অধ্যায় পঁচিশ
বাইরে এসে দেখি দিনের আলো মাত্র আস্তে আস্তে ফুটতে শুরু করেছে। বেশ ভালোই লাগছিল। তখন, তবে প্রচণ্ড ঘেমে যাওয়ায় আমার তখন
আমি তখন জানতাম না যে আমি কোথায় যাবো। কোনো হোটেলে গিয়ে ফিবির সব টাকা খরচ করারও কোনো ইচ্ছা ছিল না আমার। তাই শেষমেশ লেক্সিংটন পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে সাবওয়ে ধরে চলে গেলাম গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনে। আমার ব্যাগগুলো ওখানেই ছিল, তাই প্ল্যান করলাম যে রাতটা কোনোভাবে ওয়েটিং রুমে বেঞ্চে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিবো। তাই করলাম। কিছু সময়ের জন্য ওখানে ঘুমানোটা খুব একটা খারাপ লাগেনি। তখন স্টেশনে খুব একটা মানুষও ছিল না, কোলাহলও একদম ছিল না। তাছাড়া আমি আমার পাটাও সোজা করে রাখতে পারছিলাম। তবে ওটা নিয়ে বেশি কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই আমার। অভিজ্ঞতাটা খুব একটা ভালো ছিল না। ওটা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করলেই খুশি হবো। আসলেই। অভিজ্ঞতাটা শুনলে মানুষ হতাশ হতে পারে।
সকাল নয়টা পর্যন্তই ঘুমাতে পারলাম আমি, স্টেশনের ওয়েটিং রুমে তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ গিজগিজ করতে শুরু করেছিল। আমিও আর পা পুরোপুরি সোজা রেখে শুতে পারছিলাম না। পা মাটিতে রেখে তো আর আরামের ঘুম দেওয়া সম্ভব না। তাই উঠে বসলাম আমি। আমার তখনো মাথাব্যথা করছিল। রাতের থেকে ব্যথাটা আরো বেড়ে গিয়েছিল তখন। আর আমার মনে হয় আমি তখন আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি রকম হতাশ ছিলাম তখন।
আমি চাইনি, তবে তারপরো মি. আন্টোলিনির ব্যাপারে ভাবতে শুরু করলাম। ভাবছিলাম মিসেস অ্যান্টোলিনিকে তিনি আমার চলে যাওয়ার ব্যাপারে কী বলেছেন। যদিও ওটা নিয়ে আমার অতটা দুঃশ্চিন্তা ছিল না তখন। কারণ আমি জানতাম মি. অ্যান্টোলিনি খুবই বুদ্ধিমান লোক, তিনি মহিলাকে কিছু একটা বলে দিতে পারবেন। তিনি হয়তো বলেছেন আমি বাসায় ফিরে গেছি বা এমন কিছু। ওটা নিয়ে আমার অতটা ভাবনা ছিল না। তবে আমি তখন ভাবছিলাম ঘুম থেকে জেগে উঠে মি. অ্যান্টোলিনিকে আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলাতে দেখতে পেয়ে। মানে আমি কি আসলে ভেবেছিলাম যে তিনি হোমোদের মতো আচরণ করছেন? হয়তো হতে পারে তিনি ঘুমিয়ে থাকা মানুষদের মাথায় হাত বুলাতে পছন্দ করেন। মানে ওটা নিশ্চিতভাবে বলার কি কোনো উপায় আছে? না নেই। আমি এমনকি তখন এটাও ভাবছিলাম যে ব্যাগট্যাগ নিয়ে আমি আবার তাঁর বাসায় চলে যাবো। তাঁকে আমি এটাই বলে এসেছিলাম। এমনকি এটাও ভাবছিলাম যে তিনি যদি হোমোও হয়ে থাকেন, তারপরও আমার সাথে ভালোই আচরণ করেছেন। মানে গভীর রাতে তাকে ফোন দেওয়ার পরও তাতে তিনি কিছু মনে করেননি, এমনকি এটাও বলেছিলেন যে চাইলেই আমি তার ওখানে চলে আসতে পারি। তাছাড়া আমাকে তো তিনি অনেক উপদেশও দিয়েছেন। অনেক ভেবেই তো দিয়েছেন। এটা করতে তো উনার যথেষ্ট সময়ও খরচ হয়েছে। তাছাড়া জেমস ক্যাসল মারা যাওয়ার পর তিনিই একমাত্র মানুষ যে লাশের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। সবকিছু নিয়েই ভাবছিলাম তখন। যতই ভাবছিলাম ততই হতাশা বাড়ছিল আমার। মানে আমি তখন এটাই ভাবতে শুরু করেছিলাম যে আমার স্যারের বাসায় ফিরে যাওয়া উচিৎ। হয়তো তিনি আদর করেই আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছিলেন। যতই ওসব নিয়ে ভাবছিলাম ততই হতাশা বাড়ছিল আমার। ব্যাপারটা আরো খারাপ হয়ে গিয়েছিল যখন আমার চোখগুলো ব্যথা করা শুরু করল। ঘুম কম হওয়ার কারণে চোখ প্রচণ্ড জ্বলছিল তখন। তাছাড়া আমার বেশ ভালোই সর্দি লেগেছিল আর আমার সাথে কোনো রুমালও ছিল না। আমার স্যুটকেসে ছিল যদিও, তবে এতো মানুষের ভীড়ে তখন স্যুটকেস খুলতে তেমন একটা ইচ্ছা করছিল না।
বেঞ্চে আমার পাশেই একটা ম্যাগাজিন পড়ে ছিল। কেউ হয়তো ফেলে গিয়েছিল ওটা। কিছু করার না থাকায় ওটাই হাতে তুলে নিলাম। ভাবছিলাম যে ওটা পড়া শুরু করলে হয়তো মি. অ্যান্টোলিনিসহ অন্যান্য হাজার হাজার ভাবনাগুলো কিছু সময়ের জন্য ভুলে থাকতে পারবো আমি। তবে ম্যাগাজিনের একটা আর্টিকেল পড়া শুরু করতেই আরো বেশি খারাপ লাগতে শুরু করল আমার। আর্টিকেলটা ছিল হরমোন নিয়ে। ওখানে লেখা ছিল একজন মানুষকে দেখতে কেমন হওয়া উচিৎ, চেহারা ও চোখ কেমন হওয়া উচিৎ, যদি হরমোনগুলো সঠিক প্রকৃতিতে থাকে। আমাকে দেখতে তখন অতটা ভালো দেখাচ্ছিল না। সত্যি বলতে আর্টিকেলে থাকা ছবির বাজে হরমোনের লোকটার মতোই দেখাচ্ছিল আমাকে। তখন হরমোন নিয়ে দুঃশ্চিন্তা শুরু হলো আমার। তারপর একটা আর্টিকেল ছিল যেটাতে নিজে থেকেই নিজে ক্যান্সারে আক্রান্ত কিনা সেটার উপায় লেখা ছিল। ওটাতে লেখা ছিল যদি কারো মুখে কোনো ব্যথা থাকে এবং দ্রুত ঐ ব্যথা দূর না হয়, তাহলে ওটা হয়তো ক্যান্সারের একটা চিহ্নও হতে পারে। আমার ঠোঁটেও তখন দুই সপ্তাহ ধরে একধরনের ব্যথা করছিল। তাই ধরে নিলাম যে আমিও হয়তো ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে যাচ্ছি। ম্যাগাজিনের বেশির ভাগটাই আসলে হতাশাজনক লেখায় ভরা ছিল। তাই ম্যাগাজিনটা রেখে ওয়েটিং রুমে বাইরে হাঁটতে বেরুলাম আমি। তখন ভাবছিলাম ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হয়তো কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যাবো আমি। আসলেই এটা ভাবছিলাম। এমনকি এটা নিয়ে বেশ ইতিবাচকও ছিলাম। এটা নিয়ে অবশ্য আমার মন অতটা আশাব্যাঞ্জকও ছিল না। দিনটা দেখে মনে হছিল হয়তো বৃষ্টি হতে পারে, তারপরও আমি বাইরে হাঁটতে বেরুলাম। প্রথমত আমাকে নাস্তা করতে হবে। আমার তখন ক্ষুধা লাগেনি, তবে ভাবলাম যে আমার হয়তো অন্ততপক্ষে কিছু খাওয়া উচিৎ। অন্ততপক্ষে শরীরে কিছু ভিটামিন সরবরাহ করা উচিৎ। তাই পূর্ব দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। ওদিকে কিছু সস্তা মূল্যের খাবারের রেস্টুরেন্ট ছিল। আমার কাছে আসলে তখন বেশি টাকা ছিল না, তাই সস্তাগুলোর দিকেই পা বাড়ালাম আমি।
হেঁটে যাওয়ার সময় দেখলাম দুইজন লোক ট্রাক থেকে বিশাল বড়ো একটা ক্রিসমাস ট্রি নামাচ্ছে। নামানোর সময় এদের একজন আরেকজনকে বারবারই বলছিল, ‘ভালো করে ধর, শালা। ভালো করে ধররে, ভাই!’ নিশ্চিতভাবেই ক্রিসমাস ট্রি নিয়ে কথা বলার অন্যতম আকর্ষণীয় উপায় ছিল ওটা। ব্যাপারটা বেশ মজারও ছিল, অবশ্যই বাজে দিক দিয়ে। তবে তারপরও হাসতে শুরু করলাম আমি। আমার করা সবচেয়ে বাজে কাজ বোধহয় ওটাই ছিল, কারণ হাসতে শুরু করার সাথে সাথেই আমার মনে হলো যে আমি হয়তো বমি করতে যাচ্ছি। আসলেই। এমনকি প্রস্তুতও ছিলাম আমি, তবে বমি আর হয়নি। আমি জানি না কেন। মানে আমি তেমন অপরিষ্কার বা অস্বাস্থ্যকর কিছু তেমন একটা খাই না আর আমার পাকস্থলীও বেশ মজবুত। যাই হোক, বমি করার চেষ্টা বাদ দিয়ে ভাবলাম পেটে কিছু পড়লে আমার কিছুটা ভালো লাগবে। তাই খুবই সস্তাগোছের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ডোনাট আর কফি কিনলাম আমি। তবে ডোনাটগুলো খাইনি আমি। আমি আসলে ওগুলো গিলতে পারি না। আসলে ব্যাপারটা হলো, প্রচুর হতাশ থাকা অবস্থায় কোনো কিছু গেলা বেশ কঠিন হয়ে যায়। ওয়েটারটা যদি খুব ভালো ছিল। সে ডোনাটগুলো ফিরিয়ে নিয়েছিল, এমনকি আমার থেকে ডোনাটের জন্য কোনো টাকাও নেয়নি। আমি শুধু কফিটাই খেলাম। তারপর বেরিয়ে ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম আবার।
ওদিন ছিল সোমবার, ক্রিসমাসও খুব কাছে চলে এসেছিল, সব দোকানপাটই খোলা ছিল তখন। তাই ফিফথ অ্যাভিনিউয়ে হাঁটতে খুব একটা খারাপ লাগেনি। পুরো রাস্তাটায়ই ক্রিসমাসের ছাপ লেগেছিল যেন। রাস্তার প্রতিটা কোণা কোণাতেই সান্তা ক্লজের সাজে সেজে বেল বাজাচ্ছিল কয়েকজন। স্যালভেশন আর্মি গার্লরাও—যারা কোনো লিপস্টিক বা মেকআপ করে না—বেল বাজাচ্ছিল। আমি আসলে তখন আগের দিন নাস্তার সময় পরিচয় হওয়া দুই নানকে দেখার আশা করছিলাম, তবে কোথাও দেখতে পেলাম না তাদের। আমি জানতাম যে তাদেরকে দেখতে পাবো না, কারণ তারাই আমাকে বলেছিল যে তারা নিউইয়র্কে এসেছে স্কুল টিচার হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য, তবে তারপরও আমি তাদেরকে দেখার আশা করছিলাম। যাইহোক, শহরের কেন্দ্রস্থলের পুরোটাই ক্রিসমাসময় হয়েছিল তখন। হাজার হাজার বাচ্চা তাদের মায়েদের সাথে করে বাস থেকে নামছিল-উঠছিল, দোকানে ঢুকছিল-বেরুচ্ছিল। আমি আশা করছিলাম ফিবি যদি আমার পাশে থাকত। খেলনার দোকানে গিয়ে কোনো খেলনা জেদ করার মতো ছোটো সে না, তবে সেও দোকানে দোকানে গিয়ে ফাজলামো করতে, মানুষদের দিকে তাকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। এর আগের ক্রিসমাসে তাকে আমার সাথে করে ওখানে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে ব্লুমিংডেলে গিয়েছিলাম আমরা। একটা জুতোর দোকানে গিয়ে ফিবি এমন ভাব ধরেছিল যেন সে লেইস লাগানোর জন্য হাজার হাজার ছিদ্র থাকা হাই স্টর্ম জুতো চায়। বেচারা সেলসম্যান ঐদিন প্রায় পাগলই হয়ে গিয়েছিল। ফিবিকে প্রায় বিশ জোড়ার মতো জুতো দেখিয়েছিল লোকটা, আর প্রতিবারই জুতো পরানোর সময় লেইসগুলোও লাগাতে হচ্ছিল তাকে। খুবই বাজে একটা ট্রিক ছিল, তবে ফিবি প্রচণ্ড খুশি হয়েছিল এটাতে। শেষমেশ ঐদিন আমরা এক জোড়া মোকাসিন কিনেছিলাম শুধু। সেলসম্যান অবশ্য এতে বিরক্ত হয়নি। আমার মনে হয় লোকটা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল যে আমরা তার সাথে মজা করছি, কারণ ফিবি প্রতিবার অর্ডার করার সময় ফিক ফিক করে হাসছিল।
যাই হোক, আমি টাই পরা ছাড়াই ফিফথ অ্যাভিনিউ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম। তখন হুট করেই একটা ভুতুড়ে ব্যাপার ঘটতে শুরু করল আমার সাথে। আমি যতবারই ব্লক শেষে ফুটপাথের ধারের বাইরে পা রাখছিলাম ততবারই আমার মনে হচ্ছিল যে আমি হয়তো কখনোই রাস্তার অন্য পাশে পৌঁছাতে পারবো না। আমার মনে হচ্ছিল রাস্তায় নামলে হয়তো আমি তলিয়ে যাব এবং কেউই আমাকে দেখতে পাবে না। খোদা, আসলেই এতে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। কতটা ভয় পেয়েছিলাম তা বলে বুঝাতে পারবো না। প্রচণ্ড রকমের ঘামতে শুরু করেছিলাম আমি তখন। যতবারই ব্লকের শেষপ্রান্তে গিয়েছি ততবারই মনে হচ্ছিল আমি আমার ভাই এলির সাথে কথা বলছি। আমি তাকে বলছিলাম, ‘এলি, আমাকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দিও না। এলি, আমাকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দিও না। প্লিজ, এলি।’ আর অদৃশ্য না হয়ে রাস্তার অপর পাশে পৌঁছেই তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলাম। পরের কোনায় গিয়েও এই ব্যাপারটাই ঘটছিল। তারপরও আমি হাঁটা থামাচ্ছিলাম না। মনে হয় আমি আসলে থামতে ভয় পাচ্ছিলাম তখন। আমার আসলে মনে নেই তেমন ভালো করে। আমার এটুকু মনে আছে যে হাঁটা থামিয়েছিলাম চিড়িয়াখানার পরে থাকা সিক্সটিজে গিয়ে। ওখানে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসলাম। আমি আসলে তখন ভালো করে শ্বাসই নিতে পারছিলাম না। ঘামছিলাম দরদর করে। ওখানে বোধহয় প্রায় ঘণ্টাখানেক বসেছিলাম আমি। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাব, আমি কখনো বাসায় ফিরে যাবো না, কখনো কোনো স্কুলে যাবো না। সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি ফিবির সাথে শেষবারের মতো দেখা করে তাকে বিদায় জানিয়ে তার ক্রিসমাসের টাকাটা ফেরত দিয়ে পশ্চিমের কোনো অঞ্চলে চলে যাবো। প্ল্যান করলাম যে হল্যান্ড টানেলে গিয়ে একটা রাইডে উঠে যাত্রা শুরু করবো, ঐ রাইড শেষে আরেক রাইডে উঠব, ওটার শেষে আরেকটায়… এভাবে কয়েকদিন ধরে রাইড পালটে পালটে গেলে হয়তো আমি পশ্চিমের কোনো সুন্দর জায়গায় পৌছে যাবো—যেখানে থাকবে সূর্যের আলো, রোদ, কেউ আমাকে চিনবে না এবং আমার একটা চাকরি থাকবে। ভাবছিলাম আমি হয়তো ওখানের কোনো ফিলিং স্টেশনে মানুষের গাড়িতে গ্যাস-তেল ভরার কাজ করতে পারবো। আসলে কী করবো সেটা নিয়ে আমার অতটা দুঃশ্চিন্তা ছিল না। শুধু একটা জায়গা হলেই হবে যেখানে কেউ আমাকে চিনবে না এবং আমিও কাউকে চিনবো না। প্ল্যান করেছিলাম ওরকম কোথায় গিয়ে আমি কালা-বোবার মতো অভিনয় করে থাকবো। এতে করে কোনো মানুষের সাথেই আমাকে অনর্থক আলাপচারিতায় মত্ত হওয়া লাগবে না। আর কেউ যদি আমাকে কিছু বলতে চায় তাহলে তাকে তা বলতে হবে কাগজে লিখে, আর এই কাজটা কয়েকবার করার পরই তারা আমার সাথে কথা বলার আগ্রহ পাবে না। এতে করে সারাজীবনের জন্যই মানুষের সাথে কথা বলা থেকে মুক্ত হয়ে যাবো আমি। সবাই হয়তো আমাকে বেচারা কালা-বোবা প্রতিবন্ধী ভেবে আমাকে বিরক্ত করা থেকেও দূরে থাকবে। তারা তাদের ফালতু গাড়িতে তেল-গ্যাস ভরার জন্য আমাকে টাকা দেবে আর ঐ টাকা জমিয়ে আমি কোথাও একটা ছোটো কুটির বানাবো। কুটির বানিয়ে সারাজীবন থাকবো ঐ কুটিরেই। জঙ্গলের ধারে বানাবো কুটিরটা, তবে জঙ্গলের মধ্যে যাবো না, কারণ আমার ছায়ায় থাকার ইচ্ছা নেই, আমার পুরোটা সময় রৌদ্রজ্জ্বল পরিবেশে থাকার ইচ্ছা রয়েছে। আমি নিজেই নিজের খাবার রান্না করবো, হয়তো একসময় বিয়েও করবো। হয়তো ওখানে কোনো বোবা-কালা মেয়ের সাথে পরিচয় হবে আমার, ওকেই বিয়ে করবো। অন্য সব স্ত্রীদের মতো সেও থাকবে আমার সাথে আমার ঐ ছোটো কেবিনে। যদি আমাদের কোনো বাচ্চা হয়, তাহলে আমরা ওকে কোথাও লুকিয়ে রাখবো। তাদেরকে অনেক অনেক বই কিনে দিবো আমরা, নিজেরাই তাদেরকে কীভাবে পড়তে ও লিখতে হয় তা শেখাবো।
ওসব ভাবতে ভাবতে প্রচুর আনন্দিত হয়ে উঠেছিলাম আমি। আসলেই। আমি জানি যে বোবা-কালার অভিনয়ের প্ল্যানটা একটু পাগলাটে, তারপরও আমার ওটাই বেশি ভালো লাগছিল। আমি আসলেই পশ্চিমেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যাওয়ার আগে আমি শুধু ফিবিকে একবার গুডবাই বলতে চাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই রাস্তা ধরে পাগলের মতো ছুট লাগালাম আমি। সত্যি বলতে দৌড়াতে গিয়ে কয়েকবার আরেকটু হলেই মরতে বসেছিলাম আমি। দৌড়ে স্টেশনারি দোকানে গিয়ে পেন্সিল আর প্যাড কিনে নিলাম আমি। ভাবলাম যে আমি তাকে নোট লিখে জানাবো আমাকে বিদায় জানানোর জন্য এবং তার ক্রিসমাসের টাকা নেওয়ার জন্য ফিবিকে কোথায় আসা লাগবে। তারপর কোনোভাবে নোটটা কাউকে দিয়ে তার স্কুলের প্রিন্সিপালের কাছে পাঠিয়ে দিবো যেন তারা ফিবিকে নোটটা দেয়। তবে প্যাড আর পেন্সিলটা পকেটে ভরে দ্রুত গতিতে পা বাড়ালাম ফিবির স্কুলের দিকে। আমি আসলে এতোটা উত্তেজিত হয়েছিলাম যে স্টেশনারি দোকানে বসে নোট লিখতে ইচ্ছা করছিল না আমার। আমি দ্রুত পায়ে হাঁটছিলাম কারণ আমি চাচ্ছিলাম নোটটা যেন ফিবির হাতে লাঞ্চে বাসায় যাওয়ার আগেই পৌঁছায়, আর আমার হাতেও খুব একটা সময় ছিল না।
আমি জানতাম তার স্কুল কোথায়। ছোটোবেলায় আমিও ঐ স্কুলেই পড়েছি। তবে স্কুলে পৌঁছে অদ্ভুত লাগা শুরু করল আমার। আমি নিশ্চিত ছিলাম স্কুলের ভেতরের পরিবেশটা আমার মনে আছে কি না, তবে আমার ভালোভাবেই মনে ছিল। আমি পড়ার সময় স্কুলটা যেমন ছিল, তখনও ঐ একইরকমই ছিল। স্কুলের ভেতরে বিশাল একটা খোলা চত্বর আছে, যেটা সমসময় অন্ধকার হয়ে থাকে। বল খেলার সময় লাইটে যেন বল না লাগে সেজন্যই লাইটগুলো ছোটো ছোটো খোপ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। সেজন্যই চত্বরটা সবসময়ই অন্ধকার হয়ে থাকে। তখনও খেলাধূলার জন্য মেঝেগুলোতে সাদা বৃত্ত এঁকে রাখাছিল, বাস্কেটবল রিংটা তখনো নেট ছাড়াই ছিল।
স্কুলের আশেপাশে কাউকেই দেখতে পাচ্ছিলাম না। সম্ভবত তখনো হয়তো ছুটির পিরিয়ড শুরু হয়নি, আর তখন লাঞ্চের সময়ও হয়নি। শুধু একটা কৃষাঙ্গ ছেলেকেই দেখতে পেয়েছিলাম তখন। বাথরুমের দিকে যাচ্ছিল ছেলেটা। ছেলেটার পকেটে একটা পাস দেখা যাচ্ছিল। আমাদের সময়ও এই পাসটাই ছিল। এই পাসটা থাকার অর্থ হচ্ছে ছেলেটার বাথরুমে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে।
আমি তখনো ঘামছিলাম, তবে অতটা নয়। সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে নিচের ধাপটায় বসে প্যাড আর পেন্সিল বের করে আনলাম আমি। সিঁড়ির ঘ্রাণটা তখনো আমি পড়ার সময়ের মতোই ছিল। মনে হচ্ছিল যে কেউ হয়তো মাত্র ওখানে প্রস্রাব করে গেছে। স্কুলের সিঁড়িগুলোতে সবসময়ই এরকম গন্ধই থাকে। যাই হোক, আমি ওখানে বসে নোটে লিখলাম,
ডিয়ার ফিবি,
আমি আর বুধবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবো না, তাই আমাকে আজ বিকালেই পশ্চিমের দিকে যাত্রা শুরু করতে হবে। যদি পারো সোয়া বারোটায় আমার সাথে দেখা করে তোমার ক্রিসমাসের টাকাটা নিয়ে যেও। খুব বেশি খরচ করিনি। আর্ট মিউজিয়ামের দরজার পাশেই থাকবো আমি।
লাভ,
হোল্ডেন।
তার স্কুলটা আসলে বলতে গেলে মিউজিয়ামের ঠিক পাশেই ছিল। আর লাঞ্চে বাসায় যাওয়ার সময়ও তাকে এই মিউজিয়াম অতিক্রম করেই যাওয়া লাগবে। তাই আমি জানতাম যে সে ঠিকই আমার সাথে দেখা করবে।
নোট লেখা শেষে আমি সিঁড়ি ধরে পা বাড়ালাম প্রিন্সিপালের অফিসের দিকে, যাতে আমি কাউকে দিয়ে নোটটা ফিবির হাতে পৌঁছে দিতে পারি। আমি নোটটায় প্রায় দশটা ভাঁজ দিয়েছিলাম যাতে ফিবির কাছে পৌঁছার আগ পর্যন্ত কেউ ওটা খুলে পড়ে না দেখে। স্কুলগুলোতে আসলে কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। তবে আমি জানি তারা ঠিকই নোটটা ফিবির হাতে তুলে দেবে কারণ আমি তার ভাই।
সিঁড়ি ধরে ওপরে ওঠার সময় আমার আবারো মনে হলো যে আমি হয়তো বমি করতে যাচ্ছি। তবে ঐবারও বমি হয়নি। হাঁটা থামিয়ে কয়েক সেকেন্ড সিঁড়িতে বসে রইলাম। সিঁড়িতে বসে থাকায় আবারো ভালো লাগতে শুরু করেছিল আমার। তবে বসে থাকা অবস্থায় আমি এমন একটা জিনিস দেখলাম যেটায় আমার মাথা প্রায় নষ্ট হওয়ার অবস্থা। কেউ দেওয়ালে ‘ফাক ইউ’ লিখে রেখেছে। এটা দেখে প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়েছিলাম আমি। শুধু ভাবছিলাম ফিবি ও অন্যান্য বাচ্চারা এই লেখাটা দেখে আসলে কী ভেবেছিল। হয়তো তারা এটার মানে জানারও চেষ্টা করেছে, শেষমেশ হয়তো কোনো অশ্লীল বাচ্চা তাদেরকে এটা ভেঙে বলেছে। অর্থ জানার পর হয়তো তারা অর্থটা নিয়ে ভেবেছে, পারলে হয়তো কয়েকদিন ঐদিন অর্থটা নিয়ে চিন্তা করেছে। আমার আসলে তখন দেওয়ালে ঐ কথা লেখা মানুষটাকে মারতে ইচ্ছা করছিল। আমার ধারণা এটা হয়তো রাতের বেলা স্কুলে প্রস্রাব করতে ঢোকা হারামজাদা বিকৃতকামী লিখেছিল। আমি তখন কল্পনা করছিলাম, লোকটার ঘাড়ে ধরে আমি ক্রমাগত তার মাথা পাথরের ওপর আছড়ে ফেলছি। আমি নিজেও জানি আমার ঐ কাজ করার সাহস নেই। আমি জানতাম সেটা। এটায় আরো খারাপ লাগতে শুরু করল আমার। সত্যি বলতে, আমার তো আসলে হাত দিয়ে দেওয়ালের লেখাটা মুছে দেওয়ারও সাহস ছিল না। ভয় পাচ্ছিলাম লেখাটা মোছার সময় কোন শিক্ষক হয়তো আমাকে দেখে ফেলবে, আর ভাববে আমিই ঐ লেখাটা লিখেছি। তবে যাইহোক, শেষমেশ লেখাটা মুছেই ফেললাম। তারপর আবার পা বাড়ালাম প্রিন্সিপালের অফিসের দিকে।
প্রিন্সিপালকে রুমে দেখা গেলো না, তবে টাইপরাইটার নিয়ে একশো বছরের এক বুড়ি বসে ছিল রুমটায়। মহিলাকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম যে আমি ৪বি-১-এ পড়া ফিবি কলফিল্ডের ভাই। তাকে বললাম যে সে যেন আমার নোটটা ফিবিকে পৌঁছে দেয়। সাথে এটাও যোগ করলাম যে নোটটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমার মা খুবই অসুস্থ থাকায় ফিবির জন্য লাঞ্চ তৈরি করতে পারেনি। তাকে বলবেন যে সে যেন আমার সাথে দেখা করে, ড্রাগস্টোরে লাঞ্চ করবো আমরা। বৃদ্ধা মহিলা খুবই ভালো ছিল। আমার হাত থেকে নোটটা নিয়ে সে আরেক মহিলাকে দিয়ে ফিবির ক্লাসে পাঠিয়ে দিলো নোটটা। এরপর কিছুক্ষণ বৃদ্ধার সাথে আলাপচারিতা করলাম আমি, তাকে বললাম যে আমি আর আমার ভাইয়েরাও এই স্কুলেই পড়েছি। মহিলা আমকে জিজ্ঞেস করল আমি এখন কোন স্কুলে পড়ছি। আমি জানালাম যে পেন্সিতে। জবাবে মহিলা বলল পেন্সি নাকি খুবই ভালো একটা স্কুল। যদিও আমি চাচ্ছিলাম মহিলার ভুলটা ভাঙিয়ে দিতে, তবে সাহসে কুলাচ্ছিল না। আর তাছাড়া মহিলা যেহেতু পেন্সিকে ভালো স্কুল ভাবে, মহিলা সেটাই না হয় ভাবুক। একশো বছরের পুরোনো কাউকে নতুন কিছুর ব্যাপারে বলাটা খুবই কঠিন। যাইহোক, কিছুক্ষণ কথা বলে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত ছিল। আমি বেরিয়ে আসার সময় মহিলা পিছন থেকে আমাকে ডেকে বলল, ‘গুড লাক!’ আমি পেন্সি থেকে বেরিয়ে আসার সময় স্পেন্সারও আমাকে এটাই বলেছিল। কোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার সময় কারো ‘গুড লাক’ বলাটা আমি একদমই সহ্য করতে পারি না। আমার কাছে খুবই বাজে লাগে এই ব্যাপারটা।
নামার সময় অন্য একটা সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। ঐ সিঁড়ির দেওয়ালেও ‘ফাক ইউ’ লেখা ছিল। আমি এটাও হাত দিয়ে মুছে ফেলতে চেয়েছিলাম, তবে ঐ লেখাটা চাকু বা ধাঁরালো কিছু দিয়ে খোঁদাই করে লেখা ছিল। ওটা মোছার কোনো উপায় ছিল না। আর তাছাড়া ঐ লেখা মোছার চেষ্টাটা বৃথা চেষ্টা ছাড়া আর কিছু না। লক্ষ লক্ষ বছর হাতে নিয়ে মুছতে শুরু করলেও পৃথিবীর অর্ধেক ‘ফাক ইউ’ লেখা মোছাও সম্ভব না। এটা প্রায় অসম্ভব।
চত্বরের ঘড়ির দিকে তাকালাম আমি। বারোটা বাজতে তখনো আরো বিশ মিনিট বাকি। ফিবির সাথে দেখা করার আগে হাতে তখন প্রচুর সময় ছিল। তবে আমি হেঁটে শুধু মিউজিয়ামের দিকেই গেলাম। আমার আসলে তখন যাওয়ার মতো অন্য কোনো জায়গা ছিল না। ভেবেছিলাম একবার হয়তো থেমে ফোন বুথ থেকে জেন গ্যালাহারকে কল করবো। তবে কল করার মুড ছিল না। কারণ, আমি তখনো নিশ্চিত ছিলাম না ছুটিতে সে বাসায় এসেছে কিনা। তাই আমি মিউজিয়ামে গিয়ে ঘুরে দেখতে লাগলাম।
মিউজিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে ফিবির জন্য অপেক্ষা করার সময় দুটো বাচ্চা ছেলে মিউজিয়ামের দিকে এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল মমিগুলো কোথায় আছে তা আমি জানি কি না। যে ছেলেটা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার প্যান্টের বোতাম খোলা ছিল। আমি তাকে সেটা বললাম। সে আমার সামনে দাঁড়িয়েই প্যান্টের বোতামটা লাগালো। ঘুরে পিছন ফেরার প্রয়োজন মনে করল না সে। দৃশ্যটা দেখে প্রচুর হাসি পাচ্ছিল আমার। তবে আবার বমি বমি লাগতে পারে ভেবে হাসলাম না আমি। ‘মমিগুলো কোথায় আছে, ভাই?’ বাচ্চাটা আবারো জিজ্ঞেস করল। ‘আপনি জানেন?
বাচ্চা দুটোর সাথে কিছুক্ষণ মজা নিলাম আমি। ‘মমি? এগুলো আবার কী? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘ঐ তো, মমি, মানে মরা মানুষ। ঐ যে তাদেরকে টুনের ভেতর কবর দেওয়া হয়েছিল।’
টুন! হাহাহা! শব্দটা শুনে প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছিল আমার। সে আসলে টুম্ব বলতে চেয়েছিল।
‘তোমরা স্কুলে যাওনি কেন?’ আমি বললাম।
‘আজকে স্কুল নেই,’ বলল ছেলেটা। ঐ ছেলে একাই শুধু কথা বলছিল তখন আমার সাথে। আমি একদম নিশ্চিত যে সে আমার সাথে মিথ্যা বলছিল। যাইহোক, যেহেতু ফিবি আসার আগ পর্যন্ত আমার হাতে প্রচুর সময় ছিল, তাই আমি তাদেরকে সাথে নিয়ে মমি থাকা এক্সিবিশনটা খোঁজা শুরু করলাম। একসময় আমি জানতাম মমিগুলো ঠিক কোন জায়গায় আছে। তবে বহু বছর মিউজিয়ামে যাইনি আমি।
‘তোমাদের মমির প্রতি আগ্রহ আছে?’ আমি বললাম।
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার বন্ধু কি কথা বলতে পারে না?’
ও আমার বন্ধু না। ও আমার ভাই।’
‘সে কি কথা বলতে পারে না?’ বলে কথা না বলা ছেলেটার দিকে তাকালাম
আমি। ‘তুমি কি কথা বলতে পারো না?’
‘পারি,’ সে বলল, ‘তবে বলতে ইচ্ছা করে না তেমন।’
শেষমেশ মমি থাকা রুমটা খুঁজে পেলাম আমরা।
‘তোমরা কি জানো মিশরীয়রা কীভাবে তাদের মৃতদের সমাহিত করত?’ রুমের ভেতর ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘না।’
‘তো, তোমাদের এটা অবশ্যই জানা উচিৎ। তারা একটা গোপন কেমিক্যাল মেশানো কাপড় দিয়ে লাশগুলোর মুখ পেঁচিয়ে দিতো, যাতে করে হাজার হাজার বছর সমাধিতে থাকলেও যেন তাদের চেহারা নষ্ট না হয়। মিশরীয়রা ছাড়া কেউই এই প্রক্রিয়াটা জানে না। এমনকি আধুনিক বিজ্ঞানও না।’
মমির কক্ষে যেতে হলে একটা সরু হলের ভেতর দিয়ে যাওয়া লাগে, যেটা আবার সরাসরি ফারাওয়ের সমাধির ঠিক মাঝখান দিয়ে। ওখানের পরিবেশটা অনেকটা ভুতুড়ে ছিল। আমার সাথে থাকা দুই হোমড়া-চোমড়াকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে তারা জায়গাটা খুব একটা ভালো করে উপভোগ করতে পারছে না। তারা যতটা পারে আমার সাথেই লেগেছিল। কথা কম বলা ছেলেটা তো বলতে গেলে আমার হাত খাবলে ধরে রেখেছিল। ‘চলো,’ তার ভাইকে বলল ছেলেটা, ‘আমি আগেই দেখেছি এসব। এখন চলো বেরিয়ে যাই।’ বলে ঘুরে দৌড় লাগালো ছেলেটা।
‘আমাকেও যেতে হবে, নাহলে মাইলখানেক দূরে চলে যাবে ও,’ অন্য ছেলেটা বলল। ‘ভালো থাকবেন!’ বলে সেও দৌড় লাগালো।
আমি একাই শুধু রয়ে গিয়েছিলাম ঐ সমাধিতে। আর আসলে পরিবেশটা বেশ ভালো লাগছিল। জায়গাটা শান্ত ছিল। তারপর হুট করে চোখ পড়লো দেওয়ালের দিকে। আরেকটা ‘ফাক ইউ’ লেখা রয়েছে দেওয়ালে। কাঁচের নিচে পাথরে কেউ একজন লাল ক্রেয়ন বা কিছু দিয়ে লিখে রেখে গেছে ওটা।
এটাই হলো সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। দুনিয়াতে কোথাও কোনো শান্ত ও চমৎকার পরিবেশের জায়গা খুঁজে পাওয়া সম্ভব না, কারণ এরকম কোনো জায়গায়ই নেই। কেউ হয়তো ভাবতে পারে যে আছে, কিন্তু একবার ঐ জায়গায় গিয়ে এক মুহুর্তের জন্য সতর্ক হলেই দেখা যাবে কেউ একজন চুপিসারে এসে নাকের নিচে ‘ফাক ইউ’ লিখে চলে গেছে। আমার তো মনে হয় আমি মারা যাওয়ায় আমাকে কবরে ঢুকিয়ে রাখবে আমার আত্মীয়রা, কবরের ওপর একটা ফলকে লেখা রাখবে আমার নাম ‘হোল্ডেন কলফিল্ড’, জন্মের তারিখ, মৃত্যুর তারিখ আর ঠিক নিচেই লেখা থাকবে ‘ফাক ইউ’। আমি নিশ্চিত এমনটাই হবে।
মমির সমাধি থেকে বেরিয়ে আসার পরই বাথরুমে যাওয়ার চাপ লাগলো আমার। সত্যি বলতে আমার আসলে ডায়রিয়া হয়ে গিয়েছিল। ডায়রিয়া নিয়ে আসলে আমার তেমন সমস্যা নেই, তবে এর সাথে অন্য কিছুও ঘটেছিল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় দরজার কাছে আসতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। কপাল ভালো যে সরাসরি মেঝেতে হুমড়ে পড়িনি আমি, তাহলে মরেই যেতাম। পাশ ফিরে পড়েছিলাম বলে কোনোরকমে বেঁচে গেছি। ব্যাপারটা একটু বেশ অদ্ভুতই ছিল। অবশ্য এরপর জ্ঞান ফেরার পর থেকে আমার বেশ ভালোই লাগা শুরু করেছিল। আসলেই। পড়ে যাওয়ার কারণে আমার হাত কিছুটা ব্যথা করছিল ঠিকই, তবে আমার মাথায় আর ঝিমঝিম ভাবটা ছিল না তখন।
ততক্ষণে প্রায় বারোটা দশ বেজে গিয়েছিল, তাই উঠে তাড়াতাড়ি করে দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ফিবির অপেক্ষা করা শুরু করলাম। আমি ভাবছিলাম তাকে হয়তো ঐবারই আমি শেষবারের মতো দেখতে যাচ্ছি। মানে আমি ধরে নিয়েছিলাম যে অনেকবছরের মধ্যে ওটাই হয়তো শেষবার আমার কোনো আত্মীয়ের সাথে দেখা হচ্ছে। হয়তো বয়স পঁয়ত্রিশ হলে আমি আবার বাসায় ফিরে আসবো। ধরে নিয়েছিলাম কেউ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর আগে আমাকে দেখতে চাইলে হয়তো আরেকবার দেখা হবে, তবে এই কারণে আমি আমার ক্যাবিন ছেড়ে একেবারে চলে আসবো না। আমি এমনকি আমি ফিরে আসলে দৃশ্যটা কেমন হবে সেটাও কল্পনা করতে শুরু করেছিলাম। আমি জানি আমার মা আমাকে দেখেই পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করেছে, কাঁদতে কাঁদতে বারবার আমাকে বলছে যেন আমি আরেকবার চলে না যাই, তারপরও আমি ঠিকই আবার চলে যাবো। খুব শান্তভাবে মাকে শান্ত করে কান্না থামিয়ে বসিয়ে রেখে রুমের অন্যপাশে গিয়ে খুবই মার্জিত ভঙ্গিতে সিগারেট টানবো। তাদেরকে সৌজন্যতার সুরে বলবো যে তারা চাইলে যে কোনো সময় আমার ক্যাবিনে যেতে পারবে, তবে আমি এটা নিয়ে তেমন একটা জোর করবো না। তবে ফিবিকে ঠিকই প্রতি গ্রীষ্ম, ক্রিসমাস এবং ইস্টারের ছুটিতে আমার ওখানে ঘুরতে যেতে বলবো। এমনকি ডি.বি.কেও বলবো যেন সে আমাকে দেখতে যায়, সে চাইলে আমার ওখানের শান্ত পরিবেশে বসে লিখতেও পারবে, তবে আমি তাকে আমার ক্যাবিনে বসে মুভি লিখতে দিবো না। সে শুধু গল্প আর বইই লিখতে পারবে। আমার ওখানে একটা নিয়ম থাকবে যে ওখানে কোনো লোক দেখানো বা ধাপ্পাবাজির কাজ করা যাবে না। যদি কেউ এমনটা করার চেষ্টা করে তাহলে সে ওখানে থাকতে পারবে না।
হঠাৎ করেই চেকরুমে ঘড়িতে চোখ পড়তেই দেখি তখন একটা পঁচিশ বাজে। আমার তখন ভয় লাগছিল যে অফিসের ঐ বৃদ্ধা মহিলা হয়তো ফিবিকে নোটটা না দেওয়ার নির্দেশ করেছিল অন্য মহিলাটাকে। ধারণা করছিলাম মহিলা হয়তো নোটটা পুড়িয়ে ফেলতে বলেছিল। ব্যাপারটায় আসলেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। আমি আসলে যাওয়ার আগে ফিবিকে শুধু একবার দেখতে চাচ্ছিলাম। মানে তার ক্রিসমাসের টাকাগুলো তো আমার কাছে, ওগুলো তাকে দিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম।
অবশেষে ফিবিকে দেখতে পেলাম আমি। দরজার কাঁচের স্বচ্ছ অংশ দিয়ে তাকে দেখতে পেলাম। তাকে আমার চোখে পড়েছিল কারণ তার মাথায় তখন আমার দেওয়া লাল শিকারি টুপিটা পরা ছিল। দশ মাইল দূর থেকেও ঐ টুপিটা ঠিকই চোখে পড়বে।
তার সাথে দেখা করার জন্য দরজার কাছে গিয়ে পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম আমি। তার সাথে একটা বড়ো স্যুটকেস ছিল। আমি আসলে এটাই বুঝতে পারছিলাম না। ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের অপর প্রান্ত থেকে বিশাল একটা স্যুটকেস টেনে আসছিল ও। ব্যাগটা টানতে বিশাল কষ্ট হচ্ছিল তার। একটু কাছে আসার পর দেখি সে আসলে আমার একটা পুরোনো স্যুটকেস নিয়ে আসছে। হুটনে থাকতে আমি ঐ স্যুটকেসটা ব্যবহার করতাম। একদমই বুঝতে পারছিলাম না যে সে আসলে কী করছে। ‘হাই,’ কাছে এসে বলল ফিবি। বিশাল স্যুটকেস টেনে এনে হাঁপাচ্ছিল তখন ও।
‘আমি তো ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আসবে না,’ আমি বললাম। ‘এই ব্যাগের ভেতরে কী? আমার তো কিছু লাগবে না। আমি তো সাথে করে কিছুই নিবো না। এমনকি স্টেশনে থাকা আমার ব্যাগগুলোও নিবো না। ব্যাগের ভেতরে করে কী এনেছো?’
ফিবি স্যুটকেসটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘আমার কাপড়-চোপর। আমি তোমার সাথে যাবো। আমাকে নেবে না?
‘কী?’ আমি বললাম। তার কথা শুনে আমার প্রায় উলটে পড়ে যাওয়ার দশা হয়েছিল। সত্যি বলছি, আসলেই দাঁড়ানো থেকে পড়ে যেতে নিয়েছিলাম আমি। মাথাও আবার ঝিমঝিম করতে শুরু করেছিল, মনে হচ্ছিল আমি হয়তো আবারো অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবো।
‘যাতে শার্লিন দেখতে না পায় সেজন্য পিছনের এলিভেটরে করে নামিয়েছি এটা। এতটা ভারীও না। ব্যাগে মাত্র দুটো ড্রেস আর আমার মোকাসিন, মোজা আর কিছু জিনিস রয়েছে। ধরে দেখো। এতোটা ভারী না। একবার ধরে দেখো… তোমার সাথে যেতে পারবো না আমি? হোল্ডেন? প্লিজ!’
‘না। শাট আপ।’
আমার মনে হচ্ছিল আমি হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেছি। মানে আমি আসলে তাকে ‘শাট আপ’ বলতে চাইনি, তবে আমার মনে হচ্ছিল আমি আবারো অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি।
‘কেন আসতে পারবো না? প্লিজ, হোল্ডেন। আমি কিছুই করবো না… শুধু তোমার সাথে যাবো। তুমি না চাইলে আমি সাথে করে আমার কোনো পোষাকও নিবো না। আমি শুধু আমার…’
‘তুমি সাথে করে কিছুই নিতে পারবে না। কারণ তুমি আমার সাথে যাচ্ছো না। আমি একা যাব। তো, এখন চুপ করো।’
‘প্লিজ, হোল্ডেন। প্লিজ, নিয়ে যাও আমাকে। আমি খুবই খুবই খুবই… আমি এমনকি…’
‘তুমি আমার সাথে যাচ্ছো না। এখন চুপ করো! ব্যাগটা দাও,’ বলে তার কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিলাম আমি। আমি আরেকটু হলেই তাকে মারতে বসেছিলাম। আসলেই।
কাঁদতে শুরু করল ফিবি।
‘আমি তো জানতাম তোমার স্কুলের নাটকে অংশ নেওয়ার কথা ছিল, নাটকে তোমার বেনেডিক্ট আর্নল্ডের ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ছিল,’ আমি বললাম। খুবই কড়া ভাষায় বললাম আমি। ‘তুমি কী করতে চাও? নাটকে থাকতে চাও না?’ ওটা শুনে তার কান্নার গতি আরো বাড়তে শুরু করল। আমি খুশি ছিলাম তাতে। হুট করেই আমার মনে হলো সে যেন একবারে কেঁদে তার চোখ একদম শুকিয়ে ফেলে। আমি আসলে তাকে প্রায় ঘৃণা করছিলাম তখন। আমার মনে হয় আমি আসলে তাকে বেশি ঘৃণা করছিলাম, সে নাটকটায় বাধা দিতে চায় বলে।
‘চলো,’ বলে আমি আবারো মিউজিয়ামের দিকে পা বাড়ালাম। আমি ভাবছিলাম চেকরুমে গিয়ে স্যুটকেসটা খুলে দেখবো সে এটা ভেতরে করে কী নিয়ে এসেছে, ফিবিকেও এটা ফেরত দিবো তিনটায় স্কুল ছুটির পর। আমি জানি সে ওটা সাথে নিয়ে স্কুলে যেতে পারবে না। ‘আসো এখন,’ আমি বললাম।
তবে সে আমার সাথে করে মিউজিয়ামের দিকে আসছিল না। আমি ঠিকই ওপরে উঠে চেকরুমে গিয়ে ব্যাগটা চেক করে দেখে আবার নিচে নেমে গেলাম। গিয়ে দেখি সে তখনো রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তবে আমি কাছে পৌঁছাতেই সে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। সে ওটা করতেই পারে। তার ইচ্ছা করলে সে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই পারে। ‘আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমার মন বদলে ফেলেছি। তো এখন কান্নাকাটি বন্ধ করো,’ আমি বললাম। মজার ব্যাপারটা হলো আমি কথাটা বলার সময় সে কাঁদছিলই না। তারপরও বললাম আমি। ‘এখন চলো। তোমাকে স্কুলে দিয়ে আসি। চলো, নাহলে দেরি হয়ে যাবে তোমার।’
সে কোনো জবাব দিলো না। আমি কোনরকমে তার হাত ধরার চেষ্টা করলাম, তবে সে ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো হাতটা। যতই চেষ্টা করছিলাম ততই আমার থেকে সরে যাচ্ছিল।
‘লাঞ্চ করেছো?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
এবারও কোনো জবাব দিলো না। জবাবের বদলে আগের রাতে আমার দেওয়া লাল টুপিটা মাথা থেকে খুলে ছুড়ে মারলো আমার মুখে। তারপর আবার আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ব্যাপারটায় আমার হাসি চলে আসছিল প্রায়, তবে কিছুই বললাম না আমি। টুপিটা তুলে শুধু কোটের পকেটে ভরে রাখলাম।
‘হেই, চলো। আমি তোমাকে স্কুলে নিয়ে যাবো,’ আমি বললাম।
‘আমি স্কুলে ফিরে যাবো না।’
আমি বুঝতে পারছিলাম না তখন তার কথার জবাবে আমার কী বলা উচিৎ ছিল। ওভাবেই কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলাম শুধু আমি।
‘তোমাকে স্কুলে ফিরে যেতে হবে। তুমি না ঐ নাটকটাতে থাকতে চেয়েছিলে? বেনেডিক্ট আর্নল্ড হতে চেয়েছিলে?’
‘না।’
‘অবশ্যই চেয়েছিলে। নিশ্চয়ই চেয়েছিলে। এখন চলো,’ আমি বললাম। ‘সত্যি বলছি আমি কোথাও যাবো না। সত্যি বলছি। আমি বাসায় যাব। তোমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েই আমি বাসায় চলে যাবো। তবে এর আগে আমাকে স্টেশন থেকে ব্যাগ নিয়ে আসতে হবে। ব্যাগগুলো এনে সোজা চলে যাবো—’
‘আমি তো বলেছিই আমি স্কুলে ফিরে যাবো না। তোমার যা ইচ্ছা তুমি করো, তবে আমি স্কুলে ফিরে যাবো না,’ ফিবি বলল। ‘এখন তুমি চুপ থাক। ‘ এই প্রথমবার সে আমাকে চুপ করে থাকতে বলেছে। কথাটা বেশ রুক্ষও ছিল। ওটাকে আসলে গালির থেকে বেশি রুক্ষ মনে হচ্ছিল। সে তখনো আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছিল না। যতবারই আমি তার হাত বা কাঁধে ধরতে চাচ্ছিলাম ততবারই সে আমার হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিচ্ছিল।
‘আচ্ছা, তাহলে চলো হাঁটি। হাঁটতে পারবে?’ আমি বললাম। ‘চিড়িয়াখানা পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার ইচ্ছা আছে? তুমি যদি বিকালে স্কুলে ফিরে না ই যাও, তাহলে চলো হাঁটি। এখন কি এই পাগলামিটা বন্ধ করবে?’
সে তারপরও আমার কোনো উত্তর দিচ্ছিল না। তাই আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম, ‘যেহেতু স্কুল বাদ দিচ্ছো তাহলে চলো এখন কিছুক্ষণ হেঁটে বাসায় যাই। পাগলামিটা থামাবে এখন? কাল থেকে লক্ষ্মীমেয়ের মতো স্কুলে যাবে তো?’
যেতেও পারি, নাও যেতে পারি,’ সে বলল। তারপর সোজা হাঁটা লাগালো রাস্তার ওপর দিয়ে, দুই পাশ থেকে কোনো গাড়ি আসছে কি না সেটার দিকে খেয়াল না করেই। সে মাঝেমধ্যেই পাগলের মতো আচরণ করে বসে।
যদিও আমি তাকে অনুসরণ করলাম না। আমি জানি সে আমাকে ঠিকই অনুসরণ করবে। তাই আমি রাস্তার পার্ক সাইড দিয়ে চিড়িয়াখানার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। ফিবিও চিড়িয়াখানার দিকে হাঁটা শুরুলো ঠিকই তবে রাস্তার অন্য পাশ দিয়ে। সে তখনো আমার দিকে তাকাচ্ছিল না, তবে আমি জানি সে ঠিকই চোখের কোণ দিয়ে আমার দিকে নজর রাখছিল। যাইহোক, চিড়িয়াখানা পর্যন্ত পুরোটা রাস্তা আমরা ওভাবেই হেঁটে গেলাম। যাওয়ার সময় শুধু ডাবলডেকার বাসগুলোই আমাকে বিরক্ত করছিল, কারণ ওগুলোর কারণে রাস্তার অপর পাশটা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। তবে চিড়িয়াখানার সামনে পৌঁছেই আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘ফিবি! আমি চিড়িয়াখানায় যাচ্ছি। আসো এদিকে!’ সে আমার দিকে তাকাচ্ছিল না, তবে আমি জানি সে আমার কথা শুনতে পাচ্ছিল। চিড়িয়াখানার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি ফিবি রাস্তা ক্রস করে আমাকে অনুসরণ করতে শুরু করেছে।
চিড়িয়াখানায় ঐদিন খুব একটা বেশি ভীড় ছিল না। তবে সি-লায়নস’র সুইমিং পুলের চারপাশে বেশ ভালো পরিমাণ মানুষের সমাবেশ ছিল। আমি ওটা পেরিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম, তবে ফিবিকে দেখলাম থেমে সি-লায়নদের খাওয়ানো দেখছে। একটা লোক তাদের দিকে মাছ ছুড়ে মারছিল, তারা ওগুলো খাচ্ছিল। ফিবিকে থামতে দেখে আমিও পিছিয়ে গেলাম। মনে হলো যে তখন আর তার থেকে ওভাবে আলাদা আলাদা থাকার কোনো মানে নেই। তাই গিয়ে ফিবির পিছনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখতে চাইলাম। তবে ফিবি হাঁটু বাঁকিয়ে উবু হয়ে যাওয়ায় হাতটা সরে গেলো তার কাঁধ থেকে। ইচ্ছা করেই এটা করছিল ও। মাঝেমধ্যে সে আসলেই অনেক ক্ষীপ্ত হয়ে যায়। যাইহোক, ফিবি ওখানে দাঁড়িয়েই সি-লায়নদের খাওয়ানো দেখছিল, আর আমি দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক তার পিছনে। আমি আর পরবর্তীতে তার কাঁধ বা হাত ধরতে চাইনি। আমি জানতাম যে আরেকবার ধরতে চাইলে সে আরেকবারও সরিয়ে নিতো। বাচ্চারা আসলেই খুব মজার। তাদের কাজকর্মগুলো দেখলে আনন্দই লাগে।
সি-লায়নদের সামনে থেকে সরে আসার পরও সে ঠিক আমার পাশে থেকে হাঁটছিল না, তবে আমার থেকে খুব দূরেও ছিল না তখন। সে হাঁটছিল সাইডওয়াকের একটা পাশ দিয়ে, আর আমি হাঁটছিলাম সাইডওয়াকের অন্যপাশ দিয়ে। ব্যাপারটা খুব একটা ভালো ছিল না, তবে মধ্যে এক মাইল দূরত্ব রেখে হাঁটার চেয়ে তো ভালো ছিল। এরপর আমরা ছোটো একটা পাহাড়ে উঠতে থাকা ভাল্লুক দেখলাম। তবে ওখানে দেখার মতো কিছু ছিল না। মাত্র একটা ভাল্লুকই ছিল তখন, শ্বেত ভাল্লুক। অন্য ভাল্লুকটা তখন গুহাতে ছিল, কোনোভাবেই বেরিয়ে আসছিল না ওটা। ঐ ভাল্লুকের শুধু পিছনের অংশটাই দেখা যাচ্ছিল। আমাদের পাশে কাউবয় টুপি পরা একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে বারবার তার বাবাকে বলছিল, ‘ওটাকে বের করে আনো, বাবা। ওটাকে বের করার ব্যবস্তা করো। আমি ফিবির দিকে তাকালাম, কিন্তু সে হাসছিল না। বাচ্চারা মন খারাপ করলে যা হয় আর কী! তারা সহজে হাসতে বা কিছু করতে চায় না।
ভাল্লুক দেখা শেষে চিড়িয়াখানা থেকে বের হয়ে পার্কের ছোটো একটা রাস্তা পার হয়ে টানেলের দিকে গেলাম। টানেলটা আসলে চলে গেছে ক্যারোজেল রাইডের দিকে। ফিবি তখনো আমার সাথে কথা বলছিল না। তবে সে তখন আমার পাশে দিয়েই হাঁটছিল। আমি খেলাচ্ছলে তার কোটের পিছন দিকের বেল্টটা ধরে রাখতে চাইছিলাম, তবে সে তা করতে দিচ্ছিল না। রেগে উঠে বলল, ‘তোমার হাতটা তোমার কাছেই রাখো, প্লিজ!’ সে তখনো আমার ওপর ক্ষেপে ছিল। তবে আগের মতো অতটা না। যাই হোক, ক্যারোজেলের দিকে যাওয়ার পথে আমাদের দূরত্ব আরো কমছিল। যতই কাছে যাচ্ছিলাম ততই মিউজিকের শব্দ ভেসে আসছিল। ওখানে বাজছে ‘ওহ মেরি!’ প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে আমি যখন বাচ্চা ছিলাম তখনো এই গানটাই বাজছিল এখানে। ক্যারোজেলের এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে। তারা সবসময় একই গান বাজায়।
‘আমি তো ভেবেছিলাম ক্যারোজেল শীতের সময় বন্ধ থাকে,’ ফিবি বলল। সত্যি বলতে ঐদিন বোধহয় ঐবার প্রথম আমার সাথে ভালো করে কিছু বলেছিল। সে হয়তো ভুলে গিয়েছিল যে সে আমার সাথে রাগ করে আছে।
‘হয়তো ক্রিসমাসের সময় বলে খোলা,’ আমি বললাম।
আমার কথার কোনো জবাব দিলো না। হয়তো আমার সাথে রাগ করে থাকার ব্যাপারটা তার মনে পড়ে গিয়েছিল আবার।
‘তুমি কি রাইডে চড়বে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। আমি এমনিও জানতাম যে সে চড়বে। যখন সে এখন ছোটো বাচ্চা ছিল তখন আমি, ডি.বি. আর এলি মিলে তার সাথে পার্কে যেতাম। ক্যারোজেল তার খুবই প্রিয় ছিল। ওটা থেকে তাকে নামানোই যেতো না।
‘আমি অনেক বড়ো হয়ে গেছি,’ সে বলল। আমি ভেবেছিলাম সে হয়তো আমার কথার কোনো উত্তর দেবে না, তবে সে দিয়েছিল।
‘না, তুমি বড়ো হওনি। যাও। আমি এখানেই অপেক্ষা করবো। যাও,’ আমি বললাম। আমরা তখন ওখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। অল্প কিছু বাচ্চা রাইডে চড়ছিল, তবে এদের বেশির ভাগেরই বয়স অনেক কম ছিল। আর বাচ্চাদের সাথে তাদের বাবা-মাও ছিল। আমি এগিয়ে গিয়ে টিকেট কাউন্টার থেকে ফিবির জন্য একটা টিকেট কিনে আনলাম। সে তখন আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিল। ‘এই নাও,’ বলে টিকেটটা বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে। ‘এক সেকেন্ড—তোমার টাকাগুলো নাও আগে।’ বলে তার থেকে ধার নেওয়া টাকাগুলো ফেরত দেওয়া শুরু করলাম আমি।
‘তুমিই রেখে দাও। আমার জন্য রেখে দাও,’ সে বলল। সাথে সাথে যোগ করল, ‘প্লিজ!’ এটা বেশ খারাপ লাগার মতো ছিল। মানে কেউ প্লিজ বললে সেটায় বেশ খারাপই লাগে। বিশেষ করে ফিবি বা তার মতো বাচ্চারা যখন বলে। যাই হোক, টাকাগুলো আমি আবার আমার পকেটে রেখে দিলাম।
‘তুমি রাইডে চড়বে না?’ সে জিজ্ঞেস করল। আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ছিল ও। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে আমার ওপর আর তখন রেগে ছিল না।
‘পরেরটায় চড়বো। এখন তোমাকে দেখি,’ আমি বললাম। টিকেট পেয়েছো?’
‘হ্যাঁ।’
‘যাও তাহলে। আমি এখানে বেঞ্চে থাকবো। তোমার রাইডে চড়া দেখবো।’ বলে কাছেই থাকা বেঞ্চটাতে গিয়ে বসলাম আমি, আর ফিবি চলে গেলো ক্যারোজেল চড়তে। পুরোটা পথ ঘুরে গেলো ও, মানে সে যাওয়ার পথে পুরোটা পথ এক চক্কর দিয়ে গেছে। তারপর সে গিয়ে বসলো বড়ো বাদামী বর্ণের এক পেটা ঘোড়ার মূর্তির ওপর। শুরু হলো ক্যারোজেল। আমি বেঞ্চে বসে তাকে রাইডে ঘুরে দেখেছিলাম। সেখানে তখন মাত্র আর পাঁচ কি ছয়টা বাচ্চা ছিল মাত্র রাইডে। আর ক্যারোজেলে তখন বাজছিল ‘স্মোক গেটস ইন ইউর আইস’ গানটি। জ্যাজের সুরে গানটা বেশ অদ্ভুত শোনাচ্ছিল। বাচ্চাদের সবাই রাইডে চড়া অবস্থা সোনালি রিংটা ধরতে চাচ্ছিল, ফিবিও চাচ্ছিল। আমার ভয় লাগছিল সে হয়তো যে কোনো সময় ঘোড়া থেকে পড়ে যাবে, তবে আমি কিছুই বললাম না। আসলে ব্যাপারটা হলো, বাচ্চারা যদি কিছু ধরতে চায়, তাহলে তাদেরকে সেটা ধরতে দেওয়া উচিৎ। তখন কিছু বলা উচিৎ নয়। এটা করতে গিয়ে তারা যদি পড়ে যায়, পড়ে যাক—তারপরও তাদেরকে কিছু বলা উচিৎ নয়।
রাইড শেষে ঘোড়া থেকে আবার আমার কাছে চলে এলো ফিবি। ‘তুমিও চড়ো এবার,’ ও বলল।
‘না। আমি শুধু দেখবো। আমার মনে হয় আমার শুধু দেখাটাই ভালো হবে,’ বলে তাকে আরো কিছু টাকা দিয়ে বললাম, ‘এই নাও। আরো টিকেট কেনো।’
খপ করে আমার থেকে টাকাগুলো নিয়ে নিলো ফিবি। ‘তোমার ওপর আর রাগ নেই আমার,’ সে বলল।
‘আমি জানি, জলদি করো। আরেক রাইড তো শুরু হয়ে গেলো।’
তখন হঠাৎ করেই আমার গালে চুমু খেয়ে বসলো ও। তারপর হাত লম্বা করে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।’
‘হ্যাঁ, আমি জানি।’
এরপর সে হুট করেই আমার কোটের পকেট থেকে লাল শিকারি টুপিটা বের করে পরিয়ে দিলো আমার মাথায়।
‘তোমার এটা লাগবে?’ আমি বললাম।
‘তুমি কিছুক্ষণ পরে থাকতে পারবে।’
‘আচ্ছা। এখন জলদি করো। নাহলে রাইড মিস করবে। তোমার ঘোড়াও আর পাবে না।’
তারপরও সে ওখানেই দাঁড়িয়েছিল।
‘তুমি কি ঐ কথাটা সত্যি সত্যিই বলেছো? তুমি আসলেই কোথাও যাবে না? তুমি সত্যিই এরপর বাসায় যাবে?’ সে জিজ্ঞেস করল আমাকে।
‘হ্যাঁ,’ আমি বললাম। আমি আসলেই তাকে মিথ্যা বলিনি। আমি আসলেই এরপর বাসায় গিয়েছিলাম। ‘জলদি, জলদি,’ আমি বললাম। ‘রাইড শুরু হয়ে গেলো প্ৰায়।’
দৌড়ে গিয়ে একদম শেষ মুহূর্তে ক্যারোজেলের টিকেট কিনলো ও। এরপর পুরোটা পথ ঘুরে গিয়ে চড়ে বসলো তার ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়ায় বসে আমার দিকে ফিরে হাত নাড়লো ও, আমিও হাত নাড়লাম।
ঠিকই তখন ঝুম করে বৃষ্টি পড়া শুরু করল। ওখানে থাকা সব বাবা-মা তাদের বাচ্চাদেরকে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালো ক্যারোজেলের ছাদের নিচে। তবে আমি ঐ বেঞ্চেই বসে রইলাম আরো কিছুক্ষণ। ভিজে একদম চুপচুপে হয়ে গিয়েছিলাম আমি, বিশেষ করে আমার ঘাড় আর প্যান্ট বেশি ভিজেছিল। হান্টিং টুপিটা আমাকে বেশ কিছুক্ষণ রক্ষা করেছে ঠিকই, তবে বেশিক্ষণ আর বৃষ্টির পানি আটকে রাখতে পারেনি। আমার অবশ্য ওটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। আমার তখন ফিবিকে রাইডে ঘুরতে দেখে হুট করেই অনেক আনন্দ লাগছিল। সত্যি বলতে এতো আনন্দ লাগছিল যে আমার খুশিতে চেঁচাতে ইচ্ছা করছিল। আমি ঠিক জানি না কেন। রাইডে ঘুরতে থাকা অবস্থায় নীল কোটটাতে তাকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছিল। আহ, সবাই যদি তখনকার ঐ দৃশ্যটা দেখতে পেতো।