনি। তাঁর ব্যবসাটা আসলে পার্লারের ব্যবসা। পুরো দেশ জুড়েই তিনি প্রচুর পার্লার খুলে রেখেছেন যেগুলোতে কারো পরিবারের কেউ ঢুকলে তাকে পাঁচ ডলারের বিনিময়ে ভূত বানিয়ে দেওয়া হয়। হ্যাঁ, জনপ্রতি পাঁচ ডলার। ওজেনবার্গারকে আপনাদের একবার দেখে আসা উচিৎ অবশ্যই। তিনি খুব সম্ভবত তার পার্লারে ঢোকা মানুষগুলোকে বস্তায় পুরে নদীতে ফেলে দেন। যাই হোক, ব্যবসায় সফল হয়ে তিনি পেন্সিকে অনেক টাকা দান করেছেন। সেজন্যই আমাদের উইংটার নামকরণ করা হয়েছে তার নামে। বছরের প্রথম ফুটবল ম্যাচের দিন ওজেনবার্গার তার বিশাল ক্যাডিলাকটা নিয়ে এসেছিলেন আমাদের স্কুলে। তার আগমনের সম্মানে আমাদের সবাইকেই গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে হয়েছিল—মানে তার উদ্দেশ্যে চিয়ার করতে হয়েছিল আর কী। এরপরে সকালে তিনি চ্যাপেলে দাঁড়িয়ে প্রায় দশ ঘণ্টা জুড়ে বিশাল এক বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। তিনি কতটা মাটিতে পা রাখা সাধারণ মানুষ সেটা বুঝাতে পঞ্চাশটা ফালতু কৌতুক দিয়ে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন। কত রকমের ধাপ্পাবাজি থাকে মানুষের। কৌতুকের পর তিনি বলা শুরু করেন, তিনি সবসময় মাটিতে হাঁটু ভর করে উবু হয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন। বিপদে পড়লে বা সবসময়ই তিনি সাহায্য চেয়েছেন ঈশ্বরের কাছে। মাটিতে হাঁটু ভর করে মাথা নত করতে তিনি নাকি কখনোই কোনো লজ্জা অনুভব করেননি। তিনি আমাদেরকেও বলেছিলেন সবসময় ঈশ্বরের প্রার্থনা করতে—কথা বলতে—যখন যেখানে আছি সেখান থেকেই ঈশ্বরের সামনে মাথা নত করে প্রার্থনা করতে। আরো বলেছেন যীশুকে আমাদের বন্ধু হিসেবে ধরে নিতে। তিনি নাকি সবসময়ই ঈশ্বর, যীশুর সাথে কথা বলেন, এমনকি গাড়ি চালানোর সময়ও। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই হাস্যকর লেগেছিল। কল্পনা করছিলাম, এই বিশাল বড়ো চাপাবাজটা গাড়ির ফার্স্ট গিয়ারে শিফট করে যীশুকে বলছে তার জন্য আরো কিছু শিফট পাঠাতে। তার বক্তব্যের মাঝের অংশটা আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল। তিনি তখন বলছিলেন তিনি কত বড়ো একজন ব্যবসায়ী, এখন কত বড়ো এক হট- শটে পরিণত হয়েছেন, আরো হাবিজাবি অনেক কিছু। ঠিক তখনই হুট করে আমার সামনের সিটে থাকা এডগার মারসালা বিশাল শব্দের সাথে বায়ুত্যাগ করে বসলো। চ্যাপেলের ভেতরে এটা আসলে খুবই খারাপ এক ব্যাপার ছিল, তবে আরেক দিক দিয়ে ভাবলে বায়ুত্যাগটা বেশ হাস্যকরও ছিল। আহ, মারসালা! সে তো চ্যাপেলের ছাদই প্রায় উড়িয়ে দিয়েছিল শব্দে। এমন কেউ নেই যে শব্দ শুনে উচ্চস্বরে হাসেনি। তবে ওজেনবার্গারের ভাব এমন ছিল যেন তিনি কিছুই শুনতে পাননি। কিন্তু বক্তৃতামঞ্চে থাকা থার্মার ঠিকই শুনতে পেয়েছিল শব্দটা। ওহ, খোদা, শব্দ শুনে যেন লোকটার কপালে কালশিটে পড়ে গিয়েছিল। থার্মার তখন আমাদের কিছু বলেনি, তবে পরের রাতে সে আমাদের সবাইকেই অ্যাকাডেমিক বিল্ডিংয়ের কম্পোলসারি স্টাডি ডেকে পাঠিয়েছিল। বিশাল একটা বক্তৃতাও দিয়েছিল ঐদিন লোকটা। তার ভাষ্য ছিল চ্যাপেলে ব্যাঘাত ঘটানো ছেলেটার আচরণ পেন্সির সাথে যায় না। আমরা তখন মারসালাকে বলছিলাম থার্মারের বক্তৃতার সময় আরেকবার শব্দত্যাগ করতে, তবে সে আসলে তখন মুডে ছিল না। যাই হোক, পেন্সিতে আমি ওখানেই থাকতাম। ওজেনবার্গার মেমোরিয়াল উইংয়ের নতুন ডর্মে।
স্পেন্সারের বাসা থেকে রুমে ফিরে বেশ ভালো লাগছে। কারণ স্কুলের সবাই ছিল খেলার মাঠে, আর রুমটাও ছিল বেশ উষ্ণ। উষ্ণতার জন্য অনেক আরাম লাগছিল আমার। কোট-টাই খুলে শার্টের কলারের বোতামগুলো খুললাম প্রথমে, এরপর মাথা থেকে নামিয়ে রাখলাম সকালেই নিউইয়র্ক থেকে কেনা টুপিটা। সেটাছিল লাল শিকারি হ্যাটি, টুপিটার ওপরে অনেক লম্বা পালকের একটা ঝুঁটিও ছিল। পেন্সিং উপকরণগুলো হারিয়ে ফেলেছি বুঝার পর সাবওয়েতে নামতেই এক স্পোর্টস স্টোরের জানালায় ঐ টুপিটা দেখেছিলাম। কিনতে মাত্র এক ডলার লেগেছিল। টুপিটার ঝুঁটিটা পিছনের দিকে বাঁকিয়ে মাথায় লাগাতাম। হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনতে একটু সেকেলে মনে হচ্ছে, আমি জানি—তবে আমার ওভাবেই পরতে ভালো লাগতো। ওভাবে আমাকে দেখতেও ভালো লাগতো। এরপর আগে থেকেই পড়তে থাকা বইটা বের করে চেয়ারে বসলাম। ওখানের সব রুমেই দুটো করে চেয়ার ছিল। চেয়ারগুলোর একটা ছিল আমার, আরেকটা আমার রুমমেট ওয়ার্ড স্ট্র্যাডলেটারের। চেয়ারের হাতলগুলো দুঃখী মানুষের ঠোঁট বাঁকানোর মতো করে বানানো, কারণ প্রায় সবাই চেয়ারের হাতলে বসতো। তবে যাই হোক, চেয়ারগুলো খুব আরামদায়ক ছিল।
আমি তখন যে বইটা পড়ছিলাম ওটা আসলে লাইব্রেরি থেকে ভুলে নিয়ে এসেছিলাম। তারাই আমাকে ভুল বই দিয়েছিল, আমিও রুমে আসার আগে সেটা খেয়াল করিনি। তারা আমাকে দিয়েছিল ইসাক ডিনেসেনের আউট অফ আফ্রিকা বইটি। ভেবেছিলাম বইটা হয়তো বাজে হবে, তবে বইটা বেশ ভালোই ছিল। পড়ালেখায় খারাপ হলেও আমি প্রচুর বই পড়ি। আমার প্রিয় লেখক আমার ভাই ডি.বি.। দ্বিতীয় পছন্দ রিং লার্ডনার। পেন্সিতে আসার কয়েকদিন আগে আমার ভাই আমার জন্মদিনে রিং লার্ডনারের একটা বই উপহার দিয়েছিল। বইটাতে অনেক মজাদার, পাগলাটে কিছু কাহিনি ছিল। সাথে একটা গল্প ছিল যেটাতে সবসময়ই দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো এক সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় এক ট্রাফিক পুলিশ। তবে পুলিশটা ছিল বিবাহিত, তাই সে ঐ মেয়েটাকে বিয়ে বা অন্য কিছু করতে পারতো না। আর শেষে ঐ মেয়েটাও মারা যায়, অতিরিক্ত স্পিডে গাড়ি চালানোর জন্য। গল্পটা আমার মনে খুবই গভীর একটা দাগ কেটে দিয়েছে। বইয়ের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি যেটা পছন্দ করি, সেটা হলো বইটাতে অন্তত কোনো না কোনো একটা সময় মজাদার কিছু একটা থাকতে হবে। আমি প্রচুর ক্ল্যাসিকাল বই পড়ি। দ্য রিটার্ন অব দ্য ন্যাটিভ এদের মধ্যে একটি। আসলে ক্ল্যাসিকাল সব বইই পছন্দ করি। যুদ্ধের এবং রহস্যেরও অনেক বই পড়ি আমি, তবে সেগুলোতে তেমন একটা মজা পাই না। আমার ঐ বইটাই বেশি ভালো লাগে যেটা পড়ার পর আমার ইচ্ছা করে বইয়ের লেখককে নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত করতে এবং ফোন করে বইটা কেমন লাগলো সেটা জানাতে। এই ব্যাপারটা অবশ্য সবসময় ঘটে না। ইসাক ডিনেসেনকে ফোন করতে আমি কোনো আপত্তিই জানাবো না। রিং লার্ডনারকেও। তবে আমার ভাই ডি.বি. বলেছে লোকটা নাকি অনেক আগেই মারা গেছে। সমারসেট মউগ্যামের অব হিউম্যন বন্ডেজও ভালো বই। গত গ্রীষ্মে বই পড়েছিলাম। বইটা ভালো হলেও লেখককে ফোন করে জানানোর মতো অত ভালো নয় বইটা। এর বদলে থমাস হার্ডিকে ফোন করতে কোনো আপত্তি নেই আমার। ইউস্টেসিয়া ভাইকেও আমার বেশ ভালো লাগে।
নতুন টুপিটা মাথায় লাগিয়ে আউট অব আফ্রিকা বইটি পড়তে শুরু করলাম। যদিও বইটা আগেও একবার পড়েছি, তখন পড়ছিলাম শুধু কয়েকটা নির্দিষ্ট অংশের ওপর আরেকবার চোখ বুলানোর জন্য। তিন পৃষ্ঠা পড়েছি মাত্র, তখনই শাওয়ার কার্টেইনের ওপাশ থেকে কারো আসার শব্দ শুনতে পেলাম। না তাকিয়েই বুঝে গেলাম ওপাশে কে আছে—আমার পাশের রুমেই থাকা রবার্ট অ্যাকলি। আমাদের উইংয়ে প্রতি দুই রুম পরপরই একটা শাওয়ার রয়েছে। আর দিনের মধ্যে পঁচাশি বার অ্যাকলির দেখা হতো আমার সাথে। সে আর আমি ছাড়া পুরো ডর্মের সবাইই সম্ভবত এখন খেলার মাঠে আছে। ও কোথাও যায় না। খুবই অদ্ভুত একজন মানুষ অ্যাকলি। স্কুলের সিনিয়র সে, পেন্সিতে চার বছর ধরেই আছে, এই লম্বা সময়ে কেউই কখনো তাকে ‘অ্যাকলি’ ছাড়া আর অন্য কোনো নামে ডাকেনি। এমনকি তার রুমমেট হার্ব গেল’ও তাকে কখনো ‘বব’ বা এমনকি ‘অ্যাক’ নামেও ডাকেনি। যদি এই লোকটার কখনো বিয়ে হয়, তাহলে তার বউও হয়তো তাকে ‘অ্যাকলি’ নামেই ডাকবে। সে খুবই লম্বা এবং কাঁধগুলো তার অনেকটা গোলাকার গড়নের। উচ্চতা ছয় ফুট চার ইঞ্চি। দাঁতগুলো খুব বাজে ছিল। আমি যতদিন তার পাশের রুমে ছিলাম, ততদিনে কখনোই তাকে দাঁত ব্রাশ করতে দেখিনি। সবসময়ই খুব নোংরা আর বিশ্রি ছিল। আর সে যদি ডাইনিং রুমে আলুভর্তা বা সিমের বিচি মুখে নিয়ে কিছু বলতে যেত, তাহলে পুরো ডাইনিং রুমেরই অসুস্থ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হতো। এছাড়া তার গালে প্রচুর ব্রণও ছিল। অন্যান্য ছেলেদের মতো শুধু কপাল বা থুতনিতেই নয়, পুরো মুখ জুড়েই ব্রণ ছিল। আরেকটা কথা ভুললে চলবে না, তার ব্যক্তিত্ব ছিল খুবই বাজে। খুবই জঘন্য প্রকৃতির মানুষ ছিল ও। সত্যি বলতে তাকে নিয়ে আমার কখনো খুব একটা আগ্রহ ছিল না।
অনুভব করতে পারছিলাম সে আমার চেয়ারের ঠিক পিছনে শাওয়ার তাকের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দেখছে রুমে স্ট্র্যাডলেটার আছে কি না। স্ট্র্যাডলেটারের সাহসটা ঘৃণা করত ও। স্ট্র্যাডলেটার রুমে থাকলে সে কখনোই রুমে আসতো না। আসলে সত্যি বলতে, কারোর সাহসিকতাই পছন্দ করত না ও।
স্ট্র্যাডলেটার নেই দেখে শাওয়ার তাক থেকে নেমে রুমে ঢুকলো অ্যাকলি। ‘হাই,’ বলল। তার বলার ধরনটা এমন ছিল যে শুনলে মনে হবে সে হয়তো প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে আছে, নয়তো প্রচণ্ড ক্লান্ত। রুমে ঢুকে কখনোই বুঝাবে না যে সে রুমে ঘুরতে এসেছে অথবা এমনিই কোনো দরকারে এসেছে। সবসময়ই এটা বুঝাতে চাইতো, ভুল করে রুমে চলে এসেছে। কী অদ্ভুত!
‘হাই,’ বই থেকে মুখ না তুলেই জবাব দিলাম। অ্যাকলির মতো মানুষের সাথে বই থেকে মুখ তুলে জবাব দিতে গেলেই পরাজয় নিশ্চিত। অবশ্য পরাজয় এমনিতেও নিশ্চিত, তবে সেটা আসতে আর কী এখন একটু দেরি হবে।
রুমের ভেতর দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু করল ও। সবসময় এভাবেই হাঁটে ছেলেটা। ডেস্ক, টেবিল থেকে এটা সেটা তুলে নিয়ে দেখে। সবসময়ই সে ব্যক্তিগত জিনিসগুলোই তুলে নিয়ে দেখে। খোদা, এই ছেলেটা কারো রাগ না উঠিয়ে ছাড়ে না। ‘তো পেন্সিং কেমন ছিল?’ জিজ্ঞেস করল ও। সে আসলে চাচ্ছিল আমি যেন বই পড়া আর নিজের অলস সময় কাঁটানোটা থামিয়ে দিই। পেন্সিং নিয়ে কোনোকালেই কোনো আগ্রহ ছিল না। ‘আমরা জিতেছি, তাই না?’ বলল ও।
‘কেউ জিতেনি,’ বললাম। তখনও বই থেকে মুখ উঠাইনি।
‘কী?’ বলল ও। সে সবসময়ই মানুষকে দিয়ে একই কথা দুইবার করে বলাতো।
‘কেউ জিতেনি,’ বলে আড়চোখে দেখে নিলাম সে আমার ডেস্কের কোন জিনিসটা গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে। সে আসলে তখন দেখছিল একটা মেয়ের ছবি, নিউইয়র্কের ভেতরে মেয়েটার সাথে ঘুরে বেড়াতাম আমি। স্যালি হায়েস নাম মেয়েটার। অ্যাকলি প্রতিবারই এসে এই ছবিটা ধরতো, আমি থাকাকালে কমপক্ষে হলেও পাঁচ হাজার বার সে ঐ ছবিটা দেখেছে। আর দেখার পর সবসময়ই ছবিটা রাখতো ভুল জায়গায়। ইচ্ছা করেই কাজটা করত। এটা তো যে কেউই বুঝবে।
‘কেউই জিতেনি,’ সে বলল। ‘কীভাবে সম্ভব এটা?’
‘আমি পেন্সিংয়ের সব সরঞ্জাম সাবওয়েতে ফেলে গিয়েছিলাম।’ তখনও বই থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকাইনি।
‘সাবওয়েতে, খোদা! তুমি ওগুলো হারিয়ে ফেলেছো, মানে?’
‘আমরা ভুল সাবওয়েতে চলে গিয়েছিলাম। আমাকে বারবার উঠে দেওয়ালের ম্যাপ দেখতে হচ্ছিল।’
অ্যাকলি আরেকটু এগিয়ে আমার বাম পাশে এসে দাঁড়ালো। ‘হেই,’ আমি বললাম। ‘তুমি আসার পর থেকে আমি এই একটা বাক্যই বিশবার পড়েছি।’
অ্যাকলি ছাড়া অন্য কাউকে কথাটা বললে তারা সরাসরিই অর্থটা বুঝে যেতো। কিন্তু অ্যাকলি বুঝার পাত্র ছিল না। ‘কী মনে হয়, তারা তোমার থেকে ঐ জিনিসগুলোর জরিমানা নেবে?’ সে জিজ্ঞেস করল।
‘এটা জানি না, আর এটা নিয়ে কোনো কেয়ারও করি না। অ্যাকলি কিড, তুমি অন্য কোথাও গিয়ে বসো, নয়তো অন্য কোনো কিছু করো। তুমি এখন ঠিক আমার লাইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছো।’
‘অ্যাকলি কিড’ ডাকটা সে ঠিক পছন্দ করতে পারতো না। তাকে ঐ নামে ডাকলে সে সবসময়ই বলত যে ঐখানে বাচ্চা একমাত্র আমি, কারণ আমার বয়স ষোলো আর তার বয়স আঠারো ‘অ্যাকলি কিড’ বললে রেগে আগুন হয়ে উঠতো ও।
তবে তারপরও সে ওইখানেই দাঁড়িয়েছিল। সে আসলে এমন একজন মানুষ যাকে আলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে বলার পরও সে ঐ জায়গা থেকে নড়বে না। দাঁড়িয়েই থাকবে। তাকে সরতে বললে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার প্রতিক্রিয়া জানাবে। যেমন তখন জানিয়েছিল, ‘কী জাহান্নামটা পড়ছো তুমি?’
‘বই।’
এরপর হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে নামটা দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ভালো বই?’
‘এখন যে বাক্যটা পড়ছি সেটা খুবই মারাত্মক,’ মুডে থাকলে আমিও মাঝেমধ্যে সারকাস্টিক কথা বলতে পারি। যদিও সে ঐ কথাটা বুঝে না। সে আবারো পায়চারি শুরু করল রুম জুড়ে। আবারো আমার ব্যক্তিগত জিনিসগুলো তুলে দেখেছে, স্ট্র্যাডলেটারেরগুলোও বাদ দিচ্ছিল না। অবশেষে না পেরে বইটা নামিয়ে রাখলাম। অ্যাকলির মতো কেউ আশেপাশে থাকলে বই পড়া একেবারেই অসম্ভব।
চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে অ্যাকলিকে দেখছিলাম, সে রুমটাকে তার নিজের মতো করে সাজাতে শুরু করেছে। নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসে এমনিতেই প্রচণ্ড ক্লান্তি লাগছিল আমার, এরপর আবার যাওয়া লেগেছে মি. স্পেন্সারের বাসায়—তাই হাই তুলতে শুরু করলাম। এরপর এমনেই খেলা শুরু করলাম। মাঝেমধ্যে আমি প্রায়ই অহেতুক খেলা খেলি শুধুমাত্র নিজেকে বিরক্ত থেকে মুক্ত রাখার জন্য। আমি যে খেলাটা খেলছিলাম, সেটা হলো—আমার শিকারি টুপিটার ঝুঁটিটা সামনে নিয়ে এসেছিলাম, আর সেটা এসে পড়ল আমার চোখে। ঐভাবে আসলে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না আমি। এরপর গম্ভীর ভরা গলায় বলতে শুরু করলাম, ‘আমার মনে হয় আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। মাদার ডার্লিং, এখানের সবকিছুই অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।’
‘খোদা আমার,’ বলে গালি দিয়ে উঠলো অ্যাকলি।
‘মাদার ডার্লিং, তোমার হাত বাড়িয়ে দাও আমার দিকে। তুমি তোমার হাত কেন বাড়িয়ে দিচ্ছো না?’
‘খোদার দোহাই লাগে, থামো তুমি।’
অন্ধদের মতো সামনে হাত বাড়িয়ে হাতড়াতে শুরু করলাম। তবে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াইনি। হাতড়াতে হাতড়াতে শুধু বললাম, ‘মাদার ডার্লিং, তুমি কেন আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছো না?’ স্বাভাবিকভাবেই আমি খেলাটা খেলে যাচ্ছিলাম। এইসব পাগলামি আসলে মাঝেমধ্যে অনেক আনন্দ দিতো। তাছাড়া আমি জানতাম অ্যাকলি এতে প্রচণ্ড বিরক্ত হতো। সে সবসময়ই আমার মধ্য থেকে স্যাডিস্টিক অংশটা বের করে আনতো। আমি তার সাথে আসলেই অনেক স্যাডিস্টিক আচরণ করেছি। যদিও বেশিক্ষণ কাজটা করিনি। কিছুক্ষণ পর নিজেই খেলাটা থামিয়ে পালকের ঝুঁটিটা পিছনের দিকে ঘুরিয়ে দিলাম। অনেকটা স্বস্তি লাগছিল তখন।
‘এই জিনিসটা কার?’ আমার রুমমেটের নি-সাপোর্টারটা তুলে ধরে আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল অ্যাকলি। অ্যাকলি আসলে যেকোনো কিছুই হাতে নিয়ে নিতো। এমনকি জক স্ট্র্যাপ বা এমন কিছু হলেও তার সেটা ধরতে কোনো দ্বিধা হতো না। তাকে জানালাম যে জিনিসটা স্ট্র্যাডলেটারের। শুনে ওটা স্ট্র্যাডলেটারের বিছানার দিকে ছুঁড়ে মারলো। সে ওটা খুঁজে পেয়েছিল স্ট্র্যাডলেটারের ডেস্কের ওপর, তাই ওটা ছুড়ে মারলো তার বিছানার দিকে।
এরপর আরেকটু এগিয়ে গিয়ে স্ট্র্যাডলেটারের চেয়ারের হাতলে গিয়ে বসলো। সে কখনো চেয়ারে বসতো না। সবসময়ই হাতলে বসতো। ‘ঐ টুপিটা কোথা থেকে এনেছো?’ জিজ্ঞেস করল।
‘নিউইয়র্ক।’
‘দাম কত?’
‘এক ডলার।’
‘তোমাকে তো ডাকাতি করে ছেড়েছে দেখি।’ বলে ম্যাচের কাঠি দিয়ে আঙুলের নখ পরিষ্কার করতে শুরু করল অ্যাকলি। সে সবসময়ই তার নখ পরিষ্কার রাখে। একদিক দিয়ে ভাবলে ব্যাপারটা কিন্তু বেশ হাস্যকর। তার দাঁত সবসময়ই হলুদ হয়ে থাকে, কান থাকে ভয়ংকর রকমের নোংরা হয়ে, কিন্তু সে সবসময়ই তার নখ পরিষ্কার রাখে। আমার মনে হয় নখ পরিষ্কার রেখে সে নিজেকে পরিচ্ছন্ন মানুষদের একজন ভাবতো। নখ পরিষ্কার করতে করতেই আরেকবার আমার টুপিটা দেখলো। ‘আমাদের বাসার ঐদিকে এইরকম টুপিগুলো আমরা পরি হরিণ শিকারের সময়,’ সে বলল। ‘এটা হরিণ শিকারের টুপি।’
‘হতেই পারে।’ মাথা থেকে টুপিটা খুলে হাতে নিয়ে নিলাম। এরপর একচোখ বন্ধ করে টুপিটার দিকে তাকালাম। এমনভাবে তাকালাম দেখে মনে হতে পারে যেন আমি টুপিটা কারো দিকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারতে যাচ্ছি। ‘এটা মানুষের দিকে ছুড়ে মারার টুপি,’ বললাম। ‘এই টুপিটা আমি মানুষের দিকে ছুড়ে মারি।’
‘তোমার বাবা-মা কি জানে তোমাকে এখান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে?’
‘না।’
‘আচ্ছা! স্ট্র্যাডলেটার কই আছে এখন?’
‘খেলার মাঠে। তার একটা ডেট আছে।’ বলে হাই তুললাম। আমি আসলে একটু পর পরই হাই তুলছিলাম। রুমটা ছিল উষ্ণ। এই ঠান্ডার মধ্যে উষ্ণতায় বারবার ঘুম পাচ্ছিল আমার। পেন্সিতে থাকলে হয় বরফে জমে মরতে হয়, নয়তো গরমে সিদ্ধ হয়ে।
‘ওহ, মহান পরাক্রমশালী স্ট্র্যাডলেটার,’ অ্যাকলি বলল। ‘হেই, তোমার কাঁচিটা এক সেকেন্ডের জন্য দাও তো একটু। তোমার কাছে কাঁচি আছে না?’
‘না। ঐগুলো প্যাক করে ফেলেছি আগেই। ক্লজেটের ওপরে রাখা প্যাকটাতে রয়েছে।’
‘একটু দিতে পারো?’ অ্যাকলি বলল। ‘একটা নখের কোণা বেড়ে গেছে। ওটা কাঁতে হবে।’
কোনো কিছু প্যাক করে ফেলেছি কি না বা প্যাক করে ক্লজেটের ওপরে রেখে দিয়েছি কি না তা নিয়ে অ্যাকলির কোনো ভাবান্তর ছিল না। সে আসলে এসব বুঝতোই না। যাই হোক, আমি তাকে কাঁচিটা বের করে দিয়েছিলাম ঠিকই। ওটা বের করতে গিয়ে প্রায় মরতেই বসেছিলাম। ক্লজেটের দরজাটা খুলতেই স্ট্র্যাডলেটারের টেনিস র্যাকেট পড়লো আমার মাথার ওপর। ঐ র্যাকেটটা আবার বানানো হয়েছিল সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে। মাথায় পড়তেই বিশাল একটা শব্দ হলো। সাথে ব্যথাও করছিল অসম্ভব রকমের। ঐ ঘটনায় অ্যাকলিরও মরার দশা হয়েছিল। তবে তার এই অবস্থা হয়েছিল হাসতে হাসতে। র্যাকেটটা মাথায় পড়তেই হো হো করে হাসতে শুরু করে ও। আমি স্যুটকেস নামিয়ে কাঁচি বের করে আনার সময়ও সে হেসে যাচ্ছিল। একজনের মাথায় পাথর বা ওরকম শক্ত কিছুর আঘাত হলে সেটা ছিল অ্যাকলির কাছে সবচেয়ে সেরা বিনোদন। ‘তোমার হিউমার অনেক উচ্চমাপের, অ্যাকলি কিড,’ বললাম। ‘তুমি জানো এটা?’ বলে কাঁচিটা ওর হাতে দিলাম। ‘এক কাজ করো, আমাকে তোমার ম্যানেজার বানিয়ে দাও। তোমার সাথে রেডিওতে যোগাযোগ করবো আমি।’ বলে আবারো চেয়ারে বসলাম আর অ্যাকলি তার চোখা-তীক্ষ্ণ নখগুলো কাটা শুরু করল। ‘টেবিলটা কোনো কাজে ব্যবহার করলে কেমন হয়?’ আমি বললাম। ‘টেবিলের ওপর হাত রেখে নখগুলো কাটতে পারবে? রাতের বেলা খালি পায়ে তোমার তীক্ষ্ণ নখে পা ফেলার মতো ইচ্ছা নেই আমার।’ এরপরও সে নখ কেঁটে কেঁটে মেঝেতেই ফেলছিল। কী আচরণরে বাবা! আসলেই!
‘স্ট্র্যাডলেটারের ডেট কে?’ জিজ্ঞেস করল। সে সবসময়ই স্ট্র্যাডলেটার কার সাথে ডেটে যেতো সেটার খোঁজ রাখতো, যদিও সে স্ট্র্যাডলেটারকে ঘৃণা করত।
‘জানি না। কেন?’
‘এমনিই। খোদা, আমি হারামজাদাটাকে সহ্যই করতেই পারি না। ঐ হারামাজাদাটাকে আমি একদমই দেখতে পারি না।’
‘সে তো তোমাকে নিয়ে অনেক আগ্রহী। আমাকে বলেছে সে তোমাকে রাজপুত্র মনে করে।’ আমি বললাম। ফাজলামি করার জন্য আমি প্রায়ই মানুষকে ‘রাজপুত্র’ বলতাম। এটায় আমার বিরক্তি বা রাগ মোটামুটি অনেকটাই কমে যেতো।
‘সবসময়ই সে কেমন যেন হোমড়া-চোমড়া ভাব নিয়ে আচরণ করে,’ অ্যাকলি বলল। ‘আমি ঐ হারামাজাদাটাকে দেখতেই পারি না। তোমার কি মনে হয়…’
‘নখগুলো কি একটু টেবিলের ওপর রেখে কাটতে পারবে?’ আমি বললাম। ‘এই নিয়ে আমি কিন্তু প্রায় পঞ্চাশ…’
‘তার আচরণ সবসময়ই হোমড়া-চোমড়া গোছের,’ অ্যাকলি বলল। ‘আমার মনে হয় না ঐ হারামজাদার খুব একটা বেশি জ্ঞানবুদ্ধি আছে। তবে সে ভাবে সে অনেক বুদ্ধিমান। সে ভাবে সে সবচে…
‘অ্যাকলি! খোদার দোহাই লাগে। তুমি কি তোমার তীক্ষ্ণ নখগুলো টেবিলের ওপর রেখে কাটতে পারবে? আমি প্রায় পঞ্চাশবারের মতো কথাটা বলেছি তোমাকে।’
এরপর সে টেবিলের ওপর হাত রেখেই নখ কাটা শুরু করল। তাকে চেঁচিয়ে কিছু না বলা পর্যন্ত সে কখনোই সেটা শুনতো না।
কিছুক্ষণ তাকে পর্যবেক্ষণ করে নিলাম। তারপর বললাম, ‘স্ট্র্যাডলেটারকে তুমি অপছন্দ করো কারণ সে তোমাকে মাঝেমধ্যেই দাঁত ব্রাশ করা নিয়ে কথা বলে। সে কিন্তু তোমাকে অপমান করার জন্য এটা বলে না। এটা ঠিক যে সে যেভাবে বলে সেভাবে বলা ঠিক না, তবে সে তোমাকে অপমান করতে চায় না। তার কথার অর্থ হচ্ছে, তুমি যদি মাঝেমধ্যে দাঁত ব্রাশ করো, তাহলে এতে তোমাকেই দেখতে ভালো লাগবে এবং তোমার নিজেরও ভালো লাগবে।’
‘আমি দাঁত ব্রাশ করি। ঐ কথা বলো না আমাকে।’
‘না, তুমি করো না। আমি দেখেছি তুমি করো না,’ আমি বললাম। যদিও আমি অতটা কড়াভাবে বলিনি কথাটা। একদিক দিয়ে ওর জন্য খারাপই লাগছিল আমার। স্বাভাবিকভাবেই, কেউ যদি কাউকে দাঁত ব্রাশ করার জন্য বলে তাহলে তো সেটা শুনতে ভালো লাগবেই না। ‘স্ট্র্যাডলেটার ঠিকই আছে। সে কিন্তু অতটা খারাপ না,’ বললাম। ‘সমস্যাটা হচ্ছে তুমি ওকে অতটা ভালো করে জানো না।’
‘আমি তবুও বলবো সে একটা কুকুর ছানা। একটা অহংকারী হারামজাদা ও।’
‘হ্যাঁ, সে অনেক আত্মঅহংকারী, তবে সে কিন্তু বড়ো মনেরও। আসলেই সে অনেক বড়োমনের,’ আমি বললাম। ‘একটা উদাহরণ দেই, ধরো সে একটা টাই বা এমন কিছু পরেছে যেটা তোমার অনেক পছন্দের। উদাহরণ হিসেবে বলছি এটা। তুমি জানো তখন সে কী করবে? সে পারলে ওটা খুলে তোমাকে দিয়ে দেবে। আসলেই দেবে সে। অথবা, তখন না দিলে সে কী করবে জানো? সে ঐটা পরে তোমার বিছানা বা টেবিলে রেখে দেবে। সে ঐ টাইটা তোমাকে দেবেই। অন্য কেউ হলে খুব সম্ভবত…’
‘ধুর!’ অ্যাকলি বলে উঠলো। ‘আমার যদি অত টাকা থাকত, তাহলে আমিও তাই করতাম।’
‘না, তুমি তা করতে না,’ মাথা নাড়লাম। ‘না, তুমি তা করতে না, অ্যাকলি কিড। তোমার যদি অত টাকা থাকত তাহলে তুমি অনেক বড়োমাপের…’
‘আমাকে ‘অ্যাকলি কিড’ বলে ডাকবে না আর। আমার যত বয়স তাতে তোমার বাবাও হতে পারবো আমি।’
‘না, তুমি পারবে না।’ খোদা, মাঝেমধ্যে সে আসলেই অনেক বেশি ক্ষেপে যেত। আর সুযোগ পেলে সে কখনোই জানাতে ভুলতো না যে তার বয়স আঠারো আর আমার বয়স ষোলো। ‘প্রথমত, আমি তোমাকে আমার পরিবারে ঢুকতে দেবো না,’ আমি বললাম।
‘তাহলে, আমাকে আর ঐ নাম ধরে ডাকবে না…’
হঠাৎ করেই রুমের দরজাটা খুলে গেল তখন। তাড়াহুড়োর মধ্য দিয়ে রুমে এসে ঢুকলো স্ট্র্যাডলেটার। সে সবসময়ই তাড়াহুড়োর মধ্যে থাকত। সবকিছুই তার কাছে অনেক বড়ো কিছু ছিল। আমার দিকে ছুটে এসে চটজলদি আমার গালে খেলাচ্ছলে দুটো থাপ্পর দিলো। মাঝেমধ্যে এটা খুবই বিরক্তিকর লাগতো আমার। ‘শুনো,’ সে বলল, ‘তুমি কি আজ রাতে বিশেষ কোনো জায়গায় যাবে?’
‘জানি না। যেতেও পারি। খোদা, বাইরে তুষার পড়ছে নাকি?’ তার পুরো জ্যাকেটই তুষারাবৃত হয়েছিল।
‘হ্যাঁ, শুনো। যদি তুমি কোথাও না যাও, তাহলে আজ রাতের জন্য আমাকে তোমার হাউন্ড-টুথের জ্যাকেটটা দিতে পারবে?’
‘খেলায় কে জিতেছে?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘মাত্র হাফ টাইম হয়েছে। আমরা এখনই বেরুচ্ছি,’ স্ট্র্যাডলেটার বলল। ‘বাদ দাও, তুমি কি আজ রাতে হাউন্ড-টুথ জ্যাকেট পরে কোথাও বেরুবে? আমার ধূসর পশমের জ্যাকেটটা একটা দাগ পড়েছে।’
‘না, তবে তুমি তো তোমার চওড়া কাঁধ দিয়ে আমার জ্যাকেট বড়ো করে দেবে,’ আমি বললাম। আমাদের দুইজনেরই উচ্চতা একই সমান, তবে তার ওজন আমার থেকে দ্বিগুণ বেশি। তার কাঁধগুলোও অনেক চওড়া।
‘বড়ো করবো না।’ বলে দৌড়ে ক্লজেটের দিকে গেল ও। ‘কী অবস্থা তোমার, অ্যাকলি?’ অ্যাকলিকে জিজ্ঞেস করল। স্ট্র্যাডলেটার মোটামুটি অনেক বন্ধুবৎসল স্বভাবের ছিল। যদিও এই স্বভাবটা অনেকটাই লোক দেখানো, তারপরও কাউকে হ্যালো বলার মতো ভদ্রতা তার ছিল।
স্ট্র্যাডলেটারের প্রশ্ন শুনে মুখ কুঁচকে দিলো অ্যাকলি। সে কোনো উত্তর দেবে না। তবে স্ট্র্যাডলেটারের সামনে ভেংচি কাটার মতো সাহসও তার ছিল না। তাই আমার দিকে ফিরে বলল, ‘তো, আমার মনে হয় আমার এখন যাওয়া উচিৎ। পরে কথা হবে তোমার সাথে।’
‘ওকে,’ আমি বললাম। অ্যাকলি আসলে এমন ধরনের মানুষ ছিল যে রুম থেকে চলে গেলেও তার জন্য তেমন কোনো খারাপ লাগা কাজ করত না।
স্ট্র্যাডলেটার ওদিকে তার কোট-টাই-শার্ট সব খুলে ফেলেছে ততক্ষণে। ‘আমার মনে হয় চটজলদি একবার শেভ করে ফেলা উচিৎ,’ বলল ও। তার দাড়িগুলো বেশ ঘন ছিল।
‘তোমার ডেট কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘ও অ্যানেক্সে অপেক্ষা করছে।’ বলে রুম থেকে টয়লেট কিট আর তোয়ালে নিয়ে রওনা দিলো। শরীরে কোনো শার্ট বা এমন কিছু নেই। রুমের ভেতর সে সবসময়ই খালি গায়ে ঘুরতো, কারণ সে ভাবতো তার শরীর অনেক সুঠাম। অবশ্য আসলেই তার দেহটা অনেক সুঠাম ছিল। এটা আমাকে স্বীকার করতেই হবে।