অধ্যায় চব্বিশ
সাটন প্লেসের এক বিলাসবহুল বাসায় থাকত মি. অ্যান্ড মিসেস অ্যান্টোলিনি। তাদের লিভিং রুম থেকে দুই কদম দূরেই ছিল একটা বার। আমি আগেও বেশ কয়েকবার গিয়েছি ওখানে। এঙ্কটন হিলস ছাড়ায় মি. অ্যান্টোলিনি প্রায় আমাদের বাসায় ডিনারে আসতেন আমার খোঁজ নেওয়ার জন্য। তাঁর অবশ্য তখনো বিয়ে হয়নি। বিয়ের পর আমি প্রায়ই মি. অ্যান্ড মিসেস অ্যান্টোলিনির সাথে লং আইল্যান্ডে ফরেস্ট হিলসের ওয়েস্ট সাইড টেনিস ক্লাবে টেনিস খেলেছি। মিসেস অ্যান্টোলিনি ওখানেরই বাসিন্দা। মিসেস আন্টোলিনির মি. অ্যান্টোলিনির থেকে প্রায় ষাট বছরের মতো বেশি, তবে তারা খুব ভালোভাবেই একজন আরেকজনের সাথে মানিয়েছে। তারা দুইজনই খুব বুদ্ধিমান মানুষ, বিশেষ করে মি. আন্টোলিনি। মি. আন্টোলিনি অবশ্য বুদ্ধিমানের থেকেও বেশি কৌতুকবাজ একজন মানুষ। অনেকটা ডি.বি.র মতোই। মিসেস অ্যান্টোলিনি কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির। মহিলার খুব বাজে রকমের অ্যাজমা সমস্যা রয়েছে। তারা দুইজনেই ডি.বি.র সবগুলো গল্প পড়েছে। ডি.বি. যখন হলিউডে চলে যায় তখন মি. আন্টোলিনি তাকে ফোন করে যেতে মানা করেছিল। তিনি বলেছিলেন ডি.বি.র মতো লেখার ক্ষমতা থাকা কারো হলিউডে কাজ করা উচিৎ নয়। আমিও এই কথাটাই বলেছিলাম। তবে ডি.বি. কারো কথাই শুনেনি।
আমি তাদের বাসা পর্যন্ত হেঁটেই যেতে চেয়েছিলাম, কারণ আমার ফিবির ক্রিসমাসের টাকা খরচ করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। তবে বাসার বাইরে বেরিয়েই অদ্ভুত লাগছিল আমার, মাথা ঘোরাচ্ছিল প্রচুর। তাই একটা ক্যাব নিলাম। আমি এটা করতে চাইনি, কিন্তু আমাকে এটাই করতে হয়েছে। ঐ রাতে অবশ্য ক্যাব পেতেও অনেক লম্বা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল আমাকে।
যাই হোক, মি. আন্টোলিনির বাসায় গিয়ে ডোরবেল বাজানোর পর তিনিই দরজাটা খুললেন। হারামজাদা এলিভেটর অপারেটর আমাকে আসতেই দিচ্ছিল না, শেষমেশ কোনোরকমে রাজি করিয়েছিলাম হারামিটাকে। যাইহোক, দরজা খুলতেই দেখি মি. আন্টোলিনি বাথরোব আর স্লিপার পরে ড্রিঙ্কের গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি মানুষ হিসেবে খুবই মার্জিত এবং অনেক বড়ো ড্রিংকারও। ‘হোল্ডেন, মাই বয়!’ তিনি বললেন। ‘খোদা, তুমি তো দেখি আরো বিশ ইঞ্চি বেশি লম্বা হয়ে গেছো। তোমাকে দেখে ভালো লাগছে।’
‘কেমন আছেন, মি. আন্টোলিনি? মিসেস আন্টোলিনির কী অবস্থা?’
‘আমরা দুইজনই খুব ভালো আছি। ভেতরে এসে কোটটা রাখো।’ বলে আমার থেকে কোটটা নিয়ে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখলেন তিনি। ‘আমি তো তোমার কোলে নবজাতক শিশু দেখার আশা করছিলাম। বাচ্চাটা নিয়ে তোমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।’ তিনি আসলেই মাঝেমধে খুবই কৌতুকপূর্ণ কথা বলতে পারেন। এরপর ঘুরে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ‘লিলিয়ান! কফি কতদূর?’ লিলিয়ান হচ্ছে মিসেস আন্টোলিনির প্রথম নাম।
‘এই তো হয়েই গেছে,’ তিনিও চেঁচিয়ে জবাব দিলেন। ‘হোল্ডেন এসেছে নাকি? হ্যালো, হোল্ডেন।’
‘হ্যালো, মিসেস আন্টোলিনি!’
ওখানে গেলে আসলে সবসময়ই চেঁচিয়ে কথা বলা লাগে। কারণ তারা দুইজন কখনোই একই সময়ে এক রুমে থাকে না। ব্যাপারটা অবশ্য বেশ মজার।
‘বসো, হোল্ডেন,’ মি. আন্টোলিনি বললেন। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল তিনি কিছুটা ঘেমে আছেন। রুমটা দেখে মনে হচ্ছিল যেন কিছুক্ষণ আগেই ওখানে কোনো পার্টি হয়েছে। পুরো জায়গা জুড়েই গ্লাস, প্লেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ‘রুমের অবস্থাটা ইগনোর করো,’ তিনি বললেন। ‘কিছুক্ষণ আগেই বাফোলো থেকে মিসেস অ্যান্টোলিনির কয়েকজন বন্ধু এসেছিল… সত্যি বললে, এদের মধ্যে কয়েকজন আসলেই বাফোলো ছিল।’
শুনে হাসলাম। তখন মিসেস অ্যান্টোলিনি রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে আমাকে কিছু বললেন, তবে আমি তা শুনতে পাইনি। ‘কী বলেছেন উনি?’ মি. আন্টোলিনিকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘ও বলেছে সে রুমে আসলে যেন তুমি তার দিকে না তাকাও। মাত্ৰই বিছানা থেকে উঠেছে ও। সিগারেট নাও। তুমি তো এখন স্মোকিং করো, তাই না?’
‘ধন্যবাদ,’ বলে তাঁর বাড়ানো প্যাকেটটা থেকে একটা সিগারেট নিলাম। ‘এইতো মাঝেমধ্যে কয়েকটা টানি। এখন মোটামুটি ভালোই স্মোকিং করা হয়।’
‘দেখেই বুঝা যাচ্ছে,’ তিনি বললেন। এরপর টেবিলে থাকা বড়ো লাইটারটা জ্বালিয়ে বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। ‘তো, তোমার আর পেন্সির সম্পর্কটা শুনলাম আর নেই,’ তিনি বললেন। তিনি সবসময়ই এভাবে কথা বলেন। মাঝেমধ্যে এসব আমার বেশ ভালোই লাগে, আবার মাঝেমধ্যে তেমন একটা লাগে না। তিনি আসলে কৌতুক প্রায়ই একটু বেশি করে ফেলেন। এমন না যে কথাগুলো হাস্যরসাত্মক না, ওগুলো অবশ্যই হাস্যরসাত্মক—তবে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু কথা মনে বেশ আঘাতও দেয়। এই যেমন ‘তো তোমার আর পেন্সির সম্পর্কটা আর নেই’ ধরনের কথাগুলো। ডি.বি.ও মাঝেমধ্যে এমনভাবে কথা বলে।
‘সমস্যাটা কী?’ মি. আন্টোলিনি জিজ্ঞেস করলেন। ‘ইংরেজিতে কী অবস্থা? তুমি যদি ইংরেজিতে ফেইল করে থাকো, তাহলে কিন্তু আমি এখনই তোমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আমার বাসা থেকে বের করে দিবো।’
‘না, ইংরেজিতে ফেল করিনি। ইংরেজিতেই বেশি ভালো করেছি। কোর্সের বেশির ভাগটাই ছিল লিটারেচার নিয়ে। পুরো টার্মে শুধু দুটো কম্পোজিশনই লেখা লেগেছে আমাকে,’ আমি বললাম। ‘তবে মৌখিক পরীক্ষায় ফেইল করেছি আমি। ওখানে মৌখিক পরীক্ষার একটা কোর্স ছিল, ওটাতেই ফেইল করেছি আমি।’
‘কেন?’
‘ঠিক জানি না আমি।’ আমার আসলে ওটা নিয়ে কথা বলার মুড ছিল না। আমার তখনো অনেকটা মাথা ঘোরাচ্ছিল। সাথে সাথে হুট করেই ভয়ংকর রকম মাথাব্যথা করতে শুরু করল। আসলেই প্রচণ্ড মাথাব্যথা। তবে মি. অ্যান্টোলিনি কারণ জানায় বেশ আগ্রহী ছিলেন, তাই তাকে কিছুটা ব্যাখ্যা করে বললাম আমি। ‘ওখানে একটা কোর্স আছে যেটায় ক্লাসের সব ছাত্রকেই ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতে হয়। জানেনই তো কেমন। বক্তব্যের সময় যদি কেউ অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে কিছু বলে ফেলে তাহলে যত দ্রুত সম্ভব ‘অবান্তর’ বলে তাকে হেয় করতেই হবে। এটাই আমার ভালো লাগেনি। আমি এজন্যই ফেইল করেছি এটায়।’
‘কেন?’
‘জানি না ঠিক। ঐ অবান্তর শব্দটা আমার অসহ্য লাগে। আমি জানি না ঠিক কেন। সমস্যাটা হলো অন্য কেউ অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে কিছু বললে আমার বেশ ভালোই লাগে। আমার কাছে ওটাকে বেশ আকর্ষণীয়, আগ্রহ জাগানিয়া মনে হয়।’
‘তোমার কি মনে হয় না কিছু বলার সময় সবাইকেই নির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ?’
‘অবশ্যই। প্রাসঙ্গিক বিষয়ের বাইরে না যাওয়া মানুষদেরকে আমি অনেক পছন্দ করি। তবে আমার এটা ভালো লাগে না যখন তারা একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়েই অতিরিক্ত সময় ধরে বকবক করে। আমি জানি না কেন। মনে হয় সবসময়ই একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে আঁকড়ে থাকাটা আমি পছন্দ করি না। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে মৌখিক পরীক্ষায় যারা সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে তারা সবাইই একটা নির্দিষ্ট টপিকেই আঁকড়ে ছিল। তবে ওখানে রিচার্ড কিন্সেলা নামের একটা ছেলে ছিল, সে কখনোই একটা নির্দিষ্ট টপিকের ওপর খুব বেশি জোর দিতো না। সেই জন্য প্রত্যেকেই সবসময় তাকে দেখলেই ‘অবান্তর’ ‘অবান্তর’ বলে চেঁচাতো। ব্যাপারটা খুবই জঘন্য ছিল, কারণ প্রথমত ছেলেটা ছিল খুবই নার্ভাস প্রকৃতির, বক্তব্য দেওয়ার সময় হলেই ঠোঁট কাঁপাকাঁপি করত তার আর কথাও বলত এতো নিচু স্বরে যে ক্লাসের পিছনের বেঞ্চে বসলে সেটা শোনার কোনো উপায়ই থাকত না। তবে ছেলেটার স্বর নিচু হওয়ার পরও অন্যদের থেকে তার বক্তব্যই বেশি পছন্দের ছিল আমার। অবশ্য সেও এই পরীক্ষাটায় ফেইলই করেছে বলা যায়। ‘ডি’ পেয়েছে ও, কারণ সে কথা বলার পুরোটা সময়ই পুরো ক্লাসরুম তার দিকে ‘অবান্তর’ বলে চেঁচিয়েছে। এই যেমন ধরুণ, সে একবার তার বাবার ভারমন্টে কেনা ফার্মটা নিয়ে বক্তব্য দিয়েছিল। তার বক্তব্যের পুরোটা সময়ই ক্লাসের সবাই ‘অবান্তর’
‘অবান্তর’ বলে চেঁচিয়েছে। আর কোর্সের টিচার মি. ভিনসন ও তাকে এফ দিয়েছিল, কারণ তাঁর মতে ছেলেটা নাকি তার বক্তব্যে ফার্মে কোন প্রাণী থাকে বা কী ধরনের শাক-সব্জি চাষ করা হয় সেগুলো উল্লেখ করেনি। রিচার্ডকে টিচার এটা বলেও ছিল, রিচার্ডও এটা বলতে শুরু করেছিল—তবে বলতে বলতে এক পর্যায়ে সে বলা শুরু করে তার মায়ের কাছে তার আঙ্কেলের থেকে আসা চিঠি নিয়ে, কীভাবে তার আঙ্কেল বিয়াল্লিশ বছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, কিন্তু কাউকে হাসপাতালে তাকে দেখার জন্য যেতে দিতো না কারণ সে চাইতো না যে তাকে কেউ পঙ্গু অবস্থায় দেখুক। আমি মানছি এটার সাথে ফার্মের কোনো সম্পর্ক নেই, তবে গল্পটা ভালোই লেগেছিল আমার কাছে। কাউকে তাদের আঙ্কেল সম্পর্কে বলতে শুনতে বেশ ভালোই লাগে আমার, বিশেষ করে কেউ যখন তার বাবার ফার্মের কথা বলতে শুরু করে হুট করেই তাদের আঙ্কেলের ব্যাপারে বলতে শুরু করে। তখন তার দিকে তাকিয়ে ‘অবান্তর’ ‘অবান্তর’ চেঁচানোটা খুবই নোংরা একটা কাজ। মানে সে তো তার আঙ্কেলের ব্যাপারে কথাগুলো বলছিল খুবই আগ্রহ, উত্তেজনা ও ভালো লাগা নিয়ে। তখন তাকে এভাবে হেয় করার তো কোনো অর্থই হয় না। আমি জানি না আসলে, এটা ভেঙে বলা বেশ কঠিন।’ আমার আসলে তখন আর বেশি কিছু বলতে ইচ্ছাও করছিল না। এর একটা কারণ আমার তখন হুট করেই প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছিল। আশা করছিলাম যেন মিসেস আন্টোলিনি তখন কফি নিয়ে এসে হাজির হন। আমার এই ব্যাপারটা খুবই বিরক্তিকর লাগে—মানে কেউ বলছে যে কফি তৈরি হয়ে গেছে, কিন্তু আসলে কফি তখনো তৈরি হতে ঢের দেরি আছে।
‘হোল্ডেন… শিক্ষক হিসেবে একটা ছোটো প্রশ্ন করি তোমাকে। তোমার কি মনে হয় না সব কিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময় আর স্থান রয়েছে? তোমার কি মনে হয় না কেউ যদি তার বাবার ফার্ম নিয়ে বলতে শুরু করে, তাহলে আঙ্কেলের পঙ্গুত্বের ব্যাপারে বলার বদলে সেই বিষয়টাতেই স্থির থাকা উচিৎ? আর যদি আঙ্কেলের পঙ্গুত্বটাই আকর্ষণীয় হয়ে থাকে, তাহলে কি তার বক্তব্যের বিষয়টা ফার্মের বদলে সেটাই হওয়া উচিৎ নয়?’
আমার আসলে তখন তেমন একটা ভাবতে ইচ্ছা করছিল না। প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছিল আর নিজেকেও খুব বিষণ্ন মনে হচ্ছিল। এমনকি সত্যি বলতে আমার তখন কিছুটা পেটও ব্যথা করছিল।
‘হ্যাঁ—আমি জানি না। মনে হয় তার ওটাই করা উচিৎ ছিল। মানে বিষয়বস্তু হিসেবে ফার্মের বদলে আঙ্কেলকেই বেছে নেওয়া উচিৎ ছিল, যদি ওটাই তার বেশি আগ্রহজনক মনে হয়ে থাকে। তবে আমি বলতে চাচ্ছি, অনেক সময়ই কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলার আগ পর্যন্ত বুঝা যায় না যে কোন টপিকটা তার কাছে বেশি আগ্রহজনক। মানে মাঝেমধ্যে কোনো ভাবেই এটা ভালো করে বুঝা যায় না। আমার মনে হয়, কেউ যদি কোনো বিষয় নিয়ে অনেক আগ্রহ আর উত্তেজনা নিয়ে কিছু বলতে থাকে, তাহলে তাকে বিরক্ত না করে ওটা নিয়েই কথা বলতে দেওয়া উচিৎ। কাউকে কোনো ব্যাপার নিয়ে উত্তেজনা অনুভব করতে দেখলে আমার ভালোই লাগে। এটা আসলেই ভালো লাগার মতো। আপনি আসলে আমাদের ঐ শিক্ষক মি. ভিনসনকে চেনেন না। লোকটা মাঝেমধ্যে খুবই রাগ তুলে দেওয়ার মতো একটা মানুষ। মানে লোকটা সবসময়ই বলত টপিকগুলো ঐক্যবদ্ধ আর সহজতরভাবে উপস্থাপন করতে বা এমনকিছু যেটা কখনোই সম্ভব না। মানে কেউ চাইলেই তো আর কিছু কিছু বিষয়কে ঐক্যবদ্ধ আর সহজতরভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব না। আপনি আসলে লোকটাকে চেনে না। লোকটা খুবই বুদ্ধিমান, তবে তাকে দেখলেই বুঝবেন লোকটার তেমন একটা মগজ নেই।’
‘কফি চলে এসেছে, অবশেষে,’ একটা ট্রেতে করে কফি আর কেক নিয়ে আসতে আসতে বললেন মিসেস অ্যান্টোলিনি। ‘হোল্ডেন, ভুলেও আমার দিকে তাকিও না। আমার অবস্থা খুবই বাজে হয়ে আছে।’
‘হ্যালো, মিসেস অ্যান্টোলিনি,’ বলে আমি উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছিলাম, তবে মি. আন্টোলিনি আমার জ্যাকেটে টেনে ধরে আবার বসিয়ে দিলেন আমাকে। মিসেস আন্টোলিনির চুলগুলো তখন পুরোই এলোমেলো হয়েছিল। ঠোঁটে লিপস্টিক বা মুখে কোনো মেকাপও ছিল না। মহিলাকে দেখে তখন আর অতটা সুন্দরী মনে হচ্ছিল না। অনেক বয়স্কা দেখাচ্ছিল তাঁকে তখন।
‘আমি এটা এখানেই রেখে যাচ্ছি। তোমরা নিজেদের মতো করে নিয়ে খাও,’ বলে ট্রেটা টেবিলে রেখে গ্লাসগুলো সরিয়ে নিলেন তিনি। ‘তোমার মা কেমন আছে, হোল্ডেন?’
‘মা ভালোই আছে, ধন্যবাদ। আমার অবশ্য ইদানিং মায়ের সাথে দেখা হয়নি, তবে শেষ যেবার…’
‘ডার্লিং, যদি হোল্ডেনের কিছু লাগে সবই লিনেনের ক্লজেটে পাবে। টপ শেলফে আছে। আমি বিছানায় আছি। প্রচণ্ড ক্লান্তি লাগছে আমার,’ মিসেস আন্টোলিনি বললেন। মহিলাকে আসলেই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। ‘তোমারা দুজন মিলে কাউচটা গোছাতে পারবে না?’
‘আমরা দেখে নিতে পারবো সবকিছু। তুমি ঘুমাতে যাও,’ বলে মিসেস অ্যান্টোলিনিকে কিস করে বিদায় জানালেন মি. অ্যান্টোলিনি। তারা সবসময়ই এমন করে, মানে কারো সামনে একে-অপরকে কিস করতে তারা তেমন একটা দ্বিধা করে না।
এক কাপ কফি আর অর্ধেকটা কেক নিলাম আমি। পাথরের মতো শক্ত ছিল কেকটা। মি. অ্যান্টোলিনি তখন আরো একটা হাইবল ড্রিংক তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজের জন্য। দেখেই বুঝা যাচ্ছিল ড্রিংকটা খুবই কড়া। এতো কড়া ড্রিংক খেলে অ্যালকোহলিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে মি. অ্যান্টোলিনির।
‘তোমার বাবার সাথে কয়েক সপ্তাহ আগে লাঞ্চে গিয়েছিলাম আমি,’ হুট করে বলে উঠলেন মি. অ্যান্টোলিনি। ‘তুমি জানো এটা?’
‘না, আমি এটার ব্যাপারে জানি না।’
‘তুমি নিশ্চয় এটা জানো যে তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে অনেক দুঃশ্চিন্তায় আছে।’
‘আমি জানি। আমি জানি বাবা আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তিত,’ আমি বললাম।
‘তোমার বাবা ঐদিন ফোন করার আগে তোমার নতুন হেডমাস্টার আমাকে একটা বড়ো চিঠি পাঠিয়েছিল তোমার ব্যাপারে। লিখেছিল তুমি নাকি পড়ালেখার কোনো চেষ্টাই করছ না, ক্লাসে বাঁধা দিচ্ছো, ক্লাসে যাচ্ছো অপ্রস্তুত হয়ে। সবমিলিয়ে বলতে গেলে—’
‘আমি কোনো ক্লাসে বাঁধা দেইনি। ওখানে ক্লাসে বাঁধা দেওয়ার নিয়ম নেই। মাঝেমধ্যে শুধু মৌখিক পরীক্ষার মতো কিছু ক্লাসে আমি উপস্থিত হইনি। তবে কোনো ক্লাসে বাঁধা দেইনি।’
আমার আসলে তখন ওটা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। কফি খাওয়ার পর আমার পেট কিছুটা শান্ত হয়েছিল, তবে মাথা ব্যথাটা তখনো ঠিকই লেগেছিল।
আরেকটা সিগারেট জ্বালালেন মি. আন্টোলিনি। তিনি খুবই বড়ো ধরনের চেইন স্মোকার। তারপর বললেন, ‘সত্যি বলতে, আমি জানি না আমার এখন তোমাকে কী বলা উচিৎ, হোল্ডেন।’
‘আমি জানি আমার সাথে কথা বলা বেশ কঠিন। এটা বুঝতে পারি আমি।’
‘আমার মনে হচ্ছে তুমি খুবই বাজে ধরনের বিপদে পড়তে যাচ্ছো। তবে আমি জানি না ঠিক কোন ধরনের… তুমি কি আমার কথা শুনছো?’
‘হ্যাঁ।’
তাঁকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল তিনি খুবই মনোযোগ দিয়ে কিছু বলতে চাইছেন।
‘ব্যাপারটা এমন হতে পারে যে ত্রিশ বছর বয়সে তুমি বারে বসে বারে আসা সবাইকেই ঘৃণা করছ এমনভাবে যেন তারা কলেজে ফুটবল খেলায় জড়িত ছিল। অথবা যথেষ্ট পরিমাণ ডিগ্রি অর্জন করে তুমি ওসব মানুষকে ঘৃণা করছ যারা ‘এটা আমার আর তার মধ্যকার ব্যাপার’ বলে থাকে। অথবা তোমার চাকরি হতে পারে সারাদিনই স্টেনোগ্রাফারের দিকে পেপার ক্লিপ ছুড়ে মারার। আমি জানি না। তুমি কি বুঝতে পারছো আমি কী বলতে চাচ্ছি?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই পারছি,’ আমি বললাম। আমি আসলেই বুঝতে পারছিলাম। ‘তবে ঘৃণার ব্যাপারটায় আপনার ধারণা ভুল। মানে ফুটবল খেলোয়ারদের ঘৃণা করার ব্যাপারটা নিয়ে। আপনি আসলেই ভুল। আমি আসলে খুব বেশি মানুষকে ঘৃণা করি না। আসলে আমি মাঝেমধ্যে কিছু কিছু মানুষকে অল্প কিছু সময়ের জন্য ঘৃণা করি। এই যেমন পেন্সির স্ট্র্যাডলেটার বা রবার্ট অ্যাকলির মতো মানুষদের। আমি স্বীকার করছি যে মাঝেমধ্যে আমি তাদেরকে ঘৃণা করি—তবে এটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কিছুক্ষণ পর আমি যদি তাদেরকে না দেখি বা তারা যদি রুমে না আসে বা টানা কয়েকটা মিলে আমি তাদেরকে ডাইনিংয়ে না দেখি—তাহলে আমি তাদেরকে মিস করা শুরু করি। মানে আমি আসলেই কিছুটা মিস করি তাদেরকে।’
জবাবে মি. অ্যান্টোলিনি কিছু বললেন না। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ড্রিংকের গ্লাসে আরেক টুকরো বরফ ঢেলে আবার চেয়ারে বসলেন। তাঁকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে তিনি কিছু ভাবছেন। আমি শুধু আশা করছিলাম যে তিনি যেন বাকি আলোচনাটা সকালের জন্য রেখে দেন। তখন আমার আর আলোচনা করতে ইচ্ছা করছিল না। তবে তিনি তখন আলাপের মুডে ছিলেন। মানুষজন আসলেই তখন আলোচনার মুডে থাকে যখন আমার আর কথা বলারই কোনো মুড থাকে না।
‘আচ্ছা। এখন আমার কথা একটু শুনো। আমি চাইলেও হয়তো কথাগুলো খুব একটা সুন্দর করে বলতে পারবো না, তবে দুই-একদিনের ভেতরেই তোমাকে একটা চিঠি লিখবো আমি। তখন তুমি সবকিছু ভালোভাবে ধরতে পারবে। তবে যাইহোক, এখন আমার কথা শুনো।’ আবারো তিনি প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেন কথা বলার। ‘তুমি এখন যে বিপদটাতে পড়তে যাচ্ছো, এটা খুবই অদ্ভুত একটা বিপদ, খুবই বাজে একটা বিপদ। এই ধরনের বিপদে মানুষ আসলে একদম নিচে আছড়ে পড়ে না, সে নিচে পড়তেই থাকে, পড়তেই থাকে। পুরুষদের আসলে এটার অভিজ্ঞতা বরণ করতেই হয় তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়। এমন একটা সময় আসে যখন তার যেটা দরকার আশেপাশের পরিবেশ তাকে সেটার যোগান দিতে পারে না, অথবা তারা ভাবে যে চারপাশের পরিবেশ তাকে সেটা যোগান দিতে পারবে না। তাই তারা আশা হারিয়ে ফেলে। তারা আসলে বিপদ থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো চেষ্টা না করেই আশা ছেড়ে দেয়। তুমি কি বুঝতে পারছো?’
‘হ্যাঁ, স্যার।’
‘তুমি নিশ্চিত?
‘হ্যাঁ।’
বলতে বলতে উঠে গ্লাসে আরো অ্যালকোহল ঢেলে নিলেন উনি। তারপর আবার চেয়ারে এসে বসে লম্বা একটা সময় চুপ করে রইলেন।
‘আমি তোমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছি না,’ তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, ‘তবে আমি পরিষ্কারভাবেই দেখতে পাচ্ছি যে যেভাবেই হোক তুমি কোনো অকারণে মহত্বের মৃত্যুবরণ করতে যাচ্ছো।’ বলে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন তিনি। ‘আমি যদি তোমাকে কিছু লিখে দিই, তাহলে তুমি কি সেটা পড়বে এবং সাথে রাখবে?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই,’ আমি বললাম। আমি আসলেই তাই করেছি। আমার কাছে এখনো ঐ কাগজটা রয়েছে।
এরপর রুমের অন্য পাশে থাকা ডেস্কে গিয়ে দাঁড়িয়েই কাগজে কিছু একটা লিখে আবার চেয়ারে এসে বসলেন মি. আন্টোলিনি। ‘অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো এটা কোনো অভিজ্ঞ কবির লেখা নয়। এটা লিখেছিল উলহেল্ম স্টেকেল নামের এক সাইকোঅ্যানালিস্ট। তুমি কি আমার কথা শুনছো ঠিকমতো?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’
‘স্কেটেল লিখেছিল, ‘অপরিপক্ক বা ইমম্যাচিউর মানুষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা কোনো কারণে মহত্ত্বের মৃত্যুবরণ করতে চায়, আর একজন পরিপক্ক বা ম্যাচিউর মানুষের বৈশিষ্ট্য হলো তারা একটা নির্দিষ্ট কারণে নম্রভাবে বাঁচতে চায়।’
এরপর ঝুঁকে কাগজটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন মি. অ্যান্টোলিনি। হাতে কাগজটা নিয়েই আমি লেখাটা পড়লাম এবং তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে কাগজটা পকেটে রেখে দিলাম। আমার জন্য মি. অ্যান্টোলিনির এতো দুঃশ্চিন্তা করাটা আসলেই আমার প্রতি তাঁর আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ। আসলেই। তবে সমস্যাটা হলো আমি আসলে তখন অতটা মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। খোদা, আমার তখন হুট করেই প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছিল।
তবে মি. অ্যান্টোলিনিকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে তিনি একদমই ক্লান্ত নন। ‘আমার মনে হয় কোনো একদিন তুমি তোমার গন্তব্যটা খুঁজে পাবে, এবং সেই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। তবে এখন, এই মুহূর্তে তোমার কিন্তু এক মিনিট সময় নষ্ট করারও কোনো সুযোগ নেই। অন্তত তোমার নেই।’
আমি জবাবে শুধু মাথা দোলালাম কারণ মি. আন্টোলিনি তখন সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন আর আমিও নিশ্চিত ছিলাম না যে তিনি আসলে কী বলতে চাচ্ছেন। আমি আসলে তখন খুবই ক্লান্ত ছিলাম।
‘আর যদিও তোমাকে কথাটা বলতে খারাপ লাগছে,’ তিনি বললেন, ‘তবে আমার মনে হয় সঠিক গন্তব্য খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত তোমার প্রথম কাজ হচ্ছে স্কুলের দিকে মনোযোগী হওয়া। তোমাকে হতেই হবে। তুমি একজন ছাত্র—তুমি এটা পছন্দ করো বা না করো, তোমাকে এটা মেনে নিতেই হবে। জ্ঞানের প্রতি তোমার আলাদা দুর্বলতা আছে। আমার মনে হয় তুমি যদি একবার মি. ভিন্সেস এবং মৌখিক পরী… ‘
‘মি. ভিনসন,’ আমি বললাম। তিনি আসলে মি. ভিনসনই বুঝিয়েছিলেন। আমার আসলে তখন তাঁর কথায় বাঁধা দেওয়া উচিৎ হয়নি।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মি. ভিনসন। একবার যদি তুমি মি. ভিনসন এবং মৌখিক পরীক্ষাগুলো সহ্য করা শিখতে পারো, তাহলে তোমার আকাঙ্ক্ষা করার চাওয়াগুলোর খুবই খুবই কাছে চলে যেতে পারবে। এটা সম্ভব যদি তুমি চাও, যদি তুমি ওগুলোর সন্ধ্যান করো এবং যদি তুমি ওগুলোর জন্য ধৈর্য্য সহকারে অপেক্ষা করো। অনেক কিছুর সাথে তখন তুমি এটাও জানতে পারবে যে একমাত্র তুমিই মানুষের আচরণ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত, ভীত, এমনকি বিরক্ত হওয়া ব্যক্তি না। তুমি এটা জেনে আনন্দিত হবে যে এমন অনুভূতি তোমার একারই হয় না। তোমার প্রশ্নগুলো অন্য কেউ করে না। তোমার এখন যেই অবস্থা অনেক অনেক মানুষকেই জীবনের একটা সময় এই অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তাদের অনেকেই কঠিন অবস্থায় করা ভুলগুলো মনে রেখে দেয়, যাতে সেগুলো থেকে ভবিষ্যতে শেখা যায়। তুমিও শিখতে পারবে, যদি তুমি চাও। হয়তো একদিন তুমি তোমার এই ভুলগুলো থেকে কেউ শিক্ষা নেবে। এটা আসলে একটা চক্রাকার প্রক্রিয়া। এটা সাধারণ শিক্ষাগ্রহণ নয়, এটা হচ্ছে ইতিহাস, এটা কাব্য।’ বলে ক্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে নিলেন তিনি। তারপর আবারো বলতে শুরু করলেন। খোদা, তিনি আসলেই তখন কথা বলার মুডে ছিলেন। আমি এটায় সন্তুষ্ট যে আমি তখন তাঁর কথায় কোনো বাঁধা দেইনি। ‘আমি তোমাকে আসলে এটা বলতে চাচ্ছি না যে একমাত্র শিক্ষিত ও ডিগ্রিধারী ব্যক্তিরাই শুধু পৃথিবীর কোনো উপকার করতে পারবে। এটা এমন না। তবে আমি সবসময় এটাই বলি যে একজন শিক্ষিত ও ডিগ্রিধারী মানুষ যদি খুবই প্রখর এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পন্ন হয়—যেটা খুবই বিরল ব্যাপার—তাহলে তারা শুধু প্রখর ও উদ্ভাবনী বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মানুষদের থেকে অনেক বেশি পরিমাণ ভুল পিছনে ফেলে আসতে পারে। এই ধরনের মানুষ খুব স্পষ্টভাবে তাদেরকে প্রকাশ করতে পারে এবং তাদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত স্বপ্নগুলো অনুসরণ করে যাওয়ার একটা শক্তিশালী আবেগ কাজ করে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারহলো অশিক্ষিত ভাবুকদের থেকে তাদের মধ্যে কয়েকগুন বেশি নম্রতা কাজ করে। তুমি কি বুঝতে পারছো?’
‘হ্যাঁ, স্যার।’
এরপর আরো কিছুক্ষণ কিছু বলল না মি. অ্যান্টোলিনি। আমি জানি না কেউ কখনো এমনটা অনুভব করেছে কি না, তবে কারো কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করাটা খুবই কঠিন একটা কাজ, বিশেষ করে সেই মানুষটা যদি কথা বলার সময় একটু পরপরই কী বলবে তা নিয়ে ভাবতে বসে যায়। আসলেই খুব কঠিন এটা। আমি কোনোরকমে হাই না তোলার চেষ্টা করছিলাম শুধু। এমন না যে আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম—আমার একটুও বিরক্ত লাগছিল না—তবে আমার তখন প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল।
‘একাডেমিক শিক্ষাটা তোমার আরো একটা সুবিধা করবে। তুমি যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণ করো, তাহলে এই শিক্ষাটা তোমাকে একসময় তোমার মস্তিষ্কের আকার-প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা দিতে পারবে। তোমার মস্তিষ্কের জন্য কোন ভাবনাগুলো উপযুক্ত আর কোনটা উপযুক্ত নয় সেটা বুঝতে সাহায্য করবে। একটা সময় পর এটা তোমাকে ধারণা দেবে তোমার মস্তিষ্কে আসলে কোন ধরনের ভাবনাগুলো থাকা উচিৎ। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো, একবার মস্তিষ্কের ব্যাপারে তোমার ধারণা চলে আসার পর বাজে বা তোমার জন্য অনুপোযুক্ত ভাবনাগুলো কখনোই আর মাথায় আসবে না তোমার। তোমাকে তখন আর আলাদা করে সময় খরচ করে কোন ভাবনাটা রাখা উচিৎ আর কোনটা রাখা উচিৎ নয় সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না। প্রচুর পরিমাণ সময় বেঁচে যাবে তোমার। তুমি তোমার সত্যিকারের প্রকৃতি ধরতে শিখবে তখন।’
তখন হঠাৎ করেই হাই তুলে বসলাম আমি। আমি জানি কাজটা খুবই রুক্ষ ছিল, তবে আমি কোনোভাবেই নিজেকে আঁটকাতে পারছিলাম না।
যদিও মি. অ্যান্টোলিনি শুধু হাসলেন এতে। ‘আসো,’ বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, ‘তোমার জন্য কাউচটা ঠিক করে দিই।’
আমি তাঁকে অনুসরণ করে ক্লজেট পর্যন্ত গেলাম। ক্লজেটের ওপরের তাকে আমার জন্য কিছু চাদর ও কম্বল গুছিয়ে রাখাছিল। তবে হাতে ড্রিঙ্কের গ্লাস নিয়ে মি. অ্যান্টোলিনি ওগুলো নামাতে পারছিলেন না। তাই গ্লাসের ড্রিংকটা চুমুক দিয়ে গিলে নিয়ে গ্লাসটা মেঝেতে রেখে ওগুলো তাক থেকে নামালেন তিনি। জিনিসগুলো কাউচ পর্যন্ত আমি সাহায্য করলাম স্যারকে। দুইজনে মিলেই বিছানাটা গোছালাম। স্যার আসলে এই কাজটায় খুব একটা পটু ছিলেন না। বিছানাটা গুঁজেও দিতে পারছিলেন না। আমি অবশ্য এটায় অতটা পাত্তা দেইনি। আমি এখন এতোই ক্লান্ত ছিলাম যে দাঁড়িয়ে ঘুমাতেও আমার কোনো আপত্তি ছিল না।
‘তোমার নারী বন্ধুদের কী অবস্থা?’
‘তারা ভালোই আছে।’ আমি তখন ঠিকভাবে কথাও বলছিলাম না। কোনোরকমে উত্তর দিচ্ছিলাম শুধু।
‘স্যালি কেমন আছে?’ স্যার স্যালি হায়েসকে চিনেন। আমি তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম।
‘সে ভালোই আছে। বিকালেই তার সাথে ডেটে গিয়েছিলাম।’ খোদা, মনে হচ্ছিল যেন ডেটের পর বিশ বছর পেরিয়ে গেছে। ‘এখন আমাদের দুজনের পছন্দের আর এতটা মিল নেই।’
‘স্যালি খুবই সুন্দর একটা মেয়ে। অন্য মেয়েদের খবর কী? একজনের কথা বলেছিলে তো আমাকে—ঐ যে মেইনে থাকে?’
জেন গ্যালাহার। সেও ভালোই আছে। আমি হয়তো আগামীকালকে তাকে একবার ফোন দেবো।’
ততক্ষণে আমাদের কাউচ গোছানো হয়ে গেছে। ‘তোমার বিছানা তৈরি হয়ে গেছে,’ মি. অ্যান্টোলিনি বললেন। ‘যদিও আমি জানি না তুমি তোমার ঐ পাগুলোর কী করবে।’
‘সমস্যা নেই। আমার ছোটো খাটে শুয়ে অভ্যাস আছে,’ আমি বললাম। ‘অনেক ধন্যবাদ, স্যার। আপনারা আজ রাতে আমাকে বাঁচিয়েছেন।’
‘বাথরুম কোথায় তা তো তুমি জানোই। আর যদি তোমার কিছুর প্রয়োজন হয়, তাহলে ডাক দিয়ো। আমি কিছুক্ষণ রান্নাঘরে থাকবো। লাইট জ্বালানো থাকলে তোমার কোনো সমস্যা হবে না তো?’
‘না, স্যার। কোনো সমস্যা হবে না। অনেক ধন্যবাদ, স্যার।’
‘আরে এসব ব্যাপার না। গুডনাইট।’
‘গুডনাইট, স্যার।’
বলে স্যার চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে আর আমি গেলাম বাথরুমে। বাথরুমে গিয়ে পোশাক খুলে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। যদিও দাঁত মাজতে পারিনি, কারণ আমার সাথে তখন টুথব্রাশ ছিল না। আমার সাথে তখন নাইট ড্রেসও ছিলও না আর মি. অ্যান্টোলিনিও আমাকে নাইটড্রেস দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাই আমি ওভাবেই লিভিং রুমে ফিরে এসে কাউচের পাশে থাকা ছোটো ল্যাম্পের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে শর্ট পরেই শুয়ে পড়লাম কাউচে। কাউচটা আমার জন্য খুবই ছোটো ছিল, তবে আমার তখন এতোই ঘুম পেয়েছিল যে দাঁড়িয়েই ঘুমাতে পারতাম, তাই বিছানা ছোটো হওয়াটায় খুব একটা সমস্যাও হচ্ছিল না। কাউচে শুয়ে কিছুক্ষণ জেগে মি. অ্যান্টোলিনির বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবার চেষ্টা করছিলাম। ভাবছিলাম আমার মস্তিষ্কের প্রকৃতি জানার ব্যাপারটা নিয়ে। স্যার আসলেই খুব বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তবে আমি কোনোভাবেই চোখগুলো খোলা রাখতে পারছিলাম না, অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলাম আমি।
এরপর একটা ঘটনা ঘটেছিল। আমার আসলে ঐ ব্যাপারটা কথা বলতে অতটা ভালো লাগে না।
হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেলো আমার। আমি জানি না তখন কয়টা বাজে, তবে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। মাথায় কারো হাতের ছোঁয়া অনুভব করতে পারছিলাম। খোদা, প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। হাতটা আসলে মি. অ্যান্টোলিনির ছিল। তিনি আসলে তখন কাউচের পাশে মেঝেতে বসে আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছিলেন। খোদা, হুট করে ঘুম ভেঙে প্রায় হাজার ফুট উঁচুতে লাফিয়ে উঠেছিলাম আমি তখন।
‘কী করছেন আপনি?’ আমি বললাম।
‘কিছুই না। আমি শুধু এখানে বসে আছি, তোমার প্রশংসা—’
‘আপনি আসলে কী করছেন এখানে?’ আমি আবারো বললাম। আমি আসলে তখন জানতাম না যে কী বলা উচিৎ আমার—মানে আমি তখন প্ৰচণ্ড হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম।
‘গলার স্বরটা একটু নিচু করো। আমি শুধু এখানে…’
‘আমাকে এমনিতেও এখন যেতে হবে,’ আমি বললাম। খোদা, আসলেই প্রচণ্ড নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম আমি তখন। অন্ধকারের মধ্যেই কোনোরকমে প্যান্ট পরা শুরু করলাম। নার্ভাসনেসের কারণে ঠিকমতো পরতেও পারছিলাম। আমার মনে হয় না কেউ আমার থেকে বেশি বিকৃতমনা মানুষদের চেনে। স্কুল জীবনে প্রচুর বিকৃতমনা মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে আমার। আর সবসময় আমি আশেপাশে থাকলেই তাদের মনে বিকৃতভাবটা যেনো আরো জেগে উঠে।
‘কোথায় যাবে তুমি?’ মি. অ্যান্টোলিনি বললেন। তিনি আসলে তখন খুবই শান্ত ও ভদ্র একটা ভাব ধরার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু আসলে তিনি অতটা ভদ্র ছিলেন না।
‘স্টেশনে আমার ব্যাগ রেখে এসেছি আমি। আমার মনে হয় আমার এখন গিয়ে ওগুলো বের করা উচিৎ। আমার সবকিছুই ব্যাগে রয়েছে।
‘ওগুলো সকালেও থাকবে। এখন, ঘুমাতে যাও। আমিও ঘুমাতে চলে যাচ্ছি। সমস্যাটা কী তোমার?’
‘কোনো সমস্যা নেই। আসলে ব্যাগে আমার সব টাকা-পয়সা রয়েছে তো। আমি এখনই ফিরে আসবো আবার। ক্যাবে করে গিয়ে ওগুলো নিয়ে ফিরে আসবো,’ আমি বললাম। খোদা, আমার তখন আবার মনে হচ্ছিল যে আমি অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। ‘ব্যাপারটা হলো টাকাটা আমার না, আমার মায়ের…’
‘হাস্যকর কথা বলো না তো, হোল্ডেন। ঘুমাও তুমি। আমিও ঘুমাতে যাচ্ছি। টাকাগুলো সকাল হলেও নিরাপদেই…’
‘আমি মজা করছি না। আমাকে আসলেই যেতে হবে।’ কাপড়-চোপর পরে তখন আমি প্রায় তৈরিই হয়ে গিয়েছিলাম, শুধু আমার টাইটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মনেও করতে পারছিলাম না যে ওটা কোথায় রেখেছি। টাই ছাড়াই জ্যাকেটটা পরে নিলাম আমি। মি. অ্যান্টোলিনি তখন মেঝে থেকে উঠে গিয়ে চেয়ারে বসে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। প্রচুর অন্ধকারের মাঝে আমি তাঁকে ভালোভাবে দেখতে না পারলেও বুঝতে পারছিলাম যে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চেয়ারে বসে মদ খেতে খেতে তাকিয়েছিলেন আমার দিকে।
‘তুমি খুবই অদ্ভুত একটা ছেলে।’
‘আমি জানি,’ আমি বললাম। আমার তখন টাই খোঁজার অতটা ইচ্ছাও করছিল না। তাই টাই ছাড়াই বেরিয়ে পড়লাম। ‘গুড-বাই, স্যার,’ আমি বললাম। ‘অনেক ধন্যবাদ রাতে আমাকে জায়গা দেওয়ার জন্য।
আমার পিছন পিছন ফ্রন্টডোর পর্যন্ত এলেন তিনিও, এমনকি যখন আমি এলিভেটরের বেল চাপলাম তখনো তিনি দরজার মুখে দাঁড়িয়েছিলেন। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে বারবারই বিড়বিড় করে বলছিলেন ‘খুবই, খুবই অদ্ভুত একটা ছেলে’। অদ্ভুত না ছাই! এলিভেটর আসার আগ পর্যন্ত দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। আমি মনে হয় না আমার জীবনে কখনো এলিভেটরের জন্য এতটা অপেক্ষা করেছি।
এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করার সময় আমি বুঝতে পারছিলাম না যে আমার আসলে কী বলা উচিৎ, আর স্যার দাঁড়িয়েছিলেন দরজার মুখে। তাই কোনো রকমে বললাম, ‘কিছু ভালো ভালো বই পড়া শুরু করবো আমি। সত্যিই।’ মানে আমার আসলে তখন কিছু একটা বলতেই হতো, তাই ওটা বললাম। পরিস্থিতিটা আসলে খুবই বাজে ছিল তখন।
‘তুমি তোমার ব্যাগ নিয়ে শীঘ্রই আবার ফিরে আসবে এখানে। আমি দরজা খোলাই রাখবো।’
‘অনেক ধন্যবাদ, স্যার,’ আমি বললাম। ‘গুডবাই!’ এলিভেটরটা অবশেষে এসে পৌঁছালো। এসে পৌঁছানোর সাথে সাথেই ওটাতে ঢুকে গেলাম আমি। খোদা, আমি তখন পাগলের মতো কাঁপছিলাম তখন। ঘামছিলামও প্রচণ্ড। যখনই এমন বিকৃতকামী কিছু ঘটে, তখন আমি ঘামতে শুরু করি প্রচণ্ড। ছোটোবেলা থেকে আমার সাথে এরকম ঘটনা প্রায় বিশবারের মতো ঘটেছে। আমি এটা সহ্য করতে পারি না কোনোভাবেই।